আলোর ঝিলিক
বিশাল বিস্তৃত এক কবরস্তান। সবগুলো কবর এখনো তরতাজা। মাটির স্তূপগুলো অগোছালো-বিক্ষিপ্ত। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। কোন কোন কবর একটি অপরটির সঙ্গে লাগোয়া। যুদ্ধক্ষেত্রের কবর এরূপই হয়ে থাকে। হামাত থেকে হাল্ব পর্যন্ত এরূপ তিনটি কবরস্তান গড়ে ওঠেছে। এই সেদিনের সবুজ-শ্যামল অঞ্চলটা এখন নির্জন-নিস্তব্ধ। এখানকার বাতাসে এখন শুধুই রক্তের গন্ধ। পাখিরা কিচির মিচির করছে, শুকুনরা উড়ছে।
এমনি একটি কবরস্তান হাব শহরতলীর এজাজ দুর্গের সন্নিকটে অবস্থিত। কবরগুলোর মাটি এখনো আর্দ্র। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের শ্রদ্ধেয় ইমাম জনাকয়েক সৈন্যসহ সেখানে দাঁড়িয়ে ফাতিহা পাঠ করছেন। দুআ শেষে যখন তিনি মুখমন্ডলে হাত বুলাতে গেলেন, ততোক্ষণে তাঁর দাড়ি অশ্রুতে ভিজে গেছে।
এই ভূখন্ডটি এখন বন্ধ্যা হয়ে যাবে। এখন আর এখানে সবুজ পাতা গজাবে না- ইমাম বললেন- এখানে এক কুরআনের অনুসারীগণ একে অপরের ঘাতক হয়ে গিয়েছিলো। যে মাটিতে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত ঝরে, সে মাটি শুকিয়ে যায়। এখানে আল্লাহু আকবার ধ্বনি আল্লাহু আকবর ধ্বনির মোকাবেলা করেছে। তারা সবাই মুসলমান ছিলো। তারা একজন অপরজনের হাতে নিহত হয়েছে। হাশরের দিন তারা প্রত্যেকে একত্রিত উত্থিত হবে। মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা এক ভাই অপর ভাইয়ের যে পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছে, সেই পরিমাণ রক্ত যদি তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের শত্রুদের ঝরাতে, তাহলে শুধু ফিলিস্তীন নয় স্পেনও পুনরায় তোমাদের হাতে চলে আসতো।
ইতিমধ্যে কতগুলো ঘোড়ার পদশব্দ কানে আসতে শুরু করেছে। ইমামের সঙ্গে দন্ডায়মান এক সেনা বললো- সুলতান আসছেন। ইমাম মোড় ঘুরিয়ে তাকান। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আসছেন। তার সঙ্গে সালার ও রক্ষী বাহিনীর ছয়জন আরোহী। কবরস্তানের নিকটে এসে সুলতান আইউবী ঘোড়া থামান। তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ইমামের কাছে এসে ফাতিহা পাঠ করে ইমামের সঙ্গে মুসাফাহা করেন।
মহামান্য সুলতান!- ইমাম সুলতান আইউবীকে বললেন- এটা তো ঠিক যে, যারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তারাও মুসলমান ছিলো। কিন্তু তাদের কবরে ফাতিহা পাঠ করা হবে, আমি তাদেরকে এর যোগ্য মনে করি না। তাদেরকে শহীদদের সঙ্গে দাফন না করা উচিত ছিলো। আমাদের মুজাহিদগণ সত্যের পক্ষে লড়াই করেছে। কিন্তু আপনি তাদেরকে দুশমনের নিহতদের সঙ্গে দাফন করিয়েছেন।
যারা মিথ্যার পক্ষে লড়াই করেছে, আমি তাদেরকেও শহীদ মনে করি সুলতান আইউবী বললেন- তারা তাদের শাসকদের প্রতারণার শহীদ। আমরা আমাদের সৈন্যদেরকে আল্লাহর বাণী শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছি। আর যারা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো, তাদের রাজাগণ আবেগময় স্লোগান ও মিথ্যা বার্তা শুনিয়ে তাদের অন্তরে মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। তাদের ইমামগণ পুরস্কার-উপঢৌকন নিয়ে সৈন্যদেরকে বিভ্রান্ত করেছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করিয়েছে। আমাদের মুসলমান শত্রুদের যারা পরে বুঝতে পেরেছিলো, তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, এখন তারা আমাদের সঙ্গে আছে। আর এই যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের পর্যন্ত আলো পৌঁছেনি। রাজত্বের নেশায় বুদহওয়া শাসকগণ তাদের চোখের উপর পট্টি বেঁধে দিয়েছিলো।
মুসলমান আমীরগণ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন হয়ে গিয়েছিলেন। তারা খেলাফত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন শাসক হতে চেয়েছিলেন। তাদের একজন হলেন নুরুদ্দীন জঙ্গীর বালক পুত্র আল মালিকুস সালিহ। দ্বিতীয়জন মসুলের আমীর সাইফুদ্দীন গাজী। তৃতীয়জন হাররান দুর্গের কেল্লাদার গোমস্তগীন। শেষোক্তজনতো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই ফেলেছিলেন। এই তিন নেতা প্রত্যেকের সৈন্যদের দ্বারা একটি বাহিনী গঠন করে নিয়েছিলেন এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে এসেছিলেন। খৃস্টানরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলো। তাদের সঙ্গে খৃস্টানদের সুসম্পর্কের সূত্র কেবল এটুকু যে, এই প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা আপসে লড়াই করে করে শেষ হয়ে যাবে কিংবা দুর্বল হয়ে যাবে, যার ফলে মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। রাজত্বের নেশা, খৃস্টানদের দেয়া সম্পদ, সামরিক সাহায্য, মদ আর ইহুদীদের রূপসী মেয়েরা এই আমীরদেরকে এমন অন্ধ করে তুলেছিলো যে, তারা এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে সুলতান, আইউবীর বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, যখন নুরুদ্দীন জঙ্গী দুনিয়া থেকে চলে গেছেন এবং সুলতান আইউবী এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে মিসর থেকে এসেছেন যে, তিনি খৃস্টানদেরকে ইসলামী দুনিয়া থেকে বিতাড়িত করে প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত না করে ফিরবেন না।
দেড় মাস যাবত হামাত থেকে হাল্ব পর্যন্ত এই বিশাল সবুজ ভূ-খণ্ডে মুসলমান মুসলমানের রক্ত ঝরাতে থাকে। শেষে বিজয় সত্যেরই হয়েছে। সুলতান আইউবী জয়লাভ করেছেন। দুশমনরা তাঁর আনুগত্য মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুলতানের চেহারায় খুশির সামান্যতম ঝিলিকও চোখে পড়লো না। জাতির সামরিক শক্তির বৃহৎ অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই হিসেবে এটা খৃস্টানদেরই জয় আর মুসলমানদের পরাজয়। খৃস্টানরা তাদের লক্ষ অর্জনে সফল হয়েছে। সুলতান আইউবী কয়েক বছরের জন্য বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রযাত্রার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
১১৭৬ সালের জুন মাসের সেই দিনটিতে সুলতান আইউবী যখন এজাজ দুর্গের সন্নিকটস্থ বিশাল কবরস্তানে ইমামের সঙ্গে দন্ডায়মান ছিলেন, তখন তার চেহারাটা ছিলো বিমর্ষ। তিনি ইমামকে বললেন- প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর দুআ করবেন, যেনো আল্লাহ সেই লোকগুলোকে ক্ষমা করে দেন, যাদের চোখে পট্টি বেঁধে তাদের ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করানো হয়েছিলো।
সুলতান ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হন এবং বিস্তৃত কবরস্তানটার প্রতি। তাকিয়ে বললেন- আল্লাহকে এতো রক্তের হিসাব কে দেবে? এই পাপ আমার আমলনামায় লেখা না হয় যেনো।
সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন- আমাদের জাতি আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করেছে। কাফেররা রাসূলের উম্মতের শক্তি ও চেতনায় এতো বেশি ভীত যে, এই শক্তিটাকে নানা চিত্তাকর্ষক অস্ত্রের মাধ্যমে দুর্বল করে তুলতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এই একটি ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। তাদের নিজস্ব কোন শক্তি নেই। মুসলমানদের দুর্বলতাই তাদের শক্তি। আমাদের কোন কোন ভাই তাদের এই মাধ্যমটাকে বরণ করে নিয়েছে এবং গৃহযুদ্ধের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
আমরা যদি সেই পথ এখনই এবং এখানেই রুদ্ধ না করো দেই, তাহলে আমি ভবিষ্যৎকে যতদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি, আমি উম্মতে রাসূলকে গৃহযুদ্ধ দ্বারা আত্মহত্যা করতে দেখতে পাচ্ছি। কাফেররা এখনকার ন্যায় অর্থ ও সামরিক সাহায্য দিয়ে দিয়ে উম্মতকে আপসে লড়াতে থাকবে। গুটিকতক মানুষের উপর যখন উন্মত্ততা সওয়ার হয়, তখন তারা জাতিকে ক্রীড়নকে পরিণত করে তাদেরসহ ডুবে মরে। ক্ষমতা ও রাজত্বের মোহে মাতাল এই মানুষগুলো জাতির রক্ত এভাবেই ঝরাতে থাকবে। এই বিস্তৃত কবরস্তানটা দেখো। কবরগুলো গণনা করো। গুণে শেষ করতে পারবে না। আমরা পেছনে যেসব লাশ দাফন করে এসেছি, তাদেরও কোন সংখ্যা নেই। এতে রক্তের হিসাব আমি কার থেকে নেবো? আল্লাহকে আমি কী জবাব দেবো?
গৃহযুদ্ধের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে মাননীয় সুলতান!- এক সালার বললেন- এখন সামনের চিন্তা করুন। বাইতুল মুকাদ্দাস আমাদের ডাকছে। প্রথম কেবলা আমাদের পথপানে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু আমাকে ডাকছে মিসর- সুলতান আইউবী ঘোড়া হাঁকাতে হাঁকাতে বললেন- ওদিক থেকে বড় উদ্বেগজনক খবরাখবর আসছে। ওখানে আমার স্থলাভিষিক্ত আমার ভাই। আমাকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করার জন্য সে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমার থেকে গোপন রাখছে। আলী বিন সুফিয়ান এবং নগর প্রধান গিয়াস বিলবীসও আমাকে বিস্তারিত কিছু জানাচ্ছে না। শুধু এতটুকু সংবাদ প্রেরণ করছে যে, দুশমনের গোপন নাশকতামূলক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে, আমরা যা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। পরশু দিনের দূত আমাকে জানিয়েছে, কায়রোতে নাশকতা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যে শেখ সান্নানকে আসিয়াত দুর্গ থেকে উৎখাত করেছি, তার কোন ঘাতক চক্র কায়রোতে নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। দুজন কমান্ডার এমনভাবে খুন হয়েছে যে, তাদের শরীরে জখম বা আঘাতের কোন চিহ্ন ছিলো না। মৃত্যুর পর লাশের সুরতহাল থেকে এ প্রমাণও পাওয়া যায়নি যে, তাদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। এটা হাশিশিদের খুনের একটা বিশেষ পদ্ধতি।
তা আপনি বাহিনীকে কি এখানেই রেখে যাবেন নাকি সঙ্গে নিয়ে যাবেন? এক সালার জিজ্ঞাসা করেন।
এ বিষয়ে আমি এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেইনি- সুলতান আইউবী বললেন- কিছু সৈন্য নিয়ে যেতে পারি। ফৌজের প্রয়োজন এখানে বেশি। খৃস্টানরা মিসরে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড-তৎপরতা এই জন্য জোরদার করেছে, যেনো আমি ফিলিস্তীন অভিমুখে অগ্রযাত্রা করার পরিবর্তে মিসর চলে যাই। তাদের এই আকাঙখা আমি পূর্ণ হতে দেবো না। তবে আমার মিসর যাওয়া জরুরি।
***
সুলতান আইউবীর আশঙ্কা অমূলক ছিলো না। ক্রুসেডারদের চিন্তাধারা ও প্রত্যয়-পরিকল্পনা তার চেয়ে বেশি আর কেউ বোঝে না। যে সময়ে তিনি ফাতিহা পাঠ করে কবরস্তান ত্যাগ করে নিজের সামরিক হেডকোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিলেন, ততোক্ষণে শেখ সান্নান ত্রিপোলি পৌঁছে গেছেন। আপনারা পড়ে এসেছেন, হাসান ইবনে সাব্বাহর পর এই চক্রটির যে গুরু সবচে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তিনি হলেন শেখ সান্নান। লোকটি ফেদায়ীদের প্রধান নেতা ছিলেন। সুলতান আইউবী বনাম খৃস্টানদের বিগ্রহগুলোর সময় ফেদায়ীদের খুনী চক্রটি এই শেখ সান্নানেরই নেতৃত্বে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠেছিলো। তার ঘাতকরা একাধিকবার সুলতান আইউবীর উপর সংহারী আক্রমণ চালিয়েছিলো এবং প্রতিটি আক্রমণেরই পরিণতিতে ঘাতকরাই মারা পড়েছে। যারা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে, তারা ধরা পড়েছে। খৃস্টানরা শেখ সান্নানকে আসিয়াত নামক একটি দুর্গ দিয়ে রেখেছিলো, যেটি ১১৭৬ সালের মে মাসে সুলতান আইউবী অবরোধ করে দখল করে নেন। শেখ সান্নান অস্ত্রত্যাগ করে দুর্গ খালি করে দিলে সুলতান তাকে ক্ষমা করে দেন।
শেখ সান্নান ১১৭৬ সালের জুন মাসের একদিন ত্রিশোলী (লেবানন) গিয়ে পৌঁছেন। সঙ্গে তার ফেদায়ী চক্র ও সেনাবাহিনী। কারো সঙ্গে কোন অস্ত্র ছিলো না। সুলতান আইউবী তাদেরকে নিরস্ত্র করে বিদায় করে দিয়েছিলেন। ত্রিপোলী ও তার আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলটি এক খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডের দখলে ছিলো। শেখ সান্নান তার নিকট গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
দুদিন পর রেমন্ড সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার জন্য এদিক-ওদিক থেকে অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটদের তলব করেন। তারা যথাসময়ে যথাস্থানে এসে উপস্থিত হয়। খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারমানও এসে হাজির হন। সভা শুরু হয়ে যায়।
আপনারা আমাকে এই সূত্রে তিরষ্কার করতে পারেন না, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে পরাজিত হয়ে এসেছি- শেখ সান্নান বললেন আপনারা জানেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর ন্যায় লড়াই করতে জানি না। সুলতান আইউবীর মোকাবেলা তো আপনাদের বাহিনীও করতে পারবে না। সেখানে আমার ফেদায়ীরা কীভাবে পারবে? এখন প্রয়োজন হচ্ছে, আপনারা আইউবীর দুশমন মুসলমান আমীরদেরকে সৈন্য দিন। কিন্তু তারা সকলে মিলেও তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
শেখ সান্নান!- রেমন্ড বললেন- আইউবীর বিরুদ্ধে আমরা কী করবো, সে সিদ্ধান্ত আমাদেরকে নিতে দিন। আপনার এ ব্যাপারে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। আপনি সর্বশেষ যে চারজন লোক প্রেরণ করেছিলেন, তারাও ব্যর্থ হয়েছে। তারা ধরা পড়েছে এবং মারা গেছে। সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর একটি সংহারী আক্রমণও সফল হয়নি। তাতে প্রমাণিত হয়েছে, আপনি শুধু অকেজো-অকর্মণ্য লোকদেরই প্রেরণ করেছেন, যাদের মারা যাওয়া কিংবা ধরা পড়ায় আপনার কিছুই সমস্যা হতো না। আমরা আপনাকে যেসব সুবিধাদি প্রদান করেছি, সব বিফলে গেছে।
কেবল একজন সালাহুদ্দীন আইউবীর খুন না হওয়ায় আপনাদের অর্থ বিনষ্ট হয়নি- শেখ সান্নান বললেন- আমি মিসরে সালাহুদ্দীন আইউবীর যে দুজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে হত্যা করিয়েছি, তাদেরকেও এই অর্থের বিনিয়োগের হিসাবে রাখুন। সুদানে আপনাদের তিনজন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলো, আমি তাদেরকেও কবরে পাঠিয়ে আপনাদের পথ পরিষ্কার করেছি। হালবে আল-মালিকুস সালিহের দুই সহযোগি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো। আপনাদের ইঙ্গিতে আমি তাদেরকেও খুন করিয়েছি। সর্বোপরি বর্তমানে মিসরে গোপন হত্যাকাণ্ডের যে ধারা চলছে, সেটি কে চালু করেছিলো? আপনারা একেও কি ব্যর্থতা বলবেন?
আইউবী কবে খুন হবে?- ফরাসী ক্রুসেডার গাই অফ লুজিনান টেবিলে চাপড় মেরে বললেন- সালাহুদ্দীন আইউবীর হত্যার আলোচনা করুন। আপনি নুরুদ্দীন জঙ্গীকে যে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন, সেই বিষ আইউবীকে কবে গেলাবেন।
সেই দিন, যেদিন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যেমনটি হয়েছিলো নুরুদ্দীন জঙ্গীর সময়- শেখ সান্নান বললেন- জঙ্গী ভূমিকম্প কবলিত লোকদের সাহায্যের জন্য একাকি ছুটে চলছিলেন। না তার নিজের কোন চৈতন্য ছিলো, না তার কোন আমলার। তার জন্য খাবার কে রান্না করছিলো, সেই খবর তাদের কারো ছিলো না। এই সুযোগে আমি আপনার কথামত যাদেরকে তাকে হত্যার করার লক্ষে প্রেরণ করে রেখেছিলাম, তারা তার খাদ্যে এ বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই বিষের ক্রিয়ায় জঙ্গীর গলায় রোগ জন্ম নেয়। তিন-চারদিন পর তিনি মারা যান। জঙ্গীর ডাক্তার আজো বলছে, নুরুদ্দীন জঙ্গী গলার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর খাবার পর্যন্ত পৌঁছা তো সম্ভব নয়।
যে পাঁচক আইউবীর জন্য খাবার রান্না করে, আপনি কি তাকে ক্রয় করতে পারেন না?- এক উর্দ্ধতন কমান্ডার জিজ্ঞাসা করে।
এর উত্তর আমার বন্ধু হারমান ভালো দিতে পারবেন। শেখ সান্নান বললেন এবং হারমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
বিগত কাহিনীতে বহুবার হারমানের উল্লেখ এসেছে। লোকটা জার্মানীর বাসিন্দা। আলী বিন সুফিয়ানের ন্যায় একজন চৌকস গোয়েন্দা। নাশকতা ও চরিত্র বিধ্বংসের ওস্তাদ। মিসরে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যেসব ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিলো, সেসব এই হারমানেরই অপকর্ম। এই হারমানই চক্রান্তের মাধ্যমে সুলতান আইউবীর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন আস্থাভাজন কর্মকর্তাতে তার প্রতিপক্ষ বানিয়েছিলেন। লোকটি মুসলিম শাসক জনগণের মনস্তত্ত্ব ও দুর্বলতাগুলো বেশ ভালো করে বুঝতেন এবং তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশল জানতেন। এক খৃস্টান সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সুদান, মিসর ও আরবের যে কোন অঞ্চলের ভাষা হুবহু আঞ্চলিক ভঙ্গিতে বলতে পারতেন।
শেখ সান্নান সঠিক বলছেন- হারমান বললেন- সালাহুদ্দীন আইউবীর বাবুর্চিকে কেননা ক্রয় করা যাবে না, সে প্রশ্নের জবাব আমাকেই দিতে হবে। আইউবী মৃত্যুকে পরোয়া করেন না। অন্যথায় এতোদিনে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা ব্যাপার ছিলো না। তিনি বিশ্বাসের জোরে বেঁচে আছেন। তাঁর খাদ্য-খাবারের কেউ তত্ত্বাবধান করলো কিনা, তিনি তার কোনই তোয়াক্কা করেন না। নিজের জীবনটাকে তিনি আল্লাহর উপর সোপার্দ করে রেখেছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে, তার মৃত্যু যে দিনটিতে হবে বলে স্থির হয়ে আছে, ঠিক সেদিনই হবে এবং সেদিন কেউ তাকে ধরে রাখতে পারবে না। তার রক্ষী ইউনিটের কমান্ডার, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা এবং একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি রীতিমত তার খাবার খেয়ে পরীক্ষা করে দেখে। মাঝে-মধ্যে ডাক্তারও এসে খাদ্য পরীক্ষা করে। এতোসব কঠোর তত্ত্বাবধানের পরও আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আইউবীর বাবুর্চিসহ সকল কর্মচারি তার শিষ্য। তাদের অন্তরে রয়েছে তার অন্ধ ভক্তি ও অপার শ্রদ্ধা। আইউবী তাদেরকে নিজের চাকর মনে করেন না। তাদের সঙ্গে তিনি বন্ধু ও ভাইয়ের ন্যায় আচরণ করেন। আমি পুরোপুরি একটা পরিসংখ্যান নিয়ে রেখেছি। আইউবীর ব্যক্তিগত পরিমন্ডলের কাউকে ক্রয় করা কিংবা সেই পরিমন্ডলে কাউকে ঢুকানো সম্ভব নয়। তার লোকেরা সর্বক্ষণ তার চার পার্শ্বে মানব প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রাখে। এরা হলো আলী বিন সুফিয়ান, গিয়াস বিলবীস, হাসান ইব্ন আব্দুল্লাহ ও যাহেদান। এরা এতোই সুদক্ষ গোয়েন্দা যে, এদের চোখ মানুষের কলিজা পর্যন্ত দেখে ফেলে।
ইসলামের পতন- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- আমি শতবার বলেছি, আমাদেরকে ইসলামের পতন ঘটাতে হবে। এটি এমন একটি ধর্ম, যে মানুষের আত্মাকে কজা করে নেয়। কেউ ইসলামকে নিজের আদর্শ হিসেবে বরণ করে নিলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে পরাজিত করতে পারে না। সালাহুদ্দীন আইউবীর চার পার্শ্বে মুসলমানদের যে বেষ্টনীটা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ধর্ম-কর্মে তারা এতোই পরিপক্ক যে, সোনা-দানা, হীরা জহুরত ও রূপসী নারী দ্বারা আপনারা এই বেষ্টনী ভেদ করতে পারবেন না। আপনারা যাদের ক্রয় করেছেন, তারা কাঁচা ঈমানের মুসলমান। দেখেছেন, তো, সালাহুদ্দীন আইউবীর কেমন ছোট ছোট বাহিনী আমাদের বিশাল বিশাল শক্তিশালী বাহিনীকে কিরূপ ক্ষতিসাধন করেছে! যেখানে আমাদের ঘোড়া ক্লান্তি ও পিপাসায় নির্জীব হয়ে পড়ে, সেখানে আইউবীর সৈন্যরা বীর বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যায়। যেনো তাদের কোন ক্লান্তি নেই, ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই। এই শক্তিকেই মুসলমানরা ঈমান বলে থাকে। আমাদেরকে তাদের ঈমানটা দুর্বল করতে হবে। তাদের এক দুজন আমীর কিংবা উধ্বর্তন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে হাতে আনা নিঃসন্দেহে একটা সাফল্য হারমান! এ থেকে আপনি অনেক স্বার্থ উদ্ধার করেছেন। কিন্তু এমন একটা পন্থা আবিষ্কার করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে এই জাতিটার অন্তরে আপন ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রবীণ লোকদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করা সহজ হয় না। তাদের বংশধরকে শৈশব এবং কৈশোরেই টার্গেট করে নাও. কাঁচা মস্তিষ্ককে তুমি নিজের ছাঁচে ঢেলে নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারো। তাদের পশুবৃত্তিটাকে উত্তেজিত করে ভোলো।
ইহুদীরা এই কাজটা করে যাচ্ছে- হারমান বললেন- আমি এই ময়দানে যা কিছু করছি, তার ফলাফল ধীরে ধীরে সামনে আসছে! আপনি এক-দুদিনে কারো বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারবেন না। এ কাজে সময়ের প্রয়োজন। একটি যুগ চলে যায়।
এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকা উচিত- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- আমি এই কামনা করবো না যে, ফলাফল আমাদের জীবদ্দশাতেই ফলতে হবে। আমি পূর্ণ আশাবাদি, আমরা যদি চরিত্র ধ্বংসের এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখি, তাহলে এমন একটি সময় আসবে, যখন মুসলমান শুধুই নামের থাকবে। তাদের ধর্ম-কর্ম শুধুই একটি রেওয়াজে পরিণত হবে। চিন্তা চেতনায় তারা হবে আমাদেরই লোক। আমাদের কাজ তারাই আঞ্জাম দেবে। তাদের চিন্তা-চেতনার উপর ক্রুশ জয়লাভ করবে।
শেখ সান্নান!- রেমন্ড বললেন- আপনি যদি আসিয়াত দুর্গের পরিবর্তে আমাদের কাছে আরেকটি দুর্গ প্রার্থনা করেন, তাহলে এই মুহূর্তে আমরা তা দিতে পারবো না। আপনার সঙ্গে আমাদের চুক্তি অটুট থাকবে। দুর্গ ছাড়া অন্য সকল সুযোগ-সুবিধা আপনি পেতে থাকবেন। আপনি যদি এসব সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখতে চান, তাহলে সমগ্র মিসরে বিশেষত কায়রোতে সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা অব্যাহত রাখুন এবং সালাহুদ্দীন আইউবীরও হত্যাচেষ্টা চালু রাখুন।
সালাহুদ্দীন আইউবীর হত্যা সম্পর্কে আমি আপনাকে স্পষ্ট বলে দিতে চাই, এ কাজে আমি আর একটি লোকও নষ্ট করবো না- শেখ সান্নান বললেন- আইউবীকে হত্যা করা সম্ভব হবে না। আমি আমার বহু মূল্যবান ফেদায়ীদের বিনষ্ট করেছি। আপনারা আমাকে বলার অনুমতি দিন যে, সুলতান আইউবী আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন। আমি যখন তার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করি, তখন আমার আশঙ্কা ছিলো, আমি তার উপর একাধিকবার যে সংহারী আক্রমণ করিয়েছি, তার প্রতিশোধে তিনি আমাকে এবং আমার গুরুত্বপূর্ণ ফেদায়ীদের খুন করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি আমাকে ও আমার লোকদেরকে জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন। তারপরও আমার ধারণা ছিলো, তিনি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছেন- যেইমাত্র আমরা পিঠ ফেরাব, অমনি আমাদের উপর তীর বৃষ্টি চালাবেন কিংবা আমাদের উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়াবেন। এখন আপনারা আমাকে জীবিত দেখতে পাচ্ছেন। আমি আমার সকল কর্মী ও সমগ্র বাহিনীসহ আপনাদের সম্মুখে জীবিত উপস্থিত আছি। আপনারা আমার সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিন। আমি আইউবীর হত্যা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি। তবে কায়রোতে আমাদের লোকদের কর্মতৎপরতা আপনাদের হতাশ করবে না।
কায়রোতে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, যা সালাহুদ্দীন আইউবীকে মিসর ফিরে যেতে বাধ্য করবে- হারমান বললেন- আমি অতি তাড়াতাড়ি সুদানীয় মিসরের সীমান্ত চৌকিগুলোর উপর আক্রমণের ধারা শুরু করে দেবো। মিসরের উপর বড় কোনো আক্রমণ করা যাবে না। তবে আক্রমণের ধোকা দিতে হবে, যেনো সালাহুদ্দীন আইউবী সিরিয়া ত্যাগ করে মিসর ফিরে যেতে বাধ্য হন।
হারমান গুপ্তচরবৃত্তিতে অভিজ্ঞ। কিন্তু তার জানা নেই, আজকের এই সভায় যে কর্মচারিরা মদ ও খাদ্যদ্রব্য আনা-নেয়া-পরিবেশন করছে, তাদের মধ্যে একজন সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। ফরাসী বংশোদ্ভুত লোকটির নাম ভিক্টর। তাছাড়া তাদের মধ্যে রাশেদ চেঙ্গিস নামক একজন তুর্কী মুসলমানও আছে, যে নিজেকে গ্রীক খৃস্টান দাবি করে এই চাকরিতে নিয়োগ লাভ করেছিলো। এই লোকটিও সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা। খৃস্টানদের অতিশয় বিচক্ষণ গোয়েন্দা প্রধান হারমান এই যেসব বিশেষ কর্মচারি, সভা-সমাবেশ ও ভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মদ-খাবার পরিবেশন করছে গভীর যাচাই-বাচাই করে তাদেরকে নিয়োেগ দান করেছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, সুলতান আইউবী সর্বত্র গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে রেখেছিলেন। খৃস্টানদের অনেক ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো তথ্য সময়ের আগেই তিনি পেয়ে যেতেন। এবার শেখ সান্নানের এই কনফারেন্সের সব কথোপকথন তাঁর দুজন গুপ্তচর শুনে ফেলেছে। এখন দিন কয়েকের মধ্যেই এসব তথ্য নিয়ে তাদেরকে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে যেতে হবে।
***
মিসরে নাশকতামূলক তৎপরতা বেড়ে গেছে। সেনাবাহিনীর নায়েব সালার অপেক্ষা এক স্তুর নিচু পদমর্যাদার এক কমান্ডারকে নগরীর বাইরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু রাতে আর ঘরে ফেরেননি। সকালে তার লাশ পাওয়া গেলো। তার শরীরে কোন জখম ছিলো না, কোন আঘাতও ছিলো না। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে নিহতের পায়ের ছাপ ছাড়া অন্য আরো দুটি ছাপ দেখতে পান। চাল-চলনে এই কমান্ডার সকলের প্রশংসনীয় ছিলেন। তার গতিবিধি ভুল কিংবা সন্দেহভাজন লোকদের ন্যায় ছিলো না। তার একজনই স্ত্রী ছিলো, যে তার ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বস্ত ছিলো। তার এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোন কুই বের করা সম্ভব হয়নি।
তিন-চারদিন পর একই পদমর্যাদার অপর এক সেনা কমান্ডারকে ঠিক একইভাবে ভোরে নিজ কক্ষে মৃত পাওয়া যায়। তিনি সেনা ব্যারাকের একটি কক্ষে থাকতেন। পুরোপুরি ভালো মানুষ ছিলেন। তার বন্ধু মহলে তারই ইউনিটের কিছু লোক ছিলো। তাদের কারো সঙ্গেই তার কোন দ্বন্ধ বিবাদ ছিলো না। হত্যাকাণ্ডের বাহ্যিক কোনো কারণ ছিলো না। ঘটনাটাকে হত্যাকান্ডও বলা যায় না। শরীরে জখম কিংবা আঘাতের সামান্যতম চিহ্নও নেই।
সরকারী ডাক্তার লাশটা দেখেছেন। লাশের ঠোঁটের এক কোণে একটুখানি লালা ছিলো। ডাক্তার লালাটুকু একটি বাটিতে করে নিয়ে এক টুকরা গোশতের সঙ্গে মিশিয়ে একটি কুকুরকে খেতে দেন। তারপর কুকুরটাকে নিজের ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখেন এবং পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু কুকুর অস্বাভাবিক কোনো আচরণ করলো না। ডাক্তার সারা রাত জেগে কুকুরটার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। মধ্য রাতের পর কুকুরটা রশির সীমানা পর্যন্ত চারদিক আরামের সাথে পায়চারি করতে শুরু করে। অনেকক্ষণ পায়চারি করার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় এবং লুটিয়ে পড়ে যায়। ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, কুকুরটা মরে গেছে। ডাক্তার রিপোর্ট করেন, কমান্ডার দুজনকে এমন বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে, যাতে কোন তিক্ততা থাকে না। যা খেলে মানুষ অতিশয় আরামের সঙ্গে মারা যায়।
গোয়েন্দারা উভয় কমান্ডার সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান চালায়। জানার চেষ্টা করা হয়, জীবনের শেষ দিনটিতে তারা কার কার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, কোথায় কোথায় গেছেন এবং কার সঙ্গে আহার করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোন তথ্যই পাওয়া গেলো না। বিবাহিত কমান্ডারের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু তাকেও সন্দেহের চোখে দেখার কোনো কারণ ছিলো না। উভয় কমান্ডারই পাকা মুসলমান ছিলেন। সুলতান আইউবী স্বয়ং এক যুদ্ধে তাদের কমান্ড ও বীরত্বের প্রশংসা করেছিলেন। তারা ছিলেন সীমান্ত বাহিনীর কমান্ডার। কয়েকজন সুদানীকে তারা সীমান্তের ওপার থেকে গ্রেফতারও করেছিলেন। সুদানীরা তাদেরকে মোটা অংকের ঘুষের অফার দিয়েছিলো। কিন্তু তারা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের নায়েব সালারের পদে উন্নীত হওয়ার কথা ছিলো।
আলী বিন সুফিয়ান সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, হত্যাকান্ডের ঘটনা দুটি খৃষ্টান নাশকতাকারীদের কাজ এবং ঘাতকরা ফেদায়ী চক্রের সদস্য। তিনি বললেন, দুশমন এখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার ধারা শুরু করে দিয়েছে। সকল কমান্ডার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হলো, যেনো তারা অপরিচিত কিংবা সন্দেহভাজন কারো হাত থেকে কিছু না খায় এবং কেউ অযাচিতভাবে বন্ধুত্ব গড়তে শুরু করলে বা কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করলে তাকে ধরিয়ে দেয়।
মিসরের গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় কমান্ডারের হত্যাকান্ডের সাতদিন পর একরাতে হঠাৎ সেনা ছাউনিতে আগুন ধরে যায়। হাজার হাজার তাঁবু এক স্থানে স্তূপ করে রাখা ছিলো। প্রহরাও ছিলো। কিন্তু তারপরও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে যায়। এটিও নাশকতামূলক কাজ। সেখানে আকস্মিকভাবে আগুন ধরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। এই এলাকায় আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিলো এবং এই নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে পালিত হতো।
এসব ঘটনা ছাড়াও আরো রহস্যময় বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। সীমান্ত বাহিনীগুলোকে অধিকতর সতর্ক করে দেয়া হয়। সুদানের দিকে সীমান্তের ভেতরে গোপনে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিলো। তাদের বেশ কজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
আলী বিন সুফিয়ান তার ইন্টেলিজেন্সকে আরো বেশি ছড়িয়ে দেন এবং পূর্বাপেক্ষা অধিক সতর্ক করে দেন।
***
কায়রো থেকে সামান্য দূরে নীল নদের তীরে একটি পাহাড়ি এলাকা। এই অঞ্চলেরই কোন এক স্থানে ফেরাউনী আমলের একটি প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। ইতিপূর্বে একাধিক ঘটনায় খৃস্টান ও সুদানী সন্ত্রাসীরা এই পতিত প্রাসাদগুলোকে তাদের গোপন আস্তানারূপে ব্যবহার করেছিলো। মিসরে এরূপ পরিত্যক্ত পুরনো জীর্ণ প্রাসাদের সংখ্যা অনেক। পাহাড়ি এলাকাটাকে নজরে রাখার জন্য আলী বিন সুফিয়ান তাঁর গোয়েন্দাদেরকে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করে নিয়োজিত করেছিলেন। এখানকার খৃস্টান সন্ত্রাসীরা দু-তিন মাসে আলী বিন সুফিয়ানের ছয়-সাতজন দক্ষ গোয়েন্দাকে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গুম করে ফেলেছে।
এরা মিসরের সেইসব গুপ্তচর, যারা খৃস্টান গুপ্তপরদের পাকড়াও করার যোগ্যতা রাখতো। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই ধরা কিংবা মারা পড়ছে। আশংকার ব্যাপার হলো, যদি তারা ধরাই পড়ে থাকে, তাহলে খৃস্টানরা তাদেরকে ফেদায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে মিসরেরই সরকার ও সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তার চেয়েও বড় শংকা হলো, দুশমনের গোয়েন্দারা কায়রোর গোয়েন্দাদেরকে চিনে ফেলেছে। গুপ্তচরবৃত্তির এই যুদ্ধে দুশমন জয়লাভ করছে। আলী বিন সুফিয়ান এখন উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। তাদের একজন হলেন মাহদী আল-হাসান, যিনি ফিলিস্তীন ও ত্রিপোলীতে গুপ্তচরবৃত্তি করে এসেছেন। ইনি দুর্দান্ত সাহসী ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা। উপকূলীয় এই পাহাড়ি এলাকাটার দেখা-শোনার দায়িত্ব তারই উপর ন্যস্ত করেন আলী বিন সুফিয়ান।
এলাকাটার ভেতরে একটি মাত্র পথ আছে। পেছনে নদী। অন্য তিনদিকে পাহাড় আর টিলা। অভ্যন্তরটা সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ। কোথাও কোথাও পানির ঝিলও আছে।
রিপোর্ট আছে, পাহাড়ের ভেতরে সন্দেহভাজন কিছু মানুষ যাওয়া-আসা করছে। কেউ ফেরাউনদের কোনো ভবন বা তার ধ্বংসাবশেষ দেখেনি। কিন্তু মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, ভেতরে কোথাও না কোথাও এমন কিছু অবশ্যই আছে। ফেরাউনরা এখানে কিছু না কিছু অবশ্যই নির্মাণ করে থাকবে, যা আজো বর্তমান আছে। মোটকথা, এলাকাটা সন্ত্রাসী আস্তানার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান বটে।
মাহদী আল-হাসান এক-দুটি উট আর কয়েকটি ভেড়া-বকরী নিয়ে মরু যাযাবর কিংবা রাখালের বেশে সেখানে যাওয়া-আসা করতেন। পশুগুলো এদিক-ওদিক চরে বেড়াতে আর তিনি ঘোরাফেরা করতেন। তিনি কিছুদূর পর্যন্ত ভেতরকার এলাকা দেখেছেন। সে পর্যন্ত তিনি কিছুই দেখতে পাননি। অনেকখানি ভেতরে একটি পর্বত এমন আছে, যার পাদদেশে বিশ-পঁচিশ ফুট উপরে একটি কুদরতি সুড়ঙ্গ পথের মুখ আছে। মাহদী আল-হাসান এই সুড়ঙ্গের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন। সুড়ঙ্গটি এতো উঁচু ও প্রশস্ত যে, তার মধ্য দিয়ে উট চলাচল করতে পারে। সুড়ঙ্গটি সোজা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গটির অপর প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানে সংকীর্ণমত একটি উপত্যকা, যেখানে কোনো আস্তানা তৈরি হতে পারে না। সুড়ঙ্গটি অনেক লম্বা। ভেতরে ডানে-বাঁয়ে দেয়ালের গায়ে গুহার মতো তৈরি হয়ে আছে। এমন বড় বড় পাথরও আছে, যেগুলোর আড়ালে মানুষ দিব্যি লুকাতে পারে।
মিসরী গোয়েন্দা মাহদী আল-হাসান, আলী বিন সুফিয়ানকে রিপোর্ট করেছেন, আমি যতোদূর পর্যন্ত গিয়েছি, কোনো সন্দেহজনক স্থান চোখে পড়েনি এবং যতোবার গিয়েছি, একজন মানুষও ভেতরে যেতে কিংবা ভেতর থেকে বের হতে দেখিনি। আলী বিন সুফিয়ান তাকে বলে দেন, যেন তিনি সারাদিন সেখানে অতিবাহিত করেন এবং বেশি ভেতরে না যান। কারণ, তাতে ক্ষতির আশঙ্কা বিদ্যমান। আলী বিন সুফিয়ান তাকে এও বলে দেন, মাঝে-মধ্যে উটে সওয়ার হয়ে রাতেও চলে যাবেন। যদি কোনো মানুষের মুখোমুখি হয়ে পড়েন, তাহেল বলবেন, আমি কায়রো যাচ্ছি। নিজেকে কৃষাণ বলে দাবি করবেন।
আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশনা মোতাবেক মাহদী আল-হাসান রাতেও সেখানে গিয়েছেন। এক রাতে তিনি কারো পলায়নপর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। কোনো বন্য পশুও হতে পারে কিংবা মানুষও হতে পারে। মাহদী আল-হাসান আর সম্মুখে অগ্রসর হননি। কিছু সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসেন।
পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই মাহদী আল-হাসান দু-তিনটি উট ও গোটা কতক ভেড়া-বকরী নিয়ে সেখানে চলে যান। পশুগুলোকে উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে থাকেন। জায়গাটা সবুজ-শ্যামল। ঝোঁপড়, ঘাস ও বন্য ফল-বীচি সবই আছে। খানিক সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পর তার একজন মানুষ চোখে পড়ে। লোকটি এক স্থানে মাথানত করে বসে আছে। পরনে মূল্যবান চোগা। মুখে লম্বা দাড়ি। মাথায় দামি পাগড়ি। মাহদী আল-হাসান ধীরে ধীরে লোকটির দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেন। কারো আগমন আঁচ করে লোকটি মাথা তুলে তাকায়। বেশ-ভুষা ও চলন-বলনে মাহদী আল-হাসান একজন অশিক্ষিত গেঁয়ো লোক। তিনি ধীর পায়ে লোকটির নিকটে গিয়ে দাঁড়ান।
লোকটির হাতে একটি থলে। থলেটি কাঁচা সবুজ পাতায় ভর্তি। অপর হাতে একটি গাছের তাজা ডাল।
কী তালাশ করছেন চাচা?- মাহদী আল-হাসান বোকার মতো হেসে গেঁয়ো মানুষের ঢংয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু হারিয়েছেন কি? বলুন, আমিও তালাশ করি।
আমি হাকীম- লোকটি বললো- গাছ-গাছড়া, লতা-পাতা, গোটা দানা এসব খুঁজে ফিরছি। এসব ঔষধ তৈরিতে লাগে।
চেহারা দেখে মাহদী আল-হাসান লোকটাকে চিনে ফেলেন। কায়রোর বিখ্যাত হাকীম। তিনি সঠিক উত্তরই দিয়েছেন যে, লতা-পাতা তালাশ করছেন। এসব দিয়েই হাকীমরা ঔষধ বানায়।
তা তুমি এখানে কী করছো?- হাকীম জিজ্ঞাসা করেন- থাকো কোথায়?
ঐতো সামান্য দূরে- মাহদী আল-হাসান জবাব দেন- পরিবারের সঙ্গে থাকি। এখানে পশু চরাতে এসেছি।
দানাগুলো দিয়ে কী রোগের ঔষধ বানাবেন? মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞাসা করেন।
কোন কোন রোগ এমন হয়ে থাকে যে, রোগী নিজেও জানেনা, তার কী হয়েছে।
ইনি দেশের বিখ্যাত হাকীম। দূর-দূরান্ত থেকে রোগী আসে তার কাছে। এখানে তার দেখা পাওয়া মাহদী আল-হাসানের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।
মানুষের একটি দুর্বলতা হলো, অনেক সময় মানুষ রোগাক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে রোগী মনে করে। সব মানুষই দীর্ঘ আয়ু, সুস্বাস্থ্য এবং শারীরিক শক্তির প্রত্যাশা রাখে। কোনো মানুষই নিজেকে শক্তিহীন ভাবতে চায় না। মাহদী আল-হাসানও তেমনি একজন মানুষ। শরীরে হয়তো সাধারণ কোন সমস্যা ছিলো, যা থাকে সব মানুষেরই। এতো বড় একজন হাকীমের সঙ্গে দেখা। সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
মাহদী আল-হাসান রোগের কথা হাকীমকে জানান। হাকীম তার শিরায় হাত রাখেন। তারপর নিরিক্ষার সাথে চোখ দুটো দেখেন। এমনভাবে তাকান, যেনো তার চোখে বিস্ময়কর কিছু দেখেছেন। তারপর লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখেন। হাকীমের চেহারায় বিস্ময়ের লক্ষণ।
তুমি কি আমার দাওয়াখানায় আসতে পারো?- হাকীম জিজ্ঞাসা করেন- শহরে আসো।
আমি নিতান্ত গরীর মানুষ- মাহদী আল-হাসান বললেন- আপনাকে পয়সা দেবো কোত্থেকে?
তুমি এখনই আমার সঙ্গে চলো- হাকীম বললেন- আমার উট ওদিকে চরে বেড়াচ্ছে। তোমারও উট আছে। আমাকে তোমার পয়সা দিতে হবে না। ধনীদের নিকট থেকে অনেক টাকা নিয়ে থাকি। গরীবের চিকিংসা বিনা মূল্যে করি। তোমার রোগ এখনো সাধারণ। কিন্তু বেড়ে যেতে পারে। আমার অন্য একটি সন্দেহও হচ্ছে।
মাহদী আল-হাসান এখন ডিউটিতে আছেন। বৃদ্ধের কাছে আসা এবং তার সঙ্গে কথা বলাও তার কর্তব্যেরই অংশ। সাধারণ একটা রোগের চিকিৎসার জন্য তিনি ডিউটি ত্যাগ করতে পারেন না। তিনি হাকীমকে বললেন- আমি সন্ধ্যায় আপনার দাওয়াখানায় আসবো। হাকীম মাহদী আল-হাসানকে নিজের দাওয়াখানার ঠিকানা বলে দেন। মাহদী আল হাসান পূর্ব থেকেই দাওয়াখানাটা চেনেন। তবু না জানার ভানই দেখান।
***
সন্ধ্যার পর মাহদী আল-হাসান এই বেশেই হাকীমের দাওয়াখানায় চলে যান। উটটা সঙ্গে রাখেন, যাতে হাকীম চিনতে পারেন। হাকীমের প্রতি তার কোন সংশয় নেই। হাকীমরা গাছ-গাছড়া, লতা-পাতা তালাশ করে ফেরেন তা তার জানা আছে। সেই সুবাধে এই হাকীমেরও উক্ত পার্বত্য এলাকায় যাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া বাস্তবিকই তার বিশ্বাস জন্মে গেছে, তার এই সাধারণ রোগটা এক সময় গুরুতর কোন ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে। হাকীম তাকে আবারো দেখলেন এবং খুব ভালো করে দেখলেন এবং বললেন- আমি তোমাকে ঔষধ দিচ্ছি। যদি এতে ভালো না হও, তাহলে অন্য ব্যবস্থা আছে। তোমার ব্যাপারে আমার অন্য একটি সন্দেহ আছে।
মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞাসা করেন- কী সন্দেহ?
কামনা করি, আমার সন্দেহ সঠিক না হোক- হাকীম বললেন- তুমি সুদর্শন যুবক। পাহাড়-উপত্যকায় ঘুরে বেড়াও। যেখানে আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো, জায়গাটা ভালো নয়। ওখানে প্রেতাত্মারা বসবাস করে। তাদের কতিপয় ফেরাউনী আমলের রূপসী মেয়েদের প্রেতাত্মা। ফেরাউনরা তাদেরকে জোরপূর্বক নিজেদের কাছে রেখেছিলো এবং ভোগ-বিলাসিতার উপকরণ বানিয়েছিলো। পরে তাদের স্থলে অন্য মেয়েদের পেয়ে তাদেরকে মেরে ফেলেছিলো। আত্মা বৃদ্ধ হয় না- সব সময় যুবকই থাকে। তাদেরই আত্মারা এই সবুজ ভূ-খণ্ডে ঘুরে বেড়ায়। আমার সন্দেহটা হচ্ছে, তোমার আকার-গঠন ফেরাউনদের আমলের এক যুবকের সঙ্গে মিল খায়, যাকে সে কালের এক সুন্দরী যুবতী ভালোবাসতো, কামনা করতো। কিন্তু মেয়েটি কোন এক ফেরাউনের হাতে পড়ে যায়। তুমি ওখানে যাওয়া-আসা করছো। ঐ মেয়েটির প্রেত্মাত্মা তোমাকে দেখে ফেলেছে। সে তোমাকে কামনা করছে।
ও আমার কোন ক্ষতি করবে না তো?- মাহদী আল-হাসান হাকীমের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে খানিকটা ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন- প্রেতাত্মাদের বন্ধুত্ব তো ভালো হয় না। তা আপনি কি আমাকে সেই প্রেতাত্মা থেকে বাঁচাতে পারেন?
আমার সন্দেহ ভুলও হতে পারে- হাকীম বললেন- আগে ঔষধ দেবো। তাতে সুস্থ্য না হলে তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ করিয়ে দিবো। প্রেতাত্মা থেকে মুক্তি লাভের এ-ও একটা পন্থা। তখন আর সে তোমার কোন ক্ষতি করবে না।
মাহদী আল-হাসান যোগ্য ও বিচক্ষণ গুপ্তচর বটে; কিন্তু আলেম নন। সাধারণ মানুষের ন্যায় তারও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস আছে। এ জাতীয় শোনা ঘটনাবলীতে তার বিশ্বাস আছে। হাকীমের এক একটি শব্দ তার মনের মাঝে গেঁথে গেছে। প্রেতাত্মার ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
মাহদী আল-হাসান হাকীমের নিকট গুপ্তচরবৃত্তির জন্য নয়। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। হাকীম তাকে সান্ত্বনা প্রদান করেন, যেনো তিনি চিন্তা না করেন। কিন্তু চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছে। হাকীম তাকে এক ডোজ ঔষধ দিয়ে বলে দেন, এই ঔষধটুকু রাতে শোয়ার আগে খাবে।
মাহদী আল-হাসান ঔষধ সেবন করে শুয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম এসে যায়। তিনি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যান। এর আগে কখনো এতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম আসেনি। সকালে চোখ খোলার পর অনুভব করেন, মনটা তার অস্বাভাবিক উৎফুল্ল। সর্বপ্রথম আলী বিন সুফিয়ানের নিকট যান। কিন্তু হাকীমের ঘটনা কিছুই বললেন না। এটা বলার মতো কোন বিষয় নয়। কেননা, হাকীম সন্দেহভাজন কেউ নন। তিনি কায়রোর বিখ্যাত ও বড় হাকীম। ফৌজ ও প্রশাসনের বড় বড় অফিসাররাও তার থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তিনি তাবীজ-কবজও দিয়ে থাকেন এবং জিন-ভূত তাড়ান। আলী বিন সুফিয়ান মাহদী আল-হাসানকে বললেন, আপনি সেখানে যান। কোন সন্দেহভাজন মানুষ অবশ্যই পেয়ে যাবেন। আলী মূলত নাশকতাকারীদের আস্তানা খুঁজে ফিরছেন।
মাহদী আল-হাসান ডিউটিতে চলে যান। যাওয়ার পথে হাকীমের সঙ্গে দেখা করে যান। সেই রাখালের বেশ, রাখালের পোশাক। হাকীমকে বললেন, এই সাত সকালে আপনাকে জানাতে এসেছি, আজ রাত আমার গভীর ঘুম হয়েছে এবং ঔষধ খাওয়ার পর থেকে আমার মনটা এতো উফুল্ল ও তরতাজা যে, পূর্বে কখনো এমনটা হয়নি।
যদি বিকাল পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় থাকে, তাহলে তোমার অন্য কোন সমস্যা নেই- হাকীম বললেন- সন্ধ্যায় আবার আসবে।
মাহদী আল-হাসান ওঠে ডিউটিতে চলে যান।
মাহদী আল-হাসান এই সবুজ-শ্যামল এলাকায় বহুদিন যাবৎ যাওয়া আসা করছেন এবং গোটা দিন অবস্থান করছেন। বহুবার রাতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার হাকীমের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার জায়গাটার নামে ভয় অনুভূত হতে শুরু করেছে। হাকীম তাকে বলেছিলেন, প্রেতাত্মা তার কোন ক্ষতি করবে না। কারণ, প্রেমের টানে সে তার আত্মার কাছে আসা-যাওয়া করছে। তবু অদেখা রহস্যময় সৃষ্টির প্রতি ভীতি সহজাত। মাহদী আল-হাসানের মনে হতে লাগলো, প্রেতাত্মারা তার চার পার্শ্বে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। মাহদী আল-হাসান সাহসী সুপুরুষ। তিনি মন থেকে ভয় দূর করে ফেলার চেষ্টা শুরু করেন এবং হাকীম তাকে যে প্রেতাত্মার উল্লেখ করেছিলেন, তাকে কল্পনায় স্থান দিতে শুরু করেন। এই কল্পনায় তিনি শান্তি লাভ করেন এবং এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করেন।
হঠাৎ মাহদী আল-হাসান অনুভব করেন, তার মনের প্রফুল্লতা ও আনন্দ নির্জীব হয়ে যাচ্ছে এবং মনটা ভীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজেকে সামলে নেয়ার বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু ভয় বাড়তেই থাকে এবং হাকীমকে যে সমস্যার কথা বলেছিলেন, তা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। তিনি তাৎক্ষণাৎ হাকীমের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডিউটি ত্যাগ করে যাওয়া সম্ভব নয়।
মাহদী আল-হাসান সহ্য করতে থাকেন। বহু সময় পর তার মনের ভয় দূর হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গতকাল ওষুধ সেবনের আগে যে অবস্থা ছিলো, সেই অবস্থায় ফিরে আসেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে, এটা প্রেতাত্মার আছর।
দিন কেটে গেছে। মাহদী আল-হাসান উট ও ভেড়া-বকরীগুলোকে জড়ো করে সেই স্থানে নিয়ে যান, যেখানে প্রতিদিন নিয়ে রাখেন। তারপর উটের পিঠে সওয়ার হয়ে শহরে হাকীমের নিকট চলে যান। হাকীমকে নিজের মনের এই পরিবর্তনের কথা জানান। হাকীম প্রেতাত্মার সন্দেহের কথা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আরো একদিন ওষুধ সেবন করে দেখার পরামর্শ দিয়ে গতকালের ওষুধটাই আরেক ডোজ দিয়ে বিদায় করে দেন। মাহদী আল-হাসান রাতে শোয়ার আগে ওষুধটা সেবন করেন। গত রাতের ন্যায় আজও তার গভীর ঘুম হয় এবং সকালে ঝরঝরা শরীর-মন নিয়ে জাগ্রত হন। নিত্যদিনের ন্যায় তিনি আলী বিন সুফিয়ানের নিকট গমন করেন এবং সেখান থেকে ডিউটিতে চলে যান।
মাহদী আল-হাসানের শরীরটা এখন ভালো। মন-মানসিকতায় প্রেতাত্মার কল্পনা প্রবল। কিন্তু আধা দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রফুল্লতা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তা নিঃশেষ হয়ে যায় এবং তদস্থলে ভীতি ও নির্জীবতা এসে ভর করে। তিনি ভাবনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন এবং পায়চারি করতে শুরু করেন। কিন্তু পরে আবার ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যেতে থাকে। তার কানে এমন শব্দ ভেসে আসে, যেনো দূরে কোথাও এক নারী কাঁদছে। কান্নার শব্দ প্রথমে উঁচু হয়ে পরে আবার ক্ষীণ হতে হতে স্তিমিত হয়ে যায়।
মাহদী আল-হাসান যেখানে ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি ভাবেন, এটা কোনো এক প্রেতাত্মার কান্না হবে। হতে পারে এটা সেই প্রেতাত্মা, যার কথা হাকীম বলেছিলেন। তিনি ভয় পেয়ে যান। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলবেন বলে মনস্থ করেন। কিন্তু হাকীম তো বলেননি, প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলা উচিত কি উচিত নয়। তিনি যদি অন্য কোথাও কোন নারীর কান্নার শব্দ শুনতেন, তাহলে পরিস্থিতি যেমনই হোক তার সাহায্যে ছুটে যেতেন। কিন্তু এখানে তো জীবন্ত কোন নারীর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। এটা যে ফেরাউনী আমলের প্রেতাত্মার ক্রন্দন!
সন্ধ্যায় মাহদী আল-হাসান আগের দিনের ন্যায় হাকীমের নিকট চলে যান এবং তাকে অবস্থা জানান। নারী কণ্ঠের ক্রন্দন শোনার ঘটনাও অবহিত করেন। হাকীম কিছুক্ষণের জন্য গভীর চিন্তায় হারিয়ে যান। পরে মাথা তুলে বললেন- আমার সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়ে গেছে। এটা প্রেতাত্মা। তবে তুমি ভয় পেয়ো না। আমি এখনই তোমাকে একটা তাবিজ দেবো। তারপর প্রেতাত্মাকে জিজ্ঞেস করবো, সে কী চায়? তারপর যা করার করবো। তবে তোমাকে ভয় পাওয়া চলবে না। এই প্রেতাত্মাটা তোমাকে ভালোবাসে। তাই সে তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। তুমি ওখানে যেতে থাকো। তবে তার থেকে পালাবার চেষ্টা করলে সে তোমার ক্ষতি করবে।
হাকীম মাহদী আল-হাসানকে একটি তাবিজ দেন। তিনি তাবিজটি বাহুতে বেঁধে নেন।
অবশিষ্ট কাজ রাতে করবো- হাকীম বললেন- কাল সকালে আমার কাছে চলে আসবে। তখন আমি তোমাকে প্রেতাত্মা সম্পর্কে ধারণা দেবো। তুমি যে কান্নার আওয়াজ শুনেছো, তা সেই প্রেতাত্মারই কান্না। এই প্রেতাত্মাটা শয়তান নয়। তারপরও আমি চেষ্টা করবো, তোমাকে তার থেকে রক্ষা করা যায় কিনা।
মাহদী আল-হাসান হৃদয়ে অস্থিরতা ও উত্তেজনা নিয়ে ফিরে যান।
পরদিন মাহদী আল-হাসান আলী বিন সুফিয়ানের পক্ষ থেকে আরো কিছু নির্দেশনা লাভ করেন। তিনি পালিয়ে পালিয়ে হাকীমের নিকট চলে যান। হাকীম যেনো তারই অপেক্ষায় বসে আছেন। মাহদী আল-হাসানকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে যান এবং তাকে ভেতরে নিয়ে যান।
সে তোমার সঙ্গে একটিবারের জন্য সাক্ষাৎ করতে চায়- হাকীম মাহদী আল-হাসানকে বললেন- সে তোমার সম্মুখে আসবে এবং নিজের আসল আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করবে। হতে পারে, প্রথম দিন সে তোমার সম্মুখে এসেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। অন্য জগতের সৃষ্টি বলে হয়তো এ জগতের মানুষের কাছে আসতে ইতস্তত করবে। তা-ই যদি করে, তাহলে পরদিন তোমাকে আবার যেতে হবে।
কোথায়? মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞাসা করেন।
সেখানে, যেখানে তুমি প্রত্যহ গিয়ে থাকো- হাকীম বললেন- যেখানে তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে। সেখানে তুমি রাতে যাবে।
আপনিও কি সঙ্গে থাকবেন? মাহদী আল-হাসান খানিকটা কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন।
না- হাকীম উত্তর দেন- পরজগতে চলে যাওয়া আত্মাকে সে-ই দেখতে পায়, যাকে সে কামনা করে। কোনো পাপিষ্ঠ প্রেতাত্মা যদি কোন মানুষের উপর দৃষ্টিপাত করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ সে মারা যায়। এই যে প্রেতাত্মা তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে, সে কাউকে কষ্ট দেয় না। তার কান্না বুঝতে চেষ্টা করো। সে মজলুম, ভালোবাসার পিয়াসী। আমি রাতে যখন তাকে হাজির করেছি, তখন সে অঝোরে কাঁদছিলো এবং অনুনয় বিনয় করে বলছিলো, ঐ লোকটাকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। তারপর আমি আজীবনের জন্য চলে যাবো।
কথাগুলো যদি অন্য কেউ বলতো, তাহলে মাহদী আল-হাসান অতোটা প্রভাবিত হতেন না, যতোটা এখন হয়েছেন। সর্বজনমান্য ও দেশের বিখ্যাত হাকীম সাহেবের বক্তব্য অমূলক হতে পারে না। তাছাড়া তিনি বড় মাপের একজন আলেমও বটে। তার বলার ধরনটাই এমন যে, শ্রোতা হৃদয়ে গেঁথে যায়। তিনি মাহদী আল-হাসানকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন, এই প্রেতাত্মার দর্শনে তোমার উপর কোন ভীতির সঞ্চার হবে না এবং তোমার কোন ক্ষতি হবে না। উল্টো তোমার বিরাট উপকার হতে পারে।
তবে সাবধানতা অবলম্বন করাও আবশ্যক- হাকীম বললেন- এই প্রেতাত্মা কিংবা তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হওয়ার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না। এই ভেদ যদি ফাঁস করে দাও, তাহলে তোমার ক্ষতির আশঙ্কা আছে। তুমি এই দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দিতে পারো। কিন্তু অদৃশ্য জগতে চলে যাওয়া আত্মার ভেদ ফাঁস করে দিলে আমি বলতে পারবো না তোমার শরীরের কোন দুইটি অঙ্গ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে- দুপা শুকিয়ে যাবে, না দুই বাহু, নাকি চোখ দুটো দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলবে। তোমাকে আমি আরো একটি গোপন কথা বলবো, যাতে তুমি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো। দেশের সেনাবাহিনীর দুজন ঊর্ধ্বতন কমান্ডার রাতে মারা গেছে। কেউ জানে না, তারা কীভাবে মারা গেছে। দুতিনটি প্রেতাত্মা আমাকে বলেছে, তাদেরকে প্রেতাত্মারা মেরে ফেলেছে। তারা হত্যাকারী প্রেতাত্মাদের গোমর ফাঁস করে দিয়েছে।
তা তারা কমান্ডারদের কীভাবে খুন করলো? মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞাসা করেন। মাহদী আল-হাসান রাখালের বেশ ধারণ করে আছেন বটে, কিন্তু মূলত তিনি গুপ্তচর। তিনি কমান্ডারদ্বয়ের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে চাচ্ছেন। তিনি হাকীমের নিকট বিস্তারিত জানতে চান।
এই রহস্য কাউকে বলা যাবে না- হাকীম বললেন- যতোটুকু অনুমতি ছিলো বলেছি। তুমি একেবারে চুপ থাকবে। যা যা বলছি স্মরণ রেখো। ভেবো না, কোনো স্বার্থ ছাড়া তোমার প্রতি আমার এই হৃদ্যতা কেনো। আমি এই আত্মা ও প্রেতাত্মাদের কামনার কাছে দায়বদ্ধ। আমি যদি তাদেরকে নারাজ করি, তাহলে আমার সব বিদ্যা বেকার হয়ে যাবে এবং প্রেতাত্মারা আমারও সেই দশা ঘটাবে, যেমনটি তাদের শত্রুদের ঘটিয়ে থাকে। এই যে আত্মা তোমাকে দেখে কাঁদে, সে আমাকে বলেছে, সামান্য সময়ের জন্য হলেও যেন আমি তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ করিয়ে দিই। এখন তার বাসনা পূর্ণ করা আমার কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আচ্ছা, আমি যদি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করি, তাহলে কী হবে? মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞেস করেন।
তাহলে সে প্রেতাত্মার রূপ ধারণ করে তোমার আত্মার উপর নিজের ছায়া ফেলবে- হাকীম জবাব দেন- তুমি আমাকে যে সমস্যার কথা, বলেছিলে, সেটি কোন শারীরিক সমস্যা ছিলো না। এটি তোমার আত্মিক ব্যাধি। তবে তা এখনো তোমার উপর পূর্ণ ক্রিয়া করেনি। তুমি একজন ভালো মানুষ। তোমার নেকী তোমার কাজে এসেছে। সমস্যার কথা ব্যক্ত করে তুমি ভালোই করেছে। মহান আল্লাহ যাকে দয়া করেন, তার জন্য কোন মানুষকে তিনি ওসিলা বানিয়ে দেন। এটা আল্লাহর লীলা যে, তুমি আমাকে এখানে দেখেছে এবং আমাদের সাক্ষাৎ ঘটেছে। আল্লাহর এই দয়াকে ভয় করো না। তুমি যদি ঐ প্রেতাত্মাটার সঙ্গে মিলিত হওয়ার কামনা করো, তাহলে সে এ জগতে তোমার অনেক উপকার করবে। তোমার একটি উপকার এই হতে পারে যে, সে অতিশয় সুন্দরী নারীর রূপে গোশত-চামড়ার জীবন্ত মানুষ হয়ে যখন খুশি তোমার সঙ্গে মিলিত হবে। তুমি তাকে স্ত্রী বানিয়ে ঘরে রাখতে পারবে। আর যদি সে তোমার প্রতি অতিশয় স্নেহশীল হয়ে যায়, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে তোমাকে কোনো না কোনো ফেরাউনের গোপন ধনভাণ্ডারের সন্ধান বলে দেবে এর এমন উপায় সৃষ্টি করে দেবে যে, তুমি সেই ধনভাণ্ডার বের করে এই প্রেতাত্মাকে সঙ্গে করে মিসর থেকে দূরে কোথাও চলে যাবে এবং কোনো একটি ভূখরে রাজা হয়ে যাবে।
***
সাক্ষাৎ কবে হবে? মাহদী আল-হাসান জিজ্ঞেস করেন।
আজ রাতেই চলে যাও। হাকীম বললেন।
হাকীম মাহদী আল-হাসানকে আরো একটি তাবিজ দেন এবং বহু জরুরি নির্দেশনা প্রদান করেন। আশঙ্কা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং উৎসাহিত করে জোরালো ভাষায় বললেন, ভয় পাবে না। তিনি সাক্ষাতের স্থানে পৌঁছার সময়ও বলে দেন, রাত অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ার খানিক পরে যাবে। মাহদী আল-হাসান বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব এক প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিদায় গ্রহণ করেন এবং নিত্যদিনকার ডিউটিতে চলে যান। দিনটা সেখানে অতিবাহিত করেন এবং সূর্যাস্তের আগে আগে ফিরে যান।
***
রাতের আঁধার নেমে এলে মাহদী আল-হাসান পুনরায় সেখানে চলে যান। এবার ডিউটির জন্য নয়- প্রেতাত্মার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। একাকি এমন ঘোর অন্ধকারে ও সুনসান পরিবেশে তাকে চরম ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হাকীমের বক্তব্য তাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। বাহুতে তার দুটি তাবিজ বাধা। নিজের থেকে দুআ-কালামও পাঠ করছেন।
মাহদী আল-হাসান হাকীমের বলা স্থানে গিয়ে পৌঁছেন। পর্বতমালার ভেতরকার একটি জায়গা। গাছপালাগুলো দৈত্যের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশটা এতো নিস্তব্ধ যে, মাহদী আল-হাসান বুকের ধড়ফড়ানিও শুনতে পাচ্ছেন।
মাহদী আল-হাসান দিনে যে ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন, এখনো সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তিনি শব্দের দিকে এগিয়ে যান। কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকে। তিনি সামান্য অগ্রসর হয়ে দাঁড়িয়ে যান। এবার ক্রন্দন ধ্বনিটা পেছন দিক থেকে আসছে। তবে দূর থেকে। তিনি মোড় ঘুরিয়ে সেদিকে হাঁটা দেন। স্থানটা সম্পর্কে তিনি অবহিত। তাই অনায়াসে চলতে পারছেন। এই শব্দও থেমে যায়।
মাহদী আল হাসান উচ্চস্বরে বলে ওঠলেন- দেখা দেবে, নাকি এভাবেই ভয় দেখাতে থাকবে।
কিন্তু তিনি নিজের উচ্চারিত শব্দগুলোই স্পষ্ট শুনতে পান। যদি তার জানা না থাকতো, এটা তারই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, তাহলে ভয়ে পালিয়ে আসতেন। পাহাড়গুলো দেয়ালের ন্যায় খাড়া। খাড়া দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মাহদী আল-হাসানের চীৎকারটা তিন-চারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কানে এসে বাজে। তার কটা দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত বাতাসে সাঁতার কাটতে থাকে।
মাহদী আল-হাসানের শব্দের গুঞ্জরণ অন্ধকার পরিবেশে মিলিয়ে গেলে তিনি একটি নারী কণ্ঠ শুনতে পান- আমাকে ভয় করো না। এগিয়ে আসো।
শব্দটা দূর থেকে এসেছে। তিনি শব্দটা কয়েকবার শুনতে পান। পরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
আবারো আওয়াজ আসে- বিশ্বাসঘাতকতা করো না। আমি দুহাজার বছর যাবত তোমার পথ পানে চেয়ে আছি।
মাহদী আল-হাসান এই আওয়াজও একাধিকবার শুনতে পান। পরক্ষণে মাহদী আল-হাসানের কথা গুঞ্জরিত হয় এবং প্রতিধ্বনিত হয়ে কয়েকবার কানে বাজার পর থেমে যায়।
এভাবে উভয় দিক থেকে শব্দ উঠতে ও গুঞ্জরিত হতে থাকে। প্রেতাত্মার আওয়াজে আবেদন-অনুনয় বিদ্যমান, যার ফলে মাহদী আল-হাসানের ভীতি দূর হয়ে গেছে। তিনি পর্বতমালার একেবারে ভেতরে চলে যান। সম্মুখে আলোর ঝলকানি দেখতে পান, যা কিনা আকাশের বিজলীর ন্যায় চমকে ওঠেই নিভে যায়। এই বিজলীর চমকে তিনি নিজের অবস্থানটা দেখে নেন। এই চমকে তিনি সেই সুড়ঙ্গের মুখটা দেখতে পান, যার মধ্যদিয়ে একবার অপর প্রান্তে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানেই থেমে যান।
কিছুক্ষণ পর আলোটা আবার চমকায় এবং তার মাধ্যমে মাহদী আল হাসান সুড়ঙ্গের মুখে একজন মানুষ দণ্ডায়মান দেখতে পান। আলোটা কোথা থেকে আসছে বুঝা যাচ্ছে না। লোকটা মাহদী আল-হাসান থেকে আনুমানিক পঞ্চাশ কদম দূরে। তিনি গভীর দৃষ্টিতে দেখেন। মুখাবয়বটা অতিশয় রূপসী একটি মেয়ের। শুধু মুখমণ্ডলই দেখা যাচ্ছে। দেহের বাকি অংশ সাদা কাফনে ঢাকা। মাহদী আল-হাসানের গা ছমছম করে ওঠে। তিনি ভয় পেয়ে যান। এবার নারী কণ্ঠ ভেসে আসে- আমাকে ভয় করো না। দুহাজার বছর পর্যন্ত আমি তোমার পথপানে তাকিয়ে আছি।
মাহদী আল-হাসান সম্মুখে এগিয়ে যান। কয়েক পা অগ্রসর হওয়ার পর কাফনের মধ্য থেকে একটি হাত বেরিয়ে তার প্রতি এগিয়ে আসে। হাতের তালুটা এমনভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়, যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে অগ্রসর হয়োনা। মাহদী আল-হাসান সেখানেই দাঁড়িয়ে যান। আলো নিভে যায়। তিনি এই আশায় দাঁড়িয়ে থাকেন, পুনরায় আলো জ্বলে উঠবে এবং তিনি কাফনের মধ্যকার মেয়েটাকে দেখবেন। কিন্তু তিনি আওয়াজ শুনতে পান। তোমাকে আমি কীভাবে বিশ্বাস করি? তুমি চলে যাও। চলে যাও।
আমার উপর আস্থা রাখো- মাহদী আল-হাসান বললেন এবং সম্মুখপানে এগিয়ে গেলেন। তিনি চীৎকার করে বলছেন- আমি তোমারই জন্য এসেছি। তুমি আমার কাছে চলে আসো।
মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যান। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে- কাল এসো, আজ চলে যাও। তুমি ধ্বংসশীল জগতের মানুষ। তোমার প্রতিশ্রুতিও ধ্বংসশীল।
মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন এবং সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সুড়ঙ্গের অপর মুখটাও দেখতে পান।
সুড়ঙ্গের ভেতরের তুলনায় বাইরে অন্ধকার কম। তাই সুড়ঙ্গের মুখটা দেখা যাচ্ছে। সুরমা বর্ণের এই আলোতে লম্বা মতো একটি ছায়া দেখা গেলো, যা তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়, যা কিনা দেখতে কাফনে পেঁচানো মেয়েটির ন্যায়। মাহদী আল-হাসান সামনের দিকে দৌড় দেন। কিসের সঙ্গে যেনো হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। উঠে আবার দৌড় দেন। সুড়ঙ্গের অপর মুখের কাছে গিয়ে হাঁক দেন। কিন্তু নিজের ধ্বনির প্রতিধ্বনি ব্যতীত আর কোন উত্তর মেলেনি। কান্নার শব্দও শুনতে পেলেন না। তিনি হতাশ মনে ফেরত রওনা হন।
এখনো তিনি সুড়ঙ্গের অর্ধেক অতিক্রম করেননি, এমন সময় সুড়ঙ্গের সম্মুখপানে আলো ঝলসে ওঠে। কিন্তু এই আলোতে কাফন জড়ানো লাশ নেই।
আলো নিভে গেছে। মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসেন। সম্মুখে এবং খানিক বায়ে উঁচুতে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেটা অন্য কোন দিকের আলো, যেনো কেউ কোনো গর্তে কিংবা টিলার পেছনে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। মাহদী আল-হাসান কি যেনো ভাবেন এবং যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে হাঁটা দেন। তিনি এই পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যান। উটটা বাইরে বাঁধা ছিলো। তিনি উটের পিঠে চড়ে বসে কায়রো অভিমুখে রওনা দেন। মনে তার কোন ভীতি নেই। তবে কেমন যেনো অস্থিরতা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। তিনি পাহাড়ের অভ্যন্তরে দেখে আসা আলো দুটির ব্যাপারে ভাবছেন।
মাহদী আল-হাসান গন্তব্যে পৌঁছে যান। এখন গভীর রাত। তবু তার ঘুম আসছে না। বারংবার কাফন জড়ানো লাশটা চোখের উপর ভেসে উঠছে।
***
অভ্যাসমত মাহদী আল-হাসান ভোরবেলা উঠে পড়েন। যন্ত্রের ন্যায় নিত্যদিনের কাজগুলো সেরে নেন। আলী বিন সুফিয়ানের নিকট গিয়ে নতুন নির্দেশনা লাভ করেন, এই এলাকায় তার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে এবং তাকে শহরের বাইরে অন্য কোথাও যেতে হবে।
না- মাহদী আল-হাসান বললেন- আমাকে এখানে আরো কদিন কাজ করতে দিন। আমি আশা করি এই পার্বত্য অঞ্চল থেকে কিছু একটা পেয়ে যাবো। দুতিন দিন পর আপনাকে বলতে পারবো অঞ্চলটা নিরাপদ কিনা।
আলী বিন সুফিয়ান মাহদী আল-হাসানের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন না। মাহদী সাধারণ কোন গুপ্তচর নন। একটি অঞ্চলের দায়িত্বশীল এবং অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি।
খানিক আলোচনা ও চিন্তা-ভাবনার পর আলী বিন সুফিয়ান মাহদী আল-হাসানকে উক্ত এলাকায় ফিরে যাওয়ার অনুমিত প্রদান করেন। মাহদী আল-হাসান পেতাত্মার মিলন লাভ না করে এলাকা ত্যাগ করতে রাজি নন। এ-ই বোধ হয় প্রথম ঘটনা, যেখানে তিনি ব্যক্তিগত বাসনাকে কর্তব্যের উপর প্রধান্য দিলেন। আলী বিন সুফিয়ান যদি ঘুণাক্ষরে টের পেতেন, মাহদী আল-হাসান অন্য কোনো মতলবে ডিউটি পরিবর্তন করতে নারাজ, তাহলে এক মুহূর্তের জন্যও তাকে এই ডিউটিতে বহাল রাখতেন না। একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিজেকে এমন একটা ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করছেন, যাতে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে!
মাহদী আল-হাসান হাকীমের নিকট চলে যান। তাকে রাতের ঘটনা শোনান। হাকীম চোখ বন্ধ করে মাথানত করে মনে মনে অস্ফুট স্বরে বিড় বিড় করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে মাথা তুলে মাহদী আল হাসানের চোখের ভেতর তাকান।
আজ রাত আবার যাও- হাকীম বললেন- পাক জগতের একটি প্রাণী। এই নাপাক দুনিয়ার মানুষের কাছে ঘেঁষতে ভয় পাচ্ছে। তুমি সরলতা প্রদর্শন করবে। হয়তো বা আজো কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তুমি অধৈর্য হবে না। সে তোমার সাক্ষাতের জন্য অস্থির হয়ে আছে। অবশ্যই মিলিত হবে। এই মিলনে যদি তোমার কোনো উপকার না থাকতো, তাহলে আমি তোমাকে সেখানে পাঠাতাম না। তোমার জীবনেরও কোন আশঙ্কা নেই।
মাহদী আল-হাসান চলে যান। ডিউটির এলাকায় ঘোরাফেরা করেন। সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়েন। অপর প্রান্তে চলে যান। সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে নীচে অবতরণ করেন। মাটিতে এক টুকরা কাপড় পড়ে থাকতে দেখেন। কাপড়টা তুলে নেন। আধা ইঞ্চি চওড়া এবং আধা গজ লম্বা এক খন্ড কাপড়। মাহদী আল-হাসান কাপড়টা নেড়ে চেড়ে দেখতে শুরু করেন। তারপর কাপড়টুকু হাতে করেই পুনরায় সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়ে অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তিনি উপরের দিকে তাকান, যেখানে গত রাতে আগুন দেখেছিলেন। ওদিকটা ঢালু। মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে ঢালু বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেন। এবার তিনি একটি পুরুষালী কণ্ঠ শুনতে পান- উপরে এসো না। তুমি যার জন্য এসেছে, তার সঙ্গে তোমার রাতে সাক্ষাৎ হবে।
শব্দটি গুঞ্জরিত হয়ে বার বার কানে বাজতে থাকে।
আমাদের জগতে এসে এভাবে খুঁজে ফিরো না। কণ্ঠটা পুনরায় ভেসে আসে।
মাহদী আল-হাসান থেমে যান। তার মনে হচ্ছে, শব্দটা তার চার পার্শ্বে ঘুড়ে ফিরছে। তিনি উপরে উঠলেন। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকেন। তিনি সতর্ক থাকার চেষ্টা করছেন, যেনো তার দ্বারা এমন কোনো আচরণ না ঘটে, যার ফলে এখানকার কোনো প্রেতাত্মা তার কোনো ক্ষতি করে বসে।
মাহদী আল-হাসান স্থানটা ত্যাগ করে পেছনে ফিরে আসেন। এক স্থানে বসে ভাবতে শুরু করেন, জায়গাটার আসল রহস্য কী? এই ভাবনার মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। রাতে আবার আসবেন স্থির করে ফিরে যান।
***
সূর্যাস্তের পর। মাহদী আল-হাসান রাখালের বেশ পরিবর্তন করে নতুন বেশ ধারণ করেন। দিনের বেলা ডিউটির সময় তার কাছে লম্বা একটা খঞ্জর থাকে। হাকীম তাকে জোরালোভাবে বলে দিয়েছেন, রাতে প্রেতাত্মার সাক্ষাতে যাওয়ার সময় সঙ্গে খঞ্জর বা অন্য কোন অস্ত্র রাখা যাবে না। গত রাতেও খঞ্জর নেননি। এখন তিনি রওনা হবেন। খঞ্জরটা দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে। মাহদী আল-হাসান খঞ্জরটার প্রতি তাকান এবং কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। হাকীমের নির্দেশনা মান্য করলে খঞ্জরটা নেয়া যায় না। কিন্তু মাহদী আল-হাসান ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেন, যা হয় হবে, আজ খঞ্জর নিয়ে যাবো। তিনি খঞ্জরটা দেয়াল থেকে হাতে তুলে নেন। পোশাকের ভেতর কোমরের সঙ্গে অস্ত্রটা বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
উটটা গতকালের জায়গায় বসিয়ে রেখে মাহদী আল-হাসান পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন এবং পায়ে হেঁটে সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছেন, যেখান থেকে সুড়ঙ্গের মুখটা দেখা যায়। মাহদী আল-হাসান পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পান, যা তৎক্ষণাৎ নীরব হয়ে যায়। পরক্ষণেই উপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ কানে আসে, যা অতোটা উচ্চ নয়। কিন্তু এমন সুনসান নীরবতার মধ্যে গড়িয়ে পড়া পাথরটি স্থির হওয়ার পরও শব্দটি কানে বাজতে থাকে। তারপর শব্দটি গুঞ্জরণে পরিণত হয়ে শূন্যে সাঁতার কাটতে শুরু করে, যেনো কোন মানুষ কান্নার পর ফোঁপাচ্ছে। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এবার মাহদী আল-হাসান কারো কান্নার শব্দ শুনতে পান।
আমার সম্মুখে এসে যাও- মাহদী আল-হাসান উচ্চস্বরে বললেন আমার জগত অপবিত্র–আমি অপবিত্র নই।
তুমি আমাকে আবারো ছেড়ে চলে যাবে- নিকটের কোনো এক স্থান থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে।
মাহদী আল-হাসানের আওয়াজ আর উক্ত নারীকণ্ঠের আওয়াজ বারংবার কানে আসতে থাকে, যেনো একে অপরের পেছনে ছুটে চলছে। হঠাৎ এক স্থানে আলো ঝলসে ওঠে এবং নিভে যায়। মাহদী আল-হাসান এই আলোতে সুড়ঙ্গের মুখটা দেখতে পান। তিনি লম্বা পায়ে সম্মুখে এগিয়ে যান এবং সুড়ঙ্গের মুখের সামান্য নীচে বড় একটি পাথরের পেছনে লুকিয়ে পড়েন। তিনি গত রাতে উপরে যে স্থানটিতে আগুন দেখেছিলেন, তার প্রতি তাকান। আগুন তো নয়- ছিলো প্রবঞ্চনা। সেই প্রচঞ্চনা আজো বিদ্যমান।
সুড়ঙ্গের মুখটা অপেক্ষাকৃত উঁচু। মাহদী আল-হাসান উপুড় হয়ে পেটে ভর করে ধীরে ধীরে উপরে উঠে যান। কয়েক মুহূর্ত পরই তিনি সুড়ঙ্গের মুখে ঢুকে পড়েন। সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে উপরে যেদিক থেকে আগুনের প্রবঞ্চনাটা আসছিলো, সেদিকে তাকান। তিনি আগুনের এমন একটি আলো দেখতে পান, যার শিখা কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পান দুহাজার বছর যাবত আমি তোমার পথ পানে চেয়ে আছি।
মাহদী আল-হাসান সুড়ঙ্গের দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে আরো ভেতরে চলে যান। তার মনে পড়ে যায়, হাকীম তাকে বলেছিলেন, সঙ্গে অস্ত্র নেবে না। অন্যথায় মেয়েটির আত্মা তোমার সম্মুখে আসবে না। এখন তার সঙ্গে দেড়ফুট লম্বা একটা খঞ্জর আছে। তথাপি প্রেতাত্মাতার সঙ্গে কথা বলছে। তিনি আরো এগিয়ে যান এবং সুড়ঙ্গের মধ্যস্থলে পৌঁছে যান। সুড়ঙ্গটা বেশ প্রশস্ত। তিনি কারো আগমন অনুভব করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেয়ালের কোল ঘেঁষে বসে পড়েন। কে একজন তার গা ঘেঁষে অতিক্রম করতে শুরু করে। এতো ঘোর অন্ধকারেও তিনি অনুমান করতে সক্ষম হন, লোকটি সেই মেয়ে এবং কাফনের কাপড়ে জড়ানো।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে যায় এবং কান্নার ভান ধরে। মাহদী আল-হাসান এই শব্দ পূর্বেও কয়েকবার শুনেছেন। তার বুকটা ধড়ফড় করতে শুরু করে। কাফন-জড়ানো মেয়েটি মাথাটা মাহদী আল-হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। ঠিক তখন সুড়ঙ্গের মুখ আলো জ্বলে উঠে ও নিভে যায়। মাহদী আল হাসান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যান এবং বিদ্যুতিতে পেছন থেকে মেয়েটিকে ঝাঁপটে ধরেন। মেয়েটি বলে ওঠে- ওরে হতভাগা! এটা রসিকতার সময় নয়। আমাকে ছেড়ে দাও। অন্যথায় বিপদে পড়বে।
মাহদী আল-হাসান যে সন্দেহে জীবনের বাজি লাগিয়ে মেয়েটাকে ধরে ফেলেছেন, তা নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন, এটা যদি প্রেতাত্মা হতো, তাহলে তিনি তাকে ধরতে পারতেন না। আর সত্যিই যদি এটা প্রতারণা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছেন।
কাফন, জড়ানো নারীর কণ্ঠ শোনামাত্র মাহদী আল-হাসান তার কানে কানে বললেন- উচ্চস্বরে কথা বললে খঞ্জরটা পাজরের এক পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য পাশ দিয়ে বের করবো।
আর আমি তোমার হৃদপিন্ড ও কলিজাটা মুখের পথে বের করে চিবিয়ে খাবো- মেয়েটি বললো- আমি আত্মা।
মাহদী আল-হাসান এক হাতে মেয়েটার বাহু ধরে রেখে অপর হাতে খঞ্জর বের করে তার আগাটা মেয়েটার পাজরে ঠেকিয়ে ধরেন। সুড়ঙ্গের সম্মুখের মুখে আরেকবার আলো জ্বলে ওঠে। ওদিকে যাওয়া মাহদী আল হাসানের জন্য বিপজ্জনক।
আমি এ কারণেই তোমাকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছিলাম না যে, তুমি প্রতারক এবং ধ্বংসশীল জগতের মানুষ- মেয়েটি ক্ষীণ অথচ ক্রিয়াশীল ভঙ্গিতে বললো- দুই হাজার বছর যাবত আমি তোমার পথপানে তাকিয়ে আছি।
তোমার অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে- মাহদী আল-হাসান বললেন- এখন আর তুমি পাক জগতে ফিরে যেতে পারবে না। তুমি এখন আমাদের অপবিত্র জগতের নারী।
আমি নারী নই- মেয়েটি বললো- আমি তরুণী। আমি রূপসী মেয়ে। আমি উচ্চশব্দে কথা বলবো না। আমার বক্তব্য গভীরভাবে শোনো। আমি জানি তুমি কে এবং এখানে কেন এসেছে। তোমাকে আমার এতো ভালে লাগে যে, আমি তোমাকে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এই পন্থা অবলম্বন করেছি।
তাহলে আমার সঙ্গে চলো। মাহদী আল-হাসান বললেন।
না- মেয়েটি বললো- তোমার সঙ্গে গেলে আমরা না খেয়ে মারা যাবো। বরং তুমি আমার সঙ্গে চলল। তাহলে ফেরাউনদের সব ধনভান্ডার আমাদের হবে। তখন আর তোমাকে মরু বিয়াবান ও পাহাড়-বনে ঘুরে ফিরতে হবে না এবং সামান্য বেতন-ভাতার বিনিময়ে কারো গুপ্তচরবৃত্তি করে বেড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
এখানে তুমি কী করছো?
ধনভান্ডার উত্তোলন করছি- মেয়েটি বললো- আমার সঙ্গে অনেক লোক আছে।
তারা কোথায়?
আমার সঙ্গে চলো- মেয়েটি বললো- সকলে তোমাকে স্বাগত জানাবে। আমাকে আলোতে দেখলে তুমি যতোসব ধনভান্ডার আর নিজের জগতের কথাই ভুলে যাবে।
মেয়েটির সুরভিত দেহ অন্ধকারের মধ্যে মাহদী আল-হাসানকে বিমোহিত করে তুলছে। তার দেহের সৌরভে মাতাল করে তুলছে সুলতান আইউবীর এই পরিপক্ক ঈমানদার গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে। তিনি প্রথম যখন মেয়েটাকে ঝাঁপটে ধরেছিলেন, তখনই আঁচ করে নিয়েছেন, এই দেহ ঈমান ক্রয়ের ক্ষমতা রাখে। কণ্ঠটাও তার সুরেলা। মাদকতা ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে তুলছে মাহদী আল-হাসানকে।
ঠিক সে সময়ে সুড়ঙ্গের মুখে আবারো আলো জ্বলে ওঠে। মাহদী আল হাসান চৈতন্য ফিরে পান। তিনি মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করা সমীচীন মনে করলেন না, সুড়ঙ্গের পেছনেও তার লোকেরা আছে কিনা। সম্মুখের মুখে বের হতে চাচ্ছেন না তিনি। কারণ, তিনি নিশ্চিত, ওদিকে মানুষ আছে এবং তারাই আলো জ্বালাচ্ছে ও নেভাচ্ছে।
ওঠো- মাহদী আল-হাসান মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করালেন এবং বললেন- কাফনটা খুলে ফেলল।
মেয়েটি দেহ থেকে কাফনটাকে খুলে ফেলে। মাহদী আল-হাসান কাপড়টা ছিঁড়ে তিনটি টুকরা বের করেন। একটি দ্বারা মেয়েটির দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধেন। একটি দ্বারা টাখনুর কাছে দিয়ে পা দুটো বাধেন এবং অপর খন্ড দ্বারা মুখটা বেঁধে তাকে কাঁধের উপর তুলে নেন। খঞ্জরটা হাতে আছে। তিনি সুড়ঙ্গের পেছন মুখের দিকে হাঁটা দেন। এখান থেকে তাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
মাহদী আল-হাসান গতরাতে যখন এখানে এসেছিলেন, তখন প্রেতাত্মার সঙ্গেই মিলিত হতে এসেছিলেন। তখন সুড়ঙ্গের মুখে আলোর ঝলকের মধ্যে তার কাঙ্খিত আত্মাটিকে এক নজর দেখেছিলেন। আজ দিনের বেলা এসে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে অপর প্রান্ত দিয়ে বের হয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাটিতে পড়ে থাকা পাতলা এক চিলতে কাপড় দেখতে পেয়েছিলেন। কাপড়টা দেখামাত্র তার মনে পড়ে যায়, এরূপ কাপড় দ্বারা মৃত ব্যক্তিকে কাফন পরানো হয়। মাহদী আল-হাসান আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণ ও দীক্ষাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। সামান্য বিষয় এবং সূক্ষ্য ইঙ্গিতকে তিনি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকেন। আজ রাত যখন প্রেতাত্মার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তখন হাকীমের বারুণ সত্ত্বেও তিনি খঞ্জরটা সাথে করে নিয়ে এসেছেন। এটা পরীক্ষার একটা পদ্ধতি। সঙ্গে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও প্রেতাত্মা তাকে ধরা দিয়েছে। হাকীমের তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
মাহদী আল-হাসান সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি সুড়ঙ্গের মুখে আলোর ঝিলিক দেখামাত্র সেখানে চলে যান এবং সেখান থেকে উপর দিকে তাকিয়ে দেখেন। সেখানেই আগুনের শিখা লুকায়িত ছিলো। সুড়ঙ্গের মুখের আলোটা সেখান থেকেই আসছিলো।
মাহদী আল-হাসানের এ জাতীয় অন্য দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সে ঘটনায় বেশ কজন খৃস্টান এজেন্ট পাকড়াও হয়েছিলো এবং তাদের প্রতারণার কৌশল ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। অন্যথায় সরল মানুষেরা এ জাতীয় আলোকে গায়েবের জ্যোতি বলেই বিশ্বাস করতো। উক্ত ঘটনা দুটোতে অভিযান পরিচালনাকারীদের মধ্যে মাহদী আল-হাসানও ছিলেন। তিনি বুঝে ফেললেন, সুড়ঙ্গের ঠিক বিপরীতে পাহাড়ের উঁচুতে যে অগ্নিশিখা দেখা যাচ্ছে, সুড়ঙ্গের মুখে তারই আলো এসে পড়ছে।
প্রশিক্ষণের সময় মাহদী আল-হাসান জানতে পেরেছিলেন, মৃত্যুবরণ করার পর ইহ-জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ তার আত্মাকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দেন না যে, সে মানুষের পেছনে পেছনে ছুটে বেড়াবে। যে মৃত্যুবরণ করে, সে না দৈহিকভাবে ফিরে আসে, না আত্মা কিংবা প্রেতাত্মার আকৃতিতে। প্রশিক্ষণের সময় মাহদী আল-হাসানের মনে দৃঢ়তার সঙ্গে এই বিশ্বাস জন্মানো হয়েছিলো যে, আল্লাহ মানুষকে এতো বেশি দৈহিক ও আত্মিক শক্তি দান করেছেন যে, সে পাহাড়-পর্বতকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। ঈমান যতো শক্ত হবে, এই শক্তি ততো বেশি হবে। ভূত-প্রেতের বিশ্বাস মানুষের মস্তিষ্কের সৃষ্টি। খৃস্টানরা আমাদের ঈমানকে দুর্বল করার লক্ষ্যে অলীক ধ্যান-ধারণা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে।
এই শিক্ষাটা জাতির প্রতিজন মানুষেরই পাওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এটা সম্ভব ছিলো না। সুলতান আইউবী যে লড়াকু গোয়েন্দা তৈরি করেছেন, বহু কষ্টে তাদেরকে ঈমানী শক্তির ধরণ ও প্রকৃতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তাদেরকে অলীক ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাদেরকে বাস্তব দীক্ষাও প্রদান করা হয়েছে।
খৃস্টানরা তোমাদের সম্মুখে হযরত ঈসাকে ধরায় নামিয়ে এনেছিলো মাহদী আল-হাসানের আলী বিন সুফিয়ানের একটি পাঠ মনে পড়ে যায়–তোমাদের সম্মুখে খোদাকেও নামিয়ে এনেছিলো। এখন ধরে এনেছে প্রেতাত্মাদের। এ প্রতারণা তুমি নিজ চোখে দেখেছো। এও দেখেছো, এই প্রতারণার জালকে তারা কীরূপ নৈপুণ্যের সাথে বিছিয়ে থাকে। তুমি তো স্বচক্ষে দেখেছো, ওসব ভেল্কিবাজি ছিলো। সেসব তৎপরতা ছিলো ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, যা তোমরা ব্যর্থ করে দিয়েছে। আল্লাহ পূর্ব থেকেই পৃথিবীতে আছেন। আল্লাহ আমাদেরকে নূর দান করেছেন। খৃস্টানরা মুসলমানদের হৃদয়জগত থেকে সেই নূরকে নিভিয়ে ফেলতে সদা তৎপর।
সুলতান আইউবী তার ফৌজ, বিশেষত তার জানবাজ সৈন্যদের অন্তরে এই নীতি প্রোথিত করে দিয়েছেন- তোমরা আল্লাহর নামে যতো ঝুঁকি মাথায় তুলে নেবে, তা ঝুঁকি থাকবে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাহায্য লাভ করবে। আজ যদি তোমরা কুসংস্কারে শিকার হয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঈমান এতো দুর্বল হবে যে, তারা কুফরের সম্মুখে অস্ত্রসমর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করবে না।
এমনি আরো কিছু পাঠ মাহদী আল-হাসানের মনে পড়ে যায়। নিজে কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সেই অনুভূতিও তার হৃদয়ে জাগরুক হয়ে ওঠে।
***
মাহদী আল-হাসান মেয়েটির হাত-পা বেঁধে তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সুড়ঙ্গের অপর মুখের দিকে এগিয়ে যান। প্রশিক্ষণের সব পাঠ তার মনে পড়ে যায়। এখন তার চার পার্শ্বে সুলতান আইউবীর কণ্ঠ গুঞ্জরিত হচ্ছে একজন বিশ্বাসঘাতক যেমন সমগ্র জাতিকে অপমান ও লাঞ্চনার মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারে, তেমনি একজন স্বাধীনতাকামী ঈমানদার জানবাজও গোটা জাতিকে বড় বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।
মাহদী আল-হাসানের হৃদয়ে এই অনুভূতিটা এক শক্তিশালী চেতনার রূপ ধারণ করে জেগে ওঠে যে, আমার জাতি- দেশবাসী যে গভীর ঘুম ঘুমায়, তা তারই উপর ভরসা করে ঘুমায়। তিনি গোয়েন্দাদের পাতাল যুদ্ধের জানবাজ সৈনিক। তার জানা আছে, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশাল বাহিনী ও অশ্বারোহী সৈন্যদের ঝড় এবং তীর বৃষ্টির মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু দুশমনের গুপ্তচর ও নাশকতাকারীদের মোকাবেলা স্রেফ এক দুজন গোয়েন্দাই করতে পারে। মাহদী আল-হাসান জাতির প্রহরী ও নিরাপত্তার জিম্মাদার। কিন্তু একটি প্রশ্ন তাকে পেরেশান করে ফিরছে তাহলে হাকীম সাহেবও কি দুশমনের নাশকতাকারী চক্রের সদস্য?
এভো বড় একজন আলেম, দেশের এমন নামকরা এজন ডাক্তার প্রশাসনের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাগণ পর্যন্ত যাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন দুশমনের সঙ্গী হতে পারেন, মাহদী আল-হাসানের মন মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে যায়, প্রশিক্ষণের সময় বলা হয়েছিলো এবং তার বাস্তব অভিজ্ঞতাও যে, কোনো পদমর্যাদা, সুনাম-সুখ্যাতি ঈমান বিক্রয়ের পথে প্রতিবন্ধক নয়। যার আছে, ঈমান সে-ই বিক্রয় করতে পারে। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ঈমান উচ্চপদের লোকেরাই বেশি বিক্রয় করে থাকেন। তাদের ঈমানের মূল্য অধিক।,
এখন মাহদী আল-হাসানের সম্মুখে সমস্যা, মেয়েটাকে নিয়ে তিনি কোন পথে বের হবেন এবং উট পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছবেন। মেয়েটার থেকে তিনি পথনির্দেশ নিতে চাচ্ছেন না। কারণ, ভুল নির্দেশনা দিয়ে সে তাকে নতুন কোন ফাঁদে আটকাতে পারে। যে পথে বের হওয়া প্রয়োজন, সে পথ বন্ধ। সুড়ঙ্গের অপর মুখে বের হয়ে কোন্ পথে যেতে হবে, তার জানা নেই।
মাহদী আল-হাসান মেয়েটাকে নিয়ে সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসেন। সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে কিছুদূর নিয়ে এক স্থানে মেয়েটাকে মাটিতে বসিয়ে রাখেন এবং তার মুখ থেকে কাপড়টা খুলে দিয়ে বললেন- বলবে কি আমি কোন্ পথে যাবো, যে পথে তোমার কোন লোক নেই?
বলবো, যদি একা যাও।
তুমিও আমার সঙ্গে যাবে–মাহদী আল-হাসান বললেন- আমাকে ফাসাবার চেষ্টা করলে তোমাকে বেঁচে থাকতে দেবো না। প্রয়োজন হলে নিজেও জীবন দেবো।
তুমি যেসব ভেদ জানতে চাচ্ছো, আমি সব বলে দেবো। তবু তুমি একাকি যাও।
সব ভেদই আমার জানা হয়ে গেছে- মাহদী আল-হাসান বললেন তুমি আমাকে পথ দেখাও।
একটিবার মাত্র আমাকে আলোতে দেখে নাও-মেয়েটি বললো তারপর আমাকে নিজের মনে করো। একটিবারের জন্য আমার সঙ্গে চললো। আমি তোমাকে ধোকা দেবো না।
মেয়েটি মাহদী আল-হাসানের পৌরুষে সুড়সুড়ি জাগানোর চেষ্টা চালায়, সোনা-জহরতের প্রলোভন দেখায়; কিন্তু রাস্তা দেখাচ্ছে না। মাহদী আল-হাসান পুনরায় কাপড় দ্বারা তার মুখটা বেঁধে ফেলেন এবং আপনা থেকে একটি নিরাপদ রাস্তা আবিষ্কার করে নেন। এই পথটা পর্বতমালার উপর দিয়ে। তিনি হাত-পা বাঁধা মেয়েটাকে সেখানেই বসিয়ে রেখে নিজে উপরে আরোহণ করতে শুরু করেন। কিন্তু নীচে কানো শব্দ শুনে সেখানেই থমকে দাঁড়ান। এক পুরুষ মেয়েটাকে ডাকছে। মাহদী আল-হাসান ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসেন এবং মেয়েটির সন্নিকটে একটি পাথরের আড়ালে বসে পড়েন। লোকটি বোধ হয় মেয়েটাকে দেখে ফেলেছে।
তুমি কথা বলছো না কেন?- লোকটি জিজ্ঞেস করে এবং উপরে উঠে আসতে শুরু করে। মেয়েটার মুখ বন্ধ। লোকটি তার একেবারে কাছে চলে এসে বললো- কী হয়েছে তোমার? ওদিকে যাওনি কেননা
মাহদী আল-হাসান তার পার্শ্বেই বসা। ব্যবধান দু-চার পায়ের। তিনি উঠে সর্বশক্তি ব্যয়ে লোকটির পিঠে খঞ্জরের আঘাত হানেন। পরক্ষণেই আরেক আঘাত। দুটি আঘাতই সফল হয়। লোকটি কোনো শব্দ করারও সুযোগ পেলো না। মাহদী আল-হাসান তাকে টেনে নিয়ে সেই পাথরটার নীচে ফেলে দেন, যার তলে তিনি নিজে লুকিয়ে ছিলেন। তিনি মেয়েটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পাহাড়ের উপর উঠে যান। পাহাড়টা তেমন উঁচু নয়। তবে উপরটা চওড়া। তিনি হাঁটতে শুরু করেন।
মাহদী আল-হাসানের জন্য সহজ উপায় এটাই ছিলো যে, তিনি রাতটা কোথাও লুকিয়ে থাকবেন এবং দিনের আলোতে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু তাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কায়রো পৌঁছে যেতে হবে, যাতে রাত পোহাবার আগে আগেই হাকীমের গ্রেফতারী এবং এই অঞ্চলটাকে অবরোধ করে ফেলার আয়োজন করা যায়।
এই পার্বত্য ভূখন্ডটির অভন্তরে- যে পর্যন্ত কোন পথচারি কিংবা রাখাল গেছে না- এক পাহাড়ের পাদদেশে একটি গুহার মুখ আছে। মুখটি অপ্রশস্ত। তারই পেছনে এতো প্রশস্ত এক গুহা, যেনো ওটা গুহা নয় সুপরিসর একটি কক্ষ। তার মধ্যে বসে আছে বহু সংখ্যক মানুষ। দুটি মেয়েও আছে।
এ যাবত তো তার ফিরে আসার কথা ছিলো। একজন বললো।
এসে পড়বে- অপর একজন বললো- এখানে কোনো বিপদ নেই। আজ সে তাকে নিয়েই আসবে।
লোকটা কাজের- একজন বললো- বেটা অনেক অভিজ্ঞ। আমরা তাকে প্রস্তুত করে নেবো।
এমন সময় এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে ভেতরে ঢুকে বললো- গোপাল মৃত পড়ে আছে। মেয়েটির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গোপালকে খঞ্জরের আঘাতে মারা হয়েছে!
ওহ, মাহদী আল-হাসান কোথায়? একজন জিজ্ঞাসা করে।
কোথাও পাওয়া যায়নি- আগন্তুক জবাব দেয়- তার উট এখানেই আছে। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
দুটি প্রদীপ হাতে নিয়ে সবাই গুহা থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করে। তারা সুড়ঙ্গের মুখ পর্যন্ত গিয়ে খোঁজাখোজি করে। ওখানে তাদের সঙ্গীর লাশ পড়ে আছে। তারা সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে দেখে মেয়েটির কাফনটা পড়ে আছে। দলনেতা বললো, দুজন লোক বাইরে চলে যাও। বাইরের দিক থেকে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সংবাদ দিও। আর তাকে পাওয়া গেলে ধরে ফেলে। মোকাবেলা করলে মেরে ফেলল। অন্যরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ো। লোকটা এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। সকাল পর্যন্ত পাওয়া না গেলে আমাদের এ স্থান ত্যাগ করতে হবে।
মাহদী আল-হাসান মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে এখন মহা বিপাকে। সুড়ঙ্গওয়ালা পাহাড় থেকে তিনি অনেক দূরে চলে এসেছেন। সামনের পাহাড়টি বেশ উঁচুও বটে। যেন একটি প্রাচীর, যার উপর এক সঙ্গে উভয় পা রাখা অসম্ভব। তিনি এই দেয়ালসম পাহাড়টির উপর ঘোড়ার পিঠে বসার মতো বসে পড়েন। বসে বসে সম্মুখের দিকে এগুতে থাকেন। মেয়েটিকে কাঁধের উপর সামলে রাখা এবং তার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মেয়েটিও তার ভারসাম্য ব্যাহত করার জন্য নড়াচড়া করতে শুরু করে। মাহদী আল-হাসান বুঝে, এখান থেকে পড়ে গেলে হাড়-গোড় ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাবে। তারপরও মেয়েটির এই আত্মঘাতি আচরণ। তা থেকেই তিনি অনুমান করে নেন, এই পার্বত্য এলাকায় যে রহস্য আছে- যার সবকিছু এই মেয়েটির বক্ষে প্রোথিত- এতই মূল্যবান এবং স্পর্শকাতর যে, তাকে লুকাবার স্বার্থে মেয়েটি মাহদী আল হাসানকেসহ পড়ে গিয়ে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে।
মাহদী আল-হাসান এগিয়ে চলছেন। কিন্তু পথ শেষ হচ্ছে না। মেয়েটি তাকে ব্যাঘাত করেই যাচ্ছে। ওদিকে মেয়েটির দলের লোকেরা অনুসন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতিটা তাদের জন্য জীবন-মরণের প্রশ্ন। আস্তানা ধরা পড়া তাদের জন্য পরাজয় ধরা পড়লে অসহনীয় নির্যাতন আর মৃত্যু অনিবার্য।
মাহদী আল-হাসান মেয়েটির একটি বাহু এমন শক্তভাবে ধরে রেখেছেন যে, তার হাড়-গোড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই মুহূর্তে দৈহিক শক্তি ও সাহসিকতা ছাড়াও তিনি আত্মিক শক্তিও প্রয়োগ করছেন। অবশেষ সব শক্তির বিনিময়ে তিনি প্রাচীর অতিক্রম করে অপর প্রান্তে পৌঁছে যেতে সক্ষম হন।
সামনের চূড়াটা বেশ চওড়া। মাহদী আল-হাসান মেয়েটিকে ধপাস্ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন- তুমি কি আমার পথ আগলেই বাখবে? ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি মেয়েটিকে চীৎ হওয়া অবস্থায় কয়েক পা হেঁচড়ে নেন এবং বললেন- আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি করলে এভাবে টেনে-হেঁচড়েই নিয়ে যাবো। মরতেই যদি চাও, তো মরে যাও।
মাহদী আল-হাসান দূরে নীচে একটি প্রদীপ দেখতে পান। তিনি অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তবে এই ভেবে আশ্বস্ত হন যে, এখন তিনি আপদমুক্ত। ধরা পড়ার আশঙ্কা আর নেই। কিন্তু এখান থেকে বের হওয়া সহজ হবে না। অথচ, তাকে অতি দ্রুত কায়রো পৌঁছতে হবে। তিনি মেয়েটির পা খুলে দেন। হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা আছে। তাকে নিজের সম্মুখে নিয়ে এসে খঞ্জরের আগা তার পিঠের সঙ্গে লাগিয়ে বললেন- চলো, আমার কথা ছাড়া ডানে-বাঁয়ে তাকাবে না। মাহদী আল-হাসান ও মেয়েটির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়া লোকগুলো সুড়ঙ্গ পথ ও তার আশপাশের এলাকায় ঘুরে ফিরছে। তিনি যে পথে ভেতরে যাওয়া-আসা করেছেন, দুব্যক্তি সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
***
মাহদী আল-হাসান মেয়েটিকে নিয়ে চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে এমন এক টিলায় এসে পৌঁছান, যার সম্মুখে আর কিছু নেই। তার এতোটুকু দক্ষতা আছে যে, তিনি ঘোর অন্ধকারেও অপরিচিত এলাকার ভাব-গতি আন্দাজ করতে পারেন। তিনি বুঝে ফেললেন, নীচে নদী এবং এটাই নীল নদ। তিনি মেয়েটির হাতের বন্ধন খুলে দেন। মুখের কাপড়ও সরিয়ে নেন। টিলার ঢাল খাড়া। তিনি মেয়েটিকে বললেন, বসো এবং নীচে পড়ে যাও।
উভয়েই নিজেদেরকে টিলার ঢালে ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে আসেন। নদীর পানির কলকল ধ্বনি স্পষ্ট শোনা যেতে শুরু করে। মাহদী আল-হাসান ও মেয়েটি এখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাহদী আল-হাসান মেয়েটিকে বললেন–ঝাঁপ দাও। মেয়েটি বললো- আমি সাঁতার জানি না।
মাহদী আল-হাসান খঞ্জরটা কোষবদ্ধ করে কোমরের সঙ্গে বেঁধে নেন। মেয়েটিকে শক্তভাবে বগলদাবা করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নদীর গতি কায়রোরই দিকে। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর হঠাৎ তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আস্তে করে মেয়েটিকে ছেড়ে দেন। দেখলেন, মেয়েটি নৈপুণ্যের সাথেই সাঁতার কাটছে।
আমি জানতাম, তুমি সাঁতার জানো- মাহদী আল-হাসান সাঁতার কাটতে কাটতে বললেন- সব বিদ্যায় পারদর্শী বানিয়েই তোমাদেরকে আমাদের দেশে পাঠানো হয়। বেশি পরিশ্রম করো না। আমরা যেদিকে যাচ্ছি, স্রোতের গতিও সেদিকেই।
মেয়েটি সাঁতার কাটা অবস্থায় মাহদী আল-হাসানকে নিজের রূপবান টাটকা শরীরটা শেকলে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে; কিন্তু তার প্রচেষ্টা বিফল যায়।
বেশ কিছুদূর পথ অতিক্রম করার পর মাহদী আল-হাসান ভাবলেন বিপদের আর কোনো শঙ্কা নেই। তিনি মুখে দুটি আঙুল ঢুকিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে পদ্ধতিতে শিশ বাজান। এখন তিনি সাঁতার কাটছেন আর কিছুক্ষণ পর পর শিশ বাজান। অল্পক্ষণ পর তিনি দূর থেকে অনুরূপ একটি শিশ শুনতে পান। পরক্ষণেই দুদিক থেকে শিশ বিনিময় হতে হতে একটি নৌকা তাদের নিকটে এসে পৌঁছে।
মাহদী আল-হাসানের জানা ছিলো, যেভাবে সীমান্ত এলাকায় দেশের সীমান্ত নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে টহা সান্ত্রীরা ঘুরে বেড়ায়, তেমনি নদীতেও টহল প্রহরা থাকে। বিপদ দেখা দিলে একজন অন্যজনকে ডাকার জন্য এভাবে শিশ বাজিয়ে থাকে। এই নৌকাটাও টহল সান্ত্রীদের। মাহদী আল-হাসান তাদেরকে নিজের পরিচয় প্রদান করেন। সান্ত্রীরা তাকে ও মেয়েটিকে নৌকায় তুলে নেয়।
মেয়েটির সাঙ্গরা তাকে পাহাড়ে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে।
***
আলী বিন সুফিয়ান গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। এক চাকর তাঁকে জাগিয়ে বললো, মাহদী আল-হাসান নামক এক লোক একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মাহদী আল-হাসান নামটাই যথেষ্ট ছিলো। আলী বিন সুফিয়ান ধড় মড় মরে উঠে দাঁড়ান এবং ছুটে বাইরে চলে আসেন।
মাহদী আল-হাসান ও মেয়েটির পরিধানের কাপড় থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে। আলী বিন সুফিয়ান উভয়কে কক্ষে নিয়ে বসান। কক্ষে বাতি জ্বলছে। প্রদীপের আলোতে প্রথমবারের মতো মাহদী আল হাসান মেয়েটির মুখাবয়ব দেখলেন এবং ভাবলেন, মেয়েটি তো ঠিকই বলেছিলো- আমাকে আলোতে দেখলে তুমি সবকিছু ভুলে যাবে।
মাহদী আল-হাসান হাকীমের নাম উল্লেখ করে বললেন- এক্ষুনি তার ঘরে অভিযান চালান।
মাহদী!–আলী বিন সুফিয়ান হঠাৎ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে বললেন- কার কথা বলছো?
কেন? ঈমান বিক্রয় নতুন খবর নাকি?-মাহদী আল-হাসান বললেন এবং মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন- কি, হাকীম তোমাদের সঙ্গী না? এখানে মিথ্যা বললে পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
মেয়েটি মাথাটা নত করে ফেলে। আলী বিন সুফিয়ান তার ভেজা মাথায় হাত রেখে বললেন- এখানে তোমার সঙ্গে সেই আচরণ করা হবে না, তুমি যার আশঙ্কা করছো। তোমার রূপ-যৌবনের জন্য আমরা পাথর। আর অসহায় নারীর ইজ্জত রক্ষার সময় আমরা রেশমের ন্যায় কোমল। বলো, হাকীম কি তোমাদের সঙ্গী?
মেয়েটি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বাচক উত্তর দেয়।
মাহদী আল-হাসান কী করে এসেছেন এবং কীভাবে হাকীম তাকে প্রেতাত্মার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছিলো, সংক্ষেপে তার বিবরণ প্রদান করেন।
আলী বিন সুফিয়ান তার চাকর-নওকর ও রক্ষী সেনাদের তলব করেন। তাদেরকে বিভিন্ন কমান্ডারের নিকট বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেন। কোতোয়াল বিলবীসকেও তলব করেন। তিনি এরূপ বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বিপুলসংখ্যক সৈন্যের একটি দল তৈরি করে রেখেছেন, যারা কয়েক মিনিটের মধ্যে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে সক্ষম।
মাহদী আল-হাসানের রিপোর্ট অনুযায়ী বাহিনী তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান গিয়াস বিলবীসকে দায়িত্ব প্রদান করেন, তিনি হাকীমের ঘরে হানা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করবেন এবং তার বাড়ি ও দাওয়াখানা সীল করে দেবেন। গিয়াস বিলবীস এক ঘোড়ায় মাহদী আল-হাসানকে এবং আরেক ঘোড়ায় মেয়েটিকে তুলে নিয়ে বাহিনীসহ রওনা হন।
মেয়েটির দলের লোকেরা এতোক্ষণে তাকে অনুসন্ধান করে নিরাশ হয়ে পড়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওখান থেকে বেরিয়ে পালাবে। তাদের আশংকা হলো, মেয়েটি যদি কায়রো পৌঁছে যায়, তাহলে তাদের আস্তানার কথা বলে দিতে বাধ্য হবে। তবে দলে মতবিরোধ হয়ে গেছে। কেউ বলছে, মাহদী আল-হাসানের উট এখন এখানে। তথাপি যদি সে বেরিয়ে গিয়েই থাকে, তবু অতো তাড়াতাড়ি কায়রো পৌঁছতে পারবে না। এই মতানৈক্যের কারণে তারা এলাকা ত্যাগ করতে বিলম্ব করে ফেলেছে। অবশেষে তারা মালামাল গুটিয়ে গুহাসম কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। এমন সময় অনেকগুলো ধাবমান ঘোড়ার পদশব্দ তাদের কানে আসতে শুরু করে। বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
আলী বিন সুফিয়ানের সৈন্যরা প্রদীপ জ্বালিয়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটি তাদের সঙ্গে আছে। সে তার সঙ্গীদের আস্তানা চিহ্নিত করে দেয়। বাহিনী সেখানে গিয়ে পৌঁছে! গুহার ভেতর থেকে চার-পাঁচজন লোক ধরা পড়ে। উদ্ধার হয় নানা রকম জিনিসপত্র- দাহ্য পদার্থ, তীর ধনুক ও খঞ্জর ইত্যাদি। একটি মজবুত বাক্সে সোনা-রূপার সেই মুদ্রা, যা মিসরে সচল। ধৃতদের মধ্যে একজন মাত্র খৃস্টান। অন্যরা কায়রোর মুসলমান। তাদের নির্দেশনা মোতাবেক অন্য সঙ্গীদের অনুসন্ধান শুরু হয়। সারারাত এবং পরের পুরো দিন তল্লাশী চলে। ধরা পড়ে সব সদস্য। তন্মধ্যে দুজন মেয়ে- ঠিক মাহদী আল-হাসানের ধৃত মেয়েটির ন্যায়, যাদেরকে আলোতে দেখলে সব ভুলে যেতে হয়।
***
কায়রোতে হাকীমের বাসভবনটি ঘেরাও করে দরজায় করাঘাত করলে এক চাকর দরজা খুলে দেয়। গিয়াস বিলবীস কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা হাকীমের বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালাতে শুরু করে। তাদের হাতে প্রদীপ। হাকীমের শয়নকক্ষটা ভেতর থেকে বন্ধ। আওয়াজ দিলে অর্ধনগ্ন এক মেয়ে দরজা খুলে দেয়। হাকীম পালঙ্কের উপর অর্ধ-উলঙ্গ পড়ে আছেন। পালঙ্কের কাছে মদের পিপা ও পেয়ালা। হাকীম নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অচেতন পড়ে আছেন। তার একজন রোগী কিংবা ভক্ত বিশ্বাসই করবে না, তিনি এ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন। মেয়েটি তার স্ত্রী নয়, মুসলমানও নয়- খৃস্টানদের প্রেরিত উপহার। তার গৃহ থেকে উদ্ধারকৃত সম্পদ-ঐশ্বর্য নিঃসন্দেহে তার হালাল পন্থায় উপার্জিত নয়।
হাকীমের যখন চৈতন্য ফিরে আসে, তখন সে আলী বিন সুফিয়ানের কয়েদখানায় শিকলপরা অবস্থায় বন্দি। গিয়াস বিলবীসকে সংবাদ দেয়া হলো, হাকীম জাগ্রত হয়েছেন। তিনি হাকীমের নিকট চলে যান। বললেন, গোপন রাখার চেষ্টা করে লাভ নেই। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত হাকীম অপরাধ স্বীকার করে নেন। তিনি দুজন নায়েব সালারের নাম উল্লেখ করে বললেন, তারা সুলতান আইউবীকে ক্ষমতাচ্যুত করার তৎপরতায় লিপ্ত আছে। তারা খৃস্টানদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। উপহারস্বরূপ এই মেয়েটিকে এবং আরো বিপুল পরিমাণ সোনা-দানা দিয়ে হাকীমকেও এই দলে যুক্ত করে নেয়া হয়েছে। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, নতুন সরকারে আমাকে মন্ত্রী বানাতে হবে। তার এই শর্তও মেনে নেয়া হয়। দেশের বিখ্যাত ও বড় হাকীম এবং বিশ্বস্ত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি যখন যা বলতেন, নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা হতো। এই গ্রহণযোগ্যতার সুযোগে তিনি সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে বিষোদগার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
কায়রোতে নাশকতার যতো ঘটনা ঘটেছিলো, সবগুলোতে হাকীম জড়িত। ব্যক্তিত্বশীল লোক হওয়ার সুবাদে তিনি আলী বিন সুফিয়ানের বেশ কজন গোয়েন্দাকেও কিনে নিয়েছিলেন। মাহদী আল-হাসান তাদের একজন। হাকীম তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মাহদী আল-হাসানকে হত্যা করে ফেলবেন। কিন্তু পরে এই ভেবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়, মাহদী অতিশয় সাহসী ও যোগ্য লোক। হত্যা না করে বরং তাকে জালে আটকিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে হবে। সেই বুদ্ধি তাদের আছে। ইতিমধ্যে আলী বিন সুফিয়ানের কতক গোয়েন্দাকে হাত করে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে তারা। অথচ, গোয়েন্দা বিভাগে এখনো তারা বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে বিচেঁচিত। অবশেষে হাকীম মাহদী আল-হাসানকে জালে আটকানোর পন্থা অবলম্বন করেন।
হাকীম পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন, মাহদী আল-হাসান তার সুদর্শন প্রেতাত্মারর ফাঁদে এসে পড়বে। তারপর তাকে হাত করা ও নিজেদের মতো করে প্রস্তুত করার জন্য আছে হাশিশি ও খৃস্টান বিশেষজ্ঞরা।
মিসরের যে দুজন কমান্ডার রহস্যময় উপায়ে খুন হয়েছিলেন, তাদের সম্পর্কে হাকীম তথ্য প্রদান করেন। ঔষধের নামে হাকীম তাদেরকে এমন বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন, যাতে বিন্দুমাত্র তিক্ততা অনুভূত হয়নি। এমন বিষ, যা সেবন করে মানুষ নিজের মধ্যে কোন প্রকার যন্ত্রণা কিংবা পরিবর্তন অনুভব করে না এবং সেবনের বারো ঘন্টার মাথায় হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তাদেরকে কেন খুন করা হলো? প্রশ্নের জবাবে হাকীম জানান, তারা সুলতান আইউবী ও তাঁর সরকারের অনুগত এবং দীনদার মুসলমান ছিলেন। তাদের ঈমান ক্রয় করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা ঈমান বিক্রি করার পরিবর্তে ক্রয়কারীদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠেছিলেন। হাকীম প্রথমে তাদের একজনের সঙ্গে এমনভাবে মিলিত হন, যেনো সাক্ষাৎটা হঠাৎ হয়ে গেছে। কথায় কথায় হাকীম তার মনে কোনো একটি রোগের ভয় ধরিয়ে দেন এবং নিজের দাওয়াখানায় নিয়ে গিয়ে ঔষধের নামে বিষ খাইয়ে দেন। এই বিষ হাশিশিদের আবিষ্কার। দিন কয়েক পর হাকীম অপর কমান্ডারের সাথেও অনুরূপ হঠাৎ সাক্ষাৎ করে বসেন এবং একই কায়দায় তাকেও বিষ প্রয়োগ করেন।
এসব চাঞ্চল্যকর ও হৃদয় কাঁপানো তথ্য হাকীম আপনা থেকে দেননি। পাতাল কক্ষের নির্যাতন তাকে মুখ খুলতে বাধ্য করেছে। তিনি জানান, দেশের সেনা বাহিনীতে একদিকে অস্থিরতা ছড়ানো, অন্যদিকে তাদের মাঝে নেশা ও যৌনতার স্বভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেনা অফিসারদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি দৃঢ় চেতনাসম্পন্ন শক্ত ঈমানদারদেরকে রহস্যময় উপায়ে হত্যা করার ধারা চলছে। সুদানের ফৌজ অতিসত্বর মিসরের সীমান্ত ও সীমান্ত চৌকিগুলোর উপর হামলা চালাতে যাচ্ছে। এসকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দেবে স্বয়ং খৃস্টানরা। সীমান্ত এলাকার অধিবাসীদেরকে সুদানীরা হাত করে নেবে।
আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস তাদের গ্রেফতার অভিযান, অনুসন্ধান ও তথ্য প্রাপ্তির এসব খবরাখবর মিসরের অস্থায়ী গবর্নর আল-আদিলকে অবহিত করতে থাকেন। কিন্তু অন্য কাউকে এসব ব্যাপার-স্যাপার কিছুই জানতে দিচ্ছেন না। হাকীম ও তার অপর সঙ্গীরা যেসব নায়েব সালার ও কর্মকর্তাদের নাম বলেছেন, তাদের গ্রেফতার করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। কিন্তু সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিল সাহস করছেন না। তিনি এই রহস্যকে রহস্যই রাখার নির্দেশ প্রদান করে বললেন, পরিস্থিতিটা এতই স্পর্শকাতর যে, আমি মনে করি, সুলতান আইউবী এসে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে ভালো হবে। অবস্থাটা আসলে স্পর্শকাতরই ছিলো। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, নিজে সুলতান আইউবীর নিকট যাবেন এবং তাকে মিসর ফিরে আসতে বলবেন কিংবা তার থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করবেন।
আল-আদিলের সুলতান আইউবীর নিকট যাওয়ার বিষয়টি গোপন রাখা হলো। সকল সন্দেহভাজন নায়েব সালার প্রমুখদের সঙ্গে একজন করে গোয়েন্দা ছায়ার ন্যায় জুড়ে রাখা হলো। গোয়েন্দারা তাদের প্রতি মুহূর্তের গতবিধি অনুসরণ করছে।
***
আমি তোমার থেকে কোনো নতুন খবর শুনছি না- হাবের সন্নিকটে নিজ হেডকোয়ার্টারে বসে আল-আদিল থেকে বিস্তারিত শুনে সুলতান আইউবী বললেন- আমি জানি না, জাতির মধ্যে ঈমান বিক্রির যে ব্যাধির জন্ম নিয়েছে, তার চিকিৎসা কী হবে। আমার দৃষ্টি বাইতুল মুকাদ্দাস নয়- ইউরোপের উপর নিবদ্ধ। কিন্তু আমার ঈমান নীলামকারী ভাইয়েরা আমাকে মিসর থেকেই বের হতে দিচ্ছে না! সে যা হোক, এই ময়দান তুমি সামাল দাও। আমি দামেশক যাচ্ছি। সেখান থেকে মিসর চলে যাবো।
সুলতান আইউবী আল-আদিলকে রণাঙ্গনের পূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন এবং বললেন, আমার গোয়েন্দারা এতদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে, খৃস্টানরা যদি আক্রমণ করে বসে, তাহলে অন্তত দু-তিনদিন আগে তুমি সংবাদ পেয়ে যাবে। আমার কমান্ডো সৈন্যরা প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত অবস্থায় থাকে। আমি তাদেরকে আক্রমণের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে লুকিয়ে রেখেছি। সর্বশেষ টাটকা সংবাদ হলো, ক্রুসেডাররা হামলা করবে না। যদি আমার অনুপস্থিতি থেকে তারা ফায়দা লুটতে চেষ্টা করে, তাহলে ভয় পেয়ে না। দুর্গে আবদ্ধ থেকে লড়াই করো না। দুশমনকে সামনে আসার এবং আগে হামলা করার সুযোগ দেবে। প্রয়োজনে পেছনে সরে যাবে। এখানকার ভূমি যুদ্ধের জন্য আমাদের উপযোগি। উঁচু স্থানগুলোতে দখল বজায় রাখবে।
আর বিশেষভাবে স্মরণ রাখবে- সুলতান আইউবী বললেন- আল মালিকুস সালিহ, সাইফুদ্দীন এবং যেসব আমীর আমাদের আনুগত্য মেনে নিয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক থেকে রাজত্বের মোহ দূর হয়নি। চুক্তি মোতাবেক তারা কোন বাহিনী রাখতে পারে না। আমি তাদের মধ্যে গোয়েন্দা প্রেরণ করে রেখেছি। আর জীবনে এই প্রথম আমি আমার নীতি পরিপন্থী সিদ্ধান্ত দিয়ে রেখেছি, আমার এই মুসলমান ভাইয়েরা যদি সামান্যতম বিরোধিতামূলক আচরণ করে, তাহলে তাদেরকে হত্যা করে ফেলবো।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন, ৫৭২ হিজরীর রবিউল আউয়ালে (মোতাবেক সেপ্টেম্বর ১১৭৬)। সুলতান আইউবী রণাঙ্গন আল-আদিলের হাতে ছেড়ে দিয়ে দামেশক চলে গিয়েছিলেন। তাঁর আরেক ভাই শামসুদ্দৌলা তুরান শাহ ইয়ামান থেকে ফিরে আসেন। ইয়ামানেও ক্রুসেডারদের অপতৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিলো এবং সেখানকার মুসলমানগণ সালতানাতে ইসলামিয়ার বিদ্রোহী হয়ে ওঠতে শুরু করেছিলো। সুলতান আইউবী আপন ভাই শামসুদ্দৌলাকে সেখানে প্রেরণ করেছিলেন। শামসুদ্দৌলা সাফল্য নিয়ে এসেছেন। সুলতান আইউবী তাকে দামেস্কের গবর্নর নিযুক্ত করে ১১৭৬ সালের অক্টোবর মাসে মিসর রওনা হওয় যান।
সুলতান আইউবী এখন কায়রোতে। কায়রো পৌঁছেই তিনি সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গকে পদমর্যাদার তোয়াক্কা না করে গ্রেফতার করার নির্দেশ প্রদান করেন। তালিকা প্রস্তুত। তাদের গ্রেফতারীর আগের দিন পার্বত্য অঞ্চলের গুহা থেকে উদ্ধারকৃত সোনা ও ধনভান্ডার পেরেড ময়দানে এনে স্তূপ করেন। সে পর্যন্ত যতো খৃস্টান মেয়েকে পাকড়াও করা হয়েছিলো এবং সর্বশেষ যাদেরকে ধরা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে ধনভান্ডারের স্তূপের নিকট এনে দাঁড় করানো হয়। তাদের মধ্যে হাকীম সাহেবও আছেন। নায়েব সালারও আছেন। আছেন অনেক কমান্ডার। সকলে শিকল পরিহিত। মিসরের সকল সৈন্যকে তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করিয়ে ময়দানে এনে দাঁড় করানো হয়।
সুলতান আইউবী ঘোড়ার পিঠে চড়ে ময়দানে এসে বাহিনীর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে যান।
আমি জানতে পেরেছি, তোমাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হচ্ছে- সুলতান আইউবী উচ্চকণ্ঠে গর্জন করে বললেন তোমাদের কেউ যদি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারে যে, সে ইসলামের মর্যাদা ও আল্লাহরর রাসূলের খাতিরে তোমাদেরকে আমার ও আমার সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে এবং প্রথম কেবলা মুক্ত করার ও স্পেন আক্রমণ করে দেশটা পুনরায় সালতানাতে ইসলামিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিজ্ঞা রাখে, তাহলে সে আমার সম্মুখে এসে পড়ুক। সে আমার তারবারীটা নিয়ে নিক এবং আমার ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করুক। দেশের শাসন ক্ষমতা তার হাতে তুলে দিয়ে আমি অবসর গ্রহণ করবো।
সর্বত্র নীরবতা ছেয়ে যায়।
সুলতান আইউবী পেছন দিকে মোড় ঘুরিয়ে আসামীদের উদ্দেশ করে বললেন- আমার স্থান দখল করার মতো লোক তোমাদের মাঝে কেউ আছে কি? আসো, সামনে এগিয়ে আসো। কাবার প্রভুর কসম করে বলছি, আমি আমার ক্ষমতা তোমার হাতে তুলে দেবো এবং নিজে তোমার আনুগত্য মেনে চলবো।
নীরবতা আরো গম্ভীর হয়ে যায়। নিঃশ্বাসটুকু ফেলার শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
আল্লাহর সৈনিকগণ!- সুলতান আইউবী তার বাহিনীর দিকে মোড় ঘুরিয়ে বললেন- তোমাদেরকে বিদ্রোহের জন্য না ইসলামের মর্যাদার গাতিরে উত্তেজিত করা হচ্ছে, না রাসূলে খোদা (সা.)-এর আদর্শের স্বার্থে। যে ধনভান্ডার তোমাদেরকে প্রদর্শন করা হয়েছে, যে মেয়েগুলো তোমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেসব সেই পুরস্কার, যেগুলো এদেরকে প্রদান করা হয়েছে। এগুলো এদের ঈমানের মূল্য। আমি এদের প্রত্যেককে বলছি, তোমরা সম্মুখে এগিয়ে আসো আর বলল, আমি যা বলছি মিথ্যা বলছি।
কেউ এগিয়ে আসলো না। সুলতান আইউবী ঘোড়া থেকে অবতরণ করেন এবং আসামীদের মধ্য থেকে হাকীমকে বাহুতে ধরে টেনে ঘোড়ার নিকটে এনে বললেন- আমার ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসো আর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দাও, আইউবী মিথ্যা বলছে।
হাকীম সুলতান আইউবীর ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। কিন্তু তিনি মাথাটা নত করে ফেললেন।
বলো, সুলতান মিথ্যা বলছে। সুলতান আইউবী ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন।
হাকীম মাথা তুলে উচ্চকণ্ঠে বললেন- সুলতান আইউবী যা বলেছেন, সত্য বলেছেন। বলেই হাকীম ঘোড়া থেকে নেমে আসেন।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সঙ্গীরা এই প্রথম সুলতান আইউবীকে ক্রুদ্ধ অবস্থায় দেখেছে।
হাকীম ঘোড়া থেকে নেমে মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতান আইউবী তারবারী বের করে এক আঘাতে হাকীমের মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলেন। তারপর ঘোড়ার পিঠে চড়ে অত্যন্ত উঁচু কণ্ঠে চীৎকার করে ওঠেন- আল্লাহর সৈনিকগণ! ইসলামের প্রহরীগণ! আমি যদি অবিচার করে থাকি, তাহলে এই নাও, আমারই তারবারী দ্বারা আমার ঘাড় উড়িয়ে দাও। সুলতান আইউবী তরবারীটা বর্শা ছোঁড়ার ন্যায় বাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারেন। তরবারীর আগা মাটিতে গেঁথে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
সর্বসম্মুখের সালার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে তরবারীটা তুলে উভয় হাতে করে আদবের সঙ্গে সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন- মহামান্য সুলতান! এতো আগেপ্রবণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাহিনীর মধ্যে রব উঠে যায়। তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সুলতান আইউবী দুহাত উপরে তুলে সৈন্যদের শান্ত করেন এবং অপরাধীদের শাস্তি ঘোষণা করেন।
সুলতান আইউবী সেদিনই লিখিত বার্তাসহ সুদানে দূত প্রেরণ করেন- সুদানের ফৌজ যদি মিসরের সীমান্তে সামান্যতম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে, তো আমি তাকে মিসর আক্রমণ বলে বিবেচনা করবো আর তার উত্তরে আমি সুদান আক্রমণের অধিকার সংরক্ষণ করবো। তখন আমরা সুদানে ইসলামের পতাকা উডডীন না করে ক্ষান্ত হবো না।