৬.৩ রাঙা নাও

৬.৩ রাঙা নাও

যে-দিন নাও গড়ানি, শেষ হইল সেদিন মিস্ত্রিদের খুশি আর ধরে না। দীর্ঘদিনের চেষ্টা ও শ্রম আজ সফল হইল। এমন একখান চিজ তারা গড়িয়া দিল যে-চিজ অনেক— অনেকদিন পর্যন্ত জলের উপর ভাসিবে—কত লোক তাতে চড়িবে, বসিবে, নদী পার হইবে-এক দেশ হইতে আরেক দেশে যাইবে—কত জায়গায় দৌড়াইবে, বখশিস পাইবে— আর এই চারজনার হাতের স্বাক্ষর স্বগর্বে বহন করিতে থাকিবে। কেউ জানিবে না, কারা গড়িয়াছিল, কাঁদের বিন্দু বিন্দু শ্রম ও বুদ্ধির সঞ্চয় সম্বল করিয়া ধীরে ধীরে সে গড়িয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু নাও? সে কি ভুলিয়া যাইবে এই চার জনকে? কিছুতেই না!

সেদিন তাদের খুশি উপচাইয়া উঠিল। লোকজন জড় করিয়া চারি জনে মিলিয়া তারা পায়ের পরে পা ফেলিয়া নাচিল এবং সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়া গাহিল—শুনরে নগইরা লোক, নাও গড়াইতে কত সুখ।।

নাও-গড়ানি শেষ করিয়া মিস্ত্রীরা পাওনা গণ্ডা বুঝিয়া লইয়া  সত্যি একদিন কাঠের বাক্স মাথায় করিল, হাঁটুর কাপড় টানিয়া টানিয়া খাল পার হইল এবং গোপাটের পথ ধরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহাদিগকে দেখিতে পাওয়া গেল, কিন্তু দেখিতে তারা এক-একটা কাকের মত ছোট হইয়া গেল, তারপর এক সময় আর তাহাদিগকে দেখা গেল না!

আর একদিন কোথা হইতে তিনজন কারিগর আসিয়া দিনরাত কাজ করিয়া নৌকায় তুলি বুলাইয়া বুলাইয়া রঙ লাগাইয়া গেল। দুই পাশে লতা হইল, পাতা হইল, সাপ হইল, ময়ুর হইল আর একজোড়া করিয়া পালোয়ান হইল।

তারপর একদিন নৌকা জলে ভাসিল। ছাদির পাড়ার লোক ডাকিয়া আনিয়াছিল আর আনিয়াছিল এক হাঁড়ি বাতাসা। তাহারা নৌকার গোরায় গোরায় ধরিল; একজন বলিল, জোর আছে? সকলে বলিল, আছে। আবার সকলে বলিল, যে জোর থুইয়া জোর না করে তার জোর খায় মরা কাষ্টে রে-এ-এ…। এই বলিয়া এমন জোরে টান মারিল যে, নৌকা একটানেই জলে গিয়া পড়িল। কিন্তু তারা নৌকা থামিতে দিল না, সকলে মিলিয়া গায়ের জোরে ঠেলা দিল। ঠেলার বেগে নৌকা তিতাসের মাঝ পর্যন্ত গিয়া থামিল। ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে তালে হেলিয়া তুলিয়া নাচিতে লাগিল। রমুর দুই চোখও আনন্দে নাচিতে লাগিল।

অমন অপূর্ব জিনিস আর দেখা যায় নাই! এমন রঙ, এমন শোভা! ধনুকের মত বাকী আসমানের রামধনুটা বুঝিবা উল্টাইয়া তিতাসের জলের উপর পড়িয়া গিয়াছে।

ভাদ্রের পয়লা তারিখে কাদিরের বাড়িতে খুব ধুমধাম পড়িল। সকাল হইতে না হইতেই শত শত জোরদার চাষী তরুণ সেদিন তার বাড়িতে জমায়েত হইল। তারপর তারা রাঙা বৈঠা হাতে করিয়া নৌকায় উঠিয়া গোরায়-গোরায় বসিয়া গেল।

রমু এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করিতেছিল। এই সময় তার বাপকে একান্তে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বা’জান তোমরা নাও দৌড়াইতে যাইবা, আমারে নিবা না?

‘অখন কিসের নাও-দোঁড়ানি? অখন ত খালি তালিম দিতে যাই। নাও-দৌড়াইতে যামু দুপরের পর।’

তখন আমারে নিবা না?

‘হ হ’, বলিয়া ছাদির ঝড়ের বেগে ছুটিয়া গেল।

গাঙ-বিলে ঘুরিয়া, গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরিয়া তালিম দিয়া আসিয়া দেখা গেল, নাও খুব ভাল হইয়াছে, চলেও খুব। সব লোকে একযোগে বৈঠা মারিলে সাপের মত হিস্ হিস্‌ করিয়া চলে, শিকারীর তীরের মত সাঁ সাঁ করিয়া চলে, গাঙের সোতের মত কলকল করিয়া চলে।

সকলে দুপুরের খাওয়া সারিয়া আবার যখন বৈঠা হাতে করিয়া নৌকায় উঠিল, রমুও তখন সকলের দেখাদেখি, রাঙা লুঙ্গিখানা পরিয়া, গেঞ্জিখানা গায়ে দিয়া এবং রঙিন টুপিখানা মাথায় চড়াইয়া সকলের সমারোহের মধ্যে নদীর পারে আসিয়া দাঁড়াইল।

দুই পাশে তুই সারি লোক বৈঠা হাতে বসিয়া পড়িল। মাঝখানে কয়েকখানা তক্তার উপর, মাস্তুলের মত ছোট একখানা খুঁটি ঘিরিয়া কয়েকজন প্রবীণ লোক দাঁড়াইল। তারা সারি গাহিবে। একটি ঢোলক এবং কয়েকজোড়া করতালও উঠিল। আর উঠিল কিছু মারপিটের লাঠি।

সব কিছু উঠাইয়া ছাদির নিজে উঠিতে যাইবে, এমন সময় রমু তাহাকে কাঁকড়ার দাঁড়ার মত আঁকড়াইয়া ধরিল, ‘বাজান আমারে লইয়া যাও, অ বাজান আমারে লইয়া যাও। ‘

কামের সময় দিক করিস না, ভাল লাগে না। বলিয়া ছাদির তাহাকে এক ঝটিকায় ছাড়াইয়া, ঠেলিয়া দিল, তারপর নৌকায় উঠিয়া হালের খুঁটিতে হাত দিল।

আলীর নাম স্মরণ করিয়া তাহার নৌকা খুলিল, শত শত বৈঠা এক সঙ্গে উঠিল, পড়িল, জলের উপর কুয়াসা সৃষ্টি করিল, তারপর তিতাসের বুক চিরিয়া যেন একখানা শিকারীর তীর হিস্ হিস করিয়া ছুটিয়া চলিল।

ছাদির যখন হাল-কাঠি ধরিয়া সারিগানের তালে তালে তক্তার উপর পদাঘাত করিয়া নাচিতেছে, রমু তখন তিতাসের শূন্য তীরে বসিয়া ফোঁফাইয়া ফোঁফাইয়া কাঁদিতেছে। নানা সাধিল, মা সাধিল, কিন্তু কারো কথা সে শুনিল না। মুখে তখনও সে বলিতেছে, ‘বাজান, আমারে লইয়া যাও।‘

 

তিতাসের বুকে সেদিন অনেকগুলি পালের নৌকা দেখা গেল। সব নেীকারই গতি এক দিকে। যে স্থানে আজ দুপুরের পর নৌকা-দৌড় হইবে, সেই দিক লক্ষ্য করিয়া ছোট বড় নানা আকারের পালের নৌকা ছুটিয়া চলিয়াছে। অনেক নৌকাতেই যত পুরুষ তার বেশি স্ত্রীলোক। বনমালীর নৌকাতেও তাই। পুরুষের মধ্যে বনমালী নিজে আর বড়বাড়ির দুইজন। তাছাড়া অনন্ত। মেয়েদের মধ্যে আসিয়াছে বড়বাড়ির সকলে আর তাদের নন্দিনী অনন্তবালা, আর আসিয়াছে বনমালীর বোন উদয়তারা।

নৌকা-দৌড়ের স্থানটিতে গিয়া দেখে সে এক বিরাট কাও। তিতাসটা এইখান হইতে মাইল খানেক পর্যন্ত অনেকটা মোটা হইয়া গিয়াছে। তারই দুইপার ঘেঁষিয়া হাজার হাজার ছোট বড় ছইওয়ালা নৌকা খুঁটি পুতিয়াছে। কোথাও বড় বড় নৌকা গেরাপি দিয়াছে, আর তাহারই ডাইনে বাঁয়ে ও সামনের দিকে দশ বিশটা ছোট নৌকা তাহাকে আশ্রয় করিয়৷ রহিয়াছে। এই ভাবে যত দূর চোখ মেলা যায়, কেবল নৌকা আর নৌকা, আর তাতে মানুষের বোঝাই। নদীর মাঝখান দিয়া দৌড়ের নৌকার প্রতিযোগিতার পথ।

সবে বেলা পড়িতে শুরু করিয়াছে। প্রতিযোগিতা শুরু হইবে শেষবেলার দিকে। এখন দৌড়ের নৌকাণ্ডলি ধীরেসুস্থে বৈঠা ফেলিয়া নানা সুরের সারিগান গাহিয়া গাঙ্‌ময় এধার ওধার ঘুরিয়া ফিরিতেছে। হাজার হাজার দর্শকের নৌকা হইতে দর্শকের সে-সব নৌকার কারুকার্য দেখিতেছে, বৈঠা মারিয়া কি করিয়া উহারা জলের কুয়াসা সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা দেখিতেছে।

এক সঙ্গে এতগুলি দৌড়ের নাও দেখিয়া অনন্তর বুক আনন্দে লাফাইয়া উঠিল। একটা না ও ছাৎ করিয়া অতি নিকট দিয়াই চকিতে চলিয়া গেল, গানের কলিটাও শোনা গেল বেশ—আকাঠ মান্দাইলের নাও, ঝুমুর ঝুমুর করে নাও, জিত্যা আইলাম রে, নাওয়ের গলুই পাইলাম না।

গানের মত গান গাহিতেছে বটে একখান নৌকা। ধীরে সুস্থে চলিতেছে। বৈঠা জলে ছোঁয়াইয়া একসাথে শত শত বৈঠাকে উল্টাইয়া উপরে তুলিতেছে আর বৈঠার গোড়াটাকে একই সাথে নাওয়ের বাতায় ঠেকাইয়া বৈঠাধারীরা সামনের দিকে ঝুঁকিতেছে, আবার বৈঠা তুলিয়া জলে ফেলিতেছে। যেন হাজার ফলার একখানা ছুরি যাইতেছে আর তার সবগুলি ফলা একসাথে উঠিতেছে পড়িতেছে, আবার খাড়া হইয়া শির উচাইতেছে। মাঝখানে থাকিয়া একদল লোক গাহিতেছে, আর বৈঠাধারীরা সকলে এক তালে সে গানের পদগুলির পুনরাবৃত্তি করিতেছে।

তারে ডাক দে, দলানের বাইর হইয়া গো, অ দিদি প্রা-ণ্‌ বন্ধুরে তোরা ডাক দে ॥

আমার বন্ধু খাইবে ভাত, কিন্যা আনলাম ঝাগুর মাছ গো,  অ দিদি দুধের লাগি পাঠাইয়াছি, পয়সা, কি মুকি, কি টেকা গো, আ দিদি প্রাণবন্ধুরে তোরা ডাক দে।।

আমার বন্ধু ঢাকা যায়, গাঙ্‌ পারে রান্ধিয়া খায় গো, অ দিদি জোয়ারে ভাসাইয়া নিল হাঁড়ি, কি ঘটি, কি বাটি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।

আমার বন্ধু রঙ্গি ঢঙ্গি, হাওরে বেন্ধেছে টঙ্গি গো, আ দিদি, টঙ্গির নাম রেখেছে উদয়তারা, কি তারা গো, আ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।

আমার বন্ধু আসবে বলি, দুয়ারে না দিলাম খিলি গো, অ দিদি, ধন থুইয়া যৈবন করল চুরি, কি চুরি, কি চুরি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।

উদয়তারা হাসিল, ‘খুব ত গান। মাঝখানে আমার নামখানি ঢুকাইয়া খুইছে।’

সকলেই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সকল নৌকাতেই এমন সুন্দর গান হইতেছে তাহা নয়। একটি নৌকা হইতে শোনা গেল নিতান্ত গদ্যভাবের গান—চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে, দারোগা জিজ্ঞাসে, আরে চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে ॥ দর্শকদের এক নৌকা হইতে কেউ বলিয়া উঠিল, ও, চিনিয়াছি; বিজেশ্বর গ্রামের নাও, চর দখল করিতে গিয়া উহারাই খুনখুনি করিয়াছিল। গানটা বাঁধিয়াছে সেই ভাব থেকেই।

তারপর যে দুইখানা নাও সারি গাহিয়া গেল, তাহাদের একটি হইতে শোনা গেল—জ্যৈষ্ঠ না আষাঢ় মাসে যমুনা উথলে গো, যাইস না যমুনার জলে। যমুনার ঘাটে যাইতে দেয়ায় করল আন্ধি। পন্থহারা হইয়া আমরা কিষ্ণ বলে কান্দি ॥ যমুনার ঘাটে যাইতে বাইরে-ঘরে জ্বালা। বসন ধরিয়া টানে নন্দের ঘরের কালা ॥

পরের নাওখানার গান শুনিয়া বোঝা গেল রাধা বিপ্রলব্ধা হইয়াছে— আম গাছে আম নাই ইটা কেনে মারো, তোমায় আমায় দেখা নাই আঁখি কেনে ঠারো। তুমি আমি করলাম পীরিত কদমতলায় রইয়া, শক্ত রবাদী পাড়াপড়শী তারা দিল কইয়া।।

সঙ্গের একখানা ছইওয়াল নৌকা হইতে বলিতে শোনা গেল, গোঁসাইপুরের নিকট রাধানগর আর কিষ্টনগর নামে দুই গাও আছে—সেই দুই গ্রামেরই এই দুই নাও।

শুনিয়া বনমালী মন্তব্য করিল, তবে একখানাতে রাধাউক্তি আরেকখানাতে কিষ্ণউক্তি করিল না কেন? পূর্বোক্ত নৌকা হইতে জবাব আসিল, সবখানেই রাধা রে দাদা, সবখানেই রাধা।

চোখা মন্তব্যটা শুনিয়া আশেপাশের নৌকার লোকজন হাসিয়া উঠিল। এমন সময় বড়বাড়ির একজন উদয়তারার মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া বলিল, এদিকে শুন ভইন কি মজার গানখান হইতেছে—

ও তোরে দেখিনাই রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে। থানায় থানায় চকিদার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, কোন্‌ কোন্‌ নারীর শুভ বরাত, আমার বরাত পুড়ে—বরাত পুইড়া গেলরে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে ॥

হবিগঞ্জে নবীগঞ্জে কোণাকুণি পথ, প্রাণবন্ধু গড়াইয়া দিছে ইল্‌শা-পাট্যা নথ—সে নথ পইড়া গেল রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে ॥

শুনিয়া উদয়তারা একটু হাসিল। পরে খানিকক্ষণ কান খাড়া রাখিয়া বলিল—এমন গান আরও কত আছে —অই শুন না, পেটমোটা পাতাম নাওয়ে কি গানখান হইতেছে—সামনে কলার বাগ, পূব-দুয়ারী ঘর। রাইতে যাইও বন্ধু, প্রাণের নাগর।। আরেকখানা গান অনন্তবালার প্রতি সকলকে সচেতন করিয়া তুলিল—তীরের মত লম্বা নাও, কিন্তু চলিতেছে ধীরে ধীরে; চলিতেছে আর গাহিতেছে—ঝিয়ারীর মাথায় লম্বা কেশ, খোঁপা বান্ধে নানান বেশ, খোঁপার উপর গুঞ্জরে ভোমরা।। গাঙে আইলে আঞ্জন মাঞ্জন, বাড়িতে গেলে কেশের যতন, ঝিয়ারী জানি কোন পীড়িতের মরা ॥

গানটা শুনিতে শুনিতে অনন্তবালার বয়সাধিক বড় খোঁপাটা ধরিয়া উদয়তারা আস্তে একটু মোচড়াইয়া দিল।

অনন্ত আর অনন্তবালার চোখ অন্যদিকে। দুইটি প্রকাও মাটির গামলা বিচিত্র রঙে সাজাইয়া, দুইটি করিয়া হাত-বৈঠা হাতে করিয়া দুইটি লোক উহাদিগকে লইয়া ভাসিয়া পড়িয়াছে। উহাদের মুখে গান নাই, হাতে ছন্দ নাই। ফেশন করিয়া চুল দাড়ি ছাঁটাই করা, মাথায় জব জবে তেল, পরিষ্কার ধুতির উপর গায়ে সাদা গেঞ্জি। মুখ টিপিয়া হাসিতেছে। আর জলে বৈঠা ডুবাইয়া এলোমেলো ভাবে টানিয়া আগাইতেছে।

দেখিতে দেখিতে তারা অনন্তদের নৌকার একান্ত নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে, আর একটু অসাবধান হইলে তাহাদের নাওয়ের বাতায় ঠেকিয়াই গামলা ভাঙ্গিবে। অনন্তবালা হাত বাড়াইয়া ছুঁইতে গেলে লোক দুইটা বৈঠা দেখাইল। বনমালী মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া বলিল, ‘সকলে দৌড়ায় নাও, তাইনে দৌড়ায় গামলা। অনন্ত ও বলিল, ‘জুড়ি কেনে ধরনা তোমরা, দেখতাম কে আগে যাইতে পারে।‘ কিন্তু লোক দুটি এসব কথায় কান দিতেছে না। তাদের দিকে গ্রাম গ্রামান্তরের মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতেছে, ইহাতেই তাহারা খুশি।

‘আমি কেনে একটা গামলা আনলাম না। তা হইলে ত বৈঠা মাইরা বেশ দৌড়াইতাম।‘ অনন্ত বলিল।

‘তুমি একলা পারতা নাকি, জিগাই? তুমি কি ঐ লোকটার মতন চালাক, না চতুর? বৈঠা হাতে লইয়া চাইয়া থাকবা দৌড়ের নাওয়ের দিকে, শুনা কথা, আর কোনখানের কোন যাত্রিকের নাও দিব ধাক্কা। ঠুনকা গামলা ভাঙ্গলে তখন কি হইব। তুমি আমি দুইজনে থাকলে কোন ডর নাই; তুমি যখন একদিকে চাইয়া থাকবা, গামলারে আমি তখন সামলামু। আর গামলা যদি ভাইঙ্গা যায়, তখন তুমি আমারে সামলাইও, কেমুন?’

‘ঠিক কথা।’

তাহারা এইরূপ কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিল, এমনি সময়ে নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে উদয়তার হাসিয়া উঠিল। উদয়তারা এমনি। মনে মনে কোনকিছু ভাবিতে থাকে। ভাবিতে ভাবিতে মন তার অনেকদূর আগাইয়া যায়। কোথাও গিয়া তার চিন্তা ঠেকিয়া যায়। তখন সে কোনদিকে না চাহিয়া, কাহারও উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন না হইয়া, হঠাৎ আপন মনে হাসিয়া উঠে।

স্ত্রীলোকদের একজন, অনন্তবালার কাকীমা, মুখ ফিরাইয়া বলিল, ‘হাসলা কেনে দিদি।‘

‘হাসলাম ভইন একখান কথা মনে কইরা!’

‘কি কথা বেঙের মাথা—ক ও না শুনি।’

উদয়তারা মনে মনে বলিল, সে কথা কি বলা যায়? যে-কথা মনে করিয়া ক্ষণেক্ষণে হাসি, কারুরেই কইলাম না সে কথা—আর তুমি ত তুমি।

অনন্তবালার কাকী তরুণী। কৌতুহলে তুই চোখ ভরা। ছাড়িবার পাত্রী সে নয়। আবার ধরিল। ‘কও না গ দিদি?’

‘কি কমু গ ভইন।‘

‘কেনে হাসলা!’

‘হাসি আইল, হাসলাম।‘

‘জেতা মানুষেরে ভাঁড়াইতে চাও। না কইবা ত না কইবা।’

‘তবে কই শুন। যে-কথাখান মনে কইরা হাসলাম, সেই কথাখান এই—গাঙের উপর দিয়া কত নাও যায়। তারা কত রকমের গান গাইয়া যায়, ভালা গান, বুরা গান—ঘেন্নার গান অঘেন্নার গান! গাইয়া যায় ত?’

‘যায়।’

‘একটু আগেই ত শুনলা, কি বিটলা গান একখান তারা গাইতাছে।’

‘শুনলাম।’

‘তার একটু পরেই শুনলা, একখানা সুন্দর গান গাইয়া গেল।’

‘গেল।’

‘আচ্ছা, এই যে ভালাবুরা গান গাইয়া যায়—আমি ভাবি, গাঙ্গের বুকে ত সেই ভালাবুরার আর কোন রেখ ই থাকে না। থাকে কি?

‘না।‘

‘এইজন্যই হাসলাম।’

‘আমিও কথাখান বুঝলাম।‘

‘বুঝলা যদি, তা হইলে আসল কথাখান কই। অনন্ত আর অনন্তবালা। নামে নামে মিলছে। মনে মনেও মিলছে। কথাখান এই।‘

 

এমনি সময়ে পাশেই একখানা নৌকা ভিড়িয়াছে, তার মধ্যে একজন স্ত্রীলোককে আরেকজন স্ত্রীলোক এই বলিয়া প্রবোধ দিতেছে, ‘চিন্তা কইরা শরীর কালা কইর না দিদি। গাঙের বুকে কত লোক কত গান গাইয়া যায়, গাঙে কি তার রেখ থাকে?’

এমন সময় অনন্ত ফিসফিস্ করিয়া অনন্তবালার কানের কাছে বলিল, ‘মাসী।‘

অনন্তবালার চোখ কৌতুহলে বড় হইয়া উঠিল। অনন্তর দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সে তার ঐতিহাসিক মাসীকে দেখিল।

বিধবা নারী। এখনও তরুণীর পর্যায়েই দাঁড়াইয়া আছে, কিন্তু শরীরের লাবণ্য ধুইয়া গিয়াছে। মুখখন সুন্দর, কিন্তু মলিন। দেখিলে মায়া লাগে।

‘এই মাসীই তোমারে তাড়াইয়া দিল।‘

‘দিল ত!’

মাসী ডাকে আকৃষ্ট হইয়া সুবলার-বৌ চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তারপর সহসা উদাম হইয়া বলিয়া উঠিল, অনন্ত! আমার অনন্ত!

দুই নৌকার বাত লাগানো ছিল। লাফাইয়া সে এ নৌকাতে আসিয়া উঠিল এবং অনন্তর দিকে দুই হাত বাড়াইয়া দিল। মাসী মাসী বলিয়া অনন্তও হাত বাড়াইল। দেখিল, মাসীর তুই চোখে অশ্রুর বন্যা বহিয়াছে। তাহার নিজের চোখেও জলে ভরিয়া উঠিল।

এমন সময় উদয়তারা পাষাণের মূর্তির মত নিবাত-নিষ্কম্প ভাবে আগাইয়া আসিল।

তার দিকে মন না দিয়া মাসী অনন্তকে আরও জোরে বুকে চাপিয়া ধরিল, তারপর তার পিঠে হাত বুলাইতে বুলাইতে, রুদ্ধ গলা কোন রকমে পরিষ্কার করিয়া বলিল, এতদিন তুই কোথায় ছিলি।

দুই চোখ বুজিয়া সে বলিয়া চলিয়াছে, এতদিন কোথায় ছিলি, কার কাছে ছিলি, কে তোকে খাইতে দিত, কে শুইবার সময় গল্প শুনাইত, ঘুম পাড়াইত/

নির্মম নিষ্ঠুর উদয়তারার স্বর সপ্তমে চড়িল, ‘হ, যারে কুলার বাতাস দিয়া দূর কইরা দেয়, তারে কয় কে ঘুম পাড়াইত!’

অনন্তর পূর্ব-কথা স্মরণ হইল। তার মুখের শিরাগুলি, হাতের কজি দুইটি কঠিন হইয়া উঠিল। মাসীকে ছাড়িয়া দিয়া ঘাড় নিচু করিয়া বলিল, ‘মাসী আমারে তুমি ছাইড়া দেও।‘

‘তুইও কি আমার পর হইয়া গেলি অনন্ত!’

—আপন তো কোন কালে নই মাসী। মার সই তুমি। মা যতদিন ছিল, তোমার কাছে আমার আদরও ততদিনই ছিল। মা মরিয়া গেলে, সে আদর একদিন হাট-বাজারের মতই ভাঙ্গিয়া পড়িল।

—ভাঙ্গিয়া পড়িল! কি করিয়া তুই বুঝিলি যে, ভাঙ্গিয়৷ পড়িল?

—যাও যাও আমি সব বুঝি। যেদিন হইতে মা গেছে, সেদিন হইতে সব গেছে। সেদিন হইতেই আমি ধরিয়া রাখিয়াছি পরবাসী বনবাসী আমি,—যে ডাকিয়া ঘরে লইবে তার ঘরই আমার ঘর, যে ঘৃণা করিয়া তাড়াইয়া দিবে, তার ঘরই আমার পর l

‘আরে বেইমান কাউয়া, এই সগল কথা তোরে কে শিখাইল, কোন বান্দিনীর ঝিয়ে শিখাইল?’

উদয়তারা এবার ফাটিয়া পড়িল, ‘আ লো বান্দিনীর ঘরের চান্দিনী। মুখ সামলাইয়া কথা ক, বুক সামলাইয়া বাড়ি যা। বেশি কথা তুলিস না, ছালার মুখ খুলিস না।’

সুবলার বউ আর সহ করিতে পারিল না। সাংঘাতিক একটা কিছু করিবার আয়োজনে সে আরও একটু আগাইয়া আসিয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিল। অনন্তও জোর করিয়া মাসীর হাত ছাড়াইয়া উদয়তারার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ করিয়া লইয়া বলিল, ‘তুমি আমারে আদর জানাইও না মাসী।‘

মাসীর ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গিয়া গেল। অপমানে তার মাথা লুটাইয়া পড়িতে চাহিল। উদয়তারা অবিশ্রাম গালি দিয়া চলিয়াছে। সবই অনন্তর জন্য। রাগে মাসীর আপাদমস্তক জলিয়া গেল, বলিল, আদর আমি তোকে জানাইবই, তবে, মুখে নয়, হাতে।

এই বলিয়া সে অনন্তর চুলের মুঠি ধরিয়া পিঠে দুম্‌দুম্‌ করিয়া কীল মারিতে লাগিল। অনন্ত ভয়ার্ত চোখে মাসীর ক্রুদ্ধ জলস্ত চোখ দুটির দিকে চাহিয়াই চোখ নত করিল এবং তার ক্রোধের আগুনে নিজেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দিল। মার খাইতে খাইতে অনন্ত পাটাতনে নেতাইয়া পড়িল। সকলে থ হইয়া দেখিতেছিল। সহসা যেন সম্বিৎ পাইয়া উদয়তারা গর্জাইয়া উঠিল এবং সিংহিনীর থাবা হইতে হরিণ-শিশুর মত অনন্তকে মাসীর কবল হইতে মুক্ত করিল। অনন্ত তখন বলির কবুতরের মত কাঁপিতেছে।

তারপর যে কাণ্ড হইল তাহা বলিবার নয়। উদয়তারা সহ নৌকার সব কয়জন স্ত্রীলোক মিলিয়া সুবলার বৌকে পাটাতনে শোয়াইল, তারপর সকলে সমবেতভাবে হাতেপায়ে প্রহারের পর প্রহারের দ্বারা জর্জরিত করিতে লাগিল।

অনেক মার মারিয়া জব্দ করার পর, শেষে তাহারা ছাড়িয়া দিল। অতি কষ্টে দেহটা টানিয়া তুলিয়া সুবলার-বৌ বুকের ও উরুর কাপড় ঠিক করিল এবং আলুথালু বেশে টলিতে টলিতে নিজেদের নৌকায় গিয়া উঠিল। চারিদিকের নৌকাণ্ডলি হইতে হাজার হাজার লোক তখন তাহার দিকে চাহিয়া আছে।

অপমানে, লজ্জায় সে আর মাথা তুলিতে পারিল না। সঙ্গিনীরা তাহাকে ধরিয়া বসাইলে সে পাটাতনের উপর শুইয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

উদয়তারার দল বিজয়গর্বে ফুলিতে লাগিল। কিন্তু অনন্ত তখনও কাঁপিতেছে। পুরুষেরা দাঁড় টানিয়া নৌকা সরাইয়া লইতেছে। আর কোনদিন বোধ হয় দেখা হইবে না। অনন্ত ভয়েভয়ে ওদিকে ঘাড় ফিরাইল। মাসী পাঠাতনের উপর উপুড় হইয়া ফোঁপাইতেছে। সেই নৌকার পুরুষেরা হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছিল। বলিল, থাক আর নাও-দোঁড়ানি দেখিয়া কাজ নাই। চল ফিরিয়া যাই।

তাহারা ফিরিয়া চলিল। অনেক দূরপথ। কিন্তু তাড়া নাই। অনেক বেলা আছে। নৌকা-দৌড়ের এলাকা ছাড়াইয়া খোলা জায়গায় আসিয়া তাহার হাপ ছাড়িল। দেখা গেল, এত দেরী করিয়াও একখান নৌকা দৌড়ের এলাকার দিকে যাইতেছে। যাইতেছে আর সারি গাহিতেছে — সকলের সকলি আছে আমার নাই গো কেউ। আমার অন্তরে গরজি উঠে সমুদ্দুরের ঢেউ। নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে। নাও আছে কাণ্ডারী নাই শুধু ডিঙ্গা ভাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *