2 of 2

৭২. প্রীতম নিজে থেকেই মাস দুই আগে

প্রীতম নিজে থেকেই মাস দুই আগে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে। ইদানীং ওষুধের প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল তার। পিঠের দিকে আর মাজায় ক্ষত দেখা দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাঁফানির মতো শ্বাসকষ্ট হত। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের বেশিরভাগই কমবেশি বিষ জাতীয় জিনিস! ডাক্তারকে সে একদিন বলল, আমি আর ওষুধ খাব না।

ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, খাবে না? তা হলে কী করবে?

আমার ড্রাগ-রিঅ্যাকশন হচ্ছে।

ডাক্তার নিজেও সেটা জানেন। বিচক্ষণ প্রবীণ ডাক্তার। একটু ভেবে বললেন, খেয়ো না। ভগবানকে ডাকো। তাঁর চেয়ে বড় ডাক্তার আর কে আছেন?

পরদিন থেকেই একজন হোমিয়োপ্যাথ প্রীতমকে দেখছে। বেশ সাধু-সাধু চেহারার দাড়িওলা হাসিখুশি মানুষ। বলার চেয়ে শোনেন বেশি, আর তার চেয়েও বেশি হাসেন। লোকটাকে পছন্দ হল প্রীতমের। লোকটা একটু বাঙাল আর বাহে টানে খাঁটি উত্তরবঙ্গীয় বুলিতে শুধু বলে গেলেন, ভাল হইয়া যাইবেন গিয়া।

ছোট ছোট মিষ্টি গুলির ওষুধ খেতে আপত্তি নেই প্রীতমের। উপকার হোক না হোক, অপকারও নেই। ডাক্তার বড় একটা আসেন না, শতম গিয়ে অবস্থার বিবরণ দিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে। তাতে কাজ হয় কি না বোঝা যায় না, কিন্তু শতম খুব নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ায়। ওষুধের মাত্রা খুবই অবিশ্বাস্য রকমের কম। সাতদিনে মাত্র একদিন একটি ডোজ, খালিপেটে এবং সকালে।

এই চিকিৎসার ব্যবস্থায় মোটেই খুশি হল না বিলু। পরের দিনই সে নিজে দাড়িওলা ডাক্তারের বাড়িতে হানা দিল।

ডাক্তারবাবু, এই ওষুধে কি কাজ হবে?

ডাক্তারবাবু এই সাজগোজ করা বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে দেখে একটু তটস্থ হয়ে বললেন, হবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। একটু দেরিতে ক্রিয়া হয়।

বিলু ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনার কি মনে হয় না ওর এখনই অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা বন্ধ করাটা ঠিক হয়নি?

ডাক্তার একটু ফাঁপরে পরে বলেন, ওই চিকিৎসাতেও বিশেষ উপকার হইতেছিল না।

আপনি কি পারবেন?

ডাক্তার হেসে বললেন, রোগীর এখন-তখন অবস্থা না হইলে কেউ তো আর হোমিয়োপ্যাথের কাছে আসে না। আমার সব রোগীই তাই মরুইন্যা। তাগো ভাল করতে সময় তো একটু লাগেই, মা। আপনে নিশ্চিন্তে যান গিয়া।

ডাক্তারের পসার বেশি নয়, তা বাইরের ঘরে বসেই টের পেল বিলু। সকালবেলার দিকেও রুগি বলতে ডাক্তারের বাইরের ঘরে প্রায় কেউই নেই। ডাক্তার নিজেও তার ক্ষেতির কাজ দেখছিল। খবর পেয়ে মাটিমাখা হাতেই উঠে এসেছে। দুটো ভাঙা আলমাবিতে রাজ্যের পুরনো হোমিয়োপ্যাথির বই আর জার্নাল। দুটো ছোট পুরনো আলমারিতে হাজারখানেক শিশি আর বোতল। দেয়ালে মহাত্মা হ্যানিম্যানের ছবিতে ঝুল পড়েছে। ডাক্তার গা-আদুড়, ধুতি হাঁটু অবধি তোলা। দাড়ির ফাঁকে হাসি।

বিলু খুশি হচ্ছিল না। বলল, কলকাতায় ওকে বড় বড় স্পেশালিস্ট দেখছিল। তারাই কিছু করতে পারল না।

ডাক্তার শুধুই হাসছিলেন।

বিলু অগত্যা উঠল। তার ইচ্ছে করছিল, এক্ষুনি প্রীতমকে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যায়। এরকম অব্যবস্থায় বিনা চিকিৎসায় লোকটা মরেই যাবে।

বেরোনোর মুখে বিলু বাঁ হাতে ডাক্তারের বাগানটা দেখল। চোখ জুড়িয়ে যায়। কী সবুজ! কী সবুজ!

ওটা কি শশা নাকি?

শশাই, মা। খাইবেন? লইয়া যান কয়টা।—বলে ডাক্তার গিয়ে মাচান থেকে কয়েকটা দুধকচি শশা পেড়ে এনে বিলুর হাতে দেয়।

বিলু শশাগুলো নিয়ে এসেছিল বটে, কিন্তু বাড়িতে না দিয়েই প্রীতমকে বলল, এবারই আমার সঙ্গে তোমাকে ফিরে যেতে হবে।

কেন?–প্রীতম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

এসব কী হচ্ছে শুনি! এ কি চিকিৎসা? লোকটা তো তেমন উঁচুদরের ডাক্তারও নয়। প্র্যাকটিসই নেই।

প্রীতম থম ধরে থেকে কিছুক্ষণ বাদে বলে, এর ওষুধে আমার কাজ হচ্ছে।

ছাই হচ্ছে! হাতি ঘোড়া গেল তল, এখন মশা বলে কত জল। আমি এসব পছন্দ করছি না। এবারই আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

নিয়ে কী করবে?

যদি হোমিয়োপ্যাথিই করাও তবে তার জন্যেও কলকাতায় ঢের বড় ডাক্তার আছে। এ লোকটা কিছু জানে না।

কী করে বুঝলে?

রুগিই নেই। কেমন ক্যাবলার মতো সবসময়ে হাসে।

ওগুলো যুক্তি নয়, বিলু।

কোনটা যুক্তি নয়?

ডাক্তারের বিচার করতে যেয়ো না। আমার রোগের কোনও চিকিৎসা এখনও অ্যালোপাথিতে নেই। কলকাতার ডাক্তাররা সে কথা আকারে-ইঙ্গিতে বলেই দিয়েছে। হোমিয়োপাথিতে আছে কি না আমি জানি না। জানি না বলেই ভরসা করতে পারছি। এ লোকটা শতমের চেনা। ক্যাবলা হলে শতম ওকে দিয়ে আমার চিকিৎসা করাত না।

বিলু সাময়িকভাবে চুপ করে গেল বটে, কিন্তু যুক্তিটা মেনে নিল না।

বিকেলেই সে শতমকে বলল, এখানে তোমার দাদার ভাল চিকিৎসা হচ্ছে না। আমি ভাবছি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব।

এ কথায় একটু থতমত খেয়ে যায় শতম। সত্য বটে, দাদার দায়দায়িত্ব সে নিজের ঘাড়ে নিয়েছে, কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দাদার ওপর অধিকার তার চেয়েও বউদিরই বেশি। পুরুষ মেয়ে উভয়পক্ষই বিয়ের পর আত্মীয়স্বজনের কাছে একটু পর হয়ে যায়। দাদা মরলে বউদিরই তো সবার আগে শাঁখা ভাঙবে, সিঁদুর মুছবে। কাজেই বউদির যতটা অধিকার তার ততটা নয়।

সে বলল, আবার কলকাতা!

কলকাতাই ভাল। এখানে কেউ তোমরা ওর ওপর ঠিক নজরও রাখতে পারছ না। শুনলাম, দু’দিন ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি আসবার আগের দিনই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। যদি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেত?

শতম একটু হাসল, আমাদের পাড়াটা তেমন কনজেসটেড নয়, তাই রক্ষা। যদি এ কাণ্ড দাদা কলকাতায় করে তা হলে কী হবে বউদি, বলো তো! তুমি অফিসে থাকো, লাবু ইস্কুলে, দু’জন মাইনে-করা লোক কতক্ষণ নজর রাখবে?

দরকার হলে আমিই ছুটি নিয়ে বাসায় থাকব।

ছুটি নেবে? কেন, চাকরিটা ছেড়ে দাও না!

দরকার হলে তাও ছাড়ব।–কয়েক মাস আগে শতম যে জবরদস্তিতে দাদাকে নিয়ে এসেছিল সেই অপমানটা ভোলেনি বিলু। আজ বহুদিন বাদে সেই শুষ্ক ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ টের পায় সে। বাঘিনীর মতো জিভ দিয়ে সেই রক্তের স্বাদ নেয় সে।

শতম বউদির চেহারায় বিদ্রোহের আভাস পাচ্ছিল। তাই কথা বাড়াল না। মৃদু স্বরে বলল, নিয়ে যেতে হয়, যাবে। তার আর কথা কী!

এত সহজে দুরন্ত শতম বাগ মানবে তা ভাবেনি বিলু। একটু ক্লান্ত স্বরে সে বলল, তিনটে ফাস্ট ক্লাসের টিকিট করে দাও তা হলে।

দেব। মাকে আগে একটু জানিয়ে নাও।

নিজের ঘরে বা বারান্দায় বসে প্রীতম সবই টের পায়। কলকাতায় যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনও মতামত আর চাইছে না বিলু। অর্থাৎ প্রীতমের মতামত এখন উপেক্ষা করলেও তার চলে। বাড়ির কেউই বিলুর প্রস্তাবে বাধা দিচ্ছে না। তার মানে কি, প্রীতমকে এরা কেউ চায় না? ঠান্ডা লড়াইটা বিলু জিতে গেছে তা হলে?

শতম একদিন একটা ফার্স্ট ক্লাস কুপে রিজার্ভ করে এসে তিনটে টিকিট বউদির হাতে দিয়ে বলল, আগামী রবিবার।

বিলু টিকিট তিনটে তার ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল।

এসবই ঘটল প্রীতমের চোখের সামনেই।

বাড়িতে আজকাল হইচই কমে গেছে। রাতে খাওয়ার পর আজ্ঞা নেই। ডাক্তার ওষুধ দেওয়া প্রায় বন্ধ করেছে।

একদিন সকালবেলা বারান্দায় বসে গোটা ব্যাপারটা ভেবে মৃদু মৃদু একটু হাসল প্রীতম। তার কেবলই মনে হচ্ছিল বিলু কোনওরকমে টের পেয়েছে যে, প্রীতম ভাল হয়ে উঠবে। আর যদি তা-ই হয় তবে সে কেন প্রীতমের আরোগ্যের যোলো আনা কৃতিত্ব নিজে দাবি করবে না!

এত গভীরভাবে কথাটাকে বিশ্বাস করল প্রীতম যে সকালে প্রথম বিলুর সঙ্গে দেখা হতেই সে বলল, তাই না বিলু?

অবাক বিলু বলে, কিসের তাই না?

এই যে তুমি আমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছ, এর মূলে আছে একটা অন্য কথা!

কী কথা?

তুমি জানো যে, আমি ভাল হয়ে উঠছি। আর সেই ভাল হয়ে ওঠার জন্য তুমি নিজের কৃতিত্ব দাবি করতে চাও।

বিলু খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে কঠিন মুখ করে বলে, তুমি ভাল হয়ে উঠছ, এ কথা কে বলল?

আমি টের পাই, তুমিও টের পাচ্ছ।

আমি পাচ্ছি না, তা ছাড়া অত ঘোরপ্যাঁচ আমার মনের মধ্যে ছিল না। তুমি এসব ভাবলে কী করে?

প্রীতম হতাশার খাস ফেলে বলে, ছেড়ে দাও ওসব কথা। আইডল ব্রেন ইজ ডেভিলস। ওয়ার্কশপ।

তাই দেখছি। কিন্তু ওসব নিয়ে ভাববার সময় আমার নেই। আমি তোমাকে নিয়েই কলকাতা যাব।

প্রীতম জবাব দিল না।

 

পরদিন সকালে মরম চেঁচিয়ে উঠল, দাদা নেই! দাদা কোথায় গেল?

সারা বাড়ি তৎক্ষণাৎ জেগে উঠল। তারপর খোঁজ খোঁজ।

কিন্তু আশেপাশে কোথাও প্রীতমকে পাওয়া গেল না। এক ঘণ্টা গেল, দু ঘণ্টা গেল। সারাদিনটাই চলে গেল। প্রীতম ফিরল না।

বিলু ক্রমেই গম্ভীর আর থমথমে হয়ে উঠছিল। তারপর নিজের বাক্স-টান্স গোছাতে লাগল আপনমনে।

দুপুরের মধ্যেই সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব জায়গা থেকে ঘুরে আসতে লাগল লোক। কোথাও প্রীতম নেই। থানা হাসপাতাল কোথাও না। ধারেকাছে জলপাইগুড়ি আর খোকসাডাঙায় প্রীতমের এক পিসি আর এক দূর সম্পর্কের জ্যাঠা থাকে। সেখান থেকেও খবর এল প্রীতম যায়নি।

বিলুর মুখে দুশ্চিন্তা নেই, উদ্বেগ নেই, শুধু কঠোর লাবণ্যহীন একটা আক্রোশ জ্বলছে।

উদ্বেগে ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ায় মা বিছানায় শোয়া। বাবা ঘর বার করছে। ছবি দুপুরে ডালসেদ্ধ আর ভাত নামিয়ে রাখল কোনওক্রমে। কেউ খেল, কেউ খেল না, তবে কেউ কাউকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করল না। বিলু অবশ্য মেয়েকে নিয়ে খেতে বসল। খেতে খেতেই ছবিকে বলল, ওরা অত খোঁজাখুঁজি না করলেই পারত।

ছবি চমকে উঠে বলে, কেন বউদি?

তোমার দাদা তো আর অচেনা জায়গায় নেই। পাছে আমি কলকাতায় নিয়ে যাই সেই ভয়ে ওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এতটা না করলেই হত। তেমন আপত্তি থাকলে আমি না হয় ওকে নিয়ে যেতাম না।

ছবি অবাক হয়ে বলে, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! কে সরাল? আমরা?

তাও তোমরাই জানো। ওর মতো পঙ্গু লোকের পক্ষে খুব দূরে তো যাওয়া সম্ভব নয়।

ছবি অল্প বয়সের ধর্মেই একটু মুখিয়ে উঠে বলে, দাদাকে পঙ্গু বলছ কেন? যে হাঁটতে পারে, সাইকেল চালাতে পারে সে কি পঙ্গু মানুষ?

মোটেই পারে না। ওসব ও করে মরার জন্য। একদিন এভাবেই একটা অ্যাকসিডেন্ট করে মরবে, তোমরা তখনও চোখ বুজে থেকো।

এ কথার জবাব এল না ছবির মুখে। অসহায়ভাবে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ডালের হাতাটা মেঝেয় রেখে সে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসল।

ছবির মুখ থেকে কথাটা ছড়িয়ে পড়তেও বেশি দেরি হল না। দুপুরে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে বিলু যখন উঠল তখন তিন ভাই শ্মশানফেরত চেহারা নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। দুপুরে ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে যাওয়ায় মা অঘোরে ঘুমোচ্ছ। বাবা বাড়ি নেই। ছবি চা করছে।

বিলুকে দেখে শতম উঠে এল। বিলুকে ঘরে ডেকে এনে বলল, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে, বউদি।

বলো।–খুব নিস্পৃহ স্বরে বিলু বলে।

তোমার মনে যত সন্দেহই থাক, দাদাকে আমরা কিন্তু সত্যিই লুকিয়ে রাখিনি।

বিলু এ কথার জবাব দিল না। কিন্তু মুখটা আরও গম্ভীর আর কঠিন হল।

দাদা শেষরাতে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে জানি না। ব্যাপারটা হালকাভাবে দেখো না। এর মধ্যে লুকোচুরি নেই।

বিলু নীরস গলায় বলে, প্রীতমকে খুঁজে বের করা খুব শক্ত কাজ নয় শতম, কোথায় যেতে পারে তা তোমাদের অজানা থাকার কথা নয়।

আমরা সব জায়গায় খুঁজেছি। দাদার সব বন্ধুর বাড়িতে গেছি। কোথাও পাইনি।

বিলু তবু বিশ্বাস করল না। মৃদু বিষ-গলায় বলল, একটা কথা তো মানবে। প্রীতম মোটর নিউরো ডিজেনারেশনের রুগি। তার পক্ষে স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা সম্ভব নয়। সে কতদূর যেতে পারে?

তা তো জানি না।

এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?

বলি। কারণ, কথাটা সত্যি। এমনকী আমরা রেললাইন ধরেও খুঁজেছি, যদি সুইসাইড করে থাকে। ধারেকাছে পুকুর-টুকুর নেই, থাকলে জলে লোকনামাতাম। খুঁজে দেখেছি, দাদা তার একটা হাতব্যাগ সঙ্গে নিয়ে গেছে। সেই হাতব্যাগে দাদার সব টাকাপয়সা থাকত।

বিলু চুপ করে রইল।

শতম মিনতি করে বলল, বিশ্বাস করো বউদি, লুকিয়ে রাখলে এতক্ষণে স্বীকার করতাম।

বিলু মৃদু স্বরে বলে, তা হলে ও নিজেই হয়তো লুকিয়ে আছে। তোমাদের আর খুঁজতে হবে না। আমি চলে গেলে ঠিক ফিরে আসবে।

শতম ভীষণ উদ্বেগের গলায় বলে, তুমি এ অবস্থায় চলে যাবে? দাদা ফিরে না এলেও?

আমি না গেলে যে ও ফিরবে না।

শতম একটু অবিশ্বাসভরে বউদির দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, যদি দাদা না ফেরে?

ফিরবে। যে সুইসাইড করতে যায় সে সঙ্গে টাকা নেয় না।

মানছি। কিন্তু দাদা তো সুস্থ সবল নয়। হয়তো রাস্তায় বিপদে পড়ে যাবে।

বিরক্ত বিলু বলে, তার আমি কী করব বলো তো?

কিছু করতে হবে না। আমরা চারদিকে হাল্লাক ফেলে দিয়েছি। দু-চারদিনের মধ্যেই খবর এসে যাবে। যতদিন খবর না পাই ততদিন তুমি থাকো। নইলে পাঁচজনের চোখেই যে খারাপ দেখাবে।

লোকনিন্দার কথাটা রাগের মাথায় ভেবে দেখেনি বিলু। এখন ভাবল। লুকিয়েই থাক, আর যা-ই হোক, এই অবস্থায় তার কলকাতায় চলে যাওয়াটা খুবই বিসদৃশ।

বিলু অসহায় মুখে বলে, আমার যে ছুটি নেই!

ছুটি বউদি!—খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ শতম হেসে ফেলে, ছুটি নেই! হায় ঠাকুর, দুনিয়ায় ছুটি নেইটাই সবচেয়ে বড় কথা হল? দাদা যে নেই সেটা কিছু নয়?

বিলু এইসব খোঁচালো কথা সহ্য করতে পারে না। তবে এ সময়ে ঝগড়াও করল না সে। সে চুপচাপ চলে এল নিজের ঘরে।

লাবু ঘুম থেকে উঠে কেমন পাথরের মতো বসে আছে। অস্বাভাবিক একটা স্থিরতা। চোখ দুটোর পলক পড়ছে না। দাঁত দিয়ে খুব জোরে নীচের ঠোঁটটাকে কামড়ে রেখেছে। চোখের দৃষ্টি খানিকটা শূন্যতায় ভরা। কিছু দেখছে না।

বিলু তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে লাবুকে কোলে টেনে নিয়ে বলে, কী হয়েছে লাবু, শরীর খারাপ নয়তো!

লাবু অবাক হয়ে মাকে একটু দেখল। তারপর হঠাৎ শরীরে ঢেউ দিল তার। ঠোঁট কেঁপে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে হিক্কা তুলে সে বলল, বাবার জন্য ভীষণ মন কেমন করছে মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *