যদুপতি গাঙ্গুলীর মনে একেবারেই সুস্থিরতা নেই। অন্নচিন্তা এমনই চমৎকার যে ঈশ্বরচিন্তায় পর্যন্ত মন বসে না। গ্রাম থেকে তার তিনটি বেকার ভাগিনেয় এসে তার ঘাড়ের ওপর আছে। ভাগিনেয় তিনটির কোনো কাজকর্মের সুরাহা করা যায় নি এখনো, দুবেলা গ্রাসাচ্ছাদন জোটানোই দায়। উপরন্তু গ্রাম থেকে বিধবা দিদি বারংবার চিঠি লিখে শাসাচ্ছেন যে তিনিও কলকাতায় এসে ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকতে চান। গ্রামে গ্রামে এখন হাহাকার। উড়িষ্যায় নিদারুণ দুৰ্ভিক্ষ হয়ে গেছে, বাংলার গ্রামেও খাদ্য নেই। যা কিছু লভ্য খাদ্যবস্তু ব্যবসায়ীদের কেরামতিতে কলকাতা এবং অন্য বড় শহরগুলিতে এসে জমছে, যেখানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আছে। উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ পরিণতি সুবে বাংলার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শহরে শুধু খাদ্যবস্তুই পাচার হয়ে আসছে না, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসছে। দলে দলে ক্ষুধার্তা মানুষ। সর্বত্র জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। সবচেয়ে বেশী বিপন্ন হয়ে পড়েছে, সেই সব নিম্নবিত্ত মানুষের দল, যারা সমাজে ভদ্রলোক নামে পরিচিত। তারা পোশাক-পাদুকা পরিধান না করে পথে বেরুতে পারে না, সম্পূর্ণ অভুক্ত থাকলেও লোকের কাছে হাত পেতে ভিক্ষে চাইতে পারে না। তাদের এখন পেটে কিল মেরে পড়ে থাকার মতন অবস্থা। আবার এই ভদ্র সমাজেরই উঁচু তলার বিত্তবান মানুষেরা এ সম্পর্কে একেবারে উদাসীন, তাদের মধ্যে নাচ-গান-ফুর্তি, ধর্মসভা, বক্তৃতাসভা, দোল-দুর্গোৎসব, বিবাহ, শ্রাদ্ধের মাচ্ছবি দিব্য চলছে।
ভাগ্নে তিনটির জন্য কোনো কর্মসংস্থান করতে না পারলেও যদুপতি নিজে সকালে-বিকেলে দু জায়গায় দুটি ছাত্র পড়বার কাজ জুটিয়েছে আবার। তাতে কোনোরকমে অনাহার থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে। এইসব ছেড়ে ছুঁড়ে সে পুরোপুরি ধর্মসাধনায় মনোনিবেশ করবে ঠিক করেছিল, তা আর হলো কই! দ্বিতীয় বিবাহ না করলেও সংসার তাকে ছাড়লো না। সময়ের অভাব তো আছেই, তা ছাড়াও নানারকম দুশ্চিন্তায় সে ব্ৰহ্ম-উপাসনার সময় ঠিক মতন মনঃসংযোগ করতে পারে না। তাতে সে আরও অনুশোচনীয় ভোগে। আর সবকিছু ছাড়া যায়, কিন্তু ঈশ্বরকে ছাড়া মোটেই সহজ নয়! যদুপতি মাঝে মাঝেই শোকশ্র বিসর্জন করতে করতে ভাবে, হায় আমার এ কী হলো! কটি অপোগণ্ড ভাগেনর জন্য আমি সাধারণ মানুষ হয়ে গেলুম! অথচ, সমাজে বাস করে এদের পরিত্যাগ করাই বা যায় কী ভাবে!
একদিন এক বন্ধুর বাড়িতে সাপ্তাহিক উপাসনার শেষে প্রিয়নাথ নামে এক সতীৰ্থ ব্ৰাহ্ম তাকে নিম্ন গলায় প্রশ্ন করলো, ভ্ৰাতঃ তুমি বঙ্কিম চাটুজ্যের নবেলখনি পড়েছে। নাকি?
যদুপতির মন অপ্ৰসন্ন হয়েই ছিল কারণ আজও উপাসনার মধ্যপথে দুবার অর্থচিন্তা করেছে। সেইজন্য ঈষৎ বিরক্তভাবে সে বললো, কে বঙ্কিম চাটুজ্যে? তার নবেল আমি পড়তেই বা যাবো কেন?
প্রিয়নাথ বললো, বড় সরেস লিখেছেন। বইখানি। তুমি তো এক সময় কবিতা আদি রচনা করতে, সেই জন্যই ভাবল্লুম ও বই নিশ্চয়ই তুমি আগে ভাগেই পড়ে ফেলেছে। তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা করা যাবে।
যদুপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বললো, আর কবিতা! সে সব কবেই চুকে গিয়েছে।
কাব্যলক্ষ্মী স্বয়ং অন্তৰ্হিতা হয়েছেন না যদুপতি জোর করে তাঁকে নিজের মন থেকে বিদায় দিয়েছে, তা বলা যায় না। কুসুমকুমারীর বিবাহের আগে সে শেষ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিল। তারপর সে বিবাহ ঘটে যাবার পর যদুপতি নিজের যাবতীয় কাব্যকীর্তির পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
পাশে আর একজন যুবক বসেছিল। এই যুবকটিকে যদুপতি আগে কয়েকবার দেখেছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে, কেশব সেনের বাড়িতে এবং অন্যান্য আলোচনাসভায়। কিন্তু সে যে দীক্ষিত ব্ৰাহ্ম নয়, তা যদুপতি জানে। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের মতন পোশাক-আশাক। সেই যুবকটি ব্যগ্রভাবে বললেন, সে কি মশায়, আপনি এখনো বঙ্কিমবাবুর লেখা পড়েন নি? আপনার কবিতা তো আমরা পড়েছি, আমার সহাধ্যায়ীরা বলাবলি করে যে যদুপতি গাঙ্গুলীর কবিতা অতি উচ্চ ভাবের।
যদুপতি বললো, আমা সদৃশ সামান্য ব্যক্তির কবিতাও আপনি পড়েছেন? এ যে বড় বিস্ময়ের কথা! আমাকে আপনি চেনেন, কিন্তু আপনার পরিচয়টা তো জানা হলো না।
প্রিয়নাথ বললো, তুমি একে চেনো না! ইনি তো সোমপ্রকাশের সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ভাগনে। এর নাম শিবনাথ
যদুপতি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ভাগ্নে আর তার নিজের ভাগ্নে—কত তফাত।
—এই শিবনাথও কবিতা লেখেন! সোমপ্রকাশে দ্যাকো নি? শিবনাথ আরও একটি কাণ্ড করেছিলেন…এক হিসেবে আমাদের শিবনাথ বিশ্বে অদ্বিতীয়, ইনি নিজের বউয়ের বিয়ে দেবার উদযোগ করেছিলেন—।
শিবনাথ বললো, আঃ প্ৰিয়বাবু, আপনি থামুন তো!
প্রিয়নাথ বললো, হ্যাঁ হে, যদুপতি, আমি ঠিকই বলছি। অল্প বয়েসে শিবনাথের পিতা ওঁর দুবার বিবাহ দিয়েছিলেন…কিছুদিন আগে শিবনাথ উঠে পড়ে লেগেছিলেন, দ্বিতীয় পত্নীটির পুনর্বিবাহ দেবেন। ইনি বিদ্যাসাগরের এককাঠি বাড়া—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
শিবনাথ বললো, ওসব কথা ছাড়ুন তো। হচ্ছিল বঙ্কিম চাটুজ্যের কথা—প্রিয়বাবু, আপনি বঙ্কিমবাবুর কোন উপন্যাসটির কথা বলছেন?
—কপালকুণ্ডলা! আমি তো একটির কথাই জানি। আরও লিখেছেন নাকি?
—কেন, আপনি দুৰ্গেশনন্দিনী পড়েন নি! সে তো দুতিন বছর আগেই বেরিয়ে গেছে। অহো, সে কি অপূর্ব ব্যাপার! আমি বলে দিচ্ছি শুনে রাখুন, আমাদের দত্ত কবির একজন সমকক্ষ লেখক এসে গেছেন।
-মাইকেল দত্ত তো বিলেত থেকে পাক্কা সাহেব হয়ে এসেছেন। আর কি তিনি বাংলা লিকবেন? এক দু বছরে কিছুই তো লিখছেন না দেখি—খালি মদ ওড়াচ্ছেন।
—এখন তিনি ব্যারিস্টার, কত ব্যস্ত, সাহেব মহলে দহরম মহরম…তবে একটু থিতু হয়ে বসলে আবার লিখবেন নিশ্চয়।
যদুপতি বিস্মিত হয়ে শুনছিল। অনেক দিন সে এইসব ঘটনা থেকে বিযুক্ত, ঠিক খবর রাখে না। মেঘনাদবধ কাব্য প্রণেতা মাইকেল মধুসূদন বিলাতফেরত হয়ে বাংলা লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। এই মাইকেলকে তারা নবীনকুমার সিংহের বাড়িতে সংবর্ধনা দিয়েছিল, মনে আছে সেই দিনটির কথা—।
শিবনাথ বললো, সংবাদ প্রভাকরে দুৰ্গেশনন্দিনী প্রকাশের পর একটা সংবর্ধনা পত্র বেরিয়েছিল, আপনারা সেটাও দেখেন নি?
যদুপতি বললো, কিন্তু তত্ত্ববোধিনী কিংবা মিরর-এ তো আমি এই বঙ্কিমবাবু বিষয়ে কিছু লেখা দেখিনি!
শিবনাথ বললো, রহস্য সন্দৰ্ভ, সোমপ্রকাশ, হিন্দু পেট্রিয়টে অনেক কথা লেখা হয়েছে। আমার মাতুল অবশ্য বঙ্কিমবাবুর লেখা তেমন পছন্দ করেন নি।
যদুপতি বললো, কে এই বঙ্কিমবাবু? কোনো অজ্ঞাতকুলশীল হঠাৎ উৎকৃষ্ট বই লিখে ফেললো? এর নিবাস কোথায়? কোথাকার চাটুজ্যে? পিতা কী করেন।
—বাঃ, মনে নেই এই বঙ্কিম চাটুজ্যের কথা? যোবার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পরীক্ষা নেওয়া হলো, তাতে দুজন মাত্র ছাত্র পাস করেছিল, বঙ্কিমবাবু ফাস্ট হলেন, পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ডেপুটির চাকরি—।
শিবনাথ বললো, ইনি একসময় সংবাদ প্রভাকরে কবিতাও লিখেছেন অনেক।
এবার ওঁদের কথায় বাধা দিয়ে যদুপতি বললো, দাঁড়াও, দাঁড়াও, ইনি কি সেই বঙ্কিম চাটুজ্যে যিনি ললিতা তথা মানস নামে একখানি চটি কবিতা-পুস্তক ছাপিয়েছিলেন? সে বই আমি কিনেছিলুম এক কাপি, কিন্তু সে তো অনেককাল আগেকার কথা।
প্রিয়নাথ বললো, তুমি কিনেছিলে? তবে তো তুমি ভাগ্যবান ব্যক্তি। কৃষ্ণকমলের মুখে গল্প শুনলুম, ঐ কবিতা পুস্তক মাত্র ছ। কপি বিক্রি হয়েছিল—তাই বঙ্কিমবাবু রাগ করে আট দশ বছর বাংলা লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
শিবনাথ বললো, বঙ্কিমবাবু সম্পর্কে আমি আরও অনেক গল্প শুনেছি। ইনি নাকি চাকরিতে যাবার সময় খানিকটা গঙ্গাজল নিজের জননীর পায়ে ঠেকিয়ে একটা শিশিতে ভরে সঙ্গে নিয়ে যান। ওঁরা ভাটপাড়া-নৈহাটীর বামুন, খুব গোঁড়া হিন্দু মনে হয়। তবে যাই বলুন, রচনাশক্তি অসামান্য।
প্রিয়নাথ বললো, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ক্রিশ্চিয়ান আর এমন অপূর্ব বাংলা নবেলের লেখক গোঁড়া হিন্দু। আমাদের ব্ৰাহ্ম ভ্রাতাদের মধ্যে কেউ তেমন প্রতিভা দেখাতে পারেন না!
যদুপতি বললো, কেন, দেবেন্দ্ৰবাবুর বড় ছেলে দ্বিজুবাবু বেশ লেখেন, সত্যেন্দ্রবাবুও ভালো গান রচনা করেছেন।
—রাখো তোমাদের দেবেন্দ্ৰবাবুর ছেলেদের কথা। ওসব শখের লেখায় কিছু হবে না-মন-প্ৰাণ ঢেলে দেওয়া যে রচনা, তা লিখেছেন এই বঙ্কিমবাবুই, অহো, কপালকুণ্ডলা গদ্য তো নয়, যেন কাব্য! তবে বঙ্কিমবাবুর একটাই দোষ, রচনাটিতে কোনো উচ্চ ভাব নেই, বড় বেশী প্রণয়-দেশের মানুষের জন্য কোনো নীতি প্রচার করেন নি।
শিবনাথ বললো, দোষ কি মশাই, সেটাই তো গুণ। সেক্সপীয়ার-কালিদাস কোন নীতি প্রচার করেছেন?
যদুপতি ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বললেন, এই বঙ্কিমবাবুটি যদি গোঁড়া হিন্দুই হবেন, তবে নিজের জননীকে দিয়ে এমন পাপটা করালেন? গঙ্গাজলে পা ছোঁয়ালেন? এ কেমনতর হিন্দু! ওঁদের কাছে গঙ্গাজলের স্থান তো মাথায়।
শিবনাথ বললো, ওসব যাই বলুন, বইখানি পড়লে একেবারে মোহিত হয়ে যাবেন।
যদুপতি বললো, নিছক প্ৰণয়ের গল্প পড়বার আমার সাধ নেই। আমি এখন মরছি অন্য জ্বালায়।
প্রিয়নাথ বললো, না হে, যদু, তুমি তবু একবার বইখানি পড়ে। চাও তো আমিই দিতে পারি। কপালকুণ্ডলা আমার বাসাতেই আছে।
শিবনাথ বললে, দুৰ্গেশনন্দিনীও আমি সংগ্রহ করে দিতে পারি।
যদুপতি ফস করে বলে ফেললো, পড়তে পারি বইখানি, যদি সেই সঙ্গে পাঁচটি টাকা ঋণ দাও। ঘরে এককণা চাল নেই, শূন্য উদরে কি কাব্য-সাহিত্য পাঠ করা যায়?
প্রিয়নাথ হাসতে হাসতে বললো, বা রে, বা, আমি কি বঙ্কিমবাবুর ফড়ে যে জোর করে তাঁর বই লোকজনকে পড়াবো? সেজন্য আমায় অর্থ ব্যয় করতে হবে?
সে রাতে প্রিয়নাথের কাছ থেকে তিনটি টাকা এবং এক কপি কপালকুণ্ডলা নিয়ে যদুপতি বাসায় ফিরলো। বাড়িতে মহাহাঙ্গামা, মধ্যম ভাগ্নে লাড়ুলীমোহন পল্লীর কয়েকটি দুৰ্বত্ত যুবকের সঙ্গে কোন্দল করে মাথা ফাটিয়ে এসেছে, এখন সে একটি দরজার খিল খুলে নিয়ে তা দিয়ে ফের সে মারামারি করতে যেতে চায়। অপর দুই ভাই তাকে জাপটে ধরে আছে।
সত্যিকারের ব্ৰাহ্মসুলভ সংযম ও স্থৈৰ্যের পরিচয় আর দিতে পারলো না যদুপতি, পা থেকে চটিজুতো খুলে লাডলীমোহনকে পেটালো কয়েকবার। বইখানা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। অতিরিক্ত ক্রোধের ফলে যদুপতির নিজের বুকের মধ্যেই ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল, অসুস্থ বোধ করে সে শুয়ে পড়লো শয্যায়। তখন তিন ভাগ্নে তার চৌকির পাশে বসে শুরু করে দিল মড়াকান্না। তাতে আর এক বিপদ। প্রতিবেশীরা না ছুটে আসে।
খানিকবাদে কিছুটা সুস্থ হয়ে যদুপতি উঠে বসে বললো, হতভাগারা, খেতে পাস না, তবু তোদের এত তেজ কিসে? কাল থেকে সকাল-সন্ধ্যা অন্তত আধঘণ্টা ধরে যদি প্রার্থনায় না বসিস, তবে তোদের খাওয়া বন্ধ।
ছোট ভাগ্নে ভুবনমোহন বলে উঠলো, মামা, আজ রাতে কী খাবো?
যদুপতি পকেট থেকে একটি টাকা বার করে বড়টিকে বললেন, যা, বাজার থেকে চাল আর ডাল নিয়ে আয়। যদি পাস তো খানিকটা মাছও আনিস। আর সেরখানেক আলু। আজ পেট পুরে খিচুড়ি খাবো। যা, ছুটে যা!
সব সরঞ্জাম যোগাড়ের পর খিচুড়ি রান্না শেষ করতে বেশ রাত্রি হয়ে গেল। তবে ভোজনটা হলো বেশ তৃপ্তিপূর্ণ। বড় ভাগ্নেটা কোনো বাড়িতে রসুইবামুনের কাজ নিলে পারতো, ওর রান্নার হাত ভালো। খিচডি-আলুসেদ্ধ আর খলসে মাছ ভাজা। রান্না হয়েছিল এক হাঁড়ি। চারজনেও শেষ করতে পারলো না। লাডলীমোহন বললো, কাল আবার খাবো। বাসি। খিচুড়ির সোয়াদ বেশী ভালো হয়।
একটি পান মুখে দিয়ে শুতে যাবার আগে যদুপতির মনে পড়লো বইটির কথা। সেখানা কোথায় গেল? ঐ বইয়ের লেখকের সুবাদেই তো আজ রাত্তিরে এমন খাওয়া-দাওয়া হলো। এখন বইটি অন্তত উল্টেপাল্টে দেখা দরকার।
তখন মনে পড়লো, ভাগ্নেকে প্ৰহার করবার সময় উঠোনে বইটি খসে পড়েছিল হাত থেকে। আর তোলা হয়নি। ভাগ্নেরাও উঠিয়ে রাখেনি। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে উঠোনের এককোণে বইটি পেয়ে গেল যদুপতি। সে নিজে যখন কাব্য রচনা করতো, তখন কোনো গ্রন্থের প্রতি এতখানি অবজ্ঞা প্রকাশ করা যদুপতির স্বপ্নাতিত ছিল। দিন-কাল কেমনভাবে বদলে গেছে!
শিয়রের কাছে সেজবাতি জ্বেলে যদুপতি শুয়ে শুয়ে খুললো বইটির প্রথম পৃষ্ঠা। প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম সাগর সঙ্গমে। তার নিচে শেক্সপীয়ারের কমেডি অব এররস থেকে একটি কোটেশন। তারপর শুরু : প্ৰায় দুইশত পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে একদিন মাঘ মাসের রাত্রি শেষে একখানি যাত্রীর নৌকা গঙ্গাসাগর হইতে প্ৰত্যাগমন করিতেছিল। পর্তুগীজ ও অন্যান্য নাবিক দাসুদিগের ভয়ে যাত্রীর নৌকা দলবদ্ধ হইয়া যাতায়াত করাই তৎকালে প্ৰথা ছিল–।
পাঠ করতে করতে যদুপতির ভ্রূকুঞ্চিত হলো। যাতায়াত? এই লেখকটি বি এ পাশ যখন, তখন শিক্ষিতই বলা যায়, তবে যাতায়াত লেখে কেন? গমনাগমন শব্দটি জানে না? যাতায়াত মুখে বলি বটে। কিন্তু ভাষার শুদ্ধতার জন্য গমনাগমনই লেখা সঙ্গত ছিল নয় কি?
যাই হোক, প্রিয়নাথ এবং দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ভাগ্নে যখন অতি উচ্চ প্রশংসা করলে, তখন আর একটুখানি পড়ে দেখা যাক।
…যুবা উত্তর করিলেন, আমি তো আগেই বলিয়াছি যে সমুদ্র দেখিবার বড় সাধ ছিল, সেই জন্যই আসিয়াছি। পরে অপেক্ষাকৃত নিম্ন স্বরে কহিতে লাগিলেন, আহা! কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না…
পরদিন সকালবেলাতেই যদুপতি প্রিয়নাথের গৃহে উপস্থিত। চক্ষু দুটি রক্তবর্ণ, মাথার চুল অবিন্যস্ত, শয়নের ধুতিটিও পরিবর্তন করেনি। প্রিয়নাথকে দেখামাত্র আলিঙ্গন করে সে তীব্র আবেগের সঙ্গে বললো, ভ্রাতঃ, তুমি আমার এ কী করলে! কাল সারা রাত্র এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। কপালকুণ্ডলা আমি তিনবার পড়েছি, এখনও মনে হচ্ছে। আবার পড়ি। আবার পড়ি। বাংলাভাষাতে এমন রচনা সম্ভব? ইচ্ছে হচ্ছে, বইখানি মাথায় নিয়ে নৃত্য করি!
প্রিয়নাথ বললো, আরে রও, রও, একেবারে যে পাগল হলে দেখছি। বলেছিলুম কিনা, বইটি ধরলে আর ছাড়তে পারবে না!
—কোথায় থাকেন এই বঙ্কিমবাবু? আমায় এক্ষুনি দেখিয়ে দাও, আমি তাঁর পায়ের ধুলো নেবো!
তুমি ব্ৰাহ্ম হয়ে হিন্দুর পায়ের ধুলো নেবে? না হয় একখানা ভালো বই লিখেছেন…
–একখানা ভালো বই? এ লেখক বিশ্বজয় করতে এসেছেন। তুমি কপালকুণ্ডলার মতন গদ্যবাক্য ইংরেজী ভাষাতে কয়খানা আছে বলো দেখি। আমাদের বাংলাভাষার যে এমন ক্ষমতা কে জানতো? কোথায় থাকেন। বঙ্কিমবাবু, আমি এখুনি তাঁর কাছে যাবো!
—কোথায় থাকেন তা তো জানি না। তবে কৃষ্ণকমলের কাছে শুনেছি, বঙ্কিমবাবু এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছেন।
—তার মানে? দশ বছর আগে তিনি বি এ পাস করে গেছেন। ডেপুটিগিরি করেন মফস্বলে, তিনি আবার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হন কীভাবে?
—অত উত্তেজিত হয়ে না, চুপ করে একটু বসে। ছাত্র হতে পারবেন না কেন? বি এ পাশ করবার সময় তিনি আইন পড়া শেষ করতে পারেন নি। ঝটিতি চাকরি পেয়ে গেছেন তো-তাই এখন আইন পড়াটা সম্পূর্ণ করে পরীক্ষা দিতে চান। সেই জন্য ক্লাস করছেন-তুমি তো কৃষ্ণকমল ভটচাজকে চেনে।
—খুব ভালোই চিনি। সে সন্ধান দিতে পারবে?
—হাঁ। কৃষ্ণকমলও এখন আইনের ক্লাস করছে। উকিল হতে চায়। তার মুখেই আমি বঙ্কিমবাবুর নাম প্রথম শুনি। কৃষ্ণকমল এখন বঙ্কিমবাবুর সহপাঠী।
যদুপতি তখনই ছুটে গেল। কৃষ্ণকমলের কাছে। কিন্তু সেখানে বিশেষ সুবিধে হলো না। কৃষ্ণকমল জানালো যে বঙ্কিম চাটুজ্যে অতি সুলেখক হলেও মানুষটি অতি গভীর ও রাশভারি। অচেনা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাই বলতে চান না। কেউ উপযাচক হয়ে সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি রীতিমতন বিরক্ত হন। সুতরাং যদুপতির পক্ষে এখনি বঙ্কিম চাটুজ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না যাওয়াই ভালো। তাতে বরং প্ৰিয় লেখক সম্পর্কে আশাভঙ্গ ও স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে।
যদুপতি তাতেও সম্পূর্ণ নিরস্ত হলো না। আলাপ না করলেও সাক্ষাৎসে একবার করবেই। অন্তত দূর থেকেও। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো তীর্থের কাকের মতন। এক সময় তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ক্লাস শেষ হতে ছাত্ররা বেরিয়ে এলো বাইরে। কৃষ্ণকমলের কাছ থেকে বঙ্কিমবাবুর চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে শুনে এসেছিল, সেই জন্য যদুপতির চিনতে দেরি হলো না। এ কেমন অদ্ভুত ছাত্র! চোগা-চাপকান পরিহিত শামলা আঁটা প্রকৃত ডেপুটির মতনই চেহারা, গভীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন, এক আদলি তাঁর মাথার ওপর ছাতা ধরে চলেছে পেছনে পেছনে। যদুপতির চেয়ে বেশ ছোটই হবেন। বরং কৃষ্ণকমল-নবীনকুমারের সমবয়েসী বলে মনে হয়।
বঙ্কিম চাটুজ্যের ভাবভঙ্গি দেখে যদুপতি এগিয়ে গিয়ে কথা বলার সাহস পেল না। যতক্ষণ দেখা যায় একদৃষ্টি চেয়ে রইলো। উনি চোখের আড়াল হতেই যদুপতি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো নিজের বাড়ির দিকে। তৎক্ষণাৎ আবার খুলে বসলো কপালকুণ্ডলা।
…পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? এ ধ্বনি নবকুমারের কৰ্ণে প্রবেশ করিল। কি অর্থ, কি উত্তর করিতে হইবে। কিছুই মনে হইল না। ধ্বনি যেন হৰ্ষকম্পিত হইয়া বেড়াইতে লাগিল, যেন পবনে সেই ধ্বনি বহিল, বৃক্ষপত্র মর্মরিত হইতে লাগিল…।
পাঠ করতে করতে সত্যি সত্যিই বইখানা নিয়ে নৃত্য শুরু করে দিল যদুপতি।