দাঁড়াও আমার আঁখির আগে–
প্রথম পঙক্তিটি আসে আকাশ থেকে সহসা অশনিপাতের মতন। কোনও পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, মনের গহন কোণেও যেন এই চিন্তার অস্তিত্ব ছিল না। পর পর ঠিক এই চারটি শব্দ আগে কেউ সাজায়নি, যদিও কোনও শব্দই নতুন নয়।
বজরার জানলা দিয়ে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়, চৈত্র মাসের রাত্রির আকাশ প্রায় পরিষ্কার, তবে এখনও চাঁদ ওঠেনি, কয়েকটি তারা ফুটেছে, অমাবস্যা গেছে ক’দিন আগে। এই তরল আঁধারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায় পৃথিবীর অস্তিত্ব। শোনা যায় জলের ছলছল শব্দ।
অন্যমনস্কভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কদিন ধরেই রাত্তিরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর তিনি কুঠিবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন বজরায়, এখানে একা থাকেন। অন্যদের তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেও রাত্রি-জাগরণ তাঁর অভ্যেস। একা বসে থাকেন চুপ করে, হঠাৎ কেন যেন মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
মানুষের মন কী? নিজের মন কি নিজের বশীভূত নয়? তা কি লাগামছাড়া হয়ে যেমন খুশি রূপ নিতে পারে? রবীন্দ্রনাথ নিজের মনকে সব সময় দমন করতে চান। স্বপ্নের কথা আলাদা, জাগ্রত সময়ে মন আর চেতনা এক পথে চালিত হবে। বিশেষত যে মন খারাপের কারণ বোঝা যায় না, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। অল্প বয়সের সেই ভাবালুতা, সেই যখন তখন মন খারাপের উপভোগ, সে সব দিন কবে শেষ হয়ে গেছে। এখন কত দায়িত্ব, কত ব্যস্ততা, এর মধ্যে মন খারাপ যেন অবাঞ্ছিত বিলাসিতা।
হ্যাঁ, দুশ্চিন্তার অনেক কারণ থাকতে পারে, আছে, কিন্তু দুশ্চিন্তা আর মন খারাপ তো এক নয়। শোকতাপের সঙ্গেও এ রকম মন খারাপের কোনও সম্পর্ক নেই। দুশ্চিন্তা বা শোকের কারণগুলি অতি প্রত্যক্ষ।
মন খারাপের সঙ্গে শরীর খারাপের সম্পর্ক আছে? হা, কিছুদিন ধরেই শরীর বেশ খারাপ। প্রায় প্রতিদিনই জ্বর হচ্ছে। একটা গুরুতর রোগের আশঙ্কা জমছে আস্তে আস্তে। একজন স্পেশালিস্ট দেখানো দরকার, কিন্তু তার সময় কোথায়! জ্বরের জন্য শরীর দুর্বল লাগে, তা কারুকে জানানো হয়নি। পুরুষ মানুষের অসুখের কথা মা এবং স্ত্রীর কাছে লুকোনো যায় না। দু জনের কেউই নেই।
না, ঠিক শরীর খারাপের জন্যও নয়। এর চেয়ে আরও বেশি শরীর খারাপ তুচ্ছ করে রবীন্দ্রনাথ অনেক কাজের মধ্যে ব্যাপৃত থেকেছেন, অথচ এবারে শিলাইদহে আসার পর থেকেই মনটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আছে। বিশেষত সন্ধের পর আর কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয়, এই যে এত কমোদ্যোগ, এত দায়িত্ব, এ সবই যেন তুচ্ছ। কী হবে এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থেকে? যদিও কেউ তাঁর ওপর জোর করে এই সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়নি, সবই তাঁর স্বকৃত, এসব তাঁর ভাল লাগে। ভাল লাগে, তবু এক একসময় মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিতে, এই বৈপরীত্বের জন্য দায়ি ওই মন খারাপ!
মাত্র গতকালই যেন এর কারণটা তাঁর কাছে কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। অল্প বয়েসে কোনও বিশেষ নারীর প্রতি আকুলতায় মন খারাপ হত। প্রেম নামে একটা বায়বীয় ধারণায় মত্ত হয়ে থাকা যেত সারাক্ষণ। এখন সে সব কোথায়! ইদানীং তাঁর জীবন নারী বর্জিত। এমনকী কৌতুক-হাস্য পরিহাস করার মতনও কেউ নেই। সেই জন্যই কি দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, একটাও কবিতা লেখা হচ্ছে না। একটা নতুন গানের লাইন গুনগুন করে না মাথার মধ্যে। কবিতা আর গান জীবন থেকে বাদ হয়ে গেলে তিনি যেন আর আসল মানুষ থাকেন না। একটা নকল মানুষের মতন কাজ করে যান।
গতকাল খাতা-কলম নিয়ে লিখতে বসেছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, কলম হাতে ধরা রইল। মাথা জুড়ে রইল রাজ্যের চিন্তা। যে-মানুষের কলম হাতে এলেই অনর্গল লেখা হয়ে যায়, একই দিনে পাঁচ ছ’টি কবিতা-গানও লিখে ফেলেছেন অনেকবার, সেই মানুষটি একটি লাইনও লিখতে পারলেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, এক সময় বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লেন, তারপর অনেকক্ষণ ঘুম এল না।
আজ আর লেখার সরঞ্জাম নিয়েই বসেননি। মন প্রস্তুত না হলে মিছে এই বিড়ম্বনা। আর কোনওদিনও কি কবিতা লিখতে পারবেন? যদি বাগদেবী বিমুখ হন, তার পরেও কি বেঁচে থাকতে হবে? এক একজন মানুষের জীবনের এক এক রকম আনন্দ ও পূর্ণতা বোধ থাকে। এক দিকে জমিদারি পরিচালনা, আর এক দিকে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য হয়ে থাকাই কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের পূর্ণতা! যখনই একা হয়ে থাকেন, তখনই কি তাঁর মনে হয় না, কবিতা রচনাতেই তার প্রধানতম আনন্দ? ‘ভাল যদি বাসো সখি, কী দিব গো আর–কবির হৃদয় এই দিব উপহার’, এ গান কে রচনা করেছিল?
জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু এই ধরণী যেন তাঁর দিকেই চেয়ে রয়েছে।
এক সময় এসে গেল সেই পঙক্তি : ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’!
মন খারাপের যেমন কারণ থাকে না, স্বপ্নের যেমন যুক্তি নেই, তেমনি শিল্প সৃষ্টিরও উৎস বোঝ যায় না। কেউ কোথাও নেই, তবু মনে এল, দাঁড়াও আমার আঁখির আগে। এখানে প্রতিটি শব্দ অমোঘ। ‘আঁখির আগে’র বদলে নয়ন সমুখে হতে পারে না।
এর পরের পঙক্তিটি কী? ভাবতে হল না, সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেল, ‘তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে’। এর আগে কি একটা যেন দিলে ভাল হত? না, দরকার নেই। ‘দৃষ্টি’ শব্দটা আছে বলেই তার পরে ‘হৃদয়ে দিতে হয়েছে। এখানে ‘হৃদয়ে’র বদলে ‘মরমে’ চলে না।
রবীন্দ্রনাথ আকাশের দিকে তাকালেন। এর মধ্যে চাঁদ উঠেছে, অন্ধকারকে অনেকখানি ধবল করে ফেলেছে জ্যোৎস্না।
তৃতীয় পঙক্তিটি চিন্তা করার আগেই একটা নিছক বাস্তব চিন্তা তাঁকে আঘাত করল। আজ একটি ছাত্রের জ্বর এসেছে, তার আবার বসন্ত রোগ দেখা দিল না তো! রবীন্দ্রনাথ নিজের জ্বরের চেয়েও ছাত্রদের জন্য বেশি উদ্বিগ্ন।
শান্তিনিকেতন থেকে বিদ্যালয়টি তুলে আনা হয়েছে শিলাইদহে। এখানেও নানা রকম আশঙ্কার অবধি নেই।
মৃণালিনীর মৃত্যু নিয়ে বিশেষ শোক করার অবকাশই পাননি রবীন্দ্রনাথ। তখন রেণুকাকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল প্রধান কাজ। মৃতদের থেকে জীবিতের দাবি বেশি। বরাবরই শীর্ণ আর দুর্বল রেণুকা, কিন্তু মনটি সূক্ষ্ম, অনুভূতিপ্রবণ, তার দিকে তাকালেই মায়ায় বুক টনটন করে ওঠে। যতই অর্থসংকট থাক, তবু রেণুকার চিকিৎসার জন্য কার্পণ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ। চিকিৎসকরা হাওয়া বদলের পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাই সদলবলে রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছিলেন আলমোড়ায়। জামাতাটি অপদার্থ, তাকে দিয়ে তো কোনও সাহায্যই হয় না, বরং তার জন্যও অর্থ ব্যয় করতে হয়। পাহাড়ে গিয়েও রেণুকার জ্বর কমেনি, কাশি কমেনি। এক সময় সে নিজেই ফিরে যেতে চাইল।
এমনই ব্যাধি, যার কোনও ওষুধ নেই। শরীরটা একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যায়। গায়ে বোদ লাগলে উপকার হতে পারে শুনে রবীন্দ্রনাথ বাড়ির ছাদে মেয়ের জন্য একটা কাঁচের ঘর বানিয়ে দিলেন। সেখানে তিনি মেয়ের পাশে বসে থাকতে চান, রেণুকাই তাতে আপত্তি করে, সে বারবার তাড়া দিয়ে বলে, বাবা, তোমার কত কাজ, তুমি যাও, তুমি আমার জন্য সময় নষ্ট কোরো না।
রেণুকা টের পেয়ে গিয়েছিল, তার সময় আর বাকি নেই। একদিন সে বাবার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলেছিল, বাবা, ওঁ পিতা নোহসি বলো। আমার কানে কানে শোনাও।
সেই দিনই সে চলে গেল। শেষের দিকে তোবোঝাই গিয়েছিল যে তাকে আর ধরে রাখা যাবে, বরং সে কষ্ট পাচ্ছে দেখে কারুর কারুর মনে হয়েছিল, তার চলে যাওয়াই ভাল। ক্ষয় রোগ ছোঁয়াচে, অন্য ছেলে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য পরিশুদ্ধ করা হল সারা বাড়ি।
সন্তান বিয়োগের ব্যথা কারুকে বোঝানো যায় না। অনেকেই অবাক হয়েছিল, রেণুকার মৃত্যু তার পিতা এমন শান্তভাবে মেনে নিলেন কী করে? এ যেন বিধাতার অভিপ্রায় জেনে তার জন্য শোক করতে নেই। বরং এর পরেই সতীশের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ বেশি উতলা হয়ে পড়লেন।
সতীশচন্দ্র রায়ের মতন এমন প্রাণবন্ত যুবা, সর্বক্ষণ কত রসে মাতোয়ারা, রবীন্দ্রনাথের এত বড় ভক্ত কমই আছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পাবার জন্য সে স্বল্প বেতনে শিক্ষক হয়ে যোগ দেয় শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে। শিক্ষক হিসেবেও সে একটি অমূল্য রত্ন, ছাত্রদের সঙ্গে তার বন্ধুর মতন সম্পর্ক, ক্লাসের বাইরেও সে ছাত্রদের কত বই পড়ে শোনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই রকম শিক্ষকই চান। সতীশ রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি রচনা নিয়ে উৎসাহে লাফালাফি করে, নিজেও সে ভাল কবিতা লেখে, সেই সতীশ কোথা থেকে বসন্ত রোগ বাধিয়ে এল। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায়। সতীশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজিতকুমার চক্রবর্তী সতীশের সেবা করার জন্য শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন অজিতকে তিনিই সঙ্গে নিয়ে যাবেন। যাবার আগে দু একটা কাজ সেরে নিতে হবে।
দেরি হয়ে গেল, তাতেই খুব দেরি হয়ে গেল। বসন্ত রোগের প্রকোপ যে কী সাংঘাতিক হতে পারে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি। শেষ দেখাও হল না, ওঁরা পৌঁছবার আগেই সতীশ শেষ বারের মতন অজিত অজিত বলে আর্ত চিৎকার করে ঢলে পড়ল। রেণুকা চলে গিয়েছিল ভাদ্র মাসে, সতীশ গেল মাঘ মাসে।
অজিত বন্ধুর ওই আকুল আহ্বানের কথা শুনে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শোক করার সময় নেই। তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু এরই মধ্যে এখান থেকে সব কটি ছাত্রকে সরাবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। পরের বাড়ির ছেলে সব, বাপ-মা ভরসা করে পাঠিয়েছে, একবার যেখানে বসন্ত রোগ ঢোকে সেখানে সংক্রমণের পুরোপুরি সম্ভাবনা থাকে।
স্কুল বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তাই ছাত্র ও শিক্ষকদের আনা হয়েছে শিলাইদহে। বীরভূমের রুক্ষ মাটির বদলে পদ্মা পারের এই বৃক্ষময় দেশে এসে ছাত্ররা খুব ফুর্তিতে আছে। এত বড় নদীও তারা দেখেনি। রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন, আশ্রম-বিদ্যালয়টিকে শান্তিনিকেতন থেকে পাকাঁপাকিভাবেই সরিয়ে নেওয়া যায় কি না। শান্তিনিকেতনের জমি তাঁর নিজস্ব নয়, দেবেন্দ্রনাথের সম্পত্তি। তাঁর অন্য ভাই ও ভ্রাতুস্পুত্ররা কেউ কেউ সেই সম্পত্তির দাবিদার মনে করে, সেই হেতু বিদ্যালয়টির ওপর অযাচিত খবরদারি করারও যেন তাদের অধিকার আছে। দু-একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার এর মধ্যে ঘটে গেছে।
এর মধ্যে শিলাইদহের কাছাকাছি গ্রামেও বসন্ত রোগ শুরু হয়ে গেছে। যে-কোনও সময় এই রোগ মহামারীর রূপ ধারণ করতে পারে।
জ্বরাক্রান্ত ছেলেটির কথা চিন্তা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ আবার মন ফেরালেন। এতদিন পর আবার মাথায় কবিতা আসছিল, এখন অন্য চিন্তা থাক না। ছেলেটির শুধু জ্বর হয়েছে। আর কিছু না। বাচ্চাদের তো জ্বরজারি হয়ই মাঝে মাঝে।
আকাশের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই এসে গেল পরের কয়েকটি পঙক্তি :
সমুখ-আকাশে চরাচরলোকে
এই অপরূপ আকুল আলোকে
দাঁড়াও হে…
‘আকুল আলোকে’ কি ঠিক হল? অপরূপ-এর পর আবার দুটি অ দিয়ে শব্দ। কয়েকবার পঙক্তি দুটি উচ্চারণ করলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠিকই শোনাচ্ছে, আকুল শব্দটি এখানে দরকার। কুল কিনারাহীন এই আলোর ব্যপ্তি।
এটা কবিতা, না গান? মনের মধ্যে একটু একটু বেহাগের সুর এসে যাচ্ছে। যেন গান হওয়াই এর দাবি। দাঁড়াও, আমার আঁখির আগে…না, কমা দেবার দরকার নেই। সে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি!
আবার বাধা পড়ল, কে যেন ডাকল, গুরুদেব, ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি?
সেরেস্তার কর্মচারীরা সবাই জানে, রাত্রে জমিদারমশাই লেখালিখি করেন, সে জন্য কেউ কোনও কাজের কথা নিয়েও বিরক্ত করতে আসে না। কিন্তু শান্তিনিকেতন থেকে যে শিক্ষকরা এসেছেন, তাঁরা জানেন না।
কোনও দুঃসংবাদ এসেছে ভেবে রবীন্দ্রনাথ তড়িঘড়ি বাইরে চলে এলেন।
ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল নামে শিক্ষকটি বললেন, গুরুদেব একটা খবর দিতে এলাম—
ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, আপনি এই আশ্রমের গুরুদেব। সবাই আপনাকে গুরুদেব বলেই সম্বোধন করবে। কিন্তু তখন তা বিশেষ চলেনি। সতীশ এসে গুরুদেব বলা শুরু করেছিল। ছাত্রদেরও সে বলত, তোমরা ওঁকে কী বলে ডাকবে? রবীন্দ্রবাবু তোমাদের মুখে মানায় না, তোমাদের রবীন্দ্রদাদাও হতে পারেন না। আর রবীন্দ্ৰকাকা কিংবা রবীন্দ্রজ্যাঠাও বিদঘুঁটে শোনাবে। তোমরা সবাই বলবে গুরুদেব! এখন সেই ডাকটিই চালু হয়ে গেছে। তাই শুনে বন্ধু প্রিয়নাথ সেন রবীন্দ্রনাথকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, সে কী, ছিলে কবি, হয়ে গেলে গুরুদেব? কবিকে কি গুরুর ভূমিকায় মানায়? এর পরে প্রণয় কাব্য লিখবে কী করে? মেয়র
রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে? ছেলেদের কারুর–
ভূপেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে না। ছেলেরা সব ঠিকই আছে। তবে মোহিতবাবু নদীর ঘাটে পা ধুতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছেন। খুব কাতরাচ্ছেন। বোধহয় পা ভেঙেছে।
রবীন্দ্রনাথ শুধু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন না, হাসলেন পর্যন্ত। এই নিয়ে তিনজন হল। ছাত্রদের নিয়ে উদ্বেগ থাকার কথা, তার বদলে শিক্ষকরাই নানান কাণ্ড ঘটাচ্ছেন। নদী-নালার দেশে ঘোরাফেরার অভ্যেস নেই, এর আগে আরও দু জন শিক্ষকের পা মচকেছে। পদমর্যাদার প্রতি শিক্ষকদের এই অবহেলা মোটেই স্বাভাবিক নয়।
মোহিতবাবুর পা ভেঙেছে না মচকেছে তা দেখার জন্য এই রাত্রে রবীন্দ্রনাথের ছুটে যাবার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। আপাতত তিনি নিজেই নিজের পদদেবা করুন। এই কথাটা বুঝিয়ে দেবার পরও ভূপেন্দ্র নড়লেন না। তাঁর বোধহয় ব্যাঙ ও ঝিঁঝির ডাকে ঘুম আসছে না। তিনি একটু গল্পগুজব করতে চান। শুরু করলেন, এ কথা সে কথা।
রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই কারুকে চলে যেতে বলতে পারেন না। কারুকেই বলতে পারেন না, এখন আমি ব্যস্ত আছি, আপনি পরে আসবেন। এমনই তাঁর সৌজন্যবোধ যে অতি তুচ্ছ, অকিঞ্চিকর কথাবার্তা শোনার সময়েও সামান্য বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে না তাঁর মুখে। এখন তার মনের মধ্যে যে একটি অসমাপ্ত কবিতা পাখির মতন ছটফট করছে, সে কথা কী করে এই ব্যক্তিকে বোঝাবেন!
ভূপেন্দ্র বাজারদর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যন্ত নানা কথা বলে যেতে লাগলেন, রবীন্দ্রনাথ, তাই তো, সে তো বটেই বলে দায় সারছেন। এক সময় ভূপেন্দ্র বললেন, আচ্ছা গুরুদেব, ইংরেজরা যে এই বাংলাকে ভাগ করতে চলেছে, এতে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে না! আপনি কী মনে করেন?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, সে বিষয়ে তো আর উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। মনে হয়, ইংরেজ সরকার ভুল বুঝতে পেরেছেন। লর্ড কার্জন ইংল্যান্ডে রয়েছেন, আর তো বঙ্গভঙ্গের সম্ভাবনা দেখি না। ও বিষয়ে উত্তেজিত না হয়ে এখন আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি বোধহয়।
শেষ ইঙ্গিতটি বুঝতে পেরে ভূপেন্দ্র নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।
নিজের কক্ষে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু কবিতাটি এর মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে গেছে। লাইনগুলি মনেই পড়ছে না। কাগজে লেখেননি, মনে মনে রচনা করছিলেন, তবে কি চিরতরে হারিয়েই গেল? না, অনেক সময় আবার ফিরে আসে। দাঁড়াও আমার আঁখির আগে, এই প্রথম লাইনটি মনে গেঁথে গেছে, পরে কবিতাটা আবার লিখতে হবে।
এবার তিনি একতাড়া কাগজ ও কলম নিয়ে বসলেন। কবিতা অতি সূক্ষ্ম শিল্প, জোর করে লেখা যায় না। গদ্য তবু সম্ভব। বঙ্গদর্শনের জন্য নৌকাডুবি উপন্যাসের কিস্তি লেখা যে বাকি পড়ে যাচ্ছে।
লিখতে লিখতে লেখার টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন এক সময়। হ্যাঁজাক বাতিটা জ্বলতেই লাগল এক পাশে।
পরদিন সকালেই খবর পাওয়া গেল, সেই ছাত্রটির জ্বর কমেনি, মুখে বসন্তের গুটি উঠেছে। তা হলে আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। অচিরেই পাততাড়ি গুটিয়ে দলবল নিয়ে ফিরতে হবে কলকাতা।