৭০. ঠিক কি না?

৭০. ঠিক কি না?

প্রধানমন্ত্রীর পেয়ারা বান্দারা লুটে পুটে দেশ সাবাড় করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুনেছিলাম কত লক্ষ কোটি টাকা হাওয়া করে দিয়েছেন তেনারা। মন্ত্রী মশাইগণ ইউরোপ আমেরিকায় টাকা পাচার করে বাড়িটাড়ি বানিয়ে ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এক পা দেশে দিয়ে রেখেছেন দেশের অবশিষ্ট সম্পদ পাচারের জন্য। যাঁর ছাতার তলায় বসে এতসব কুকর্ম চলে, তিনি বিরোধী দলের কোনও চিহ্ন রাখেননি, গণতন্ত্রকে ভীষণ ভয় পান কিনা। পেয়ারা বান্দারা বিনা বাধায় দেশের বারোটা বাজিয়ে খুশি থাকুন, এ তিনি মন থেকেই চান।

তেনার এক পেয়ারা বান্দা দু’দিন আগে বোরখা পরে বর্ডার পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। কেন বর্ডার পার হতে গেলেন? হতে গেলেন কারণ পেয়ারা বান্দাটির কীর্তিকলাপ সব ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁস হয়ে গেলে তিনি কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেন, বেইজ্জত করার অর্ডার দিয়ে দেন। সুতরাং যতক্ষণ ধরা না পড়ছো, ততক্ষণ তুমি আমার।

চোরকে নিয়েও না, বাটপারকে নিয়েও না, যে জিনিসটাকে নিয়ে কথা বলতে চাইছি, সেটা কালো বোরখা। বোরখা যত না মেয়েদের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের। ক্রিমিনাল পুরুষেরা চুরি ডাকাতি আর খুন খারাবি করতে গিয়ে বোরখা পরেন, অবৈধ ভাবে বর্ডার পার হওয়ার সময়ও বোরখা পরেন। এ ছাড়া বোরখার আর কোনও উপকারিতা আমি তো দেখি না। বোরখা ব্যান করলে অন্তত ক্রিমিনাল পুরুষেরা আরও সহজে ধরা পড়তে পারতো। ঠিক কি না?

৭ ১. সিংহী

কেনিয়ার উত্তরে সাম্বুরু জঙ্গল। সেখানে এক সিংহীর সামনে পড়েছিল এক সদ্যজাত হরিণ শাবক। শাবকটিকে না খেয়ে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছিল সিংহীটি। সিংহীটির কাজই ছিল জঙ্গলের বাঘ চিতা সিংহ হায়েনার থাবা থেকে শাবকটিকে বাঁচানো। শাবককে একা রেখে কোথাও শিকার করতে যেতে পারতো না সিংহী, কারণ হরিণ-শাবকেরা সিংহ-শাবকদের মতো এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করে না মায়েদের জন্য। হরিণ-শাবকটি আবার দূরে কোথাও চলে গিয়ে কী না কী বিপদে পড়ে সেই জন্য মাসের পর মাস সিংহীটি কোনও কিছু শিকার করেনি, খায়নি। একবার শাবকটি হরিণের পালের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সিংহীটি ওকে ফেরত নিয়ে আসে।

এটিই প্রথম নয়, সিংহীটি আরও পাঁচটি হরিণ-শাবককে মায়ের মতো লালন পালন করে বড় করেছে। যাঁরা এই সিংহীর জীবনকে গোপনে লক্ষ করেছেন এবং ক্যামেরায় বন্দি করেছেন, তাঁরা সিংহীর নাম দিয়েছেন কামুনিয়াক। কেনিয়ার ভাষায় কামুনিয়াক মানে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। কামুনিয়াক কেন নিজের শিকারকে নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেও সেবা যত্ন এবং নিরাপত্তা দিয়েছে, তা আজও কেউ জানে না। আমি যখনই কামুনিয়াককে দেখি হরিণ-শাবককে লালন পালন করছে, চোখে আমার জল আসে।

তুমি নিজের সন্তানকে লালন পালন করো, তুমি করবেই। তুমি যদি অন্যের সন্তানকে একই আদর দাও, তাহলেই তো তুমি অনন্য। জঙ্গলের সিংহীরা যেভাবে শিকারকে ধরে এবং কামড়ে খায়, তা দেখে অভ্যস্ত আমরা। যদি তাদের মতো ভয়ংকর প্রাণীর মধ্যে অন্যের জন্য, তাদের শিকারের জন্য, দয়া মায়া দেখি, তাদের মহত্ত্ব দেখি, তখন তো ভালো লাগায় মন ভরবেই। আর ভালো লাগা থেকেই ওই চোখের জল।

৭২. ধনী

মুকেশ আম্বানি তো এখন ওয়ারেন বাফেটের চেয়ে বেশি ধনী হয়ে গেলেন। আম্বানির সম্পদ এখন ৬৮.৩ বিলিয়ন ডলার, আর বাফেটের ৬৭.৯ বিলিয়ন ডলার। আমার কাছে অবশ্য ওয়ারেন বাফেটকে বেশি ধনী মনে হয়, কারণ তিনি তাঁর সম্পদের প্রায় সবটাই মানুষের কল্যাণে দান করে দিয়ে যাচ্ছেন।

৭৩. সাজ

আমাদের ছোটবেলায় সাজগোজের স্বাধীনতা ছিল না। আমার বাবা আমাদের মুখে কোনও রকম রঙ লাগানো সহ্য করতো না। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপ্সটিক, গালে রুজ সবই ছিল নিষিদ্ধ। কানে দুল, গলায় মালা, হাতে চুড়িও বাবা সহ্য করতো না। বাবা মনে করতো সাজলে লেখাপড়ায় আমাদের মন বসবে না। সুতরাং আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে সাজগোজহীন। ভেতরে ভেতরে তাই সাজগোজের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। সেই আকর্ষণটিকে প্রশ্রয় দিত আমার দুই দাদা। তারা আমাদের ওইসব এনে দিত। কৈশোরোত্তীর্ণ আমি বাবার চোখের আড়ালে সেজেগুজে সাজগোজের স্বাধীনতা নিয়েছি। সেই স্বাধীনতা পাওয়ার পর আবার নিজেই না-সাজার স্বাধীনতা ভোগ করেছি দীর্ঘকাল। এখন ইচ্ছে হলে সাজি, ইচ্ছে না হলে সাজি না।

৭৪. নারীকে মানুষ কেন এত ঘৃণা করে?

মানুষ লেখাপড়া করছে কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছে না। মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানুষ সভ্য হচ্ছে না। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর সব রকম তথ্যের নাগাল পাচ্ছে মানুষ, ভালো এবং মন্দ, ন্যায় এবং অন্যায়, শান্তি এবং অশান্তি, ভালোবাসা এবং ভায়োলেন্স, সমতা এবং বৈষম্য, সততা এবং অসততা, নারীর সমানাধিকার এবং নারী নির্যাতন, মানবাধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার, যুক্তিবাদ এবং ধর্মান্ধতা। বাংলাদেশের মানুষ যারা মন্দকে বেছে নিচ্ছে, তারা তো জেনে বুঝেই নিচ্ছে। তারা জেনে বুঝেই অন্যায়, অশান্তি, ভায়োলেন্স, বৈষম্য, অসততা, নারীনির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতার প্রতি ঝুঁকেছে। এরা জ্ঞানপাপী, এদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা খুব কঠিন।

কিন্তু যে যুবসমাজকে সৎ এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যেত, সঠিক পথ যাদের দেখানো যেত, সুস্থ সুন্দর জীবনকে গ্রহণ করার প্রেরণা দেওয়া যেত, শিশুকাল থেকেই তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে এক পাল অসৎ, নারী-নির্যাতক, ধুরন্ধর, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ বদ লোকের হাতে। তারা প্রতিনিয়ত তাদের অমানবিক, নির্মম নিষ্ঠুর হওয়ার জন্য ইন্ধনই যোগাচ্ছে না, তারা নারীকে ঘৃণা করার জন্য নারীর বিরুদ্ধে যত কুৎসিত কুকথা বলা দরকার বলছে। নারীর কোনও অধিকার বা স্বাধীনতা থাকতে নেই, নারীর শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতার প্রয়োজন নেই, নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের সেবা ও সঙ্গমের জন্য,পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য, নারীর দুশ্চরিত্রা, নারী ডাইনি, নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, নারী পাপী, একে বিশ্বাস করো না, একে মারো, একে ঘৃণা করো, কোনও পবিত্র জায়গায় একে প্রবেশাধিকার দিও না। যুব সমাজের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকে যাচ্ছে নারীবিদ্বেষ। নারীবিদ্বেষী ওয়াজিদের বক্তৃতা শুধু শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে সীমাবদ্ধ নয়, অন্তর্জালে তাদের উপস্থিতি ভয়াবহ রকম। সন্ত্রাসী দল আইসিসে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা কিন্তু ইউটিউব থেকে ইসলামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মগজধোলাই হওয়া তরুণ তরুণী!

দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু যুবককে গ্রেফতার হতে হয়েছে। এ কেমন অদ্ভুত আচরণ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদই তো হওয়া উচিত। পুলিশের কাজ রাতে টহল দেওয়া, চোর ছ্যাঁচড়, গুন্ডা বদমাশ, ধর্ষক নির্যাতক, খুনী সন্ত্রাসীদের ধরা, শহর বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ আশ্চর্য, বাংলাদেশের পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে সচেতন ছাত্রছাত্রী গ্রাফিতি আঁকছিল, তাদের মেরে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে থানায় নিয়ে রাতভর অত্যাচার করেছে। পুলিশ বলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি নিতে হয়। ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়? অবশ্যই নয়। অনুমতি ছাড়া অন্যায় করা যাবে, অনুমতি ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না।

দেশটা নষ্ট হতে হতে একেবারে গলে গেছে। দেশের মস্তিষ্ক থেকে এখন দুর্গন্ধ পুঁজ বেরোচ্ছে। এই দেশই তো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘লেখালেখি পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাইলে আমাদের অনুমতি নিতে হবে’। মৌলবাদীরা যে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছিল, তাতে অবশ্য তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা কেউ বলেনি।

ভালো কাজ করার সময় যে সরকার অত্যাচার করে, নির্বাসনে পাঠায়, জেলে ভরে, সেই সরকার নিজের ভালো ছাড়া আর কারও ভালো চায় না। দেশের ভালো তো চায়ই না।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেই নারীনির্যাতন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁচেছে। মনীষা বাল্মিকী নামে উত্তরপ্রদেশের এক গরিব মেয়েকে চারটে বীরপুরুষ ধর্ষণই শুধু করেনি, মনীষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে, জিভও কেটে নিয়েছে। কেন করেছে ওরা এই নির্যাতন? কারণ মনীষা মেয়ে। অন্যদের মতো আমি বলবো না কারণ মনীষা নিচু জাত। কেন, উঁচু জাত বুঝি ধর্ষণের শিকার হয় না? হয়। ভারতে এই জাতপাত আইনত নিষিদ্ধ হলেও এটি সকলে মেনে চলে। ওপরে ওপরে না মানলেও ভেতরে ভেতরে মানে। আমার কত প্রগতিশীল বন্ধুর সার্টের ফাঁক দিয়ে দেখেছি উঁকি দিচ্ছে সাদা পৈতে। জাত গোত্র হাবিজাবি সব দেখে তবে এরা বিয়ে করে। পুরুষতন্ত্রের বিচারে মেয়েদের একটাই জাত, সেটা হল নিচু জাত। সুতরাং মেয়েদের উচুঁনিচু সব জাতের পুরুষই ধর্ষণ করতে, হত্যা করতে দ্বিধা করে না।

মনীষা শেষপর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। গরিবের মৃত্যুতে কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু মনীষার হাল অনেকটা নির্ভয়ার মতো, গণধর্ষণের পর মৃত্যু—তাই পুরোনো প্রতিবাদ মনে পড়েছে লোকের। চেঁচিয়ে কিচ্ছু হবে না। চেঁচিয়ে, ধর্ষকদের ফাঁসি দিয়ে কিচ্ছু হয়নি, ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি। ফাঁসির চেয়েও যেটি ভয়াবহ, সেটির নাম পুরুষতন্ত্র। পুরুষেরা ফাঁসির ভয় ভুলে যায়, পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা ভোলে না।

যতদিন নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারের লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হবে, যতদিন মেয়ে-জন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত থাকবে, যতদিন পণপ্রথা টিকে থাকবে, যতদিন মেয়েরা যৌনবস্তু হিসেবে চিহ্নিত হবে, যতদিন মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থাকতে যাবে, যতদিন সিঁদুর শাঁখা হিজাব বোরখা পরতে হবে, যতদিন স্বামীর নামে পরিচিত হবে, যতদিন পুরুষ প্রভু নারী দাসি’র কাঠামো রয়ে যাবে, যতদিন বেশ্যাপ্রথার অস্তিত্ব থাকবে, যতদিন পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র বজায় থাকবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। কারণ ধর্ষণ ব্যাপারটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক, আগাগোড়াই নারী-বিদ্বেষ। ধর্ষণ যারা করে তারা জন্মের পর থেকেই পুরুষতন্ত্র দ্বারা মগজধোলাই হওয়া, তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নারীকে ভোগ করা, নির্যাতন করা, নারীকে মেরে ফেলা, কেটে ফেলার একশোভাগ অধিকার তাদের আছে।

বাংলাদেশের একটি খবর, একটি ভিডিও এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ”এক মেয়েকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ”। কেন খবরটি ভাইরাল হল? ওই ‘বিবস্ত্র’ শব্দটির জন্য। স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্যাতন করেছে ওরা। কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, সম্ভব না হওয়ায় বিবস্ত্র করেছে। বিবস্ত্র করার ভিডিও করেছে ওরা, ফেসবুকে ভিডিও আপ্লোড করবে বলে। মেয়েটির শরীর শুধু ওরা নয়, আরও হাজার লোকে দেখবে, এর চেয়ে বড় শাস্তি একটি মেয়ের জন্য ওরা মনে করে না আর কিছু আছে।

যদি একটি পুরুষকে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করা হত, তাহলে কি খবরটা এমন ছড়াতো? মানুষ তখন পুরুষকে মারধর করার বিরুদ্ধে কিছু হয়তো বলতো, বিবস্ত্র করার বিরুদ্ধে নয়। পুরুষ বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক নয়, মেয়ে বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক। দুটোই শরীর। দুটো শরীরে শুধু যৌনাঙ্গগুলো ভিন্ন। তাহলে এক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি নেই, আরেক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি কেন?

যদি খবরটি এমন হত—’একটি মেয়েকে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ’, তাহলে কারও কিছু যেত আসতো না। বিবস্ত্র শব্দটি শুনে লোকে লাফিয়ে উঠেছে। কী, এত বড় স্পর্ধা, বিবস্ত্র করেছে! তার মানে মেয়েটির বুক মুখ পেট পিঠ হাত পা এমন কী যৌনাঙ্গ পর্যন্ত দেখে ফেলেছে! কী সর্বনাশ।

মেয়েরা তো শুধু স্বামীর সম্পত্তি নয়, মেয়েরা কোনও না কোনও ভাবে সমস্ত পুরুষের সম্পত্তি। সে কারণেই সব পুরুষই মেয়েদের শরীর নিয়ে চিন্তিত, এই শরীর আবার কেউ না দেখে ফেলে! সে কারণেই তো মেয়েরা কী পোশাক পরবে, তা পুরুষেরাই নির্ধারণ করে। বিবস্ত্র না করে নির্যাতন করলে সেটিকে অন্যায় বলে মনে করা হত না। বিবস্ত্র না করে জবাই করে ফেললেও মানুষ এতটা ক্ষিপ্ত হতো না, যতটা বিবস্ত্র করায় ক্ষিপ্ত।

মেয়েকে বিবস্ত্র করাটা লোকের কাছে বড় নির্যাতন মনে হয়েছে, ওই চড় ঘুসি, লাথির চেয়েও। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে, মেয়েরা আস্ত একখানা ‘শরীর’ ছাড়া কিছু নয়। যেহেতু মেয়েরা শুধুই ‘শরীর’, তাই শরীরের সবকিছু আগলে রাখতে হবে, ঢেকে রাখতে হবে, কারণ ওগুলো মেয়েটির হলেও মেয়েটির নয়, ওগুলো মেয়েটির মালিক অর্থাৎ স্বামীর খাদ্য, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া কারো নজর পড়লে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও লালা ঝরলে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও ছোঁয়া লাগলে খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়, ভক্ষণের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

যে মানসিকতা মেয়েদের বোরখায় ঢেকে রাখে, মেয়েদের বিবস্ত্র করাকে অন্যায় বলে বিচার করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’, এই শরীরটাই উলঙ্গ হয়ে গেলে শরীরের আর কিছুই থাকে না—এই একই মানসিকতা মেয়েদের বিবস্ত্র করে, ধর্ষণ করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’।

অনেকে পুরুষকে অনুরোধ করে নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীকে মা, বোন, কন্যা হিসেবে দেখো, নারীকে সম্মান করো। আমি মনে করি না, নারীকে এত ফেভার করা উচিত। নারীকে মা বোন কন্যা হিসেবে দেখার দরকার নেই, নারীকে মায়ের জাত হিসেবে শ্রদ্ধা করারও দরকার নেই, নারীকে নারী বলে সম্মান করারও দরকার নেই। কই, পুরুষকে বাপের জাত হিসেবে সম্মান করার কথা বলা হয় না, পুরুষকে তো মানুষ হিসেবে দেখার অনুরোধ করা হয় না! কারণ পুরুষ বলে তাদের কেউ অসম্মান করে না, পুরুষ বলে তাদের কেউ ঘৃণা করে না। যেভাবে নারীকে করে।

তাহলে কী করতে হবে? কী করলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে? আমি মনে করি, শিশুকাল থেকে মানুষের মগজধোলাই হয়েছে যা দিয়ে সেসব শুধু মগজ থেকে বিদেয় করতে হবে। কী সেটা? সেটা হল কুশিক্ষা বা ভুল শিক্ষা, যেমন : নারী যৌনবস্তু, নারী পুরুষের ভোগের সামগ্রী, নারীকে নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা কোনও অপরাধ নয়, নারীর কোনও স্বাধীনতা বা অধিকার থাকতে নেই, নারীর জন্য শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা নয়, নারীকে পরনির্ভর হতে হবে, নারীকে পিতা, স্বামী এবং পুত্রের অধীনে বাস করতে হবে, পুরুষের ক্রীতদাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া নারী কিছু নয়—এইসব হাজারো নারীবিদ্বেষী শিক্ষা। এই বিদ্বেষগুলো মগজ থেকে বিদেয় করতে পারলেই যথেষ্ট, তাহলেই নারী পুরুষে সমতা আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

৭৫. ধর্ষণ বন্ধ করার উপায়

ধর্ষণ ধর্ষণ ধর্ষণ। আর ভালো লাগে না এই শব্দটি উচ্চারণ করতে। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন শুনতে হয়, পড়তে হয় এই শব্দটি। এমন কোনও দিন কি আসবে যেদিন এই শব্দটি আর কেউ উচ্চারণ করবে না, কারণ ধর্ষণ বলে কিছু আর ঘটবে না দুনিয়াতে?

ভারতের উত্তরপ্রদেশে মনীষা বাল্মিকী নামে এক ১৯ বছর বয়সী মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিল, সেখানেই তাকে ওড়না ধরে টেনে নিয়ে চার জন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে, জিভ কেটে ফেলে, মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে। মনীষাকে প্রায়-মৃত ফেলে রেখে গিয়েছিল ওই চার ধর্ষক। ১৫ দিন ভোগার পর গতকাল মনীষার মৃত্যু হয়েছে দিল্লির হাসপাতালে। কেন ওই পুরুষেরা মনীষাকে ধর্ষণ করেছে? কারণ মনীষা মেয়ে। কারণ মনীষা নিচু জাত। আর ওরা ধর্ষকরা? ধর্ষকরা পুরুষ, ধর্ষকরা উঁচু জাত। তাহলে কি শুধু উঁচু জাতের লোকেরাই ধর্ষণ করে? নিচু জাতের লোকেরা করে না? উঁচু জাতের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না? হয়। সব জাতের, সব ধর্মের, সব ভাষাভাষীর, সব রঙের, সব শ্রেণীর, সব গ্রামের, সব শহরের, সব দেশের, সব বয়সের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়, এবং সব ধরনের পুরুষই ধর্ষণ এবং নির্যাতন করে মেয়েদের। ধর্ষণ ততদিন বন্ধ হবে না যতদিন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টিকে থাকবে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানুষকে এই শিক্ষা দিয়ে মগজধোলাই করে যে পুরুষেরা প্রভু, মেয়েরা নিতান্তই দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তু। দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করবে না তো কি তাদের পুজো করবে? দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তুকে হাসতে হাসতে হত্যা করাও তো আলাদা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পুরুষেরা এই রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চায়। ধরা পড়বে না, ধরা পড়লেও শাস্তি পাবে না, এই বিশ্বাস থেকেই স্বাদ নিতে চায়।

কয়েক বছর আগে যখন দিল্লিতে নির্ভয়া অর্থাৎ জ্যোতি সিংকে গণধর্ষণ করা হল চলন্ত বাসে, মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যেতে হল নির্ভয়াকে, নির্ভয়ার মৃত্যু হল, তখন হাজারো মানুষ পথে নেমেছিল। ধর্ষণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল ভারত। নির্ভয়াকে ধর্ষণ করার অপরাধে প্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষকদের ফাঁসি হল। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো একেই বলে। কিন্তু ধর্ষণ কি বন্ধ হয়েছে? লাগাতার চলছে ধর্ষণ।

ভারতে গতবছর প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি করে ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। পুরো দেশে নারীর ওপর নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৮৬১টি। নথিভুক্ত করা হয়নি’র সংখ্যাটা নিশ্চয়ই বেশি। নথিভুক্ত একটি সংখ্যা দেখলে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশে, সেই সংখ্যার দ্বিগুণ -ত্রিগুণ এমনকি চতুর্গুণ একটি সংখ্যাকে সত্যিকারের সংখ্যা হিসেবে আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়। নিতে তো হয়ই, ক’টা মেয়ে আর ক’টা অপরাধ নথিভুক্ত করে! পুরুষের অপরাধ নথিভুক্ত করে পুরুষের সমাজে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে থাকবে কোন মেয়ে, কার এত বড় দুঃসাহস! মুখ গুঁজে বেঁচে থাকতে মেয়েদের বাধ্য করা হয়, এতেই ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে।

নারী নির্যাতন কমছে না, বরং বাড়ছে। ২০১৮ সালে নারী নির্যাতন যা ছিল, তার চেয়ে, পরের বছরে, ৭ ভাগ বেড়েছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ২৩৬টি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ভারতে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৩৫৬। ২০১৭ সালে নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৩২ হাজার ৫৫৯টি। সংখ্যাটা প্রতিবছর বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে কি আকাশ ছোঁবে? মেয়েরা তো শিক্ষিত হচ্ছে, স্বনির্ভর হচ্ছে, ধর্ষকদের ফাঁসি হচ্ছে, যাবজ্জীবন হচ্ছে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর সব রকম চেষ্টা হচ্ছে, সরকারি বেসরকারি নানা রকম সংগঠন দিন রাত ধর্ষণ বন্ধ করতে চাইছে, তাহলে ধর্ষণ কেন বন্ধ হচ্ছে না? এই প্রশ্নটি করতে হবে বারবার, এবং উত্তরটি, নকল উত্তরটি নয়, আসল উত্তরটি খুঁজে বের করতে হবে।

শুধু কি ভারতেই নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ আর নারীহত্যার উৎসব চলে? বাংলাদেশও কিছু অংশে পিছিয়ে নেই। গত ৮ মাসে শুধু ধর্ষণই নথিভুক্ত হয়েছে ৮৯২টি। নথিভুক্ত নয় এমন ধর্ষণকে আমাদের নিজ দায়িত্বে যোগ করে নিতে হবে। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, ধর্ষণের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা এমন ঘটনাগুলোও আমাদের যোগ করতে হবে।

সেদিন পাহাড়ের একটি চাকমা মেয়েকে ৯ জন বাঙালি পুরুষ ধর্ষণ করেছে। শুনে কি আমি অবাক হয়েছি? মোটেও না। যদি কোনও পুরুষ ধর্ষণ থেকে বিরত রাখে নিজেকে, সে রাখে আইনে ফেঁসে যাবে বা লোকে পেটাবে—এই ভয়ে। আজ এমন আইন হোক, যে আইনে পুরুষেরা যা খুশি করুক শাস্তি পাবে না, তাহলে হয়তো একটি পুরুষও ধর্ষণ না করে একটি দিনও বসে থাকবে না।

আজই খবরে পড়লাম, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে মনির হোসেন নামে এক লোক তার নাবালিকা কন্যাকে দীর্ঘকাল ধরে ধর্ষণ করছে। শেষ অবধি মনির হোসেনের স্ত্রীই স্বামীর কুকীর্তির কথা পুলিশকে জানায়। কন্যাটিও মনির হোসেনের সামনে পুলিশকে বলেছে, কী করে সে তার পিতা দ্বারা ধর্ষণের শিকার হত। মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু মনিরের মতো লোকের অভাব সমাজে নেই।

আমাদের দুঃখ এই, আমরা মেয়েরা সংখ্যাগুরু হই, সংখ্যালঘু হই আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ আমাদের দুর্ভাগ্য এই, আমরা এক সমাজে যাদের সঙ্গে বাস করি, তারা সকলেই পুরুষ নয়, তারা অনেকেই চক্ষুকর্ণহীন বোধবুদ্ধিবিবেকহীন পুরুষাঙ্গ। এই পুরুষাঙ্গগুলো যতদিন না পুরুষ হয়ে উঠবে ততদিন ধর্ষণ বন্ধ হবে না। পুরুষাঙ্গ হওয়া কোনও গৌরবের ব্যাপার নয়। যদিও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের পুরুষাঙ্গ হয়ে ওঠার প্রেরণাই জীবনভর জুগিয়েছে। জন্মের সময়ই তো নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারে খুশির ফোয়ারা ছোটে। সেই থেকে শুরু। তারপর পরিবারের পুত্রধনকে যে হারে সেবা যত্ন করা হয়, তার পেছনে ধনসম্পদ যেভাবে ব্যয় করা হয়, তার জন্য আশা আকাঙ্ক্ষা যেভাবে জমানো হয়, যত স্বপ্ন দেখা হয় তাকে নিয়ে—তাকে একরকম সম্রাট বানিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাট তো হবেই অহংকারী, করবেই ধরাকে সরা জ্ঞান। তাকে তো জন্ম থেকে শেখানো হয়, সে ছেলে বলে সে মূল্যবান, আর অজস্র যে মেয়ে আছে পরিবারে, সমাজে, তারা কেউ তার মতো মূল্যবান নয়। মেয়েদের জন্ম পুরুষের সেবা করার জন্য, পুরুষের ভোগের বস্তু হওয়ার জন্য, পুরুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। যেমন শেখে, তেমন ব্যবহার করে। যতদিন এই সমাজ পুরুষকে মেয়েদের চেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে মানবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। ধর্ষণ যারা করে, তারা সবাই মগজধোলাই হওয়া লোক। পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র তাদের অবিরাম মগজধোলাই করেছে। রাষ্ট্রের তৈরি পারিবারিক আইনে পুরুষের অধিকার বেশি। সমাজের রীতিনীতি পুরুষ তৈরি করেছে, পুরুষেরই জয়জয়কার সেসবে, পরিবারে পুরুষই হর্তাকর্তা। এই সব পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে, তবেই না সমতা আসবে। নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার চর্চা না হলে ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রভুরা দাসিদের নির্যাতন করে। প্রভু দাসির সম্পর্ক আদিকাল থেকে এমনই। ধর্ষণ একধরনের নির্যাতনের নাম। সমতার সমাজ তৈরি করা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলাই ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধ করার উপায়।

৭৬. কুকুর নিধন বন্ধ হোক

বাংলাদেশে কুকুর নিধন করার আর্জি নিয়ে মানববন্ধন হয়। এ বড় অভিনব মানববন্ধন। কুকুর নিধন তো চলছেই। পৌরসভা থেকে তো বটেই, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পাড়ায় পাড়ায় এই নিধন যজ্ঞ চলে। নৃশংসতার ভয়াবহতা কত দূর পৌঁছোলে অসহায় প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারে মানুষ। একটি দেশ কতটা সভ্য তা নির্ভর করে সেই দেশ তাদের অসহায় প্রাণীদের কতটা নিরাপত্তা দেয় তার ওপর। যে দেশ কুকুর বেড়াল হত্যা করে, সে দেশ অসভ্যই শুধু নয়, ভয়ংকর নির্মম।

অরণ্যের নেকড়ে প্রজাতি থেকেই বিবর্তনের ফলে কুকুরের জন্ম, শৃগালের সঙ্গেও প্রজাতিগত আত্মীয়তা রয়েছে কুকুরের। এরা অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে বহু আগে। ১২ হাজার বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করছে মানুষের সঙ্গে। এদের কাজ ছিল দূরপাল্লার পথিকদের সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর শিকারীদের শিকারে সঙ্গ দেওয়া। কুকুর সঙ্গে নিয়ে শিকারে যেত শিকারীরা, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি মানুষের ঘ্রাণ এবং দৃষ্টিশক্তির চেয়ে বেশি ধারালো বলে শিকারে কুকুরদের সাহায্য দরকারী ছিল। শুধু কি শিকারী আর পথিকের উপকারই করতো কুকুর? সব মানুষেরই উপকার করতো। ভেড়ার পালকে চড়াতে নিয়ে যাওয়া, গবাদি পশুকে পাহারা দেওয়া, বরফের দেশে স্লেজগাড়ি চালানো, ভার বওয়া, সব কাজই কুকুর করতো, এখনও করে। প্রাচীন মিশর তো কুকুর বেড়ালকে দেবতা মানতো। তারা কুকুর বেড়ালের উপকারকে যথাযথ মূল্য দিয়েছিল। বেড়ালেরা শস্যক্ষেতের ইঁদুর মেরে মিশরের মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

কুকুর বেড়ালদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করা, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজটি এখন উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের লোকেরা করছে। অনুন্নত দেশগুলোয় এখনও কুকুর বেড়ালকে খাদ্য হিসেবে, আপদ হিসেবে বা চোর তাড়ানোর প্রহরী হিসেবে দেখা হয়। কুকুরকে তো নাপাক প্রাণী হিসেবে অনেক দেশেই ঘৃণা করা হয়। এশিয়ার উচ্চবিত্তরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো কুকুরে কুকুরে মিশ্রণ ঘটিয়ে পছন্দসই শাবক প্রসব করিয়ে তবে পোষে। কিন্তু দেশি কুকুরেরা পথে পথে ঘোরে, দেশি মানুষেরা তাদের খাদ্য দেয় না, আশ্রয় দেয় না। এই কুকুরেরা অভুক্ত অবস্থায় ডাস্টবিন ঘেঁটে পচা গলা কিছু পেলে খায়, তা না হলে ওভাবেই অভুক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। কুকুরকে মেরে পা ভেঙে দেওয়া, কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা—এসব অহরহই অসভ্য সমাজে ঘটে চলেছে। রাস্তার জীবন্ত তরতাজা কুকুরগুলোকে হত্যা করে করে ভোরবেলায় ট্রাক বোঝাই করতে দেখেছি। কুকুর কামড় দিলে মানুষের
র‍্যাবিস হতে পারে। এর সমাধান তো কুকুরদের মেরে ফেলায় নয়। এর সমাধান ওদের র‍্যাবিসের টিকা দেওয়ায়।

মানুষ কি চাইলেই কিছুটা উদার হতে পারে না? আমি তো মনে করি রাস্তার কুকুরদের ঘরে ঘরে নিয়ে পোষা উচিত। তাহলেই রাস্তায় কোনও কুকুর থাকবে না। এ যদি না করা হয় তাহলে কুকুরদের বন্ধ্যাত্বকরণের ব্যবস্থা হোক। মহল্লা মহল্লায় কুকুরের আশ্রয় স্থল থাকুক। যেখানে তারা খাবে, ঘুমোবে। কুকুরদের পশু হাসপাতালে নিয়ে বন্ধ্যা করলেই তো কুকুরের জনসংখ্যা কমবে। হত্যাযজ্ঞ করে কুকুরের সংখ্যা কমানো যায় না। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা অনুশীলন করে সভ্য হওয়া যায় না, শিক্ষিতও হওয়া যায় না।

আমি বেড়াল পুষি। আমার বেড়ালটিকে দোকান থেকে জাত দেখে কিনে আনিনি। দেশি বেড়াল আমার। বেড়ালটিকে কলকাতার এক মাছের বাজার থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যাঁ রাস্তার বেড়াল। আজ আমার বেড়ালের বয়স ১৭ বছর। মানুষের হিসেবে ওর বয়স ৮০। ১৭ বছর দেশি বেড়ালরা বাঁচে না। রাস্তাঘাটে মানুষের মার খেয়ে অসুখে অনাহারে দুর্ঘটনায় মারা যায় অল্প বয়সেই। পুষেছি বলেই বেঁচেছে এত কাল। ভালো খাদ্য পেয়েছে, নিরাপত্তা পেয়েছে। এই বেড়াল অতি বুদ্ধিমতি। আমি পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতের বেড়াল দেখেছি, এত বুদ্ধিদীপ্ত কোনও বেড়াল দেখিনি। সিয়ামিস জাতের বেড়ালের বুদ্ধি বেশি লোকে বলে, কিন্তু আমাদের দেশি বেড়ালের ঘটে নিঃসন্দেহে বুদ্ধি তার চেয়েও বেশি ধরে, এত প্রতিকূল পরিবেশে বুদ্ধি না থাকলে বেঁচে থাকতে পারতো না। নির্বংশ হয়ে যেত অনেক আগেই। ওর বুদ্ধিমত্তার খবরে শহরে চাউর হয়ে গিয়েছিল। ওর ফুটবল শো দেখানো হয়েছে টিভিতে, ওকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেই চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। শুধু বেড়াল নয়, কুকুরও প্রখর বুদ্ধি ধারণ করে। সে কারণেই বিরুদ্ধ পরিবেশে আজও টিকে আছে। দেশি কুকুর পোষ মানে না বলে যে প্রচার হয়, সেটা ভুল। ভারত-বাংলাদেশের রাস্তা থাকে কুকুরের বাচ্চা ধরে নিয়ে আমেরিকায় পুষেছে এমন লোকের ঘরে গিয়ে দেখে এসেছি আমাদের দেশিগুলো কুকুরশ্রেষ্ঠ হয়ে সোফায় রাজা বাদশাহর মতো বসে আছে। খাবার পেলে, নিরাপত্তা পেলে, আরাম আয়েশ পেলে, আদর পেলে রাস্তার অসহায় প্রাণীও সুন্দর পোষ্য হয়ে ওঠে, প্রভুভক্ত হয়ে ওঠে। কুকুরের প্রভুভক্তি তুলনাহীন। ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায় গৃহহীন মানুষকে কুকুর পাশে নিয়ে শুয়ে থাকতে কত যে দেখেছি। কুকুর যতই ক্ষিধেয় কষ্ট করুক, তার ভিক্ষুক-বন্ধুকে ছেড়ে কোথাও সে যায় না, প্রভু শব্দটির চেয়ে বন্ধু শব্দটি ভালো। কুকুর নিয়ে বসলে মানুষের ভিক্ষেও ভালো জোটে। কারণ কুকুর না খেয়ে থাকবে, উদার পথচারীরা এ সইতে পারে না।

আমি কুকুর পুষি না এখন। কিন্তু আমার গাড়িতে কুকুরের খাবার সবসময় থাকে, রাস্তায় কুকুর দেখলেই আমি গাড়ি থামিয়ে থালায় করে ওদের খাবার দিই, দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ খাওয়া শেষ না হয়। রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ানোর জন্য ডে কেয়ার সেন্টারই খুলেছি। এই কাজটি করে আমি স্বস্তি পাই। অসংখ্য অসহায় ক্ষুধার্ত কুকুর বেড়ালের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কের মূল্য আমার কাছে অনেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে বেশি। এতে কোনও রাজনৈতিক বাণিজ্যিক সাহিত্যিক স্বার্থ নেই, এই স্বার্থ না থাকাটাই আমাকে অপার আনন্দ দেয়। নিঃস্বার্থ কাজের একটি সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যটি, দুঃখ এই, সকলে দেখতে পায় না।

অনেকে আমাকে দোষ দেয়, রাস্তার কুকুর বেড়ালকে খাওয়াচ্ছি, কিন্তু রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছি না! রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে আমি খাওয়াচ্ছি না, এ কথা ঠিক নয়। তাদের খাওয়াচ্ছি, তরে রাস্তার মানুষের চেয়ে রাস্তার কুকুর বেড়ালদের প্রতি আমার দরদ বেশি, বেশি কারণ মানুষকে সাহায্য করার জন্য অনেক সংস্থা সংগঠন আছে, কুকুর বেড়ালকে সাহায্য করার জন্য নেই। কুকুর বেড়ালদের মানুষ ঘৃণা করে, তাদের নিধন করে, তাদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বেশি কেউ নেই। তাই আমি তাদের পাশেই দাঁড়াই। কিন্তু আমার একার পক্ষে তো বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারি বেসরকারি সংগঠনের এগিয়ে আসতে হবে, কুকুরদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাদ্য দিতে, টিকা দিতে, বন্ধাত্ব দিতে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকেই অনেকে পোষার জন্য ঘরে নিয়ে যাবে কুকুরদের।

দেশি বেড়াল পুষেছি অনেক কাল, যদি বেঁচে থাকি, একটি দেশি কুকুরের বাচ্চা এনে পুষবো। ভালোবাসা আর নিরাপত্তা পেলে দেশি কুকুরও জার্মান শেফার্ডকে টেক্কা দেবে।

রাস্তার কুকুরের চিৎকারে কান্নায় অনেক বিরক্ত, তাই কুকুর নিধনের চিন্তা তাদের মাথায় আসে। আমি বুঝি না তাদের কেন মাথায় আসে না, কুকুর হয়তো ক্ষিধেয় চিৎকার করছে, কেন তাদের মাথায় আসে না কুকুরকে খাবার দেওয়ার। খাবার দিলেই তো খেয়ে শান্তিতে ঘুমোবে ওরা। এই সহানুভূতি তো মানুষের সমাজ থেকে ওরা আশা করতে পারে। মানুষের সেবা করেছে ওরা হাজার হাজার বছর, আজ ওরা ব্রাত্য, আজ সামান্য খাদ্যের আশায় উদ্ভ্রান্ত ঘোরে। ওদের কষ্ট যন্ত্রণা ওদের অসহায়তা, অসুখ, অশান্তি, অনিরাপত্তা একমাত্র আমরাই দূর করতে পারি, ওদের জীবনের সুখ দুঃখ আমাদের ওপরই নির্ভর করে। আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। নিঃস্বার্থ হওয়াই শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণ।

৭৭. কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ?

ঘন ঘন দাঙ্গা হচ্ছে ভারতবর্ষে। ভারতের উগ্র হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচণ্ড। কারও কারও ঘৃণা এমনই ভয়াবহ যে পারলে মুসলমানদের ধরে ধরে খুন করে, অথবা ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশে কিন্তু দাঁড়ায় হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা প্রগতিশীল, যাঁরা মুক্তচিন্তক, তাঁরা। একই রকম অন্যান্য দেশেও। বিশ্বের মানবতা আর মানবাধিকারের জন্য সেরা দেশ বলে খ্যাত ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়েয় বাড়ছে মুসলিম-বিদ্বেষী ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী নয়া- নাৎসির সংখ্যা। আজ তারা কোরান পোড়াবার উৎসব করে জনসভা ডেকে। ডেনমার্কের উগ্র দক্ষিণপন্থী মুসলিম বিরোধী রাজনীতিক রাসমুস পালুডান ‘নাম’ কামিয়েছেন মুসলিম-বিরোধী কাজকর্ম ক’রে। ইউটিউবে কোরান পোড়ানোর ভিডিও আপ্লোড করতেন, একবার তো শুকরের মাংসে মুড়িয়ে কোরান পুড়িয়েছিলেন। লোকটি ২০১৭ সালে ‘স্টাম কুর্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়েছেন। যে দলের লোকেরা ভয়াবহ রকম ঘৃণা পোষে উত্তর-ইউরোপে বাস করা মুসলিম অভিবাসিদের বিরুদ্ধে। পালুডান ডেনমার্ক থেকে ৩ লক্ষ মুসলিম অভিবাসিকে তাড়িয়ে দেবেন, ডেনমার্কে ইসলাম ধর্মকে নিষিদ্ধ করবেন এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত নির্বাচনে প্রায় জিতে যাচ্ছিলেন। ডেনমার্কের সবাই যে পালুডানকে সমর্থন করেন, তা নয়। বেশ ক’বার জেল খেটেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য। এই চরম বর্ণবাদী রাসমুস পালুডানই আসতে চাইছিলেন সুইডেনের মালমো শহরে, তাঁর মতো উগ্র-দক্ষিণপন্থী মুসলিম-বিদ্বেষীদের অনুষ্ঠানে, ঘটা ক’রে কোরান পোড়াবার জন্য। সে কারণেই পালুডানকে সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে দু’ বছর সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমনও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পালুডানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সুইডেনের বর্ণবাদী নেতা ড্যান-পার্ক। এই ড্যান পার্কও ইমিগ্রেন্ট-বিদ্বেষ ছড়িয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। পালুডান-ভক্তরা, বা সুইডেনের স্টাম কুর্সের সদস্যরা মালমোর রাস্তায় জমায়েত করেছে, বিক্ষোভ দেখিয়েছে, রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে কোরান পুড়িয়েছে, সেই কোরান পোড়ানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পরই শহরের ৩০০ মুসলিম রাস্তায় বেরিয়ে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়েছে, গাড়ির টায়ারে আগুন ধরিয়েছে। ওই আগুন থেকে ধোঁয়া উঠেই মালমোর আকাশ কালো করেছে।

৭৮. কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ বিশ্বের সেরা মানবাধিকারের দেশগুলোয়?

২০১৩-২০১৪ সালে সিরিয়ার ৭০,০০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে সুইডেন। শুধু আশ্রয়ই নয়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে। এরপর, ২০১৫ সালে সিরিয়া, ইরাক আর আফগানিস্তান থেকে আসা এক লক্ষ বাষট্টি হাজার শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে। এর ফলেই সুইডেনে ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী উগ্র-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘সুইডেন ডেমোক্রেট’ নামে সুইডেনের উগ্র দক্ষিণপন্থী যে দলটি এখন সুইডেনের সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল, সেটি নয়া-নাৎসিবাদে বিশ্বাস করে। সুইডেন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রতিটি নাগরিকের শিশুপালন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বেকার ভাতা ইত্যাদি রাষ্ট্রই জোগায়। এখন সেই ওয়েলফেয়ার স্টেট একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। এর কারণ, দক্ষিণপন্থীরা মনে করে, অভিবাসীরা। অভিবাসিদের মধ্যে কাজকর্ম না ক’রে বসে বসে ভাতা খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের সুবিধে ভোগ করতে অভিবাসীরা এক পায়ে খাড়া। শিক্ষাদীক্ষা এবং দক্ষতার অভাবে চাকরিবাকরি করাও অবশ্য অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। সুতরাং সুইডিশদের করের টাকায় চলা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের দুর্বল হয়ে যাওয়ার জন্য অভিবাসিদেরই দায়ি করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে সুইডেনের বেকার সংখ্যা ৩.৮% থেকে লাফ দিয়ে ১৫%-এ ওঠে। এসব কারণেই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদ ইউরোপের প্রতিটি দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

সুইডেনের মালমোয় আগুন জ্বলার পর নরওয়ের রাজধানী অসলোতেও আগুন জ্বলেছে। উগ্র-দক্ষিণপন্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, স্থানীয় মুসলমানরা বিক্ষোভের প্রতিবাদ করেছে। ফলে শান্তিপ্রিয় ছোট্ট দেশটিতেও দাঙ্গা বেঁধেছে। যে কারণে সুইডেনে এবং ডেনমার্কে মুসলিম-বিদ্বেষ বাড়ছে, একই কারণে নরওয়েতেও বাড়ছে সেটি। এইসব দেশে অভিবাসীদের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বর্ণবিদ্বেষী, অভিবাসী-বিদ্বেষী হওয়া মানে মুসলিম-বিদ্বেষী হওয়া। এই মুসলিম-বিদ্বেষ বন্ধ করার উপায় কী? কোরান যারা পুড়িয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার জন্যও বর্ণবাদীদের গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন জেল খাটার পর এরা তো বেরিয়ে আসে। মানুষকে জেলে ভরা যায়, মানুষের বিদ্বেষকে তো জেলে বন্দি করা যায় না। সেটি তো আগুনের মতো ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আমার মনে হয় না জেল জরিমানা ক’রে এই বিদ্বেষের সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব। লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ সারা বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোয় বাস করছে। যারা সন্ত্রাসী, তারা তো সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত হচ্ছেই। কিন্তু যারা সন্ত্রাসী নয়, যারা ধর্মীয় মৌলবাদী নয়, সন্ত্রাসী নয়, ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী নয়, যারা সাদাসিধে ভালো মানুষ, নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তাদের কেন ঘৃণা পেতে হবে, যেহেতু কিছু মুসলমান সন্ত্রাস করেছে বিশ্বময়? কিছু সন্ত্রাসী মুসলমানের অপকর্মের দায় এখন প্রতিটি মুসলিমকেই নিতে হবে! পাশ্চাত্যের দেশগুলোয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানরা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে, বা অভিবাসী হয়েছে, সে দেশগুলোর অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে দিন দিন মুসলিম বিরোধিতা বাড়ছে। একে ঠেকানোর উপায় তো বের করতে হবে। ঘৃণা নিয়ে বাস করা মুসলিম অমুসলিম কারও জন্যই ভালো নয়। ঘৃণা চিরকালই শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ। বাস্তবতা এই যে, মুসলমানরা নিজেদের মুসলিম দেশে বাস করার চেয়ে উন্নত এবং সভ্য অমুসলিম দেশেই বাস করতে আগ্রহী, কারণ ওসব দেশে তাদের নিজের দেশের চেয়ে বেশি মানবাধিকার, বেশি মানবতা, বেশি বাকস্বাধীনতা তারা ভোগ করতে পারে, শুধু তাই নয়, বিনে পয়সায় উন্নত শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ভাতা পাওয়ার সুবিধেও তারা পেয়ে যায়। এ কারণে মুসলিম দেশ থেকে মানুষ ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি সভ্য দেশগুলোয় পাড়ি দিতেই থাকবে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই।

এক সময় ইউরোপের বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা তাদের দেশের সংখ্যালঘু ইহুদিদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। ঘৃণার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছিল জার্মানির হিটলার এবং তার নাৎসি দল। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসিরা। বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা আজ ইহুদিদের ঘৃণা করে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের শেকড় হলেও ইহুদিদের তারা আজ ইউরোপীয় বলেই মনে করে। ইহুদিরাও আর ক্রিশ্চানদের ঘৃণা করে না, বরং ঘৃণা করে মুসলমানদের। ইহুদি খুবই ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী, এই জনগোষ্ঠী এককালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল ইউরোপময়। বর্ণবাদের শিকার হয়েছে, নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পে অবর্ণনীয় অত্যাচার সয়েছে, গ্যাস চেম্বারে মরেছে কিন্তু দমে যায়নি, প্রতিশোধ নেয়নি, সন্ত্রাস করেনি, যুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয় হলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়নি, নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে নিয়ে হত্যা করেনি, বরং পড়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, সেরা ডাক্তার, সেরা ইঞ্জিনিয়ার, সেরা বিজ্ঞানী, সেরা দার্শনিক হয়েছে, সেরা ফিল্ম মেকার, সেরা সাহিত্যিক হয়েছে। আজ ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যাই বেশি। কারা করবে তাদের ঘৃণা?

মুসলমানদেরও শিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে অশিক্ষিত, আর অসভ্য হয়ে জীবন কাটালে, নারী পুরুষের সমানাধিকারে, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্রে, ধর্ম নিরপেক্ষতায়, বিজ্ঞানে, বিবর্তনে বিশ্বাস না করলে, অমুসলমদের ঘৃণা করলে, ১৪০০ বছর আগের আইন মেনে চললে ঘৃণাই জুটবে, শ্রদ্ধা জুটবে না। মুসলমানদের আধুনিক হতে হবে। অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে শুধু প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, আর দাঙ্গা হাঙ্গামা ক’রে কোনও বেঁচে থাকাই সুখকর নয়। তার চেয়ে অমুসলিমদের শ্রদ্ধা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। সভ্য শিক্ষিত সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতি এত ভঙ্গুর হলে চলবে না। একে ইস্পাত কঠিন করতে হবে। আজ কোথাও বাইবেল পোড়ালে যেমন দাঙ্গা বাঁধবে না, তেমন ভাবে কোরান পোড়ালেও যেন দাঙ্গা না বাঁধে। ক্রিশ্চানরা একসময় ভয়ংকর বর্বর ছিল। কেউ ঈশ্বরে অবিশ্বাস পোষণ করলে তাকে হত্যা করতো। সেই বর্বরতার দিন নিজেরাই শেষ করেছে ওরা। সত্যি কথা হল, ধর্ম কোনো গ্রন্থে থাকে না। ধর্ম থাকে অন্তরে। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবতাই সত্যিকার ধর্ম। সেটিকেই লালন করা শিখতে হবে।

৭৯. বোরখা পরে মেয়েরা ক্রিকেট খেলবে, সাঁতার কাটবে, এভারেস্টে উঠবে

বোরখা বা খিমার পরা একটি মেয়ে তার মাদ্রাসায় পড়া পুত্রের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে, এই ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হওয়ার পর মানুষ নানারকম মন্তব্য করছে। মন্তব্যগুলো মূলত এরকম :

১। মেয়েদের খেলাধূলা করা ইসলামে হারাম। এই মেয়ে ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। এই মেয়ে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।

২। বোরখা পরে মেয়েরা সবরকমের কাজ করতে পারে, এমনকি ক্রিকেট খেলতেও পারে। বোরখা কোনও কাজের জন্য বাধা নয়।

৩। নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের নির্দেশে অন্দরমহলে বন্দি থাকতে হয় মেয়েদের। এই অবস্থায় একটি মেয়ে যদি বাইরে বের হয়ে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিয়ে খেলে, তাহলে এই উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত।

৪। যারা খেলার ফটো তুলে পত্রিকায় ছাপিয়েছে এবং মেয়েটি যে অন্যের চাপে নয়, নিজের ইচ্ছেয় বোরখা পরেছে—তা প্রকাশ করেছে, তারা বোঝাতে চাইছে বোরখা পরা মানে অনাধুনিক হওয়া নয়। বোরখা পরেও মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, এভারেস্টে উঠতে পারে।

৫। মেয়েটির নাম ঝর্ণা আক্তার। খেলোয়াড় ছিল, দৌড়, লং জাম্প ইত্যাদি খেলতো। তার ছোট ভাই জাতীয় ফুটবল দলে খেলে। ছোট ভাইকে খেলা ছাড়তে হয়নি, কিন্তু মেয়েটিকে মেয়ে বলেই খেলা ছাড়তে হয়েছে। এই খেলোয়াড় মেয়েটিকে এখন গৃহবধূর জীবন বরণ করতে হয়েছে। অনেকে বলছে মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে। না, মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে না, সে তার ছেলেকে সঙ্গ দিচ্ছে। নিজের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তার পুত্রের সাধ আহ্লাদ পূরণ করছে। আদর্শ মা হিসেবে মেয়েরা এভাবেই বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য খেলোয়াড় তাঁর খেলা ছেড়ে দেবেন, শিল্পী গান ছেড়ে দেবেন, চিত্রকর ছবি আঁকা ছাড়বেন, পেশাজীবী পেশা ছাড়বেন, শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছাড়বেন, ডাক্তার হাসপাতাল ছাড়বেন, নাট্যকর্মী মঞ্চ ছাড়বেন… তবেইনা নারী ‘ভালো মা’ ‘ভালো মেয়েমানুষ’ হয়ে উঠবেন!! নারীর নিজের কোন জগৎ থাকবে না, যোগ্যতা থাকবে না, পরিচয় থাকবে না, সক্ষমতা থাকবে না, দক্ষতা থাকবে না, নারী কেবল সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, স্বামীর সেবা করবেন, সবাইকে সুখে শান্তিতে রাখবেন, তবেইনা নারীর সার্থকতা!! ‘মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’।

৬। হিজাব বোরখা নিকাব আবায়া খিমার কোনওটাই মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়, ঠিক যেমন পতিতাবৃত্তি মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়। এসবই আদিকাল থেকে মেয়েদের জন্য পুরুষের ‘চয়েজ’। পুরুষের চয়েজের চাপাতির তলায় মেয়েদের ইচ্ছেরা বলি হয়। মেয়েরা ভুল করে মনে করে এ বুঝি তাদের ইচ্ছে, তাদের ‘চয়েজ’। পুরুষেরা কেন পুরুষদের জন্য বোরখা নিকাব খিমার আবায়া ‘চয়েজ’ করে না? কেন পতিতাবৃত্তি তাদের ‘চয়েজ’ নয়? কারণ তারা জানে যে এসব মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার সব নষ্ট করে দেয়, মানুষকে কারাগারে বন্দি করে।

৭। ছবি দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানের ছবি। তাহলে কি বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে?

৮। একজন মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে ক্রিকেট খেলছে, এটা প্রগতির লক্ষণ।

একজন অবরোধবাসিনী মা স্টেডিয়ামে এসে সন্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন, এটা সমাজ অগ্রগতির লক্ষণ।

৯। কোন নারীই নিজের ইচ্ছেয় পছন্দ করে বোরখা পরে না। নারীকে নির্দেশ দেওয়া আছে যে তুমি তোমাকে আবৃত করে রাখবে। তুমি হচ্ছো সুস্বাদু রসগোল্লার মতো, পুরুষের খাওয়ার জিনিস। তোমাকে দেখলে চোখের যেনা। তুমি নিজেকে অনাবৃত রেখে সেই যেনায় অংশ নিচ্ছ, সেই জন্যে তুমি জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল জ্বলবে ইত্যাদি। এটা হচ্ছে তার বিশ্বাসের নির্দেশ। সাথে আছে সামাজিক এবং পারিবারিক চাপ। পর্দা কর, হিজাব পর বোরকা পর, তাহলে লোকে তোমাকে ভালো বলবে, নাহলে মন্দ বলবে।

১০। ছোটবেলা থেকে যাকে নরকের ভয় দেখানো হয়েছে, আগুনে জ্বালাবার আর অনন্তকাল শাস্তি দেয়ার ভয় দেখিয়ে ছোটবেলা থেকেই তাকে এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, সে স্বাভাবিকভাবেই বোরখাই পরবে। সামাজিক এই ধারণা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং তাকে বোঝানো হয়েছে, বোরখা সে নিজেই পছন্দ করে বেছে নিয়েছে। সে ভেবেছে সে নিজেই ইচ্ছে করে বোরখা পরেছে, অথচ তার এই ইচ্ছেটি খুব সুকৌশলে তাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। তার এই ইচ্ছে স্বাধীনভাবে নেয়া কোন পছন্দ নয়। ভীতির মাধ্যমে আদায় করে নেয়া সম্মতি। যার পেছনে কাজ করেছে অন্ততকালের শাস্তির ভয়, সামাজিকভাবে হেয় করার আর ধর্ষণের পরোক্ষ হুমকি। বোরখা পরে ক্রিকেট খেলা ওই নারী ইসলামের একটি শেকল ভাঙতে পেরেছে। এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। অন্য শেকলগুলো সে ভাঙতে পারুক না পারুক, সে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক অন্য নারীদের। পাখীকে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে সে খাঁচার ভেতরেই উড়তে চাইবে। এমনকি ডানা কেটে ফেললেও সে উড়তে চাইবেই।

১১। বোরকা না শর্টস, আফগান না বাংলা, চয়েস না ফোর্সড এসব আলাপে আমাদের ব্যস্ত রেখে মিড়িয়া কিন্তু এক দারুণ দাবার চালে আপসে দু’দুটো কিস্তিমাত করে ফেলেছে তুমুল হই চই করে। ঝর্ণা আক্তারের মুখে দুটো পুরোনো অথচ ভয়ংকর শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক স্টেটমেন্টকে নতুন করে বেশ পোক্ত করে দিয়েছে। ”…..আমার অ্যাথলেট জীবন আমি পিছে ফেলে এসেছি, সামনের নিজের জন্য কিছু চাই না। কেবল চাই আমার ছেলেটাকে বিকেএসপি পর্যন্ত পৌঁছে যেন দিতে পারি।”

১২। মা যখন সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করান, তখন তাতে আমরা মা সন্তানের ভালোবাসা বা ভালোবাসায় পূর্ণ কাটানো সময় খুঁজে পাই না। তখন আমরা তাতে কেবল খুঁজে পাই নগ্নতা আর অশ্লীলতা। মা যখন খিমার পরে ক্রিকেট খেলে তখন আমরা ওখানে মাতৃত্বের বন্ধন আর অতি সুন্দর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সময়ের উপস্থাপন দেখতে পাই।

১৩। অনেকে মনে করে বোরখা পরা বা পর্দা করা মানে সে হয়তো বাইরে গিয়ে অন্যদের মতো লেখাপড়া, খেলাধূলা, চাকরি, ব্যবসা এসব স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না, যা সম্পূর্ণ ভুল। বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা যায় এই সচেতনতা বাংলাদেশের মতো একটি ৯৯% ইসলামিক দেশে অত্যাধিক জরুরি। পর্দার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আমাদের মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ ভাইয়েরা তাদের পরবর্তী একটা সিরিজে দলীয়ভাবে বোরখা পরিধান করে মাঠে নেমে খেলে সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারে আসলে বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা সম্ভব, তাহলে হয়তো আরও অনেক বোন পর্দার ব্যাপারে উৎসাহী হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পর্দার ভিতরেই নারী সব করতে পারে কেননা ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সুবিধা। আমিন।

১৪। পোশাককে ওভারলুক করে সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহটাকেই বড় করে দেখা উচিত।

১৫। দাসত্বকে বরণ করে বিপ্লবের ডাক দেয়া যায় না, সন্তানের মুক্তির আগে নিজের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত।

আলোচনা অনেক সময় ঝর্ণা আক্তারের বোরখা পরে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার বাইরে চলে গিয়ে বোরখা নিয়ে এবং মিডিয়ায় একে হাইলাইট করার উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছে। যা কিছু নিয়ে হোক, এই যে বিতর্ক চলছে, এটি খুব দরকারি। যে কোনও বিতর্ককেই স্বাগত জানানো উচিত। সুস্থ সমাজেই বিতর্ক হয়। বিতর্ক হলেই মানুষ নানা মত সম্পর্কে জানতে পারে এবং নিজের অবস্থানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে সমাজে বিতর্কের জায়গা নেই, সেই সমাজ ভয়ংকর। বাংলাদেশ এখনও আফগানিস্তান হয়ে যায়নি, এখনও এ দেশ পিছিয়ে থাকা আরব দেশগুলোর মতো নয়। হিজাব বোরখা খিমার নিকাব আবায়া ইত্যাদি যদি বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা, তাহলে মেয়েদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি ব্যবসা খেলাধূলা কোনও কিছুতেই যেন পর্দা কোনও বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এখনও ইরান হয়ে যায়নি। পর্দা করা বাধ্যতামূলক নয়। পর্দা না করারও অধিকার এখন অবধি বাংলাদেশে আছে। আমি অবাক হব না যদি একসময় ইরান এবং সৌদি আরবের মতো পর্দা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। গত তিন দশকে বাংলাদেশে মসজিদ মাদ্রাসা, নামাজ রোজা, পর্দা পুশিদা বেড়েছে। এসব বাড়ার কারণে নৈতিকতা বেড়েছে তা কিন্তু নয়। বাইরের আবরণ বদলে গেছে তা ঠিক। প্রদর্শন বেড়েছে। নীতিবোধ আগে যা ছিল, তা-ই আছে অথবা কমেছে। নৈতিকতা কিছু কম ছিল না বাংলাদেশে। সাত এবং আটের দশকে আমি ইস্কুল কলেজে পড়েছি। ইস্কুল কলেজের মেয়েরা তখন হিজাব বোরখা পরতো না, নামাজ রোজাও খুব একটা করতো না, কিন্তু নীতিবোধ সবারই ছিল, ভালোমন্দের জ্ঞান ছিল। মন্দটাকে এড়িয়ে চলতো, ভালোটাকে গ্রহণ করতো। পুরুষের কপালেও নামাজের দাগ ছিল না সাত/আটের দশকে, দাড়ি গোঁফে, পোশাক আশাকে ধর্মের ছোঁয়া এখনকার মতো লাগেনি। কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকাংশই মন্দ ছিল না। প্রচুর আদর্শবাদীর দেখা মিলতো। চোর ডাকাত খুনী ধর্ষক মিথ্যুক জালিয়াত আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে আগে তাদের শরীরে এত বেশি ধর্মীয় পোশাক ছিল না, এখন আছে। ধর্মীয় পোশাক আগে মানুষ লোভ লালসা বিসর্জন দিয়েই গায়ে চড়াতো। এখন জিরো নৈতিকতা নিয়েই গায়ে চড়ায়। এতে ধর্মীয় পোশাক পরা মানুষের ওপর থেকে অনেকের বিশ্বাস সরে যাচ্ছে। এ ভালো লক্ষণ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *