৬.৪ দরবেশ

দরবেশ

 রামাল্লা। আজকের ইসরাইল কবলিত এই রামাল্লায়-ই খৃস্টানদের হাতে পরাজয়বরণ করেছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দশ মাইল দূরে উত্তরে জর্ডানে অবস্থিত এই রামাল্লা। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল জর্ডানের এই এলাকাটি দখল করে নিয়েছিলো। জর্ডান নদীর পশ্চিমতীরে ইসরাইলী সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাটা। অঞ্চলটি এখনো ইসরাইলের দখলে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, পৃথিবীর কোন শক্তি এই অঞ্চলটি তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। রামাল্লা এবং অন্যান্য অধিকৃত অঞ্চলকে সেদিনও তারা বধ্যভূমি বানিয়েছিলো এবং আজো সেগুলো বধ্যভূমিই রয়ে গেছে। রামাল্লার মুসলমানরা ইসরাইলের এই অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে আর ইসরাইল তাদের রাইফেলের গুলি দ্বারা মুসলমানদের দমন করছে।

ইসরাইলের হঠকারিতা আর আরব দুনিয়ার নীরবতা-নির্জীবতা প্রমাণ করছে, ইসরাইল এই অঞ্চলটির দখল ছাড়বে না এবং ছাড়তে বাধ্য হবে না। কিন্তু আটশত বছর আগে যখন রামাল্লা খৃস্টানদের দখলে চলে গিয়েছিলো, তখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একটি দিনের জন্যও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক কষ্টে জীবন রক্ষা করেছিলেন। শোচনীয় পরাজয় বরণ করে তাঁর বাহিনী পিছপা হয়ে সোজা মিসরের দিকে মুখ করতে বাধ্য হয়েছিলো। বিপুলসংখ্যক সৈন্য খৃস্টানদের হাতে বন্দি হয়েছিলো। কিছু সৈন্যরা উপায়-উপকরণ ব্যতীত কায়রো যেতে গিয়ে পথেই প্রাণ হারিয়েছিলো। এরূপ পরাজয় একটি বাহিনীর মনোবল ও উদ্দীপনা ভেঙে দিয়ে থাকে। নিজেদের সামলে নিতে নিতে চলে যায় বহু সময়- বছরের পর বছর। কিন্তু সুলতান আইউবী মিসর পৌঁছে শুধু আত্মসংবরণই করেননি। অল্প কিছুদিনের মধ্যে অভাবনীয়রূপে সেই এলাকায় ফিরে যান, যেখানে তিনি পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিলেন। তিনি ক্রুসেডারদের যম হয়ে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করেন।   

রামাল্লা আজ আবারো সালাহুদ্দীন আইউবীর অপেক্ষা করছে।

সুলতান আইউবীর সম্মুখে কাজ শুধু এটুকুই নয় যে, পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হবে এবং ক্রুসেডারদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে হবে। তাঁকে বহু বিপদ-শঙ্কা ও সমস্যা বেষ্টন করে রেখেছে। তাঁর সারিতে বিশ্বাসঘাতকদের অভাব নেই। সুদানের দিক থেকে আক্রমণ আশঙ্কা বেড়ে গেছে। সুদানীদের জানা আছে, আইউবীর কাছে ফৌজ নেই। যে কজন আছে, তারা পরাজিত ও আহত। বিপরীতে ক্রুসেডারদের সৈন্য দশগুণ বেশি। রামাল্লার জয় তাদের মনোবল ও উন্মাদনা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরেকটি আশঙ্কা, সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধবাদী আমীরগণ তার এই পরাজয়কে কাজে লাগাতে পারে। তারা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুলতান আইউবীর সেই বাহিনীটির জন্য আপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যাদের তিনি রণাঙ্গনে রেখে এসেছেন। সেই বাহিনীর প্রধান সেনানায়ক সুলতানের ভাই আল-আদিল, যার উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে।

একটি শঙ্কা খৃষ্টান গোয়েন্দাদেরও। পিছপা হওয়ার সময় মিসরী সৈন্যের বেশে খৃস্টান গোয়েন্দাদেরও মিসরে ঢুকে যাওয়া সহজ ছিলো। এ সুযোগটা তারা অবশ্যই গ্রহণ করেছে। তারা মিসরে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মনোবল ভেঙে দিতে পারে।

রামাল্লার পরাজয়ের পর আল-আদিল হামাত পর্যন্ত সরে এসেছিলেন। এই স্থানটিতেই সুলতান আইউবী তার প্রতিপক্ষ মুসলিম আমীরদের পরাজিত করেছিলেন। হামাতে দুর্গও আছে। খৃস্টানরা সুলতান আইউবীকে পরাজিত করে হামাতের দিকে এগিয়ে যায়। আল-আদিল নিজেও একজন সালার এবং এখন তাঁর সঙ্গে যেসব সালার আছে, তাঁরাও দুঃসাহসী মুজাহিদ। তাদের দীন ও ঈমান সুলতান আইউবীরই ন্যায় পরিপক্ক। আল আদিল স্বীয় ভাই আইউবীর শিষ্য। তারই নিকট থেকে যুদ্ধকৌশল রপ্ত করেছেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শিতার বলে তিনি বুঝে ফেলেন, এমন একটি সহজ ও বিশাল জয়ের পর ক্রুসেডাররা রামাল্লায় বসে থাকবে না। তিনি পেছনে ছদ্মবেশে গোয়েন্দা রেখে দুটি ফৌজ নিয়ে হামাত অভিমুখে রওনা হন। তিনি জেনে ফেলেছেন, সুলতান আইউবী মিসর চলে গেছেন।

আল-আদিলের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। গোয়েন্দারা তাঁকে সংবাদ প্রদান করে, খৃস্টান বাহিনী হামাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আল আদিল তার বাহিনীর অবস্থা আঁচ করেন। ভালো নয়। সৈনিকদের মনোবল ভেঙে গেছে। উট-ঘোড়ার সংখ্যাও কমে গেছে। রসদের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। তবে তিনি ফৌজকে খুবই উপযুক্ত একটি স্থানে নিয়ে এসেছেন। সবুজ পাহাড়ি এলাকা। পানি আছে। তিনি সৈনিকদেরকে এক স্থানে সমবেত করে নেন। তিনি দেখলেন, অধিকাংশ উট আহত। গুরুতর আহত উটগুলোকে জবাই করিয়ে ফৌজকে বলে দেন, পেট পুরে গোশত খাও। এভাবে একটি প্রশস্ত অঞ্চলে রাতটাকে তিনি উৎসবের আমেজে ভরে দেন। তিনি সন্ধ্যায়ই হাল্ব ও দামেশকে দূত প্রেরণ করেন যে, যতো পারো রসদ, পশু ও অস্ত্র প্রেরণ করো।

রাতের বেলা। সৈন্যরা উটের গোশত খেয়ে পরিতৃপ্ত। আল-আদিল একটি পাথরের উপর উঠে যান। তাঁর ডানে ও বাঁয়ে দু ব্যক্তি প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি উচ্চকণ্ঠে ভাষণ দিতে শুরু করেন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুজাহিদগণ! তোমরা এই বাস্তবতাকে মেনে নাও, আমরা পরাজিত হয়ে এসেছি। তোমরা কি এই পরাজিত অবস্থায়-ই মা-বোন, স্ত্রী-কন্যাদের নিকট ফিরে যাবে এবং বলবে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমনের হাতে পরাজিত হয়ে এসেছি? তোমাদের মায়েরা কি দুধের দাবি ক্ষমা করবেন? তারা ঘরে বসে সংবাদের অপেক্ষা করছেন, আমরা প্রথম কেবলাকে কাফেরদের কজা থেকে মুক্ত করেছি কিনা! তারা জানে, আমাদের বে-দখল অঞ্চলগুলোতে কাফেররা মুসলিম নারীদের লাঞ্চিত করছে। ভেবে দেখো, তোমরা তোমাদের মা-বোনদেরকে কী জবাব দেবে। তোমাদের যারা এখান থেকেই পেছনে কেটে পড়তে চাও, তারা মজলিস থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়াও। আমি তাদেরকে বাঁধা দেবো না। তাদের জন্য বাড়ি-ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি আছে।

আল-আদিল থেমে যান। সমবেত সৈনিকরাও নীরব। একজন সৈনিকও আলাদা হলো না। প্রত্যেকে আপন আপন স্থানে বসে আছে।

সালারে আলা!- এক সৈনিক দাঁড়িয়ে গর্জে ওঠে বললো আমাদেরকে কী করতে হবে বলুন। আপনাকে কে বলেছে, আমরা যুদ্ধ পরিত্যাগ করে বাড়ি চলে যেতে চাই?

আমি যদি পিছপা হতে গিয়ে প্রাণ হারাই- আরেক সৈনিকের উদ্দীপ্ত কণ্ঠ- তাহলে আমার অসিয়ত আমার লাশ দাফন না করে শকুন নেকড়ের জন্য ফেলে রাখবেন।

এবার একসঙ্গে কয়েকটি কণ্ঠ গর্জে ওঠে। প্রতিটি কণ্ঠেই চেতনার জোশ। আল-আদিলের বুকটা প্রশস্ত হয়ে যায়। তিনি বললেন- দুশমন তোমাদের পেছনে আসছে। তোমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে, রামাল্লার জয়ই তাদের শেষ জয়। আজ রাত এবং আগামী দিন পরিপূর্ণ বিশ্রাম নাও। আগামী রাত পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা পাবে।

আল-আদিল পাথরের উপর থেকে নেমে আসেন। সালার ও কমান্ডারদের তাঁবুতে ডেকে এনে নির্দেশনা প্রদান করেন।

খৃস্টানরা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এটি বল্ডউইনের বাহিনী। তার জানা আছে সম্মুখে হামাতের দুর্গ এবং আল-আদিলের বাহিনী সেখানেই অবস্থান করছে। তিনি গুপ্তচর মারফত এ তথ্যও পেয়েছেন, যে বাহিনীটি হামাতের দিকে সরে গেছে, তার কমান্ডার আল-আদিল এবং আল-আদিল সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই। একজন সাধারণ সৈনিকও বুঝতে পারে, পরাজিত বাহিনী তার নিকটবর্তী দুর্গেই আশ্রয় গ্রহণ করবে।

বল্ডউইন দ্রুত অগ্রসর হয়ে হামাতের দুর্গ অবরোধ করে ফেলেন। তিনি ঘোষণা দেন, দুর্গের ফটক খুলে দাও। অন্যথায় দুর্গটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো। তার ধারণা, আল-আদিলের বাহিনী যুদ্ধ করার অবস্থায় নেই। কিন্তু তার ঘোষণার জবাবে দুর্গের পাঁচিলের উপর থেকে তীর বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

বল্ডউইন পুনরায় ঘোষণা দেন, এই খুনাখুনি অনর্থক। তোমরা লড়াই করতে পারবে না। দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দাও। আমি ওয়াদা দিচ্ছি, একজন বন্দির সঙ্গেও অন্যায় আচরণ করা হবে না।

দুর্গের উপর থেকে আওয়াজ আসে—

 তোমরা এতটুকু দূরে থাকো, যে পর্যন্ত আমাদের তীর পৌঁছুতে না পারে। তোমাদের না দিয়ে বরং দুৰ্গটা আমরা নিজেরাই গুঁড়িয়ে ফেলবো। আমাদের রক্ত অনর্থক ঝরবে না। তোমরাই বরং উদ্দেশ্যহীন মৃত্যুবরণ করবে।

ঘোষক ক্রুসেডার বাহিনীর অবস্থাটা দেখতে পায়। যেনো সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ চারদিক থেকে দুর্গটাকে গ্রাস করে রেখেছে। তার মোকাবেলায় দুর্গে যে সৈন্য আছে, তা না থাকারই সমান। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের কমান্ডার অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত নয়।

সূর্য অস্ত্র যাচ্ছে। খৃস্টানরা পরবর্তী কর্মসূচি ভোর পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেছে। তাদের বাহিনী দ্রুতগতিতে পথ চলে এসেছে। সবাই ক্লান্ত। এটি পশ্চাদ্ধাবন। বল্ডউইন এই চেষ্টায় রত যে, তিনি আল-আদিলকে কোথাও বিশ্রাম করার এবং বাহিনীকে নতুনভাবে সংগঠিত করার সুযোগ দেবেন না। তিনি আল-আদিলকে জীবিত ধরতে চাচ্ছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই হওয়ার কারণে আল-আদিল অত্যন্ত মূল্যবান কয়েদি। তাঁর বিনিময়ে খৃস্টানরা সুলতান আইউবীর নিকট থেকে কঠিন শর্ত আদায় করে নিতে পারে। বল্ডউইনের পরিপূর্ণ আশা, তিনি দুর্গের বাহিনী ও আল আদিলকেসহ দুৰ্গটা নিয়ে নিতে পারবেন।

***

বল্ডউইন তার বাহিনীকে দুর্গ থেকে এতোটুকু পেছনে সরিয়ে নিয়ে গেছেন যে, দুর্গওয়ালাদের তীর সে পর্যন্ত পৌঁছছে না। বাইরে থেকে কোনোবাহিনী তার উপর আক্রমণ চালাতে পারে এমন আশঙ্কা তার নেই। সুলতান আইউবী এখানে নেই। নেই তাঁর কোন বাহিনীও। হামাত দুৰ্গটাকে নিজের পায়ের তলেই দেখতে পাচ্ছে বল্ডউইন।

সন্ধ্যার পর পর তিনি তার কমান্ডারদেরকে আগামী দিনের কর্মসূচি পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে নিজ তাঁবুতে ফিরে যান। তাবুটা ফৌজ থেকে সামান্য দূরে পেছনে। সে যুগের রাজা-বাদশাহদের তবু শীশমহল থেকে কম হতো না। বল্ডউইন তত বিজয়ী সম্রাট। তিন চারটি রূপসী খৃস্টান মেয়ে তার সঙ্গে আছে। চারটি মুসলমান মেয়েও আছে। এই মেয়েগুলোকে খৃষ্টান কমান্ডাররা বিজিত অঞ্চল থেকে ধরে এনে বল্ডউইনকে উপহার দিয়েছিলো। মেয়েগুলো আরবের রূপের রাণী।

খৃস্টান মেয়েরা এই মুসলিম মেয়েগুলোকে বুঝিয়েছে, তোমাদের ক্রন্দন ও মুক্তির জন্য ছটফট করা অর্থহীন। তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমাদের সৌভাগ্য যে, তোমরা ক্রুশের একজন সম্রাটের ভাগে পড়েছে। তারা বুঝায়

শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে কোনো মুসলিম আমীর কিংবা শাসকের হেরেমে যেতেই হতো, যেখানে তোমাদেরকে কয়েদির মতো থাকতে হতো। দু-চার বছর পর যখন তোমাদের যৌবনের আকর্ষণ কমে যেতো, তখন তোমাদেরকে কোনো সওদাগরের কাছে বিক্রি করে দেয়া হতো। যদি তোমরা তোমাদেরই সৈনিকদের হাতে পড়তে, তাহলে তারাও তোমাদের সেই দশা-ই ঘটাতো, যা আমাদের সৈন্যরা ঘটাচ্ছে। নারীর কোনো ধর্ম থাকে না। যখন যার সঙ্গে বিয়ে হয়, সে-ই তার খোদা, সে-ই তার ধর্ম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তোমাদের সেই মানুষটির কাছে থাকতে আপত্তি কোথায়, যিনি রণাঙ্গনের সম্রাট, একটি রাষ্ট্রের ও কোটি মানুষের হৃদয়ের রাজা!

মেয়েগুলো প্রথম দিনটি খুব ছটফট করে কাটায়। তাদের উপর কোনো অত্যাচার করা হয়নি। কোনো ভয়-ভীতিও দেখানো হয়নি। রউইন তাদের রূপ-যৌবন দেখে তার হাই কমান্ডের সেনাপতিদের বললেন, মেয়েগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উত্তম পন্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এমন মূল্যবান মেয়েগুলোকে ভোগ-বিলাসিতার উপকরণ বানিয়ে নষ্ট করা ঠিক হবে না। তিনি মেয়েগুলোকে নিজের কাছে রেখে দেন।

আমাদেরকে সম্ভ্রমের কুরবানী দিতেই হবে- নির্জনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে চার মেয়ের একজন বললো- আমাদের পালানো দরকার।

আর প্রতিশোধ নেয়া উচিত- অন্য একজন বললো।

তার জন্য আমাদেরকে প্রকাশ করতে হবে, আমরা আন্তরিকভাবেই তাদের দাসত্ব মেনে নিয়েছি- প্রথম মেয়ে বললো- তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।

আমার পিতা সুলতান আইউবীর বাহিনীতে আছেন- অন্য একজন বললো- বর্তমানে মিসরে আছেন। আমি তাঁর নিকট থেকে শুনেছি, কাফেরদের মেয়েরা তাদের ধর্ম, জাতি ও ক্রুশের জন্য নিজের ইজ্জত বিলিয়ে আমাদের বড় বড় শাসকদেরকে ক্রুশের অনুগত বানায়। কাউকে হত্যা করতে হলে করায়। আমাদের ফৌজের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তাদের সম্রাটদের নিকট পৌঁছায়।

আমি জানি- অন্য এক মেয়ে বললো- তাদের মেয়েরা সে কাজটাই করে, যা আমাদের পুরুষ গুপ্তচররা শত্রুর দেশে গিয়ে করে থাকে। মেয়েটি কথা বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে গোপনীয়তা বজায় রেখে বললো- যদি তাদের বলে দেই, আমরা তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করবো, তাহলে এমন সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে যে, আমরা এই সম্রাটকে খুন করে ফেলবো।

আর কিছু না হোক, অদ্ভুত পালাবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। একজন বললো।

বল্ডউইন বাহিনীর হামাত দুর্গ অবরোধের রাতের দুরাত আগের ঘটনা। সম্মুখপানে অগ্রসর হতে হতে মুসলিম মেয়েরা খৃস্টান মেয়েদের বললো, আমরা তোমাদের কথা বুঝে ফেলেছি। যে কোনো সময় আমরা ইসলাম ত্যাগ করে তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করে ফেলবো।

বিষয়টা বল্ডউইনকে অবহিত করা হলো। তিনি তাদেরকে মূল্যবান হার উপহার দিয়ে গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু তিনি খৃস্টান মেয়েদের আলাদা ডেকে নিয়ে বললেন- আমি এদের কারো হাতে কিছু পানাহার করবো না। হতে পারে, এটা তাদের কৌশল। মুখের কথায় ধর জাগ গ্রহণের ঘোষণা দিলেই তো হয়ে যায় না। মনের পরিবর্তন সহজ নয়। তোমরা তাদের মন জয় করার চেষ্টা করো। মুসলমানদের ক্রয় করা কঠিন নয়। তবে তাদের উপর ভরসা রাখাও অনিরাপদ। যেসব মুসলমানের ঈমান পাকা, তারা এমন এমন ত্যাগ দিয়ে বসে, আমরা যার কল্পনাও করতে পারি না। এই মেয়েগুলো পালাতে পারবে না। তবে চোখ রাখবে, যেন এরা আমার উপর আক্রমণ না করে বসে।

***

অবরোধের প্রথম রাত। চার মেয়ে আলাদা আলাদা কক্ষে ঘুমিয়ে আছে। বল্ডউইনও তাদের নিয়ে ফুর্তি করার পর ঘুমিয়ে পড়েছেন। ছোট বড় সকল কমান্ডার অচেতনের ঘুম ঘুমাচ্ছে। সৈন্যদেরও কোনো চৈতন্য নেই। জেগে আছে শুধু সান্ত্রীরা আর বল্ডউইনের দেহরক্ষীদের চার-পাঁচজন সৈনিক। হামাতের একটি উপত্যকা চলে গেছে দুর্গের দিকে। সম্মুখে দুর্গ পর্যন্ত খোেলা মাঠ। এই উপত্যকায় অন্তত এক হাজার পদাতিক সৈন্য পা টিপে টিপে হাঁটছে। কমান্ডার তাদেরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা সম্মুখপানে এগিয়ে চলছে। বল্ডউইনের বাহিনীর তাবু এখন সামান্য দূরে।

এই পদাতিক বাহিনী আল-আদিলের সৈনিক। আল-আদিল দুর্গে নেই। তাঁর অনুমান ছিলো, খৃস্টানরা দুর্গ অবরোধ করবে। তাই তিনি তাঁর সবকটি ইউনিটকে বলে রাখেন, অবরোধ হলে ভয় পাবে না। আল আদিল দুর্গপতিকে পরিকল্পনা জানিয়ে রাখেন। সে কারণেই দুর্গপতি অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে তীর বৃষ্টির মাধ্যমে ক্রুসেডারদের হুৎকারের যথার্থ জবার প্রদান করেছেন। দুর্গপতি হলেন আল-আদিলের মামা শিহাব উদ্দীন আল হারেমী।

রাতে আল-আদিলের এক হাজার পদাতিক সৈন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে গেরিলা আক্রমণ চালায়। তারা সর্বপ্রথম তাঁবুগুলোর রশি কেটে ফেলে এবং উপর থেকে খৃস্টানদেরকে বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা করতে শুরু করে। তাঁবুর তলে আটকেপড়া সৈনিকরা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়।

এটা স্থির হয়ে লড়াই করার যুদ্ধ নয়। এটা সুলতান আইউবীর আঘাত করো আর পালাও ধরনের বিশেষ রণকৌশল। এতো বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে এক হাজার সৈনিকের স্থির হয়ে যুদ্ধ করা সম্ভবও নয়। বিভক্ত ক্ষুদ্র দলগুলোর দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন। দু-তিনটি দল ক্রুসেডারদের উট-ঘোড়া ও খচ্চরের বাঁধন খুলে দেয়। এক হাজার সৈনিক চুপিচুপি আসে আর পলকের মধ্যে ডানে-বাঁয়ে বেরিয়ে যায়। খৃস্টান বাহিনীর মধ্যে শোরগোল ও আর্তচীঙ্কার শুরু হয়ে যায় যে, আসমান-যমিন এক সঙ্গে কেঁপে ওঠে।

বল্ডউইনের চোখ খুলে যায়। তার কমান্ডারগণও জেগে ওঠে। তিনি তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখতে পান, কোথাও আগুন জ্বলছে। আল-আদিলের সৈনিকরা তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আক্রমণের সময় তারা আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়েছিলো। এই ধ্বনি মুসলমান মেয়েগুলোও শুনেছিলো। তারা বুঝে ফেলে, এই আক্রমণ মুসলিম সৈন্যদের। এক মেয়ে বলে ওঠে, চলো পালাই। কিন্তু দুটি মেয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে বল্ডউইনকে খুন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়া হলো। বল্ডউইনের দেহরক্ষীরা তার চতুর্পাশ্বে ঘোড়ায় চড়ে দাঁড়িয়ে যায়।

হঠাৎ পায়ের তলার মাটি কাঁপতে শুরু করে প্রচন্ড কম্পন। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ঘোড়র ক্ষুরধ্বনি কানে আসতে শুরু করে। এরা আল আদিলের অশ্বারোহী সৈনিক। মুসলমান ঐতিহাসিকদের মতে তাদের সংখ্যা ছিলো দুহাজার। ইউরোপিয়নদের মতে চার হাজারের অধিক। ধেয়ে এসে এই অশ্বারোহীরা সবদিক ছড়িয়ে গিয়ে এমন তীব্র আক্রমণ করে বসে যে, মুহূর্ত মধ্যে প্রলয় ঘটে যায়। রক্তের বন্যা বইতে শুরু করে। খৃস্টান সৈনিকরা মোকাবেলার অবস্থায় ছিলো না। এখনো তারা বুঝেই ওঠতে পারেনি যে, হচ্ছেটা কী এবং আক্রমণগুলো কোথা থেকে আসছে। তাকবীর ধ্বনি থেকে প্রমাণ মিলছে, তারা মুসলমান। আল-আদিলের আরোহী সৈন্যরা খৃস্টানদের অবরোধ ভেঙে যে-ই মোকাবেলায় আসে, তাকেই ঘোড়ার পদতলে দলিত করে কিংবা তরবারী ও বর্শার নিশানা বানিয়ে দুর্গের দিকে বেরিয়ে যায়। কমান্ডারদের আহ্বানে তারা পেছন দিকে মোড় ঘুরিয়ে আবার ঘোড়া হাঁকায়। তারা পুনরায় ছুটে গিয়ে খৃষ্টানদের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে চলে যায়।

দুর্গের অপর দিকে যে খৃস্টান বাহিনী ছিলো, তাদের উপর আক্রমণ হয়নি। এদিককার হৈ-হুঁল্লোড়, আর্ত চীৎকার আর ঘোড়ার আকাশকাঁপানো হেষারবে তাদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এদিককার খৃস্টান সৈন্যরা ওদিকে পালিয়ে যায়। তাদের হাজার হাজার উট-ঘোড়া ও খচ্চরের রশি খুলে দেয়া হয়েছিলো। তারা এলোপাতাড়ি ছুটতে গিয়ে সৈনিকদের পিষে মারতে এবং আতঙ্কিত করতে শুরু করে। বল্ডউইন বাহিনীর এই অংশটা পালাতে উদ্যত হয়।

ওদিকে মুসলিম মেয়ে চারটি নিখোঁজ হয়ে গেছে। তাদের একজন মুসলিম সৈনিকদের সংবাদ দেয়ার চেষ্টা করছে যে, বল্ডউইন এখানে আছেন। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা সবাই অশ্বারোহী এবং অবিরাম ছুটে চলছে। তারা খৃস্টান বাহিনী থেকে দূরে চলে গেছে। মেয়েটি দু-তিনজন অশ্বারোহীর পেছনে পেছনে চীৎকার করে ছুটেছে। কিন্তু হট্টগোল এতো বেশি যে, তার চীৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। কেউ তার দিকে ফিরে তাকায়নি। মেয়েটি পেছনে অনেক দূরে চলে গেছে।

হঠাৎ এক অশ্বারোহী মেয়েটিকে দেখে ঘোড়া থামায়। মেয়েটি তাকে কম্পিত কণ্ঠে বললো, আমি মুসলমান। আমরা তিনটি মেয়ে খৃস্টান সম্রাটের কজায় আছি।

বল্ডউইনের তাঁবু- যেটি তার সামরিক হেডকোয়ার্টারও ফৌজ থেকে আলাদা এবং দূরে। মেয়েটির ডাকে যে সৈনিক ঘোড়া থামিয়েছে, তিনি একজন কমান্ডার। তিনি মেয়েটিকে নিজের ঘোড়ার পিঠে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যান।

আল-আদিলের এক সালার মেয়েটির পুরো কাহিনী শোনেন। মেয়েটি বল্ডউইনের হেডকোর্টারের ঠিকানা বলে। সালার সেখানে গেরিলা আক্রমণ এবং বল্ডউইনকে ধরার জন্য দুটি সেনাদল প্রস্তুত করেন এবং নিজে তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি বল্ডউইনের তাঁবুটা ঘিরে ফেলেন। সালার বল্ডউইনকে হুংকার দেন। তাঁবুতে অগ্নিসংযোগের হুমকি প্রদান করেন। কিন্তু বল্ডউইন তাঁবুতে নেই। নেই তার দেহরক্ষীরাও। যারা অস্ত্র সমর্পণ করে সম্মুখে এগিয়ে আসে, তারা চাকর, কয়েকটি খৃস্টান ও তিন মুসলিম মেয়ে এবং কয়েকজন সাধারণ সৈনিক। তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। বল্ডউইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। কিন্তু কেউ বলতে পারলো না, লোকটা কোথায় আছেন।

বেগতিক অবস্থায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বল্ডউইন সম্মুখে চলে গেছেন। দীর্ঘক্ষণ পর তিনি জেনে ফেলেছেন, এটা মুসলিম বাহিনীর গেরিলা আক্রমণ-পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি নিজ তাঁবু অভিমুখে ফেরত রওনা হন। সঙ্গে দেহরক্ষী আছে। তবু এলাকা থেকে বেশ দূরে থাকতেই একদিক থেকে একটি ঘোড়া ছুটে এসে তার সম্মুখে  দাঁড়িয়ে গিয়েই বললো, আপনি অন্য কোথাও চলে যান। আপনার তাঁবুতে মুসলিম সৈন্যরা হানা দিয়েছে।

বল্ডউইন সেখান থেকেই ঘোড়ার গতি ফিরিয়ে দেন।

 আল-আদিল সারা রাত আঘাত হানো আর পালিয়ে যাও নীতিতে অভিযান অব্যাহত রাখেন। রাত পোহাবার পর দেখা গেলো হামাতের দুর্গের চতুর্পার্শ্বে খৃস্টানদের লাশ ছড়িয়ে আছে। আহতরা কাতরাচ্ছে। আল আদিলের শহীদদের লাশও আছে। খচ্চর-ঘোড়া ও উট দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। এখানকার কোথাও না বল্ডউইন আছে, না তার জীবিত সৈন্যরা। খৃস্টানরা তাদের রসদও ফেলে গেছে। আল-আদিল তার বাহিনীকে নির্দেশ দেন, দুশমনের ফেলে যাওয়া সম্পদগুলো জড়ো করো এবং তাদের পশুগুলোকেও ধরে আনেনা।

আল-আদিলের এই আক্রমণ বীরত্ব, জযবা ও যুদ্ধবিদ্যার বিচারে প্রশংসনীয় অভিযান ছিলো। কিন্তু সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তার দ্বারা ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। প্রয়োজন ছিলো, দিশেহারা অবস্থায় পলায়নপর খৃস্টানদের ধাওয়া করে তাদের সামরিক শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া। তারপর সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে সেই অঞ্চলে ঢুকে যাওয়া, যেটি খৃস্টানরা জয় করে নিয়েছিলো। যতো বেশি সম্ভব শত্রুসেনাদের বন্দি করাও আবশ্যক ছিলো, যাদেরকে নিজেদের বন্দিদের মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যেতো। কিন্তু সফল গেরিলা আক্রমণ থেকে বড় কোনো সফলতা অর্জন করা আল-আদিলের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কারণ, তার সৈন্য ছিলো কম। ধাওয়া করার শক্তি তার ছিলো না। গেরিলা ও কমান্ডো হামলা চালিয়ে দুশমনকে অস্থির ও আধমরা করা যায়। পরাজিত করে ভূ খন্ড দখল করতে হলে পরিপূর্ণ সামরিক শক্তির প্রয়োজন। আল-আদিল প্রথম কাজটি সাফল্যের সঙ্গে আঞ্জাম দিয়েছেন বটে; কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য কোন সামর্থ তাঁর ছিলো না।

আল-আদিল একটি সাফল্য এই অর্জন করেছেন যে, রামাল্লার পরাজয় তার স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের উপর যে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিলো, সেটি দূর হয়ে গেছে এবং সৈনিকদের জা ও মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে। তাদের মনে বিশ্বাস ও আস্থা জন্মে গেছে, খৃস্টানরা তাদের চে শক্তিশালী নয় এবং যে কোনো ময়দানে তারা খৃস্টানদের পরাজিত করতে সক্ষম। প্রয়োজন শুধু সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করা। এই সাফল্যও অর্জিত হয়ে গেছে যে, তারা হামাতের দুৰ্গটাকে রক্ষা করেছে। অন্যথায় খৃস্টানরা একটি দুর্গও পেয়ে গিয়েছিলো।

আল-আদিল নিজ হেডকোয়ার্টারে বসে আক্ষেপ করছেন। সালারদের আবেগ তাঁর চেয়েও বেশি উত্তেজিত। যদি পর্যাপ্ত সৈন্য থাকতো, তাহলে এ কমান্ডো অভিযানের পর অনেক বড় সাফল্য অর্জন করা যেত এবং বল্ডউইন তার সৈনিকদেরকে জীবিত নিয়ে যেতে পারতো না।

আল-আদিল স্বীয় বড় ভাই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নামে পত্র লিখেন

শ্রদ্ধেয় বড় ভাই এবং মিসর-সিরিয়ার সুলতান! আল্লাহ আপনাকে সালতানাতে ইসলামিয়ার মর্যাদার খাতিরে দীর্ঘায়ু দান করুন। আমি এই আশায় পত্র লিখছি যে, আপনি সুস্থ্য শরীরে নিরাপদে কায়রো পৌঁছে গেছেন। একবার সংবাদ পেয়েছিলাম, আপনি শহীদ হয়ে গেছেন। তারপর খবর এলো, আহত হয়েছেন। আমি ও আমার সালারগণ চিন্তা ও পেরেশানীতে আছি। আপনি বুদ্ধির কাজ করেছেন যে, রাস্তা থেকেই দূত প্রেরণ করে আমাদের অবহিত করেছেন, আপনি নিরাপদ আছেন এবং কায়রো যাচ্ছেন। আমি আশা করছি, আপনি রামাল্লার পরাজয়ে ভেঙে পড়েননি। আমরা ইনশাআল্লাহ এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো, হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করবো এবং বাইতুল মুকাদ্দাস অতিক্রম করে সম্মুখেও এগিয়ে যাবো।

আপনি রামাল্লার পরাজয়ের কারণ নিয়ে চিন্তা করছেন। আমি এর দায় ফৌজের উপর চাপাবো না। আমাদের ভাইয়েরাই আমাদেরকে সেইদিন পরাজয়ের পথে নিক্ষেপ করেছে, যেদিন তারা আমাদের বিপক্ষে সারিবদ্ধ হয়েছিলো। দুই ভাই যখন আপসে যুদ্ধ করে, তখন তাদের শত্রুরা সহমর্মিতার আড়ালে একজনকে অপরজনের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে থাকে। রাজত্বের নেশা আমাদের ভাইদেরকে অন্ধ করে দিয়েছে। সালতানাতে ইসলামিয়ার যে সম্পদ ছিলো, গৃহযুদ্ধে সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বাহিনীর ভালো ভালো অভিজ্ঞ সৈন্যগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের ফৌজ আর আমরা একই খেলাফতের সৈনিক ছিলাম। কিন্তু তাদের সেই ফৌজ শুধু এ কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে যে, তাদের কতিপয় লোক সিংহাসনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো। যে জাতির নেতৃস্থানীয় লোকদের মধ্যে শিহাসনের লোভ সৃষ্টি হবে, সেই জাতিকে তারা দলে দলে ও গোত্রে পাত্রে বিভক্ত করে আপসে যুদ্ধ করাবে। আমাদেরকে এদিকেও দৃষ্টি খতে হবে, যেনো জাতি বিভেদ-বৈষম্যের শিকার না হয়। আমাদের সিংহভাগ সৈন্য গৃহযুদ্ধে বিনষ্ট হয়েছে। নতুন ভর্তি দ্বারা আমরা সেই অভাব পূরণ করেছি এবং পরাজয়বরণ করেছি। রণাঙ্গন থেকে বিশৃংখলভাবে পলায়নকারী সব সৈন্যই নতুন ছিলো।

রামাল্লার পরাজয়ের পরপরই আমি এবং আমার সালারগণ প্রমাণ করে দিয়েছি, আমাদের ফৌজ পরাজিত হয়নি। আমার নিকট সেই পদাতিক ও অশ্বারোহী যোদ্ধারাই ছিলো, আপনি যাদেরকে আমার কমান্ডে, রেখে গিয়েছিলেন। আপনি আমাকে রিজার্ভ রেখেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা এত দ্রুত পাল্টে যায় যে, আপনার কোনো নির্দেশ আমার কাছে এসে পৌঁছেনি। আমি এ-ও জানতে পারিনি, সম্মুখে কী হচ্ছে। আর আমি আপনাকে কি-ইবা সাহায্য করতে পারতাম। পেছনে সরে আসা এক কমান্ডার- যে ডান পার্শ্বে ছিলো আমাকে উদ্বেগজনক সংবাদ জানালো এবং পরামর্শ দিলো, আমি যেনো আমার বাহিনীকে ব্যবহার না করি এবং আক্রমণ করে ভুল না করি। আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে বিবেক অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমি আমার বাহিনীকে হামাত অভিমুখে রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করি।

আমার বাহিনীর মনোবল ভেঙে গিয়েছিলো। আমি দুআ করতে থাকি, যেনো দুশমন আমার সামনে এসে পড়ে আর আমি আমার সৈনিকদের চেতনায় জীবন ফিরিয়ে আনতে পারি। আমি পেছনে লোক রেখে এসেছিলাম। হামাতের পার্বত্য অঞ্চলের সংবাদদাতারা আমাকে মূল্যবান সংবাদ জানালো, বল্ডউইন আমার পশ্চাদ্ধাবনে আসছে। আমি দুর্গে আছি মনে করে তিনি তার পুরো বাহিনীকে হামাতের দুর্গ অবরোধের জন্য নিয়ে আসেন। কিন্তু আমি আপনারই কৌশল মোতাবেক পাহাড়ের অভ্যন্তরে সৈন্যদের লুকিয়ে রাখি এবং দুর্গপতিকে আমার পরিকল্পনা ও পরিস্থিতি অবহিত করে রাখি। আল্লাহ আমার আশা পূর্ণ করেছেন। আমার সৈন্যরা বল্ডউইনের বাহিনীর উপর যাদের সংখ্যা আমার চেয়ে দশগুণ বেশি। অত্যন্ত বীরোচিত ও সফল কমান্ডো আক্রমণ চালায়। এটি আপনার সেই বাহিনীর কমান্ডো অভিযান, যাদের সম্পর্কে ইতিহাস বলবে, এরা পরাজিত হয়েছিলো। আমি মনে করি, এই কমান্ডো অভিযানের কাহিনী লিপিবদ্ধ করে রাখা দরকার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলতে না পারে, পরাজয়ের পর জাতি মরে যায়।

পরদিন রাত পোহাবার পর আমরা যে দৃশ্যটা দেখলাম, যদি আপনি দেখতেন, তাহলে রামাল্লার পরাজয়ের সব বেদনা ভুলে যেতেন। আমার আফসোস, বল্ডউইন আমার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে গেছে। আমি তাকে ধরতে পারিনি। এই মুহূর্তে আমি একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কাতের দ্বারা পত্র লেখাচ্ছি। ঐ যে আমি হামাতের দুর্গটা দেখতে পাচ্ছি। তার উপর মিসর ও সিরিয়ার পতাকা উড়ছে। দুর্গের চতুর্পার্শ্বে খৃস্টানদের লাশ ছাড়া আর যা দেখা যাচ্ছে, তাহলে হাজার হাজার শকুন, যারা লাশগুলো খাবলে খাচ্ছে। আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনের দল নামছে। কোনো কোনো স্থান থেকে ধোঁয়া উঠছে। এই আগুন গত রাতে আমার গেরিলারা লাগিয়েছিলো। বল্ডউইনের জীবিত সৈন্যরা যেরূপ বিক্ষিপ্ত ও জ্ঞানশূন্য অবস্থায় পলায়ন করেছে, তাতে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সে পাল্টা আক্রমণ করতে পারবে না। তথাপি আমি তার জন্য প্রস্তুত আছি।

বর্তমানে আমার হাতে যে পরিমাণ সৈন্য আছে, যদি আরো এ পরিমাণ সৈন্য থাকতো, তাহলে আমি খৃস্টানদের ধাওয়া করতাম এবং পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করে দিতাম। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমার সালার, কমান্ডার ও সকল সৈন্যের যুদ্ধের জ্যুবা চাঙ্গা হয়ে গেছে। আমি জানি, আপনি আরামে বসে নেই। মিসর পৌঁছেই আপনি নতুন ভর্তি ও নববিন্যাসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আপনি শান্তমনে প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমি গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখবো। আমি দুশমনকে কোথাও সুস্থির বসতে দেবো না। এই প্রক্রিয়ায় আমি কোনো অঞ্চলের উপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না বটে; কিন্তু আপনি প্রস্তুতির সময় পেয়ে যাবেন। আমি দামেশকে ভাই শামসুদ্দৌলাকে বার্তা প্রেরণ করেছি, যেন তিনি আমার জন্য কয়েক ইউনিট সৈন্য ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি প্রেরণ করেন। হাবে আল-মালিকুস সালিহকে পত্র দিয়েছি, যেন তিনি চুক্তি মোতাবেক আমাকে সাহায্য দেন। আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি আপনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি ও আমার সালারগণ আপনার কুশল ও তৎপরতা সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমি তারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমাদের সকলকে তারই নিকট ফিরে যেতে হবে।

-ইতি আল-আদিল।

লেখা শেষ হওয়ার পর আল-আদিল পত্রখানা পাঠ করিয়ে শোনেন। তারপর তাতে স্বাক্ষর করে দূতের হাতে দিয়ে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেন।

***

কায়রোর আকাশে হতাশার কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এখন কায়রো। নগরে-প্রত্যন্ত অঞ্চলে সকলের মুখে একটি-ই শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে পরাজয়, পরাজয়, পরাজয়। সংশয় সন্দেহও দিন দিন বেড়ে চলছে। পরাজয়ের মতো দুর্ঘটনা এবং অজ্ঞাত কারণ ঘটনাবলি এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে, যার থেকে গুজব জন্ম নিয়ে দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিটা সৃষ্টি হয়ে গেছে কায়রোতে এবং তার আশপাশের অঞ্চলসমূহে, যেখানে শত্রুর নাশকতা কর্মী এবং গুপ্তচরও আছে, যারা ইউরোপের বাসিন্দা। মিসরেরই মুসলমান অধিবাসী। তারা খৃস্টানদের বেতনভোগি হয়ে কাজ করছে। তাদের দায়িত্ব, প্রচার করে বেড়ানো যে, খৃষ্টানদের এতোবেশি সামরিক শক্তি আছে, যার সম্মুখে পৃথিবীর কোনো শক্তির পঁাড়ানোর ক্ষমতা নেই। সুলতান আইউবীর পরাজিত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়ে যায় যে, এরা অথর্ব ও বিলাসী বাহিনী। যেখানে যায় লুট করে ফিরে এবং হাতে পেলেই মেয়েদের সম্ভ্রমহানী ঘটাতেও কুণ্ঠিত হয় না। সুলতান আইউবীর সামরিক যোগ্যতার বিরুদ্ধেও প্রচারণা শুরু হয়ে যায়।

একজন মানুষ যতো বেশি সরল হয়, গুজব ও আবেগময় বক্তব্য দ্বারা সে ততোবেশি প্রভাবিত হয়। সর্বত্র আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এই কাজটা বেশি করছে নতুন ভর্তি হওয়া সৈন্যরা। আর সাধারণ মানুষ এই অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠছে। আল-আদিল ঠিকই লিখেছেন, রাজত্বের লোভী মুসলিম আমীরগণ নিজেদেরকে এবং সুলতান আইউবীর বাহিনীকে যদি গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে ধ্বংস না করতো, তাহলে নতুন সৈনিকদের দ্বারা যুদ্ধ করাবার ঝুঁকি মাথায় নিতে হতো না। একটি ভুল ভর্তিসংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তাও করেছিলেন যে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গনীমতের প্রলোভন দেখিয়েছিলেন। অথচ, প্রয়োজন ছিলো জিহাদের ফযীলত, গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে মানুষকে সেনা বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং একথা জানানো যে, তাদের শত্রু কারা, তাদের প্রকৃতি ও লক্ষ্য কী?

রামাল্লায় পরাজয়বরণ করে ফিরে আসা এই সৈন্যরা একাকি কিংবা দু দুজন, চার-চারজনের ছোট ছোট দলে মিসরের সীমানায় প্রবেশ করছিলো। কেউ পায়ে হেঁটে কেউবা উট-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। কোন সৈনিক যখন লোকালয়ে প্রবেশ করছে, জনতা তাকে ঘরে নিয়ে পানাহার করাচ্ছে এবং যুদ্ধের কাহিনী জিজ্ঞাসা করছে। নতুন ও অনভিজ্ঞ বলে তারা পরাজয়ের গ্লানি দূর করার লক্ষ্যে কমান্ডারদেরকে অযোগ্য ও বিলাসী আখ্যায়িত করছে এবং খৃস্টান বাহিনীর শক্তির বর্ণনা দিচ্ছে। কারো কারো কথায় প্রমাণিত হচ্ছিলো, খৃস্টানদের কাছে অলৌকিক এমন কোন শক্তি আছে, যার ফলে তারা যেখানেই যাচ্ছে বিজয় ছিনিয়ে আনছে।

দু-তিনজন ঐতিহাসিক- যাদের মধ্যে আরনল্ড অন্যতম- লিখেছেন, খৃস্টানরা একটি গোপন অস্ত্র নিয়ে এসেছিলো এবং সেটিই তাদের বিজয়ের কারণ হয়েছিলো। সেই গোপন অস্ত্রটা কী, ইতিহাসে তার উল্লেখ নেই। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের রোজনামচায় এরূপ কোনো অস্ত্রের উল্লেখ নেই। তৎকালের কাহিনীকারগণও এই গোপন অস্ত্র সম্পর্কে নীরব। সম্ভবত অস্ত্রটি হলো খৃস্টানদের প্রোপাগান্ডার অস্ত্র, যাকে মিসর ও অন্যান মুসলিম অঞ্চলে খৃষ্টানদের আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো। বোধ হয় এই প্রোপাগান্ডা কৌশলকেই ঐতিহাসিকরা অস্ত্র বলে অভিহিত করেছেন।

এই গোপন অস্ত্র আসলে প্রোপাগান্ডাই ছিলো। তার উদ্দেশ্য ছিলো চারটি। প্রথমত, জানগণের চোখে সেনা বাহিনীকে অপদস্ত করা, যাতে সুলতান আইউবীর ফৌজ জনগণের সহযোগিতা ও নতুন ভর্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের মনে খৃস্টানদের ভীতি সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত, সুলতান আইউবীর প্রতি দেশবাসীর আস্থা নষ্ট করা। চতুর্থত, আরো কিছু লোক রাজত্বের দাবিদার হয়ে যাবে এবং পুনর্বার গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া যাবে।

সুলতার আইউবী দুশমনের এই অস্ত্র সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। তাই কায়রো পৌঁছেই তিনি গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান, নগর প্রধান গিয়াস বিলবীস ও তাদের নায়েবদেরকে ডেকে বলে দেন, দুশমনের এই গোপন তৎপরতা প্রতিরোধের জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং আমাদের গুপ্তচর ও সংবাদদাতাদেরকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে জোরদারভাবে কাজে লাগিয়ে দিন।

কিন্তু জনগণ জানতে চায় এই পরাজয়ের কারণগুলো কী, এর জন্য দায়ী কে?

***

রামাল্লা থেকে কায়রোর দূরত্ব অনেক দীর্ঘ এবং সফর অত্যন্ত কঠিন ও বিপজ্জনক। পথে পাহাড়ি এলাকাও আছে, বালির টিলা এবং মরুভূমিও আছে, যে ভূমি পথভোলা পথিকের রক্ত চুষে খেয়ে থাকে। রামাল্লায় পরাজিত হয়ে মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া সুলতান আইউবীর সৈনিকগণ এই দীর্ঘ ও বিপজ্জনক পথেই যাত্রা শুরু করে। তাদের প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য ছিলো ভয়ংকর। যারা মরুভূমির সফরে অভ্যস্ত ছিলো না, তারা কোথাও পড়ে গেলে আর উঠতে পারতো না। মৃতদের লাশ মাত্র একদিন নিরাপদ থাকতো। একদিন পরই মরু শিয়াল আর নেকড়েরা তাদের হাড়-মাংস ছিন্নভিন্ন করে ফেলতো। দলবদ্ধভাবে চলা সৈনিকরা এই পরিণতি থেকে রক্ষা পেতো। যারা উট-ঘোড়া ও খচ্চরে আরোহণ করে চলতো, তাদের জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশি ছিলো।

এমনই একটি ক্ষুদ্র দল পথ চলছে। তারা উট ও ঘোড়ার আরোহী। পথে পথে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নিঃসঙ্গ সঙ্গীরা তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। এক পর্যায়ে দলটি ত্রিশ-চল্লিশজনের বড়সড় একটি কাফেলায় পরিণত হয়ে যায়। তারা সেই ভয়ানক মরুদ্যান দিয়ে পথ চলছে, যাকে বর্তমানে সিনাই মরুভূমি বলা হয়। দলবদ্ধতার কারণে তাদের মনোবল অটুট। কিন্তু দিগন্ত পর্যন্ত পানির চিহ্ন চোখে পড়ছে না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত রণাঙ্গন ত্যাগ করে আসা এক একজন, দুদুজন এবং তিন তিনজন সৈনিক পা টেনে টেনে হাঁটছে। তারা একে অন্যের কোনোই সাহায্য করতে পারছে না। শুধু এতোটুকু পারছে, কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার কোনো একজন সঙ্গী তাকে। বালিতে পুতে রাখছে।– আরোহীদের এই কাফেলাটি এগিয়ে চলছে। এখন সম্মুখে আছে দেয়াল, খুটি এবং গৃহের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা, মাটির উঁচু-নীচু টিলা। এক সৈনিক একটি টিলার উপর একজন মানুষের মাথা ও কাঁধ দেখতে পায়। কিন্তু পরক্ষণেই লোকটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সৈনিক তার সঙ্গীদের বললো, ও পর্যন্ত গিয়ে নেমে যাবো। ওখানে অন্য কিছু আছে। ক্ষুৎপিপাসা ও ক্লান্তিতে কাফেলার অধিকাংশ সদস্যেরই দিশেহারা অবস্থা। এতোক্ষণ তারা যুদ্ধের আলোচনা করে চলছিলো। কিন্তু এখন আর কারো মুখ থেকে কথা সরছে না। তাদের পশুগুলোর মধ্যে এখনো প্রাণ আছে। তারা ভালোভাবেই হাঁটছে।

এক মাইল দূরের টিলা শত ক্রোশের দূরত্বে পরিণত হয়ে যায়। কাফেলা সেখানে পৌঁছে যায় এবং দুটি টিলার মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সকলে বাহনের পিঠ থেকে অবতরণ করে। পশুগুলোকে ছায়ায় ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি উঁচু টিলার নীচে বসে পড়ে।

লোকগুলো বসে সবেমাত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ একটি টিলার আড়াল থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে তাদের সম্মুখে এসে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে যায়। লোকটি মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা পোশাকে আবৃত। পোশাকটি কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বিত চৌগা। মুখে কালো দাড়ি। নিপুণভাবে ছাটা খাটো দাড়ি। হাতে একটি লাঠি, যে লাঠি সাধারণত আলিম, বুযুর্গ-দরবেশ ও খতীবদের হাতে থাকে। লোকটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কাফেলার লোকজনও একদম নীরব। খানিক পর একজন ক্ষীণ কণ্ঠে মন্তব্য করে- হযরত খিজির বোধ হয়।

ইনি এই পৃথিবীর মানুষ নন- আরেকজন ফিস্ ফিস করে বললো।

কাফেলার লোকদের মনে ভয় ধরে যায়। তারা এমনিতেই সন্ত্রস্ত। এই রহস্যময় লোকটি তাদের ভীতি বাড়িয়ে তুলেছে। আপনি কে? জিজ্ঞাসা করার সাহস কারো নেই। এই নিষ্ঠুর মরু অঞ্চলে এ প্রকৃতির কোনো মানুষের উপস্থিতি বিস্ময়করই বটে। সৈনিক হলে ভয়ের কিছু ছিলো না।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটি মেয়ে তার এক পার্শ্বে এমনভাবে দাঁড়িয়ে যায়, যেনো মেয়েটি তার দেহের ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে। পরক্ষণে আরো একটি মেয়ে একইভাবে তার অপর পার্শ্বে আত্মপ্রকাশ করে। নিতান্ত বিস্ময়কর ও অলৌকিক ব্যাপারই বটে। কাফেলার ভীতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মেয়ে দুটো আপাদমস্তক পোশাকাবৃত। চোখের উপর জালের ন্যায় পাতলা কাপড়। হাতগুলোও বোরকাসম চাদরে ঢাকা।

তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক- দরবেশ মুখ খোলে আমি কি আরো এগিয়ে এসে তোমাদেরকে আমার পরিচয় বলবো?

সকলে পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর সেই লোকটি ও, মেয়ে দুটোকে নিরীক্ষা করে দেখে। একজন ভয়জড়িত কণ্ঠে বললো- আপনি আমাদের নিকটে এসে বলুন আপনি কে এবং আমাদের জন্য আপনার কী নির্দেশ। আমরা আপনার নির্দেশ পালন করবো।

লোকটি এমনভাবে হেঁটে তাদের নিকটে চলে আসে, যে হাঁটা মানুষ হাঁটে না। লোকটির চলন ও ভাবভঙ্গিতে গাম্ভীর্য ও প্রভাব বিদ্যমান। মেয়ে দুটোও তার পেছনে পেছনে এগিয়ে আসে। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য কাফেলার সকলে দাঁড়িয়ে যায়। তারা সন্ত্রস্ত। লোকটি টিলাটা পেছনে করে বসে পড়ে। মেয়েরাও দুপার্শ্বে বসে যায়। জালের মধ্যদিয়ে তাদের চক্ষু দেখা যাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে, খুবই রূপসী মেয়ে। কিন্তু তাদের চোখে চোখ রাখার সাহস কারো হচ্ছে না। লোকটির এবং মেয়ে দুটোর পোশাক ধুলামলিন। বোঝা গেলো, তারাও সফরে আছে।

***

আমিও সেখান থেকে এসেছি, যেখান থেকে তোমরা এসেছে দরবেশ মিসরের পালিয়ে আসা সৈনিকদের বললো- পার্থক্য শুধু এটুকু যে, তোমরা যেখানে যাচ্ছে, সেটি তোমাদের আবাস আর আমার আবাস সেটি ছিলো, যেখান থেকে আমি এসেছি।

লোকটির কণ্ঠে হতাশা।

আমরা কীভাবে বিশ্বাস করবো, আপনি মানুষ?- এক সৈনিক জিজ্ঞাসা করে। আমরা তো আপনাকে আকাশের প্রাণী মনে করছি? 

আমি মানুষ- লোকটি উত্তর দেয়- আর এরা দুজন আমার কন্যা। আমিও তোমাদের ন্যায় রামাল্লা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার মুরশিদ যদি আমার প্রতি দয়া না করতেন, তাহলে খৃস্টানরা আমাকে হত্যা করে ফেলতো এবং আমার মেয়ে দুটোকে ছিনিয়ে নিতো। এ আমার মুরশিদের মাজারের বরকত। আমি রামাল্লার বাসিন্দা। শৈশব থেকেই আমার ধর্মজ্ঞান অর্জনের আকাঙ্খ ছিলো। আমি বহু মসজিদের ইমামের অনেক খেদমত করেছি এবং তাদের থেকে ইলম হাসিল করেছি। আল্লাহ তাঁর রাসূলের ধর্মের অনুসারীদের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করে থাকেন। এক রাতে আমি স্বপ্নে নির্দেশ পাই, তুমি বাগদাদ চলে যাও এবং সেখানকার খতীবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করো।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। সঙ্গে কিছুই ছিলো না। পায়ে হেঁটে রওনা হই। পিতা-মাতা নিতান্ত গরীব ছিলেন। সঙ্গে পানি রাখার জন্য একটি মশকও ছিলো না। ইলমের পিপাসা এই সহায় সম্বলহীন অবস্থায় আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। রওনার সময় সকলে মন্তব্য করলো, ছেলেটা পথেই মরে যাবে। বাবা-মা খুব কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু আমি তারপরও বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার পর এই আশায় কোথাও পড়ে থাকতাম যে, এখানেই মরে বাঁচবো। কিন্তু চোখ খুলে দেখতাম, পার্শ্বে পানির একটি পাত্র ও কিছু খাবার পড়ে আছে। প্রথমবার খুব ভয় পেয়েছিলাম। প্রথমে বিষয়টা জিন-পরীদের কারসাজি মনে করেছিলাম। কিন্তু রাতে স্বপ্নে ইঙ্গিত পেলাম, এটা কোনো এক মুরশিদের কারামত। আমি জানতে পারলাম না, এই মুরশিদ কে এবং কোথায় আছেন। আমি পানাহার করে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে জাগ্রত হয়ে দেখি, পানির পেয়ালাও নেই, খাবারের পাত্রও নেই।

বাগদাদ পৌঁছতে পৌঁছতে দুটি নতুন চাঁদ উদিত হয়েছে। সফর অনেক দীর্ঘ ছিলো। প্রতিরাতেই আমি প্রথম দিনের ন্যায় খাদ্য-পানীয় পেতে থাকি। আমি বাগদাদের জামে মসজিদে গিয়ে পৌঁছি। খতীব আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই বললেন, আমি তোমার পথের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি আমাকে তার হুজরায় নিয়ে গেলেন। আমি বিস্মিত হলাম, যে দুটি পাত্র করে প্রতিরাতে আমার নিকট খাদ্য-পানীয় পৌঁছতো, সেগুলো হজরতের হুজরায় পড়ে আছে। তিনি বললেন, আল্লাহ হযরত মূসাকে (আ.) সাহায্য করতে চাইলেন। তিনি নীলনদকে নির্দেশ দিলেন, পথ দিয়ে দাও। নদীর ডানের পানি ডানে, বাঁয়ের পানি বাঁয়ে সরে গেলো। মধ্যখানটা শুকিয়ে রাস্তা হয়ে গেলো। মূসা (আ.) বেরিয়ে গেলেন। ফেরাউন তাঁকে ধাওয়া করতে গিয়ে যখন নদীর রাস্তায় নেমে পড়লো, অমনি দুদিকের পানি একত্রিত হয়ে তাকে ডুবিয়ে মারলো। ফেরাউন আল্লাহর গজবে নিপতিত হলো।

খতীব বললেন, আমরা সেই সত্ত্বার অনুগত, তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর যে বান্দা তার ইলমের প্রেমে পাগল হয়, যেমনটি তুমি হয়েছে; তাকে তিনি মরুভূমিতে পিপাসায় মরতে দেন না; নদী-সমুদ্রেও ডুবিয়ে মারেন না। সেই মহান সত্ত্বাই তোমাকে কয়েক মাসের কঠিন পথ পার করিয়ে নিরাপদে এখানে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে আদেশ করেছেন, তোমার বক্ষে যে ইলম আছে, সব ঐ বালকটির বক্ষে স্থানান্তরিত করো এবং তোমার খেদমতের জন্য যে দুটি জিন নিয়োজিত রেখেছি, তাদেরকে বললো, পথে পথে ছেলেটাকে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছিয়ে দিক। আমি মহান আল্লাহর আদেশ পালন করেছি। প্রতিরাতে তোমার জন্য এখান থেকে খাবার যেতো। তুমি বিস্মিত হয়ো না বেটা!, অস্থিরও হওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক কম লোকেরই হৃদয়ে ইলমের বাতি প্রজ্বলিত হয়ে থাকে, যার আকাঙ্খা তুমি নিয়ে এসেছে। তোমার নিয়ত ভালো। অন্তরে আল্লাহর খোশনুদির তামান্না আছে। এই তামান্না যার থাকে, সমগ্র মানুষ ও জিন তার গোলাম হয়ে যায়।

জিনরা কি আপনার গোলাম? এক সৈনিক জিজ্ঞেস করে।

তা নয়- দরবেশ জবাব দেয়- কেউ কাউকে গোলাম বানাতে পারে না। আমরা সকলে এক আল্লাহর বান্দা। উঁচু-নীচু, ধনী-দরিদ্য বিবেচিত হয় না। ঈমানের পরিপক্কতা আর দুবর্লতা দ্বারা মানুষের মর্যাদা পরিমাণ করা হয়।

লোকটির বক্তব্যে এমন এক যাদু, যা সকলকে মুগ্ধ করে তোলে। সকলে তন্ময় হয়ে তার বক্তব্য শুনছে। সে বললো- বাগদাদের খতীব আমার হৃদয়কে ইলম দ্বারা আলোকিত করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে বিবাহও করিয়েছেন। সেখানেই আমার এই দুটি কন্যা জন্ম লাভ করে। বহু সাধনার পর আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে দু-তিনটি ভেদ লাভ করি। এক রাতে খতীব আমাকে বললেন, এবার যাও। গিয়ে সেই লোকগুলোর সেবা করো, যারা ইলমকে সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য কবরে ঘুমিয়ে আছে। তিনি আমাকে রামাল্লায় নিজ বাড়িতে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। আমাকে দুটি উট দিলেন। পাথেয় দিলেন এবং বললেন, অন্তরে কখনো পাপের কল্পনা জাগ্রত হতে দেবে না। রামাল্লা পৌঁছার পর এক রাতে তুমি অনিচ্ছায় শয্যা থেকে উঠে হাঁটা দেবে। সম্ভবত তোমাকে বেশি দূর যেতে হবে না। তোমার পা আপনা-আপনি থেমে যাবে। সেটি একটি পবিত্র স্থান হবে। সেটিকে তুমি আস্তানা বানিয়ে নেবে। তবে আমি একটি সময়- যা এখনো ভবিষ্যতের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে দেখতে পাচ্ছি। সেই সময়টায় পাপ হবে এবং তোমাকে অন্যের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে। বোধ করি, তোমাকে হিজরতই করতে হবে।

আমি যখন স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে সফরে ছিলাম, তখন সূর্যের প্রখরতা আমার জন্য শীতল হয়ে গিয়েছিলো। যে মরুভূমিতে পানির নাম-চিহ্ন থাকার কথা নয়, আমি সেখানেও অনায়াসে পানি পেয়ে যেতাম। রামাল্লা পৌঁছে দেখি, আমার পিতা-মাতা দুজনই মারা গেছেন। আমার স্ত্রী বিরান ঘরটিকে ঝেড়ে-মুছে বাসযোগ্য করে তোলে। আমি বিদ্যার সাগরে ডুবে থাকি। ধীরে ধীরে মেয়েগুলো বেড়ে ওঠে। আল্লাহ তাদের মাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে যান। মেয়েরা আমার ঘর-গেরস্থলির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এক রাতে আমি গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ এমনভাবে আমার চোখ খুলে যায়, যেনো কেউ আমাকে ডেকে তুলেছে।

আমি ধড় মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে যাই। বাগদাদের খতীবের কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়, তুমি আপনা-আপনি জেগে উঠবে এবং কোনো ইচ্ছা-পরিকল্পনা ছাড়াই হাঁটতে শুরু করবে। তা-ই হয়েছে। আমার মনে কোনো ইচ্ছা, কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। লোকালয়ও ত্যাগ করে চলে আসি। কোথাও কোথাও মনে হতো, কে যেনো আমার সামনে সামনে হাঁটছে। জানি না, এটা নিছক কল্পনা ছিলো, না বাস্তব।

আমি হাঁটতে থাকি। জানি না তোমরা সেই জায়গাটি দেখেছো কিনা, যেখানে বেশ গভীরতা আছে এবং সেই গভীরতায় নদী প্রবাহিত হচ্ছে। খৃস্টানদের ফৌজ সেখানেই লুকিয়ে ছিলো। আমি শুনেছি, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নাকি মাটির শেষ স্তরে লুকিয়ে থাকা দুশমনকেও দেখতে পান। কিন্তু ওখানে আল্লাহ তাঁর চোখের উপর এমন আবরণ ফেলে দিয়েছিলেন যে, তিনি এটুকুও জানতে পারলে না, তিনি নিজে কোথায় আছেন। খৃস্টান বাহিনী তোমাদের বাহিনীকে ফাঁদে নিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ চালায়। পরে তোমাদের কী পরিণতি ঘটেছিলো, তা তো তোমাদের জানা আছে।

সেই যুদ্ধের বছর কয়েক আগে এক রাতে আমি আপনা-আপনি কিংবা কোন অদৃশ্য শক্তির জোরে সেই গর্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম এবং এক স্থানে আমার পা আটকে গিয়েছিলো। জোছনা রাত ছিলো। আমি একটি কবর দেখতে পেলাম, যার চার পার্শ্বে দুহাত উঁচু পাথরের দেয়াল। আমি পরীক্ষার জন্য অন্য একদিকে পা বাড়াতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি আপনা আপনি কবরের দিকে ঘুরে গেলাম এবং পাথরের দেয়ালের অভ্যন্তরে যাওয়ার যে পথ ছিলো, তাতে ঢুকে পড়ি। ফাতেহা পাঠের জন্য আমার দুহাত আপনা-আপনি উপরে উঠে যায়। মনে হলো, জায়গাটার জোছনা বেশি ফকফকা। মনে জাগলো, খতীব আমাকে এ স্থানটির কথা-ই বলেছিলেন। আমি কবরের উপর হাত রেখে বললাম, আমি গোলামটার জন্য নির্দেশ কী? কোন উত্তর আসলো না। মনে প্রতীতি জন্মালো, কয়েকটা রাত সেখানেই কাটিয়ে দেই। সকালে নদীতে গিয়ে অজু করে এসে নামায আদায় করি। তারপর যখন সেখান থেকে বিদায় নিলাম, তখন আমার মধ্যে এক রকম মাদকতা বিরাজ করছিলো, যেনো আমি ধনভান্ডার পেয়ে গেছি।

তারপর উক্ত কবর থেকে আমার প্রতি এমনভাবে দিক-নির্দেশনা আসতে শুরু করে যে, আমি কোনো শব্দ শুনতাম না। অন্তরে যা কিছু জাগ্রত হতো, তা-ই আমার দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হতো। আমি কবরটির দেয়াল আরো উঁচু করে উপরে গম্বুজ নির্মাণ করে দেই। আমি অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত গিয়েছি। হাল্ব-মসুল ছাড়াও বাইতুল মোকাদ্দাসও গিয়েছি। কিছুদিন যাবত উক্ত মাজার থেকে যে সব নির্দেশনা পাচ্ছিলাম, সেগুলো সুখকর ছিলো না। এটি যে বুযর্গের মাজার, তার আত্মা ছটফট করছে বলে মনে হচ্ছিলো। আমি কবরের উপর সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছিলাম। এক রাতে হঠাৎ চাদরটি ফড় ফড় শব্দ করে ওঠে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চাদরের উপর হাত বুলিয়ে বললাম- আদেশ করুন মুরশিদ!

মাজারের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে- তুমি কি দেখছো না মুসলমান মদপান করছে? তুমি মুসলমানদেরকে মদের অপকারিতা সম্পর্কে সতর্ক করো।

আমি তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। কিন্তু মদ পানকারীরা ছিলো আমীর ও শাসক গোষ্ঠী। আমার আওয়াজ তাদের কানে পৌঁছেনি।

তারপর আরেক রাত মাজারের চাদর ফড়ফড় করে ওঠে আমাকে বললো, মিসর থেকে আসা ফৌজ মুসলিম বসতিগুলোতে মুসলমানদের সঙ্গে সেই আচরণই করছে, যেমনটি খৃস্টানরা করে থাকে। সে সময় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ দামেশকেও ছিলো। তাছাড়া দামেশক থেকে হাব পর্যন্ত এবং সেখান থেকে রামাল্লা পর্যন্ত স্থানে স্থানে তারা অবস্থান করছিলো। সেই ফৌজের কমান্ডাররা মুসলমানদের ঘরে মূল্যবান যতো সম্পদ পেয়েছে, লুট করে নিয়ে গেছে। তারা পর্দানশীন মুসলিম নারীদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করেছে। কমান্ডারদের দেখাদেখিতে সৈনিকরাও লুটপাট ও নারীর সম্ভ্রমহানী শুরু করে দিয়েছিলো। এই রিপোর্টও আছে যে, তোমাদের সালার ও কমান্ডারগণ মুসলিম মেয়েদের অপহরণ করে নিজেদের তাবুতে নিয়ে রেখেছিলো। মাজার থেকে আদেশ আসে, তুমি সুলতান আইউবীর নিকট গিয়ে তাঁকে বলো, এই ফৌজ বাগদাদের খেলাফতের- মিসরের ফেরাউনদের নয়। কিন্তু যদি তারা এসব অপরাধ অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের পরিণতি ফেরাউনদের মতোই হবে।

সে সময়ে সুলতান আইউবী হাবের সন্নিকটে এক স্থানে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলেন। আমি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তাঁর দেহরক্ষীরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি সুলতানের সঙ্গে কেননা সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছো? বললাম, আমি রামাল্লা থেকে এসেছি। এবং একটি বার্তা নিয়ে এসেছি। তারা জিজ্ঞাসা করলো, কার বার্তা? আমি বললাম, এই পয়গাম যার, তিনি জীবিত মানুষ নন। রক্ষীরা খিল খিল করে হেসে ওঠে। তাদের কমান্ডার উচ্চকণ্ঠে বললো, পাগল কোথাকার! সুলতান আইউবীর জন্য কবরের বার্তা নিয়ে এসেছে, না? একজন বললো, লোকটি শেখ সান্নারের প্রেরিত ঘাতক। সুলতানকে হত্যা করতে এসেছে। একে আটক করো। কেউ বললো, খৃস্টানদের চর, মেরে ফেলো। অগত্যা গ্রেফতার এড়াবার জন্য আমি প্রকাশ করলাম, আমি পাগল। আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, সুলতান আইউবীর রক্ষীদের এক কক্ষে দুটি মেয়ে বসে আছে।

আমরা তো আমাদের ফৌজের সঙ্গে কোনো নারী দেখিনি! এক সৈনিক বললো।

 তারা যখন দামে গিয়েছিলো, তুমি কি তখন থেকেই ফৌজের সঙ্গে আছো? লোকটি জিজ্ঞাসা করে।

আমরা সবাই এই প্রথমবার এসেছি- সৈনিক জবাব দেয়। আমরা নতুন সৈনিক।

আমি পুরাতন সৈনিকদের কথা বলছি- লোকটি বললো- সে ফৌজের কমান্ডার ও সৈনিকরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়ে গেছে। তোমরা নতুন। এখনো পাপ করোনি। সে কারণেই তোমরা জীবিত ও নিরাপদে ফিরে এসেছে। যারা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের ঘর লুট করেছিলো এবং মুসলিম নারীদের প্রতি হাত বাড়িয়েছিলো, তারা মারা গেছে। যারা বেশি গুনাহগার ছিলো, তাদের কারো পা কাটা গেছে, কারো বাহু। জীবিত পড়ে থাকা অবস্থায় শকুনেরা তাদের চোখ খুলে খেয়েছে। যারা তাদের চেয়েও বড় পাপী ছিলো, তারা খৃস্টানদের হাতে বন্দি হয়ে গেছে। যে বন্দিত্ব তাদের জন্য জাহান্নামের চেয়ে কম হবে না। তাদের জন্য রয়েছে অনন্ত নির্যাতন। তারা ক্ষুৎপিপাসায় ছট ফট করতে থাকবে; কিন্তু মরবে না। মৃত্যুর জন্য দুআ করবে; কিন্তু কবুল হবে না।

এই কি আমাদের পরাজয়ের কারণ? এক সৈনিক বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে।

আমি দুবছর আগেই ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, এই বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে- লোকটি বললো- আর এই ফৌজ কাফেরদেরকে ইসলামের অবমাননা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। এখন এই বাহিনী আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হলো।

আপনি কোথায় যাবেন?- একজন জিজ্ঞাসা করে।

আমি তোমাদের ন্যায় আল্লাহর গজব থেকে- যা খৃষ্টান বাহিনীর আকারে নাযিল হয়েছিলো- পালিয়ে এসেছি- লোকটি উত্তর দেয়- খৃস্টান, বাহিনী ঝড়ের ন্যায় এসেছিলো। তোমাদের ফৌজ তাকে প্রতিহত করতে পারেনি। আমি যদি একা হতাম, তাহলে মুরশিদের মাজারে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করে দিতাম। কিন্তু আমার এই যুবতী মেয়েগুলোর ইজ্জত তো আমি কুরবান করতে পারি না। খৃস্টানরা দুটি বস্তু নাগালে পেলে ছাড়ে না। অর্থ আর নারী। আমার প্রতি মাজার থেকে নির্দেশ আসে, মেয়েদের নিয়ে তুমি মিসর চলে যাও। জিজ্ঞাসা করলাম, জীবন নিয়ে নিরাপদে যাবো কীভাবে? উত্তর আসে, তুমি আমার যে খেদমত করেছে, তার বিনিময়ে তোমরা নিরাপদেই কায়রো পৌঁছে যাবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে নীরবে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিজন মানুষকে বলতে হবে, পাপ করবে তো, এমন শাস্তি ভোগ করবে, যেমনটি ভোগ করছে তোমাদের ফৌজ। মাজার থেকে আমাকে আরো অনেক কিছু বলা হয়েছে, যা আমি মিসর পৌঁছে বলবো। তোমরা পরস্পরকে তাকাও। তোমাদের চেহারা লাশের ন্যায় সাদা হয়ে গেছে। তোমাদের দেহে যেনো প্রাণ নেই। আর আমার দিকে তাকাও। আমি আমার কন্যাদের নিয়ে পায়ে হেঁটে এসেছি। সঙ্গে কোন খাদ্য-পানীয় ছিলো না। তারপরও আমরা কিরূপ তরতাজা! এটা মহান আল্লাহরই অনুগ্রহ।

 আপনি কি আমাদেরকে মিসর পর্যন্ত আপনার ন্যায় নিয়ে যেতে পারেন? এক সৈনিক জিজ্ঞাসা করে।

পারি, যদি তোমরা ওয়াদা করো; অন্তর থেকে পাপের কল্পনা ঝেড়ে ফেলবে- লোকটি উত্তর দেয়। আর এই প্রতিশ্রুতি দাও যে, আমি যে মিশন নিয়ে মিসর যাচ্ছি, তাতে তোমরা আমার সঙ্গ দেবে।

আমরা সত্যমনে ওয়াদা করছি- অনেকগুলো কণ্ঠ ভেসে ওঠে। আপনি বলুন, আমাদের কী করতে হবে। জীবন থাকা পর্যন্ত আমরা আপনার সঙ্গ দেবো।

আমি শুধু নিজের জীবন আর মেয়ে দুটোর ইজ্জত রক্ষা করার জন্য রামাল্লা থেকে পালিয়ে আসিনি- লোকটি বললো- মাজার আমাকে নির্দেশ দিয়েছে, আমি মিসর গিয়ে বলবো, তোমরা ফেরাউনদের দেশের মানুষ। এই মাটিতে পাপের ক্রিয়া আছে। হযরত ইউসুফ (আ.) মিসরে নীলাম হয়েছিলেন। মূসা (আ.)-এর সঙ্গে বেআদবী মিসরে হয়েছিলো। ফেরাউনদের হাতে অনেক নবীর গোত্র এই মিসরে খুন হয়েছিলো। হে মিসরবাসী! তোমাদের ধ্বংস ও শাস্তি শুরু হয়ে গেছে। তোমরা আল্লাহর রশিকে শক্তভাবে আকড়ে ধরো। এই বার্তা আমি মিশরবাসীর জন্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা যদি এই বার্তা সারা দেশে প্রচারের কাজে আমাকে : সাহায্য করো, তাহলে তোমাদের দুনিয়াও জান্নাতে পরিণত হবে এবং আখেরাতেও তোমাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যাবে।

***

সূর্য অস্ত যেতে এখনো অনেক বাকি। রামাল্লার দিক থেকে আসা দু তিনজন সৈনিক নিকট দিয়ে অতিক্রম করছে। দরবেশ বললো, ওদের থামাও। ওরা রাত পর্যন্ত জীবিত থাকবে না।

তাদের থামানো হলো। তারা পানি প্রার্থনা করছে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। দরবেশ বললো, পানি রাতে পাবে। সে পর্যন্ত সেই আল্লাহকে স্মরণ করো, যিনি তোমাদের রামাল্লা থেকে জীবিত উদ্ধার করে এনেছেন এবং নতুন জীবন দান করেছেন।

কিছুক্ষণ পর আরো দুব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে এদিক দিয়ে অতিক্রম করে। তারা সৈনিক নয়। তারা প্রথমে কাফেলার প্রতি তাকায়। তারপর কালো চোগা পরিহিত কালো দাড়িওয়ালা লোকটির প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে। তারা ঘোড়া থামিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে ঘোড়াগুলো ওখানেই রেখে ছুটে আসে। উভয়ে তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারপর তার হাতে চুমো খেয়ে বললো- মুরশিদ! আপনি এখানে? তারা কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই কাফেলার সৈনিকদের উদ্দেশে বললো, আপনাদের খোশনসিব যে, আপনারা এই বুযুর্গের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইনি এক বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মিসরের গোনাহগার ফৌজ যদি মাজার এলাকায় আসে, তাহলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

***

এদিক-ওদিক লক্ষ্য রাখো- লোকটি সকলকে বললো- যেখানেই পথভোলা কাউকে মিসরের দিকে যেতে দেখবে, এখানে নিয়ে আসবে। রাতে এখানে কেউ ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত থাকবে না।

মিসর যাওয়ার এই একটিই পথ। অন্য সব জায়গা টিলায় পরিপূর্ণ। এটিই প্রশস্ত জায়গা। তবে এর মধ্যদিয়ে যাওয়াও অনর্থক। বাইরে থেকেই বুঝা যায়, এখানে পানির নাম-চিহ্ন নেই। সবাই মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে। মিসরের সীমান্ত এখনো অনেক দূর। এই লোকগুলোর আশ্রয় প্রয়োজন। কালো দাড়িওয়ালা দরবেশই এখন তাদের ভরসা। লোকটির প্রতিটি কথা তাদের হৃদয়ে বসে গেছে। কিন্তু পিপাসার আতিশয্যে দু-তিনজন সৈনিক চৈতন্য হারাবার উপক্রম হয়। দরবেশ তাদেরকে সান্ত্বনা প্রদান করছে।

সূর্য ডুবে গেছে। আঁধারে ছেয়ে গেছে রাত। নীরব-নিস্তব্ধ সাহারা। হঠাৎ টিলার মধ্য থেকে একটি পাখির ডাক ভেসে আছে। সবাই চমকে ওঠে। যে জাহান্নামে পানির কল্পনাও করা যায় না, মৃত্যু যেখানে মাথার উপর ঝুলে থাকছে সারাক্ষণ, সেই অঞ্চলে পাখির ডাক! না, এটি পাখির ডাক নয়, হতে পারে না। সকলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এটি কোনো প্রেতাত্মার শব্দ হবে।

শোকর আল্লাহ!- দরবেশ বললো- আমার দুআ কবুল হয়ে গেছে। লোকটি তার সম্মুখে উপবিষ্ট দুজন সৈনিককে বললো তোমরা দুজনে ওদিকে যাও। চল্লিশ পা গণনা করো। সেখান থেকে ডান দিকে মোড় নাও। চল্লিশকদম গণনা করো। সেখান থেকে বা দিকে মোড় নাও। সম্মুখে এক স্থানে আগুন জ্বলছে দেখবে। সেই আগুনের আলোতে তোমরা পানি দেখতে পাবে। হয়তো কিছু খাবারও পেয়ে যাবে। যা পাবে তুলে নিয়ে আসবে। এই যে ডাকটা শুনেছো, ওটা পাখির ডান নয়- গায়েবের ইশারা।

আমি যাবো না- এক সৈনিক ভয়জড়িত কণ্ঠে বললো- তার গা ছমছম করছে- আমি জিন-পরীর জায়গায় যাবো না।

যে দুজন লোক পরে ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলো, তারা দাঁড়িয়ে যায়। দরবেশকে একটা সেজদা দিয়ে সৈনিকের উদ্দেশে বললো- ভয় করো না। জিন-পরীরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তাদের প্রতি নির্দেশ আছে, এই বুযর্গ যেখানে যাবেন, তাকে খাদ্য-পানীয় পৌঁছাতে থাকবে। আমরা হযরতের কারামত সম্পর্কে অবগত। দু-তিনজন লোক আমাদের সঙ্গে চলো।

এবার সৈনিকরা যেতে সম্মত হয়। তারা রওনা হয়ে পড়ে। দরবেশের কথামতো পা গননা করে। মোড় ঘুরে। তারপর দুটি টিলার মধ্যখান দিয়ে অতিক্রম করতে গিয়ে একস্থানে আগুন দেখতে পায়। সকলে কালেমা ঝপতে ঝপতে এগিয়ে যায়। আগুনের আলোতে পানিভর্তি চার-পাঁচটি মশক পড়ে আছে দেখতে পায়। আছে একটি কাপড়ের পুটুলিও। থলেটি খেজুরে ভর্তি। তারা মশক ও থলেটি তুলে নেয়। ফিরে গিয়ে বস্তুগুলো দরবেশের সম্মুখে রেখে দেয়। দরবেশ খেজুরগুলো অল্প অল্প করে সকলের মাঝে বন্টন করে দেয়। পরে দুটি মশক তাদের হাতে তুলে দিয়ে বললো, প্রয়োজনের বেশি পান করো না। পানি বাঁচানোর চেষ্টা করো। এবার কারো সন্দেহ রইলো না, লোকটি একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও বড় মাপের একজন বুযুর্গ। সে সকলকে তায়াম্মুম করিয়ে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করে।

সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত পোহাতে এখনো অনেক দেরি। লোকটি সকলকে জাগিয়ে তোলে এবং কাফেলা মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। দরবেশ একটি উটের পিঠে এবং তার মেয়ে দুটো আরেকটি উটের পিঠে চড়ে বসে। পথে তাদের তিন-চারজন সৈনিকের সঙ্গে সাক্ষৎ হয়। তারাও মিসর যাচ্ছে। দরবেশ তাদেরও খেজুর খাওয়ায় ও পানি পান করায়। তারপর তাদেরকে দুজন উষ্ট্রারোহীর পেছনে বসিয়ে নেয়।

এই কাফেলার ডান দিক দিয়ে আরো একটি কাফেলা যাচ্ছিলো। একজন বললো, ওদেরকেও নিয়ে নিন। দরবেশ বললো, তারা আমাদের ন্যায় পালিয়ে এসেছে বলে মনে হয় না। তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

***

অনেকদিন পর সৈনিকদের এই কাফেলা দরবেশরূপী কালো দাড়িওয়ালা লোকটির সঙ্গে মিসরের সীমানায় প্রবেশ করে। যে দুব্যক্তি পরে এসে দরবেশকে সেজদা করেছিলো, তারা পথে সৈনিকদেরকে দরবেশের কারামতের কাহিনী শোনাতে থাকে। তারা সৈনিকদের ধারণা প্রদান করে, যে ব্যক্তি লোকটিকে নিজ গ্রামে আশ্রয় দেবে, তার জীবিকার কোনো অভাভ থাকবে না এবং খোদা সব সময় তার উপর দয়াপরবশ থাকবেন। একই গ্রামের তিন সৈনিক তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা দরবেশকে বললো, আপনি আমাদের গ্রামে চলুন। লোকটি তাদেরকে দু চারটি প্রশ্ন করে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে।

কায়রোর অদূরে বড় একটি গ্রাম। কাফেলা উক্ত গ্রামটিতে প্রবেশ করে। সৈনিকদের দেখে গ্রামের অধিবাসীরা তাদের চার পার্শ্বে ভিড় জমায়। তাদের পশুগুলোকে খেতে দেয় এবং তাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করে।

জনতা যুদ্ধের কাহিনী শুনতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তারা কালো দাড়িওয়ালা ব্যক্তিটি সম্পর্কে বললো, ইনি আল্লাহর নৈকট্যশীল বুযুর্গ মানুষ। আল্লাহ জিনের মাধ্যমে এর নিকট খাবার পৌঁছিয়ে থাকেন। সৈনিকরা জনতাকে লোকটির সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত শোনায়। দরবেশ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। দুচোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে আছে। তার মেয়ে দুটোকে এই গ্রামেরই অধিবাসী এক সৈনিক নিজ ঘরে নিয়ে যায়।

রণাঙ্গনের ভেদ আমাকে জিজ্ঞাসা করো- দরবেশ বললো- এরা সৈনিক। এরা কেবল লড়াই করতে জানে। সৈনিকদের জানা থাকে না, যুদ্ধের নেপথ্য নায়কদের উদ্দেশ্য কী। এই যে কজন সৈনিককে আমি সাহারার আগুন থেকে রক্ষা করে নিয়ে এসেছি, এরা সেই ফৌজের শাস্তি ভোগ করছিলো, যারা এদের অনেক আগে সিরিয়া গিয়েছিলো। সেই ফৌজ প্রতিটি রণাঙ্গনে বিজয় অর্জন করেছিলো। সেখানকার উপত্যকা-মরুভূমি সুলতান আইউবী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত ছিলো। এই বাহিনী সর্বত্র হীরে-জহরত ও নারী দেখতে পায়। ওখানকার নারীরা মিসরের নারীদের চেয়েও বেশি রূপসী। গনীমতের নেশা বাহিনীটির মধ্যে ফেরাউনী চরিত্র সৃষ্টি করে দেয়। তাদের মন-মস্তিষ্কে গনীমত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। তারপর ফৌজের সালার, কমান্ডার ও সৈনিকরা জাতির ইজ্জত এবং মর্যাদাবোধকেও বিদায় জানায়। তারা মুসলমানদের ঘরে ঘরে লুট তরাজ শুরু করে দেয়। সুন্দরী মেয়েদের শ্লীলতাহানী ও অপহরণ করতে শুরু করে। এই নারীগুলো সবাই ছিলো সম্ভ্রান্ত ও পর্দানশীল মুসলিম মহিলা। তাদেরকে তারা নিজ তাঁবুতে আটকে রাখে।

কেন, সুলতান আইউবী কি অন্ধ ছিলেন?- এক ব্যক্তি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে তিনি কি দেখলেন না, তার সৈন্যরা কী করছে?

খোদা যখন কোনো জাতিকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন দেশের ইমাম, আলিম ও শাসকদের বিবেকের উপর পর্দা ফেলে দেন দরবেশ বললো- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী স্বয়ং জয়ের নেশায় মাতাল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বোধ হয় আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার শাস্তি-সাজার কথাও ভুলে গিয়েছিলেন। তার দেহরক্ষী ও বিলাসী সালারগণ তাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলো যে, কোনো মজলুমের ফরিয়াদ তাঁর কানে পৌঁছতো না। যে রাজা ফরিয়াদীদের জন্য ইনসাফের দ্বার এবং নিজের কান বন্ধ করে রাখেন, সে রাজা আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়ে যান। আমি দুবছর আগেই ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, এই বাহিনী পাপের শাস্তিস্বরূপ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি রাতে গায়েবী আওয়াজ শুনতাম। কিন্তু যার জন্য আওয়াজ আসতো, তার কান বন্ধ ছিলো।

তারপর খোদা তাদের চোখের উপর পট্টি বেঁধে দেন এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- যিনি রণাঙ্গনের রাজা ছিলেন এবং যাকে খৃস্টানরা রণাঙ্গনের দেবতা মনে করতো এমনই জ্ঞানান্ধ হয়ে যান যে, তিনি সকল রণকৌশল ভুলে যান। তাঁর কৌশলে যুদ্ধ করে শত্রুরা। তিনি এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন যে, একাকি মিসর পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।

আমরা খৃস্টানদের থেকে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো- এক বেদুঈন তেজস্বী কণ্ঠে বললো- আমরা আমাদের পুত্রদেরকে কুরবান করে দেবো।

জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে- দরবেশ বললো- তিনি যদি কারো কপালে পরাজয় লিপিবদ্ধ করেন, তাহলে জয় ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা তার থাকে না। তখন বান্দার সব জোশ ঠান্ডা হয়ে যায়। আমিও এখানে এজন্যই এসেছি যে, মিসরের শিশুটিকেও প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত করবো। কিন্তু শাস্তির মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। তোমরা যদি তোমাদের পুত্রদেরকে এখনই পুনরায় ভর্তি করিয়ে ময়দানে প্রেরণ করো, তাহলে তারা মারা যাবে এবং পরাজয়বরণ করবে। প্রতিটি কাজের একটি উপযুক্ত সময় নির্ধারিত থাকে। খৃস্টানদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের সেই মোক্ষম সময়টি এখনো আসেনি। এখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করো এবং তার নিকট তোমাদের সেই পুত্রদের গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করো, যাদেরকে তোমরা সিরিয়া প্রেরণ করেছিলে।

***

পরাজয়ের সব দায় আমার মাথায় রাখো- সুলতান আইউবী বললেন। তিনি সালার, নায়েব সালার, কমান্ডার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন- পরাজয়ের কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। ভুল হয়েছে, আমি নতুন সৈনিকদের ময়দানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি যদি আরো অপেক্ষা করতাম আর মিসরে বসে থাকতাম, তাহলে দুশমন সমগ্র মিসরে ছড়িয়ে যেতো। আমি ফৌজের যে অভাবটা নতুন সৈনিকদের দ্বারা পূরণ করেছি, তোমরা জানো, তার দায় কার উপর বর্তায়। কিন্তু সেই আলোচনায় জড়িয়ে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না। অপরাধ আরোপ যদি করতেই হয়, তাহলে আমার উপর করো। বাহিনী দ্বারা যুদ্ধ আমি করিয়েছি। কৌশলে ভুল থাকলে সেই ভুল আমার। তার কাফফারা আমাকেই আদায় করতে হবে এবং করবো। জয়-পরাজয় যে কোনো যুদ্ধের শেষ ফল। আজ আমরা এমন একটি পরিণতির মুখোমুখি, যার জন্য আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। সে কারণেই আমি তোমাদের চেহারায় মলিনতা এবং চোখে অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি। তোমরা যদি আমাকে পরাজয়ের শাস্তি দিতে চাও, আমি তার জন্যও প্রস্তুত আছি। আমার কানে এ আওয়াজও আসছে যে, আমার ফৌজ সিরিয়া গিয়ে নারীর শ্লীলতাহানি, লুণ্ঠন ও মদপানে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে, বাগদাদের খলীফার উপর প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজয়বরণ করেছি এবং আমি এই পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করে খলীফাকে আমার অনুগত বানাবার চেষ্টা করবো। আমাকে ফেরাউনও আখ্যা দেয়া হচ্ছে। আমি এর একটি অপবাদেরও জবাব দেবো না। এসব অপবাদ-অভিযোগের জবাব আমি মুখে দেবো না- দেবে আমার তরবারী। আমি শব্দ দ্বারা নয়, কাজে প্রমাণ করবো এসব কার পাপ, যার শাস্তি আমি এবং আমার মুজাহিদরা ভোগ করেছে।

ইতিমধ্যে দারোয়ান সংবাদ জানায়, হামাত থেকে দূত এসেছে। সুলতান। আইউবী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভেতরে তলব করেন। সর্বাঙ্গ ধুলায় মাখা ও দীর্ঘ সফর-ক্লান্ত দূত আল-আদিলের একখানা পত্র সুলতানের হাতে তুলে দেন। সুলতান পুত্ৰখানা খুলে পাঠ করেন। তাঁর চোখে অশ্রু নেমে আসে। পত্রখানা এক সালারের হাতে দিয়ে সুলতান বললেন- পড়ে সবাইকে শোনাও।

সালার বার্তাটি পড়তে শুরু করেন। পড়তে পড়তে যতোই অগ্রসর হচ্ছেন, শ্রোতাদের চোখে আনন্দের দ্যোতি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অজান্তে তাদের মুখ থেকে অস্ফুট জিন্দাবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে।

এ হলো গুনাহগারদের কীর্তি- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা যারা কায়রোতে ছিলে, জানো না আল-আদিলের নিকট কতোজন সৈন্য আছে। জানতে না বল্ডউইনের কাছে আমাদের দশগুণ বেশি সৈন্য ছিলো। তার আরোহীরা বর্মপরিহিত। সব পদাতিকের মাথায় শিরস্ত্রাণ। আল আদিল কি প্রমাণ করেনি, আমরা পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করতে জানি? তোমরা কি ভাবতে পারো, আমি মাথায় হাত রেখে বসে পড়বো? তোমরা পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করো। আমাকে নতুন সেনাভর্তি দাও। বায়তুল মুকাদ্দাস তোমাদের ডাকছে। দুশমনের সঙ্গে আমি কোনো প্রকার চুক্তি-সমঝোতা করবো না।

আল-আদিলের বার্তা যেমনি সুলতান আইউবীকে উজ্জীবিত করে তোলে, তেমনি তাঁর সালার, কমান্ডার প্রমুখদের বিক্ষত মনোবলকেও চাঙ্গা করে তোলে। যাদের অন্তরে সুলতান আইউবী ও তাঁর ফৌজের বিরুদ্ধে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিলো, তা দূর হয়ে যায়।

ওদিকে আল-আদিলও থেমে নেই। তিনি তার বাহিনীকে ত্রিশ চল্লিশজনের দলে বিভক্ত করে সেই এলাকায় নিয়ে যান, যেখানে বল্ডউইন ছাউনি ফেলে অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর কমান্ডারদেরকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। উদ্দেশ্য, দুশমনকে অস্থির করে রাখতে হবে। যেনো তারা অগ্রযাত্রা করতে না পারে এবং বসে থাকতে না পারে।

বল্ডউইন পূর্ব থেকেই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি এতো বিশাল বাহিনী নিয়ে এই আশায় এসেছিলেন যে, তিনি দামেশক পর্যন্ত সকল ভূখণ্ড দখল করে ফেলবেন। কিন্তু এখন তার অবস্থা হচ্ছে, প্রতি রাতে বাহিনীর কোনো না কোনো অংশের উপর তীরবৃষ্টি হচ্ছে কিংবা আক্রমণ হচ্ছে। সৈন্যদের সচেতন হতে না হতে আক্রমণকারীরা সটকে পড়ছে।

বল্ডউইন তার বাহিনীকে সমগ্র অঞ্চলে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল-আদিলের কমান্ডো বাহিনীর ন্যায় গ্রুপ তৈরি করে দিয়েছেন, যারা রাতে এদিক-ওদিক টহল দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি ভোরেই বল্ডউইনকে সংবাদ শুনতে হচ্ছে, আজ অমুক ক্যাম্পের উপর আক্রমণ হয়েছে কিংবা অমুক গ্রুপটি মারা পড়েছে।

অঞ্চলটা পাহাড়ি। আল-আদিলের গেরিলাদের জন্য এটি একটি বিশেষ সুবিধা। সুযোগটা তারা ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। তবে এই স্বার্থ উদ্ধার করতে আল-আদিলকে অনেক মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। কমান্ডোরা এতো দুঃসাহসিকতার সাথে আক্রমণ চালাচ্ছে যে, তারা দুশমনের ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে এবং নিজেদের জীবন কুরবান করে সমূহ ক্ষতিসাধন করছে।

এই ধারার যুদ্ধ আর এই কুরবানীর মাধ্যমে কোনো অঞ্চল জয় করা সম্ভব ছিলো না। আল-আদিল দুশমনকে সেখান থেকে পেছনে হঠাতে পারছেন না। কিন্তু উপকারও কম হচ্ছে না যে, খৃস্টানদের এই বিশাল বাহিনীটি সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। বল্ডউইন যদি সম্মুখে অগ্রসর হতেন, তাহলে এই সামান্য সৈন্য নিয়ে আল-আদিল মুখোমুখি যুদ্ধে দুঘন্টাও টিকতে পারতেন না।

বল্ডউইনের ক্যাম্পে কর্মরত স্থানীয় লোকদের মধ্যে আল-আদিলের গুপ্তচরও আছে। সুযোগমতো তারাও কাজ করছে। খৃস্টানরা ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্য পাহাড়ের উঁচুতে শুস্ক ঘাসের স্তূপ জড়ো করে রেখেছিলো। আল-আদিলের এক গুপ্তচর তাতে আগুন ধরিয়ে ভস্ম করে ফেলে।

আল-আদিল সংবাদ পান, দামেশক থেকে সামান্য সাহায্য আসছে। হাল্ব থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। আল-মালিকুস সালিহ বার্তা প্রেরণ করেন, খৃস্টানরা হাররান দুর্গ অবরোধ করার পরিকল্পনা আঁটছে। তা-ই যদি ঘটে যায়, তাহলে হাবের ফৌজ দ্বারা তাদের মোকাবেলা করতে হবে।

***

কয়েকজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লিখেছেন, রামাল্লার পরাজয়ের পর ইসলামী বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তার ক্ষুদ্র যে ইউনিটগুলো বেঁচে গিয়েছিলো, তারা লুটপাটকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তারা খৃস্টানদের সেনা কাফেলাগুলোতেও হাইজ্যাক শুরু করে।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, লুট করতো স্বয়ং খৃস্টান সৈন্যরা। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ তথ্য স্বীকার করেছেন। পূর্বেও ঐতিহাসিকদের সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, খৃস্টান সৈন্যরা অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে মুসলিম কাফেলাসমূহ লুণ্ঠন করতো। তারা এই লুটতরাজ এমন ধারায় করতো, যেন এটি তাদের সামরিক ডিউটি। কতিপয় ঐতিহাসিক যেসব মুসলিম সেনাদল সম্পর্কে লিখেছেন, তারা লুটতরাজ করতে শুরু করেছিলো, তারা ছিলো মূলত আল-আদিলের কমান্ডো সেনা, যারা ম্রাট বল্ডউইনের বিশাল বাহিনীকে গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে একই অঞ্চলে আটকে রেখেছিলো।

যা হোক, গেরিলা অপারেশনে আল-আদিলকে অনেক মূল্য গণনা করতে হয়েছে। কিন্তু সৈনিকদের জযবা এতই তীব্র ছিলো যে, একজন সৈনিকও পেছন দিকে তাকাতে সম্মত ছিলো না। অধিকাংশ সৈন্য অবিরাম উপত্যকা ইত্যাদি অঞ্চলে টহল দিয়ে অপারেশন পরিচালনা করে ফিরছিলো। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ক্ষণিকের জন্য ক্যাম্পে যাওয়ার ফুরসত ছিলো না। ঐতিহাসিক আসাদুল আসাদীর প্রকাশিত পান্ডুলিপির ভাষ্যমতে, তারা ব্যাঘ্রের ন্যায় শিকারের সন্ধানে ওঁৎ পেতে থাকতো এবং যখনই শিকার চোখে পড়তো, তখন আর নিজের জীবনের কোনো তোয়াক্কা থাকতো না। তারা দুশমনের অধিক থেকে অধিকতর ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে অবলীলায় শহীদ ও আহত হয়ে যেতো। তাদের রাত কাটতো মরু বিয়াবানে-অঘুম নয়নে।

কিন্তু কায়রোতে এই প্রোপাগাণ্ডা জোরেশোরে বেড়ে চলেছে যে, মিসরের ফৌজ চরিত্রহীন ও বিলাসী হয়ে ওঠেছে এবং রামাল্লার পরাজয় তার শাস্তি। কায়রোর ইন্টেলিজেন্স খুঁজে বের করতে পারছে না, এই অপপ্রচার কোথা থেকে উত্থিত হচ্ছে। এটা নতুন সৈনিকদের অসতর্ক কথাবার্তার প্রতিফল, নাকি দুশমনের এজেন্টরা সুকৌশলে এই প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এখন এ-ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মানুষ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে ইতস্তত করছে। রামাল্লার পরাজয়ের আগে মিসরীদের চিন্তা চেতনা এরূপ ছিলো না। আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু জনগণ ফৌজের দুর্নাম করে বেড়াচ্ছে এই তথ্য ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধেও মানুষ মুখ খুলছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

কালো দাড়িওয়ালা দরবেশ তার দুকন্যাকে নিয়ে যে গ্রামটিতে অবস্থান নিয়েছিলো, এখন সে সেখানকার বাসিন্দা। গ্রামবাসীরা তাকে একটি ঘর দিয়ে রেখেছে। মিসরীদের গুনাহ মাফ করাবার জন্য তিন মাস চিল্লা করতে হবে বলে সে প্রকাশ্যে উঠাবসা করা ও মানুষের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। উক্ত গৃহ থেকে বাইরে বের হলেও স্বল্প সময়ের জন্য বের হচ্ছে এবং নীরব থাকছে। উপস্থিত জনতাকে হাত নেড়ে ইঙ্গিতে সালাম করছে এবং ভেতরে চলে যাচ্ছে। মাঝপথ থেকে তার সঙ্গে আসা সৈনিকরাই তার ঘনিষ্ঠ সহচর। আর সেই দুব্যক্তি যারা পরে পার্বত্য অঞ্চলে এসে তাকে সেজদা করেছিলো। লোকটাকে এতো প্রচার করে দেয় যে, এখন তাকে এক নজর দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসা-যাওয়া করছে।

***

আলী বিন সুফিয়ানের এক গোয়েন্দা ডিউটির অংশ হিসেবে ছদ্মবেশে কায়রোর উপকণ্ঠে এক স্থানে যোরাফেরা করছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের নামায আদায় করার জন্য সে মসজিদে প্রবেশ করে। নামাযের পর ইমাম সাহেব দুআ করেন। মুনাজাত শেষ হলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে মুসল্লীদের কিছুক্ষণের জন্য বসতে অনুরোধ জানিয়ে ভাষণ দিতে শুরু করে। তার ভাষণের বিষয়বস্তু রামাল্লার পরাজয়। সে সুলতান আইউবীর ফৌজের বিরুদ্ধে সেসব কথাবার্তা বলতে শুরু করে, যা কালো দাড়িওয়ালা দরবেশ বলেছিলো। এই লোকটি দরবেশের সূত্র এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেনো লোকাট গায়েব জানে এবং জিনরা তাকে জীবিকা পৌঁছায়। সে সফরের পূর্ণ কাহিনী শোনায় এবং তারা কীভাবে গায়েব থেকে পানি ও খেজুর লাভ করেছিলো, তার বিবরণ প্রদান করে।

মুসল্লীরা তন্ময় হয়ে তার বক্তৃতা শুনতে থাকে।

বক্তব্য শেষ হলে মুসল্লীরা তাকে দরবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করে তিনি কি মনের আশা পূরণ করতে পারেন? দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকদের আরোগ্য দান করতে পারেন? ভবিষ্যতের খবর জানেন? সন্তান দিতে পারেন?

উত্তরে বক্তা বললো, তিনি এখনো সকলকে শুধু এ কথাই বলছেন যে, সুলতান আইউবী ও তার বাহিনীতে ফেরাউনী চরিত্র সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং তাদের পরাজয়ের কারণও এটাই। তিনি আরো বলছেন, তোমরা না নিজেরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবে, না অন্যকে ভর্তি হতে দেবে। অন্যথায় তোমাদের বিরাট ক্ষতি হবে। কারণ, গুনাহের শাস্তির মেয়াদ এখনও পূর্ণ হয়নি। তিনি তিন মাসের জন্য মুরাকাবায় বসেছেন। তিন মাস পরে বলবেন, মিসরীদের পাপ ক্ষমা করা হয়েছে কিনা।

লোকটি মসজিদ থেকে বের হয়ে একদিকে হাঁটতে শুরু করে। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা তার পিছু নেয় এবং তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি যে বুযুর্গের কথা বলেছেন, তার সঙ্গে কীভাবে সাক্ষাৎ করতে পারি। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি একজন সৈনিক। আপনার বক্তব্য শুনে মনে ভয় ধরে গেছে যে, ফৌজের পাপের শাস্তি আমাকেও ভোগ করতে হয় কিনা। আমিও দামেশক-হালুবের রণাঙ্গনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমিও সেই পাপ করেছি, যার আলোচনা আপনি করেছেন। আপনি আমাকে বুযুর্গের নিকট নিয়ে চলুন। তিনি যদি বলেন আমি ফৌজ থেকে পালিয়ে যাবো। তিনি আমার থেকে যে সেবা চাইবেন, আমি দেবো। আমি খোদর অসন্তোষকে ভয় করি।

লোকটি এতোই অনুনয়-বিনয় করে যে, তার চোখ থেকে অশ্রু নেমে আসে।

 আমার সঙ্গে চলো- লোকটি বললো- কিন্তু কাউকে বলবে না তুমি তার কাছে গিয়েছিলে। বর্তমানে তিনি চিল্লায় আছেন। তিন মাসের জন্য মুরাকাবায় বসেছেন। কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সাক্ষাতের পর তিনি যা যা জিজ্ঞেস করবেন, কেবল তারই উত্তর দেবে, কোন ফালতু কথা বলবে না।

আপনি কি সেই গ্রামেরই বাসিন্দা?- গোয়েন্দা জিজ্ঞেস করে বলেছেন আপনি রামাল্লার রণাঙ্গন থেকে আসা সৈনিক?

এই জন্যই তো কুরআনে হাত রেখে বলতে পারবো, এই বুযুর্গ আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বান্দাদের একজন সৈনিক বললো- আমি রণাঙ্গনের রুদ্ররোষ দেখেছি। দেখেছি সফরের গজবও। কিন্তু এই লোকটি মরু প্রান্তরকে ফুল বাগিচায় পরিণত করে দিয়েছিলেন। এখন আর আমি বাহিনীতে যোগ দেবো না।

গ্রামটা দূরে নয়। দুজন কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেছে। রাত গম্ভীর হয়ে গেছে। সৈনিক গোয়েন্দাকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে সেই ঘরে চলে যায়, যেখানে তার পীর অবস্থান করছে। খানিক পর ফিরে এসে বললো, আপনি পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে চলে আসুন। বলেই নিজে তার সম্মুখে সম্মুখে হাঁটতে শুরু করে। দুজন পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। দেউড়ি ও বারান্দা অতিক্রম করে তারা একটি কক্ষে প্রবেশ করে। বারান্দায় আলো ছিলো। দরবেশ যে দুটো মেয়েকে নিজের কন্যা বলে পরিচয় দিয়েছিলো, তারা অন্য এক কক্ষে অবস্থান করছে। বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে তারা কক্ষের জানালা খুলে দেখে। বাইরে চোখ ফেলেই একটি মেয়ে চমকে ওঠে এবং অলক্ষ্যে তার মুখ থেকে উহ! বেরিয়ে আসে।

কী হলো? অপর মেয়ে জিজ্ঞেস করে- লোকটি কে?

মনে হয় আমরা ধরা পড়ে গেছি- মেয়েটি উত্তর দেয়- এই লোকটাকে আমি আগেও কোথাও দেখেছি। গোয়েন্দা মনে হচ্ছে। মেয়েটি গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায়।

গোয়েন্দা কক্ষে প্রবেশ করে দরবেশের সম্মুখে সেজদাবনত হয়। তার পায়ে মাথা ঘষে। দরবেশ মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে বসে আছেন। গোয়েন্দা কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ জানায়, আপনি আমার গুনাহগুলো মাফ করিয়ে দিন। সে সৈনিকদের সঙ্গে পথে যেসব আবেগময় কথা বলেছিলো, দরবেশের সম্মুখেও সেসব পুনর্ব্যক্ত করে। তার চোখে অশ্রু এসে যায়। দরবেশ নিজের তাসবীহটা তার মাথার উপর বুলিয়ে মুচকি হেসে মাথায় হাত রাখে।

এতে আমার প্রশান্তি আসবে না- গোয়েন্দা অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বললো- মুখের কথায় আমাকে সান্ত্বনা দিন। আমাকে আদেশ করুন। আমি আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমার একটি মাত্র সন্তান। আপনি আদেশ করলে আমি তাকেও আপনার পায়ের উপর জবাই করে ফেলবো। সুলতান আইউবীকে হত্যা করতে বলুন, আমি আপনার আদেশ পালন করবো। কথা বলুন। আদেশ করে দেখুন আমি মান্য করি কিনা।

অপর এক ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করে। সে গোয়েন্দার কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শুনছে এবং গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করছে। সে গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করে- তুমি এতো অস্থির হচ্ছো কেনো? এখন তো তুমি মুর্শিদের ছায়ায় এসে পড়েছো!

আমার পাপ এতো বেশি যে, আমি রাতে ঘুমাতে পারি না গোয়েন্দা বললো- আমি হামাতের সন্নিকটে এক গ্রামে এক মুসলিম পরিবারের একটি মেয়েকে অপহরণ করতে গিয়ে তার যুবক ভাইকে খুন করেছিলাম। আমি যদি ফৌজের সৈনিক না হতাম, তাহলে আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হতো। কিন্তু এই ঘটনার জন্য কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি।

দরবেশ চক্ষু বন্ধ করে ফেলে। ঠোঁট নড়ছে। হাত দুটো উপরে তুলে পরে গোয়েন্দার দিকে ইশারা করে। কিছুক্ষণ পর ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। চোখ খুলে যায়। এবার মুখ খোলে। গোয়েন্দাকে বললো- অনেক কষ্টে তোমার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পেয়েছি। মন দিয়ে শোন। আমি তোমার গুনাহ মাফ করিয়ে দেবো বরং তুমি ও তোমার পরিবার এতো বেশি হালাল জীবিকা লাভ করবে, যা তুমি স্বপ্নেও দেখোনি। এখন চলে যাও, কাল আবার এসো।

দরবেশ পুনরায় মুরাকাবায় আত্মনিয়োগ করে। সৈনিক এবং অপর লোকটি গোয়েন্দাকে বারান্দায় নিয়ে যায়। তারা তাকে দরবেশের এমন সব কারামতের কাহিনী শোনায় যে, গোয়েন্দা অভিভূত হয়ে পড়ে। মেয়ে দুটো জানালার ফাঁক দিয়ে দেখছে। যে মেয়েটি গোয়েন্দাকে প্রথমবার দেখে চমকে ওঠেছিলো, সে অপর মেয়েকে বললো- একে আমি আগে কোথাও দেখেছি। লোকটা ধোকা দিচ্ছে না তো! মানুষটা কিন্তু সে-ই।

***

ঘটনাটা সেরূপই মনে হচ্ছে, যেমনটি আমরা আগেও একবার ধরেছিলাম- গোয়েন্দা আলী বিন সুফিয়ানকে রিপোর্ট করছে- সেই মুরাকাবা, সেই চিল্লা সেই জিন ও মানুষের আবেগকে আয়ত্ত্ব করে তাদের উপর যাদু প্রয়োগ করা। আমাদের ফৌজের যে সৈনিক আমাকে তার নিকট নিয়ে গিয়েছিলো, সে কেবল ফৌজের বিরুদ্ধেই কথা বলছিলো। মসজিদে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যেও একই কথা বলেছিলো। লোকটি আমার সঙ্গে যেসব কথা বলেছে, তাতে প্রমাণিত হচ্ছে, তার আরো একাধিক সঙ্গী আছে, যারা তারই মতো মসজিদে মসজিদে গিয়ে মুসল্লীদের আমাদের ফৌজের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে। রণাঙ্গনের অসত্য কাহিনী শোনাচ্ছে এবং বুঝাতে চেষ্টা করছে, ফৌজে ভর্তি হওয়া পাপের কাজ।

তাদের এই অভিযান মসজিদেই পরিচালনা করার কথা- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- মসজিদে বলা কথাকে মানুষ অহীর সমান মর্যাদা দিয়ে থাকে। মানুষ আবেগের গোলাম। তারা সেই লোককে মুরশিদ-পথের দিশারী বলে বরণ করে নেয়, যে প্রথমে আবেগকে উত্তেজিত করে পরে শব্দ দ্বারা তাকে শান্ত করে। তুমি কাল আবার যাও। আমাকে গ্রাম ও ঘরটা বুঝিয়ে দাও। এদিক-ওদিক দেখে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করো। তোমার তথ্যের ভিত্তিতে আমি সেখানে কমান্ডো অভিযান চালাবো।

আমার ভয় হয় কমান্ডো অভিযান চালালে সেখানকার অধিবাসীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠবে- গোয়েন্দা বললো- সৈনিক আমাকে বলেছে, গ্রামের প্রতিটি শিশুও তার অনুরক্ত এবং দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে।

আমাদের অতো কিছু তোয়াক্কা করা চলবে না- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- যে শাসক জনগণের উপর শাসন চালাতে চায়, জনগণের আবেগ-উচ্ছ্বাসের তোয়াক্কা তাকে করতে হয়। এই চরিত্রের শাসকরা জনগণের আবেগ নিয়ে খেলা করে থাকে, যাতে প্রজারা খুশি থাকে এবং তাদের আনুগত্য করে। আমাদের কাজ সালতানাতে ইসলামিয়া ও দেশের জনগণের মর্যাদার সুরক্ষা। আমরা এলাকাবাসীকে হাকীকত দেখাবো। আমরা তাদেরকে সুলতান আইউবীর গোলাম বা ভক্ত বানাতে চাই না। আমরা তাদেরকে বলবো, ইসলামের প্রহরী তোমরাও ততোটুকু, যতোটুকু তোমাদের সুলতান। আমরা তাদেরকে ইসলামের দুশমন দেখাবো। আমরা আবেগ-পূজার নেশা জাগিয়ে জাতিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাই না। জাতিকে বাস্তবতার ধাক্কা দিয়ে জাগাতে হবে। তুমি যাও। দেখো, বুঝে। তারপর রিপোর্ট করো।

গোয়েন্দার দরবেশের আস্তানায় যাওয়ার সময় রাতে। আলী বিন সুফিয়ান নিজের বেশভূষা পরিবর্তন করে উক্ত গ্রামে চলে যান। তিনি দরবেশের ঘরটি চিনে নেন এবং তার প্রতি মানুষের ভক্তি-বিশ্বাসের আন্দাজ করেন। মানুষের কথাবার্তা শোনেন। মিসরের ফৌজের বিরুদ্ধে ঝড় তোলা হচ্ছে। আলী বিন সুফিয়ান বাড়ির পেছনটা দূর থেকে দেখে নেন। ওখানে ছোট্ট একটি দরজা। দরজাটা বন্ধ। গাছ-গাছালি আছে। ডানে ও বামে আরো দুটি ঘরের পশ্চাদ্দেশ। কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। যতো ভিড় বাড়ির সম্মুখে। হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। পুরাতন চোগা পরিহিত শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত এক ব্যক্তি বেরিয়ে আসে। আলী বিন সুফিয়ান আড়াল হয়ে যান। তিনি খোলা দরজাটায় একটি সুন্দরী যুবতীকে দেখতে পান। মেয়েটি দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

লোকটি লাঠি হাতে ঝুঁকে ঝুঁকে ধীর পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান তাকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। বেশ দূরে গিয়ে লোকটি দাঁড়িয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। একদিক থেকে এক অশ্বারোহী ধেয়ে আসে। লোকটি ঘোড়ায় চড়ে বসে এবং কায়রোর দিকে রওনা দেয়। ঘোড়া নিয়ে আসা লোকটি পায়ে হেঁটে গ্রামের দিকে চলে যায়।

আলী বিন সুফিয়ান নিজ ঘোড়ায় আরোহণ করে অশ্বারোহী সাদা দাড়িওয়ালা লোকটির পেছন পেছন এগুতে থাকেন। লোকটি কয়েকবারই পেছন দিকে তাকায়। আলী বিন সুফিয়ান এগুতে থাকেন। লোকটি কায়রোর দিকে এগুতে থাকে। একটি লোক পেছনে পেছনে চলছে বলে সে বেজায় বিরক্ত। কায়রোমুখী হয়ে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেয় সে। আলী বিন সুফিয়ানও গতির তাল বজায় রাখেন। তাঁর ঘোড়া আরো দ্রুত চলতে শুরু করে। লোকটি বারবার পেছন দিকে তাকাতে থাকে। আলী বিন সুফিয়ান তার পেছন পেছন যেতে থাকেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে লোকটি কায়রোর রাস্তার পরিবর্তে ঘোড়া অন্য পথে ঘুরিয়ে দেয়। ঘোড়ার গতি স্বাভাবিক। আলী বিন সুফিয়ান তার ঘোড়াও সেই পথে ঢুকিয়ে দেন।

উভয় ঘোড়া এখন যেখানে, সেখানে এদিক-ওদিক দুএকটি ঝুপড়ি বা তবু দেখা যাচ্ছে। কোথাও যাযাবরদের অস্থায়ী ডেরা। লোকটি একের পর এক পথ পরিবর্তন করছে এবং বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। আলী বিন সুফিয়ানও তার পেছন পেছন অগ্রসর হচ্ছেন। লোকটির অস্থিরতা বেড়ে চলছে। অবশেষে সে কায়রোর দিকেই মুখ করে এবং ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। আলী বিন সুফিয়ানের ঘোড়ার গতিও বেড়ে যায়। এখন উভয় ঘোড়ার মধ্যখানের ব্যবধান পনের-বিশ কদম। তারা কায়রো নগরীতে ঢুকে যাবে বলে। এমন সময় হঠাৎ শশ্রুমণ্ডিত লোকটি ঘোড়া থামিয়ে মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ানও তার সম্মুখে গিয়ে থেমে যান।

তুমি দস্যু মনে হচ্ছে–সাদা শশ্রুমণ্ডিত অশ্বারোহী বললো। খঞ্জর বের করে পুনরায় বললো আমার পিছু নিয়েছো কেনো?

আলী বিন সুফিয়ান দেখলেন, সাদা দাড়ির কারণে লোকটার বয়স সত্ত্বর বছর মনে হচ্ছে। কিন্তু চেহারা, চোখ ও দাঁত বলছে চল্লিশেরও কম। আলী বিন সুফিয়ানও ছদ্মবেশে। তিনি কটিবন্ধ থেকে সোয়া গজ লম্বা তরবারীটা বের করে হাতে নেন।

দাড়ি খুলে ফেলো- আলী বিন সুফিয়ান লোকটির এক পাজরে তরবারী ঠেকিয়ে বললেন- আমার সামনে সামনে চলো।

শুনে লোকটির চোখ দুটো পলকহীন দাঁড়িয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান তরবারীর আগাটা তার কালো পট্টির উপর রেখে দাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ঝটকা টান দেন। সঙ্গে সঙ্গে দাড়িগুচ্ছ মুখমণ্ডল থেকে আলাদা হয়ে যায়। ক্লিনসেভ চেহারাটা বেরিয়ে আসে। পরক্ষণে তিনি নিজের কৃত্রিম দাড়িও খুলে ফেলে বললেন- আমিও তোমাকে চিনি। তুমিও আমাকে চেনো। চলো রওনা হই।

লোকটি ক্ষমতাচ্যুৎ আব্বাসী খেলাফতের একজন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী। এই খেলাফতকে- যার সিংহাসন কায়রোতে ছিলো- সাত-আট বছর আগে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন। তখন খলীফা ছিলেন আল-আজেদ, যিনি হাশিশি, ক্রুসেডার ও সুদানীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রেখেছিলেন। সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে কথা বলে এই খেলাফতকে বিলুপ্ত করে এমারতে মেসেরকে খেলাফতে বাগদাদের অধীন করে দেন। কিন্তু খেলাফতে আব্বাসিয়ার পদচ্যুৎ কর্মকর্তারা এখনো গোপন তৎপরতায় লিপ্ত। সুলতান আইউবীর রামাল্লা পরাজয় তাদের জন্য সোনালী সুযোগ এনে দেয়। এই আব্বাসীরা গোপন পন্থায় সুলতান আইউবী এবং তার বাহিনীকে চরিত্রহীন, বিলাসী, লুটেরা এবং পরাজয়ের জন্য দায়ী প্রচারে তৎপর হয়ে ওঠে।

এই ধৃত লোকটিও তাদেরই একজন। 

আলী বিন সুফিয়ান লোকটিকে হেফাজতে নিয়ে নেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েদখানায় আটক করে রাখেন।

***

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা রাতে দরবেশের নির্ধারিত সময়ে গ্রামের বাইরে এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। গত রাতের সৈনিক তাকে নিতে চলে আসে। সৈনিক তাকে নতুন কিছু উপদেশ দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তারা পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু গোয়েন্দাকে গত রাতের কক্ষের পরিবর্তে অন্য এক কক্ষে নিয়ে বসায়। এই কক্ষে কালো দাড়িওয়ালা বুযুর্গ নেই- কেউ নেই। তাকে রেখে সৈনিকও বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। গোয়েন্দা দরজায় হাত লাগিয়ে বুঝতে পারে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কক্ষে কোনো জানালা নেই। গোয়েন্দা বুঝে। ফেলে আমি ধরা পড়ে গেছি। এরা জেনে গেছে, আমি গুপ্তচর। পালাবার কোনো পথ নেই। কী করা যায় ভাবতে শুরু করে গোয়েন্দা।

অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। যে দুটি মেয়েকে দরবেশ নিজের কন্যা পরিচয় দিয়েছিলো, তাদের একজন ভেতরে প্রবেশ করে। এখন সে পূর্বের ন্যায় আপাদমস্তক পর্দাবৃতা নয়। তবে ইউরোপিয়ানদের ন্যায় নগ্নও নয়। তার পোশাক আরব নারীদের পোশাকের ন্যায়। কারুকাজ কিছু এরাবিয়ান, কিছুটা ইউরোপিয়ান। মেয়েটি ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কে যেনো বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। দরজা আবারো বন্ধ হয়ে যায়। কক্ষে প্রদীপ জ্বলছে। মেয়েটির প্রতি চোখ পড়ামাত্র গোয়েন্দার চোখ বিস্ময়ে নিষ্পলক হয়ে যায়।

মেয়েটি মিটি মিটি হাসছে।

চেনার চেষ্টা করছে, না?- মেয়েটি বললো- এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেছো? তুমি আমার শহর থেকে রক্ষা পেয়ে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু এখন নিজ ভূখণ্ডে আমর কয়েদি হয়ে গেছে। এখন আর বেরুতে পারবে না।

গোয়েন্দা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, যাতে প্রশান্তিও আছে, উদ্বেগও আছে। গোয়েন্দার তিন বছর আগের কাহিনী মনে পড়ে যায়। তাকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আক্রা প্রেরণ করা হয়েছিলো। আক্রা তখন খৃস্টানদের দখলে ছিলো। সেখানে তাদের বড় পাদ্রীর আস্তানা ছিলো, যাকে ক্রুশের মহান মোহাফেজ বলে অভিহিত করা হতো। যেসব খৃস্টান সম্রাট আরব এলাকা দখল করার জন্য আসতেন, তারা অবশ্যই সেখানে যেতেন এবং বড় পাদ্রীর আশির্বাদ। গ্রহণ করতেন। সে কারণে সামরিক দিক থেকে স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। আলী বিন সুফিয়ান সেখানে গোয়েন্দা প্রেরণ করে রেখেছিলেন। তারা সেখানে খৃস্টানবেশে একটি আস্তানাও গড়ে তুলেছিলো। তাদের তিন-চারজন গোয়েন্দা শত্রুর হাতে ধরা পড়েছিলো এবং দুজন শহীদ হয়েছিলো। ফলে সেখানকার কমান্ডার আরো গোয়েন্দা চেয়ে বার্তা প্রেরণ করেছিলো। তখন নতুনভাবে যাদের প্রেরণ করা হয়েছিলো, তাদের একজন এই গোয়েন্দা, যে এখন মিসরের একটি কক্ষে শক্রর হাতে বন্দি।

লোকটির গাত্রবর্ণ, দৈহিক কাঠামো ও মুখাবয়ব অত্যন্ত সুন্দর ও আকর্ষণীয়। বুদ্ধিমত্তাও অতিশয় প্রখর ও সতর্ক। অশ্বচালনায় এতোই দক্ষ যে, সামরিক মহড়া ও সমর প্রদর্শনীতে নিজের কৃতিত্ব-যোগ্যতা দেখিয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিতে। চরিত্রও ফুলের মতো পবিত্র। খৃস্টান নাম ধারণ করে সে আক্রা প্রবেশ করেছিলো এবং নিজের দুর্দশা ও নির্যাতনের কাহিনী শুনিয়ে বলেছিলো, আমি হাবের মুসলিম বাহিনীতে নতুন সৈনিকদেরকে অশ্বচালনা প্রশিক্ষণ দিতাম। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা আমার এক যুবতী বোনকে অপহরণ করে আমাকে অন্যায়ভাবে ফৌজ থেকে বের করে দিয়েছে।

খৃস্টানরা তার চাল-চলন ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে অশ্বচালনার প্রশিক্ষণের জন্য রেখে দেয়। কিন্তু তার শিষ্যরা সৈনিক নয়। তারা যুবতী মেয়ে এবং বড় বড় অফিসারদের পুত্র। গোয়েন্দা জানতে পারে, এই মেয়েগুলোকে মুসলমানদের বিভিন্ন অঞ্চলে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরে কতিপয় পুরুষকেও তার হাতে তুলে দেয়া হয়। এরা সকলে খৃস্টান গোয়েন্দা। মুসলিম গোয়েন্দা তাদের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। খৃস্টানদের থেকে সে মোটা অংকের ভাতাও পেতে শুরু করে।

এই মেয়েটি যে এখন তার সঙ্গে কক্ষে কথা বলছে- আক্ৰায় তার শিষ্য ছিলো। মেয়েটির গুপ্তচরবৃত্তির যোগ্যতা ছিলো; কিন্তু অশ্বচালনা জানতো না। আলী বিন সুফিয়ানের এই গোয়েন্দার মেয়েটিকে ভালো লাগতে শুরু করে। প্রথমে ভালো লাগা, তারপর ভালোবাসা। অবশেষে দুজনের মাঝে গভীর প্রণয় জমে যায়। এক পর্যায়ে গুরু-শিষ্য নয় প্রেমিক-প্রেমিকা পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। মেয়েটি এমনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, এই লোকটির খাতিরে গুপ্তচরবৃত্তির মতো হীন পেশাটা ছেড়ে দেবে এবং তার স্ত্রী হয়ে সম্মানের জীবনযাপন করবে। মুসলমান গোয়েন্দা তার ভালোবাসার উত্তর ভালবাসা দ্বারাই দিয়েছিলো বটে; কিন্তু কর্তব্য পরিত্যাগ করতে পারেনি। মেয়েটি কাজ-কর্মে অবহেলা করতে শুরু করেছিলো। প্রেমিক গুরুকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগছিলো না।

একদিন আক্রায় দুজন মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়ে যায়। তাদের একজন তার জানামতো সকল সহকর্মীর ঠিকানা বলে দেয়। এই গোয়েন্দাও তাদের একজন ছিলো। খোঁজাখোজি শুরু হয়ে যায়। মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করে- তুমি গুপ্তচর নও তো? মুসলমান নও তো? শুনেছি, এখানকার গোয়েন্দা বিভাগ তোমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছে এবং তোমার উপর নজর রাখছে।

জবাবে গোয়েন্দা হেসে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু মনটা তার অস্থির হয়ে ওঠে। রাতে কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কমান্ডার বললো, আমাদের বহু লোক চিহ্নিত হয়ে গেছে। সম্ভব হলে এখান থেকে বেরিয়ে যাও।

গোয়েন্দা কমান্ডারের গৃহ থেকে বের হয়ে টের পায়, দুব্যক্তি তাকে অনুসরণ করছে। সে এগিয়ে গিয়ে আস্তাবলে ঢুকে পড়ে। একটি ঘোড়ায় জিন কষে। অমনি দুজন লোক এসে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাচ্ছো? লোকটি অত্যন্ত চৌকস ও সতর্ক। অবস্থা বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়েই ঘোড়া হাঁকায়। একজন তাঁর ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। অপরজন কিছু বুঝতে না বুঝতে সে ছুটতে শুরু করে। গোয়েন্দা আক্ৰা থেকে বেরিয়ে আসে।

***

আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি- গোয়েন্দা মেয়েকে বললো। তিন বছর পর তাদের এই সাক্ষাৎ- আমি বিস্মিত হয়নি। তুমি যে গোয়েন্দা, আমি জানি।

তিন বছর আগে তোমার প্রেমের ফাঁদে পড়ে আমি গুপ্তচরবৃত্তি ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। মেয়েটি বললো- তুমি যদি বলতে, তুমি। মুসলমান এবং গোয়েন্দা, তবু আমি তোমাকে ধোঁকা দিতাম না। আমি তোমার সঙ্গে এসে পড়তাম। তোমার পালিয়ে আসার পর আমি যখন জানতে পারলাম, তুমি মুসলমান গুপ্তচর ছিলে, তখন আমি ব্যাথিত হয়নি। আমার বেদনাটা ছিলো তোমার বিরহের।

এখন কি তোমার হৃদয়ে আমার ভালোবাসা নেই?- গোয়েন্দা জিজ্ঞাসা করে- তুমি এখন আমার দেশে। আমার সঙ্গে আসো। এখানে আমি তোমাকে ধোকা দেবো না।

আছে- মেয়েটি উত্তর দেয়- তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো আছে। কিন্তু কর্তব্য তার উপর বিজয়ী হয়ে গেছে। এটা তোমার অপরাধ। তোমার ভালোবাসার খাতিরে আমি গোয়েন্দাগিরি পরিত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সংকল্পকে দলিত করে আমাকে গুপ্তচরবৃত্তির নোংরামিতে ডুবিয়ে দিয়েছে। তিনটি বছর কেটে গেছে। এই দীর্ঘ সময়টায় আমি নিজেকে জঘন্যরূপে নাপাক করে ফেলেছি। ইসলামের প্রতি ঘৃণা আমার আত্মায় মিশে গেছে। এখন আর প্রেম নয়। এখন তুমি আমার বন্দি। আমি আমার জাতিকে ধোকা দিতে পারি না। আমি যে লোকটির সঙ্গে এসেছি, তাকে বলে দিয়েছি, তুমি গুপ্তচর। তাকে আমি আক্রার সব ঘটনা খুলে বলেছি। বারান্দা দিয়ে অতিক্রম করার সময় যদি আমি তোমাকে না দেখে ফেলতাম, তাহলে আমরা সকলে গ্রেফতার হয়ে যেতাম। তোমাকে আমিই ধরিয়েছি।

তোমাদের যে লোকটি পীর সেজেছে, সে মুসলমান না খৃস্টান? গোয়েন্দা জিজ্ঞাসা করে।

জেনে কী করবে? মেয়েটি পাল্টা প্রশ্ন করে।

গোয়েন্দাগিরি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে- গোয়েন্দা বললো- মৃত্যুর প্রাক্কালে আরো তথ্য জানতে চাই আর কি। এই ভেদ তো এখন আর বাইরে নিতে পারবো না।

মুসলমান- মেয়েটি বললো- মুসলমানদের দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত ওস্তাদদেরও ওস্তাদ।

কক্ষের দরজা খুলে যায়। কলো দাড়িওয়ালা দরবেশ এক ব্যক্তির সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেই মেয়েটিকে বললো- তোমার কথা-বার্তা শেষ হয়ে থাকলে বেরিয়ে যাও।

মেয়েটি গোয়েন্দার প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বেরিয়ে যায়।

দরবেশ গোয়েন্দাকে বললো- শুধু এটুকু বলল, আমার ভেদ কার কার জানা আছে। তুমি কি আলী বিন সুফিয়ানকে বলে দিয়েছে, আমি সন্দেহভাজন?

না- গোয়েন্দা জবাব দেয়- আমি গোয়েন্দা বটে; কিন্তু এখানে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আসিনি।

দরবেশের হাতে হান্টার (চামড়ার চাবুক) ছিলো। সে পূর্ণ শক্তিতে গোয়েন্দাকে প্রহার করতে করতে বললো- আমি সত্য কথা শুনতে চাই।

কক্ষের দরজাটা সজোরে খুলে যায়। মেয়েটি ভেতরে প্রবেশ করে। সে দরবেশের উভয় হাত ধরে বিনয়ের সাথে বললো- একে মেরো না, সব বলে দেবে।

না, আমি কিছুই বলবো না। গোয়েন্দা বজ্রকণ্ঠে বললো।

 দরবেশ আবারো প্রহার করতে উদ্যত হয়। মেয়েটি ছুটে গিয়ে গোয়েন্দার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। চীৎকার করে বলে ওঠে- মেরো না। এর দেহের আঘাত আমার হৃদয়ের জখমে পরিণত হবে।

তুমি কি একে রক্ষা করতে চাচ্ছো? অপর ব্যক্তি গর্জে ওঠে জিজ্ঞেস করে।

না- মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো- লোকটি যদি কোনো তথ্য না দেয়, তাহলে তরবারীর এক আঘাতে এর মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলো। নির্যাতন দিয়ে হত্যা করো না।

মেয়েটিকে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। গোয়েন্দার উপর অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। সারাটা রাত তাকে শয্যায় পিঠ লাগাতে দেয়া হলো না। তাকে বহু কিছু জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। নির্যাতনের পর নির্যাতন চলছে; তবু কোন তথ্য দিচ্ছে না।

রাতের শেষ প্রহর। মেয়েটি তার কক্ষে প্রবেশ করে। গোয়েন্দা অর্ধ অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। দরবেশের লোকেরা তরবারীর আগা দ্বারা তার শরীরে খোঁচাচ্ছে। দেখে মেয়েটি তার গায়ের উপর শুয়ে পড়ে চীৎকার করতে শুরু করে- এ আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি তোমাকে বলে দিয়েছি, এটা আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। এর কষ্ট আমার কষ্ট। লোকটি তার কর্তব্য পালন করছে আর আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। একে তোমরা প্রাণে মেরে ফেলো- নির্যাতন করো না।

গোয়েন্দা অর্ধ অচেতন অবস্থায় নিজ গায়ের উপর পড়ে থাকা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে বললো- তুমি চলে যাও। পাছে আমি আমার কর্তব্য থেকে ছিটকে না পড়ি। এই অত্যাচার আমার কর্তব্যেরই অংশ। তুমি তোমার ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করো আর আমাকে আমার দীনের জন্য জান কুরবান করতে দাও।

মেয়েটি পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাকে পুনরায় টেনে-হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।

দরবেশ আদেশ করে– এই হতভাগীকে একটি কক্ষে আটকে রাখো।

***

দিনের অর্ধেকটা কেটে গেছে। আলী বিন সুফিয়ান তার গোয়েন্দার ফিরে আসার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠেছেন। তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে। সেই রাতে গেলো; এখনো ফিরলো না কেন! গতকাল তিনি শুভ্র শশ্রুমন্ডিত যে লোকটিকে পাকড়াও করেছিলেন, কয়েদখানায় রাতে নির্যাতনের মাধ্যমে তার থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে, কালো দাড়িওয়ালা দরবেশটা কে, তার আসল পরিচয় কী এবং তার মিশন কী।

দিবসের শেষ বেলা আলী বিন সুফিয়ান একটি কমান্ডো সেনাদল প্রস্তুত করেন। এখন তার প্রবল ধারণা, তাঁর প্রেরিত গোয়েন্দা ধরা পড়ে গেছে। আস্তানাটি যে শত্রুর নাশকতাকারী গোয়েন্দাদের আড্ডাখানা, তা এখন প্রমাণিত।

আলী বিন সুফিয়ান-এর কমান্ডোরা এতো দ্রুততার সঙ্গে এসে পৌঁছে যে, এলাকাবাসি কিছুই বুঝে ওঠতে পারেনি। তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বানরের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পলকের মধ্যে ভেতরের সবগুলো লোককে ধরে ফেলে।

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা একটি কক্ষে অচেতন পড়ে আছে। তার মুমূর্য অবস্থা। তার প্রেমিকা মেয়েটি এক কক্ষে মেঝেতে পড়ে আছে। তার বুকে একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে। আমি আত্মহত্যা করেছি বলেই মেয়েটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এলাকাবাসী ঘটনাটা টের পেয়ে গেছে। তারা দরবেশের আস্তানার বাইরে ভিড় জমায়। পরস্পর কানাঘুষা চলছে।

দরবেশকে বের করে জনতার সম্মুখে দাঁড় করানো হলো। তাকে বলা হলো, আসল পরিচয় নিজ মুখে শোনাও। জনতাকে বলো, কী উদ্যেশ্যে মিসরের ফৌজ ও সুলতান আইউবীর দুর্নাম রটনা করছে।

দরবেশ সত্য সত্য বলে দেয়। মানুষ তার যে পরিচয় জানে, সব ভুয়া। আসল পরিচয়, সে খৃস্টানদের চর এবং নাশকতার হোতা। ইদানিংকার দেশময় অপপ্রচারের মূল নায়ক।

এক মেয়ে মারা গেছে। অপর মেয়েকে জনতার সম্মুখে উপস্থিত করা হলো এবং বলা হলো, এই মেয়েটি মুসলমান নয়- খৃস্টান। জনতাকে আরো অবহিত করা হলো, রামাল্লা থেকে আশার পথে পার্বত্য এলাকায় আগুনের কাছে যে পানি ও খেজুর পড়ে ছিলো, সেগুলো এদেরই লোকেরা রেখেছিলো।

আলী বিন সুফিয়ান তাঁর পাতাল কক্ষে ধৃত দরবেশ ও সাঙ্গপাঙ্গদের থেকে যেসব তথ্য লাভ করেছেন, তাতে জানা গেলো, লোকটি রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে আসা নতুন সৈন্যদেরকে ফন্দি করে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিলো। সঙ্গে তার নিজেরও লোক ছিলো। এরা বিভিন্ন মসজিদ ও নানা লোক সমাগমের স্থানে মিসরের ফৌজের বিরুদ্ধে কথা বলতো। উদ্দেশ্য ছিলো, দেশের জনগণ ও ফৌজের মাঝে সংশয় ও ঘৃণার প্রাচীর দাঁড় করানো। এই মিশনে মিসরের প্রশাসনের জনাকয়েক কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাচ্যুৎ আব্বাসী খেলাফতের গোপন কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মোটকথা, দুশমনের পরিচালিত এই অভিযানে স্বার্থপূজারী ঈমান বিক্রেতা মুসলমানও অংশীদার ছিলো।

যখন দেশের সেনা বাহিনী ও জনগণের মাঝে ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে যাবে, তখন বুঝে নিও সালতানাতে ইসলামিয়ার পতন শুরু হয়ে গেছে- সুলতান আইউবী বললেন। তিনি নির্দেশ জারি করেন। দেশের সমস্ত মসজিদের ইমামদেরকে রামাল্লার পরাজয়ের প্রকৃত কারণ অবহিত করার ব্যবস্থা করো। ইমামগণ বিষয়টি দেশের মানুষকে অবহিত করবেন। কাউকে দায়ী কিংবা অভিযুক্ত করে যদি কেউ শান্তি লাভ করে থাকে, তাহলে সব দায় দায়িত্ব আমার উপর চাপাও। ফিলিস্তিনের রণাঙ্গনে জীবন দিয়ে আমি জাতির সেই লোকগুলোর গুনাহের কাফফারা আদায় করবো, যারা ক্ষমতার নেশায় আমার ফৌজ ও ফিলিস্তীনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তখন আমার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা চীৎকার করে করে জানান দেবে, রামাল্লার পরাজয়ের জন্য ফৌজ দায়ী ছিলো না এবং মিসরের একজন ফৌজও কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলো না।

[ষষ্ঠ খণ্ড সমাপ্ত]

1 Comment
Collapse Comments

পরবর্তী দুই খন্ডের আশায়।।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *