৭১
অপর্ণার ইদানীংকালের জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটল পরশুদিন, শুক্রবার। একজন ঠাকুরমশাইকে ধরে পাঁজি দেখিয়ে তবেই দিনটা স্থির করে রেখেছিল সে। সঠিক লগ্নটি অবধি বয়ে যেতে দেয়নি। করপোরেশনে সে বাড়ির প্ল্যান জমা দিয়ে এল।
কিন্তু এত বড় ঘটনাটা শুধু তার কাছেই বড়। বাড়ির আর কারও কাছে নয়। ছেলেমেয়েরা কেউ ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না, এমন কি মণীশ পর্যন্ত নিরুত্তাপ। কিন্তু একটা আনন্দকে সবাই মিলে অনুভব না করলে কি হয়?
আনন্দটা অপণার একার এবং নিজস্বই রয়ে গেল। সারা দিন নানা কাজের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ তার ভাবী বাড়িটার কথা মনে হয়। সুড়কি রংয়ের মিষ্টি একটা দোতলা। গেরুয়া বর্ডার থাকবে তাতে। চারদিকে গাছ-গাছালি থাকবে। দক্ষিণে একটা নিম গাছ, পাশে রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া। একটা পলাশ গাছও থাকবে কোথাও।
কিন্তু বাড়ি হওয়ার আগে কত কি করার থাকবে অপর্ণার? ইট আসবে, সিমেন্ট আসবে, বালি আর পাথরকুঁচি আসবে। মাটি খুঁড়ে ভিত গাঁথা হবে। পিলার উঠবে। ধীরে ধীরে দেওয়াল, গাঁথনি, ছাদ ঢালাই। একটা শূন্য স্থানে স্বপ্নের মতো, ম্যাজিকের মতো তৈরি হবে একখানা বাড়ি। আর কেউ না হোক অপর্ণা প্রথম থেকেই সাক্ষী থাকবে ঘটনাটার। সারা দিন সে ছাতা মাথায় দিয়ে বসে থাকবে একটি কোণে। কাজ দেখবে, পাহারা দেবে, কাজের ফাঁকি ধরবে। আর এইসব করতে করতে ওই বাড়ির প্রতিটি ইটে, কাঠে, খাঁজে, কোণে সঞ্চারিত হতে থাকবে তার মায়া আর ভালবাসা। একখানা বাড়ি এমনিতেই কিছুই নয়। কিন্তু অপর্ণার বাড়ির মধ্যে সে নিজেও মিশে থাকবে ইট কাঠ সিমেন্টের মধ্যে।
আজ রবিবার। কিন্তু সব রবিবারই ঠিক রবিবারের মতো হয় না। আজকের রবিবারটা কেমন যেন গোমড়ামুখো, নীরব, নীরস আর ঘটনাহীন। ফি রবিবারের মতোই আজও কিছু ভালমন্দ রান্না হচ্ছে। মুর্গির মাংস আর ফ্রায়েড রাইস। এসব আজকাল খুব সাবধানে রাঁধতে হয় অপর্ণাকে। মণীশের রিচ খাওয়া বারণ। অপর্ণা তাই মাংসটা রাঁধে অনেকটা স্টু-এর মতো করে। ফ্রায়েড রাইস রাঁধে স্যালাড অয়েল দিয়ে। যাতে মণীশও খেতে পারে।
সকাল থেকে মণীশ আজ গোটা চারেক খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে নিজের ঘরে। ব্রেকফাস্টের সময় রবিবার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহই করে। এমনই কপাল যে, আজ সেটাও ঘটেনি। বুবকা সকালে জগিং করে এসেই চলে গেল স্কুলের ফেট-এ। অনু গেল ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ক্লাস করতে। ঝুমকি আছে বটে, কিন্তু না থাকার মতোই। টনসিল ফুলে কষ্ট পাচ্ছে খুব। অনেক বেলা অবধি শুয়ে ছিল। একটু আগে উঠেছে। চা খেয়ে আবার শুয়েছে, জ্বর জ্বর ভাব।
বাসমতী দেরাদুন চালের ভাতটা চড়িয়ে একটু হাঁফ ছাড়ল অপর্ণা। হোক। মাংস হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা স্যালাড কাটছে, খাওয়ার মুখে একটু ভাজাভুজি করে দিলেই হবে।
প্রথমেই মেয়ের ঘরে হানা দিল সে।
কী করছিস, এই মেয়ে?
ঝুমকি করুণ চোখ মেলে তাকাল, শুয়ে আছি, দেখছ তো!
কেমন লাগছে?
ভাল না। ঢোঁক গিলতে গলায় লাগছে।
কতবার করে বলি, বাইরে বেরনোর সময় গলাটা মাফলার দিয়ে জড়িয়ে নে! কখনও কথা শুনিস?
মাফলার গলায় দিয়ে বেরনো যায় বুঝি?
কেন যাবে না? রোগ হলে সব করতে হয়।
এ মা, মাফলার যে বিচ্ছিরি জিনিস।
অন্তত একটা স্কার্ফ তো গলায় বাঁধতে পারিস! যার টনসিলের অসুখ তার কি স্টাইল করলে চলে?
উঃ, অত জোরে কথা বোলো না তো মা। মাথা ধরেছে, জোরে শব্দ হলে মাথা দপদপ করে।
সকালে তো কিছু খেলি না। এখন একটু দুধ খা।
ইচ্ছে করছে না। একটু শুয়ে থাকতে দাও চুপ করে।
খুব রেগে যাচ্ছিল অপর্ণা। রাগটা সামাল দিল। মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখল, একটু টেম্পারেচার আছে।
ডাক্তার ডাকব রে?
না মা, টনসিল তো আমার পুরনো বন্ধু। চিন্তা কিসের?
বন্ধু না শত্রু? ওরকম বন্ধুর সঙ্গে ভাব না রাখলেই হয়।
ডাক্তার ডেকো না মা। গুচ্ছের অ্যান্টিবায়োটিক গেলাবে। ওসব খেলে আমার আরও শরীর খারাপ হয়।
আচ্ছা, বাড়িতে একজন শুয়ে থাকলে কি ভাল লাগে, বল তো!
ইচ্ছে করে শুয়ে আছি নাকি?
একটু উঠে রোদে গিয়ে বোস না।
না মা, এই বেশ আছি। বাবাকে একটু আমার কাছে এসে বসতে বলল।
অপর্ণা স্থির চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে, আমি যে তোর কাছে বসে আছি সেটা বুঝি কিছু নয়? আমি কি তোদের কেউ নই?
ঝুমকি একটু হেসে মায়ের একখানা হাত ধরে বলল, কে বলে তুমি কেউ নও? বাবা কাছে এলে ভাল লাগে, তাই বলছিলাম।
আর আমি কাছে এলে ভাল লাগে না, না?
খুব লাগে মা। তুমিও থাকো। কিন্তু তোমাকে তো ডেকে পাই না। কত কাজ তোমার! একটু বসেই উঠে যাও।
আর তোর বাবা বুঝি সারা দিন বসে থাকে তোদের কাছে?
খুব হিংসুটি হয়েছে তো মা!
অপর্ণা ঠাট্টা করছিল না। তার দু’ চোখ ভরে জল আসছিল। তার তিনটে ছেলেমেয়েই কোন এক আশ্চর্য কার্যকারণে মণীশের ভক্ত। বাবা ওদের প্রাণ। সেটা মোটেই অপর্ণার খারাপ লাগে না। হিংসেও হয় না। কিন্তু তার মাঝে মাঝেই মনে হয়, ওরা তাকে ততটা ভালবাসে না যতটা ভালবাসা উচিত ছিল।
মায়ের মুখ দেখে দুঃখে করুণ হয়ে গেল ঝুমকি, ও মা, তোমার চোখ ছলছল করছে কেন? আমি কী বলেছি বলো ত! শুধু তো বলেছি বাবাকে একটু আমার কাছে এসে বসতে বলল। তাতে কি দোষ হল মা?
না, দোষ হবে কেন?
এ কথায় তো কিছু নেই মা।
সে আমি জানি আর ভগবান জানে। তোরা যে কেন আমাকে সহ্য করতে পারিস না!
ঝুমকি দু’ হাতে অপর্ণার কোমরটা জড়িয়ে ধরে বলল, মা গো, রাগ কোরো না, লক্ষ্মী মেয়ে।
রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়েটা হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ই মা! গ্যাস যে ফুরিয়ে গেল!
অপর্ণা তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়াল, কী হয়েছে রে?
তোমার গ্যাস নিবে গেছে।
ফ্যান পড়ে নেবেনি তো?
না গো, ফ্যান পড়বে কি, ওথলায়নি তো এখনও।
ছোটখাটো দুশ্চিন্তাগুলোই কুরে খায় অপর্ণাকে। এই যে গ্যাস ফুরোলো এটা কোনও সমস্যাই হয়তো নয়। কিন্তু তার কাছে এখন এটাই মস্ত সমস্যা। ভরা সিলিন্ডার রয়েছে তিনটে ঘর পেরিয়ে সেই বারান্দায়। দুর্ঘটনার ভয়ে তারা বারান্দায় সিলিন্ডার রাখে। রান্নাঘর থেকে যেটা অনেকটাই দূর। এখন ওই ভারী সিলিন্ডার টেনে আনবে কে? আগে মণীশ আনত, ইদানীং বুবকা। কিন্তু মণীশের পক্ষে অসম্ভব, কোনও ভারী কাজ করা তার একদম বারণ, বুবকা বাড়ি নেই। কী হবে এখন?
দেখলি তো কপালটা আমার! এখন কী করি?
ঝুমকি বলল, ভাবছো কেন? বুবকা এসে যাবে। তুমি বসে থাকো।
পাগল! আধসেদ্ধ ভাত ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। কত দামী চাল!
তোমার যে কত প্রবলেম মা!
অপর্ণা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সংসারটা তো আমাকেই চালাতে হয় কিনা, তাই প্রবলেমগুলোও যে আমারই। যাই দেখি গে!
রান্নাঘরে এসে অপর্ণা সিলিন্ডার ঝাঁকিয়ে বুঝল, গ্যাসই ফুরিয়েছে বটে। এবং ভাত খুব বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এখনই আগুনে না বসালে নষ্ট হয়ে যাবে।
স্যালাড কুটতে কুটতে কাজের মেয়েটা বলল, বাবাকে বলল না, সিলিন্ডার লাগিয়ে দেবে।
তোর যেমন বুদ্ধি! বাবা কত বড় অসুখ থেকে উঠেছে জানিস? যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
একটু উঁচুগ্রামেই কথা হয়ে থাকবে। মণীশ শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়াল। চোখে চশমা, হাতে খবরের কাগজ।
কী হল বলল তো! এনি প্রবলেম?
আর বোলো না। গ্যাসটা ফস করে ফুরিয়ে গেল।
ওঃ, তাতে কি হল? এখনই লাগিয়ে দিচ্ছি।
তুমি? বলে একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠে অপর্ণা।
মণীশ যাওয়ার জন্য ঘুরেছিল খানিকটা, থমকে গিয়ে বলে, কী হল?
তুমি সিলিন্ডার টানতে যাচ্ছ?
বরাবর তো আমিই লাগিয়েছি।
অপর্ণা দুখানা বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, সত্যিই তুমি বোধ হয় মানুষও খুন করতে পারো। ওই ভারী সিলিন্ডার টানলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে? যাও, চুপচাপ ঘরে গিয়ে বসে থাকো। রান্নাঘরের প্রবলেম আমি সামলাব।
মণীশের খেয়ালই ছিল না যে, তার হার্টের অসুখ। এ কথায় হঠাৎ সে আনমনে বাঁ হাতটা তুলে নিজের বাঁ পাঁজরে রাখল। তারপর বলল, আমি কি ততটা আনফিট?
অপর্ণা মেঘগর্জনের মতো বলল, ডাক্তারের বারণ, মনে থাকে যেন।
হার্ট অ্যাটাক হলে আর কি কোনওদিনই নর্মাল লাইফে ফিরে আসা যায় না অপু? সামান্য একটা সিলিন্ডার লাগানো এমন কি শক্ত কাজ?
খবরদার বলছি। আর একটাও কথা নয়।
ঝুমকি ঘর থেকে উঠে এল। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে দু’ হাত দিয়ে একটু ভর রেখে বলল, না বাবা, তুমি এসব করবে না।
মণীশ একটু হেসে বলে, দেখ না একদিন এক্সপেরিমেন্ট করে। আমি শক্ত মালে তৈরি।
অপর্ণা চোখ পাকিয়ে বলে, তুমি কী দিয়ে তৈরি তা আমার জানা আছে। খুব বীরপুরুষ। কিন্তু বয়সটাও বসে নেই আর শরীরটাও লোহা দিয়ে তৈরি নয় এটা মনে রেখো।
ঝুমকি বলল, আচ্ছা মা, এক কাজ করলে হয় না? আমি আর বাবা ধরাধরি করে নিয়ে আসি না কেন?
অপর্ণা দৃঢ় গলায় বলে, না কখনও না। মেয়েদের ভারী জিনিস টানা একদম ভাল নয়।
বাঃ রে, আজকাল তো মেয়েরা ওয়েট লিফটিংও করে।
যে করে করুক। তোমাকে করতে হবে না।
মণীশ ঝুমকির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, দ্যাটস্ এ গুড প্রোপোজাল। তবু তোমার যদি আপত্তি থাকে তবে তুমিও চলো হাত লাগাবে। তিনজনে মিলে আনলে সিলিন্ডার ব্যাটা খুব জব্দ হবে। চলো।
বাসমতী অত্যন্ত সুখী চাল। একটুতেই গলে যাবে বা আঠা হয়ে যেতে পারে। চালটা নতুনও বটে। বুবকার জন্য আর অপেক্ষা করলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অগত্যা বেজার মুখে অপর্ণা বলল, তোমাকে ধরতে হবে না। আমি আর ঝুমকি বরং গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে আসি।
মণীশ মাথা নেড়ে বলে, তাতে মেঝেতে দাগ পড়বে। সরো, ফাঁকা সিলিন্ডারটা সরিয়ে নিয়ে যাই।
না না, তুমি না।
মণীশ কথাটা কানে তুলল না। সিলিন্ডারটা গিয়ে খুলে ফেলল। ঝুমকি গিয়ে ধরল। তাড়াতাড়ি।
ছেড়ে দে। এটা হালকা, আমি পারব।
অপর্ণা ফের চেঁচাল, তুমি তো সবই পারো। আমার গলাটা টিপে ধরতে পারো না?
আরে বাবা, এটা সত্যিই হালকা। ধরেই দেখ না।
আমি জানি। বলে অপর্ণা ঝুমকির দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, বাপের গন্ধে উঠে এলি বুঝি? এখন বুঝি আর শরীর খারাপ লাগে না?
দুজনে ধরাধরি করে যখন সিলিন্ডার বারান্দায় নিয়ে যাচ্ছিল তখন অপর্ণাও গেল সঙ্গে সঙ্গে। মণীশ সব পারে। ওকে বিশ্বাস নেই। হয়তো ঝুমকিকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই আনবে টেনে জগদ্দল জিনিসটা। অপর্ণা আগেভাগেই গিয়ে সিলিন্ডারের হাতল চেপে ধরল।
একটু হাসল মণীশ। ভরা সিলিন্ডারটা তিনজনে মিলে তুলল বটে কিন্তু ঝুমকি বা অপর্ণার গায়ে তেমন জোর নেই। কার্যত মণীশই ওজনের সিংহভাগ বহন করল। সেটা টের পাচ্ছিল অপর্ণা, বলল, তুমি অমন ঝাঁকুনি দিলে কেন? …ওই দেখ, তুমিই তো দেখছি বেশি ভার নিচ্ছ… আহা, অত তাড়াতাড়ি কোরো না…
সামান্য কাজ, তবু কত অসামান্য হয়ে গেছে আজকাল। মণীশের হাঁফ ধরে গিয়েছিল রান্নাঘর অবধি আসতেই। কিন্তু জোর করে হাঁফধরা খাস গোপন করল সে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক শ্বাস ছাড়ার চেষ্টা করতে করতে সিলিন্ডারটা লাগিয়ে দিল সে।
বাবা!
কী রে!
আমার কাছে এসে একটু বসবে?
কেন, তোর কী হয়েছে?
শরীরটা ভাল নেই। জ্বর।
দেখি। বলে নিজের গালটা মেয়ের কপালে ঠেকিয়ে বলল, টেম্পারেচার তো আছে দেখছি।
বাবা, তোমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে কেন?
কোথায়! না তো।
করছে কিন্তু বাবা।
সামান্য। ওটা কিছু নয়।
অপর্ণা গ্যাস জ্বালাতে ব্যস্ত ছিল বলে এই ডায়লগটা শুনতে পেল না। পেলে বিপদ ছিল।
ঝুমকির ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে মণীশ বলে, বাঃ, ঘরটা তো বেশ গুছিয়ে রাখিস তুই?
মা রোজ বকে, জানো? বলে আমি নাকি ভীষণ অগোছালো।
কই, আমার চোখে তো অগোছালো ঠেকছে না।
বোস না বাবা, একটু গল্প করি।
তোর শরীর খারাপ, শুয়ে পড়। আমি বসছি।
শোবো না। এখন ঘাম হচ্ছে। একটু ভাল লাগছে। বাবা, তোমার অফিসে আমার একটা চাকরি কি কিছুতেই হয় না?
চাকরি করবি কেন? তোর কিসের অভাব?
অভাব! অভাব তো কিছু নেই। কিন্তু বসে থাকব কেন?
তোর চাকরি করা উচিত নয়। যার চাকরির প্রয়োজন নেই সে যদি চাকরি করে তা হলে আর একজন নিডিকে সে বঞ্চিত করে।
আমার যে দরকার বাবা।
কিসের দরকার সেটা বলবি তো!
আমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে।
তোর মা তো চায় তোর বিয়ে দিতে।
বিয়ে? কক্ষনও না।
না কেন?
ওসব আমার ভাল লাগে না।
মণীশ একটু হাসল। চেয়ারে বসে দেওয়ালে একটা টিকটিকির কিছু কেরামতি দেখতে দেখতে বলল, ভাল। খুব ভাল।
কি ভাল?
স্বাধীন থাকার ইচ্ছাটা।
তুমি আমাকে সাপোর্ট করছ তো?
করছি। তোর বিয়ে হলে আমি অনেকটা একা হয়ে যাব। হার্ট দুর্বল, হয়তো আর একটা অ্যাটাকও হয়ে যাবে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, বেশ ভাল। আবার অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে মোটেই ভাল নয়।
ভাল নয় কেন বাবা?
এককথায় কি এর জবাব হয়? আমরা কেউ কোনও অবস্থাতেই স্বাধীন নই। স্বাধীনতা একটা রিলেটিভ ধারণামাত্র। এক ধরনের আই ওয়াশ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানেই চাকরির অধীনতা, সেখানেও হুকুম করার লোক আছে, বাধ্যবাধকতা আছে। পুরো স্বাধীনতা কোথাও নেই।
তবু বিয়ের চেয়ে অনেক সম্মানজনক!
তাই কি?
সিস্টেমের অধীনতা মানা যায়, কিন্তু বিশেষ একজন পুরুষের বাঁদী হয়ে থাকব কেন?
তোর মা কি আমার বাঁদী?
তোমাদের কথা আলাদা। তোমাদের মতো কাপল ক’টা আছে?
বিয়ে হলে দেখবি, তুইও তোর মায়ের মতোই। স্বাধীনতার ব্যাপারটা কেমন জানিস? দুধ ফেলে পিটুলিগোলা খাওয়ার মতো। যে সব মেয়েরা সব সময়ে স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে তারা একটু সাইকিক কেস।
বাবা! তুমিও একথা বলছ?
মণীশ একটু ক্লান্ত হাসি হেসে বলে, ভালবাসার অভাব হলেই মানুষ একটা অলটারনেটিভ খোঁজে। স্বাধীনতা হল সেই জিনিস। স্বাধীনতা ব্যাপারটাই আমি বুঝতে পারি না।
সকাল থেকে দুপুর অবধি স্তিমিত রবিবারটা আবার একটু চাঙ্গা হল বুবকা আর অনু ফেরার পর। মুর্গি আর ফ্রায়েড রাইস দুটোই জমে গেল খুব। হইহই হল।
ক্লান্ত মণীশ দুপুরে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমল। বুকে একটা অস্বস্তি তার আছেই। ব্যথা নয়, ধড়ফড়ানি নয়, শুধু মনে হয় কে যেন একটা আঙুলের ডগা তার বুকের বাঁ ধারে ছুঁইয়ে রেখেছে। এই অস্বস্তিটা সে প্রায় সবসময় টের পায়।
ঘুম থেকে উঠে যখন ঘড়ি দেখল মণীশ তখন পৌনে চারটে। তার পাশেই ঘুমোচ্ছে অপর্ণা। ইদানীং একটু মোটা হয়েছে। চুলগুলো কিছু ফাঁকা। দু-একটা সাদার ঝিলিক।
মনটা খারাপ লাগল তার। বয়স হচ্ছে।
পত্রিকার পাতা নাড়াচাড়া করল আরও কিছুক্ষণ। আধঘণ্টা পর উঠল অপর্ণা।
উঠেই বলল, এই তোমাকে অমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
ফ্যাকাসে? যাঃ, আমি তো ভাল আছি।
কিন্তু কেমন দেখাচ্ছে বলো তো! টায়ার্ড ফিল করছ?
না তো।
কতদিন চেক-আপ হয়নি! কাল চলো তো, চেক আপ করাবো।
মাসখানেক আগেই হয়েছে। অকারণ ভয় পেও না।
একটু চুপ করে থেকে অপর্ণা বলে, একটা কথা বলবো?
বলো।
আমি যে বাড়ির প্ল্যান জমা দিলাম তাতে তুমি খুশি হওনি?
মণীশ একটু অবাক হয়ে বলে, আলাদা করে খুশি হওয়ার মত ঘটনা কি সেটা?
আমাদের বাড়ি হবে এটা ভাবতে তোমার ভাল লাগছে না?
বাড়ি! বলে মণীশ কিছুক্ষণ যেন ভাবল। তারপর বলল, বাড়ি।
তার মানে কি হল?
মণীশ একটু হাসে, বাড়ি তো ভাল জিনিস। নিজেদের বাড়ি।
ঠেস দিচ্ছ কেন?
মণীশ হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। শূন্য চোখে চেয়ে থেকে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কোথায় বাড়ি কে জানে?
ওটা আবার কেমন কথা?
ওটাই কথা অপু। বাড়ি যে কোথায় তা কি জানি! কে জানে সেই বাড়ির চেহারা কেমন?
ফের ওসব বলছ?
তোমার আনন্দ দেখে আমারও একরকম আনন্দ হচ্ছে। একটা খেলনা পেয়ে বাচ্চা যেমন ভুলে থাকে তুমিও তেমনি।
বাড়ি কি খেলনা?
একটু সিরিয়াস খেলনা। একটু দামী। এই যা।
তোমার ফিলজফির জ্বালায় কি আমি পাগল হয়ে যাবো?
মণীশ নড়েচড়ে বসে বলল, আচ্ছা, ভেবে দেখি আর একটু। এক কাপ চা করে আনো। ততক্ষণ ভেবে ফেলি।
থাক, তোমাকে আর ভাবতে হবে না।
অপর্ণা চা করে এনে দেখে, মণীশ জানালার ধারে চেয়ারে এলিয়ে বসে আছে। মুখচোখ ভাল নয়। দুর্বল। একটু জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।
কী হল তোমার?
মণীশ অবাক হওয়ার ভান করে বলে, কী হবে? তোমার যে রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে।
শরীর খারাপ নয় তো?
না। শরীর ঠিক আছে।
শোনো। হার্ট এইলমেন্টে মনেরও একটা ভূমিকা আছে। তুমি আবার আগের মতো একটু ফুর্তিবাজ হয়ে ওঠো তো!
মণীশ চায়ে চুমুক দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে কী ভেবে নিয়ে বলে, অপু, তুমি বরং ঝুমকির বিয়ের চেষ্টা করো।
হঠাৎ একথা কেন?
বিয়েটা দিয়ে যাই।
দিয়ে যাই কথাটার অর্থ জানো?
জানি। জেনেই বলছি।
হ্যাঁ গো, তোমার তবে সত্যিই শরীর ভাল নেই। ডাক্তার ডাকবো?
না। এখনও ডাক্তারের দরকার নেই। কিন্তু যা বলছি শোনো।
কী শুনবো?
ঝুমকির বিয়েটা এবার দেওয়া দরকার।
মেয়ে কি আমার কথা শুনবে? তুমি বুঝিয়ে বলল।
একটু খোঁজ নাও। হতে পারে, শী ইজ ইন লাভ উইথ সামওয়ান। কিন্তু হয়তো প্রেমটা একতরফা। একটু খোঁজ নাও।
কার কাছে খোঁজ নেবো? ও মেয়েকে কেটে ফেললেও একটি কথা বের করা যাবে না।
মণীশ চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, তা হলে বাড়িটাই হোক।