৬-১০. রবিবার সকালে

০৬.

 রবিবার সকালে সোম-এর কার্ডটা পকেটে নিয়ে হাজরার মোড় অবধি হেঁটে এসে বাস ধরল যুযুধান কুদঘাটের।

কনডাক্টরকে জিজ্ঞেস করল কোথায় হবে জায়গাটা। কনডাক্টর বলল, তা জানি না দাদা, তবে এমন জায়গায় নামিয়ে দেব যে, খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। মনে হচ্ছে কুঁদঘাটের শেষ প্রান্তেরও শেষ প্রান্তে।

এর আগে কখনো আসেনি যুযুধান কুদঘাট। মোড়ের পানের দোকানে জিজ্ঞেস করতে দোকানি বাঁ-হাত দিয়ে পাশের গলিটা দেখিয়ে দিল। বলল, অনেকটা যেতে হবে। একটা অটো-টটো নিলে ভালো করতেন।

অনেকটা মানে যে এতখানি, ঠিক অনুমান করতে পারেনি যুযুধান। যেখানে এসে পড়ল সে জায়গাটার চেহারা গ্রাম গ্রাম। এখনও বেশ কিছু গাছগাছালি আছে। টিনের চালের বাড়ি এবং সব চেয়ে বড়ো স্বস্তির কথা এই যে, একটিও বহুতল বাড়ি নেই। এক একটি বহুতল কংক্রিটের বাড়ির এফেক্ট এক একটি পাহাড়েরই মতো। পুরো কলকাতার আবহাওয়া যে এমন বদলে গেল তার পেছনে এই বহুতল বাড়িগুলোর মস্ত ভূমিকা আছে। জলের জন্যে এখন পাইপ নামাতে হচ্ছে অনেকটা গভীরে। বড়ো বড়ো গাছওয়ালা পাখি-ডাকা লন ও বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর সব গাছ কেটে পাখিদের নিরাশ্রয় করে কংক্রিটের পাহাড় গজিয়ে গেল চারিদিকে, আকাশ পর্যন্ত দেখা যায় না। এই বাড়িগুলোকেঘেন্না করে যুযুধান।

একটি চায়ের দোকানের সামনে রবিবারের সকালে কয়েকটা ছেলে বসে ছিল। গত শনিবার তারা রেসের মাঠে গেছিল। হার-জিতের হিসেব করছিল নিজেদের মধ্যে। যুযুধান। সোম-এর নাম বলে, বাড়ির ঠিকানা বলে শুধোল, ওরা জানে কি না?

একটি ছেলে বলল, ও, পাগলা ইনকাম ট্যাক্স?

যুযুধান হেসে বলল, পাগলা বলা কি ঠিক? পাগলাটে বরং বলা ভালো।

 অন্যজন বলল, পাগলা রে পাগলা, সাঁকোটা নাড়াস না।

আর একজন দূরে দেখিয়ে বলল, ওই যে কচুরিপানাভরা পুকুরটা দেখছেন, তারই পাশে যে ম্যাড়ম্যাড়ে-হলুদ একতলা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে ওটাই ওঁর বাড়ি। বুঝেছেন তো? ওই মস্ত গাছটার ঠিক তলায়।

বাড়িতে কি আছেন এখন?

অন্যজন বলল, যাচ্চলে। তা আমরা কী করে জানব? আমরা কি পাগলা ইনকাম ট্যাক্সের বউ? না, মাগ?

যুযুধান একবার ছেলেটির দিকে চেয়ে আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে চলল।

কয়েক পা যেতেই যুযুধানের কানে এল, ওরে দেখ তো, এ লোকটাকে অমলের দাদা বলে মনে হচ্ছে না? এ পাড়াতে ছোঁক ছোঁক করছে কেন?

আর একজন বলল, অমল বলে, দাদা আমার ভারি সতীপনা করে। এই সেই দাদা। একই দাদা তো অমলের।

প্রথমজন বলল, সতী! শালা। দেশে ঢ্যাঁড়া পেটালে সতী মেলে না মেয়েদের মধ্যেই আর এ দুম্বো পুরুষ কিনা সতী? কী দিনকাল হল মাইরি।

অন্যজন বলল, অ্যাই তোরা চুপ কর। অমলের দাদা হলে কী হয় এই হচ্ছে সেই যুযুধান রায়, লেখক।

ছাড় শালা! আজকাল লেখক-ফেখকের কোনো খাতির নেই। হত প্লেয়ার, কি ফিলম স্টার, তো বুঝতাম। চোর-ডাকাতেরও খাতির বেশি লেখকের চেয়ে। কী মাল ছড়াচ্ছে কে কোন কাগজে কার শালার পড়বার টাইম আছে? লেখা-পড়াই উঠে গেছে দেশ থেকে। কিছু মেয়েরা পড়ে। তাও যারা ভালো দেখতে নয়। ভালো চেহারার মেয়েরা তো সবসময়ই বুকড। তাদের ফালতু সময় কোথায় এসব পড়বার?

না না। উনি বড়ো লেখক।

জানলি কী করে? মা-ন-তু।

 যাঃ শালা। বিজ্ঞাপনে কত বড়ো বড়ো করে নাম ছাপা হয় দেখিস না? যুযুধান রায়। আজকাল নিরমা বা গোল্টকাফের মতো লেখকও পায়দা করে বিজ্ঞাপন। বুয়েছিস। কে বড়ো কে ছোটো তা মাল পড়ে বলতে হয় না।

কী যুক্তি। খবরের কাগজে তো পান-বাহারেরও বিজ্ঞাপন বড়ো বড়ো করে বেরোয়। তা বলে কি পান-বাহারও লেখক।

তুই শালা একটা থার্ড ক্লাস ইললিটারেট। তুই তো বুঝিস ঘোড়া আর মেয়েছেলে।

 ততক্ষণে যুযুধান অনেক দূরে চলে এসেছে। সব কথা যে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। এমনও নয়। শুধু একটা কথাই ওর মাথায় ঘুরছে যে, এই ছেলেগুলি অমলের বন্ধু অথবা ধান্দার অংশীদার। তারা যখন তাকে দেখেই অমলের দাদা বলে চিনে ফেলেছে তখন অমলকে তারা বিলক্ষণই চেনে। কথাটা মনে করেই বাঁ-দিকের বুকের কাছে এবং বাঁ-হাতে ব্যথা বোধ করতে লাগল যুযুধান।

.

এসে গেছে সোম-এর বাড়ি। সামনে সামান্য একটু পথ। পুকুরটাতে কচুরিপানা ভরে রয়েছে। দুজন মেয়ে শাড়ির ওপরে বুকের কাছে গামছা ফেলে ওই পুকুরেই ডুব দিতে নামল। যুযুধানকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল।

 একটা ডাহুক পাখি কচুরিপানার ওপরে নাচতে নাচতে সরে গেল। আন্দাজেই বুঝল ডাহুক পাখি। ভারি ভালো লাগল যুযুর।

একটা মস্ত গাছ। কী গাছ কে জানে? হলুদ বাড়িটার দেওয়ালে একটি কালোরঙা লেটার বক্স। সোমের নাম লেখা তাতে।

কড়া নাড়তেই দুটো কুকুর ভেতর থেকে বন্ধ দরজার দিকে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। তারা দরজায় নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। ভেতর থেকে সোম-এর গলা শোনা গেল। তারপর খড়মের শব্দ।

কুকুর দুটোকে ধমকে বলল, এই কুত্তার বাচ্চারা। মারব এক লাথি। সর সর।

সোম আজকাল বড়ো খারাপ ভাষা ব্যবহার করে, স্কুলে পড়ার সময় একেবারেই অন্যরকম ছিল। কে জানে! ওর জীবন এবং বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীতই বোধ হয় ওকে এমন রুক্ষ করে দিয়েছে। অথবা এটা ভেক। লোক-দেখানেনা। তাও হতে পারে।

 সোম দরজা খুলেই বলল, মাই ডিয়ার যুযু! হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আয় আয় ভেতরে আয়।

যুযুধান ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভারি সুন্দর জায়গায় তোর বাড়ি। কত্ত গাছ। এটা কী গাছ রে? এই মস্ত গাছটা?

আরে এটাও চিনিস না? এ তো বিলিতি আমড়া। তোকে দিয়ে দেব ক-টা। বাড়ি গিয়ে অম্বল রেঁধে খাস।

সোম-এর পরনে একটি সবুজ আর সাদা খোপ-খোপ লুঙ্গি। ওপরে হাত-কাটা গেঞ্জি। শরীরের গড়ন এখনও খুবই মজবুত। বুক ভরতি চুল।

সোম ডাকল, সপ্তমী।

একটি বছর পঁচিশের মেয়ে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে।

সোম বলল, আগে দু-কাপ চা কর। ওমলেট করে আমাদের দে। তারপর মাংসটা ভালো করে মাখ দেখি দই দিয়ে। আমি নিজে হাতে রান্না করব। আমার বন্ধু এসেছে। স্কুলের বন্ধু। যু যু।

মেয়েটি ভীতচোখে তাকালো যুযুর দিকে।

 মনে মনে বলল, কী নাম রে বাবা! জুজু!

আয় আয়। আমরা উঠোনেই বসি! হাওয়া আছে।

মাটির উঠোন। একপাশে তুলসী মঞ্চ। সন্ধ্যামালতীর ঝাড়। জুই। এককোণে একটি টগর গাছ। ছোটো ছোটো পাখি তাতে কিচিরমিচির করছে। বিলিতি আমড়া গাছটা ঝুঁকে আছে, ওপর থেকে। বহুদূর অবধি চিকন-সবুজ ডালপালা ছড়িয়ে।

সামনের ঘরটা বসার ঘর। উলটোদিকে রান্নাঘর। টিনের চালের। ডানদিকে শোবার ঘর। উঠোনের একপাশে একটি কুয়ো এবং একটি টিউবওয়েল। কুয়োর চারপাশটা বাঁধানো। কাপড় শুকোবার দড়ি, আমড়া গাছের ডাল আর একটা বাঁশের মাঝামাঝি বাঁধা আছে।

অবাক হয়ে দেখছিল যুযুধান কলকাতার মধ্যেও এখনও এমন জায়গা আছে দেখে, এমন বাড়ি আছে দেখে অবাক হচ্ছিল।

আয় বোস। বলে, সোম দুটি হাতল-আলা ভীষণ ভারী শালকাঠের চেয়ার আনল বসবার ঘর থেকে উঠোনে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বলল, ছাড় তো সপ্তমী, একটা টুল ছাড়। আমার বন্ধু পা রাখবে।

বলেই, একটা কাঠের টুল এনে যুযুধানের পায়ের কাছে রাখল। বলল, অ্যাই, অ্যাই, অ্যাই যে। পা তুলে দে। আরাম করে বোস। ছেলেবেলায় তোদের বাড়ি কত আদর যত্ন পেয়েছি। মাসিমা কত খাইয়েছেন, তোর জন্যে কোনোদিন তো কিছুই করিনি। পা টিপে দেব কি? বল?

যুযুধানের খুব লজ্জা করছিল। ওকে এমন আর কেউ কখনো করেনি। সোম-এর কুকুর দুটো উঠোনে শুয়েছিল পায়ের ওপরে মাথা রেখে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলছিল। তাতে তাদের নাকের সামনে থেকে ধুলো উড়ে যাচ্ছিল। একটি মাছি এসে ওদের নাকে-কানে বসছিল ভনভন করে। বিরক্ত হচ্ছিল দুটি কুকুরই। একটি কালো আর একটি লাল।

কীরে যুযু কথা বলছিস না কেন?

বড়ো বেশি অবাক হয়ে গেছি বলেই বোধ হয়। তোর ব্যাপার তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু খুলে বল। কলকাতার কোনো ইনকামট্যাক্স অফিসারকে তেমনভাবে থাকতে তো দেখিইনি। থাকার কথা ভাবতেও পারি না।

ছিলাম। ছিলাম। এখন আর নেই। ও পরিচয়ে আমাকে ডাকিস না।

 ঠিক আছে।

আমার বন্ধুদের কেমন দেখছিস?

কারা? কোথায়?

যুযুধান বলল।

 এই যে। স্নেহ আর মমতা। স্নেহটা কালো। পুরুষ ওটা। লালটা মমতা। মেয়ে।

ওদের নামোচ্চারিত হতে দেখেই ওরা কান নাড়াল।

সোম বলল, অনেক হয়েছে। চুপ করে শুয়ে থাক।

 তারপর বলল, এখন বই আর রেকর্ড আর ক্যাসেট ছাড়া ওরাই আমার বন্ধু, আত্মীয়, পরিজন, যাই বলিস। মানুষের ওপর বিশ্বাস আমার একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কুকুরের মতো প্রাণী নেই। এত ভালোবাসা, এত কৃতজ্ঞতা। অথচ ভগবান শালা এই ফাসকেলাস ভদ্রলোকেদেরই আয়ু এত কম দিলেন কেন, কে জানে? কচ্ছপ, মানুষ এসব ওয়ার্থলেস জানোয়ারের এত আয়ু দিলেন আর এদের? ভালোবাসাটা পাকতে না পাকতেই কাঁদিয়ে চলে যাবে। জানি, চলে যাবে। তবু যতদিন থাকে। তবে এটাও ঠিক যে, সেবা করে যাবে জেনারেশান আফটার জেনারেশান। ওদের ছেলে-মেয়ে, নাতি পুতি, যতদিন অবধি আমি বেঁচে আছি এরা কোনোদিন আমাকে ফেলবে না। দু-বেলা দু-মুঠো খাবার দিলেই এই কৃতঘ্ন, তঞ্চক পৃথিবীতে এত ভালোবাসা আর কে দিত বল?

ওঃ ভালো কথা। তোর ভাদ্রবউ মুনিয়া কেমন আছে?

মুনিয়া কে?

আরে তোর ভাইয়ের বউ।

শ্ৰীলা?

ওই তিলগুলোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলি? ও সেদিন বলতেই ভুলে গেছিলাম, ওর ডান উরুতে দুটো বড়ো বড়ো লাল তিল আর বাঁ-দিকের পেছনে, মানে ছাপতে সবুজ রঙের বাংলা পাঁচ-অক্ষরের মতো একটি জন্মদাগ আছে। শুয়ে ভারী আরাম ছিল ওর সঙ্গে।

 যুযুধান উঠে পড়ে বলল, আমি কি চলে যাব? আমার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী সম্বন্ধে এমন সব কথা শোনা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

সোম বলল, বোস। বোস। আমার কথা ধরিস কেন রে? আমি তো পাগল। সবাই জানে। পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়। ভুলে যা।

 ভুলে যাই কী করে? ভোলার মতো কথা তো তুই বলছিস না।

হঠাৎ সোম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলল, মার গুলি শালা! আমি আমার সমস্ত জীবনটা ভুলে যেতে পারলাম আর তোর ভাদ্রবউ পয়সা নিয়ে লোকের সঙ্গে শুত এই সামান্য কথাটা তুই ভুলে যেতে পারছিস না। আমি কি তার সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা বলেছি?

 সোম-এর উত্তেজনায় কুকুর দুটো তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে কটমটে চোখে যুযুধানের দিকে চেয়ে রইল।

আমার ছোটো ভাইয়ের…

মার গুলি শালা। সংসারে কেউ কারও নয় রে যুযু। আমার জীবন দিয়ে শিখেছি কথাটা। তাই তোকে বলছি। এ আমার বইয়ে পড়া কথা নয়। চোখের জলের কথা। যাকগে, ও প্রসঙ্গ। আমি আর তুলবই না। আমার কী? তবে বড়ো সব সুখের দিনের কথা মনে পড়ে গেছিল সেদিন ওকে দেখে, তাই..। তাই তো তোর বাড়িতে জলখাবার না খেয়েই চলে এসেছিলাম। জলখাবার খেলে যদি অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করত! অব্যেস বড়ো খারাপ জিনিস রে ভাই। মুনিয়া আমার অব্যেস হয়ে গেছিল।

 একটু চুপ করে থেকে বলল সোম গম্ভীর গলায়, চলে এসেছিলাম, তোকে আহত করেছিলাম বলেও।

অন্য কথা বল।

যুযুধান বলল।

সরি। এই সপ্তমী। বেশি করে পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা লঙ্কা আর …

আমি কাঁচা লঙ্কা খাই না।

সে কী রে! কাঁচা লঙ্কাই তো জীবন!

আচ্ছা, তাহলে প্যাঁজ খাস তো?

 তা খাই।

 তাহলে প্যাঁজ, একটু দুধ, একটু চিনাবাদাম আর একটু ডালমুট ফেলে দিস বাবুর ওমলেটে। ভালো করে ফ্যাটাবি ডিম ভেঙে নিয়ে ওগুলো দিয়ে, তারপর নরম নরম থাকতে তুলে নিবি। পোড়াবি না। না পারিস তো বল, আমি যাচ্ছি।

রান্নাঘরের ভেতর থেকে সপ্তমী নীচু গলায় কী একটা বলল, তার মানে সোমই বুঝল।

বলল, ঠিক আছে। কর। আর হলেই আমাদের এনে দে। আগে ওমলেট। তারপর চা।

 বলেই বলল, তোর ক-চামচ চিনি যুযু?

দু-চামচ।

বাবুর চায়ে দু-চামচ চিনি। আমার চায়ে চার চামচ। জানিসই তো!

এই বাড়ি তোর নিজের বাড়ি? যুযুধান শুধোল।

হ্যাঁ। এই একটিই নিজস্ব সম্পত্তি আছে আমার। চাকরিতে ঢোকার দু-বছর পর কিনেছিলাম। কত করে কাঠা কিনেছিলাম বল তো?

কত?

শুনলে তুই ভিরমি যাবি। এসব জায়গায় যে পরে বাড়ি করে কেউ থাকবে তা তো ভাবেনি কেউই। শালা, আমিই কি ভেবেছিলাম। আমাদের আগের জেনারেশানের মানুষেরা ঢাকুরিয়া লেক, বালিগঞ্জকেই জঙ্গল দেখেছেন।

কত জমি আছে?

এক বিঘে ছিল। দশ কাঠা বেচে তা থেকে এই বাড়ি করেছি। আর বাকি টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে রেখেছি। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড ইত্যাদিও পেয়েছিলাম লাখ দেড়েক মতো। পেনশান এ মাস থেকে পাচ্ছি। আমি যে নির্দোষ তা কতৃপক্ষ এখন বুঝেছেন। আমি কিছু বলতে যাইনি। তবে আমাকে রি-ইনস্টেটও করবে বলে মনে হচ্ছে।

তাহলে তো ফিরেই যাচ্ছিস ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে।

দুর শালা। ওরা করলে করুক। লোকে জানবে যে, আমি অন্যায় করিনি। কিন্তু চাকরি ফিরে পেলেও আর ফিরে যাব না। আয়কর ভবনেও যাব না আর এই জন্মে।

কেন? এখন তো যাস।

এখন যাই! আমার বিবেক পরিষ্কার বলে যাই। আমার কলিগ, জুনিয়র, সিনিয়র, সবাই আমাকে নির্দোষ বলে মানেন বলেই যাই। চাকরি ফেরত যেদিন দেবে সেদিন থেকেই সম্পর্ক ছেদ করে দেব সকলের সঙ্গে। আমার কাছে যারা ভালোবেসে আসবে, তারা আসতে পারে। যেমন তুই এসেছিস। আমি কারও দরজায় বা ওই ডিপার্টমেন্টে আর যাব না। শালা এত বড়ো অন্যায় যেখানে হতে পারে একজন মানুষের ওপর সেখানে মানুষের কোনো ভরসা নেই।

আসলে কী হয়েছিল, বলবি না?

বলব, বলব, সবই একদিনে শুনে কী করবি? সব কথাই বলার বা শোনবার সময় চাই। আমার প্রতি যদি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখিস তবে তো আবারও আসবি। বলব কখনো। আমি ভালো এ কথা বলতে গেলে, তোকে বোঝাতে গেলে, অন্য একজন যে খারাপ বড়োই খারাপ, এ কথাও তো তোকে বলতে হবে। আসলে কোনো মানুষ সম্বন্ধেই আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বিশ্বাস কর। আমার কালু-লালুর সম্বন্ধে আমার অনেকেই বেশি ইন্টারেস্ট পৃথিবীর যে-কোনো মানুষের চেয়ে।

এখানে জমি পাওয়া যায় আর?

খোঁজ করতে হয়।

কীরকম কাঠা এখন?

তা হাজার কুড়ি পঁচিশ তো হবে। আমার ঠিক জানা নেই রে। তুই যদি বলিস তো খোঁজ করতে পারি।

শান্তিনিকেতনে জমি পাচ্ছি পাঁচ হাজার করে কাঠা। তুই কী বলিস? নেব?

নিয়ে নে। নিয়ে নে। দামের জন্যে নয়, প্রাণের আরামের জন্যে। যুযু, এখনও সময় আছে। প্রকৃতির কাছে ফিরে যা, গাছপালা, পাখি, ফুল, নদী, মাঠ, মনুষ্যত্বে ফিরে যা। পারলে এই কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে পালা, এই ইলেকট্রিসিটি থেকে, এই লোভ, এই নিয়ত-অসুখ ছেড়ে; প্রাগৈতিহাসিক কালে ফিরে যা। যদি বাঁচতে চাস। প্রিয় নারী, প্রিয় মাটি, প্রিয় পালিত প্রাণী নিয়ে এই সুন্দর চাঁদ তারার ব্রহ্মান্ডে পরমশান্তিতে বাস কর। বাঁচতে কতটুকু দরকার হয় রে একজন মানুষের? কতটুকু? বড়ো শহর ছেড়ে এই সাংঘাতিক শ্বাপদদের ভিড় থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচা।

তোর বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই?

না। চারপাশের সব বাড়িতে আছে। আমি ইচ্ছে করেই নিইনি। আমাদের বাপ দাদারা তো দিব্যি চালিয়ে গেছিলেন। সুখ-শান্তি তো তাঁদের অনেকই বেশি ছিল আমাদের চেয়ে। মরার সময়ও টুপ করে মরে যেতেন! জ্যান্ত অবস্থাতে শকুনের মতো একগাদা অর্থগৃদ্ধ ডাক্তারেরা ব্লাড-প্রেশার, ব্লাড-সুগার, ক্লোরোস্ট্রোল, ইউরিক-অ্যাসিড, হার্ট, কিডনি, ইসিনোফিলিয়া নিয়ে এত হইচই করে মানুষকে জিয়ন্তে মৃত করে রাখত না। কথায় কথায় ছুরি ধরে পাঁচ দশ হাজার খসাত না। মরে গেলে পাড়ার লোকে বলত উনি সন্যাস রোগে মরিয়াছেন। কী শান্তি ছিল বলত। শালার টি ভি ছিল না, প্রচন্ড ডেসিবলে-বাজা সব কানের পর্দা ফাটানো গান-বাজনার রেকর্ড ছিল না। শান্তি! কী শান্তি!

সপ্তমী বলে মেয়েটি স্টেইনলেস স্টিলের প্লেটে করে ওমলেট এনে দিল!

যুযুধান বলল, আমি কিন্তু দুপুরে এখানে খাব না বলে তো আসিনি। তোর না হয় ঘর সংসার নেই। আমার তো ভাই আর তার বউ আছে। দুপুরে খাওয়ার আগে না ফিরে গেলে তারা থানা পুলিশ করবে।

ভাবছিস তাই। শালা! তুই মরে গেলেও তোকে বারো ঘণ্টা মনে রাখবে না রে। বারো ঘণ্টাও মনে রাখবে না। যতদিন বেঁচে আছিস এইসব সুখ-কল্পনা করেই বেঁচে থাক।

তুই বিয়ে করিসনি সোম?

করেছিলাম।

তাহলে?

আমার বন্ধু আমার চাকরি এবং বউ দুই-ই একসঙ্গে নিয়ে নিল। উলটে আমাকে চোর বানাল। সেসব কথা থাক। খারাপ-জিনিস নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো।

তোর ছেলে-মেয়ে?

আছে। চুরির দায়টা যেমন আমার ঘাড়ে চাপিয়েছিল, ছেলে-মেয়ের দায়টাও তেমনই। তবে আমি তাদের আসল বাবা নই। পদবিটাই আমার। আমার ছেলেকে দেখবি?

বলেই হাঁক ছাড়ল, এই সপ্তমী। তোর ছেলে কই? কোথায় গেলিরে? পাঙা?

অমনি অদৃশ্য থেকে একটি সাত-আট বছরের ছেলে, খালি গা, একটি খাকি হাফপ্যান্ট পরা, একটি দিশি আমে আঁটি চুষতে চুষতে কুয়োটা ঘুরে যুযুধানের সামনে এসে দাঁড়াল।

বলল, কী বইলতেচো?

 ইস্কুলের পড়া করবি না?

কইরবোনে। মাংস ভাত রাঁধতিচি মা। ভালো কইরো মাংস-ভাতটা খেয়ে নিয়ে তাপ্পর পড়তে বসবোনে।

 বুঝেছি। মাংস-ভাতটা খাওয়ার পর তো মায়ের কোলে ঠ্যাংটি তুলে দিব্যি ঘুমোবে সেই চারটে অবধি। তারপর ডাংগুলি খেলবে।

ডাংগুলি কেনে? আজ তো রোববার। আজ ফুইটবল।

তাই খেলিস প্যাঙা। ফুটবলের পেছনে লাথি মেরো বাপ। এখন যাও আমটা খেয়ে হাতটা ধুয়ে এসে আমাকে ধন্য করো।

তোর ছেলে? অবাক হয়ে যুযুধান বলল।

ছেলে সপ্তমীর। সপ্তমীর বর মরেছে কলে কাটা পড়ে। ডায়মণ্ডহারবার রোডে একটি টেক্সটাইল মিলে কাজ করত। গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফাণ্ড সব মেরে দিয়েছে। কিছুই দেয়নি। সপ্তমীর চেহারা ছবি ভালো। ছেলেটাকে আমি অ্যাডাপ্ট করেছি। এ পাড়ার মাগো বীণাপাণি স্কুল-এ ভরতি করে দিয়েছি।

অ্যাডাপ্টই যখন করলি তখন কোনো ভালো ইংলিশ-মিডিম স্কুলে দিলি না কেন?

কী জন্যে? বাঁদর বানাবার জন্যে? ইংরিজি গালাগালি, ইংরিজি গান, আর চুটিয়ে ইংরিজি বলতে পারবে বলে? আজকাল তো আবার হিন্দি-মিশ্রিত ইংরিজি চালু হয়েছে। তারপর সাবান, তেল, টিভি, টুথব্রাশের ফেরিওয়ালা হবে? ব্রিলিয়ান্ট মার্কেটিংম্যান! প্রোডিগ্যাল ম্যানেজার! প্র্যাগম্যাটিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট! সব তো মাড়োয়ারি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ব্যাবসাদারদের চাকর হয়ে, বাপ-মাকে তাচ্ছিল্য করে ধরাকে সরা-জ্ঞান করবে! ও আমার অনেক দেখা আছে। প্যাঙা যখন কলেজে পড়বে তখনও ওকে দিয়ে আমি পা টেপাব রাত্তিরবেলা। দিশি কুকুরদের যেমন অ্যাডাপ্ট করেছি, দিশি ছেলেই অ্যাডাপ্ট করব। দোআঁশলা ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই।

আর সপ্তমী?

তাকেও অ্যাডাপ্ট করেছি।

যুযু অবাক হয়ে বলল, মেয়ে হিসেবে?

দুর শালা! তুইও যেমন। মেয়ে কেন, বউ হিসেবে।

বউ অ্যাডাপ্ট?

হোয়াই নট? ছেলে-মেয়ে তো আর হবে না। নিজের নাম আর পদবি তো পরের ছেলে মেয়েকে দান করেই দিয়েছি। নিজের নামটাই তো চুরি হয়ে গেছে। নিজের ছেলে-মেয়ে হলে ঝামেলা। এই ভালো। উইলও করে ফেলেছি একটা। আমার এই বাড়ি এবং যতটুকু সঞ্চয় আছে তা সপ্তমী পাবে। তবে প্যাঙাকে মানুষ করার এবং কালু-লালুকে কুকুর হিসেবে যতদিন বাঁচবে তাদের পূর্ণ সম্মান ও রক্ষণাবেক্ষণ তাকেই করতে হবে।

তোর উইল এগজিকুট করবে কে?

সে একজন হাইকোর্টের জজ এবং একজন নামি সলিসিটারকে এগজিকুটর করেছি। উইল ঠিকই একজিকুটেড হবে। জজ সাহেব আমার ছেলেবেলার বন্ধু।

আমি যদি একটা উইল করে যাই তো তুই তার একজিক্টর হবি?

নিশ্চয়ই। কিন্তু দাগি চোর, চুরির দায়ে যার চাকরি যায়, তাকে কি তোর এগজিক্টর করা উচিত?

সে আমি বুঝব।

আর একজন?

আর একজন কাকে করি তাই ভাবছি।

তোদের পাড়ার মোড়ের মধুদার পান-বিড়ির দোকানটা এখনও আছে?

তোর মনে আছে এখনও? আশ্চর্য মেমারি তোর! সত্যি! আছে। তবে মধুদার এখন প্রায় ষাট বছর হতে চলল।

তো ওই মধুদাকেই কর। তুই থাকতে থাকতে মধুদা পটল তুললে তখন ভেবেচিন্তে আর একজনকে করিস। আমি পটল তুললেও আমার জায়গায় অন্য একজনকে করতে হবে।

চাল নেই চুলো নেই মধুদাকে করা কি ঠিক হবে?

একদম ঠিক হবে। চাল-চুলোওয়ালাদের মধ্যে ভদ্রলোক আর নেই বললেই চলে। বেশির ভাগই চোর-ছ্যাঁচোড়।

তাই করব তাহলে।

সপ্তমী যখন চা নিয়ে এল তখন ভালো করে চেয়ে দেখল যুযুধান। বুদ্ধিমতী, সুন্দর শরীরের গড়ন। তবে ঘোর লালরঙের শায়ার ওপরে ঘোর বেগুনে রঙের একটি তাঁতের শাড়ি। গায়ে একটা ছাইরঙা ব্লাউজ। রুচি-টুচির কোনো বালাই-ই নেই।

যুযুধানের চোখে তাকিয়ে সোম বলল, আমার বিয়ে করা বউ-এর রুচি খুব ভালো ছিল। কোন রঙের সঙ্গে কোন রং যায় না-যায় তা দারুণ জানত। পার্ক স্ট্রিটের হেয়ার-ড্রেসারের কাছে গিয়ে পেডিকিউর, ম্যানিকিউর, ফেসাল, হেয়ার-ডু সব করে আসত। ইকেবানা জানত। সাজসজ্জা ছিল তার দেখার মতো। কিন্তু বাইরের সাজ নিয়ে, বাইরের চরিত্র নিয়ে তো ঘর করলাম! নিরাবরণ শরীর আর নিরাভরণ সরল সৎ মন যার আছে তাকে দিয়েই বাকি জীবন চলে যাবে আমার! আসল কাকে বলে আর মেকি কাকে বলে তা আমার মতো জানবি না তুই কক্ষনো।

স্তব্ধ বিস্ময়ে, মাথা নীচু করে বসে যুযুধান বলল, হবে।

হবে না রে। এইটেই সত্যিকথা।

আমি এবারে উঠব সোম। চা খাওয়া হল।

আরে দাঁড়া। দাঁড়া। পান খা দুটো। একছিলিম হুঁকো খেয়ে যা।

হুঁকো!

 হ্যাঁরে। এমন নির্দোষ নেশা আর কী আছে। তোকে আলাদা হুঁকো দেব।

প্যাঙা–আ-আ, বলে এক তীব্র ডাক ছাড়ল সোম।

আমি এইখানে।

একটি ক্ষীণক শোনা গেল ঊর্ধ্বাকাশ থেকে।

কোথায় গেছিস হতভাগা? মেরে তোর হাড় গুঁড়ো করে দেব।

এই যে! আমড়া গাছে। আমড়া খেতিচি।

নেমে আয় এখুনি। হুঁকো সাজ আমাদের জন্যে। সপ্তমী, ভালো করে চারখিলি পান সাজ তো দেখি। আমার বন্ধুকে জর্দা দিস না।

যুযুধান বলল, প্যাঙাকে একটা ভালো স্কুলে দিলি না এইটে ভেবেই আমার দুঃখ হচ্ছে।

 ভালো স্কুলে দিলে জন্ম-জ্যাঠা হয়ে যেত, আমার পদবির ছেলে-মেয়েরা যেমন হয়েছে। প্যাঙার শৈশব আর কৈশোর তো থাকবে নিজস্ব। তাতে কেউ আর চুরি করে নিতে পারবে না। এই পুরো এডুকেশন সিস্টেমটাকেই স্ক্যাপ করে দেওয়া উচিত। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় আছে কার বল? একমাত্র চিন্তা তো গদির। পাঁচ বছর বাদে বাদে কী করে গদিতে বসা যায়। এই চিন্তা সকলেরই। আর মধ্যের পাঁচটা বছর শুধু ভুজুং-ভাজুং। এমন করেই পাঁচ ইন্টু এইট চল্লিশ বছর কেটে গেল। আমার পলিসিই ভালো, বুঝলি। প্যাঙাদের তবু কিছু নিজস্বতা থাকবে, মধুদাদের মতোন। ইংলিশ-মিডিয়ামের ছেলে-মেয়েগুলো যেন সব রোবোট। একরকম চেহারা, একরকম কথাবার্তা, একরকম উচ্চাশা, সব প্রোটোটাইপ, ওরিজিনালিটি বলে কোনো ব্যাপারই নেই। অমানুষ তৈরি করা হয় সেখানে মানুষের বাচ্চাদের ভরতি করে। আসলে যে-কোনো এডুকেশনেরই একটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত। ছেলে-মেয়েরাই জাতের ভবিষ্যৎ। তাদের নিয়ে যে কী ছিনিমিনি খেলা চলছে তা যদি তুই জানতিস। আমার পদবির দুটি বাঁদর-বাঁদরিকে কাছ থেকে দেখে আমি জানি ভালো করেই। ইংলিশ-মিডিয়াম, এডুকেশন অফ লেটার্স দেয়, এডুকেশন অফ ক্যারেকটার দেয় না।

যুযুধান চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমি উঠি।

আরে দাঁড়া। পানটা না হয় হাতে করে নিয়ে গিয়ে রাস্তায়ই খাস, হুঁকোতে তো দু-টান লাগিয়ে যা। তোর থ্রিলড লাগছে না? একবিংশ শতাব্দীর চৌকাঠে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার যে এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছোনোর সাধনা। তাকে কি তুই খারাপ বলিস?

না। তা নয়, তবে তুই যে ওরিজিনাল সে বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। আচ্ছা, একটা কথা বল তো? তুই কি সত্যিই সুখী এই মুহূর্তে! না, তোর নানারকম দুঃখেরই একটা বিকৃত রূপ তোর এই জীবন?

সোম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে এল। তারপর ও বলল, খুবই দুঃখী ছিলাম। আগে ছিলাম। এখন সত্যিই সুখী। সুখ তোকে এ সংসারে চামচে করে কেউই খাইয়ে দেবে না যুযু। তোকে তা কেড়ে নিতে হবে। এবং একজনের সুখ মানেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, আর একজনের দুঃখ। এটাকে বেশিরভাগ সময়েই অ্যাভয়েড করা যায় না। কিন্তু বাই এনি মিনস, সুখকে যদি একবার চিনে নিতে পারিস, তবে সেই সুখকে তোর পাওয়া উচিত, নিজের কাছে টেনে নেওয়া উচিত। চিনে নিলে, তা কাছে টানা নিয়ে দ্বিধা না করাই ভালো।

প্যাঙা আমড়া গাছ থেকে নেমে এসে শোয়ার ঘরে গিয়ে একটু পর দুটো হুঁকো দু-হাতে ধরে নিয়ে এল। বলল, ছিলিম তো সাজানোই ছেলে। জলও পাইলটে দিচি সক্কালে।

সোম প্যাঙাকে বলল, আয় তো দেখি, মাথার পাকা চুল বাছ তো দেখি। একটার জন্যে এক নয়া করে পাবি।

মাইরি বলতেছো?

মাইরি বলতেচি। সোম বলল।

যুযু অবাক হয়ে সোমের দিকে চেয়ে রইল। সোম ম্যাট্রিক পরীক্ষাতে বাংলা এবং ইংরিজিতে লেটার পেয়েছিল। তা ছাড়াও চারটে বিষয়ে লেটার পেয়েছিল। পরবর্তী জীবনেও নিশ্চয়ই সেরকমই ভালো করেছিল ফল।

সপ্তমী রেকাবিতে পান সেজে এনে দাঁড়িয়ে রইল নীরবে। মাথায় একটু ঘোমটা টানা।

নে। পান নে যুযু।

বলেই সপ্তমীকে বলল, তুই তো একটু হাসতেও পারতিস আমার বন্ধুকে দেখে। কই দেখা তো তোর গজদাঁতিটা একবার!

তারপর যুযুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, না হাসলি আবার তেনার গজদাঁতিটা দেখাই দিইতে চান না।

 সপ্তমী কথার ধরনে হেসে ফেলল এবং সত্যিই ভারি মিষ্টি দেখালো হাসিটা গজদন্তর জন্যে।

যুযুধান হুঁকোতে দু-টান দিয়ে, একটু কেশে, পান দুটো হাতে নিয়ে সপ্তমীকে বলল, এবার যাই।

সপ্তমী আবারও গজদন্ত দেখিয়ে হেসে বলল, যাওয়া বইলতে নেই, আসুন। আবার আইসবেন। ওঁর কোনো বন্ধু নেই। এ বাড়িতে উনি কাউকে আনেননি আজ অবধি। দেড় বছর হয়ে গেল। আপনিই একমাত্র মানুষ। আইসবেন। আমারও তো মাঝে মাঝে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে কারও সঙ্গে।

বইয়ের মতো বন্ধু নেই। বই পড়তে পারলে জানবি।

বলেই, যুযুধানকে বলল, ওকে বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করিয়েছি। শিখছে কিন্তু খুবই ফাস্ট। সত্যজিৎ রায়ের বাংলা খুবই ঝরঝরে। তাঁর ফেলুদা কাহিনি দিয়ে শুরু করিয়েছি। ঠাকুরমার ঝুলি বা বুড়ো আংলা দিয়ে শুরু করার বয়স তো আর নেই।

যুযুধান হাসল।

সোম বলল, জানিস তো সপ্তমী, আমার বন্ধু কিন্তু লেখে টেখে। যুযুধান রায়। তোকেও সই করে বই দেবে যদি তাড়াতাড়ি আরও একটু শিখতে পারিস।

সপ্তমী হাসল! বলল, আপনার একটি গল্প পড়েছি আমি।

কোথায়?

রীতিমতো সহর্ষে বলল, যুযুধান।

একটি পুজো সংখ্যাতে। ভালো নেগেচে বেশ।

নেগেচে নয়, লেগেছে। প্যাঙাকেও একটু শেখা। ছ্যা! লোকে বলে কী?

নাকের ভয় কি আপনি করেন?

না। করি না। আর করি না যে সেটা তোরা সকলে জেনে গেছিস বলেই তো যা-নয়-তা করে বেড়াচ্ছিস।

চলিরে। তোকে বাসরাস্তা অবধি তুলে দিই আমি।

না না।

এই যে কালু-লালু, টা! টা! করে দাও কাকাকে। এই প্যাঙা গেলি কই? হতচ্ছাড়া?

কোথা থেকে একটা আওয়াজ এল, আমি যে পাইকানায়।

আরও আম খাও। বাঁদর ছোকরা। আম, আমড়া হুঁকো সব একসঙ্গে।

যুযুধান আর সপ্তমী একসঙ্গে হেসে উঠল।

সপ্তমী বলল, জুজু কারও নাম হয়? আমি তো নাম শুনেই ভয়ে মরি।

সোম বলল, আরে ইডিয়ট। ওর নাম জুজু নয়। যুযু। যুযুধান।

 মানে কী?

সংসদের অভিধান কিনে দিয়েছি। মাংসটা ভালো করে দই দিয়ে মেখে প্যাঙাকে নিয়ে পড়তে বোস গিয়ে। মাংস আমিই রাঁধব খুব জম্পেশ করে। যুযুধান মানে দেখে আমাকে বলে যাবি। বুঝেছিস।

এবারে সত্যিই চললাম রে। ভৌ। ভৌ। ভুক ভুক করে ডাকল লালু-কালু। সোম বলল, পরদিন তোকে আমার লাইব্রেরিটা দেখাব। যবে আসবি দু-দিন আগে একটা পোস্ট-কার্ড ফেলে দিস।

আচ্ছা।

ভাবতে ভাবতে যুযুধান বাসরাস্তার দিকে এগোল। ক্রমশ পেছনে পড়ে যেতে লাগল সোম-এর নিজস্ব জগৎ! আমড়া গাছ, কুয়োতলি, কালু-লালু, কাঁচা উঠোন, সোম-এর অ্যাডাপ্টেড বউ আর অ্যাডাপ্টেড ছেলে, সপ্তমী, আর প্যাঙা। পাকা বাড়ি, টিভির গাঁকগাঁক, গাড়ির হর্ন, বাসের ও মিনির আওয়াজ, হাজার হাজার লোকের গলার স্বর, মাথা-তোলা তিনতলা চারতলা বাড়ির আড়ালে ক্রমশই হারিয়ে যেতে লাগল সোম-এর একেবারে ওরিজিনাল জগৎ। কলকাতায় যে সোমের প্রোটোটাইপ আর দ্বিতীয় নেই সে কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে যুযুধান।

.

প্রায় বাসস্টপেজে চলে এসেছে, হঠাৎ পেছনে একটা মোটর সাইকেলের আওয়াজ পেল সোম। সেটা পাশে এসে আস্তে হয়ে গেল।

অমল বলল, দাদা! তুমি এখানে?

 ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল যুযুধান, সকালে যে ছেলেগুলি চায়ের দোকানের সামনে বসেছিল তাদেরই একজন মোটর সাইকেলের পেছনে বসে আছে। অনেক বোঁচকা-কুঁচকি তার দু দিকেই।

যুযুধান বলল, এসেছিলাম। তুই কোথায় এসেছিলি?

এই যে। আমার বিজনেস-পার্টনার সিভাস সেন।

কী নাম?

সিভাস। সিভাস রিগ্যাল হুইস্কি আছে না?

তার নামে।

কীসের বিজনেস তোর?

অর্ডার সাপ্লাই।

চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস?

 সে কব্বে।

আমাকে জানাসনি তো।

কী হবে? কামাই না থাকলে জানাতাম।

বাড়িতে খাবি না?

না! আজ শ্রীও আসবে। আমরা পিটারক্যাট-এ খাব। লাঞ্চ।

সেটা কোথায়?

ওমা! তাই জানো না? মিডলটন রে-তে।

ও।

চলি। অমল বলল।

চলি দাদা। অমলের বন্ধুও বলল। সিভাস।

.

০৭.

 শালা আর যুযুধান খেতে বসেছিল। পচার মা খাবার দিচ্ছিল। শ্রীলা বসবার আগে সব গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে বসেছিল।

 একটি বাসন্তী রঙা তাঁতের শাড়ি পরেছে শ্রীলা। মধ্যে কালো কালো বুটি। সঙ্গে একটি কালো ব্লাউজ। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যেমন হাতার ব্লাউজ পরতেন, স্লিভলেসও নয় আবার আধখানা হাতাও নয়, এইরকম ব্লাউজ পরেছে সে একটা।

কী হল দাদা। আপনি আজ খাচ্ছেন না?

কই? না তো। খাচ্ছি তো।

মুড়িঘণ্টটা আমি বেঁধেছি। কেমন হয়েছে?

ভালো। খুবই ভালো। আমি তো ভেবেছিলাম, পচার মা বেঁধেছে।

না। আমি।

বাঃ খোকা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

 হ্যাঁ।

কিন্তু তুমি আজ বাড়িতে আমার সঙ্গে খাচ্ছ যে। তোমাদের না আজ পিটার-ক্যাট না কোথায় খাওয়ার কথা ছিল দুপুরে, তাই না?

শ্ৰীলার দু-চোখের মণি স্থির হয়ে গেল।

বলল, আপনি জানলেন কী করে?

আজ তো অমলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কোথায়?

কুঁদঘাটে।

শ্ৰীলার চোখের মণি দুটো কেঁপে গেল।

কুঁদঘাটে? কুঁদঘাটের কোথায়?

সে শেষ প্রান্ত থেকেও অনেকই দূর। প্রায় পাড়াগাঁই বলতে পারো। কাঁচা রাস্তা। দু-ধারে কাঁচা নর্দমা। কিন্তু কী সবুজ! কী সবুজ! ভারি ভালো লাগল। সেখানেই দেখা হল অমলের সঙ্গে। মোটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ওর এক বন্ধু বসেছিল অনেক মালপত্র নিয়ে। নাম বলল সিভাস। পৃথিবীবিখ্যাত মদের নামে নাম। শ্রীলা কিছু বলার আগেই যুযুধান বলল, অমল নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে? বলল, ব্যাবসা করছে? সিভাস সেই ব্যাবসার পার্টনার। ওই তো বলল, তোমরা আজকে দুপুরে…

কথা তো সেইরকমই ছিল। হয়তো অপেক্ষাও করছে। একটার সময় ওর এক বন্ধু, হয়তো আপনি যাকে দেখেছেন সেই, মোটর সাইকেল করে আমাকে নিতে এসেছিল। পেছনে আরও একজন বসেছিল, তার মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল এবং চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। আমাকে দুজনের মধ্যে বসতে বলেছিল, দাদা। আমার গা ঘিনঘিন করছিল, তবু আমি বসতাম, কিন্তু দেখি দোতলার বারান্দাতে অপরেশদার স্ত্রী, হেনাদি দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য বারান্দাতেও ছিল আরও কেউ কেউ। কেন জানি না, আমার ভালো লাগল না। আমি বললাম, আমার শরীর ভালো না, আমি যাব না।

ওর বন্ধু বলল, অমল কিন্তু খুব রেগে যাবে।

বললাম, কী করব? তাছাড়া, দাদা বাড়ি ফেরেনি। দাদাকে না বলেই যাই বা কী করে? সেটাও সত্যি কারণ ছিল দাদা।

হুঁ। যুযুধান বলল।

 ভাত দিই আর একটু?

না। আর দিয়ো না। অবেলায় একটা বিরাট ওমলেট খেয়ে পেট ভরে গেছে। সোম শুনল না কিছুতেই।

কে?

 সেই যে আমার সেই পাগলাটে বন্ধু এসেছিল না সেদিন। মানে এক রবিবার সকালে। তারপর না খেয়েই চলে গেল।

শ্রীলা বাঁ-হাত দিয়ে জলের জাগ থেকে জল ঢালছিল গ্লাসে। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল যুযুধানের শ্রীলার বাম বাহুতে। এক ঝলক দেখতে পেল। তিনটি কালো তিল। আশ্চর্য! কোনোদিনও লক্ষ করেনি আগে। অবশ্য তিল খোঁজার জন্যে এমন চিল-চোখে চায়ওনি কখনো।

 বুকটা ধক করে উঠল। অশান্তি, ঝামেলা, খারাপ কথা, অপ্রিয় প্রসঙ্গকে বড়ো ভয় করে যুযুধান।

শ্রীলা বলল, আপনার সেই বন্ধু কি এখন কুঁদঘাটে থাকেন?

হ্যাঁ।

তোমরা কি কখনো কুঁদঘাটে থাকতে?

 হ্যাঁ।

মাথা নীচু করে বলল শ্রীলা।

তোমার বিয়ের সময়ে তো তোমরা বাঁশদ্ৰোণীতে থাকতে।

হ্যাঁ। কুদঘাট থেকে বিয়ের দু-বছর আগে চলে আসি। বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার করছিলেন। তারপর মাও মারা গেলেন। বাবা তো চিরদিনই শয্যাশায়ী। তাই…। বাবাও।

ও। তুমি খাচ্ছ না কেন শ্রীলা?

পেট ভরে গেছে দাদা। আপনার ভাই, যদি এসে আমাকে মারধর করে আপনি বাঁচাবেন কিন্তু।

মারধর? অমল তোমাকে মারধরও করে নাকি?

না। রোজ কি আর করে? যদি কোনো অন্যায় করি।

পচার মা ইচ্ছে করে আড়ালে চলে গেল।

 কই? একবাড়িতে থেকে আমি তো কখনো বুঝতে পারিনি।

বুঝতে আমি তো দিইনি কোনোদিন দাদা। যদি কখনো অসহ্য হয় তখন বালিশে মুখ দিয়ে কাঁদি। যাতে আপনি না শুনতে পান, যাতে পাড়া-প্রতিবেশী শুনতে না পান, যাতে আপনার সম্মানহানি না হয়।

আমার সম্মানের কথা ভেবে তোমার মুখ বুজে মার খাওয়াটা উচিত হয়নি শ্ৰীলা। আমার সম্মান এত ঠুনকো নয়।

যূনীদিদির কথা ভেবেও চিৎকার করিনি দাদা। আমার বিয়ে হয়তো কোনোদিনও হত না। ক্লাস নাইন অবধি পড়েছি, তাও বাংলা মিডিয়াম স্কুলে। যূনীদিদি যদি এ সম্বন্ধ না করে দিতেন তবে তো ঘর, বর, ছেলে কিছুই পেতাম না। আপনার মতো দেবতুল্য ভাসুরও পেতাম না।

শ্ৰীলার চোখ জলে ভরে এল।

 যুযুধান এরকম নাটকীয় ঘটনার বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে বড় মুশকিলে পড়ে যায়, কিন্তু আজ সকালে সোমকে দেখে পৃথিবীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গেছে। কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতিই তার কাছে আর আশ্চর্যজনক বলে মনে হবে না হয়তো।

যুযুধান উঠে শ্রীলার মাথাতে তার বাঁ-হাতের তালুটি ছোঁয়াল। সারাশরীরে শিহরন খেলে গেল। লজ্জিত হল যুযুধান। তার নিজের জন্যে, তার ভাইয়ের জন্যেও।

মুখে বলল, তুমি খেয়ে উঠে বিশ্রাম করো। তোমার মাথার তালু তো খুব গরম। তালুতে ভালো করে তেল দিয়ে চান কোরো, গরম জলে, বিকেলে। ভবিষ্যতে, যে ঘটনার কথা তুমি বললে, তা যাতে আর না ঘটে তা আমি দেখব।

.

নীচে নেমে, নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে বড়ো অসহায় বোধ করতে লাগল যুযুধান। এই ভাইকে বশে রাখার মতো কোনো জোরই তার নেই। অমল কোনোদিনও তার শাসন মানেনি। মানলে আজ সে এতখানি বাড়তে পারত না।

আবার শ্রীলার বাম বাহুতে তিনটি তিলও তাকে বড়ো বিচলিত করেছে। অন্যান্য যে-সব চিহ্ন বলেছে সোম শনাক্তকরণের, তা দেখার উপায় এবং ইচ্ছাও যুযুধানের নেই। কিন্তু এ তো গভীর সমস্যার কথা।

যূনী এত বুদ্ধি রাখে, সে নিশ্চয়ই সব জেনেশুনে শ্রীলার সঙ্গে অমলের বিয়ে দেয়নি। সে চিরদিনই দিল্লিতে। তার নিগুণ অর্থহীন মোটামুটি সুশ্রী কাজিন-এর সঙ্গে যুযুধান-এর নির্গুণ চাকরিহীন ভাইয়ের সম্বন্ধ এনে সে কোনো অন্যায়ই করেনি। শ্ৰীলার অতীত ঠিক কী ধরনের ছিল, তা জানতে পারে ও একমাত্র সোম-এর কাছ থেকেই। কিন্তু পাগলার কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তাই তো বোঝা মুশকিল।

বড়োই বিপদে পড়ল যুযুধান।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। তবুও অমল এল না। যুযুধানও ছটফট করতে লাগল। তারপর পচার মাকে বলে, শ্রীলার কাছে থাকতে বলে সে আবারও বেরিয়ে পড়ল কুদঘাটেরই দিকে। জীবনে যেখানে একবারও যায়নি সেইখানেই একই দিনে দু-বার যেতে হচ্ছে। সোমও কী মনে করবে, কে জানে! ও বলেছিল, এলে পোস্ট কার্ড ফেলে আসতে। ওর যেমন স্বাধীনচেতা জীবনযাত্রা তাতে সেও নিশ্চয় চায় না যখন তখন যে কেউ গিয়ে তাকে বিরক্ত করুক।

বাস থেকে যখন নামল তখন লোডশেডিং। দোকানপাটের ঝাঁপও যেন বন্ধ বলে মনে হল। একটি অল্পবয়েসি ছেলে একটি একতলা বাড়ির রক-এ বসেছিল। সে বলল, অন্ধকারে ওদিকে যাবেন না দাদা। একটু আগেই পেটো ছোঁড়াছুঁড়ি হয়ে গেছে।

কারা করল?

সে জানব কী করে? আর জানলেও বলা বারণ। নিজের প্রাণের মায়া কার না আছে?

ও।

প্রাণের মায়া তার নিজের আছে কি নেই সে-কথা ভাবার মতো মানসিক অবস্থাও যুযুধানের ছিল না। লোডশেডিং থাকলেও আকাশে চাঁদ ছিল। বাস থেকে নামার একটু পরই চোখ অভ্যস্তও হয়ে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল যুযুধান।

কিছুটা যেতেই পথের পাশের অন্ধকার গলি থেকে কে যেন একজন বলে উঠল, কে যায়?

আমি।

আমি কে রে শালা?

আমি যুযুধান রায়।

কী ধান?

যুযুধান।

এমন ধানের নাম তো জন্মেও শুনিনি বাপ! কোন দেশের মাল গো তুমি? আমন, আউশ, বোরো, গোঁড়, এমনকী আই-আর-এইট, তাইচুং অবধিও শুনেছি। জুজুটা কী প্রকার ধান একটু দেখে আয় তো গিয়ে পটলা। ধানের আমার প্রাণের মায়া আছে কি নেই জেনে আয়।

যুযুধান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

পটলা নামক বেঁটে-মোটা একটি কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে এগিয়ে এল। পেছন থেকে সেই নেপথ্য-কণ্ঠ বলল, খোচড় কি না ভালো করে দেখিস। ডানহাতে পেটো নিয়ে বাঁ-হাতে পুরো বডি সার্চ কর। এদিক ওদিক হলেই ঝেড়ে দিবি।

পটলা আজ্ঞামতো কাজ করল।

চেঁচিয়ে বলল, সঙ্গে যন্তর-টন্তর নেই।

ধরে নিয়ে আয় শালা আমার কাছে। চাঁদমুখে টর্চ ফেলে দেখি একবার।

পটলা যুযুধানের কলার বাঁ-হাতে শক্তমুঠিতে ধরে বলল, চল শালা।

 বড়ো অপমানিত লাগছিল যুযুধানের। ইচ্ছে হচ্ছিল একঘুসিতে পটলার কানের পাটি ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু যুযুধানের হাত যে কবিতাই লিখতে পারে শুধু। মারামারি গুণ্ডামি করা তো শেখেনি ছেলেবেলা থেকে। তা ছাড়া একটা অশিক্ষিত গুণ্ডা ছোকরা তার কলার ধরে টেনে নিয়ে যাওয়াতে তার যা অপমানবোধ হচ্ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি অপমান বোধ হয়েছিল একথা জেনে যে, অমল শ্রীলাকে নিয়মিত একতরফা পেটাই দেয়। মারা আর মারামারিতে তফাত আছে। চিরদিনই ছিল। একটি অসহায় ছিপছিপে মেয়েকে, যূনীর বোনকে, প্রায়ই একতরফা মারে তার ভাই তারই মাথার ওপরের দোতলাতে বসে একথা শোনার পর থেকে তার মাথার ঠিক নেই। অসহ্য না হলে শ্রীলা বলতও না যুযুধানকে কখনো। পচার মাও কোনোদিন বলেনি। পচার মায়ের চোখ দেখে মনে হয়েছিল শ্রীলার প্রতিই সব সহানুভূতি ওর। তার ওপরে আরও অপমানিত হয়েছে শ্রীলার বামবাহুতে আবিষ্কৃত তিনটি তিল।

সোমও এত বছর পরে তার জীবনে এক অভিশাপেরই মতো উদিত হয়েছে। স্কুলের পরীক্ষার পর কোনো যোগাযোগই ছিল না। হঠাৎ যে কোথা থেকে সেদিন উদয় হল চৌরঙ্গির মোড়ে। কেনই বা ওদের বাড়িতে এল। এলই যদি বাড়িতে, তবে কেনই বা শ্ৰীলার সঙ্গে যুযুধান আলাপ করিয়ে দিতে গেল! এতদিন যার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই সে তো সম্পূর্ণ অপরিচিতই!

পটলা বলল, লিয়ে এসেছি গুরু। দেখে নাও টর্চ ফেলে।

কলার ছাড় পটলা। সকলের সঙ্গে কি এক ব্যবহার করতে হয়? তোদের আর কত যে শেখাব জানি না।

ছেলেটির গলার স্বর এবারে বেশ মার্জিত এবং শিক্ষিত বলে মনে হল। ইচ্ছে করে বাইরে একটা অন্যরকম ব্যক্তিত্বের আলখাল্লা পরে থাকে।

ছেলেটি টর্চ ফেলল যুযুধানের মুখে। টর্চ জ্বেলেই নিবিয়ে দিল।

বলল, কোথায় যাচ্ছেন?

এইখানে সোম ব্যানার্জি থাকেন। আজ সকালেও তাঁর কাছে এসেছিলাম। আমার বন্ধু ছেলেবেলার।

এত কথা বলার দরকার ছিল না যুযুধানের। কিন্তু ইচ্ছে করেই বলল যাতে সোম সম্বন্ধে এরা কিছু জানে কি না জেনে নেবার জন্যে। সোমও যে অন্য আর এক রহস্য নয়, শ্রীলারই মতো বা সিভাস-এর মতো তা কী করে জানবে ও?

 গলির প্রায়ান্ধকারে বসা ছেলেটি বলল, ও। পাগলা ইনকাম ট্যাক্স! চলে যান। তবে সাবধানে যাবেন। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে প্রথমেই এই কথা বলে দেবেন।

কী কথা?

 যে, আপনি সোম বাঁড়ুজ্যের কাছে যাচ্ছেন। আমাদের সোমদার কথা আগে বললেও আমরা হ্যারাস করতাম না।

যুযুধান বলল, সোমবাবু লোক কীরকম?

 ছেলেটি হেসে ফেলল। বলল, আপনার বন্ধু বলছেন অথচ আমাকে জিজ্ঞেস করছেন লোক কীরকম? লোক চমৎকার। খাঁটি লোক। এ যুগে এমন খাঁটি লোক পাওয়া যায় না। তবে ছিটেল। মাঝে মাঝে ছিট বাড়ে। চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকেই এরকম হয়েছে। অনেক কম্যুনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, কংগ্রেসি শিক্ষা-তড়পানোলোক দেখলাম দাদা, কিন্তু এমন খাঁটি লোক আর দেখলাম না। পড়াশুনাই বা কত্ত।

সোম-এর বাড়ির সামনে গিয়ে যখন পৌঁছোল যুযুধান তখন ফিকে জ্যোৎস্নায় ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছিল একটানা।

দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে যখন তখনই কারেন্ট এল। কিন্তু সোম-এর বাড়িতে তো ইলেকট্রিসিটি-ই নেই। তাই এখানে কোনো তফাত বোঝা গেল না।

প্যাঙা এসে দরজা খুলল, সঙ্গে কালু ও লালু।

ভেতর থেকে সোম বলল, কে রে প্যাঙা? সন্ধের পর কে এল? না বলে কয়ে?

প্যাঙা বলল, তোমার সি বন্ধু গো। সেই যে সকালে এয়ে ডাবল ডিমের আমলেট সাঁইটে গ্যাইলো।

চোপ। শালা! তোর বাবার ওমলেট?

হ্যাঁ তো। বাবারই তো! তুমি আমার বাপ না তো কে?

প্যাঙাকে উপেক্ষা করে সোম বলল, কী রে যুযু? এত রাতে?

ভারি বিপদে পড়ে এসেছি। একটু বাইরে আসবি?

বাইরে? দাঁড়া! পাঞ্জাবিটা গলিয়ে আসি। মাংস খাবি নাকি? তোর জন্যে সপ্তমী রেখে দিয়েছিল কেন জানি না। তোকে খুব মনে ধরেছে। বলেছে, খুব ভদ্রলোক নাকি তুই। দেখিস তুই আমার অফিসের বন্ধুর মতো করিস না আবার। অনেক প্রবঞ্চনা সয়েছি, আর সইব না।

যুযুধান সে কথার উত্তর না দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। ভারি শান্তি এখানে। দু-একটি বাড়ির আলো জ্বলছে তাও এতই কম পাওয়ারের যে হ্যারিকেনের আলো বলে মনে হচ্ছে। চাঁদের আলোতে এই জায়গাটাকে কলকাতা শহরের অংশ বলে মনেই হচ্ছে না আদৌ।

সোম বাইরে বেরিয়ে এল, বলল, প্যাঙা লালু-কালুকে সামলা। বাইরে না চলে যায়। আর  তোর মাকে বলিস আমি কাকাকে বাস-রাস্তা অবধি এগিয়ে দিয়ে এই এলাম।

একটু এগিয়ে এসেই সোম বলল, বল এবারে, কী ব্যাপার?

কোনোরকম ভণিতা না করেই যুযুধান বলল, তুই শ্ৰীলাকে চিনলি কী করে?

কে শ্রীলা?

আমার ছোটো ভাই অমলের স্ত্রী।

 কে সে? কার কথা বলছিস তুই?

কী বলছিস তুই এখন। আমাদের বাড়ি যখন গেছিলি। এক রবিবার সকালে, আমার ভাইয়ের স্ত্রীকে দেখে তুই বললি না, তার বামবাহুতে তিনটি তিল আছে এবং …।

ও-ও-ও। তাই বল। তুই মুনিয়ার কথা বলছিস? ওর নাম ছিল মুনিয়া আর ওর দিদির নাম ছিল দুনিয়া। হ্যাঁ ওকে তো চিনতাম।

কী করে চিনলি? মানে কীভাবে চিনলি?

 আরে আমি যখন আমার স্ত্রীর প্রবঞ্চনার কথাটা জানি তখন কিছুদিনের জন্যে আমি আমার স্ত্রীর ওপরে প্রতিশোধ নেবার জন্যে অনেক কিছুই করেছিলাম। প্রতিশোধ যে নিজেকে নষ্ট করে নেওয়া যায় না, নিজেকে গড়েই নিতে হয় সেই সত্যটা তখনও জানিনি তো, তাই। তখনই ওদের চিনি। একজন নিয়ে গেছিল আমাকে প্রথমবার। তারপর থেকে মাস পাঁচ-ছয় যেতাম সপ্তাহে একবার করে। শুধু মুনিয়ার কাছেই। দুনিয়ার সঙ্গে আমি একবারও শুইনি। ভারী নম্র, সভ্য মেয়ে ছিল।

তুই বলছিস কী? শ্রীলা প্রস্টিটুট ছিল।

কে শ্ৰীলা? আমি মুনিয়ার কথা বলছি। হ্যাঁ। ছিল। প্রাইভেট।

তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস? সে আমার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী।

তুই তো শালা আচ্ছা মানুষ রে যুযু। মা শয্যাশায়ী, বাবা পঙ্গু, একপয়সা রোজগার নেই। দয়া করলে, সে দাদার বন্ধু, দিদির নন্দাই, বা দেওরেরা সকলেই তাদের কাছ থেকে কিছু ট্যাক্সো বদলে নিয়েই দয়া করত। তাই ওরা দু-বোন বাধ্য হয়েছিল। এবং যতটুকু টাকা না হলেই চলে না সেটুকুর জন্যেই করত। বাজারের মেয়ে ছিল না।

 একটু চুপ করে থেকে সোম বলল, একটা মানুষের প্রাণ তার ইজ্জতের চেয়ে অনেকই দামি রে যুযু! তুই কী করে জানবি? ভবানীপুরে নিজেদের বাড়িতে থাকিস। শিশুকাল থেকে অভাব কাকে বলে তো জানিসনি। আমি জেনেছি। আমি বুঝি।

তা বলে প্রস্টিটুশান।

গুলি মার শালা! গুলি মার! কোন শালা প্রস্টিট্যুশান করে না রে। তুই করিস না? আমি করিনি? শিক্ষক, নেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কে প্রস্টিচ্যুট নয় আজকে? ও মেয়ে দুটো নিজেদের আর মা-বাবাকে কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যা করার করেছিল। যেই অবলম্বন পেয়েছে অমনি ছেড়ে দিয়েছে। আর আমরা কি সহজে ছাড়ি? প্রোমোশান পাবার জন্যে, অর্ডার সাপ্লাইয়ে অর্ডার পাওয়ার জন্যে, প্রফেশানে ভালো করার জন্যে, সে প্রফেশান যাই হোক না কেন, প্রতিমুহূর্তে নিজেদের আমরা বিক্রি করে দিই না? ওরা তো ছেড়ে দিয়েছে একটি মাত্র সুযোগ পেয়েই, আর যাদের দেখিস, তারা কি পারে? ন্যাকামি করিস না শালা। ওরকম মেয়ে পেয়েছিস ভাদ্রবউ হিসেবে তোর ভাই বর্তে গেছে। তুই যদি ওদের এই কথা জানার পরেও তোর ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতিস তবে আমি তোকে আরও ভালো বলতাম। বুঝি না, এটা কী একটা ব্যাপার যার জন্যে তোর রাতেরবেলা আমার কাছে ছুটে আসতে হল?

তুই অনেক লেখাপড়া শিখে থাকতে পারিস যুযু, তোর শিক্ষার রকমটা যেমন দেখছি, তাতে তোকে শিক্ষিত বলতে পারছি না। উদার হ। উদার হ। জীবনের প্রত্যেক ঘটনাকেই প্রপার পার্সপেকটিভে বিচার করতে হয়। দোষ তো আমারই। মাথার গোলমাল যখন হয়, তখন কখন যে কী করে বসি। ছিঃ ছিঃ আমি তোকে ওই কথা বলেছি তোর বাড়িতেই বসে। ছি : অন্যায় তো তাহলে আমিই করেছি।

 আজ শ্রীলাকে তোর কথা বলেছিলাম। চোখের মণি দুটো স্থির হয়ে গেল। আমার আরও অনেক সমস্যা। ভাইটাকে দেখলাম তোদের এই পাড়ায় সকালে। হয় চোরাই মালের কোনো ব্যাবসা ফেঁদেছে নয় স্মাগলিং-এর। হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারপর শ্রীলাকে নাকি মারে প্রায়ই।

 খুবই খারাপ কথা! তবে তোকে আমি বলছি, আমি তোর এবং মুনিয়ার যে ক্ষতি করেছি, যে শান্তিভঙ্গ করেছি, তা আমিই পূরণ করে দেব। তোর বাড়ি শিগগিরই একদিন গিয়ে আমি এমন ব্যবহার করব মুনিয়ার সঙ্গে, তোরই সামনে যে, আমি পাগল বলেই যে ওকে চিনি বলে তোকে বলেছি একথা ও বিশ্বাস করবে। ও বিশ্বাস করবে, যদি তুই দেখাস যে, তুই বিশ্বাস করেছিস। এটা আমার অপরাধ লাঘবের জন্যে তুই দয়া করে করিস রে যুযু। ঈস, বেচারি মুনিয়া। কত কষ্ট পেয়ে এসে একটি আশ্রয় পেল তাও আমি ভাঙতে বসেছি। শালা নিজের পেছনে নিজের লাথি মারতে ইচ্ছে করে।

তাহলে আসবি একদিন।

 নিশ্চয়ই। যত তাড়াতাড়ি পারি যাব।

আসিস কিন্তু। একটা মেয়ের, তার সন্তানের জীবন তোর ওপর নির্ভর করছে। একটি রেসপেকটেবল পরিবারের রেসপেকট।

হাঃ। হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল সোম।

বলল, জোক অফ দ্যা ইয়ার! রেসপেকটেবল। মাই ফুট! রেসপেকটেবল লোক কি দেশে এখনও আছে নাকি? ওসব গুমোর ছাড়! বল রেসপেকটিবিলিটির ভেক আছে। তোর। আমার। সকলের ওসব কথা ছাড়। ওসব কথা শুনলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। মাই ওয়াইফ ইজ আ মাচ বিগার হোর দ্যান মুনিয়া। মাই ফ্রেণ্ড মাই কলিগ, ইজ আ স্কাউন্ট্রেল। আ ডিবচ। অ্যাণ্ড দে আর রেসপেকটেবল। মুনিয়ার রেসপেক্ট নেই, আমার, সপ্তমীর রেসপেক্ট নেই। থুথু ছিটোই আমি তোদের, সকলের, এই ফালতু রেসপেকটিবিলিটির মুখে।

সোম-এর গলা উত্তরোত্তর চড়ে যাচ্ছিল।

যুযুধান বলল, আস্তে আস্তে। এই সোম।

আস্তে কেন রে? এও তো তোদের ভন্ডামি! শালা ঘোমটার তলায় খেমটা নেচেই দিন গেল তোদের। একটা সত্যকে স্বীকার করতে পারিস না, চড়ের মতো চট্টাস শব্দ করে একটা সত্যকে ছুঁড়ে মারতে পারিস না অন্য লোকের মুখে, কীসের মানুষ রে শালা তুই! গুলি মারি তোদের।

থাম থাম। সোম থাম। আমি এবারে চলে যাই। একাই যাব।

দাঁড়া। পান খা একটা। সপ্তমীর সেজে দেওয়া পান। শি ইজ এইটিন ক্যারেট গোল্ড। সো ইজ মুনিয়া। ঊ্যমাস্ট গিভ হার অল দ্যা প্রোটেকশান শি নিডস। নইলে জানব, তুই শালা পুরুষমানুষ নোস। আই উইল প্লে মাই পার্ট অল রাইট। আই অ্যাম সরি যুযু। আমার এই পাগলামি। আমাকে ক্ষমা করেছিস তো? বল তুই! দিস সামটাইমস ফেইলস মি। তুই বুঝবি না। এর চেয়ে উন্মাদ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো ছিল, এই নাসি, উইথ লুডিস ইনটারভ্যালস, এইটে অসহ্য।

 কী যে বলিস। কী যে বলিস তুই। বলতে বলতে, যুযুর চোখ ভিজে এল। এই পৃথিবীতে যে, সোম-এর মতো মানুষ এখনও দেখা যায় এই তো মস্ত বড়ো আশ্চর্যের কথা।

.

০৮.

কলকাতা

যূনী কল্যাণীয়াসু,
শান্তিনিকেতনে গেছিলাম গতকাল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। প্রণবেশের সঙ্গে। ওখানে ইন্দ্রনাথবাবুর বইয়ের দোকান (সুবর্ণরেখা) আছে। একেবারে রেলের টিকিট ঘরের পাশে। রতন পল্লিতে। উনি স্থানীয় লোক এবং প্রতিপত্তিসম্পন্ন। অনেকেই জানেন শোনেন। তাঁর দোকানে আমার বই দেখে পুলকিত হলাম। কিরীটি রায় বলে শ্রীনিকেতনের একজন ঠিকাদারও অনেক সাহায্য করলেন। ওঁর গাড়ি নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক জমি দেখালেন। ভারি ভদ্রলোক। ওখানের অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়িও তিনি বানিয়েছেন। তা ছাড়া ভগত ভাই-এর দুই ভাই, হরি মাড়োয়ারির ছেলে নন্দলাল আগরওয়ালা এঁরাও খুব সাহায্য করলেন।

প্রণবেশের ব্যাপারই আলাদা। ও নিমাইসাধন বসু, ভি সি কেও চেনে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনে। সিমেন্স-এর (এখন ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের ডিরেক্টর) পি সি গুহ সাহেব, সি ই এস সির ম্যানিজিং ডিরেক্টর পি বি ঘোষ সাহেব, দিলীপ সেন, সুশীল বোস ইত্যাদি বহু মানুষকে চেনে। তবে এত চেনা-জানা আমার মতো সামান্য মানুষের তো কোনো কাজে আসার নয়। বরং বেশি চেনা-শোনাতে গাজন-নষ্ট হয়। যার সামর্থ্য সামান্য এবং সাধ অসীম তার পক্ষে এমন সব বিখ্যাত পদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে আসাটাও অস্বস্তিকর।

যে কটি জায়গা দেখলাম, তারমধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগল একটি। কয়েকটি সোনঝুরি গাছ আছে। দূরে ক্যানালটি দেখা যায়। কোপাই নদী পেরিয়ে যে বর্ধমানের দিকে বাইপাস চলে গেছে সেই পথটিও। দাম তিন হাজার করে কাঠা। আমি দশ কাঠার কথা বলে এসেছি এবং এক হাজার টাকা বায়না-বাবদ দিয়েও এসেছি। ওখানকার উকিল এবং সারভেয়র লতফুল কবির সাহেবকে সব দায়িত্ব দিয়ে এসেছি। তুমি এলে রেজিস্ট্রি করব। তুমি নিজে না দেখে হ্যাঁ না বললে, নেব না। বায়নার টাকা না হয় মারই যাবে।

টাকা তোমার পাঠাতে হবে না। তোমাকে ছোট্ট একটি বাড়ি ওখানে আমি করে দিতে পারব। তুমি তোমার বান্ধুকে বোলে প্ল্যান করাতে পারো। এখানেই শুনলাম যে, বাপ্প নাকি প্রীতিরঞ্জন রায়ের ছেলে। উনি ইণ্ডিয়ান অক্সিজেনের ডিরেক্টর? এও শুনলাম যে, বাঙ্গু নাকি সস্ত্রীক স্টেটস-এ চলে গেছে। যদি তাই হয় তো জানিয়ো।

প্রণবেশের জানাশোনা একজন ভালো আর্কিটেক্ট আছেন এখানে। নাম মিহির মিত্র। ব্যালার্ডি থমসন ম্যাথুজের প্রিয়ব্রত সরকারকেও বলতে পারি। উনি আমার লেখার খুবই ভক্ত। চমৎকার, অভিমান-শূন্য মানুষ। ভালো ছবিও আঁকেন। আমাকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন। সম্পূর্ণ স্বার্থহীন এ ভালোবাসা, তাই তাঁর কাছে কিছু দাবি করা চলে। মানুষও খুব ভালো।

আজকাল ভালো কথা বলার মতো মানুষ সংসারে এতই কমে যাচ্ছে যে কারও সম্বন্ধে ভালো কিছু বলতে পারলে বড়োই প্রসন্ন বোধ করি। অন্যকে ভালো বলতে বলতে মানুষ নিজেকেও বোধ হয় ভালো করে তুলতে পারে।

শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস সকালে ছাড়ে। নটা পঞ্চাশে। পৌঁছে যায় সাড়ে বারোটা নাগাদ। বর্ধমানে থামে শুধু পথে। যদি ভোরবেলা যেতে চাও তো কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস আছে, দুটো নাগাদ ছেড়ে প্রথম স্টপেজেই শান্তিনিকেতনে। দু-ঘণ্টা লাগে। কাঞ্চনজঙ্ঘা রবিবারে নেই। এই দুটি গাড়িই হয়েছে গণিখান চৌধুরির আমলে। নিমাইসাধন বসুরও অবদান নিশ্চয়ই আছে। এই অধ্যাপক তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে শান্তিনিকেতনের জন্যে অনেক কিছুই করে গেলেন, সে কথা স্বীকার অবশ্যই করতে হবে। এই ট্রেন দুটি হবার পর থেকেই কলকাতার দমবন্ধ মানুষদের শান্তিনিকেতনের দিকে চোখ পড়েছে। এত কাছে অথচ লাল মাটি, খোয়াই, তীব্র শীত-গ্রীষ্ম। অতি মনোরমা বর্ষা। শান্তিনিকেতনের বর্ষার নাকি কোনো তুলনা নেই। জল জমে না। হিম হিম ভাব। খিচুড়ি খাও আর কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাও!

তবে সেখানে যাঁরাই বাড়ি করেছেন বা করছেন তাঁরা সকলেই যদি গাছ লাগানোকে ব্রত হিসেবে না নেন (ফুলের বাগান নয়, বড়ো গাছ), তবে শান্তিনিকেতনও কলকাতা হয়ে উঠবে আর কিছুদিনের মধ্যে। দোতলা তেতলা বাড়ির ধুম পড়ে গেছে। দেখে খারাপ লাগল। এই ধুম-এর প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো শঙ্খদার নতুন কবিতার বই প্রকাশ করেছে প্রমা, ধুম। লেগেছে হৃৎকমলে। এবং আরও মনে পড়ে গেল যে, শঙ্খ ঘোষ শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবন-এর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এমন সুস্থ ও যোগ্য নির্বাচন এই অযোগ্যতা আর দলাদলির প্রদেশে খুব বেশি দেখা যায় না। এর পরের বার শঙ্খদার সঙ্গে দেখা করে আসব। মেয়েরা ভালোবেসে না করলে বাড়ি-টাড়ি হয়ও না; করা উচিতও নয়। আমার তাই মনে হয়। জমি, বাড়ি, ফুল, পাখি ও নারী সকলেই সমগোত্রীয়। তুমিও যদি তেমন উৎসাহ না পাও, তাহলে কী হবে? আমি টাকা দিতে পারি কিন্তু তা ছাড়া আমার আর যে কোনোই যোগ্যতা নেই। আমি যে পুরোপুরিই অপদার্থ যূনী। তা কি তুমি এতদিনেও বোঝোনি? হয়তো বুঝেছ বলেই ভালোবাসো এত। মেয়েরা বোধ হয় স্ব-নির্ভর পুরুষমানুষকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু ভালোবাসতে পারে না। আমার মনে হয়। কথাটা ঠিক!

 শান্তিনিকেতনে এখনও অনেক পাখি আছে। সাইকেল রিকশার হর্ন ছাড়া এখনও নয়েজ পলিউশান বিশেষ নেই। কোনো তরুণ গলা তুলে তরুণীকে ডাকলে পাখির ডাকের সঙ্গে মেশা শুধুমাত্র তার গলাই কোনো পাখিরই ডাকের মতো আলাদা করে কানে আসে হাওয়ার মর্মরের সঙ্গে। এও এক বিস্ময়! বড়ো শান্তির জায়গা এই শান্তিনিকেতন। নামটি সার্থক। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম কি অনর্থক হতে পারে!

তুমি কবে আসছ? এবারে এলে তোমার সঙ্গে আমার স্কুলের এক সহপাঠীর আলাপ করিয়ে দেব। সে এই কলকাতারই বুকে তার শান্তিনিকেতন গড়ে নিয়ে চমৎকার বেঁচে আছে। সে এতই ওরিজিনাল, তার ব্যক্তিত্বর এতই ঔজ্জ্বল্য, সে এতই বিপরীতমুখী তার চরিত্রে ও ব্যবহারে, যে তাকে দেখার আগে মনে মনে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে এসো। নইলে চোখ ঝলসে যাবে এবং ওকে বুঝতে না পেরে ভুল বুঝবে। অনেক দুর্নাম মাথায় নিয়ে, অনেক বঞ্চনা সয়ে তবে সে মানুষের জীবনের এক গন্তব্য আবিষ্কার করেছে। জীবনের মানে পেয়েছে। তার মত ও পথ তুমি না মানলেও মানতে পারো, কিন্তু সাহস ও ওরিজিনালিটিকে না মেনে কারও উপায় নেই।

 অমলকে নিয়ে সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সেসব কথা চিঠিতে বিস্তারিত লিখছি না। শ্রীলা ছেলেমানুষ। তার সঙ্গে অমলের ব্যবহার ক্রমাগত খারাপই হয়ে চলেছে। তুমি কি এসে আমার এই সংসারের ভার নিতে পারো না হাতে?

প্রণবেশকে বলেছি তোমার জন্যে যে করেই হোক পশ্চিমবঙ্গে এবং কলকাতার একশো মাইলের মধ্যে যেখানে হয় একটি লেকচারারশিপ জোগাড় করে দিতে। শান্তিনিকেতনে হলে তো কথাই নেই। হয় তুমি আসবে সপ্তাহান্তে, নয় আমি যাব। তোমার গাছগাছালি-ঘেরা পর্ণকুটিরে থাকব। তোমার সঙ্গে একখাটে শোব।

ভাবতেই গায়ে শিহরন লাগছে।

ভালো থেকো।
-ইতি তোমার যুযুদা।

পুনশ্চ/গতকাল টেলিফোন ঠিক হল। ইলা বসু বলে যিনি পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি মিথ্যা নাম বলেছিলেন। প্রেম করার জন্যে তো আমি নাম জিজ্ঞেস করিনি জেনারাল ম্যানেজারের পি এ-র! যাতে কমপ্লেন যে করলাম এবং কার কাছে করলাম তা ভবিষ্যতে রেফার করতে পারি এইজন্যেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। জি এম হীরালাল মুখার্জি ও ইলা বসুকে সই করে বইও পাঠিয়েছিলাম অগ্রিম কৃতজ্ঞতা হিসেবে। মুখার্জি সাহেব বই গ্রহণ করে লেখক যুযুধান রায়কে সত্যিই খুশি করেছেন। কিন্তু অস্তিত্বহীন ইলা বসুর বইটি ফেরত এসেছে। জানি না, কী ধরনের শিক্ষা এবং রসিকতা এবং দায়িত্বজ্ঞান থেকে এই ধরনের অকারণের অপমান ঘটানো যেতে পারে। ইলা বোস-এর এই অহেতুক তঞ্চকতা ভবিষ্যতে কাউকে কোনো বই দেওয়ার আগে আমাকে বহুবারই ভাবতে বাধ্য করবে। বিদেশে প্রত্যেক সরকারি চাকুরে তাঁদের আইডেনটিটি জানাতে বাধ্য। সেখানে তাঁরা জনতার সেবক। এখানে জনতাই তাঁদের সেবক। এই তফাত। না চাইলে কাউকেই বই পাঠানো বোধ হয় নিজেকে অপমান করার একটি সহজ পথই তৈরি করা। তা আর করব না। এই লজ্জাকর ব্যাপারটাতে বড়োই মর্মাহত হয়েছি। সারল্য এই সংসারে মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

টেলিফোন শেষকালে ঠিক হল যাঁর দয়াতে (মুর্মু সাহেবের অফিসের একজন) সেই মহিলা নিজেই একটি বই চেয়েছেন আমার সই করা। আমার লোকের মাধ্যমে। নাম বলেননি। বই পাঠিয়ে দিয়েছি সই করে। মানে হচ্ছে, প্রকৃত ইলা বোস মহিলা মানে, ইলা বোসের আড়ালে থেকে অভব্যতাটা যিনি করেছিলেন তিনি পুরো টেলিফোন ভবনেই যে, কত চালাক এবং লেখক যুযুধান রায় যে, কতখানি বোকা এই কথাটা বলে সকলকেই অনামা থাকতে বলেছেন। জেনারাল ম্যানেজারের অফিসে তো হেঁজিপেঁজি মেয়ে বসে ফোন ধরেন না। তিনিও বিলক্ষণ ক্ষমতাবান। এবং এই দেশে যার হাতে যেটুকু ক্ষমতা, সেইটুকুই অপব্যবহার বা পুরোপুরিই অব্যবহার করাটারই আর এক নাম তো বড়ো চাকরি করা!

ভালো থেকো যূনী। চিঠি দিয়ো। আনু আর যবন কেমন আছে?
ইতি তোমার যুযুদা।

 চিঠি লেখা শেষ করে কলম নামিয়ে রাখল টেবিলে যুযুধান।

যুনীর কলমটা আজও পাওয়া গেল না।

পচার মা এসে বলল, দাদা ফোনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।

সে কী!

হ্যাঁ! বউদি এসে বলবে কী হয়েছে।

 বাইরে থেকে শ্রীলা বলল, দাদা, আসব?

এসো।

এক্ষুনি এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন। বললেন টেলিফোন ভবন থেকে। বললেন, যুযুধানবাবুকে বলবেন যে, আমার নাম ইলা বোস। আমি দেখব যাতে ওঁর ফোন কখনোই ভালো না থাকে। উনি জি এম-এর অফিসে কমপ্লেন করেছেন কেন?

আমি বললাম, আমি তো কিছুই জানি না। আপনি কী যে বলছেন তাও বুঝতে পারছি না।

আপনি কি যুযুধানবাবুর স্ত্রী বলছেন?

আমি বললাম, না। আমি ওঁর ছোটোভাইয়ের স্ত্রী।

ওঁর স্ত্রীকে একটু দিতে পারেন?

 বললাম, ওঁর তো স্ত্রী নেই।

গত হয়েছেন?

না, না। উনি তো ব্যাচেলর! আমি বললাম।

ও ব্যাচেলর! বুঝেছি!

বলেই কী যে বুঝেছেন তা না বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন। এবং ছেড়ে দেওয়ার পরই ডায়াল টোন চলে গেল।

এখন কী করবেন দাদা? দু-মাস তিন দিন পরে ঠিক হল ফোন!

 যুযুধান হাসল শ্রীলার উত্তেজনা এবং কথা বলার ধরন দেখে।

করব আর কী? বেশি যা করতে পারি…

চিঠি লিখবেন? খবরের কাগজের সম্পাদককে?

 দুস, তাতে কী হবে? রোজ কত চিঠি বেরোচ্ছে। পিঠ করেছি কুলো আর কানে ভরেছি তুলো। লজ্জাবোধ ব্যাপারটা, আত্মসম্মান ব্যাপারটাই নষ্ট হয়ে গেছে পুরোপুরিই! যা করতে পারি তা হচ্ছে কোথাও লিখে দেওয়া। কোনো ম্যাগাজিনে, কোনো-গল্পের মধ্যে এই সত্য ঘটনা ঢুকিয়ে দেওয়া।

ওরা যদি কেস করে?

কেস ওঁরা কী করবেন। কেস করলে টেলিফোন যারা পয়সা দিয়ে রাখে অথচ ফোন কাজ করে না তারাই করতে পারি। কিন্তু করলে ইলা বোসেরই বা কী আর জি এম-এরই বা কী! ওঁদের পকেট থেকে তো আর কেস লড়ার খরচা দিতে হবে না। আর জেলেও যেতে হবে না। সরকারের টাকা হল গৌরী সেনের টাকা! যত্তরকম ট্যাক্স আছে তা কেন্দ্রীয় সরকারই এল আর রাজ্য সরকারই এল কান ধরে আদায় করতে খুবই দড়। কিন্তু সিভিক স্টেটে যে জনগণেরও কিছু পাওয়ার ছিল ন্যায্য মূল্যের বদলে তা কে দেন এল? রেশনের চালে কাঁকর, চাল বাড়ন্ত, হাসপাতালে নবজাত শিশুকে কুকুরে মুখে তুলে নিয়ে যায়, লোডশেডিং, টেলিফোন চলে না, চিঠি আসা-যাওয়া করে না সময়মতো, বাসে-ট্রামে চড়া যায় না, নিত্য ব্যবহার্য জিনিস অগ্নিমূল্য, লেখাপড়ার এই অবস্থা! কত হাজার পরীক্ষার্থীর ফল যেন ইনকমপ্লিট? এক ছাত্রী তো আত্মহত্যাই করল ফল না বেরোনোতে। তার মা-বাবা যে কেস করেছেন খুব খুশি হয়েছি।

আমরা সবই সহ্য করে করে এদের সকলেরই, সব স্তরের সরকারি আমলাদেরই সাহস এমন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছি যে, এঁরা অসহ্যই হয়ে উঠেছেন। আমিও সরকারি কর্মচারী। তোমাকে বলছি শ্রীলা, আবারও নকশাল আন্দোলনের মতো কোনো আন্দোলনের সময় হয়েছে। ব্যাবসাদার আর কিছু সরকারি চাকুরেদের প্রাণে মেরে দেওয়ার সময় এসে গেছে। মারকে এরা যমের মতো ভয় পায়। টেররিজম খারাপ টেররিজম খারাপ সবসময়ে চিৎকার শুনি, অথচ দেখো যারাই টেরর ক্রিয়েট করছে সন্ত্রাসবাদের পথে যাচ্ছে, তাদের সব দাবিই সুড়সুড় করে মেনে নেওয়া হচ্ছে। দার্জিলিং দেখো, পাঞ্জাব দেখো, আসাম দেখো। টেররিজমই যদি একমাত্র পথ হয় তবে যে বাঙালিরা একদিন পুরো দেশকে টেররিজম শিখিয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, সেই টেররিজমই ফিরিয়ে আনতে হবে। এই বাঙালি জাতের ঘুম ভাঙাতেও চাবুকের দরকার। শক-থেরাপির। নইলে কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না।

দাদা, বলছেন বটে! কিন্তু দেশের দশের কথা ভেবে এসব করবেটা কে, আপনার ভাইয়েরা?

না। অমলরা নয় তা আমি জানি। কিন্তু দেশ নিয়ে ভাবে এমন ছেলেরও অভাব নেই। নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সবচেয়ে মেধাবী ছেলেরাই আগে। আন্দোলনের মাথা তারাই। তবে সেই আন্দোলন ভুল পথে চালিত হয়েছিল, ভুল লোকদের মারা হয়েছিল সেবারে। আন্দোলন বানচাল করার জন্যে গুণ্ডা বদমাশ খুনিদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে। সেই জমানাতে যেভাবে গুলি করে সব তাজা ছেলেদের বিনা বিচারে এমনকী বিচারের প্রহসন ছাড়াই মারা হয়েছিল তা চিরদিন মানুষ মনে করে রাখবে।

সাক্ষী পাওয়া যেত না বলেই তো বিচার করে শাস্তি দেওয়া যেত না। তাই তো অমন করে মারা ছাড়া উপায় ছিল না।

শ্ৰীলা বলল।

কেন পাওয়া যেত না? রবিবারের দিনদুপুরে সরু গলির মধ্যে পাঁচ-ছজন ছেলে মিলে যদি একজন মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারে আর সে-মানুষটা ক্রমাগত বাঁচাও বাঁচাও! বলে চিৎকার করতে থাকে, আর তখন গলি বা পাড়ার সব মানুষ ঝপাঝপ জানালার কপাট বন্ধ করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন এবং মানুষটা মরে যাবার পরে পুলিশ এলে আমরা কেউ কিছু দেখিনি বা শুনিনি বলেন তাহলে সাক্ষী দেবেটা কে? যদি আমাদের এতটুকু সাহস বা সততাও না থাকে তবে তো আমাদের মরাই উচিত। এই বেঁচে থাকা কি বেঁচে থাকা? প্রতিপদে দয়া ভিক্ষা করে? বাসের পাদানিতে একটু পা রাখার জন্যে, সময়মতো রেশন পাওয়ার জন্যে, অসুখ হলে সাধারণ চিকিৎসার জন্যে, ছেলে-মেয়েকে ন্যূনতম লেখাপড়া শেখাবার জন্যে, টেলিফোন সচল রাখার জন্যে, ডাকে ফেলা চিঠির গন্তব্যে পৌঁছোনোর জন্যে, যেখানে ইলেকট্রিক বিল কুড়ি টাকা হওয়ার কথা সেখানে তিনশো টাকা বিল দয়া করে না-পাঠানোর জন্যে, এই যে লাগাতার দয়া ভিক্ষা এ পৃথিবীর কোনো গণতন্ত্রে চিন্তা পর্যন্ত করা যায় না। যেমন আমরা তেমনই আমাদের নেতারা, আমলারা আর তেমনই আমাদের প্রাপ্তি শ্রীলা। টেররিজম। টেররিজম ইজ দ্যা ওনলি ওয়ে আউট। অনেক সময় বয়ে গেছে। এনাফ ইজ এনাফ।

.

০৯.

অমলকে একবার ডাকো তো পচার মা। অমল কি কলকাতায় নেই?

ছোটদাদাবাবু, তো কলকাতায় নেই।

কলকাতায় নেই? তো সে কোথায় গেছে?

 বন্ধুদের সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গেছে।

কাশ্মীর সঙ্গে শ্রীলাকে আর খোকাকে না নিয়ে?

না। ওরা তো যায়নি।

শ্রীলাকে ডাকো তো একটু।

বউদিকে ডেকে দিয়েই আমি বাজারে চলে যাচ্ছি। রবিবার হলেও দেরি করে বাজারে গেলে কিছুই পাওয়া যায় না।

ঠিক আছে।

যুযুধান বাইরের ঘরের ইজিচেয়ারেই বসেছিল। সকালের জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে। শ্রীলা পর্দা ঠেলে এসে বলল, দাদা, ডেকেছেন?

হ্যাঁ।

বোস শ্ৰীলা। খেয়েছ? খোকা কোথায়?

 নন্তুদের বাড়িতে গেছে খেলতে। ওখানেই দুপুরে খাবে। সীতাদি বলে পাঠিয়েছিলেন।

অমল নেই, খোকা তো প্রায়ই এ বাড়ি সে বাড়িতে যায়, তোমার একা লাগে না?

একা? নাঃ।

কী করে সময় কাটাও?

রান্না করি। বই পড়ি। আপনি কলেজস্ট্রিটের দিকে গেলে আমাকে একটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম (দু-সেট), সমরেশ মজুমদারের কালবেলা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দূরবীণ আর মানব জমিন আর

আর কী? বল।

দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত যদি এনে দেন।

আরে যদি কেন। নিশ্চয়ই এনে দেব। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত আমি পড়িনি। তোমার জানাশোনা কেউ কি পড়েছেন?

 হ্যাঁ চাঁপামাসি পড়েছেন। বলেছেন, গত তিরিশ বছরের মধ্যে এমন বই বাংলাসাহিত্যে নাকি পড়েননি।

 যুযুধান সোজা হয়ে বসল। দেবেশ রায়কে সে কখনো চোখে দেখেনি। লেখাও খুব বেশি পড়েনি। বলল, চাঁপা তো খুব ভালো পাঠিকা। চাঁপা যদি একথা বলে থাকে তো৷…

এমন সময় দরজাতে কড়া নড়ে উঠল।

আমি যাচ্ছি দাদা।

বলে, শ্রীলা দরজা খুলল। খুলেই, যুযুধানের দিকে ফিরে বলল, দাদা।

যুযুধান দেখল শ্রীলার মুখ সাদা হয়ে গেছে।

সোম ঘরে ঢুকল দরজা খুলে। দরাজ গলায় হেসে বলল, কেমন আছ তুমি শ্রীলা! তোমার কথা সেদিন বলছিলাম তোমার ভাসুরকে। ভ্রাতৃবধূ পেয়েছে বটে শালা। আমার তো ভাই-ই নেই। থাকলে তোমারই মতো কাউকে আমি ঘরে আনতাম।

শ্ৰীলা নীরস গলায় বলল, বসুন।

আমি যাব দাদা?

যাবে কেন। এখানেই বোসো। আগে অমলের কথাটা ভালো করে শোনা যাক। কোথায় গেছে এল তো? আর কে কে গেছে? বেড়াতেই যদি যাবে তত তোমাকে আর খোকাকে নিয়ে গেল না কেন?

 জানি না। বলল তো বেড়াতেই গেছে।

যূনী চিঠি লিখেছে, তাতে লিখেছে যে, দূর থেকে মনে হল যেন দরিয়াগঞ্জের মোতিমহল-এ অমল এবং আর একজন ছেলে, সঙ্গে তিনজন মহিলা নিয়ে খেতে ঢুকছে। ও অফিস থেকে ফিরছিল, বাস থেকে দেখেছে, তাই আর নামেনি। ভেবেছিল দিল্লি যখন এসেছে তখন অমল যোগাযোগ একবার নিশ্চয়ই করবে। সাত দিনেও যখন যোগাযোগ করল না, তখন লিখেছে, মনে হয়, নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি। অমল নয়, অমলের মতো কাউকে।

না। কাশ্মীরে গেছে। দিল্লি হয়েই তো গেছে। দিল্লিতে ক-দিন থাকবারও কথা।

শ্ৰীলা বলল।

যুযুধান বলল, তুমি বড়ো আলগা দিয়েছ শ্রীলা। জোর খাটাও। তোমার সব জোর খাটাও।

শ্রীলা মাথা নীচু করে বলল, জোর যেখানে খাটে না সেখানে জোর কী করে খাটাই দাদা।

ঠিক কথা। সোম বলল।

জোর খাটিয়ো না। তুমি ইগনোর করো পুরোপুরি। আমার পাড়ায় ওর কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের সঙ্গে আমি কথা বলব।

সেটা কি ভালো হবে সোম? তোর পক্ষেও।

আমার ভালোর কথা আমাকেই ভাবতে দে!

 ছেলেগুলো তো ভালো নয়।

কে বলেছে? ভালো নয় তোকে কে বলেছে? বি এ পাশ করে বসে থেকে থেকে হেদিয়ে গিয়ে কোথাওই কোনো ওপেনিং না পেয়ে রোজগারের জন্যে হয়তো কোনো পথ বেছে নিয়েছে। সেইজন্যেই কি তুই তাদের খারাপ বলবি? মানুষের খারাপ ভালো কখনো জীবিকা দিয়ে বিচার করতে নেইরে যুযুধান। যে জীবিকা মানুষ পেটের খিদে বা নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই গ্রহণ করে, কোনো অন্য পথ খোলা না পেয়েই, শুধু সেই জীবিকা গ্রহণ করার কারণেই কোনো মানুষকেই খারাপ বলা যায় না। সমাজ যদি তাদের অন্য সম্মানজনক জীবিকা দিতে পারত এবং সে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তারা অন্যতর জীবিকা গ্রহণ করত তাহলে তুই খারাপ বলতে পারতিস তাদের?

যুযুধান চুপ করেই রইল। কথা বলল না কোনো।

সোম বলল, শ্রীলা, আজকে আমি তোমার হাতের রান্না খাব। আমাদের কুঁদঘাটে একেবারে কচি পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়। দু-কেজি নিয়ে এসেছি। রবিবারে তোমার ভাসুর রাঁধা মাংস না খেয়ে চলে এল, তাই সপ্তমী সেদিন থেকেই প্যান প্যান করছিল, এমনকী প্যাঙাটা পর্যন্ত। তুই যে কী গুণ করে এসেছিস তাদের, তা তুই-ই জানিস। যাও শ্রীলা। মাংসটা নিয়ে তুমি যাও।

সপ্তমী কে? আর প্যাঙা? শ্রীলা শুধোল।

যুযুধানের মুখ কালো হয়ে গেল। কী বলবে, ভেবে পেল না।

সোম বলল, আমার অ্যাডাপ্টেড বউ আর অ্যাডাপ্টেড ছেলে। পরে শুনো যুযুর কাছ থেকে।

বলেই বলল, আমাকে এককাপ চা খাওয়াতে পারো? আর বাড়িতে কি পান আছে?

পচার মার কাছে আছে। আসুক, পাঠিয়ে দিচ্ছি।

পাঠিয়ে নয়। তুমি নিজে নিয়ে আসবে। পান একটা বিশেষ বস্তু, আসামে পান-গুয়া কী করে নিবেদন করে মেয়েরা তা যদি দেখতে। যে জাত যত বেশি মাথা নোয়াতে জানে ব্যক্তিগত জীবনে, জাতীয় জীবনে তাদের মাথা ততই উঁচু হয়। এর চেয়ে বড়ো সত্য আর নেই। আমরা বাঙালিরা ভালো করে হাতজোড় করে নমস্কার করতেই শিখলাম না, আমাদের কথা আর কী বলি।

শ্রীলা মাংসর পলিথিনের ব্যাগ হাতে চলে গেলে, যুযুধানকে সোম বলল, তোর জন্যে একটা বই এনেছি। পড়ে দেখিস।

কী বই?

দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত। কী বলব! বহুদিন এমন একটা বই পড়িনি বাংলাতে। পঁচিশ-তিরিশ বছর তো হবেই।

বলিস কী রে! এই কথাই তো চাঁপাও বলেছে।

কে চাঁপা?

আমাদের পাড়ার একটি মেয়ে। দেখতে ভালো না, কালো, উঁচু উঁচু দাঁত, পয়সা নেই সুতরাং বিয়ে হয়নি। স্বার্থপরতা ও বাঙালি ছেলেদের গৌরবের সুভ্যেনির হয়ে সে এই গলিতেই রয়ে গেছে। কিন্তু এমন ভালো পাঠিকা বঙ্গভূমে বড়ো বেশি নেই। চাঁপা যদি কোনো বইকে ভালো বলে তো, আর কোনো প্রশ্নই থাকে না তার ভালোত্ব সম্বন্ধে।

সোম বলল, চল চাঁপাকে অ্যাডভাইসার করে আমরা একটা বুক-ক্লাব করি। কলকাতার মানুষ নিজেদের এত বড়ো বুদ্ধিজীবী বলে মনে করে, আর্ট-কালচারগুলো খায় দু-বেলা অথচ কলকাতা শহরেই আজ অবধি একটিও বুক-ক্লাব গড়ে তোলা গেল না। তা ভাবতেই খারাপ লাগে। যদি কখনো গড়ে ওঠেও তো দেখবি সেও আর এক দলবাজিরই জায়গা হয়ে উঠেছে, ডান বা বাম গোষ্ঠীর বহুশক্তির প্রজনন ক্ষেত্র। সেই বুক-ক্লাব-এ হয়তো দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্তর নাম পর্যন্ত উল্লিখিত হবে না। অথবা এই অত্যন্ত ভালো বইয়ের ভালোত্বকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি প্রচন্ডতার সঙ্গে প্রকট করে তুলবে। বঙ্গভূমের নিরানব্বই ভাগ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই তা ভেস্টেড-ইন্টারেস্টের ব্রিডিং-প্লেস। যাই হোক, এসব প্রসঙ্গ থাক, আসল কথা হচ্ছে বইটা পড়ে দেখিস। আহা! একটি বইয়ের মতো বই! সৎ সাহিত্য সব সময়েই সৎ-সাহিত্য সে বইয়ের লেখকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন। সাহিত্য যে আনন্দমেলা এই কথাটা এদেশের কমিউনিস্ট অ-কমিউনিস্ট সবাই যে কবে বুঝবে? সাহিত্যকে কবে এই সব ভোটরঙ্গর ভন্ডামির জমি থেকে মুক্ত করবে? তা ঈশ্বরই জানেন। বইটা পড়ে দেখিস যুযু, তোর নিজের লেখাকে একদম জোলো বলে মনে হবে।

আমি আবার লেখক নাকি! নিশ্চয়ই পড়ব। তার আগে শ্রীলাকে পড়াব। ও তো বলছিল বইটার কথা।

যারা ভালো পড়ুয়া, তাদের অধিকাংশই মেয়ে। এবং দুঃখী মেয়ে। কেন বল তো এমন হয়? সুখী মেয়েও অবশ্য আছেন। সোম বলল।

ঠিক জানি না। বহির্জগৎ যতই বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, অন্তর্জগৎ ততই খোলামেলা হতে থাকে বোধ হয়। অন্তর্মুখী মানুষ ছাড়া সাহিত্য-সংগীতের রসাস্বাদন করবে কে বল? সে কারণেই এই আমাদের বঙ্গভূমে কি বাংলাদেশে মেয়েরাই চিরদিন ভালো পাঠক, ভালো শ্রোতা, ভালো বোদ্ধা। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই।

তুই অমলের কথা কী বলছিলি? সোম বলল।

 শুনলি তো সবই। যূনী লিখেছে, অমল আর তার এক বন্ধুকে দেখেছে দরিয়াগঞ্জ-এর মোতিমহল-এ ঢুকতে তিনজন মহিলার সঙ্গে। দিল্লির মোতিমহলে।

হু। আমি অমল-এর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব।

নিজেকে বাঁচিয়ে। যার সঙ্গে কথা বলবি ভাবছিস, দেখবি, সে-ই হয়তো গেছে অমল-এর সঙ্গে।

দেখব। সেদিন আমার বাড়ি কেমন লাগল বল যুযু?

কী ভালো লেগেছে, কী বলব! তুই একটা ওরিজিনাল মানুষ সোম। টু-হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি মানুষ। তুই কিন্তু তোর চাকরি যাওয়ার ব্যাপারটা বলিসনি। মানে কারণটা।

বলার বিশেষ কিছু নেই। শুনেই বা কী করবি? আমার যে বন্ধুর কথা বললাম, সে ডিসেম্বর থেকে সিক রিপোর্ট করে ছুটি নিল। তার ওয়ার্ডের চার্জ আমাকে নিতে হল। ও বলল, সোম, তোর কোনো চিন্তা নেই।

আমি বললাম, চিন্তা নেই বলছিস কী করে? দেড়শো টাইম-বারিং ম্যাটার আছে তোর ওয়ার্ডে। আমার ওয়ার্ডে তো দুশো আছে।

সে বলল, তুই পর পর রোজ কেস, পেনাল্টি ইত্যাদির হিয়ারিং ফিক্স করতে থাক। আমি বাড়ি বসে তোকে অর্ডার লিখে দেব। তুই শুধু অফিসে টাইপ করিয়ে সই মারবি।

আমি বললাম, তুই আমার চাকরিটা খাবি না নিশ্চয়ই। কারণ, আমার ওয়ার্ডেও দুশো টাইম-বারিং ম্যাটার বাকি। ও যে সৎ নয় তা আমি জানতাম। আজকাল অসৎ হওয়া দোষের বলেও মনে করি না আমি। অসতোকে প্রত্যেক মধ্যবিত্ত মানুষের গলায় ফাঁসির মতো পরিয়ে দিয়েছে এই বিয়াল্লিশ বছরের স্বাধীনতা আর নেতৃত্বর রকম। কী রাজ্যে কী কেন্দ্রে। কিন্তু ও যে আমাকে মারবে সেটা ভাবিনি।

ও বলেছিল, কে কার চাকরি খায় রে এই ভারতবর্ষে। গভর্নমেন্টের চাকরি হওয়াটা কঠিন, যাওয়া তার চেয়েও কঠিন।

তারপর?

তারপর ও অ্যাসেসিদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে কারও কাছে পাঁচ, কারও কাছে দশ কারো কাছে বিশ বানিয়ে নিয়ে অ্যাসেসিদের দিয়েই তাদের সুবিধেমতো অর্ডার ড্রাফট করিয়ে রাতে বাড়ি ফিরলে আমাকে দিত। বলত, কাল টাইপ করে সই করে ডিমাণ্ড নোটিশ, চালান, বা রিফাণ্ড অর্ডার ভাউচার সই করে পাঠিয়ে দিস। আমি যখন অফিসে থাকতাম তখন সে আমার সতী-সাবিত্রী স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করত। মাইনের টাকা, আর ঘুসের টাকা! জানি না, কিন্তু আমি যাদের দেখেছি তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মেয়েরাই যার টাকা আছে তাকেই বড়ো বলে জানে। উইমেনস লিব-এর প্রবক্তারা যাই বলুন আর তাই বলুন।

তারপর?

 তারপর আর কী। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং যা করেছেন গত তিন যুগে আর কেউই তা করেনি। চাকরি, সরকারি চাকুরেদের গেছে সব সেই আমলেই। তবে আমার চাকরি গেছে আমারই মূখামির জন্যে বিশ্বনাথপ্রতাপের খড়র জন্যে নয়। বন্ধুকে বিশ্বাস করার জন্যে। তার জন্যে দায়ী তো বিশ্বনাথপ্রতাপ নন। আমার সঙ্গে আরও অনেকেরই চাকরি গেছে। বিভিন্ন লেভেল-এর আমলাদের মধ্যে কারও কারও দুর্নামও ছিল। তবে ইনএফিশিয়েন্সি, ব্যাড পাবলিক রিলেশন-এর জন্যও বোধ হয় গেছে কারও কারও। আমারটা গেছিল অসতোর অভিযোগে। দুঃখটা সেটাই। তবে মজা এই যে, আমাদের ইনকাম ট্যাক্সে যারা সত্যিকারের ডাকাত তাদের নাম কেউই জানে না। জাহাজের কারবারিরা সতীপনার সার্টিফিকেট পায়, সতীত্ববিহীন হয় আদার ব্যাপারীরা। আমিও তাই চাকরি হারালাম। এইখানেই আমার সঙ্গে শ্ৰীলার মিল আছে। মুনিয়ার দুঃখ তাই বুঝি। অপারগতাও।

তারপর? তারপর আর কী? ভগবান যা করেন মঙ্গলেরই জন্যে। চাকরিটা অমন করে না গেলে এই সংসারকে জানা হত না। এই চাকরি যাওয়ার পেছনেও আমার বন্ধু। সে নিজে অর্ডার ড্রাফট করে আমাকে দিয়ে সই করাত যেমন, পরক্ষণেই নিজেই বেনামে ভিজিলেন্স-এ চিঠি লিখত। আমার টাইপিস্টকে একদিন ভিজিলেন্স-এর লোক ডেকে নিয়ে ধমক-ধামক দিয়ে তার স্টেটমেন্ট নিল যে, ওই অর্ডারগুলির একটা অর্ডারও আমার লেখা নয়, অ্যাসেসিরা যা টাইপ করে এনেছে তাই হুবহু টাইপ করে দেওয়া। আমাকে বাঁচাতে ও মিথ্যা বলতেও পারত। কিন্তু বলেনি। ওকেও মোটা টাকা দিয়ে রেখেছিল আমার বন্ধু। পার-অর্ডার পাঁচশো টাকা। এবং তার বউ-এর সঙ্গেও আমার বন্ধুর অ্যাফেয়ার ছিল। টাকাই এখন সংসারের সবচেয়ে দামি জিনিস বুঝলি যুযু। চুরি কর, খুন কর, রেপ কর, মার্ডার কর, পার পেয়ে যাবি।

তারপর?

তারপর আর কিছু নেই। তিস্তাপারের বৃত্তান্তটা পড়ে ফ্যাল। ধরলে আর ছাড়তেই পারবি না।

পচার মা বাজার থেকে ফিরল। যুযুধান বলল, পচার মা একটু পান দিয়ে আমার বন্ধুকে। জর্দাও।

পচার মা হেসে বলল, দামি জর্দা তো নেই।

তুমি যা দেবে তাই দামি বলে মেনে নেব পচার মা। যা আছে, তাই দাও। হেসে বলল সোম।

শ্ৰীলা নিজে হাতে চা নিয়ে এসে বলল, সোমদাদা, মাংস কি একটু চাখবেন?

নাগো। তুমি যা রেঁধে দেবে তাই অমৃত ভেবে খাব। এখন এল, তুমি কবে তোমার ভাসুরের সঙ্গে আমার বাড়ি যাবে? সারাদিন কাটাবে?

দাদা যেদিন বলবেন। শ্রীলা বলল।

 সোম বলল, সুমিত্রার মতো ভাদ্ৰবউ পেয়েছিস রে তুই শালা। যদিও তুই রামচন্দ্র নোস!

হাসল যুযুধান।

শ্ৰীলা বলল, আমি এখন যাই। বলেই চলে গেল।

হঠাই সোম বলল, আজকে একটু ভদকা খেতে মন করছে। আনাব?

 যুযুধান বলল, আমার বউ যদি থাকত তবে তোর মতো বন্ধুর জন্যে তার সামনে বসেই খেতাম। আমাদের গলিটা পুরোনো। সব কিছুকেই এখনও প্রাণপণে আঁকড়ে আছে, তেমন ভালো এবং নতুন কিছুই জড়িয়ে-ধরার পায়নি বলেই হয়তো। তা ছাড়া, ঘরে আমার ভাদ্রবউ। তাকে জিজ্ঞেস না করে এসব না করাই ভালো। তার চেয়ে চল না বার থেকে খেয়ে আসি। কাছেই পাঞ্জাবিদের মদের দোকান আছে। অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনেও যেতে পারিস।

দুস শালা। এই বাড়িতে ঠাণ্ডায় শান্তিতে বসে খেতে ইচ্ছে হয়েছিল এইটুকুই। ছেড়ে দে। নেশাগ্রস্ত হতে বা নেশা-তাড়িত হতে তো আমার জীবনই যথেষ্ট। অন্য নেশা না হলেও চলবে।

তুই গ্রেট লোক সোম। তুই মদ খাস অথচ নেশা করিস না।

না করি না।

বা:!

যুযুধান বলল। কিন্তু তুই তো খেতে চাইলি, খাবি না? আমি শ্রীলাকে জিজ্ঞেস করে তারপরই আনাই।

 প্লিজ না। মুনিয়া অবশ্য নিজেই তার আয়াকে দিয়ে আমার জন্যে ভদকা আনাত। ওকে কিছু বলিস না। পুরোনো কথা মনে করে ও নতুন করে লজ্জা এবং হয়তো দুঃখও পাবে। ভয়ও পেতে পারে। আমার এমনকিছু প্রয়োজন নেই। আজ এখানে এসেছি তোরই কথামতো শুধু ওকে ভয়মুক্ত করতে। ও বড়ো ভালোমেয়ে। ও তো জানে না যে, এ জীবনে আমার দ্বারা কারও ক্ষতি হয়নি। তা ছাড়া ও যে আমার তোর চেয়েও অনেকই ভালো।

গলা নামিয়ে সোম বলল, যুযুধান! ও যদি প্ৰস হয় তাহলে আমরা ওর চেয়ে অনেকই বড়ো প্রস। কান খুলে শুনে রাখ। একথা বোধ হয় বলেও ছিলাম সে রাতে।

এই সময় পচার মা এসে বলল, দাদাবাবু, পান।

আমার বন্ধুকে দাও। আমি একটা সাদা পান খাব।

খেতে বসে শ্রীলা বলল, সোমদাদা! আপনি ভালো করে খান। কেমন হয়েছে মাংসটা? আসলে এরকম মাংস তো আমাদের এদিকে পাওয়া যায় না। মাংস ভালো হলে রাঁধুনির গুণ লাগে না।

সোম বলল, মাংস তো অনেক পাড়াতেই ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু ভালো রাঁধুনি সব জায়গায় কি পাওয়া যায়? অমৃতের মতো বেঁধেছ তুমি! কী কী দিয়েছিলে এল তো মাংসে?

যা সকলেই দেয়। তার সঙ্গে একটু সুপারি, একটুকরো দইয়ের ভাঁড়-ভাঙা, পেঁপে, দই বেশি করে, এই। আর কী!

এইসব মুসলমানি ব্যাপার তুমি কোত্থেকে শিখলে শ্রীলা? আমিষ রান্নার ব্যাপারে মুসলমানদের কোনো জবাব নেই। সত্যিই ভোগী জাত, বাঁচতে জানে ওরা! আমাদের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের বাড়িতে ইদ আর মুহাব্বাসে যে খানা খেয়েছি তা মুখে লেগে আছে।

আমার….

বলতে গিয়েই থেমে গেল শ্ৰীলা।

সোম বলল, বুঝেছি বুঝেছি। তোমরা তো বহুদিন বিহারে ছিলে। সেখানে তোমার বাবার তো বহু মুসলমান বন্ধু-বান্ধব তাই না? আমাকে বলেছে যুযুধান।

অবাক হয়ে শ্রীলা যুযুধানের মুখের দিকে চাইল।

যুযুধান ভ্রাতৃবধূকে আশ্বস্ত করে, বাঁ-হাঁতের আঙুল মাথার বাঁ-দিকে কানের পাশে টেম্পল এ ঠেকিয়ে আঙুলটা ঘুরিয়ে দিয়ে মুখ আড়াল করে হাসল।

সোম ওদের দুজনকেই অপদস্থ করে বলল, জানোই তো আমি পাগল। আমার কথার কোনো দাম নিয়ো না, দাম দিয়ো না। ভারি আনন্দ হল আজকে। আর একদিন মাংস নিয়ে আসব, অমল যেদিন থাকবে। সেদিনও এমন করেই বেঁধে।

.

খাওয়া-দাওয়ার পর যুযুধান বলল, এই গরমে কোথায় যাবি? শুয়ে থাক আমার কাছে। তোকে কী আর বলব। তোর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।

সোম পান চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাপি তো? কী রে! আমার মাথায় তো ছিট আছেই, সকলেই বলে, কিন্তু মুনিয়াকে তুই বসিল যে, আমি রিয়্যাল উন্মাদ। তাহলে ও একথা বিশ্বাস করবে যে, আমার কোনো কথাই তোর এবং অন্য কারোরই ধর্তব্যর মধ্যেই নয়। কখনোই। মুনিয়া নিশ্চিন্ত হবে।

ঠিক সেই সময়েই যুযুধানের ঘরের পর্দার আড়াল থেকে চুড়ির রিন ঠিন এবং শ্রীলার গলা শোনা গেল।

দাদা!

যুযুধানের মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। শ্রীলা নিশ্চয়ই ওদের কথা শুনেছে।

খাটে ও আধশোয়া হয়ে বসেছিল। উঠে বসে বলল, এসো। এসো। ভেতরে এসো শ্ৰীলা।

শ্রীলা, যুযুধান বাড়ি-থাকাকালীন ওর শোয়ার ঘরে কমই ঢোকে। যদিও ওর অনুপস্থিতিতে ওর মেয়েলি মঙ্গলপরশে সব কিছুই ঠিকঠাক গোছ-গাছ করে রাখে। একজন মেয়ে যে একটি বাড়িতে কত বড়ো প্রয়োজন, কত বড়ো সহায়ক সে বাড়ির শ্রীর, সৌন্দর্যর, শান্তির জন্যে তা যুযুধান অফিস থেকে ফিরলেই বুঝতে পারে। যেদিন শ্ৰীলা তার ঘরে আসে না গোছ-গাছ করতে সেদিন ঘরে ঢুকেই ও বুঝতে পারে যে, কোনো কারণে শ্রীলা আসেনি। কাউকেই বলে দিতে হয় না তাকে। শ্ৰীলা ভেতরে এসে দাঁড়াল। তার দু-চোখে জল টলটল করছে।

বড়ো অপরাধী লাগল। যুযুধানের নিজেকে। সত্যটা, এমনিতেই অসহ্য ছিল; কিন্তু সেই সত্যটা চাপা দেওয়ার চেষ্টাতেই সত্যটা আরও অনেকই বেশি প্রকটভাবে নগ্ন হয়ে পড়ল।

সোম মাথা নীচু করে রইল।

 যুযুধান দু-বার গলা খাঁকরে বলল, এল, শ্ৰীলা।

শ্রীলা যুযুধানকে কিছু না বলে, সোমকে বলল, আপনি একটু বাইরে আসবেন?

আমি? কেন? কী হল?

কথা আছে।

যুযুধান কোথায় লুকোবে নিজেকে, ভেবে পেল না। দু-হাতে বালিশটা তুলে নিজের মুখে চাপা দিল।

.

সোম শ্রীলার সঙ্গে বাইরে গেল। সেও গলা খাঁকরে বলল মুনিয়া ক্ষমা করো আমাকে। যুযুধানের মতো ভাসুর হয় না। ও সব জানে। জানে বলেই, ব্যাপারটাকে চিরদিনের মতো মুছে দিতে চায় তোমার জীবন থেকে। আমিও বলেছি তোমার তো …

ব্যানার্জি সাহেব ……

তোমার তো কোনো…..

ব্যানার্জি সাহেব, দাদাকে আপনিই খবরটা দিন।

 কী খবর?

আমি পারব না দিতে। আপনার বন্ধু, আপনিই দিন।

কী খবর? সেটা তো বলবে!

আমাদের বাড়ির কোন খারাপ। আজ রবিবার, দাদার অফিসও বন্ধ। তাই পাশের বাড়ির হরিবাবুকে ফোন করেছে যবন, দিল্লি থেকে, ফোন ধরে আছে।

কী খবর?

যূনীদি কাল দুপুরে জনপথ-এ গাড়ি চাপা পড়েছিলেন। ওয়েস্টার্ন কোর্ট আর ইস্টার্ন কোর্টের মাঝে। কলেজ ছুটির পর কেনাকাটা করতে গেছিলেন জনপথ-এ। ওঁর আজ কলকাতার রওয়ানা হবার কথা ছিল। দাদাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যেই দাদাকে আগে জানাননি। শান্তিনিকেতনে যাবেন বলেই আসছিলেন নাকি সাত দিনের ছুটি নিয়ে।

তারপর?

আধঘণ্টা আগে মারা গেছেন যূনীদি। এখনও সময় আছে। দাদা যদি বিকেলের ফ্লাইট ধরে দিল্লি পৌঁছোতে পারেন…

সোম একমুহূর্ত ভাবল। তারপরই বলল, যে ফোন করেছে তাকে বলে দাও যে যুযুধানের জ্বর। যেতে পারবে না।

বলে দেব? দাদাকে জিজ্ঞেস না করেই?

হ্যাঁ। বলে দাও। আমি বলছি। ও গিয়ে কী করবে? ও যা নরম মনের মানুষ।

ঠিক আছে। ভাগ্যিস এই সময়ে আপনি ছিলেন। নইলে আমি কী যে করতাম!

 গলা নামিয়ে সোম বলল, তুমি ঠিক থেকো। তোমারও তো দিদি। তোমার দাদাকে আমি দেখছি।

 সোম যখন ঘরে ঢুকল তখন যুযুধান বলল, তুই-ই আমার জীবনের শনি। তোর সঙ্গে কেন যে দেখা হল এত বছর পরে। আমার সুখের সংসার তুই ভেঙে দিলি। কী বলল রে শ্রীলা?

 যুযুধানের বেডসাইড টেবিলে যূনীর একটা ছবি ছিল। লেডি শ্রীরাম কলেজের সামনে বইখাতা হাতে দাঁড়ানো। ছবিটি অনেকদিন আগের কিন্তু ওইটেই বাঁধিয়ে রেখেছিল যুযুধান। কারণ যূনী সবচেয়ে বেশি ওই ছবিটিতেই। চিরকালের যূনী।

সোম বলল, এ কার ফোটো?

যূনীর। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। তবে কবে যে, তা কে জানে? প্রত্যেক ফুলের জীবনে যেমন একটি সময় আসেই সব থেকে বেশি করে ফোটবার, প্রত্যেক নারীর জীবনেও তাই। প্রস্ফুটিততম হবার পর তার ওপরে বিকেলের ছায়া পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। তখন মন-ফোঁটার বেলা শুরু হয়, আর শরীর মলিন হবার। এই ফোটোটা যখনকার, তখন যূনী থিসিস করছিল।

ফোটোটা হাতে তুলে নিয়ে সোম বলল, এই মহিলা?

বাঃ। এই তো যূনী। দিল্লিতে থাকে। শ্ৰীলার সম্বন্ধ তো ও-ই করেছিল। তোকে বলিনি যূনীর কথা?

মুখে বলিসনি। কিন্তু তোকে দেখে বুঝতাম যে তুই কারও প্রেমে পড়ে আছিস গভীরভাবে।

 প্রেমে না পড়ে থাকলে কারও মুখ অমন ঔজ্জ্বল্য পায় না।

যুযুধানের মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সোম বলল, ফোটো দেখেই আমি প্রেমে পড়ে গেছি।

যুযুধান গৌরবের হাসি হাসল। পরক্ষণেই তার মুখের হাসি নিভে গেল। বলল, শ্রীলা কী বলল, তাই বল।

ও কিছু না। তোর ভয় নেই। ও আমাদের কথা শোনেনি। আমাকে বলল, অমলের সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিতে। ওর ধারণা অমল ড্রাগ-পেডলার হয়েছে। অন্য স্মাগলিং-এর কাজেও আছে। যে-কোনোদিন পুলিশের হাতে পড়বে, নয়তো খুন হয়ে যাবে।

বলিস কী রে!

 যুযুধানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, আমার মনও তাই বলছিল। নইলে এত ফুটুনি করে কী করে! দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ঘুমোয়। সকালে একবার বেরোয়, তাও কোনো কোনোদিন। বিকেলে চা খেয়ে বেরোয় ছটা নাগাদ, তাও নটা-দশটা নাগাদ চলে আসে।

তুই ভাবিস না। আমি খোঁজ নেব। এবং দেখি কী করা যায়।

যুযুধান বলল, মা নাম রেখেছিলেন যুযুধান, কোলবালিশ-পেটাপেটি করতাম বলে। বোনটা তো মরেই গেল। ভাইও দু-দিনের জ্বরে এনকেফেলাইটিস-এ। সেও পনেরো কুড়ি বছর হল। এখন আমি আর অমল। আমার নিজের কারণে কারও সঙ্গেই কোনো যুদ্ধ নেই অথচ দ্যাখ সারাটা জীবনই অন্যর কারণে যুদ্ধ করে যেতে হল।

সোম বলল, যুদ্ধ, সকলেই করে, কারও যুদ্ধ যাত্রার যুদ্ধর মতো, চিৎকার, চেঁচামেচি, রাংতা-মোড়া তলোয়ারের ঠনঠন। কারও যুদ্ধ তোর মতো, নীরবে নির্জনে, লোকের চোখের আড়ালে। তবে যুযুধান নাম বোধ হয় আর কারো নেই। মাসিমার ওরিজিনালিটি ছিল।

বলেই বলল, এই যূনী মেয়েটিকে বিয়ে করছিস না কেন?

এদিকে তা চাকরি জোটাতে পারছি না। আমি দিল্লি যেতে পারতাম চেষ্টা চরিত্তির করে তবে স্টেট-গভর্নমেন্টের আর কটা চাকরি দিল্লিতে আছে? আমি তো আই এ এস বা ডারু বি সি এসও নই!

যুনী কি শিগগিরই আসবে কলকাতায়? এলে, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিস।

নিশ্চয়ই দেব। তোর কথা লিখেওছি ওকে। তোর কথা, সপ্তমীর কথা, প্যাঙার কথা।

এবার চল ওঠ। পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে পায়জামাটা পরে নে। তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। যোধপুর পার্কে। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দেব। কল্যাণ মজুমদার।

দুর। রবিবারের দুপুরে আমি ঘুমোই। নে তো। তুইও শুয়ে পড়। চল্লিশ হয়ে গেছে তো। শরীর একটু আরাম চায়।

না রে ওঠ। তোকে যেতেই হবে একবার।

আমি কোথাওই যাচ্ছি না।

তাহলে আমিই উঠি। আমার যেতেই হবে।

এই রোদে যাবি? বড়ো চড়া রোদ।

জীবন মানেই তো রোদ। ছায়া কোথায় পাবি যুযুধান?

আমি চলি রে।

দরজা খুলে যুযুধান বলল, চল তোকে বাসে চড়িয়ে দিয়ে আসি।

সোম বলল, তাহলে তো যেতেই পারতিস। তুই ঘুমো। একটা দিনই তো! আমার মতো ভ্যাগাবণ্ড তো তুই নোস যে, রোজই ছুটি।

.

১০.

শ্রীলা অনেক কেঁদেছিল পচার মাও কম কাঁদেনি। কিন্তু যার সবচেয়ে বেশি কাঁদার ছিল সেই যুযুধানই পাঁচটা অবধি ঘুমিয়েছে। তারপর পচার মাকে ডেকে চা খেয়ে বেরিয়ে গেছে। প্রতি রবিবারেই যেমন যায়। ফেরবার সময় খোকার জন্যে কিছু না কিছু খাবার কিনে আনবেই।

শ্রীলা ভাবছিল, আশ্চর্য এই সংসার! নিজের ভাই অমলের সঙ্গেই তার সম্পর্ক সবচেয়ে কম অথচ শ্রীলা আর খোকাই যুযুধানের অনেক কাছের মানুষ। এতদিন যূনীদিদি ছিল। সেও চলে গেল! যুযুধানের স্বভাব দেখে মাঝে মাঝেই শ্রীলার মনে হয় অমলের বদলে দাদা তার স্বামী হলে কত ভালো হত। অমন স্বামীর জন্যে যে-কোনো মেয়ে সবকিছুই দিতে পারে। অমলের আপন দাদা বলে মনেই হয় না। অমল জীবনের কোনো একটি বইও পুরো পড়েনি। শ্রীলা একরকম আর অমল অন্যরকম।

পচার মা বলল, কবে কাজ করবে গো দিদি?

তিনদিনে তো করার কথা। কিন্তু পোস্ট মর্টেম করে ডেডবডি কবে হাতে পাবে তার ওপরে তো। সকার হলে না কাজ। দেখলে না, অপরেশদার বেলাতে কী হল। অ্যাকসিডেন্টে মরলে নানা হ্যাঁপা। ইশ। যূনীদিদিটা সত্যিই চলে গেল। ভাবতেও পারছি না আমি। আমাদের কাছে সে আপনেরও বেশি ছিল।

সন্ধের পর যুযুধান যখন ফিরল তখন শ্ৰীলা নিজেই নীচে নেমে দরজা খুলল। আজ কোথায় গেলেন দাদা কে জানে। আত্মহত্যা-টত্যা করবেন না তো।

ওর মুখে চেয়েই মনে হল যুযুধানের যে, কান্নাকাটি করেছে।

বলল, অমল ফিরেছে নাকি?

না তো!

এই নাও! গুপ্ত-ব্রাদার্সের ভেলপুরি এনেছি তোমার জন্যে।

 দরজা না-লাগিয়েই শ্রীলা বলল, আমি খাব না দাদা। বলেই, ও একটি সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ করেই চুপ করে গেল।

ও কী, তোমার চোখ মুখ ফোলা কেন? কী হয়েছে শ্রীলা? সোম কি তোমাকে কিছু বলেছে? অপমানজনক কিছু বলেছে? রাসকেলটা তো আমাকে কিছুই…..

শ্রীলা অবাক হয়ে বলল, উনি আপনাকে কিছু কি বলেননি? আমি যা বলতে বলেছিলাম।

আমাকে? কই? নাতো!

কী সাংঘাতিক লোক!

বলতে বলতেই, দরজার পাল্লা ঠেলে সোম একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল।

শ্রীলা আক্রমণাত্মক গলায় বলল, আপনি দাদাকে বলেননি?

বলব! বলব! সবকিছুরই বলার সময় থাকে। অত তাড়া কীসের?

কী, ব্যাপারটা কী? যুযুধান একটু অবাক হয়ে বলল। এমন কী কথা যা শ্রীলা বলতে পারে না, সোমের তাকে বলতে হবে, অথচ শ্রীলা অত্যন্তই মথিত।

 সোম পকেট থেকে একটা টিকিট বের করল ট্রেনের। তারপর কারও প্রশ্নর অপেক্ষা না করেই চেয়ারে বসে বলল, যুযু, তোকে পরশু দিল্লি রওয়ানা হতে হবে ট্রেনে। আর আমি যাচ্ছি কাল সকালের ফ্লাইটে, প্লেনে। ভোর ছটায় ফ্লাইট। রাতটা তোর এখানেই থাকব। সকালে ট্যাক্সি পেতে সুবিধে হবে।

কী ব্যাপার? হতভম্বর মতো যুযুধান শুধোল।

তারপর শ্রীলার দিকে অসহায়ের মতো ফিরে বলল, কী ব্যাপার? যবন আনুর কি কিছু হয়েছে? কি? …

শ্ৰীলা দু-দিকে ঘাড় নাড়ল। দু-চোখে জল নিয়ে।

 তবে? কোনো খারাপ খবর কি?

 শ্রীলা, আমাদের জন্যে দু-গ্লাস জল এনে দাও তো। সোম বলল।

কী হয়েছে রে? সোম?

জলটা খাই। বলছি। বড়ো ঘোরাঘুরি করতে হল তো সারাদুপুর। তোর এখান থেকে বেরিয়ে গোপেনদার বাড়ি গেলাম, টাকা ধার করে আই এ সিতে গিয়ে আমার টিকিট কাটলাম। তাও বলে কিনা, একশো-বত্রিশ নাম্বার চান্স। সেখান থেকে কল্যাণ মজুমদার সাহেবকে তাঁর বাড়িতে ফোন করিয়ে তাঁকে দিয়ে বলিয়ে তারপর কোনোক্রমে ভি আই পি কোটা থেকে এই টিকিট পেলাম। তারপর তোর টিকিট। তাও আবার একজিকুটিভ ক্লাস। লোকে দেখলে ভাববে, চাকরিটা ন্যায্য কারণেই গেছে। তারপর বাড়ি গেলাম ওদের বলে আসতে। তিন-চারদিন থাকব না। একা থাকবে ওরা। ওই প্যাঙাটাকে নিয়েই চিন্তা।

এই যে জল। শ্রীলা ট্রেতে বসিয়ে জল এনে বলল।

জল তুলে নিয়ে সোম বলল, তুই খাবি না? খা।

 ওর এমনই হাব-ভাব যেন বাড়িটা সোম-এরই। যুযুধান-ই অতিথি।

যুযুধান ভাবছিল।

গ্লাসটা তুলে যুযুধানও খেল জল।

গ্লাস নামিয়ে রেখে সোম বলল, আমরা যে কত সুখে আছি, থাকি, তা আমরা বুঝতে পারি যখন কোনো দুঃখ বা মানসিক ঝড় বা আঘাত এসে আমাদের শান্তিকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। আমি বোধ হয় তোর পক্ষে খুবই অপয়া যুযু। আমি…

কী হয়েছে বলবি কি না বল?

বলছি বলছি। শ্রীলা পচার মাকে এল না একটু চায়ের জল চড়াবে আর তুমি এখানে এসে বোসো।

যুযুধান তীব্ৰচোখে চেয়েছিল সোম-এর চোখে।

 শ্রীলা ফিরে এলে সোম বলল যূনী আমাদের ফেলে চলে গেল রে।

কোথায় গেল? চমকে উঠে যুযুধান বলল।

সোম বলল, আমার স্ত্রীর যাওয়ার চেয়ে এ যাওয়া অনেক ভালো, অনেকই সম্মানের। জনপথ-এ রাস্তা পার হবার সময় গাড়ি চাপা পড়ে কাল। আজ দুপুরে আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখনই সে চলে যায়। তাই তো শ্রীলা?

ভাবাবেগহীন ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট গলাতে সোম বলল।

যুযুধান দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। মাথা নুইয়ে নিল। চিবুক ঠেকে গেল বুকে।

সোম চোখ দিয়ে শ্রীলাকে ইশারা করল। শ্রীলা যুযুধানের পায়ের কাছে এসে মাটিতে বসে যুযুধানের হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

 সোম বলল, যুযুধান! তুই পুরুষমানুষ। শ্রীলাকে সামলা আগে। কেঁদে কেঁদে চোখমুখের অবস্থা কী করেছে দেখছিস?

যুযুধান চোখ থেকে হাত সরিয়ে শ্রীলার মাথায় রাখল। সে কাঁদছিল না। কিন্তু দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছিল।

 শ্ৰীলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, শান্তিনিকেতনে যাবে বলেই আসছিল কলকাতায়। আজ রওয়ানা হয়ে আসত। কাল শনিবার, কলেজ ছুটির পর কনট-সার্কাসে বাজার করতে গেছিল। আপনাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে, জানায়নি।

যুযুধান বলল, তোর টিকিটটাই আমাকে দে।

না। এখন গিয়ে তুই কী করবি? পোস্ট মর্টেম হবে। কবে ছাড়বে বডি। ভালোবাসার জনকে কখনো অমন শেষদেখা দেখতে নেই। তোর শোয়ার ঘরের বেডসাইড টেবলে যে যূনী আছে, সে-ই থাক তোর কাছে চিরদিন। আমি যাচ্ছি, এই দুঃসময়ে যবনের পাশে থাকার জন্যে, পোস্টমর্টেম, দাহ, কাজের বন্দোবস্ত সবই করতে হবে তো! তুই আমাকে একটা লিস্ট বানিয়ে দে। দিল্লিতে তোর জানাশোনা কে কে আছেন, কাজে, তাঁদের বলতে হবে তো। যবনের কাছে বাকি লিস্টও পাব।

একমুহূর্ত থেমে বলল, যবন বিয়ে করেছে?

না। একটি পাঞ্জাবি মেয়েকে ভালোবাসে। ভারি চমৎকার মেয়ে। অনুরাধা। শ্রীলা বলল।

ওদের বিয়েরও বন্দোবস্ত করে আসব এবারে। তুই এসে পৌঁছো। অনুরাধার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে আসব। ওঁরাই তো এখন যবনের গার্জেন হবেন।

 সোম নিজের মনেই আরও অনেক কিছু বলে যেতে লাগল, এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে, যেন যূনীকে ও যুযুধানের চেয়েও বেশি বেশি চিনত, চিনত যবন আর অনুরাধাকে। ওই শোকের মধ্যেও যুযুধান একবার সোম-এর রোদে-পোড়া লম্বা তামাটে চেহারার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকাল। ভাবলেশহীন মুখ। ও ভাবছিল, নামটা ওর যুযুধান বটে কিন্তু আসল যুদ্ধ করতে এসেছে এখানে সোমই।

সোম ছিল বলেই বোধ হয় যূনীর চলে যাওয়াটার প্রভাব পুরো পড়ল না নিজের ওপরে। আশ্চর্য। জীবনের ঠিক যে সময়ে সবচেয়ে বেশি করে বাঁচতে ইচ্ছে করছিল, বাঁচার মতো বাঁচার ইচ্ছেটা তীব্রতম দীপ্তি পেয়েছিল; ঠিক সেই সময়েই..

সোম যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল, বুঝলি যুযু, man proposes; God disposes.

সোম-এর দিকে চেয়ে যুযুধান চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলল, তুই চা খাবি বলছিলি তো?

হ্যাঁ। শ্ৰীলা, যাও একটু চা করো আমাদের সকলেরই জন্যে। আর কিছু আমরা আজ কেউই খাব না। খোকাকে খাইয়ে শুইয়ে দাও গিয়ে। একমাস নিরামিষ। যুযুর সঙ্গে যূনীর বিয়েটা হয়ে গেলে তো তাই-ই হত!

তাইতো! বলে, শ্রীলা উঠে গেল।

সোম বলল, আজ সারারাত তুই যূনীর গল্প বলবি আমার কাছে আর আমি শুনব। ভোর চারটেতে আমাকে তোর এখান থেকে বেরোতে হবে, দমদম-এ যাওয়ার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *