৭। প্রশ্ন
রাতে ভোজনের পর বিশ্রামকক্ষে বসেছিলেন বসুমান, অগস্ত্য এবং উপল। উপল আজ আর ফিরে যাবে না, এই রাতটুকু সে রাজ আতিথ্য গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। তার কারণ অবশ্যই অগস্ত্য। ইরতেনসেনুকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার পর থেকে অগস্ত্য রাজপ্রাসাদের একটি মহার্ঘ্য কক্ষে থাকে। দীর্ঘ এক বছর সমুদ্রযাত্রার অনেক কথা উপলের বুকে জমা হয়ে আছে। তা সে বন্ধুকে বলতে চায়।
আজ রাতে তাই দুই বন্ধু একান্তে গল্প করে কাটাবে। এখন তারা রাজার সঙ্গে অষ্টপদ নামের এক খেলায় ব্যস্ত। এই খেলাটি বেশ আকর্ষণীয়। একটি তালপাতায় একটি বর্গক্ষেত্র আঁকা আছে। আবার একে ভাগ করা হয়েছে মোট চৌষট্টিটি খোপে। এর মধ্যে আটটি করে খোপ অনুভূমিক ভাবে রয়েছে এবং আটটি উল্লম্বভাবে। দু’জন এই খেলা খেলতে পারে।
এখন রাজা এবং উপল খেলছে, অগস্ত্য পাশে বসে আছে। বসুমানের কাছে আছে চারটি গাঢ় বাদামি বর্ণের নুড়ি এবং উপলের কাছে আছে চারটি সাদা নুড়ি। এইগুলি এই খেলার ঘুঁটি। পালা করে তিনটি চ্যাপ্টানো গোলাকার পাথরের টুকরোকে হাতের মধ্যে নিয়ে ঝাঁকিয়ে তালপাতার উপরে ফেলছেন তারা দুজনে। এগুলি পাঞ্জা। পাঞ্জা তিনটির একদিকে কালো রঙ করা।
তালপাতার উপরে পড়ার পরে এই দিকটি উপরে থাকলে প্রতি পাঞ্জা পিছু প্রতিজনের ঘুঁটি দু’পা করে সামনের দিকে এগোয়। তালপাতার বর্গক্ষেত্রগুলির উপরে দাগ করা আছে। দাগগুলি বৃত্তাকারে ঘুরে এসে শেষ হয়েছে কেন্দ্রে থাকা চারটি বর্গে। দুই প্রতিযোগীর ঘুঁটিগুলি এই দাগ লক্ষ করে কেন্দ্রের দিকে এগোতে থাকে। কোন একটি বর্গে একটি ঘুঁটি অপরটির উপরে এসে পড়লে ঘুঁটিকে ফিরে যেতে হয় আবার প্রথম বর্গক্ষেত্রে। আবার কিছু বর্গে দাগ কাটা আছে।
এগুলিকে দুর্গ বলা হয়। এই দুর্গে দুটি ঘুঁটিই নিরাপদ অবস্থায় থাকতে পারে। যার চারটি ঘুঁটিই প্রথম কেন্দ্রে পৌঁছবে সে এই খেলায় জিতবে। একসময় উপল পাঞ্জার এক চালে তার একটা ঘুঁটিকে রাজার একটি ঘুঁটির বর্গে রেখে দিয়ে বলল, ‘এবারে আপনাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে রাজন, আপনার তিনটি খুঁটি কেন্দ্রে পৌঁছলেও এটি বেশ বেগ দিচ্ছে। এত সহজে জিততে দেব না আপনাকে।
খেলার ছকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন বসুমান, বললেন, ‘আপনি চতুর বটে। কোন পথে এসে যে খেলায় বাজিমাত করলেন আমি বুঝতে পারলাম না। আপনার খেলা দেখে আমার বিশ্বাস হয়েছিল আপনি নিজের ঘুঁটিগুলিকে বাঁচানোর জন্য এগোবেন। কিন্তু দেখলাম সেটি ছিল ছলনামাত্র।’
‘বিশ্বাস বড় বিষম বস্তু রাজা। বিশ্বাসের বলে মানুষ গিরি লঙ্ঘন করে। আবার বিশ্বাসের ফাঁদে পড়ে সে সর্বস্ব খোয়াতেও পারে। তার তুলনায় এই খেলায় বিশ্বাসের হার তো তুচ্ছ।’
‘এ কথা ঠিক বলেছেন। আপনার দেওয়া চালগুলি আমি মনে রাখার চেষ্টা করব। এই খেলাটি আরও কিছুক্ষণ চলুক নাকি?
উপল সম্মতিসূচক ভাবে ঘাড় নেড়ে আবার অষ্টপদের ঘুঁটিগুলির দিকে তাকাল। অগস্ত্য এতক্ষণ নিবিষ্ট মনে তাদের খেলা দেখছিল। রাজা এবার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি মহর্ষি?’
‘অবশ্যই, নির্দ্বিধায় করুন।’
‘প্রশ্নটা করতে দ্বিধাবোধ তো হচ্ছেই। তবে প্রশ্নটি আমার মনে বেশ কয়েক বছর হল জাগ্রত হয়েছে। বহুবার ভেবেছি জিজ্ঞাসা করব কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে অনধিকারচর্চা হয়ে যাবে। আজ আর নিজেকে সংবরণ করতে পারব না বলে মনে হচ্ছে।’
অগস্ত্য সামান্য হেসে আবার বলল, ‘বলুন রাজন, দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। এই ঘরে আপনি আর উপল ছাড়া তো আর কেউ নেই। আপনি বলুন কী জানতে চান। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব উত্তর দেওয়ার।’
রাজা বসুমান এবারে সামান্য দ্বন্দ্বভরা কণ্ঠেই বললেন, ‘আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন অগস্ত্য? সত্যি করে বলুন তো?’
অগস্ত্য এ হেন প্রশ্নে অবাক হল। একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। অগস্ত্য বলল, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস আমি করি রাজা, কিন্তু এমন প্রশ্ন আপনার মনে এল কেন?’
‘আপনাকে আমি আজ প্রায় সাত বছর ধরে চিনি, মাঝের দু’বছর বাদ দিলে পাঁচ বছর আপনি বিদর্ভে বাস করছেন। আপনি ঋষি, আপনার জ্ঞান অন্তহীন। কিন্তু এই রাজ্যের বাকি কিছু ঋষিদেরকেও আমি চিনি, তাদের আশ্রমের পৃষ্ঠপোষক আমি। সেইসব শান্তির স্থানে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে। তাই সপ্তাহের দু’দিন কোনও একটি আশ্রমে কয়েক দণ্ড সময় ব্যয় করি আমি। আমি দেখেছি সন্ন্যাসীদের দিনের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে দেবতার আরাধনায় এবং তপস্যায়। তাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন করেন, ফলাহারেই ক্ষুধার নিবারণ করেন, মাছ-মাংস খেতে দেখি না তাদের।
‘কিন্তু আপনাকে আমি কোনওদিন দেখিনি কোনও দেবতার পূজা করতে। আপনি এই কুন্দিনাপুরীর মহাদেবের মন্দিরে কোনদিন যাননি, এই প্রাসাদের দেবালয়েও নাকি কেউ কখনও দেখেনি আপনাকে। আপনাকে বেশিরভাগ সময় নিজের গবেষণাগারে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। আপনি বলেছিলেন ব্রহ্মার উদ্দেশে তপস্যা করে লোপামুদ্রাকে পেয়েছেন। লোপামুদ্রা আমার অমূল্য রত্নসমা কন্যা, আমার চোখের মণি সে। আপনার কর্মের প্রতি সন্দেহ পোষণ করার কোন অভিপ্রায় আমার নেই। কিন্তু আমি কোনওদিন আপনাকে প্রজাপতির স্তুতি করতেও দেখিনি। আজ সকালে প্রজারা যখন এই বিদর্ভের আরাধ্য দেবতা মহাদেবের নামে জয়ধ্বনি করছিল তখন তাতে আমিও গলা মিলিয়ে ছিলাম। কিন্তু খেয়াল করেছিলাম আপনি চুপ ছিলেন। সেই সময়ে আমার মনে প্রশ্নটি আবার উদয় হল। আপনাকে অপদস্ত করার কোন অভিপ্রায় আমার নেই জানবেন।’
অগস্ত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। রাজার এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সে? আবার একটি মিথ্যা বলবে? সে একবার উপলের দিকে তাকাল। উপল নিজের মনে অষ্টপদের ছকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন একা একাই নিজের মনের মধ্যে খেলাতে ব্যস্ত সে, রাজার প্রশ্নটি তার কর্ণগোচর হয়নি। সামান্য রাগ হল অগস্ত্যের।
উপল সব জানে, এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় সে কি পারত না কোন এক অজুহাতে এই আলোচনার স্রোতকে ঘুরিয়ে দিতে? তার চতুর বুদ্ধিতে কি এটা সম্পূর্ণই অসম্ভব ছিল? অগস্ত্য নিজের মনের মধ্যে একটি উত্তরকে তৈরি করে নিল। তারপর বলল, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী রাজা। লোপামুদ্রার সৃষ্টি ঈশ্বরের আশীর্বাদে, আমার তপস্যার ফলে। কিন্তু আমি ঈশ্বরকে নিজের মনের মধ্যে কল্পনা করি, তাই মন্দিরের বিগ্রহ পূজার প্রয়োজন আমার হয় না। আমার আরাধনার ধরণটি অন্যরকম। আমি বিজ্ঞানের পূজা করি।’
‘বিজ্ঞান বিষয়টি আমার কাছে অজ্ঞেয় মহর্ষি। আপনি নিজেই আমাকে আগেও বলেছেন যে আপনার অলৌকিক কর্মকাণ্ড আসলে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের ফল। কিন্তু প্রকাশ্যে আপনি এই নিয়ে চুপ থাকেন। আমাদের পুরাণের গল্পে দেবমাহাত্মের যে আশ্চর্য গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি তাদের সবকটিকেই কি বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? আপনার কি মনে হয় ধর্মের তুলনায় বিজ্ঞান বেশি শক্তিশালী? তাহলে ধর্মের প্রয়োজনই বা আর কী?’
‘না, ধর্মই বিজ্ঞানের তুলনায় শক্তিশালী, আমি তাই মনে করি।’
‘আপনার তাই যদি মনে হয় তাহলে আপনাকে কখনও তো দেখি না ধর্মের উপাসনায় সময় ব্যয় করতে। আপনি ধর্মে বিশ্বাসী?’
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা অগস্ত্যর ছিল না। সে বলল, ‘বিজ্ঞানের রহস্য আপনার অজ্ঞেয় বললেন রাজা। বিজ্ঞান আসলে এই পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এক পদ্ধতি। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে চিনে তাদের মানব কল্যানের কাজে লাগানো হল বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।’
‘তাহলে আপনি কখনও সর্বসমক্ষে বলেন না কেন যে আপনার অলৌকিক কর্মকাণ্ডগুলি আসলে কোনও দৈবশক্তিতে নয়, বিজ্ঞানের ফলে ঘটে!’
‘বলি না, কারণ আমি চাই যে মানুষ দৈবে বিশ্বাসী হোক।’
রাজা বসুমান এবারে দৃশ্যতই অবাক হলেন, বললেন, ‘কেন? এমন ভাবনার কী কারণ?’
অগস্ত্য এবার শান্ত স্বরে বলল, ‘দেখুন রাজন, বিজ্ঞানচর্চা এখনও ভারতবর্ষে সেই ভাবে ব্যপ্তি লাভ করেনি। বিদ্যালয়ে ছাত্ররা গুরুর থেকে যে শ্রুতি পাঠ করে তার মধ্যেও বিজ্ঞানের পাঠ নেই। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা সেই ভাবে জন্মায়নি। অন্যদিকে দেশের মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। এই ধর্ম কিন্তু বয়সে তরুণ। মাত্র কয়েক শত বছর আগে এর জন্ম হয়েছে। ধর্ম মানুষকে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে। ধর্মের বলে সমাজ তৈরি হয়, সমাজ থেকে তৈরি হয় রাজ্য। আপনার এই রাজত্ব আপনি শাসন করলেও আদতে কুন্দিনাপুরীর মহাদেবের মন্দির এই রাজ্যের ভরকেন্দ্র
মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে, ভয় পায় কারণ সে তাঁদের অপরিসীম ক্ষমতার গল্প শোনে। আপনি ক্ষণিক আগে বিশ্বাসের কথা বললেন, ভারতবর্ষের মানুষের এই ধর্মবিশ্বাসের এখন একান্ত প্রয়োজন। আমি আজ অবধি যত আপাত অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছি তার সবই বিজ্ঞানপ্রসূত। কিন্তু জনগন তাকে দৈবের আশীর্বাদ ভেবে থাকলে আমি তাদের আটকাইনি। এই ভাবনা তাদের ঈশ্বরচিন্তাকে আরও দৃঢ় করেছে।
এই সমাজের ভবিষ্যত এতে আরও শক্তিশালী হবে। বিজ্ঞান এখন সদ্যজাত শিশু গাছ, সে নিজের জল হাওয়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠুক না হয়। একদিন সে বৃক্ষে পরিণত হবে, ততদিনে ধর্ম মহীরূহের আকার ধারণ করবে। তখন হয়তো এই দেশের মাটির ভাগ পাওয়ার জন্য ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের যুদ্ধ হবে। তবে সেই সময় আগামী সহস্র বছরেও আসবে বলে আমার মনে হয় না।’
অগস্ত্যের এই উত্তরে বসুমান চুপ করে রইলেন। তার যুক্তি যে অকাট্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানে বিশ্বাসী হলে তারা ধর্ম, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করতে শুরু করবে। ধর্মের গতি বায়ুর মতো অবাধ, সমাজের যে কোন স্তরের মানুষের কাছে তা পৌঁছে যেতে পারে। অন্যদিকে বিজ্ঞান একটি অচেনা পুষ্পের মতো। তার সুগন্ধ সবাই পাবে বটে, কিন্তু সেই গন্ধের উৎসের সন্ধান অগস্ত্যের মতো কিছু মহামানবই করতে পারবেন। অগস্ত্যকে আর কোন প্রশ্ন করলেন না রাজা।
আরও কিছুক্ষণ খেলার পরে রাজার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে প্রাসাদের দ্বিতলের লম্বা দালান দিয়ে হাঁটতে লাগল অগস্ত্য এবং উপল। তাদের বাঁ দিকে সারি দিয়ে ঘর, ডানদিক উন্মুক্ত। সেখানে বেশ বড় একটি উদ্যান আছে। এখন রাত্রি কত তা বোঝা দুস্কর। দালানের স্তম্ভগুলির গায়ে যে মশালগুলি জ্বলে তাদের আগুন কমে এসেছে। বাইরের আকাশের চাঁদের আলো দালানে এসে পড়েছে। চারদিন আগে পূর্ণিমা ছিল, এখন চন্দ্র পুরো গোলাকার নয়। যেন গাঢ় নীল আকাশের আগে কোন অপটু কারিগর একটি অসমান রূপার থালা তৈরি করেছেন। থালার আশেপাশে অসমঞ্জস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাবে লেগে রয়েছে আরও কিছু রূপার বিন্দু। কোনও এক অদৃশ্য উৎস থেকে আলো এসে তাদের ওপর পড়ায় সেই বিন্দুগুলি ঝিকমিক করে উঠছে। ওইগুলি আকাশের তারা।
জ্যোতির্বিদ্যায় অগস্ত্যর আগ্রহ আছে, তবে আকাশের তারাদের নিরীক্ষণ করার জন্য অমাবস্যার রাত আদর্শ। উপল একবার পিছন ফিরে দেখল রাজার কক্ষটিকে। বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে তারা, এখান থেকে রাজার কক্ষ থেকে নির্গত আলো ক্ষীণ ভাবে দেখা যাচ্ছে। এবার যেন সামান্য নিশ্চিন্ত হয়েই নিজের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা কৌতুকবোধকে আর ধরে রাখতে পারল না উপল। বাম হাতে মুখ চেপে হাসতে হাসতে অগস্ত্যের পিঠে চাপড় মারল সে। অগস্ত্য মুখে ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলল, ‘কী ভাই, খুব মজা পেলে তো আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে।’
‘মজা পাব না! আমি তো হাসি চেপে রাখতেই পারছিলাম না। শেষে মনে মনে দেড়টি মাস আগের এক ঝড়ের রাতের কথা ভাবতে লাগলাম, মাঝ সমুদ্রের বিষম ঢেউয়ের মধ্যে কোনক্রমে নিজের নৌকাটিকে ভাসিয়ে রাখছি। সেই ভয়ানক মুহূর্তের কথা ভেবে কোনওরকমে হাসি আটকালাম, না হলে রাজার সামনে একটা বিশ্রি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। তা ভাই, তুমি কিন্তু বেশ ধুরন্ধর ব্যক্তি, কীভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে সেটা শেখবার মতো বটে!’
‘হ্যাঁ! ভাবিনি এমন প্রশ্নের সামনে আমাকে কখনও পড়তে হবে। রাজা যে আমার গতিবিধির উপরে নজর রাখছেন সেটা বুঝতে পারলাম।’
‘হ্যাঁ, তবে আমি এতে অবাক হইনি। হয়তো তোমার নিরাপত্তার জন্যই কোন দেহরক্ষী গোপনে তোমার ওপরে নজর রাখে সর্বদা। একে তুমি রাজগুরু, তার উপরে রাজার জামাতা।’
‘হুম, সেটাই হবে। মনে হয় না রাজা আমার উপরে কোন সন্দেহ করেছেন।
‘একদমই করেননি, এই বিদর্ভে আসার পর তুমি এই রাজ্যকে এত কিছু দিয়েছ যে রাজা তোমার মন্দিরে না যাওয়ার ভাবনা নিয়ে খুব বেশি কালক্ষেপ করবেন না। তবে আমার মনে হয় মাঝে মাঝে তোমার উচিত মন্দিরগুলোতে যাওয়া, মাসে অন্তত একবারের জন্য হলেও। এতে রাজার মনে যদি নূন্যতম সন্দেহও তৈরি হয়ে থাকে, তার নিরসন হবে।’
‘তুমি জানো উপল, এ আমি পারব না। তুমি নিজেও কি পারতে? আমার নিজের বিশ্বাসকে আমার নিজের কাছে অটুট রাখতেই হবে। ওইটুকু আমার একান্ত ব্যক্তিগত। এই দেশে আসার পর কম মিথ্যের আশ্রয় তো আমাকে নিতে হয়নি। তোমাকেও অনেকবার সত্যের পথ ত্যাগ করতে হয়েছে। আমি নিশ্চিত এর জন্য আমার মনের মধ্যে যতটা গ্লানি আছে ততটাই তোমার মনেও আছে। আমার যতটুকু জ্ঞান তাই দিয়ে সমাজের কল্যানের চেষ্টা করি। তোমার বাণিজ্যতরী কতবার এই ভূখণ্ডে ঐশ্বর্য বয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা এই ভারত ভূমির কোনও ক্ষতিসাধন তো করিনি। আমার নিজের ঈশ্বরের প্রতি অটুট বিশ্বাস আমার শেষ সম্বল, তাঁকে আমি কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না। আমাকে তুমি মন্দিরে যেতে বোলো না।’
উপল সামান্য গম্ভীর মুখে বলল, ‘জানি বন্ধু, তোমার সঙ্গে মজা করছি বটে, কিন্তু জানি তোমার মনের মধ্যে কী চলছে। অতটুকু গোপনীয়তা রক্ষা করতে তুমি আর আমি বদ্ধপরিকর। আজ যদি রাজা আমাকে প্রশ্নটা করতেন তাহলে আমি চলচ্ছক্তিহীন প্রস্তরে পরিণত হতাম, আমার মুখ থেকে কোন কথা সরত না। তুমি বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ টেনে এনে যেভাবে কথাটাকে এড়িয়ে গেলে তা সত্যিই প্রসংশনীয়। তোমাকে কোনভাবে দুঃখ দিয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা কোরো।’
অগস্ত্য এই কথা শুনে উপলের কাঁধে হাত রেখে কৌতুকের সুরে বলল, ‘তোমাকে আমি ক্ষমা এমনিতেও করতে পারব না ভাই। গতবার দেশত্যাগের আগে বলেছিলে ফেরার সময় মিতানিদের উটপাখির মাংস নিয়ে আসবি। তা তো আনোনি নিশ্চয়ই, ওই পাখির মাংসই তোমার আমার বিচ্ছেদের কারণ হবে এবারে।’
অগস্ত্য এবং উপল দুজনেই হো-হো করে হেসে ওঠে, রাতের নির্জনতা কাটিয়ে তাদের হাসির আওয়াজ এই দালানে গমগম করতে থাকে। দ্রুত নিজেদের সংবরণ করে নেয় দুই যুবক। হাসি থামলে উপল অগস্ত্যকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা ভাই, ইরতেনসেনুকে কি তুমি আমাদের আসল পরিচয়টা জানিয়েছ?’
এই মন্দালোকেও উপল বুঝতে পারে যে অগস্ত্যের মুখে অন্ধকার নামল। সে মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘না, জানানো হয়নি। আসলে মিশরে যখন প্রথম আমাদের দেখা হয় তখন ইরতেনসেনু আমাকে আর্য বলেই ভেবেছিল। আমিও তার এই ভ্রম নিরসনের চেষ্টা করিনি কখনও।’
‘এটা মনে হয় ঠিক হয়নি অগস্ত্য। সে তোমার ধর্মপত্নী। এমন কিছু থাকার কথা নয় যা তুমি তার কাছ থেকে গোপন রাখবে।’
‘হুম, তুমি ঠিক বলেছ। বলব, সঠিক সময়ে সব বলব আমি।’
এই সঠিক সময়ের অপেক্ষা অগস্ত্য গত চারবছর ধরে করে আসছে। তার আসল পরিচিতি, তার বংশকুলের ইতিহাসের কথা ইরতেনসেনুকে বলতে সাহস পায় না সে। তার মনে ভয় হয়। সবটা জানালে হয়তো ইরতেনসেনু তাকে ত্যাগ করবে। অগস্ত্যর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস হয়তো পৃথিবীর কোনও মানুষের কাছে অজ্ঞাত নয়। খারাপ খবর দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। অগস্ত্য নামের নতুন পরিচয় গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব জীবনের সবকিছুকে ত্যাগ করে এসেছে সে। তার নিজের বলে আছে কেবলমাত্র উপল, আর লোপামুদ্রা। এই দুজনের কারোকেই সে হারাতে পারবে না।
সহসাই নূপুরের আওয়াজে অগস্ত্যর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল।