গঙ্গানারায়ণের প্রথমেই মনে হলো ছোট্কুকে খবর দিতে হবে!
নবীনকুমার ঠিক কোন পথে এবং কতদিন সময় নিয়ে হরিদ্ধার পৌঁছোবে, সে কথা সবিস্তারে জানিয়ে যায় নি। তবে মোটামুটি এই প্রকার ঠিক আছে যে, প্রথমে সে নৌকাযোগেই কলকাতা থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত যাবে, তারপর সেখান থেকে স্থলপথে অন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করবে। এর মধ্যে সে কত দূরের পথ পার হয়েছে তার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই।
এখন রেলপথে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়া যায, কিন্তু ভদ্র-সন্ত্রান্ত পরিবারের কেউ সহসা রেলওয়ে ক্যারেজে উঠতে চান না। শৌখিন, আরামদায়ক প্ৰথম শ্রেণীর কামরা দখল করে থাকে সাহেবরা, আর অন্যান্য কামরাগুলিতে কুমড়ো গাদাগাদি অবস্থা। তা ছাড়া নবীনকুমার ধীরে সুস্থে দেশ পরিভ্রমণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত জননীর কাছে পৌঁছোবে, এই রকম বাসনা প্ৰকাশ করে গিয়েছিল।
দিবাকর এখন বাতে প্ৰায় পঙ্গু, নকুড় আর দুর্যোধন নামে দুজন এখন গোমস্তার কাজ চালায়। এদের মধ্যে দুর্যোধন খুব করিৎকম। একবার গঙ্গানারায়ণ ভেবেছিল, সে নিজেই যাবে। প্রবাসে অকস্মাৎ মাতৃবিয়োগের সংবাদ পেয়ে যদি ছোট্কু একেবারে ভেঙে পড়ে! তারই উচিত স্বয়ং গিয়ে ছোট্কুকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সব কিছু অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে তার পক্ষে হঠাৎ চলে যাওয়া সম্ভব নয়, ব্যবস্থা করতে দুচারদিন সময় লাগবে। অথচ নবীনকুমারকে সংবাদ পাঠাতেও দেরি করা আর কোনোক্রমেই উচিত নয়।
সন্ন্যাসীটিকে কোনোক্রমেই আতিথ্য গ্রহণে সম্মত করাতে না পেরে গঙ্গানারায়ণ চলে এলো অন্দর মহলে। কুসুমকুমারী কুরুস কাঠি দিয়ে টেবিল-ঢাকার জন্য নকশা বুনছিল, স্বামীর পদশব্দ শুনে মুখ তুলে চাইল। গঙ্গানারায়ণের মুখ দর্শন করেই কুসুমকুমারী অমঙ্গল অনুভব করল, হাতের জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে দ্রুত পদে কাছে এগিয়ে আসতেই গঙ্গানারায়ণ কম্পিত কণ্ঠে বললো, কুসুম, মা আর নেই!
শুধু শোক নয়, তার চেয়েও বেশী অনুতাপানলেই যেন দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে গঙ্গানারায়ণের হৃদয়। বহুকাল সে বিম্ববতীকে দেখেনি। ভাব-বৈকল্যে দেশান্তরী হবার পর থেকেই তো আর সে দেখেনি জননীর মুখ। কলকাতায় পুনরায় ফিরে বিবাহ-টিবাহ করে থিতু হয়ে বসবার পর সে কতবার ভেবেছে না হরিদ্ধারে গিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আসবে? যাওয়া যে হয়নি, সে জন্য তার কর্মব্যস্ততাই শুধু দায়ী নয়, তার মনে কি একটা অপরাধবোধও সুপ্ত ছিল না? সে জানে, সে যে বিধবা বিবাহ করেছে তা বিম্ববতী কখনোই সবন্তিঃকরণে সমর্থন করতে পারবেন না। তার বিবাহ হয়েছিল অনেকটা হুড়োহুড়ি করে, জননীর সম্মতি চাওয়ার সময় ছিল না, সে প্রশ্নও ওঠেনি। পরে অবশ্য গঙ্গানারায়ণ দীর্ঘ পত্র লিখেছিল। বিম্ববতীর অক্ষরজ্ঞান নেই, অপরের দ্বারা লিখিত একাধিক পত্র তিনি এর মধ্যে যদিও পাঠিয়েছেন, কিন্তু সেই সব পত্রও তাঁর ব-কলমে নয়। অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষভাবে কারুকে সম্বোধন করেন নি, তাঁর হয়ে অন্য কেউ কুশল সংবাদ জানিয়েছে। কোনো পত্রেই গঙ্গানারায়ণের বিবাহের কোনো উল্লেখ ছিল না। এই কয়েক বৎসরের মধ্যে এ বাড়ি থেকে একাধিকবার লোক প্রেরণ করা হয়েছে বিম্ববতীকে দেখে আসবার জন্য, একবারও কারুর হাত দিয়ে বিম্ববতী সামান্যতম কোনো উপহারও প্রেরণ করেন নি তাঁর পুত্রবধূদের জন্য। এ জন্য গঙ্গানারায়ণের মনের মধ্যে একটি কাঁটা বিধে ছিল।
কুসুমকুমারী অবশ্য এই অপরাধবোধ কিংবা গ্লানি থেকে মুক্ত। সে যে এক সময় বিধবা ছিল এই স্মৃতিই যেন মুছে গেছে তার মানসপট থেকে। যেন গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে মিলনই তার পক্ষে বিধির নির্বন্ধ ছিল। বধূ হিসেবে না হলেও এ বাড়িতে কুসুমকুমারী আগে যে কয়েকবার এসেছে তখন বিম্ববতীকে দেখেছে এবং তাঁর কাছ থেকে অনেক সাদর সম্ভাষণ পেয়েছে। বিম্ববতী তার চোখে স্বর্গের দেবীর তুল্যা। সুতরাং, এই দুঃসংবাদ শোনা মাত্র কুসুমকুমারীর দুই চক্ষে অশ্রু উদগত হল।
স্বামী-স্ত্রী দুজনে বসে কাঁদলো কিছুক্ষণ।
গঙ্গানারায়ণই সামলে নিল প্ৰথমে। পরিবারের কর্তার পক্ষে এমন ভেঙে পড়লে চলে না। এখন অনেক কাজ বাকি।
বিধুশেখরকে এই সংবাদ জানাতে হবে। সে ব্যাপারেও গঙ্গানারায়ণের ভয়। সে নিজের মুখে কী করে এই নিদারুণ দুঃসংবাদ দেবে সেই বৃদ্ধকে! আবার কোনো কর্মচারী মারফতও এমন খবর পাঠানো শোভা পায় না!
সেই রাত্রেই গঙ্গানারায়ণ গেল ও বাড়িতে। যদি বিধুশেখর এর মধ্যে নিদ্রা গিয়ে থাকেন, তা হলে এক পক্ষে গঙ্গানারায়ণের পক্ষে ভালোই। কিন্তু বিধুশেখর জেগেই আছেন। প্রথমেই বিধুশেখরের সঙ্গে দেখা না করে গঙ্গানারায়ণ খোঁজ করলো সুহাসিনীর।
সুহাসিনীর পুত্র প্ৰাণগোপাল এখন সদ্য কৈশোরে পদার্পণ করেছে, সুন্দর মুখশ্ৰী, উজ্জ্বল দুটি চক্ষু, তীক্ষ্ণ নাসিকা। ঐ বয়েসের নবীনকুমারের সঙ্গে তার মুখের কিছুটা সাদৃশ্য আছে এমন হঠাৎ মনে হয়। তবে ছেলেটি নবীনকুমারের তুলনায় অতিশয় লাজুক। সে এখন ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে পড়ে। এই প্ৰাণগোপালের সঙ্গেই প্রথম দেখা হলো গঙ্গানারায়ণের। একে জানিয়ে কোনো লাভ নেই, তাই গঙ্গানারায়ণ প্ৰাণগোপালকে দিয়েই ডেকে পাঠালো সুহাসিনীকে।
গঙ্গানারায়ণ এ গৃহে কচিৎ-কদাচিৎ আসে। সেই বড় ঝড়ের পর এই আর একবার। নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর ব্যাপার। সে প্রায় ছুটে এসে ভয়-চকিত নেত্ৰে প্রশ্ন করলো, কী গঙ্গাদাদা? কী হয়েচে? কর্তামার কোনো চিটি পেয়েচো? তিনি ভালো আচেন তো?
পুরুষের তুলনায় নারীর বোধ-অনুভূতি হয় অনেক বেশী তীক্ষ্ণ, অথবা ভিন্নপথে চলে। সুহাসিনী এমন সঠিক অনুমান করলো কী করে? সন্ন্যাসীটিকে দেখেও তো গঙ্গানারায়ণের এরকম কিছু মনে আসে নি।
চক্ষে আঁচল চাপা দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সুহাসিনী। গঙ্গানারায়ণ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বললো, সুষি, ওঠ। কাজের কতা আচে। শান্ত হ, বোনটি!
সুহাসিনী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, এ পৃথিবীতে-কত পাপী-তাপী…কত পাষণ্ড-কুষণ্ড বেঁচে থাকে…আর কর্তামা…অমন সতী সাধ্বী…অত দয়া-মায়া…তিনি রইলেন না…গঙ্গাদাদা, তিনি যে আমাদের মায়ের চেয়েও বেশী। আপনি ছিলেন গো…
আরও একটু পরে গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করলো, সুষি, তুই একটা পরামর্শ দে তো! কী করে বড়বাবুর কাচে কতটা ভাঙি? তাঁর শরীরগতিক ভালো নয়, এত বড় একটা আঘাত যদি পান-আবার তাঁর কাছ থেকে গোপন করেও রাখা যায় না…কোনো এক সময় তাঁর কানে ঠিক উঠবেই।
ঠিক নটার তোপ পড়লে বিধুশেখর দ্বিতলেরই এক কক্ষে রাত্রির আহার গ্রহণ করতে আসবেন। তার আগে কি তাঁকে এই সংবাদ দেওয়া উচিত হবে? তাঁর আহার মানে তো রোগীর পথ্য, তা বাদ দেওয়া তাঁর শরীরের পক্ষে আরও অনিষ্টকর। সুতরাং, গঙ্গানারায়ণ অপেক্ষা করাই মনস্থ করলো।
কিন্তু কাৰ্যকারণের যোগাযোগ সব সময় মানুষের হিসেব মতন হয় না। বিধুশেখর নিজের ঘরের জানালা দিয়ে একটু আগে গঙ্গানারায়ণকে তাঁর বাগানের মধ্যেকার সুরকিঢালা পথ দিয়ে আসতে দেখেছেন। গঙ্গানারায়ণ স্বেচ্ছায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি বিস্মিত হন, এ বাড়িতে এসেও কিছুক্ষণের মধ্যে গঙ্গানারায়ণ তাঁর দর্শনপ্রার্থী হলো না, এটা আরও আশ্চর্যের কথা। তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করে রইলেন।
কেল্লা থেকে পর পর নবার তোপ দাগার শব্দ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতলের বারান্দায় শোনা গেল বিধুশেখরের খড়ম ও লাঠির যুগপৎ ঠকঠক শব্দ। বিধুশেখর খাবারের ঘরে আসছেন। সুহাসিনীই তাঁর পরিচর্যা করে। সে দ্বারের কাছে প্ৰস্তুত হয়েই ছিল, পিতার হাত ধরে মেঝেতে পাতা পশমের আসনে বসিয়ে দিল। খাড়া অবস্থা থেকে নিচে মাটিতে বসতে বিধুশেখরের প্রয়োজন হয় অপরের সাহায্যের। শ্বেত পাথরের গেলাস থেকে একটু জল হাতে ঢেলে নিয়ে বিধুশেখর প্রথমে পঞ্চ দেবতাকে অন্ন নিবেদন করে আচমন করলেন। তারপর মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন, সুষি, ও বাড়ি থেকে গঙ্গা এয়েচে দেকলুম যেন!
বিধুশেখরের সামনে মিথ্যে বলবে এমন সাধ্য কার! সুহাসিনী ধরা গলা কোনোক্রমে সংযত করে বললো, হ্যাঁ, গঙ্গাদাদা এয়েচে!
বিধুশেখর কনিষ্ঠা কন্যার দিকে তাঁর এক চক্ষু স্থির রেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই রাতে কেন এসেচে সে?
-কী জানি! আপনার সঙ্গে কোন জরুরি কাজের কতা আচে।
–ডাক তাকে এখেনে!
—বাবা, আপনি আগে খেয়ে নিন। বরং-গঙ্গাদাদা বলেচে, এমন কিছু তাড়া নেই—
বিধুশেখর গলা চড়িয়ে বললেন, ওরে, কে আচিস? ও বাড়ির গঙ্গাবাবু কোতায় বসে আচে দ্যাক। তাকে খপর দে, বল, আমি এখেনে ডাকচি!
গঙ্গানারায়ণ মাত্র দুখানি ঘর পরে প্রাণগোপালের পাঠকক্ষে অপেক্ষারত ছিল। ডাক শুনে তাকে আসতেই হলো।
বিধুশেখর ঘাড় ঘুরিয়ে গঙ্গানারায়ণের আপাদমস্তক দেখলেন একবার। গঙ্গানারায়ণ দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। বাল্যকাল থেকেই এ গৃহে তার অবারিত দ্বার। তবু যেন কোনো সংস্কার বশে সে জানে যে একমাত্র ঠাকুরঘরে এবং কেউ রন্ধন করা অন্ন গ্রহণ করার সময় তখন সে ঘরে তার প্রবেশ করতে নেই। কারণ, যত আত্মীয়তাই থাকুক, এটা ব্ৰাহ্মণের বাড়ি।
বিধুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গ্যাচে?
গঙ্গানারায়ণ তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু সুহাসিনী আবার কান্না শুরু করতেই সব বোঝা গেল।
গঙ্গানারায়ণ সবিস্ময়ে দেখলো, বিধুশেখর একেবারেই বিচলিত হলেন না। মৃত্যু সম্পর্কে তিনি যেন উদাসীন হয়ে পড়েছেন একেবারে। সামনের একটি ছোট বাটি হাতে তুলে নিয়ে তিনি নিরাসক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, হরিদ্বার থেকে পত্তির এসেচে?
এবার সন্ন্যাসী সংক্রান্ত বৃত্তান্তটি গঙ্গানারায়ণ বিবৃত করলো।
বিধুশেখর বললেন, তা, যা হয়েচে, ভালোই তো হয়েচে। তিনি সংসার ত্যাগ করেছিলেন স্বেচ্ছায়, তারপর আর বেঁচে থাকা না থাকা ও একই কতা! তিনি পুণ্যবতী, ঈশ্বরের পাদপদ্মে ঠাঁই চেয়েছিলেন, এখন ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হলেন…এই শোকতাপের পৃথিবীতে বেঁচে থেকেই বা কী লাভ…এখানে থাকলেও নানারকম অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেকে দুঃখ পেতেন…
গঙ্গানারায়ণের কর্ণকুহরে। এসব কথা যেন প্রবেশ করছেই না। দু এক বৎসর পর বিধুশেখরকে দেখে তার বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিধুশেখর যেন শেষ বয়সে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। একটি চক্ষু অবশ্য চিরতরে গেছে, বা পা-টিও অবশ, কিন্তু আগেকার মতন জড়দগব ভাবটি নেই, কণ্ঠস্বরও বেশ সুস্থ মানুষের মতন পরিষ্কার।
তাঁর সামনের খাদ্য দেখেও গঙ্গানারায়ণের চক্ষু কপালে ওঠার উপক্ৰম। বড় একটি থালার মাঝখানে যুঁই ফুল রঙের কিছুটা ভাত এবং সেই থালা ঘিরে অবিকল ষোড়শ ব্যঞ্জন যাকে বলে। এমনকি এই শোকের অবস্থাতেও গঙ্গানারায়ণ গুণে দেখলো, ঠিক ষোলোটি বাটিতেই নানা রকম রান্না সাজানো। তবে যে সুহাসিনী বলেছিল, উনি রাত্রে নিছক রোগীর পথ্য খান!
সুহাসিনী অবশ্য মিথ্যে বলে নি, রাত্রে বিধুশেখর শুধু একটুখানি নুন-চিনি ছাড়া সাদা ছানা এবং এক টুকরো মাগুর মাছ খান। সম্পূর্ণ তণ্ডুল-বর্জিত খাদ্য খেয়েই তিনি বহুমূত্র রোগ থেকে কিছুটা নিরাময় হয়েছেন। শুধু চিকিৎসকের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি মাঝে মাঝে খান তাঁর অতি প্ৰিয় মুসুর ডাল ছোট এক বাটি ভর্তি। অতুল সম্পদের অধিকারী বিধুভুষণ মুখুজ্যের নিজের আহার্যের জন্য দু বেলার ব্যয় দু আনাও নয়। তবে সম্প্রতি এই একটি নতুন বাতিক হয়েছে তাঁর। তিনি নিজে খান বা না খান প্রতিদিন দু বেলা এরকম ষোড়শ ব্যঞ্জন সাজিয়ে দিতে হবে তাঁর সামনে। বড় গলদা চিংড়ি মাছের মুড়ো ভাজা কিংবা আলু পোস্তের তরকারি ভক্ষণ তাঁর বাকি সারা জীবনের মতন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এগুলো রোজ অন্তত একবার করে দেখতে দোষ কী! আর ঘ্রাণে অর্ধভোজনও চিকিৎসাশাস্ত্ৰে নিষেধ করে না। বিধুশেখর কোনোদিনই খুব একটা ভোজনরসিক ছিলেন না, ইদানীং তিনি উত্তম উত্তম খাদ্যের দৃষ্টিলোভী বা ভ্ৰাণ-লোভী হয়েছেন। অথবা, তিনি হয়তো নিশ্চিন্ত হতে চান যে তাঁর আত্মীয়-পরিজনরা অন্তত দুবেলা এগুলি খেতে পাবে।
ডালের বাটিটি এক চুমুকে শেষ করে বিধুশেখর বললেন, শুনে যা বুঝচি, প্রায় মাস দু এক আগেই তোমাদের মাতা-ঠাকুরাণীর মৃত্যু ঘটে। গ্যাচে। তবে আর বিলম্বে কাজ নেই, তোমরা দুভায়ে মিলে কাল-পরশুর মধ্যে শ্ৰাদ্ধ-শান্তি চুকিয়ে ফেল। বেশী ঘটা করারও প্রয়োজন নেই কো, তিনি সন্ন্যাসিনী হয়েছেলেন, ওঁদের শ্ৰাদ্ধ নিয়ে বেশী ঘটাপেটা করা শোভন হয় না। পুরুত ঠাকুরদের ডাকাও, যেটুকু না করলে নয়।–তবে পিণ্ডদান যেন শুধু ছোট্কুই করে, তোমার আর করবার দরকার হবে না—।
নবীনকুমার শহরে উপস্থিত নেই শুনে বিধুশেখর খাওয়া বন্ধ করে ফের মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললেন, অ্যাঁ? সে এখেনে নেই মানে? কোতায় গ্যাচে?
বিম্ববতীর মৃত্যু সংবাদের চেয়েও যেন নবীনকুমারের অনুপস্থিতির সংবাদ বিধুশেখরকে অনেক বেশী বিচলিত করে। তিনি বারবার নবীনকুমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে সব জেনে নিলেন। তারপর নৈরাশ্যের সুরে বললেন, সে গেল, একবার আমার সঙ্গে দ্যাকা পর্যন্ত করে গেল না?
—সে আসেনি? সে যে বলেছেল, যাবার আগে আপনাকে প্ৰণাম করে যাবে?
—নাঃ! ছোট্কু আমার কাচে আসে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, সুষি, আজ চিঁড়ের পায়েস করিস নি? দে, আজ একটু পায়েস খাই, মুখটা তেতো তেতো লাগচে-।
অতঃপর নকুড় আর দুর্যোধনকেই পাঠানো হলো কিছু লোকজন সঙ্গে দিয়ে। যেমন করে পারে, তারা যেন নবীনকুমারকে ভারতের যে কোনো অঞ্চলে খুঁজে বার করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
গঙ্গানারায়ণ সংক্ষিপ্তভাবে বিম্ববতীর শ্ৰাদ্ধ সেরে নিল নিজে একাই। বিধুশেখর যা-ই ইঙ্গিত করে থাকুন না কেন, বিম্ববতীকে সে নিজের জননীই মনে করে থাকে। পিণ্ডদান বিষয়ে অবশ্য তার নিজেরও কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। সে ব্ৰাহ্মসমাজের সদস্যভুক্ত হয়নি বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে গুপ্ত ব্ৰাহ্ম, বারাণসীতে প্রবেশের পূর্বে সে নিজেই নিজেকে ব্ৰাহ্ম ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল, তার থেকে সে আর সরে আসেনি। শ্রাদ্ধের সময় নারায়ণ শিলার পূজা কিংবা পিণ্ডদানে সে বিশ্বাসী নয়।
দুই গোমস্তা ছোটকুকে সঙ্গে নিয়ে কিংবা তার সংবাদ বহন করে এক সপ্তাহের মধ্যেও ফিরলো না। গঙ্গানারায়ণ প্রতিদিন অধীরভাবে প্রতীক্ষ্ণ করে। তার প্রবল ইচ্ছা জেগেছে তারা দুই ভাই কাছাকাছি বসে অনেকক্ষণ ধরে তাদের মায়ের সম্পর্কে কথা বলবে। বিম্ববতী আর নেই বলেই গঙ্গানারায়ণের মনে আসছে। তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য স্মৃতি।
শ্রাদ্ধের সময় গঙ্গানারায়ণের আরও একটা কথা বার বার মনে আসছিল, এই সিংহ পরিবারে একটা পর্বের সম্পূর্ণ সমাপ্তি ঘটে গেল। বিম্ববতী এত বছর অনেক দূরে রইলেও এ গৃহ থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে যায় নি। দাস-দাসী-কর্মচারীরা বলতো, ওটা কর্তামার ঘর, ওটা কর্তামার মানের পাল্কী, খাঁচা-বন্দী পাখিগুলি ছিল কর্তামার পাখি, এ ছাড়া বিম্ববতীর নামে এস্টেটের পৃথক তহবিল, পৃথক সম্পত্তি আরও কত কিছু। এখন তার সব শেষ। বিম্ববতীর দেওয়া ওকালতিনামার জোরে গঙ্গানারায়ণ এতকাল তাঁর সব কিছুর তদারকি করতে পেরেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ সব কিছুর মালিকানা নবীনকুমারের ওপরেই বতাবে।
বিধুশেখর নিজে একদিন এসে সে কথা গঙ্গানারায়ণকে জানিয়েও দিয়ে গেলেন। নবীনকুমার ফিরে আসার আগে বিম্ববতীর সম্পত্তির অংশ যেমন আছে তেমনই থাকবে।
গঙ্গানারায়ণের বিষণ্ণতার ভার বেশ কয়েকদিনেও কাটলো না। হৌসে বেরুতে ইচ্ছে করে না। নেহাত যেটুকু কাজ না করলে নয়, তা সেরে দিয়ে সে বইপত্র পাঠ করে মন ফেরাতে চায়।-মা ও বাবা দুজনেই চলে যাবার পর একটা বিরাট শূন্যতার ভাব আসে। কিন্তু তা যে এতখানি শূন্যতা, তা গঙ্গানারায়ণ আগে জানবেই বা কী করে!
রাত্ৰিবেলা ছাদে পায়চারি করতে করতে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে গঙ্গানারায়ণ চেয়ে থাকে। শিশুদের মতন তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে আকাশে একটি নতুন নক্ষত্র উঠেছে, সেই নক্ষত্রটি বিশেষ আলো ফেলে চেয়ে আছে তার দিকে। পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে বিম্ববতীই যেন তার জননী হন আবার! পরজন্ম…? কে যেন বলেছিল পরজন্মের কথা?
কাশীর গঙ্গায়, নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বিন্দুবাসিনী বলেছিল, আবার পরজন্মে…। গঙ্গানারায়ণের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। কয়েকদিন আগে বিধুশেখরদের গৃহে গিয়ে তার একবারও মনে পড়েনি বিন্দুবাসিনীর কথা। আশ্চর্য! মানুষের মন এমনও হয়!
–আপনি এমন হিমের মধ্যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আচেন!
গঙ্গানারায়ণ চমকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। কুসুমকুমারী তাকে ডাকতে এসেছে। কুসুমকুমারীর মুখখানির চার পাশে যেন আভা ফুটে আছে, এমনই সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও রোধ করলো গঙ্গানারায়ণ। পরজন্ম না ছাই! ওসব কিছুই নেই। বিন্দুবাসিনী এ জন্মে কিছুই পেন না, শুধু লাঞ্ছনা আর বেদনা নিয়ে চলে গেল। অথচ সে তো কুসুমকুমারীকে পেয়েছে। সে স্বার্থপর!
এর কয়েকদিন পর একটি চমকপ্ৰদ রোমহর্ষক সংবাদে কেঁপে উঠলো সারা শহর। সব সংবাদপত্রগুলি হুলুস্থুল করতে লাগলো এই ব্যাপার নিয়ে। এক অত্যন্ত ধনী পরিবারের কুলবধূ তার স্বামীকে স্বহস্তে খুন করে রক্তাক্ত খড়্গ হাতে চামুণ্ডার মতন বেশে পথে নেমে এসে বলেছে, হ্যাঁ, আমি আমার স্বামীকে খুন করিচি! বেশ করিচি!
সংবাদপত্রে যা প্ৰকাশিত হয়, তার চেয়ে রটে আরও বেশী। কেউ বললো, সেই খড়্গধারিণীকে ধরতে গিয়ে দুজন সেপাই জখম হয়েছে। কেউ বললো, না, না, সে তো স্বেচ্ছায় গিয়ে গারদে ঢুকেচে। কেউ বললো, নন্দকুমারের যেমন ফাঁসী হয়েছেল, এবার এক হিন্দু ঘরের বউকে গড়ের ময়দানে সর্বসমক্ষে ফাঁসীতে লটকাবে ইংরেজ সরকার বাহাদুর। কেউ বললো, না, না, সে বেটী আদালতে ডাঁড়িয়ে নিজেই নিজের সওয়াল করেচে। আর জজ-ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেচে, অনন্ত নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই সে নিজের হাতে তার স্বামীকে নিধন করেচে। যে আদালত তার পাপিষ্ঠ-নরাধম স্বামীকে শাস্তি দিতে পারেনি, সে আদালত কোন এক্তিয়ারে তার মতন নিযাতিতা রমণীকে শাস্তি দিতে আসে! কেউ বললো, না গো না, কোর্টে কোনো মেয়েমানুষের কতা কইবার একরার নেই, ব্যারিস্টার এম এস ডাটু, তার মানে সেই যে আমাদের মেঘনাদের কবি শ্ৰীমধুসূদন গো, তিনিই ঐ খুনে মেয়ের হয়ে সওয়াল করবেন। কেউ বললে, মেয়েমানুষের এত বাড়, হিন্দু ধর্ম এবার রসাতলে গেল। কেউ বললে, মেয়েমানুষ যদি এমনভাবে কুলাঙ্গার পতির বিনাশ করতে পারে, তবে বুঝতে হবে দেশটা একটু নড়াচড়া দিয়ে উঠচে।
সংবাদের মধ্যে সত্যতা শুধু এইটুকুই যে হাটখোলার প্রখ্যাত ধনী মল্লিক পরিবারের এক বধূ, তার নাম দুর্গামণি, তার লম্পট দুশ্চরিত্র স্বামী চণ্ডিকাপ্ৰসাদের গলায় এক রাতে ক্রোধের বশে ছুরি বসিয়ে তারপর নিজেও আত্মঘাতিনী হতে গিয়েছিল। কিন্তু সে পুলিস হেফাজতে এখনও বেঁচে আছে।
এ খবর কুসুমকুমারী শোনা মাত্র সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেল গঙ্গানারায়ণের পায়ের কাছে।