ছয়
রাসকোল্নিকভের মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তার তুফান ছুটছে। পুলিশ আসবার আগেই গয়না আর টাকার থলি সরাতে হবে নিজের ঘরের ভেতর থেকে।
কে জানে, এতক্ষণে হয়তো পৌঁছেই গেছে পুলিশ। ওদের তো গাড়ি আছে, ঘোড়া আছে। রাসকোল্নিকভের আগেই পৌঁছেছে, দেওয়ালের গর্ত থেকে রক্তমাখা জিনিসগুলো হয়ত টেনে নামাচ্ছে!
তাহলে তো এখুনি শহর ছেড়ে চলে যেতে হয় রাসকোল্নিকভকে। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও তো মনটা স্বস্তি পাবে না। ঘরের ব্যাপারটা নিজে না জানা পর্যন্ত যাবে কোথায়?
তাই ঘরেই ফিরে এল রাসকোল্নিকভ। গিয়ে দেখল, ঘরটা যেমন ছিলো ঠিক তেমনি আছে। পুলিশ তো আসেইনি_ন্যাসটাসিয়াও ঘরে ঢুকেছে বলে মনে হচ্ছে না।
দৌড়ে গেল দেয়ালের সামনে। হাত ঢুকিয়ে দিল গর্তের মধ্যে। এই তো রয়েছে গয়না আর টাকার থলি!
তাড়াতাড়ি টেনে বার করে কোট আর প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিল রাসকোল্নিকভ। প্যান্টের একটা পকেট তো কেটে বাদ দিয়েছে–অন্য পকেটটায় মালপত্র ঢোকাল অল্প করে–যাতে বেশি উঁচু না হয়ে থাকে।
বেরিয়ে এল ঘর থেকে মাথা উঁচু করে। মাথা এখন বেশ পরিষ্কার। পুলিশ আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। তার আগেই লুকিয়ে ফেলতে হবে এই জিনিসগুলো।
খালের পানিতেই ফেলে দেবে সবকিছু। ল্যাঠা চুকে যাবে তাহলে।
কিন্তু খালের ধারে গিয়ে দেখে সে আর এক ঝামেলা। লোক গিজগিজ করছে। রাসকোল্নিকভের স্পষ্ট মনে হচ্ছে যেন সব্বাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। একবার খালের ধার পর্যন্ত নেমে গিয়ে মনে হল সব্বাই যেন আরও বেশি করে দেখছে ওকে।
যাওয়া যাক নদীর ধারে। শহর থেকে বেশ দূরে। সেখানে নিশ্চয় লোক যাবে না। কিন্তু নদী পর্যন্ত যেতেও হল না। রাস্তা দিয়ে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা কানাগলি, বেশ নির্জন জায়গা। লোকজন একদম নেই।
খামোকা নদী পর্যন্ত যাবার দরকারটা কী? এইখানেই তো লুকিয়ে রাখা যায় সমস্ত জিনিস। কাকপক্ষীও টের পাবে না।
গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল রাসকোল্নিকভ। একটু দূরেই একটা বড় পাথর। পাথরের পাশে একটা পচা ডোবা।
গলির দুপাশে উঁচু দেয়াল। সে দেয়ালে দরজা নেই, জানালা নেই। চারতলা গুদামবাড়ির দেয়াল এটা–পেছন দিক বলে দেয়ালে দরজা জানালা কিছু নেই।
বড় পাথরটা রয়েছে ভেতরের উঠোনে। তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। কেউ কোথাও নেই।
তারের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকল রাসকোল্নিকভ। মতলবটা ছিল ডোবার পানিতে ফেলে দেবে গয়না আর থলে। পাথরের ওপর দাঁড়িয়েছিল সেই উদ্দেশ্যেই।
কিন্তু আচমকা মনে হল, তার কি দরকার? বিশাল এই পাথরের তলায় জিনিসগুলো লুকিয়ে রাখলেই তো হয়!
যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। পাথরটা মন দেড়েক ভারি, টেনে তুলে তলার মাটি সরিয়ে একটু গর্ত খুঁড়ে নিল হাত দিয়ে। তারপর পকেট থেকে গয়না আর টাকার থলি বের করে রাখল তার ভেতরে।
ভারি পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে দিল গর্তটা। আশপাশের ঝুরো মাটি হাত দিয়ে টিপে টিপে সমান করে দিল। ব্যস! আর কোনো ভয় নেই। পুলিশ এসে করুক খানাতল্লাশী-ঘরে পাবে না কিছুই।
তবে এখনও একটা জিনিস রয়ে গেছে। রক্তমাখা কাটা পকেটটা। সেটা রয়েছে বালিশের তলায়।
আরও আছে পায়ের এই রক্তমাখা মোজা। এটাকেও বিদেয় করতে হবে। কিন্তু আর তো মোজা নেই তার। পরবে কি রাসকোল্নিকভ।
এইসব আবোলতাবোল উল্টোপাল্টা চিন্তা নিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল রাসকোল্নিকভ।
বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। নিদারুণ অবসাদে শরীর আর চলছে না। কোনোমতে জামাকাপড় খুলে ওভারকোটটা গায়ে দিল। মাথাটা বালিশে দিয়ে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল অঘোরে।
কতক্ষণ এইভাবে ঘুমিয়েছিল, তা জানা নেই রাসকোল্নিকভের। তবে ঘুম ছুটে গেল একটা কানফাটা আর্তনাদে।
আঁতকে উঠে চোখ খুললো সে। কিন্তু গভীর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারেও বিরামবিহীনভাবে সেই ভয়ানক আর্তনাদটা হয়েই চলেছে। কানের পর্দা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে সেই শব্দে।
শুধু কি আর্তনাদ! আরও অদ্ভুত আওয়াজ মিলেমিশে রয়েছে বুকফাটা চেঁচানিটার সঙ্গে। কারা যেন গলা চিরে চেঁচাচ্ছে। হাউহাউ করে কাঁদছে। বিটকেল একটা ঘরঘর আওয়াজও শোনা যাচ্ছে–সেই সঙ্গে বেদম ঠ্যাঙানো হচ্ছে কাউকে। গালাগাল আর অভিশাপ দেওয়া হচ্ছে তারস্বরে!
কী ব্যাপার এসব? এমন কাণ্ড, এমন অস্বাভাবিক আওয়াজ তো কখনও শোনেনি সে!
ধড়মড় করে উঠে বসল রাসকোল্নিকভ। চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে মারপিট, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি, অভিশাপ আরও বেড়ে গেল!
কাঠের মত বসে বসে শুনছে রাসকোল্নিকভ। শুনছে আর হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে।
আচমকা মনে হল–ওই যে বিচ্ছিরি হাউমাউ কান্না–ওটা বাড়িওলির গলা থেকে বেরোচ্ছে। কাঁদছে আর কাকুতি-মিনতি করছে। ঠেঙানি খাচ্ছে আর তড়বড় করে এন্তার কথা বলে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বলছে যে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না রাসকোল্নিকভ।
মারধর চলছে সিঁড়ির ওপর। বাড়িওলির একটা কথা শুধু বোঝা যাচ্ছে– মেরো না…মেরো না…মেরো না।…
কে এমনভাবে পিটাচ্ছে বাড়িওলিকে। ভীষণ রেগেছে লোকটা। এক নাগাড়ে সে-ও চেঁচাচ্ছে–তারও কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গলা তো নয় যেন ব্যাঙের ডাক। বিকট চিৎকার!
এ গলা যেন এর আগেও কোথায় শুনেছে রাসকোল্নিকভ। মনে পড়ে যায় পরক্ষণেই। এ যেন ইলিয়া পেত্রোভিচ! ভীষণ দাম্ভিক সেই সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট।
ইলিয়া বাড়ি বয়ে এসে মারছে বাড়িওলিকে! কী আশ্চর্য! কেন এই মার! ধাই ধাই করে লাথি মারছে। ঠাস ঠাস করে সিঁড়ির ধাপে মাথা ঠুকে দিচ্ছে! কেঁদে ককিয়ে হাট বসাচ্ছে বাড়িওলি!
লণ্ডভণ্ড কাণ্ড চলছে বাড়িময়! লোকজন ধুপদাপ ধুমদাম করে ছুটে আসছে পাঁচতলা চারতলা তেতলা থেকে। তারা সবাই চেঁচাচ্ছে দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে–আবার দুমদাম করে পাল্লাগুলো খুলেও যাচ্ছে।
হাত বাড়িয়ে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিতে গেল রাসকোল্নিকভ। পারল না। একটা আঙুলও নড়াতে পারল না। শরীর তার বরফের মত ঠাণ্ডা–নিদারুণ আতঙ্কে!
পুলিশ এসে গেছে বাড়িতে। এবার আর তার নিস্তার নেই।
বিকট আওয়াজগুলো কিন্তু একটু একটু করে কমে আসছে। ইলিয়া পেত্রোভিচ এখনও বাজখাই গলায় চিৎকার করছে। বাড়িওলি এখনও মরাকান্না কাঁদছে। একগাদা লোক হঠাৎ দুড়দাড় করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
চলে যাচ্ছে পুলিশ? রাসকোল্নিকভকে না ধরেই? তবে এসেছিল কেন?
হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একটা আলো।
ঘরে ঢুকল ন্যাসটাসিয়া। হাতে তার প্লেট, চামচ, রুটি, তরকারি। বললো– হোটেলের খাবার শেষ। একটু তরকারি ছিল এনেছি–খেয়ে নাও। সারাদিন তো টো-টো করে ঘুরেছে–জ্বরে কাঁপছও দেখছি।
ন্যাসটাসিয়া, বাড়িওলিকে মারছিল কেন?
বাড়িওলিকে মারছিল? কে? তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ন্যাসটাসিয়া।
পুলিশের সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট। সিঁড়ির ওপর ফেলে কি মার মারল এতক্ষণ! কেন?
ন্যাসটাসিয়া শুধু চেয়ে রইল। চোখ আরও তীক্ষ্ণ। মুখে কথা নেই। অস্বস্তি বোধ করে রাসকোল্নিকভ।
বলে ভয়ে ভয়ে কথা বলছ না কেন, ন্যাসটাসিয়া?
রক্ত! রক্ত! আপনমনে বললে ন্যাসটাসিয়া।
রক্ত! কিসের রক্ত? বলতে বলতে রাসকোল্নিকভের মুখ থেকেও যেন রক্ত নেমে যায়–চোখ ফিরিয়ে নেয় দেয়ালের দিকে।
ন্যাসটাসিয়া কিন্তু তখনও একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে।
তারপর বললো শক্ত গলায়–কেউ মারেনি বাড়িওলিকে।
নিজের কানে শুনলাম এতক্ষণ ধরে। বাড়িসুদ্ধ লোক দৌড়ে এল। কি মার! কি চিৎকার! পুলিশে ছেয়ে গেছিল গোটা বাড়ি।
কেউ আসেনি। তোমার মাথায় রক্ত উঠেছে। মাথায় রক্ত উঠলে অমন আজগুবি আওয়াজ শোনা যায়। যাকগে, কিছু খাবে?
না, ন্যাসটাসিয়া। পানি দাও, পানি খাব।
বেরিয়ে গিয়ে কুঁজোয় করে পানি এনে দিল ন্যাসটাসিয়া। খেতে গিয়ে গা-মুখ ভাসিয়ে ফেলল রাসকোল্নিকভ।
তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।
.
মুখে পানি ঢালবার পর থেকেই জ্ঞান হারিয়েছিল রাসকোল্নিকভ। পুরো অজ্ঞান অবস্থা নয়। ঘোরের মধ্যে থেকেছে। কখনও প্রলাপ বকেছে, কখনও ঝিম মেরে পড়ে থেকেছে। কখনও মনে হয়েছে ঘরে লোক গিজগিজ করছে–তাকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়ার জন্যে কথা কাটাকাটি করছে। কখনও মনে হয়েছে– লোকগুলো পালিয়েছে তার ভয়ে দরজা ফাঁক করে তাকে দেখছে…
ঘরে সে একলা রয়েছে।
লোকগুলো ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে-দূরে দাঁড়িয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে, টিটকিরি দিচ্ছে, মতলব আঁটছে তাকে জব্দ করার জন্যে।
ন্যাসটাসিয়াকে মাঝে মাঝে দেখেছে বিছানার পাশে।
আর, একটা লোককে।
লোকটাকে চেনে রাসকোল্নিকভ। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তার নামটা।
মনে না করতে পারার জন্যে ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। কেঁদেও ফেলছে হাউহাউ করে।
কখনও মনে হচ্ছে, প্রায় একমাস হল শুয়ে আছে এইভাবে।
আবার কখনও মনে হচ্ছে, এই তো মোটে একটা দিন অসুখে পড়েছে।
কিন্তু সবসময় একটা অস্বস্তি ফুরফুরে খাচ্ছে বেচারীকে। অস্বস্তিটা একটা ভুলে যাওয়া ব্যাপার নিয়ে।
তার মন বারবার খুঁচিয়ে চলেছে–ওহে রাসকোল্নিকভ, আসল ব্যাপারটা যে ভুলে যাচ্ছো!
আসল ব্যাপারটা যে কী, তা কিছুতেই মনে করতে পারছে না রাসকোল্নিকভ।
প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন মনে করতে পারছে না––বিষম উদ্বেগে তখন ছটফট করছে। নয়তো ভীষণ রাগ হচ্ছে নিজের ওপর।
তারপরেই কেঁদে উঠছে গলা ছেড়ে!
আতঙ্ক চেপে বসছে মনের ওপর। ইচ্ছে হছে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে।
কিন্তু সেই লোকটা–যাকে চেনা মনে হলেও নামটা মনে করতে পারছে না রাসকোল্নিকভ–সে তাকে চেপে ধরে রাখছে বিছানায়।
গায়ের জোরে তার সঙ্গে পেরে উঠছে না রাসকোল্নিকভ। একসময়ে এলিয়ে পড়ছে বিছানায়। একটু একটু করে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।
অবশেষে একদিন ফিরে এল তার টনটনে জ্ঞান।
তখন সকাল দশটা। ঘরে রোদ এসে পড়েছে। ন্যাসটাসিয়া দাঁড়িয়ে বিছানার পাশে। পাশে একটা লোক–রাসকোল্নিকভ তাকে চেনে না। দরজার ফাঁক দিয়ে বাড়িওলি একদৃষ্টে তাকে দেখছিল। সরে গেল জ্ঞান ফিরে আসতেই।
বিষম খুশিতে বলে ওঠে ন্যাসটাসিয়া–যাক, জ্ঞান ফিরল তাহলে।
অচেনা লোকটাও বললো সঙ্গে সঙ্গে–হ্যাঁ, জ্ঞান ফিরেছে।
বাড়িওলির কথা ভাবতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল রাসকোল্নিকভ।
এখন বললো অচেনা লোকটাকে–তুমি কে?
লোকটা জবাব দেবার আগেই দরজা খুলে গেল। কুঁজো হয়ে ঘরে ঢুকল রাজুমিখিন–রাসকোল্নিকভের সেই বন্ধু। এত ঢ্যাঙা যে, এই খুপরি ঘরে সোজ হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না।
খুশি তার চোখেমুখে–বাড়িওলির কাছে এখুনি শুনলাম, জ্ঞান ফিরে পেয়েছ।
জ্ঞান তো এল এখনি। বললো ন্যাসটাসিয়া।
হ্যাঁ, এখুনি। আবার বললো সেই অচেনা লোকটি।
সবেগে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় রাজুমিখিন–তোমাকে তো চিনতে পারছি না!
শেলোপায়েভের অফিসের পিয়ন আমি, বললো লোকটা–দরকার আপনার এই বন্ধুর সঙ্গে।
কি দরকার?
ওঁর মা কিছু টাকা পাঠিয়েছেন আমাদের অফিসে ওঁকে দেবার জন্যে। এই যে খাতা–এতে সই করে দিলেই টাকা দিয়ে বিদেয় হই।
টাকা! খুবই দরকার এখন। ওঠো হে, রাসকোল্নিকভ, সইটা করো।
চাই না ওই টাকা! মুখ ভার করে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ।
যেন আকাশ থেকে পড়ে রাজুমিখিন–সেকী! টাকা নেবে না মানে? নিশ্চয় নেবে। দাও, তোমার হাত দাও–ধরে সই করিয়ে দিচ্ছি
জোর করে সই করাতে হবে না। নিজেই করছি।
খাতায় সই করিয়ে নিয়ে পঁয়ত্রিশ ফুল রাসকোল্নিকভের হাতে দিয়ে চলে গেল পিয়ন।
অমনি বকর বকর শুরু করে দিলো রাজুমিখিন–উঃ! কি ঝামেলাতেই না ফেলেছিলে! চার দিন তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। চামচে করে একটু একটু চা গিলিয়েছি শুধু। জোসিমভ ডাক্তারকে দুদিন এনেছিলাম। ও বলে গেল, ভারি অসুখ নয় এটা। না খেয়ে দেয়ে স্নায়ুর গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছ। পেট ঠেসে খেলেই সব সেরে যাবে–ক্ষিধে পেয়েছে?
পেয়েছে। বললে রাসকোল্নিকভ।
ন্যাসটাসিয়া, সুপ আছে?
কালকেরটা আছে, বললো ন্যাসটাসিয়া।
আলু আর চালের সেই সুপ তো?
হ্যাঁ।
যাও, তাই নিয়ে এসো। চা-ও আনবে।
অবাক হয়ে দেখে রাসকোল্নিকভ, রীতিমত দাবড়ানি দিয়ে ন্যাসটাসিয়াকে দিয়ে কাজ করিয়ে যাচ্ছে রাজুমিখিন! আশ্চর্য ব্যাপার মনে হচ্ছে তার! স্বপ্ন-টপ্ন দেখছে না তো রাসকোল্নিকভ?
চা-খাবার এসে গেল। টেবিলে সাদা চাদর পাতা হয়ে গেল। অনেকদিন এমনিভাবে খাওয়ার আয়োজন হয়নি এই ঘরে।
ফের হুকুম দেয় রাজুমিখিন–বাড়িওলিকে দু-বোতল বীয়ার দিতে বলো।
হুকুম তামিল করতে বেরিয়ে গেল ন্যাসটাসিয়া।
আরও হতভম্ব হয়ে যায় রাসকোল্নিকভ! অজ্ঞান হওয়ার আগে যার দিন কেটেছে ভিখিরির মত–বাড়িওলির লাথিঝাটাও খেতে হয়েছে। জ্ঞান ফিরে পেতেই তার সুদিন এসে গেল!
গরম সুপ চামচে করে নিয়ে রাসকোল্নিকভকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো রাজুমিখিনকদিন ধরেই আমি এইভাবে খেয়ে যাচ্ছি রাজার হালে। বাড়িওলি আমাকে খাইয়ে খুশি হয়। তোমার নামে পুলিশে খবর দিয়েছিল বাজে লোকের উস্কানিতে–আর করবে না। টাকাপয়সাও আর চাইবে না। টাকা দেবে বলে যে কাগজটা তুমি লিখে দিয়েছিলে, সেটাও ফিরিয়ে দিয়েছে–এই নাও।
বলে কাগজটা পকেট থেকে বের করে রাসকোল্নিকভকে দেখাল রাজুমিখিন–পরক্ষণেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল মেঝেতে।
কথা বলে চলল অবিরাম–সেদিন তিনটে রুব্ল যখন ফেরৎ দিয়ে চলে এলে–তখনই তোমাকে আটকানো উচিত ছিল। আসলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম। তক্ষুণি বেরিয়ে পড়লাম তোমার খোঁজে। ঠিকানা জানতাম না। তিন তিনটে দিন অনেক খোঁজাখুজির পর এখানে যখন এলাম তখন তুমি জ্বরে বেহুশ।
রাসকোল্নিকভ বলে ওঠে–জ্বরের ঘোরে একটা লোককে কিছুতেই চিনতে পারছিলাম না–
সে লোকটা আমি, মুচকি হেসে বললে রাজুমিখিন–শুধু আমাকে কেন, জামেটভ এসেছিল। তাকে দেখেই তুমি এমন রেগে গেলে
জামেটভ কে?
আরে! পুলিশ অফিসের সেই বড় সাহেব। সেখানেই তো তোমার সঙ্গে ওর আলাপ হয়। আমার কাছে তোমার নাম আর অসুখ শুনেই এসেছিল দেখা করতে।
পুলিশের বড় সাহেব! খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রাসকোল্নিকভের। পলকহীন চোখে চেয়ে আছে রাজুমিখিনের মুখের দিকে।
আরে হ্যাঁ! আমার বন্ধু জামে সাহেব। তার সামনেই তো অজ্ঞান হয়ে গেছিলে। প্রলাপের ঘোরে ইলিয়া পেত্রোভিচ আর নিকোডিম ফোমিচকে নিয়ে কত সব আবোলতাবোল কথাই বলে গেলে।
কী? কী বলেছি।
যা-বাব্বা! অমন আঁতকে উঠছো কেন? এমন কিছু গোপন কথা বলেনি। সোনার গয়না, কানের দুল, গলার হার, দারোয়ান–যত্তসব আজেবাজে কথা! মাথামুণ্ডু বোঝাই যায় না। একবার তো মড়াকান্না জুড়ে দিলে তোমার মোজা নিয়ে। মোজা চাই এখুনি। অনেক খুঁজেপেতে শেষকালে তোমার এই বিছানার তলা থেকেই মোজা টেনে বের করল জামেটভ। যার দশ আঙুলে দশটা আংটি–তাকে বাধ্য হয়ে নোংরা মোজাটা হাতে করে ধরে তুলে আনতে হল তোমার কান্নাকাটির ঠেলায়!
আর কিছু? মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে রাসকোল্নিকভের।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আরও অনেক উদ্ভট কথা বলেছ। প্যান্টের কাটা পকেটের জন্যে একবার বায়না ধরলে। সে জিনিসটা অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। আচ্ছা, এখন যাই। দশটা রুব্ল নিয়ে যাচ্ছি–হিসেব পরে দেব।
দিতে হবে না।
আমি না ফেরা পর্যন্ত ন্যাসটাসিয়া তোমার দেখাশুনো করবে। বলতে বলতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রাজুমিখিন। পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো ন্যাস টাসিয়াও।
তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এল রাসকোল্নিকভ।
এবার সব মনে পড়েছে। পুলিশ যখন এসেছে, তখন নিশ্চয় সব জেনেই এসেছে। অসুখ দেখে না জানার ভান করেছে। এইবার নিশ্চয় আসবে ধরে নিয়ে যেতে।
পাগলের মত আশেপাশে চায় রাসকোল্নিকভ। দরজায় কান পেতে শোনে, সত্যিই কেউ পা টিপে টিপে আসছে কিনা।
ভীষণ ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যাবার।
তারপরেই মনে হয়–অসম্ভব! পুলিশ যদি সিঁড়ির তলায় ওৎ পেতে বসে থাকে।
ছুটে যায় দেয়ালের কাছে। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দেখে–গয়না আর পড়ে নেই তো?
না, নেই, জবাব দেয় নিজেই–প্যান্টের কাটা পকেটটা? রেখেছিলাম ফায়ারপ্লেসের ঠাণ্ডা উনুনের মধ্যে ঢাকনি চাপা দিয়ে। বের করে নিয়ে যায়নি তো?
হন্তদন্ত হয়ে উনুনের ঢাকনি তোলে রাসকোল্নিকভ।
ঐ তো পড়ে রয়েছে রক্তমাখা কাটা পকেট!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে রাসকোল্নিকভ। আবার কিন্তু খচখচ করে ওঠে মনটা। রক্তমাখা মোজাটা হাতে নিয়েও জামেটভ ধরতে পারল না রক্ত লেগে রয়েছে এতে। পুলিশের চোখে রক্ত ধরা পড়ে না। ময়লায় চাপা পড়ে গেছে বলে কি ভুল করে গেল? নাকি জেনেশুনে অভিনয় করে গেল।
বিকার গ্রন্থের মতো নিজেই নিজের সঙ্গে কথা যেনো বলতে থাকে রাসকোল্নিকভজামেটভ কেন এসেছিল। রাজুমিখিন কেন ওকে নিয়ে এসেছিল? নিশ্চয় এর মধ্যে একটা রহস্য আছে। পালাতেই হবে দেখছি–পঁচিশ রুব্ল নিয়েই বেরিয়ে যাওয়া যাক। অন্য বাসায় উঠলে রাজুমিখিন আর আমাকে খুঁজে পাবে না। সবচেয়ে ভাল হয় দেশ ছেড়ে পালালে। আমেরিকায় চলে গেলেই তো হয়! আমার জামা-কাপড় কই? জুতো? লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়–যাতে পালাতে না পারি।
উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর থেকে খামচি মেরে পঁচিশ রুব্ল তুলে নিতে গিয়ে থমকে গেল রাসকোল্নিকভ।
টেবিলে রয়েছে আধ বোতল বীয়ার।
তুলে নিয়েই ঢেলে দিল গলায়। আগুন জ্বলছিল যেন বুকে আর মাথায়।
বীয়ারের নরম নেশায় ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগে সেই আগুনে। ঠাণ্ডা স্রোত নেমে আসে শিরদাঁড়া বেয়ে। সেই সঙ্গে ঘুমঘুম ভাব।
বালিশে মাথা রেখে গায়ে লেপ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাসকোল্নিকভ। এ লেপ আগে ছিল না। এসেছে অসুখের সময়ে।
.
সাত
চোখ খুলল রাসকোল্নিকভ। দেখল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজুমিখিন।
বললো সোল্লাসে, একটানা ছ-ঘণ্টা ঘুমোলে।
পুরো ছ-ঘন্টা। তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েই আছি। যাক, এইভাবে ঘুমোল চাঙা হয়ে যাবে শীগগিরই।
তোমার হাতে ওগুলো কী, রাজুমিখিন?
তোমার নতুন জামাকাপড়।
আমার?
যা পরে আছ, ওগুলো আর গায়ে দেওয়া যায় না। পরে দ্যাখো এগুলোর মাপ ঠিক আছে কিনা।
প্যাকেট খুলে একগাদা পুরনো জামাকাপড় আর একজোড়া জুতো বের করল রাজুমিখিন।
ন্যাসটাসিয়া দাঁড়িয়েছিল ঘরের এককোণে। পুরনো জুতো দেখে বলে উঠল–আন্দাজে জুতো কিনলে কি পায়ে লাগবে।
আন্দাজে কিনতে যাব কেন? বলতে বলতে ওভারকোটের পকেট থেকে রাসকোল্নিকভের পুরনো জুতোজোড়া বের করল রাজুমিখিন–এর মাপে কিনেছি।
এখন বুঝল রাসকোল্নিকভ–কেন একটু আগে জুতো খুঁজে পায়নি। পাশ ফিরে শুলো সে দেওয়ালের দিকে মুখ করে।
অবাক গলায় বললো রাজুমিখিন–ও কী! পছন্দ হল না জামাকাপড়-জুতো?
শুকনো গলায় বললো রাসকোল্নিকভ–এসব কিনবার টাকা পেলে কোত্থেকে।
সেকী! তোমার কাছ থেকেই তো দশ রুব্ল নিয়ে গেলাম।
আমি তো ভেবেছিলাম, চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিয়ে গেছে।
চিকিৎসার আবার খরচ কী? জোসিমভ ডাক্তার তো আমার বন্ধু।
আর এই যে খাওয়া-দাওয়া?
এ তো রুগীর পথ্য। দিচ্ছে বাড়িওলি পাশেঙ্কা। আমার খাতিরেই সে এক পয়সাও নেবে না।
নেবে না?
না। সুতরাং কারো কাছেই তোমার দেনা নেই। চারদিন পেটে দানাপানি যায়নি তোমার–
ঘরে ঢুকল জোসিমত ডাক্তার–শরীর কিরকম?
ভালই। বললে রাসকোল্নিকভ।
আমিও তাই দেখছি। ওষুধ বন্ধ থাক–খাওয়া চলুক। মাংস আর শশা বাদে। কালকের দিনটা দেখি, তারপর–
গনগনে চোখে ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে রইল রাসকোল্নিকভ। চাহনিটার মানে হতে পারে এই রকম–ডাক্তার, ভীষণ ক্ষতি করে দিলে আমার।
ডাক্তারের মনে কিন্তু একটা সন্দেহ ঢুকে পড়ে রাসকোল্নিকভের ওই জ্বলন্ত চাহনি দেখে। কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে যেই বেরোতে যাবে, রাজুমিখিন চেপে ধরল তাকে–জোসিমভ, আজ আমার বাড়িতে একটু খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। তুমি তো আসবেই–রাসকোল্নিকভকে কি নিয়ে যেতে পারব।
খাওয়া-দাওয়া? দুই চোখ বড় বড় করে তাকায় রাসকোল্নিকভ।
বাড়ি পাল্টেছি–তাই। তোমার এই বাড়ির কাছেই ঘর পেয়েছি। তাই দু চারজন বন্ধুবান্ধবকে ডেকে একটু ফুর্তি করব। সবাই তোমার আমার মত ছাত্র। সেই সঙ্গে থাকছেন আমার মফস্বলের চাচা, আর পর্ফাইরি পেত্রোচি–
কে? শেষ নামটা শুনে চমকে ওঠে রাসকোল্নিকভ।
পর্ফাইরি পেত্রোভিচ। গোয়েন্দা বিভাগের বড়কর্তা।
তোমার আত্মীয়।
খুবই দূরে সম্পর্কের। পুলিশ অফিসে সেদিন.ওঁর সঙ্গেই তোমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তিনি লোক ভাল—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি যাবে আমার সঙ্গে মনে ঝাল পুষে রেখো না। জামেটভতও আসছে।
ঘুষখোর জামেটভ? ফস্ করে বলে ওঠে জোসিমভ।
তাতে কি যায় আসে। ঘুষ খায় তো আমার কী? ঘুষ খাওয়াটা বরদাস্ত করি না ঠিকই–কিন্তু লোকটার অন্য দিকগুলো তো ভাল–
ভালো? মিটমিট করে তাকায় ডাক্তার।
খুবই উত্তেজিত হয়ে যায় রাজুমিখিন। বললো হড় হড় করে রাসকো নিকতকে–বুড়ি অ্যালিওনাকে মনে পড়ে। এই তো সেদিন খুন হয়ে গেল। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে নিরীহ এক রঙের মিন্ত্রীকে। আমি তাকে পুলিশের খপ্পর থেকে বের করবই-জামেটভের সঙ্গে সেই নিয়েই চলছে বুদ্ধির কসরত।
রঙের মিস্ত্রীকে খালাস করার জন্যে তোমার খাওয়া-দাওয়া শিকেয় উঠল কেন? ব্যঙ্গের সুরে বলে ডাক্তার।
দ্যাখো জোসিম, অন্যায় অবিচার একদম সইতে পারি না বলেই মাথাটা গরম হয়ে যায় আমার। বেশ রেগেছে রাজুমিখিন–পুলিশের লোকগুলো পয়লা নম্বরের অবিচারক। বুড়ির খুনের জন্যে প্রথমে পাকড়াও করল নিরীহ দুজনকে। ক আর পেচত্রিয়াকভকে তারা নাকি প্রথমে দরজা বন্ধ দেখেছিল–দারোয়ান দেখেছে, কথাটা ঠিক নয়-দরজা খোলাই রয়েছে। ব্যস, সেইটাই হয়ে গেল তাদের খুন করার মোক্ষম প্রমাণ! হা হা হা! আর এখন রঙমিস্ত্রীকে নিয়ে নাজেহাল করছে ঠিক ওইরকমই খেলো যুক্তি নিয়ে।
যুক্তিটা কী? ডাক্তার জানতে চাইল।
রঙ-মিস্ত্রী নিকোলে নাকি একজোড়া কানের দুল বেচবার চেষ্টা করেছিল।
কানের দুল!
যে দুল ছিল বুড়ির সিন্দুকে।
যুক্তিটা খেলো মনে হলো না তো! বুড়িকে যে খুন করেছে, সে-ই তো কানের দুল নিয়েছে সিন্দুক থেকে।
কি মুশকিল! ফের উত্তেজিত হয়ে যায় রাজুমিখিন–কানের দুল তো ঘরে পড়ে থাকতেও পারে। রঙের মিত্রী পড়ে থাকতে দেখেছে, তাই কুড়িয়ে নিয়েছে।
কোন ঘরে?
যে ঘরে রঙের কাজ হচ্ছিল, নিচের একটা ফ্ল্যাটে। হঠাৎ দুজনে ইয়ার্কি মেরে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। দিত্রি নামে রঙের মিটার পেছন পেছন দৌড়েছিল নিকোলে, দিত্রি-কে না পেয়ে ফিরে আসে যন্ত্রপাতি নিতে। একটা তুলি পাচ্ছিল না কিছুতেই। সেটাকেই খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল কানের দুলের বারটা রয়েছে দরজার পেছনে। দরজার পেছনে? আচমকা বেখাপ্পা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে রাসকোল্নিকভ।
থ হয়ে গেল রাজুমিখিন আর জোসিমভ ডাক্তার!
এতক্ষণ তো দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিল রাসকোল্নিকভ। ওদের কথা শুনছিল বলে মনেই হচ্ছিল না। হঠাৎ এ কী মন্তব্য! এত উসই বা কেন?
রাসকোল্নিকভ নিজেও বুঝেছে, হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠে নিজেকে সে সন্দেহভাজন করে তুলেছে দুই বন্ধুর চোখে।
তাই সামলে নেবার জন্যে বললো ঢোক গিলে–দরজার পেছনে ছিল বলেই সবশেষে চোখে পড়েছে–নইলে আগেই দেখা যেত।
তা বটে! তা বটে! বলল বটে রাজুমিনি, কিন্তু বেশ বোঝা গেল মুখখানা তার উদ্বেগে কালো হয়ে উঠেছে। জোসিমভের মুখেও সেই একই উদ্বেগের কালো ছায়া।
রাসকোল্নিকভের কথায় যুক্তি থাকতে পারে–কিন্তু এতটা আবেগ আর উস বড় বেখাপ্পা, বড় বেমানান।
ঠিক এই সময়ে ঘরে এলেন এক ভদ্রলোক। ফুলবাবুর মত সাজগোজ। মাঝবয়সী–চুল পাকতে শুরু করেছে। দেখেই বোঝা যায়, বেশ বড়লোক।
ঘরের তিন বন্ধু অবাক হয়ে চেয়ে রইল আগন্তুকের দিকে। এ আবার কে? বলা নেই কওয়া নেই, হট করে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে।
আগন্তুক শুধু ঘরেই ঢোকেননি–তাচ্ছিল্যের চোখে ঘরের দীনহীন অবস্থা দেখছেন। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে এতটা শ্রীহীন অবস্থা দেখতে হবে, তা তিনি আশা করেননি।
তিন বন্ধুর কাউকেই যে চেনেন না জ্বলোক, তা বোঝা গেল তার প্রশ্নটা শুনে। প্রথমে তিনি ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন বিছানায় শুয়ে থাকা রাসকোল্নিকভের দিকে। তারপর তাকালেন রাজুমিখিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ির দিকে। তারপর তাকালেন জোসিমভের দিকে।
প্রশ্নটা করলেন তাকেই–কারণ তিনজনের মধ্যে শুধু তার জামাকাপড়ই ভদ্রচিত।
বললেন–রোডিয়ন রোম্যানোভিচ রাসকোল্নিকভ কে বলুন তো?
জবাবটা দিল রাজুমিখিন–সোফায় শুয়ে আছেন। কি দরকার আপনার?
কথাটা যেন বিশ্বাস হল না ভদ্রলোকের। জামাকাপড়ের যা ছিরি রাসকোল্নিকভের, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে মনেই হয় না।
তাই দুই চোখে সংশয় নিয়ে তাকালেন জোসিমভের দিকে।
হাই তুলে বললো জোসিমভ–রাসকোল্নিকভ আপনার সামনেই—সোফায়,বলে পকেট থেকে সোনার ঘড়ি বের করে সময়টা দেখে নিল চট করে।
ভয় পেয়েছে রাসকোল্নিকভ। বেশ মরিয়াও হয়ে গেছে সে। তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়।
ভাঙা গলায় বললো–হ্যাঁ, আমিই রাসকোল্নিকভ!
ভাবখানা যেন-–হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই রাসকোল্নিকভ! কি করবেন আমার।
ভদ্রলোক প্রথমে ফুটিয়ে দেখলেন রাসকোল্নিকভের পা থেকে মাথা পর্যন্ত।
তারপর বললেন ধীরে গম্ভীর গলায় আমার নাম পিওর পেত্রোভিচ লুজিন। নামটা শুনেছেন নিশ্চয়।
নিমেষে ভয় কেটে গেল রাসকোল্নিকভের। যাক, পুলিশের লোক নয়–এ সেই মহাকিপটে পয়সার চামার লোকটা যে তার বোনকে বিয়ে করে কৃতার্থ করতে চায়।
জবাব দিতেও প্রবৃত্তি হল না রাসকোল্নিকভের।
লুজিন এতখানি উদাসীনতা আশা করেননি। আলতু ফালতু লোক নন তিনি। অথচ রাসকোল্নিকভ তো তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না!
বলে উঠলেন তারিকী গলায়–কী আশ্চর্য! আমার কথা কি আপনাকে বলা হয়নি?
একটি কথাও না বলে ফের শুয়ে পড়ল রাসকোল্নিকভ। লাল-লাল চোখে চেয়ে রইল লুজিনের দিকে। এই সেই শয়তান, যে কিনা তার বোনকে হুকুম করে এসেছে–গাঁটের কড়ি খরচ করে পিটার্সবার্গে এসে সে যেন তাকে বিয়ে করে।
হাওয়া থমথমে হয়ে উঠছে দেখে রাজুমিখিন একটা চেয়ার এগিয়ে দিল পুজিনের দিকে। একটু দ্ৰতা তো করা দরকার।
যেন খুবই কষ্ট হচ্ছে বসতে এমন একখানা চেয়ারে–এইভাবেই মুখখানা বেঁকিয়ে বসলেন লুজিন। তারপর যেন দয়া করতে যাচ্ছেন রাসকোল্নিকভকে, এমনি করে বললেন আমাদের এই প্রথম পরিচয় খুব শীগগিরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াবে–
ব্যস, বাকি কথাগুলো আর বলাই হল না। বাঘের মতো গর্জে উঠল রাসকোল্নিকভ–তা তো বটেই। তা তো বটেই। সব কাজই যে খুব শীগগিরই করতে চান আপনি।
না-মানে? থতমত খেয়ে গেছেন লুজিন।
দুনিয়া যেই বিয়ে করতে রাজি হল আপনাকে অমনি তাকে বলে বসলেন– ভিখারিনী বলেই তাকে বিয়ে করবেন ঠিক করেছেন।
মিথ্যে কথা! আপনার মা আপনাকে বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন।
খবরদার! ছিটকে উঠ বসল রাসকোল্নিকভ। চকচক করে জ্বলছে দুই চোখ–মা-র সম্বন্ধে আর একটা বাজে কথা বললেই ছুঁড়ে ফেলে দেব সিঁড়ির ওপর থেকে!
ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন লুজিন। জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামলে নিলেন নিজেকে। ঘনঘন নিশ্বাস নিতে নিতে বললেন অবরুদ্ধ গলায়– ভাবতেও পারিনি এতটা দুর্ব্যবহার করবেন। শরীর খারাপ থাকলে অবশ্য মাথায় রক্ত উঠে যায় একটুতেই–।
রক্ত! রক্ত ওঠেনি মাথায়। শরীর আমার খারাপ নয়।
তাহলে তো ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে গেল!
জাহান্নামে যান আপনি।
সাঁ করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন কিপটে লুজিন।
ধমকে ওঠে রাজুমিখিন কাজটা ভাল হল না, রাসকোল্নিকভ।
রাসকোল্নিকভের দু-চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে এল এবার–-বেরোও! তোমরাও বেরোও! একলা থাকতে দাও! কারো ধার ধারি না আমি!
রাজুমিখিনের কানে কানে বললে জোসিমভ–চলে এসো।
না। বেঁকে বসেছে রাজুমিখিন। অসুস্থ বন্ধুকে এ অবস্থায় ফেলে যাওয়া যায়?
জোসিমভ ওকে ঠেলে নিয়ে এল বাইরে।
গজগজ করে ওঠে রাজুমিখিন বাইরে এসেই–বিয়েটা বোধহয় আর হবে না।
তাতে রাসকোল্নিকভের বয়ে গেল। বললে জোসিমভ–শুধু ওই খুনের ব্যাপার ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে ইদানীং ওর আগ্রহ নেই।
ভাবনায় পড়ে রাজুমিখিন–সেদিন ও নাকি থানায় জ্ঞান হারিয়েছিল এই খুনের কথা কানে যেতেই।
তাই নাকি? সন্ধ্যের সময়ে শুনব পুরো ব্যাপারটা। ওর রোগটা অদ্ভুত– রুগী হিসেবেও ও অদ্ভুত।
ঘরের মধ্যে কিন্তু একা থাকতে পারল না রাসকোল্নিকভ। ভয়ানক অস্থির লাগছে নিজেকে। রাজুমিখিনের কিনে আনা জামা-কাপড়-জুতো পরেই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
পাগলের মত এ-রাস্তায় সে-রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুরেই হঠাৎ মনে হল কিছু খাওয়া দরকার। পঁচিশ ফুল তো পকেটে আছেই–আছে আরও কয়েকটা তামার কোপেক।
একটা হোটেলে ঢুকল। খানসামা এসে দাঁড়াতেই তাকে কয়েক কোপে বকশিস দিয়ে বললো–গত পাঁচ দিনের খবরের কাগজ এনে দাও। আর কিছু খাবার আর চা।
সবগুলো জিনিসই এল একসঙ্গে। মজা করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাগজগুলোতে তন্নতন্ন করে রাসকোল্নিকভ খুঁজতে লাগল একটাই খবর।
খুনের খবর! যদি কোথাও কিছু ছাপা হয়ে থাকে।
ঠিক এই সময়ে একটা লোক এসে ওরই টেবিলে বসল।
কাগজ পড়তে পড়তে আড়চোখে তাকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল রাসকোল্নিকভ।
লোকটা জামেটভ। পুলিশ অফিসের বড় সাহেব।
চোখোঁচাখি হয়ে যেতেই অবাক গলায় বললো জামেটভ–আরে! কালকেই তো দেখতে গিয়েছিলাম তোমাকে রাজুমিখিনের সঙ্গে। জ্বরে হুঁশ হারিয়ে যেভাবে পড়ে ছিলে–
কাগজ নামিয়ে রাখল রাসকোল্নিকভ। জামেটভের চোখে চোখ রেখে বললো–পাশের ঘরটায় কি করছিলে? ওখান থেকেই তো বেরিয়ে এলে আমাকে দেখে?
এক বন্ধুর সঙ্গে বসে গলা ডিজাচ্ছিলাম।
নাকি ঘুষ নিচ্ছিলে?
ঘুষ!
ওই হল গিয়ে! অইহেসে বলে রাসকোল্নিকভ–ঠাট্টা করছিলাম। ঘুষ নেয়া তো খারাপ নয়–তুমি নিচ্ছ, আর আমি ঠাট্টা করছি। যেমন নিকোলে করছিল দিত্রির সঙ্গে। ঠাট্টা করতে করতেই নিকোলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল জামেটভ।
আবার হা-হা করে হেসে ওঠে রাসকোল্নিকভ–বুঝলে না? বুড়ির খুনের ব্যাপারটা বলছি হে!
তুমি জানলে কিভাবে?
তোমার চাইতেও বেশি জানি বলে। এখনও প্রলাপ বকে চলেছ! রাস্তায় বেরোনো ঠিক হয়নি তোমার।
তাই নাকি? তাই নাকি? প্রলাপ বকছি মনে হচ্ছে?
তা হচ্ছে বইকি! মন দিয়ে এত কাগজ পড়ছ কেন? কাগজে তো শুধু আগুন লাগার খবর। চারদিকে আগুন লেগেই চলেছে।
অদ্ভুতভাবে চোখ নাচিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ–আগুন নয়, আগুন নয়–পড়ছি অন্য খবর! চাঞ্চল্যকর খবর! জানতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?
একটুও না! এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। তবে তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, বিকার এখনও যায়নি।
বিকার! বিকার কেন থাকবে? হাবভাব একটু খাপছাড়া হতে পারে—
খুবই খাপছাড়া।
কেন খাপছাড়া, তা যদি জানতে। জানো এই কাগজগুলো কেন পড়ছি?
কেন বলো তো?
বুড়িটার খুনের খবর খুঁজছি। ষড়যন্ত্রকারীর মত ফিসফিস করে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ। একদৃষ্টে এখন ও চেয়ে রয়েছে জামেটভের চোখে চোখে।
হতভম্ব হয়ে যায় জামেটভ–তা খোঁজো না।
কথাটা যেন শুনতেই পেল না রাসকোল্নিকভ। ফিসফিস করে বলে গেল একই কথা–বুড়িটা! সেই বুড়িটা! যার কথা শুনতে শুনতে ধা করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম থানায়। বুঝেছ কি বলছি।
জামেটভ এবার জয় পেয়েছে। রাসকোল্নিকভের কথা, তার চাহনি মোটেই স্বাভাবিক নয়।
তাই আমতা আমতা করে বলে–বুঝলাম না।
ঠিক এই সময়ে রাসকোল্নিকভের মনে পড়ে যায় খুনের দিনটার কথা। দরজা বন্ধ। মেঝেতে বুড়ি মরে পড়ে আছে। হাতে কুড়োল নিয়ে দরজার এদিকে দাঁড়িয়ে রাসকোল্নিকভ। ওদিকে কক্ আর পেচত্রিয়াকত। হঠাৎ বড় ইচ্ছে হয়েছিল গলা ছেড়ে হেসে উঠবার। ইচ্ছে হয়েছিল চিৎসার করে বলে–এই যে আমি! বুড়িটা তত খুন হয়ে গেছে–সাড়া দেবে কি করে। আমি সাড়া দিচ্ছি…আমি…আমি…খুনী আমি…হা হা হা!
ভাবতে ভাবতেই হা-হা করে হেসে ওঠে রাসকোল্নিকভ। দমকে দমকে হাসি বেরিয়ে আসে বুকের মধ্যে থেকে। কিছুতেই হাসি আটকাতে পারে না।
হেসে যায় উন্মাদের মত।
আঁতকে উঠে চেয়ার সরিয়ে বসে জামেটভ-পাগল হলে নাকি?
পাগল? হয়তো। অথবা হয়তো খুনী! খুনই যদি করে থাকি, প্রমাণ করতে পারবে? খুন করলে তো বড়লোকি চালেই থাকতাম–এরকম গরিবি হালে থাকব কেন? হা হা হা! সন্দেহ করতে পারবে না।
হাঁ করে চেয়েই আহে জামেটভত।
কুর হাসি হাসে রাসকোল্নিকভ–নজরে রেখেই আমাকে, তাই না? দেহ পকেট গরম আছে কিনা।
এবার কিন্তু হেসে ফেলে জামেটভ-–তোমার মত শিক্ষিত মানুষ খুন করে পয়সা ওড়াতে হোটেলে ঢুকবে–এ কী ভাবা যায়? কি যে বলছ!
তবে কি ভাবা যায়। আবার ব্যঙ্গ করে ওঠে রাসকোল্নিকভ–আমার মত শিক্ষিত লোক খুন করবার পর কি কি করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
ঢোক গেলে জামেটভ–খুনীদের মনের খবর আমি জানব কি করে। তবে হ্যাঁ, করতে পারে অনেক কিছুই।
ঘোড়ার ডিম পারে!
থতমত খেয়ে যায় জামেটভ। একটু একটু করে উগ্র হয়ে উঠছে রাসকোল্নিকভ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে যাচ্ছে-আমি যদি খুনী হতাম, কি করতাম জানো? বুড়ির টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। যেতাম একটা নির্জন জায়গায় যেখানে তারের বেড়া টপকালেই দেখা যাবে একটা প্রকাও পাথর। বহু বছর পড়ে আছে একইভাবে–পড়েও থাকবে সেইভাবে আরও অনেক বহর। গয়না আর টাকা লুকিয়ে রাখতাম সেই পাথরের তলায়। তোমরা পুলিশরা আমার পেছন পেছন ঘুরে মরে নাজেহাল হতে। তারপর হাল ছেড়ে দিলে জিনিসগুলো বের করে আনতাম পাথরের তলা থেকে থাকতাম রাজার হালে।
অবাক হয়ে বলে জামেটভ–কি যে বলো! পুলিশ তোমার পেছনে লেগে থাকবে কেন? তোমাকে সন্দেহই বা করতে যাবে কেন?
করেছে! করেছে! একশবার করেছে! নিমেষে মাথার রক্ত চড়ে যায় রাসকোল্ নিকভের–নইলে কেন আমাকে জেরা করেছিল ইলিয়া পেত্রাভিচ নামে ওই বাজে লোকটা? তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে হাঁকডাক করে খানসামাকে ডেকে বিল চেয়ে আনে রাসকোল্নিকভ। বিলের টাকা মিটিয়ে দিয়েই পকেটের পঁচিশটা রুব্ল জামেটভকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভীষণ চিৎকার করে বলে–এতগুলো টাকা পকেটে এল কোত্থেকে, সেই খোঁজটা করো আগে। তাহলেই দেখবে খুনের সমাধান হয়ে যাবে। দুদিন আগে তো পকেটে কানাকড়িও ছিল না–তাই না?
বলতে বলতে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল রাসকোল্নিকভ। টলছে দস্তুর মত। জামেটভকে বিধিয়ে বিধিয়ে দু-কথা শোনাতে পেরে মনটাও খুব খুশি। সেই সঙ্গে ভীষণ অবসাদে শরীর যেন ভেঙে পড়ছে।
গুম হয়ে বসে রইল জামেটভড। কিছুক্ষণ পরে বলে উঠল নিজের মনে– ইলিয়া পেত্রেভিচের মত বোকা দুনিয়ায় আর নেই!
হোটেল থেকে বেরিয়েই কিন্তু রাজমিখিনের মুখোমুখি হয়েছে রাসকোল্নিকভ। ওকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে রামিখিন–আকেলের বলিহারি যাই! কাল পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে–আজকে ফিটফাট হয়ে হোটেলে খেতে এলে? খুঁজতে খুঁজতে প্রাণ যায় আমার! পাগল হলে নাকি?
প্রচণ্ড রেগে গেলেও বাইরে খুব শান্ত রইল রাসকোল্নিকভ। বললো ধরা গলায়–রাজুমিখিন, আমাকে একলা থাকতে দাও। তোমাকে আর অভিভাবক হয়ে থাকতে হবে না। দেখলেই তো, জোসিমভ আমাকে একলা রেখে চলে গেল। ডাক্তার বলেই বুঝেছে, যে মানুষ একলা থাকতে চায়, তাকে শাসন করতে গেলে, সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কথাটা শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় রাজুমিখিন। জুৎসই জবাবটা মুখে আনবার আগেই দেখলো, দ্রুত পা চালিয়ে সরে পড়ছে রাসকোল্নিকভ।
পেছন থেকে বললো চিৎকার করে–-দাওয়াতের কথাটা মনে রেখো। পশিকডের বাড়ি, তেতলা, ৪৭ নম্বর ফ্ল্যাট। অবশ্যই আসবে।
না, আসব না। যেতে যেতেই বলে উঠল রাসকোল্নিকভ।
আসবে! আসতেই হবে! চেঁচিয়ে বলে গেল রাজুমিখিন, কিন্তু বোধহয় শুনতে পেল না রাসকোল্নিকভ। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে সে তখন অনেক দূরে চলে গেছে।
ভাবনায় পড়ে রাজুমিখিন। এভাবে ওকে ছেড়ে দেয়াটা ঠিক হল না। জোসিমভ এমন কথাও বলেছে–রাজকোনিকভের হয়তো মাথা খারাপ হয়েছে।
মাথা খারাপই যদি হবে তো অমন গুছিয়ে ধীরস্থিরভাবে কথাগুলো কিভাবে বলে গেল রাসকোল্নিকভ?
তাতে কী? নিজের মনেই বলে রাজুমিখিন–অনেক বদ্ধ পাগলই কথা বলে দিব্যি বুদ্ধিমানের মত!
ভাবতে ভাবতে হোটেলে ঢুকল রাজুমিখিন। এইভাবেই দেখা হওয়ার কথা জামেটভডের সঙ্গে। দুজনে মিলে যাবে একটা দাওয়াতে।
.
আপন মনে হেঁটেই যাচ্ছে রাসকোল্নিকভ। আচমকা হৈ-হৈ চেঁচামেচি শুনে চোখ তুলে দেখল, খালের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে একজন স্ত্রীলোক। একজন পুলিশ পানিতে নেমে গিয়ে আধডোবা শরীরটাকে টেনে নিয়ে তুলেছে রাস্তায়। ভিড়ের মধ্যে থেকে মড়াকান্না জুড়েছে আর একটি মেয়ে–এ যে অফ্রোসিনিয়া! ক্ষিধের জ্বালায় মরতে যাচ্ছিল।
মনটা খিঁচড়ে যায় রাসকোল্নিকভের! মরতেই যদি প্রাণ চায়, তাহলে খালের নোংরা পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার কি দরকার? কুড়োলের এক কোপেই তো মাথা দু-ফাঁক হয়ে যায়। গলগল করে কি সুন্দর তাজা রক্ত বেরিয়ে আসে!
দূর! দূর! বড় উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটছে এই দুনিয়াটায়। গলদ রয়েছে সমাজের সমস্ত ব্যবস্থায়!
হাঁটতে হাঁটতে চলে এল খালের পাশ থেকে অনেক দূরে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল একটা বাড়ির সামনে।
এটা সেই বাড়ি–মাত্র পাঁচ দিন আগে যে-বাড়ির পাঁচতলায় কুড়োল চালিয়ে সমাজটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করেছিল সে নিজে।
আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে অজান্তে চলেই এসেছে যখন, দেখে যাওয়া যাক রক্তাক্ত ফ্ল্যাটের চেহারাখানা। প্রচণ্ড ঝোঁক চেপে বসেছে মাথায়–কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না নিজেকে।
এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। ধাপে ধাপে উঠতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে।
তখন সন্ধ্যে হয়েছে। এতক্ষণ মিস্ত্রীরা কাজ করছিল সেই ফ্ল্যাটে–এবার তারা বাড়ি যাবে।
এমন সময়ে রাসকোল্নিকভ ঢুকল সেখানে।
অবাক হল মিস্ত্রীরা। প্রথমে ভেবেছিল পুলিশের লোক এসেছে।
কিন্তু পুলিশের লোক এরকম অদ্ভুতভাবে চারদিক দেখছে কেন? বিড়বিড় করে বকছে কেন? সত্যিই কি পুলিশ? না, অন্য কেউ?
সত্যিই বড় অদ্ভুত কাণ্ড করে যাচ্ছে রাসকোল্নিকভ। ঘরে ঢুকেই ভীষণ বিরক্তিতে মুখ-চোখ কুঁচকে ফেলেছে।
ঘরটা তার চেনা। কিন্তু মেরামতির কাজ করে মিস্ত্রীরা অচেনা করে তুলেছে ঘরটাকে। দেওয়ালে ঝুলত পুরনো হলদে কাগজ–সেসব খুলে ফেলে লাগানো হয়েছে নতুন কাগজ।
অন্যায়। অন্যায়! ঘোর অন্যায়! খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে ঢুকল ভেতরের ঘরে।
একটু খুশি হয় মনটা। কেন না, এ ঘরে এখনও হাত দেয়নি মিস্ত্রীরা। শুধু আগেকার আসবাপত্রগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। দেরাজ নেই, সিন্দুক নেই…
তবে…ঘরের কোণে কে যেন বসে?
বুড়িটা! নিশ্চয় সে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই বটে। সন্ধ্যের আঁধার ঘরের কোণে কোণে জমে গেলেও বুড়িকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বুড়ির দুই চোখ। চেয়ে আছে রাসকোল্নিকভের দিকে। চোখ মিটমিট করছে। চোখের এই ভাষা খুব স্পষ্ট!
বুড়ি যেন বলতে চাইছে–ভালই করেছ। বন্ধকী কারবার থেকে রেহাই দিয়ে আমার ভাবনাচিন্তা যেমন শেষ করে দিলে ঠিক তেমনি এই সমাজটার কত মঙ্গল করলে বলো তো? তবে হ্যাঁ, টাকা আর গয়না লুকিয়ে রাখলে কেন? তোমার মত ভালো লোকের হাত দিয়ে ওগুলো খরচ হয়ে গেলে সমাজের চেহারা ফিরে যাবে!
হঠাৎ কর্কশ গলায় ধমকে ওঠে একজন মিস্ত্রী–এখানে কি চাই?
বলে কি মিস্ত্রীটা! বুড়ি আলিওনার বন্ধুকে এইভাবে কেউ কথা বলে?
রেগেমেগেই জবাব দেয় রাসকোল্নিকভ–ভাড়া নেব এই ফ্ল্যাটটা।
ভাড়া নেবে তো দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে এসো।
কথাটা শুনতেই পেল না রাসকোল্নিকভ। সে তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টুং-টাং করে ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে।
বেশ মিষ্টি আওয়াজ! ঠিক আগের মত। ঘণ্টার আওয়াজ নিশ্চয় এতক্ষণে শুনতে পেয়েছে বুড়ি।
রাসকোল্নিকভের মনে হল–দরজার ফাঁক দিয়ে মিটমিট করে দেখছে বুড়ি।
পকেটে হাত দেয় ও বন্ধকী জিনিসটা বের করার জন্যে।
সত্যি সত্যিই এবার ঝটাৎ করে খুলে গেল দরজার পাল্লা। বেগে বেরিয়ে এল একজন ভণ্ডামার্কা বেঁটে মিস্ত্রী। ধমকে উঠল কড়া গলায়–ঘন্টা বাজাচ্ছ কেন? কে তুমি?
গম্ভীরভাবে বললে রাসকোল্নিকভড থানায় গিয়ে জিজ্ঞেস করো কে আমি। পেয়ে যাবে জবাবটা।
থানা? থানার লোক নাকি? ঘাবড়ে যায় বেঁটে মিস্ত্রী।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফস করে প্রশ্ন করে রাসকোল্নিকভ–রক্ত কোথায় গেল। সব ধুয়ে ফেললে?
রক্ত! মিস্ত্রীদের চোখে এবার সন্দেহ ঘনিয়ে এসেছে। তাকাচ্ছে এ ওর দিকে। দেখে ইশ হয় রাসকোল্নিকভের। উজবুকের মত এত কথা বলা তার ঠিক হয়নি।
এখানে আর থাকাও উচিত নয়।
পেছন ফিরেই তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
মিস্ত্রীরাও নেমে এল পেছন পেছন।
ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে গেল রাসকোল্নিকভ।
মিস্ত্রীরা কিন্তু গেল দারোয়ানের কাছে।
বেঁটে মিস্ত্রীটা বললো–থানায় নিয়ে যাও ওকে এক্ষুণি!
ধমকে ওঠে দারোয়ান–পুলিশের কাজ পুলিশে করুক। আমার বয়ে গেছে থানায় যেতে–ভাগো তোমরা। মুখ চুন করে সরে পড়ে মিস্ত্রীরা।
রাসকোল্নিকভ ততক্ষণে অনেক দূরে। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে থমকে দাঁড়িয়েছে। অনেক লোক জমে গেছে রাস্তায়।
ঘোড়ার গাড়ি চাপা দিয়েছে একটা লোককে! উঁকি মেরে দেখেই চমকে ওঠে রাসকোল্নিকভ। রক্তমাখা ওই মানুষটাকে সে চেনে।
মার্মেলাডভ্। মাতাল মার্মেলাডভ্। একেই একদিন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল। নিজের আংটি বন্ধক দেওয়া টাকা পয়সা থেকে পঞ্চাশ কোপেক রেখে এসেছিল বাচ্চাগুলোর খাবার কেনার জন্যে।
কেউ কিন্তু চিনতে পারছে না মার্মেলাডভ্কে। তাই সবাই বলছে–দাও, দাও, হাসপাতালেই পাঠিয়ে দাও।
মুখ বাড়িয়ে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ–না, না, না। ওর বাড়ি কাছেই, আমি চিনি। চলো আমার সঙ্গে।
সবাই মিলে যখন মার্মেলাডভ্কে বয়ে নিয়ে এল ওর বাড়ির সামনে, তখন কিন্তু ঘরের কোণে উলঙ্গ হয়ে বসে আছে বাচ্চা তিনটে। রোজ রাতে এইভাবে জামাকাপড় খুলে দেয় ওরা। ওদের মা কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত বের করতে করতে সেগুলো কেটে দেয়। শুকিয়ে গেলে ওরা পরে–আবার খুলে দেয় রাতে।
ঠিক এই সময়ে ওদের বাবার রক্তাক্ত দেহটা এসে পৌঁছলো বাড়ির সামনে। ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল ঘরের মধ্যে।
বিছানাতে শুইয়ে দাও, বলে উঠল রাসকোল্নিকভ।
ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল না কিন্তু ক্যাটেরিনা-মার্মেলাডভের বউ। অভাব আর দুঃখ তাকে পাথর করে দিয়েছে। কাঁদতেও ভুলে গেছে।
ডাক্তার এল। ধর্মযাজক এল। দুজনেই বলে দিলো–কোনো আশা নেই।
মার্মেলাডভ্-এর তখন জ্ঞান ফিরেছে। বলছে অস্ফুট গলায়–সোনিয়া কোথায়?
.
সোনিয়ার কোলে নিজের হাতখানি রেখে মারা গেল মার্মেলাডভ্।
ফাঁকা হয়ে গেল ঘর।
পকেট থেকে পঁচিশটা রুব্ল বের করে ক্যাটেরিনার হাতে তুলে দিল রাসকোল্নিকভ।
বললো–আপনার স্বামীর শেষ কাজ করবেন এই টাকা দিয়ে। বলেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
দুই চোখে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে সোনিয়া চেয়ে রইল তার দিকে। চেয়ে রইল আরও একজন। তার দুই চোখে ঠিকরে পড়ছে। নাম তার লুজিন। যাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে রাসকোল্নিকভ। এই বাড়িতেই সে উঠেছে–আড়াল থেকে সে দেখল সব কিছু।
রাস্তায় বেরিয়েই রাসকোল্নিকভ কিন্তু মুখোমুখি হল পুলিশের বড় কর্তার সঙ্গে। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই খোঁজ নিতে এসেছেন নিকোডিম ফোমিচ।
চমকে উঠলেন তিনি রাসকোল্নিকভকে দেখে–কি ব্যাপার! এখানে আপনি?
হেসে বললো রাসকোল্নিকভ–এই মাত্র যে লোকটা মারা গেলে, দয়া করে তার বউটাকে আর জেরা করতে যাবেন না বেচারার ক্ষয়রোগ আছে। কাশলেই রক্তবমি করে।
…কিন্তু আপনার সারা গায়ে যে রক্ত! বলে উঠলেন নিকোডিম। মার্মেলাডভ্-এর মাথার রক্ত তো লেগে রয়েছে রাসকোল্নিকভের গায়ে।
জপে না করে রহস্যময় হাসি হেসে রাসকোল্নিকভ শুধু বললো–ঠিক বলেছেন। রক্ত আমার সারা গায়ে!
.
আট
রাজুমিখিনকে খুব জোর গলায় বলেছিল রাসকোল্নিকভ-দাওয়াত রাখতে যাবে না? কিন্তু তারপর অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ওর সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলা দরকার। তাই দাওয়াত রাখতেই চলল রাসকোল্নিকভ।
পথে পড়ে খালের ওপর সেই সেতু। একটু আগে এখানে থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে গিয়েছিল এফ্রোসিনিয়া, ক্ষিধের জ্বালায়।
বুড়ি অ্যালিওনাকে খুন করেছে রাসকোল্নিকভ ঝোঁকের মাথায়। ভালই করেছে। তাতে পাঁচজনের উপকার হবে।
বুড়ি মরেছে–যাক না বেহেস্তে। রাসকোল্নিকভ কিন্তু থাকবে এই দুনিয়ায়–বেঁচে থাকবে মানুষের মত।
এসব কথা মাথার মধ্যে নিয়ে দাওয়াত রাখতে গেল রাসকোল্নিকভ। কিন্তু ভাল লাগল না খানাপিনা আর হাসিহল্লা। বেরিয়ে এল বাইরে। বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক।
সঙ্গে রাজুমিখিন এল। তার এক কথা–তোমাকে একলা থাকতে দেব না।
নাছোড়বান্দা বন্ধুকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ির দিকে চলল রাসকোল্নিকভ। যেতে যেতে উল্টোপাল্টা অনেক কথাই বলে গেল অনর্গল। শুনে সত্যিই ভয় হয় রাজমিখিনের।
জোসিমভ ডাক্তার ঠিক এই আশঙ্কাই করেছে। খুব সম্ভব মাথা খারাপ হয়েছে রাসকোল্নিকভের। বকর বকর করতে করতে বাড়ির সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল রাসকোল্নিকভ। মুখ তার বিবর্ণ।
চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে পাঁচতলায় নিজের চিলেকোঠার খুপরি ঘরটার দিকে।
আলো জ্বলছে সে ঘরে!
পুলিশ এসেছে নিশ্চয়। নইলে এমন অসময়ে আলো জ্বালিয়ে কে বসে থাকবে টঙের ওই ঘরে?
ফ্যাকাশে মুখে বললো রাভূমিনিকে–বিদায়!
বিদায়! কেন? রাজুমিখিন ঘাবড়ে গেছে বন্ধুর ভাবভঙ্গী দেখে।
আঙুল তুলে পাঁচতলার ঘরের আলো দেখিয়ে ম্লান হাসন রাসকোল্নিকভ ও ঘরে পা দেবার পর বিদায় নেবার সুযোগ আর পাব না। তাই এখনই বিদায় নিয়ে রাখলাম।
দুজনে উঠে গেল পাঁচতলায়। ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতরে কারা যেন কথা যাবে।
এক ধাক্কায় দরজার পাল্লা ফাঁক করে দিলো রাসকোল্নিকভ। সে এখন মরিয়া। কিন্তু…
স্তম্ভিত হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
ঘরে দাঁড়িয়ে দুজন মহিলা। রাসকোল্নিকভের মা আর বোন।
আচমকা দড়াম করে দরজা খুলে যাওয়ায় কয়েক সেকেণ্ড ভ্যাবাচাকা খেলে দুজনেই। তারপরেই লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল রাসকোল্নিকভকে।
রাসকোল্নিকভ কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল কাঠের পুতুলের মত। হাত তুলে মা আর বোনকে জড়িয়ে ধরবার প্রবৃত্তি তার নেই। হাতে বুড়ির রক্ত লেগেছিল। হয়তো রক্তের গন্ধ এখনও রয়ে গেছে। মা আর বোন যদি সেই গন্ধ শুঁকে আঁতকে ওঠে।
রাসকোল্নিকভকে ওরা কিন্তু আদরে আদরে অস্থির করে তুলছে। সইতে পারল না ও। দু-পা এগিয়ে ঢুকল ঘরের মধ্যে…
তারপরেই দড়াম করে সটান আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর।
ভয়ে ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ওর মা আর বোন। ন্যাসটাসিয়া আগেই সব বলেছে। অজ্ঞান হয়ে বকেছে রাসকোল্নিকভ দিনের পর দিন।
চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে তার প্রমাণ। জ্ঞান নেই রাসকোল্নিকভের।
মেয়েদের চেঁচামেচিতে কান না দিয়ে সবেগে ঘরে ঢুকেছে রাজুমিখিন। দু হাতে বন্ধুকে তুলে ধরে শুইয়ে দিলো বিছানায়।
কিছুক্ষণ সেবা করতেই ডান ফিরে এল রাসকোল্নিকভের। তখন নিজেদের কথা বললেন পলচেরিয়া, মানে, রাসকোল্নিকভের মা।
বললেন–আগে থেকে ছেলেকে খবর দিইনি–ভেবেছিলাম, লুজিন নিজেই স্টেশনে হাজির থাকবেন। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে দেখি, পাঠিয়ে দিয়েছেন একজন চাকরকে নিজে আসেননি। তার সঙ্গে উঠলাম বাকালায়েভের বাড়িতে।
এই পর্যন্ত শুনেই রাগে চেঁচিয়ে ওঠে রাজুমিখিন–বাকালায়েভের বাড়িতে! ওটা তো একটা আড়াবাড়ি। দ্রঘরের মেয়েরা তো ওখানে থাকতে পারে না!
তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন পলচেরিয়া–আরে, দু-চার দিনের বেশি তো থাকছি না ওখানে!
আসলে তিনি চান না, বিয়ের আগেই ভাবী জামাই-এর দুর্নাম হোক।
রাসকোল্নিকভকে কিন্তু আর থামিয়ে রাখা গেল না। বোমার মত ফেটে পড়ল সে-–এ বিয়ে হবে না! বলেই দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল কাঠ
কি বলছিস, রোডিয়া? মা চেঁচিয়ে উঠলেন।
দুনিয়ার মুখে কথা নেই–শুধু গভীর বিষয় দুই চোখে।
পাশ ফিরে ছোট বোনের অবাক চাহনি দেখে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ– দুনিয়া, আমার মঙ্গলের জন্যেই তুই ওই মহাকিপটেটাকে বিয়ে করবি ঠিক করছিস, তাই না? কিন্তু তা হবে না। ওর মত ইতর লোকের ঠাঁই নেই আমাদের বংশে।
এবার বিরক্ত হয় দুনিয়া–ভাইয়া, আমার বিয়ে বন্ধ করার তুমি কে?
রাজুমিখিন দেখলো, এখুনি লেগে যাবে ঝগড়া। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে পলকেরিয়া আর দুনিয়াকে–অসুস্থ মানুষটার সঙ্গে এখন কোন কথা নয়। বাসায় যান। কথা হবে ঠাণ্ডা মাথায়–পরে।
পলচেরিয়া বললেন–দুনিয়া যাক বাসায়। আমি থাকি রোডিয়ার কাছে।
গলার শিরা ফুলির চেঁচিয়ে ওঠে রাসকোল্নিকভ-কী জ্বালা! একলা থাকতেও পারব না?
পলচেরিয়ার কানে কানে বলে রাজুমিখিন–আপনি যান। ও-বাড়িতে দুনিয়াকে একলা রাখবেন না। আমি আছি আপনার ছেলের কাছে।
বলে প্রায় ঠেলেঠুলে মা আর মেয়েকে নিয়ে গেল বাইরে। সেখান থেকে গেল বাকালায়েভের বাড়িতে। আসবার সময়ে বলে এল পইপই করে রাতে একদম দরজা খুলবেন না। ঘন্টাখানেকের মধ্যে জানিয়ে যাব কিরকম আছে রোডিয়া।
চলে গেল রাজুমিখিন।
চটপটে ছেলে। খুব ভালো ছেলে। দুনিয়াকে বললেন পলচেরিয়া–ভাগ্যিস ওকে পেলাম; নইলে কি ফ্যাসাদেই না পড়তাম। লুজিনের তো টিকি দেখা যাচ্ছে না।
চুপ করে থাকে দুনিয়া।
সারারাত ছুটোছুটি করেই কাটালো রাজুমিখিন। পলচেরিয়ার কাছে খবর দিয়ে গেল দু-বার।
দ্বিতীয়বার এল ডাক্তার জোসিমভের সঙ্গে, বলে গেল, ভালই আছে রোডিয়া।
মনটা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয় পলচেরিয়ার।
খুশি খুশি মনে বললেন মেয়েকে বড় চৌকস ছেলে রে! সত্যিই ভালবাসে রোডিয়াকে।
মানুষ হিসেবে চমৎকার! এতক্ষণে একটাই মন্তব্য করে দুনিয়া।
.
পরের দিন চাঙ্গা হয়ে উঠল রাসকোল্নিকভ। ঠিক হল সন্ধ্যের দিকে রাজুমিখিনকে নিয়ে আড্ডা মারতে যাবে মা-এর কাছে।
কিন্তু তার আগে রাজুমিখিল গেল পর্ফাইরি পেত্রোভিচের কাছে। গোয়েন্দা বিভাগের এই বড়কাটি রাজুমিখিনের আত্মীয়। তাই ওকে সঙ্গে নিয়েই গেল।
পর্ফাইরি তখন তন্ময় হয়ে শুনছেন জামেটভের কথা।
এই সময়ে দুই বন্ধু ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে মুখখানা শক্ত হয়ে গেল জামেটভের।
হাসছিল রাসকোল্নিকভ। হো হো করে হাসছিল। রঙ্গ রসিকতা হচ্ছিল বন্ধুর সঙ্গে। হাসি মিলিয়ে গেল জামেটভের মুখ দেখে। রাসকোল্নিকভকে দেখেই কঠিন হয়ে উঠেছে জামেটভ। হোটেলে খবরের কাগজ পড়বার পর অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিল রাসকোল্নিকভ। সেইসব কথাই কি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লাগানো হচ্ছিল বড় সাহেবের কাছে।
রাসকোল্নিকভের চোখে চোখেও সে তাকাচ্ছে না।
কথা বলে উঠলেন পর্ফাইরি–আসুন, আসুন! আপনার কথাই হচ্ছিল জামেটভের সঙ্গে।
আমার কথা! থমকে যায় রাসকোল্নিকভ।
বেশ কিছুদিন আগে আপনার লেখা একটা প্রবন্ধ পড়েছি উইকলি রিভিউ কাগজে।
উইকলি রিভিউ কাগজে তো কোনো প্রবন্ধ পাঠাইনি। পাঠিয়েছিলাম পিরিয়ডিক্যাল রিভিউতে। সে কাগজ বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্ধ হয়নি–উইকলি রিভিউ কাগজের সঙ্গে মিশে গেছে। তাই আপনার প্রবন্ধটা পিরিয়ডিক্যাল রিভিউতে ছাপা হয়নি–হয়েছে উইকলি রিভিউতে।
অনেক খবর রাখেন দেখছি।
তা রাখি বই কি। ভাল প্রবন্ধ চোখে পড়লেই পড়ি। আপনার লেখাটা চমৎকার! অপরাধ বিজ্ঞান সম্পর্কে।
সবটা পড়েছেন? একটু কৌতূহলী হয় রাসকোল্নিকভ।
গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। হাসেন পর্ফাইরি–আপনার মৌলিক ভাবনাকে তারিফ জানাই। মানুষ জাতটাকে আপনি দূ-ভাগ করেছেন–সাধারণ আর অসাধারণ।
জানলেন কি করে বন্ধটা আমার লেখা? সম্পাদককে বলেছিলাম যেন আমার নাম ছাপা না হয়।
সম্পাদক আপনার নাম ছাপেননি। কিন্তু এত ভাল প্রবন্ধ কার লেখা জানতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার। তাই সম্পাদককে জিজ্ঞেস করে নামটা জেনে নিয়েছি। অপরাধ করার আগে আর পরে অপরাধীর মনের অবস্থাটা কি-রকম দাঁড়ায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন চমৎকার।
তা করেছিলাম বটে, সায় দেয় রাসকোল্নিকভ।
প্রবন্ধটায় আপনার দুটো নিজস্ব ভাবনা মনে রাখবার মত।
কি-কি বলুন তো?
অপরাধ করার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, লিখেছিলাম।
আপনার নিজস্ব আর একটা ভাবনা নিয়ে খুলে লেখেননি–শুধু ছুঁয়ে গেছেন। সেটা এই–এমন কিছু লোক আছে, আইন যাদের জন্যে নয়–যারা ইচ্ছে করলে যে কোনো অপরাধ করতে পারে। অপরাধ করাটা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
হেসে ফেলে রাসকোল্নিকভ–ঠিক ওকথা লিখিনি। আমি যা বলতে চেয়েছি, তা এই– মনীষীরা পৃথিবীর উপকার করতে গিয়ে এমন কিছু কাজ করে ফেলতে পারেন। আইনের চোখে যা অপরাধ ছাড়া কিছুই নয়। যেমন ধরুন, নিউটন যদি দেখতেন, দু-একজনের মত না ঘটালে বড় বড় আবিষ্কারগুলো করা যাচ্ছে না–তাহলে আইনের ভয়ে কি চুপ করে বসে থাকতেন? তিনি তো পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যেই আবিষ্কারের পর আবিষ্কার করে গেছেন।
কথা ঘুরিয়ে নিলেন পর্ফাইরি–বলুন কেন এসেছেন?
আমার কিছু জিনিস বন্ধক আছে বুড়ি অ্যালিওনার কাছে। কিভাবে ফেরত পাওয়া যাবে?
কালকে আসুন। একটা দরখাস্ত করে দেবেন। আপনার আসবার পথ চেয়েই তো বসেছিলাম। অমায়িকভাবে বলে গেলেন পর্ফাইরি।
চমকে ওঠে রাসকোল্নিকভ–কেন?
সবাই তো আসছেন বন্ধকী জিনিস ফিরিয়ে নিতে। যার জিনিস, তার নাম লিখে জিনিসটাকে কাগজে মুড়ে রেখে দিত বুড়ি। কয়েকটা জিনিসের মোড়কে পাওয়া গেছে আপনার নাম। তাই জানতাম, আপনি আসবেনই। আসতে পারেননি অবশ্য অসুখের জন্যে…খুবই সন্দেহজনক অসুখ…কেননা, আপনিই তো লিখেছেন প্রবন্ধে–অপরাধ করার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে আপরাধী! হা হা হা!
রেগে যায় রাজুমিখিন–অদ্ভুত কথা বলছেন! অপরাধ না করলে কারো অসুখ হতে পারে না।
আর এক দফা হেসে নিয়ে বললেন পর্ফাইরি–নিশ্চয় পারে! যাকগে, এ নিয়ে কথা হবে কালকে। ভাল কথা রাজুমিখিন, রঙ-মিস্ত্রী নিকোলের ব্যাপারটা মনে আছে? তুমি তো বলে খালাস নিকোলে নির্দোষ। কিন্তু প্রমাণ কোথায়? এই যে আপনি ঘড়ি বন্ধক দিয়েছিলেন বুড়ির কাছে–কবে কখন গেছিলেন বলুন তো?
খুনের দু-দিন আগে–সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। বললো রাসকোল্নিকভ।
তখন তো রঙ-মিস্ত্রীদের কাজ চলছিল দোতলার ফ্ল্যাটে। আপনিও দেখেছিলেন নিশ্চয়?
রঙ-মিস্ত্রী? দেখিনি তো! থেমে থেমে বলে যায় রাসকোল্নিকভ।
হুঁশিয়ার সে। পর্ফাইরি তাকে কথার জালে জড়াতে চাইছেন, ফাঁদে ফেলতে চাইছেন–এটা সে বুঝেছে।
তাই, ধীরস্থিরভাবে গুছিয়ে জবাব দিল এইভাবে–রঙ-মিস্ত্রী দেখিনি। কোনো ফ্ল্যাটে রঙ-মিস্ত্রী ছিল কিনা তাও খেয়াল করিনি। তবে হ্যাঁ, চারতলার একটা ফ্ল্যাট থেকে কুলিরা জিনিসপত্র বের করার সময়ে আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিল। কিন্তু রঙ-মিস্ত্রী তো দেখিনি!
চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু রাজুমিখিন–কি যে বলেন! রঙ-মিস্ত্রীরা কাজে লেগেছিল খুনের দিন। রাসকোল্নিকভ ঘড়ি বন্ধক দিতে বুড়ির কাছে গেছিল তার দু-দিন আগে-রঙ-মিস্ত্রীদের তখন দেখবে কি করে?
ঠাম ঠাম করে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে উঠলেন পর্ফাইরি–সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার নিজেরই। ছি ছি ছি! আপনি কিছু মনে করবেন না ভাই_ বললেন রাসকোল্নিকভের দিকে তাকিয়ে। এই খুনটা আমার সব গোলমাল করে দিচ্ছে। ঘটনার দিন রঙ-মিস্ত্রী নিকোলেকে ফ্ল্যাটে দেখতে পাওয়া গেছে–এমন কথা সাক্ষী হিসেবে কেউ যদি বলত–সহজ হয়ে যেত আমাদের কাজ।
খুনের ব্যাপারে এইভাবে মাথা গুলিয়ে ফেললে অন্যের পক্ষে তা ভয়ানক পরিণতি ঘটাতে পারে, কড়া গলায় কথাগুলো বলে গটগট করে ঘরের বাইরে চলে এল রাজুমিখিন।
রাস্তায় নেমে গম্ভীর হয়ে রইল দুই বন্ধুই। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
.
নয়
বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাসকোল্নিকভ। ঘুম ভাঙতেই দেখল, সামনে বসে আছেন এক ভদ্রলোক।
অবাক গলায় শুধোয় রাসকোল্নিকভআপনাকে তো চিনতে পারলাম না?
আমার নাম সিদ্রিগয়লভ।
সিদ্রিগয়লভ! আপনার বাড়িতে দুনিয়া কিছুদিন ছেলেমেয়ে পড়িয়েছিল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
দুনিয়ার নামে বাজে কথা ছড়িয়েছিলেন আপনি আর আপনার স্ত্রী মার্কা তাড়ায় তাকে বাড়ি থেকে?
হ্যাঁ, কিন্তু দেখুন–ভুলটা তো পরে ধরা পড়েছিল, আমতা আমতা করতে থাকে সিদ্রিগয়লভ।
কড়া গলায় বলে রাসকোল্নিকভ–এখানে এসেছেন কি মতলবে?
কুমতলবে নয়।
ধানাই-পানাই ছাড়ুন। কেন এসেছেন?
রেগে যাবেন না, শুনুন। দুনিয়ার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্যে আমি অনুতপ্ত। তাই ওকে দশ হাজার রুব্ল দিতে চাই।
নিমেষে মাথায় রক্ত চড়ে যায় রাসকোল্নিকভের–জুতো মেরে গরু দান করতে এসেছেন? বেরিয়ে যান– বেরিয়ে যান–এখুনি।
মুখ লাল হয়ে যায় সিদ্রিগয়লভের– আমার স্ত্রী মারা যাবার সময়ে তার শেষ ইচ্ছাপত্রে তিন হাজার রুব্ল দিয়ে গেছে দুনিয়াকে।
দূর হয়ে যান!
রাসকোল্নিকভের রুদ্রমূর্তি দেখে আর ঘরে থাকবার সাহস হয় না সিদ্রিগয়লডের।
.
সন্ধ্যে নাগাদ মা আর বোনের দাওয়াত রাখতে গেল রাসকোল্নিকভ। সঙ্গে রাজুমিখিন।
বললো–দুনিয়া, সিদ্রিগয়লভ সকালে এসেছিল আমার কাছে।
কেন? মুখ শক্ত হয়ে যায় দুনিয়ার। সিদ্ৰিগয়লভ লোকটা যে কতখানি নীচ, সে তা হাড়ে হাড়ে জেনেছে।
খারাপ ব্যবহার করার জন্যে সে অনুতপ্ত। তাই তোকে দশ হাজার রুব্ল দিতে চায়।
চাই না। অমন লোকের মুখও দেখতে চাই না।
কিন্তু ওর স্ত্রী যে তোকে তিন হাজার ফুল দিয়ে গেছেন শেষ ইচ্ছা হিসেবে।
তাই নাকি! দুনিয়ার রুষ্টমুখে এবার খুশির রোশনাই দেখা দেয়– ভদ্রমহিলার মনটা বড় ভাল। ভুল বুঝতে পেরে আমি যে নির্দোষ সে কথাটা শহরসুদ্ধ সবাইকে নিজেই জানিয়েছিলেন–
তাহলে, বললেন দুনিয়ার মা-–ওঁর টাকা নিতে ক্ষতি কী?
পরে ভাবা যাবে, মা, বলে দুনিয়া।
নিলে বেঁচে যাই রে। শহরে এসেছি যার ভরসায়–সে তো কানাকড়িও দিচ্ছে না, দেবে বলেও মনে হচ্ছে না–রোডিয়া ওকে যা অপমান করেছে।
করেছি–আবার করব, রেগেমেগেই বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ।
বোকা ছেলে! মাথা গরম করিসনি, বাবা। আজকের চা-এর আসরে তাকেও যে দাওয়াত করেছি।
লুজিনকে!
হ্যাঁরে। মিটমাট করে নে–হাজার হোক ভাবী জামাই তো।
কক্ষণো না।
শেষ হল না রাসকোল্নিকভের কথা। ঘরে ঢুকল স্বয়ং লুজিন।
ঢুকেই চোখমুখ লাল করে ফেলল রাসকোল্নিকভকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে সে কী চিৎকার–এ লোকটাকে ডেকেছেন কেন?
লোকটা! থতমত খেয়ে যান রাসকোল্নিকভের মা–আমার ছেলে তো থাকবেই।
আমাকে যে অপমান করে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আমি রাখতে চাই না।
তাহলেও সে আমার ছেলে। তাহলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এইবার রেগে যায় দুনিয়া–আমার ভাই-এর সঙ্গে যে সম্পর্ক রাখতে চায় না–তার সঙ্গে আমিও কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। হাজার হলেও সে আমার ভাই।
দুনিয়ার মুখ দিয়ে যে এমন কথা বেরোবে, তা ভাবতেও পারেনি লুজিন। রেগে টং হয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ঘরের সবাই। লুজিন ভেবেছে, মা-বোন-ভাই পথের ভিখিরি। তাই তাদের দেমাক ভাঙবেই–শহরে থাকতে হলে টাকার দরকার, টাকার মালিক তো লুজিন। কিন্তু সে জানে না, তিন হাজার রুব্ল পেতে চলেছে দুনিয়া।
আলোচনা শুরু হল এই তিন হাজার রুব্লকে কেন্দ্র করে।
রাজুমিখিন বললো-–তিন হাজারের এক হাজার ব্যবসায়ে লাগানো যাক। আরও এক হাজার দেবে আমার চাচা।
কিসের ব্যবসা? রাসকোল্নিকভের প্রশ্ন।
বই ছাপানোর ব্যবসা। প্রকাশকদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে–জানি এ-ব্যবসা কিভাবে চালাতে হয়।
তাহলে আর দেরি কেন, শুরু করে দাও।
তুমিও তো থাকছ ব্যবসায়ে?
জবাবটা পরে দিচ্ছি।
একটু পরেই পথে নেমে এল দুই বন্ধু।
রাজুমিখিন শুধালো তক্ষুণি–জবাবটা এবার দাও।
গম্ভীর গলায় বললো রাসকোল্নিকভ–বন্ধু, কোনো ব্যবসাতেই আর থাকছি না আমি; কারণ তোমাদের সঙ্গেই আর থাকা হবে না আমার।
মানে? অবাক হয়ে যায় রাজুমিখিন।
মানেটা বুঝে নাও। চোখে চোখে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললে রাসকোল্নিকভ–আর, আমার একটা কথা রেখো। দুনিয়াকে বিয়ে কোরো। তাহলেই শান্তি পাব আমি। জানব, মা আর বোনের পাশে আছে তোমার মতো বন্ধু।
রাজমিখিনের সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। চোখের ভাষায় আর গলার সুরে অনেক রহস্যই তো ব্যক্ত করে দিল রাসকোল্নিকভ।
.
রাসকোল্নিকভ এখন দাঁড়িয়ে ওর বাড়ির সামনে। একা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দুটি লোক। একজন এবাড়ির দারোয়ান–আর একজন সেই বেঁটে রঙ-মিস্ত্রীটা। বুড়ি অ্যালিওনার ফ্ল্যাটে যে তেড়ে কথা বলেছিল রাসকোল্নিকভের সঙ্গে। পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল ওকে।
রাসকোল্নিকভকে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল দারোয়ান। বেঁটে রঙ-মিস্ত্রী পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে।
বললো ফিসফিস করে–খুনী!
বলেই হনহন করে উধাও হয়ে গেল পথে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাসকোল্নিকভ।
রাতে যেতে হল মার্মেলাভের বাড়িতে। আজ তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। তাই সামান্য পাওয়ার আয়োজন করেছে ওর বউ ক্যাটেরিনা।
দাওয়াত করে গেছিল সোনিয়া–মার্মেলাডভের সেই ষোল-সতের বছরের মেয়ে–যে পাপের পথে রোজগার করে চলেছে অভাবের জালায়।
তাই রাসকোল্নিকভ গেল দাওয়াত রাখতে।
এবং ওর সামনেই ঘটে গেল একটা বিশ্রী কাণ্ড!
হঠাৎ ভীষণ রেগেমেগে ঘরে ঢুকল লুজিন!
সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল তারস্বরে চিৎকার-–চোর! চোর।
কে চোর? রুদ্রমূর্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রাসকোল্নিকভ।
সোনিয়া! একশ রুব্ল চুরি করেছে আমার ঘর থেকে!
থ হয়ে যায় সোনিয়া–আমি!
ন্যাকা। যেন কিছু জানে না! একটু আগেই তো গিয়েছিলে আমার ঘরে।
আপনিই তো ডেকে পাঠালেন–দশটা কল দিলেন মাকে দেবার জন্যে।
তখুনি নিয়েছ একশ রুব্লের নোটটা।
কক্ষণো না।
বেশ তো, দেখাও তোমার পকেট।
রেগেমেগে পকেটে হাত দিয়েই ফ্যাকাশে হয়ে গেল সোনিয়া। আস্তে আস্তে বের করল হাত।
মুঠোয় রয়েছে একশ রুলের একটা নোট!
কিন্তু ভগবান আছেন। তিনিই বাঁচালেন সোনিয়াকে এই বিষম বিপদ থেকে।
ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল একজন যুবক। রাগে থমথম করছে তার চোখমুখ। গনগনে চোখে লুজিনের দিকে তাকিয়ে সে প্রথমেই শুধু বললো–ছি ছি ছি!
বিবর্ণ হয়ে গেল লুজিন।
চোখ ছোট হয়ে আসে রাসকোল্নিকভের।
বলে–তুমি কে?
আমার নাম লেবেজিয়াৎনিকত। এই বাড়িতেই থাকি আমি। আমার ঘরেই উঠেছে এই লুজিন। একটু আগেই আমাকে বলেছিল, সোনিয়াকে ডেকে দিতে।
তারপর?
ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম সোনিয়াকে। দয়ার অবতার হয়ে লুজিন যখন ওকে দশটা রুব্ল দিল তখন আমি ঘরেই ছিলাম। তারপর ছিলাম ঘরের বাইরে। কিন্তু আড়াল থেকেই দেখেছি লুজিনের হাতসাফাই।
হাতসাফাই?
একশ রুলের এই নোটটা টুক করে ফেলে দিল সোনিয়ার পকেটে। তখন ভেবেছিলাম, কাউকে না জানিয়ে বুঝি আরও দান করছে–তাই বলিনি আমি দেখে ফেলেছি। কিন্তু এখন তো দেখছি উল্টো ব্যাপার। সোনিয়াকে চোর সাজানোই ওর উদ্দেশ্য!
সিংহের মতো গর্জে ওঠে রাসকোল্নিকভ–বন্ধু! ওর আসল উদ্দেশ্য আমাকে অপমান করা; কারণ ওকে আমি তাড়িয়েছি বাড়ি থেকে, আমার বোন চায় না ওকে বিয়ে করতে। কিন্তু তবুও সোনিয়া দাওয়াত করে এনেছে আমাকে–তাই।
চকিতে হাওয়া হয়ে গেল বদমাশ লুজিন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চম্পট দিল বাড়ি থেকে।
রাসকোল্নিকভের জীবন থেকে চিরকালের মত বিদায় নিল লুজিন! সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেল।
.
ঠিক এক ঘন্টা পর।…
সোনিয়া নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। ভাবছে, আশ্চর্য মানুষ বটে এই রাসকোল্নিকভ। এক পয়সাও নেই নিজের কাছে–অথচ পকেট উজোড় করে পঁচিশ রুব্ল দিয়েছে তার মাকে বাবার শেষ কাজের জন্যে।
আজ সকালেই দাওয়াত করতে গিয়ে সে দেখে এসেছে কত দীনহীন অবস্থায় থাকে রাসকোল্নিকভ। সোনিয়ার চাইতেও তার অবস্থা খারাপ। অথচ দুর্গতকে সাহায্য করার সময়ে নিজের কথা খেয়াল করে না…
ঠিক এই সময়ে নড়ে উঠল দরজার কড়া।
এত রাতে আবার কোন আপদ এল, ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দিলো সোনিয়া।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রাসকোল্নিকভ!
আপনি! সত্যিই অবাক হয়ে যায় সোনিয়া। সে খারাপ মেয়ে—রাসকোল্নিকভের মত ভালো মানুষ তার কাছে এত রাতে আসবে–এ যে ভাবাও যায় না!
ঘরে ঢুকল রাসকোল্নিকভ। সে এসেছে মনের বোঝা কমাতে। সোনিয়া খারাপ মেয়ে। সে নিজেও তো খারাপ লোক–খুন করেছে দু-দুজন নারীকে।
বসল চেয়ারে। হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলে। সেখানে রয়েছে একটা বাইবেল।
সে আবেগমাখা গলায় বললো–সোনিয়া, বাইবেল থেকে কিছু পড়ে শোনাবে?
নীল-নীল চোখে রাসকোল্নিকভের উদ্ভ্রান্ত মুখের দিকে চেয়ে সোনিয়া কি বুঝল, সে-ই জানে।
বসল ওর সামনে। বাইবেল তুলে নিয়ে মন দিয়ে পড়ে গেল বেশ কিছু শান্তির কথা। ল্যাজারাসের আবার বেঁচে ওঠার মনছোঁয়া কাহিনী।
শুনতে শুনতে অভিভূত হয়ে গেছিল রাসকোল্নিকভ। সোনিয়া স্তব্ধ হতেই সোনিয়ার দু-হাত চেপে ধরে বলে উঠল আবেগঘন গলায়–আমিও আবার বাঁচতে চাই, সোনিয়া–ঈশ্বর কি সে সুযোগ আমাকে দেবেন না।
নিশ্চয় দেবেন।
ব্যস, ভেঙে পড়ল রাসকোল্নিকভ। মন উজাড় করে বলে গেল সমস্ত কথা। স–ব।
সব শুনে গম্ভীর গলায় সোনিয়া শুধু একটা কথাই বললো–প্রায়শ্চিত্ত করো।
.
দরজা তখন বন্ধ ছিল। কিন্তু পাল্লার ওদিকে দাঁড়িয়েছিল সিদ্ৰিগয়লভ। যাকে আজ সকালেই দূর-দূর করে তাড়িয়েছে রাসকোল্নিকভ। সে এসেছিল সোনিয়ার সঙ্গে আড্ডা মারতে, পাশের ঘরেই যে উঠেছে।
রাসকোল্নিকভ খুনী! কথাটা জেনেই আনন্দে নেচে উঠল সিদ্রিগয়লভ। দুনিয়া মেয়েটাকে পায়ের তলায় রাখবার সুযোগ এসে গেছে হাতের মুঠোয়। দশ হাজার রুব্ল দিতে গিয়েও যা করা সম্ভব হয়নি–এবার তা সম্ভব হবে, শুধু একটা চিঠির মাধ্যমে। শুধু একটা চিঠি!
চিঠিখানা লেখা হল দুনিয়াকে। পরের দিনই, তার ভাই যে মহাঅপরাধ করেছে–তা জানে শুধু সিদ্রিগয়লভ। দুনিয়া যদি এখুনি না আসে তাহলে পুলিশকে জানানো হবে সমস্ত কথা।
ঠিক তখুনি পুলিশের বড়কর্তার সামনে হাজির হল রাসকোল্নিকভ।
সোনিয়া তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছে। কিন্তু সহজে ধরা দেবে না সে। তাহলে যে পুলিশ জিতে যাবে।
আগে হার স্বীকার করুক পুলিশ। তারপর রাসকোল্নিকভ ধরা দেবে নিজে।
বড়কর্তা পর্ফাইরি বড় ধুরন্ধর। বুদ্ধির খেলা খেলছেন ওর সঙ্গে। গতকাল কথার ফাঁদে ফেলতে গিয়েছিলেন–পারেননি। আজকে ডেকেছেন নিশ্চয় অন্য মতলবে।
দেখা যাক, বুদ্ধির যুদ্ধে কে জেতে!
বন্ধকী জিনিসগুলো ফেরৎ নেবার জন্যে একটা দরখাস্ত লিখে নিয়ে গিয়েছিল রাসকোল্নিকভ।
কিন্তু তা দেখলেন না পর্ফাইরি। ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বনবন করে চর্কিপাক দিতে লাগলেন ঘরময়। আর বকে গেলেন সমানে।
বললেন–আপনি যে খুনী, সে প্রমাণ এখনও পাইনি। তবে পাঁচটা কারণে আপনাকে সন্দেহ করছি।
যথা? চোখ নাচিয়ে বলে রাসকোল্নিকভ।
এক নম্বর কারণ–খুনের ঠিক পরেই আপনি অসুস্থ হলেন। দু-নম্বর কারণ, অসুখ সারতে না সারতেই বুড়ির ফ্ল্যাটে গিয়ে মিস্ত্রীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন–রক্ত গেল কোথায়? তিন নম্বর কারণ, জামেটভকে খুব বড়াই করে বলেছিলেন–আপনি নিজে খুন করলে লুটের মাল লুকোতেন কিভাবে।
চার নম্বর কারণটা? অধীর গলায় শুধোয় রাসকোল্নিকভ।
কাল হাসতে হাসতে বন্ধুকে নিয়ে ঢুকলেন আমার ঘরে। হাসিটা অস্বাভাবিক। লোক-দেখানো হাসি।
বড্ড বাজে বকছেন, চড়া গলায় এবার বলে রাসকোল্নিকভ–পাঁচ নম্বর কারণটা দয়া করে বলবেন?
অট্টহেসে বললেন পর্ফাইরি–সেটা নিজের চোখেই দেখে যান। এই নিন চাবি। খুলুন ওই দরজাটা। দেখুন পঞ্চম কারণ কে?
রেগেমেগে চাবি নিয়ে উঠে যাচ্ছিলো রাসকোল্নিকভ। ঠিক এই সময়ে হইচই শোনা গেল বাইরে। কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে–আমি খুনী! আমি খুনী! আমি খুনী!
একদল পুলিশ কর্মচারি ঢুকে পড়ল ঘরে। বললো সোল্লাসে-ঐ শুনুন–নিকোলে স্বীকার করছে–খুন করেছে ও নিজেই।
ঠিক আছে, যাও তোমরা। বলে, কর্মচারিদের ঘর থেকে বিদেয় করে, মুচকি হেসে রাসকোল্নিকভের হাত থেকে চাবিটা কেড়ে নিলেন পর্ফাইরি–নিকোলের গুষ্টিসুদ্ধ মাথা খারাপ। হাজতবাস করে দেখছি ওর পাগলামি বেড়েছে।
অবাক গলায় বললো রাসকোল্নিকভ–আপনি বিশ্বাস করেন না, নিকোলে খুন করেছেন?
একেবারেই করি না।
তবে কে করেছে?
আপনি করেছেন। কিন্তু প্রমাণ নেই। সন্দেহ যা ছিল, তা এই বোকা নিকোলের পাগলামির ফলে টিকল না। ইচ্ছে ছিল, আজই আপনাকে গ্রেপ্তার করব। ঠিক আছে, আরও দিন কয়েক ঘুরে বেড়ান। তারপর–
কিন্তু দরজার ওপারে রহস্যময় সেই পঞ্চম প্রমাণটা কী?
.
দশ
চিঠি পেয়েই ছুটে এল দুনিয়া। সিদ্রিগয়লভ ঘরে ছিল তারই প্রতীক্ষায়। উঠে গিয়ে দরজায় চাবি দিয়ে রাখল নিজের পকেটে।
বসল মুখোমুখি দুটি চেয়ারে।
বলুন, কেন ডেকেছেন? বুক কাঁপছে দুনিয়ার। না জানি কি কথাই শুনতে হবে এখুনি ভাই সম্পর্কে। রাসকোল্নিকভ সম্বন্ধে অনেক কানাঘুষো কথা তার কানে আসছে। পুলিশ নাকি তাকে খুনের ব্যাপারে সন্দেহ করেছে।
কিন্তু রাসকোল্নিকভ নিজে কাউকে কিছু বলছে না। বরং যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মা আর বোনকে সে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। তাদের ভারও ছেড়ে দিয়েছে প্রিয় বন্ধু রাজুমিখিনের ওপর।
জ্ঞানীগুণী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান রাসকোল্নিকভ। ইদানীং তার হাবভাব পাগলের মতো। এই কারণেই পুলিশের আরও সন্দেহ।
তাই দুনিয়া ছুটে এসেছে চিঠি পেয়েই। খুবই নীচ লোক এই সিদ্রিগয়লভ। কিন্তু শহরে নিশ্চয় বদমায়েশি করতে সাহস পাবে না। এটা তার মফস্বলের জমিদার বাড়ি নয়। সেখানে সে রাজা হতে পারে…
সিদ্রিগয়লভ কুটিল হেসে বলে উঠল–দুনিয়া, তোমার ভাই খুন করেছে বুড়ি অ্যালিওনা আর তার বোনকে। লুট করেছে গয়না আর টাকার থলি।
আপনি জানলেন কি করে?
আড়ি পেতে।
মানে?
পাশের ঘরেই থাকে সোনিয়া। কাল রাতে রাসকোল্নিকভ এসেছিল সেই ঘরে। নিজেই সব খুলে বলল সোনিয়াকে। আমি শুনলাম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
দুনিয়ার মুখ কালো হয়ে যায়। খুনী! রাসকোল্নিকভ সত্যিই খুনী! নিজের মুখে যখন কবুল করেছে…।
সিদ্রিগয়লভ বললো–দুনিয়া, যদি আমার একটা কথা শোনো, তাহলে আমি পুলিশকে কিছু বলব না।
কি কথা? গলা শুকিয়ে গেছে দুনিয়ার।
আমাকে বিয়ে করতে হবে।
জাহান্নমে যান আপনি!
তাহলে তো রাসকোল্নিকভকেও সাইবেরিয়ায় যেতে হবে।
তাই যাবে। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে বই কি!
সেকী! সে না তোমার ভাই!
ভাই বলে কি অন্যায়ের সাজা পাবে না? চললাম আমি। বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দুনিয়া।
উঠে দাঁড়ায় সিদ্রিগয়লভ-ও। মুখে তার ক্রূর হাসি। টাকার লোভ দেখিয়ে হল না। ভাইকে পুলিশে দেবার ভয় দেখিয়েও হল না।
তাহলে এবার গায়ের জোর কাজে লাগানো যাক…
দাঁতে দাঁত চেপে বললো–কোথায় যাবে, দুনিয়া? ঘর যে বন্ধ। আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হলে এ-ঘর থেকে তো বেরোতে পারবে না!
আগুন জ্বলে উঠল দুনিয়ার চোখে। বড় তেজী মেয়ে সে। এ রকম একটা সম্ভাবনার কথা ভেবেই তৈরি হয়ে এসেছিল আগে থেকে।
একটানে পকেট থেকে বের করল একটা পিস্তল এবং সটান গুলি করল সিদ্রিগয়লভকে…
গুলি বেরিয়ে গেল তার কানের পাশ দিয়ে–চামড়া উড়িয়ে দিয়ে। রক্তের স্রোত নেমে এল কাটা জায়গা থেকে।
পাথরকঠিন মুখে আবার পিস্তল টিপ করেছে দুনিয়া। সিদ্রিগয়লভ এগিয়ে আসছে ওকে ধরবে বলে…
ঘোড়া টিপতে গেছে দুনিয়া…
এমন সময়ে চোখে পড়ল রক্ত গড়াচ্ছে সিদ্রিগয়লভের কানের পাশ দিয়ে ঘাড়ের ওপর…
রক্ত!
খুন। দুনিয়া খুন করতে চলেছে! জীবন নিতে চলেছে!
প্রভু যিশু কিন্তু বলেছেন–কখনও কারো জীবন নিও না।
থরথর করে কেঁপে ওঠে দুনিয়া। ছুঁড়ে ফেলে দেয় পিস্তল।
কি হল? চমকে ওঠে সিদ্রিগয়লভ।
আবেগৰুদ্ধ কণ্ঠে দুনিয়া শুধু বললো– কারো প্রাণ নেবার অধিকার আমার নেই। কপালে যা আছে–তাই হোক!
থমকে গেল সিদ্রিগয়লত। পিছিয়ে গেল এক-পা এক-পা করে।
আশ্চর্য মেয়ে তো এই দুনিয়া! বিপদ সামনে জেনেও নীতিকে বিসর্জন দেয়! ভগবানের নাম নেয়!
পকেটে থেকে চাবি বেরে করে ছুঁড়ে দিল সিদ্ৰিগয়ল। বললো ভাঙা গলায়-–যাও দুনিয়া, চলে যাও।
দরজা খুলে বেরিয়ে গেল দুনিয়া। পাশের ঘরে ঢুকল সিদ্ৰিগয়লভ। এ-ঘর সোনিয়ার।
বললো–সোনিয়া, তোমার তিন ভাইবোনকে আশ্রমে ভর্তি করে দাও। আমার এই চিঠি আর তিনজনের জন্যে এই তিন হাজার রুব্ল সঙ্গে নিয়ে যাও। অসুবিধে হবে না।
সোনিয়া স্তম্ভিত।
সিদ্ৰিগয়লভ বলে চলেলো–আরও তিন হাজার রুব্ল দিচ্ছি তোমাকে।
কেন?
রাসকোল্নিকভ সাইবেরিয়ায় গেলে তোমাকেও তো সরে যেতে হবে–নিজের খরচেই যেতে হবে। সরকার দেবে না সে-টাকা। এই তিন হাজার রুব্ল তখন কাজে লাগবে।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সিদ্ৰিগয়লভ।
পকেটে রয়েছে একটা পিস্তল। যে-পিস্তল একটু আগেই ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল দুনিয়া।
যার মধ্যে তখনও রয়েছে একটা গুলি।
.
কাঁদতে কাঁদতে বললো দুনিয়া–দাদা, এইবার ধরা দাও। আমার জন্যে, মায়ের জন্যে ভেবো না–ঈশ্বর আমাদের দেখবেন।
হ্যাঁ, ধরা দেব এবার। শান্ত গলায় বললো রাসকোল্নিকভ। বুদ্ধির খেলায় জিতেও সে হেরে গেল ভাগ্যের কাছে। এতদিন কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
পাবে এবার। সিদ্রিগয়লভ সাক্ষী দেবে। জেরার মুখে সোনিয়াও সত্যি কথাই বলবে।
সুতরাং ধরা দেয়া যাক।
উঠে দাঁড়িয়েছে দুনিয়া। রাসকোল্নিকভ তাকে বললো–আমার একটা কথা রাখিস। রাজুমিখিনকে বিয়ে করিস।
কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল দুনিয়া।
উঠে দাঁড়াল রাসকোল্নিকভ–এবার যাওয়া যাক পুলিশ দপ্তরে।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল একটা লোক–সেই বেঁটে রঙ-মিস্ত্রী। যে তাকে গতকাল ফিসফিস করে বলেছিল–খুনী!
চমকে বলে ওঠে রাসকোল্নিকভ–কী ব্যাপার?
বেঁটে রঙ-মিন্ত্রী সজল চোখে বললো–ক্ষমা চাইতে এসেছি।
কেন?
অন্যায় করেছি বলে।
কি অন্যায়?
তুমি খুন করোনি–করেছে নিকোলে। আমি কিন্তু তোমাকে খুনী বলেছি। সব্বাইকে তাই বলে বেড়িয়েছি।
তুমি!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি। পুলিশ দপ্তরে চাবি নিয়ে দরজা খুলে যে পঞ্চম প্রমাণটাকে দেখতে যাচ্ছিলো–সেটা কী, তা জানো?
পঞ্চম প্রমাণ!
হ্যাঁ, মোক্ষম প্রমাণ! আমি…আমি…আমিই ছিলাম দরজার আড়ালে!
তুমি!
দরজা খুলেই আমাকে দেখে আঁতকে উঠে নিশ্চয় বেফাঁস কথা বলে ফেলতে। কিন্তু ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন। নিকোলে ঠিক সেই মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠেছে।
নিকোলে নিয়ে এবার নির্বাসনে যাবে সাইবেরিয়ায়।
তা তো যাবেই।
.
পুলিশ দপ্তর। রাসকোল্নিকভ ঘরে ঢুকতেই ছুটে এল ইলিয়া পেত্রোভিচ–কী লজ্জা। কী লজ্জা! খামোকা আপনাকে সন্দেহ করেছিলাম। নিকোলে সব স্বীকার করেছে। ওকেই যেতে হবে সাইবেরিয়ায়।
প্রচণ্ড ঝোঁক এল রাসকোল্নিকভের। এবার সরে পড়লেই তো হয়!
না, না, না! সিদ্ৰিগয়লভ এখুনি আসবে–বলবে সব কথা। ধরা দেয়া যাক তার আগেই…
নিজেকে সামলে নিল রাসকোল্নিকভ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন নিকোডিম ফোমিচ–পুলিশের বড় সাহেব।
রাসকোল্নিকভকে তিনি দেখেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন ইলিয়াকে–কী কাণ্ড! গুলি করে নিজেই নিজের খুলি উড়িয়ে দিয়েছে লোকটা!
কে সে। ইলিয়ার প্রশ্ন।
সিদ্রিগয়লত।
মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল রাসকোল্নিকভ। সামলে নিল টেবিলের কোণ ধরে।
ভগবান কি মুখ তুলে চাইলেন? শেষ বিপদটাকেও কাটিয়ে দিলেন? এখন সে নিজে ধরা না দিলে কেউ আর তাকে ধরতে পারবে না…
হেসে বললেন নিকোডিম-–খুব চিন্তায় ফেলেছিলাম আপনাকে, তাই না?
ভাঙা গলায় বললো রাসকোল্নিকভ–এসেছিলাম জামেটভের কাছে। চললাম।
বলে এগোলো দরজার কাছে। নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
উঠোনের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে সোনিয়া। হাতে তার বাইবেল। দুচোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত।
মিলিয়ে গেল রাসকোল্নিকভের মনের লড়াই। দৃঢ় সঙ্কল্প শক্ত করে তুলেছে মনকে। মুখে ভাসছে এখন শান্তির জ্যোতি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরপদে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ঘরের মাঝখানে। নিকোডিমের টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্রশান্ত প্রসন্ন স্বরে বললো–আমিই সে-ই।
কী? চোখ তুলে হাসলেন নিকোডিম।
খুনী!
.
আট বছরের জন্যে রাসকোল্নিকভকে সাইবেরিয়ায় পাঠালেন বিচারকরা। হাল্কা সাজা দেয়া হল শুধু এই কারণে যে, সে নিজে স্বীকার না করলে কেউ তাকে ধরতে পারত না।
কয়েদীদের সঙ্গে সে সাইবেরিয়ার পথে রওনা হতেই আর একজন নিজের খরচে পা বাড়ালো সে দিকেই।
নাম তার, সোনিয়া।