2 of 2

৭৫. রেণুর কাছ থেকে অনুমতি

আমি ভেবেছিলাম, রেণুর কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে গেলেই আমার আর বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা থাকবে না। তারপর থেকে আমি একটু একা থাকলেই স্বপ্ন দেখি। জার্মানির পথে পথে আমি একটা ভারী ওভারকোট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দারুণ শীত। মাঝে মাঝে ফুঁ দিয়ে গরম করে নিচ্ছি হাতদুটো। আমি কথা বলছি জার্মান ভাষায়। দিনেরবেলায় কাজ করি কারখানায়, রাত্তিরবেলা কলেজে ক্লাস করি। আমার বাড়ির খুব কাছেই পোস্ট অফিস। এক এক দিন মাঝ রাত্তিরে আমি হেঁটে যাই চিঠি ফেলতে–যেন চিঠিখানা তক্ষুনি পোস্ট না করলে পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

পাসপোর্টের ফর্ম আনবার পর অবশ্য দেখলাম অনেক ঝামেলা। শুধু ভাড়া জোগাড় করতে পারলেই বিদেশে যাওয়া যায় না। একজন কোনও হোমরাচোমরা সরকারি অফিসারের সই লাগবে, না হলেই পুলিশ ভেরিকিকেশান দরকার। সেটা একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। তা ছাড়া লাগবে একজন গ্যারান্টর। আমি যদি বিদেশে হঠাৎ মারা ‘যাই কিংবা নিঃস্ব হয়ে পড়ি, তা হলে আমার সৎকার কিংবা আমাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব ভারতের রাষ্ট্রপতির। তিনি সে ব্যবস্থা করবেন বটে, কিন্তু খরচটা পরে আদায় করে নেবেন আমার গ্যারান্টরের কাছ থেকে। কে হবে সেই গ্যারান্টর? আমি সে রকম কারোকেই চিনি না। তা ছাড়া, আমাকে সবকিছুই করতে হবে খুব গোপনে। বাবা-মাকে আগে কিছুই জানানো চলবে না।

সারা দিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করি, কিন্তু কারোকেই কিছু বলতে পারি না মুখ ফুটে। কিন্তু বিদেশে না গেলে আর আমার চলবেই না। একবার যখন মাথায় ঢুকেছে, তখন শুধু মনে হচ্ছে, এইটাই আমার মুক্তির পথ।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রভাস জামাইবাবুর কথা। প্রভাস জামাইবাবুরা বড়লোক, উনি অনায়াসে হতে পারেন আমার গ্যারান্টর। বড়দিকে আর জামাইবাবুকে যদি খুব করে বুঝিয়ে বলি যে বাবা-মাকে এখন কিছু না জানাতে, তা হলে শুনবে না?

কলকাতা এখন বেশ সরগরম। দেওয়ালে দেওয়ালে ইলেকশানের পোস্টার পড়েছে। বিরাট বিরাট। স্বাধীন ভারতের প্রথম জেনারেল ইলেকশান। পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদপত্র সন্দেহ প্রকাশ করছে যে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র টিকবে না। এশিয়ার গরিব দেশগুলোতে সামরিক শাসনই একমাত্র পথ। পাকিস্তানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট। ওদিকে, চিনের মূল ভূখণ্ড লাল ফৌজের অধিকারে এসে গেছে, ইয়েনানের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে মাও সে তুং এত বড় দেশটাকে একতাবদ্ধ করে সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছেন। চিনের দারুণ সম্মান বেড়ে গেছে। ভারত থেকে কয়েক জন চিন ঘুরে এসে প্রশংসা করছেন উচ্ছ্বসিত ভাবে।

তেলেঙ্গানার ব্যর্থতার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার। আমার পুরনো সহকর্মীদের অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করি। প্রায়ই স্ট্রিট কর্নার মিটিং হয়, একদিন হচ্ছিল আমাদের বাড়ির সামনেই; বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আদিনাথদা। আদিনাথদার সঙ্গে আমার অনেক দিন কথা বন্ধ। মন্টু কিংবা পরিতোষ–যারা লোকাল পার্টি অফিসে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাস্তায় কখনও তাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলেও কেউ কথা বলে না আমার সঙ্গে। মুখটা ফিরিয়ে নেয়। চাপা রাগ ও অপমানে আমার শরীর জ্বলে। একসময় কত আড্ডা দিয়েছি, কত দিন তিন কাপ চা পাঁচ জনে ভাগ করে খেয়েছি, আর এখন দেখা হলে একটা সামান্য। ভদ্রতার কথাও বলা চলে না! এখন ওদের সঙ্গে রাস্তায় বেরোলেই ঘন ঘন দেখা হয়, আরও খারাপ লাগে।

তবে, একথা ঠিক, ওরা খাটছে খুব। সবাই বলে, কমিউনিস্ট পার্টির ছেলেরা ডেডিকেটেড ওয়াকার। কংগ্রেস থেকে প্রচুর টাকা ছড়িয়ে ছেলে জোগাড় করছে।

এই রকম সময়ে আমার কোনও অংশ নেই বলেই আমার আরও অসহ্য লাগছিল। মা’র কাছে অনেক কাকুতিমিনতির পর দশটা টাকা আদায় করে চলে গেলাম খড়্গপুরে বড়দির কাছে।

বড়দির শ্বশুর মারা গেছেন। সেই বিশাল একান্নবর্তী পরিবারটি আর একান্নবর্তী নেই। ভাগাভাগির পর প্রভাস জামাইবাবু বাড়িটার একটা অংশ পেয়েছেন, আলাদা সিঁড়ি। প্রভাস জামাইবাবু তিনটি বিষয়ে এম. এ পরীক্ষা দেবার পর থেমেছেন, কোনও চাকরিবাকরি করেন না, কবিতা রচনাতেও ভাটা পড়েছে, তার বদলে স্কুলের টেক্সট বই লেখেন। জমিজমা যথেষ্ট আছে, অবস্থা বেশ সচ্ছল।

বড়দির দুটি ছেলেমেয়ে হলেও চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। প্রভাস জামাইবাবুর টাক পড়তে শুরু করেছে।

আমাকে পেয়ে বেশ খুশি হল বড়দি। বড়বাবুর মৃত্যুর পর আর দেখা হয়নি। কয়েকটা দিন বেশ হইচই করে কাটল। আমি আমার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বলিনি। দিদির বাড়িতে ভাই এমনিই বেড়াতে আসে না? বড়দি আমার আপন দিদি না হলেও নিজের দিদির চেয়েও বেশি ভাব।

সকালবেলা চায়ের টেবিলে বসেই অনেক পুরনো গল্প শুরু হয়। যে-সময়টা চলে গেছে, মনে হয় যেন সেটাই সবচেয়ে সুখের ছিল। বড়বাবুর বাড়িতে যখন বড়দিরা আর আমরা সকলে একসঙ্গে থাকতাম, মানুষজনে সারা বাড়িটা গমগম করত, সেই সব দিনের কথা উঠলে মনে হয়, ও রকম আনন্দ আর কখনও ফিরে আসবে না।

কথায় কথায় সূর্যদার প্রসঙ্গও আসে। সূর্যদা সম্পর্কে প্রভাস জামাইবাবুরই আগ্রহ বেশি মনে হয়। তিনি বার বার বলতে লাগলেন, ছেলেটি অদ্ভুত, ছেলেটি অদ্ভুত, ওই সব। ছেলে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ডকারখানা ছাড়া বাঁচতে পারে না! চোখদুটো লক্ষ করেছ, মোটেই স্বাভাবিক মানুষের মতন নয়।

বড়দি হাসতে হাসতে বলে, বাদল, তোর মনে আছে, সূর্যদাকে আমরা যখন প্রথম দেখি, কী রকম সাহেব ছিল? বাংলাই বলতে পারত না!

কথার সূত্রে অতীত ও বর্তমান বার বার স্থান পরিবর্তন করে। আমরা কখনও কখনও বয়স্ক কণ্ঠস্বরে ছেলেবেলার মতন হাসতে চেষ্টা করি।

বড়দি-জামাইবাবুরা দিন দশেক বাদে পুরী যাবেন বলে সব ঠিকঠাক করা ছিল আগে থেকেই। বড়দি আমাকে বলল, বাদল, তুইও আমাদের সঙ্গে চল। আমি কাকিমাকে চিঠি লিখে দিচ্ছি।

প্রভাস জামাইবাবুও খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, চলো চলো। খুব ভালো হবে। তুমি পুরীতে যাওনি তো আগে?

আমি পুরীতে যাইনি এবং বেড়াতে খুবই ভালোবাসি। কিন্তু আমার পক্ষে অতগুলো দিন কলকাতার বাইরে কাটানো এখন সম্ভব নয়। বললুম না, তোমরাই যাও। আমার অনেক কাজ আছে।

বড়দি হেসে বলল, তোর আবার কাজ কী রে?

প্রভাস জামাইবাবু বললেন, ও-সব কিছু শুনতে চাই না। তোমাকে যেতেই হবে। শ্রীলেখা, ওকে ধরে রাখতে পারবে না?

আমি ফস করে বলে ফেললাম, তোমরা সমুদ্রের ধারে যাচ্ছ তো, আমি সমুদ্র পেরিয়ে যাচ্ছি।

খানিকটা অবিশ্বাস, খানিকটা কৌতূহল নিয়ে বড়দি জিজ্ঞেস করল, কী? কোথায় যাচ্ছিস?

আমি লাজুক ভাবে উত্তর দিলাম, আমি জার্মানিতে যাচ্ছি। সেই ব্যাপারেই জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

বড়দি খুব খুশি হয়ে বলল, জার্মানি যাচ্ছিস? বাঃ, এ তো দারুণ খবর। আগে বলিসনি কেন?

প্রভাস জামাইবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এত জায়গা থাকতে জার্মানি কেন? ইস্ট না ওয়েস্ট?

ওয়েস্ট জার্মানিতেই যাব। তার কারণ ওখানে এখন খুব চাকরি পাওয়া যাচ্ছে। তারপর ইস্ট জার্মানিও ঘুরে আসার ইচ্ছে আছে।

বড়দি বলল, কাকা-কাকিমা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছেন? কাকিমা তো কদিন আগেই চিঠি লিখেছেন, কিছু জানাননি তো!

মা এখনও জানে না। বড়দি, প্লিজ, মাকে কিছু বোলো না এখন।

তারপর আমার পরিকল্পনা সব খুলে বললাম। প্রভাস জামাইবাবু খুব আগ্রহী হয়ে পড়লেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন সব রকম সাহায্য করার। প্রভাস জামাইবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। উনি মানুষটি খুবই কৌতূহলী ধরনের, সব বিষয়েই জানতে চান। ওঁর নিজের জীবনযাত্রার ব্যাপারে কোনও সমস্যা নেই–তবু দুঃখ-দারিদ্র অর্থাৎ যাকে বলে ‘জীবন সংগ্রাম’–এসবের প্রতি একটা রোমান্টিক আকর্ষণ আছে। আমাকে বার বার বলতে লাগলেন, তুমি যে নিজে নিজে চলে যাওয়া ঠিক করেছ, এটা খুব ভালো করেছ। যা হয় তোক। দরকার হয় রেল স্টেশনে শুয়ে থাকবে, একটা রুটি খেয়ে সারা দিন কাটিয়ে দেবে, তবু জীবনকে দেখতে হবে–

প্রভাস জামাইবাবু আগে একবার দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে একটা ওভারকোট কিনে ছিলেন। পুরনো তোরঙ্গ খুলে সেটা বার করে আমায় বললেন, দেখো তো বাদল, এটা তোমায় ফিট করে কিনা! তোমার তো একটা ওভারকোট লাগবেই!

ওভারকোটটার দু’-এক জায়গায় পোকায় কেটেছে, তবু সেটা গায়ে দিয়ে আমার এত ভালো লাগল যে আমি আবার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। ঝুরঝুর করে বরফ পড়ছে, আমি হেঁটে যাচ্ছি জার্মানির একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে আমাকে একটা পোস্ট অফিস খুঁজে বার করতে হবে। এক্ষুনি একটা চিঠি পোস্ট করা দরকার, রেণুকে কথা দিয়েছি, প্রত্যেক সপ্তাহে একবার–

বড়দির স্নেহপ্রবণ মন। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর নানা রকম শঙ্কা দেখা দিল। ঘুরেফিরে আমাকে এসে বলতে লাগল, কাকিমা যদি মনে দুঃখ পান? কাকারও বয়েস হয়েছে, বাড়িতে আর কেউ থাকবে না তুই চলে গেলে।

আমি কোনও উত্তর দিই না। বড়দি আমার পিঠে হাত রেখে বলে, বাদল, মায়ের অনুমতি না নিয়ে কোনও কাজ করতে নেই। তুই কাকিমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বল–

আমি তখন বড়দিকে সান্ত্বনা দিই, তুমি অত ভাবছ কেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিদেশে যাবার জন্য আমার তখন প্রাণ নাচছে। বার বার মনে হয়, আমি যাবই, যাবই, যাবই, যাবই!

তিনতলার জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক সময় মনে হয়, আলোকোজ্জ্বল ইয়োরোপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

বড়দি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ফিরে দেখে বললাম, বড়দি, তুমি শুতে যাওনি?

বড়দি হেসে বলল, তোকে দেখছিলাম। সূর্যদাও ঠিক ওই রকম ভাবে জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত।

আমি বললাম, সূর্যদা কি এই ঘরে থাকত নাকি?

হ্যাঁ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, না রে? অথচ মনে হয় সেদিনের কথা। কত কী বদলে গেল!

বড়দি, মানুষ তো বদলাবেই।

বড়দি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, আমি বোধহয় বদলাইনি। আমার এখনও পুরনো সবকিছুর জন্য মন কেমন করে।

বড়দি, তুমি এখনও সূর্যদাকে ভুলতে পারোনি। সূর্যদা কিন্তু তোমাকে বেমালুম ভুলে গেছে।

তা তো ভুলবেই। ওর তো কোনও দোষ নেই। আমি তো ওকে কিছু দিইনি।

সূর্যদা যদি এখন আবার ফিরে আসে, তোমার কাছে কিছু চায়, তুমি দিতে পারবে?

না। এ-কথা জানি, ও আর ফিরে আসবে না। ওর স্বভাব সে রকম নয়।

তা হলে আর মন খারাপ করে লাভ কী?

সে তুই বুঝবি না।

আমি এখন আর সেই ছেলেমানুষটি নেই। এখন সব বুঝি।

ছাই বুঝিস! কারোকে ভালো না বাসলে এসব কিছুই বোঝা যায় না। আর ভালোবাসা কখন বোঝা যায় জানিস? বিচ্ছেদের সময়। যখন দেখা হয় না, তখনই বোঝা যায় ভালোবাসা কতটা গভীর।

কথাটা শুনে আমার মনখারাপ হয়ে গেল একটু। ভালোবাসা মানে কি তা হলে দুঃখ পাওয়া? সূর্যদার জন্য বড়দি তো শুধু দুঃখই পেয়েছে, তবু এত ভালোবাসা থাকে কী করে? প্রভাস জামাইবাবুর কথা ভেবেও আমার একটু কষ্ট হতে লাগল। উনি সুখে আছেন। উনি ভালোবাসা পাননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *