৭০. ছেলে হয় কিভাবে

অধ্যায় ৭০

“বাস্টার্ড আপনার ছেলে হয় কিভাবে!” অবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল সামনে বসা লোকটি। “আপনি তো বিয়েই করেননি!”

কথাটা শুনে ভীষণ অবাক হলো অমূল্যবাবু। এই লোক তাকে চেনে?! চোখ কুঁচকে তাকালো সামনের দিকে। ড্রইংরুমটা বেশ বড়, সামনের সোফায় বসে আছে লোকটা। ঘরে এখন উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু চশমা ছাড়া লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। খোলা দরজার ঠিক বাইরে আরেকটি ঘোলাটে অবয়ব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো-পাহারাদার? সম্ভবত যে দু-জন তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, এই লোক তাদেরই একজন। ঘোলাটে অবয়বটা সম্ভবত কালো রঙের একটা টি-শার্ট পরা আছে।

গভীর করে শ্বাস নিলো বাবু। তার বিচরণ খুবই ছোট্ট গণ্ডীর মধ্যে। ক্ষমতার একেবারে শীর্ষে থাকা মানুষজনের সাথে ওঠবস, যদিও তাদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। ক্ষমতার পালা বদল ঘটে, নতুন নতুন মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটে এই জগতে। এমনও অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে সে চেনে

কিন্তু তারা তাকে ঠিকই চেনে। ছোট্ট একটা গণ্ডীতে, ক্ষুদ্র একটা পরিসরে তার পরিচিতি আছে। এই লোকটা সেই জগতেরই বাসিন্দা হবে।

“আমি খুবই তাজ্জব হচ্ছি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আগন্তুক। “ওকে আপনি নিজের ছেলের পরিচয় দিয়েছেন…কেন?”

বাবু কিছুই বলল না।

“আনবিলেভেল!” লোকটা সোফায় নড়েচড়ে বসলো। “তার মানে এই বাস্টার্ড আপনার লোক!” এবার সেই কণ্ঠে হতাশা। “ওর সঙ্গে আপনার কানেকশান আছে! মাই গড!”

বাবু বুঝতে পারছে, এই লোক আর যে-ই হোক, ব্ল্যাক রঞ্জু না, তার দলের কোনো হোমড়াচোমড়া হবে। হয়তো সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। কিন্তু লোকটা তাকে চেনে! চশমা থাকলে হয়তো তাকে দেখে চিনতে পারতো–কণ্ঠ শুনে অবশ্য চিনতে পারছে না। এর অর্থ, খুব বেশি পরিচিত কেউ না। অনেক আগের কেউ?

“অবশ্য আপনার মতো একজন মানুষের সব কিছু অন্যেরা জানবেও না …খুবই স্বাভাবিক।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু। তার স্মৃতি আসলেই দুর্বল হয়ে গেছে। এটা বেশ পীড়াদায়ক।

“যদিও অনেক দিন আগের কথা, তবে আমার ধারনা আপনি আমাকে দেখলে চিনতে পারবেন।”

স্মৃতি থেকে এমন কারোর কষ্ঠ মনে করতে পারলো না বাবু, সামনের অবয়বটা ঘোলাটেই দেখছে এখনও। চোখদুটো পিটপিট করে তাকালো।

“ওহ,” বলে উঠলো লোকটা। “উনার চশমাটা এনে দে তো।”

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যে আছে তাকে বলল, কিছুক্ষণ পরই লোকটা তার হাতে চশমাটা দিয়ে গেল। ময়লা লেগে আছে চশমাটায়। তাকে গাড়িতে তোলার পর যখন হাত-মুখ-চোখ বাঁধা হচ্ছিল তখন একজন নিয়ে নিয়েছিল। চমশার কাঁচটা জামার প্রান্ত দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে পরলো সে।

সামনের সোফায় বসে আছে হালকা-পাতলা গড়নের একজন মানুষ, গায়ের রঙ ফর্সা, সুন্দর করে ছাটা দাড়ি-গোঁফ আর মাথার চুল। আধা-কাঁচা পাকা চুল-দাড়ি, মুখে সামান্য বলিরেখাও আছে। বয়স পঞ্চাশের উপরে হবে। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, সাদা শার্ট আর ধূসর রঙের প্যান্ট পরে আছে, পায়ে কালো পাম সু। লোকটার মুখে স্মিত হাসি।

ভুরু কুঁচকে তাকালো বাবু। তাকে দেখে খুবই চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছে না। বয়স হয়েছে, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তার মস্তিষ্ক যতোই সমৃদ্ধ হোক, দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি।

“আপনার বন্ধু কায়সার আহমেদ…এক সময় মন্ত্রী ছিলেন, আমি ছিলাম তার পিএস…চিনতে পেরেছেন এবার?”

অমূল্যবাবু চিনতে পেরে বিস্ময়ে থ বনে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। “তুমি!”

অধ্যায় ৭১

তায়েবের?

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো বাবলু। গাড়িটা ঐ লোকই চালিয়েছে, মানিব্যাগটা তারই হবার কথা।

এ দেশের প্রায় সব মানুষই প্যান্টের পেছনের পকেটে ওয়ালেট রাখে। যদিও এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, স্পাইনে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে, সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণও। কোথাও বসলে শরীরের ওজনের চাপে পেছনের পকেট থেকে পিছলে বেরিয়ে আসে, বেখেয়াল হারিয়ে যায়। তায়েবের বেলায় সেটাই হয়েছে।

মানিব্যাগটা খুলে দেখলো। কয়েক হাজার টাকা আর কিছু ভিজিটিং কার্ড। অনেকে এনআইডি কার্ড, ক্রেডিট কার্ড রাখে কিন্তু তায়েব সে রকম কিছু রাখেনি। মানিব্যাগটা বন্ধ করতে যাবে অমনি কিছু একটা দেখে আবার খুলে ফেলল, ভিজিটিং কার্ডগুলোর মাঝে ভাঁজ করা ছোট্ট একটি কাগজের টুকরো, ওটার ভাঁজ খুলে দেখলো সে। একটা লন্ড্রির স্লিপ :

রূপসী লন্ড্রি অ্যান্ড ড্রাই ক্লিনার্স।
১১২/২, পূর্ব রায়ের বাজার, পশ্চিম ধানমণ্ডি
ঢাকা-১২০৯

কপাল কুঁচকে গেল তার। তারিখ দেখে বুঝতে পারলো, আগামি কাল দুটো বেডশিট আর বালিশের কাভার ডেলিভারি দেবার কথা। সামান্য আশার আলো দেখতে পাচ্ছে, তাই রঞ্জু গ্রুপের গাড়িটা আর পরিত্যাগ করলো না। ঠিক করলো, ওটা নিয়েই গুলশান থেকে ধানমণ্ডির রায়ের বাজারে যাবে। রওনা দেবার আগে ডিবির ভেস্টটা পরে নিলো, এটা তাকে বাড়তি সুবিধা দেবে, সেই সাথে অনেক কিছু থেকে রক্ষাও করবে।

একটা সুযোগ এসে গেছে ঘটনাচক্রে, এর সদ্ব্যবহার করতে হবে এখন। টের পেলো, তার ভেতরে আগের সেই জেদ, সেই একরোখা মনোভাব, সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে যাওয়ার যে শক্তি, সেটা যেন ফিরে এসেছে। দিনের বেলায় যে ঢাকা শহর জ্যামে আটকে থাকে, রাত গাঢ় হতে থাকলে সেই শহরটাই কেমন ভুতুরে হয়ে যায়। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো সে। রাত অনেক হয়েছে, একটু দ্রুতই তাকে পৌঁছাতে হবে, নইলে রূপসী লন্ড্রিটা বন্ধ করে কর্মচারিরা চলে যাবে। দোকানি এই স্লিপটা দেখে কাস্টমারকে চিনতে পারবে কি না বুঝতে পারলো না। স্লিপে যথারীতি কাস্টমারের নাম লেখা নেই। এর অবশ্য অন্য একটি দিকও আছে : কাস্টমারকে দোকানি চেনে।

পশ্চিম ধানমণ্ডির এক সরু গলি দিয়ে তার মাইক্রোবাসটা যখন ধীরগতিতে ঢুকে পড়লো, আশেপাশের কোনো মুদি দোকানও খোলা দেখতে পেলো না। তার আশঙ্কাই সত্যি হলো, রূপসী ততক্ষণে ঘোমটা দিয়ে দিয়েছে। দোকানটা বন্ধ।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে চারপাশটা দেখে নিলো। সরু গলির দু-পাশে সব অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। একটু সামনে, গলির মোড়ে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের সামনে অল্প বয়সি দুই ছোকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খাচ্ছে।

ক্যাপটা পরে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে, চায়ের দোকানের দুই কাস্টমার তাকে এগিয়ে আসতে দেখেই ঝটপট কাপদুটো রেখে সটকে পড়লো পাশের এক গলিতে। দোকানি অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে, ডিবির ভেস্টটা দেখামাত্রই চোখেমুখে ভয় জেঁকে বসলো লোকটার।

“সালামালাইকুম, স্যার।”

মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিলো সে। আঙুল তুলে রূপসীকে দেখিয়ে জানতে চাইলো, “ওটা কখন বন্ধ হয়েছে?”

“এট্টু আগেও তো ভোলা আছিল…কহন বন্ধ হইছে কইতে পারুম না, স্যার।”

“ঐ লোককে খুব দরকার…কোথায় থাকে, জানো?”

“মজিবর মিয়া তো ভিতরেই ঘুমায়…দরজায় টোকা মারেন, দেখেন সজাগ আছে কি না।”

রূপসীর সামনে গিয়ে বন্ধ শাটারে পর পর দুটো টোকা মারলো। “মজিবর মিয়া, আছেন?”

“কে?” বিরক্তিভরা কণ্ঠে ভেতর থেকে জবাব এলো সঙ্গে সঙ্গেই।

“একটু খুলুন, দরকার আছে।”

ভেতরে বাতি জ্বালানোর পর খুটখাট আওয়াজ হলো, তারপরই শাটার তোলার বিচ্ছিরি শব্দটা। ডিবি’র লোক দেখে ভড়কে গেল দোকানি। তার হাতে মোবাইলফোন, ইউটিউবে কিছু একটা দেখছিল। কান থেকে ইয়ারফোনটা আগেই খুলে রেখেছে।

“একটা ইনফর্মেশন দরকার আমার।”

ভয়ে ঢোক গিলল দোকানি।

পকেট থেকে স্লিপটা বের করে দেখালো তাকে। “এই কাস্টমারকে চেনেন?”

দোকানি স্লিপটা দেখে মনে করার চেষ্টা করলো-কাস্টমারের নাম নেই, আছে কেবল ডেলিভারির তারিখ আর সিরিয়াল নাম্বার। “একটু খাড়ান, স্যার,” বলেই দোকানের র‍্যাক থেকে খুঁজে বের করলো বেডশিট আর বালিশের কাভারগুলো। “এইটা শিকদারসাবের বাড়ির নয়া আড়াইটার।”

আশান্বিত হয়ে উঠল সে। তায়েব মাস দুয়েক আগেও কক্সবাজারে ছিল, ঐ ঘটনার পরই ঢাকায় এসেছে নিশ্চয়ই। “বাড়িটা কোথায়?”

দোকান থেকে বের হয়ে এলো মজিবর মিয়া, ডানদিকের গলিটা দেখিয়ে বলল, “গলিটার শ্যাষে ডাইনে যাইবেন…বামে যে মসজিদটা আছে না, ওইটার পরের বাড়িটাই, স্যার।”

মাইক্রোবাসটা নিয়ে সে রওনা দিলো, বাড়িটা খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হলো না। মেইন গেট বন্ধ তাই কলিংবেল বাজালো। কিছুক্ষণ পর বিরক্তি নিয়ে সেন্ডো গেঞ্জি পরা এক লোক খুলে দিলো দরজাটা, যথারীতি ডিবির ভেস্ট দেখে ভড়কে গেল সে। হয়তো ভেবেছিল বেশি রাত করে ফেরা কোনো ভাড়াটিয়া হবে।

“আপনাদের নিচতলায় তায়েব নামের যে লোকটা ভাড়া থাকে, সে কি ঘরে আছে?”

“তায়েব?” দারোয়ান মনে করার চেষ্টা করলো।

“বেশিদিন হয়নি উঠেছে।”

“ওহ…বুঝছি, স্যার…এহনও আহে নাই তো।”

“কখন আসতে পারে?”

“এই লোক সব সময় দেরি কইরা আহে…এইরকম টাইমেই আয়া পড়ে, স্যার।”

একটু ভেবে দারোয়ানকে বলল, “দরজাটা বন্ধ করে রাখুন। ওই লোক যদি ফিরে আসে, দরজা খুলবেন না।”

দারোয়ান ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো।

“বিরাট বড় সন্ত্রাসি…অনেক দিন থেকে তাকে খুঁজছি।”

ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান।

বাড়িটা যে গলিতে, তার থেকে একটু দূরে, একটা বাড়ির সীমানা প্রাচীরের গা ঘেষে মাইক্রোবাসটা রেখে সেটার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষায় করলো সে। জায়গাটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন। তায়েব যদি গলিতে ঢোকে, গাড়িটা খুব সহজে চোখে পড়বে না।

রাত গাঢ় হচ্ছে, সুনশান হয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকাটি। পথে দুয়েকটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ পর পর ঘরে ফেরা দুয়েকজন মানুষজনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করে গেল বাস্টার্ড। ঠিক কতোক্ষণ পর সে জানে না, তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। পকেট থেকে বের করে দেখলো, জায়ানের নাম্বার। তার মানে নওরিন খান।

“হ্যালো?”

“একটু আগে আমার বান্ধবি কলব্যাক করেছিল, ও ঢাকায় ফিরছিল গ্রামের বাড়ি থেকে…পথে ছিল বলে আমার কলটা ধরতে পারেনি। ও আমাকে পন্থপথের ঐ অ্যাপার্টমেন্টটার ঠিকানা দিয়েছে…নুর হাভেন ৬৭/১ আর/এ, পান্থপথ। তিন তলায়, লিফটের ডান দিকের ফ্ল্যাটটা।”

“থ্যানক্স,” ছোট্ট করে বলল। দোটানায় পড়ে গেল এবার। সে কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তায়েবের জন্য অপেক্ষা করবে নাকি উজ্জ্বলকে পাকড়াও করবে? তায়েবের চেয়ে উজ্জ্বল অনেক বেশি খবর দিতে পারবে-এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতোদূর এসে তায়েবকে না ধরে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। দারোয়ান ওকে বলে দেবে, কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে এক ডিবি অফিসার এসেছিল ওর খোঁজে। এ কথা শোনার পর সে তো সটকে পড়বেই, রঞ্জু গ্রুপকেও জানিয়ে দেবে।

অগত্যা সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে আবারো অপেক্ষা করতে লাগলো।

প্রায় বিশ মিনিট পর দেখতে পেলো শিকদার সাহেবের বাড়ির সামনে একটা সিএনজি থামতেই সেটা থেকে নামছে তায়েব। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দরজার পাশে সুইচ টিপে কলিংবেল বাজাচ্ছে।

সিএনজিটা চলে যেতেই মাইক্রোবাসের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো সে। ততক্ষণে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়েছে। প্রায় নিঃশব্দে তায়েবের পেছনে এসে দাঁড়ালো।

পেছনে কেউ আছে টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো তায়েব। ভুত দেখার মতো চমকে উঠল আরো একবার। মনে হলো তার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। পিস্তলটা তায়েবের তলপেটে ঠেকিয়ে ওর কলার ধরলো বাঁ-হাতে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছে না সে, মূর্ছা যাবার দ্বারপ্রান্তে চলে গেল রঞ্জুর লোকটা।

অধ্যায় ৭২

দীর্ঘদিন পর দেখলো।

সত্যি বলতে, ভুলেই গেছিল এর কথা। সেই সাথে একে নিয়ে যাবতীয় উপাখ্যানগুলো। মৃত মানুষ যেভাবে আড়ালে চলে যায়, স্মৃতিগুলো ফিকে হতে থাকে, এই মানুষটাও ঠিক সেরকমই বিস্মৃত হয়ে গেছিল।

অমূল্যবাবু তাকে চিনতে পেরেছে বলে খুশিতে চোখদুটো চকচক করে উঠল লোকটার। “অনেক দিন পর দেখা হলো। ভাবিনি কখনও আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।”

মলিন হাসি দিলো বাবু। এই লোক কিভাবে রঞ্জুর দলের সাথে আছে, বুঝতে পারছে না।

“আপনাকে যেভাবে আনা হয়েছে তার জন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন, আন্তরিকভাবেই বলল। “বাস্টার্ডের বাপ যে আপনি, এটা আমি পরে জেনেছি।”

বাবু কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

“কিন্তু আপনি যদি ওর বাপ হয়ে থাকেন তাহলে ওকে বাস্টার্ড বলে কেন?” মিটিমিটি হেসেই জানতে চাইলো লোকটি।

গভীর করে শাস নিলো বাবু। সামনে যে বসে আছে তার আসল নামটা মনে করতে না পারলেও এর কাছের মানুষজন কি নামে ডাকতো, মনে পড়েছে তার। “নামের সাথে সাথে বদনামও থাকে,” এই প্রথম মুখ খুলল অমুল্যবাবু। “তোমাকে যেমন লোকে কিসিঞ্জার নামে ডাকে, এটাও ওরকম কিছু…ওর বদনাম।”

কথাটা শুনে লোকটার মিটিমিটি হাসিটা চওড়া হলো সামান্য। “আপনি আমার নামটা তাহলে মনে করতে পেরেছেন। আমার সৌভাগ্য।”

কিসিঞ্জারের দিকে ছিরচোখে চেয়ে রইলো অমূল্যবাবু। পুরনো স্মৃতিগুলো উঠে আসতে শুরু করেছে।

দুর্লভ একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে এই লোকের। পর পর তিনটি ভিন্ন আর প্রতিপক্ষ দলের মন্ত্রীর পিএস হিসেবে কাজ করেছে সে। এ সব ব্যাপারে যাদের ধারনা আছে তারা জানে, এটা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু অসম্ভব কাজটাই করেছিল সে।

এ দেশের বেশিরভাগ মন্ত্রীদের পিএসের কাজ যে আসলে কি, সেটা সাধারণ মানুষ কমই জানতে পারে। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীরা তাদের সমস্ত অপকর্ম করে থাকে এসব পিএসদের দিয়েই। এরাই সব ধরণের যোগাযোগ, যোগসাজশ, লেনদেন করে। একজন মন্ত্রী সরকারি অফিসের কেরাণী নয় যে, টেবিলের উপর দিয়ে কিংবা নিচ দিয়ে ঘুষের টাকা নেবে। এসব লেনদেন করে তাদের পিএস-এপিএসের মতো ঘনিষ্ঠ লোকগুলো। এ কারণে ক্ষমতাচ্যুত খুব কম মন্ত্রী-এমপিকেই এ দেশে দুর্নীতির দায়ে বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়। প্রতিপক্ষ হিসেবে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে হরহামেশাই মামলা হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচারের পর শান্তি পায় অনেক কম সংখ্যক।

মনে করতে পারলো না, কে এই লোকটাকে তার কাছে নিয়ে এসেছিল। তখন সে ছিল টগবগে এক যুবক। তার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছিল, অবাকও হয়েছিল ছেলেটার কথা শুনে। যেকোনো চাকরি না–মন্ত্রীর এপিএস হতে চায়। এটাই নাকি তার এইম ইন লাইফ! বাবু কখনও কোনো বঙ্গ সন্তানের মুখে এর আগে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া এমন কথা শোনেনি। ছেলেটার আচার-ব্যবহারও তার ভালো লেগেছিল। মাথা ঠাণ্ডা, সব সময় মুখে অমায়িক হাসি ধরে রাখে। পড়াশোনা শেষ করেছে। মাত্র। ঘটনাচক্রে ঐ সময়েই তার বন্ধু কায়সার মন্ত্রীত্ব পেয়েছিল, ঢাকা ক্লাবে বড় একটা ট্রিট দিয়েছিল সে। পার্টি চলার সময়ই বাবু তাকে বলেছিল, এর কথা। অবশেষে তার সুপারিশেই চাকরিটা হয়েছিল।

পরবর্তী কালে স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও এর কোনো সমস্যা হয়নি বরং আরেক ধাপ উন্নতি ঘটে। ততদিনে অনেকেই জেনে গেছিল তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা। কিভাবে যেন সব কিছু ম্যানেজ করে নতুন সরকারের এক মন্ত্রীর পিএস বনে যায় সে। পাঁচ বছর পর সেই দল পরবর্তি নির্বাচনে ক্ষমতা হারালে চলে আসে বিরোধীরা। মেধাবি এই যুবক নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিল এরই মধ্যে। আবারো ম্যাজিক দেখায়-নতুন সরকারের এক মন্ত্রীর পিএস হয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়। এভাবে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে। পরিচিত মহলে সবাই তার বুদ্ধির উপরে আস্থা রাখতো।

“কেমন আছেন, দাদা?” অনেকক্ষণ বাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল।

সম্বিত ফিরে পেলো অমূল্যবাবু, পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। সে এখন বন্দি, তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কেমন আছে?

“অনেকদিন পর আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। আপনি একদম টেনশন করবেন না, আপনি এখন আমার হেফাজতে আছেন। আপনার কিছু হবে না।”

অমূল্যবাবু খুব ভালো করে তাকালো সামনে বসা লোকটার দিকে। তার বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো।

“আমি যার কাছ থেকে উপকার পাই তার কোনো ক্ষতি করি না। কৃতঘ্নতাকে আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে করি।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বাবু।

“আপনি হয়তো জানেনই না, আপনাকে আমি আমার দ্রোণাচার্য মানি!”

অধ্যায় ৭৩

মাইক্রোবাসের ভেতরে, অন্ত্রের মুখে থর থর করে কাঁপছে তায়েব।

পেছনের সিটে বসিয়ে রেখেছে তাকে, সাইলেন্সারের লম্বা নলটা ওর পেটে ঠেকানো আছে। প্রচণ্ড ভয়ে কাঠ হয়ে আছে রঞ্জু গ্রুপের মামু। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। বলার মতো কিছু নেই-ও।

“আপনাকে কক্সবাজারে ছেড়ে দিয়েছিলাম,” শান্ত কণ্ঠে বলল বাস্টার্ড। “তার প্রতিদান এভাবে দিলেন?!”

ভয়ে ঢোক গিলল তায়েব, ঠোঁটদুটো কাঁপছে কিন্তু কথা বলতে পারলো না।

সত্যি বলতে তায়েবকে ঐদিন ছেড়ে দেবার আগে খুবই দ্বিধায় পড়ে গেছিল। যতোই সময় গড়াচ্ছে তার মধ্যে কঠোরতা কমে আসছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তার উপরে হামলার সংখ্যাও। তিমুখে তাকালো রঙুর লোকটার দিকে। ফ্যাকাশে চেহারায় বার বার পলক ফেলছে আর ঢোক গিলছে।

“এক দিক থেকে আপনাকে না মেরে কিন্তু ভালোই হয়েছে।”

কথাটা শুনে অবাক হলো তায়েব।

“মেরে ফেললে রঞ্জুর খোঁজ এখন কে দিতো আমাকে?” মুচকি হেসে বলল সে। “সময় নষ্ট না করে বলেন ফেলুন, রঙ্গু কোথায়…কিভাবে পাবো তাকে।”

তায়েব কিছুই বলল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

বাস্টার্ড তার পিস্তলটা তুলে ধরে শীতল কণ্ঠে বলল, “বলেন।”

“আ-আমি জানি না,” রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো। “বৃ-বিশ্বাস করো, বু-র কই থাকে কেউ জানে না,” ঢোক গিলল আবার। “আল্লাহর কসম, এইটা কেউ জানে না। ওয় খুবই অ্যালার্ট থাকে এহন।”

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। পিস্তলের লম্বা নলটা তায়েবের দুচোখের মাঝখানে তা করলো। “আমাকে কোথায় ডেলিভারি দেবার কথা ছিল?”

প্রশ্নটা যেন বুঝতে পারছে না এমন ভাণ করলো তায়েব, বার বার পলক। ফেলতে লাগলো।

“ওদের কাছে ট্রাঙ্ককুলাইজার গান ছিল, আমাকে তুলে নিয়ে যাবার প্ল্যান ছিল ওদের।”

ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছে তায়েব।

“এটা দিয়ে গুলি করলে আওয়াজ-টাওয়াজ হয় না,” পিস্তলটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে। “আমি তিন গুণববা…তার আগে বলবেন, নইলে কিছু করার থাকবে না।”

অধ্যায় ৭৪

দ্রোণাচার্য?!

এমন কথা শুনে পরিহাসের হাসি দিলো অমূল্যবাবু।

“আপনার সঙ্গে আমার খুবই অল্প দেখা হয়েছে কিন্তু দূর থেকে আমি আপনাকে ভক্তি করে গেছি, আপনার মতো হবার চেষ্টা করেছি সব সময়,” বলল কিসিঞ্জার। “আপনার একটা কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি সারা জীবন।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো অমূল্যবাবু।

“এ দেশে সবচেয়ে ঠুনকো জিনিস হলো রাজনৈতিক আদর্শ। ওটা দিয়ে ছেলে ভোলানো হয়…মানুষের অন্ধ আনুগত্য হাতিয়ে নেবার জন্য ব্যবহার করা হয়।”

বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটা ঠিক, সে এমন কথা বলেছে। “তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য আছে। আমি কখনও সন্ত্রাসি দলের হয়ে কাজ করিনি,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

“অবশ্যই,” স্মিত হাসি দিয়ে বলল কিসিঞ্জার। প্রতিটি মানুষই আলাদা, তার জীবন, কাজ, লক্ষ্য…অনেক কিছু। আপনার সঙ্গেও আমার পার্থক্য আছে। কিন্তু আমাদের পথ আর গন্তব্য এক না হলেও আমরা আসলে একই মডেলের গাড়ি।”

লোকটার দিকে চেয়ে রইলো অমূল্যবাবু।

“আপনি হয়তো জানেন, রঞ্জুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল বাস্টার্ড, তাই প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গেছে সে।”

“রঞ্জু বেঁচে নেই,” দৃঢ়তার সঙ্গে বলল অমূল্যবাবু। “অনেক আগেই মরে গেছে।”

কিসিঞ্জারের মুখের হাসি একটুও বদলালো না। সে-ও অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে বেশ পারঙ্গম। তবে অমূল্যবাবু যেখানে নির্বিকার থাকে, কিসিঞ্জার সেখানে মুখে এঁটে রাখে স্মিত হাসি। “আপনি এতোটা নিশ্চিত হলেন কী করে? বাস্টার্ড বলেছে?”

গভীর করে শ্বাস নিলো বাবু, তবে কিছু বলল না।

“অবশ্য খুব একটা ভুল বলেনি। ওভাবে আগুনে পুড়ে গেলে কেউ বেঁচে থাকে না।”

অমূল্যবাবু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে।

“কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, রঞ্জু বেঁচে আছে। বেঁচে গেলেও ওর অবস্থা ভালো না, মুখ আর শরীর পুড়ে গেছে। দীর্ঘদিন পঙ্গুও ছিল, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতো। এখন অবশ্য একটু আধটু হাঁটাচলা করতে পারে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।”

“দলটা তাহলে তুমিই চালাচ্ছো এখন।” কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না।

মিটিমিটি হাসলো কিসিঞ্জার, এ কথার জবাব দিলো না সে। “ভেবেছো আমাকে জিম্মি করলে ও ধরা দেবে?”

মাথা দোলালো কিসিঞ্জার। “রঞ্জু এতোটা বোকা না, দাদা। বাস্টার্ডের মতো পেশাদার খুনি আপন বাপের জন্যেও এটা করবে না, আর আপনি তো তার…” কথাটা শেষ করলো না। আপনাকে হত্যা করে মনের জ্বালা মেটাবে।” হাসিটা মুখে ধরে রেখেই আবার বলল, “বাস্টার্ডের সাথে আমার পারসোনাল কোনো ইসু নেই…যদিও আমার বিরাট ক্ষতি করেছে সে।”

ভুরু কুঁচকে গেল অমূল্যবাবুর। “ও তোমার কী করেছে?”

“আমার একটা প্ল্যান বরবাদ করে দিয়েছিল,” ভারি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।

কপাল কুঁচকে গেল অমূল্যবাবুর। কোন্ প্ল্যানের কথা বলছে, ঠিক বুঝতে পারলো না কয়েক মুহূর্তের জন্য। “রঞ্জুকে মারার প্ল্যান…?”

“হুম।”

এবার বুঝতে পারলো বাবু। মিস্টার টেন পার্সেন্টের সঙ্গে এই লোকের সখ্যতা ছিল। তাহলে প্ল্যানটাও ছিল তারই! খুব বেশি যে অবাক হয়েছে, তা নয়। তবে দীর্ঘ সময়েও এটা জানাজানি হয়নি। সবাই জানে, মি. টের পার্সেন্টই পরিকল্পনাটা করেছিল।

কিসিঞ্জার গালে হাত বুলিয়ে আক্ষেপের সাথে বলল, “প্ল্যানটা ভালোই ছিল, একদম সহজ-সরল। কোত্থেকে এসে আপনার ঐ বাস্টার্ড সব গুবলেট করে দিলো!”

“ও এসবের কিছুই জানতোও না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল বাবু। “আমিও জানতাম না এর পেছনে তুমি আছো।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য স্মিত হাসি উধাও হয়ে গেল, কিসিঞ্জারের চোখেমুখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের অভিব্যক্তি। “আহ!” আর্তনাদ করে উঠল সে। “আপনি!” বিস্ময়টা হজম করে নিতে বেগ পেলো। “ওটা আপনার প্ল্যান ছিল তাহলে?!”

নির্বিকার রইলো অমূল্যবাবু।

কিসিঞ্জারের বিস্ময় হুট করেই তিরোহিত হলো, ফিরে এলো তার মুখের সেই স্মিত হাসি। “গুরু-শিষ্য পর্দার পেছন থেকে খেলেছে…মহাভারতের মতো এখানেও গুরুই জয় হয়েছে!” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো এবার। “এই ঘটনায় আপনি কিভাবে জড়ালেন? কে জড়ালো আপনাকে?”

মৌব্রত পালন করলো অমূল্যবাবু।

“আপনি বলতে চাইছেন না?”

“না।” দৃঢ়ভাবেই বলল কথাটা।

মিটিমিটি হেসে মাথা নাড়লো কিসিঞ্জার। “ক্ষমতাবানেরা বিপদে পড়লে আপনার কাছে পরামর্শ নেয়, আপনিও তাদেরকে বিমুখ করেন না। আন্দাজ করতে পারছি, আপনার কাছে কে এই ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিল।”

বাবুর ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল।

“আমিও আপনার মতোই তার নাম বলবো না,” থুতনিটা চুলকে আমোদের সঙ্গেই বলল, “তবে কিভাবে জানি, সেটা বলতে পারি।”

বাবু কিছুই বলল না, স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কেবল।

“আমার প্ল্যানটা ভণ্ডুল হবার পর টেন পার্সেন্টের ওয়াইফ নির্বাচনে জিতে প্রাইমিনিস্টার হয়ে যায়…এক লোক সবাইকে চমকে দিয়ে মন্ত্রীত্ব পেয়ে গেছিল। কেউই আশা করেনি, ঐ ভদ্রলোক মন্ত্রী হবে কিন্তু ভালো একটা মন্ত্রণালয়-ই পেয়ে যায়…কাইন্ড অব রিওয়ার্ড! কীসের জন্য?” কাঁধ তুলল সে। “আকালমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি।”

অমূল্যবাবু তার সামনে বসা লোকটার দিকে চেয়ে রইলো। এই মানুষটি ধুরন্ধর আর সূক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে অনেক কিছুর হিসেব করে ফেলতে পারে। আর খুব কম ক্ষেত্রেই সেগুলো ভুল প্রমানীত হয়।

তবে তার হিসেবেও ভুল হয়েছিল এক সময়। তিন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সরকারের মন্ত্রীর পিএস হলেও একটা সময় গিয়ে ঠিকই হোঁচট খায়। মি. টেন পার্সেন্টের সঙ্গে যাদের বেশি সখ্যতা ছিল, এই কিসিঞ্জার ছিল তাদেরই একজন। ফলে টেন পার্সেন্ট জেলে গেলে অন্য অনেকের মতো সে-ও দেশ ছাড়ে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিল, আমেরিকায়-কানাডায় গিয়ে সেখানে আরাম-আয়েশের জীবন বেছে নেয়।

তাহলে এতোদিন পর কেন আবার দেশে এসে রঞ্জুর মতো এক সন্ত্রাসির দলের হাল ধরলো?

“এর আগে দুয়েকজনের মুখে বাস্টার্ডের কথা আমি শুনেছি,” বলল কিসিঞ্জার। “কিন্তু সেগুলোকে মিথ মনে হয়েছে। বিশ্বাস হয়নি, আসলেই এ রকম খুনি আছে দেশে। তবে রঞ্জুর কাছ থেকে ওর সম্পর্কে শোনার পর আমার সন্দেহ কিছুটা দূর হয়। আজকে যখন তিনজনকে মেরে ফেলল, বুঝতে পারলাম, ওর ব্যাপারে যা শুনেছি সবটাই সত্যি।”

এবার বাবুর মুখে স্মিত হাসি দেখা গেল, তবে সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য।

“আগেই বলেছি, আপনার ঐ ইয়ে…মানে, বাস্টার্ডের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। পেশাদার খুনি সে, টাকা পেয়েছে কাজ করেছে-ব্যাপারটা আমি এভাবেই দেখি,” হাসিটা আরো প্রসারিত করে বলল, “আমি চাই, ও আমার জন্যে একটা কাজ করে দিক।”

ভুরু কুঁচকে গেল অমূল্যবাবুর। তবে ভেতরে ভেতরে কৌতূহলি হয়ে উঠল। “কি কাজ?”

“ও যে রকম কাজ করে, সে রকম কাজই,” নিজের গালে পরম তুষ্টি নিয়ে হাত বোলালো কিসিঞ্জার।

স্থিরচোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে অমূল্যবাবু বলল, “তোমার ধারনা ও তোমার কাজ করবে?”

“যে কাজ টাকার বিনিময়ে করে, সেটা আপনার জন্য করবে না?”

মাথা দোলালো বাবু। “করবে না। ও ভালো করেই জানে, কাজটা করলেও আমাকে বাঁচাতে পারবে না।”

“আমার ধারনা, ও করবে,” মিটিমিটি হেসে বলল কিসিঞ্জার।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো বাবু। “তুমি ওকে চেনো না, আমি চিনি।”

মুখে স্মিত হাসি লেগেই আছে কিসিঞ্জারের মুখে।

“তোমার ভালোর জন্যই একটা কথা বলি, ওর পেছনে লেগে না।”

“আপনি এভাবে দেখছেন কেন?” হাসিমুখেই বলল লোকটা। “এটাও একটা কাজ। ও যদি রাজি না হয় আপনি ওকে কনভিন্স করবেন। আপনার কথা নিশ্চয়ই ফেলতে পারবে না।”

বাবুর মুখটা তিক্ততায় ভরে উঠল। একদম ধীরস্থির কণ্ঠে বলল, “তুমি অসুস্থ!”

হঠাৎ করেই কিসিঞ্জারের মুখ থেকে মিটিমিটি হাসিটা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল, শক্ত হয়ে গেল তার চোয়াল।

অধ্যায় ৭৫

কমিউনিকেশন্স রুমে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে জেফরি বেগ।

তার পাশে বসে আছে জামান। আইটি এক্সপার্ট মনীষকে অনেকগুলো ফোনের সিডিআর বের করতে দেয়া হয়েছে। ওসব নিয়ে ব্যস্ত আছে সে।

একটু আগে জেফরি বেগ যখন সিদ্ধান্ত নিলো উত্তরা থানার এসআইকে গ্রেফতার করে হোমিসাইডে নিয়ে যাবে তখন জামান খুবই অবাক হয়েছিল। তার বস্ কি আজকের রাতের মধ্যেই ব্ল্যাক রঞ্জুকে ধরার চিন্তা করছে নাকি!-এমন প্রশ্নের উদয় হলেও মুখে অবশ্য সেটা বলেনি। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জেফরি বেগের কথামতো উত্তরা থানার ওসিকে ফোন দিয়ে সংক্ষেপে সবটা জানায়। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতো সহজ হবে না, তা জানতো। যদিও শেষ পর্যন্ত ওসিকে বোঝাতে পেরেছিল, ঘটনার গুরুত্ব কতোখানি। স্বয়ং হোমমিনিস্টার উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন তার ঘনিষ্ঠ এক লোককে অপহরণ করার পর থেকে। আর উত্তরা থানার এসআই কালামের ফোনে প্রমানও পাওয়া গেছে। এসআই নিজেও স্বীকার করেছে, সে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে রঞ্জু গ্রুপের কাছে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ওসি আর অমত করেননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে টহল দলটির নেতৃত্বে ছিল এসআই আবুল কালাম, সেই দলটিই তাকে পৌঁছে দেয় হোমিসাইডে।

উত্তরা থেকে বাইকে করে আসার সময় সে বুঝতে পারছিল, আজকের রাতটা সহজে শেষ হবে না!

এতো রাতে হোমিসাইডে এসে প্রথমেই এসআইকে ইন্টোরোগেশন রুমে নিয়ে আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে জেফরি বেগ। কিন্তু রঞ্জুর হয়ে কাজ করা পুলিশের এই সাব-ইন্সপেক্টর তোতাপাখির মতো বার বার এই এক কথা বলে গেছে : ফোনে কন্ট্যাক্ট করা ছাড়া আর কিছু জানে না। রঞ্জু এখন অনেক সতর্ক। যারা তার হয়ে কাজ করে, তারা শুধুমাত্র সিগন্যাল মেসেজিং অ্যাপস ব্যবহার করে যোগাযোগ করে। সেলফোনে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগই নেই-দেখা-সাক্ষাৎ তো বহু দূরের কথা।

“আপনি ওদের চেনেন না, স্যার!” কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল এক পর্যায়ে।

মুচকি হেসেছিল জেফরি বেগ। “আপনি তাহলে জানেন না, রঞ্জুকে আমিই প্রথম ধরেছিলাম।”

এ কথা শুনে ঢোক গিলেছিল এসআই।

“এবারও করবো,” জোর দিয়ে বলেছিল কথাটা। “কিন্তু এবার সে জেল থেকে আর বের হতে পারবে না।” স্থির চোখে তাকিয়েছিল পুলিশের লোকটার দিকে। “আপনি যদি আরেকটু কো-অপারেট করেন, ভোর হবার আগেই রঞ্জুকে গ্রেফতার করবো আমরা।”

“হোমমিনিস্টার নিজে তদরকি করছেন এটা,” জামান বলেছিল তখন পাশ থেকে।

তারপরও এসআই কালাম কোনো তথ্য দিতে পারেনি। লোকটার পেছনে সময় নষ্ট না করে জেফরি বেগ সহকারিকে নিয়ে চলে আসে কমিউনিকেশন্স রুমে।

“স্যার,” আইটি এক্সপার্ট মনীষ বলল। “এই সিগন্যাল অ্যাপসের কোনো কিছুই ট্র্যাক করা যায় না। যতোদূর জানি, এটা হাইলি এনক্রিপ্টেড…খুবই সিকিউড।”।

জেফরি বেগ এটা আগেই বুঝে গেছিল, রঞ্জুর দলটা এখন খুব কমই ইনসিকিউড লাইনে যোগাযোগ করে। দ্রুত মাথা খাটাতে লাগলো। বাস্টার্ডের উপরে প্রতিশোধ নিতেই বাবুকে তুলে নিয়ে গেছে রঞ্জু লোকজন। নিশ্চয়ই ওরা বাস্টার্ডকে সেটা জানাবে। আর সেটা করতে হলে, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

চট করেই একটা চিন্তার উদয় হলো তার : বাস্টার্ডের সঙ্গে নিশ্চয়ই যোগাযোগ আছে নওরিন খানের!

“মনীষ?” বলে উঠলো জেফরি।

“জি, স্যার।”

নওরিন খানের ফোনটার সিডিআর বের করতে বলেছিলাম, করেছো? বন্ধ হবার আগে কোন কোন নাম্বারে যোগাযোগ করেছে, সেগুলোর ডিটেইলস চাই।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আইটি-এক্সপার্ট। কি-বোর্ডের উপরে সচল হয়ে উঠল তার আঙুলগুলো। অতিবাহিত হলো কয়েক মিনিট।

“স্যার?” কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল ছেলেটা। “নওরিন খানের সিমটা উনার নিজের নামেই রেজিস্ট্রেশন করা…বন্ধ হবার আগে এই নাম্বারগুলোতে ফোন করেছেন…” একটু দেখে নিয়ে বলল। “মামুনুর রহমান নামে রেজিস্ট্রেশন করা একটি নাম্বারে কল করেছিলেন।”

“ঐ লোকই মহিলার হয়ে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেছেন, আমি তাকে ফোন দিয়েছিলাম, ভয় পেয়ে কলটা কেটে দিয়েছিল।”

“এছাড়া আজকে আর অন্য কাউকে কল করেননি মহিলা।”

“তার নাম্বারে কারা কল করেছে?”

“উমম…” স্ক্রিনে দেখে নিলো আইটি এক্সপার্ট। “আজকে আরেকটা নাম্বার থেকেও কল করা হয়েছে…এই যে, এটা…” রোভিং চেয়ারটাসহ একটু সরে গেল সে।

সামনে ঝুঁকে দেখে নিলো জেফরি বেগ। “এটা কার নাম্বার?

“এই নাম্বারটাও ঐ মহিলার নামেই রেজিস্ট্রেশন করা।”

অবাক হলো জেফরি বেগ।

“ঐ বাচ্চার হতে পারে, স্যার,” পাশ থেকে বলল জামান। “ওখানকার দারোয়ান আমাকে বলেছিল, বাচ্চাটার হাতে সব সময় ট্যাব দেখতো।”

জেফরিরও তাই মনে হচ্ছে, এটা ঐ বাচ্চাটার নাম্বারই হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ নিজের নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করতে পারে না-তার হয়ে তার মা-ই সিমটা কিনবে। “ঐ নাম্বারটার সিডিআর কি বলে?”

“দেখছি, স্যার,” মনীষ দ্রুত কাজে নেমে পড়লো।

উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ। জামানও উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে মনিটরের দিকে।

“এই যে, স্যার…” বলল আইটি এক্সপার্ট। “এই নাম্বারে।”

মনিটরে তারা একটি নাম্বার দেখতে পেলো। “নওরিন খানের নাম্বার ছাড়া কেবলমাত্র এই নাম্বারটাতেই কল করা হয়েছে…এসএমএসও করেছে কয়েক বার।”

একটা বাচ্চা ছেলে অন্য একটা নাম্বারে কল করেছে, এসএমএসও করেছে! নড়েচড়ে উঠল জেফরি বেগ। “এসএমএসগুলো এক্সট্রাক্ট করো, আমি দেখতে চাই।”

“জি, স্যার,” মনীষ কাজে নেমে গেল। আবারো কিবোর্ডের উপর সচল হয়ে উঠল তার হাতের আঙুলগুলো। “এই যে…” টেক্সট মেসেজদুটো স্ক্রিনে দেখা গেল।

থ্যাঙ্কস।

আই ক্যান মিট ইউ!!! মাম্মি সেইড নো প্রবলেম 😊

ছোট্ট আর নির্দোষ একটি মেসেজ। কিন্তু দ্বিতীয়ট মেসেজটার বেলায় এ কথা বলার উপায় নেই।

ডু নট ওপেন ইউর ডোর। দে উইল কিল

অধ্যায় ৭৬

মৃদু আলো জ্বলছে ঘরটায়।

আধো-আলো অন্ধকারে মুখোমুখি বসে আছে দু-জন নর-নারী। সিগারেট টানছে মাঝবয়সি মহিলা, বিপরীতে যে বসে আছে তার মুখটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। একটা পাতলা গামছা দিয়ে মাথা পেচিয়ে রেখেছে সে। তবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার মন মেজাজ ভালো নেই। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে।

“কী হইছে?” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল মহিলা। “মেজাজ খারাপ ক্যান?” অ্যাস্ট্রে হিসেবে একটা চায়ের কাপ ব্যবহার করছে।

কোনো জবাব দিলো না লোকটি। মেজাজ খারাপ হবার সঙ্গত কারণ আছে তার। একটু আগে বাস্টার্ডকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তার বাপকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে, কিন্তু হারামির বাচ্চাটার কথা শুনে রাগে গা পুড়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে কোনো বিকারই ছিল না, উল্টো তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে! হতভম্ব হয়ে কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছে সে।

পাঁচ-ছয় মাস আগে ঢাকায় ফিরে আসার পর থেকেই বাস্টার্ডকে হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে। যদিও আন্ডারওয়ার্ল্ডে রটে গেছিল, ঐ খুনি মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। কিন্তু লাশ যেহেতু পাওয়া যায়নি, কথাটা বিশ্বাস করেনি। এটা ঐ খুনির কোনো চালাকি হতে পারে। আইনের হাত থেকে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক শত্রুর হাত থেকে বাঁচার কৌশল হবে হয়তো। সে মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। তার ধারনা যে সত্যি সেটা মাত্র এক-দেড় মাসের মাথায়ই প্রমানীত হয়ে যায় তায়েবের কথায়। এক কালে তাদের সঙ্গেই কাজ করতো লোকটা। কিন্তু তাদের দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে। তায়েব জোর দিয়ে বলেছে, কক্সবাজারে নিজের চোখে দেখেছে। বাস্টার্ডকে। এক পা ল্যাংড়া হয়ে গেছে।

এ কথা শোনার পরই অস্থির হয়ে ওঠে সে। এই যে তার বেহাল অবস্থা, পোড়া মুখটা কাউকে দেখাতে পারে না, চোখ দিয়ে সারাক্ষণ পানি পড়ে, নানান শারিরীক সমস্যায় আক্রান্ত থাকে বারোটা মাস, তার জন্য দায়ি ঐ খুনি।

সেজন্যেই দলটা গোছানোর পর তার দলের লোকজনের কাছে বাস্টার্ডের ছবি বিলি করে দিয়েছিল সে, বলে দিয়েছিল, এর খোঁজ যে দিতে পারবে তার জন্য থাকবে মোটা অঙ্কের পুরস্কার। ঢাকার প্রায় প্রতিটি থানায় কম করে একজন পুলিশ তাদের হয়ে কাজ করে, ওদেরকেও ছবি দিয়ে রেখেছিল, কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি বানচোতটার।

অবশেষে, আজ সন্ধ্যায় উজ্জ্বল ফোন করে কিসমত আরাকে এই সুসংবাদটি দেয়। কিসমতের কাছ থেকে খবরটা পেয়ে নড়েচড়ে ওঠে সে, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা প্রতিশোধের আগুন। দেরি না করে উজ্জ্বলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নেয় : ঈদের সময় একমাত্র ছেলেকে দেখার জন্য সাবেক স্ত্রীর অ্যাপার্টমেন্টে গেছিল, কিন্তু ছেলের মা তাকে দেখা করতে দেয়নি, এ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের নিচে কথা কাটাকাটি হলে সেখানে হাজির হয় বাস্টার্ড। উজ্জ্বলকে সে তাড়িয়ে দিয়েছে ওখান থেকে।

কিন্তু এমন সুসংবাদ শোনার পর তার খুশি টিকে ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। এরপরই মনে পড়ে, এখন ঈদের ছুটি চলছে, দলের বেশিরভাগ লোকজনই ঢাকার বাইরে-কেউ গেছে গ্রামের বাড়িতে, কেউ বা ছুটি কাটাতে অন্য কোথাও।

কিসমত আরা তাকে শান্ত হতে বলেছিল। বাস্টার্ড যেহেতু ঢাকায় আছে, কয়েকটা দিন পর সবাই চলে এলে কাজটা করা যাবে।

এমন কথায় আশ্বস্ত হতে পারেনি সে। উজ্জ্বলের সাবেক স্ত্রী আর বাস্টার্ড একই বিল্ডিংয়ে থাকে, ঐ মহিলার কাছ থেকে সে জেনে যাবে, উজ্জ্বল রঞ্জু গ্রুপের পুরনো লোক। এটা জানার পর ধুরন্ধর খুনি কি বসে থাকবে? সতর্ক হয়ে যাবে বানচোতটা, সটকে পড়ার ধান্দা করবে। এতোক্ষণে হয়তো জেনেও গেছে, যেকোনো সময় পালাবে। দেরি করলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ওদিকে ঈদের ছুটির আগেই কিসিঞ্জার জানিয়ে দিয়েছিল, গুলশানের এক এমপিপুত্রকে ভয় দেখাতে গিয়ে খুন করে ফেলেছে তাদের লোকজন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি উঠেপড়ে লেগেছে, কয়েকটা দিন সব ধরণের অপারেশন বন্ধ রাখতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে তাদেরকে।

সেজন্যে কিসিঞ্জারকে না জানিয়েই কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। শামসু নামের পুরনো এক লোককে কাজটার দায়িত্ব দেয়। খুবই করিকর্মা এই লোক, বহুদিন আগে সে নিজে তাকে দলে ভিড়িয়ে ছিল। এখন তাদের দলের বেশিরভাগ কিলিং অপারেশনের কাজ করে শামসু। কিন্তু এতো অল্প সময়ের মধ্যে বাস্টার্ডকে জীবিত ধরে আনার কাজটা করতে গড়িমসি করেছিল, কিন্তু সবটা খুলে বলার পর যখন মোটা অঙ্কের টাকার কথা বলা হলো তখন আর গাইগুই করেনি। বহু কষ্টে ট্রাঙ্কুলাইজার গান আর দু-জন গানম্যান জোগাড় করতে পারলেও যে মাইক্রোবাসে করে অপারেশন করবে, সেটার ড্রাইভার খুঁজে পায়নি শামসু। পরিচিত কোনো ড্রাইভারই ঢাকায় নেই এখন। সেজন্যে তায়েবকে তাদের সঙ্গে দিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে ড্রাইভার হিসেবে অপারেশনে অংশ নেয় সে, বাকি সময়টা কিসমত আরার গাড়ি চালায়।

কিন্তু তায়েব প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে কিসমতকে জানায়, শামসুসহ তিনজনকেই হত্যা করেছে বাস্টার্ড। এ কথা শোনার পর রাগেক্ষোভে সিগারেটের অ্যাস্ট্রেটা ছুঁড় মারে দেয়ালে। অর্ধেক বোতল মদও তার সেই ক্ষোভের উপশম করতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাতে যখন উত্তরার থানার এক এসআই কিসমত আরাকে ফোন করে জানায়, বাস্টার্ডের বাপ থাকে উত্তরার এক বাড়িতে, তখন সমস্ত ক্ষোভ মেটানোর জন্য ঐ লোককেই ধরে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। আগামিকাল নির্জন কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে বাস্টার্ডের এই বাপকে।

কিন্তু কিসিঞ্জারকে এ কথাটা জানিয়ে দিয়েছে কিসমত। সে ভেবেছিল খুব রাগ করবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, নিরাপদ কোথাও রাখতে হবে লোকটাকে, নইলে সমস্যা হতে পারে। কথাটা মিথ্যে নয়, এই লোকের নিকটজনেরা থানা-পুলিশ করবে, তারা আবার খোঁজ করার চেষ্টা করবে। যেখানে খুশি সেখানে রাখাটা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আজকের রাতটার জন্য লোকটাকে রাখা হয়েছে তাদেরই এক সেফহাউজে।

ফস্ করে শব্দ হলে সম্বিত ফিরে পেলো সে। কিসমত আরা আবারো সিগারেট ধরিয়েছে। একটার পর একটা সিগারেট লাগে তার।

“ঘর তো ধুয়ায় ভইরা ফালাইছো,” বিরক্ত হয়ে বলল সে।

মুখ বেঁকালো কিসমত, এটা তার মুদ্রাদোষ। সোফা থেকে উঠে বড় জানালাটা খুলে দিলো।

“রাইত অনেক হইছে, ঘুমাও…কাইল সকালে যা করার কইরো,” বলেই সিগারেটের বাকি অংশটায় জোরে জোরে কয়েকটা টান দিয়ে খালি চায়ের কাপে ফেলে দিলো। “অ্যাস্ট্রেটাও ভাইঙ্গা ফাইলাছো…পুরা পোলাপান হয়া গেছো তুমি। আমি গেলাম, ঘুম পাইতাছে…” এ কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে।

“বাস্টার্ড!” অন্ধ আক্রোশে ফেটে পড়লো। “তোরে না মারলে আমার শান্তি নাই!” পোড়ামুখে অপ্রীতিকর একটা হাসি দিলো। “শুরুটা করুম তোর বাপরে দিয়া!”

অধ্যায় ৭৭

তিন গোনা শেষ হবার আগেই তায়েব মুখ খুলেছিল। জোর দিয়ে বলেছে, রঞ্জু বেঁচে আছে, তবে কোথায় থাকে সে জানে না।

“আমি রঞ্জুর বইন কিসমত আরার গাড়ি চালাই,” প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল। “ওয় জানে, রঞ্জু কই থাকে…ওয় কইবার পারবো।”

“আমাকে কোথায় ডেলিভারি দেবার কথা ছিল?”

“কিসমত আরার ওইখানে,” ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল তায়েব।

কথাটা শুনে খুবই অবাক হয়েছিল সে। ব্ল্যাক রঞ্জুর কাছে না, ওর বোনের কাছে নিয়ে যেতো তাকে!

তারপরই তায়েব জানায় কিসমত আরা কোথায় থাকে। আবারো অবাক হয় বাস্টার্ড। নিকেতনের মতো অতি পরিচিত আবাসিক এলাকায়? অথচ পুলিশ এতোদিনেও ঐ মহিলার নাগাল পায়নি!

তায়েবের দাবি, ঈদের ছুটিতে দলের খুব কম লোকজনই ঢাকায় আছে বলে তাকে হিট টিমের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতে বলেছিল।

এরপর বাস্টার্ড জানতে চেয়েছিল, বয়স্ক এক লোককে যে রঞ্জুর লোকজন তুলে নিয়ে গেছে, তাকে কোথায় নিয়ে গেছে। অনেক ভয়ভীতি দেখালেও, কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে আরেক বার তিন গোণার পরও তায়েব সেটা জানাতে পারেনি।

এই লোক সব কিছু জানবে, এমনটা সে আশাও করে না। তবে তার দেয়া ইনফর্মেশন ঠিক আছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি। অনেক আগে থেকেই এই লোককে চেনে। সন্ত্রাসি গ্রুপে সব সময় ড্রাইভার হিসেবেই কাজ করে গেছে, অম্রপাতির সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। সব সন্ত্রাসি দলে তায়েবের মতো লোক থাকে, যারা খুনোখুনি কিংবা মারামারি করে না।

তবে তায়েব যেটুকু বলেছে, সেটাই যথেষ্ট। তার মতে, রঞ্জুর এই বোন একাই থাকে। তথ্যটা পাবার পরও তাকে ছেড়ে দেয়নি দুটো কারণে : ছেড়ে দিলে সে রঞ্জু কিংবা কিসমতকে জানিয়ে দেবে। আর তার দেয়া তথ্য সত্যি না মিথ্যা, সেটা যাচাই করার উপায় থাকবে না। তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, কথার হেরফের হলেই প্রাণটা খোয়াতে হবে। এরপর মাইক্রোবাসের একেবারে পেছনের সিটে ফেলে তায়েবের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে। পরিহাসের ব্যাপার হলো, বেঁধে রাখার সরঞ্জামগুলো তার জন্য আনা হয়েছিল!

রায়ের বাজার থেকে মাইক্রোবাসটা যখন গুলশান নিকেতনে প্রবেশ করলো, তখনও সে নিশ্চিত ছিল না কী দেখতে পাবে। ডিবির পোশাকটা ভালোই কাজে দিচ্ছে। যে পোশাক পরে রঞ্জুর দল তাকে মারতে গেছিল, সেই পোশাকই এখন তাকে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিচ্ছে রঞ্জুর দোরগোড়ায়!

নিকেতনের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলো কালো রঙের মাইক্রোবাসটি। তায়েব যেমনটা বলেছিল, কিসমত আরা থাকে নিকেতনের বনশ্রী’ নামের একটি ভবনে। ব্যাপারটা কাকতালীয় কি না বুঝতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে, এটা এক ধরণের চালাকি। বনশ্রী নামে ঢাকায় আরেকটি আবাসিক এলাকা রয়েছে, ফলে এটা এক ধরণের ধোঁকা তৈরি করে।

অন্য ভবন থেকে বনশ্রী’কে আলাদা করে চোখে পড়ে, কারণ নামের প্রতি সুবিচার করে পুরো ভবনের সামনের দিকটা লতানো অর্কিডে ঢাকা।

“পাঁচ তলায় এক মহিলা থাকে না?”

ডিবির ভেস্ট দেখে যথারীতি ভয় পেলো দারোয়ান। “হ, স্যার।”

“ঐ মহিলা খুবই ডেঞ্জারাস…টপ টেরর।”

দারোয়ান ঢোক গিলল ভয়ে।

“আমি চাই না এতো রাতে গোলাগুলি হোক এখানে। তুমি ইন্টারকমে কল দিয়ে বলবে, তার গাড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।”

দারোয়ান গোল গোল চোখে চেয়ে রইলো কথাটা শুনে।

এখানে ঢোকার ঠিক আগে দিয়ে এই বুদ্ধিটা তার মাথায় এসেছিল। তায়েব বলেছে, কিসমত আরার গাড়িটা এখানকার পার্কিংলটে রেখে বাড়িতে ফিরে গেছিল সে।

“তার গাড়ির ভেতরে আগুন লেগেছে, সে যেন এক্ষুণি নিচে নেমে আসে…ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান। ইন্টারকমটা হাতে তুলে নিয়ে নাম্বার প্রেস করলো সে। কয়েক মুহূর্ত কানে চেপে রাখার পর বলল, “ম্যাডাম, আপনের গাড়ি থেইক্যা ধুয়া বাইর হইতাছে, ভিতরে আগুন লাগছে…” একটু নার্ভাস হলেও ঠিকঠাক বলতে পারলো। “আপনে জলদি আসেন, দেইখ্যা যান।” ইন্টারকমটা রেখে তাকালো তার দিকে, “নিচে আইতাছে, স্যার।”

“একটু পর আমার ফোর্স চলে আসবে, ওরা এলে গেট খুলে দেবে।”

ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান।

লোকটা যেন মনে করে সে একা আসেনি, একটু পর তার ফোর্সও আসছে, সেজন্যেই এটা বলল।

দ্রুত পিস্তলটা হাতে নিয়ে লিফটের দিকে চলে গেল বাস্টার্ড। এলিভেটরের ইন্ডিকেটর বলে দিচ্ছে, চার নাম্বার ফ্লোর থেকে নেমে আসছে কেউ। লিফটের দরজার সামনে পিস্তল ধরা হাতটা পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো সে। টুং করে শব্দ হতেই দরজা খুলে গেল, দেখতে পেলো ট্রাউজার আর টি-শার্টের উপরে ওড়না জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝবয়সি এক মহিলা। ডিবির ভেস্ট পরা একজনকে দেখে চমকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলটা মহিলার দিকে তাক করে বড় বড় পা ফেলে ঢুকে পড়লো লিফটের ভেতরে। রঞ্জুর বোন চিৎকার দেবারও সময় পেলো না, তার আগেই তার কপাল বরাবর পিস্তলের নলটা তাক করা হলো।

“একদম চুপ!” কিসমত আরার কপালে নলটা ঠেকিয়ে বাঁ-হাতে বাটনটা টিপে দরজা বন্ধ করে দিলো।

লিফটের দেয়ালে সেঁটে রইলো কিসমত আরা, ভয়ে ঢোক গিলল।

রঞ্জু গ্রুপের নারীদের ব্যাপারে যেহেতু তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই সতর্ক রইলো বাস্টার্ড। রঞ্জুর এক স্ত্রী, মিনাআপাকে সে হাল্কাভাবে নিয়েছিল, পরিণামে আরেকটুর জন্যে প্রাণ খোয়াতে বসেছিল। তাই এক মুহূর্তের জন্যও রঙুর বোনের উপর থেকে চোখ সরালো না।

অধ্যায় ৭৮

“এটাই বাস্টার্ডের নাম্বার!”

মেসেজটা দেখার পর জেফরির মনে আর কোনো সন্দেহ নেই।

জামানের সঙ্গে সঙ্গে মনীষও বিস্মিত হলো। নতুন হলেও সে জানে বাস্টার্ড কে। হোমিসাইডের পিয়নও জানে ওর কথা।

নওরিন খানের নামে আরেকটি সিম রেজিস্ট্রেশন করা আছে-এটা কোনো বড় খবর নয়। এ দেশে এক নামে সর্বোচ্চ সাতটা সিম রেজিস্ট্রেশন করা যায়। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হলো, এক সিম থেকে আরেক সিমে কল করা হয়েছে তার মানে সিম দুটো দু-জন ব্যবহার করে।

বাস্টার্ডের সিম থেকে ঐ ট্যাবে শেষ কলটা করা হয়েছে। আর নওরিন খানের নামে রেজিস্ট্রেশন করা দ্বিতীয় নাম্বার থেকে এতো রাতেও বেশ কয়েকবার অন্য একটি নাম্বারে কল করেছেন। সেটা এখন আরিচা ঘাটে আছে। মুভ করছে, তার মানে গাড়িতে আছে এমন কেউ।

“এতো রাতে দশ-এগারো বছরের বাচ্চাকে কেউ কল করবে না,” বলল জেফরি বেগ। “সে-ও কাউকে কল করবে না।”

“আমি শিওর, ডিভাইসটি এখন নওরিন খান ব্যবহার করছে,” বলল জামান। “কারণ উত্তরায় আমরা যাবার ঠিক আগে দিয়ে মহিলার ফোনটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল, স্যার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। বাস্টার্ড ঐ মহিলাকে কল দিয়েছে। “জিপিএস কী বলছে, মনীষ?”

“ঐ নাম্বারটা এখন গুলশান নিকেতনে আছে, স্যার।”

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরি বেগের। “আর ট্যাবটা আছে কোথায়?”

“উত্তরার ছয় নাম্বার সেক্টরে।”

গাল চুলকালো সে। নওরিন খান আর তার ছেলেকে তাহলে উত্তরারই কোনো এক বাড়িতেই সরিয়ে ফেলেছে অমূল্যবাবু।

যে নাম্বারটাকে তারা বাস্টার্ডের বলে সন্দেহ করছে, সেটা এখন নিকেতনে আছে। ওটা কি কোনো সেফহোম? বাস্টার্ডের নতুন ঠিকানা? এতো রাতে ঐ মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার কেন পড়লো? প্রশ্নের জট পাকিয়ে গেল তার মাথায়। “বাস্টার্ডের নাম্বারটার সিডিআর বের করো।”

মনীষ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কাজে নেমে পড়লো। এখন এসব কাজ করতে অতো বেশি সময় লাগে না। দিন দিন এসব বিষয় সহজ হয়ে উঠছে। হাত দিয়ে টাচস্ক্রিনে নাম্বারগুলোর মধ্যে ইনকামিং-আউটগোয়িং কলের তালিকাটায় কিছু মার্কিং করলো সে। “বাস্টার্ডের নাম্বার থেকে এই নাম্বারটায় প্রথমে কল করা হয় আজ রাত সাড়ে ৮টা ১১-তে…তার পর ৮টা ১৬-তে নাম্বারটা থেকে সাসপেক্ট নাম্বারে কল করা হয়।”

জেফরি বেগ যতোটুকু বুঝতে পারছে, এটা সোয়ান লেক সিটিতে খুনগুলো হবার পরের সময়।

“এরপর বাস্টার্ডের নাম্বারে ঐ নাম্বারটা কল করে ৮টা ২৫-এ। রাত ৯টা ৫২-তে বাস্টার্ড আবার কল করে ঐ নাম্বারে।”

“তখন আমরা উত্তরায় যাচ্ছিলাম,” পাশ থেকে জামান বলল।

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। “এই নাম্বারটা কি নামে রেজিস্ট্রেশন করা…?”

সিডিআর-এর ডেটা চেক করে দেখলো মনীষ। কিছুক্ষণ পর পেছনে ফিরে বলল, “এটা অমূল্য রায় চৌধুরী নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে।”

অমূল্য রায় চৌধুরী! জামানের দিকে তাকালো জেফরি বেগ। তার মানে বাবলু-ই অমূল্যবাবুকে কল করে তাদের আগমণের কথা জানিয়ে দিয়েছে! ও কী করে জেনে গেল তাদের আসার কথা? “নাম্বারটা কি চালু আছে?” যদিও জেফরি জানে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। রঞ্জুর দল কিডন্যাপ করার পর নাম্বারটা চালু রাখবে না।

খতিয়ে দেখলো মনীষ। “না, স্যার…বন্ধ আছে এখন।”

“অমূল্য রায় চৌধুরীর নাম্বারটার শেষ লোকেশন কি ছিল?”

টাচ-স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে কিছু দেখে নিলো মনীষ। “জায়গাটা স্যার…নিকেতনের খুব কাছেই।”

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জেফরি বেগ। পেছন ফিরে জামানের দিকে তাকালো। “অমূল্যবাবুর নাম্বারটা বন্ধ হয়েছে নিকেতনের কাছেই! আমার মনে হয় ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছে রঞ্জুর লোকজন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে সেটা সবাই জানে না। জানলেও সব সময় সতর্ক থাকা সম্ভব হয় না, বিশেষ করে আজকের দিনে। “আমারও তাই মনে হচ্ছে, স্যার। যে লোকগুলো তুলে নিয়ে গেছে, তারা হয়তো অতোটা সতর্ক ছিল না।”

“বাস্টার্ডের নাম্বারটা কি এখনও সেখানেই আছে?”

“হ্যাঁ, স্যার…মুভ করেনি আর,” মনীষ জানালো। “ওটা একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন।

কিছু একটা ভেবে গেল জেফরি বেগ।

“ঐ ট্যাব আর অমূল্য রায় চৌধুরীর নাম্বার ছাড়াও বাস্টার্ডের নাম্বারে আরেকটা নাম্বার থেকে কল করা হয়েছে, স্যার…” বলেই সে স্ক্রিনে দেখালো, “এই যে, স্যার…এই নাম্বার থেকে। এই নাম্বারটা চালু আছে…নিকেতনেই আছে।”

“একই বিল্ডিংয়ে?” অবিশ্বাস্য কণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি।

“কো-অর্ডিনেশন তো তাই বলছে, স্যার।”

“নাম্বারটার রেজিস্ট্রেশন…?”

“একটু, স্যার…” সিডিআর থেকে মনীষ খতিয়ে দেখতে শুরু করলো।

উত্তেজনার চোটে উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ।

“আনরেজিস্টার্ড নাম্বার, স্যার,” পেছন ফিরে বলল মনীষ।

“এই নাম্বারটা তাহলে রঞ্জুর!” অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

জামানও উঠে দাঁড়ালো, তার চোখেমুখে অবিশ্বাস।

“মনীষ, তুমি জামানের ফোনে এই নাম্বারগুলোর আপডেট দিতে থাকবে,” যুদ্ধের জেনারেলদের মতো করে আদেশ দিলো সে। “আমরা ধরে নিচ্ছি, এই নাম্বারটা বাস্টার্ডের…” পর্দায় আঙুল দিয়ে নাম্বারটা দেখিয়ে বলল। “ওর ফোনে যে আনরেজিস্টার্ড নাম্বার থেকে কল করেছে সেটাকে আমরা রঞ্জুর বলে ধরে নিচ্ছি। এখন থেকে এই নাম্বার দুটোতে যতো ইনকামিং-আউটগোয়িং কল আসবে সব টেপ করবে…জিপিএস ট্র্যাকিং করবে!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মনীষ।

“স্যার, কী করবেন?” একটু উদ্বিগ্ন হয়েই জানতে চাইলো জামান।

“আমি অনেকটাই নিশ্চিত, রঞ্জুকে লোকেট করতে পেরেছি আমরা…অমূল্যবাবুও ওখানে আছে।”

“বাস্টার্ডও আছে, স্যার!” আতঙ্কের সাথেই বলল সহকারি।

“ঠিক।” যেতেই যেতেই বলল জেফরি বেগ, “এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, জামান।”

“রেইড দেবেন?”

“হুম।”

“লোকাল থানাকে জানাবেন না?”

হন হন করে হোমিসাইডের হেডকোয়ার্টারের হলওয়ে দিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়ালো জেফরি। “ভুলেও না!” আবারও হাঁটতে শুরু করলো সে।

“কিন্তু স্যার…” লিফটের কাছে এসে বলল জামান। তার বস অস্থির হয়ে লিফটের বাটন চাপলো পর পর দু-বার। “আমরা দু-জন-”

“আমি ফারুক স্যারের সঙ্গে কথা বলবো, অন্য কোথাও থেকে ব্যাকআপ নেয়া যায় কি না দেখি।”

বুঝতে পারলো জামান। থানার ব্যাকআপ নিতে গেলে খবরটা রঞ্জুর কাছে চলে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।

লিফটের দরজা খুলে যেতেই তারা দু-জন ঢুকে পড়লো।

জামানের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। একে তো রঞ্জুর মতো নৃশংস সন্ত্রাসির ডেরায় ঢুকতে যাচ্ছে, তার উপরে বাস্টার্ডের মতো দুর্ধর্ষ খুনিকে মোকাবেলা করতে হবে-সেধে সেধে ক্রশ ফায়ারের মধ্যে গিয়ে পড়বে তারা। আর এই ক্রশ ফায়ার সাজানো কিছু হবে না।

সত্যিকারের ক্রশ ফায়ার!

অধ্যায় ৭৯

বন্ধ লিফটের ভেতরে কিসমত আরার কপালে অস্ত্রটা ঠেকানোর পর পুরোপুরি ভড়কে গেল। এমন নয় যে বাস্টার্ডকে ডিবি ভেবে ভয়টা পেয়েছে, ডিবি পুলিশকে আজকাল তেমন ভয় পায় না তারা, ধরা পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে সুরসুর করে ছেড়ে দেয় তাদেরকে।

কিন্তু এই লোক যে ডিবি না, সে জানে! বাস্টর্ডের ছবি সে দেখেছে। আর আজকে যে নকল ডিবি সেজে এই খুনির ফ্ল্যাটে লোক পাঠানো হয়েছিল, সেটাও জানে। সবগুলোকে মেরেছে এই খুনি! প্রচণ্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল সে।

“আর কে কে থাকে আপনার সঙ্গে?”

ঠোঁট কামড়ে ধরলো কিসমত। “আমি একলাই থাকি।”

মহিলার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ পেলো সে। লিফটের সুইচবোর্ডের ৪ নাম্বার বোতামটা টিপে দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। সতর্ক চোখে পুরো ফ্ল্যাটটায় চোখ বোলালো বাস্টার্ড। কেউ নেই। অমূল্যবাবুকে তাহলে কোথায় রেখেছে?

“রঞ্জু কোথায়?”

কিসমত এমন ভাব করলো, যেন আকাশ থেকে পড়েছে। “রঞ্জু? কোন্ রঞ্জু?”

মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। পিস্তলটা নেড়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসার জন্য ইশারা করলো।

“আপনার নাম কিসমত আরা, আপনি ব্ল্যাক রঞ্জুর বোন।”

“নাহ্ তো!” প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও অভিনয়টা দারুণভাবেই করতে পারলো রঞ্জুর বোন। ভয়ে ভয়ে সোফায় বসলো সে। “আমার নাম সুরভী ইসলাম…প্রমান চাইলে দেখাইতে পারি। ঘরে আমার এনআইডি কার্ড আছে।”

বাঁকা হাসি দিলো বাস্টার্ড। “ও রকম কার্ড আমারও আছে।”

কিসমত আরা ঢোক গিলল। এই খুনি সম্পর্কে যতোটুকু শুনেছে, তাতে করে মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছে তাকে। কলকাতায় চলে গেছিল রঞ্জুকে মারতে, তারপর দিল্লিতে গিয়ে…

“ধানাই পানাই করবেন না, তায়েব আমাকে সব বলেছে।” কিসমত আরার ভাবনায় ছেদ পড়লো। তায়েব বলছে? তবে কি বেঈমানি করেছে সে? সেটা করলে তো এই খুনি আরো আগেই তাকে ধরতে পারতো, যখন তায়েব প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে তাকে সব জানালো।

“রঞ্জু কোথায়?” কথাটা বলেই তার কপালে পিস্তল ঠেকালো বাস্টার্ড। “ও আমার এক লোককে ধরে এনেছে, কোথায় রেখেছে তাকে?”

“আ-আমি জানি না।”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। তারপর শীতল চোখে, শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই পিস্তলে কোনো শব্দ হয় না। আরেক বার জিজ্ঞেস করবো, যদি বলেন কিছু

জানেন না, সোজা গুলি করে দেবো!”

“আমরা কেউই জানি না, বিশ্বাস করেন…” প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল রঞ্জুর বোন। “ভাইজান জানে!”

মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। “অবশ্যই ভাইজান জানে!” পিস্তল নেড়ে বলল, “তার কাছ থেকেই তাহলে জেনে নিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *