৬.১ আত্মরতিবতী

আত্মরতিবতী
দ্বিতীয় খণ্ড । ভাগ ৬ –যাথার্থ্য প্রতিপাদন। পরিচ্ছেদ ১

কখনো কখনো ধারণা পোষণ করা হয়েছে যে আত্মরতি হচ্ছে সব নারীর মৌলিক মনোভাব; কিন্তু এ-ধারণাকে বেশি দূর বাড়ানো হচ্ছে একে ধ্বংস করা, যেমন ল্য রশফুকো ধ্বংস করেছেন অহংবাদের ধারণা। আত্মরতি হচ্ছে অভেদত্ববোধের একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, যাতে অহংকে গণ্য করা হয় একটি ধ্রুব লক্ষ্য বলে এবং পাত্র নিজের থেকে সরে আশ্রয় নেয় অহংয়ে। আরো অনেক মনোেভাব–সত্য বা মিথ্যে দেখা যায় নারীর মধ্যে, যার কিছু কিছু আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তবে একথা সত্য যে অবস্থা পুরুষের থেকে নারীকে অনেক বেশি চালিত করে নিজেকে নিজের প্রতি নিবদ্ধ করতে এবং তার প্রেমকে নিজের প্রতি নিয়োগ করতে।

প্রেমে দরকার পড়ে কর্তা ও কর্মের এক দ্বৈততা। আত্মরতির দিকে নারী চালিত হয় একই গন্তব্য-অভিমুখি দুটি পথ দিয়ে। কর্তা হিশেবে সে বোেধ করে ব্যর্থতা; যখন সে খুবই ছোটো, তখনই তার অভাব সে-বিকল্প অহংয়ের, বালক যা পায় তার শিশ্নে; এর পরে তার আক্রমণাত্মক কাম থেকে যায় অতৃপ্ত। এবং যা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পুরুষসুলভ কাজগুলো তার জন্যে নিষিদ্ধ। সে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু সে কিছুই করে না; স্ত্রী, মা, গৃহিণী হিশেবে কাজ করে সে একজন ব্যক্তি হিশেবে স্বীকৃতি পায় না। পুরুষের বাস্তবতা সে যে-গৃহগুলো তৈরি করে, যে-অরণ্যগুলো পরিষ্কার করে, যেসব ব্যাধি সে নিরাময় করে, তার মধ্যে; কিন্তু পরিকল্পিত কোনো কর্ম ও লক্ষ্যের মাধ্যমে নিজেকে চরিতার্থ করতে না পেরে নারী বাধ্য হয় নিজের দেহের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিজের বাস্তবতা খুঁজতে। সিয়েসের উক্তি ব্যঙ্গ করে মারি বাশকির্তসেভ লিখেছিলেন : ‘আমি কী? কিছুই না। আমি কী হবো? সব কিছু’। যেহেতু তারা কিছুই নয়, তাই বহু নারী চাপা ক্রোধে নিজেদের সমস্ত আগ্রহ নিবদ্ধ করে শুধু তাদের অহংয়ের প্রতি এবং সেগুলোকে এতোটা ফুলিয়ে তোলে যে সেগুলোকে তারা সব কিছুর সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আবার, মারি বাশকির্তসেভ বলেছেন, ‘আমি আমার নিজের নায়িকা’। যে-পুরুষ কাজ করে, সে নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে বাধ্য হয়। অকার্যকর, বিচ্ছিন্ন, নারী নিজের জন্যে কোনোস্থানও পায় না নিজের সম্পর্কে কোনো সুস্থ ধারণাও করতে পারে না; সে নিজের ওপর আরোপ করে পরম গুরুত্ব, কেননা কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিশেই তার প্রবেশাধিকার নেই।

সে যে নিজেকে দান করতে পারে নিজের কামনাবাসনার কাছে, তার কারণ হচ্ছে শিশুকাল থেকেই সে নিজেকে একটি বস্তু হিশেবে বোধ করে এসেছে। তার শিক্ষা তাকে বলেছে নিজেকে তার সম্পূর্ণ শরীরের সাথে অভিন্ন করে তুলতে, বয়ঃসন্ধি এদেহকে বিকশিত করেছে অক্রিয় ও কামনার বস্তু বলে; এটা এমন বস্তু, যা সে সাটিন বা মখমলের মতো ছুঁতে পারে, এবং প্রেমিকের দৃষ্টিতে নিবিষ্টভাবে অবলোকন করতে পারে। একলা আনন্দের সময় নারী নিজেকে একটি পুরুষ কর্তা ও নারী কর্মরূপে দুভাগে ভাগ করতে পারে; দালবিজের এক রোগী ইরেন এ-ভঙ্গিতেই কথা বলতো নিজের সাথে নিজে; ‘আমি নিজেকে ভালোবাসতে যাচ্ছি,’ বা আরোসংরাগের সাথে বলতে : ‘আমি নিজের সাথে সঙ্গম করতে যাচ্ছি,’ বা বেদনার প্রবল বিস্ফোরণের সময় বলতো : ‘আমি নিজেকে গর্ভবতী করতে যাচ্ছি’। মারি বাশকির্তসেভ যুগপৎ হয়ে ওঠেন কর্তা ও কর্ম যখন তিনি লেখেন : ‘কী দুঃখ কেউ আমার বাহু ও দেহ দেখতে পায় না, এ-সজীবতা ও যৌবন’।

প্রকৃতপক্ষে, কারো পক্ষেই বাস্তবিকভাবে একজন অপর হয়ে ওঠা এবং নিজেকে সচেতনভাবে একটি বস্তু হিশেবে দেখা অসম্ভব। এ-দ্বৈততা নিতান্তই স্বপ্ন। শিশুর কাছে এ-স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় পুতুলরূপে; সে নিজের দেহে যেভাবে দেখে নিজেকে তার চেয়ে বেশি মূর্তরূপে নিজেকে দেখে পুতুলের মধ্যে, কেননা সে আর পুতুল বাস্তবিকভাবে পরস্পরপৃথক। নিজের সঙ্গে নিজের একটা প্রীতিপূর্ণ সংলাপ চালানোর জন্যে দরকার পড়ে নিজে দুজন হওয়া, যা, উদাহরণস্বরূপ, প্রকাশ করেছেন মাদাম আনা দ্য নোয়াইলে তাঁর লিভল দ্য ভি-এ :

‘আমি পুতুল ভালোবাসাতাম, সেগুলোকে আমি আমার মতোই জীবন্ত বলে কল্পনা করতাম; আমার চাদরের নিচে উষ্ণভাবে আমি ঘুমোতে পারতাম না, যদি না সেগুলোকে পশম ও মখমলের কাপড়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিতাম… আমি কল্পনা করতাম আমি বাস্তবিকভাবেই উপভোগ করছি বিশুদ্ধ দ্বৈত নির্জনতা… শৈশবের শুরুতে আমি তীব্রভাবে অনুভব করতাম এই পূর্ণাঙ্গ থাকার, নিজে দুজন হওয়ার প্রয়োজন। … আহা, বেদনার মুহূর্তগুলোতে যখন আমার স্বপ্নাতুর মৃদুতা হয়ে উঠতোতিক্ত অশ্রুর বলি, তখন আমার পাশে আমি কতো যে চাইতাম আরেকটি ছোটো আনাকে, যে জড়িয়ে ধরবে আমার গলা, আমাকে সান্ত্বনা দেবে, আমাকে বুঝবে!… পরবর্তী জীবনে আমি তাকে পাই আমার হৃদয়ে এবং তাকে আমি শক্ত করে ধরে রাখি; সে আমাকে যে-সহায়তা দিতো, তা সান্ত্বনারূপে নয়, যেমন আমি আশা করতাম, বরং দিতো সাহসরূপে’।

কিশোরী তার পুতুল ছেড়ে দেয়। কিন্তু নিজেকে প্রক্ষেপ করার প্রচেষ্টায় ও তারপর আত্মপরিচয় লাভে জীবনভর নারী একটা প্রচণ্ড সহায়তা পায় তার আয়নার ইন্দ্রজালের কাছে। কিংবদন্তি ও স্বপ্নে আয়না ও ডবলের মধ্যে সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেছেন মনোবিশ্লেষক অটো র্যাংক। বিশেষ করে নারীতে, প্রতিবিম্বটিকে শনাক্ত করা হয় অহংরূপে। পুরুষে সুদর্শন আকৃতি নির্দেশ করে সীমাতিক্ৰমণতা; নারীতে, সীমাবদ্ধতার অক্রিয়তা; শুধু দ্বিতীয়টির কাজ হচ্ছে স্থির দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং এজন্যে একে ধরা যেতে পারে গতিহীন, রুপোলি ফাদে। পুরুষ নিজেকে সক্রিয়, কর্তা রূপে অনুভব ও কামনা করে নিজেকে সে একটা স্থির মূর্তিতে দেখে না; তার কাছে এর আবেদন খুব কম, কেননা তার কাছে পুরুষের দেহকে একটি কাম্যবস্তু বলে মনে হয় না; আর তখন নারী, নিজেকে একটি বস্তু হিশেবে বোধ করে ও তৈরি করে, বিশ্বাস করে যে আয়নায় সে সত্যিই দেখছে নিজেকে। প্রতিবিম্বটি এক অক্রিয় ও বিদ্যমান ঘটনা, যা তার নিজের মতোই একটি বস্তু; এবং সে যেহেতু লালসা করে মাংস, তার মাংস, তাই সে দেখে যে-কাল্পনিক গুণগুলো, সেগুলোকে সে জীবন্ত করে তোলে তার অনুরাগ ও কামনার মাধ্যমে। মাদাম দ্য নোয়াইলে, যিনি এ-ব্যাপারে বুঝতেন নিজেকে, আমাদের বিশ্বাস করে সে-গোপনকথা বলেছেন নিম্নরূপে :

‘আমার ঘন ঘন-ব্যবহৃত আয়নাটিতে প্রতিফলিত হতো যে-প্রতিবিম্ব, তার থেকে আমি কম অহঙ্কার পোষণ করতাম আমার মেধাগত ক্ষমতা সম্পর্কে, যেগুলোএতো তীব্র ছিলো যে সেগুলো সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ ছিলো না… শুধু শারীরিক সুখই পুরোপুরি পরিতৃপ্ত করে আত্মাকে’।

শারীরিক সুখ কথাগুলো এখানে ব্যবহৃত হয়েছে অস্পষ্ট ও অশুদ্ধভাবে। আত্মাকে যা পরিতৃপ্ত করে, তা হচ্ছে যখন মনকে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে তখন সেখানে, আজ, কল্পিত মুখভাবটি আছে এক নিঃসন্দিগ্ধ, বিদ্যমান ঘটনারূপে। সমগ্র ভবিষ্যৎ সংহত হয়ে আছে সে-আলোকপাতের মধ্যে, যা হচ্ছে আয়নার ফ্রেমে বন্দী এক মহাবিশ্ব; এ-সংকীর্ণ সীমার বাইরে সব কিছু এক বিশৃঙ্খল গোলমাল; বিশ্ব পর্যবসিত হয়েছে এ-আয়নার পাতে, যাতে স্থির হয়ে আছে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল মূর্তি : অনন্যা। প্রতিটি নারী, যে তন্ময় হয়ে পড়ে তার প্রতিফলনে, একা, সার্বভৌমরূপে শাসন করে স্থান ও কালের ওপর; তার সমস্ত অধিকার আছে পুরুষ ও সম্পদ, খ্যাতি ও বিনোদ লাভের। মারি বাশকির্তসেভ তার রূপের প্রেমে এতোই মুগ্ধ ছিলেন যে তিনি একে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন অবিনাশী মর্মরে; যখন তিনি লিখেছিলেন এশব্দগুলো, তখন তিনি নিজেকেই দান করেছিলেন অমরত্ব :

‘বাড়ি ফেরার পর আমি পোশাক খুলে ফেলি এবং আমার নগ্ন সৌন্দর্য দেখে মোহিত হই যেনো একে আমি আগে কখনো দেখি নি। আমার একটি ভাস্কর্য অবশ্যই তৈরি করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? বিয়ে না করলে এটা একেবারেই অসম্ভব। কুৎসিত হয়ে উঠে একে নষ্ট করার আগে এটা অবশ্যই করতে হবে… শুধু ভাস্কর্যটি তৈরির জন্যে হলেও আমাকে একটি স্বামী পেতেই হবে’।

অভিসারে যাওয়ার জন্যে তৈরি হওয়ার সময় সেসিল সসারেল নিজেকে চিত্রিত করেছেন এভাবে :

‘আমি আমার আয়নার সামনে। আমাকে আরো রূপসী দেখাতে হবে। আমি আমার সিংহের কেশর নিয়ে খাটাখাঁটি করতে থাকি। আমার চিরুনি থেকে স্ফুলিঙ্গ বেরোতে থাকে। আমার মাথাটি সোনালি রশ্মিতে ঘেরা একটি সূর্য’।

আমার মনে পড়ছে আরেক তরুণীকে, যাকে আমি এক সকালবেলা দেখেছিলাম একটি কাফের প্রসাধনঘরে; তার হাতে ছিলো একটি গোলাপ এবং তাকে একটু নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছিলো; সে আয়নায় তার ঠোট লাগায় যেনো সে পান করতে চায় তার প্রতিবিম্বটিকে, এবং স্মিত হেসে সে গুঞ্জন করে ওঠে : ‘মোহিনী, আমি একেবারে মনোমমাহিনী!’ একই সঙ্গে যাজিকা ও মূর্তি, আত্মরতিবতী গৌরবের জ্যোতিশ্চক্র পরে চিরন্তন ভুবনের ভেতর দিয়ে উড়াল দিয়ে উঠতে থাকে ওপরে, এবং মেঘমণ্ডলের নিচে মোহিত হয়ে নতজানু হয় প্রাণীরা; সে হচ্ছে আত্মধ্যানে নিমগ্ন বিধাতা। ‘আমি নিজেকে ভালোবাসি, আমি আমার বিধাতা!’ বলেছিলেন মাদাম মিয়েরোস্কি। যে-তরুণী তার আয়নায় দেখতে পেয়েছে তার নিজের দেহের গঠনের

মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে রূপ, বাসনা, প্রেম, সুখ, সে তার সমগ্র চেতনা দিয়ে বিশ্বাস করে এ-দীপ্ত প্রত্যাদেশ টিকে থাকবে সারাজীবন। নারীটি যদি নিখুঁত রূপসী নাও হয়, তবুও সে দেখতে পায় তার মুখাবয়বে দীপ্ত হয়ে উঠেছে তার আত্মার বিশেষ সৌন্দর্য, এবং তাকে নেশাগ্রস্ত করার জন্যে এটুকুই যথেষ্ট। ‘তার রূপের জন্যে তাকে পছন্দ নাও করতে পারে, তবে তার আছে বিশেষ এক অপরূপ যাদু…’

এটা বিস্ময়কর নয় যারা কম ভাগ্যবান, তারাও অনেক সময় ভাগ পায় আয়নার পরমোল্লাসের, কেননা তারা আবেগ বোধ করে নিতান্ত এ-ঘটনায়ই যে তারা একটি মাংসের বস্তু, যা তারা সত্যিই; যেমন ঘটে পুরুষের বেলা, তরুণীর রমণীয় মাংসের বিশুদ্ধ প্রাচুর্য তাদের বিস্ময়াভিভূত করার জন্যে যথেষ্ট; এবং তারা যেহেতু নিজেদের স্বতন্ত্র কর্তা বলে বোধ করে, তাই তারা একটু আত্মপ্রবঞ্চনার মাধ্যমে তাদের বিশেষ গুণাবলিকে দিতে পারে একটি ব্যক্তিগত আকর্ষণীয়তা; তারা মুখে বা দেহে আবিষ্কার করবে কোনো মাধুর্যময়, অস্বাভাবিক, বা উত্তেজক কিন্ত সুখকর বৈশিষ্ট্য। তারা বিশ্বাস করে তারা যেহেতু অনুভব করে যে তারা নারী, শুধু এ কারণেই তারা রূপসী।

এছাড়াও, ডবল লাভের জন্যে আয়নাই একমাত্র উপায় নয়, যদিও এটাই সবচেয়ে প্রিয়। অন্তর্গত সংলাপের মাধ্যমে প্রত্যেকেই সৃষ্টি করতে পারে তার একটি যমজ। সে প্রায় সারাদিন ভরে নিঃসঙ্গ, করে চলছে একঘেয়ে গৃহস্থালির কাজ, কল্পনায় একটি উপযুক্ত চরিত্র সৃষ্টির অবকাশ আছে নারীর। যখন সে ছিলো অল্প বয়সী বালিকা, তখন সে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে; এখন অন্তহীন বর্তমানে বন্দী থেকে সে স্মরণ করে তার ইতিহাস; সে একে আবার এমনভাবে সংশোধন করে যে একে দেয় নান্দনিক শৃঙ্খলা, মৃত্যুর আগেই সে তার অনিশ্চিত জীবনকে রূপান্তরিত করে একটি নিয়তিতে।

পুরুষদের থেকে নারীরা অনেক বেশি এঁটে থাকে বাল্যস্মৃতির সাথে : ‘যখন আমি ছোট্ট মেয়ে ছিলাম…’ তারা স্মরণ করে পিতামাতার তত্ত্বাবধানে তারা স্বাধীন ছিলো, তাদের সামনে ছড়ানো ছিলো মুক্ত ভবিষ্যৎ এখন তারা কম নিরাপদ, এবং তারা বর্তমানের মধ্যে রুদ্ধ হয়ে আছে চাকর বা বস্তুর মতো; একদা তাদের সামনে ছিলো জয় করার জন্যে বিশ্ব, এখন তারা পরিণত হয়েছে সাধারণ্যে : লাখ লাখ স্ত্রী ও গৃহিণীর একটিতে। সে হয়ে উঠেছে যে-নারী, সে আক্ষেপ করে সে-মানুষটির জন্যে, যা সে ছিলো এক সময়, এবং সে আবার দেখতে চায় তার ভেতরের মৃত শিশুটিকে, এমনকি পুনর্জীবিত করতে চায় তাকে। তাই সে ভাবার চেষ্টা করে যে তার রুচি, ভাবনা, আবেগের মধ্যে এখনো আছে একটা অসাধারণ সজীবতা, এমনকি আছে কিছুটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বকে না মানার ঔদ্ধত্য : ‘তুমি আমাকে চেনো’; ‘ওই দিক দিয়ে আমি অদ্ভুত’; ‘আমাকে ঘিরে আমি ফুল চাই’; ইত্যাদি। তার আছে একটি প্রিয় রঙ, একজন প্রিয় গায়ক, বিশেষ বিশ্বাস ও কুসংস্কার, যা সাধারণ্যের থেকে ওপরের। তার অনন্য ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় বস্ত্রে ও তার ‘অভ্যন্তর’-এ; সে তৈরি করে একটি ডবল, যা প্রায়ই রেখাচিত্রিক, তবে কখনো কখনো সেটি হয়ে ওঠে একটি নির্দিষ্ট সম্রান্ত ব্যক্তি, যার ভূমিকায় নারীটি জীবনভর অভিনয় করছে। বহু নারী নিজেদের দেখতে পায় সাহিত্যের নায়িকাদের মধ্যে : ‘সে একেবারে আমার মতো!’ এ-ধরনের অভিন্নতা সে বোধ করতে পারে রূপসী, রোম্যান্টিক নায়িকাদের বা শহিদ নায়িকাদের সাথে। নারী প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতে পারে আমাদের দুঃখিনী রমণীর বা অনাদৃত স্ত্রীর : ‘আমি জগতের সবচেয়ে হতভাগিনী নারী’। স্টেকেল এ-ধরনের এক রোগিণী সম্পর্কে বলেছেন : ‘সে আনন্দ পেতো এ-বিষাদান্তক ভূমিকায়অভিনয় করে’।

একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণভাবে দেখা যায় এসব নারীর মধ্যে, তা হচ্ছে তারা মনে করে তাদের ভুল বোঝা হচ্ছে; তাদের চারপাশের লোকজন তাদের বিশেষ গুণাবলি বুঝতে ব্যর্থ; তাদের প্রতি অন্যদের এ-অজ্ঞতা বা ঔদাসীন্যকে তারা অনুবাদ করে এ-ধারণায় যে তাদের অন্তরে তারা ধারণ করে কিছু গূঢ় সত্য। ঘটনা হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই নীরবে সমাহিত করেছে তাদের শৈশবের বা যৌবনের কিছু উপাখ্যান, যেগুলোর অতিশয় গুরুত্ব ছিলো তাদের জীবনে; তারা জানে তাদের আনুষ্ঠানিক জীবনীগুলোকে তাদের প্রকৃত জীবনকাহিনী বলে মনে করা ঠিক নয়। তবে প্রায় সময়ই আত্মরতিপরায়ণ নারীর নায়িকা নিতান্তই কাল্পনিক, কেননা সে বাস্তবিক জীবনে আত্মসিদ্ধি লাভ করে না; মূর্ত বিশ্ব তাকে দান করে নি তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য : এটা এক সংগুপ্ত নীতি, ফ্লোজিস্টনের মতোই অবোধ্য এক ধরনের শক্তি বা গুণ। নারী তার নায়িকার বিদ্যমানতায় বিশ্বাস করে, কিন্তু সে যদি তাকে প্রকাশ করতে চাইতো অন্যদের সামনে, তাহলে সে তেমন বিব্রত হতো স্পর্শাতীত অপরাধের স্বীকারোক্তি করতে গিয়ে যেমন বিব্রত হয় স্নায়ুবিকল ব্যক্তি। উভয়ের ক্ষেত্রেই গৃঢ় সত্যটি কমে পরিণত হয় শূন্যগর্ভ একটি প্রত্যয়ে যে অনুভূতি ও ক্রিয়াগুলোর পাঠোদ্ধার ও সত্যতা প্রতিপাদনের জন্যে তাদের অন্তরের অন্তস্তলে আছে একটা চাবি। তাদের ইচ্ছাশক্তির রুগ্ন অভাব, জড়তা, স্নায়ুবিকল ব্যক্তিদের মধ্যে সৃষ্টি করে এ-মতিবিভ্রম এবং দৈনন্দিন কর্মের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার অসামর্থ্যই নারীকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে তার অন্তরেও আছে এক অনির্বচনীয় রহস্য। নারীর রহস্যময়তার বিখ্যাত কিংবদন্তিটি উৎসাহিত করে এ-বিশ্বাসকে এবং পালাক্রমে এর দ্বারা দৃঢ়তরভাবে বলবৎ হয়।

তার ভুল-বোঝা সম্পদে ঋদ্ধ হয়ে, তার নিজের দৃষ্টিতে, বিয়োগান্তক নায়কের প্রয়োজন হয় যেমন একটা প্রধান নিয়তি, তার অংশীদার হয়ে ওঠে নারী। তার সমগ্র জীবনকে দেয়া হয় একটি আদর্শায়িত মূর্তি এবং সেটি হয়ে ওঠে এক পবিত্র নাটক। তার ভাবগম্ভীরভাবে নির্বাচিত গাউনের ভেতরে সে দাঁড়ায়, যাজকীয় বস্ত্রে যুগপৎ সে একজন যাজিকা এবং বিশ্বাসীদের হাতে শ্রীমণ্ডিত ও ভক্তদের পুজোর জন্যে উপস্থাপিত এক মূর্তি। তার গৃহ হয়ে ওঠে মন্দির, যেখানে সম্পন্ন হয় তার পুজো। আত্মরতিপরায়ণ নারী তার বস্ত্রের প্রতি যতোটা যত্নশীল ততোটাই যত্নশীল সে-সব আসবাব ও অলঙ্কারের প্রতি, যা তাকে ঘিরে থাকে।

যখন সে নিজেকে প্রদর্শন করে অন্যদের কাছে বা নিজেকে সমর্পণ করে প্রেমিকের বাহুবন্ধনে, নারী সিদ্ধ করে তার ব্রত : সে হয়ে ওঠে ভেনাস, যে তার রূপের অমূল্য সম্পদ দান করছে বিশ্বকে। সেসিল সেরেল যখন বিবের ব্যঙ্গচিত্রের কাঁচের ঢাকনাটি ভাঙেন, তখন তিনি নিজের নয়, পক্ষ নিয়েছিলেন সৌন্দর্যের; তার মেমওয়ার-এ দেখতে পাই সারাজীবন তিনি মরগণকে ডেকেছেন শিল্পকলা আরাধনার জন্যে। আইসোডোরা ডাঙ্কানও তা-ই করেছেন, এভাবে তিনি নিজেকে চিত্রিত করেছেন মাই লাইফ-এ :

‘একেকটা অনুষ্ঠানের পর, আমি টিউনিক পরা, আমার চুল গোলাপে ঢাকা, আমাকে এতো রূপসী দেখাতো। কেননা উপভোগ করা হবে না এ-সৌন্দর্য?… যে-পুরুষ সারাদিন পরিশ্রম করে মগজের… তাকে কেননা নেয়া হবে না এ-সুন্দর বাহুতে এবং মুক্তি পাবে না তার কষ্ট থেকে এবং কয়েক ঘণ্টার জন্যে ভোগ করবে না সৌন্দর্য ও বিস্মরণ?’

আত্মরতিবতীর সহৃদয়তা তার জন্যে একটি লাভের জন্ম দেয় : আয়নার থেকে অনেক বেশি ভালোভাবে অন্যদের চোখের ভেতরে সে দেখতে পায় গৌরবের জ্যোতিক্রথচিত তার ডবলকে। যদি সে কোনো অনুরক্ত দর্শকশ্রোতামণ্ডলি না পায়, তাহলে সে তার মন খুলে দেয় কোনো স্বীকারোক্তিগ্রহণকারীর কাছে, চিকিৎসকের কাছে, মনোচিকিৎসকের কাছে; সে যায় হস্তরেখাবিদ ও অলোকদ্রষ্টার কাছে। ‘এমন নয় যে আমি তাদের বিশ্বাস করি,’ বলেছে চলচ্চিত্রের একটি ‘ক্ষুদেতারকা’, ‘তবে আমি ভালোবাসি কেউ আমার কাছে আমার নিজের সম্বন্ধে কথা বলুক!’ সে তার বন্ধুর কাছে বলে তার সম্পর্কে সমস্ত কথা; অন্য যে-কোনো লোকের থেকে বেশি ব্যাকুলভাবে সে তার প্রেমিকের মধ্যে খোঁজে একটি শ্রোতা। সত্যিকার প্রেমে পড়েছে যে-নারী, সে অবিলম্বে ভুলে যায় তার অহংকে; তবে বহু নারী খাঁটি প্রেমে জড়িয়েপড়তে অসমর্থ, শুধু এ-কারণে যে তারা কখনো নিজেদের ভুলতে পারে না। তারা নিভৃত কক্ষের অন্তরঙ্গতার থেকে বেশি পছন্দ করে বড়োসড়ো মঞ্চ। এজন্যেই তাদের কাছে সমাজের গুরুত্ব : তাদের দিকে তাকানোর জন্যে তাদের দরকার চোখ, তাদের কথা শোনার জন্যে তাদের দরকার কান; সম্রান্ত ব্যক্তি হিশেবে তাদের দরকার যথাসম্ভব শ্রেষ্ঠ শ্রোতৃমন্ডলি। তার নিজের ঘরের বর্ণনা করে মারি বাশকির্তসেভ অবাধে করেছেন এ স্বীকারোক্তিই : ‘এভাবে লোকজন যখন এসে দেখে আমি লিখছি তখন আমি থাকি মঞ্চেই’। এবং আরো : ‘আমি ঠিক করেছি আমি নিজেকে দেখবো মঞ্চরূপেই। আমি নগরে সারার থেকে উৎকৃষ্টতর একটি বাড়ি, ও বড়ো স্টুডিও তৈরি করবো’।

তাঁর ব্যাপারে, মাদাম দ্য নোয়াইলে লিখেছেন : ‘আমি মুক্তাঙ্গন ভালোবাসতাম এবং এখনো ভালোবাসি… বহু অতিথি সমাগমে যারা ভয় পেতে যে এতে আমি বিরক্ত হতে পারি, প্রায়ই আমি ক্ষমা চেয়ে সে-বন্ধুদের আশ্বস্ত করতে সমর্থ হয়েছি এ-আন্তরিক অবাধ প্রকাশ্য স্বীকৃতির মাধ্যমে : আমি খালি আসনের সামনে অভিনয় করতে পছন্দ করি না’।

পোশাক ও কথোপকথন অনেকাংশে তৃপ্ত করে এ-নারীসুলভ প্রদর্শনের রুচি। তবে কোনো উচ্চাভিলাষী আত্মরতিবতী নিজেকে প্রদর্শন করতে চাইবে আরো কম সাধারণ ও বহুবিচিত্র রীতিতে। বিশেষ করে, সে প্রায়ই নিজের জীবনকেই করে তুলবে জনগণের হর্ষধ্বনির কাছে উপস্থাপিত একটি প্রদর্শনীরূপে এবং ঐকান্তিকভাবে ঢুকবে মঞ্চে। কোরিন-এ মাদাম দ্য স্কাল আমাদের বিস্তারিতভাবে বলেছেন হার্পসহযোগে কবিতা আবৃত্তি করে তিনি কীভাবে অভিভূত করেছিলেন ইতালীয় ভিড়কে। কোপেতে তার সুইস পল্লীভবনে তার একটি প্রিয় বিনোদন ছিলো বিয়োগান্তক চরিত্রের ঢঙে কথা বলা; তিনি পছন্দ করতেন ফেদ্র সেজে হিপোলিতের পোশাকপরিহিত এক বা আরেক প্রেমিকের কাছে অতিশয় ব্যাকুলভাবে প্রণয় নিবেদন করতে। পরিস্থিতি অনুকূল হলে অভিনয়-মঞ্চের কাছে প্রকাশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার থেকে আর কিছুই এতো গভীরভাবে তৃপ্ত করে না আত্মরতিবতীকে। ‘অভিনয়-মঞ্চ’, বলেছেন জর্জেৎ লেব্লা, ‘আমাকে তা দেয়, যা আমি দীর্ঘকাল ধরে চেয়েছি : পরমানন্দ লাভের একটি কারণ। আজ একে আমার মনে হয় ক্রিয়ার ব্যঙ্গরূপ, এমন একটা কিছু, যা অতিরিক্ত মেজাজের জন্যে অপরিহার্য’।

তিনি যে-বাকভঙ্গিটি প্রয়োগ করেন, তা চমকপ্রদ। কাজের অভাবে নারী আবিষ্কার করে কাজের বিকল্প; কারো কারো কাছে অভিনয়-মঞ্চ একটি প্রিয় বিকল্প।অভিনেত্রীরা, অধিকন্তু, পোষণ করতে পারে নানা লক্ষ্য। কারো আরো কাছে অভিনয় হচ্ছে জীবিকার একটা উপায়, নিতান্তই একটি পেশা; অন্যদের কাছে এটা এনে দেয় এমন খ্যাতি, যা ব্যবহার করা যেতে পারে নাগরালির কাজে; আরো অন্যদের কাছে, এটা এনে দেয় তার আত্মরতির বিজয়োল্লাস। বড়ো অভিনেত্রীরা–রাশেল, দুস–খাঁটি শিল্পী, যারা বিভিন্ন ভূমিকায় সীমাতিক্রমণ করেন নিজেদের; কিন্তু তৃতীয়-মানেরটি, এর বিপরীতে, সে কী অর্জন করছে তাতে উৎসাহী নয়, বরং এটা তার জন্যে যেগৌরব বয়ে আনছে, তাতে উৎসাহী; সবার আগে সে জোর দিতে চায় তার নিজের গুরুত্বের ওপর। নিজেকে সমর্পণ করার অসামর্থ্যবশত একগুঁয়েআত্মরতিবতী প্রেমে যেমন সীমাবদ্ধ শিল্পকলায়ও তেমনি সীমাবদ্ধ।

এ-ক্রটির সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে তার সমস্ত কাজের ওপরই। সে প্রলোভন বোধ করবে যে-কোনো ও প্রতিটি পথের প্রতি, যা তাকে নিয়ে যাবে খ্যাতির দিকে, কিন্তু সে কখনোই সর্বান্তকরণে কোনো একটিতে নিজেকে নিয়োজিত করবে না। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, আর সমস্ত জ্ঞানের শাখা, যাতে দরকার পড়ে কঠোর শিক্ষানবিশি ও একলা প্রচেষ্টা; বহু নারী এগুলো চেষ্টা করে দেখে, কিন্তু অবিলম্বে তারা এগুলো ছেড়ে দেয় যদি না তারা চালিত হয় সৃষ্টি করার ইতিবাচক বাসনা দিয়ে; অনেকে অধ্যবসায় চালিয়ে যায়, তবে তারা কাজের নামে খেলার বেশি কিছু করে না। তারা ঘণ্টার পর ঘন্টা ইজেলের সামনে কাটাতে পারে, কিন্তু তারা নিজেদের এতো মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসে যে চিত্রকলার প্রতি তাদের কোনো প্রকৃত ভালোবাসা থাকে না এবং তাই তারা পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। যখন কোনো নারী, মাদাম দ্য স্তাল ও মাদাম দ্য নোয়াইলের মতো, ভালো কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়, তখন ব্যাপার হচ্ছে সে। একান্তভাবে আত্মপুজোয়ই মগ্ন থাকে নি; তবে অজস্র নারী লেখককে অধঃপতিত করে যে-সব ত্রুটি, তার একটি হচ্ছে তাদের আত্মপ্রেম, যা তাদের আন্তরিকতাকে দূষিত করে, তাদের সীমাবদ্ধ করে, এবং তাদের মর্যাদা হ্রাস করে।

তাদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি প্রত্যয়শীল বহু নারী, অবশ্য, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব জগতের কাছে প্রকাশ করতে পারে না; তখন তাদের উচ্চাভিলাস দেখা দেয়কোনো একটি পুরুষ, যাকে তারা মুগ্ধ করতে পারে তাদের গুণে, তাকে মধ্যস্থতাকারীরূপে ব্যবহার করার। এমন নারী তার নিজের মূল্যবোধ অনুসারে তার স্বাধীন পরিকল্পনার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে না; সে তার অহংয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় গতানুগতিক ভাবনাচিন্তা; তাই নিজেকে প্রেরণা, কলালক্ষ্মী, এজেরিয়ারূপে পুরুষের প্রভাব ও খ্যাতির সঙ্গে অভিন্ন করে তোলার আশায় সে আশ্রয় নেয় সে-সব পুরুষের, যাদের আছে প্রভাব ও খ্যাতি। লরেন্সের সঙ্গে সম্পর্কে মাবেল ডজ লুহান পরিচয়। দিয়েছেন এর এক চমকপ্রদ উদাহরণের : তিনি চেয়েছেন ‘লরেন্সের মনকে প্রলুব্ধ করতে, কিছু উৎপাদনে তাঁর মনকে বাধ্য করতে’; তার দরকার ছিলোলরেন্সের সপ্নবিভাব, তাঁর সৃষ্টিশীল কল্পনাপ্রতিভা; তাঁর নিজের কিছু করার ছিলো না বলে এদুঃখের এক ধরনের ক্ষতিপূরণ হিশেবে লরেন্সকে দিয়ে কাজ করিয়ে তিনি এক ধরনের সক্রিয়তা বোধ করতেন। তার তাওসমূহের সুফল লাভের জন্যে, তিনি চাইতেন লরেন্স জয় করবে তাঁর মাধ্যমে। একই উপায়ে জর্জেৎ লেব্লা হতে চেয়েছিলেন মেটারলিংকের ‘খাদ্য ও শিখা’; তবে তিনি মেটারলিংকের বইয়ে তার নিজের নামও চেয়েছিলেন। এখানে আমরা পাচ্ছি না সে-উচ্চাভিলাষী নারীদের, যারা নিজেদের লক্ষ্য সাধনের জন্যে ব্যবহার করে পুরুষদের, বরং পাচ্ছি সে-নারীদের, যারা গুরুত্বলাভের একটা মন্ময় বাসনা দ্বারা উদ্দীপিত, যার কোনো বস্তুগত লক্ষ্য নেই, এবং যারা অন্যের সীমাতিক্ৰমণতা চুরি করার জন্যে একাগ্রচিত্ত। তারা কোনোক্রমেই সব সময় সফল হয় না; তবে তারা নিজেদের কাছে নিজেদের ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখতে এবং তাদের অপ্রতিরোধ্য প্রলুব্ধকরতায় নিজেদের প্ররোচিত করতে নিপুণ। নিজেদের তারা ভালোবাসার যোগ্য, কাম্য, প্রশংসণীয় জেনে নিশ্চিত থাকে যে অন্যরা তাদের ভালোবাসছে, কামনা করছে, এবং প্রশংসা করছে।

এসব মোহ ঘটাতে পারে প্রকৃত মস্তিষ্কবিকৃতি, এবং ক্লেরাম্বল কামক্ষিপ্ততাকে অকারণে এক ধরনের পেশাগত ‘ব্যাধি’ বলে গণ্য করেন নি; নিজেকে নারী বলেবোধ করা হচ্ছে নিজেকে একটি কামনার বস্তু বলে বোধ করা, নিজেকে কাম্য ও প্রেমাস্পদ বলে বোধ করা। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে যে-রোগীরা এ-মোহে ভোগে যে তাদের কেউ ভালোবাসে, তাদের দশজনের মধ্যে ন-জনই নারী। এটা বেশ স্পষ্ট যে কাল্পনিক প্রেমিকের মধ্যে তারা যা চায়, তা হচ্ছে তাদের আত্মরতির মহিমান্বিতকরণ। তারা চায় একে দেয়া হোক একটা অবিসম্বাদিত মূল্য, কোনো পুরোহিত, চিকিৎসক, আইনজীবী, বা কোনো শ্রেষ্ঠ পুরুষ দ্বার। এবং পুরুষটির আচরণ প্রকাশ করে যেনিরঙ্কুশ সত্য, তা হচ্ছে পুরুষটির কল্পনার দয়িতা সর্বোপরি সমস্ত নারীর থেকে অপ্রতিরোধ্য ও শ্রেষ্ঠতর গুণাবলিতে পরিপূর্ণ।

কামক্ষিপ্ততা দেখা দিতে পারে বিচিত্র ধরনের মনোবৈকল্যের সঙ্গে, তবে এর আধেয় সব সময়ই এক। ব্যক্তিটি দীপ্তিময়ভাবে মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে ওঠে এমন একজন বিখ্যাত পুরুষের প্রেম দ্বারা, যে হঠাৎ তার আকর্ষণীয়তায় মুগ্ধ হয়েছে–যখন সে এধরনের কিছুই প্রত্যাশা করছিলো না–এবং যে তার আবেগ প্রকাশ করে পরোক্ষ তবে সনির্বন্ধ রীতিতে। এ-সম্পর্ক অনেক সময় থেকে যায় আদর্শ স্তরে এবং অনেক সময় ধারণ করে যৌন ধাচ; তবে এর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে নারীটি যতোটা প্রেমে পড়েছে, বিখ্যাত ও শক্তিশালী নরদেবতাটি প্রেমে পড়েছে তার থেকে বেশি এবং সে তার সংরাগ প্রকাশ করে অদ্ভুত ও দ্ব্যর্থবোধক রীতিতে।

তবে আত্মরতির কমেডি অভিনীত হয় বাস্তবতার মূল্যে; একটি কাল্পনিক চরিত্র এক কাল্পনিক জনগণের কাছে প্রশস্তিবোধের সনির্বন্ধ আবেদন জানায়; তার অহংয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে সে বাস্তবিক জগতের ওপর সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলে, অন্যদের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোন আগ্রহ তার থাকে না। তাঁর অনুরাগীরা রাতে তাদের নোটবইয়ে লিখবে যে-সব ক্ৰিপাত্মক মন্তব্য, সেগুলোর কথা যদি আগেই বুঝতেন মাদাম দ্য স্কাল, তাহলে তিনি অনেক কম উৎসাহে কথা বলতেন ফের ঢঙে। তবে আত্মরতিবতী একথা মানতে অস্বীকার করে যে সে নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করে, লোকজন তাকে সে থেকে ভিন্নভাবেও দেখতে পারে, এটাই ব্যাখ্যা করে একথা যে যদিও সে সব সময়ই মগ্ন থাকে আত্মধ্যানে, তবু কেননা সে হয়ে থাকে নিজের নিকৃষ্ট বিচারক, এবং কেননা সে অতি সহজেই হাস্যকর হয়ে ওঠে। সে আর শোনে না, সে বলে; এবং যখন সে বলে তখন সে তার ভূমিকা বলে।

মারি বাশকির্তসেভ লিখেছেন : ‘এটা আমাকে আমোদ দেয়। আমি তার সাথে আলাপ করি না, আমি অভিনয় করি, এবং আমি আছি যথার্থ-মূল্য-বুঝতে-সমর্থ এক দর্শকমণ্ডলির সামনে, এটা অনুভব করে আমি দক্ষ হয়ে উঠি শিশুসুলভ ও খেয়ালি স্বরে কথা বলতে এবং ঢংয়ে’।

সে নিজেকে এতো বেশি দেখে যে সে কিছুই দেখতে পায় না; সে অন্যদের মধ্যে যেটুকু নিজের মতো বলে চেনে, শুধু সেটুকুই বুঝতে পারে; যা কিছু তার নিজের সঙ্গে, তার নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, তা রয়ে যায় তার বোধগম্যতার বাইরে। সে তার অভিজ্ঞতাগুলোকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে ভালোবাসে; সে জানতে চায় প্রেমের মাতলামো ও যন্ত্রণা, মাতৃত্বের, বন্ধুত্বের, নির্জনতার, অশ্রুর ও হাস্যের বিশুদ্ধ আনন্দ; তবে সে যেহেতু নিজেকে দান করতে পারে না, তাই তার আবেগগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি। সন্দেহ নেই যে তাঁর সন্তানদের মৃত্যুতে আইসোরা ডাক্কান সত্যিকার অশ্রু ফেলেছেন। কিন্তু যখন তিনি মস্ত যাত্রাভিনয়ের ভঙ্গিতে তাদের ভস্ম সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে চান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন একটি অভিনেত্রী মাত্র; এবং কারো পক্ষে বিবেকের অস্বস্তি ছাড়া আমার জীবন-এর এ-অংশটুক পড়াসম্ভব নয়, যাতে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন তার দুঃখের :

‘আমি অনুভব করি আমার নিজের দেহের উষ্ণতা। আমি তাকাই আমার নগ্ন পায়ের দিকে–ওগুলো ছড়িয়ে দিই। আমার স্তনের কোমলতা, আমার বাহু, যেগুলো কখনো স্থির নয়, বরং কোমলভাবে। তরঙ্গিত হয়ে নিরন্তর দুলে যাচ্ছে, এবং আমি বুঝতে পারি যে বারো বছর ধরে আমি ক্লান্ত, এ-বক্ষ মনে মনে পোষণ করেছে এক অশেষ যন্ত্রণা, আমার এ-হাত দুটিতে লেগে আছে দুঃখের দাগ, আর যখন আমি একলা থাকি, তখন এ-চোখ দুটি কদাচিৎ শুষ্ক থাকে’।

কিশোরী তার আত্মপুজো থেকে উদ্বিগ্নকর ভবিষ্যতের মুখখামুখি দাঁড়ানোর সাহস সংগ্রহ করতে পারে; তবে তাকে অবিলম্বে পেরিয়ে যেতে হয় এ-স্তর, নইলে ভবিষ্যৎ রুদ্ধ হয়ে যায়। যে-নারী তার প্রেমিককে বন্দী করে যুগলের সীমাবদ্ধতার মধ্যে, সে তার প্রেমিক ও নিজেকে বিপর্যস্ত করে মৃত্যুতে; এবং যে-আত্মরতিবতী নিজেকে অভিন্ন করে তোলে তার কাল্পনিক ডবলের সাথে, সে ধ্বংস করে নিজেকে। তার স্মৃতিগুলো হয়ে ওঠে অনড়, তার আচরণ ছকবাঁধা; সে কথার পুনরুক্তি করে, সে পুনরাবৃত্তি করে। আন্তরিকতাহীন নাটকীয় আচরণের, যেগুলো ধীরেধীরে সব অর্থ হারিয়ে ফেলেছে, তাই নারীদের লেখা বহু দিনপঞ্জি ও আত্মজীবনীর এমন দরিদ্রদশা; নিজের জন্যে ধূপ জ্বালানোয় পুরোপুরি নিয়োজিত থেকে, যে-নারী কিছুই করে না সে নিজেকে কিছুই করে তুলতে পারে না এবং ধূপ জ্বালায় একটি অসত্তার জন্যে।

তার দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে, তার সমস্ত আন্তরিকতাহীনতা সত্ত্বেও, সে সচেতন এঅসারতা সম্পর্কে। একটি ব্যক্তি ও তার ডবলের মধ্যে কোনো সত্যিকার সম্পর্ক থাকতে পারে না, কেননা এ-ডবলের কোনো অস্তিত্ব নেই। আত্মরতিবতী হঠাৎ মুখোমুখি হয় এক মৌল হতাশার। সে একটি সমগ্রতারূপে মনে মনে নিজের ছবি আঁকতে পারে না, পুর-সো–আঁ-সো হওয়ার প্রতিভাস রক্ষা করতে সে অসমর্থ হয়। তার বিচ্ছিন্নতা, প্রতিটি মানুষের বিচ্ছিন্নতার মতোই, আকস্মিকতা ও নিঃসহায়পরিত্যাগরূপে অনুভূত হয়। এবং এজন্যেই–যদি সে না বদলায়–নিজের জন্যে কথা বলার জন্যে সে দণ্ডিত হয় ভিড়ের কাছে, অন্যদের কাছে, অস্থিরতাবে পালিয়েযেতে। একথা মনে করা খুব ভুল হবে যে নিজেকে পরম লক্ষ্যরূপে গণ্য করে সে মুক্তি পায় পরনির্ভরতা থেকে; বরং এর বিপরীতে, সে নিজেকে ধ্বংস করে অতিশয়সার্বিক দাসত্বে। সে স্বাধীনভাবে দাঁড়ায় না, বরং নিজেকে করে তোলে একটি বস্তু, যা বিপন্ন। হয় বিশ্ব ও অন্য সচেতন সত্তাদের দ্বারা।

আত্মরতিবতী, প্রকৃতপক্ষে, হেতাইরার মতোই পরনির্ভর। বিশেষ একটি পুরুষের স্বৈরাচার এড়িয়ে গেলেও সে মেনে নেয় জনমতের স্বৈরাচার। এ-বন্ধন, যা তাকে বেঁধে রাখে অন্যদের সাথে, তাতে নেই বিনিময়ের পারস্পরিকতা, কেননা সে আর আত্মরতিবতী থাকতো না, যদি সে চাইতো যে অন্যরা স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করে তাকে স্বীকৃতি দিক, এবং যদি সে এ-মূল্যায়নকে নিজের কর্মের দ্বারা অর্জনীয় লক্ষ্য বলে মনে করতো। তার মনোভাবের বিসঙ্গতিটি এখানে যে সে এমন এক বিশ্বের কাছে থেকে মূল্য পেতে চায়, যাকে সে নিজে মূল্যহীন মনে করে, কেননা তার বিচারে একমাত্র সে-ই মূল্যবান। অন্যদের অনুমোন হচ্ছে একটা অমানবিক শক্তি, রহস্যময় ও চপল, এবং এটা অর্জনের যে-কোনো উদ্যোগ নিতে হবে যাদুর মাধ্যমে। তার। অগভীর ঔদ্ধত্য সত্ত্বেও, আত্মরতিবতী তার অনিশ্চিত অবস্থান বুঝতে পারে; এবং এই ব্যাখ্যা করে কেননা সে অস্থির, অতিস্পর্শকাতর, খিটখিটে, সব সময় সম্ভাব্য বিপদের দিকে লক্ষ্য রাখে; তার অহমিকা চির-অতৃপ্ত। যতোই সে বুড়োহতে থাকে, ততোই ব্যগ্রভাবে সে কামনা করে স্তুতি ও সাফল্য এবং সে আরো সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে থাকে তার চারদিকের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে; বিহ্বল, আবিষ্ট, সে আত্মগোপন করে আন্তরিকতাহীনতার তমসায় এবং প্রায়ই নিজেকে ঘিরে বিকারগ্রস্ত মানসিক বৈকল্যের একটি খোলক তৈরি করে পরিসমাপ্তি লাভ করে। একটি প্রবাদ আছে, যা একান্তভাবে তার বেলা যথোচিত : ‘যে জীবন লাভ করেছে, সে তা হারাবে’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *