হেতেফেরিসের রহস্য
‘আজ থেকে ৪৭০০ বছর আগের একটা দিন, মিশরের ফারাও হুনি নিজের প্রাসাদে মাথা নীচু করে বসে আছেন। দেশের মানুষ তাঁরকে ভগবানের মতো পুজো করে। হেন কোনো পার্থিব সম্পদ নেই যা তাঁরর আয়ত্তের বাইরে। তবুও হুনি আজকে নিঃস্ব। যেকোনো পিতার সবচেয়ে কষ্টের কাজটা এইমাত্র তাঁরকে করে আসতে হল। কবর দিয়ে এলেন নিজের একমাত্র পুত্রসন্তানকে। হঠাৎ একদম কম বয়সেই ছেলেটা চলে গেল। হুনির সামনে এখন একটা বড়ো প্রশ্ন, পরের ফারাও কে হবে? কোনো পুরুষকেই তো বসতে হবে মেমফিসের মসনদে। কিন্ত হুনির বাকি সন্তানেরা তো সবাই কন্যা। এদিকে তাঁরর চারিদিকে শত্রুরও তো অভাব নেই। শকুনের মতো তাঁরকে তারা ঘিরে রাখবে। ফারাও মারা গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সিংহাসনের জন্য। হুনির বয়স হয়েছে। এই বয়সে নতুন করে আর সন্তানের বাবা হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে উপায়?’
এই বলে ভবেশদা একটা ভ্রূ ওপরে তুলে আমাদের দিকে চাইলেন। দু-নম্বর কবিরাজিটা এই একটু আগেই দিয়ে গেছে। আমরা আর কিছু অর্ডার করিনি। এমনিতেই বাড়ি থেকে বেশি টাকা পাওয়া যায় না মাসের হাতখরচার জন্য। একদিনে দুটো করে ফিশ কবিরাজি সাঁটালে পরের উইকএন্ডে হোস্টেলের ক্যান্টিনের ট্যালট্যালে ডাল ভাত দিয়েই পেট ভরাতে হবে। তার চেয়ে এই ভালো। ভবেশদাকে অন্তত আরেকটা কবিরাজি দিয়ে আটকে রাখা গেছে।
আমি ভবেশদার প্রশ্নর উত্তরে বললাম,
‘হুম, খুব চাপের কেস বটে। তবে হুনি চাইলে নিজের জামাইকেই দেশের রাজা বানাতে পারতেন তো। রাজত্ব আর রাজকন্যা দুটোই পাবে সে তাহলে।’
‘একদম ঠিক ধরেছ, স্পন্দন ভাই। ফারাও হুনি ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন। নিজের সবচেয়ে বড়ো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এমন একজনের যার বংশ নামকরা হলেও সেই বংশের কেউ কোনোদিন আগে ফারাও হননি। হুনির পরে ইনিই ফারাও হন। হঠাৎ ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া এই লোকটির নাম ছিল নেফ্রু।’
‘মানে, খুফুর বাবা?’
‘হ্যাঁ, আর নেফ্রুর স্ত্রী, হুনির বড়োমেয়ে যার জন্য নেফ্রুর ফারাও হওয়া সম্ভব হল, সে হল রানি হেতেফেরিস। হেতেফেরিস শব্দের মানে হল সেই মেয়েটা যার হাসিমুখ।’
পিজি এবারে ফিচ করে হেসে বলল,
‘বুঝেছি, হেতেফেরিস বাঙালি হলে নাম হত সুহাসিনী!’
‘চ্যাংড়ামি শুরু করলে কিন্তু আমি উঠে যাব।’
‘না না, সরি সরি। আর কিছু বলব না, আপনি বলুন।’
পিজি জিভ কেটে চুপ করে বসল।
‘যেটা বলছিলাম, আরও অনেক রানি থাকলেও ফারাও নেফ্রু হেতেফেরিসকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। কারণটা খুব স্বাভাবিক। ওই মেয়েটির জন্যই যে তিনি সম্রাট হতে পেরেছিলেন। আগেই বলেছি নেফ্রুর দুটো পিরামিড ছিল, একটা মেইদামে আরেকটা দাশুর নামের একটা জায়গায়। দাশুরের পিরামিডেই নেফ্রুকে সমাধিস্থ করা হয়। হেতেফেরিসকেও কবর দেওয়া হয় নেফ্রুরই পিরামিডের পাশে।’
‘বলছেনটা কী? হেতেফেরিসের সমাধি দাশুরে? আমরা তো জানতাম গিজাতে। খুফুর পিরামিডের পাশে।’
ভবেশদার কথায় আমি একটু অবাকই হলাম এবারে।
‘তুমি যেটা বলছ ঠিক, আবার আমার কথাও ঠিক।’
‘তার মানে হেতেফেরিসকে দু-বার সমাধিস্থ করা হয়?’
মুখে সেই ট্রেডমার্ক রহস্যাবৃত হাসিটা এনে ভবেশদা এবারে বললেন,
‘সেটা এখনই বলব না, আগে খুফুর একটা গল্প শোনো।’
একদিন খুফুর দরবারে একটা লোক ভয়ে ভয়ে হাজির। খারাপ একটা খবর সে নিয়ে এসেছে, ফারাও জানতে পারলে হয়তো তার জন্য চরম শাস্তিও পেতে হতে পারে একে, কিন্তু খবরটা এমনই যে ফারাওকে জানাতেই হবে।’
‘কী খবর?’
‘ডাকাতির।’
‘কোথায়?’
‘দাশুরে, খুফুর মায়ের সমাধিতে।’
‘বলেন কী!’
‘হুমম, তবে আর বলছি কী। দাশুরের সমাধিক্ষেত্রকে যারা পাহারা দেয়, এ তাদের প্রধান। অনেক সাবধানতা নেওয়া সত্ত্বেও রাতের অন্ধকারে নাকি রানি হেতেফেরিসের সমাধিতে ডাকাত ঢুকেছিল। তবে খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। সমাধির একটা দেওয়ালই শুধু ভেঙে গেছে। ডাকাতেরা ভেতর থেকে প্রায় কিছুই নিয়ে পালাতে পারেনি। তবে যেহেতু ওরা একবার সমাধিটার কথা জেনে গেছে তাই ফের কখনো সিঁধ কাটবার চেষ্টা করতেই পারে।’
আমি বললাম,
‘আচ্ছা এবারে বুঝলাম, সেইজন্যই খুফু ওর মায়ের সমাধিকে দাশুর থেকে সরিয়ে গিজাতে নিজের পিরামিডের কাছে নিয়ে চলে এলেন।’
‘কারেক্ট!’
‘কিন্তু ভবেশদা, তাহলে তো গিজার সমাধিতে হেতেফেরিসের মমি থাকার কথা। কিন্তু ছিল না কেন?!’
‘এত অধৈর্য হলে কি চলবে স্পন্দন ভাই? হেতেফেরিসের মমির কথা তো ছেড়েই দাও। সমাধিটাও খুঁজে পাওয়া যেত না যদি না একজন ফোটোগ্রাফারের ট্রাইপড পিছলাত।’
গল্পের মধ্যে আবার একটা নতুন গল্প, আমি আর পিজি এবারে শিরদাঁড়া সোজা করে বসলাম। ভবেশদা বলে চললেন,
‘পয়লা নভেম্বর ১৯২৪ সালে আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্পনসরশিপে খুফুর পিরামিডের দক্ষিণ-পূর্বদিকে নতুন এক্সক্যাভেশন শুরু হয়, আমেরিকান আর্কিয়োলজিস্ট জর্জ রেসনারের নেতৃত্বে। কিন্তু জানুয়ারির শেষের দিকে রেসনারকে কয়েক মাসের জন্য হার্ভার্ডে ফিরে যেতে হয়। যাওয়ার সময় জর্জ কাজের দায়িত্ব দিয়ে যান সাইট ম্যানেজার অ্যালান রো-কে। আরেকটা বড়ো কাজ দেন মিশনের ফোটোগ্রাফার আবদৌকে। আবদৌ-এর কাজ ছিল রোজ কী কী কাজ হচ্ছে তার ছবি ডিটেলে তুলে রাখা। ভোরবেলায় আবদৌ সাইটে চলে আসত ক্যামেরা আর ট্রাইপড কাঁধে, শ্রমিকদের আসার ঘণ্টাখানেক আগে, কাজ শুরু হওয়ার আগে একবার ভালো করে ছবি তুলে রাখত। আবার বিকেল বেলায় সেদিনের মতো কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে নতুন যা যা কিছু পাওয়া গেল সেগুলোর ছবি তুলত। সব মিলিয়ে হাজারের ওপরে ছবি তুলেছিল আবদৌ।
‘১৯২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটা ভোরবেলা। অন্য বাকি দিনগুলোর মতোই আবদৌ আজও পৌঁছে গেছে সাইটে। খুফুর পিরামিডের পূর্বদিকে একটা উঁচু জায়গা দেখে ট্রাইপড বসাতে গেল। কিন্তু কী অদ্ভুত! খরখরে বালির মধ্যেও ট্রাইপডটা স্লিপ করে গেল! ভাগ্যিস ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা গলা দিয়ে ঝোলানো ছিল! নয়তো ওইটার বারোটা বাজত। আবদৌ এবারে ওইখান থেকে আরেকটু সরে এসে ট্রাইপড বসাল। কিন্তু খেয়াল করল ট্রাইপডটা বালির নীচে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি এখানে বালির নীচে অন্য কিছু আছে? সামান্য একটু বালির আস্তরণ হাত দিয়ে সরাতেই সেই অন্য কিছুটা দেখতে পাওয়া গেল। ঝুরো ঝুরো ময়লা আর সাদা চুনাপাথরের গুঁড়ো! এমনটা তো এখানে থাকার কথা নয়। তাহলে কি…!
‘তখনই আবদৌ একছুটে ডেকে আনল অ্যালান রো-কে। শ্রমিকদের দিয়ে ওপরের বালি পরিষ্কার করিয়ে দেখা গেল একটা আয়তাকার গর্তের মুখ। সেখানে জমে থাকা চুনাপাথরের টুকরোগুলোকে সরানোর পরে বেরিয়ে এল বারো ধাপের একটা সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়ির শেষে কিছু নেই।’
‘যাহ! তার মানে ধাপ্পা!’
‘মোটেই তা নয়। সমাধি যাতে কেউ খুঁজে না পায় তাই সমাধির মুখ পাথরের টুকরো দিয়ে এইভাবেই বুজিয়ে রাখা হত। শ্রমিকরা এবারে নতুন উদ্যমে ভারী ভারী পাথরগুলোকে সরাতে লাগল। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই ন-মিটার গভীর গর্তে পৌঁছোনোর পরে একটা মসৃণ পাথর পাওয়া গেল। পাথরের পিছনেই একটা লুকোনো কুঠুরি, যেখানে রাখা আছে একটা মানুষের মাথার খুলি আর ষাঁড়ের তিনটে পায়ের হাড়।’
‘মাথার খুলি না হয় বুঝলাম। কিন্তু ষাঁড়!’
‘হ্যাঁ, দেবতাকে খুশি করার জন্য ষাঁড়ের বলি দেওয়া হত। রো এই হাড় দেখেই নিশ্চিত হলেন যে খুব কাছাকাছিই কোনো সমাধি আছে। গর্তটা আরও গভীর হতে হতে পঁচিশ মিটারে এসে থামল। এবারে একটা বড়ো পাথরের চাঁই সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা অন্ধকার ঘর! কিন্তু মাটির অত নীচে থাকা সেই ঘরে সূর্যের আলো তো পৌঁছোতেই পারছে না। শ্রমিকরা এবারে দারুণ একটা বুদ্ধির আশ্রয় নিল। কাচের আয়না দিয়ে সেই খাড়াই গর্তের মধ্যে সূর্যের আলো ফেলা হল। তারপরে সেই আলো রিফ্লেক্ট করানো হল আরেকটা আয়নায়, তারপরে আরেকটায়, এইভাবে অন্ধকার ঘরটাতে অবশেষে আলো এসে পৌঁছোল। ওই আলোয় ঘরের যেটুকু দেখা গেল তাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল সবার!
‘ঘরের মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে সোনার টুকরো! কাঠের বড়ো পালঙ্ক, চেয়ার রাখা আছে। সেগুলোও জায়গায় জায়গায় সোনায় মোড়া। কাঠের একটা বড়ো বাক্স পাওয়া গেল। তাতে আটখানা ছোটো ছোটো পাথরের কৌটো রাখা, যার মধ্যে রাখা আছে সুগন্ধি তেল। মেয়েদের সাজগোজের সরঞ্জামও পাওয়া গেল। আর আছে অ্যালাবাস্টার পাথরের একটা কফিন! নাও পিজি, এবারে তোমার হেতেফেরিসের কবরে পৌঁছে গেছি।’
রানির অ্যালাবাস্টােরর কফিন
পিজি একটু গোমড়া মুখ করে বলল,
‘বুঝলেন কী করে যে ওটা অন্য কারোর নয়, হেতেফেরিসেরই?’
‘নাম লেখা ছিল যে।’
‘অ্যাঁ, নাম লেখা ছিল?’
‘হ্যাঁ, একটা কাঠের পাতের ওপরে লেখা ছিল,
“উপরের আর নীচের ইজিপ্টের মাতা, হোরাসের অনুগামী, রানি হেতেফেরিস!”
আমি এবারে বললাম,
‘তাহলে হেতেফেরিসের এই সমাধির খোঁজ ডাকাতরা আর পায়নি।’
‘না পায়নি, তাই তো এত কিছু পাওয়া গিয়েছিল এর মধ্যে। তবে এবারে মুশকিলটা হল অন্য জায়গায়। জর্জ রেসনার হার্ভার্ড থেকে ফিরে আসার পরে হেতেফেরিসের সমাধির জিনিসপত্রগুলো বের করা শুরু হয়। সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো কাঠের খাট, চেয়ার, বাক্সগুলোর হাল খুব খারাপ ছিল। অনেকগুলো জায়গাতে শত টুকরো হয়ে পড়ে ছিল মেঝেতে। সেইসব টুকরোগুলোকে খুব সাবধানে গুছিয়ে ওই পঁচিশ মিটার লম্বা গর্ত থেকে বের করতে লেগে গেল ৩২১ দিন। মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোটো ছোটো সোনার টুকরোগুলো ওই আসবাবপত্র থেকেই খসে পড়েছিল। মোম গলিয়ে মাটিতে ফেলে তোলা হল ওগুলোকে। কিন্তু এই শত সহস্র টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাবে কে? রেসনার নিজে পৃথিবীর তাবড় তাবড় এক্সপার্টের দ্বারস্থ হলেন। তাতেও কোনো সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। শেষে কায়রো মিউজিয়ামের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যান্টিকুইটি থেকে পাঠানো হল আহমেদ ইউসুফ নামের একজনকে। রেসনার প্রথম প্রথম তাকে পাত্তা দেননি। কিন্তু চারিদিকে অনেক চেষ্টা করেও কোনো আশার আলো না দেখে রেসনার যখন হাল ছেড়ে দিতে বসেছেন তখন আহমেদ ওঁকে বললেন,
‘‘সুযোগ পেলেই আমি এই টুকরোগুলো জুড়ে দিতে পারি।’’
এই কথায় রেসনার বেশ হাসলেন। কিন্তু আহমেদ একদম অবিচলিতভাবে আবার বললেন,
‘‘আমাকে এক সপ্তাহ একদম একা ছেড়ে দিন।’’
এক সপ্তাহও লাগল না, ছ-দিনের মাথাতেই রেসনার অবাক হয়ে দেখলেন আহমেদ একটা গোটা বাক্স জোড়া লাগিয়ে ফেলেছেন। ওপরের সোনার সূক্ষ্ম কাজ নিয়ে! এই ঘটনার পরে রেস্টোরেশনের কাজটা রেসনার আহমেদের ওপরেই ছেড়ে দেন। আহমেদ একে একে রানির খাট আর চেয়ারগুলোও জোড়া লাগিয়ে ফেলেন। এগুলো এখন কায়রোর মিউজিয়ামে রাখা আছে।’
‘আর হেতেফেরিসের মমি?’
আহমেদ ইউসুফ যে বাক্সটা জোড়া লাগিয়েছিলেন
‘হ্যাঁ, এবারে তার কথায় আসি। হেতেফেরিসের অ্যালাবাস্টার কফিনটা দারুণ ভালো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ৩ মার্চ, ১৯২৭ সালে জর্জ রেসনার এই কফিনটা খোলেন। কিন্তু ভেতরে কিছু পাননি। হেতেফেরিসের মমি হাওয়া! অথচ কফিনের সঙ্গেই চারটে ছোটো ছোটো পাথরের জারও পাওয়া গিয়েছিল। ওগুলোর মধ্যে ছিল হেতেফেরিসের ফুসফুস, স্টমাক, লিভার আর ইনটেস্টাইন।’
রানির বসার চেয়ার, শোওয়ার খাট
‘হেতেফেরিসের মমিটা তাহলে গেল কোথায়?! ওটাকে তো দাশুর থেকে তুলে নিয়ে এসে গিজার ওই কবরেই রাখা হয়েছিল বললেন?’
‘না তো, আমি কি বলেছি হেতেফেরিসের মমিসুদ্ধু সব কিছু আনা হয়েছিল দাশুর থেকে?’
‘মানে?’
‘মানে, মিথ্যে।’
‘মিথ্যে?’
‘হ্যাঁ, ফারাও খুফুকে সেদিন মিথ্যে কথা বলা হয়েছিল। ডাকাতরা হেতেফেরিসের সমাধি লুঠ করার সময় মমিটাকেও নষ্ট করে ফেলে। খুব সম্ভবত মমির গায়ে লাগানো সোনার জুয়েলারি আর দামি পাথরের জন্যই। কিন্তু সেই খবর খুফুকে দিলে কারোর শরীরে আর মাথা থাকত না। তাই সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল ঘটনাটাকে। খুব তাড়াহুড়ো করে দাশুর থেকে সমাধির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেইটুকুকে তুলে নিয়ে চলে আসা হয় গিজার সমাধিতে। ফাঁকা কফিনটাও সেই সময়েই নিয়ে এসে রেখে দেওয়া হয়। খুফু তো আর কফিন খুলে মৃত মায়ের মমি দেখতে চাইতেন না!’
‘কিন্তু এই ঘটনাটা জানা গেল কীভাবে? কোথাও লেখা ছিল নাকি?’
‘না, লেখা থাকবে কী করে? হেতেফেরিসের ফাঁকা কফিনের কারণটা জর্জ রেসনারেরই হাইপোথিসিস বলতে পারো। পাক্কা গোয়েন্দার মতো তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন।’
‘কীভাবে!’
‘হেতেফেরিসের সমাধিতে ঢুকেই রেসনার খেয়াল করেন সমাধিতে অনেক আসবাবপত্র থাকলেও সেগুলো সব অগোছালোভাবে রাখা আছে। যেন কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে কাজটা করতে চেয়েছে। তার একমাত্র লক্ষই ছিল যত জলদি সম্ভব হেতেফেরিসের জিনিসপত্রগুলোকে এক জায়গাতে রেখে সমাধিটা বন্ধ করে দেওয়া। আর পাথরের জারগুলোতে পাওয়া দেহের অংশই বলে দিচ্ছে যে কফিনের মধ্যেও একসময় হেতেফেরিস শুয়েছিলেন।’
‘তার মানে মমিটা সত্যিই পাওয়া যায়নি!’
‘না, যায়নি। তবে পরে আবার সেটা কফিনে ফিরেও আসেনি। শুনতে খারাপ লাগলেও এই জায়গাতে সুনীল গাঙ্গুলি ভুল ছিলেন। তাও ওঁর জন্যই তোমরা হেতেফেরিসের নামটা অন্তত শুনেছিলে।’
‘তবে বুঝলে মানিকজোড়, বইটাতে আরও দুটো ভুল আছে। হেতেফেরিসের সমাধির বর্ণনা ঠিক নেই। ১২৪ নম্বর পাতায় “কি অফ লাইফ”-এর ছবিটাও ভুল আঁকা আছে।’
‘কি অফ লাইফ!’
‘হুমম, সেটা কী জিনিস পরে বলব ’খন। এখন চলো, ওঠা যাক। অনেকক্ষণ ধরে ফাঁকা প্লেট সামনে রেখে আমরা গল্প করে যাচ্ছি। রেস্টুরেন্টের লোকেরা না তেড়ে আসে।’
দিলখুশা থেকে বেরিয়ে এম জি রোডের ওপরে এসে দাঁড়ালাম। ভবেশদা শিয়ালদার বাস ধরে নিলেই আমরা উলটোদিকে হোস্টেলের পথে হাঁটা লাগাব। দূরে দেখলাম শিয়ালদার বাস আসছে। ভবেশদা সেইদিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমাদের তাহলে গিজার পিরামিড চত্বরের প্রায় সব কিছুই বলে দিলাম, বাকি রয়ে গেল শুধু হোর-এম-আখেতের গল্প।’
‘হোর-এম-আখেত? সেটা কী?’
‘সেটা? সেটা হল…
স্ফিংস!!’
বলেই ভবেশদা টপ করে বাসে উঠে পড়ল।