২১১.
মাদারির মা মানুষের গন্ধ শোঁকে, আওয়াজ শোনে
সেই শুরু, বাকি পথটা আর তাদের কখনো সঙ্গীর অভাব হয় না। বানারহাট থেকে সোজা গিয়ে ল্যাটারাল রোডে উঠতে হবে। বানারহাটের পর থেকেই তারা দেখে সামনে দূরে কোনো ট্রাক যাচ্ছে, বা, তাদের পেছনে কোনো ট্রাক আসছে। গয়েরকাটা থেকে ল্যাটারাল রোডের মাইল পনের-ষোলর দূরত্বে বানারহাট পার হয়ে দূরে দূরে ছড়ানো-ছিটনো ট্রাকের সঙ্গ সংখ্যার দিক থেকে হয়ত তেমন কিছু নয় কিন্তু আর-একটা ট্রাক দেখলেই কেমন উৎসাহ আসে। সবগুলো ট্রাক একই দিকে যাচ্ছে, সবাই একই শ্লোগান বলছে, যে-কোনো ট্রাকের সঙ্গে যে-কোনো ট্রাক বদল করে নিলেও কিছু এসে যাবে না–এতে দূরত্ব আর দূরত্ব থাকে না। মাদারির মার খুব ভালো লাগে।
তাকে ট্রাকে তুলে যেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে সেখানেই বসে আছে। এটা দেবপাড়ার মেয়েদের ভেতরেই একটা কোণ। কোণ হওয়ায় মাদারির মার খুব সুবিধে হয়েছে। সে ড্রাইভারের কেবিনের পেছনের দেয়ালটাতে হেলান দিতে পারছে। নইলে, সে হেলান দেয়ার জন্যে আর-একটা ঘাড় পেত কোথায়? আর, মাদারিটা আছে তার মাথার ওপরে–ইচ্ছে করলেই ডেকে মুখটা দেখে নিতে পারে, বা দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে আসতে পারে।
এই এত লোক, এত ট্রাক, এত মিছিল, এত আওয়াজ, এত কথা–এর ত কোনো মানেই নেই তার কাছে। তাকে যেমন কেউ আজকের মিছিলে যেতে ডাকত না, তেমনি সে-ও ত আজকের মিছিলে আসত না, কোনোভাবেই আসত না। মিছিলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। ফরেস্টের অজস্র লতাপাতা, গাছ, ঝোরা–এর সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন সর্বাঙ্গীণ ও দৈনন্দিন যে সেই সম্পর্কের বাইরে তার পক্ষে আসা সম্ভবই নয়। নেহাত মাদারি জেদ ধরল। আর মাদারির মা এখনই মাদারিকে একা-একা মিছিলে যেতে দিতে চায় না। এখনই যদি মিছিলে চলে যায় মাদারি, তা হলে সে আর-একটা ছেলে পাবে কোথায়? একটা ছেলে ছাড়া ত তার চলবে না। আজ না-হয় সে সঙ্গে এল কিন্তু আর বড় জোর বছর দুয়েক, তারপর ত মাদারি চলে যাবেই–হাসিমারা, শিলিগুড়ি বা নেপাল–তখন? তখন মাদারির মা ছেলে পাবে কোথায়? একটা ছেলে পাবে কোথায়? একটা ছেলে হতে ত বছর লাগে না, কিন্তু আবার একটা ছেলে পেটে নেয়া যেন তার পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে গেছে।
আরো একটা কথা মাদারির মায়ের মনে এসেছে। সে কোনোদিন এত দূরে আসেনি, এত বড় মিছিলে আসেনি! এত দূর-দূর থেকে যখন এত-এত লোক আসছে, তার মধ্যে ত তার আট-না-দশটা ছেলেও থাকতে পারে, অন্তত কয়েকটা ত থাকতেই পারে। তারাও ত দূরে-দূরেই গেছে।
মাদারির মায়ের কাছে এই এত মিছিল, এত মানুষজন, এত হৈ-চৈ একদিক থেকে অর্থহীন হলেও সেই হাটখোলা থেকেই তার কেমন ভাল লাগছিল। প্রথম দিকে না–যখন সে আর মাদারি চা খায়। কিন্তু দেবপাড়ার দলটা এসে যাওয়ার পরই ঐ ভিড়ের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে তার ভাল লাগছিল। প্রত্যেকদিনই ত সকাল থেকে তাকে এরকম হটাই হাঁটতে হয় কিন্তু সে ত গাছপালার লতাপাতার গা ঘেঁষে-ঘেঁষে। আর যদি, সে ফরেস্টের ভেতর ঢুকতে কোনো-কোনো দিন একটু দেরিও করে, ঐ শ্যাওড়াঝোরায় তার ঘরের মধ্যেও ফরেস্টের গন্ধটা ত তাকে ছাড়ে না, এমন-কি ঘুমের মধ্যেও ছাড়ে না। সবুজের তীব্র এক কষা গন্ধ, তার সঙ্গে মিশে যায় ফরেস্টের ভেতর কত পচনের গন্ধ-শুকনো পাতা পচে, মৃত পশু পচে, কাল রাতে গাছ চাপা পড়া লতা পচে। তার সঙ্গে থাকে এমোনিয়ার ঝাঁঝ। আর মাদারির মাকে সেই মিশ্র গন্ধের মধ্যে সব সময় শ্বাস টানতে হয়।
সে যে এই গন্ধ সম্পর্কে সচেতন, তা নয়। এমনকি গন্ধটা যে আছে, তাও তার খেয়াল থাকে না। এরকম অপ্রয়োজনীয় খেয়াল রাখার অবকাশ তার জীবনযাপনে নেই। কিন্তু সেই হাটখোলা থেকেই এত মানুষের ভিড়ে ঘুরতে-ঘুরতে তার কখন যেন হালকা লাগতে শুরু করে, একটু হালকা ভাবে শ্বাসও টানতে পারে যেন। তার পর এই ট্রাকে এত মানুষজনের ভেতরে বসে রাস্তা দিয়ে মাইলের পর মাইল চলে আসতে-আসতে তার শাসটা আরো হালকা হয়, আরো হালকা। তার জীবন কাটানোর নকশা এমন নয় যে একটু দুঃখবিলাস করে, শ্যাওড়াঝোরার কথা তার মনেও আসে না, বা, তার বর্তমান এই মুক্তির সঙ্গে সে শ্যাওড়াঝোরার তুলনাও করতে যায় না, কিন্তু, তার বড় ভাল লাগে এত মানুষের সঙ্গ, এত মানুষের চামড়ার গন্ধ।
মাদারির মা ত মানুষের এই সঙ্গটাই পায় না। এখন, এই মিছিলে, এই ট্রাকে মানুষই তার কাছে প্রধান। যে-মানুষের কাছ থেকে তার দৈনন্দিনের আহার জোটে না বলেই সে ফরেস্টে গিয়ে গাছপালা পশুপাখি কীটপতঙ্গ আর নদীঝোরার সঙ্গে থাকে, সেই মানুষেরই গায়ের গন্ধ তাকে এক মুক্তির স্বাদ দেয়, তার এখনকার দৈনন্দিনের গন্ধের চাপ থেকে তাকে সরিয়ে আনে। সেই সরে আসাটা আস্বাদ করতে মাদারির মা, মাঝে-মাঝে গভীর শ্বাস টানে। একজন লোকও নেই যার সঙ্গে সে এখানে কথা বলতে পারে। হাটের দু-চারজন দোকানদার এলে হয়ত তাকে মাদারির মা বলে অন্তত চিনত, এখন, এক বাহাদুরই চেনে বা দরকার হলে ডাকতে পারে। তার নাম ধরে ডাকতে পারে এমন একজনও না থাকা এই ভিড়ে তাকে ত চুপচাপই বসে থাকতে হয়, এক কোণে। বা, হাটখোলায় যেমন ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এই জলুশ যেখানে নামবে সেখানেও হয়ত একা-একা ঘুরেই বেড়াবে অথচ সঙ্গ পাবে, মানুষের।
যেমন মানুষের গায়ের গন্ধ থেকে মাদারির মা সঙ্গ পায়, তেমনি সঙ্গ পায় মানুষের আওয়াজ থেকে। ফরেস্টের প্রত্যেকটা আওয়াজ ত তার জানা। শুধু শ্যাওড়াঝোরায় তার পাতার ঘরের চারপাশের আওয়াজ নয়, তার ঘর থেকে অনেক দূরে ফরেস্টের ভেতরের আওয়াজগুলোও তার চেনা-মাদারির শ্বাসের মতন চেনা। ফরেস্টে কোনো আওয়াজ অকারণ ঘটে না। প্রত্যেকটা আওয়াজের একটা কারণ। থাকে, ইতিহাস থাকে। ফরেস্টের পশুপাখি পোকামাকড় এই প্রতিটি আওয়াজের কারণ ও ইতিহাস জানে, বোঝে। তাদের শরীর দিয়ে জানে, শরীর দিয়ে বোঝে। আর, শরীর দিয়েই সেই আওয়াজের অর্থের সঙ্গতিতে নিজেকে বদলায়। শরীর দিয়ে যে ফরেস্টের আওয়াজ চেনে না আর শরীর দিয়ে সে-আওয়াজের প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে না–সে ফরেস্টে থাকতে পারে না। কিন্তু মাদারির মা ত আর পশুপাখি কীটপতঙ্গ নয়। তার মানুষের শরীরে ফরেস্টের ঐ আওয়াজ নিশিদিন গ্রহণবর্জনের ত একটা শারীরিক সীমাও আছে। কত লক্ষ বছর আগে মানবজাতির শরীর থেকে যে-আওয়াজ শোনার অভিজ্ঞতা লুপ্ত হয়ে গেছে, এক মাদারির মার শরীরে তা ত আর সঞ্চিত রক্ষিত থাকতে পারে না, শুধু এই সুবাদে যে গ্রাম-শহর ইত্যাদি কোথাও কোনো মানববসতিতে তার জায়গা জোটেনি এবং এক ফরেস্টই তাকে জায়গা দিতে পেরেছে। সব বাদর ত আর মানুষ হয়ে যায়নি, তেমনি, সব মানুষই ত আর গ্রামশহরে চলে যায়নি–এই যুক্তিতে মাদারির মা ত আর নিজের শরীরে লক্ষ বৎসর আগের আরণ্যক স্মৃতি বহন করে যেতে পারে না। মিছিলের এই মানবিক কলরোল তার ভাল লাগে। এই যে সবাই মিলে একটা কথা ধরে গানের মত চেঁচিয়ে ওঠে–তার ভাল লাগে। বর্ষার নদীর চাইতেও, বা আকাশের মেঘের চাইতেও, গমগমিয়ে এই আওয়াজ যে আকাশে উঠে যাচ্ছে–তার ভাল লাগে। এত মানুষের গলার এত কথা–তার ভাল লাগে।
রাতদিন, দিনরাত, মাসবছর, বছরমাস ঝিঁঝির ডাকে আচ্ছন্ন তার কানে এই মানবিক সমবেত স্বর এক পরিচিত বিভ্রম আনে, জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখার মত বিভ্রম। এই এত মানুষের এত আওয়াজ তাকে সেই বিভ্রমে জাগায়।
আর, এখন যেন এই আওয়াজটা আরো দূরে-দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। একটা পাহাড়ের ইশারা মাঝেমধ্যে সামনের ফরেস্টের গাছপালার ওপর দিয়েও কখনো কখনো দেখা যায়। ট্রাকের চাকার তলার মাটিটা ইতিমধ্যেই হয়ত চড়াই ধরেছে। হঠাৎ-হঠাৎ ডাইনে বায়ে:একটু উঁচু দিয়ে যেন একটা ট্রাক চলে যায়। চা বাগানের সবুজ বা মাঠের সবুজের সঙ্গে ট্রাকের সবুজ মিশে থাকে, শুধু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কোনো-কোনো ট্রাকের ওপরের ঝাণ্ডা আর মানুষজনের রঙিন পোশাক। মাঝখানে সবুজের পার্থক্য রেখে এই ট্রাক আর দূরের সেই ট্রাকটা যেন অনেকক্ষণ সমান্তরালে চলে।
তারপর আড়ালে পড়ে যায়।
.
২১২.
পাহাড়, খাদ, নদী, ব্রিজ
ট্রাকটা একটা আওয়াজ করে খানিকটা উঁচুতে ওঠে, তারপর বা দিকে ঘুরে যেতেই সামনে চকচকে এক কাল রাস্তা আর ডান দিকে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে পাহাড়, নীল পাহাড়। মাদারি, তার সানে যারা বসেছিল তাদের দুজনকে দুহাতে একটু সরিয়ে মাঝখান দিয়ে মাথাটা গলিয়ে দেয়, তারপর ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পাহাড় দেখে, আর একবার রাস্তা দেখে। মাদারি যেন বুঝে উঠতে পারে না, তার পক্ষে কোনটা বেশি আকর্ষণীয়। রাস্তা ত তার কাছে নতুন কিছু নয়, ফরেস্টের মতই চেনা, তবু এ রাস্তাটা নতুন লাগে কেন? খোলা রাস্তা–ওপরে আকাশ আর নীচে রাস্তা, এটা ত সে সেই বিন্নাগুড়ি থেকেই দেখে আসছে। কিন্তু এখানে রাস্তাটা যেন আরো খোলা হয়ে যায়–কারণ বা দিকে খাদ, সেই। খাদের ভেতর দিয়ে নদী বয়ে যায় মাঝে-মাঝেই, আর, সেই খাদটা দিয়ে বহুদূরে তাকানো যায়–বহুদূরে নীলচে ফরেস্ট। সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকে মেঘের মত পাহাড়। খানিকটা যেতেই মাদারি বোঝে পাহাড়টা, খুব কাছাকাছি নয়। কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে যে-থিকথিকে জঙ্গল নেমে এসেছে সেটা বোঝা যায় অথচ তার সবুজ রঙ চেনা যায় না। ট্রাকটা নতুন রাস্তায় এত জোরে চলে যে মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে পাশের পাহাড়টাও দিক বদল করছে। মাদারি সামনের দুজনের ফাঁক দিয়ে তার গলা এতটাই বাড়ায় যে দুই। হাত দিয়ে তাকে সামনে ভর সামলাতে হয়। বায়ের যুবকটি বলে, কী দেখিছিস রে?
পাহাড়, পাহাড়
আগত দেখিস নাই কোটত?
না দেখি। এই এত উঁচা পাহাড়ত কায় থাকে?
মানষি থাকে—
নামিবার নাগে না? ঐঠে ঢুকে ক্যানং করি? এ্যানং ফরেস্ট যে নদীও সিন্ধাবার পারিবে না, নদীও ঢুকতে পারবে না–এমন জঙ্গল মাদারি বলে। লোকটি হাসে, এইঠে দেখাছে এ্যানং। ঐঠে তুইও যাবার পারবু।
মাদারি নিজে এরকমই একটা ফরেস্টের একেবারে ভেতরে থাকে কিন্তু সে ত কোনো দিন এতটা দূর থেকে সে-ফরেস্ট দেখেনি।
পারবু? মাদারি, যেন সম্ভাবনাটাকে যাচিয়ে দেখতে চায়। তারপর সেই পাহাড়ের দিকে তাকিয়েই গভীর প্রশ্ন করে, নামিবু ক্যানং করি, এ্যানং উচা?
পথ আছে, পথ ধরি নামিবু, ঐঠেও ত মানষি থাকে—
থাকে? মানষি? ঐঠে? মাদারি জিজ্ঞাসা করে, তারপর একটু চুপ করে গিয়ে নিজে অপরিবর্তিত থেকেই চেঁচায়, হে মা, মা-ই-গে-এ।
মাদারির মা সোজা হয়ে বলে, ক কেনে। কিন্তু মাদারি শুনতে পায় না। সে ওপর থেকে চেঁচায়, হে মা, মা-ই-গে-এ, পাহাড় দেখছু, উচা পাহাড়?
মাদারির কথায় ট্রাকের সবাই হেসে ওঠে। মাদারির মা আস্তেই জবাব দেয়, দেখছু। মাদারির জিজ্ঞাসায় সকলেই মাদারির মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নেয় যেন। মাদারির মা একটু অস্বস্তি বোধ করে–এতগুলো লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ নামায়, আবার চোখ তোলে।
মাদারির মা যেখানে বসেছিল সেখান থেকে দেখায় যেন পাহাড়গুলো পেছন থেকে ছুটে আসছে। তাতে অনেক সময়ই পাহাড়ের চূড়া দেখা যায় না, মনে হয় আকাশ পর্যন্ত ঢাকা পড়ে আছে পাহাড়ে। আবার, কোনো-এক সময় পাহাড়ের দেয়ালটা ভেঙে যায় যেন। বরং বা দিকে তাকালে সে দেখে টানা খাদ চলেছে, আর সেই খাদের ভেতরে, নদী, ঝোরা, চা-বাগান, চষা খেত, দূরে দূরে ফরেস্ট। নাগরাকাটার কাছাকাছি আসার পর দেখা যায়, আরো দুটো-একটা ট্রাক একই ভাবে চলেছে। তাদের কোনোটাকে এই ট্রাক পার হয়ে যায়, আবার কখনো পেছনের একটা ট্রাক, এই ট্রাকটাকে পার হয়ে যায়। পার হওয়ার সময় সেই আগের মতই হাত তুলে হৈ হৈ হচ্ছে, কখনো শ্লোগান বিনিময়ও হচ্ছে, কিন্তু, এই ট্রাকের লোকজন ত ততক্ষণে মাইল চল্লিশেক পার হয়ে এসেছে, প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হল, ফলে এরা অনেক সময় হাত তুলেই সারছে।
বানারহাটের পর দূরে-দূরে ট্রাক দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু, এই রাস্তায় ওঠার কিছুক্ষণ পর মনে হল সব ট্রাকই এই রাস্তা দিয়ে চলেছে। অনেক জায়গায় দাঁড়ানো ট্রাকের পাশেও লোকজন দাঁড়িয়ে। তারা ট্রাকে করে ব্যারেজেই যাবে, নাকি কোনো হাটে, নাকি ওখানকার পাতি তুলে ট্রাকে করে ওজনের জায়গায় যাবে, তা বোঝা যায় না। কিন্তু হাত নাড়ানাড়ি, একটু চেঁচামেচি হয়েই যায়।
সেই মাদারিহাট থেকে বেরিয়ে এই রাস্তাটায় পড়ার পর মনে হচ্ছে তারা সেই তিস্তানদীর ব্যারেজের কাছাকাছি যেন চলে আসছে। তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের দিন এই জলুশের কথা তারা যখন থেকে শুনেছে, টাড়ির বৈঠকে, লাইন মিটিঙে, হাট মিটিঙে, তখন থেকেই ত এই নদী, বাঁধ, জলের একটা কল্পনাকে তারা লালন করেছে। এই ট্রাকটা ত আসছে তোর্সা পার থেকে। তোর্সা থেকে তিস্তা। তিস্তার সঙ্গে ত তাদের দৈনন্দিন চেনাজানা নেই। সে-নদী তোর্সা থেকে বড় ও ভয়ংকর–পাহাড়টাহাড় ভেঙে, বনজঙ্গল উপড়ে, গ্রাম-শহর ভাসিয়ে চলে যায়। প্রত্যেক বছরই তাদের তিস্তার বন্যার কথা শুনতে হয়। সেই সব শোনা থেকে তাদের কাছে তিস্তা ব্যারেজের যে কল্পনা প্রশ্রয় পেয়েছে, এই পাহাড় আর এই খাদ, এই অপরিচিত প্রকৃতি যেন সেই কল্পনাটিকে সত্য করে তুলেছে। মনে হতে শুরু করেছে যে এই সব পাহাড়েরই একটা ব্রাক থেকে তিস্তা একেবারে আকাশ ছাপিয়ে নামছে, তাদের ট্রাকটা হঠাৎ সেদিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে যাবে আর তাদের দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, তিস্তা, এই পাহাড়গুলির মতই, তিস্তা ব্যারেজ।
তারা যে তিস্তা ব্যারেজের কাছে চলে আসছে, সেটা মনে হওয়ার আর-একটা কারণ এই রাস্তাটায় নদীর পর নদী, ব্রিজের পর ব্রিজ। ডান দিকটাতে পাহাড় আর চড়াই, বা দিকটাতে খাদ। ফলে, একটু পর-পরই দেখা যাচ্ছে ডান দিক থেকে শাদা ফেনা-তোলা জল বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠে এক-একটা রঙিন ব্রিজের তলা দিয়ে বা দিকে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়ে বয়ে যাচ্ছে। এতগুলো নদীর ঝর্না হয়ে ঝরা আর নদী হয়ে বওয়া দেখতে-দেখতে এক-একটা ব্রিজ সঁ সঁ করে পেরিয়ে যায়–লংতি, চুয়া পাথাং, ডায়না, জলঢাকা, মূর্তি, নেওরা, জুর্তি। মনে হয়, এই রাস্তা গিয়ে থমকে শেষ হবে যেখানে তিস্তা পাহাড় থেকে পাহাড় ভেঙে নামছে।
চালসার মোড়ে পুলিশ ট্রাক থামাল। মাদারিহাট ছাড়ার পর সেই প্রথম থামা। সামনেও অনেকগুলি ট্রাক। থামল বলেই অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছড়ায়। দু-এক জন নামতেও গিয়েছিল কিন্তু পুলিশ দেখে আর নামে না।
পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করে–কোথ থেকে আসছে ট্রাক? কোথা থেকে? গলার স্বরে ব্যস্ততা বোঝ যায়।
যারা ডালার ওপর বসে ছিল, তারা তখন দাঁড়িয়ে, প্রায় এক সঙ্গেই বলে ওঠে, মাদারিহাট।
ড্রাইভার কোথায়? পারমিট দেখি–পুলিশ ড্রাইভারের কেবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ড্রাইভার একটা কাগজ হাতে-হাতে এগিয়ে দেয়। সেটা দেখে ফেরত দিতে-দিতেই চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে, লিডার কে আছে, ট্রাকে, লিডার কে। এর জবাব কী হবে বোঝার জন্যেই পুলিশ যেদিক থেকে কথা বলছে সেদিকে বসা লোকজন সেই ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল উল্টোদিকে, সে মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে সাবধানে একটা পা দেয়, তারপর আর-একটা পা দেয়ার জায়গা খুঁজতে-খুঁজতে সামনের একজনের ঘাড় ধরে মুখ বাড়িয়ে দেয়–কী ব্যাপার?
আপনি নিয়ে যাচ্ছেন? নাম বলেন—
সুখেন্দু রায়
বাগানের লোক সব, নাকি বস্তির লোক—
দুইই আছে—
একটু নাম দিতে পারবেন?
কী? এই প্রত্যেকের নাম?
না। গ্রামের আর বাগানের। আচ্ছা, বাদ দেন। ওদলাবাড়িতে যদি চায় দেবেন। নেন, এই শিপটা রাখেন–পুলিশের বাড়ানো হাত থেকে একজন কাগজটা নেয়।
.
২১৩.
শতাব্দী-সহস্রাব্দীর স্বাদ
চালসার মোড়ে পুলিশ সব গাড়ি আটকে চেক করে বলে গাড়ির একটা ভিড় হয়ে যায়। এই ল্যাটার্যাল রোডে আর ওদিককার ন্যাশনাল হাইওয়েতে গাড়ির লাইন পড়ে যায়–মাটিয়ালির দিকের রাস্তাটা ফাঁকাই। আর সব গাড়িই ত সোজা মাল হয়ে ওদলাবাড়ি যাবে–তাই ওদিক থেকে যে-সব গাড়ি এদিকে আসছে, সেগুলোকে পুলিশ আটকাচ্ছে না।
পুলিশ অবিশ্যি গাড়িগুলো বেশিক্ষণ আটকায় না। মিছিল-ছাড়া কোনো গাড়ি থাকলে সেটাকে রাস্তার পাশে সাইড করতে বলে মিছিলের গাড়ি ছেড়েই দেয়। কিন্তু ঐখানে দাঁড়ানোর ফলে আর পুলিশের শ্লিপ নিয়ে ছাড়ার ফলে চালসা থেকে মালবাজার পর্যন্ত রাস্তা মিছিলের ট্রাকেই ভর্তি হয়ে যায়। মনে হয়, আজ এ রাস্তায় আর-কোনো কিছুই ঘটবে না। আর, এতগুলো ট্রাক একসঙ্গে যাচ্ছে, এখন আর কেউ কাউকে পেরিয়েও যাচ্ছে না, তাতে মনে হয় যেন ট্রাক দিয়েই মিছিলটা সাজানো হচ্ছে। মালবাজারের ভেতরে ত আর এই ট্রাকের মিছিল ঢোকে না–ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে সোজা বেরিয়ে যায়। মালবাজারের মোড়ে বিরাট গেট বানানো হয়েছে, তার ওপর বামফ্রন্টের লাল ঝাণ্ডাই উড়ছে। আর মোড়ের মাথাতেও লোকজন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। সেখানেও কিছু-কিছু ট্রাক, কিছু-কিছু মিছিল তৈরি হচ্ছিল বটে কিন্তু তখন রাস্তার মিছিলটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। মালবাজার থেকেই আবার শ্লোগান শুরু হল।
কিন্তু এবারের শ্লোগানের জোর আলাদা। এক-একটা ট্রাকে কেউ বসে নেই–সবাই দাঁড়িয়ে, গায়ে গা লাগিয়ে, এক হাতে পরস্পরের কাধ ধরে ট্রাকের ঝুঁকি সামলাচ্ছে, আর-এক হাত আকাশে তুলে শ্লোগান দিচ্ছে। এমন ভাবে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যে তাদের মুখটা বাইরের দিকে ঘোরানো। শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে নাচের ভঙ্গিতে কোমরের ওপর অংশ আর হাঁটু দোলাচ্ছে।
কোনো-কোনো ট্রাকে আবার শুধুই মেয়েরা। তারা তীব্র স্বরে গান গেয়ে যাচ্ছে, শ্লোগানেরই গান কি না কে জানে কিন্তু এই সারি-সারি ট্রাকের নানা ধরনের শ্লোগানের ফাঁকে সেই সমবেত স্বরের তীব্রতা বাতাস চিরে দিচ্ছে।
দু-তিনটি ট্রাকে এন-সি-সিরা পপাশাক পরে যাচ্ছে। দু-তিনটি ট্রাকে ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা তাদের পোশাক পরে।
এখন মনে হচ্ছে তারা সেই ব্যারেজের কাছাকাছি চলে এসেছে–সবাই মিলেই সেখানে পৌঁছনো হবে। আর, এই পৌঁছনোর একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে, একটা ছন্দ আছে–ইচ্ছে করলেও সেই শৃঙ্খলা বা ছন্দ কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। মাদারিহাটের ট্রাকের ভেতর ওরা মালবাজারের পর থেকেই একটা বৃহৎ ব্যাপারে নিজেদের একটু-একটু করে হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।
ওদলাবাড়িতে এসে ট্রাকটা থামে–কারণ, আগের ট্রাকটা থেমেছে। থামার পর এই ট্রাকের ওপর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখা যায়, আরো সামনেরটাও থেমেছে। চালসার অভিজ্ঞতাটা আছে বলেই হয়ত এখানে একজন ট্রাক থেকে চাকা বেয়ে নেমে যেতে সাহস পায়। কিন্তু এগয় না। ট্রাকের কাছেই রাস্তার পাশে পেচ্ছাপ শুরু করে। করে আর মাঝে-মাঝেই উদ্বিগ্ন ভাবে বায়ে তাকায়–আগের ট্রাকগুলো চলতে শুরু করল কিনা। ট্রাকের ভেতর থেকে একজন চিৎকার করে–হে বেঙ্গু, কলখান খুলি রাখি চলি আয়। আর-এক জন প্রায় নিদ্রিতস্বরে যোগ করে, বেঙ্গুর কলখান পাবলিক হেলথের কল না-হয়, ঘোষমশাইয়ের টিউবওয়েল, হ্যান্ডেল খাড়াই থাকে, নামিবার না-পারে। যে-স্বরে এই মন্তব্য আসে তা শ্লেষ্মজড়ানো। কিন্তু বেঙ্গুর পেচ্ছাপ শেষ হতে না-হতেই আরো কয়েকজন ট্রাক থেকে নামে–কেউ ডালার ওপর দিয়ে লাফ মেরে, কেউ চাকা বেয়ে, কেউ পেছনের ডালা ধরে ঝুলে। একজন বুড়োমত দেউনিয়া নামতে পারে না। সে চাকার ওপর পা রাখতে পারে না, উঠে আসে, আবার ডালা ধরে ঝুলতেও পারে না। নীচের থেকে একজন বলে, হে-এ তালই, তোমার নামিবার নাগিবে না, ঐঠে ছাড়ি দাও, মায়ের কোলত ছাওয়াছোটর আর নাজ্জা কী?
সেই ছেলেটি ডাকে, এদিক দিয়ে নামুন, বলে মাদারির মার কোণ দিয়ে, ড্রাইভারের দরজার পাশ দিয়ে নামার রাস্তাটি দেখায়। দেউনিয়া একটু লজ্জিত মুখেই মেয়েদের ভিড়ের ভেতর দিয়ে পা ফেলে-ফেলে সেই কোণটায় আসে তারপর ঝুঁকে দেখে নেয় কী ভাবে নামতে হবে। তার সামান্য হাসিতে বোঝা যায়, এই পথটা তার কাছে নিরাপদ ঠেকেছে। ডান হাতে ড্রাইভারের চালের পেছনটা আর বা হাতে ড্রাইভারের দরজার ওপরটা ধরে দেউনিয়া যেই দুই ধাপ নেমেছে, সামনের ট্রাকটা চলা শুরু করে। এই ট্রাকের লোকজন চিৎকার শুরু করে–হে তালই, উঠি আসেন, উঠি আসেন। দেউনিয়া তাড়াতাড়ি আবার যেই ড্রাইভারের দরজার ওপরটা ধরে ধাপে বা পা দিয়েছে, তার পায়ের ধুতিটা পেছনে আটকে যায়। ততক্ষণে সেই ছেলেটি মুখ বাড়িয়ে বলে, আপনি যান, গাড়ি যাবে না, যান। দেউনিয়াকে প্রধানত ধুতির কারণেই নামতে হয়। ছেলেটি আশ্বাস দেয়ায় রাস্তায় নেমে একটু সরে গিয়ে বসে পড়ে।
ততক্ষণে সামনের ট্রাকটা অনেকখানি চলে গিয়ে বা দিকে ঘুরে গেল। পেছনের ট্রাক হর্ন বাজাচ্ছে। সামনের পুলিশ হাত দিয়ে ডাকছে। ছেলেটি ডালার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পুলিশকে হাত দেখিয়ে ইশারা করে।
ট্রাকের ভেতর থেকে আবার চিৎকার ওঠে, হে-এ তালই, বাকিখান এইঠে করিবেন, চলি আসেন। রসিকতা করে ড্রাইভারই বুঝি হর্ন দিয়ে বসে। আর, দেউনিয়া উঠে দাঁড়ায়, তাড়াতাড়ি ঘুরে ট্রাকের দিকে মুখ করে কাপড় নামায়। তারপর দৌড়ে এসে ড্রাইভারের দরজা ধরে পাদানিতে ওঠে।
দেউনিয়া ট্রাকের ভেতর নামলে সেই লিডার ছেলেটি হাত বাড়িয়ে ড্রাইভারের দরজার ওপরের টিনে আওয়াজ করে বলে, চালান।
একটু চালিয়ে ক্যাম্পটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ এসে বলে পারমিট? :
ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে চালসার শ্লিপ দেখায়। কতজন আছেন, একজ্যাক্ট নাম্বারটা বলুন–পুলিশের লোকটি না-তাকিয়ে বলে। ছেলেটি সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই গুনতে শুরু করে। গোনা হচ্ছে এটা বোঝার পর সকলেই একটু সোজা হয়ে বসে। একবার গোনা শেষ হলে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে, কেউ নীচে নেই ত? ড্রাইভারের ওখানে কজন আছে? বলে, আর-একবার গোনা শুরু করে–সাতাশি। তারপর মুখ বাড়িয়ে বলে, এইটি সেন।
পুলিশ পাশের ছেলেটিকে বলে, এইট্টি সেন। তারপর একটা বড় কাগজ এগিয়ে দেয়, এইটা, কাঁচে লাগিয়ে নেবেন, নইলে ট্রাক ঢুকতে দেবে না। ছেলেটি হাত বাড়াতেই পুলিশের পারে ছেলেটি একটি ব্যাজের বান্ডিল এগিয়ে দিয়ে বলে, প্রত্যেককে পরে নিতে বলবেন, নইলে এনক্লোজারের ভেতর ঢুকতে দেবে না। আর, একটু দাঁড়ান।
সেই ফাঁকে পুলিশ বড় কাগজটি ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশের পাশের ছেলেটি একটা ঝুড়ি, তুলে ধরে বলে, টিফিন। সাতাশিটা আছে, নামিয়ে নিয়ে ঝুড়িটা দিন, ঝুড়িটা দিন।
ছেলেটির হাত থেকে ট্রাকের কয়েকজন ঝুড়িটা তুলে নেয়। তারপর ইতস্তত করে, কোথায় রাবে। সেই লিডার ছেলেটি বলে, ওখানেই ঢেলে রেখে ঝুড়িটা ফেরত দিয়ে দিন।
ট্রাকের ভেতর একটু জায়গা করে দেয় সবাই। ওরা ঝুড়িটা উপুড় করে বাইরে ফেরত দেয়। ট্রার্কের ভেতরটা আলু আর আটার গন্ধে ভরে যায়। ট্রাক চলতে শুরু করে। মানাবাড়ির ধাক নেয়।
ট্রাক যখন আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতর ঢোকে মাদারি ও মাদারির মার মনে হয় তারা যেন আবার শ্যাওড়াঝোরায় ফিরে আসছে।
সেই সময় মাদারির মা ব্যাজ পায়, সঙ্গের সেফটিপিন দিয়ে সেটা ফোতার ওপর বুকের কাছে এটে নেয়। টিফিনের ঠোঙা পায়। কয়েক শতাব্দী পর যেন মাদারির মা তার জিভে মানুষের তৈরি গম ও সেই গম থেকে তৈরি আটার স্বাদ পায়। কয়েক সহস্রাব্দী পর মাদারির মা জিভ দিয়ে জানে–পৃথিবীতে স্বাদের বৈচিত্র কতটাই। মাদারির মার মুখের ভেতরে আলু আর রুটির টুকরো মুখবিবরের সহস্র গ্রন্থিমুখ থেকে নিঃসৃত লালায় যখন ভিজছে, ভিজছে, আর মুখের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখন সে দেখে আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত এক নদীকে আড়াআড়ি ভাগ করে এক দেয়াল যেন আকাশের দিকেই ছুটে যায়। তিস্তা ব্যারেজ।
.
২১৪.
নেতা আর মিছিল
ব্যারেজের চারটে স্লুইস মাত্র সম্পূর্ণ হয়েছে। তাতেই এখন এই উদ্বোধন করাতে হচ্ছে ব্যারেজের সবগুলো স্লুইস না-হলে তার কোনো অর্থই নেই কিন্তু এখানে উদ্বোধনের জন্যে তিস্তা ব্যারেজকে সাজানো হয়েছে বেশ কৌশল করে।
তৎসত্ত্বেও লোকজনকে স্লুইস খোলার ঘটনাটা দেখানো দরকার যাতে সবাই বোঝে তিস্তাকে আটকে তার মূলখাতে ফিরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বলতে আসতে কী বোঝায়। কিন্তু সারা বর্ষা ত তিস্তা নির্দিষ্ট খাতেই বয়ে গেছে। এখন ত আর উদ্বোধনের সুবিধের জন্যে তার জলকে ভাটি থেকে ফিরিয়ে এনে যাকে বলে রিজার্ভেয়ার সেখানে ঢোকানো যাবে না।
সেই কারণে, উদ্বোধন-অনুষ্ঠানের জন্যেই বিশেষ করে, ব্যারেজের উত্তরদিকে তিস্তার জলকে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে দিয়ে পুব পারের দিকে, আপলচাঁদ ফরেস্টের দিকে, সরিয়ে আনা হয়েছে। উদ্বোধন হয়ে গেলে, এই বাধ ভেঙে আবার জল ছড়িয়ে দিতে হবে, নইলে ব্যারেজের কাজ এগবে না। বাধ মানে, বন্যা-ঠেকানো বাধ নয় জল-সরানোর বাধ। সেজন্যে গত প্রায় মাসখানেক, বিশেষত দিনবিশেক, ব্যারেজের সব কুলিকে এই বাঁধের কাজে লাগানো হয়েছে। একটু ওপর থেকে কোনাকুনি এনে বাঁধের মুখটাকে ব্যারেজের প্রথম দুটি সুইসের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। চারটে স্লুইস সম্পূর্ণ হলেও, স্লুইস, দিয়ে জলের প্রবাহ যদি দেখাতে হয় তা হলে দুটো স্লুইস দিয়েই জল ছাড়তে হবে। চারটে স্লুইস দিয়ে সমান তোড়ে ছুটে হারিয়ে যাবে–তিস্তায় এখন এত জল, নেই।
ব্যারেজটা যত উঁচু, ততটা উঁচু দেখায় না–তার কারণ তিস্তার মাইল-মাইল বিস্তার, আর পাড়ে এমন আকাশসমান ফরেস্ট। আকাশের কত কাছাকাছি গেছে, তাই দিয়েই ত একটা উচ্চতা মাপা হয়। এখানে সবাইকে আকাশসমান শালগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ব্যারেজটাকে দেখতে হয়। পাড়ের কাছে ব্যারেজের ওপরে বিরাট এক স্টেজ বানানো হয়েছে, এত উঁচু যে ঐ উঁচু পাড় থেকেও চোখ একটু তুলে দেখতে হয়। নানা রঙের কাপড়ে স্টেজটা ঝলমল করছে। স্টেজের দুদিকে দুটি বড় জাতীয় পতাকা আর মাঝখানে সরকারি দলগুলির নিজস্ব পতাকা। স্টেজের বাঁ দিকে আবার একটু বেশি উঁচু মঞ্চ। সেখান থেকে বক্তৃতা হবে। ডান দিকে ঐ একই সাইজের আর-একটা মঞ্চ–ওখান থেকে বোম টিপে স্লুইস গেট খোলা হবে। তিস্তার বুকে সব সময়ই জোর বাতাস থাকে। সেই বাতাসে স্টেজের কাপড়চোপড়গুলো ফুলে-ফুলে ওঠে, ঝালরগুলো বা থেকে ডাইনে ওড়ে, জাতীয় পতাকাদুটিসহ অন্যান্য সব পতাকাই বা থেকে ডাইনে ওড়ে, যেন, মনে হয়, এই যেদিকে মুখ করে মঞ্চ বানানো হয়েছে সেটা সোজা দিক নয়, সোজা দিকটা তিস্তার ভাটি বুকের মধ্যে।
তিস্তা ব্যারেজে আসার রাস্তা একটাই–ঐ মানাবাবাড়ির মোড় দিয়ে। আর-এক আসা যায় লাটাগুড়ি থেকে ক্রান্তিহাট হয়ে আপলচাঁদ ফরেস্ট দিয়ে। কিন্তু ব্যারেজ-উদ্বোধন মানে ত এসে ফিতে কাটা বা বোম টেপাই নয়। ঐ ক্রান্তিহাটের রাস্তায় লোকজন দেখবে কী করে যে মন্ত্রীরা ব্যারেজ উদ্বোধনে আসছেন।
কিন্তু ভিআইপিদের জন্যে ত আর স্বতন্ত্র রাস্তার ব্যবস্থা করা যায়নি। পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষকে বারবার একটা কথাই বলেছে যে কোনো অবস্থাতেই যেন ভি-আই-পিদের আসার সময়টা বদলানো না হয়। শেষ মুহূর্তের সময়বদল সামলানোর মত ব্যবস্থা করা এই তিস্তার চরে, পাহাড়ের তলায়, ফরেস্টের মধ্যে সম্ভব নয়।
সেই নির্দিষ্ট সময়েই ভি-আই-পিদের কনভয় জাতীয় সড়ক ধরে বেশ জোরেই আসে–সামনে ছয় মোটর সাইকেলের এসকর্ট ছুটে গেলে রাস্তায় যত জোরে গাড়ি চালানো যায়।
নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা আগে চালসার মোড়ের সব দিকেই মিছিলের ট্রাক সাইডে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। রাস্তার পাশে রাইফেল কাঁধে পুলিশ দাঁড়িয়েই ছিল– ট্রাকগুলো দাঁড়ানো মাত্র এক-একজন এক-এক ট্রাকে উঠে পড়ে রাস্তার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চালসার মোড়ে টিলার ওপরে গাছপালার সবুজের সঙ্গে মিশে কিছু কম্যান্ডো ফোর্স ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে–বিশেষত চালসা থেকে মাটিয়ালি যাওয়ার পথের দুপাশে। পুলিশের দিক থেকে এই দুটো পয়েন্টেই সিকিউরিটি রিস্ক আছে–দাঁড়ানো ট্রাকের পাশ দিয়েই ত ভি-আই-পিদের গাড়িগুলো আসবে।
ভি-আই-পিদের কনভয়টা চালসার মোড়ে পৌঁছনোর আগেই এসকর্টের মোটর সাইকেলগুলো যেন গতি বাড়িয়ে দেয়। আর সেই বর্ধিত গতির সঙ্গতি রেখে কনভয়ের সব গাড়ির গতিই বেড়ে যায়। সেই প্রবল গতিতে চালসার মোড়ে ছটি মোটর সাইকেলের পেছনে অন্তত চল্লিশটি গাড়ি বাঁক নেয় রাস্তার সঙ্গে টায়ারের সংঘর্ষে একটা আওয়াজ কয়েক সেকেন্ড পরপরই উঠতে থাকে। সমকোণে দাঁড়িয়ে থাকা যাওয়ার মিনিট তিন পর যখন পথ খুলে যায়, তখন নেতাদের পেছনে-পেছনে মিছিল যাচ্ছে–এই বোধটা ফিরে আসে আর সব ট্রাক থেকেই শ্লোগান উঠতে থাকে।
মানাবাড়ির মোড়ে একই ঘটনা। সেখানে একই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনের আগে সব ট্রাককে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। মানাবাড়ি থেকে তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তায় সেই চল্লিশটি গাড়ি ও ছটি মোটর সাইকেলকে বাধ্যতই একটু ধীর গতিতে বাক নিতে হয় রাস্তাটা ছোট। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দাঁড়িয়ে থাকা মিছিলে কোনো শ্লোগান ওঠে না। একটা গাড়ির জানলা দিয়ে কোনো একজন নেতা হাত বাড়িয়ে খানিকটা নাড়ান। তাতেও রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া মিছিল বুঝে উঠতে পারে না তাদের কাছে এখন কোন ব্যবহার প্রত্যাশিত। এক অদ্ভুত ধাঁধায় এই মিছিলও পড়ে গেছে আর নেতাদের নিয়ে আসা চল্লিশটি গাড়িও পড়ে গেছে। মিছিলের অংশ হবেন বলেই নেতারা মিছিলের পাশ দিয়ে, বা, ভেতর দিয়ে, বা, মিছিলের সঙ্গেই যেন ব্যারেজে আসতে চেয়েছেন, তাই ত এই পথ বেছে নেয়া। আর, উত্তরবঙ্গের পক্ষে বৃহত্তম এই কর্মযজ্ঞ উপক্ষে বৃহত্তম এই সমাবেশেরও ত উল্লসিত হয়ে ওঠার কথা তাদের নেতাদের পেয়ে। কিন্তু, কার্যত মিছিল আটকে, রাইফেলধারী পুলিশ আর গোপন কম্যান্ডো বাহিনীর পাহারায় তাদের দাঁড় করিয়ে দেখে, নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সেটা ত সমর্থনযোগ্যই–উত্তরখণ্ড বা গোর্খাল্যান্ড-এর লোকদের হাত থেকে নেতাদের বাঁচানোর দায়িত্ব ত নিতেই হবে। কিন্তু এমনই মানবস্বভাব যে কাউকে যখনই সন্দেহ করা হবে, বা,সন্দেহের সীমার মধ্যে যখন কাউকে টেনে আনা হবে, সে তখনই সন্দেহজনক হয়ে পড়ে। নিজেরই কাছে। সত্যি ত এই এত বড় মিছিলের যে-কোনো ট্রাকে বা বাসে এক দল বা একজন আততায়ী আত্মগোপন করে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সত্য আশঙ্কারই আবোরা একটা অর্থ ত এই যে এই আমাদের এই মিছিলের ভেতরই আততায়ী লুকিয়ে থাকতে পারে। একবার এই সত্য পরিষ্কার হয়ে। গেলে মিছিলের মূলে টান পড়ে, তখন নেতাদের চল্লিশ গাড়ি আর মিছিলের শশ ট্রাকের মধ্যে দূরপনেয় পার্থক্য ঘটে যায়। মিছিলের জন্যেই এসেছেন নেতারা, নেতাদের জন্যেই মিছিল আসছে, একই কর্মকাণ্ডের শরিক হবেন নেতারা ও মিছিলের মানুষ, তারপর এই কর্মকাণ্ডের বাণী এই মিছিলই। উত্তরবঙ্গের কোণে-কানাচে নিয়ে যাবে, যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সত্যি করেই করব দেয়া যায়, তাদের কাল হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু কার্যত নেতাদের জন্যেই মিছিল আটকে রাখা হয়, নেতাদের জন্যেই মিছিলকে উদ্যত ও গোপন রাইফেলের সামনে অন্তত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়, মিছিল থেকে নেতাদের নিশ্চিত ও নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়া যতক্ষণ শেষ না হয়, ততক্ষণ, পুলিশ অন্তত এই মিছিলকেই তার সন্দেহের একমাত্র লক্ষ্য করে রাখে। মিছিল, তার নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, নেতারা তাদের মিছিলের আশ্রয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে না–ঐ চল্লিশটি গাড়ি অনেক বেশি নিরাপদ থাকে মিছিল আর নেতাদের মাঝখানে দাঁড়ানো পুলিশের পাহারায়। নেতা আর মিছিল আলাদা। হয়ে গেছে।
.
২১৫.
নদীর বুকের ওপর দিয়ে হাঁটা
মানাবাড়ি থেকে আপলচাঁদ পর্যন্ত রাস্তা ফাঁকা রাখা হয়েছে।
ভি-আই-পিদের নিয়ে চল্লিশটা গাড়ি, ছটি মোটর সাইকেলের পাহারায় সেই সরু রাস্তায় ঢুকে যায়। এখানে পাহাড় নেই ও জঙ্গলও নেই। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্ন কিছুটা সরল। মোটর সাইকেলের পুলিশরা তাদের গতি একটু কমিয়ে আনে। এখানে ভি-আই-পিরা একটু অলস ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখতে পারেন। পেছনের গাড়িগুলোর গতিও স্বাভাবিক ভাবেই কমে আসে। একটা শিথিলতা অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে পুরো কনভয়টাতেই ছড়িয়ে পড়ে–অবকাশের শিথিলতা।
আপলচাঁদের কাছে পৌঁছে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে যায়। একটা রাস্তা সোজা চলে যায়, আর-একটা ডাইনে। এই ডাইনের রাস্তাটা নতুন বানানো হয়েছে– ব্যারেজের জন্যে। সোজা রাস্তাটাও ব্যারেজেই গেছে, ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে একটু ঘুরে। ভি-আই-পিদের গাড়িগুলো ব্যারেজের নতুন রাস্তা ধরে আলাদা হয়ে গেলে–মানবাবাড়ি থেকে ট্রাকগুলো ছাড়া হয়। মিছিলের ট্রাক পুরনো রাস্তা ধরে ব্যারেজের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় যাবে।
ভি-আই-পিদের কনভয় সোজা ব্যারেজের মুখে চলে যায়। গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা মঞ্চে যাবার রাস্তায় পা দেন। আর গাড়িগুলো সোজা গিয়ে গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ছোট-ছোট প্ল্যাকার্ডে জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে–সি-এমস কার, ইউনিয়ন মিনিস্টার অব স্টেটস কার ইরিগেশন মিনিস্টারস কার, পি-ডব্লু-ডি মিনিস্টারস কার ইত্যাদি।
গাড়ি থেকে মঞ্চে যাবার রাস্তাটা নতুন করে বানানো হয়েছে এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্যে। তিস্তার শুকনো খাত থেকে ছোট নুড়ি পাথর তুলে এনে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। জলের নীচে থাকলে এগুলোর আলাদা-আলাদা রঙ দেখা যায় কিন্তু রোদে সে রঙ নষ্ট হয়ে যায়। যাতে অন্তত কিছুটা রঙ থাকে, সেজন্যে কাল রাতে এই সব পাথর তোলা ও বেছানো হয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টও কাল রাতেই দুট্রাক গাছ দিয়েছে, সেগুলো রাস্তার দুপাশে পুঁতে দেয়া হয়েছে। সে-সবই গোটা-গোটা গাছ-দুদিনের মধ্যে শুকিয়ে মরে যাবে, কিন্তু, এখন দেখাচ্ছে যেন কত শুশৃষায় এই সব গাছকে বড় করা হয়েছে। গাছ ত আর রাতারাতি বড় হয় না–তাই একটা গাছ বহু বছরের যত্নের প্রমাণ দেয়।
ওঁরা নেমে একটু দাঁড়ান। অনেকে দুহাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে নেন সশব্দ হাই তুলে। দু-একজন একটু চারপাশে তাকান–প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার তৃপ্তি পেতে। মুখ্যমন্ত্রী একটু অন্যমনস্ক ভাবে তৈরি থাকেন–নিশ্চয়ই কেউ এসে বলবেন কী করতে হবে। সেই মুহূর্তেই ইনজিনিয়াররা এসে প্রত্যেকের বুকে বড় বড় ব্যাজ এঁটে দেন। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাজটা সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে রঙিন।
ওতে খানিকটা সময় যায়। কেন্দ্রের জলপথমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসে জানতে চান পাহাড় এখান থেকে কত দূর হবে, মানে কোন জায়গায় নদী সমতলে নেমেছে। মুখ্যমন্ত্রী নদীর ওপারের দিকে তাকান। ওপারটা দেখতে তাকে কোনাকুনি তাকাতে হয়, কারণ সোজা পথটা আটকে রেখেছে মঞ্চ। তারপর একটু আনমনা ভঙ্গিতে ডান হাতটা দিয়ে একটা দিক দেখান। উত্তরটা খুব সম্পূর্ণ হল না ভেবে হাতটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে জানান–পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় অঞ্চল, সিকিম ও ভুটান এই জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তার চোখ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাত অনুসরণ করে ইংরেজিতে বলেন, এই জায়গাটি দেখতে একেবারে গাড়োয়ালের মত। আপনি গাড়োয়ালে গেছেন?
মুখ্যমন্ত্রী হেসে বলেন, এত বয়স হয়েছে যে ভারতের কোনো জায়গায় আর যাওয়া বাকি নেই। গাভোয়ালে ত গিয়েইছি। সেবার বহুগুণার ইলেকশনে অনেকগুলো মিটিং করলাম, ইলেকশন মানে স্থগিত ইলেকশনে, মিসেস গান্ধীর প্রেস্টিজ ইলেকশনে। আপনি কি গাড়োয়ালের? না ত?
না, না, আমি ত সমতলের লোক। কিন্তু গাড়োয়ালে গিয়েছি, থেকেছিও।
কেন?
আমার কাকার বড় ফলের খেত আছে।
ইনজিনিয়ারদের একজন, মুখ্যমন্ত্রী বুঝে নেন ইনিই নিশ্চয় ব্যারেজের প্রধান ইনজিনিয়ার, এসে বলেন, স্যার, ডায়াসে ওঠার আগে একবার ব্যারেজটা দেখে নিন।
হ্যাঁ। গাভোয়ালে ফলের শিল্প খুব বেড়েছে, হিমাচল প্রদেশেও খুব বেড়েছে। এই শিল্পটা ওখানকার পাহাড়ি লোকদের একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি দিয়েছে। সে জন্যে দেখবেন, উত্তর প্রদেশের পাহাড় অঞ্চলে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নেই–ওরা প্রধান ভূখণ্ডের সঙ্গে থাকতে চায়, তাতেই ওদের লাভ, বলতে বলতে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে যান।
তা আপনি বলতে পারেন না–আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত রাজ্যেই ত খালিস্তান শ্লোগান উঠল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন।
নুড়ি পাথর এত গভীর করে ঢালা যে হাঁটা মুশকিল, জুতো হড়কে যায়। পেছন থেকে একজন মন্তব্য করেন, এত পাথর ঢেলেছেন কেন, মন্ত্রীদের আছাড় খাওয়াবার জন্যে?
একটু আস্তে-আস্তে হাঁটুন স্যার, আমরা ত বাঁধিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সিকিউরিটি বলল পাথর ঢালতে, একজন ইনজিনিয়ার ব্যাখ্যা করেন।
মুখ্যমন্ত্রী আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই সবার আগে-আগে যাচ্ছিলেন, ধীরে-ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবে, যেন, ওঁদের একটু বিশেষ ভাবে জানা আছে নুড়ি পাথরে কী করে হাঁটতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পাঞ্জাব ত আসলে আপনাদের পার্টির কেলোর কীর্তি। আপনারা আকালি রাজনীতির ভেতর ঢুকলেন আর তার সঙ্গে পাকিস্তান জড়িয়ে গেল।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কোনো জবাব দিলেন না। নুড়ি পাথরের স্তূপ তারা প্রায় পেরিয়েই এসেছেন।
মঞ্চের তলা দিয়েই তাদের ব্যারেজের ওপর যেতে হবে। মঞ্চের তলাটাও তাই কাপড় দিয়ে মোড়া ও পেছনে, যেখান দিয়ে তারা ব্যারেজে ঢুকবেন, সেই জায়গাটায় পর্দা ঝোলানো। দুই ইনজিনিয়ার দুদিক থেকে পর্দাটা সরিয়ে ধরেন আর মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ব্যারেজের ওপর পা রেখে দাঁড়ান।
মঞ্চের পেছনে টিভি ক্যামেরাম্যান, প্রেস ফটোগ্রাফার ও রিপোর্টাররা তৈরি হয়েই ছিলেন। যে-পর্দা ঠেলে ওঁরা ঢুকলেন তারই দুপাশে রিপোর্টাররা, মাটির ওপর উবু হয়ে বসে ফটোগ্রাফাররা, একটু দূরে টিভি ক্যামেরা, তার বায়ে সরকারের প্রচারবিভাগের ক্যামেরা, এই দুই-এর মাঝখানে আর-একটু পেছনে ফিল্ম ডিভিশনের দল। একটা ক্যাসেট-রেকর্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে লম্বা একটা মাইক্রোফোন নিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও।
মুখ্যমন্ত্রীও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসে দাঁড়াতেই একসঙ্গে ফ্ল্যাশ জ্বলে, টিকটিক করে মুভি ক্যামেরা তিনটি চলতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী একটু ডান দিকে তাকান যেদিকে তিস্তার জল ফুলে-ফুলে উঠছে। তারপরই কয়েক পা এগিয়ে যান কারণ ততক্ষণে পেছনের পর্দা ঠেলে বাকি ভি-আই-পিরাও এসে গেছেন, তার মধ্যে জনাকয়েক মন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মাঝখানে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, দাঁড়িয়ে থাকেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তার পাশে। অন্য মন্ত্রী কজন এদের দুপাশে নিজেদের জায়গা করে নেন, পেছনে অফিসাররা দাঁড়িয়ে পড়েন। কেউ কিছু বলার আগেই গ্রুপ ছবির মত করে সবাই দাঁড়িয়ে যান এবং মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই এই পুরো দলটা হাঁটতে শুরু করে।
যারা ছবি তুলছেন ও যাদের ছবি তোলা হচ্ছে এই দুই দলের মধ্যেই অদ্ভুত বোঝাপড়া কাজ করে। প্রত্যেকেই জানেন, কখন কী করতে হবে। এমন-কি প্রেস ফটোগ্রাফাররা এগিয়ে গিয়ে ছবি তোলার সময়ও সচেতন থাকেন যেন যারা মুভি তুলছেন তাদের ক্যামেরার পথে বাধা না হন। প্রায় দৈনন্দিন অভ্যস্ততায় তারা এই অনভ্যস্ত পথে হাঁটছিলেন, তিস্তার বুকের ওপর দিয়ে তিস্তা পেরচ্ছিলেন, অথচ যেন সেই কথাটা কেউই খেয়াল করেন না।
.
২১৬.
অভিনয়ে স্লুইস গেট খোলা
উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়।
উত্তরবঙ্গের এমএল-এরা কেউ-কেউ বলবেন—-দার্জিলিং থেকে মালদহ পর্যন্ত। উত্তরবঙ্গের এম-পিরা বলবেন। কংগ্রেসের কোনো এম-পি আসেননি, বলবেন প্রধানত রাজ্যের সরকারি দলের এম-পিরা। তারপর যার-যার দপ্তর এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা বলবেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী, পি-ডবলু-ডি মন্ত্রী। শেষে বলবেন বিশেষ অতিথি কেন্দ্রের মন্ত্রী। আর তারপর মুখ্যমন্ত্রী বলবেন ও বলার শেষে, আর-এক মঞ্চ থেকে বোম টিপে স্লুইস গেট খুলবেন। বেলা দুটোর মধ্যে সমস্ত প্রোগ্রাম শেষ করতে হবে। তারপর ভি-আই-পিরা চলে যাবেন, তারপর মিছিলগুলো ফিরতে শুরু করবে।
মিছিল জড়ো হয়েছে ব্যারেজের দক্ষিণে, ভি-আই-পিদের গাড়ি রাখার জায়গার পেছন থেকে তিস্তার পাড় ধরে–যতদূর চোখ যায়। জায়গাটা আগেই পরিষ্কার করা ছিল কিন্তু এতটা জায়গা নয়। ব্যারেজের জলের জন্যে এখানটা খোলা রাখারই কথা। পরে এই খোলা জায়গাসহই এই অংশটাকে নিশ্চয়ই কাটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হবে অথবা অন্য কোনো ভাবে পাহারাধীন রাখা হবে কারণ মানুষের পক্ষে এই জায়গাটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। স্লুইস খুললে এখান দিয়েই ত সবচেয়ে জোরে জল বইবে–প্রায় জলপ্রপাতের বেগে। তা ছাড়া ব্যারেজের নিরাপত্তার জন্যেও এত কাছে কাউকে আসতে দেয়া হবে না।
দুদিন ধরে ফরেস্টের নীচের জঙ্গল কেটে ঐ মাঠটাকেই আরো বড় করে দেয়া হয়েছে। ওরও পেছনে এক জায়গায় সারি দিয়ে ট্রাকগুলোকে দাঁড় করানো হচ্ছে। মঞ্চ থেকে দেখাচ্ছে, যেন মানুষের মাথা আর ফরেস্টের গাছ মিশে গেছে। মঞ্চে একজন ইনজিনিয়ারের হাতে মেড-ইন হংকং একটা বাইনোকুলার ছিল–সেটাই সবার হাতে-হাতে ঘুরছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখলেন। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটি তরুণ। তিনি ঠিক এত বড় সমাবেশের সঙ্গে খুব পরিচিত নন। এই সমাবেশ গড়ে তুলতে যে-শ্রম, নিষ্ঠা, ও ধৈর্য দরকার, তার দলের কাজকর্মের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মেলে না। ঠিক বুঝে উঠতেও পারেন না, ব্যাপারটা কী। তিনি ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে বাইনোকুলারটি ফেরত দেয়ার জন্যে হাত বাড়ালে পেছন থেকে একজন নিয়ে নেন। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি মন্তব্য করে ফেলেন, আপনার জনপ্রিয়তা যে এতটাই আমার ধারণা ছিল না।
মুখ্যমন্ত্রী স্মিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সমাবেশের দিকে তাকান। সমাবেশের শ্লোগান, হৈ-হৈ সব শোনা যাচ্ছে কিন্তু মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে না, মঞ্চটা এতই উঁচু আর সমাবেশটা এতই দূরে। কোথায় একটু বিষণ্ণতা এসে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি একটু জোর দিয়ে বলেন, আপনাদের জন্যেই আমাদের এই সমাবেশ সংগঠিত করতে হল। আমাদের ও সমাবেশ কথা দুটির ওপর মুখ্যমন্ত্রী একটু অতিরিক্ত জোর দিলেন। তারপর যোগ করেন, পশ্চিমবাংলাকে ত আমরা পাঞ্জাব হতে দিতে পারি না। এ-কথাটার মধ্যেও জোর ছিল, যেন, মুখ্যমন্ত্রী তার বক্তৃতার লাইন বলছেন। তাঁর বক্তৃতার এই জোরটাই বৈশিষ্ট্য, শুনলে আত্মবিশ্বাস আসে যেমন, তেমনি, ওঁর ওপর নির্ভরতাও আসে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কথাটাকে একটু বুঝে নেন। মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রীর কথার মধ্যে তাদের দলের বা সরকারের বিরুদ্ধে যে-সমালোচনার ছোঁয়া ছিল সেটা আর তিনি ঘটাতে চান না। বিষয়টা তিনি জানেনও না, আর, মুখ্যমন্ত্রীর কথা তিনি শুনেছেন অনেক, সকলেই ত বেশ শ্রদ্ধা করেন। এই প্রথম তার সঙ্গে আলাপ। মিছিমিছি একটা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে তিনি বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে চাইছেন না। ইংরেজির কুশলতায় তিনি কথাটা-এড়িয়ে যেতে চাইলেন, মন্ত্রী হওয়ার পর আমার সবচেয়ে বেশি সময় কিসে লাগছে, আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে।
মুখ্যমন্ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, বলুন না। আপনি কি নতুন মন্ত্রী হলেন?
হ্যাঁ। আমার এখন সবচেয়ে বেশি সময় যায় মধ্যমপুরুষ বহুবচনের অর্থ বুঝতে। মানে, কখনো আমাকে বলা হয় তোমাদের কথা ছাড়ো, তোমরা ত ভারতের নয়া শাসক। তখন বুঝতে হয়, আমি ইউ-পির লোক। কখনো বলা হয় প্রধানমন্ত্রীর নতুন ছেলেরা। তখন বুঝতে হয়, আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক। কখনো বলা হয়–তোমরা ব্রাহ্মণ। এই পর্যন্ত বলেই মন্ত্রী থেমে যান।
মুখ্যমন্ত্রী সামান্য একটু হেসে বলেন, আপনাদের দলের ত একটা রাজনৈতিক সমস্যা আছেই-এ রাজ্যে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মত পশ্চাদপদ জায়গায় সমস্যাটা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের লোকজন সব দলে-দলে গোখাল্যান্ড, উত্তরখণ্ড, এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে চলে যাচ্ছে। আর আপনাদের স্থানীয় নেতারা তাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাচ্ছে। তাতে একটা বিপদ দেখা দিচ্ছে।
মঞ্চের ওপর থেকে মাইকে শ্লোগান দেয়া শুরু হয় আর দেখতে-দেখতে সামনের সমাবেশ জমাট বেঁধে যায়। মঞ্চের শ্লোগানের জবাবে সমাবেশের হাজার-হাজার মানুষ একসঙ্গে হাত তুলে, শ্লোগান তুলছে। এত মানুষের গলার আওয়াজ এক সঙ্গে কী প্রবল শক্তি হয়ে ওঠে, মুহূর্তে, তা শ্লোগান ওঠার পূর্ব মুহূর্তেও যেন ভাবা যায়নি। এই শ্লোগানই যেন এই মঞ্চ, এই ফরেস্ট, এই নদীর সঙ্গে এই মানুষকে জুড়ে দেয়। এত মানুষ যেখানে এমন সরবে এতটা সমর্থন জানাতে চায় তখন রাজনীতির তত্ত্ব যেন দুই হাতে ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এমন এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা পায়।
মঞ্চের এই নেতারা ত সব সময়ই মিটিং করেন। আর বছরে দুবছরে অন্তত একবার ব্রিগেডের জনতা তারা মঞ্চ থেকে দেখে থাকেন। কিন্তু এখানে, এই সমাবেশে, সেই সব অভিজ্ঞতার বাইরের একটা ব্যাপার ঘটে যায়। তিস্তার একটা গম্ভীর ধ্বনি সব সময় শোনা যাচ্ছিল। সেই গাড়ি থেকে নামার পর থেকেই সব সময় সেই আওয়াজটা পরিবেশের সঙ্গে লেগে আছে। অনেকটা যেন দিগন্তের মেঘ-গর্জনের মত। তার সঙ্গে প্রবল বাতাস–তিস্তার জলময় বুক থেকে প্রবল উঠে এসে বয়ে যাচ্ছে। নদীস্রোতের সমান্তরালে অত বড় আকাশের নীচে সে যেন বাতাসের আর-এক তিস্তা। আর, এরই সঙ্গে আছে ফরেস্টের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার অবিরল দীর্ঘশ্বাস, বিরতিহীন, পতনহীন। সেই তিস্তার, ফরেস্টের, বাতাসের আওয়াজের সঙ্গে মিশে শ্লোগানের নাদ বদলে গেছে। আদিবাসী উচ্চারণে শ্লোগানে যেন মাঝে-মাঝে টঙ্কারও জাগছে। এ-শ্লোগানের ভেতর যেন এক বিষাদও মাখানো থাকে–পাহাড়ের বা জঙ্গলের বা নিধুয়াপাথারের গানে যে-বিষাদ থাকে।
যারা ফিল্ম তুলছিলেন, তাদের কয়েকজন গুটিগুটি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ান, কিছু বলতে। টের পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। বয়স্ক-মত একজন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সুবাদে যার মুখ মুখ্যমন্ত্রী চেনেন, বলেন, স্যার, একটা বিপদে পড়েছি।
কী হল?
আসলে আমরা ত একটা করে ক্যামেরা এনেছি। আর এরা ডায়াস এমন ভাবে বানিয়েছে যে আপনার বোম টেপার শট নেয়ার পর দৌড়ে নেমে আর স্লুইস খুলে যাচ্ছে সেই শট নেয়া যাবে না।
ত, কী, করতে হবে কী?
সুইসের শট নেয়ার জন্যে ত এখন থেকেই ওখানে ক্যামেরা ফিট করে রাখতে হবে। ঐ শট স্যার ঐ মিছিলের ভেতর থেকেই নিতে হবে। ধাক্কাটাক্কা লেগে যেতে পারে।
ফিট করে রাখুন গিয়ে।
ভদ্রলোক এবার আর-একটু হেসে বলেন, আপনি যদি স্যার এখান থেকে একবার হেঁটে ঐ বোতাম টেপার ডায়াস পর্যন্ত যান, ওখানে গিয়ে একবার দাঁড়ান, তা হলে আপনার বোতাম টেপার শটটা এখনই নিয়ে আমরা নীচে চলে যেতে পারি।
ও। এ্যাকটিং করতে হবে? যান, আপনারা যন্ত্রপাতি লাগান গিয়ে।
আমরা লাগিয়েই এসেছি স্যার। শুনে, মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়ান, তারপর দ্রুত পায়ে ডাইনের সেই মঞ্চের দিকে হেঁটে যান, বোতাম টিপছেন–এরকম একটা ভঙ্গি করেন। অনেকগুলো ঘড়ি একসঙ্গে চললে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম সমবেত টিকটিক শব্দে ফিল্ম চলতে থাকে। স্যার, হাতটা একটু নাড়ান স্যার। মুখ্যমন্ত্রী হাত নাড়ান।
.
২১৭.
মাদারির মায়ের সন্তান সন্ধান
বক্তৃতায় বক্তৃতায় মিটিং জমে ওঠে।
মঞ্চে এক-একজন বক্তা আসছেন, কেউই বেশিক্ষণ বলছেন না, কিন্তু পর-পর বলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে একটা বক্তৃতাই যেন অনেকক্ষণ ধরে চলেছে।
নদীর কল্লোল, হাওয়ার গর্জন আর ফরেস্টের প্রবল মর্মর যেমন শ্লোগানের ধ্বনি বদলে দিচ্ছিল, তেমনি বক্তৃতার আওয়াজও বদলে দিচ্ছে। বাতাসটা বইছে নদীর স্রোতের অনুকূলে পুব থেকে পশ্চিমে। আর বিরাট-বিরাট, স্পিকারের মুখগুলোও পশ্চিম দিকে। সেই চোঙাগুলো দিয়ে আওয়াজ বেরনো মাত্র বাতাস সে–আওয়াজ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমাবেশের ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে। তা ছাড়া, নদীর ওপরের বাতাস ত আর জলস্রোতের মত মাটির ঢাল বেয়ে-বেয়ে যায় না। পুবের বাতাস নদীর ওপরের অতটা অবকাশে এলোমেলো বয়ে যায়। যে-সব চোঙ লাগানো হয়েছে তার আওয়াজগুলো এরকম বাতাসের ধাক্কায় এলোমেলো বয়ে যাচ্ছে। ফলে বক্তার একটা কথাই বিভিন্ন চোঙ থেকে বিভিন্নভাবে এসে সেই সমাবেশের ওপর পড়ছে, তারপর মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে তিস্তার জলে কুটো পড়লে যেমন ভেসে যায়।
মাদারির মা মিটিঙের ভেতরে ঘুরে-ঘুরে বেড়ায়। এত মানুষ এসেছে যেন মনে হয় দশটা মাদারিহাট এই মিটিঙের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। হাটে ত তাও দোকানের জন্যে জায়গা ছাড়তে হয়, খদ্দেরদের চলাফেরার জন্যে রাস্তা রাখতে হয়। কিন্তু এখানে ত মানুষে-মানুষে কাধ লাগিয়ে বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে–ফরেস্টের গাছের মত, একটা গাছের সঙ্গে আর-একটা গাছের কোনোনা-কোনো একটা সংযোগ থাকেই।
মানুষই ত ভালবাসছিল মাদারির মা, মানুষের আওয়াজ, মানুষের চামড়ার গন্ধ, মানুষের সব কিছু। যেন, সে যখন এই জলুশটাতে এসে পড়েইছে, এত মানুষের ভেতরে এতক্ষণ যখন সে থাকতে পারছেই, তখন, তার এই ভাল লাগাটা সে পুরো উশুল করে নেবে।
কিন্তু মানুষকে ভালবাসতে বাসতে, মানুষের আওয়াজ শুনতে-শুনতে, মানুষের গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতেও মাদারির মা তার ছেলেদের খুঁজছিল। এখানে ত সারা দুনিয়ার মানুষ এসেছে। এত মানুষ এক সঙ্গে কোনো দিন মাদারির মা দেখেনি। তার বাকি জীবনে সে আরো একবার এত বড় মিটিঙে কখনো আসতে পারবে না। আজকের জলুশ যে এতই বড় আর, তাদের যে সেই মাদারিহাট থেকে এই এত দূরে আসতে হবে–তা সে ভাবেও নি। এই জায়গাটাকে যদিও তার তত অপরিচিত ঠেকে না–এমন বড় নদী না দেখলেও ত সে তোসর জল ও চর দেখেছে আর নদীর পাশের এই ফরেস্ট। কিন্তু আসতে-আসতে রাস্তাটা দেখে তার মনে হচ্ছিল সত্যি তারা এত দূরে যাচ্ছে যে আর শ্যাওড়াঝোরায় ফেরা যাবে না। দেশ বোঝে না মাদারির মা, কিন্তু বিদেশ বোঝে। এত দূর বিদেশেও সে কি আর-কোনো দিন আসবে? তা হলে সে তার ছেলেদের একবার খুঁজে দেখবে না, এখানে? তার আটটি কি দশটি সন্তানের মধ্যে দুটি-একটি ত এই মিটিঙে এসে থাকতেই পারে।
মাদারির মা যে খুব একটা নিয়ম মেনে খোঁজে, তা নয়। এই মিটিঙে কোন-কোন জায়গা থেকে লোক এসেছে, তা ত সে জানতে পারবে না। তার ছেলেরা কোথায়-কোথায় চলে গেছে, তাও সে জানে না। তা হলে আর জায়গা মিলিয়ে-মিলিয়ে সে খুঁজবেই বা কেমন করে? তাকে এই হাজার-হাজার মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াতে হয়, হেঁটে বেড়াতে হয়, যেমন সে প্রতিদিন ঘুরে বেড়ায় ফরেস্টের মাটির দিকে চোখ রেখে তার খাদ্যের সন্ধানে। এমন একা-একা হাটা আর খোঁজা, খোঁজার জন্যে হাঁটাই ত তার রোজকার জীবন।
কিন্তু এখানে ফরেস্টের অন্ধকার নেই, এখানে পচা শুকনো পাতা নেই, এখানে লতাপাতার জঙ্গলের আড়াল নেই, এখানে ভেজা মাটি নেই। এখানে, আকাশ থেকে রোদ মাটিতে সম্পূর্ণই আসছে–একটা মেঘের ছায়ার বাধাও নেই। এত বড় আকাশ থেকে এত রোদ এত দূর পর্যন্ত ঝরে পড়ছে যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। এখানে, সামনে আকাশ পর্যন্ত চওড়া একটা নদীকে দু-টুকরো করে শুকনো খটখটে সিমেন্টের দেয়াল সেই আকাশ পর্যন্তই ছড়িয়ে গেছে। এখানে পায়ের নীচে শক্ত মাটি, সবুজ ঘাসের মাটি। এখানে এই রোদে আর এই হাওয়ায়, এই নদী আর এই জলের সামনে এই হাজার-হাজার মুখ। সব মুখ একই দিকে উঁচু করা–সামনে মঞ্চের দিকে তাকাতে ঘাড়টা একটু হেলাতেই হয়। মঞ্চের মানুষগুলোর চোখ এখান থেকে দেখা যায় না, কিন্তু, তাদের হাত নাড়ানোটা বোঝা যায়। সেই হাজার-হাজার একটু উঁচু করা মুখের প্রায় প্রত্যেকটা খুঁটিয়ে দেখার এমন সুযোগ মাদারির মা আর-কোথায় পাবে?
তাই মাদারির মা হাঁটে, তার প্রতিদিনের হাটা-হাঁটে। প্রতিদিনের মত বেগেই হাঁটে। ধীরে-ধীরে। তাড়াহুড়ো নেই। যা খুঁজছে তা খুঁজে যেতে হয়, তাড়াহুড়ো করলেই পাওয়া যাবে, তা নয়। শুধু বেঁচে থাকার জন্যে দরকারি খাদ্যটুকু ফরেস্টের ভেতর থেকে জোগাড় করতে যে-প্রয়াসহীন ক্লান্তিহীন হাঁটা হাঁটতে হয়–তেমনি ভাবে সে হাটে। শুধু তার হাতে অস্ত্র হিশেবে সেই লাঠিটা নেই, তলার দিকে। সমকোণ হয়ে যাওয়া সেই লাঠিটা, যা মাথার ওপর তুলে সে খঙ্গের মত নামিয়ে আনতে পারে, নির্ঘাত। এখন তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, শুধু চোখদুটো আছে, চোখের সেই দৃষ্টিটুকু আছে। এত রৌদ্রভাসিত, বায়ুতাড়িত মুক্ত জায়গায় এত মানুষের ভিড়ে চোখের দৃষ্টি সে অত তীব্র না করলেও পারত।
মাদারির মা হটে আর সেই ব্যগ্র মুখগুলির দিকে চাপা তীব্রতায় চেয়ে যায়। কতগুলো গর্ভ সে ধরেছে তার একেবারে ঠিক হিশেব তার পক্ষে দেয়া সম্ভবই নয়। কোনোদিন ত সেভাবে সন্তানদের হিম্পূের্বাব্লাখেনি। কিন্তু, একটা ছেলে ছাড়া ত তার কোনো সময়ই চলেনি। আর, ছেলেরা মাথায় একটু লম্বা হলেই ত চলে গেছে। ততদিনে ত আর-একটি ছেলে এসে গেছে।
মাদারির মা এখন তার সেই সব ছেলেদেরই খুঁজছে।
সে একের পর এক মুখ দেখে যায়–এই মুখগুলি তার চেনা রাজবংশী মুখ। একটা আন্দাজ ত তার আছে তার ছেলেদের বয়স এখন কত হতে পারে-ওপরের দিকে। তাই সেই আন্দাজি বয়সের চাইতে বয়স্ক মুখগুলো এক পলক দেখেই সে সরে যায়। আর, তার ছেলেদের আন্দাজি বয়সের সীমার মধ্যে পড়তে পারে এমন যে-কোনো মুখের দিকেই সে নিবিড় ভাবে এক পলক চায়।
এরকম চাইতে-চাইতে মনে-মনে সে তার ছেলেদের কথাটা একবার যাচাই করে নেয়। নেপালি জ্যেষ্ঠপুত্রের কথা আর তার পরের মদেশিয়া ছেলের কথা পরপর মনে আসে। কিন্তু তারপর সব গোলমাল হয়ে যায়। কোন ছেলে আগে–সেই মিলিটারি, নাকি সেই রাজবংশী দেউনিয়াসে নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারে না। তার বাকি সব ছেলে যে-কোনো বয়সী হতে পারে।
মাদারির মা একের পর এক গোখা মুখ দেখে যায়।
বড় বেশি চেনা এই সব ছোট-ছোট মুখ, প্রবল চিবুক আর তীব্র হনু। বয়স খুব একটা বোঝা যায় না বলে সে প্রায় কোনো মুখই বাদ দিতে পারে না আর হঠাৎ-হঠাৎ এক-একটা মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। কোথায়, কত দূরে তার ছেলেরা গেছে যে দুনিয়ার মানুষের এই মিছিলেও তারা কেউ আসে না! তার একটা-দুটো ছেলে এ মিটিঙে আছেই, শুধু খুঁজে যেতে হবে, প্রতিদিনের খাদ্য খোঁজার মত ধীরে, অত্যন্ত ধীরে, দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ণ অভ্রান্ত রেখে, এই রৌদ্রভাসিত প্রান্তরেও অভ্রান্ত রেখে।
এর ভেতর প্রবল জয়ধ্বনির মধ্যে, স্লুইস গেটের অবকাশ দিয়ে কৃত্রিম বাঁধে ধাধে প্রবাহিত তিস্তার জল তার স্বাভাবিক গতির চাইতে বহুতর গুণ বেগে নিজেরই খাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আকাশে ফেনা ছুঁড়ে, ছুটে যায় এই মিটিঙের হাজার-হাজার মানুষের সামনে ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে। মাদারির মা সেই মুক্ত সফেন জলরাশির দিকে তাকায় না। তার কাছে এই ব্যারেজ, এই স্লুইস গেট, এই নদীনিয়ন্ত্রণ, এই মঞ্চ,. এই জয়ধ্বনি অবান্তর। তিস্তার জল এমনিতেও তার শ্যাওড়াঝোরায় যায় না। ব্যারেজ হলেও যাবে না। কিন্তু এই জলরাশিকে, এই নতুন তিস্তাকে অভিনন্দন জানানো জয়ধ্বনিমুখর মুখগুলো তার পক্ষে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। এই মুখের অরণ্যে তার ছেলেদের মুখগুলো আছে। খুঁজতে হবে। মাদারির মাকে ধীরে পায়ে খুঁজতে হবে। ফরেস্টের ভেতর যে-পদক্ষেপে সে রোজ তার খাদ্য খোঁজে, সেই পদক্ষেপে খুঁজতে হবে।
মাদারির মা একের পর এক মদেশিয়া মুখ দেখে যায়–তার ছেলেদের সমবয়সী মুখ বড় বেশি চেনা এই মুখের লম্বা ধাচ, চওড়া কপাল, চোয়ালের চওড়া হাড়।
.
২১৮.
মাদারির মায়ের স্বরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন-অন্ত্যপর্বের শেষ অধ্যায়
রাত মাঝামাঝি কাবার হয়ে যাবার পর একটা ট্রাক ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে মাদারিহাটের হাটখোলায় দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করে না। ট্রাকভর্তি মেয়েপুরুষ ঐ আচমকা থামার ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি থেকে জেগে ওঠে। ট্রাকের ভেতরের এক কোণ থেকে ক্লিনার নিদ্রিত গলায় বলে ওঠে, কে নামবেন, মাদারিহাটে, নামেন।
মাদারির মা ট্রাকের পেছনে বসে ছিল। সে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তাকিয়ে মাটির দূরত্ব দেখে নেয়। ক্লিনার আর-একটু কম নিদ্রিত গলায় বলে, এদিক দিয়ে নামেন, এদিক দিয়ে। বলে ক্লিনার উঠে দাঁড়ায়! পুরো ট্রাকটা পার হয়ে মাদারির মাকে সামনে দিয়ে নামতে হবে।
সে বা পাশ দিয়ে এগতে-এগতে চাকার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ডালাটা ধরে বা-পাটা নামিয়ে চাকার ওপর রাখে, আরে, আরে পড়ে যাবেন, পড়ে যাবেন, ক্লিনারের এই কথা শুনতে-শুনতে ডান পাটাও সে চাকার ওপর নামায়, তারপর চাকার ওপর থেকে বা পাটা মাটির দিকে নামায়–ট্রাকের ডালা ধরে থাকা হাত টানটান করে যতটা ঝোলা সম্ভব ঝুলে হাত ছেড়ে দেয় আর রাস্তার ওপর ধুপ করে বসে পড়ে। ক্লিনারটি ওদিক থেকে এদিকে এসে উঁকি দিয়ে দেখে, ততক্ষণে মাদারির মা দাঁড়িয়ে পড়েছে। ক্লিনার ভাল করে তাকে দেখে নিয়ে ড্রাইভারের কেবিনের পেছনে চড় মারে। রাতময় একটা আওয়াজ তুলে ট্রাকটা সোজা বেরিয়ে যায়–আওয়াজের প্রতিধ্বনিকে দীর্ঘ, দীর্ঘ করে। বাঁক নিতেই ট্রাকের লাল আলোটা আর মাদারির মা দেখতে পায় না, কিন্তু আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে শুনতে পায়। এবং-শোনে।
মাদারির মা তার গাড়ি হারিয়ে ফেলেছিল। শেষে এক ভদ্রলোকের ছেলে, তাকে নিয়ে খুঁজে-খুঁজে এই ট্রাকটাতে তুলে দিয়েছে, ট্রাকটা মাদারিহাটের ওপর দিয়ে ফালাকাটার দিকে যাবে।
ট্রাক চলে যাবার পর মাদারির মা সেই নিশুতরাতের মাদারিহাটের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। মাদারি আগে এসে কোথাও বসে থাকতে পারে, সে যাতে তাকে দেখে মাই গে বলে ডেকে উঠতে পারে সেজন্যে মাদারির মা নিজেকে দৃশ্যমান করে রাখে—-ঐ রাতে ঐ অন্ধকারে যতটা দৃশ্যমান করে রাখা সম্ভব।
মাদারি যদি তার অপেক্ষায় কোথাও বসেই থাকত এই হাটখোলায় তাহলে ট্রাক থামলেই চলে আসত। অবিশ্যি ঘুমিয়ে পড়ে থাকতে পারে।
মাদারির মা রাস্তা ছেড়ে রাস্তার পাশের দু-একটা দোকানের বারান্দা দেখে। ঘোমশাইয়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। তার বাইরে থেকে মাদারির মা ডাকে-হে-এ মাদারি, মাদারি, হে-এ মাদারি। একটা কুকুর অন্ধকারের ভেতর থেকে নিঃশব্দে এসে মায়ের কোমরের দিকে তার নৈশ গ্রীবা তুলে দেয়। তার ঘন নিশ্বাসের বাতাস মাদারির মায়ের কোমরে, উরুতে, লাগে। সে কি খাবার চায়, নাকি সঙ্গ, নাকি আক্রমণই করতে চায়–বোঝা যায় না।
মাদারির মা ডাকে, হে-এ মাদারি, মাদারি গে, মাদারি।
এবার ভেতর থেকে বাহাদুরের ঘুমজড়িত স্বরে জবাব আসে, মাদারি গাড়িত আসে নাই।
মাদারি আসে নাই। এলে ত বাহাদুরের গাড়িতেই মাদারি আসবে। নাকি মাদারি আর বাহাদুরও ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল? কুকুরটার আরো ঘন শ্বাস মাদারির মায়ের গায়ে লাগে। মাদারির মা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মাদারি কোটত গেইল? একবারই জিজ্ঞাসা করে। সে জানে এই প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যাবে না, তাই একটু দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার রাস্তায় ওঠে।
এখন সে শ্যাওড়াঝোরার দিকে হাঁটে। তার প্রতিদিনের হাটার মত করে নয়, কারণ এখন তাকে ত কিছু খুঁজতে হয় না–এই নিশুতিতে, অন্ধকারে। এখন তাকে মাইল-মাইল হেঁটে শ্যওড়াঝোরায় ফিরতে হবে–ততক্ষণে রাত আরো কয়েক ঘণ্টা ফুরুবে। কত মাইল তাকে হাঁটতে হয়, সে জানে না–যতক্ষণ না পৌঁছয় সে হেঁটে যাবে।
সে বোঝে কুকুরটা তার সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে–কিসের গন্ধে, কে জানে? একবারও ডাকেনি। মাঝে-মাঝে দু-এক পা পেছিয়ে পড়ছে, মাটি শুঁকছে বোধহয়–সেটা মাদারির মা অনুমান করে রাস্তার ওপর কুকুরটির শাস ফেলার প্রতিধ্বনিতে। মাঝে-মাঝেই তার গলাটা লম্বা করে মাদারির মায়ের গায়ের গন্ধ শোকে।
মাদারি ফেরেনি। বাস বা ট্রাক গোলমাল করে থাকতে পারে–যেমন মাদারির মা নিজেই করেছে। তা হলে, মাদারির মায়ের মতই কি সে আর-কোনো গাড়িতে এসে পড়ত না? বাহাদুরের সঙ্গ মাদারি ছাড়ল কেন? এমনিই ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকতে পারে। বা, মাদারিকে দেখেশুনে ফেরত নিয়ে আসছে–সে-দায়িত্ব ত বাহাদুরকে কেউ দেয়নি।
এক হতে পারে–মাদারি চলে গেল, আর-কোনোদিনই ফিরবে না। এত জায়গা থেকে এত গাড়ি এসেছে, এত মানুষ, এত কাজ। পাহাড় বেঁধে নদীর বন্যাকে আটকে দেয়া হচ্ছে, আবার ইচ্ছে মত বন্যা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, বন্যার জলও নদীর খাত ছেড়ে যেতে পারবে না–এই সব একবার দেখে ফেলার পর, মাদারি আর ফিরতে পারে না। তার ছেলেরা হাসিমারা, শিলিগুড়ি, নেপাল–এই সব দূর-দূর জায়গায় চলে গেছে। মাদারিকে, আর সেভাবে যেতে হল না–সে তার মায়ের সঙ্গেই সেই দূরের একেবারে ভেতরে গিয়ে সেখানেই থেকে গেছে।
রাস্তাটা যেখানে ফরেস্টে ঢুকে পড়ল, সেখানে ফরেস্টের গাছগুলোও যেন রাস্তার ওপর উঠে এসেছে। পাতায়-পাতায় ছাওয়া সেই রাস্তাটাকে একটা গুহার মত লাগে, আরো অন্ধকার গুহা। সেইখানে, প্রায় সীমান্তে, কুকুরটা দাঁড়িয়ে গেল। মাদারির মায়ের নাকে এসে লাগে ফরেস্টের তীব্র ভেজা গন্ধ, সবুজের, এমোনিয়ার। কুকুরটাও সে-জন্যেই দাঁড়িয়ে যায়–এই গন্ধের ভেতর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাকা কুকুর ঢুকতে ভয় পায়। ঐ গন্ধের ভেতর অনেক বেশি ছায়া, অনেক বেশি আওয়াজ, অনেক বেশি গন্ধ। মাদারির মায়ের গায়ে কুকুরটি সেই কোন আরণ্যক জন্মান্তরের গন্ধ পেয়েই কি কুকুরটা সঙ্গ নিয়েছিল?
সেই অন্ধকার গুহার মত রাস্তা দিয়ে তরতরিয়ে মাদারির মা চলে যায়। ঐ গন্ধের ভেতরে, আরো ভেতরে, ঢুকে যায়। তার নিজের পায়ের সঙ্গে রাস্তার ঘর্ষণের আওয়াজ এমনই তীব্র হয়ে কানে আসে যে জঙ্গলের আওয়াজগুলো তার কানে আসে না। সে খুব একটা কানও দেয় না।
রাত্রির পশুর মত খর অথচ সতর্ক পায়ে মাদারির মাকে সেই ঢাল আর বাক পেরিয়ে তার তৈরি, শ্যাওড়াঝোরার জলেভেজা ন্যাশন্যাল হাইওয়েতে দাঁড়াতে হয়। তার সামনের অন্ধকারটা, একটা পাথরের মত গোটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই পাথরটা, অন্য আকার পায়। তার শ্যাওড়া গাছটার যে-ডালটা ওপরের দিকে উঠে গেছে তা অন্ধকারে দাঁড়ানো হাতির গুঁড়ের মত দোলে আর যে-ডালটা নীচে নেমে গেছে তা অন্ধকারের হাতির মত ঝোরা থেকে জলপান করে।
এই জাতীয় সড়ক দিয়ে ভারতবর্ষ যাতায়াত করে, রোজ। আজ মাদারির মা দেখে এল মানুষ পাথর। বেঁধে-বেঁধে নদী বানাল, নদীর বন্যা বানাল, তৈরি করা বন্যার সে-জলও খাত মেনে চলে–উপছোয় না।
মাদারির মায়ের কাছে এই সবই অবান্তর–এই জাতীয় সড়ক, এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করা ভারতবর্ষ, ঐ নদী, ঐ ব্যারেজ, ঐ বন্যা। সে জাতীয় সড়কের পাশেই তার নিজের নদী, নিজের বৃক্ষ, নিজের পাথর দিয়ে নিজের শ্যাওড়াঝোরা তৈরি করে নিয়েছে। তার নিজের তৈরি শেষ মানুষটিও ছিল, আজ থেকে আর-থাকল না বোধ হয়।
মাদারির মা কোমর বেঁকিয়ে চড়াইটা পেরিয়ে তার পাতার ঘরের দিকে উঠতে শুরু করে।
বহু-বহু মাইল দূর থেকে সেই কুকুরটার প্রবল কান্না এতক্ষণে একটানা ছুটে আসে অন্ধকার গুহার মত সেই জাতীয় সড়ক দিয়ে–এই ফরেস্টে এখন মনুষ্যপালিত কোনো পশুরও প্রবেশ নিষেধ।
বাকি রাতটুকুর জন্যে মাদারির মা তার পাতার ঘরে প্রবেশ করে।
.
এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ করা ভাল-সব বৃত্তান্তই ত একটা যোগ্য জায়গায় শেষ করতে হয়। এবৃত্তান্তের পক্ষে এটা বেশ যোগ্য জায়গা। মাদারির মায়ের পক্ষে দূরতম ভ্রমণশেষে ঘরে ফিরে আসা–একা। মাদারি ফেরে না।
শেষ না করলে ত এ বৃত্তান্ত চলতেই থাকবে–পরদিন, তার পরদিন, তার পরদিন।
কারণ, মাদারির মা ভারতবর্ষের প্রায় আশি কোটি মানুষের মধ্যে সেই ছ-সাত কোটির এক জন, যারা, বনের পশুর নিয়মে বাঁচে। দারিদ্র্যসীমা, পশ্চাদপদ অংশ, ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ তাকে ঘেঁয় না।
ফলে, মাদারির মায়ের প্রতিদিনের বাঁচাই এক স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বরাষ্ট্র, স্বাবলম্বী বাঁচা! সেই বাঁচা, দিনের পর দিন বেঁচে থাকা নয় মাত্র, প্রতিটি দিনই একটা পুরো জীবন বাঁচা, একটা গোটা মানবজীবন বাঁচা। সেই বাঁচার নিয়মেই সে তিস্তা ব্যারেজ, কাবেরী ব্যারেজ, হীরাকুঁদ ড্যাম, ভাকরানাঙ্গাল এই সবের বিরুদ্ধে তার নিজের এক শ্যাওড়াঝোরা বানাতে পারে। সেই ধাচার নিয়মেই নিশিদিন ভারতবর্ষ যাতায়াত করে এমন একটা সড়কের পাশে নিজের এক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে।
কিন্তু এ-নিয়ে গৌরব করারও কিছু নেই। মাদারির মায়ের দারিদ্র্যের মধ্যে ত কোনো গৌরব নেই, বড় বেশি অপমান আছে।
সেই অপমানের বিচ্ছিন্নতাকে বিদ্রোহের বিচ্ছিন্নতা বলে ভাবার মধ্যে, তার সাতকাহন বৃত্তান্ত রচনার মধ্যে, মিথ্যা কিছু থেকেই যায়। ভারতবর্ষে যারা কালিকলম ব্যবহার করতে জানে, আমাদের মত, তারা জানে না ভারতবর্ষের দরিদ্রতম ছ-সাত কোটির কথা কোন অক্ষরে লেখা যায়। তাই অক্ষরজ্ঞানহীন এই বৃত্তান্ত যত লেখা হবে, ততই মিথ্যা হবে—সে কহে বিস্তার মিছা, যে কহে বিস্তর।
এ বৃত্তান্ত তাই এখানেই, এমনই একটা যোগ্য জায়গায়, শেষ হোক।
মাদারির মা তার পাতার ঘরে রাত্রির বাকি কয়েক ঘণ্টা শেষপুত্রহীন কাটাক।