৬.২ পৃথিবীর অধীশ্বর

২৯. পৃথিবীর অধীশ্বর

আমার কোৰ্চি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালো বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর কি সমস্যা হয়েছে? মোলশ পাঁচ সালের অক্টোবর মাসের এক ভোর বেলায় সেলিম আকবরের প্রধান হেকিমকে জিজ্ঞেস করলো।

মহামান্য সম্রাট তিন ঘন্টা আগে প্রচণ্ড পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং বমি করা শুরু করেছেন, বয়স্ক এবং মর্যাদা সম্পন্ন চেহারার অধিকারী আহমেদ মালিক উত্তর দিলো। ঘাড়ের উপর দিয়ে পিছনে তাকিয়ে আকবরের শয়নকক্ষের বাইরে প্রহরারত রক্ষীদের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে সে গলার স্বর নিচু করে আবার কথা বলে উঠলো, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে।

 বিষ! অসম্ভব। যা কিছু আমার বাবা আহার করেন তা কমপক্ষে তিন বার পরীক্ষা করা হয় এবং রন্ধনশালার প্রধান মীর ভাওয়াল প্রতিটি পদ বারকোশে অবরুদ্ধ করে রক্ষীদের পাহারায় বাবার জন্য প্রেরণ করে…এমনকি তার পছন্দের গঙ্গার পানিও একাধিক বার পরীক্ষা করা হয়।

কোনো না কোনো উপায় ঠিকই আবিষ্কার করা যায়। স্মরণ করুন আপনার পিতামহ কেমন করে এই আগ্রাতেই বিষে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে বসেছিলেন। আমার দাদা আব্দুল মালিক সে সময় তার চিকিৎসা করেছিলেন। তবে এখন আমি বুঝতে পেরেছি আমার সন্দেহ ভিত্তিহীন। আমি আপনার পিতা বমি গুলি তক্ষুণি কিছু কুকুরকে খাওয়ানোর আদেশ দেই। বমি খাওয়ার পর সেগুলির কোনোটিই অসুস্থ হয়ে পড়েনি। আপনার পিতার লক্ষণগুলি তেমন প্রকট হয়ে উঠছে না বিষ খাওয়ানো হলে যেমনটা হতো।

তাহলে তার কি হয়েছে? এটা কি সেই একই পেটের পীড়া যাতে তিনি কয়েক মাস আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন?

 সেরকমই মনে হচ্ছে, যদিও আমি এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে অসুখের প্রকৃতি যাই হোক সেটা আপনার পিতার শরীরকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তবে আমি আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে আমি এবং আমার সহযোগীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রোগের কারণ নির্ণয় করতে।

 আপনারা আন্তরিক চেষ্টা করবেন সেই আস্থা আমার রয়েছে। আমি কি এখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারি?

 তিনি বর্তমানে অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করছেন এবং আদেশ করেছেন তাঁকে যাতে বিরক্ত করা না হয়।

 আপনি তার যন্ত্রণা কমানোর জন্য কিছু করতে পারেন না?

 নিশ্চয়ই পারি। আমি তাকে ওপিয়াম দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বললেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সেই জন্য তার মস্তিষ্ক স্থির এবং পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন, এমনটি এর জন্য যদি তাকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাহলেও।

হেকিমের বক্তব্যের তাৎপর্য অনুধাবন করে সেলিমের চোখ কিছুটা প্রসারিত হলো। কেবল মাত্র একটি কারণেই আকবর এমন কথা বলতে পারেন উত্তরাধিকারী নির্বাচন। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছেন তিনি মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন…

হেকিম, আমি জানি আপনার উপর আমার বাবার আস্থা কতোটুকু। তাকে সুস্থ করে তুলুন।

আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো জাহাপনা কিন্তু আমি আপনার কাছে বাস্ত বতা গোপন করবো না। আমি তাকে এতো দুর্বল হয়ে পড়তে আগে কখনও দেখিনি। তাঁর নাড়ির গতি অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। আমি সন্দেহ করছি অনেক দিন ধরেই তিনি পেটের পীড়ায় ভুগছেন কিন্তু সেটা গোপন রেখেছিলেন। গতরাতে অসুস্থতা মারাত্মক রূপ ধারণ করাতেই তিনি আমাকে ডাকতে বাধ্য হয়েছেন।

 হেকিম… সেলিম কিছু বলতে নিলো; কিন্তু অগ্রসরমান পদশব্দ শুনে সে চুপ করে গেলো। খোসরু করিডোর দিয়ে দৌড়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো। আমি এই মাত্র খবর পেলাম। আমার দাদা এখন কেমন আছেন? সেলিমের নৈরাশ্যজনক দৃষ্টি খোসরুর রক্তিম মুখমণ্ডলে উদ্বেগের পরিবর্তে উত্তেজনা দেখতে পেলো।

তিনি খুবই অসুস্থ, সেলিম সংক্ষেপে উত্তর দিলো। আহমেদ মালিক তোমাকে তার অসুখ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন। তবে বেশি প্রশ্ন করে তাকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখ না কারণ তাতে তোমার দাদার চিকিৎসা বিঘ্নিত হবে।

এখনো জ্বলতে থাকা কয়েকটি মশালের অল্প আলোতে সেলিম করিডোর দিয়ে অগ্রসর হলো। করিডোরের পার্শ্ববর্তী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো দিগন্ত ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। একটি বাক ঘুরে দেখতে পেলো সুলামান বেগ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

কি অবস্থা? তার দুধভাই তাকে জিজ্ঞাসা করলো।

হেকিমের কথা শুনে মনে হলো বাবার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, তবে সে স্পষ্ট ভাবে এ কথা বলেনি। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি বহুবার তার মৃত্যুর কথা ভেবেছি এবং তা হলে আমার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তাও ভেবেছি। কিন্তু কখনোও ভাবিনি সত্যি সত্যি সেই মুহূর্ত একদিন উপস্থিত হবে।

 সুলায়মান বেগ এগিয়ে এসে সেলিমের কাঁধে হাত রাখলো। তুমি তোমার অনুভূতি গুলিকে জোর করে এক পাশে সরিয়ে রাখো, কারণ সেগুলির জটিলতা তোমাকে দুর্বল করে তুলবে। সম্রাটের অসুস্থ্যতার খবর ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং খোসরুর সমর্থকেরা আগ্রা দুর্গের আশেপাশে সদম্ভে চলাফেরা শুরু করেছে, ভাবটা এমন যেনো তারাই ক্ষমতা লাভ করে ফেলেছে। সর্বত্র একই প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে, যে কাকে ম্রাট তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করবেন।

 সেটা তো নির্ধারণ করবেন আমার বাবা।

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা কেউই অনুমান করতে পারছি না বাস্তবে কি ঘটবে। আমাকে মাফ করো, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে কোনো উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার আগেই ম্রাটের মৃত্যু হতে পারে…এবং তিনি যদি তোমাকে নির্বাচন করেনও, খোসরুর সমর্থকেরা হয়তো বিদ্রোহ করে বসবে। তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তুমি যতো সবল হবে ততো দ্রুত তুমি আঘাত হানতে পারবে যদি প্রয়োজন হয়।

 তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু সুলায়মান বেগ এবং সর্বদাই সঠিক বিশ্লেষণ করো। তাহলে বর্তমানে আমার করণীয় সম্পর্কে তোমার পরামর্শ কি?

 আমাকে অনুমতি দাও যাতে আমি আমাদের সমর্থক সেনাপতিদের তাদের সৈন্যসহ রাজধানীতে আসার জন্য ডাক দিতে পারি।

ঠিক আছে তাই করো। তবে তাদের নিরবে আসতে বলো যাতে কোনো রকম ক্ষমতা প্রদর্শনের ঘটনা না ঘটে। বাবার মনে সন্দেহ বা দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু আমি করতে চাই না।

*

ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে পরিচারকদের সহায়তায় হেঁটে এসে আকবর দরবার কক্ষের সিংহাসনে বসলেন। দুদিন আগে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং হেকিমরা তার বমির সঙ্গে অপসৃয়মান রক্ত বন্ধ করতে পারেনি। অবশ্য রক্ত যাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমেছে, সেটা হয়তো এই জন্য যে তিনি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছেন। তার গায়ের চামড়া প্রায় স্বচ্ছ হয়ে পড়েছে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে যে এই দুর্বল বৃদ্ধ লোকটি এক সময় উৎফুল্ল চিত্তে আগ্রার দুর্গপ্রচীরের চারদিকে দৌড়াতে পারতেন দুই বগলে দুইজন পূর্ণবয়স্ক যুবককে নিয়ে। আকবরের পরিচারকরা যখন তার পিঠের পিছনে একটি বালিশ স্থাপন করছিলো সেলিম লক্ষ্য করলো তার বাবার মুখ ব্যথায় কুঁচকে উঠেছে। কিন্তু এক মুহূর্ত পর যন্ত্রণা সয়ে নিয়ে সম্রাট তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। আমার বিশ্বস্ত উপদেষ্টাগণ, আজ আমি তোমাদের ডেকেছি সম্ভবত আমার শাসন আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাকে সাহয্য করার জন্য। আকবর নিচু স্বরে কথা বললেন, কিন্তু অন্য সকল সময়ের মতোই তাঁকে কর্তৃত্বপূর্ণ শোনালো। আমার অসুস্থতা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। হয়তো শীঘই আমার মৃত্যু হবে। সেটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমার সাম্রাজ্য-মোগল সাম্রাজ্যকে উপযুক্ত হাতে সমর্পণ করা। সেলিম লক্ষ্য করলো খোসরু তার প্রিয় রুপালী ও বেগুনি পোষাকে সজ্জিত হয়ে আছে, সে উত্তেজনায় এক পা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে দাঁড়ালো।

 আমার উচিত ছিলো বহু আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিম অথবা জ্যেষ্ঠ নাতি খোসর মধ্যে কাকে নির্বাচন করবো। ভেবেছিলাম আমি আরো অনেক বছর বাঁচবো, সেই জন্য আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং পর্যবেক্ষণ করতে থাকি তাঁদের দুজনের মধ্যে কে সবচেয়ে যোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় প্রতিটি ক্ষণ আমার জন্য মহা অমূল্য সম্পদ এবং সিদ্ধান্ত আমি একাই নেবো। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদের মতামত শ্রবণ করতে চাই কারণ তোমরা আমার উপদেষ্টা। শুরু করো।

 এক মুহূর্তের জন্য সেলিমের শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যাবে। শেখ সেলিম চিশতির কথা গুলি তার মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হলো- তুমি সম্রাট হবে- কিন্তু বালক অবস্থায় ফতেহপুর শিক্রির সেই উষ্ণ সন্ধ্যায় সুফির কাছে সাহায্যের জন্য দৌড়ে যাওয়ার পর অনেক কিছু ঘটে গেছে। চেষ্টা সত্ত্বেও কখনোই সে তার পিতার সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি কিম্বা মনোযোগ অর্জন করতে পারেনি। ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রলোভনে মরিয়া হয়ে নানা অঘটনে জড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারেও সে নিশ্চিত যে আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ডের জন্য আকবর তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারেননি যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। খোসরুর মামা অম্বরের রাজা মান সিং আকবরের দিকে কয়েক পদক্ষেপ অগ্রসর হলো। জাহাপনা, আপনি আমদের বিবেচনা জানতে চেয়েছেন তাই আমি আমার মতামত দিচ্ছি। আমি যুবরাজ খোসরুর প্রতি আমার সমর্থন প্রদান করছি। সে তরুণ, তার সম্মুখে অনেক গুলি বছর রয়েছে। আমি আমার ভগ্নিপতি যুবরাজ সেলিমকেও সম্মান করি, কিন্তু ইতোমধ্যেই সে তার মধ্যবয়সের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করেছে। তার উচিত তার পুত্রকে উপদেশ এবং নির্দেশনা প্রদান করা, সিংহাসনে আরোহণ করা তার ঠিক হবে না। কথা শেষ করে মান সিং এমন ভাবে তার মাথাটি ঝাঁকালো যাতে মনে হলো তার কাঁধের উপর থেকে কোনো ভারী বোঝা নেমে গেছে এবং তার জন্য কাজটি সহজ ছিলো না। কতো মারাত্মক কপটতা, সেলিম ভাবলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে মান সিং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের আশায় ভাগ্নের জন্য সুপারিশ করছে।

 আমি ওনার সঙ্গে একমত, আজিজ কোকা বলে উঠলো, সে আকবরের একজন তরুণ সেনাপতি। সেলিমের ঠোঁটে ভাজ পড়লো। জানা কথা খোসরু তাকে তার প্রধান সেনাপতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যদি সে সম্রাট হতে পারে। আমাদেরকে আরো গৌরব উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর করার জন্য যুবরাজ খোসরুর মতো একজন শক্তিশালী তরুণ নেতা প্রয়োজন, বলে আজিজ কোকা তার বক্তব্য শেষ করলো।

সমগ্র সভাকক্ষ জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে এবং সেলিম লক্ষ্য করলো উপস্থিত সভাসদগণ পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছে। এরপর হাসান আমল, তরুণ বয়সে যার বাবা কাবুল থেকে হিন্দুস্তানে আসার সময় বাবরের সঙ্গী হয়েছিলেন, তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন।

 না! যদিও তার বয়স আকবরের তুলনায় দশ বছরের মতো বেশি হবে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর সেই তুলনায় অনেক দৃঢ় শোনালো। আমাদের ইতিহাসে বহু বার দেখা গেছে সিংহাসন অধিকারের জন্য এক ভাই অন্য ভাই এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু মোগল গোত্র গুলির মধ্যে অতীতে এমনটা কখনোও দেখা যায়নি যে বাবাকে হটিয়ে পুত্রকে ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে। আমাদের মহান সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী হতে পরে যুবরাজ সেলিম। এটা কেবল আমার মনের কথাই নয় বরং আমার বিশ্বাস এখানে উপস্থিত অনেকেই দুই যুবরাজকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া বিরোধের বিষয়ে দুর্ভাবনাগ্রস্ত। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত অশোভন এবং ভয়ঙ্কর। যদিও আমার বয়স তখন অত্যন্ত কম ছিলো কিন্তু সেই দিন গুলির কথা আমি ভুলিনি যখন হিন্দুস্তানে আমাদের অবস্থান পাকাঁপোক্ত হয়নি এবং এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে আমরা একটি অবিসংবাদী সম্রাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিপতি। মোগলদের চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আমাদের এই শক্তিশালী অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না। ন্যায় বিচার এবং বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে এটাই যুক্তিযুক্ত যে সম্রাট আকবরের একমাত্র জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ সেলিম সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী। আমাদের অনেকের মতো সেও অনেক ভুল ত্রুটি সম্পাদন করেছে কিন্তু এই সঙ্গে অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি নিশ্চিত সে একজন দক্ষ সম্রাট হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে।

 জাঁহাপনা, আপনার প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমিও মাননীয় হাসান আমলের সঙ্গে একমত পোষণ করছি, আব্দুল রহমান নরম সুরে তার মতামত পেশ করলো। তার আশেপাশে উপস্থিত সকলে মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করছিলো কিন্তু সেলিম সামান্য একটি সংকেত পাওয়ার জন্য তার বাবার মুখের দিতে চেয়ে রইলো। আকবরের চোখ গুলি বর্তমানে আধবোজা হয়ে আছে এবং সেলিমের আশংকা হলো তিনি হয়তো অচেতন হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তখনোই সম্রাট তার একটি হাত তুললেন।

 হাসান আমল এবং আব্দুল রহমান, তোমাদের বিচক্ষণতার জন্য আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, এর আগেও তোমরা বহুবার তোমাদের বিজ্ঞতার প্রমাণ রেখেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষ তোমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করছে। অবশ্য তারা সেটাই সমর্থন করছে যা আমি মনে মনে ঠিক করেছি। আমার পরিচারকরা রাজ পাগড়ি এবং জোব্বা নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।

 নিজের অজান্তেই সেলিমের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো এবং নিজেকে শান্ত রাখার জন্য সে লড়াই করতে লাগলো। তারপর পিতার দিকে তাকাল যখন তিনি আবার তার বক্তব্য শুরু করলেন, এখন শুরু মাওলানাদের ডাকা বাকি রয়েছে। আমি চাই তারাও প্রত্যক্ষ করুক যে আমি যুবরাজ সেলিমকে আমার উত্তরসূরি নির্বাচন করেছি।

 যখন উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সেলিমের উপর নিবদ্ধ হলো, একটি অসহনীয় ভারী বোঝা তার বুকের উপর থেকে নেমে গেলো। অবশেষে শাসন ক্ষমতা তার উপর বর্তালো এবং নিয়তির বিধান পূর্ণ হলো। তার মুখমণ্ডল খুশিতে উদ্ভাসিত হলো কিন্তু সেই সঙ্গে চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে উঠলো যখন সে কথা বললো, ধন্যবাদ বাবা, আমি আমার উপর আপনার অস্থার মর্যাদা রক্ষা করবো। যখন সময় উপস্থিত হবে তখন সকলের সমর্থন আমার প্রয়োজন হবে এবং আমি সকলের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করবো।

 বিশ মিনিট পরে, উপস্থিত সভাসদ এবং ওলামা পরিষদের সম্মুখে, আব্দুল রহমান সেলিমের মাথায় সবুজ রেশমের রাজকীয় পাগড়িটি পড়িয়ে দিলো এবং হাসান আমল রাজকীয় আলখাল্লাটি দিয়ে সেলিমকে আচ্ছাদিত করলো। আকবর কয়েক মুহূর্ত তাঁর পুত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, তোমাদের সকলের সামনে আমি সেলিমকে পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করছি যে আমার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করবে। আমি তোমাদের সকলকে আদেশ করছি তার প্রতি তোমাদের আনুগত্য প্রদর্শন করতে, তোমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ যাই হোক না কেনো। এখন আমি তোমাদের সকলের মুখ থেকে সেই শপথ বাক্য শ্রবণ করতে চাই।

 দরবার কক্ষে উপস্থিত সকলে সমস্বরে আকবরের বক্তব্যে সাড়া প্রদান করে সেলিমের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করলো। এমনকি আজিজ কোকাও তাতে যোগ দিলো।

আমার আরেকটি কর্তব্য পালন করা বাকি রয়ে গেছে। আকবর সিংহাসনের আচ্ছাদনের নিচে হাত ঢুকালেন এবং কম্পিত হস্তে রত্নখচিত খাপ এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী তলোয়াটি বের করে আনলেন। এটা সেই আলমগীর, যে তলোয়ারের সাহায্যে আমার দাদা বাবর তার শত্রুদের নির্বাপিত করেছিলেন এবং একটি সাম্রাজ্য জয় করেছিলেন। বহুবার এটি আমার নিজের জীবন রক্ষা করেছে এবং আমাকে বিজয় এনে দিয়েছে। সেলিম এটি আমি তোমার কাছে হস্তান্তর করছি। কখনোও এর মর্যাদা রক্ষা করার যোগ্যতা হারিও না।

যখন সেলিম তলোয়ারটি গ্রহণ করার জন্য তার বাবার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসলো, ঈগলের চুনিখচিত চোখ গুলি ঝলসে উঠলো। শেখ সেলিম চিশতি সত্যের চেয়ে একটুও বেশি কিছু বলেননি। অবশেষে সেই মোগল সম্রাটের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলো।

*

সেইদিন কয়েক ঘন্টা পর, আকবরের প্রধান হেকিম আহমেদ মালিক সেলিমের কক্ষে এলো। তার চেহারা অত্যন্ত গম্ভীর। আপনার বাবার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। তবে তার মস্তিষ্ক পরিষ্কার রয়েছে। তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর আয়ু আর কদিন রয়েছে। আমরা তাকে বলতে বাধ্য হয়েছি যে আমাদের পক্ষে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো ধারণা দেয়া সম্ভব নয়, তবে এই টুকু বলা সম্ভব যে তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। হয়তো কয়েক দিন অথবা আরো কয়েক ঘন্টা। তিনি এক দুই মিনিট কিছু বললেন না। তারপর তিনি শান্তভাবে আমাদের সতোর জন্য ধন্যবাদ দিলেন এবং এতোদিন আমরা তার জন্য যা করেছি এবং তাকে আরাম প্রদানের জন্য এখনোও যা করছি তার জন্য। এরপর তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, সেলিম বললো। কয়েক মিনিট পরে সূর্যালোকিত উঠান পেরিয়ে সেলিম তার পিতার শয়নকক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। উঠানের কেন্দ্রে জল উদগিরন্দরত মার্বেল পাথরের ফোয়ারার সৌন্দর্য তার দৃষ্টি কাড়লো না। পিতার কক্ষের বাইরে অবস্থানরত দেহরক্ষীরা সেলিমের প্রবেশের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দিলো। চন্দনকাঠের সুঘ্রাণ বা আগরবাতিদানে প্রজ্জ্বলিত কর্পূরের গন্ধ কোনো কিছুতেই আকবরের পচনশীল পরিপাকতন্ত্রের কটু গন্ধকে আচ্ছাদিত করা সম্ভব হয়নি।

 সম্রাট কিছু বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। আকবরের চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, চোখের নিচে সৃষ্টি হওয়া ভাঁজগুলি বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে। তা সত্ত্বেও তিনি শান্ত স্থির দৃষ্টিতে পুত্রের দিকে তাকালেন এবং মুখের কাছে ধরে থাকা পানির পাত্রে একটি চুমুক দিলেন। এসো সেলিম, আমার পাশে বসো। আমার কণ্ঠস্বর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সময় থাকতে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।

অনুগত পুত্রের মতো সেলিম তার বাবার পাশে গিয়ে বসলো। সে বসার পর আকবর বলতে লাগলেন, আহমেদ মালিক বলেছে শীঘ্রই আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো।

আমি প্রর্থনা করি এতো শীঘ্রই যেনো এমন কিছু না ঘটে, সেলিম বললো, অনুভব করলো এই কথাগুলি সে মন থেকে বলেছে। এতোদিন পরে যখন বহুপ্রতীক্ষিত রাজমুকুটটি তার অধিকারে এসে গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিকে সে আরো উদার চিত্তে গ্রহণ করার সামর্থ অর্জন করেছে। তার বাবার কৃতিত্বের সঙ্গে সে, কি নিজেকে তুলনা করতে পারে? সেলিম আবার বলে উঠল, কিন্তু সত্যিই যদি তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাহলে আমি অনুরোধ করবো সেই আনন্দ এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে তুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নাও যে তোমার মতো মহান কৃতিত্ব অর্জনকারী সম্রাট পৃথিবীতে কদাচিৎ জন্ম নেয়।

 একজন ইউরোপীয় ধর্মযাজক আমাকে একবার বলেছিলো তাদের খ্রিস্টিয় ধর্মবিশ্বাসের গোড়া পত্তনের শত বছর পূর্বে একজন দার্শনিক জন্ম নিয়েছিলেন যিনি মৃত্যু সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন একজন মানুষকে সত্যিকার অর্থে সুখি বলা যাবে না যদি না সে শন্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় করার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা কালীন সময়ে আমি ঐ দার্শনিকটির বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেয়েছি। আমি সেভাবেই এই সাম্রাজ্যকে সুগঠিত করার চেষ্টা করেছি যাতে আমার মৃত্যুর পরে এর সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত না হয়ে। এখন যখন আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে আমি শান্তিতে দেহত্যাগ করতে পিরবো যদি তুমি আমার কিছু বিদায়কালীন উপদেশ সত্যিকার গুরুত্ব সহকারে শ্রবণ করো।

 নিশ্চয়ই বাবা। মাত্র কিছু সময় আগে তুমি যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে তোমার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করলে তখন এই বিশাল দায়িত্ব আমাকে আস্থার সঙ্গে প্রদান করায় আমি একাধারে আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ বোধ করেছি।

 প্রথমত, সর্বদা মনে রাখবে সাম্রাজ্যকে কখনোও স্থবির হতে দিলে চলবে না। অপরাপর ঘটনা প্রবাহ দ্বারা যদি এর সমৃদ্ধি এবং পরিবর্তন সাধিত না হয় তাহলে তা ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হবে।

 আমি বুঝতে পেরেছি। আমি দাক্ষিণাত্যের সেনা অভিযান অব্যাহত রাখব। আমাদের সাম্রাজ্যের উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত নদী এবং পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত। বর্তমানে দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করাই আমদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং ফলপ্রসূ উদ্যোগ হবে।

দ্বিতীয়ত, সর্বদা বিদ্রোহ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এক মুহূর্তের জন্য সেলিমের মনে হলো বাবা তাকে এখনোও তিরস্কার করছেন কি না। কিন্তু তিনি যখন তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন তখন সে সেরকম কোনো ইঙ্গিত পেলো না, আমার একজন ইতিহাসবিদ আমাকে জানিয়েছে আমি আমার শাসনামলে একশ পঞ্চাশটি বিদ্রোহ দমন করেছি। তখনই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে যখন সেনাবাহিনীর যুদ্ধাভিযান অথবা লুটের মালামাল প্রাপ্তির সুযোগ রহিত হয়েছে যা তাদের ষড়যন্ত্র করা থেকে বিরত রাখতে পারতো।

সেলিম মাথা ঝাঁকালো।

সকলের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করবে, তাদের মর্যাদা বা ধর্ম যাই হোক না কেনো এবং সর্বদা ক্ষমা প্রদর্শন করবে যদি সম্ভব হয়। এর ফলে প্রজাদের মাঝে ঐক্য বজায় থাকবে। কিন্তু তোমার ক্ষমাকে যখন দুর্বলতা ভাবা হবে অথবা কোনো গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হবে, নির্দয় ভাবে চূড়ান্ত আঘাত হানবে যাতে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে সকলে অবহিত হতে পারে। আমার বাবা হুমায়ূন যে সব ভুল করেছিলেন সেগুলি এড়িয়ে চলবে। উদাহরণ সৃষ্টির জন্য আগেই অল্প মানুষের মৃত্যু হওয়া ভাল পরবর্তীতে অনেক বেশি প্রাণহানির তুলনায়।

আমি যখন কাউকে আক্রমণ করবো তখন কোনো দুর্বলতা প্রদর্শন করবো না বরং সুচিন্তিত এবং দৃঢ় ভাবে আগ্রাসন চালাবো, সেলিম প্রায় যান্ত্রিক ভাবে বললো। পিতার বক্তব্য সে স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছে এবং তা নতুন কিছু নয়। হয়তো আকবর তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নিজেরই প্রশংসা করছেন সেলিমকে সহায়তা মূলক উপদেশ প্রদানের পরিবর্তে। কিন্তু তখন, সেলিমের মনোভাব বুঝতে পেরেই যেনো, আকবর বললেন, আমি আমার ভুল গুলি থেকে শিক্ষা নিয়েই কঠিন পথে বাস্তব সম্মত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।

সেলিমের দেহ সামান্য আন্দোলিত হলো। এই প্রথম সে শুনলো তার পিতা নিজের ভুল ত্রুটি সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করছেন।

তোমার পরিবারের প্রতি মনোযোগ প্রদান করবে। বর্তমানে আমাদের সাম্রাজ্য যতোটা শক্তিশালী তাতে বাইরের শত্রুর কাছ থেকে আক্রমণের আশংকা তুলনামূলক ভাবে কম। আভ্যন্তরীণ কলহ বিবাদই বর্তমানে আমাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। আমার বাবা তার সম্ভাইদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় প্রদান করেছিলেন। কিন্তু আমি এই বাস্তবতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি যে ক্ষমতা কখনোও ভাগাভাগি করা যায় না এবং আমার কর্তৃতুই চূড়ান্ত। আমি এখনোও বিশ্বাস করি সেটা সত্যি- এক শাসনামলে একজনই শাসন করতে পারে। যাইহোক, তুমি এবং তোমার ভাইয়েরা যখন বড় হলে, আমি আশা করলোম তোমাদের মাঝে আমার গুণাবলী গুলি বিকশিত হবে এবং প্রশ্নাতীত ভাবে তোমরা আমার নির্দেশনা মেনে চলবে। কিন্তু তোমাদের মাঝে আমি আমার আশার প্রতিফলন দেখতে পেলাম না। তবে একথা সত্যি যে, যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে আমিও হয়তো তাঁর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করতাম অথবা স্বাধীন ক্ষমতা দাবি করতাম।

 সেলিম দেখলো আকবরের মুখ ব্যথায় কুঁচকে উঠলো, সেটা পেটের ব্যথার জন্য হতে পারে অথবা তার আচরণের স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ার কারণেও হতে পারে। সে বলে উঠলো, আমি আমার সন্তানদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিবেচনা করার চেষ্টা করবো, কিন্তু ইতোমধ্যেই আমি উপলব্ধি করা শুরু করেছি সেটা অত্যন্ত কঠিন কাজ।

তোমাদের মধ্যে কে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী হতে পারে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে আমি একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি যা কারো জন্যেই মঙ্গল বয়ে আনেনি। কিন্তু আমি যদি এমনটা নাও করতাম, সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে এই বাস্তবতাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতো যে পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক কখনোই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। একজন পিতা তার পুত্রকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করে। কিন্তু পুত্র তার পিতার প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখে। পিতা যে দায়িত্ব সন্তানের উপর অর্পণ করে তাতে সে অসন্তুষ্ট হয় এবং স্বাধীন ভাবে সবকিছু করার চেষ্টা করে। সে মনে করতে থাকে তার সকল ব্যর্থতা, ত্রুটি এবং নৈরাশ্যের জন্য তার পিতাই দায়ী এবং তার সকল সাফল্য এবং সৎগুণাবলীর জনক সে নিজে। সে এটাও বিশ্বাস করতে থাকে যে সুযোগ পেলে সে তার পিতার তুলনায় অধিক সফল হতো।

 আমি তোমার বক্তব্য এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছি, সেলিম স্বীকার করলো, বর্তমানে আমার সন্তানরাও বড় হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি তোমার বিরল এবং মহান কৃতিতু গুলির জন্য তোমার প্রতি শ্রদ্ধাও অনুভব করেছি। সেই সব বৈশিষ্ট্যের জন্য নিজেকে তোমার তুলনায় তুচ্ছও মনে হয়েছে। যে কষ্ট আমি তোমাকে দিয়েছি তার জন্য আমি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত।

এবং আমি তোমাকে যে কষ্ট প্রদান করেছি সেজন্য আমিও দুঃখিত। কিন্তু আমি তোমাকে বর্তমানে একটিই অনুরোধ করবো। অতীত থেকে শিক্ষা নাও কিন্তু তাকাও ভবিষ্যতের দিকে। কথা বলতে বলতে আকবর তার শীর্ণ হাতটি সেলিমের দিকে বাড়িয়ে দিলেন এবং সেলিম তা নিজের হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। শৈশবের পর এই প্রথম তার মনে হলো সে তার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করছে, সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে।

*

স্থান আগ্রা দুর্গের দরবার কক্ষ। ধীর লয়ে বেজে চলা নাকাড়ার(একপ্রকার ঢাক) শব্দের সঙ্গে সেলিম মার্বেল পাথরের মঞ্চের ধাপ পেরিয়ে তার জন্য অপেক্ষারত সিংহাসনটির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার আঙ্গুলে তৈমুরের ব্যাঘ প্রতীক বিশিষ্ট আংটিটি শোভা পাচ্ছে। নয় দিন আগে সেটি তার মৃত পিতার আঙ্গুল থেকে কোমল ভাবে খুলে নিয়ে সে নিজের আঙ্গুলে পড়েছিলো। ঈগলের হাতল বিশিষ্ট আলমগীর তার কোমরের পাশে ঝুলছে। গলায় তিন স্তর বিশিষ্ট অকর্তিত পান্না এবং মুক্তা শোভিত মালা যেটি একসময় তার প্রপিতামহ বাবরের ছিলো। একটি বীরত্বপূর্ণ অতীতের ধারাবাহিকতার অনুভূতি সেলিমের হৃদয়কে গর্বে ভরে তুলেছে। সেলিমের মনে হচ্ছিলো তার সভাসদ এবং সেনাপতিদের মধ্যে তার পূর্ব পুরুষেরাও উপস্থিত রয়েছেন এবং তারা তার সিংহাসনে আরোহণ প্রত্যক্ষ করছেন, যেই মসনদের জন্য তারা বহু লড়াই করেছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং তাকে ভবিষ্যতে আরো নতুন বিজয় অর্জনের জন্য অনুরোধ করছেন।

সেলিম সিংহাসনের সোনারুপার কারুকাজখচিত সবুজ গদিতে আসন গ্রহণ করলো এবং সেটার রত্নখচিত সোনার হতলের উপর তার বাহু দুটি স্থাপন করলো। আমার শ্রদ্ধেয় পিতার মৃত্যুর কারণে আমি নয় দিন শোক পালন করেছি, তার দেহটি এখন তার প্রিয় সিকান্দ্রার বাগানে শায়িত আছে। সেখানে আমি তার মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবো। মসজিদ গুলিতে গত শুক্রবারে আমার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে এবং এখন সময় হয়েছে আপনাদের নতুন সম্রাট হিসেবে নিজেকে আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করার।

 সেলিম থামলো এবং তার সম্মুখে একাধিক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের উপর নজর বুলালো, নিজ পিতাকে বহুবার সে এমনটা করতে দেখেছে। তার বর্তমান আসনটি থেকে সমগ্র পৃথিবীটাকে অন্য রকম মনে হচ্ছে। যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে কেবল তাদের ভাগ্যই নয় বরং সমগ্র সাম্রাজ্যের শত কোটি মানুষের ভাগ্য এখন তার অধীনস্থ। এটা একটি সীমাহীন, প্রায় ঈশ্বরপ্রতীম দায়িত্ব এবং উৎসাহব্যঞ্জকও। সেলিম তার মেরুদণ্ডটি আরো সোজা করে বসলো। তখন তার সঙ্গে সুলায়মান বেগের চোখাচোখি হলো, সে লম্বা চওড়া দেহের অধিকারী আব্দুল রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার দুধভাই এর মুখে ফুটে থাকা মৃদু হাসি দেখে সে বুঝতে পারলো সেও তার বর্তমান অনুভূতি কিছুটা আঁচ করতে পারছে।

সেলিম তার পুত্রদের দিকে তাকালো, তারা মঞ্চের ঠিক নিচে তার ডান পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে। আঠারো বছর বয়সী খোসরুকে তার বেগুনি রেশমের জোব্বা এবং হীরক ঝলসানো পাগড়িতে চমৎকার দেখাচ্ছে। খোসরুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তেরো বছর বয়সী খুররম, তার শীর্ণ মুখটিতে শোকের ছায়া ফুটে আছে, আকবরের মৃত্যু তাকে যতোটা গভীর ভাবে শোকার্ত করেছে সম্ভবত পরিবারের আর কাউকে ততোটা করেনি। ষোল বছর বয়সী পারভেজ তাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তিনজনই সুস্থ্য সবল সুন্দর তরুণ, কিন্তু খোসরুর উপরই সেলিমের দৃষ্টি বেশিক্ষণ নিবদ্ধ রইলো। তার অস্থির উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য তাকে ক্ষমা করতে হবে এবং তার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় বের করতে হবে। তার সঙ্গে আন্তরিক হওয়ার কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই রয়েছে এবং খোসরুর মাঝে সৃষ্টি হওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা জনিত হতাশা, ঈর্ষা এবং অনিশ্চয়তার ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করতে হবে যা আকবরের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্ষত্রিস্ত করেছিলো।

 সেলিম তার মনকে টেনে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো, তারপর আবার তার বক্তব্য শুরু করলো। আমি একটি নতুন নাম নির্বাচন করেছি যে নামে আমি আপনাদের সম্রাট হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই। সেটা হলো জাহাঙ্গীর, এর অর্থ পৃথিবীর অধীশ্বর। আমি এই নাম গ্রহণ করলোম কারণ সম্রাটদের দায়িত্ব তাদের নিয়তিকে জয় করা এবং জগৎকে পরিচালনা করা। আমার পিতা আমাকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য দিয়ে গেছেন। আপনারা, আমার বিশ্বস্ত প্রজাগণ, আপনাদের সহায়তায় আমি এই সাম্রাজ্যকে আরো অধিক শক্তিশালী করতে চাই।

সেলিম সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এবং তার বাহু দুটি দুদিকে প্রসারিত করলো, যেনো দরবার কক্ষে উপস্থিত সকলকে সে আলিঙ্গন করছে। সেই মুহূর্তে সমগ্ৰ কক্ষ জুড়ে একটি বাক্য ধ্বনিত হতে থাকল জাহাঙ্গীর দীর্ঘজীবি হোক! সেই ধ্বনি সেলিমের কানে বড়ই মধুর মনে হলো।

*

তোমরা এখন যেতে পারো, জাহাঙ্গীর তার কোষাধ্যক্ষ এবং পরিচারকদের আদেশ দিলো যারা তার সঙ্গে দীর্ঘ সিঁড়ি পথ বেয়ে লোহামোড়ান কাঠের দরজা বিশিষ্ট কোষাগার পর্যন্ত এসেছে। কোষাগারটি আগ্রাদুর্গের কোনো একটি আস্তাবলের নিচের গোপন জায়গায় অবস্থিত।

আপনি যখন আদেশ করেছেন আমরা নিশ্চয়ই চলে যাবো জাহাপনা। কিন্তু আলো জ্বালা না হলে কোষাগারের এই নিচ্ছিদ্র কক্ষটি সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে এবং এর মেঝে অত্যন্ত পিচ্ছিল।

 তোমার চাবিটি আমাকে দাও এবং আমাকে একটি মশালও দিয়ে যাও। আমি একাই ভিতরে ঢুকতে চাই।

কোষাধ্যক্ষ চামড়ার ফালিতে বাধা একটি জটিল নকশার লোহার চাবি জাহাঙ্গীরের কাছে হস্তান্তর করলো এবং একজন পরিচারক তার হাতে একটি জ্বলন্ত মশাল দিলো। সকলের অপসৃয়মান পদশব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর অপেক্ষা করলো এবং সেঁতসেঁতে, মাটির গন্ধ যুক্ত পাতাল সুরঙ্গে একা হয়ে পড়লো। সে এখনো নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা যে বর্তমানে সে সীমাহীন ধনদৌলতের মালিক। রাজকীয় রত্নের যে তালিকা কোষাধ্যক্ষ তার জন্য প্রস্তুত করেছে তাতে প্রায় একশ আটান্ন কেজি ওজনের হীরা, মুক্তা, চুনি(ঘন লাল বর্ণের রত্ন) এবং পান্নার উল্লেখ রয়েছে। ছয় লক্ষ পঁচিশ হাজার রতির বেশি মহামূল্যবান রত্ন রয়েছে জাহাপনা, কোষাধ্যক্ষ তার দক্ষ আঙ্গুলের সাহায্যে সেলিমকে তালিকাটির একটি জায়গা নির্দেশ করে দেখানোর সময় বলেছিলো। এবং স্বল্পমূল্য রত্নে সংখ্যা এতো বেশি যে তা গণনা করা সম্ভব নয়, তাছাড়া সোনা এবং রুপার মোহর তো রয়েছেই।

 যদিও বিষয়টি কিছুটা ছেলেমানুষী পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু জাহাঙ্গীর তার যে কোনো একটি কোষাগার পরিদর্শন করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলো। সে সযত্নে তেল দেয়া মজবুত তালাটির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরালো, তারপর ধাক্কা দিয়ে ভারী দরজাটি খুলে মশালটি উঁচু করে ধরে ভেতরে উঁকি মারলো। কক্ষটি ভীষণ অন্ধকার ছিলো, কিন্তু জাহাঙ্গীর সেখানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মশালের আলোতে কিছু একটা ঝলসে উঠলো। সে মশালটি আরো উঁচু করে ধরলো এবং দেখতে পেলো দরজার বাম পাশের দেয়ালের সারিবদ্ধ কোটরে তেলের প্রদীপ রাখা আছে। সে মশালের আগুনের সাহায্যে প্রদীপগুলি প্রজ্জ্বলিত করে একটি মোমদানের ভিতর মশালটি গুঁজে দিলো। তারপর চারদিকে তাকালো। জাহাঙ্গীর যা অনুমান করেছিলো তার তুলনায় কক্ষটি বেশ বড় লম্বায় প্রায় ত্রিশ ফুট এবং সেটার ছাদ কক্ষটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সুদর্শন দুটি বালুপাথরের থামের উপর ভর দিয়ে আছে।

তবে যে জিনিস গুলি জাহাঙ্গীরে দৃষ্টি কাড়লো সেগুলি হলো চারটি বিশাল আকারের গম্বুজাকৃতির ঢাকনা বিশিষ্ট বাক্স। সেগুলি কক্ষের শেষ প্রান্তের দেয়ালের কাছে কাঠের কাঠামোর উপর স্থাপিত রয়েছে। ধীরে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে সে একটি বাক্সের ঢাকনা উন্মুক্ত করলো। সেটার ভিতর প্রায় হাসের ডিমের সমান আকারের রক্তলাল চুনি দেখতে পেল। সেগুলির এক মুঠো হাতে নিয়ে তার দিকে তাকালো। কতোই না চককার এই রত্নের রাণী নামে খ্যাত রত্ন গুলি। এক মুহূর্তের জন্য মেহেরুন্নেসার মুখটি তার মনে পড়লো যখন তার নেকাবটি ছুটে গিয়েছিলো। এই চুনি গুলি তাকে ভীষণ মানাবে এবং এখন যখন সে সম্রাট, সে তার পছন্দের যে কাউকে রত্ন উপহার দিতে পারে…যে কাউকে তার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করতে পারে…রত্নগুলি রেখে দিয়ে ঢাকনা আটকে সে আবার অগ্রসর হলো। পরের বাক্সটি বিভিন্ন আকারের গাঢ় সবুজ বর্ণের পান্নায় পরিপূর্ণ। সেগুলির কোনোটি কাটা হয়েছে কোনোটা অকর্তিত রয়েছে। পরের বাক্সটিতে রয়েছে নীলা এবং হীরা। পৃথিবীতে একমাত্র দাক্ষিণাত্যের গোলকোন্দার খনি গুলিতেই এই রত্ন পাওয়া যায়। চতুর্থ বক্সটি মুক্তায় ভরা। জাহাঙ্গীর মুক্তাগুলির মাঝে তার কনুই পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিলো এবং তার ত্বকে সেগুলির প্রলুব্ধকর শীতলতা অনুভব করলো।

 জাহাঙ্গীর এই বাক্সগুলির ডান দিকে একাধিক খোলা বস্তার মধ্যে প্রবাল, টোপাজ, টোরকুইজ, অ্যামিথিস্ট এবং অন্যান্য স্বল্পমূল্যের পাথর অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলো। শুধুমাত্র এগুলি দিয়েই একটি সেনাবাহিনীর এক বছরের অর্থসংস্থান করা সম্ভব…হঠাৎ সে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। এই কোষাগারে যা রয়েছে তা তার মোট সম্পদের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র- দিল্লী বা লাহোরের কোষাগারের তুলনায় এটুকু কিছুই নয়, কোষাধ্যক্ষ তাকে জানিয়েছে। হাসতে হাসতেই জাহাঙ্গীর মেঝে থেকে একটি বস্তা তুলে নিয়ে তার উপাদান মেঝেতে উপুর করে ঢেলে দিলো, তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি, বিভিন্ন রঙের পাথর গুলি নির্বিচারে খিচুড়ি পাকিয়ে ফেললো। সেগুলি বিশাল একটি স্কুপে পরিণত হওয়ার পর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং একপাশ থেকে অন্য পাশে গড়াতে লাগলো। সে এখন মহামান্য সম্রাট। একজন হিন্দু ঋষি লিখে গেছেন যে, কারো মনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত বাসনাটি পূরণ হওয়ার মতো হতাশা জনক আর কিছুই নয়। জাহাঙ্গীর অনুভব করছে ঋষিটির মতামত ভুল ছিলো। সে একমুঠো রত্ন ছাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো এবং প্রদীপের আলোতে সেগুলি জোনাকি পোকার মতো তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

 এক ঘন্টা পরের ঘটনা, জাহাঙ্গীর এপ্রিলের উজ্জ্বল সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে চোখ পিট পিট করছে। তার মস্তিষ্কটি এখনো অনেক হালকা বলে অনুভূত হচ্ছে। যেনো সে আকণ্ঠ সুরা পান করেছে কিম্বা অপিয়াম সেবন করেছে। কিন্তু সুলায়মান বেগকে তার দিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে এগিয়ে আসতে দেখে মনের হালকা চপলতাকে সে ঠেলে সরিয়ে দিলো।

 কি ব্যাপার?

বিশ্বাসঘাতকতা, জাঁহাপনা!

কি বলছো তুমি? কার এতো বড় সাহস…?

আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র। আপনি জানেন, তিন দিন আগে যুবরাজ খোসরু আগ্রাদুর্গ ত্যাগ করেছেন?

নিশ্চয়ই জানি। সে আমাকে বলেছে কিছু দিনের জন্য সে সিকান্দ্রায় যেতে চায় এবং সেখানে বাবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ তদারক করতে চায়। স্থপতিদের কি নির্দেশনা প্রদান করতে হবে তাও আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। সিকান্দ্রায় যাওয়া কখনোই তার উদ্দেশ্য ছিলো না। তিনি উত্তরে লাহোরের দিতে অগ্রসর হচ্ছেন। পথে তার সমর্থকরা তার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে এবং তিনি আরো বেশি লোককে ঘুষ দিয়ে দলে টানছেন। তিনি অবশ্যই কয়েক সপ্তাহ আগে সমস্ত পরিকল্পনা করেছেন। আজিজ কোকা তার সঙ্গে আছে। আমি এ সব জানতে পেরেছি কারণ আজিজ কোকা আপনার স্ত্রীর ভাই মান সিংকে তাদের বিদ্রোহে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং আমাকে এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা অবহিত করেন।

জাহাঙ্গীর সুলায়মান বেগের কথাগুলি আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো না। তার মনে তখন দ্রুত বেগে ভাবনা চলছে। চেষ্টা করলে আমরা তাদের পিছনে ফেলে অগ্রসর হতে পারি। আমার একদল দ্রুতগামী অশ্বারোহী যোদ্ধাকে প্রস্তুত করো। আমি নিজে তাঁদের নেতৃত্ব দেবো। আমি বহু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমার প্রাপ্য অধিকার অর্জন করতে পেরেছি। সেই অধিকার আমি কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবো না। যে আমার বিরুদ্ধাচারণ করবে তাকে রক্তের বিনিময়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে, সে যেই হোক না কেনো…

*

ঐতিহাসিক নোট

মহান মোগল সম্রাটদের নিয়ে আলোচনা করতে হলে সাধারণত মানুষ আকবরকে নিয়েই সার্বিক পর্যালোচনা করে। একথা সত্য এবং দৃঢ়তার সাথে বলা যায় তিনি হচ্ছেন প্রথম মোগল সম্রাট যার জন্ম এই হিন্দুস্তানে। তাঁর জীবন খুবই বিচিত্র। দীর্ঘ শাসনামলে এই মহান সম্রাট যেমন ছিলেন সফল তেমনভাবে তিনি তার সাম্রাজ্য এতোটাই প্রসারিত করেছিলেন যে ভারতীয় উপমহাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ করায়ত্ব করে ফেলেন। শুধু তাই নয় এই ভারত বর্ষের লক্ষ লক্ষ প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মের মূলবাণী নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। বাবা হুমায়নের শাসনামলের শেষ ভাগে তার সাম্রাজ্যের কিছু অংশ শাহ্জাদা আকবরের নামে উপহার দেন।

আকবরের সাফল্য এতোটাই বিস্তৃত হয়েছিলো যে তার পরবর্তী বংশধর ও প্রজন্ম তার ভূলত্রুটিগুলো গোপন রেখে বরং তার কীর্তিগাথা কাহিনী শুধু হিন্দুস্তানেই নয় সারা ভারতবর্ষে প্রচার করেছে। আকবরের কাজের ধারাবাহিকতা ছিলো নিখুঁত এবং অনন্য। তাঁর গুণ, মহত্ব ও কাজ সম্পর্কে বিস্ত রিত জানা যায় আবুল ফজলের আকবর নামা এবং আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ থেকে। এই দুটি গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে–যা প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত। এই দুটি গ্রন্থে আকবরের শাসনামলের পূর্ণ ও বিস্তারিত বর্ণনা সুন্দর ও নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আকবরের শাসনামলের ঐতিহ্য, ক্ষমতা এবং সাংস্কৃতিক মিলনের যে সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে তাই তুলে ধরা হয়েছে আবুল ফজলের আকবর নামা গ্রন্থে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এবং নিজের বাস্তব উপলব্ধি থেকে আবুল ফজল তার গ্রন্থে শুধু এটাই বর্ণনা করেন নি-যে কীভাবে সম্রাট আকবর তার শত্রুকে পরাস্থ করেছেন, তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। সেই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন-মান কতোটা উন্নত করেছেন সেই ব্যাপারেও বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। নিত্যপণ্যের দাম সর্বদা সাধারণ মানুষের সহনশীল পর্যায়ে রাখতেন। দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য তার বিশাল রাজপ্রাসাদে প্রতিনিয়ত খাবারের আয়োজন করা হতো। রান্না-বান্না হতো সারা দিন-রাত, হারাম-হালাল খাবারের জন্য অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। ১৬০২ সালে আবুল ফজল খুন হলে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন আসাদ বেগ। ঐ ব্যক্তিই আবুল ফজলকে সার্বিক সহায়তা করতেন, তিনি আকবরের জীবনের শেষ পরিণতির সময়ে গ্রন্থের পান্ডুলিপি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।

ভিকায়া গ্রন্থে আকবরের জীবনের শেষ দিককার সব কাহিনী তুলে ধরেন তিনি। আকবরের তীব্র সমালোচক বাদাউনী, মুনতাখাব আল-তারিখ-গ্রন্থে আকবরের জীবনের শেষ অংশে কি করুণ পরিণতি হয়েছিলো সেই অগণিত কথা বর্ণনা করেছেন।

আকবরের শাসনামলে ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটতে থাকে। ব্যবসায়ী, ধর্ম প্রচারক এবং নিজের ভাগ্য উন্নতির জন্য বহু শ্রমিক ও পেশাজীবী মানুষ এই মোগল সাম্রাজ্যের দিকে ছুটতে থাকে। মহা মিলনমেলা রচিত হয়। ধর্ম প্রচারক ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরাট অন্যতম প্রধান ধর্ম প্রচারক–যিনি আকবরের শাসনামলে প্রথম ভারত বর্ষ ভ্রমণ করেন। তিনি কমিউনিটি অন হিজ জার্নি টু দা কোর্ট অব আকবর প্রবন্ধে তার ধর্ম সম্পর্কে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিলো তা মানুষকে অবহিত করেন। আকবরের ইবাদত খানায় সব ধর্মের মানুষ মুক্ত আলোচনা করতো। রালফ ফিটস নামের একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী যিনি ১৮৫৪ খ্রি. প্রথম হিন্দুস্তানে এসে আগ্রা এবং ফতেহপুর শিক্রির বিস্ময়কর সৃষ্টি দেখে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেন।

আকবরের জীবন কাহিনী এবং তার কীর্তি বর্ণনা করা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সেজন্য আমি (লেখক) যেসব স্থানে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলাম-বাস্তবিক অর্থে দুইবার পরিদর্শন করতে হয়েছে। সে সব স্থান আকবরের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আগ্রাতে আমি আকবরের সুন্দর বাগানে বসেছিলাম, শেষ বিকালের সূর্য অস্তমিত হচ্ছে, সেই সময় বাগানের রূপ আরো মোহময় হয়ে ফুটে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে হুমায়ুনের সমাধিস্থলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই সমাধিস্থল সুন্দরভাবে তৈরি করেছিলেন আকবর। বাবার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন। কীর্তিগাথা এই সমাধিস্থল একেবারে দেখতে যেনো তাজমহলের মতো। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত এই সমাধিস্থলও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আগ্রাতে যখন ছিলাম প্রচণ্ড তাপমাত্রায় হাঁটাচলা করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিলো, আর এজন্যই মনে হয় এই অঞ্চলের মানুষ উটের পিঠে করে চলাচল করে। উট হচ্ছে তাদের প্রধান যানবাহন, এই কাজটি আকবর কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে। মূলত যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় পানি এবং খাদ্য সরবরাহ হতো এই উটের গাড়িতেই। উপরন্ত এই উটের বিশাল বহর দেখেই শক্তি ও ক্ষমতার প্রকাশ ফুটে উঠতো। ঝরোকা বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে একটা কথাই ভাবছিলাম–আকবর প্রতিটি বিষয় কীভাবে যাচাই বাছাই করে মূল্যায়ন করতেন। তিনি নিখুঁতভাবে নিজেকে প্রদর্শিত করতেন আর এই রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর কূলে বসতেন তিনি।

আকবরের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং আত্মবিশ্বাস যা এই ফতেহপুর শিক্রির সুন্দর বাগান অবারিত সুখের সৃষ্টি করেছে। অথচ তিনিই এই বালুময় শহর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। রাজ প্রাসাদের চারপাশে সুরম্য অট্টালিকা, মনোরম স্থান এবং আনন্দ উপভোগের জন্য হেরেমখানা তৈরি করেছেন। তবে এতো প্রাচীন এই রাজপ্রাসাদে কোনো অশরীরী আত্মা বা ভূত প্রেত নেই, হেরেমখানা এবং রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে নীল টালি দ্বারা আবৃত, ছাদ তৈরি হয়েছে ধূসর রঙ দিয়ে। আকবরের সময় নারীরা জানালার পাশে বসে থেকে তাদের দিনাতিপাত করতো। হেরেমখানার নারীদের কথা ভিন্ন।

আকরব নিজের তৈরি সুইমিং পুল অনূপতালাও এ বসে প্রকৃতির প্রেম-ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করতেন। প্রচন্ড গরম, শুস্ক আবহাওয়া এবং মরু অঞ্চল তবুও এই সুইমিং পুলে বসে শরীর মন সতেজ করতেন আকবর। পুলের পাশেই শেখ সেলিম চিশতির মসজিদ এবং সেখানে মানুষ নামাজ আদায় করতে যায়। মসজিদটি সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি।

রাজস্থানে অম্বর এবং জোদপুরের বিধ্বস্ত রাজপ্রাসাদ-তাদের বর্ণানুযায়ী আকবরের ইচ্ছা ছিলো ঐ গোষ্ঠীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার, রাজপুত গোষ্ঠীকে তার মিত্রবাহিনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চত্তিরগড়ের রাজপুত উপলব্ধি করলেন আকবর তাদের সাম্রাজ্যে আঘাত হানতে যাচ্ছে তখন তারা সতর্ক হলেন। আকবরের রাজ প্রাসাদে পূর্ব দিক থেকে উপরে উঠছিলাম-সম্রাট আকবর নিজেও তার সৈন্য বাহিনীকে পূর্ব দিক থেকে উপরে উঠতে বলতেন। এর কারণ শত্রুপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করা সম্ভব। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পাথরের চিহ্ন দিয়ে একটি স্থান সংকুলান করে রাখা আছে, যা দিয়া বুঝানো হতো যে মোগলদের পরাজয় হতে পারে না। একই সাথে রাজপুত নারীরা নিজেদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো, তারা যুদ্ধের সময় মশাল জ্বালিয়ে রাখতো, মোগলদের কর্তৃক পতন বা নির্যাতিত হওয়ার থেকে এই মশালের আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া উত্তম মনে করতো তারা। একথা স্মরণযোগ্য যে, তার আমলে সমসময় অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল, নম্র আচরণ করা হতো। একই সময়ে এই মোগল সম্রাট তার শাসনামলে যতো সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছেন–তা ইতিহাসে বিরল। তিনি প্রতিপক্ষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেন।

মোগল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন নিয়ে যতো বই, দলিল-পত্র উপস্থাপিত হয়েছে তাতে রয়েছে সামরিক শাসন, তাদের ঔদ্ধত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শাসন ক্ষমতা দখল। এ সবকিছুই রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড বইতে তুলে ধরা হয়েছে। আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ খুবই নাটকীয়। শ্বেত পাথরে নির্মিত রাজ প্রাসাদের বেলকনিতে সম্রাট হুমায়ুন প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গিয়াছিলেন। তারপর তিনি যখন প্রাসাদের নিচে নামতে যান তখন সিঁড়িতে তার সুন্দর জুতায় ধাক্কা লাগে এবং পায়ে আঘাত পেয়ে একেবারে নিচে পড়ে যান। তার শরীর রক্তাক্ত হয়। বহু হাকিম বৈদ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। কিন্তু এই পর্যায়ে কোনো কাজ হয়নি। তিনি পরলোক গমন করেন। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর ফলে তার স্ত্রী হামিদা খান চিন্তিত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশংকা করেন। কারণ সে সময় আকবরের বয়স ১৩ বছর। এ সময় বৈরাম খান পরামর্শ দেন হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর কাউকে জানানো যাবে না। এজন্য তারা পাথরের বেলকোনিতে এমন একজনকে দাঁড় করিয়ে রাখতো যা দূর থেকে হুমায়ুনের মতোই মনে হতো, কেউই বুঝতে পারত না যে হুমায়ুন মারা গেছে।

আকবরের দুগ্ধ ভ্রাতা আদম খান তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তারই হেরেমখানায়। আকবর তার প্রতিপক্ষ হিমু এবং তার বাহিনীকে রাজস্থান, গুজরাট, বাংলা, কাশ্মির, সিন্ধু এবং দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধে পরাজিত করে। ম্রাট আকবর বহু বিবাহ করেন এবং তার শতাধিক রক্ষিতা ছিলো। তার অনেক স্ত্রীর নামই কেউ কখনো জানতে পারেনি। জানা সম্ভবও ছিলো না। আকবরের জীবন এতোটাই সমৃদ্ধ ছিলো যে-তার পঞ্চাশ বছরের শাসনামলে যতো ঘটনা ঘটেছে তা এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আর ঐতিহাসিকদের কাছে থেকেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে এমনটা বলা যাবে না। এমন অনেক ঘটনা আছে যা বর্ণিত হয়নি।

এই বইয়ের প্রতিটি স্তরে আমি (লেখক) চেষ্টা করছি যে আকবর প্রকৃত অর্থে কেমন ছিলেন তা বর্ণনা করতে। বাস্তব তথ্য তুলে ধরার জন্যই এই বইটি লিখেছি। এই বই লেখার সময় বহু মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো, তারা আমাকে ঠিকমতো তথ্য দিচ্ছিলো না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এমন একজনকে পেলাম যিনি আমাকে তথ্য-উপাত্তের জন্য সার্বিক সহায়তা করেছেন। এই বইয়ের প্রতিটি চরিত্র বাস্তব সত্য বটে–তারা হচ্ছে আকবরের মা হামিদা, ফুফু গুলবদন, তার দুধভাই আদম খান, দুধমাতা মাহাম আঙ্গা, তার নিকট আত্মীয় বৈরাম খান উপদেষ্টা, হিমু, শাহ দাউদ, রানা উদয় সিং, ছেলে সেলিম, মুরাদ, দানিয়েল এবং স্বর্গীয় সূফি শেখ সেলিম চিশতি–যাঁরা তাদের জন্মের জন্য গর্বিত এবং তারা তাদের দাদাজান, পারস্যের গিয়াস বেগ- তাদের পরিবারের কাছে ঋণী। এছাড়াও জেসুইট পুরোহিত ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট, ফাদার ফ্রান্সিসকো হেনরিকস, উচ্চ পদস্থ ওলামা শেখ মোবারক, শেখ আহমেদ-তাদের প্রত্যেকের চরিত্র বইটিকে সমৃদ্ধি করছে।

.

আনুষাঙ্গিক

অধ্যায়-১ আকবর ছিলেন অশিক্ষিত–সেটাই সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। লেখাপড়া করতে বিশেষ করে অক্ষর বানান করতে সমস্যা ছিলো বলেই পড়ালেখা আর হয়নি তার। হুমায়নের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সনের জানুয়ারিতে। আকবরের জন্ম ১৯৪২ সনের ১৫ অক্টোবরে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন ১৫৫৬ সনে। তৈমুর, বর্বর তুর্কীদের সভ্যতার পথে নিয়ে আসেন। পাশ্চাত্য জগতে তাম্বুর লাইন নামেই তিনি পরিচিত লাভ করেন। ক্রিস্টোফার মারলোওয়েস স্কোর্জ অত্ গড গ্রন্থে তৈমুর দি লেম নামে একটা পর্ব লেখেন। আকবরই প্রথম মুসলিম বর্ষপঞ্জিকা প্রচলন করেন। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জিকায় যেহেতু মুসলিম দিন-ক্ষণ-তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এটাকে রূপান্তরিত করে খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জিকার সাথে মিল রাখতে হয়েছে।

অধ্যায়-২ পানিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সনের নভেম্বরে।

অধ্যায়-৩ বৈরাম খানের পতন হয় ১৫৬০ সনে।

অধ্যায় ১৫৬১ সনে বৈরাম খান খুন হোন।

অধ্যায়-৫ আতগা খানকে হত্যা করে আদম খান এবং তিনি ১৫৬২ সনে আকবরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মাহাম আঙ্গা এর কিছুদিন পরে শারীরিক দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আকবর অর্থ সংগ্রহ করে তাদের জন্য স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। এই স্মৃতিসৌধ দক্ষিণ দিল্লীর কুতুব মিনারের পাশে মেরাওলিতে অবস্থিত।

অধ্যায়-৭ চত্তিরগড় আন্দোলন সংঘটিত হয় ১৫৬৭-৬৮ সনে।

অধ্যায়-৮ আকবর অম্বরের জয়পুরের শাসক রাজপুতের কন্যাকে বিয়ে করেন। তিনি অবশ্য আকবরের প্রথম স্ত্রী ছিলেন না। তার নাম কখনোও জানা যায়নি, এমনকি তার সাথে আকবরের মূলত কি ধরনের সম্পর্ক ছিলো তাও পরিস্কারভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি শাহজাদা সেলিমের মা ছিলেন।

অধ্যায়-৯ ১৫৬৮ সনে শেখ সেলিম চিশৃতির মাজারে ভ্রমণ করেন আকবর। আর তার ছেলে সেলিমের জন্ম হয় ১৫৬৯ সনের ৩০ আগস্ট। সূফি শব্দের অর্থ–যারা ঐশ্বরিক দর্শন ও মতবাদে বিশ্বাসী।

অধ্যায়-১০ ১৫৫১ সনের জানুয়ারিতে আবুল ফজল জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৭৪ সন থেকে আকবরের সেবায় নিয়োজিত হন। আকবর তাকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসাবে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি অফিসিয়াল ভাবে প্রথমে ‘দশ সংখ্যা ব্যবহার করেন। নির্দিষ্ট সৈন্য সংখ্যার ক্ষেত্রে শূন্যকে ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়েছে। এই শূন্য আবিষ্কারক ভারতীয় গণিতবিদ। এই সম্পর্কে পরবর্তীতে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের জ্ঞানী সমাজ জানতে পারে। আকবর পৃথিবীর মানুষকে জানালো কীভাবে ইটের দালান নির্মাণ করতে হয়।

অধ্যায়-১১ গুজরাট সম্পর্কিত প্রচার প্রচারণা শুরু হয় ১৫৭২ সনে।

অধ্যায়-১২ পাটনা সম্পর্কে প্রচার এবং বাংলা দখল হয় ১৫৭৪ সনে। ১৫৭৬ সনে শাহ। দাউদ মৃত্যুবরণ করেন।

অধ্যায়-১৩ ১৫৭০ সনের জুনে মুরাদ জন্মগ্রহণ করেন এবং তার দুই বছর পর ১৫৭২ সনের সেপ্টেম্বরে দানিয়েল জন্মগ্রহণ করেন। শিয়া এবং সুন্নীর লড়াই শুরু হয়। এটা ছিলো ইসলামের প্রথম শতাব্দীর ঘটনা। এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বের কারণ উভয়েই দাবি করে তারাই মোহাম্মদ (সা:)-এর প্রকৃত উত্তরসূরি এবং তাঁর উত্তরসূরিরাই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে। শিয়াদের দাবি মহানবীর উত্তরসূরি হিসাবে তারাই একমাত্র যোগ্য কারণ মোহাম্মদ (সা:) এর চাচাতো ভাই এবং পরবর্তীতে জামাতা আলী (রা:) শিয়াদের যোগ্য নেতা। শিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘দল’ আর এই শব্দটা মূলত এসেছে প্রবাদ বাক্য “আলীর দল” থেকে। “সুন্নী শব্দের অর্থ যারা নিয়ম-রীতি মেনে চলে। এখানে মূলত মোহাম্মদ (সা:) এর নীতি, আদর্শ, আচরণকেই বুঝানো হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনবরত বিরোধ বাধে। বিরোধের মূল কারণ ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে। ১৫৮০ সনে আকবরের রাজপ্রাসাদের উপস্থিত হোন জেসুইট পুরোহিত ফাদার এ্যান্টিনিও মনসেরাট।

অধ্যায়-১৪ ১৫৭৭ সনে গিয়াস বেগের কন্যা মেহেরুন্নেসা জন্মগ্রহণ করেন। এ সময় গিয়াস বেগ ভারত বর্ষে তার যাত্রা শুরু করেন।

অধ্যায়-১৬। ইংরেজ বণিক জন নিউবেরি ভারতে পৌঁছান, তাঁর সাথে ছিলেন রালফ ফিট। তারা আসেন ১৫৮৪ সনে। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, আকবর তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

অধ্যায়-১৮ ফতেহপুর শিক্রি ধ্বংসের পিছনে বহু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে পানি সংকট একটা প্রধান কারন। আরেকটি কারণ যমুনা নদী থেকে বহু দুরে ফতেহপুর শিক্রি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতমানের ছিলো না। আকবর তার রাজধানী লাহোর পর্যন্ত বিস্তৃত ঘটান। ১৫৮৬ সনে কাশ্মির দখল করেন।

অধ্যায়-১৯। সিন্ধু প্রচারণা শুরু হয় ১৫৮৮-৯১।

সেলিম ১৫৮৫ সনে মান বাঈকে বিয়ে করেন।

১৫৮৭ সনের আগষ্ট মাসে খোসরুর জন্ম হয়।

অধ্যায়-২১ ১৫৯২ সনের ৫ জানুয়ারি খুররম লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন।

পারভেজ ভূমিষ্ট হয় ১৫৮৯ সনে। আবুল ফজল তার ‘আকবর নামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন আকবর তার সন্তানদের থেকেও নাতাঁকে বেশি ভালোবাসতেন। আকবর নিজের বাসগৃহে প্রিয়নাতী খুররমকে নিয়ে আসেন এবং তার দেখাশুনার ভার স্ত্রী রুকাইয়ার উপর অর্পণ করেন।

অধ্যায়-২২। ১৫৯৫ সনের মে মাসে কান্দাহারের পতন হয়।

অধ্যায়-২৩ সেলিমের আনারকলি কাহিনী–যা পরবর্তীতে ইংরেজ বণিক উইলিয়াম ফ্রিঞ্চ ১৬০৮ সনে এবং ১৬১১ সনে হিন্দুস্তান ভ্রমণ করে এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তুলে ধরেন। সেলিম যখন ভারতবর্ষের সম্রাট হোন তখন তিনি লাহোরে আনারকলির সমাধিস্থল নির্মাণ করেন আবার তার দ্বারাই এ সমাস্থিল ধ্বংস হয়। আনারকলির রোমান্স এবং বিচ্ছেদপূর্ণ কাহিনীর বাস্তবিক কোনো সত্যতা না থাকলেও ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে প্রেমিক প্রেমিকা হিসাবে আনারকলির প্রেম কাহিনী টিকে থাকবে, আনারকলির প্রেমকাহিনী নিয়ে মোগল সাম্রাজ্য যুগে সে সময়কার সাহিত্যকরা অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। আর এটা আমার একান্ত নিজস্ব ধারণা যে আনারকলি রূপক এবং পরী ছাড়া আর কিছুই না।

অধ্যায়-২৬। মদ, গাঁজা এবং আফিমে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন সেলিম। নেশাগ্রস্থ হওয়ার ফলে সেলিম সব সময় অসুস্থ থাকতো। তার হাত-পা কাঁপতো। এমন পর্যায় চলে গিয়েছিলো যে সে গ্লাসও হাতে ধরে রাখতে পারতো না। চিকিৎসকরা শেষ পর্যন্ত তাকে জানিয়ে দিয়েছিলো যদি নেশা ত্যাগ না করেন তাহলে ছয় মাসের বেশি বাঁচবেন না আর যদি নেশা ত্যাগ করেন তাহলে সুস্থ হতে ছয় মাস লাগবে।

অধ্যায়-২৭ ১৬০০ সনে শাহজাদা সেলিম এলাহাবাদ ত্যাগ করেন। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন–জাহাঙ্গীর নামায় সেলিম লেখেছেন “বন্ধুহীন আমি”। ১৫৯৯ সনের মে মাসে মুরাদের মৃত্যু হয়। ১৬০৩ সনে এপ্রিলে সেলিম আগ্রায় ফিরে আসেন।

অধ্যায়-২৮ ১৬০৪ সনের আগষ্ট মাসে আকবরের মাতা হামিদার মৃত্যু হয় এবং আকবরের কনিষ্টপুত্র দানিয়েলের মৃত্যু হয় ১৬০৫ সনের মার্চ মাসে।

অধ্যায়-২৯ পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মতে সম্রাট আকবর দ্বৈত চরিত্রের পুরুষ ছিলেন। তার মৃত্যু হয় ১৬০৫ সনের ১৫ অক্টোবর। পশ্চিমা বিশ্বের বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে এটা ছিলো তাঁর ৬৩তম জন্মবার্ষিকী। আকস্মিকভাবে বিখ্যাত সমকালিন সাহিত্যিক উইলিয়াম সেক্সপিয়ার-এর জন্ম-মৃত্যু একই তারিখে হয়েছিলো। সেক্সপিয়ারের জন্ম ২৩ এপ্রিল ১৫৬৪ সালে এবং মৃত্যু ২৩ এপ্রিল ১৬১৬ সালে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৫২ বছর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *