2 of 2

৭২. এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলি

এলাহাবাদের সেই বাঙালি ছেলেগুলির কথা মতন সূর্য আগ্রায় যে-হোটেলটাতে উঠেছিল, সেটা একটা গোলমালের জায়গা। বহু পুরনো আমলের বাড়ি এবং অনেক পুরনো পাপ সেখানে বাসা বেঁধে আছে।

সূর্যকে দেওয়া হয়েছে তিনতলার একটি ঘর। ঘরটি ছোট হলেও মোটামুটি পরিষ্কার। জানলা দিয়ে বাইরের অনেকখানি দৃশ্য দেখা যায়। ঘরে একটা পাখা আছে, বিছানায় ধপধপে সাদা চাদর। তবু বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না, এত অসহ্য গরম।

সূর্য তাজমহল থেকে ফিরেছে বেশ রাত করে, আসবার পথেই খেয়ে নিয়েছে। টাঙ্গা নিয়ে সে একবার ইতমদৌল্লার দিকে গিয়েছিল, কিন্তু রাত্রে সেখানে কিছুই দেখার নেই। রাত্রে আর কিছু করবারও নেই তার, পুরনো আগ্রার পথে অধিক রাত পর্যন্ত মানুষজন দেখা যায়, অনেক দোকানপাট খোলা, কোনও কোনও জায়গা থেকে হইহল্লার আওয়াজ ভেসে আসে, কিন্তু যে-মানুষ কারোকে চেনে না, সে আর কোথায় যাবে! হোটেলে ফিরে এসে একটা ইংরেজি উপন্যাস খুলে শুয়েছিল সে।

কিন্তু বইতে মন বসানো অসম্ভব। ঘামে বিছানার চাদর ভিজে যায়। শরীরে যেন সহস্র সুঢ় বিদ্ধ হচ্ছে। একসময় অসহ্য বোধ হওয়ায় সূর্য বই মুড়ে রেখে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল।

এ-বাড়ির গঠন একটু অদ্ভুত ধরনের। চৌকো মতন একটা বড় উঠোনের চারদিকে ঘর, প্রত্যেক ঘরের সামনে দিয়ে অর্থাৎ উঠোনের দিকে রয়েছে টানা বারান্দা, বাইরের দিকে কিছু নেই। প্রত্যেক তলাতেই উঠোনের ওপর অংশটা লোহার শিক দিয়ে ঢাকা। সেই লোহার শিকের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করা যায় স্বচ্ছন্দে, এর ওপরে দাঁড়ালে একতলা পর্যন্ত দেখা যায়। হোটেলের ছোকরা চাকররা অনেক সময় ওখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে একতলার কারোকে ডাকে।

এখন গরমের জন্য অনেক ঘরের বাসিন্দাই বাইরে এসে বসেছে, কেউ কেউ বিছানা পেতেছে সেই লোহার শিকের ওপর। বাইরেও গরম কম নয়, তবে, ঘরের মধ্যে যেমন একটা পোড়া পোড়া ভাব–এখানে সেটা অন্তত নেই।

গেঞ্জি আর পাজামা পরে সূর্য উঠোনের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। একটুখানি স্বস্তি পেল যেন।

পূর্ণিমার রাত্রি, মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে, ঝকঝকে নীল আকাশ–কিন্তু এত অসহ্য গরমের জন্য সৌন্দর্য দেখার দিকে কারওর মন নেই।

সূর্য একবার ভাবল, বেয়ারাকে ডেকে তার বিছানাটা বাইরেই পাততে বলবে কিনা। এখনও অনেকটা জায়গা আছে। কিন্তু দ্বিধা করতে লাগল। সে একা-চোরা স্বভাবের ছেলে, এত লোকের পাশাপাশি শুতে তার ইচ্ছে নেই। কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল রেলিংয়ে ভর দিয়ে।

অনেকেই এখনও জেগে আছে। কোনও বাংলা কথাবার্তা শুনতে না পেয়ে সে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। এখন কারওর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার ইচ্ছে নেই তার। সন্ধ্যা থেকেই মনটা ভারী হয়ে আছে।

উঠোনের এক কোণে বসে জন চারেক লোক খুব খোলাখুলি ভাবেই মদ্যপান করছে। উঁচু গলায় হাসাহাসি করছে তারা। মাংসের হাড় চিবিয়ে লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে সেই হাড় একতলার কারওর মাথায় ফেলার চেষ্টা করা ওদের অন্যতম কৌতুক। হোটেলের বেয়ারারা ব্যস্ত হয়ে তাদের জন্য এনে দিচ্ছে ঘন ঘন সোডার বোতল এবং নানা রকম মাংস। লোকগুলির চেহারা ডাকাতের মতন, কিন্তু একজনের গানের গলা চমৎকার।

কাছাকাছি যারা শুয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে কয়েক জন নারী। কিন্তু এই মদ্যপানরত দলটি সম্পর্কে তারা ভ্রূক্ষেপহীন। শুয়ে-থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ মাঝে মাঝে এদের সঙ্গে রসিকতা বিনিময় করছে।

মাঝে মাঝে একটি যুবতী মেয়ে নীচতলা থেকে আসছে এখানে, মদ্যপানের দলটির পাশে দু-এক মিনিট বসে আবার চলে যাচ্ছে। মেয়েটির আঁটসাট স্বাস্থ্য, ঘাঘরা ও কাঁচুলি পরা, শরীরের দর্শনীয় ব্যাপারগুলি প্রকট করে তোলার ব্যাপারে যত্নশীল। মেয়েটি একটু বসেই চলে যাচ্ছে, আবার কয়েক মিনিট বাদেই ফিরে আসছে–তার এ রকম ঘন ঘন আসা-যাওয়ার অর্থ বোঝা যায় না।

সূর্য অপলক চোখ মেলে এইসব ব্যাপার লক্ষ করছিল। একসময় ঠিক ওই একই পোশাক পরা এবং প্রায় এক রকম চেহারার তিনটি মেয়েকে দেখে সে বুঝতে পারল, বার বার একটি মেয়েই আসেনি, এসেছিল বিভিন্ন জন।

এরা কারা? সে-সম্পর্কে সূর্যর কোনও কৌতূহল নেই। তবে, একটি মেয়ে যখন সূর্যর কাছেই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল এবং তার দিকে দুষ্টুমিভরা চোখে হাসল তখন সূর্যকে সচকিত হয়ে উঠতেই হল।

সূর্যও একটু হাসল। মেয়েটিকে সে চিনতে পেরেছে। তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও সে জানে, পৃথিবীতে এ রকম মেয়ের সংখ্যা দু-তিন কোটি তো হবেই? ভুরুর ব্যবহারেই এরা আত্মপরিচয় দেয়।

সেই মাতালের দলটি সূর্যকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বলল। রাগের কথা কিছু নয়। বোধহয় তারা সূর্যকে তাদের সঙ্গে যোগদান করতে আহ্বান জানাচ্ছে। বাকি দুটি মেয়েও বসে গেছে ওদের পাশে।

সূর্য হাত জোড় করে বলল, মাপ কিজিয়ে।

মেয়েটি এবার সূর্যর কাছ ঘেঁষে এসে বলল, আইয়ে?

সূর্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, মাপ কিজিয়ে।

তারপর হোটেলের একজন বেয়ারাকে কাছাকাছি দেখে সে গম্ভীর ভাবে ডাকল। তাকে বলল, বরফের একটা বড় চাই আনতে পারো?

এই ব্যাপারটা সূর্যর হঠাৎ মনে পড়েছে। হাজারিবাগে স্কুলে পড়ার সময় সে দেখেছিল, সেখানকার একজন ফাদার কিছুতেই গরম সহ্য করতে পারতেন না। তিনি গ্রীষ্মের দুপুরে তার ঘরে একটা মস্ত বড় বরফের চাই রেখে দিতেন পাখার ঠিক নীচে। তাতে হাওয়া খানিকটা ঠান্ডা হত। সূর্য আজ হোটেলে ঢোকার ঠিক মুখেই দেখেছে, বড় বড় বরফের চাই আঁকষি দিয়ে টেনে ভেতরে আনা হচ্ছে।

সূর্যর কথা শুনে বেয়ারাটি গাঁইগুঁই করতে লাগল। সূর্য ঘরে ঢুকে জামার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট এনে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুরন্ত।

মেয়েটি মুখে ফিকফিকে হাসি নিয়ে সূর্যকে দেখছিল তখনও। সূর্য আর সেদিকে তাকাল না। বেয়ারাটি বরফের চাইটা নিয়ে আসার পর সূর্য সেটাকে পাখার ঠিক সামনেই রাখল একটা টুলে। হাওয়াটা সোজাসুজি যাতে বরফের ওপর লাগে। তারপর সূর্য দরজা বন্ধ করে দিল।

পাখাটার কাছাকাছি দাঁড়াতেই একটু ঠান্ডা হাওয়া পাওয়া গেল এবার। বরফ গলে জল পড়ে সারা ঘরে ছড়াবে অবশ্য, তা ছড়াক! এতখানি বরফ গলতেও অনেক সময় লাগবে।

বাইরের মেয়েটির কথা ভাবতে গিয়েই ঝনঝন করে উঠল একটা কৈশোর-স্মৃতি। হাজারিবাগে স্কুলে পড়ার সময় রাত্তিরবেলা সে যখন কয়েকটি ছেলের সঙ্গে পালাত, হাজির হত একটা জুয়ার আড্ডায়, সেখানে একদিন একটি মেয়ে নাচ দেখিয়েছিল। ঠিক এই রকমই পোশাক, এই মেয়েটিরই জাতের আর একটি মেয়ে। একই রকম ভুরুর ভঙ্গি আর কাঁচুলি ঠেলে বেরিয়ে আসা স্তন।

কী উদগ্র কৌতূহল ছিল তখন সূর্যর। সেই কৈশোরে ওই রকম একটি মেয়ের শারীরিক রহস্য জানবার জন্য সে সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারত। আজকের এই মেয়েটির সেই রহস্যের দাম বড় জোর পাঁচ টাকা বা দশ টাকা, কিন্তু সূর্যর কোনও রকম চিত্তবিকারই হল না।

মেয়েটি তার কাছে এসে দাঁড়াবার মুহূর্ত থেকেই সূর্যর মনে পড়ছিল দীপ্তির কথা। তাজমহল কিংবা যৌবনবতী কোনও সুলভ নারী–সবকিছুই আড়াল করে দাঁড়াচ্ছে দীপ্তি। তার সেই সরল চোখ–যার দুর্বোধ্য ভাষা সূর্য পড়তে পারে না, চিবুকের দৃঢ় ভঙ্গি। সূর্য অত্যন্ত গভীর ভাবে জেনে গেছে যে, দীপ্তির সঙ্গে তার আর দেখা হবে না সে আর কখনও দীপ্তির কাছে ফিরে যাবে না। তবু, বার বার দীপ্তি এ রকম ভাবে চোখের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে কেন? সূর্য কি আর কোনও দিন সুন্দর কিছু উপভোগ করতে। পারবে না?

দীপ্তি একদিন বলেছিলেন, সূর্য, তোমাকে দেখার পর আমি একটা দায়িত্ব বোধ করি। আগে আমি অনেক স্বাধীন ছিলাম। যখন যা খুশি করতে পারতাম। এখন তোমার সঙ্গে দেখা করা কিংবা তোমার কাছে কথা রাখার ব্যাপারে আমাকে সব সময় চিন্তা করতে হয়।

সূর্য ভাবল, দীপ্তিদি কি এখনও তার সম্পর্কে সেই রকম দায়িত্বের কথা ভেবেই…।

সূর্য একটা ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ফেলল।

একটু পরে কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল। সূর্য আলো নেভায়নি, ঘরের দরজা খুলতেই দেখল, সেই রকম দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও কথা না বলে হাসছে মিটিমিটি।

সূর্য ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী?

মেয়েদুটি একজন ঠ্যালা দিল আরেকজনের গায়ে। ওদের দেখে মনে হয় যমজ। ওদের হাসি ও শরীরভঙ্গির মধ্যে যেন নাচের মুদ্রা আছে।

একজন উর্দু-হিন্দি এবং আশ্চর্যের বিষয়, খানিকটা বাংলা মিশিয়ে বলল, বাবুজি যে আশ্চর্য বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই গরমের মধ্যে বরফের হাওয়া খাচ্ছেন, ওরাও কি একটুক্ষণের জন্য সেই হাওয়া খেতে পারে? স্রেফ পাঁচ মিনিটের জন্য?

সামান্য একটু চিন্তা করে সূর্য বলল, আইয়ে ভিতরমে।

মেয়েদুটি ঘরে ঢুকে পাখার সামনে দাঁড়াল। সূর্য খাটে শুয়ে আবার গল্পের বইটা খুলল।

সূর্য মাঝে মাঝে বই থেকে চোখ তুলতেই দেখতে পাচ্ছে, মেয়েদুটি তাকিয়ে আছে। তার দিকেই। চোখাচোখি হতেই ওরা হাসছে, যে-হাসিতে স্পষ্ট আহ্বান। সূর্য গম্ভীর হয়ে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।

ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। সূর্য ভাবছে, মেয়েটিকে এবার ঘর থেকে চলে যেতে বলা উচিত, কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারছে না। আর মেয়েদুটিরও হাওয়া খাওয়ার বিরাম নেই। টেবিল ফ্যানের জোরালো হাওয়ায় উড়ছে ওদের ঘাঘরা, এবং দুষ্টুমি করে ওরা ব্লাউজ টেনে ধরে বুক জুড়োচ্ছে। সূর্যর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, ওরা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।

একটু পরেই সূর্যর মনে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হল। সে রূপপিপাসী, মেয়েদুটির ভরাট শরীরের দিকে তাকাতে তার যে ভালো লাগছে, একথা অস্বীকার করতে পারবে না। ওদের ফুরিত ওষ্ঠ, সুগোল স্তন এবং সুগঠিত ঊরুর দিকে বার বার তার চোখ চলে যাচ্ছে। কিন্তু, একথাও ঠিক, ওদের শয্যাসঙ্গিনী করার একটুও ইচ্ছে জাগছে না তার। সূর্যর নীতিবোধ নেই, নারীসঙ্গ পেলে সে স্পষ্টত উৎফুল্ল হয়, তবু তার লোভ জাগছে না কেন? ওরা এত সুলভ বলে? এ-পর্যন্ত যে ক’টি নারীর গায়ে সূর্য হাত ছুঁইয়েছে, সব জায়গাতেই জোর করতে হয়েছে তাকে।

আর একটা জিনিসও বোঝা যাচ্ছে না, দুটি মেয়ে একসঙ্গে এসেছে কেন? মেয়েদুটি যেন যমজ, একই রকম চেহারা, একই রকম পোশাক, মুখদুটি অবশ্য সামান্য আলাদা। বাইরে যে আর একটি মেয়ে রয়েছে, তাকেও এদেরই মতন দেখতে। যদি এদের তিন জনের মধ্যে যে-কোনও এক জনকে বেছে নিতে হয়, তা হলে লটারি করতে হবে।

আর একবার চোখ পড়তেই একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপ কঁহাসে আ রাহা হ্যায়?

সূর্য গম্ভীর ভাবে বলল, কলকাতা!

মেয়েটি তখন জানাল যে সূর্যকে দেখলেই বোঝা যায় বাঙ্গালিবাবু। বাঙ্গালিবাবুরা এখানে অনেক আসে। তাদের দিল খুব ভালো হয়।

মেয়েটি এগিয়ে এসে সূর্যর খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তার ভাবখানা এই যে, আমাকে আপনার পছন্দ হচ্ছে না? অন্য মেয়েটি দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

সূর্য বলল, এবার আপনারা বাইরে যান। আমি এবার ঘুমোব।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে দারুণ লজ্জিত হয়ে পড়ল। নানা রকম ভাবে দুঃখ জানিয়ে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল, ছি, ছি, ছি, তাদের বিষম অন্যায় হয়ে গেছে। সাহেব ঘুমোবেন জানলে তারা মোটেই হাওয়া খেতে আসত না।

মেয়েদুটি ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সূর্য এবার উঠে দরজা বন্ধ করতে যাবে, এর মধ্যেই পুরো মদ্যপায়ী দলটা এসে দাঁড়িয়েছে তার দরজার কাছে। প্রত্যেকের হাতেই গেলাস। একজন বলল, সাহেব নাকি হাওয়া ঠান্ডা করার একটা কল। বানিয়েছেন? বাঃ, বেশ আজিব কায়দা তো!

তারা অনুমতি নেবার অপেক্ষা করল না। সকলে ঢুকে এল ঘরের মধ্যে। বরফের চাইটার সামনে দাঁড়িয়ে তারা বলল, হ্যাঁ, প্রত্যেক ঘরেই এ রকম বন্দোবস্ত করা উচিত। যা গরম আজ!

ওদের সঙ্গে যে তৃতীয় মেয়েটি ছিল, সে এসে সরাসরি বসে পড়ল সূর্যর খাটের ওপর। তার হাতের মদের গেলাসটা সূর্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপ পিতে নেহি?

সূর্য দু’দিকে মাথা ঝাঁকাল।

একজন পুরুষ লঘু গলায় জিজ্ঞেস করল, কেয়া সাব, বেড়াতে এসেছেন তাও একটু ফুর্তিটুর্তি হবে না?

সূর্য এখন রীতিমতন বিরক্ত বোধ করছে। এই লোকগুলোকে এখন ঘর থেকে তাড়ানো যায় কী করে? কত রাত পর্যন্ত এই মাতালের হল্লা চলবে? মেয়ে তিনটির সঙ্গে এই লোকগুলোর সম্পর্ক কী? এদের তো কোনও রকম লজ্জাশরমের ব্যাপার নেই দেখা যাচ্ছে। কালকেই হোটেল পালটাতে হবে।

সূর্য বুঝতে পারছে, এত মাতালের সঙ্গে রাগারাগি করে কোনও লাভ নেই। হোটেলের ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করা যায়, কিন্তু ম্যানেজার কি জানে না যে তিনতলায় এই কাণ্ড চলছে?

খাটের ওপর বসা মেয়েটি তার ব্লাউজ ফাঁক করে ফুঁ দিচ্ছে ঘামে-ভেজা বুকে। তার তকতকে মসৃণ পেট ও নাভির দিকে সূর্য কয়েক বার তাকাল। মাত্র কয়েকটি টাকা দিলেই মেয়েটি বাকি বস্ত্র খুলে ফেলবে। সুগঠিত নারী শরীর দেখতে ভালো লাগে। সূর্যর মনের একটা অংশে সেই ইচ্ছেটা প্রবল, আবার মনের অন্য অংশে একটা ঘৃণা জাগছে এদের সম্পর্কে।

সূর্য মৃদু গলায় মেয়েটিকে মিনতি করে বলল, আমি খুব ক্লান্ত, আমার ঘুম পাচ্ছে, তোমরা এবার বাইরে যাবে?

এই মেয়েটিও খুব লজ্জা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এদের নির্লজ্জতা এবং লজ্জা, দুটোই খুব অদ্ভুত। শারীরিক আমন্ত্রণ জানাবার ব্যাপারে এদের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই, আবার একটি মাত্র কথাতেই এরা হঠাৎ অনুতপ্ত হয়ে পড়ে।

মেয়েটি উঠে গিয়ে মাতালগুলোকে ধমক দিয়ে বলল, আরে চলো, চলো, শিগগির বাহার চলো, সাহেবের ঘুম পেয়েছে!

মাতালের দল সূর্যর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল ঘর থেকে। সূর্য দরজার খিল তুলে দিল। তৎক্ষণাৎ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল খাটে।

কিন্তু বহুক্ষণের মধ্যেও তার ঘুম এল না। ওই মেয়ে তিনটির শরীর তাকে বিরক্ত করছে। বিশেষত তৃতীয় মেয়েটির বুকে ফুঁ দেওয়ার দৃশ্যটা বার বার ভেসে উঠছে তার চোখে। সে জোর করে ছবিটা মুছে দিতে চাইছে। আবার, এটা ভুলতে চাইলে যা মনে পড়ছে, সেটা যে বড় দুঃখের। জলপাইগুড়ির আশ্রমে থাকার সময়ে দীপ্তিদি কোনও দিন সূর্যর কাছাকাছি আসেননি, কোনও দিন একটুও প্রশ্রয় দেননি। তবু শেষের দিকে একদিন তিনি বলেছিলেন, সূর্য, এক এক দিন আমার ইচ্ছে করত, মাঝ রাত্রে উঠে তোমার ঘরে চলে যাই, তোমার শিয়রের পাশে বসি, তোমার ঘুমন্ত মুখে হাত রাখি কত কষ্ট করে যে নিজেকে দমন করেছি–! কথাটা মনে পড়তেই সূর্যর শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল।

দীপ্তিদি সত্যি যদি কোনও দিন মাঝ রাত্রে আসতেন তার কাছে, বসতেন শিয়রের পাশে–তা হলে সূর্যর জীবনটা যেন ধন্য হয়ে যেত। সূর্য দু হাত তুলে শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরল। ঠিক এই রকম ভাবে দীপ্তিকে সে নিজের বুকের মধ্যে–

না, এ ভাবে চিন্তা করা ঠিক হচ্ছে না। সূর্য মাথা ঠান্ডা করল। দীপ্তিদি আর কোথাও নেই, কোনও দিন ছিল না। সেটা অন্য জীবন। এই তিনটি মেয়ের যে-কোনও একজনের, সঙ্গে দীপ্তিদির তফাত কী? এই মেয়েগুলিরও শরীরে যৌবন আছে, আনন্দ করার স্পৃহা আছে। তৃতীয় মেয়েটির কথাই ধরা যাক, যে বুকে ফুঁ দিচ্ছিল, তাকে পাশে নিয়ে শুয়ে সূর্য কেন আনন্দ পাবে না? ওর শরীরটা সুন্দর, সুন্দর শরীরই তো উপভোগের, তবু সূর্য কেন ওকে ডাকতে পারল না?না, লজ্জা নয়, অন্য রকম বাধা ছিল। আর, দীপ্তিদি এখানে নেই, সূর্যর জীবনেই আর নেই, তবু তার জন্য এখনও এত কাতরতা রয়ে গেছে কেন? এরই নাম ভালোবাসা? পৃথিবীতে এত সুলভ নারী আছে, অথচ যাকে ভালোবাসা যায়, সেই সবচেয়ে দুর্লভ হয়ে ওঠে কেন?

দীপ্তিদি সহজে তার শরীর স্পর্শ করতে দিতেন না, কলকাতায় সেই অদ্ভুত দুরন্ত দিনগুলিতেও। কখন কে দেখে ফেলবে এই চিন্তা তো ছিলই, তা ছাড়া ভেতরের বাধা। তিনি কোনও সময়েই ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবু কখনও সামান্য একটু বাহুর স্পর্শ, পিঠে একটু হাত রাখা–তাতেই ছিল কত রোমাঞ্চ। মনে আছে, একদিন মধ্য কলকাতার একটা ছোট চায়ের দোকানে সূর্য আর দীপ্তি বসেছিল একট ক্যাবিনে। পরদা। ফেলা ছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মুখ তুলে দীপ্তিদিকে এত অসহ্য সুন্দর মনে হল সূর্যর, যেন ওই বুকে মাথা রেখে তক্ষুনি মরে যেতে ইচ্ছে হয়। দু’জনের মাঝখানে টেবিলের দূরত্বটা মনে হচ্ছিল কী বিশাল, সূর্য দীপ্তিদির গালে শুধু তার হাতটা ছোঁয়াতে চাইল একবার, দীপ্তিদি মুখটা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিয়ে বললেন, না, ও-সব কী! সূর্য তখন টেবিলের ওপর পড়ে থাকা দীপ্তিদির ডান হাতটা তুলে নিয়ে একটা আঙুল তার মুখে পুরে দিল। আলতো ভাবে দাতে চেপে ধরে রইল দীপ্তিদির আঙুল, কয়েক মুহূর্ত। সামান্য ব্যাপার, অথচ ওতেই দীপ্তিদির মুখে লাগল লাল রঙের ছোপ, আর সূর্যর শরীরে যেন প্রচণ্ড জ্বরের উত্তাপ। পৃথিবীর আর কোনও মানুষ আর কোনও নারীকে অমন তীব্র ভাবে চেয়েছে? কী নিদারুণ অতৃপ্তি!

না, না, সূর্য এসব ভাববে না, আর কিছুতেই ভাববে না। দীপ্তিদি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

বাইরে তখনও হইহল্লা চলছে। শোনা যাচ্ছে মেয়েলি গলার চনমনে হাসি। ওরা বেশ জমিয়ে নিয়েছে। এদের জীবন কত সরল। এদের ভালোবাসা টাসার ঝাট নেই। তিনটি মেয়ে কী সহজ ভাবে মাতামাতি করছে অতগুলো পুরুষের সঙ্গে, আবার অর্থ উপার্জনের জন্য ওদের সামনেই একজন পরদেশিকে প্রলুব্ধ করতে এসেছিল–তার জন্য পুরুষদের মধ্যেও তো কোনও ঈর্ষার চিহ্ন ছিল না। ওরা এ রকম কী ভাবে পারে?

সূর্য বিছানা ছেড়ে উঠে এল দরজার কাছে। আলো জ্বালল না। দু-এক মিনিট ধরে ভাবতে লাগল, দরজা খুলে সে-ও ওদের দলে গিয়ে যোগ দেবে কিনা। কেন সে একা একা বিছানায় ছটফট করবে? কিংবা কোনও মেয়েকে ডেকে এনে–

শেষ পর্যন্ত সূর্য দরজা খুলল না। মনের দুটো অংশ কিছুতেই এক হচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সে লোভীর মতন শুনতে লাগল বাইরের ওদের হাসাহাসি। দীপ্তিদি কি তাকে সারা জীবনের সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে ছেড়ে দিলেন?

পরদিন সকালেই সূর্য হোটেল বদলে ফেলল। দু’দিন ধরে ফতেপুরসিক্রি, সেকেন্দ্রা আর আগ্রা দুর্গ দেখা শেষ করল। তারপর ট্রেন ধরল গোয়ালিয়ারের।

বড়বাবু মৃত্যুর আগে বার বার সূর্যকে বলেছিলেন গোয়ালিয়ারের কথা। তিনি চেয়েছিলেন, ছেলেকে নিয়ে নিজেই এখানে আসবেন একবার। কেন? হয়তো কোনওই মানে নেই, অসুস্থ অবস্থার প্রলাপ। কিংবা তার নিজের জীবনের অনেকগুলি বছর কেটেছে এখানে, সেই স্মৃতি মনে পড়ছিল।

সূর্যর জন্ম হয়েছিল এইখানে। কিন্তু খুব কম বয়সেই এ-জায়গা থেকে চলে গিয়েছিল। স্মৃতিতে বিশেষ কিছুই নেই।

গোয়ালিয়ারে এসে সূর্যর হোটেল পেতে খুব অসুবিধে হল। ভালো হোটেল নেই। এখানে, সাধারণ যে কটা আছে, তার কোনওটায় জায়গা নেই, কোনওটা তার পছন্দ হয় না। টাঙ্গাওয়ালা তাকে নিয়ে তুলল ডাকবাংলোতে। সেখানেও ঘর খালি নেই। তবে ডাকবাংলোর বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে একটি যুবক খবরের কাগজ পড়ছিল, সে সূর্যকে দেখে বলল, ইফ ইউ লাইক, আই ক্যান অ্যাকোমোডেট ইউ ইন মাই রুম। দেয়ার ইজ অ্যান একস্ট্রা বেড।

অন্য কারওর সঙ্গে এক ঘরে থাকা সূর্য একেবারেই পছন্দ করে না। সেই জন্য সে যুবকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আমার একটা আলাদা ঘরই চাই। আমি বরং সার্কিট হাউসে চেষ্টা করে দেখি।

যুবকটি বলল, সার্কিট হাউসে জায়গা পাবার কোনও আশাই নেই। দুজন মিনিস্টার এসেছে। আপনি এখানে থাকলে কাল একটা ঘর খালি পেয়ে যাবেন। আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন, না কোনও কাজে?

সূর্য টাঙ্গা থেকে সুটকেসটা নামাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *