৭১.
বড়বউ যে তন্ত্রমন্ত্র জানে তা তো জানত না বাসন্তী। মন্দিরের ভিতরে যে কালীমূর্তি রয়েছে তেমনটা জন্মেও দেখেনি সে। চৌকোমতো বিশাল মুখ, অ্যাই বড় বড় চোখে কী ভীষণ দৃষ্টি, আর সবচেয়ে আশ্চর্যের হচ্ছে জিবখানা। লাল টকটকে রক্ত মাখা জিবখানা তিন হাত নেমে পেটের নীচ অবধি চলে এসেছে। সেই মূর্তির মুখোমুখি লালপাড় গেরুয়া রঙের ছালের শাড়ি পরা বড়বউ বাসন্তীর দিকে পিছন ফিরে বসা। মাথার চুল পিঠ কেঁপে নেমে এসেছে বন্যার মতো। কীসব মন্তর যেন বলছে বড়বউ, বাসন্তী কি আর মন্তর-তন্তর বোঝে! সে শুধু হাঁ করে চেয়ে দেখছে কাণ্ডখানা। আজ কী একটা সর্বনাশ যেন হবে। কী হবে তা জানে না বাসন্তী, শুধু তার বুকটা দৌড়চ্ছে খুব। ডুগডুগির মতো আওয়াজ হচ্ছে বুকের ভিতরে। বড়বউয়ের মুখখানা দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ভয়ে ভয়েও দেখতে বড় সাধ হচ্ছে বাসন্তীর। দেখলে হয়তো মূছাই যাবে। তবু না দেখেই বা থাকে কী করে সে? ভয়ে, দুশ্চিন্তায় তার চোখ ভর্তি জল, হেঁচকি তুলে তুলে ফেঁপাচ্ছে সে। ঠাকুর আমার কী হবে গো?
ঠিক এই সময়ে বড়বউ খুব ধীরে ধীরে মুখখানা ফেরাতে শুরু করল, মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে বাসন্তী। কী দেখবে, কাকে দেখবে কে জানে, কিন্তু চোখ যে ফিরিয়ে নেওয়ারও সাধ্য নেই তার। ঘাড় শক্ত হয়ে আছে। হার্টফেল হবে নাকি তার?
এলোচুলে আধখানা ঢাকা মুখখানা যখন তার দিকে ফিরে তাকাল তখন বাসন্তী দেখতে পেল, বড়বউয়ের মুখখানা কী সুন্দর। যেন লক্ষ্মীপ্রতিমা। কেমন পানপাতার মতো ডৌল, কী সুন্দর নাক, মুখ চোখ। কিন্তু চোখ দুখানা যেন জ্বলছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। অত বড় বড় চোখ যেন বাসন্তীকে ভস্ম করে দেবে।
বড়বউ একটু হেসে কঠিন হিমশীতল গলায় বলল, এসেছিস! তোর জন্যই বসে আছি। আয়, কাছে আয়… আয়…
আর কাঁদতে কাঁদতে বাসন্তী হামাগুড়ি দিয়ে এগোবার চেষ্টা করছে। বড়বউ, তার কথা মান্যি না করলে উপায় আছে? বাসন্তী কি পারে মান্যি না করে ছুটে পালাতে? সে সাধ্যি তার নেই। কিন্তু সে কাঁদছে, ভীষণ কাঁদছে, আর এগোচ্ছে। কী হবে তা কে জানে। কোন সর্বনাশ!
ও দিদি, মাপ করে দাও, পায়ে পড়ি তোমার… ও দিদি…
নিজের চিৎকারেই ঘুম ভেঙে গেল বাসন্তীর। নিশুত রাতে, ধড়াস ধড়াস করছে বুক, গলা শুকিয়ে কাঠ, গাল বেয়ে চোখের জলের ভাসাভাসি। ঘুমের মধ্যেও কাঁদছিল সে। ভয়ে সে জবুথুবু হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তলপেটে হাত রাখল সাবধানে, বাচ্চাটার কোনও ক্ষতি হবে না তো ঠাকুর? রক্ষা করো। বাথরুমে অবধি যেতে পারছিল না ভয়ে।
শেষে মুক্তাকে ডেকে তুলল সে। মরণের বাবা না থাকলে মুক্তা এ-ঘরের মেঝেতে শোয়।
স্বপ্ন দেখেছ নাকি বউদিদি?
হ্যাঁ। ভীষণ খারাপ স্বপ্ন।
কাল শনিবারে একটু বারের পূজো দিও। এ অবস্থায় খারাপ স্বপ্ন দেখা ভাল নয়।
আর ভয় দেখাসনি বাপু, এমনিতেই ভয়ে মরে আছি।
ভয়, ভয় আর ভয়। এই বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই যেন কীসব হচ্ছে। এই নিয়ে তিন চারটে খারাপ স্বপ্ন দেখল গত এক মাসে। কী হবে কে জানে! ঠাকুর-দেবতাকে ডাকা ছাড়া সে আর কীই বা করতে পারে।
বড়বউকে এত ভয় কেন তার কে জানে!
ভয় যা আছে তা তার মনের মধ্যে আছে। ঝাঁপি না খুললে তো সাপ বেরোয় না। রসিকের বড় ছেলে এল, সে এসে থেকে গেল। ভয়-ভয় ভাব ছিল বটে বাসন্তীর। কিন্তু কেটেও গেল ভয়। ভারী ভাল ছেলেমেয়ে দুটো। সুমন তো তাকে শেষ অবধি মা ডেকে গেছে। দুজনের জন্য আজকাল মায়াও হয়েছে বাসন্তীর বুকের মধ্যে। কিন্তু বড়বউ তো আর ছেলেমেয়ে নয়। তাকেই তাই সবচেয়ে বেশি ভয়। বাসন্তী তো তার ভাগীদার, সতীন, চির-শস্তুর। তার সঙ্গে তো সহজে মিলমিশ হওয়ার নয়।
তবু বাসন্তী ভালমানুষের মতো মাঝে মাঝে মরণের বাপকে বলে, একবার দিদিকেও আনো না।
সুখে থাকতে কি তোমারে ভূতে কিলায় নাকি?
আহা, কী কথা! দিদিকে আমি ঠিক জল করে দেবো।
আর আহ্লাদের কাম নাই। তারে দেখলে তো ভয়ের চোটে সিটকাইয়া থাকবা, কাপড়ে-চোপড়ে হইয়া যাইব। তোমারে তো চিনি, এক নম্বরের ডরফোক।
আহা, দিদি তো আর ভয়ের জিনিস নয়। হ্যা
য় যদি বাঘিনী, তবে তুমি হইলা মেচি বিলাই।
কথার কী ছিরি বাবা। আমার কিন্তু দেখতে ইচ্ছে করে।
চাও তো লইয়া আমু, শ্যাষে কপাল চাপড়াইবা।
তার চেয়ে একবার আমাকেই কলকাতায় নিয়ে চলো না। গিয়ে একটিবার প্রণাম করে আসি।
ইঃ, প্রণাম করনের লিগ্যা দেখি হাত খাউজ্যাইতাছে!
মরণের বাপ ওরকমধারাই মানুষ। মুখের আগল নেই। মনের কথা সব মুখে বলে ফেলে, জলের মতো। কিন্তু মনে একটু খটকা তো আছেই বাসন্তীর।
সে বলে, দিদির তো আমার ওপর রাগ থাকারই কথা। তার জিনিসে ভাগ বসিয়েছি না!
কার যে জিনিস হেইরে কেডা কইব? আমি হইলাম ফাটা বাঁশের মধ্যখানে। মাইনকা চিপি আর কারে কয়। শুন তো ভালমাইনষের মাইয়া, তুমি একখানে, তাইন আর একখানে, মইধ্যখানে মেলা ফাঁক। ওই ফাঁকটুক ফাল দিয়া পার হওনের কাম নাই। বোঝলা বলদা মাইয়ালোক?
বাসন্তী যা বলে তা তার মনের কথা নয়। বড়বউয়ের সঙ্গে দেখা করার কৌতূহল থাকলেও আগ্রহ তার নেই। ভীষণ ভয় পায় সে। আর ভয়ই তার ঘুমের মধ্যে নানা দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে। তবু মুখে ওসবও সে বলে, তার ভালমানুষিই তাকে দিয়ে বলায়। ভাবে, না বললে খারাপ দেখাবে। তার বর হয়তো ভাববে, সে বড়বউকে হিংসে করে।
ভালমানুষ হয়ে থাকার একটা নেশা আছে। বাসন্তী অনেক সময়ে তার বরের কাছে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও ভালমানুষ সাজে। ওই একজনের চোখে সে মন্দ হতে চায় না কখনও। সে মানুষটার মাত্র অর্ধেক পেয়েছে, সেটুকুই আগলে রাখতে হবে তো। সম্পর্কটা তো অধিকারের নয়। মাকড়সা যেমন নাভির সুতোয় ঝুলে থাকে, এও যেন খানিকটা তাই। বাসন্তীর ভয় কি একটা! তার হাজারো ভয়। একটা ভয় থেকে আর একটা ভয় জন্মায়। তারপর ভয় যেন বিরাট বড় হাঁ করে গিলতে আসে।
ঠিক বটে, রসিক তাকে সুখে মুড়ে রেখেছে। ভালওবাসে খুব। তবু কেবলই মনে হয়, তারা কি আসল স্বামী-স্ত্রী? নাকি নকল? সাজা? যাত্রাপালার মতো মিথ্যে জিনিস? বাসন্তীর বুকে ডুগডুগি কি এমনি বাজে?
তার গর্ভে ওই লোকটার ছেলে হল, মেয়ে হল, আর একটাও আসছে, তবু কি আপন হল না লোকটা? তাহলে আর কীসে আপন হবে? মাঝে মাঝে আজকাল এই এক চিন্তা হয় তার। ওই যে এক না-দেখা বড়বউ আধখানা দখল করে আছে, ওই কাঁটাই মনের মধ্যে খচ খচ করে। আধখানা নয়, হয়তো আরও বেশিই দখল করে আছে বড়বউ। হয়তো সবটুকুই। তার মায়ের মুখে বিষ আছে বটে, কিন্তু হয়তো যখন বলে তখন মিথ্যে বলে না, তুই কি আর সত্যিকারের বউ! রাখা মেয়েমানুষের বেশি নোস, এই বলে রাখলুম, পরে বুঝবি।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সোজা পথে যায় না কখনও। মাঝে মাঝেই পাশ ফেরে, বাঁক নেয়। ঠিক নদীর মতোই। শুকিয়ে চর পড়ে যায়, বার ভেসে যায় প্লাবনে। কিন্তু এ তো ঠিক দুজনের সম্পর্ক নয়। তাদের হল তিন জনের সম্পর্ক। বড়বউ যে ঠিক কেমন ধারা তা জানেই না বাসন্তী। ওই অজানের সঙ্গে সে বৃথাই লড়াই করছে হয়তো।
মাঝে মাঝে একা একা খুব কাঁদে বাসন্তী। আজও দুপুরে একা ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছিল খুব। পাশেই হাম্মি ঘুমিয়ে আছে। আজকাল তার খুব গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে। ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য পারে না। নইলে আজকাল কেবলই মনে হয়, তার জীবনটা একটা ফক্কিকারি মাত্র। কিছু নেই তার, এই ইটকাঠের ইমারত, ক বিঘে জমি এর কি কোনও দাম আছে? মানুষটাকেই তো সে পায়নি।
হ্যাঁ লা বাসন্তী, সে কি তোকে কখনও অনাদর করে? দূর ছাই?
না না, তা করে না মানছি।
রাগী মানুষ সে, তবু কখনও তোর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা কয়?
না, কখনও নয়।
তোকে কি অবিশ্বাস করে? তোর হাতে ছেড়ে দেয় না সব কিছু?
দেয় তো।
আর সোহাগ করে না? মন চেয়ে কথা কয় না?
সেও কয়, মানছি।
তবে তোর আর চাই কী?
তা কি আর আমি এই বোকা-বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারি?
মেয়েমানুষের কি বেশি চাইতে আছে? তারা তো নিজেদের বিলিয়ে দিতেই আসে। কত লাথিঝাঁটা খায়, কত উপোস-কাপাসে দিন কাটায়, কত গঞ্জনা, কত গর্ভযন্ত্রণা সয়, কদিন সুখের মুখ দেখে বল তো একজন মেয়েমানুষ?
তা বইকী! জানি না বুঝি!
তাহলেই দেখ, অন্য সকলের মাপে তুই কি কিছু খারাপ আছিস?
অন্যদের যে ভাগীদার নেই!
কে বলল নেই? পুরুষমানুষ জাতটাই তো ঠুকঠুকে। তারা কি একটি নিয়ে থাকে? আর কেউ না জুটল তো বেশ্যাপাড়ায় যেতেও ছাড়ে নাকি?
উম্মা গো! কিন্তু আমার যে অন্য যন্ত্রণা।
যন্ত্রণা কীসের? বড়বউ?
সে নয় তো কে?
তোকে তো লুকোয়নি। দেখে-বুঝেই তো গলায় মালা দিলি।
বুঝলাম? বুঝলাম কোথায়! আমার বুঝি বুদ্ধি আছে?
বুদ্ধি ভাল জিনিস। তা বলে এটাই তো সব নয়। অত যে ভালবাসিস তার দাম নেই বুঝি?
ভালবাসার কী দাম বলো!
হা লা, তবে কি নিষ্কন্টক হতে চাস?
চাইলে?
সর্বনাশী! তুই নিষ্কন্টক হতে চাইলে যে বড়বউকে মরতে হয়! তাই চাস? তবে মা কালীর কাছে তার মরণ চেয়ে জোড়া পাঁটা মানত কর।
বাবা গো! ও কী কথা! আমি তাই বললাম বুঝি?
তুই চাইলে সে মরবে বোধহয়, কিন্তু তারপর আর সারা জীবন তোর বরের মুখের দিকে নিষ্পাপ চোখে তাকাতে পারবি কখনও?
চাইনি গো, চাইনি।
তাহলে কী চাস পষ্ট করে বল তো!
আচ্ছা, এমন বুঝি হয় না যে, সে আমাকে ভালই বেসে ফেলল।
বড়বউ?
হ্যাঁ।
তাই কি বাসে পাগল? দুনিয়াটা কি তোর হাতের মোয়া? যা চাইবি তাই বুঝি পাওয়া যায়।
আমি তো তার পায়ে পড়তেও রাজি।
পায়ে পড়লেই যদি সব হত, ওলো, দুনিয়াটা তোর মনের মতো হবে বলেই ধরে নিয়েছিস বুঝি? অত সোজা নয়। দুনিয়া তার নিয়মে চলবে, যতই তুই চোখের জল ফেলিস আর বুক থাবড়ে হা-হুঁতোশ করিস। বরং দুনিয়ার নিয়ম মেনে চল দেখি।
দুনিয়ার নিয়ম যদি বুঝতুম।
কিছু পাবি, কিছু ছাড়বি– এই হল নিয়ম। সবারই তো ভাগ আছে রে, সেইটে আগে বুঝে নে। যার– যার হক্কের জিনিস তার তারটা তো ছাড়তেই হবে তোকে।
ওইটেই তো সইতে পারিনা। এই একটা জিনিসই তো নিজের মতো করে চেয়েছি। আমার বর।
শোন বোকা, খুব যে বর বর করিস, হ্যাঁ লা সে যদি আজ মরে তবে তো তোর পাখিই উড়ে গেল!
ওম্মা গো! ও কী সর্বনেশে কথা! ওরকম বলতে আছে?
কেন, সে কি মরবে না একদিন, যেমন সবাই মরে? ভেবে দেখতে বলছি, তাকে যে খানিক পেয়েছিস বলিস, কেউ কি বরকে পুরো পায়? পুরো কেউ পেয়েছে আজ অবধি? সব ওই সিকি বা আধুলি, ষোলো আনা নয়।
কিন্তু সে তো আমাকে সবটুকুই পেয়েছে। দিইনি আমি নিজের সব কিছু তাকে? জান বেটে দিইনি?
ছাই দিয়েছিস। সে তোকে রাজরানি করে রেখেছে, গায়ে আঁচটি লাগতে দেয়নি, তাই তোর অত ভালবাসার দেখনাই। তার যদি চালচুলো না থাকত, এমন ভালবাসা না থাকত তখন দেখতুম কেমন তোর একবগ্না পিরিত।
তোমার মুখে আগুন।
তাই দে, কিন্তু ওঠ, চুল বাঁধ, সাজুগুজু কর। ওসব করলে মন ভাল হয়ে যায়।
কান্নার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বাসন্তী।
ঘুম ভাঙল চেঁচানিতে।
বলি, আঁচলের আড়ালে ও কী নিয়ে যাচ্ছ গো ঠাকরোন?
তা দিয়ে তোর দরকার কী রে মাগী?
অ্যাই খবর্দার, ওসব খারাপ কথা বলবে না বলছি।
আহা, কী এমন বললুম! মাগীকে মাগী বলবে না তো কি মেসোমশাই বলতে হবে নাকি লা? বড়লোকের চাকরানি বলে কি পাখা গজিয়েছে?
কথা চাপা দিও না। আঁচলের তলায় কী দেখাও আগে।
তোর বাপের মাথা।
ঘুম ভেঙে ঝুম হয়ে বসে রইল বাসন্তী।
মুক্তার সঙ্গে মায়ের লেগেছে। দুজনে প্রায়ই লাগে। ছেলেরা আর ছেলেদের বউরা মিলে মাকে তাড়িয়েছে বটে, কিন্তু মা হল দু কান কাটা। এখনও ওই বাড়ির জন্যই তার যত টান। এ-সংসার থেকে যা পারে কুড়িয়ে বাড়িয়ে বা চুরি করে এখনও ও-বাড়িতে পাচার করা চাই। আড়ালে-আবডালে নাতি নাতনিরা এসে দাঁড়ায়। কখনও কচুবনের আড়ালে, কখনও ঘাটে। ইশারায় কথা হয়ে যায়। মশলাপাতি, আনাজ, গম কি চাল, এক শিশি তেল, কাটা মূলোটা যা পারে চুপি চুপি দিয়ে আসে।
মাঝে মাঝে বাসন্তী বলে, হ্যাঁ মা, শুধু তাদের ভালটা দেখলে, তোমার জামাইয়ের ভালটা দেখলে না? তারা যখন মারধর করে হিঁচড়ে পথে বের করে দিয়েছিল তখন তোমার জামাই-ই তো তোমাকে তুলে এনে রেখেছে। তবু এ-সংসারের দিকে তোমার টান নেই কেন? এত অবিচার কি ধর্মে সইবে?
বুড়ি তটস্থ হয় বটে, তবে হার মানে না। বলে, না খেয়ে মরছে দু চোখে দেখে থাকি কী করে বল? তোর তো ভাসাভাসি, না হয় দিলামই একটু খুদ কুঁড়ো।
তা দিতে হলে বলেই তো নিতে পারো। চুরি করে দাও কেন?
আহা, চুরি হতে যাবে কেন, আমার কি হক নেই! তুই পেটের মেয়ে নোস?
বিয়ে হলে মেয়ে পর হয়ে যায়, এ তুমি জানো না? খেয়ে পরে আছ, সেই ঢের। বেশি বায়নাক্কা দেখলে কিন্তু অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
শুনে মরে যাই, বলি মানুষের মতো কি রেখেছিস? গুদোমঘরটায় ইঁদুর বেড়ালের মতো পড়ে আছি, ও কি থাকা হল? ওদিকে দালানকোটার ঘরগুলো তো হা-হা করছে, দরদ থাকলে না হয় দিতি একখানা ভাল ঘর। পাঁচজনে দেখে যে মুখে থুথু দিচ্ছে তোর। বড় মুখ করে আবার বলতে এয়েছে, খাওয়া-পরা দিচ্ছে। কুকুর-বেড়ালকেও লোকে দেয়, বুঝলি? অত বড়াই করতে হবে না, তোরটাই কি থাকবে ভেবেছিস? উড়ে পুড়ে আংড়া হবে একদিন, দেখিস, মেগে-পেতে খাবি।
শুনে বড় ভয় পেয়ে যায় বাসন্তী। মা তো নয়, ডাইনি, কোনও কথা মুখে আটকায় না। শাপশাপান্তকে বড্ড ভয় তার। যদি ফলে যায়! তাই আর কথা বাড়ায় না সে।
কিন্তু মুক্তার ওসব ভয়-টয় নেই। সে প্রায়ই ঝেড়ে কাপড় পরায় মাকে। এখনও তার ঝনঝনে গলা আসছিল উঠোন থেকে। তুমুল হচ্ছে দুজনে।
মায়ের জন্য রসিক ভাল ব্যবস্থাই করতে চেয়েছিল। মরণের পড়ার ঘরের পাশের ঘরখানা। দিব্যি বড়-সড় আলো-হাওয়ার ঘর। কিন্তু বাসন্তীই রাজি হয়নি। বলেছিল, ভাল ঘরদোর পেলে পেয়ে বসবে, আর কখনও ফিরে যেতে চাইবে না। আর মায়ের মন তো জানি, চোরাপথে ছেলেদেরও আনাগোনা শুরু হবে। জেনেশুনে ঘরে খাল কেটে কুমির আনতে পারব না। আতান্তরে পড়েছে, দুদিন ওই লাকড়ির ঘরেই থাক। নইলে পেয়ে বসবে।
কথাটা খুব মিথ্যেও বলেনি বাসন্তী। সে জানে তার দাদারা ওত পেতেই আছে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
অশান্তি আর ভাল লাগে না বাসন্তীর। একে সে মরছে নিজের মনের হাজারো জ্বালায়।
সে বারান্দায় এসে দেখল, মা উঠোনের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে। আঁচলের আবডালে একটা ছোট ধামা গোছের কিছু। আর এদিকে মুক্তা, তার হাতে উঠোন পরিষ্কার করার বঁটাখানা, সেইটে আস্ফালন করেই সে বলছিল, আর কত এ-বাড়ির সর্বনাশ করবে ঠাকরোন? তোমার চেয়ে কালসাপও ভাল।
মা ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, শুনলি লা আস্পদ্দার কথা!
বাসন্তী মুক্তাকে একটা ধমক দিল, চুপ কর তো মুক্তা। আর চেঁচামেচি ভাল লাগছে না।
মুক্তা ওপর দিকে চেয়ে বলল, যদি দানছত্তর খুলে থাকো তাহলে বলার কিছু নেই, এ-বাড়ির ভালমন্দের সঙ্গে জুড়ে আছি বলে বলি, নইলে আমার কী? গতকালও আড়াই কেজি গম গেছে ও বাড়িতে। এই দেখ, আবার কী যায়। পটলি ছুঁড়িটাকে তো দেখলুম ওই হোথা কচুবনের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে শেয়ালের মতো। নিত্যি আসে। বলি, বাবুর ভিটেতে কি ঘুঘু চড়াবে শেষ অবধি? দুধ-কল্লা দিয়ে কালসাপ পোষা বই তো নয়।
বড় হতাশ লাগে বাসন্তীর। কথা না বাড়িয়ে সে ঘরে চলে এল, যা হচ্ছে হোক, সে আর ওসবের মধ্যে থাকবে না।
আবার মনে হয়, সে কী কথা! কত বিশ্বাস করে, কত নির্ভরতায় নিজের রক্ত জল করা বিষয় সম্পত্তি তার হাতে দিয়ে বসে আছে লোকটা। বাসন্তীর কি দায় নেই? সে কি পারে সব উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে? এসব রক্ষে করার জন্যই না সে বহাল আছে এখানে।
বিকেলে সে গিয়ে শান্তভাবেই মাকে বলল, অনেকদিন তো হল মা, এবার বরং বাড়ি যাও।
তাড়িয়ে দিচ্ছিস নাকি লা?
মেয়ের বাড়িতে থাকা কি ভাল? খারাপ দেখাচ্ছে না?
সে আগেকার দিনে বড় বড় বাড়িতে ওসব মানত। আমাদের মতো হাঘরেদের আবার নিয়ম কী লা? কেন, জামাই কিছু বলেছে?
সে বলার মতো লোক নয়, তুমিও তা জানো। মিথ্যে কথা বলব কেন মা, আমারই ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।
হারে, আমি তোর সৎমা?
তাই কি বললুম! বরং তোমাকে মাসে মাসে কিছু থোক দেবোখন, যদিও তোমার ছেলেরা টের পেলে কেড়ে নেবে। তবু বলি আলগা থাকাই ভাল।
বুঝেছি বাপু, বুঝেছি। তোর সুখের সংসারে আমার শ্বাসটুকুও তোর সহ্য হয় না, কী চোখেই যে দেখলি আমাকে কে জানে! তা তোর আর দোষ কী? তুই কি আর সেই বাসন্তী আছিস? মন্তর করে তোর মাথাটাই খেয়ে রেখেছে বাঙাল। নইলে নিজের গর্ভধারিণী মাকে এমন অচ্ছেদ্দা কেউ করে?
বলে মা কাঁদতে বসল, বাসন্তী জানে, কান্নাটা ও মানুষের মধ্যেই আছে। চোখে জল এনে ফেলতে দেরি হয় না।
খুব ক্লান্ত গলায় বাসন্তী বলল, সে তুমি যা ভাল বোঝো ভেবে নিও, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাও। শত হলেও সেটা তোমার স্বামীর ভিটে। জামাইয়ের বাড়িতে থাকলে লোকে দুয়ো দেবে।
বাসন্তী চলে এল নিজের ঘরে। মন ভাল নেই। সংসারের এইসব তুচ্ছ, সংকীর্ণ ব্যাপার তার আর ভাল লাগে না। মনটা বড় ক্ষ্যাপা হয়ে আছে।
আজ শুক্রবার। শনিবার তার মন ভাল হয়। তার বর আসে। দুটো দিন তার মন ভরে থাকে।
এবার এলে সে বরের কাছে সব বলবে। সব মনের কথা, ভয়ের কথা, মন খারাপের কথা। বলে বলবে, আমার কী হবে বলে দাও। আমি কি সত্যিই তোমার কেউ হই?
কই গেলা গো?
ভীষণ চমকে গেল বাসন্তী। কার গলা! আজ তো তার আসার কথা নয়।
দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে দেখল, রসিক দুটো মস্ত ব্যাগ বারান্দায় নামিয়ে রাখছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নেমে আসছিল বাসন্তী। রসিক কাণ্ড দেখে চেঁচিয়ে উঠল, আরে কর কি পোয়াতি মানুষ? পিছলাইয়া পড়বা নাকি?
.
৭২.
সিঁড়ির শেষ ধাপটায় ঠিকমত পা রাখতে পারেনি বাসন্তী। খন্দের মতো ফাঁকায় পা পড়ে শরীর টাল খেয়ে গেল তার। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে দুর্বল শরীর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল নীচে, বারান্দার শানের ওপর। সতর্ক ও তৎপর রসিক একটা লাফ দিয়ে গিয়ে জাপটে না ধরলে বাসন্তীর সর্বনাশ লেখা ছিল কপালে।
দেখছ কাণ্ড! ওই রকম আথালি-পাথালি হইয়া লামতে আছে।
কিছুক্ষণ বাসন্তীর হুঁশ ছিল না। রসিক পাঁজা করে ধরে তাকে বসাল বারান্দায় তারপর নরম গলায় বলল, ভয় নাই, কিছু হয় নাই তোমার। চক্ষু মেইলা চাও তো!
বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল বাসন্তী হাঁ করে। প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। তারপর হাঁফ-ধরা গলায় বলল, কী হয়েছে গো আমার?
কিছু হয় নাই।
দু হাত বাড়িয়ে স্বামীর দুখানা হাত চেপে ধরে বলল, আমি কি রাখতে পারব ওকে? ও পেটে আসার পর থেকেই কীসব হচ্ছে বলো তো! এত ভয় করে আমার!
রসিক হেসে বলল, ভয়ই তো তোমারে খাইল। এত ডরানের কী আছে? লও, উপরে লও তো, তোমার কথা শুনি।
বাসন্তী এবার একটু স্বাভাবিক বোধ করছে। এই একটা লোক কাছে থাকলে তার ভয় ভীতি থাকে না, বলভরসা হয়। কিন্তু এ-মানুষটা কাছে না থাকলেই সে যেন কেমনধারা হয়ে যায়, পায়ের নীচে যেন মাটি থাকে না।
বাসন্তী সামলে নিয়ে বলল, তুমি ওপরে গিয়ে বোসো, আমি চা নিয়ে আসছি।
থোও ফালাইয়া চা; অখন উপরে লও। এক কাপ চা মুক্তাই বানাইয়া আনতে পারব।
ও বুঝবে না। গুচ্ছের চিনি দিয়ে ফেলবে, লিকার কড়া হয়ে যাবে। দামি চা নষ্ট করবে। আমার শরীর এখন ঠিক আছে, পারব।
তা হইলে আমি নীচেই বসি। চা লইয়া উপরে উঠতে গিয়া আর এক বিপত্তি বাধাইবা।
কিছু হবে না।
চা নিয়ে এসে বাসন্তী দেখল, রসিক গভীর চিন্তায় মগ্ন। হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে বলল, বোঝলা, আমি একটা কথা ভাবলাম।
কী কথা?
যতদিন প্রসব না হইতেছে ততদিন তোমারে আর দোতলায় থাকতে হইব না। আইজই ব্যবস্থা করতাছি। কিছুদিন আর সিঁড়ি ভাঙানোর কাম নাই।
তাই বুঝি হয়! আমার সব যে ওপরে। পোশাক-আসাক, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি।
আরে দূর। বিলিব্যবস্থা করতে লহমাও লাগব না।
অত ভাবছ কেন? তোমার গলা শুনে হঠাৎ দিশাহারা হয়ে নামতে গিয়ে পা-টা ফসকে গিয়েছিল। ও কিছু না। এবার থেকে সাবধান হব।
আমার গলা শুইন্যা তোমার ওইরকম বেজাহান হওয়ার কী হইল? আমি কোন বিলাত থিক্যা আইলাম?
লজ্জা পেয়ে বাসন্তী মুখ নামিয়ে বলে, তোমার কথা খুব বোধহয় ভাবছিলাম। তাই হঠাৎ
রসিকের কঠোর মুখখানা হঠাৎ স্নিগ্ধ হয়ে গেল।
সে একটু হেসে বলল, আমি কোন নূতন গোসাঁই আইলাম যে আমার কথা ভাবছিলা, আবার দুঃস্বপ্ন দ্যাখছ নাকি?
দুঃস্বপ্ন! সে তো রোজ দেখি। তুমি যদি এ সময়টায় কিছুদিন আমার কাছে থাকতে! তুমি থাকলে কিছু হয় না।
তা হইলে যে কারবার লাটে উঠব। খাইবা কী? হরিমটর?
সেই তো ভাবি। কী যে করি।
ঠাকুর-দ্যাবতায় তো তোমার খুব বিশ্বাস! না! তাগো ডাকোনা ক্যান?
তারা বুঝি আমার ডাকে সাড়া দেয়? আমি পাপী না?
এইটা আবার কী কথা! তুমি পাপী হইলা ক্যামনে?
সে আছে।
পাপীরই তো ভগবানরে বেশি দরকার। কী কও? পতিতপাবন না কী জানি কয়।
সে ঠিক। তবে আমার ওপর কেন যেন চটা।
রসিক একটু হাসল। তারপর কোমল গলায় বলল, ভগবান যদি চেইত্যা যায় তবে হ্যায় আর ভগবান থাকে কেমনে?
হ্যাঁ গো, তুমি বুঝি ভগবান মানো না?
মানুম না ক্যান? মাল বেইচ্যা খাই, ভগবান না মাইন্যা উপায় আছে? আমার গদিতে তো যাও নাই, ইয়া বড় নাদাপ্যাটা গণেশঠাকুর দেখতে পাইবা। সকালে বিকালে পুরুত আইয়া মালা চড়াইয়া যায়।
খুব ভাল। আমাকেও একটা ভাল দেখে গণেশঠাকুর এনে দিও তো। আমার একটা পটের গণেশ আছে, কিন্তু ছবিটা বড্ড আবছা। গণেশবাবার আহ্লাদী ভাবটা নেই। এনে দেবে?
দিমুনা ক্যান? আইজকাইল গণেশবাবার প্র্যাকটিস খুব ভাল। মূর্তিও মেলা পাওয়া যায়।
হ্যাঁ গো, দিদি কার ভক্ত জানো?
ক্যান কও তো!
এমনিই। মনে হয় দিদি খুব কালীর ভক্ত। তাই না?
বুঝলা কেমনে?
বলব? রাগ করবে না?
রাগের কী?
একদিন স্বপ্নে দেখলাম দিদি এলোচুলে বসে কালীপুজো করছে। কালীমূর্তির চোখদুটো যেন জীবন্ত!
মাইয়ালোকে পুজা করে নাকি?
স্বপ্নে দেখলাম, সত্যি নাও হতে পারে। স্পষ্ট শুনছিলাম দিদি বিড় বিড় করে মন্ত্র বলছে।
হ্যায় যে কার ভক্ত তা জানি না। তবে ঠাকুরঘরে সবরকমই আছে। শিব-দুর্গা কালী-জগদ্ধাত্রী, সন্তোষী মা সব।
দিদি বুঝি খুব পুজো-টুজো করে?
তোমারে আইজ দিদিতে পাইছে ক্যান?
একটা দীর্ঘশ্বাস পেলে বাসন্তী বলল, আমি ভাবি কী, আমি কি তার নখের যুগ্যি?
না হইলে কি গলায় দড়ি দিতে হইব নাকি? তাইন তাইনের মতো, তুমি তোমার মতো। তার লগে তো তোমার কাইজ্যা নাই।
আছে বইকী গো। মুখে ঝগড়া নেই ঠিকই, কিন্তু আমি তো দিদির চক্ষুশূল। তাই না বলো!
নাকি? ভাল। কারও চক্ষু শূলাইলে কী করবা? গিয়া তো আর তার চোখে মলম লাগাইতে পারবা না।
পায়ে তো পড়তে পারতাম।
খামাখা তার ঠ্যাং ধরতেই বা যাইবা ক্যান? তুমি তো কিছু দোষ কর নাই, করছি স্যান আমি। তুমি ঠ্যাং টানাটানি করলে লাভ কী?
আমারও কি দোষ নেই?
খুচাইয়া খুচাইয়া দোষ বাইর করনের কামটা কী? তুমি হইলা ঢ্যাপের দলা। মায়ে বাপে ধইরা বাইন্ধ্যা আমার লগে বিয়া দিয়া দিছিল। তোমার তো তাতে হাত আছিল না।
সে তো ঠিক কথা, তবু মনটা মানতে চায় না।
মনের বালাই বেশি থাকলে মাথার গণ্ডগোল হইব, বোঝলা? বিষয়-আশয় আছে, পোলাপান আছে, সংসারধর্ম আছে, এইসবে মনটা সই করতে পার নাই? দিদি-দিদি কইরা হাদাইয়া মর ক্যান?
হ্যাঁ গো, তোমাকে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না?
আরে কও, কও, সব কইয়া ফালাও, মনটা পরিষ্কার কর।
লোকে বলে আমি নাকি তোমার আসল বউ নই। আইনের চোখে নাকি আমার কোনও দাম নেই। সত্যি?
আইন? আইন তো দেখি সারাক্ষণই চক্ষু বুইজ্যা ঘুমাইয়া আছে। হ্যায় চাইলে স্যান কোনটা গতিক কোনটা বেগতিক তা বোঝন যাইব। আমরা কি আইনের লাগুড় পাই?
লোকে তো বলে দুটো বউ থাকা বে-আইনি।
লোকে মিছা কয় না। কিন্তু সরকারের যেমন আইন আছে তেমন আমাগরও কিছু কয় কর্তব্য আছে। আমার তো মোটে দুগা বিয়া, আগে তো মানুষ গণ্ডায় গণ্ডায় করত।
আগের দিনে ওসব হত, আজকাল তো হয় না।
আজিকাইল আরও খারাপ কিছু হয়। দুইটা-তিনটা বিয়া হয় না বইল্যা কি সব সাধুপুরুষ হইয়া বইস্যা আছে নাকি। চোরায়-গোপ্তায় কত কী হয়। বিয়া করতে বুকের পাটা লাগে, বোঝলা? গৌরহরি উকিল আমার পিঠ চাপড়াইয়া যে কইছিল তুমি বাপের ব্যাটা আছো হে সে তো এমনি কয় নাই।
তাহলে কি আমি তোমার সত্যিকারের বউ?
মিছা বউ তো আর না। এই লইয়া ধন্ধে পড়ছ নাকি?
চোখে জল আসছিল বাসন্তীর। আঁচলে চোখ মুছে বলল, যখন লোকে বলে আমি তোমার মিথ্যে বউ তখন আমি সইতে পারি না। দিদিকে তখন আমার ভারী হিংসে হয়।
রসিক সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বলল, আইন মানুষই বানায়, মানুষই বদলায়। যখন যেমন দরকার। আইন লইয়া ভাববা না, সংসার লইয়া ভাব।
সব প্রশ্ন যে জল হয়ে গেল তা নয়; তবে দম ধরল বাসন্তী। বুক ঠান্ডা হল না, তবে জ্বলুনি একটু কমল। রসিকের জুলপিতে একটু পাক ধরেছে। শরীর অবশ্য সেই আগের মতোই মেদশূন্য এবং কঠিন ও পুরুষালি। কিন্তু রসিক আর নবীন যুবক নয়। বাসন্তীর চেয়ে বছর পনেরোর বড়। বাসন্তীর বয়সও তো বসে নেই। মেয়েদের বয়স রেলগাড়ির মতো দৌড়য়। তাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। তারা এখন মোহনার দিকে। এখন আর সম্পর্কের হেরফের হয় না।
রাতে দুজনের আদর সোহাগ হল খুব।
বাসন্তী বলল, এবার কী হবে গো? ছেলে না মেয়ে?
পোলা।
কেমন করে বুঝলে?
ওই যে কয় মাইয়ার মা সুন্দরী, পোলার মা বারী। তোমার চেহারাখান ভাল দেখি না। ঝটকাইছে।
.
তার যে ভাই হবে একথা সে মায়ের কাছেই শুনেছে। শুনে যে খুশি হয়েছে তা নয়। বরং তার ভারী লজ্জা করে। কারণ, কী করে কোন প্রক্রিয়ায় ভাইবোন হয় তা সে আগে জানত না, সদ্য জেনেছে। আর সেটা এক ভীষণ অসভ্য কাজ। সেই অসভ্য কাজটা তার মা আর বাবা করেছে এটা ভাবতেই তার কেমন যেন মনটা বিকল হয়ে যায়, কান্না পায়। ভগবান, কেন এই বিচ্ছিরি নিয়ম। ওসব অসভ্যতা ছাড়া এমনিতে কোনও নিরাপদ প্রক্রিয়ায় কি ভাইবোন হতে পারে না?
দুপুরবেলায় তার প্রিয় গাছের তলায় অদৃশ্য শিবঠাকুরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সে। বুকে অভিমান, লজ্জা, ঘেন্না।
ঠাকুর, এসব অসভ্য নিয়ম তুমি বদলে দাও। ওভাবে কেন ভাইবোন হবে ঠাকুর? ছিঃ ছিঃ ভাবতেও যে লজ্জায় মরে যাই। ওভাবে কি আমিও হলাম ঠাকুর? দোহাই তোমার, এ নিয়ম পালটে দাও, তার চেয়ে বরং আকাশ থেকে নেমে আসুক শিশুদের বীজ। বৃষ্টির মতন। জল পড়ুক মায়েদের মাথায়, গায়ে। শিশু সঞ্চারিত হোক মাতৃগর্ভে। না হয় তো অন্য কিছু হোক, অন্য কোনও প্রক্রিয়ায়। ওই লজ্জাহীন বিচ্ছিরি কাজের ভিতর দিয়ে নয়। দোহাই ঠাকুর…
তার ভালমানুষ শিবঠাকুর সব তাতেই রাজি। হাই তুলে বলল, তাই হবে রে বাবা, এখন থেকে তাই হবে।
বর দিলে তো?
দিলাম।
বরটাকে ঠিক বিশ্বাস হয় না মরণের। বর দিলে হবে কী, ভোলাবাবা সব আবার ভুলে মেরে দেয়। শিবঠাকুরকে নিয়ে ওইটেই মুশকিল। এমনিতে মানুষটা বড্ডই ভাল, কারও সাতেপাঁচে নেই। আপনমনে ঝুঁদ হয়ে থাকে। মরণ সেই জন্যই শিবঠাকুরকে এত ভালবাসে। কিন্তু শিবঠাকুরের ভুলো মনের জন্য তার দেওয়া বরগুলো মোটেই ফলতে চায় না। তিনটে-চারটে বরের মধ্যে একটা হয়তো ফলল, বাকিগুলো ফলল না। এতে ভারী মুশকিল হয় মরণের। বরগুলো ফললে কত কী হয়ে যেত এতদিনে।
আমি হলাম মরণকুমার সাহা, আমার কথা তোমার মনে আছে তো ঠাকুর?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোকে আবার মনে থাকবে না।
তুমি তো ভীষণ ভুলে যাও। এই যে সেদিন পল্টন আমার জলছবিগুলো কেড়ে নিল তুমি কিছু করলে না। কী ভাল সব জলছবি মাকে দিয়ে বাবাকে বলিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। বদলে ভিডিওগেমটা দেওয়ার কথা ছিল পল্টনের। দিল তা? তোমাকে কত করে বললাম, পল্টনের হাতটা যেন ভেঙে দিও ঠাকুর। বাঁ হাতটা ভাঙলেও হবে। শুনলে সে কথা?
বাঁ হাত বলেছিলি, না ডান হাত সেইটেই তো গুলিয়ে ফেললুম রে। তাই আর ভাঙা হয়নি বটে।
তাহলে আমার গায়ে আরও জোর দাও না কেন? একাই যাতে দশ জনকে ঠান্ডা করে দিতে পারি।
কেন, তোর জোর কি কম?
কম নয়, কিন্তু আর একটু হলে ভাল হয়। পল্টন আর গদাইকে খুব পেটাতে ইচ্ছে করে যে। দুটোই পাজি।
তুই পাজি নোস তো।
আমিও আছি একটু, তবে ওদের সঙ্গে পারি না।
ঝগড়া কাজিয়া কি ভাল? ভাব করে নে না।
তুমি কিন্তু কিচ্ছু পারো না শিবঠাকুর। জগু কী বলেছে জানো? ও নাকি মা কালীর কাছে যা চায় সব পায়। মা কালী নাকি তোমার চাইতে অনেক ভাল। সত্যি ঠাকুর?
আরে না না, কালী কি আমার মতো পারে?
আমিও তো তাই বললাম জগুকে। দুজনে একটু ঝগড়াও হল। পান্নাদি সেদিন বলছিল, সন্তোষী মা নাকি কালীর চেয়েও ভাল। সত্যি ঠাকুর?
ওরে, আমিই তোকে সব দেবোখন।
দিচ্ছ কোথায়? এরপর কিন্তু আমি ঠিক একদিন কালীভক্ত হয়ে যাব। তখন বুঝবে।
রাগ করিসনি বাপধন। আর ভুল হবে না।
হ্যাঁ ঠাকুর, তোমাকে যে বলেছিলাম পান্নাদির সঙ্গে আমার দাদার একটু ভাবসাব করে দাও, দিলে না তো!
দিইনি বুঝি! তা সে আর কী করা যাবে।
ওদিকে যে অর্ঘ্য ব্যানার্জির সঙ্গে পান্নাদির ভাব হয়ে গেল!
সে আবার কে রে?
পান্নাদির দাদার বন্ধু। দেখনি বুঝি? কী সুন্দর লম্বা পানা চেহারা কম্পিউটার ইনজিনিয়ার। এই তো বড়দিনের ছুটিতে এসে ঘুরে গেল। তারপর গেল হপ্তায় এসেছে। খবর আছে এ-হপ্তায়ও আসবে। খুব নাকি বড়লোকের ছেলে। তুমি কিন্তু কিচ্ছু পারো না ঠাকুর।
চোখ বুজেই মরণ টের পেল। শিবঠাকুর খসখস করে জটার নীচে মাথা চুলকে নিল। তারপর বলল, সব কি আর খেয়াল থাকে রে। চারদিকে কত কী হুটহাট হয়ে যায়।
ও ঠাকুর, তোমাকে উকুনে খাচ্ছে নাকি? মায়ের কাছে উকুনমারা তেল আছে, চুরি করে এনে দেব?
উকুনমারা তেলও আছে নাকি? দিস তো বাবা, কতকালের পুরনো জটা, উকুন তো হবেই।
পান্নাদির মুখখানা আজকাল খুব ঝলমল করে আর একটা লালচে আভাও দেখতে পায় মরণ। সেদিন জ্যাঠাইমার জন্য ডাব পাড়তে গাছে উঠেছিল মরণ। আজকাল গাছে ওঠা বারণ হয়েছে তার। বাবা হুকুম দিয়ে গেছে, এই বান্দর, গাছে উঠলে কিন্তু চ্যাঙ্গাব্যাঙ্গা কইরা ঠ্যাঙ্গামু। তবু চুরি করে কারও কারও কথায় এখনও গাছে-টাছে উঠতে হয় তাকে।
ডাব পেড়ে যখন নেমে এল তখন দেখল, পান্নাদির বাড়িতে খুব হই-চই। কারা সব এসেছে। বাইরের ঘরে হাসাহাসি হচ্ছে খুব।
উঁকি মেরে তখনই ছেলেটাকে দেখতে পেল মরণ। তার দাদাও সুন্দর বটে, কিন্তু এ আরও সুন্দর। কী লম্বা আর ফর্সা। আর মুখখানা অনেকটা ফিল্মস্টারের মতো। মরণ বেশি সিনেমা দেখেনি। টিভিতে একটু আধটু। অন্যদের মতো সে ফিল্মস্টার বেশি চেনে না। তবে জানে ফিল্মস্টাররা খুব সুন্দর দেখতে হয়।
পরদিন সে পান্নাদিকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, পান্নাদি, এই লোকটা কে এসেছিল তোমাদের বাড়িতে? সুন্দরপানা, লম্বা?
পান্নাদির মুখটা রাঙা হয়ে গেল হঠাৎ। মুখে টেপা একটু হাসি।
ও দাদার বন্ধু। অর্ঘ ব্যানার্জি।
ফিল্মস্টারের মতো দেখতে, না?
আছে একরকম।
আগে ওসব বুঝতে পারত না মরণ। আজকাল পারে।
আর বুঝতে পারে বলে তার মোটেই ভাল লাগে না। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তার এত বুঝতে পারার দরকারই ছিল না।
পান্না বলল, তোর খুব উঁকিঝুঁকি দেওয়ার অভ্যাস, না? একদিন তোর মাকে বলে দেব।
বাঃ, উঁকিঝুঁকি হল বুঝি? আমি জ্যাঠাইমার জন্য ডাব পেড়ে আনলাম না? তখন দেখলাম তো!
পান্না হাসছিল, খুব সুন্দর লাগল বুঝি তোর?
খুব। তোমার লাগেনি?
মুখটা একটু বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাব করে পান্না বলল, দেখতে খারাপ নয়। তবে বড় নিজের গল্প করে। অহংকার, বুঝলি?
না, ওসব বুঝতে পারে না মরণ। এখনও সব আবছায়া পরিষ্কার হয়ে যায়নি তার কাছে। তবে ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্কদের জগতের পর্দা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। আর যন্ত্রণা হচ্ছে তার। ভাল লাগছে না।
আজকাল সে কমবয়সি মেয়েদের দিকে তাকায়। তার নানারকম অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। কেন এসব হয়? কেন এসব হতেই হয়?
জগুও সেদিন বলছিল, অনেক ব্যাপার আছে, বুঝলি?
কী ব্যাপার?
জগু হেসে বলে, একে একে দুই। মানে জানিস?
জানে, না জেনেও মরণ জেনে গেছে। এসব কথার মধ্যে যে একটা আমিষ গন্ধ পায়। তবে তার দুনিয়া যে পালটে যাচ্ছে, এটা খুব সত্যি কথা। শরীরে অনভিপ্রেত উত্তেজনা, মনের মধ্যে আনচান।
জগু কিছু অসভ্য কথা শুনিয়েছিল তাকে। শুনে তার কান গরম হয়ে গিয়েছিল। আবার খারাপও লাগছিল না।
বিজুদার দোতলার ঘরের ঘুলঘুলিতে আর আলমারির মাথায় চড়াইপাখি বাসা বেঁধেছে। সেখান থেকে একটা চড়াই-বাচ্চা পড়ে গেছে মেঝেয়। সেটা এখনও উড়তে শেখেনি। ও বাড়িতে ভয়ংকর সব বেড়ালের উৎপাত।
বিজুদা তাকে ডেকে একদিন বলল, হ্যাঁ রে, একটা ব্যবস্থা করতে পারিস? তুই তো আগে খুব পাখির বাচ্চা চুরি করতি গাছে উঠে। এই বাচ্চাটাকে সাবধানে বাসায় তুলে দিতে পারবি না?
খুব পারবে মরণ। চড়াই বাচ্চা তুলতে গিয়েছিল বিকেলবেলা। রবিবার ছিল, মনে আছে। গিয়ে দেখে সোহাগদি আর বিজুদা কম্পিউটারের সামনে জোড়া লেগে বসা। দুজনেরই চোখ পর্দায় ধ্যানস্থ। তাকে দেখে কেউ চমকাল না। বিজুদা শুধু বলল, ছাদে ফোন্ডিং মইটা আছে। নিয়ে আয়। পাখির ছানাটা বোধহয় খাটের তলায় ঢুকেছে।
পাখির ছানাকে তার বাসায় স্থাপন করতে যেটুকু সময় লাগল তার, দেখল, দুজনে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। কিছু করছেও না। মনিটরের পর্দায় চোখ রেখে বসে আছে। সেখানে কীসব লেখা আর ছবি-ছক্কর ফুটে উঠছে।
রায়বাড়ির জ্যাঠাইমা ডেকে সেদিন তাকে দুটো গন্ধলেবু আর একটা বাতাবি দিল। গন্ধলেবু মরণের বাবা খুব ভালবাসে। বাতাবিটা কেউ খাবে না। এ বাড়ির বাতাবি জোঁদো টক। আগে টক-মিষ্টির তফাত ছিল না মরণের কাছে। আজকাল হয়েছে।
জ্যাঠাইমা গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাঁ রে, ওদের একসঙ্গে দেখতে পাস?
কাদের?
সোহাগ আর বিজু! গাঁয়ে তো ঢি ঢি পড়ে গেছে। পাস না?
.
৭৩.
ঘড়ির দুটো কাঁটা হাতজোড় করে রাতের মতো বিদায় জানাচ্ছে সবাইকে। শুভরাত্রি বন্ধুগণ। রাত বারোটা।
আধো ঘুমের ভিতরেই একবার বাঁপাশ ফিরল সে। ফের ডানপাশ। অস্থিরতা, তার ঠোঁটে এখনও লেগে আছে একটি ভীরু চুম্বনের স্বাদ। ইট ওয়াজ এ কাওয়ার্ডলি কিস। আত্মবিশ্বাসহীন, কল্পিত, অগভীর। একটি চকিত চুম্বন থেকেও কত কী বুঝতে পারা যায়। বুঝতে পারা যায়, এই পুরুষটি আর কখনও কোনও মেয়েকে চুমু খায়নি। এই নীতিবাগীশ পুরুষটি তার কৌমার্য হারানোর ভয়ে জড়সড়, এবং চুম্বনের সময়ে তার ভিতরে চিৎকার করছে তার নানা সংস্কার। ফলে প্রাচীন পবিত্রতার শৃঙ্খল ঝনঝন করে বেজে উঠছে হাতে পায়ে। ফণা তুলছে পাপের ভয়। অসহায় পুরুষটি তাকে আলিঙ্গনও করতে পারেনি যথারীতি। গাঢ় শ্বাসে ভয়ের কাপন, বুকের টিপটিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে দেহের বাইরেও। লজ্জায় চোখ বোজা, কোনও আশ্লেষ নেই, তীব্রতা নেই, অধিকারবোধ বা পৌরুষ নেই। শুধু অধরে অধরে কুশল বিনিময়ের মতো। ভিতর থেকে রাশ টেনে রাখল কে? কে বলল তো! বোধহয় ওর প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল, গোঁড়া পূর্বপুরুষদের ডি এন এ নাকি জিন-এর পরম্পরা?
হাসি পেয়েছিল কি সোহাগের? মায়া হয়েছিল কি অসহায় পুরুষটির দিকে গোল গোল চোখে চেয়ে?
আশ্চর্যের বিষয় হল, সেসব হয়নি। সে ওই চকিত লঘু চুম্বনটিকে উপভোগ করেছিল। তার ঠোঁটে পুরুষদের অধরের নিষ্পেষণ কম হয়নি। প্যাশনেট কিস কাকে বলে তা সোহাগ জানে। কিন্তু আজকের ওই স্পর্শটির মতো এমন রোমান্টিক কোনওটাই ছিল না কখনও। ঠোঁটে স্বাদ লেগে আছে এখনও। বারবার তন্দ্রা ছুটে যাচ্ছে তার। বারবার পাশ ফিরছে। এত চঞ্চলতা কখনও বোধ করেনি সে।
জীবনে কোনও পুরুষের প্রয়োজন অনুভব করেনি বলেই এর আগে কখনও হাউড়ে পুরুষের হামলা একটুও ভাল লাগেনি তার। সোহাগ জানত তার জীবন অন্যরকম এবং একক। পুরুষ কেন, কোনও মানুষ না হলেও তার চলে। তার চারদিকের আবহমণ্ডলে নিত্যই সে কত সত্তার সন্ধান পায়। এই গাছপালা, বাতাস, পশুপাখি, জীবজন্তু তার সঙ্গে কত কথা কয়। পৃথিবীতে যত মানুষ জন্মেছে তাদের সকলের যেসব স্পন্দন আর চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে তারাও কাছে চলে আসে তার। সে টের পায় তাদের। কথাও বলে তাদের সঙ্গে। তার মা আর বাবার ধারণা তার মাথায় ছিট আছে, সে ভূতগ্রস্ত, প্রবলেম চাইল্ড। হয়তো তাদের ধারণা মিথ্যেও নয়। সে জানে সে স্বাভাবিক নয়। তার কথা শুনে অনেকেই অবাক হয়। আর তার ওই বিভোর নাচ দেখে কতজন বলেছে, একে ভূতে পেয়েছে।
হ্যাঁ, ভূতেই পায় তাকে। অনেক ভূত তার। আর ওই ভুতুড়ে জগৎই তার প্রিয়। ঘর সংসার আর মেয়েলিপনা তার একটুও সহ্য হয় না। তাই তার পুরুষে আসক্তিও জন্মায়নি কখনও।
পিসি সেদিন তার কথাবার্তা শুনে দুঃখ করে বলছিল, হ্যাঁ রে, তুইও কি শেষে আমার মতো হবি? এই যে একা একা টেনে নিচ্ছি নিজেকে এটা কি বেঁচে থাকা?
কেন পিসি, তুমি তো চমৎকার আছ! কত কাজ তোমার, কত রোজগার করছ।
সে তো ঠিকই রে। লোকে বলেও তাই। লোকে ভাবে, পয়সা হলেই হল, আর কিছুর দরকার নেই। কিন্তু পয়সা দিয়ে আমি কী করব বল তো! ব্যাঙ্কে আমার লাখ দুয়েক টাকা জমেছে, কিন্তু এ-টাকা দিয়ে কী করব যখন ভাবতে বসি তখন কূলকিনারা পাই না। কী করব বল তো টাকা দিয়ে? টাকা থেকে যদি নিংড়ে একটু আনন্দ পাওয়া যেত তাহলেও হত। আর কাজ! হাড়ভাঙা খাটুনিরও একটা আনন্দ হয় যদি সেটা কারও জন্য হয়।
তবে কী হলে ভাল হত পিসি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলে, ঘরসংসার হলে, স্বামী, ছেলে মেয়ে এসব থাকলে তখন খেটে আনন্দ।
তোমার কেবল এক কথা, পিসেমশাইকে খুব ভালবাসতে বুঝি?
তা নয়, ভাল করে চোখের দেখাই তো হল না, ভালবাসাটা হবে কেমন করে বল। সেরকম ভালবাসা নয়, এ হল অন্যরকম। কীরকম জানিস? বিয়ের পরই মনে হল, এ আমার নিজের মানুষ। এই আমার সম্বল, আমার আশ্রয়, আমার ইহকাল পরকাল, দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের ভিড় থেকে এই যে একজন উঠে এসে গলায় মালা পরিয়ে দিল, অমনি তার সঙ্গে বাদবাকি মানুষের তফাত হয়ে গেল।
এটাই তো প্রেম!
মাথা নেড়ে সন্ধ্যা বলে, না রে, তোরা যাকে ভালবাসা বলিস এ তা নয়, তার চেয়েও বেশি। ও তুই বুঝবি না। আমি তাকে কম খুশি করতে চেষ্টা করেছি? বাইরে থেকে এলে পা থেকে জুতো খুলে দিয়েছি, বাতাস করেছি। তার যত্নের এতটুকু ত্রুটি রাখিনি। তাকে পেয়ে যেন আমি উথলে উঠলাম, ডবল হয়ে গেলাম। আর তাতেই সে হাঁসফাঁস হয়ে গেল কিনা কে জানে। হয়তো অত আদেখলেপনা দেখেই বিমুখ হল। হয়তো সইল না।
যাই বলল পিসি, লোকটা কিন্তু আনগ্রেটফুল ছিল।
তা তো ছিলই। সে কি আর ছিল না। তবে আমি তো তার দোষগুণ বিচার করে দেখিনি, এমনকী সুন্দর না কুচ্ছিত সে কথাও মনে হয়নি।
লোকটা কি হ্যান্ডসাম ছিল পিসি?
আরে না। মাঝারি খেকুড়ে চেহারা, রোগা, রংটাও শ্যামলা। মুখের ছিরি ওই একরকম। তুই বুঝবি না, লোকটা বড় কথা নয়, সে হয়তো পছন্দ করার মতোও নয়, তবু তাকে নিয়েই আমার যে মাতামাতি সেটা হল আমার ব্যপার। একটা মানুষকে পেয়েছি, এবার তাকে ঘিরেই লতিয়ে উঠব।
লোকটাকে তো তুমি ডিভোর্স দাওনি, না পিসি?
কী সব কাগজপত্র পাঠিয়েছিল সই করতে। আমি সই করেও দিয়েছি, তবু নাকি হয়নি। আমাকে খুব ধরেছিল যেন মামলা না করি।
করলে লোকটাকে বাইগামির চার্জে জেল খাটাতে পারতে।
লাভ কী বল। সে জেল খাটবে আর তার নতুন বউ চোখের জল ফেলে আমাকে শাপশাপান্ত করবে সেটা কি ভাল? আমার যা গেছে তা তো আর ফিরে পেতাম না।
তুমি খুব সংসার করতে ভালবাসো, না পিসি?
সন্ধ্যা লাজুক একটু হেসে বলল, এক একটা মেয়ে সংসার করতেই জন্মায়। তারা আর কিছু চায় না। কত মেয়ে গান গায়, লেখাপড়ায় বড় হয়, মিস ইন্ডিয়া হয়। ফিল্মস্টার হয়, মন্ত্রী হয়, তাদের ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে বলে, জীবনটা নষ্ট হল। আবার আমার মতো কিছু আছে যারা আর কিছু হতে চায় না। শুধু সংসার নিয়ে মেতে থাকতে চায়।
তুমি যা করেছ পিসি তা যে সংসার করার চেয়ে অনেক বেশি।
জানি রে জানি। লোকে তাও বলে। কিন্তু তারা তো আমার বুকের ভিতরটা দেখতে পায় না। সেই জায়গাটা বড় ফাঁকা।
তুমি সেই লোকটার কথা এখনও ভাবো?
দেখ, সত্যি কথা বলতে কি তার মুখটা এখন ভাল করে মনেই পড়ে না। এ তো ঠিক একটা লোকের ওপর টান নয়। ওই লোকটাকে ঘিরে যা গড়ে উঠতে পারত সেই সংসারের ওপর টান। ওসব বুঝবি না তুই।
সোহাগ যে বুঝতে পারে না তা নয়। অন্তত এটুকু বোঝে পৃথিবীতে এক একটা মানুষ এক একটা অবসেশন নিয়ে জন্মায়। পিসির সঙ্গে তার কি যোজন যোজন তফাত? সেটাও মনে হয় না তার। মাঝে। মাঝে মনে হয় তার ভিতরেও একটা টোটাল সারেন্ডার আছে। অবশ্যই সেটা কোনও পুরুষমানুষের জন্য নয়। সেরকম প্রাণ সঁপে দেওয়ার মতো পুরুষমানুষ তো জন্মায় না। তবে কার জন্য হবে সেই সমর্পণ তা ভেবে পায় না সে।
পিসি বলে, আমার মতো হোস না রে। বড় কষ্ট।
আবার বিয়ে করতে পারো না কেন পিসি?
সন্ধ্যা হেসে বলে, বয়স বসে নেই রে। মনটাও বড় আঁচড়ে কামড়ে গেছে। এখন আর সেরকম হবে না। আরও কী জানিস? এখন আমার টাকা হয়েছে, কোমরের জোর হয়েছে, এখন কেউ বিয়ে করলে তার নজর থাকবে আমার টাকার উপর। এখন তো একটু একটু করে বুদ্ধিও খুলেছে আমার। আগের মতো বোকা তো নই। তাই স্বার্থপর দুনিয়াটাকে দেখতে পাই।
তাহলে তোমার কী হবে পিসি?
কী আবার হবে! অসুরের মতো খাটব, গুচ্ছের টাকা হবে আর তা দিয়ে কী করব ভেবে কূল পাব না। এখন এ-সংসারে আমার কত কদর হয়েছে দেখেছিস? সবাই তোতাই-পাতাই করে, বড় গলায় কেউ কথাটি কয় না। বিয়ে-ফেরত মেয়েমানুষের বাপের বাড়িতে কদর হয় দেখেছিস কখনও? হয় না। এ কদর আমার নয়, আমার টাকার। তলিয়ে ভাবতে গেলে বড় ঘেন্না আসে সবানার ওপর। তাই আর ভাবি না। আস্তে আস্তে একটা যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি।
পিসির মানসিকতাটা সোহাগের অদ্ভুত লাগে। এই স্বাধীনভাবে খেটে এত রোজগার করছে, পাঁচজনের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে তা পিসির পছন্দ নয়। এর চেয়ে কী করে বেশি পছন্দের হয় একজন অচেনা পুরুষের সংসারে দাসীবৃত্তি করা এবং তার সন্তান ধারণ ও পালন করা? এবং সে পুরুষটাও নিতান্তই এক সাদামাটা সাধারণ মানুষ। এই বিস্ময়টা অনেক ব্যাখ্যা করেও মেটে না তার।
আজ রাতে পলকা তন্দ্রার মধ্যে বার বার সে পিসিকে দেখছিল। স্বপ্নই, তবে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নয়। একবার দেখল, আকাশে দিগন্তে ঘোর মেঘ করেছে, পিসি তাকে বলছে, ওই দেখ, আজ ভাসিয়ে নেবে। ফের দেখল, পিসি একটা ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। সে বলল, কোথায় যাবে পিসি? সন্ধ্যা একটা পোস্টকার্ড তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ওই দেখ না, ডেকে পাঠিয়েছে। সে অবাক হয়ে বলে, কে ডেকে পাঠিয়েছে পিসি? সন্ধ্যা মুখ টিপে হেসে বলল, কে আবার। আমার যম। কিন্তু সে ডেকে পাঠালে তো না গিয়ে উপায় নেই রে। সে চেঁচিয়ে বলল, তুমি যেও না পিসি। পিসি বলল, তাও কি হয়?
ঘুম ও জাগরণের একটা মাঝামাঝি চৌকাঠে সে স্পষ্ট টের পেল সে কথা কইছে, মেয়েদের কোনওদিন কিছু হয় না কেন জানো? তাদের মনটায় একটা দাসখত লেখাই থাকে।
ঘুম ভেঙে সে চারদিকে চাইল। অন্ধকার। পুঞ্জীভূত অন্ধকার। তারপর স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল। সেই লোকটা যদি আজ পিসিকে ডেকে পাঠায় তাহলে কি পিসি সত্যি সত্যিই সব ছেড়ে চলে যাবে নাকি? ভাবতেই ভারী রাগ হচ্ছিল তার, মধ্যরাতে, একা একা।
ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়ার মতো চুম্বনের সঙ্গে স্বাদ লেগে আছে। তার অধর ধর্ষিত হয়নি, নন্দিত হয়েছে। অন্ধকারে সে ভারী আরামে চোখ বুজল। মুখে একটু হাসি।
তারপর ভাবল, যদি সত্যিই কোনওদিন ডাকে লোকটা আর পিসি যদি সত্যিই চলে যায় তাহলেই বা ক্ষতি কী? যে যার নিজের জীবন তো নিজেই রচনা করবে। দাসীবৃত্তির মধ্যেই যদি কেউ আনন্দ পায় তো সে তাতে বাধা দেওয়ার কে?
ভেবে ফের একটু হাসল সোহাগ। একটু গরম লাগছে। আজকাল বেশ গরম পড়েছে এখানেও। পাখাটা কি চালিয়ে দেবে? না থাক। শেষরাতে হিম-টিম পড়লে তার অ্যালার্জি হবে।
.
তার শরীরেও সংকেত পৌঁছায়। নির্ভুল সংকেত। গভীর গুহার কবোষ্ণ অন্ধকারে তার শরীরে নানা স্পন্দন ছুঁয়ে যায়। ওঠো। জাগো। ধীরে, খুব ধীরে তোমার চোখ সইয়ে নাও জাগরণে। উপোসী, জীর্ণ শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে জমে থাকা আলস্য ও ঘুম ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে তার। ক্লেশময় তার জীবন। শুধুই ক্লেশ, শুধুই ক্লান্তি, শুধুই পলায়ন।
তার বোধ নেই, বুদ্ধি নেই, স্মৃতিশক্তি নেই, কর্মফল নেই, পাপ বা পুণ্যও নেই। তার আহার বিস্বাদ ও কষ্টকর, তার মৈথুন বাধ্যতামূলক এক প্রক্রিয়ার বেদনা, তার বিশ্রাম উদ্বেগাকীর্ণ। ওই যে বাহির তাকে ডাক পাঠাচ্ছে ওখানেও কোনও মুক্তি নেই তার। সেখানেও বাধা ও বিরুদ্ধতা। বন্ধুর তার গতিপথ, বিপদসংকুল। তবু সে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। তাকে জাগতেই হয়। সংকেতময় শরীরে সুনির্দিষ্ট বার্তা ঠিক পৌঁছে যায়। না তার স্বাধীন ইচ্ছাও কিছু নেই। তাকে চালায় ক্ষুধা, ভয়, মৈথুন। তাকে চালায় সংকেত ও পারিপার্শ্বিক। সে কখনও কোনও সৌন্দর্য দেখেনি, গান শোনেনি, স্থির জলে নিজের ছায়া দেখেও সে কখনও বোধ করেনি–ওই আমি।
আলস্য জড়ানো তার চোখ থেকে নেমে যাচ্ছে ঘুমের ভার। সে জাগছে। জাগছে।
.
তোমার কী খবর সোহাগ?
আমার! আমার কিছু এগোয় না। থেমে থাকে। আচ্ছা যা থেমে থাকে তাকেই কি স্থবির বলে?
আমি বাংলায় ভীষণ কাঁচা। তা বলে ইংরিজিতে পাকা নই। আমি সব বিষয়ে কাঁচা। তবু স্থবির মানে তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ।
আমার হচ্ছে স্থবির জগৎ। আমার চারদিকে যা কিছু সব থেমে আছে। গাছপালা, মাটি, আকাশ। আসলে কিন্তু ওসবও কিছু থেমে নেই। আহ্নিক গতি আছে না?
সে আছে। তবু আমার নিজস্ব জগতে কোনও ঘটনা ঘটেই না। বড় জোর পুকুরের স্থির জলে একটা ঢিল পড়ল। ঢেউ ভাঙল, তারপর আবার নিঃঝুম।
আমি সবাইকে কী বলি জানো?
কী বলো?
বলি আমাদের সোহাগ অন্য রকম মেয়ে, আর পাঁচজনের মতো নয়। কথাগুলো এমন যে চমকে উঠতে হয়, ভাবতে হয়। ভারী আচমকা কথা সব। তাই না?
আসলে আমার যা মনে হয় তাই বলি। কেন যেন সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেই পারি না।
এরকমই তো ভাল। মাঝে মাঝে এই যে আমাকে চমকে দিয়ে যাও তার রেশ কয়েকদিন থাকে। কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াঘাটা করি। কী খাবে বল তো আজ!
আমি বুঝি খেতে আসি?
আহা তাই বললাম বুঝি? গেরস্তবাড়িতে এলে কিছু মুখে দিতে হয়, এসব গা দেশের নিয়ম যে। আজকাল কেউ আসেও না, খায়ও না। উনি যতদিন ছিলেন বাড়ি গমগম করত। এসোজন বোলোজনের অভাব ছিল না। মাঝে মাঝে লোকের জ্বালায় বিরক্ত হয়েছি। আর বোধহয় তাই ভগবান শোধ নিলেন। এখন কেউ আসে না।
আচ্ছা উইডোদের খুব কষ্ট, না?
হ্যাঁ মা, বড্ড কষ্ট। আমার যেন ডান হাতখানাই নেই।
আমার পিসিরও খুব কষ্ট। তিনি উইডো নন, কিন্তু
ওর কষ্ট আরও বেশি। মুখ দেখলে বুঝবে না, ভিতরে কত জ্বালা আর অপমান, শুনি এখন ওর ব্যবসা খুব ভাল চলছে।
স্টিল শি ইজ নট হ্যাপি।
জানি। আগে আসত-টাসত, আজকাল বোধহয় সময় পায় না। সংসারে সবাই ভারী ব্যস্ত, আমারই কেবল দিন কাটে না। ওই দুখুরিই আমার সম্বল, আর কাজের লোকেরা। বোসো, আজ ক্ষীর দিয়ে মোয়া খাওয়াই তোমাকে।
উঠতে গিয়েও থমকায় বলাকা। তারপর হেসে বলে, বুঝেছি মিষ্টি জিনিস তো তোমার আবার পছন্দ নয়। কিন্তু কী জানো, এই বর্ধমানের লোকেরা মিষ্টির পোকা। তুমি কেন মিষ্টি ভালবাসো না বল তো!
আমার বোধহয় সুইট টুথ নেই।
আচ্ছা, তাহলে গরম চপ আনিয়ে দিচ্ছি। এখানে বেশ ভাল একটা খাবারের দোকান হয়েছে, বাজে জিনিস রাখে না। চমৎকার ভেজিটেবল চপ বানায়। খেয়ে দেখ।
তার চেয়ে বরং মোয়াই দিন।
বলাকা বসে পড়ে মোড়ায়, বলে, এ মেয়েকে নিয়ে যে কী করি। আমার বাড়িতে কত খাবারের আয়োজন। কত দুধ, ঘি, সবজি। কে খায় বল তো। বিলিয়েও শেষ করতে পারি না।
শুনেছি আপনি নাকি খুব ফ্রুগাল ইটার।
ও বাবা, তোমার ইংরিজি কি আমি বুঝি! তবে বোধহয় বলছ যে খুব কম খাই কি না। হ্যাঁ, এখন আর গলা দিয়ে ভাল খাবার নামতে চায় না। উনি খুব খেতে ভালবাসতেন। কিছু মুখে তুলতে গেলেই ওঁর কথা মনে পড়ে, আর খেতে ইচ্ছে হয় না।
আচ্ছা এটা কি অদ্ভুত নয়?
কোনটা অদ্ভুত?
এই আনক্যানি লাভ? এখন কেউ তো আপনার মতো ভাবতেই পারবে না।
কেন পারবে না! এরকমই তো হয়।
ইমপসিবল।
ইমপসিবল কেন?
আমার তো মনে হয় আপনাদের পৃথিবী আর নেই। এখন উই আর মোর প্র্যাকটিক্যাল অ্যান্ড মোর লজিক্যাল।
বলাকা হাসে, সে তো ঠিকই। চারদিকে তাই তো দেখছি মা। তা এ-ও বোধহয় ভাল। আমাদের যে বাড়তি ব্যাপারটা আছে তার জন্য তো কষ্টই পেতে হয়। তোমাদের আমলের সম্পর্কই বোধহয় ভাল। কে কার কড়ি ধারে তাই না?
একটুও হাসল না সোহাগ। বরং গভীর একটা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বলাকার মুখের দিকে। অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে বলল, হাউ ক্যান ইউ বি টোটালি মেসমেরাইজড বাই এ পারসন? আপনার অহংকার নেই? ব্যক্তিত্ব নেই? সেলফ রেসপেক্ট নেই?
বাবা রে বাবা! এ মেয়ের আজ হল কী? আজ আবার বুঝি মাথায় পোকা নড়ছে?
মাথা নেড়ে সোহাগ গম্ভীর মুখে বলে, না, আমি সত্যিই জানতে চাই। তর্ক করতে আসিনি। আমার সত্যিই আপনাকে দেখে অবাক লাগে।
এতে অবাক হওয়ার কী আছে বুঝি না বাপু। মায়েরা ছেলে-মেয়েকে যখন ভালবাসে তখন কি আর অহংকার, ব্যক্তিত্ব, সেলফ রেসপেক্ট কোনও বাধা হয়। পারলে প্রাণটা অবধি দিয়ে দেয়। তা সেই ভালবাসাটা তো মায়ের ভিতরেই থাকে, তাই না? তা সেরকম ভালবাসা যদি স্বামীর ওপর হয় তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল?
খুব চিন্তিতভাবে সোহাগ বলাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল। চট করে জবাব দিল না। বেশ খানিকটা বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ভীষণ বুদ্ধিমতী, তাই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। বাট দেয়ার ইজ এ মিষ্ট্রি ইন ইউ।
দুর পাগল। কী যে বলে! শোনো মেয়ে, আমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র দশ বছর বয়সে। তখন আমার স্বামীর বয়স পঁচিশ বছর। এরকম বয়সের তফাতে বিয়ের কথা আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভাবতেও পারবে না। তখন স্বামী কী জিনিস, তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয় তাই তো জানতাম না। অন্য পুরুষ হলে কী করত জানি না, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে আগলে আগলে রাখতেন, অনেকটা বাবার মতো। অসুখ হলে বাপের বাড়ি না পাঠিয়ে নিজে সেবা করতেন। ভালবাসা তো এমনি এমনি হয় না।
একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন?
না রে বাপু!
ডিড হি ট্রাই সেক্স?
পাগল নাকি? সে সেইরকম পুরুষমানুষই ছিল না। শক্তিমান পুরুষের লক্ষণ কী জানো? সংযম। আর মেয়েরা শক্তিমানকেই সর্বস্ব দিতে চায়। এ তোমাদের মাসল ফোলানো শক্তি তো নয়।
ওঃ, ইউ রিয়েলি ওয়ারশিপ হিম।
বলাকা হেসে ফেলে বলল, শুনে শুনে কান পচে গেল। আমি তো জানি না কী এমন হাতিঘোড়া করেছি তার জন্য। আমি তো চেষ্টা করে কিছু করিনি। ভালবাসা হলে সব ভেসে যায়। দেখো না, এখন কেমন শূন্য হয়ে বসে আছি।
শূন্য হয়ে বসে আছি– কথাটা একটা মাছির মতো উড়ে উড়ে বারবার এসে বসছে তার মাথায়। গুনগুন করছে, সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সোহাগ বড় জ্বালাতন হল সারাদিন।
অ্যাই সোহাগ, কী হচ্ছে শুনি।
কী হচ্ছে?
আমার দাদাটিকে নাকি একদম পাত্তা দিচ্ছো না! তুমি কি চাও বিজুদা সাধু-টাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাক?
গেলে ভালই তো হত। আমার তো মনে হয় সব পুরুষেরই কিছুদিন হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়ে থেকে আসা উচিত।
ওমা! বলে কী রে?
.
৭৪.
স্বপ্নহীন এক দীর্ঘ ঘুমের পর সে জেগে উঠল মাটির গভীর তলদেশে। সমস্ত শরীর জুড়ে বেজে যায় ক্ষুধার মাদল। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না। দেখার দরকারও নেই তার। তার চঞ্চল চেরা জিব মুহুর্মুহু ছোবল দিচ্ছে বাইরের বাতাসকে। বার্তাবহ ওই জিব তার কাছে অনেক সংবাদ পৌঁছে দেয়। নিজের দীর্ঘ চিত্রল শরীরের আলস্য এবার ঝেড়ে ফেলতে হবে। ফের জীবন ধারণ, ফের অন্বেষণ, ফের পলায়ন আর আত্মগোপন, ফের আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ, স্মৃতিহীন, বোধ ও বিবেচনাহীন সে তার শরীরের সংকেত পেয়ে ধীর গতিতে একটু একটু করে এগোয়। শীতঘুমের পর তার শরীরে এখনও জড়তা, গতি শ্লথ। দীর্ঘ ঈষৎ আঁকাবাঁকা গর্তের মুখে গেলে অস্পষ্ট দিবালোকের একটা চাকতি। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সে নিঃশব্দে তার চারদিকটা দেখে।
ধানের উঁচু করা মরাইয়ের মাচানের তলায় বিষয়কর্মে ব্যস্ত ইঁদুরের যাতায়াত। শোনা যায় তাদের দুর্বোধ্য কিচকিচ শব্দ। একটি ইঁদুর গর্তের মুখ দ্রুত পেরিয়ে গেল, তার মুখের ওপর দিয়েই। সে তার ক্ষীণ মস্তিষ্কের সামান্য জৈব প্রয়োজনভিত্তিক সতর্কতায় তার চারদিকটা অনুধাবন করে নিল। নিয়তি তাড়িত দ্বিতীয় ইঁদুরটি সামান্য অনভিজ্ঞতাবশে এসে গিয়েছিল গ্রাসের দূরত্বে। খর দাঁতে কয়েক দানা ধান জিবোচ্ছিল সে। বিদ্যুতের গতিতে সে মুখে তুলে নিল তাকে। আঁকুশির মতো দাঁতে বিদ্ধ ইঁদুরটা প্রাণপণে চেঁচাল খানিক। তারপর কম্পিত, চমকিত ছোট্ট শরীরটা অতি কষ্টে প্রাণপণ আয়াসে সে গিলতে লাগল। দীর্ঘ উপবাসের পর এ কোনও সুস্বাদ নয় তার কাছে। এ শুধু প্রয়োজন। শুধুই প্রয়োজন। আর কষ্ট। মুখ থেকে গলা অবধি টেনে নিতেও কষ্ট। গলা থেকে পেট। তার আহার্য গ্রহণও এক ধৈর্যশীল, ক্লেশকর, ধীর প্রক্রিয়া। আহারের কোনও স্বাদ ও আনন্দ নেই তার।
সতর্ক ইঁদুরেরা সরে গেছে নিরাপদ আড়ালে। সে ঝিম ধরে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। মাচার তলাকার আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরম। এই তার বহির্গমনের উপযুক্ত ঋতু। ক্ষীণ দৃষ্টির চোখে সে মাচানের বাইরে রোদের ঝকঝকে তলোয়ার দেখতে পাচ্ছে, আলো ও ছায়াকে দ্বিখণ্ডিত করে সে এখন অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
.
চোখের কি আনন্দ হয়? মনে হয় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরই নিজস্ব আনন্দ, দুঃখ, বিষাদ ও উল্লাস আছে। হয়তো সবাই টের পায় না, কিন্তু সে পায়। ধীরেন জানে, অম্য সবাই তাকে ছিটিয়াল বলেই মনে করে। তা আছে বোধহয় তার মাথায় একটু ছিট। যে মাথায় কাজের চিন্তা নেই, যে মাথায় বিদ্যে নেই, সৎ কথা নেই, যে মাথা নিজের অস্তিত্বের বাইরে বাদবাকি দুনিয়াটা নিয়ে ভাবল না সে মাথায় ছিট হবে না তো কি? তা আছে একটু ছিট। দুনিয়াটাও তো বড্ড ছোট তার। আগে তবু এ-গাঁ ও-গাঁ গতায়াত ছিল, গত কয়েক বছর এই গাঁয়ের গাছেই বড় আটক পড়ে গেছে।
এই যে দুনিয়াটা দেখা যাচ্ছে এটা কিন্তু এক মাপের নয়, এক চৌহদ্দিও নয় এর। লোক বুঝে দুনিয়াও ছোট-বড় হয়। এই গৌরহরিদা ছিলেন, তাঁর দুনিয়াটা কি ধীরেনের মতো ছোট রে বাবা! কত লোকজন আসছে যাচ্ছে, এসোজন-বোসোজন, মক্কেল-মুরুব্বি, উকিল-মুৎসুদ্দি, জজ-ব্যারিস্টার নিয়ে বিরাট ব্যাপার। কত লোকের সঙ্গে নিত্যি যোগাযোগ, কত জীবনের কত কথা এসে যোগ হচ্ছে জীবনে, যেমনটা খালবিল নদীনালার জল এসে দরিয়ায় পড়ে, তবে না বারদরিয়ার অত বড় প্রসার। সেই তুলনায় ধীরেনের ডোবায় জলই নেই মোটে। ছোট্ট এঁদো-পুকুর বই তো নয়।
পাঁচটা লোকের সঙ্গে কথা কইতে আর শুনতে বরাবর বড্ড ভালবাসে ধীরেন। কিন্তু তার সঙ্গে কথা কইবে কে? কার গরজ! তাই সে গিয়ে সন্ধেবেলার দিকে গৌরহরিদাদার চেম্বারে এক কোণে চেপে বসে থাকত। কথা শুনত। মামলা-মোকদ্দমার কূট কথাই সব। তবু তাইতেও ভারী আনন্দ হত তার। কত কী শোনা হয়ে যাচ্ছে, জীবনে যোগ হচ্ছে কিছু। গৌরহরিদা কিছু বলত না। কথা শোনা আর লোকের মুখচোখ হাবভাব দেখা। নেশার মতো ছিল ব্যাপারটা। গৌরহরিদাদা মাঝে মাঝে তাকে জিজ্ঞেস করত এই নোকটাকে দেখে কিছু বুঝলি? কেমন গোলগাল ভালমানুষের মতো মুখ, দেখে বোঝা যায় যে আটটা খুন করেছে? বড় মাপের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে নিজের মাপটাও একটু একটু করে বাড়ে।
কিন্তু কথা হল, ধীরেনেরও একটা আলাদা ছোট দুনিয়া আছে, যেমন সব মানুষেরই থাকে। সেই দুনিয়ায় ধীরেনের বোকা-বুদ্ধিতে নানা অদ্ভুত জিনিষ ধরা দেয়। এই সেদিন রাখাল রায়ের বাড়িতে দ্বাদশ ব্রাহ্মণ খাওয়াল। মায়ের বাৎসরিক, ধীরেন বামুন নয়, তবু পুরনো একটু আত্মীয়তা ছিল বলে তাকেও ডেকেছিল খেতে। ধীরেন এখন তু বললেই যায়। তা খাসির মাংস হয়েছিল সেদিন! হাড় চিবোতে গিয়ে ধীরেন টের পেল যৌবনকালে মাংস খাওয়ার সময়ে দাঁতের একটা আলাদা আনন্দ হত। মোটা মোটা হাড়ের মধ্যে ননী লুকিয়ে থাকে। চুষলে বেরোতে চায় না। পিছন দিকটা ভেঙে ভেন্টিলেশন না করে নিলে ওই ব্যাটা ননী বেরোবেও না। তা তখন সঁতের জোর ছিল বটে, কড়াক করে মোটা হাড়ের গোড়া ভেঙে হাড়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ননী বের করত। রাখালের বাড়িতে সেদিন খেতে বসে দেখল দাঁতের আর আনন্দ হচ্ছে না। হাড় ভাঙতে গিয়ে দাঁতই ভেঙে যাওয়ার দশা, ননীচোরা হাড় পাতে ফেলেই উঠতে হল।
বুড়ো হলে কোনও কোনও প্রত্যঙ্গে আনন্দ কমে যায় বটে, তবে কিছু থাকেও। এই যে তার চোখ দুখানা, দুটোতেই ছানি পড়েছিল। যত মলিন হল দৃষ্টি ততই যেন চোখ দুখানা মন খারাপ করে থাকত। এখন বাঁ চোখের ছানি কাটার পর একটা চোখে আনন্দ নেচে বেড়াচ্ছে। দেখে দেখে যেন আর ফুরোতে চায় না দেখা। কত কী দেখতে পায় ধীরেন এখন, মনে হয় যেন যৌবনকালেও এত ভাল দেখতে পেত না। সবই ভারী নতুন নতুন লাগে আজকাল।
নিজের বউয়ের মুখখানা সেদিন ভাল করে দেখছিল। সোজাসুজি নয়, সোজাসুজি তাকাবে অত সাহস আর নেই ধীরেন কাষ্ঠের। বউ পাঁজি না কী একটা উলোঝুলো চটি বই খুলে দেখছিল দাওয়ায় বসে। পাশ থেকে বাঁ চোখ দিয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিল ধীরেন। কিছু ইতরবিশেষ মনে হল না। যৌবনের মুখটা তো নেই, সেই জায়গায় কোন কুমোর এসে যেন আর একখানা মুখ বসিয়ে দিয়ে গেছে। যৌবনেও খ্যাকানো স্বভাব ছিল, তবে একটা চটক ছিল তখন। দেখতে তেমন খারাপ ছিল না, স্বভাবটা আরও তিরিক্ষে হয়েছে, আর মুখটা যেন অন্য মানুষের মুখ। তবু এই বউকে নিয়েই তো তার উত্তাল যৌবন ভারী উদ্দীপ্ত হত।
আজও কি হয়? নির্লজ্জ ধীরেন কাষ্ঠ সেই রাতে, এই বৃদ্ধ বয়সে তার বউয়ের কাছে শরীর চেয়েছিল। ওই বয়সে ভাটিয়ে-যাওয়া শরীর। তার বউ খুব অবাক হয়ে তার দিকে হ্যারিকেনের নিবু নিবু আলোয় চেয়ে থেকে বলেছিল, গলায় দড়ি দাও গো বেহায়া বেল্লিক পুরুষ।
না, অপমান আর গায়ে লেগে থাকে না আজকাল। তবে অপমানে পুরুষের কামজ্বর ছেড়ে যায়। সুরুত করে পারদ নেমে যায় নীচে। তবে ধীরেনের আত্মগ্লানি নেই। চেয়েছিল, দিল না, ব্যস।
তবে এই যে অনেকদিন পর কাম ভাবটা, এটা বোধহয় ছানি কাটানো চোখটারই গুণ। নইলে হয় কী করে?
ধীরেন ভেবেছিল, বাকি জীবনটা এক চোখেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ডান চোখ কাটানোর হাঙ্গামায় আর যাবে না। আজকাল ভাবে, তা কেন, এবার ডান চোখটাও কাটিয়ে নেওয়া যাক। শুধু দেখাই তো নয়। চোখের ভিতর দিয়ে নানা দৃশ্য এসে তার ভিতরটাকেও বোধহয় ঝাড়পোঁছ করে দিচ্ছে। পুরনো ঘরে নতুন রং লাগাচ্ছে। চোখের আনন্দে তার ভাটিয়ে-যাওয়া বয়সও ফিরে আসছে বুঝি।
দুজনে কফি খেতে খেতে মহিম গম্ভীর মুখ করে সব শুনল। তারপর একটু হেসে বলল, তোর মাথাটাই গেছে। পাগল কোথাকার! অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আবার আলাদা করে আনন্দ হয় নাকি? যত সব বাহাত্তুরে কথা।
ধীরেন কাষ্ঠ তর্ক করে না। তার পেটে বিদ্যে আর মাথায় বুদ্ধি কোনওটাই নেই। বড় মানুষদের সঙ্গে তাই সে কখনও কথার লড়াইতে নামে না। সে জানেই বা কতটুকু, বোঝেই বা কি। কিন্তু প্রকাশ্যে মেনে নিলেও মনে মনে সে যা বুঝেছে তাই বুঝেছে। যদি তা ভুলও হয় তাতেই বা কী? কত ভুল আঁকড়ে থেকে মানুষ বেমালুম জীবন কাটিয়ে দেয়। সব সত্য জানতেই হবে এমন কী মাথার দিব্যি দেওয়া আছে? দুনিয়াটা যে যার নিজের মতো করেই বোঝে। দুনিয়া তো আর একটা নয়। যত মানুষ তত দুনিয়া। ওই যে সব কুকুর বেড়াল পশুপাখি ওদের দুনিয়াও আলাদা রকমের। ধীরেন এরকমই বোঝে। আর বুঝটা যদি একদিন ভেঙে যায় তবে তার খুব কষ্ট হবে।
মহিম দুলে দুলে হাসছিল, বউমার ওপর চড়াও হয়েছিলি এই বয়সে, তোর আক্কেলটা কী রে?
কাঁচুমাচু হতে গিয়েও হতে পারল না ধীরেন। হেসে ফেলল, কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, একটা তাড়নার মতো হল, ভাবলাম দোষের তো কিছু নয়।
তোর বয়স আশি ছাড়িয়েছে না?
তা তো হবেই।
ওসব করতে গেলে হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়। পাগল কি আর গাছে ফলে! আহাম্মক কোথাকার।
ধীরেন আহাম্মকের মতোই হাসছিল। তার পেটে কোনও কথা থাকতে চায় না। কাউকে না কাউকে বলে ফেলে, আগে গৌরহরিদাদাকে সব বলত। আজকাল মহিমদাদাকে বলে। বলে ফেলার মধ্যে একটা খালাস আছে। বললেই মনের ভারটা কমে যায়। অনুতাপ-টাপও থাকে না তেমন।
এই চোখটা কাটিয়ে ইস্তক আমার কীসব যেন হচ্ছে। ঠিক আগের মতো আর নেই আমি। মাঝে মাঝে ভারী ফুর্তির ভাব আসে। শরীরেও কীসব চাগাড় দিয়ে উঠছে।
দুনিয়ায় কত লোক ছানি কাটাচ্ছে তাদের এরকম ধারা হচ্ছে বলে শুনিনি তো! তোরই সব উদ্ভুটে ব্যাপার হয় কেন?
সেটাই তো ভাবছি।
এই বয়সে অত উচাটন ভাল নয়। সামলে সুমলে থাক। ঠাকুর-দেবতার নাম করলেও তো পারিস।
ভগবানের কথা উঠলে ধীরেন সত্যিকারের কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে। ওই একটা ব্যাপারে সে বরাবর কঁকিতে থেকেছে। তার কেবলই মনে হয়, ও নাগালের বাইরের ব্যাপার। ধীরেন ঠিক নাস্তিক নয়, তবে ভাবে, তিনি যদি আছেন তো সবই দেখছেন-টেখছেন, সবই বুঝছেন, আর যা করার করবেনই। ডাকাডাকি করে লাভ নেই। ধীরেনের ডাকে বাড়ির পোষা কুকুরটাও নড়তে চায় না, ভগবান কোন ছাড়।
কফিতে আরও একটা চুমুক দিয়ে ধীরেন বলে, ভগবানকে ডেকে তেমন জুত পাই না দাদা। পাপীতাপী মানুষ তোতা। কত অপকর্ম করে বসে আছি, ভগবান তেমন খেয়াল করেননি হয়তো। ডাকাডাকি করলে হয়তো নড়েচড়ে বসবেন, ভাববেন, দেখি তো ব্যাটার খাতাখানা খুলে পাপপুণ্যির হিসেবটা। তাহলেই তো হয়ে গেল। একেবারে চিৎপাত করে ফেলে দেবেন।
তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
হেঁঃ হেঁঃ করে একটু হাসে ধীরেন কাষ্ঠ। তারপর বলে ধর্মকর্ম করতে বড় দেরিও হয়ে গেছে। এখন ওসব করতে গেলে ভগবান ভাববেন, মশকরা করছি। আরও একটা কথা দাদা।
কী কথা! বলে ফেল।
ভিতু মানুষের কি ধর্মকর্ম হয়? সব ব্যাপারেই যারা জুজুবুড়ি দেখে তাদের ধর্মকর্মেও জুজুবুড়ি ঘাপটি মেরে থাকে। ডাকছে হয়তো কালী বা কেষ্ট ঠাকুরকে, কিন্তু মনের মধ্যে খাপ পেতে আছে জুজুবুড়ির ভয়। তাই পুজো শেষ অবধি ওই জুজুবুড়ির পায়ে গিয়েই পড়ে।
দামড়া কোথাকার। তবে কথাটা খুব খারাপও বলিসনি। আমার এক বিধবা পিসিমাকে দেখেছি ধর্মের নামে এমন শুচিবায়ু করে বেড়াত যে শেষ অবধি মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল। তবু বলি ধর্ম না করিস অধর্মও করতে যাস না।
কফির কাপটা জগের জল দিয়ে ধুয়ে সাবধানে রেখে ধীরেন উঠল।
বড্ড রোদ ওঠে আজকাল, ছাতা নিয়ে বেরোসনি?
পুরনো ছাতাটার শিক-টিক ভেঙে রয়েছে দেখলাম। না সারালে চলবে না।
এই রোদ বেশি মাথায় না লাগানোই ভাল। তোর যে বয়স হয়েছে সে খেয়ালটা রাখিস তো!
রেখেই বা হবে কী? বয়সকে তো কেউ খাতির করছে না। রোদে জলে মরব কিনা বলতে পারি না। তবে মনে হয়, মরণ এখনও দূরে আছে।
ভাল, দূরে থাকাই ভাল।
কিন্তু খুব দূরেও ছিল না মরণ। সেটা মহিমদাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে শর্টকাটে যাবে বলে ঘাসজমিতে কয়েক কদম হাঁটার পরই টের পেল ধীরেন।
দুদিন বৃষ্টি গেছে মাঝখানে। তাইতেই ঘাসগুলো যেন তেজালো হয়েছে একটু। চটিসুদ্ধ ডান পা বাড়িয়ে ফেলতে গিয়েও তার সদ্য কাটানো বাঁ চোখ ঘাসের গভীরে চিত্রল একটি হিলিবিলি চকিতে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল।
বাপ রে! বলে ধীরেন পিছোতে গিয়ে বেকায়দায় চিত হয়ে পড়ে গেল পিছনে। সাপটা প্রায় গা ঘেঁষে ফিসফাস করে আপন মনে কথা কইতে কইতে চলে গেল দূরে।
মাজায় বেশ লেগেছে। ধীরেন উঠে বসল। একটু দম নিয়ে হাঁটুতে ভর করে দাঁড়াল। না, তেমন কিছু নয়। অল্পের ওপর দিয়েই চোটটা গেছে। সে ঘাসজমি ছেড়ে রাস্তা ধরল।
বাঁ চোখই বাঁচিয়ে দিল তাকে। বেঁচে গিয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে তার। অনেকটা কামভাবের মতোই যেন একটা কিছু, ভারী অদ্ভুত লাগছে বটে। আনন্দটা একটা যেন সুড়সুড়ির মতো। সাপের বিচিত্র শরীরের এই গতি ওর মধ্যে কামের কোনও অনুষঙ্গ আছে নাকি রে বাবা! আশির কাছাকাছি বয়সে এসব আবার কীরকম ভাবসাব?
একবার ভাবল ফিরে গিয়ে কথাটা মহিমদাদাকে জিজ্ঞেস করবে। তারপর ভাবল, কাজ কী, তার কথাকে তো কেউ গুরুত্ব দেয় না। এই আবছা মাথায় সে যা বুঝেছে ওটুকুই তার থাক। বেশি বুঝে হবে কী।
.
তোমার হাতে পোস্টকার্ডটা দেখে আমার ভীষণ অবাক লাগছে।
কেন রে?
সেদিন স্বপ্ন দেখছিলাম তোমার বর তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে আর তুমি তার কাছে চলে যাচ্ছ সব ছেড়েছুঁড়ে।
ও মা! বলিস কী? সত্যি স্বপ্ন দেখেছিলি?
হ্যাঁ পিসি। আমি তোমার ওপর খুব রাগ করছিলাম।
অবাক কাণ্ড তো!
কেন পিসি?
এ তো সত্যিই তার চিঠি রে! আজকের ডাকেই এল! হা রে, তোর মধ্যে তো ভগবান অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন!
দুর! ওসব কিছু নয়। এটা সত্যিই তোমার হাজব্যান্ডের চিঠি?
হ্যাঁ। তবে এটা প্রথম নয়। মাস তিনেক আগে আরও একটা লিখেছিল। তাতে শুধু কুশল প্রশ্ন ছিল। আমি অবশ্য জবাব দিইনি।
এবার চিঠিতে কি তোমাকে যেতে লিখেছে?
করুণ একটু হেসে সন্ধ্যা বলল, না রে, সে আর আমাকে চায় না। তবে আমার টাকা চায়। পড়ে দেখ না। প্রেমপত্র তো নয়।
ও বাবা। আমি ছাপা বাংলা পড়তে পারি, কিন্তু হাতের লেখা বাংলা পড়তে পারি না। আর এই ভদ্রলোকের হ্যান্ডরাইটিং ভীষণ জড়ানো। তুমিই পড়ো না।
ও আর পড়ে কী হবে। দুর্গাপুরের কাছে কোথায় যেন বাড়ি করছে। টাকার জন্য কাজ আটকে গেছে। খুব করুণ করে কিছু ধার চেয়ে পাঠিয়েছে।
হি ইজ শেমলেস, তাই না?
আমি ভাবি, আমার আর কোনও খবর তার কাছে না পৌঁছলেও আমার টাকার খবর কিন্তু ঠিক পৌঁছে গেছে। টাকার কত ক্ষমতা দেখেছিস?
খবরটা কে দিল পিসি?
কত লোক আছে। মেয়েমানুষ ব্যবসা করে পয়সা করছে দেখে কত লোকের আঁতে লাগে, চোখ কটকট করে। তাদেরই কেউ জানিয়ে দিয়েছে।
দেবে নাকি টাকা?
এখনও ভাবিনি কিছু। আমার তো আর তার সংসার করা হল না, টাকাও জমে যাচ্ছে। কী করব বল তো! দেওয়া উচিত হবে কিনা সেইটেই ভেবে পাচ্ছি না।
ধার নিয়ে যদি শোধ না দেয়?
সেটা যে দেবে না তা খুব জানি। ধার বলে দেবও না। আমি শুধু উচিত অনুচিতের কথা ভাবছি।
এই একটা জায়গায় তোমার ভীষণ উইকনেস, তাই না পিসি? নইলে এমনিতে তুমি বেশ হার্ডেনড মেয়ে।
তোরা হলে সে চাইতেই সাহস পেত না। সে লোক চেনে। সে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না বটে, কিন্তু আমি তো মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারিনি সম্পর্কটা। তাই দুর্বল হয়ে পড়ি।
তোমরা একটু কেমন যেন আছ। তাই না? তুমি, বলাকা।
এই ধিঙ্গি মেয়ে, বলাকা কী রে? আমরাই জেঠিমা ডাকি।
তা হোগ গে, আমার তো খুব বন্ধুর মতো মনে হয়।
দেব মাথায় গাঁট্টা, তা জেঠিমার আবার কী হল?
তোমার মতোই। একজন পুরুষকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এটা কী করে হয় তাই ভাবছি। তোমাদের অবস্থা তো দাসীবাদির চেয়েও খারাপ।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বলল, তা নয় রে।
তাহলে?
সমাজের নিয়ম কি সব সময়ে সকলের ক্ষেত্রে খাটে? মানুষের মনের ভিতরটায় কত কী আছে, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
তা বলে তুমি লোকটাকে টাকা দেবে?
দেবো বলিনি। ভাবছি। আমার তো অনেক টাকা জমে আছে, আমি মরলে সে টাকার কী গতি হবে কে জানে। তা সেই লোকটার যদি উপকার হয় সে কথাই ভাবছি। টাকা দিলে লোকটার হয়তো একটু আক্কেলও হবে। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লজ্জাও করবে। তাই না, বল!
সেসব আমি জানি না। শুধু জানি, তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি এক্কেবারে যা-তা।
সন্ধ্যা হেসে ফেলে। তারপর হঠাৎ চোখের জল সামলাতে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে চোখে। একটু চুপ করে থাকে। তারপর ধরা-ধরা গলায় বলে, তবু যা হোক আমার একটা দাম হয়েছে তো তার কাছে, এতদিন বাদে। একটু গুরুত্ব তো দিচ্ছে, হাত পাতছে।
তোমার যা খুশি কর গে। আমি তোমাকে নিয়ে আর পারি না।
সত্যিই বলেছিস, আমি একেবারে যাচ্ছেতাই। বড্ড সেন্টিমেন্টাল। কিন্তু কী জানিস, কয়েকদিন আগে বড়দার ঘরে টি ভি-তে একটা সিনেমা দেখছিলাম। ইংরেজি ছবি। তাতে একটা মেমসাহেব একটা সাহেবের জন্য যা ল্যালামি করছিল দেখলে তোর রাগ হত। ছেলেটা মেয়েটাকে একদম পাত্তা দিচ্ছিল না, একবার তো ধাক্কা মেরে ফেলেই দিল। গালাগালও করছিল যেন। তবু মেয়েটা এমন হ্যাংলামি করছিল যে বলার নয়। ইংরিজি তো ভাল বুঝি না। ছবিটা দেখে ভাবলাম, সাহেবদের দেশেও তো এরকম হয়। ওরা অবশ্য স্বামী-স্ত্রী ছিল না, প্রেমিক-প্রেমিকাই হবে।
সেই ছবিটাই বুঝি তোমার ইনস্পিরেশন?
না রে। ছবিটা দেখে মনে হল, এরকম হয়, হতে পারে। ও-দেশে যেমন হয়, এ-দেশেও তেমন হয়।
সোহাগ হেসে ফেলল। বলল, এই জন্যই তোমাকে এত সুইট লাগে আমার।
সন্ধ্যা লাজুক হেসে বলে, বোকা বলে তো!
একজ্যাক্টলি। তুমি একদম বুদ্ধ আর বোকা। তাই এত সুইট। বুঝলে?
ভাগ্যিস বুদ্ধিমতী হইনি, তাহলে তো আমার সঙ্গে তোর এত ভাব হত না। হত, বল?
বোধহয় না।
হ্যাঁ রে, আমার পুষ্যি মেয়ে হবি?
ও আবার কী কথা পিসি? আমি তো তোমার মেয়েই।
মা বলে তো ডাকিস না!
তা ডাকতে পারি। কিন্তু তুমি যে মায়ের মতো বড় নও।
আমার বয়সই বুঝি বসে আছে!
তাহলেও তুমি আমার মা হওয়ার পক্ষে একটু বেশি ইয়ং।
সন্ধ্যা লাজুক হেসে বলে, তা অবিশ্যি ঠিক। আমি মা আর বাবার বুড়ো বয়সের সন্তান। বেশি বয়সে সন্তান হওয়াতে নাকি মা-বাবার নিন্দে হয়েছিল। থাক বাবা, পিসিই ডাকি। মা ডাকলে আবার পাঁচটা কথা উঠবে। বউদিও পছন্দ করবে না। আসল কথা কী জানিস? একটা ভালবাসার লোক থাকলে কাজকর্ম করে একটা আনন্দ হয়। আমি ভেবে রেখেছি আমার সব টাকা-পয়সা, ব্যবসা-ট্যাবসা সব তোকেই দিয়ে যাব।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি যাবেটা কোথায়?
যখন মরব তখনকার কথা বলছি।
হ্যাঁ পিসি, তোমার বুঝি ইচ্ছামৃত্যু?
কেন রে, একদিন কি মরব না?
ইউ আর ইন মিড থার্টিজ। মরার বয়স হতে যে ঢের দেরি। ততদিনে আমি কোথা থেকে কোথায় চলে যাব তার কি ঠিক আছে? হিসেব করলে তোমার যখন মরার বয়স হবে তখন আমিও বুড়ি হয়ে যাব।
দুজনেই খুব হাসল।
কথা হচ্ছিল নিমের ঝিরঝিরে ছায়ায় দুটো মোড়া পেতে বসে। পাশেই ধানের মরাই। সামনে অনেকটা ঘাসজমি। একটা সুঁই কুমড়োর গাছ লতিয়ে গেছে অনেক দূর অবধি। কুমড়ো ফলেছে অনেক। সবজে-সাদা কচি কুমড়ো বয়ার মতো ভেসে আছে ঘাসের ওপর। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে সকালবেলার রোদে ওই ঘাসজমিটা।
মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিল সোহাগ। অবাক হয়ে দেখল ঘাসজমিটার মাঝামাঝি জায়গায় হঠাৎ একটা হাত উঠে আসছে শূন্যে। যেন ডুবন্ত কোনও মানুষ জলের ওপর অসহায় তার হাতখানা তুলে দিয়েছে। অবাক চোখের বিভ্রম খসে পড়তেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল সোহাগ।
সন্ধ্যা বলল, কী রে? কী হল?
দ্যাট স্নেক! আই লাভ দ্যাট স্নেক।
সন্ধ্যাও দেখতে পেল। প্রকাণ্ড পাকা বয়সের গোখরোটা ফণা তুলে আছে।
কোথায় যাচ্ছিস! বলে আর্তনাদ করে ওঠে সন্ধ্যা।
দাঁড়াও। আই মাস্ট হ্যাভ এ ক্লোজ লুক। বলেই ঘাসজমির দিকে ছুটে গেল সোহাগ।
করিস কী পাগল! মরবি নাকি? বলে সন্ধ্যা ছুটে গিয়ে একটা হাত ধরে ফেলে টেনে আনে সোহাগকে।
সোহাগ হিহি করে হেসে বলে, তুমিই না বলেছ ওটা বাস্তুসাপ! আমাদের পোষা।
দুর বোকা! বাস্তুসাপ বলেই কি আর বিষ নেই নাকি?
তুমি যে বলেছিলে ওরা কামড়ায় না!
সন্ধ্যা ভয়ার্ত চোখে সোহাগের দিকে চেয়ে বলে, সর্বনাশী মেয়ে বাবা তুই! বাস্তুসাপ বলে কি বুকে টেনে নিতে হবে নাকি? ক্ষেপি কোথাকার!
আমার যে খুব বিশ্বাস হয়েছিল, ওটা আমাদের পোষমানা সাপ।
ঘাসজমিতে উঁচু হয়ে থাকা হাতখানা বাতাসে খানিক দোল খাচ্ছিল। তার সাদাটে বুকে রোদ। চারদিকটাকে পেরিস্কোপের ভঙ্গিতে বুঝবার চেষ্টা করছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে ডুবে গেল ঘাসের গভীরে।
আমার অনেকদিন ধরে একটা সাপ পুষবার শখ।
আচ্ছা মেয়ে রে বাবা! তুই বোধহয় সব পারিস। আমার বুকটা এখনও ধকধক করছে।
হি হি করে হাসল সোহাগ, কেন ভয় পাও পিসি? আমার তো একটুও ভয় করে না। আমি একদিন সাপটাকে ফলো করব। দেখব ও কোথায় কোথায় যায়, কী কী করে, ওর লাইফ স্টাইলটা কীরকম। হাত নেই। পা নেই। শুধু একটানা একটা শরীর, আশ্চর্য না?
এবার সন্ধ্যাও হেসে ফেলে, তার পর গম্ভীর হয়ে বলে, ওসব যদি করিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি, এই বলে রাখলাম।
.
কেমন আছো পারুলদি?
একটু আগেই রাত এগারোটা বেজেছে, পারুল জানে। তবু একবার দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। এগারোটা কুড়ি। বলল, অ্যাই হনুমান, রাত সাড়ে এগারোটায় ফোন করে কুশল প্রশ্ন করা হচ্ছে? ব্যাপারটা কী তোর?
আহা, রাত সাড়ে এগারোটায় একটা লোক কেমন আছে তা জানার কৌতূহল কি হতে পারে না? ধরো সকালে হয়তো লোকটা ভাল আছে, বিকেলে খারাপ, রাত এগারোটায় হয়তো খুব ভাল। সেইজন্যই কুশল প্রশ্নও বিভিন্ন সময়ে, এমনকী আনগডলি আওয়ারেই করা উচিত।
থাপ্পড় খাবি।
শুয়ে পড়েছিলে নাকি?
না রে। ইয়ার এন্ডিং আসছে, হিসেবপত্তর নিয়ে বসেছি।
তোমার ছোটো ছেলেটা? হাউ ইজ হি?
ছেলের নামে একটু উথলে ওঠে পারুল। মাত্র তিন মাস বয়েস। তবু তার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখতে পায় পারুল। মায়েরা দেখে।
আর বলিস না ভাই, যা দুষ্টু হয়েছে। ওকে নিয়েই তো সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।
কেন, তোমাদের আয়া-টায়া নেই?
তা আছে। দুজন। তবু এটাকে আমি নিজের মতো করে মানুষ করতে চাই বলে আয়াদের কাছে। বেশি দিই না। হ্যাঁ রে বিজু, এত রাতে ফোন করলি যে হঠাৎ!
আরে আজকাল কেবল টিভি-র গুণে কোনও বাড়িতেই কেউ রাত বারোটা-একটার আগে শুতে যায় না। তাই ভাবলাম, তোমাকে একটু ফোন করে খবর নিই।
আসলে বেশি রাতে ফোন এলে বুকটা ধক করে ওঠে। কার কী হল সেই চিন্তা হয়।
আরে না না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
তোর খবর কী?
নাথিং নিউ। যথাপূর্বং।
বাজে বকিস না। সব জানি।
কী জানো?
পান্নার সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়।
পান্না! ও আবার কী লাগিয়েছে তোমার কাছে?
যা সত্যি তাই বলেছে।
দুর দুর। যা শুনেছ সব বাজে কথা।
কী শুনেছি তা জানলি কী করে? এখনও তো বলিনি কিছু।
আসলে ওই সোহাগকে নিয়ে তো!
হ্যাঁ তো!
গাঁয়ের লোকেরা কূপমণ্ডুক হয়, জানো তো! মুখরোচক কিছু পেলেই হল।
তাহলে কি ঘটনাটা কি সত্যি নয়?
আরে না। আমার কম্পিউটারে ই-মেল চেক-টেক করে। বেশি কথাও হয় না আমাদের। বিশ্বাস করো।
করলাম। সোহাগ অন্য রকমের মেয়ে। অন্য সব মেয়ে যা করে ও তা কিছুতেই করবে না। সত্যি কথা বল তো, ওকে তোর ভাল লাগে?
এমনিতে ঠিকই আছে।
পছন্দ?
আহা, পছন্দের কথা উঠছে কেন?
বল না, আমি অনেকদিন আগেই মনে মনে তোর জন্যই ওকে বাছাই করে রেখেছিলাম।
তোমাদের কি সব সম্পর্কের একটা হেস্তনেস্ত না করে শান্তি নেই?
হেস্তনেস্ত আবার কী? মেয়ে পুরুষের দুজনের দুজনকে পছন্দ হলে বিয়ের কথা তো উঠবেই।
পারুলদি, তুমি কিন্তু কিছুদিন আগেও এত সেকেলে ছিলে না।
তোর আর বেশি একেলে হওয়ার দরকার নেই। তৈরি হ।
পাগল নাকি! এখনও আমার প্র্যাকটিস জমেনি।
বাজে কথা বলিস না। সব খবর জানি।
কী জানো?
বাবার সব মক্কেল এখন তোর হাতে। বাবার অর্ধেক করা মামলাগুলো সব তুই হাতে নিয়েছিস এবং এখন তোর রোরিং প্র্যাকটিস–ঠিক বলেছি?
যা শুনেছ ততটা নয়। যে কোনও গল্পের চারাগাছই বর্ধমান থেকে জামশেদপুর যেতে যেতে মহীরুহ হয়ে যায়।
গাড়িও তো কিনেছিস শুনলাম। সেটা কি আকাশ থেকে পড়ল?
আরে সেকেন্ডহ্যান্ড মারুতি এইট হান্ড্রেড, ও তো আজকাল হকারদেরও থাকে।
বাজে বকিস না, গাড়ির বাজার আমি ভালই জানি। সেকেন্ড হ্যান্ড কিনলি কেন? পান্না যে বলল, নতুন গাড়ি।
এক রকম নতুনই। আমার এক মাড়োয়ারি ক্লায়েন্ট কিনেছিল। হাজার কিলোমিটারও চলেনি।
হাজার কিলোমিটার! তাহলে তো একদম নতুন।
ওই এক রকম।
আর বিনয় করতে হবে না। গাড়িতে সোহাগকে চড়িয়েছিস?
সাহস পাইনি।
তার মানে?
ও ওসব গাড়িবাজি পছন্দ করে না।
তাহলে কী পছন্দ করে?
চুপচাপ বসে থাকা।
ওমা! তোদের মধ্যে ভালবাসার কথা হয় না?
পাগল নাকি?
তোরা কী রে?
এসব পোস্ট মডার্ন পারুলদি, তোমরা বুঝবে না। বড্ড সেকেলে আছ এখনও।
একটু পাগলি আছে ঠিকই, কিন্তু শি ইজ ভেরি গুড অ্যাট হার্ট, আমাকে কেন যে গডেস ভাবত কে জানে!
তোমাকে অনেকেই গডেস ভাবত পারুলদি।
মারব গাঁট্টা। কে আমাকে গডেস ভাবত রে?
এ-গাঁয়ের তৎকালীন ব্যর্থ যুবকেরা।
তোর মুন্ডু। শোন, তোদের ওই পোস্ট মডার্ন সম্পর্কটা যেন কেটে না যায়। আজকাল ছেলেতে-মেয়েতে ভাবসাব হতে না হতে বড্ড ছাড়কাট হয়ে যায়। তুই তো আবার কাঠখোট্টা গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের, তার ওপর পিউরিটান। তোর যে কী হবে কে জানে বাবা।
আমার কিছু হওয়ার নয়।
সেই জন্যই তো ভয়। তুই যেমন বেরসিক, তেমনি জুটেছে তোর সোহাগ পাগলি।
ইয়ে পারুলদি, কাল পরশু একবার চলে এসো না।
দুর পাগল! এখন কি আর যাওয়ার উপায় আছে! বললাম না ইয়ার এন্ডিং।
আরে রাখো তো ইয়ার এন্ডিং। ওসব করার জন্য তোমাদের অনেক কর্মচারী আছে। শোনো, বড়মার আজ একটু ব্রিদিং ট্রাবল হচ্ছে।
সর্বনাশ! এতক্ষণ বলিসনি?
আরে অ্যালার্মিং কিছু নয়। ডাক্তার এসে দেখে-টেখে গেছে।
আমি তো সন্ধেবেলাতেই মার সঙ্গে কথা বললাম। তখন তো
তখন ছিল না। রাত আটটা নাগাদ ব্যাপারটা হয়। নাথিং সিরিয়াস।
সিরিয়াস না হলে আমাকে তুই যেতে বলতিস কি?
বড়মা নিজেই একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। তোমাদের দেখতে চাইছে।
দাঁড়া আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলব।
আরে দাঁড়াও, শি ইজ আন্ডার সেডেটিভ। আমি তো বড়মার কাছেই আছি। শি ইজ পিসফুলি অ্যাস্লিপ, পারলে চলে এসো।
হ্যাঁ রে, সত্যি করে বল তো সিরিয়াস নয়?
আরে না।
দাদাদের খবর নিয়েছিস?
হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। দে উইল বি হিয়ার বাই টুমরো।
আমার বুকটা কাঁপছে রে। ডাক্তার কী বলল?
ডাক্তার বলেছে, ব্রংকিয়াল ব্লক থেকেও হতে পারে। কাল আমি বড়মাকে ই সি জি করাতে নিয়ে যাব বর্ধমানে। সকালবেলায়।
তুই আছিস, এটাই যা ভরসা।
আমি আছি পারুলদি। চিন্তা কোরো না। বড়মা উইল বি অলরাইট।
ফোনটা যখন রাখতে গেল পারুল তখন তার হাত শিথিল। চোখে জল। মা বাঁচবে তো!
.
দুপুরের খরসান আলোয় সে স্রোতের মতো বয়ে এল এতদূর। সে কি একটু পরিশ্রান্ত? দীঘল শরীর কিছু শ্লথ। সামনে কিছু জটিলতা। ডালপালা আগাছার অবরোধ। সে ধীর গতিতে পেরোল। তারপরই একটা বাধা। বিপদ কি?
সামনেই সাদা, মসৃণ একজোড়া পা। ভারী সুন্দর পা। কোনও সুন্দরীর পা। কিন্তু তার কোনও সৌন্দর্যের বোধ নেই। নারীর মর্মও সে বোঝে না। সে শুধু বোঝে বিপদ, বোঝে বাধা।
সন্দিহান, কুটিল চক্ষুর দৃষ্টিতে সে লক্ষ করল সাদা পা দুখানাকে। শত্রুপক্ষ? খাদ্য? প্রতিরোধ?
একটু অপেক্ষা করল সে। শরীরে তার ভয়ের সংকেত। সে ভয় পায়।
পা দুটো নড়ে। একটু এগোয়, ফের পিছোয়। বিরক্তিকর। সে একটা শ্বাস ছাড়ল। তারপর ধীরে উত্তোলিত করতে লাগল তার ফণা।
.
৭৫.
মনোরম বন্ধনগুলো এইসব সময়ে টের পাওয়া যায়। যেন লতায় পাতায়, মায়ায়, মোহে বেঁধে রেখেছে হাত-পা, এমনকী মগজ আর মনও। কখন বাঁধা পড়ে যায় তা মানুষ টেরও পায় না। এইসব সংকটের ডাক এলে টের পাওয়া যায়। বোঝা যায় একটা সিস্টেমের কত আঁকুশি, কত ফের-ফেরতা। মায়ের অসুখের খবর পেয়ে সকালেই রওনা হবে বলে তৈরি হতে গিয়ে পারুল এইসব বন্ধনকে টের পেল খুব। মাত্র দু-চার দিনের জন্য যাওয়া, তাতেও কত বাধা, কত অসুবিধে। বড় ছেলেমেয়ে দুটোর স্কুল খোলা বলে যাবে না, তার বর নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে ছোটাছুটি করছে দিনরাত, তার নিজেরও কি শ্বাস নেওয়ার সময় আছে? তাদের ব্যবসা বাড়ছে, কারখানা বড় হচ্ছে, নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার লগ্নি। কত দায়ভার তার মাথার ওপরে। তার অনুপস্থিতি ঘরগেরস্থালিতেও কত শূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। এইসব বন্ধন সারা রাত তার হাত-পা শিথিল করেছে, মন হয়েছে বিকল। এখন হুট বলতেই ছুটকারা পাওয়া বড় কঠিন। একটা ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল করছে তারা, চলছে একটা কম্পিউটার আর স্পোকেন ইংলিশ ইন্সটিটিউট। সবই পারুলের দায়িত্বে। আর দায়িত্বটা বিশাল। সে তার বরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই কাজ করে। কত বেকার ছেলেমেয়ের সামনে সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে তারা।
খুব সকাল থেকেই বারবার ফোন করেছে মাকে। মা ধরেনি, ধরেছে বিজু বা পান্না।
বিজু বলল, আরে, টেনশনের কিছু নেই। তুমি ধীরেসুস্থে এসো।
মায়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে না?
কেন যাবে না? কিন্তু এখনও ঘুমোচ্ছে যে।
মা তো এত বেলা অবধি ঘুমোয় না।
এটা তো নরম্যাল ঘুম নয় পারুলদি। শি ইজ আন্ডার সেডেটিভ।
ইস, আমার যে বুকের মধ্যে কেমন হচ্ছে।
ডাক্তার তো অ্যালার্মিং কিছু বলেনি, ভাবছ কেন?
ডাক্তারটা কেমন?
অনল বাগচীর খুব নাম। এদিকে সবাই তো প্রশংসাই করে। বিদেশি ডিগ্রি আছে।
পারুল বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল দশটা নাগাদ। তাদের সদ্য কেনা এ-সি গাড়িতে, সঙ্গে আয়া, লাঞ্চের বাস্কেট, জল।
তার মোবাইলে সবসময়ে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। তবু ঘণ্টা খানেক বাদে পান্নাকে পাওয়া গেল ফোনে।
কী খবর রে, মা কেমন?
তুমি আসছ তো! ওঃ কী ভালই যে হবে।
দুর মুখপুড়ি, মায়ের কথা বল।
বড়মাকে নিয়ে বিজুদা তো বর্ধমানে গেছে। ই সি জি হবে, আরও কী কী সব টেস্ট যেন।
মা নরমালি যেতে পারল?
হ্যাঁ তো।
ব্রিদিং ট্রাবলটা?
একটু আছে। খুব সামান্য। সবাইকে দেখতে চাইছে। বড়মার ধারণা হয়েছে, আর বাঁচবে না। শুনে আমরা খুব হাসিঠাট্টা করেছি।
আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে।
অত ভেব না। আমরা তো সবাই কাল রাতে বড়মার কাছে ছিলাম।
কে কে?
বাবা, আমি, ছোটমা, বিজুদা। একজন নার্সও ছিল। তুমি একদম ভেব না। বড়মা ঠিক আছে।
মায়ের যদি সিরিয়াস কিছু না-ই হবে তবে তোরা সবাই মিলে মায়ের কাছে রাতে ছিলি কেন?
আমরা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বড়মার তো কখনও তেমন অসুখ-বিসুখ করে না। তাই স্বাসকষ্ট হচ্ছে শুনে সবাই চলে এলাম। আজ সকালে সোহাগও চলে এসেছে খবর শুনে। তুমি এখন কোথায় পারুলদি? গলাটা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে কেন?
কোথায় তা কি আমিই জানি? একটা পেট্রল পাম্পে থেমেছি। গাড়িতে তেল নেওয়া হচ্ছে। যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে।
পারুল ফোন কেটে দিল।
সোহাগ বলল, ওয়াজ দ্যাট গডেস?
পাল্লা হেসে বলল, হ্যাঁ। তোমার গডেস এখন একজন বিগ উওম্যান। অনেক টাকা। শুনলাম স্কুল খুলছে। আমাকে বলে রেখেছে, পাস করলেই চাকরি। কী মজা হবে বল তো!
নাক কুঁচকে সোহাগ বলল, চাকরিতে আর কীসের মজা?
মজা নয়। আমার তো ভাবতেই থ্রিল হচ্ছে। চাও তো তোমার জন্যও বলে রাখি।
সোহাগ হাসল, চাকরি-টাকরি আমার ভাল লাগে না। রোজ একটা লোক একই কাজ কীভাবে করে ভাবতে আমার অবাক লাগে।
আহা, আমরা তো রোজ ভাত খাই, ঘুমোই, দাঁত মাজি। সেগুলোও তো একই কাজ।
সোহাগ কথাটার জবাব দিল না। হেসে বলল, ফ্রক পরে আজ তোমাকে একদম বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। ভারী সুইট।
লজ্জা পেয়ে পান্না বলে, ফ্রক পরতেই আমার ভাল লাগে কেন বল তো! আজকাল পরছি কেন জান? শাড়ি পরে ঘুমোলে বড্ড জড়িয়ে যায় পায়ে-টায়ে। আমার শোওয়া তো বিশ্রী। একদিন ভোরবেলা উঠতে গিয়ে পায়ে শাড়ি জড়িয়ে দড়াম করে আছাড় খেয়েছি। সেই থেকে শোওয়ার সময় ফ্রক পরে শুই। আজ বড়মার ঘরদোর সারতে হবে বলে ফ্ৰকই পরেছি। কত সুবিধে বল।
দুখুরি এসে বলল, ও দিদি, ঠাকুরঘর সারবে না! সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে যে!
যাচ্ছি, যাচ্ছি, তুই বড্ড হুড়ো দিস।
ইস তাই বইকী। মা তো কোন ভোরবেলা ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে দেয়।
সোহাগ বলল, মে আই হেলপ? কিছু কাজ আমিও করতে পারি।
চলো, তাহলে ফুল তুলে আনি।
দোপাটি আর টগর ছাড়া এখন তেমন ফুল নেই বাগানে। আছে, লঙ্কাজবা, দু-পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে কদিন আগে। ঘাস আর আগাছা উঠেছে তেড়েফুঁড়ে। বড় টগর গাছটা থেকে ডিং মেরে ফুল পাড়ছিল পান্না।
হঠাৎ ফোঁস শব্দটা শুনে কেঁপে উঠল। একটু হলেই সাজিটা পড়ে যেত হাত থেকে। চোখ বিস্ফারিত করে নীচে তাকাতেই স্পষ্ট চোখাচোখি হয়ে গেল সাপটার সঙ্গে। একটা চিৎকার দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ভয়ে কাঠ। সাপের চোখ চোখের পলকে সম্মোহিত করে ফেলল তাকে। সে চোখ সরাতে পারছে না, নড়তে পারছে না, বাকরুদ্ধ, চোখে পলক নেই।
একটু পিছন থেকে এগিয়ে এল সোহাগ।
এই, চেঁচালে কেন? কী হয়েছে? এনিথিং রং?
সাপটা ফণা তুলে আছে স্থির হয়ে। কুটিল চোখে পলকহীন এক দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে বিবশ করে ফেলছে পান্নাকে।
সোহাগ তার হাত ধরে হ্যাঁচকা একটা টানে সরিয়ে নিল। তারপর বলল, ভয় পাচ্ছ কেন? ইট ইজ জাস্ট এ স্নেক।
অজ্ঞানই হয়ে যেত পান্না, সোহাগের হ্যাঁচকা টানে চৈতন্য হল তার।
সে চেঁচাল, পালাও, পালাও।
তাকে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে সোহাগ বলল, টেক ইট ইজি। দেখ, সাপটা চলে যাচ্ছে। দেখ, হাউ ম্যাগনিফিসেন্ট ইট ইজ। সাপের মতো গ্রেসফুল কিছু হয়? ভয়ের কী?
অবাক হয়ে পান্না বলল, তুমি সাপকে ভয় পাও না, না?
আমি কোনও কিছুকেই ভয় পাই না। নট ইভন লোনলিনেস।
.
বেলা বারোটার মধ্যেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেল বলাকা। সিরিঞ্জ ভরে কত রক্ত শরীর থেকে টেনে নিল ওরা। তারপর এক্স-রে, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম।
বিজু, এবার রেহাই দে বাবা। বাড়ি চল তো, একটু শুয়ে থাকি।
হ্যাঁ বড়মা, সব হয়ে গেছে। এবার যাব।
তুই তো সকাল থেকে দাঁতে কুটোটিও কাটিসনি। মুখখানা শুকিয়ে গেছে।
যা খেল্ দেখাচ্ছ, খিদে উবে গেছে। শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
লাগবে না, কত রক্ত নিয়ে নিল বল তো।
শ্বাসকষ্টটা?
তেমন টের পাচ্ছি না এখন। তবে কোমর টনটন করছে, চোখ মেলে চেয়ে থাকতে পারছি না।
ওটা কাল রাতের সেডেটিভের এফেক্ট। তার ওপর কিছু খাওনি।
রামহরি বিষয়কর্মে কোথাও গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, জল-টল কিছু খাবে বউদি? এখানে একটা দোকানে ভাল রসগোল্লা হয়।
না ভাই। একেবারে বাড়ি গিয়েই যা হয় খাব, স্নানও করিনি তো।
তেষ্টা পেয়ে থাকলে বোতলের জল কিনে আনি।
আমার খিদেতেষ্টা যে কত কমে গেছে আজকাল, তোমরা জান না।
জানব না কেন, খুব জানি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়েছ বলেই তো শরীরের এই হাল। আজকাল সত্তর বাহাত্তর বছরের মহিলারা লিপস্টিক মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখ গে যাও। তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি।
বলাকা ক্ষীণ একটু হাসল।
বাড়িতে ফিরেই অবশ্য মনটা ভাল হয়ে গেল। ছেলেরা, বউরা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে গেছে। বাড়ি গমগম করছে লোকে। বাড়িতে পা দিতেই সবাই যেন আগলে নিল তাকে।
এই তো তার ওষুধ, এই তো চিকিৎসা। গুচ্ছের ট্যাবলেট গিলে কি আর বেঁচে থাকা যায়! বাঁচতে তো মানুষজনও চাই। এই সত্যি কথাটা বলাকা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। আর পারে না বলেই ভিতরে ভিতরে তার ভূমিক্ষয় হতে থাকে। আজ বুকটা বড় ঠান্ডা লাগছে।
স্নান খাওয়ার পর আজ আর শোবে না বলে ঠিক করেছিল বলাকা, কিন্তু একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে কখন অসতর্কভাবে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে। ডাক্তার বসে নাড়ি দেখছে। ঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সবাই।
কী হয়েছে তার? কী হয়েছে? উঠে বসতে যেতেই মাথাটা কেমন করল।
ডাক্তার অনল বাগচী বলল, না না, উঠবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন।
আমার কী হয়েছে ডাক্তার?
অনল বাগচী বলল, তেমন কিছুই তো নয়। একটু রেস্ট নিন।
রেস্ট! আর কত রেস্ট নেব বাবা!
ডাক্তার জবাব না দিয়ে প্রেশারের যন্ত্র বের করল।
একটু রাতের দিকে এল মহিম রায়। চোখে জল, গলা আবেগে কাঁপছে, চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন নাকি বউঠান?
বলাকা হাসে, চলে আর যেতে পারছি কই? দেখছেন না, ডাক্তার বদ্যি, ওষুধপত্রে বাড়ি ভরে গেল। ডাক্তার বলে গেল, ভয়ের নাকি কিছু নেই। ওরা তো বোঝে না, চলে যাওয়াটা মোটেই ভয়ের ব্যাপার নয়।
আপনার যে ইচ্ছামৃত্যু বউঠান। শরীরে মনে যাদের পাপ নেই তারা যেদিন ইচ্ছে দেহ ছাড়তে পারে। আমাদের মতো পাপীতাপীদেরই নানা ভোগান্তি।
ওসব বলবেন না ঠাকুরপো, মরার কথা ভাবেন কেন?
ও আপনিও ভাববেন না, আপনি চলে গেলে, আমার মনে হয়, গাঁয়ের লক্ষ্মীই চলে যাবে। আপনি নমস্যা।
আমাকে আর পাপের তলায় ফেলবেন না ঠাকুরপো, পায়ে পড়ি, সম্পর্কে বড় হলেও আমি বয়সে আপনার ছোট, মনে রাখবেন।
মহিম মলিন হেসে বলে, বয়সটাই হল, আর কিছু হল না। গৌরদা গিয়ে অবধি বড় কাহিল হয়ে পড়েছি। আপনি গেলে যে সব যাবে।
মহিম চোখের জল মোছে। এ তার মন-ভোলানো কথা নয়। মনে মনে সে এই মহীয়সী নারীকে এই গাঁয়ের লক্ষ্মী বলেই ভেবে এসেছে। গৌরহরিকে বলেছেও সে কথা। গৌরহরি শুধু হাসত। সেই হাসির মধ্যে একটা উজ্জ্বল তৃপ্তি ফুটে উঠত। যেন প্রাইজ জেতার আনন্দ।
টর্চের ব্যাটারিটা বড্ড কমজোরি হয়ে গেছে, বদলাতে হবে। নিবু নিবু আলোয় পথ ঠাহর করে ফিরছিল মহিম। মনটা ভার। বউঠানের অসুখ-টসুখ শোনেনি কখনও। বলতে গেলে এই প্রথম। কিন্তু শরীর কি সিগন্যাল দিচ্ছে? বউঠান চলে গেলে একটা যুগই শেষ হয়ে যাবে যেন।
কাঞ্জিলালের জমিটার কাছ বরাবর রাস্তায় একটা আড়াআড়ি খাঁজ। একটা নালার মতো। টর্চের আলোটা ভাল পড়েনি সেখানে। আনমনে পা বাড়িয়েও হঠাৎ কী যেন মনে হল মহিমের। কে যেন টেনে ধরল পিছন থেকে। টর্চের বাতি আরও ক্ষীণ হয়েছে। চোখের জোরও তো কমে গেছে অনেক। শূন্যে বাড়ানো পা টেনে নিল মহিম। তারপর দেখতে পেল।
বিশাল লম্বা চিত্রিত একটা শরীর খুব ধীরে ধীরে রাস্তাটা পেরিয়ে যাচ্ছে। টর্চটা ধরে রইল মহিম। সাপটা অনেকক্ষণ ধরে রাস্তাটা পার হল।
চিন্তিত মহিম আবার হাঁটতে লাগল। এই রাতের অন্ধকারে সাপটা যে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
নিজেও সে জানে না। আলো আর অন্ধকার কোনওটাই তার প্রিয় নয়। সে শুধু এক অনির্দিষ্ট নির্দেশেই চলে। কখনও থামে, চারদিকটা ঠাহর করার চেষ্টা করে। সে ভয় পায়। এই পৃথিবীতে তার বসবাস কখনওই নিরাপদ নয়।
অন্ধকার মাঠের মধ্যে সাপটা একটু থামল। শরীরে একটা চলবলে ভাব। খোলস ছেড়ে যাচ্ছে দেহ। একটা ইটের পাঁজার শ্যাওলা ধরা খাঁজে সে প্রবাহিত করে দেয় নিজেকে। ইটের খাঁজে খাঁজে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভূতি। তবু সে নিজেকে প্রবাহিত রাখে। খাঁজে খাঁজে আটকে যায় তার আলগা খোলস। শরীরে নির্মোক খসে যেতে থাকে। সিরসির করে তার নতুন ত্বক। ধীরে ধীরে দীর্ঘ একটা মোজার মতো নিজের খোলসটি ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে।
না, তার কোনও স্থায়ী গৃহ নেই, ঠিকানা নেই, গৃহিণী বা সংসারও নেই। সে একা, সে অসুখী। সে প্রবহমান এক অনন্ত একাকিত্ব।
তার হৃদয় নেই, প্রেম নেই। তবু বীজ বপনের অস্থিরতা আছে। শরীরে সেই চঞ্চলতা টের পায় সে। বারংবার সে শ্বাসবায়ু ত্যাগ করে। ক্ষীণ চোখে, ত্বকে, তার অস্পষ্ট ঘ্রাণশক্তি দিয়ে সে নারীগন্ধ খোঁজে। তার বিবাহের সময় এল। শরীরে অনাগত সন্তানের কোলাহল। সে সংবরণ জানে না। তার নারীশরীর চাই।
সে তাই খোঁজে। সর্পিল শরীরে কত খানাখন্দ, কত গহ্বর কন্দরে সে তার পিছল কামার্ত শরীর প্রবাহিত করে দেয়।
যখন চড়া রোদে ধুধু করছে মাঠঘাট, সে একটা বিশুষ্ক নালা পার হয়ে নিবিড় এক ঘাসজমির ভিতরে অকস্মাৎ দেখা পেল তার। নির্ভুল নারীগন্ধ পেয়ে গেল সে।
পূর্বরাগ ছিল না, ভূমিকাও নয়, তারা উভয়েই উত্তোলিত ফণায় মুখোমুখি হল। চোখে চোখ। নর ও নারী। তার পর মুহূর্তেই তীব্র ছোবল এসে পড়ল তার শরীরে। সে এই মুদ্রা চেনে। পালটা ছোবলে সে তার মহিলাকে আক্রমণ করে। ভাষাহীন, ভাবাসাহীন তাদের এই আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের ভিতরেই লুকোনো ইচ্ছা বেরিয়ে আসে যেন। তোমাকে চাই। ছোবলে ছোবলে চুম্বন নেই, কিন্তু আসঙ্গ আছে। আর ওই আক্রমণের ভিতরেই পাক খেয়ে জড়িয়ে যায় দুটো বাহুহীন শরীর। কাছাকাছি দুটি মুখে কোনও রূপতৃষ্ণা নেই, পছন্দ অপছন্দ নেই, নেই প্রিয় ফিসফাস। শুধু প্রয়োজন, শুধু মোক্ষণ। রতিক্রিয়া কোনও উপভোগ্য কাজ নয় তার কাছে। এ যেন শরীরের এক বাধ্যতামূলক নির্দেশ মাত্র। সে তার বীজের ভূমি খুঁজে পেল আজ দ্বিপ্রহরে। মাত্র এটুকুই।
ওরে শঙ্খ লেগেছে! শঙ্খ লেগেছে। একটা নতুন কাপড় নিয়ে আয়। ফেলে দে এ দুটোর ওপরে।
জিজিবুড়ির চিৎকার শুনে দোতলায় চমকে উঠল বাসন্তী।
ও মুক্তা, দ্যাখ তো, মা চেঁচায় কেন।
মুক্তা পা ছড়িয়ে বসে একটা কাঁথায় ফোঁড় তুলছিল। নতুন মানুষ আসছে এ-সংসারে কত কাঁথাকানি লাগবে। ঠোঁট উলটে বলল, সারাদিনই তো চেঁচায়, বোধহয় ঘরে ভাম-টাম ঢুকেছে।
তবু দ্যাখ ভাই। ও ঘরে বিছে-টিছে আছে। কামড়াল কি না দ্যাখ।
সে বিছে এখনও জন্মায়নি। কামড়ালে নিজেই মরবে। আফিং-খাওয়া শরীর বাপু, ওকে কামড়ালে রক্ষে আছে?
তোর ওই দোষ। কেবল ফুট কাটিস।
দেখছি বাবা, দেখছি।
মুক্তা উঠে এসে দোতলার রেলিং দিয়ে ঝুঁকে বলল, হয়েছে কী? চেঁচাচ্ছ কেন?
কানে কি ময়দা গুঁজে আছিস তোরা? শুনতে পাস না? এমন যোগ আর পাবি? সাপের শঙ্খ লেগেছে এদিককার বাগানে। একটা নতুন কাপড় নিয়ে আয় শিগগির।
ও মা! বলে মুক্তা ঘরে এসে বলল, একটা নতুন কাপড় দাও তো! সাপের শঙ্খ লেগেছে বলছে।
ওই আলমারিতে আছে, নিয়ে যা।
মুক্তা কাপড় বের করে নিয়ে যাচ্ছিল, বাসন্তী বলল, বেশি কাছে যাসনি। কামড়ে কামড়ে দেবে। এ সময়টায় ওদের বিরক্ত করতে নেই কিন্তু।
জানি বাবা, জানি। তুমি শুয়ে থাকো তো।
মুক্তা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসন্তী উঠল। শরীর ভাল নেই। তার চেয়েও খারাপ তার মন। সেদিন যে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিল সেই থেকে ভয় খামচে ধরে আছে বুক। পেটেরটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো!
বারান্দায় এসে রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিল বাসন্তী। কিন্তু ওদিকে জিজিবুড়ির ঘর আর উত্তর দিকের দালানের ফাঁকটায় কলার ঝাড় হওয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জিজিবুড়ি আর মুক্তাকেও না।
সবসময়ে আজকাল তার বড্ড ভয় হয়। সব ব্যাপারেই ভয়। বছর তিনেক আগে শঙ্খ লাগা দুটো সাপকে ঢিল দিয়ে মেরে ফেলেছিল মরণ। বড্ড দস্যি ছেলে। খুব রাগ করেছিল বাসন্তী।
মারলি কেন রে যমদূত? মা মনসার বাহনকে কি মারতে আছে?
বড় করে মনসাপুজো করিয়ে মা মনসার কাছে অনেক মাথা কুটেছিল বাসন্তী, অবোধ ছেলে মা, ভুল করে তোমার বাহনকে মেরেছে। ক্ষমা করে দাও মা।
কিন্তু ওই দুরন্ত ছেলে কি কথা শোনে? বাপ ছাড়া কাউকে ডরায় না। তার পরও কতবার সাপ মেরেছে তার হিসেব নেই। এর ওর তার মুখে খবর পায় বাসন্তী। ছেলের ওপর রাগ করে, তারপর কাঁদে, তারপর ঠাকুর-দেবতার পায়ে মাথা খোঁড়ে। ওই যে মরণ গাছে ওঠে, পাখি কি ফড়িং মারে এসবই বাসন্তীকে ভারী ভয় খাইয়ে দেয়। পাপ হচ্ছে ছেলেটার, অধর্ম হচ্ছে, ভগবান যদি শাস্তি দেয়।
এভাবে মাকে কাঁদিয়ে, ভাবিয়েই এখন একটু বড় হয়েছে মরণ। বোনের দাদা হয়েছে, এখন হাতপায়ের চঞ্চলতা একটু কমেছে, দস্যিপনায় একটু ভাঁটার লক্ষণ। তবু সর্বদা কাঁটা হয়ে আছে বাসন্তী। ছেলেপুলে মানেই তো দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, ভয়, উদ্বেগ। এই যে বড় হচ্ছে হাম্মি, কম উৎকণ্ঠা ওকে নিয়ে! কখন পড়ে, কখন ব্যথা পায়, কখন কাঁদতে গিয়ে টাগ ধরে দম আটকায়। তার ওপর আর একজন এসেছেন পেটে। এখনই পেটের মধ্যে তার খলবলানি টের পায় বাসন্তী। ইনিও জানান দিচ্ছেন, কম দুটি হবেন না জন্মানোর পর। খলবলানি থেকেই টের পায় বাসন্তী।
সিঁড়ি থেকে যেদিন পড়ে গেল তার পর পুরো একটা দিন বাচ্চাটা পেটের মধ্যে নড়েনি মোটে। কী ভয়ই যে পেয়েছিল সে! রসিক গিয়ে অনল ডাক্তারকে ডেকে আনল পরদিন সন্ধেবেলা। ডাক্তার নল লাগিয়ে কী যেন দেখে-টেখে বলল, মনে হয় বাচ্চা ঠিকই আছে। তবু একবার গায়নোকোলজিস্ট দেখিয়ে নিন।
তা আর দেখাতে হয়নি। একদিন চুপ থাকার পর দুটা আবার দ্বিগুণ তেজে হাত-পা নাড়ছে, পাশ ফিরছে মায়ের পেটের মধ্যে।
রসিক বলে রেখেছে এইবার তোমার পোলা হইব। তা তাই হবে বোধহয়। ছেলে হলে বাসন্তীর আরও দুশ্চিন্তা বাড়বে। মেয়েদের তবু হাতে পায়ে দামালপনা নেই, তেমন হার্মাদও হয় না তারা। কিন্তু ছেলে হলে, বাসন্তী জানে, সে হবে মরণেরই দোসর। এইসব আগাম ভেবে তার সর্বদা বুক দুরদুর করে।
বাগানের দিক থেকে শাড়ি হাতে উঠোনে ঢুকে মুক্তা চেঁচিয়ে বলল, ওরেব্বাস! কী বড় বড় দুটো সাপ গো বউদি!
কী সাপ রে?
মাথায় খড়ম, সাক্ষাৎ গোখরো। তোমার নতুন শাড়িতে খুব গড়াগড়ি খেয়েছে দুজন।
ঘরেদোরে আসবে না তো!
না। ওদিক পানে চলে গেছে।
মরণের বাবা আবার ওখানেই রোজ সকালে কাককে রুটি খাওয়াতে যায়। একটু সাবধান করে দিতে হবে।
পৃথিবীটা যে কেন এত ভয়ভীতিতে ভরা কে জানে বাবা। একটা দিনও বাসন্তী নির্ভাবনায় কাটাতে পারে না।
আর ওই যে সম্পর্কের একটা কাঁটা বিঁধে আছে বুকে তাই থেকে সর্বক্ষণ কিছু কিছু রক্তক্ষরণ হয়। কে জানে বড়বউয়েরও তাই হয় কি না। দুজনে কি দুজনের মরণ চায়? না, না, ছিঃ ছিঃ, সে আর ভাববে না ওরকম। বড়বউয়ের একশো বছর পরমায়ু হোক।
শঙ্খ লাগা কাপড়টা এনে তার হাতে দিয়ে মুক্তা বলল, রেখে দাও যত্ন করে। দেখবে ঘরদোরে মা লক্ষ্মী উপচে পড়ছে।
কাপড়টা ফিরিয়ে দিয়ে বাসন্তী বলল, যত্ন করে ভাঁজ কর, তারপর আলমারির ওপরের তাকে রেখে দিগে যা।
শনিবার রাতে এক মধুর রতিক্রিয়ার পর সে যখন তার বরের গলা জড়িয়ে নিবিড় হয়ে শুয়েছে তখনও তার মনে হচ্ছিল, এত মাখামাখি, এত কাছাকাছির পরও কেউ আপন না হয়ে পারে?
গাঢ় স্বরে সে বলল, তুমি কাছে থাকলে আমার মনটা বড় ভাল থাকে। একটুও ভয় করে না, তুমি চলে গেলেই কেমন যেন হয়ে যাই।
রসিক তার সবল হাতে নিজের মেয়েমানুষটিকে আগলে ধরে বলল, এত ডরাও ক্যান? দুনিয়াটারে ক্যাজুয়েলি লইতে পার না?
সেটা কী গো?
সবসময় ভাববা দুনিয়ায় কেডা কার। চক্ষু বুজলেই কে কোনখানে যামু গিয়া তার কি কিছু ঠিক আছে?
এ কথায় কেঁপে উঠে রসিককে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা ঘষে সে। না না, তারা কেউ কোথাও যাবে না। এক বিশাল অচেনা অন্ধকার মহাবিশ্বে তারা কেউ কখনও ছিটকে যাবে না পরস্পরের কাছ থেকে। মরলেও ফের এই বর, এই ছেলে মেয়ে এদের ঠিক ফিরে ফিরে পাবে সে। পাবেই। না পেলে যে পাগল হয়ে যাবে। অস্ফুট স্বরে আকুল হয়ে সে বলে, আর বোলো না, আর কক্ষনও বোলো না ওরকম…
ভাঙা চাঁদ যে সোনার গুঁড়ো নির্জন নিশুতি রাতে মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিচ্ছিল চরাচরে সেই হিরন্ময় আবছায়ায় এক প্রকাণ্ড মেঠো ইঁদুরকে সে পেয়ে গেল তার হাতে। সে জানে, শুধু সে-ই জানে কী প্রাণান্তকর খাদ্যের সঙ্গে তার এই নিজস্ব লড়াই। খুব ধীরে এক ক্লেশকর প্রক্রিয়ায় সে গিলতে থাকে ইঁদুরটাকে। শরীরের সবটুকু শক্তি ও প্রয়াস দিয়ে, বড় ক্লান্ত লাগে তার, বড় পরিশ্রান্ত।
এই নিশুত রাতে কত কীট ও পতঙ্গ জেগে আছে চারদিকে। কত চোখ জ্বলছে নিবছে। খাদ্য ও খাদকের এই নিষ্ঠুর জগতে ক্ষুধা নিদ্রাহীন। রাতচরা পাখিরা অন্ধকার ডানায় ভর করে চক্কর দিচ্ছে ওপরে। মাটির অন্দরে অন্দরে চলেছে ক্ষুদ্রকায় জীবদের অন্তহীন চলাফেরা, বিষয়কৰ্ম। জেগে আছে পিঁপড়ে, ডাঁশ, জোনাকি। মেঠো ইঁদুরটাকে গিলে সে তার দীঘল শরীরে নিশ্চুপ প্রলম্বিত হয়ে থাকে আলের পাশে। চারদিকে হিরন্ময় আবছায়ায় সে এই জাগ্রত জগৎকে টের পায়।
.
কখনও এরকম হয়, সারাদিন ধরে মনটা যেন একটু খারাপ হয়ে থাকে। কারণটা বোঝা যায় না, অনেক ভাবলে, ভাবতে ভাবতে হয়তো মনে পড়ে যায়, কারও একটা আলাদা কথা, একটা রূঢ় চাউনি, একটু শীতল ব্যবহার বা ওইরকম তুচ্ছ কিছু। তুচ্ছ, তবু সারাদিন জেদি মাছির মতো উড়ে উড়ে এসে মনের ওপর বসে থাকে, কিংবা শরীরের দুরূহ খাঁজে লুকিয়ে থাকা লাল পিঁপড়ের মতো কুটুস কুটুস করে কামড়ায়। পারুল বড় জ্বালাতন হল।
অথচ মন খারাপের যেটা সবচেয়ে বড় কারণ অর্থাৎ মায়ের অসুখ, সেটা তেমন গুরুতর নয় বলে জানা গেছে। গতকাল যখন জামশেদপুর থেকে নতুন টয়েটো গাড়িটায় আসছিল তখন কী টেনশন! জ্যোতিপ্রকাশ তাকে বলে দিয়েছিল, তুমি টেনশন নিয়ে যাচ্ছ, সাবধান, ড্রাইভ কোরো না কিন্তু। বরের কথাটা রাখেনি পারুল। দুপুরের দিকে ধাবায় নেমে লাঞ্চ করে আসার পর তার ড্রাইভারের বারবার ঢুলুনি এসে যাচ্ছিল বলে পারুল বলল, তুমি পাশের সিটে বসে একটু ঘুমিয়ে নাও, নইলে অ্যাকসিডেন্ট করবে। ততক্ষণ আমি চালাচ্ছি। ড্রাইভার অবশ্য বলেছিল জাপান বা গুটকা খেলেই ঘুম উড়ে যাবে। পারুল রিস্ক নেয়নি।
অনেকটাই ড্রাইভ করেছে পারুল। এক মুহূর্ত সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য। সন্ধেবেলা এসে পৌঁছে দেখল, বাড়ি ভর্তি লোকজন জড়ো হয়েছে। দাদারা, বউদিরা, ছেলেমেয়েরা, তবে মা ভাল আছে। শরীর দুর্বল, তবে সিরিয়াস কিছু নয়। তাকে দেখে বলাকা হেসে বলল, হ্যাঁ মা, তুই নাকি অনেক কাজ ফেলে এসেছিস।
হ্যাঁ মা, কিন্তু তোমার চেয়ে তো কাজ বড় নয়।
বিজু বকছিল আমাকে। বলল, জানো পারুলদি এখন কী রকম ভি আই পি হয়ে গেছে? কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ওদের। হুট করে আসতে পারে নাকি?
পারুলরা যে সাংঘাতিক বড়লোক হয়ে গেছে এটা সকলের মুখেই ঘুরেফিরে শুনতে পাচ্ছিল পারুল। বিনয়ের সঙ্গে অস্বীকার করছিল বটে, কিন্তু কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। তারা এখন সত্যিই বড়লোক। বড়লোক আর ব্যস্ত লোক। এই বড়লোক হওয়ার পিছনে তার অবদানও খুব কম নেই। সে এখন ব্যবসা বোঝে, কারখানা তিনটের অন্ধিসন্ধি জানে, বাজার অর্থনীতির সব খবর রাখে। খুব শিগগিরই জ্যোতিপ্রকাশ তাকে বিজনেস টুরে দিল্লি বোম্বে পাঠাবে। ফিনান্সিয়াল ইয়ারের পর তাদের ইউরোপেও যাওয়ার কথা। আপাতত তার দম ফেলার সত্যিই সময় নেই। তার ল্যাপটপ কম্পিউটারে জমা কত যে তথ্য। এই যে সে মায়ের কাছে এল, নিজেকে ছিঁড়ে আনতে হল কত দায়দায়িত্ব থেকে!
তবে এসে খারাপও লাগছে না তার। যেন একটা পারিবারিক গেট টুগেদার। অসুখ গুরুতর নয় বলে দিব্যি আড্ডাও হচ্ছিল তাদের।
রাত্রিবেলা যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসে হিসেবপত্র করছিল তখনই হঠাৎ মন খারাপটা টের পেল। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কেন খারাপ। কী এমন হয়েছে এর মধ্যে? বারবার কাজের মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সে। ভ্রূ কুঁচকে ভাবছিল। কেন, কেন মনটা খারাপ রয়েছে?
অনেকক্ষণ ভাববার পর হঠাৎ চাবুকের মতো মনে পড়ে গেল কথাটা। বড়বউদি আজ তাকে দেখেই বলেছিল, এঃ পারুল, তোমার বেশ ফ্যাট হয়েছে।
হ্যাঁ, ওই কথাটাই। ওটাই তার মন খারাপের কারণ।
আর কারণটা মিথ্যেও নয়। সে নিজেও টের পাচ্ছে, ছেলে হওয়ার পর থেকেই তার শরীরের বাঁধন কিছু আলগা হয়েছে। ব্যবসার কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে কমে গেছে রোজকার ব্যায়াম। খাওয়াও হচ্ছে কিছু উলটোপালটা।
কিছুদিন আগেই জামশেদপুরের একজন পরিচিত বিউটিশিয়ান মেয়ে তাকে বলেছিল, মিসেস গাঙ্গুলি, মুখের মাসাজ করান। আপনার প্রোফাইলের শার্পনেস কমে যাচ্ছে।
খুব দুশ্চিন্তার হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু মন কি সব কিছু মেনে নিতে চায়? তিন বারের মাতৃত্ব তার খাজনা নিয়েছে, খাজনা নিচ্ছে বয়স, খাজনা দিতে হচ্ছে ব্যবসার জন্য। অত্যধিক মানসিক টেনশন এবং শরীরকে না খাটানোর জন্য।
কিন্তু সকলের ওপরে হল বয়স।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপে মনোযোগ দিতে যাচ্ছিল সে। খেয়াল হল রাত একটা বাজে। ব্যস্ততার সময়ে শরীরের ক্লান্তিও টের পাওয়া যায় না। নইলে যা জার্নি করেছে তাতে এতক্ষণ ঘুমে ঢুলে পড়ার কথা।
তার স্থির করা ছিল, ছোট ছেলেটাকে নিজের হাতে মানুষ করবে। ওর সবকিছু নিজেই করবে সে। বড় দুটোকে সময় দেয়নি, ওরা আয়ার কাছে মানুষ বলে তেমন যেন আপনও হয়নি তার। সূক্ষ্ম দূরত্ব রয়ে গেছে যেন একটু। ভেবেছিল ছোটটার বেলায় পুষিয়ে দেবে। আদর করে ওর নাম রেখেছে জুড়ান। তাকে জুড়িয়ে দেবে। কিন্তু ঘটনা সেরকম ঘটল না। সারাদিন পরিশ্রমের পর আর পারে না সে।
দিনের বেলা অফিস, মিটিং, নতুন স্কুলের জন্য ছোটাছুটি, জুড়ান সেই আয়ার হেফাজতে। রাতে সারাদিনে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসে, তখন ঘুম থেকে উঠে কাঁথা পালটানো বা দুধ খাওয়ানোর শক্তিও থাকে না তার। তাই জুড়ানও অন্য দুই ছেলেমেয়ের মতোই আয়াকে মায়ের চেয়ে বেশি চিনেছে।
সন্তানদের একশো পারসেন্ট মা হওয়া আর হল না তার। ছেলেমেয়েরা অতি সৎ ভব্য, কেতাদুরস্ত, মায়ের সঙ্গে তারা সবসময়েই সৌজন্যমূলক আচরণ করে। কোনও বেয়াদপি করে না কখনও, আর সেটাই তার বুক থেকে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস টেনে বের করে।
একা বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এইসব ভাবল পারুল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
এঃ পারুল, তোমার ফ্যাট হয়ে যাচ্ছে! কথাটা সারা রাত ঘুমের মধ্যেও ক্রিয়া করল পারুলের মনে। অভ্যাসবশে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কথাটা মনে হল তার, একটু জগিং করা দরকার। তারপর কিছু স্ট্রেচ আর ফ্রি হ্যান্ড। জামশেদপুরে তার অনেক ব্যায়ামের যন্ত্রপতি পড়ে আছে। কতকাল ছোঁয়া হয়নি সেগুলো।
সে উঠে পড়ল। বাথরুম সেরে এসে সে ট্রাকসুট পরে নিল। পায়ে গলাল স্লিপার। ঠিক বটে, গাঁয়ের রাস্তায় ট্রাকসুট পরে দৌড়লে লোকে অবাক হবে। তোক গে। গেঁয়ো ভূতেদের জন্য নিজেকে গুটিয়ে রাখার মানে হয় না। সেই যে মেয়েদের কত বড় শত্রু তা সে খুব ভাল জানে। থপথপে, পেটমোটা, কিম্ভুতকিমাকার হওয়ার চেয়ে বরং মরা ভাল।
স্নিগ্ধ ভোরের আবছা আলোয় সে বেরিয়ে পড়ল।
নির্জন রাস্তায় সে তার পায়ের টুপটাপ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল। না, এখন সে আর আগের মতো হালকাপলকা নেই। শরীরের অনেক টিলা অংশ দৌড়ের তালে লাফাচ্ছে, বিশেষ করে পেট, বুক, নিতম্ব। হাঁফ ধরছে, ঘাম হচ্ছে।
গাঁয়ে আর আগেকার মতো ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা নেই। কত বাড়িঘর উঠে গেছে। ভরাট হয়েছে কত শূন্যতা, বসত বাড়ছে, তোক বাড়ছে, এখন গাঁয়ে স্পষ্টই শহরের আদল।
ছুটতে ছুটতে রাস্তা ছেড়ে পোড়ো একটা জমি আড়াআড়ি পার হচ্ছিল সে। একটা আল। আলের ওপর সরু রাস্তা ধরে ছুটছিল সে।
আচমকাই–তাকে চমকে দিয়ে আলের পাশ থেকে চাবুকের মতো মাথা তুলল লেলিহান একটা প্রকাণ্ড সাপ।
পারুল শিহরিত হয়ে থেমে গেল, ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে হাঁ করে সে টের পেল গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। তার হাত পায়ে শীতল শিথিলতা, নড়তে পারছে না পারুল। মাত্র কয়েক ফুট দূরে পারুলের কোমর সমান উঁচু ফণা তুলে আছে সাপ। পুব আকাশের সিঁদুরে আভায় লকলক করছে, ঝলসাচ্ছে মৃত্যুদূত। শিকড়-বাকড়ের মতো তার কালো চেরা জিব বারবার চেটে নিচ্ছে শূন্যতা।
বিহ্বল, অবশ পারুলের চোখে চোখ রেখে তাকে সম্পূর্ণ সম্মোহিত করে ফেলেছে সাপ। পারুল টের পাচ্ছে, তার আর কিচ্ছুটি করার নেই। সে চোখ সরাতে পারছে না, তার পলক পড়ছে না, হাতে পায়ে সাড় নেই। সাপটা এখন এগিয়ে এসে যদি ছোবল দেয়, পারুলকে বিনা প্রতিরোধে ছোবলটা খেতেই হবে। এত অসহায় নিজেকে কখনও লাগেনি তার। বহু বছর আগে আর একটি সাপ তাকে খেয়েছিল বটে, সে ছিল মানুষ সাপ। তার বিষে জর্জরিত পারুলের মন থেকে বিশ্বাস, প্রেম, নির্ভরতা সব ঝুরঝুর করে সরে গিয়েছিল। আবাল্য প্রণয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল অমল। সেই বিষে এক পারুল মরল, এক অমলও মরল।
আজ জীবনের আর এক লগ্ন। সামনে কালসাপ ফণা তুলে তার অমোঘ সম্মোহনে আচ্ছন্ন করে ফেলছে পারুলকে। পারুলের দু চোখে জল, তার মন অসংলগ্ন এক সংলাপ বলে যাচ্ছে, আমাকে কামড়াবে তুমি? কেন কামড়াবে বলল। দেখ, আমার মতো রূপ তুমি দেখেছ কখনও? এত রূপ নষ্ট করে দেবে? জানো আমার জীবন কত সুন্দর, কত সুখ আমার! সব নষ্ট করে দেবে? আমার কত কাজ পড়ে আছে, সব যে ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আমার ছেলেমেয়েরা আর মা বলে ডাকবে না! তুমি কি জানো, আমার জুড়ান এখনও মা বলে চেনেনি আমাকে! আমাকে ভিক্ষা দাও আয়ু। আমাকে মেরো না। মেরো না…।
আজ এই ভোরে আলের ওপর চিকণ শরীরে দাঁড়িয়ে সম্মোহিত পারুল টের পেল, তার অস্তিত্ব থেকে ঝরে যাচ্ছে রূপ, যৌবন, সুখ, তার চালচিত্রে ঐশ্বর্যের পেখম গুটিয়ে নেতিয়ে পড়ে গেল। সে কাঁদছে, বাচ্চা একটা অবোধ মেয়ের মতো কেঁদে যাচ্ছে সে।
বিস্ফোরক কয়েকটি মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর সাপটা একটা তাচ্ছিল্যের শাস ফেলে টেলিস্কোপের মতো ফণা নামিয়ে নিল। তারপর পোডো জমিটার ভিতরে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল চোখের পলকে।
না, পারুল পালাল না, সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নতজানু হয়ে বসল আলের ওপর। সাপের কাছ থেকে ভিক্ষালব্ধ প্রাণ, তুচ্ছ আয়ু যেন কাঙালিনীর মতো কুড়িয়ে নিল সে। সে বুঝতে পারল, কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে তাকে দুমড়ে, মুচড়ে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে সাপটা, সে ফিসফিস করে বলল, আই অ্যাম নো গডেস, আই ওয়াজ নেভার এ গডেস, ওঃ গড।
কতক্ষণ বসেছিল তার হিসেব নেই, চোখে রোদ পড়ল, মাঠঘাট পরিদৃশ্যমান হল, চারদিকে সমবেত জাগরণের নানা শব্দ, ধীরে সংবিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়াল পারুল। চোখ মুছল। তারপর ফিরে এল বাড়িতে।
না, কারও কাছেই সে সাপের গল্পটা বলল না, যতদিন বাঁচবে ততদিন কারও কাছেই কখনও বলবে না। এ তো কোনও গৌরবগাথা নয়। এ তার এক পরাভবের গল্প। আজ ভিখারিণীর মতো লাগছে নিজেকে। অন্য রকম, যেন সে নয়।
.
সাপটা ঘাসজমি পেরিয়ে গেল। একটা ন্যাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এল সে। এইখানে ঝিরিঝিরি গাছের ছায়া। একটা শ্লথ অবয়ব। একজন মানুষ পাজামা পরা দুটো পা ছড়িয়ে বসে আছে। পায়ে চটি। নিথর। সাপটা একটু থমকাল।
একটি ছোট্ট নৌকো পাল তুলে পাড়ি দিচ্ছে অনন্ত আকাশে। ধীর, অতি ধীর তার গতি, নৌকোয় কয়েকজন মানুষ। একটি শিশু, একটি বালক, এক কিশোর, একজন যুবক এবং জনৈক বৃদ্ধ। নৌকোর গতি ধীর। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। মাঝে মাঝে ছুটে আসছে অনিকেত উল্কা। মহাজাগতিক ধুলো। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দূরাগত মহাবিস্ফোরণ বা সংঘর্ষ বা ঘূর্ণনের শব্দ। নক্ষত্রমণ্ডলীর ক্ষীণ আলোর আভায় তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছে। তারা চলেছে ধীরে। কিন্তু অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্র, অতিকায় তারা বা কৃষ্ণগহ্বর।
বুড়োর হাতে পেনসিল, হাঁটুর ওপর রাখা একটা খাতা। বুড়ো মন দিয়ে একটা অঙ্ক কষছে।
যুবকটি জিজ্ঞেস করে, আর কত দূর?
বুড়ো খরখরে গলায় বলে, আর বেশি দূর নয় বাবারা। এসে গেছি। তবে ঠিকানাটা বড্ড প্যাঁচালো, অনেকটা ধাঁধার মতো। এই অঙ্কটা মিলে গেলেই ঠিকানাটা বেরিয়ে আসবে।
কিশোরটি বলে, আমার যে খিদে পেয়েছে বুড়ো।
আর একটু চেপে থাকো বাবা, কাছেপিঠেই এসে গেছি। অঙ্কটা মিললেই হয়ে গেল।
পিছনের বাচ্চাটা বলে উঠল, তুমি যে বলেছিলে বাবার কাছে নিয়ে যাবে।
হ্যাঁ গো দাদুভাই, বাবাও এখানেই আছেন। এইসব ধাঁধাধন্ধ কেটে গেলেই বাপের কোল। একটু রোখো বাবাসকল, অঙ্কটা মিললেই হয়।
বালকটি বলে ওঠে, আর অঙ্ক না মিললে?
না মিলে কি উপায় আছে শালার? সহজে ছাড়ব ভেবেছ? সেই কবে থেকে কষে আসছি, কষতে কষতে বুড়ো হয়ে গেলুম, না মিললে চলবে কেন?
যুবকটি চড়া গলায় বলে, অনেকক্ষণ ধরে তুমি ধাপ্পা দিয়ে যাচ্ছ বুড়ো, তোমার সব ফকিকারি। তোমার চালাকি আমি বুঝে গেছি। নৌকো ঝাঁকিয়ে এবার তোমাকে ফেলে দেব।
বুড়ো ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে মাথা চুলকোয়। ছেলেগুলোর দিকে চোরা চোখে চায়, তারপর বলে, অঙ্কটার মধ্যে কিছু ফকিকারি ভয় আছে বটে, কিন্তু মিলে যাওয়ারই কথা।
বাচ্চাটা চেঁচিয়ে বলল, আমি বাড়ি যাব।
যাবে বইকী বাবা, যাবে বইকী। এখানে কাছেপিঠেই তোমাদের বাড়িঘর। শুধু অঙ্কটা মিলে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাড়ির ঘাটে ভিড়ে যাবে নৌকো।
এসব তোমার চালাকি বুড়ো।
বুড়ো আর্তনাদ করে ওঠে, না না, মাইরি বলছি। আমি ঘাটের গন্ধ পাচ্ছি।
যুবকটি হিংস্র গলায় বলে, ছাই পাচ্ছ। তোমার সব মিথ্যে কথা।
বুড়ো ভারী জড়সড় হয়ে বলে, না গো, বাবাসকল, এই শেষের পথটুকুই যা গোলমেলে। আর দু চার লাইনের মধ্যেই অঙ্কটা মিলে যাবে মনে হয়। মেরে এনেছি প্রায়। আর অঙ্ক মিললেই কেল্লা ফতে।
অঙ্ক-ফঙ্ক আমরা বুঝি না। আমরা বাড়ি যেতে চাই।
বুড়ো ভয়ে ভয়ে বলে, সে তো আমিও যেতে চাই বাবাসকল। একটু চেপে বসে থাকো, আর দেরি নেই।
কতকাল ধরে তুমি একই কথা বলে যাচ্ছ বুড়ো! আর নয়, এবার তোমাকে নৌকো থেকে ফেলেই দেব।
বুড়ো ফঁৎ করে নাকটা ঝেড়ে নিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে, তাহলে যে বড় পাপ হবে বাবা! আত্মহত্যা যে পাপ।
আত্মহত্যা?
নয়! আমাকে মারলে তুমি যে তোমাকেই মারবে।
তার মানে?
ভাল ঠাহর করে দেখ দিকি বাবা, আমার মুখখানা চেনা লাগছে না?
না তো!
ওই যে একটা বড় তারা আসছে কাছে, তার আলোয় ভাল করে দেখ। চেনা লাগে?
যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাই তো! তুমিই তো বুড়ো বয়সের আমি!
বুড়ো শতখান হয়ে হেসে বলে, তাই তো বলছি বাবা, এক নৌকোয় এই আমরা কজনা কি আলাদা? ওই আঁতুড় থেকে এই সেকেলে বয়স অবধি একটাই যে লোক। আলাদা আলাদা মনে হয় বটে, আসলে একটাই লোক যে, আবার একটা লোক হয়েও আলাদা আলাদা বটে।
তার মানে কী?
ওইটেই তো ধাঁধা। আর ওই ধাঁধার জন্যই তো শালার অঙ্কটা মিলে গিয়েও মিলতে চায় না। কেবলই ফ্যাকড়া বেরোয়। একটু চুপ করে বোসো বাবারা। আর একবার মাথা ঠান্ডা করে অঙ্কটা শুরু থেকে কষে দেখি। কোথায় যে শালা ভুল হচ্ছে।
সবাই চুপ করে বসে রইল। নৌকোটা দুলে দুলে চলতে লাগল। কত যুগ কেটে যেতে লাগল। কত আলোকবর্ষ পার হল তারা। তবু পৌঁছল না। শুধু কাগজের ওপর পেনসিলের শব্দ হয়ে যাচ্ছে খস্ খস খস্ খস্
গাছের নিবিড় ছায়ায় বসে লিখতে লিখতে অমল একটা খড়মড় শব্দ পেল। খেয়াল করল না। কিন্তু আচমকা পায়ের ওপর ঠান্ডা একটা স্পর্শ পেয়ে ঘোর লাগা চোখে চাইল। প্রথমটায় বুঝতেই পারল না ব্যাপারটা। কালো লম্বা ভারী কী একটা জিনিস তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ বুঝতে পারল সে, ওটা সাপ। অমল নড়ল না। ভয়ও পেল না তেমন। খুব অন্যমনস্কভাবে যেন, দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির পায়ের ওপর দিয়ে সাপের বিচিত্র গমন অবলোকন করতে লাগল সে।
সাপটা তার পা পেরিয়ে ঘাসজঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়ার পর যে একটু হাসল। তারপর আবার মগ্ন হয়ে লিখতে লাগল।
.
সাড়ে চারটেয় স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল মরণ। কিছু দূর পর্যন্ত বন্ধুরা থাকে। তারপর খানিকটা পথ সে একা। কাঞ্জিলালদের জমিটা কোনাকুনি পার হওয়ার সময়েই দেখা হয়ে গেল তাদের। মুখোমুখি।
বোধহয় নিজের নিয়তির নির্দেশ টের পেয়েই সাপটা মরণের পথ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছিল। মরণ টক করে একটা ঢিল তুলে নিয়ে ওর মুখের কাছে আলতো হাতে ছুঁড়ে দিল। জানে, এবার ও ফণা তুলবে। ফণা তোলাটাই দেখতে মজা।
তীব্র শ্বাসের শব্দ তুলে পাকা গোখরোটা প্রশ্ন চিহ্নের মতো উঠে দাঁড়াল শূন্যে।
মরণের ডান হাতে আধলা ইট। একটু নাচিয়ে নিল সে। তার টিপ অব্যর্থ, কখনও ফসকায় না।
ঢিলটা তুলেও ছিল মরণ। কিন্তু আচমকাই তার মনে পড়ে গেল, শিবঠাকুরের গলায় মালা হয়ে দোলে সাপ। ঠাকুরের জটা জড়িয়ে থাকে। সাপ মারলে শিব ঠাকুর রাগ করবেন না? কয়েকদিন আগেই শঙ্কর মাস্টারমশাই ক্লাসে পড়ানোর সময় বলছিলেন, সাপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
মরণের মনে পড়ল, আজকাল গাঁয়ে আর বেশি সাপ দেখা যায় না তো আগের মতো। মাঠঘাট জুড়ে কত বাড়িঘর হচ্ছে, সাপের থাকার জায়গাই নেই আর বিশেষ।
মরণ চিন্তিতভাবে আধলাটা দোলাল হাতে।
সাপটা যেন করুণ চোখে চেয়ে ছিল মরণের দিকে। যেন প্রাণভিক্ষা চায়।
মরণ হঠাৎ ঢিলটা ফেলে দিয়ে বলল, যাঃ চলে যা। মারব না।
কৃতজ্ঞ সাপটা তার প্রাণ ভিক্ষা পেয়ে মাথা নত করল। তারপর মিলিয়ে গেল তার নিচু অন্ধকার জগতে।
মহৎ একটা কাজ করার পর প্রসন্ন মনে বাড়ি ফিরতে লাগল মরণ।