প্রণয়িনী নারী
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৬ –যাথার্থ্য প্রতিপাদন। পরিচ্ছেদ ২
প্রেম শব্দটি উভয় লিঙ্গের কাছে কোনোক্রমেই একই অর্থ বোঝায় না, এবং এটাই তাদের মধ্যে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির একটি কারণ, যা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে মতানৈক্য। বায়রন চমৎকারভাবে বলেছেন : ‘পুরুষের প্রেম পুরুষের জীবনের থেকে দূরের জিনিশ, এটা নারীর সমগ্র অস্তিত্ব’। নিটশে দি গে সায়েন্স-এ ব্যক্ত করেছেন একই ধারণা :
প্রেম শব্দটি প্রকৃতপক্ষে পুরুষ ও নারীর কাছে বোঝায় দুটি ভিন্ন জিনিশ। নারী প্রেম বলতে যা বোঝে, তা খুবই স্পষ্ট : এটা শুধু গভীর অনুরক্তি নয়, এটা দেহ আর আত্মার এক সামগ্রিক দান, যাতে নেই কোনো মনোভাবসংবরণ, নেই অন্য কিছু বিচারবিবেচনা। নারীর প্রেমের এ-শর্তহীন প্রকৃতি একে করে তোলে একটি ধর্মবিশ্বাস, তার একমাত্র বিশ্বাস। পুরুষের কথা বলতে গেলে, সে কোনো নারীকে ভালোবাসলে, সে যা চায় তা হচ্ছে নারীটির প্রেম; যদি পুরুষ থেকে থাকে যারা বোধ করে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের বাসনা, তাহলে আমি আমার সম্মানের দোহাই দিয়ে বলছি, তারা পুরুষ নয়।
পুরুষেরা তাদের জীবনের বিশেষ কোনো সময়ে সংরক্ত প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাকে বলা যেতে পারে ‘মহাপ্রেমিক’; তীব্রতম আবেগে আত্মহারা অবস্থায়ও তারা কখনো সম্পূর্ণরূপে অধিকার ত্যাগ করে না; এমনকি দয়িতার সামনে নতজানু অবস্থায়ও তারা যা চায়, তা হচ্ছে দয়িতাকে দখল করতে; তাদের জীবনে মর্মমূলে তারা রয়ে যায়সার্বভৌম কর্তা; প্রিয়তমাটি আরো বহু মূল্যবান বস্তুর মধ্যে একটি মাত্র; তারা দয়িতাকে সন্নিবিষ্ট করতে চায় তাদের অস্তিত্বের মধ্যে এবং তার অস্তিত্বকে দয়িতার জন্যে পুরোপুরি অপব্যয় করতে চায়। অন্য দিকে, নারীর প্রেমে পড়া হচ্ছে প্রভুর কল্যাণের জন্যে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া। যেমন বলেছেন সেসিল সভাজ : ‘যখন সে প্রেমে পড়ে নারীকে ভুলে যেতে হয় তার ব্যক্তিত্ব। এটা প্রকৃতির বিধান। একটি প্রভু ছাড়া নারী অস্তিত্বহীন। একটি প্রভু ছাড়া নারী একটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফুলের তোড়া’।
সত্য হচ্ছে এখানে প্রকৃতির বিধানের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব নেই। প্রেম সম্পর্কে পুরুষ ও নারীর ধারণার মধ্যে যে-ভিন্নতা দেখা যায়, তাতে প্রতিফলিত হয় তাদের পরিস্থিতির ভিন্নতা। যে-ব্যক্তিটি কর্তা, যে নিজে, যদি সীমাতিক্ৰমণতার দিকে তার থাকে সাহসী প্রবণতা, তাহলে সে প্রয়াস চালায় বিশ্বের ওপর তার অধিকার সম্প্রসারণের : সে উচ্চাভিলাষী, সে কাজ করে। কিন্তু একটি অপ্রয়োজনীয় প্রাণী অসমর্থ তার মন্ময়তার মর্মমূলের ধ্রুবকে অনুভব করতে; সীমাবদ্ধতায় দণ্ডিত কোনো সত্তা কর্মের মধ্যে সিদ্ধি লাভ করতে পারে না। আপেক্ষিকতার জগতে বন্দী হয়ে, শৈশব থেকে পুরুষের জন্যে পূর্বনির্ধারিত হয়ে, পুরুষের মধ্যে একটি অসাধারণ সত্তাকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে, যে-পুরুষের সমকক্ষ সে হয়তো হবে না, যে-নারী তার মনুষ্যত্বের দাবি ত্যাগ করে নি, সে স্বপ্ন দেখবে সে নিজের সত্তাকে অতিক্রম করে। এগিয়ে গেছে এসব শ্রেষ্ঠ সত্তার কোনো একটির প্রতি, সে স্বপ্ন দেখবে নিজেকে সে মিশিয়ে দিচ্ছে সার্বভৌম কর্তার সাথে। যাকে তার কাছে উপস্থিত করা হয়েছে ধ্রুবর, অনিবার্যের প্রতীকরূপে, তার মধ্যে দেহে-মনে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ছাড়া তার মুক্তির আর কোনো পথ নেই। যেহেতু সে কোনো-না-কোনোভাবে পরনির্ভরতায় দণ্ডিত, তাই সে স্বৈরাচারীদের পিতামাতা, স্বামী, বা রক্ষককে মান্য করার থেকে একটি দেবতার পুজো করতেই বেশি পছন্দ করবে। সে তার দাসত্ববন্ধনকে এতো ব্যগ্রভাবে কামনা করে যে একেই মনে হয়তার স্বাধীনতার অভিব্যক্তি বলে; সে যে অপ্রয়োজনীয় বস্তু, এটা পুরোপুরি স্বীকার করে নিয়ে সে অপ্রয়োজনীয় বস্তু হিশেবে তার পরিস্থিতির উর্ধ্বে ওঠার জন্যে চেষ্টা করে; তার মাংস, অনুভূতি, আচরণের মাধ্যমে সে প্রেমিককে অধিষ্ঠিত করে পরম মূল্য ও বাস্তবতা রূপে; প্রেমিকের সামনে নিজেকে অধম করে তুলে সে নিজেকে করে তোলে শূন্যতা। প্রেম তার কাছে হয়ে ওঠে ধর্ম।
আমরা যেমন দেখেছি, কিশোরী মেয়ে প্রথমে নিজেকে অভিন্ন করে তুলতে চায় পুরুষের সাথে; যখন সে এটা ছেড়ে দেয়, তখন সে পুরুষদের পুরুষত্বের অংশীদার হতে চায় তাদের একটিকে তার প্রেমে আবদ্ধ করে; এমন নয় যে সে আকৃষ্ট হয়। এটির বা ওটির ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রতি; সে প্রেমে পড়ে সর্বসাধারণ পুরুষের। অবশ্য পুরুষটিকে হতে হয় তার শ্ৰেণীর ও জাতির, কেননা এ-কাঠামোর মধ্যেই চলে কামের খেলা। পুরুষকে নরদেবতা হতে হলে প্রথমে তাকে হতে হবে মানুষ, আর ঔপনিবেশিক কর্মকর্তার কন্যার কাছে উপনিবেশের আদিবাসীরা মানুষ নয়। কোনো তরুণী যদি নিজেকে দান করে কোনো ‘নিকৃষ্ট’-এর কাছে, তাহলে সে তা করে একারণে যে সে নিজেকে অধঃপতিত করতে চায়, কেননা সে বিশ্বাস করে সে কারো প্রেম লাভের অনুপযুক্ত; তবে স্বাভাবিকভাবে সে খোঁজে থাকে এমন একটি পুরুষের, যে তার কাছে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। অবিলম্বে সে বুঝে ফেলে যে অনুগ্রহপ্রাপ্ত লিঙ্গের অনেকেই দুঃখজনকভাবে ঘটনাচক্ৰজাত ও পার্থিব, তবে প্রথম দিকে তার অনুমানগুলো থাকে পুরুষের অনুকূলেই। সরল তরুণী মুগ্ধ হয় পৌরুষের ছটায়, এবং তার দৃষ্টিতে পুরুষের যোগ্যতা, পরিস্থিতি অনুসারে, প্রতিভাত হয় শারীরিক শক্তিতে, আচরণের আভিজাত্যে, ধনসম্পদে, সংস্কৃতিতে, বুদ্ধিতে, কর্তৃত্বে, সামাজিক মর্যাদায়, সামরিক উর্দিতে; তবে সে যা সব সময় চায়, তা হচ্ছে তার প্রেমিক হবে পুরুষত্বের সারসত্তার প্রতীক।
ঘনিষ্ঠতা প্রায়ই পুরুষের মর্যাদা বিনষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট; এটা ধসে পড়তে পারে প্রথম চুম্বনেই, বা দৈনন্দিন সাহচর্যে, বা বিয়ের রাত্রিতে। তবে দূরে দূরে থেকে ভালোবাসা হচ্ছে নিতান্তই একটা উদ্ভট কল্পনা, তা প্রকৃত অভিজ্ঞতা নয়। প্রেমের জন্যে কামনা তখনই শুধু হয়ে ওঠে সংরক্ত প্রেম, যখন তা শারীরিকভাবে চরিতার্থ হয়। এর বিপরীতে, দৈহিক সঙ্গম থেকে উদ্ভূত হতে পারে প্রেম; এ-ক্ষেত্রে কামগতভাবে অধীনস্থ নারীটির কাছে পুরুষটি প্রতিভাত হয় অসাধারণ বলে, যাকে প্রথমে নারীটির কাছে মনে হয়েছিলো খুবই তুচ্ছ।
তবে এটা প্রায়ই ঘটে যে কোনো নারী যে-সমস্ত পুরুষকে জানে, তাদের কারো ওপরই দেবত্ব আরোপ করতে সে সফল হয় না। সাধারণত যা ধারণা করা হয়ে থাকে, তার থেকে নারীর জীবনে প্রেমের স্থান অনেক কম। স্বামী, সন্তান, গৃহ, হাস্যকৌতুক, সামাজিক দায়িত্ব, অহমিকা, কাম, কর্মজীবন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ নারী স্বপ্ন দেখে একটা মহাপ্রেমের, একটা আত্মবিবশকর প্রেমের। তারা এর বিকল্পের সাথে পরিচিত হয়েছে, তারা এর কাছাকাছি এসেছে; এটা তাদের কাছে এসেছে আংশিক, ক্ষতবিক্ষত, হাস্যকর, অশুদ্ধ, মিথ্যে রূপ ধরে; তবে খুব কম নারীই এর প্রতি উৎসর্গ করেছে তাদের জীবন। সে-সব নারীই সাধারণত হয় মহাপ্রেমিকা, যারা কৈশোরিক প্রেমে নিজেদের লক্ষ্যহীনভাবে অপচয় করে নি; তারা প্রথমে মেনে নিয়েছে নারীর প্রথাগত নিয়তি : স্বামী, গৃহ, সন্তান; অথবা অরা বেছে নিয়েছে নির্মম নিঃসঙ্গতা; বা তারা নির্ভর করেছে কোনো কর্মোদ্যোগের ওপর যা কম-বেশি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যখন তারা কোনোশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে জীবন উৎসর্গ করে তাদের ব্যর্থ জীবনকে পুনরুদ্ধার করার সুযোগ দেখতে পায়, তখন তারা মরিয়া হয়ে এআশার প্রতি নিয়োগ করে নিজেদের। মাদমোয়াজেল আইসি, জুলিয়েত দ্ৰো, ও মাদাম দআগল ছিলেন তিরিশ বছর বয়সের কাছাকাছি, যখন শুরু হয় তাঁদের প্রেম-জীবন, জুলি দ্য লেসপিনাস ছিলেন চল্লিশের কাছাকাছি। মূল্যবান মনে হতে পারে এমন আর কোনোলক্ষ্যই তখন তাদের সামনে ছিল না, প্রেমই ছিলো তাঁদের কাছে একমাত্র মুক্তির পথ।
এমনকি স্বাধীনতা বেছে নিতে পারলেও অধিকাংশ নারীর কাছে এ-পথটিকেই মনে হয় আকর্ষণীয় : নিজের জীবনের ভার নেয়া নারীর কাছে যন্ত্রণাদায়ক। বয়ঃসন্ধিকালে এমনকি পুরুষও পথনির্দেশ, শিক্ষা, মাতৃসুলভ লালনের জন্যে বয়স্ক নারীর মুখাপেক্ষী। হতে ইচ্ছুক হয়; কিন্তু প্রথানুগ মনোভাব, বালকের প্রশিক্ষণ, এবং তার নিজের আন্তর প্রণোদনা পরিশেষে তাকে বারণ করে অধিকার ত্যাগের সহজ সমাধান গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত বোধ করতে; তার কাছে বয়স্ক নারীর সঙ্গে এ-ধরনের সম্পর্ক নিতান্তই তার পথযাত্রার একটি পর্ব। পুরুষের এটা এক সৌভাগ্য যে–যেমন শৈশবে তেমনি। প্রাপ্তবয়স্কতার কালে তাকে নিতে হয় সর্বাধিক দুঃসাধ্য, তবে সবচেয়ে সুনিশ্চিত, পথ; নারীর এটা এক দুর্ভাগ্য যে সে পরিবেষ্টিত থাকে অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন দিয়ে; সব কিছুই তাকে সহজ ঢাল বেয়ে নামতে প্ররোচিত করে; নিজের পথ তৈরির সগ্রামে আহ্বান জানানোর বদলে তাকে বলা হয় তার কাজ শুধু নিজেকে পিছলে দেয়া এবং তাহলেই সে পৌঁছোবে মনোহর স্বর্গগুলোতে। যখন সে বুঝতে পারে সে মরীচিকা। দিয়ে প্রতারিত হয়েছে, তখন খুবই দেরি হয়ে গেছে; তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে একটি অবধারিতভাবে ব্যর্থ, ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগে।
মনোবিশ্লেষকেরা একথা ঘোষণা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে নারী প্রেমিকের মধ্যে খোঁজে পিতার ভাবমূর্তি; তবে এটা এ-কারণে যে পিতা একটি পুরুষ বলে, সে পিতা বলে নয়; সে বিস্ময়বিহ্বল করে ছোটো মেয়েকে, এবং প্রত্যেক পুরুষেরই আছে এ-যাদুকরী শক্তি। নারী বিশেষ একটি ব্যক্তিকে অন্য একটি ব্যক্তির মধ্যে প্রতিমূৰ্ত করতে চায় না, সে পুনর্গঠন করতে চায় একটি পরিস্থিতি : সে-পরিস্থিতি, যার অভিজ্ঞতা সে লাভ করেছে ছোটো মেয়ে হিশেবে, প্রাপ্তবয়স্কের রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে। সে গভীরভাবে বিন্যস্ত হয়েছিলো গৃহে ও পরিবারে, সে জেনেছে দৃশ্যতঅক্রিয়তার শান্তি। প্রেম তাকে ফিরিয়ে দেবে তার মাকে ও পিতাকে, এটা তাকে ফিরিয়ে দেবে তার শৈশব। সে যা পুনরুদ্ধার করতে চায়, তা হচ্ছে তার মাথার ওপর একটি ছাদ; দেয়াল, যা তাকে বুঝতে দেবে না যে সে পরিত্যক্ত হয়েছে বিশাল বিশ্বলোকে; কর্তৃত্ব, যা তাকে রক্ষা করবে তার মুক্তি থেকে। এ-শিশুসুলভ নাটক হানা দেয় বহু নারীর প্রেমে; তারা সুখী হয় ‘আমার ছোট্ট মেয়ে, আমার প্রিয় শিশু’ ধরনের ডাকে; পুরুষেরা জানে যে এ-শব্দগুলো : ‘তুমি একেবারে একটি ছোট্ট মেয়ের মতো’ সে-সবের অন্যতম, যা নিশ্চিতভাবে ছোঁয় নারীর হৃদয়। আমরা দেখেছি বহু নারী প্রাপ্তবয়স্ক হতে গিয়ে কষ্ট পায়; তাই বিপুলসংখ্যক নারী একয়েভাবে রয়ে যায় ‘শিশুসুলভ’, আচরণে ও পোশাকে তারা শৈশবকে প্রলম্বিত করতে থাকে অনির্দিষ্ট কাল ধরে। পুরুষের বাহুবন্ধনে আবার শিও হয়ে উঠতে পেরে আনন্দে ভরে ওঠে তাদের পেয়ালা। ব্যবহারজীর্ণ বিষয়টি : প্রিয়, তোমার বাহুর মধ্যে নিজেকে এতো ছোটো লাগে, ফিরে ফিরে আসে প্রেমাতুর সংলাপে ও প্রেমপত্রে। ‘শিশু আমার’, গুনগুন করে প্রেমিক, নারীটি নিজেকে বলে ‘তোমার ছোট্টটি’ ইত্যাদি। তরুণী লেখে : ‘কখন আসবে সে, যে আধিপত্য করবে আমার ওপর?’ আর যখন সে আসে, তখন নারী ভালোবাসে তার পুরুষসুলভ শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করতে। জেনেটের পর্যেষিত স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ত এক রোগী খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরে এ-মনোভাব :
আমি যতো বোকামির কর্ম ও ভালো কাজ করেছি, সেগুলোর পেছনে আছে একই কারণ; একটি বিশুদ্ধ ও আদর্শ প্রেমের জন্যে আকাঙ্খা, যাতে আমি পুরোপুরি দান করতে পারি নিজেকে, আমার নিজের সত্তার ভার তুলে দিতে পারি আরেকজনের, বিধাতা, পুরুষ, বা নারীর, হাতে, যিনি আমার থেকে এতো শ্রেষ্ঠ যে জীবনে আমি কী করবো, তা আর আমার ভাবার দরকার পড়বে না বা নিজেকে রক্ষা করতে হবে না… এমন একজন, যাঁকে মান্য করা যায় অন্ধভাবে ও আস্থার সঙ্গে… যিনি আমাকে লালন করবেন এবং আলতোভাবে ও প্রেমময়ভাবে নিয়ে যাবেন উৎকর্ষের দিকে। আমি কী যে ঈর্ষা করি মেরি ম্যাগডালেন ও জেসাসের আদর্শ প্রেমকে : একজন পূজ্য ও যোগ্য প্রভুর অতিশয় আকুল ভক্ত হওয়ার জন্যে; আমার দেবমূর্তি, তার জন্যে বাঁচতে ও মরতে, পশুর ওপর অবশেষে দেবদূতের জয় লাভের জন্যে, তাঁর সুরক্ষাপূর্ণ বাহুতে আশ্রয় নিতে, এতে ক্ষুদ্র, তাঁর প্রেমময় যত্নের মধ্যে এতো বিলুপ্ত, এতো পূর্ণাঙ্গভাবে তার যে আমার আর অস্তিত্ব নেই।
বহু উদাহরণ আমাদের ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে যে আত্মনিশ্চিহ্নকরণের এ-স্বপ্ন আসলে বেঁচে থাকার এক লোলুপ ইচ্ছে। সব ধর্মেই বিধাতার পুজোর সাথে মিশে থাকে পুজোরীর নিজের পরিত্রাণের বাসনা; নারী যখন নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে তার আরাধ্যের কাছে, তখন নারীটি আশা করে পুরুষটি তাকে একই সাথে দেবে তার নিজের ওপর নিজের দখল ও পুরুষটি যে-বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে, তার অধিকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সে প্রেমিকের কাছে চায় তার অহংয়ের সত্যতা প্রতিপাদন ও উন্নয়ন। বহু নারী প্রেমের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে না, যদি না তার বদলে তারা প্রেম পায়; এবং কখনো কখনো তাদের প্রতি যে-প্রেম দেখানো হয়, তা-ই তাদের প্রেম জাগানোর জন্যে যথেষ্ট। পুরুষের চোখে তাকে যেমন দেখাবে তরুণী নিজেকে স্বপ্নে দেখেছে সেভাবে, এবং নারীটি বিশ্বাস করে অবশেষে পুরুষের চোখেই সে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে।
মিডলটন মারিকে লেখা চিঠিগুলোর একটিতে ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ড লিখেছেন যে তিনি এইমাত্র একটা দুর্দান্ত উজ্জ্বল বেগুনি রঙের কর্সেট কিনেছেন; সাথে সাথে তিনি যোগ করেছেন : ‘খুবই দুঃখের কথা যে এটা দেখার জন্যে কেউ নেই!’ নিজেকে পুষ্প, সুগন্ধি, রত্ন বলে অনুভব করা, কিন্তু সেটি কারো বাসনার বস্তু নয়, এর চেয়ে বেশি যাতনার বিষয় আর কিছু হতে পারে না : এটা কেমন সম্পদ, যা আমাকে। সমৃদ্ধ করে না এবং কেউ চায় না যার দান? প্রেম হচ্ছে সে-ছবি পরিস্ফুটকারী, যে ঘোলাটে নেগেটিভকে পরিস্ফুট করে সুস্পষ্ট অনুপুঙ্খ পজিটিভরূপে, নইলে এটা একটি শূন্য আলোকসম্পাতের মতোই মূল্যহীন। নারীর মুখমণ্ডল, তার দেহের বাঁকগুলো, তার শৈশবের স্মৃতিপুঞ্জ, তার পূর্বতন অশ্রুরাশি, তার গাউন, তার অভ্যস্ত পথ, তার বিশ্ব, তার যা কিছু আছে, যা কিছু তার অধিকারে, প্রেমের ভেতর দিয়ে সে-সব মুক্তি পায় অনিশ্চয়তা থেকে এবং হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় : তার দেবতার বেদিমূলে সে একটি বিস্ময়কর অর্ঘ্য।
শুধু প্রেমেই নারী কাম ও আত্মরতির মধ্যে মিলন ঘটাতে পারে বৈরিতামুক্তভাবে; আমরা দেখেছি এ-আবেগগুলো এমন বিপরীত যে তার যৌন নিয়তির সাথে খাপ খাওয়ানো নারীর পক্ষে খুবই কঠিন। নিজেকে একটি শারীর বস্তুতে পরিণত করা, আরেকজনের শিকারে পরিণত করা, তার আত্মপুজোর সাথে বিসঙ্গত : তার মনে হয় আলিঙ্গন তার দেহকে বিবর্ণ ও কলুষিত করে বা অধঃপতিত করে তার আত্মাকে। এজন্যেই কিছু নারী শরণ নেয় কামশীলতার, তারা মনে করে এভাবেই রক্ষা করতে পারবে তাদের অহংয়ের শুদ্ধতা। অন্যরা বিশ্লিষ্ট করে নেয় পাশবিক সুখ থেকে উন্নত আবেগকে। স্টেকেলের এক রোগিণী তার শ্রদ্ধেয় ও বিখ্যাত স্বামীর সাথে ছিলো কামশীতল, এবং তার মৃত্যুর পর, একজন সমতুল্য শ্রেষ্ঠ পুরুষ, একজন মহৎ সঙ্গীতস্রষ্টা, যাকে সেআন্তরিকভাবে ভালোবাসতো, তার সাথেও ছিলো কামশীতল। কিন্তু হঠাৎ একটি স্কুল, বর্বর বনরক্ষকের সাথে সে লাভ করে পরিপূর্ণ শারীরিক তৃপ্তি, ‘এক বন্য নেশাগ্রস্ততার পর দেখা দেয় এক অবর্ণনীয় ঘৃণা’, যখন সে তার প্রেমিকের কথা ভাবে। স্টেকেল মন্তব্য করেছেন ‘অনেক নারীর জন্যে পাশবিকতায় নেমে যাওয়া পুলকের আবশ্যক শর্ত’। এ-ধরনের নারীরা শারীরিক প্রেমে দেখতে পায় এক অধঃপতন, যা অসমঞ্জস শ্রদ্ধাবোধ ও প্রীতির সাথে।
অন্য নারীদের মধ্যে, উল্টোভাবে, পুরুষটির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, প্রীতি, ও অনুরাগই শুধু পারে অধঃপতনের বোধ দূর করতে। সে-পুরুষের কাছে তারা নিজেদের সমর্পণ করে না, যদি না তারা বিশ্বাস করে যে পুরুষটি তাদের ভালোবাসে গভীরভাবে। দৈহিক সম্পর্ককে আনন্দের বিনিময় হিশেবে গণ্য করার জন্যে, যা দিয়ে উভয় সাথীই সমভাবে উপকৃত হয়, এটা বোধ করার জন্যে নারীর থাকা দরকার যথেষ্ট পরিমাণে সিনিসিজম, ঔদাসীন্য, বা গর্ববোধ। নারীর সমপরিমাণেই সম্ভবত তার থেকেও বেশি–পুরুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তার বিরুদ্ধে, যে তাকে যৌন শোষণ করতে চায়; তবে সাধারণত নারীই বোধ করে যে তার সঙ্গীটি তাকে ব্যবহার করছে একটি করণরূপে। আর কিছুই নয়, শুধু অতিশয় প্রশস্তিবোধই পারে সে-কর্মের গ্লানির ক্ষতিপূরণ করতে, যাকে নারী একটি পরাজয় বলে মনে করে।
আমরা দেখেছি সঙ্গমে নারীর দরকার পড়ে সুগভীর আত্মবিসর্জন; সে স্নাত হয় অক্রিয় অবসন্নতায়; নিমীলিত চোখে সে নামপরিচয়হীন, বিলুপ্ত, তার মনে হয় যেনো সে ভেসে যাচ্ছে ঢেউয়ে, বিক্ষিপ্ত হচ্ছে ঝঞায়, ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে : মাংস, জরায়ু, কবরের অন্ধকার। নিশ্চিহ্ন হয়ে এক হয়ে ওঠে সে সমগ্রের সাথে, বিলুপ্ত হয়ে যায় অহং। তবে পুরুষটি যখন তার থেকে সরে যায়, সে নিজেকে ফিরে আবার দেখতে পায় পৃথিবীতে, শয্যায়, আলোতে; সে আবার একটি নাম পায়, মুখমণ্ডল পায় : সে পরাস্ত একজন, শিকার, বস্তু।
এটা এমন এক মুহূর্ত, যখন প্রেম হয়ে ওঠে এক আবশ্যিকতা। দুধ ছাড়ার পর শিও যেমন খোঁজে তার পিতামাতার আশ্বস্তকর দৃষ্টি, তেমনি নারী পুরুষটির প্রেমময় অনুভবের মধ্যে বোধ করে সে এখনো এক হয়ে আছে সমগ্রের সাথে, যার থেকে তার মাংস বেদনাদায়কভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি পুলক লাভ করলেও নারী খুব। কম সময়ই পরিপূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হয়, সে তার মাংসের যাদুমন্ত্র থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায় না; প্রীতিরূপে তার বাসনা চলতেই থাকে। তাকে সুখ দিয়ে পুরুষটি বাড়িয়ে তোলে তার আসক্তি, পুরুষটি তাকে মুক্তিদান করে না। পুরুষটির দিক থেকে, সে আর নারীটিকে কামনা করে না; কিন্তু নারীটি তার এ-ক্ষণিক ঔদাসীন্যকে ক্ষমা করবে যদি না পুরুষটি তার প্রতি নিবেদন করে কোনো চিরন্তন ও পরম আবেগ। তখন ওই মুহূর্তটির সীমাবদ্ধতা লাভ করে সীমাতিক্ৰমণতা; তীব্র স্মৃতিগুলো আর মনস্তাপ হয়ে থাকে না, বরং হয়ে ওঠে মূল্যবান সুখ; সুখের হ্রাসপ্রাপ্তি হয়ে ওঠে আশা ও প্রতিশ্রুতি; প্রতিপন্ন হয় আনন্দভোগের যাথার্থ্য; নারী সগৌরবে মেনে নিতে পারে তার কামকে, কেননা সে একে অতিক্রম করে যায়; উত্তেজনা, আনন্দ, কামনা আর মানসিক অবস্থারূপে থাকে না, বরং হয়ে ওঠে হিতসাধন; তার দেহ আর বস্তু নয় :এটি একটি স্তোত্র, একটি শিখা।
তারপর সংরাগের সাথে সে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে কামের যাদুর কাছে; অন্ধকার হয়ে ওঠে আলো; তখন প্রণয়িনী নারী মেলতে পারে তার চোখ, তাকাতে পারে সে-পুরুষের দিকে, যে তাকে ভালোবাসে এবং যার দৃষ্টি তাকে গৌরবান্বিত করে; তার মাধ্যমে শূন্যতা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের পূর্ণতা, এবং অস্তিত্ব হয়ে ওঠে মূল্যবান; সে আর ছায়ার সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় না, বরং উড়তে থাকে পাখায় ভর করে, ওঠে সুউচ্চ আকাশমণ্ডলে। ক্ষান্তি হয়ে ওঠে পবিত্র তুরীয়ানন্দ। যখন নারী গ্রহণ করে তার প্রিয়তমকে, তখন নারীর ওপর সেভাবে অধিষ্ঠিত হয়, নারী সেভাবে সাক্ষাৎ লাভ করে, যেভাবে কুমারী মেরির ওপর ভর করেছে, কুমারী মেরি সাক্ষাৎ লাভ করেছে পবিত্র প্রেতের, যেভাবে ধর্মবিশ্বাসী লাভ করে খ্রিস্টান্ন। এটাই ব্যাখ্যা করে ধর্মীয় স্তোত্র ও কামগীতির অশ্লীল সাদৃশ্য; এমন নয় যে অতীন্দ্রিয় প্রেমের সব সময়ই থাকে একটা যৌন চরিত্র, বরং ঘটনা হচ্ছে প্রণয়িনী নারীর কাম রঞ্জিত থাকে অতীন্দ্রিয়বাদে। ‘আমার বিধাতা, আমার আরাধ্য, আমার প্রভু ও পালক’–একই শব্দরাশি ঝরে পড়ে নতজানু সন্তের এবং শয্যায় প্রণয়িনী নারীর ওষ্ঠ থেকে; এক নারী তার মাংস নিবেদন করে খ্রিস্টের বজ্রের কাছে, সে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কুশের কলঙ্কদাগ গ্রহণের জন্যে, সে চায় স্বর্গীয় প্রেমের জ্বলন্ত উপস্থিতি; অন্যজনও অর্ঘ্যদান করে ও অপেক্ষা করে; বন্ধু, তীব্রবেগ, বাণ মূর্ত হয়ে ওঠে পুরুষের যৌনাঙ্গে। উভয় নারীতেই থাকে একই স্বপ্ন, শৈশবপ্ন, অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন, প্রেমের স্বপ্ন : অপরের মধ্যে নিজেকে লুপ্ত করে পরম অস্তিত্ব অর্জনের স্বপ্ন।
অনেক সময় এটা দাবি করা হয়েছে যে নিশ্চিহ্নকরণের এ-বাসনা চালিত করে। মর্ষকামের দিকে। কিন্তু আমি কামের প্রসঙ্গে যেমন উল্লেখ করেছি, একে মর্ষকাম বলা যেতে পারে শুধু তখনই যখন আমি চেষ্টা করি ‘বস্তু হিশেবে আমার নিজের অবস্থান দিয়ে মুগ্ধ হতে, অন্যদের সংঘটনার মাধ্যমে’; অর্থাৎ বলা যায় যখন বিষয়ীর চৈতন্য পেছনমুখো হয়ে চালিত হয় অহংয়ের দিকে, একে হীনাবস্থায় দেখার জন্যে। এখন, প্রণয়িনী নারী একান্ত ও সম্পূর্ণরূপে তার অহংয়ের সাথে অভিন্ন আত্মরতিবতী নয়; সে বোধ করে নিজেকে অতিক্রম করার এক সংরক্ত বাসনা এবং যার প্রবেশাধিকার আছে অনন্ত বাস্তবে, তার সহযোগিতায় সে হতে চায় অনন্ত। নারী নিজেকে রক্ষা করার জন্যে নিজেকে বিসর্জন করে প্রেমে; তবে মূর্তিপুজোরী প্রেমের স্ববিরোধ এখানে যে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে পরিশেষে সে নিজেকে অস্বীকার করে শোচনীয়ভাবে। তার অনুভূতিগুলো লাভ করে এটি অতীন্দ্রিয় মাত্রা; তার বিধাতা তার অনুরাগী থাকুক ও তাকে অনুমোদন করুক, এটা আর তার দরকার পড়ে না; সে মিশে যেতে চায় তার সাথে, নিজেকে ভুলে যেতে চায় তার বাহুবন্ধনে। ‘আমি হতে চাই প্রেমের সন্ত’, লিখেছেন মাদাম দ’আগল। ‘এ-উন্নয়ন ও তপশ্চর্যাপূর্ণ ক্ষিপ্ততার মুহূর্তে আমি লাভ করতে চাই শহিদত্ব’। এসব কথা থেকে যা বেরিয়ে আসে, তা হচ্ছে যে-সীমারেখা পৃথক করে রাখে তাকে ও তার প্রিয়তমকে, সে-সীমারেখা বিলুপ্ত করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার বাসনা। এখানে মর্ষকামের কোনো ব্যাপার নেই, আছে এক পরমোল্লাসদায়ক মিলনের স্বপ্ন।
এ-স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে প্রথমে নারী যা চায়, তা হচ্ছে সে সেবা করতে চায় কেননা প্রেমিকের দাবিদাওয়া মেটাতে গিয়ে নারী অনুভব করে যে সে প্রয়োজনীয়; সে সুসংহতি লাভ করবে প্রেমিকের অস্তিত্বের মধ্যে, সে অংশীদার হবে তার প্রেমিকের বিশেষ মূল্যের, তার যাথার্থ্য প্রতিপন্ন হবে। অ্যাঞ্জেলাস সিলেসিউসের মতে এমনকি অতীন্দ্রিয়বাদীরাও বিশ্বাস করে যে বিধাতার মানুষ দরকার; নইলে তারা যে নিজেদের দান করছে, তা বৃথা হয়ে যাবে। পুরুষ যতো দাবি জানাতে থাকে, নারী ততো সন্তোষ বোধ করে। ভিক্তর উগো জুলিয়েত দ্রোর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন যে-নিঃসঙ্গতা, তা যদিও ওই তরুণীর জন্যে দুর্বহ হয়ে উঠেছিলো, তবু মনে হয় যেনো তরুণীটি উগোকে মান্য করে সুখই পেতে : উনোনের পাশে থাকা হচ্ছে প্রভুর সুখের জনো কিছু করা। সে চেষ্টা করে উগোর কাছে সদর্থকভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে। সে উগার জন্যে পছন্দের খাবার তৈরি করে এবং গুছিয়ে রাখে ছোটো একটি বাসা, যেখানে উগো আরাম করতে পারে; সে উগোর কাপড়চোপড়ের যত্ন নেয়। ‘আমি চাই তুমি যতোটা পারো তোমার কাপড়চোপড় ছেড়ো’, উগগাকে সে লেখে, ‘এবং আমি নিজে সেগুলো শেলাই করতে ও ধুতে চাই’।
কোনো মহাসংরাগের প্রথম দিকের দিনগুলোতে নারীটি হয়ে ওঠে আগের থেকে সুশ্রী, অনেক বেশি রুচিশীল : ‘যখন আদেল আমার চুল বাঁধে, আমি তাকিয়ে থাকি আমার ললাটের দিকে, কেননা তুমি এটি ভালোবাসো’, লিখেছেন মাদাম দআগল। এই মুখ, এই দেহ, এই ঘর, এই আমি–সে এ-সবের জন্যে পেয়েছে একটি লক্ষ্য ও যাথার্থ্য প্রতিপাদন, সে এগুলোকে হৃদয়ে পোষণ করে এ-প্রিয় মানুষটির মধ্যস্থতায়, যে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছু পরে সে ত্যাগ করে সব ছলাকলা; যদি তার প্রেমিক চায়, তাহলে সে বদলে ফেলে সে-ভাবমূর্তি, প্রথম দিকে যা ছিলো প্রেমের থেকেও মূল্যবান; সে এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে; সে যা, তার যা আছে, তার সব কিছুকে সে পরিণত করে প্রভুর প্রজায়; যাতে তার প্রেমিকের আগ্রহ নেই, সে ত্যাগ করে সেসব। প্রেমিকের প্রতি সে উৎসর্গ করে প্রতিটি হৃদস্পন্দন, তার প্রতিটি রক্তবিন্দু, তার অস্থির মজ্জা; এবং এটাই প্রকাশ পায় শহিদত্বলাভের স্বপ্নের মধ্যে : উৎপীড়ন বরণ। করেও, মৃত্যুবরণ করেও সে বাড়িয়ে দেবে তার দান, সে হয়ে উঠবে তার প্রেমিকের পদতলের ভূমি। প্রেমিকের কাছে যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, সে পাগলের মতো ধ্বংস করে সে-সব। নিজেকে সে যে-দান হিশেবে দিয়েছে, তা সর্বান্তকরণে গৃহীত হলে কোনো মর্ষকাম দেখা দেয় না; এর সামান্যই দেখা যায়, উদাহরণ হিশেবে, জুলিয়েত দ্রোর মধ্যে। ভক্তির আতিশয্যে সে কখনো কখনো নতজানু হয়েছে কবির প্রতিকৃতির সামনে এবং যদি সে কখনো কোনো অপরাধ করে থাকে, তার জন্যে ক্ষমা ভিক্ষা করেছে; সে নিজের ওপর ক্রোধ বোধ করে নি।
যে-নারী পুরুষের খেয়ালখুশির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে সুখ পায়, তার ওপর চালানো স্বৈরাচারের মধ্যে একটি সার্বভৌম স্বাধীন সত্তার সুস্পষ্ট কর্মের প্রতি সে। মুগ্ধতাও বোধ করে। উল্লেখ করা দরকার যে যদি কোনো কারণে প্রেমিকের মর্যাদা লোপ পায়, তাহলে তার ঘুষি ও যাচ্ঞাগুলো হয়ে ওঠে ঘৃণ্য; সেগুলো শুধু তখনই মহার্ঘ, যখন সেগুলো প্রকাশ করে প্রেমাস্পদের দেবত্ব। ওগুলো তা প্রকাশ করলে সে নিজেকে আরেকজনের স্বাধীন ক্রিয়ার শিকার বলে বোধ করে পায় মাদকতাপূর্ণ আনন্দ। আরেকজনের পরিবর্তনশীল ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক ইচ্ছের মাধ্যমে নিজের যাথার্থ প্রতিপাদনকে একটি অস্তিত্বশীলের কাছে মনে হয় এক অতিশয় বিস্ময়বিহ্বলকর রোমাঞ্চকর কর্ম বলে; সব সময় একই চামড়ায় থাকা ক্লান্তিকর, এবং অন্ধ আনগত্যই মানুষের জ্ঞাত আমূল রূপান্তরের একমাত্র সুযোগ। তার প্রেমিকের ক্ষণকালীন স্বপ্ন, তার কর্তৃত্বপরায়ণ আদেশ অনুসারে নারী তাই হয়ে ওঠে ক্রীতদাসী, রাণী, পুষ্প, হরিণী, স্বচ্ছ রঙমিশ্রিত কাচের জানালা, খেয়ালি, দাসী, বারবনিতা, শিল্পদেবী, সহচরী, মা, বোন, সন্তান। যতো কাল সে বোঝে না যে সব সময়ই তার ঠোটে লেগে ছিলো। আনুগত্যের পরিবর্তনহীন স্বাদ, ততো কাল সে বিমুগ্ধচিত্তে নিজেকে সমর্পণ করে এসব রূপান্তরের কাছে। প্রেমের স্তরে, যেমন কামের স্তরে, এটা সুস্পষ্ট যে মর্ষকাম হচ্ছে সে-ঘুরপথগুলোর একটি, যে-পথে যায় অতৃপ্ত নারীরা, যারা হতাশ প্রেমে ও কামে এবং নিজের ওপর; তবে এটা সময়গাপযোগী দাবিত্যাগের স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। মর্ষকাম অহংয়ের বিদ্যমানতাকে চিরস্থায়ী করে রাখে এক ক্ষতবিক্ষত ও অধঃপতিত অবস্থার মধ্যে প্রেম অপরিহার্য কর্তার অনুকূলে আনে আত্ম-বিস্মৃতি।
মানবিক প্রেমের পরম লক্ষ্য, অতীন্দ্রিয় প্রেমের মতোই, প্রিয়তমের সঙ্গে অভিন্নতাবোধ। প্রিয়তমের চৈতন্যে আছে মূল্যবোধের মানদণ্ড, বিশ্বের সত্য; তাই তার সেবা করাই যথেষ্ট নয়। প্রণয়িনী নারী প্রেমিকের চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে; প্রেমিক যে-সব বই পড়ে সে পড়ে সে-বই, সে পছন্দ করে সে-সব ছবি ও সঙ্গীত, যা প্রেমিক পছন্দ করে; সে শুধু সে-সব ভূদৃশ্যের প্রতিই আগ্রহ বোধ করে যা সে দেখে প্রেমিকের সাথে, সে আগ্রহ বোধ করে সে-সব ভাবনাচিন্তার প্রতি যা আসে প্রেমিকের কাছে থেকে; সে গ্রহণ করে তার বন্ধুদের, তার শত্রুদের, তার মতামত; যখন সে। নিজেকে প্রশ্ন করে, তখন সে শুধু প্রেমিকের উত্তরটিই শুনতে চায়; সে নিশ্বাসে নিতে চায় সে–বায়ু, প্রেমিক যা এরই মাঝে নিশ্বাসে নিয়েছে; যে-সব ফল ও ফুল প্রেমিকের হাত দিয়ে আসে নি, তার কাছে সে-সবের কোনো স্বাদ ও সুগন্ধ নেই। তার। স্থানবোধও বিপর্যস্ত হয় : সে যেখানে আছে, তা আর বিশ্বের কেন্দ্র নয়, বরং তার প্রেমিক যেখানে আছে, সেটিই বিশ্বের কেন্দ্র; সব পথই তার প্রেমিকের গৃহমুখি এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সব পথ। সে ব্যবহার করে তার প্রেমিকের ভাষা, অনুকরণ করে তার অঙ্গভঙ্গি, আয়ত্ত করে তার বাতিক ও তার মুখের খিচুনি। ‘আমি হিথক্লিফ’, বলে উদারিং হাইটস-এর ক্যাথেরিন; এটাই সব প্রণয়িনী নারীর আর্তনাদ; সে তার প্রিয়তমের এক প্রতিমূর্তি, তার প্রতিফলন, তার ডবল : সে হচ্ছে সে (প্রেমিক)। সে তার নিজের বিশ্বকে আকস্মিকতায় ভেঙে পড়তে দেয়, কেননা সত্যিকারভাবে সে বাস করে তার প্রেমিকের বিশ্বে।
তবে এ-মহিমামণ্ডিত পরম সুখ কদাচিৎ স্থায়ী হয়। কোনো পুরুষই আসলে বিধাতা নয়। অতীন্দ্রিয়বাদী নারী ঐশী অনুপস্থিতির সঙ্গে যে-সম্পর্ক পাতায়, তা। নির্ভর করে একলা তারই অনুভূতির উত্তাপের ওপর; কিন্তু দেবত্বে অধিষ্ঠিত পুরুষটি, যে বিধাতা নয়, উপস্থিত। এবং এ-ঘটনা থেকেই উৎপন্ন হয় প্রণয়িনী নারীর নিদারুণ যন্ত্রণা। তার চরম সাধারণ নিয়তির সারকথা প্রকাশ পেয়েছে জুলি দ্য লেসপিনাসের বিখ্যাত উক্তিতে : ‘সর্বদা, আমার প্রিয় বন্ধু, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি কষ্ট পাই এবং আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি’। এটা সত্য, পুরুষের কাছেও প্রেমের সঙ্গে জড়িত থাকে কষ্ট; তবে তাদের যন্ত্রণাগুলো স্বল্পকালস্থায়ী বা খুব তীব্র নয়। মাদাম রেকমিয়ের জন্যে মরে যেতে চেয়েছিলেন বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট : তিনি সেরে। উঠেছিলেন এক বারো মাসেই। তেঁদাল বহু বছর আক্ষেপ করেছিলেন মেতিলদের জন্যে, তবে এটা এমন এক আক্ষেপ, যা তাঁর জীবনকে ধ্বংস না করে সুরভিত করে তুলেছিলো। আর সেখানে নারী, অপ্রয়োজনীয়রূপে নিজের ভূমিকা গ্রহণ করে, একটা সামগ্রিক পরনির্ভরতা স্বীকার করে নিয়ে, তার জীবনকে করে তোলে নারকীয়। প্রতিটি প্রণয়িনী নারী নিজেকে দেখতে পায় হ্যান্স অ্যান্ডারসেনের ছোট্ট মৎস্যকন্যার মধ্যে, যে প্রেমে পড়ে নারীর পায়ের সঙ্গে বিনিময় করে নিয়েছিলো তার মাছের লেজ এবং তারপর দেখতে পেয়েছিলো সে হাঁটছে সুচ ও জ্বলন্ত কয়লার ওপর। একথা সত্য নয় যে প্রেমাস্পদ পুরুষটি চূড়ান্তরূপে অত্যাবশ্যক, আকস্মিকতা ও পরিস্থিতির ওপরে, এবং নারীটি তার কাছে আবশ্যক নয়; আসলে পুরুষটি এমন অবস্থানে নেই যে সে যাথার্থ প্রতিপাদন করবে সে-নারীসত্তাটির, যে উৎসর্গিত হয়েছে তার পুজোয়, এবং সে নারীটি দিয়ে আবিষ্ট হওয়াতে সে নিজেকে সম্মত করতে পারে না।
পতিত দেবতা পুরুষ নয় : সে একটা প্রবঞ্চক; সে সত্যিসত্যিই এই রাজা, যে গ্রহণ করছে স্তুতি, এটা প্রমাণ করা ছাড়া প্রেমিকের আর কোনো বিকল্প নেই–বা নিজেকে একটা জবরদখলকারী বলে তাকে স্বীকারোক্তি করতে হবে। যদি সে আর আরাধ্য না হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই পায়ে মাড়াতে হবে। সে তার প্রেমিকের ললাটে পরিয়ে দিয়েছে যে-মহিমার জ্যোতিচক্র, তার জন্যেই প্রণয়িনী নারী প্রেমিকের জন্যে নিষিদ্ধ করে যে-কোনো চারিত্রিক ত্রুটি; সে প্রেমিকের যে-মূর্তি তৈরি করেছে, প্রেমিক তা রক্ষা করতে না পারলে সে হতাশ ও বিরক্ত হয়। যদি প্রেমিক ক্লান্তিবোধ করে বা অসতর্ক হয়, যদি তার অসময়ে ক্ষুধা পায় ও তৃষ্ণা লাগে, যদি সে কোনো একটা ভুল করে বা স্ববিরোধিতা করে, তাহলে নারী দাবি করে যে সে আর সে নেই এবং একেই সে দুঃখের একটা কারণে পরিণত করে। এ-পরোক্ষ পথে সে এতোটা যায় যে প্রেমিকের প্রতিটি উদ্যোগ, যা সে সমর্থন করে না, তার জন্যে সে তিরষ্কার করে তার প্রেমিককে; সে বিচারকের বিচার করে, এবং প্রেমিক যে তার প্রভু থাকতে চাইবে, তার সে-স্বাধীনতা সে অস্বীকার করে। প্রেমিকে উপস্থিতির থেকে অনুপস্থিতিতেই অনেক সময় তার পুজোয় পাওয়া যায় বেশি পরিতৃপ্তি; আমরা যেমন দেখেছি, বহু নারী নিজেদের নিবেদন করে মৃত বা অন্য কোনোভাবে অগম্য বীরদের প্রতি, যাতে কখনোই দৈহিকভাবে তাদের মুখোমুখি হতে না হয়, কেননা রক্তমাংসের পুরুষ মারাত্মকভাবে তাদের স্বপ্নের বিপরীত। এ কারণেই জন্মেছে এসব সুখস্বপ্নভঙ্গজাত উক্তি : ‘মোহন রাজকুমারকে বিশ্বাস কোরো না। পুরুষেরা নিতান্তই দীনহীন জীব’, এবং এমন আরো অনেক। তাদের বামন মনে হতো না যদি না তাদের দৈত্য হতে বলা হতো।
প্রথম দিকে প্রণয়িনী নারী উল্লাস বোধ করে তার প্রেমিকের কামনা পরিপূর্ণরূপে চরিতার্থ করে; পরে সেই বিখ্যাত দমকল কর্মীর মতো, যে তার পেশার প্রতি প্রেমে সর্বত্র আগুন লাগিয়েছিলো–সে নিজেকে নিযুক্ত করে এ-কামনা জাগিয়ে তোলার কাজে, যাতে সে তা চরিতার্থ করতে পারে। এ-উদ্যোগে সফল না হলে সে নিজেকে এতো অপমানিত ও অপদার্থ মনে করে যে তার প্রেমিক যে-উষ্ণ আবেগ বোধ করে, তার ভান করে। প্রেমিককে মুগ্ধ করার সুনিশ্চিততম উপায়টি সে পেয়েছে নিজেকে একটি ক্রীতদাসী বানিয়ে। আমরা এখানে দেখতে পাই প্রেমের আরেক প্রতারণামূলক কাজ, যা বহু পুরুষ–উদাহরণস্বরূপ, লরেন্স ও মতেরল–ক্ষুব্ধভাবে অনাবৃত করে দেখিয়েছেন : এটা আসে দানের রূপ ধরে, যদিও আসলে এটা এক স্বৈরাচার। নারীর ওই অতিশয়মহৎ সংরাগ কীভাবে পুরুষকে ঘিরে শেকল জড়ায়, তা আদফএ তিক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট। ‘সে তার ত্যাগস্বীকারগুলোর আগে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নি, কেননা সে ব্যগ্র ছিলো আমাকে ওগুলো গ্রহণে বাধ্য করতে,’ এলিওনোর সম্পর্কে নিষ্ঠুরভাবে বলেছেন তিনি।
গ্রহণ আসলে একটা বাধ্যবাধকতা, যা প্রেমিকের জন্যে এমন একটি শর্ত, যাতে সে যে একজন দাতা তেমন মনে হওয়ারও সুযোগ থাকে না; নারী চায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে প্রেমিক গ্রহণ করবে সে-বোঝা, যার চাপে সে ভেঙেচুরে ফেলে প্রেমিককে। এবং তার স্বৈরাচার চির-অতৃপ্ত। প্রণয়ী পুরুষ স্বৈরাচারপরায়ণ, তবে সে যা চায়, তা পেয়ে গেলে সে তৃপ্তিবোধ করে; আর সেখানে নারীর অত্যধিক দাবিপূর্ণ অনুরক্তির কোনো সীমাপরিসীমা নেই। যে-প্রেমিকের আস্থা আছে তার দয়িতার ওপর, দয়িতা যদি অনুপস্থিত থাকে, তার কাছে থেকে দূরে কোথাও কাজে নিয়োজিত থাকে, তাহলে সে অসন্তোষ বোধ করে না; দয়িতা তারই আছে এ-বোধে নিশ্চিত থেকে সে একটা বস্তুর মালিক হওয়ার থেকে একটি স্বাধীন সত্তার মালিক হতে বেশি পছন্দ করে। নারীর কাছে, এর বিপরীতে, তার প্রেমিকের অনুপস্থিতি সব সময়ই একটা পীড়ন; প্রেমিক একটি চোখ, একজন বিচারক, আর যখনই সে প্রেমিকাকে ছাড়া আর কিছুর দিকে তাকায়, সে হতাশ করে তার প্রেমিকাকে; যা কিছু সে দেখে, তার থেকেই সে প্রেমিকাকে বঞ্চিত করে; যখন সে দূরে থাকে প্রেমিকার থেকে, প্রেমিকাটি একই সঙ্গে অধিকারবঞ্চিত হয় নিজের ও বিশ্বের; এমনকি যখন তার পাশে বসে প্রেমিক পড়ে বা লেখে, তখনও সে প্রেমিকাকে ত্যাগ করছে, তার সাথে বিশ্বাসঘাকতা করছে। সে প্রেমিকের ঘুমকেও ঘৃণা করে। কিন্তু বদলেয়ার দয়ালু হয়ে উঠেছেন তার নারীকে ঘুমন্ত দেখে : ‘তোমার সুন্দর চোখ দুটি ক্লান্ত, আমার নিঃস্ব প্রিয়তমা’; এবং প্রুস্ত মুগ্ধ হয়েছেন আলবার্তিনকে নিদ্রিত দেখে। বিষয়টি এই যে পুরুষের ঈর্ষা হচ্ছে নিতান্ত একান্তভাবে অধিকারের ইচ্ছা; প্রিয়তমা নারী, নিদ্রিত অবস্থায় যে ফিরিয়ে আনে শৈশবের নিরস্ত্র সারল্য, কারো অধিকারে নয়; ওই নিশ্চয়তাই যথেষ্ট। কিন্তু দেবতার, প্রভুর, উচিত নয় সীমাবদ্ধতার ঘুমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা; নারী প্রেমিকের সীমাতিক্ৰমণতাকে দেখে বৈরী দৃষ্টিতে; সে তীব্রভাবে ঘৃণা করে এ-দেহের পাশব জড়তাকে, যা আর তার থাকে না, থাকে নিজের, পরিত্যক্ত থাকে এমন এক আকস্মিকতায়যার মূল্য হচ্ছে তার আকস্মিকতা।
পুরুষেরা পরস্পরের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘোষণা করে যে প্রেম হচ্ছে নারীর পরম সিদ্ধি। ‘যে-নারী ভালোবাসে, নারী হিশেবে সে হয়ে ওঠে আরো নারীধর্মী,’ বলেছেন নিটশে, এবং বালজাক বলেছেন : ‘উৎকৃষ্ট পুরুষের জীবন হচ্ছে খ্যাতি, নারীর জীবন হচ্ছে প্রেম। নারী তখনই সমতুল্য হয়ে ওঠে পুরুষের, যখন সে তার জীবনকে করে তোলে এক বিরতিহীন অর্ঘ্য, যেমন পুরুষের জীবন এক বিরতিহীন কর্ম’। কিন্তু এতে আছে এক নিষ্ঠুর প্রতারণা, কেননা নারী যা দান করে, পুরুষ তা কোনোক্রমেই গ্রহণের জন্যে ব্যগ্র নয়। যেদিন নারীর পক্ষে তার দুর্বলতায় নয় বরং তার শক্তিতে ভালোবাসা সম্ভব হবে, নিজের থেকে পলায়ন নয় বরং নিজেকে লাভ করা সম্ভব হবে, নিজেকে অধঃপতিত নয় বরং নিজেকে জ্ঞাপন করা সম্ভব হবে–সেদিনই পুরুষের। মতো তার জন্যে প্রেম হয়েউঠবে জীবনের এক উৎস এবং তা আর মারাত্মক বিপদ হয়ে থাকবে না। তার আগে প্রেম হচ্ছে নারীর ওপর চেপে থাকা এক ভয়ঙ্কর মর্মস্পর্শী অভিশাপ, যে-নারী বন্দী হয়ে আছে এক নারীর জগতে, যে বিকলাঙ্গ নারী, যে পর্যাপ্ত নয় নিজের জন্যে।