১৬ ডিসেম্বর সকাল নটায় জেনারেল নিয়াজী একটা চিরকুট পেলেন। চিরকুটটি নিয়ে এসেছে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরার এডিসি। দুই লাইনের চিরকুট পড়তে তার তিন মিনিটের মতো লাগল। তিনি কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন। বা হাতে কপালের ঘাম মুছলেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি বললেন, কী লেখা? নিয়াজী তার হাতে চিরকুট দিলেন। রাও ফরমান আলি চিরকুটটি পড়লেন এবং বাড়িয়ে দিলেন মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে।
চিরকুটে লেখা–প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর সেতুর কাছে। পরামর্শ হচ্ছে, আপনি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।
মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে নিয়াজী পরিচিত। নাগরা ইসলামাবাদে অনেকদিন ছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসে তিনি ছিলেন মিলিটারি এটাচি। সেখানেই পরিচয়, সেখানেই সখ্য।
মেজর জেনারেল ফরমান আলি নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আত্মসমর্পণের আলোচনা কি আমরা নাগরার সঙ্গে করব?
নিয়াজী হ্যাঁ না কিছুই বললেন না।
ফরমান আলি বললেন, আপনার কি কোনো রিজার্ভ বাহিনী আছে?
নিয়াজী এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে তিনি সাময়িক বধিরতায় আক্রান্ত। চিরকুটটি সব হাত ঘুরে এখন তার হাতে এসেছে। তার দৃষ্টি চিরকুটের লেখা আবদুল্লাহ নামটার দিকে।
রিয়ার এডমিরাল শরীফ নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে পাঞ্জাবিতে উঁচু গলায় বললেন, কুছ পাল্লে হ্যায়? এর অর্থ–থলেতে কিছু আছে? নিয়াজী তাকালেন জেনারেল জামশেদের দিকে। ঢাকা রক্ষার দায়িত্ব জেনারেল জামশেদের। তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন। থলে শূন্য। থলেতে বিড়াল নেই।
রিয়ার এডমিরাল শরীফ বললেন, এই যদি হয় অবস্থা তাহলে নাগরা যা বললেন। তাই করাই বাঞ্ছনীয়।
রাও ফরমান আলী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কিছু সময়ের জন্যে দলটির ভেতর কবরের নৈঃশব্দ নেমে এলো। নীরবতা ভঙ্গ করলেন রাও ফরমান আলী। তিনি নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন কিছু নোংরা পাঞ্জাবি রসিকতা শোনা যেতে পারে।
নিয়াজী চুপ করে রইলেন। এই প্রথম তিনি কোনো রসিকতা করলেন না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বের জন্যে মিলিটারি ক্রস পাওয়া সৈনিক পাংশু মুখে উঠে দাঁড়ালেন। রাও ফরমান আলী তাকালেন তাঁর দিকে। জেনারেল জামশেদ বললেন, আমি মিরপুর ব্রিজের দিকে যাচ্ছি।
এডমিরাল শরীফ বললেন, কেন?
জেনারেল জামশেদ তিক্ত গলায় বললেন, আত্মসমৰ্পণ করব। এবং জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসব।
ও আচ্ছা।
আমার কাছে কোনো দ্বিতীয় বিকল্প নেই। আপনাদের কাছে কি আছে?
কেউ জবাব দিল না।
ষোলই ডিসেম্বর ভোরবেলা (সাড়ে দশটা) কারফিউ দেয়া শহরে দুটি গাড়ি যাচ্ছে। সেদিন নগরী ঘন কুয়াশায় ঢাকা। রাস্তা জনশূন্য। গাড়ি দুটি যাচ্ছে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টারের দিকে। প্রথমটা জিপ। সেখানে বসে আছেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দ্বিতীয়টা পতাকা উড়ানো স্টাফ কার। এখানে আছেন ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। লম্বা চুল দাড়িতে কাদের সিদিককে দেখাচ্ছে চে গুয়েভারার মতো।
নিয়াজী প্ৰতীক্ষা করছিলেন। জেনারেল নাগরা ঘরে ঢোকার মাধ্যমে সেই প্ৰতীক্ষার অবসান হলো। নিয়াজী নাগারাকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিড়বিড় করে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, আমার আজকের এই অপমানের জন্যে দায়ী রাওয়ালপিন্ডির বাস্টার্ডরা।
নিয়াজীর ফোঁপানো একটু থামতেই জেনাবেল নাগরা তাঁর পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।
জেনারেক নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। তাদের স্তম্ভিতভাব কাটতে সময় লাগল। এক সময় নিয়াজী করমর্দনের জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে।
কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না।
টাইগার নিয়াজী অপেক্ষা করছেন ভারতীয় প্রতিনিধির জন্যে। কার কাছে তিনি আত্মসমৰ্পণ করবেন? আত্মসমর্পণের শর্ত কী? ঘটনাটা ঘটবে কোথায়? তিনি খবর পেয়েছেন আত্মসমর্পণের ব্যাপারটির দেখার জন্যে লেফটেনেন্ট জেনারেল জেকব হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসছেন। নিয়াজী বুঝতে পারছেন না তার কি উচিত। ঢাকা এয়ারপোর্ট নিজে উপস্থিত হয়ে জেকবকে অভ্যর্থনা জানানো? নাকি অন্য কাউকে পাঠাবেন? কাকে পাঠানো যায়?
লেফটেনেন্ট জেনারেল অরোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। জেনারেল অরোরা সন্ত্রীক আসছেন। এমন অদ্ভুত ঘটনা দেখার লোভ তাঁর স্ত্রী সামলাতে পারছেন না। অরোরা কখন আসবেন? তাদের জন্যে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা কি তার করা উচিত না? মেনু কী হবে? অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে টাইগার নিয়াজী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ঢাকা রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করলেন। তিনি তার কোমরের বেল্টে ঝুলানো পিস্তল তুলে দিলেন লেফটেনেন্ট জেনারেল অরোরার হাতে। ঘড়িতে তখন সময় বিকাল চারটা উনিশ মিনিট।
আমি (এই গ্রন্থের লেখক) তখন ঢাকায়। ঝিকাতলার একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছি। আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালও ঢাকায়। সে কোথায় আছে, বেঁচে আছে না মারা গিয়েছে, কিছুই জানি না। আমার সঙ্গে ঝিকাতলার সেই একতলা টিনের ছাদের বাড়িতে আছে আমার অতি প্ৰিয় বন্ধু আনিস সাবেত। তিনি বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমার দেখা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন। ষোলই ডিসেম্বরে আমরা দুজন কী করলাম একটু বলি। হঠাৎ মনে হলো আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কানে বিঝি পোকার মতো শব্দ হচ্ছে। আনিস সাবেত বাড়ির সামনের মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন। গড়াগড়ি করছেন।
আমি তাকে টেনে তুললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল রাস্তায় চল। একটু আগেই তিনি কাঁদছিলেন। এখন আবার হাসছেন। আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম এবং ফাঁকা রাস্তায় কোনোরকম কারণ ছাড়া দৌড়াতে শুরু করলাম। আনিস ভাই এক হাতে শক্ত করে আমাকে ধরে আছেন, আমরা দৌড়াচ্ছি।
ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হৈচৈ, লাফালাফি। মাঝে-মধ্যেই আকাশ কাঁপিয়ে সমবেত গর্জন–জয় বাংলা। প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। এই পতাকা সবাই এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে?
ঝিকাতলার মোড়ে আমাদের দুজনকে লোকজন আটকাল। তারা শঙ্কিত গলায় বলল, রাস্তা পার হবেন না। খবরদার! কিছু আটকা পড়া বিহারি দোতলার জানালা থেকে এইদিকে গুলি করছে। আমরা গুলির শব্দ শুনলাম। আনিস ভাই বললেন, দুক্তেরী গুলি। হুমায়ূন চল তো। আমরা গুলির ভেতর দিয়ে চলে এলাম। আমাদের দেখাদেখি অন্যরাও আসতে শুরু কবল।
সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এসে আনিস ভাই দুপ্যাকেট বিসকিট কিনলেন। (আমার হাত সে সময় শূন্য। কেনাকাটা যা করার আনিস ভাই করতেন।) আমরা সারাদিন খাই নি। প্ৰচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। আমি আনিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিস ভাই, পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে।
তিনি বললেন, অবশ্যই পোলাও খাব। পোলাও। আমরা দুজন অর্ধউন্মাদের মতো পোলাও পোলাও বলে চেঁচালাম। রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছে। কেউ কিছু মনে করছে না। একটা রিকশাকে আসতে দেখলাম। রিকশার সিটের উপর বিপদজনক ভঙ্গিতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি জিগিরের ভঙ্গিতে বলেক যাচ্ছেন–জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা। আনিস ভাই তার হাতের বিসকিটের প্যাকেট গুড়া করে ফেললেন। আমিও করলাম! আমরা বিঙ্কিটের গুড়া ছড়িয়ে দিতে দিতে এগুচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি তাও জানি না। আজ আমাদের কোনো গন্তব্য নেই।
স্মৃতিকথন বন্ধ থাকুক। মূল গল্পে ফিরে যাই।
মরিয়মদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। মরিয়ম বিয়ের শাড়ি পরেছে। তার মন সামান্য খারাপ। কারণ শাড়িতে ঝোলের দাগ পড়েছে। রান্না করতে গিয়ে এই দাগ মরিয়ম নিজেই ফেলেছে। অনেক ধোয়াধুয়ি করেও এই দাগ উঠানো যাচ্ছে না। দাগটা এমন জায়গায় লেগেছে যে আড়াল করা যাচ্ছে না।
মরিয়ম বসে আছে তাদের বাসার সিঁড়ির সামনে। আজ সারাদিন সে কিছু খায় নি। যদিও ঘরে অনেককিছু রান্না হয়েছে। এর মধ্যে অনেক তুচ্ছ রান্নাও আছে। একটা হলো খুবই চিকন করে কাটা আলুর ভাজি। আরেকটা কাঁচা টমেটো আগুনে পুড়িয়ে ভর্তা। এই দুটা আইটেম নাইমুলের পছন্দ। মরিয়ম নিজে রোধেছে। নতুন আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঝোল।
একটু পরপর মরিয়মকে খাওয়ার জন্যে সাধাসাধি করা হচ্ছে। তার খুবই বিরক্তি লাগছে। সে তো অনশন করছে না যে সোধে তার অনশন ভাঙতে হবে। সে যথাসময়ে খেতে যাবে।
নাইমুল কথা দিয়েছিল দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন সে উপস্থিত হবে। মরিয়ম জানে নাইমুল কথা রাখবে। যত রাতই হোক সে বাসার সামনে এসে গম্ভীর গলায় বলবে–মরি, আমি এসেছি। কেউ কথা না রাখলেও আমি নাইমুল। আমি কথা রাখি। এই বলে সে নিশ্চয় ইংরেজি কবিতাটাও বলবে–Anable Lee না কী সব হাবিজাবি।
সন্ধ্যার পর সাফিয়া এসে মেয়ের হাত ধরলেন। কোমল গলায় বললেন, মা তুই কতক্ষণ এখানে বসে থাকবি?
মরিয়াম বলল, মা, তুমি বিশ্বাস করো আমি ও না আসা পর্যন্ত বসেই থাকব।
রাত একটা বেজে গেল। মরিয়মের দুই বোন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মরিয়মের মুখ ভাবলেশহীন। এক সময় মরিয়ম বলল, তোমরা এখান থেকে যাও। আমি একা বসে থাকব।
সবচে ছোটবোন করুণ গলায় বলল, তুমি একা বসে থাকবে কেন? আমরাও বসি।
মরিয়ম কঠিন গলায় বলল, না। বোনরা উঠে গেল।
তারো অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি-গোফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে কি আমি চিনি? দীর্ঘকায় এই যুবক দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, মা দেখ, কে এসেছে! মাগো দেখ কে এসেছে।
মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে–আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছ কেন? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে।
নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এরকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি।
বাস্তবের সমাপ্তি এরকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখে নি। সে ফিরে আসতে পারে নি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্ৰান্তরের কোথাও তার কবব হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহারে! আহারে!