ষষ্ঠ অধ্যায় – স্মৃতি
৬.১ কানুদা
বিমল ঘোষ। আমাদের কানুদা। এল আই সি-তে কাজ করতেন। কিন্তু আমাদের কাছে সেটা ওঁর পরিচয় ছিল না। এমন কাছের মানুষ, এমন অকৃত্রিম বন্ধু জীবনে বেশি পাইনি। সেটাই ছিল ওঁর পরিচয়।
১৯৪৭ সালে, দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন আগে, আশুতোষ কলেজে আমার কর্মজীবন আরম্ভ হয়। ঐরকম সময়েই কানুদার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ইতিহাসও শুরু। আমরা দু’জনেই তখন অবিবাহিত { পরে কানুদার বিয়ে হয় ভারতীর সঙ্গে। আশুতোষ কলেজে ভারতী ছিল আমার প্রিয় ছাত্রীদের একজন। আমিই কানুদার সঙ্গে ভারতীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সবই আজ স্মৃতি। আজ কানুদা নেই।
সন্তোষ, নির্মল, কল্যাণ, মিহির, রণজিৎ, প্রভাকর এদের নিয়ে আমাদের এক বন্ধু গোষ্ঠী ছিল। এদের অধিকাংশই তখন মার্ক্সবাদী। প্রভাকর আর আমি ছিলাম অন্যমতের। কানুদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ঐ বন্ধু গোষ্ঠীতে। উনি নিজেও তখন মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী।
কানুদার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে। উনি একটা বিশেষ কৌতূহল নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। সেটা পরে শুনেছি। ওঁর তখন ধারণা, মার্ক্সবাদ যদি কেউ মেনে না নেয়, তবে দুটো কারণেই শুধু সেটা সম্ভব, মস্তিষ্কের অভাব অথবা সততার অভাব। কানুদা আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, আমি এ দুয়ের কোন প্রকারের মানুষ। প্রায় বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নিয়েই উনি আমার কাছে চলে এসেছিলেন। কানুদার ভিতর আমি কখনই সদিচ্ছার অভাব দেখিনি।
আমরা সবাই ছিলাম আড্ডাবাজ। কিন্তু কানুদার সঙ্গে আমার আলোচনা হ’ত বিশেষ ধরনের। পাঁচজনের আড্ডার মধ্যে তো আমরা ছিলামই। তাঁর বাইরেও বিশেষভাবে চলতো আমাদের দুজনের একান্ত আলোচনা। তার যেন শেষ নেই। ঘণ্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, ঘরে বসে, পার্কের ধারে দাঁড়িয়ে, পথে হাঁটতে হাঁটতে, কফি হাউসে, চায়ের দোকানে। ব্যক্তিগত কথাবার্তা প্রাধান্য পেত না। চিন্তায় বিশ্ব পরিক্রমাটাই প্রধান কথা। আলোচনার একটা বড় বিষয় ছিল রাজনীতি।
তখনও কম্যুনিস্ট দুনিয়ায় ফাটল দেখা দেয়নি, অন্তত সেটা সাধারণের চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সেদিনকার কম্যুনিস্ট আন্দোলন ছিল সোবিয়েত ভক্তিতে আচ্ছন্ন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লোকেরা ছিলেন ব্যতিক্রম। সোবিয়েত দেশের প্রতি অবিচল আনুগ্যত্যই তখনও কমিউনিজমের প্রধান কথা।
কানুদা ছিলেন প্রথমদিকে মানবেন্দ্রনাথের প্রতি অনুরক্ত। যুদ্ধের সময় সোবিয়েত দেশের দিকেই ছিল ওঁদের সক্রিয় সমর্থন। বিশ্বযুদ্ধের শেষে মানবেন্দ্রনাথের চিন্তার পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্ক্সবাদ আর সোবিয়েত রাজনীতি থেকে তিনি অনেকখানি দূরে সরে যান। কানুদা তবু রয়ে গেলেন সোবিয়েত সমাজব্যবস্থার সমর্থক। কিছু সংশয়ের সঙ্গে হয়তো উনিও লড়ছিলেন, কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ দেখা দেয়নি। আমি যখনকার কথা বলছি তখন কম্যুনিষ্ট দলের প্রতি কানুদার সহানুভূতি জোরালো।
কাজেই আমাদের তর্কটা ছিল প্রবল। তাতে উত্তেজনা ছিল কি তিক্ততা ছিল না। কখনই। কানুদার ভিতর এই গুণটি আমি শেষ অবধি দেখেছি। তর্কের ভিতর উত্তেজিতভাবে অনেক কথা বলতেন। কিন্তু সে যেন এক রকম নিরাসক্ত উত্তেজনা। তর্কের ভিতর দিয়ে উনি প্রতিপক্ষের কথা বুঝতেই চেষ্টা করতেন। শত তর্কেও আমাদের বন্ধুত্বের গায়ে আঁচড় পড়তো না। কানুদার এই আশ্চর্য গুণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কানুদার মতামত ধীরে ধীরে পালটে গিয়েছিল। হঠাৎ বদলায়নি। বদলেছে অনেক বছর ধরে, ক্রমে ক্রমে।
সোবিয়েত দেশ নিয়ে আলোচনায় কয়েকটা মোটা কথা আমি ওঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। সব দেশের সব ব্যবস্থারই কিছু দোষগুণ আছে। সোবিয়েতের বেলায়ও তাই। দোষগুণ দুই-ই দেখে, তথ্য যাচাই করে, একটা বিশেষ ব্যবস্থার সমর্থক কেউ হতে পারেন। কিন্তু মোহ থাকবে কেন? বুদ্ধিকে সতর্ক রাখা চাই। সোবিয়েত দেশকে কল্পনায় স্বর্গরাজ্য করে তোলা হচ্ছে, একটা সম্পূর্ণ অবাস্তব চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, এইখানেই ছিল আমার প্রধান আপত্তি। চল্লিশের দশকের শেষভাগে অথবা পঞ্চাশের প্রথম দিকে কানুদার সঙ্গে আমার এইসব আলোচনা যখন চলছিল, স্তালিনী আমল তখনও চালু।
সোবিয়েত দেশ সম্বন্ধে সেদিনকার অনেক ভ্রান্ত ধারণা ক্রমে পরিত্যক্ত হয়েছে। তারপর চীন নিয়ে নতুন মোহ সৃষ্টি হতে দেখেছি। আরো পরে কিউবা নিয়ে। এইসব দেখে মনে হয়েছে, আমরা অনেকেই মোহে জড়াতে ভালোবাসি। কোনো দেশকে তীব্রভাবে হিংসা করব, কোনো দেশকে মুগ্ধভাবে ভালোবাসব, এইরকম একটা নেশা বোধ। হয় আমাদের টানে। আমি বলতে চেয়েছি, আমাদের অন্তিম আনুগত্য জমা থাক কিছু। আদর্শের জন্য। বাস্তবে কোথাও সেইসব আদর্শ রূপায়িত হবার ধারে কাছেও আমরা পৌঁছইনি। ভালো মন্দ দেখেশুনে যা চাই নানা দেশ থেকে খুঁজে নিতে হবে। পৃথিবীর কিছু দেশের বেলায় চরম সন্দেহপ্রবণতাকেই বাস্তব বুদ্ধি বলে মানবব, আর অন্যকিছু দেশের প্রতি আমরা ভক্তি গদ হব, এটা আমার কাছে সত্যানুসন্ধানের পথ বলে মনে হয়নি।
এইসব যুক্তিতেই যে কানুদার মতের পরিবর্তন ঘটেছিল এমন নয়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁর বুদ্ধি এবং সর্বোপরি সততাই তাঁকে। নতুন চিন্তার দিকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি চাইছিলেন, দেশে কাজকর্ম হোক। দেশের উন্নতি হোক। তাঁর ক্রমেই মনে হচ্ছিল যে, প্রচলিত বামপন্থী চিন্তা আমাদের ক্রুদ্ধ হতে শিখিয়েছে, কাজ করতে শেখায়নি। দেশের বর্তমান অবস্থায় কীভাবে আর্থিক উন্নতির। দিকে যথাসম্ভব অগ্রসর হতে হবে সেই পথ দেখায়নি। এমনকি আমাদের চিন্তার ঝোঁকটাই সেদিকে যায়নি। বামপন্থী চিন্তায় তিনি ক্রমেই কেমন যেন একটা অবাস্তবতা আর কপটতা দেখতে পেলেন।
রাজনীতির বাইরেও কানুদার সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা ___ আরো নানা বিষয় নিয়ে। এর ভিতর ছিল কিছু আধা-দার্শনিক বিষয়। যেমন যুক্তিবাদ। এটা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দর্শনের সূত্র ধরে আমাদের আলোচনায় চলে এসেছিল। তাছাড়া, ছবি অর্থাৎ চলচ্চিত্র, যে বিষয়ে কানুদার জ্ঞান এবং আগ্রহ ছিল আমার তুলনায় অনেক বেশি; আমি তো প্রায়ই কিছুই জানতাম না, এখনো জানি না।
মানবেন্দ্রনাথ যুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই বিশ্বাসের মূলে ছিল জড়বাদী দর্শন। তাঁর সঙ্গে আমার দার্শনিক চিন্তার খানিকটা অমিল ছিল। যাই হোক, কানুদার সঙ্গে আমার আলোচনা হ’ত জড়বাদ নিয়ে ততো নয়, বরং মানুষের আদর্শ চিন্তায় যুক্তির স্থান নিয়ে। আমার বক্তব্য ছিল এই যে, যুক্তির কাজ হ’ল তথ্য থেকে সঠিকভাবে সিদ্ধান্তে আসা, অথবা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপায় নির্ধারণ করা। লক্ষ্যের ভিতরও একটা উচ্চ-নীচ ভেদ থাকতে পাবে। অর্থাৎ যাকে এক সময় আমরা লক্ষ্য বলি তাও উচ্চতর কোনো লক্ষ্যের পথে উপায় বিশেষ হতে পারে। কিন্তু আমাদের উচ্চতম লক্ষ্য অথবা মৌল আদর্শ অন্য কিছুর জন্য উপায় অথবা উপকরণ বলেই মূল্যবান নয়, তার মূল্য স্বাশ্রয়ী, নিজের ভিতরই নিহিত। প্রত্যক্ষ অনুভবের ভিতর দিয়ে সেই মূল্য সম্বন্ধে আমরা প্রত্যয় লাভ করি।
মনে আছে একদিন ধর্মতলার মোড় থেকে হাজরার মোড় পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে এইসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কানুদা বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ অনুভব থেকে যে মূল্যবোধ, সেটাও কি আমরা পাই না যুক্তিরই সাহায্যে? আমি বলেছিলাম, যুক্তি শব্দটা আমরা কোন অর্থে ব্যবহার করছি তারই উপর প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে। বিশ্লেষণী বুদ্ধি আর প্রত্যক্ষ অনুভব এক জাতের বস্তু নয়। দুটো ভিন্ন জিনিসের জন্য যুক্তি নামে একটা অভিন্ন শব্দ ব্যবহার করলে শেষ অবধি কিছুই আর পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। কানুদা জোরের সঙ্গে এরপর কিছু বলেননি। এসব বিষয়ে তিনি মন ভোলা রাখতেন। আমার কথা হয়তো বা উনি মেনে নেননি, হয়তো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
চলচ্চিত্রের ব্যাপারে উনিই ছিলেন বক্তা, আমি শ্রোতা। নানা ধরনের শিল্পের ভিতর পার্থক্য তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। যেমন গান আর কবিতার প্রকাশের মাধ্যম এক নয়, একটাতে সুর অন্যটাতে শব্দ, কাজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধরনটাও ভিন্ন। তেমনই একটা উপন্যাস পড়া আর তাকে ছবি হিসেবে দেখা এক ব্যাপার নয়। প্রত্যেকটি মাধ্যমের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। নিজস্ব সম্ভাবনা আছে। নিজস্ব সীমা আছে। এইসব কথা তত্ত্ব হিসেবে এবং উদাহরণ দিয়ে তিনি বলতেন। চলতি চলচ্চিত্র থেকেই সেইসব উদাহরণ নেওয়া হত প্রধানত! অন্যতম উদাহরণ ছিলেন সত্যজিৎ। চলচ্চিত্রে ওঁর এই আগ্রহ শেষ অবধি ছিল। ওঁর কাছ থেকে আমার যথেষ্ট শেখা হয়নি। সেটা আমারই শূন্যতা!
১৯৭০ সালের পর অনেকটা সময় আমি কলকাতার বাইরে কাটিয়েছি। কলকাতায় এলে কানুদার সঙ্গে দেখা হত। এই যোগাযোগ রক্ষার কৃতিত্ব প্রধানত ওঁরই। শেষ জীবনে অনেকটা সময় তিনি শারীরিক ও মানসিক ক্লেশের ভিতর কাটিয়েছেন। তবু তারই ভিতর যথাসাধ্য যোগাযোগ রেখে গেছেন। এজন্য ওঁর কাছে সর্বদাই আমি কৃতজ্ঞ বোধ করেছি।
কানুদার বন্ধুত্বের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, বন্ধুর কাছ থেকে অন্তত আমার কাছ থেকে, তাঁর কোনো জাগতিক সুবিধার প্রত্যাশা ছিল না। অপর সব ব্যবহারিক ফল নিরপেক্ষভাবে বন্ধুভাব যে আপনি মূল্যবান, অন্য কোনো উদ্দেশ্যের উপায় হিসেবে নয় বরং তার নিজস্ব গুণে সে পরম কাম্য, কানুদা তাঁর আচরণের ভিতর দিয়ে সেটা স্পষ্ট করে তুলেছিলেন। কোনো দর্শনের ভিতর দিয়ে সম্ভবত তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেননি। তিনি একে পেয়েছিলেন সহজ বোধের মতো করে। আমরা ক’জন এ জিনিস পাই অথবা পেয়ে রক্ষা করতে পারি? সংসারে নানা মালিন্যের ভিতর কানুদা এই মূল্যবোধকে আশ্চর্যভাবে রক্ষা করেছিলেন।
সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)