কোটাল, ছেড়ে দে মোরে
নিয়ে যা তুই চোর, দিগে ফাঁসি!
মালীর মেয়ে ফুল বেচে খাই,
কোন্ বেটী বা চোরের মাসী।
এ যে দেখি সৃষ্টি ছাড়া
দেখি নাক এমনি ধারা
যেমন শনিবারের মড়া,
রবিবারে হয়েছে বাসি…
হার্মোনিয়াম সহযোগে এই গান তারস্বরে ভেসে আসছে দ্বিতলের এক কক্ষ থেকে। গৃহের সামনের পথে হুজুগ-খোর, উনপাঁজরে লোকেরা ভিড় জমিয়েছে এই উপলক্ষে, কেউ অহো-হো বলে তারিফ করছে মাঝে মধ্যে, কেউ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছে, কে রে? কে গায়? এ যে দেকচি স্বয়ং গোপাল!
গানটি পুরুষকণ্ঠের বটে, কিন্তু কখনো কখনো তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কোনো নারীর বেসুরো স্বর। ভালো করে সন্ধ্যা নামেনি, এর মধ্যেই মজলিশ বেশ জমে উঠেছে বোঝা যায়। এই সব বাড়ি একেবারে বারদুয়ারী, যার খুশী প্রবেশ করতে পারে। তবে যার জেবে কড়ির জোর নেই, তাকে নোকরের হাতে কোৎকা খেতে হয়। নোকররাও মুখ দেখেই মানুষ চেনে।
এরই মধ্যে এক দল লোক একটা ঠেলাগাড়ি টানতে টানতে এনে এমন জমাটি ভিড় দেখে থেমে গেল। একজন হ্যাট-কোট পরা ব্যক্তি হেদোর মোড়ের কালো সাহেবের খ্ৰীষ্টানী বক্তৃতার ঢং-এ চিৎকার করে উঠলো, কালো জগতের আলো! আইস, আইস, দাখো, দাখো! কলিযুগের কী বাহার, অল্প রান্নায় অপূর্ব আহার! গিমীর হইল ভাবান্তর, পাকশালায় যুগান্তর!
বাঈজী গানের শ্রোতারা এবার কৌতূহলী হয়ে এদিকে মুখ ফেরালো।
ক্যাটি কেষ্ট ভায়ার মতন চেহারার হাট-কোট পরা লোকটি এবার ঠেলাগাড়ির ওপরে এক লাফে চড়ে চারদিক ঘুরে দেখে নিল একবার। তারপর এক হাত কোমরে দিয়ে এক হাত ওপরে তুলে কেষ্ট যাত্রার সখীদের মতন নাচের ভঙ্গি করে গান গেয়ে উঠলো।
ময়লার সাথে মিল দেবে কী?
গয়লা আছে হাতের কাছে
গয়লার সাথে মিল দেবে কি?
গয়লা বেচে সাদা দুগ্ধ
বুড়ো গুড়ো সব যা খেয়ে মুগ্ধ
সেই দুধ কেউ ময়লা করে কি?
গয়লা ভেয়েরা মাথায় পাগুঁড়ি
ডাণ্ডা হাতে লয়ে এসো আগুরি
ময়লা কইলে মেনে লবে কি?
গায়কটি এখানে একটু থেমে মাথার শোলার টুপিটি খুলে একবার ঘাম মুছে নিল। পুনশ্চ দম নিয়ে সে বললো, ওয়েল, জেন্টেলমেন, ময়লার সাথে কেউ কি গয়লার মিল দেয়, আপনারাই বলুন? ভেবেচিস্তে বলুন! আপনাদের ব্রেনের মধ্যে জাঁতাকল ঘুরিয়ে একেবারে ঠিকঠাক বলুন!
একজন হেঁড়ে গলায় বললো, দূর বেটা অনামুখো! ময়লার সঙ্গে মিল দেবার জন্য মাতা খুঁড়ছিস কেন? কয়লাই তো রয়েচে!
সবাই হো-হো করে অট্টহাস্য করলো।
হাসির রেশ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত গায়কটি অদ্ভুত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বললো, হীয়রা! হীয়র! ওয়েল সেইড। ভাই বেরাদারগণ আমাদের এই লানেড ফ্ৰেণ্ডের সম্মানে সবাই ক্ল্যাপ দিন! চটপট চটপট চটপট! উনি ঠিক বলেচেন! ময়লার সঙ্গে আমি মিল দেবার জন্য মাথা খুঁড়চিলুম, উনি কেমন যুগিয়ে দিলেন। কয়লা হলো ময়লা!
এবার সে ঠেলাগাড়ির ওপরে একটি বস্তা চাপা দেওয়া চ্যাঙ্গাড়ি থেকে এক ঢেলা কয়লা তুলে নিয়ে বললো, এই দেখুন, কয়লা, প্রকৃতই ময়লা, তাই না? কয়লা হলো কালো, কুচকুচে কালো। কাক কালো, কোকিল কালো, কেষ্টঠাকুর কালো, যুবো বয়েসের মাতার চুল কালো, তা হলে এই সবই হলো গে। ময়লা! ম্যাগো! ছিঃ, এই কয়লা, তুই ময়লা কেন রে?
দর্শকদের একজন বললো, এ আবার কোন নতুন সং রে বাবা!
হ্যাট-কোটধারীটি আবার বললো, শুনুন মশায়েরা। কালো, জগতের আলো, কেমন কিনা? ধলা, পায়ের তলা!
তারপর আবার পূবেক্তি ভঙ্গিতে গান :
এই যে কয়লা
এমন ময়লা
এ হলো আমার প্রাণের সয়লা!…
কেন? বুঝিয়ে দিচ্ছি! বাড়িতে গিনীর চাঁদবদনে হাসি ফোটাতে পারলে দুনিয়াটাই স্বগ্যো স্বাগ্যো মনে হয়। কিনা? আপনার গিনীর যদি গেঁটে বাত হয়, কোমরে ফিক ব্যথা হয়, তা হলে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কিনা? কেন গিনীদের গেঁটে বাত হয়। আর ফিক ব্যথা হয়? জানেন? কেউ জানেন? এনিবডি? আমাদের লানেড ফ্ৰেণ্ডটি এর রিপ্লাই দিতে পারেন? পারবেন না! আমি বলচি, শুনুন! সাষ্টাঙ্গে প্ৰণিপাত করবার মতন এই যে বাড়ির গিন্নীদের দু বেলা অন্তত দশবার চুল্লির মুখে ফুঁ দিতে হয়। সেই জন্যই তো কোমরে ফিক ব্যথা আর গেঁটে বাত!
সকলে আবার অট্টহাস্য করে উঠলো।
লোকটি এবার কণ্ঠস্বর বদলে গম্ভীরভাবে বললো, যদি ডবকা নীরোগ গিমী চান, বাড়িতে কয়লা নিয়ে যান। কয়লা দিয়ে রান্না করুন। চ্যালা কাঠের যুগ শেষ! এক বোঝা চ্যালা কাঠের বদলে এইটুকখানি কয়লায় আপনার রান্না শেষ! কয়লার চুল্লি জ্বালাতে কোনো হ্যাপা নেই, ফুঁ দিয়ে চোখ লাল কত্তে হয় না। দুখানা ঘুটে তলায় দিলেই দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। কী করে সহজে কয়লার উনুন জ্বালাতে হয়, তা এখুনি দেকিয়ে দিচ্চি! প্ৰাণকেষ্ট!
ঠেলা গাড়ির নিচে বসে এক ছোঁকরা ততক্ষণে এক তোলা উনুন সাজিয়ে ফেলেছে। সেটি এবার ওপরে স্থাপন করলো। হ্যাট-কোটধারী সেটির দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললো, এই যে দেকুন! সাজাবার ক্যায়দা আচে। এতে কম কয়লা খর্চা হয়, আগুনও জ্বলে জলদি। যারা এই কায়দা শিকতে চান, আমাদের কোম্পানির প্রতিনিধি গিয়ে শিকিয়ে দিয়ে আসবে। ফ্রি অব চার্জ! প্রাণকেষ্ট, আগুন জ্বাল!
সব সরঞ্জাম ওদের সঙ্গে তৈরিই আছে। একটি বড় মাটির মালসায় তুষের আগুন। ডগায় গন্ধক মাখানো এক টুকরো প্যাঁকটি তার মধ্যে ঠসে ধরতেই সেটা ফস করে জ্বলে উঠলো। তারপর তার সাহায্যে প্রাণকেষ্ট তোলা উনুনে সাজানো কয়লা ধরিয়ে ফেললো সহজেই।
সে আগুন দেখে দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো এক ধরনের। তা ঠিক বিস্ময়ের নয়। কেউ যে আগে কয়লার আগুন দেখেনি, তা নয়। কয়লার ফেরিওয়ালাও এই প্রথম নয়। তবু অনেকের মনেই কয়লা সম্পর্কে একটা বিরাগের ভাব আছে।
ফেরিওয়ালাটি উত্তম প্রচারক। সে সব রকম প্ৰতিক্রিয়ার কথা জানে। এবার সে বলতে শুরু করলো, মশায়েরা, জেণ্টলমেন, কয়লার এক হাজার গুণ, কিন্তু সে গুণগান না করে আমি এর কিচু দোষের কতা বলি, কেমন? যেমন, কয়লা সত্যিই ময়লা। চ্যালা কাঠ ময়লা নয়। তাই নয়? কয়লায় হাত দিলে কালি লাগে। ঠিক! কিন্তু হাত ধুয়ে ফেললেই সে কালি উঠে যায়। যে-কেউ পরীক্ষা করে দেকতে পারেন। চ্যালা কাঠ থেকে যে যখন তখন চোঁচ ফুটে হাত রক্তারক্তি হয়, কয়লায় কিন্তু সে ভয় নেই। কয়লায় ধোঁয়া হয়। বেশী ধোঁয়া হয়! ঠিক। কিন্তু কয়লার ধোঁয়ায় যে মশা মাছি পালায়, সে খবর জানেন? পরীক্ষা প্ৰাৰ্থনীয়! বোকা লোকেরা কয়লার নামে যে আর একটা অপবাদ দেয়, সেটা কিন্তু আমরা মানবো না! কোনো এক বাংগালা কাগচে এক পত্রদাতা লিকেচেন যে কয়লার রান্না খেলে নাকি খাদ্য ঠিক পরিপাক হয় না, হজমের দোষ হয়, অন্নরোগ হয়! এমন গোমুখুও এ দেশে আচে! আমি আপনাদের শত শত সাটিফিকেট দেকাতে পারি যে, কয়লায় রান্নাও যেমন তাড়াতাড়ি হয়, হজমও হয় তেমন ঘোড়দৌড়ের মতন! কয়লার রান্না খেলে ছোট শিশুদের উদরাময় সেরে যায়। সাহেবদের কতা বাদই দিলুম, সাহেবরা তো কয়লার নাম আদর করে দিয়েচে ব্ল্যাক ডায়মণ্ড, জানেন বোধ হয়, যা কয়লা, তাই হীরে! এ ছাড়া, আমাদের দেশে শত শত বামুন পণ্ডিত, জমিদার, উকিল-মোক্তার, ডাক্তারি-মাস্টার কয়লার রান্না খেয়ে ভুরি ভুরি প্রশংসা করেচেন। এই দেকুন না, আমার সঙ্গেই যে চারজন রয়েচেন, একজন বামুন, একজন কায়েত, একজন সোনার বেনে আর একজন তেলী। জিজ্ঞেস করে দেকুন, ওঁয়ারা সব্বাই গত এক বচ্ছর কয়লার রান্না খেয়ে কেমন আচেন! আমার সামনে জিজ্ঞেস করতে হবে না, আপনার প্রাইভেটলি টক করে দেখুন! ওদিকে আমাদের মোছলমান ভায়েরাও কয়লার রান্নায় দিব্যি বিরিয়ানি-পোলাও-কারি-কাবাব খাচ্ছেন। আর ক্রিশচীনদের তো কয়লার আঁচ ছাড়া কেক-পুডিং তৈরিই হয় না! আমাদের রয়াল বেঙ্গল কোল কোম্পানি চোদ্দ পয়সায় এক মণ কয়লা দিচোন! প্ৰথম দশ সেরা ফিরি। আমাদের কয়লাঘাট গুদামে গিয়ে চাইলেই প্রথম দশ সের সেম্পেল হিসেবে ফিরি পাবেন! মনে রাখবেন মশায়েরা, নতুন যুগ আসচে, পাড়াগেয়ে রীত আর চলবে না, রান্নাঘরের আমূল সংস্কার করুন! গিল্পীদের মুখে হাসি ফোঁটান! উদরের প্রকৃত আদর করুন তা হলেই সমাজে সমাদর পাবেন!…
সন্ধ্যার পর অন্য দৃশ্যও দেখা যায়। ব্ৰাহ্মদের মধ্যে বৈষ্ণব প্রভাব অনুপ্রবেশ করায় প্রায়ই তাঁরা দল বেঁধে সংকীর্তনে বার হন। ব্ৰাহ্মরা প্ৰায় সকলেই বিদ্বান ও উচ্চবর্ণের মানুষ বলে পথের পাঁচমিশেলি। লোকদের উটকো মন্তব্য বা ব্যঙ্গোক্তিতে তাঁরা কর্ণপাত করেন না। এ ছাড়া আছে পাড়ায় পাড়ায় হরিসভা, ব্ৰাহ্মদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরাও বার করেন কীর্তনের দল। এবং ছুটির দিন হলেই শুরু হল অষ্টপ্রহরব্যাপী নাম গান, সেই সঙ্গে মুড়কি ও বার্তাসা বিতরণ।
বিশেষ বিশেষ পল্লীতে বিশেষ রকম গান বাজনা। সাহেবপাড়ায় চলছে বড়দিনের মহড়া। ইডেনের বাগানে গোরারা প্রতি সন্ধ্যাবেলা হাইল্যাণ্ডার ব্যাণ্ড বাজায়, তা দর্শন ও শ্রবণ করার জন্যও প্রচুর জমায়েত হয়। নেটিভ পাড়াও পিছিয়ে নেই। দুর্গা পূজা কালী পূজার পর আর কাছাকাছি বড় কোনো পূজার উৎসব নেই, সুতরাং দেশী লোকেরা ইদানীং সাহেবদের দেখাদেখি বড়দিন পূজা শুরু করেছে। ডিসেম্বর মাস পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে যায় গান বাজনার ধূম। এই উপলক্ষে বড় মানুষের সন্তানরা দেদার টাকা-পয়সা শুঁড়ি ও বারনারীদের ঘরে ঢালে।
তালতলার দিকে দেখা গেল এক চমকপ্রদ দৃশ্য। একখানি বিচিত্র আকৃতির জুড়ি গাড়ি আসছে, সেটিকে দেখতে অবিকল একটি বিশাল খাঁচার মতন। তার মধ্যে তিন-চার জন সাকরেদের মধ্যিখানে বসে আছে এক অদ্ভুত পাশাক পরা ব্যক্তি। এই বাবুটি রীতিমতন সুপুরুষ, উত্তম কোঁচানো ধুতি এবং আলপাকার কোট, মাথার চুল তো কোঁচকানো বটেই, নাকের নিচে পুরুষ্ট গুম্ফটিও কুঞ্চিত মনে হয়। এবং তাঁর দু বাহুর সঙ্গে জোড়া রয়েছে দুটি ডানা। তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন।
অল্প বয়েসী ছোঁকরাদের কাছে এই দৃশ্য অভিনব। তারা পথ চলা বন্ধ করে হাঁ করে চেয়ে থাকে। শহরের প্রবীণ লোকরা কিন্তু ঠিকই চিনতে পারে। তারাও বিস্মিত হয়ে বলে, আরে, এ সেই পক্ষীর গাড়ি না? খুব কাছে এসে তারা সেই মধ্যমণি ডানাওয়ালা বাবুটিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে বলে, এ কি, এ তো স্বয়ং রূপচাঁদ পক্ষী মশায়।
পক্ষীর দলের শিরোমণি রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয় ইদানীং আর বাড়ি থেকে বিশেষ বের হন না। পক্ষীর দলের সেই রবরবা অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। সেই রাজা নবকেষ্টও নেই, গোপীমোহন ঠাকুরও নেই, তেমন পৃষ্ঠপোষক আর পাওয়া যাবে না। আর সেই এক আসনে বসে একশত ছিলিম গাঁজা টানার মতন কলজের জোর দেখানো মানুষই বা কোথায়! রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয় অনেক দিন পর্যন্ত দল টিকিয়ে রেখেছিলেন, তারপর কালের নিয়মে সবই নষ্ট হয়ে গেছে।
অনেক দিন পর তিনি বাগবাজারের বাসা থেকে কয়েকজন ইয়ার বক্সীর সঙ্গে বেরিয়েছেন তাঁর সেই পুরাতন, মাকামারা গাড়িটি নিয়ে। উদ্দেশ্য বাগবাজারে গিয়ে আগেকার দিনের সঙ্গীরা যে কয়েকজন বেঁচে বর্তে আছেন, তাঁদের নিয়ে আবার একটি ঘরোয়া আসর বসাবেন। কিন্তু তাঁকে চিনতে পেরে পথচারীরা চার পাশ দিয়ে ঘিরে ধরে খাঁচা-গাড়ি আটক করে দিল। সকলের অনুরোধ, একখানা গান শোনাতেই হবে।
রূপচাঁদ দাস পক্ষী মশায়ের বয়েস এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি, কণ্ঠে আর সেই আগেকার মতন জোর কিংবা লহরী নেই। তবু এত লোকের উপরোধে তাঁকে গাইতেই হলো। গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি ধরলেন :
চিরদিন সমান যায় না রে ভাই,
উন্নতি বিলয় প্ৰায় দেখতে পাই,
ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসিচে সদাই
কালে হত হবে দুনিয়া।…
কয়েকজন এনকোর, এনকোর বলে উঠলো। কয়েকজন বললো, এ গান নয়। এ বড় উঁচু ভাবের গান। একখানা রসের গান হোক!
খগপতি রূপচাঁদ হাত জোড় করে বললেন, সে রকম আর পারি না। এখন ক্ষমা দাও, ভাইগণ। কিন্তু জনতা তা মানবে না। রসের গান শোনাতেই হবে। কেউ কেউ বলে উঠলো, সঙ্গে কন্ধে নেই? দু-চার দম দিয়ে নিন না, তা হলে গলা খোলতাই হবে!
বাধ্য হয়েই রূপচাঁদ আবার ধরলেন :
গো মেনকা শোন তোর অম্বিকার গতি
গাঁজা টেনে শ্মশানে যায় পশুপতি
মাঠে ঘাটে বেড়ায় ছুটে কার্তিক-গণেশ দুই নাতি।
শৈশবে যদি শিখাতে দুটিরে
বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা আসিত পাশ করে
অনায়াসে দুটিতে বিদ্যাবুদ্ধির জোরে।
হতো হাইকেটের বিচারপতি…।
এতেই হাসির হর-রা পড়ে যায়। শব্দে আকৃষ্ট হয়ে নতুন লোক এসে জমে। দু চারজন ইংরেজী শিক্ষিত যুবক অভক্তিও প্রকাশ করে। একজন বললো, ড্যাম! এই গেঁজেল পক্ষীর দল তো গোল্লায় গেসলো, আবার কি রিটার্ন করলো? কালটা কি পেচিয়ে যাচ্চে না এগুচ্চে!
কিন্তু উপভোক্তাদের সংখ্যাই বেশী। আরও কয়েকখানি গান শোনাতে হলো রূপচাঁদ পক্ষী মহাশয়কে। তারপর অনেকে মিলে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলো : আমারে ফ্রড করে! আমারে ফ্রড করে! ওটা একবার না শোনালে ছাড়ান-ছোড়ন নেই।
তখন রূপচাঁদ ধরলেন তাঁর বিখ্যাত গান :
আমারে ফ্রড করে কালিয়া ড্যাম তুই কোথা গেলি
আই য়্যাম ফর ইউ ভেরি সরি,
গোলডেন বডি হলো কালি।
হো মাই ডিয়ার, ডিয়ারেস্ট
মধুপুরে তুই গেলি কৃষ্ট
ও মাই ডিয়ার, হাউ টু রেস্ট
হিয়র ডিয়র বনমালী।
(শুন রে শ্যাম তোরে বলি।)
পুওর কিরিচর মিল্ক গেরেল
তাদের ব্রেস্টে মারলি শেল
ননসেন্স তোর নাইকো আক্কেল
ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট করিলি।
(ফিমেলগণে ফেল করিলি।)
গান থামিয়ে রূপচাঁদ বললেন, আর মনে নেই।
কিন্তু মনে করিয়ে দেবার মতন মানুষ আছে। শ্রোতাদের মধ্য থেকেই দু তিন জন বলে উঠলো, লম্পট শঠের ফরচুন! লম্পট শঠের ফরচুন!
রূপচাঁদ আবার ধরলেন :
লম্পট শঠের ফরচুন খুললো
মথুরাতে কিং হলো
আংকেলের প্রাণ নাশিল
কুবুজার কুঁজ পেলে ডালি…।
তালতলার রাস্তায় এই সন্ধ্যায় রূপচাঁদ পক্ষীকে পেয়ে বিনি। পয়সায় দুশো মজা লুটলো পথের মানুষ। তাদের মধ্যে আগাগোড়া প্রচ্ছন্নভাবে মিশে রইলো নবীনকুমার।