॥ ৭০ ॥
গাড়ি ব্যাকসীটে বসে ধ্রুব নার্সিং হোমের উজ্জ্বল দরজার দিকে চেয়েছিল। কিছুই ভাবছে না, মনে পড়ছে না। মাথায় আজকাল এরকম এক একটা ফাঁকা ভাব, ব্ল্যাংকনেস আসে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, মগজটা শুকিয়ে যাচ্ছে না তো!
লাল্টুদা বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। দেখার অবশ্য কিছু নেই। চারদিক নিঝুম এবং জনশুন্য। লাল্টুদাকে বেশ স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে। বড় বেশী স্বাস্থ্যবান। যখন খেলত তখন পেটানো ছিপছিপে শরীর ছিল। এখন রীতিমতো মুশকো, ভারী, গুন্ডামীর চেহারা টাইট একটা ভুঁড়িও হয়েছে। ভাল কামায়, দেদার টানে। মনটা সাদামাটা এবং মেজাজ উগ্র।
ধ্রুবকে সন্ধেবেলা একটা বড় চড় মেরেছিল লাল্টুদা। এখনো কি চড়ের জায়গাটা চিনচন করছে? নিজের গালে একটু হাত বোলায় ধ্রুব।
গাড়িটা কাদের তা বুঝতে ধ্রুবর একটু সময় লাগল। মদ খাওয়ার পর হঠাৎ কোনো ধাক্কায় নেশা কেটে গেলে বোধশক্তি খুব ভাল কাজ করতে চায় না। পারসেপশন বড্ড কমে যায়। তবু কিছুক্ষণ গাড়ির গদি এবং ড্যাশবোর্ডের চাকতিগুলো নজর করে ধ্রুবর মনে হল, এটা তাদেরই গাড়ি। ইগনিশনে চাবি ঝুলছে। মৃত্যুহিম এই রাতের নিস্তেজ, ঘুমন্ত ভাবটা তার সহ্য হচ্ছে না। কিছু একটা করা দকার। রেমি যদি মরে যায় তাহলে বিস্তর জবাবদিহি করতে হবে তাকে। লোকে বলে, রেমি খুব ভাল মেয়ে ছিল। ওকে নাকি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে ধ্রুবই। রেমি সত্যিই মরে গেলে কথাটা ফের উঠবে। ধ্রুবর এইসব আত্মীয়স্বজন ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। শোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। রেমির বাপের বাড়ির লোকেরাও ছেড়ে কথা কইবে না। কিন্তু শালারা বুঝবে না, ধ্রুব নিজেই মরতে চেয়েছিল বরাবর, রেমিকে বাঁচিয়ে।
রেমির আর এই সময়টায় এখানে সেঁটে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না ধ্রুবর। তার পালানো উচিত। পৃথিবটা তো একজন রেমির মৃত্যু ঘটছে বলে থেমে নেই। কালও সূর্য উঠবে। ট্যাঁ করে কেঁদে উঠবে নবজাতকেরা। লোকে খাবে, ঘুমোবে, রতিক্রিয়া এবং ধান্ধাবাজি করে যাবে, যেমন করত বরাবর।
ধ্রুব হামাগুড়ি দিয়ে সামনের সীটে এসে বসল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এল ফটকের সামনে।
লাল্টু তাকিয়ে ছিল। ধ্রুব গলা বাড়িয়ে বলল, বেড়াতে যাবে? চলো একটু ঘুরে আসি।
লাল্টু অবাক হয়ে চেয়ে বলে, বেড়াতে যাবি মানে? এটা কি বেড়ানোর সময়?
আমার আর বসে থাকতে ভাল লাগছে না। একটু ঘুরে আসি।
লাল্টু এক পা এগিয়ে এসে জানালায় ঝুঁকে তীক্ষ্ণ চোখে ধ্রুবকে দেখে নিয়ে বলে, তোর কী হয়েছে?
খুব অস্থির লাগছে।
গাড়ির ড্রাইভার কোথায়?
জানি না।
তুই এই অবস্থায় গাড়ি চালাবি না। ড্রাইভারকে ডাক, সে ঘুরিয়ে আনবে।
আমি পারব।
লাল্টুদা নীরবে ধ্রুবকে আর একবার জরিপ করে। তারপর ঘুরে এসে ড্রাইভারের দরজা খুলে ধ্রুবকে একটু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে স্টিয়ারিং হুইল ধারে বসে।
কোথায় যাবি?
ধ্রুব লাল্টুকে বাধা দেয় না। সে জানে, লাল্টুদা একটু মস্তান টাইপের। ধ্রুবর যেসব গুন্ডা বদমাশ বন্ধু আছে তারাও লাল্টুদাকে সমঝে চলে।
লাল্টু গাড়ি চালাতে থাকে দক্ষিণের চওড়া গড়িয়াহাট রোড ধরে। চালাতে চালাতে বলে, কাকা একদম ব্রেকডাউন।
ধ্রুব একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলে, জানি।
ইউ আর রেসপনসিবল ফর এভরিথিং।
এটা প্রশ্ন নয়, ঘোষণা। ধ্রুব চুপ করে থাকে।
লাল্টু বলে, এত ভাল একটা মেয়ে, আমাদের বংশে এরকম একটা বউ আর আসেনি, তাকে রাখতে পারলি না। ডিসগাস্টিং। ওর বদলে তুই মরলি না কেন?
ধ্রুব চুপ করে থাকে। তবে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না।
লাল্টু ধ্রুবর দিকে চকিতে একবার চেয়ে দেখে বলে, এখন টের পাচ্ছিস?
কী টের পাবো?
রেমি কেমন মেয়ে ছিল!
ভালই তো!
শুধু ভাল নয়। শী হ্যাড বিন জেম অফ এ গার্ল। তোর মতো বানরের গলায় ও ছিল মুক্তোর মালা। জানিস?
ধ্রুব একথার জবাব দিল না। তবে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি পাস্ট টেনসে কথা বলছো কেন লাল্টুদা? ইজ শী ডেড?
লাল্টু মাথা নাড়ে, না। কিন্তু মরতে আর বাকি কী? ডাক্তাররা বলছে শী হ্যাজ নো রেজিস্ট্যান্স। বাঁচার ইচ্ছেটাই তো মরে গেছে মেয়েটার। একটা ভাল মেয়েকে এনে ঘরে বন্দী করে রেখে তিলে তিলে মারলি তোরা। ও আর বেঁচে থেকে কী করবে? তোদের বংশধর দরকার ছিল, দিয়ে গেল।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। না, রেমির জন্য তার শোক হচ্ছে না। অন্তত তেমন তীব্র কোনো শোক নয়। একটু দুঃখ হচ্ছে, একটু ভয়ও। তার বেশী কিছু নয়। সে ক্ষীণ স্বরেই বলে, বাচ্চাটা কেমন আছে জানো?
ভালই বোধ হয়। কেন?
এমনি। রেমি যদি মরে যায় তবে ওটাও বোধ হয় বেঁচে থাকবে না।
বেঁচেও থাকবে আর তোর মতো জানোয়ারের হাতে আর একটা জানোয়ারও তৈরি হবে। ওটার জন্য ভাবতে হবে না।
লাল্টুর এইসব কথাবার্তার সামনে ধ্রুব একেবারেই প্রতিরোধহীন। সে লাল্টুকে ভয় পায়, এমন নয়। কিন্তু লাল্টুর এমন একটা সহজ সরল অকপট এবং ধারালো জিব আছে যা অপ্রিয় কথাকে তরোয়ালের মতো ব্যবহার করতে পারে। লোকটা ঘুষ খায়, মাতাল হয়, গুণ্ডামী করে, আবার পরের দায়ে দফায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, জান কবুল করে লোকের উপকার করে বেড়ায়। ব্যালান্সের অভাব আছে বটে, কিন্তু লাল্টুর অস্তিত্ব বিশেষ রকমের ঝাঁঝালো।
গড়িয়াহাটার মোড়ে ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে রাসবিহারী অ্যাভেনিউ ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে লাল্টু বলল, এখন কেমন লাগছে?
অস্থির।
বমি করবি?
না।
লাল্টু বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটের একটা স্ট্রিপ বের করে ধ্রুবর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, দুটো খেয়েনে।
ধ্রুব একটা উদ্গার তোলে। ট্যাবলেট দুটো মুখে ফেলে চিবোতে থাকে। বিস্বাদে ভরে যায় মুখ।
লাল্টুদা!
কী?
তুমি কি ঠিক জানো যে, বাচ্চাটা আমার?
লাল্টু আর একবার টেরিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, আমার জানার কথা নয়। কিন্তু তোর কি সন্দেহ আছে?
না, এমনি বলছিলাম। ধ্রুব হতাশ গলায় বলে।
লাল্টু বিষ গলায় বলে, রেমি কিরকম মেয়ে তা আমি জানি। তুই কেমন তাও জানি। নোংরামির লাইনে যাওয়ার চেষ্টা করিস না। একটা চড় খেয়েছিস, এবার গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো।
ধ্রুব মৃদুস্বরে বলল, আমি রেমির বিরুদ্ধে কিছু বলছি না।
লাল্টু চাপা হিসহিসে গলায় বলে, তবে কী বলছিস? তুই কখন কী বলিস তা খেয়াল করে বলিস? তোর সেই কাণ্ডজ্ঞান আছে? রাজার সঙ্গে রেমিকে কে ভিড়িয়েছিল তাও সবাই জানে। ইউ রাসক্যাল, ইউ!
লাল্টু ব্রেক চাপে। গাড়িটা হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকে।
ধ্রুবর শরীরটা জোর টাল খেয়েছিল। সামলাতে একটু সময় নিল সে। তারপর বলল, তুমি এত রেগে যাও কেন কথায় কথায়?
লাল্টু হয়তো মারত। কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল সে। ধ্রুবর দিকে বাঘা চোখে চেয়ে বলে, দ্যাখ কুট্টি, আমাদের বংশে যদি সত্যিকারের কলঙ্ক কেউ থেকে থাকে তার সেই ব্ল্যাক স্পট হছিস তুই। কাকার উচিত ছিল বহুদিন আগে তোকে গুলি করে মেরে ফেলা।
ধ্রুব খুব অসহায় গলায় বলে, আমার যে সিওর হওয়া দরকার।
কিসের সিওর?
বাচ্চাটা সম্পর্কে।
লাল্টু তেমনি বাঘা চোখে চেয়ে থাকে বলে, ঠিক আছে। তোর সন্দেহের কারণটা কী আমাকে বল।
রেমি রাজার সঙ্গে মিশত। সবাই জানে।
তুই রেমির গায়ে কাদা মাখাতে চাস?
না। আমি সত্যি কথাটা জানতে চাই।
ইস! ধর্মপুত্তুর! বলে লাল্টু আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়। বলে, অন্য কেউ হলে আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু রেমি সম্পর্কে তোর মুখে এসব কথা শুনলেও পাপ হয়, বুঝলি রাসক্যাল!
রেমি কি তোমাদের কাছে রমণী-রত্ন?
আলবাৎ তাই। তোর মতো লুম্পেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বলে আজ ওর এই দশা। মরেও বেচারার শান্তি নেই। শেষ সময়টাতেও তুই চেষ্টা করছিস যাতে ওর ইমেজটা নষ্ট করে দেওয়া যায়। তোর মতো হারামজাদা দুনিয়ায় আর একটাও বোধ হয় নেই রে কুট্টি।
ধ্রুব আপন মনে একটু হাসল।
লাল্টু সামনের দিকে চেয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে স্বাগত ভাষণের মতো বলতে লাগল, আরে মদ আমরাও খাই। তোর চেয়ে বেশীই টানতে পারি। তা বলে নর্দমায় পড়ে থাকি না, বেহেডও হই না। ঘরসংসার করি, চাকরি করি, পরোপকারও করি। সব বজায় রেখে তবে ভদ্রলোকেরা ফুর্তিফার্তা করে। তোর মতো আমাদের বংশে কে আছে বল তো। কাকা পিছনে আছেন বলে খুঁটোর জোরে তোর মতো মেড়া লাফায়। নইলে কবে ফুটে যেতি। বংশের নাম ডোবালি, কাকার নাম ডোবালি, তার ওপর রেমির এই স্যাড এন্ড। সভ্য দেশ হলে তোকে মার্ডার চার্জে ফাঁসি দিত।
গাড়িটা ল্যান্সডাউন দিয়ে ঘুরিয়ে তীব্র গতিতে চালায় লাল্টু। চোখের পলকে ফের নার্সিং হোমের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। দরজা খুলতে খুলতে বলে, আমাকে যা বলেছিস বলেছিস। আই শ্যাল ফরগেট। কিন্তু যদি আর কারো কাছে রেমি সম্পর্কে এসব বলিস আমি জানে খেয়ে নেবো।
লাল্টু ইগনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে রাখে।
নার্সিং হোম তেমনই নিশ্চুপ। লবিতে এক নিঃশব্দ ভীড়। সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন কৃষ্ণকান্ত।
লাল্টু ভীড় কেটে এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণকান্তর পাশে জায়গা করে নিয়ে বসে।
কাকা!
কৃষ্ণকান্ত মুখ তুলে তাকান। যেন চিনতে পারছেন না। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তোদের খুব কষ্ট হচ্ছে?
না কাকা, কষ্ট কী?
কফির কথা বলে দিয়েছি। একটু দেখ, হল কিনা।
আপনি ব্যস্ত হবেন না। কফি তো দিচ্ছেই মাঝে মাঝে।
কৃষ্ণকান্ত আকুল চোখে চারদিকে চেয়ে দেখে বলেন, এখনো নাকি ব্লাড দেওয়া চলছে। কাজ হচ্ছে না তেমন।
হবে। চিন্তা করবেন না। শী উইল সারভাইভ।
কৃষ্ণকান্ত ভাষাহীন চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন লাল্টুর দিকে। তারপর মাথাটা আস্তে আস্তে নেড়ে বলেন, আমার অনেক পাপ ছিল। অনেক পাপ। কর্মফল ফলছে।
ওসব বলবেন না কাকা। এ তো আপনার আমার হাতে নয়।
কৃষ্ণকান্ত বুকভাঙা একটা শ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন, মা! বুড়ো বয়সে এ কষ্টটা পেতে হল। রেমির জন্য এই একজন মানুষের শোক কত গভীর ও কত ভেজালহীন তা দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে গেল লাল্টু। কৃষ্ণকান্তকে কেউ কখনো এত দুর্বল হতে দেখেনি। লাল্টুর মনে আছে উনিশশো তেতাল্লিশে জেলে থাকার সময় কৃষ্ণকান্তর একটি মেয়ে টাইফয়েডে মারা যায়। সে খবর জেলখানায় পৌঁছে দিতে হয়েছিল লাল্টুকেই। কৃষ্ণকান্ত একটু উদাস চোখে চেয়েছিলেন মাত্র। কয়েক ফোঁটা চোখের জল পড়েছিল। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। “লোহার মানুষ” বলে খ্যাতি হয়েছিল তো এমনি নয়।
রাজনীতিতে বহু জল ঘোলা হয়েছে। বহুবার নানারকম বিপদে, বিপাকে পড়তে হয়েছে। কখনো উত্তেজিত হননি।
এই বয়সেও কৃষ্ণকান্তর মনোবল অসাধারণ। যত বিপদই আসুক তাঁকে কেউ ভেঙে পড়তে দেখেনি কখনো।
খুড়িমার মৃত্যু লাল্টুর মনে পড়ে যায়। অসাধারণ রূপসী সেই মহিলা সারাজীবন স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে করতে একদিন আর পারেননি। গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছিলেন। একথাও ঠিক, মানসিক দিক দিয়ে ছিলেন ভীষণ দুর্বল। আত্মহত্যার আগে তাঁর পাগলামির লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। সেই পাগলামিরই কিছু উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তেছে ধ্রুবর ভিতরেও। কিন্তু খুড়িমার মৃত্যুতেও অবিচল ছিলেন কৃষ্ণকান্ত। ছেলের উচ্ছৃংখলতাতেও তিনি বিচলিত নন। তাই কৃষ্ণকান্তর এই শোকার্ত চেহারা বড় অচেনা লাগে লাল্টুর।
লাল্টু কৃষ্ণকান্তর হাতখানা ধরে বলে, কাকা, আপনি বাড়ি যান! একটু রেস্ট নিন। চলুন আমি আপনাকে রেখে আসি।
কৃষ্ণকান্ত লাল্টুর দিকে চেয়ে বলেন, রেস্ট আমাকে দেবে কে? শরীরটা শুইয়ে রাখলেই কি রেস্ট হয়? রেস্টের সঙ্গে মনের সম্পর্ক নেই?
লাল্টু কৃষ্ণকান্তর কব্জিটা আলতো হাতে চেপে ধরে নাড়ীটা অনুভব করছিল। নাড়ীর গতি স্বাভাবিক নয়। প্রেসার বেড়েছে সন্দেহ নেই। সে বলল, আপনার কাছে প্রেসারের ওষুধ নেই?
কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, না।
জগা ভীড়ের ভিতরে থেকে মাথা তুলে বলল, কর্তার প্রেসারের ওষুধ আমার কাছে আছে। দেবো?
লাল্টু বলে, দে।
কৃষ্ণকান্ত বিনা প্রতিবাদে বড়িটা গিলে চোখ বুজে হেলান দিয়ে থাকেন সোফায়।
দোতলার অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন সিনিয়র নার্স নেমে আসে। ভীড়টা তার দিকে নীরব প্রশ্ন তুলে চেয়ে থাকে।
লাল্টু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এনি নিউজ?
স্টিল নাথিং।
তার মানে?
ব্লাড চলছে।
অপারেশন?
এখনো শুরু হয়নি।
রুগীর অবস্থা কিরকম?
একই রকম। ডাক্তাররা কনসাল্ট করছেন।
লাল্টু একটু অসন্তোষের গলায় বলে, এখানে কিছু না হলে আমরা পেশেন্টকে বেটার কোনো নার্সিং হোম-এ রিমুভ করতে পারি। ওঁরা সেকথা বলছেন না কেন? আমাদের ফাইন্যাল কিছু জানা দরকার।
নার্সটি একটু থতমত খায়। এরা যে ভি আই পি-র আত্মীয় তা সে জানে। বিনীত স্বরে বলে, পেশেন্টের অবস্থা রিমুভ করার মতো নয়।
হেমারেজটা কি চলছে?
চলছে। তবে আমার মনে হয় রেট অফ ব্লিডিং একটু কম।
তার মানে কী? ইজ শী ইমপ্রুভিং?
এখনো কিছু বলা সম্ভব নয়। ডাক্তার বলতে পারেন।
আপনি তো ও-টিতেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনি কী দেখলেন বলুন।
নার্সটি খুবই অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। অনিশ্চিত গলায় বলে, পেশেন্টের এখনো জ্ঞান নেই।
কোমা কি?
অনেকটা তাই। তবে খুব ডীপ কোমা নয়। মাঝে মাঝে কনশাস হয়ে উঠছেন। তবে কাউকে চিনতে পারছেন না।
কারো নাম করছে?
নার্স একটু চিন্তা করে বলে, বোধহয় ওঁর হাজব্যাণ্ডের কথা বলছেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
কী বলছে?
ডিলিরিয়ামের মতো। স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
পেশেন্ট কি তার হাজব্যাণ্ডকে দেখতে চাইছে?
নার্স মাথা নাড়ল, না। শী ইজ স্পিকিং টু হিম ইন হার ডিলিরিয়াম।
লাল্টু খুব বিরক্ত গলায় বলে, ডাক্তারদের জানাবেন যে, পেশেন্টের আত্মীয়রা অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে আছেন। তাঁরা মাঝে মাঝে পজিটিভ কোনো খবর যেন দেন। একদম সায়লেন্ট থাকলে আমাদের উদ্বেগ কীরকম হয় বুঝতেই পারছেন। পেশেন্টের শ্বশুর হাই প্রেসারের রুগী।
নার্স মাথা নেড়ে বলে, ঠিক আছে। আমি বলব।
মেক ইট এ পয়েন্ট। সাইলেন্ট থাকলে এদিকেও এক-আধজন রুগী হয়ে পড়তে পারেন।
নার্সটি চলে গেলে লাল্টু এসে কৃষ্ণকান্তর পাশে বসে বলল, ব্লিডিংটা কম।
তাই বলল?
হ্যাঁ।
ঠিক শুনেছিস?
ঠিক শুনেছি। আপনি ভাববেন না।
আর কী বলল?
কৃষ্ণকান্ত সবই শুনেছেন, তবু আবার শুনতে চান। লাল্টু নার্সের কথার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে রেমির অবস্থার উন্নতি সম্পর্কে তাঁকে নিঃসন্দেহ করতে লাগল।
রেমি বাস্তবিকই খুঁজছিল তার একমাত্র পুরুষকে। পুরুষ? না স্বামী?
স্বামী কাকে বলে তা এখন আর রেমি বুঝতে পারছে না। তবে সে জানে, সমস্ত পৃথিবীর সব পুরুষ একদিকে, আর এই পুরুষটি অন্যদিকে। একে সে আর সকলের সঙ্গে মিশিয়ে দেখে না। এ শুধু তার। শুধু তার।
রেমি ডাকছিল, কোথায় তুমি?
বহু দূর থেকে অন্ধকার ভেদ করে ক্ষীণ জবাব এল, কেন রেমি?
কাছে এসো।
পারছি না রেমি
কেন?
এখানে এমন ব্যবস্থা যে ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না। চেষ্টা করছি।
আমি এখানে। এই যে! ওগো!
তুমি অনেক ওপরে রেমি। আমি যে উঠতে পারছি না।
কেন গো?
পারছি না। কিছুতেই পারছি না।