“নদীর উত্তাল তরঙ্গ, জলাভূমি, কণ্টকাকীর্ণ পথ মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করল; কিন্তু তাদের আল্লাহু আকবার ধ্বনি, বজ্রের নিনাদ ও পাহাড়সম বাধার প্রাচীর চুর্মার করে সম্মুখে অগ্রসর হলো… আর তারা ফ্রান্স সীমান্তে পৌঁছে গেল।”
আমীরে মুসা ইবনে নুসাইরের স্পেন আগমনে তারেক ইবনে যিয়াদ অত্যন্ত খুশী হয়ে ছিলেন। তিনি খুশীর আতিশায্যে বলেছিলেন,
“আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর যিনি আমার পীর-গুরু তিনি স্পেনে এসেছেন এ খবর শ্রবণ মাত্র আমি রুহানী শক্তি খুঁজে পাচ্ছি।”
তারেক যখন সংবাদ পেলেন মুসা মেরীদা ও ইসাবালার মত গুরুত্বপূর্ণ শহর করতলগত করেছেন তখন তিনি নতুন প্রেরণা-উদ্দীপনা ফিরে পেলেন।
তারেক : “আমি আমার মুনীবের চরনে টলেড়ো পেশ করতে চেয়েছিলাম, এখন শুধু টলেডো নয় বরং তাকে আমি স্পেনের আরো অনেক বিস্তৃত এলাকা পেশ করব।”
তারেক বিন যিয়াদ টলেডোতে। এখান থেকে তিনি আশে পাশের যে সকল এলাকা বিজয় হয়নি তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সম্মুখে বড় তিনটি শহর ছিল, সেদিকে তিনি রওনা হবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু যাবার জন্যে যে রাস্তা তিনি নির্বাচন করলেন তা জলাভূমি, খুবই সংকটময়।
জুলিয়ন : কিন্তু… ইবনে যিয়াদ! তুমি যে রাস্তা দিয়ে যাবার মনস্থ করেছ তা তো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ঐ রাস্তা নিয়ে কেউ যাতায়াত করে না। তুমি এত বিপুল পরিমাণ রসদপত্র, সৈন্য-সামন্ত দিয়ে সে পথ কিভাবে অতিক্রম করবে?
তারেক ইবনে যিয়াদ : সহজ রাস্তা কোনটি তা আমি জানি। কিন্তু তুমিতো জান, সে রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেক দূর ঘুরে যেতে হবে ফলে রাস্তায় দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। আমি রাস্তাতে সময় ব্যয় করতে চাচ্ছি না। স্পেনের বিস্তৃত এলাকা দ্রুত বিজয় করে আমি সুসা ইবনে নুসাইরের সাথে মুলাকাত করতে চাচ্ছি। বর্বররা যে সাহসী তাদের কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই, ফলে রাস্তা যত কঠিনই হোক তা তারা অতিক্রম করতে পারবে।
আওপাস : আমার প্রিয় বন্ধু! ঐ রাস্তা এত সংকটময় যে আপনার সৈন্য হালাক হয়ে যেতে পারে বা বিপদে পড়তে পারে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আওপাস! এমন কোন বিপদ নেই যা আমাদের সম্মুখে আসেনি। এটা কি কম বিপদ ছিল যে রডারিক এক লাখ সৈন্য নিয়ে আমাদের মাত্র বার হাজার সৈন্যের সম্মুখে এসেছিল। তুমি জান টলেডোতে পৌঁছবার পূর্বে আমরা শুনেছিলাম যে টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই মজবুত, আমরা যদি সে ভয়ে বসে থাকতাম তাহলে আজ আমরা এখানে পৌঁছতে পারতাম না। আওপাস! আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আল্লাহ তায়ালা তাকে পথ প্রদর্শন করেন যে তার রাস্তায় দ্বিধাহীন চিত্তে-শংকাহীনভাবে অগ্রসর হয়।
জলাভূমি। বিপদশংকুল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল তারেক ইবনে যিয়াদের বাহিনী। পাহাড়ী নদীর খর স্রোত। যে কোন সময় বিপদ ঘটতে পারে। কয়েকটা খচ্চর রসদ-পত্রসহ ভেসেও গেল। এহেন মুহূর্তে তারেক ইবনে যিয়াদ ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে লস্কর বাহিনীর পশ্চাৎ-সম্মুখে গিয়ে বিভিন্নভাবে ফৌজের মাঝে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলতে লাগলেন তিনি চিৎকারে করে করে বলতে লাগলেন,
“তোমাদেরকে এ দরিয়া, নদী রুখতে পারবে না।”
“তোমরা পাহাড়ী প্রাচীর ভেদ করতে পারবে।”
“আল্লাহ্ তোমাদের সাথে আছেন।”
“হে আল্লাহর লস্করেরা! মঞ্জিল সন্নিকটে।”
“তোমরা জান্নাতের রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে।”
“গোটা স্পেন তোমাদের, স্পেনের তাবৎ খাজানা তোমাদের।”
আল্লাহকে স্মরণ করে অগ্রসর হও।
তারেক একথাগুলো এমন স্পৃহা-উদ্দীপনা নিয়ে বলছিলেন, ফৌজরা মুসীবতে থাকা সত্ত্বেও তাদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। স্বমরে তারা জবাব দিল,
“তারেক! আমরা তোমার সাথে রয়েছি।”
“আমরা তোমাকে আল্লাহর সম্মুখে লজ্জিত হতে দেব না।”
“আল্লাহু আকবার… আল্লাহু আকবার।”
চলতে চলতে এমন এক এলাকা এলো যা সবুজ-শ্যামল ঘাসে ঢাকা। তারেক ইবনে যিয়াদ তার মাঝ দিয়ে ফৌজ নিয়ে রওনা হলেন। ঘোড়ার পদতল হতে পানি উঠতে লাগল। কিছুদূর অগ্রসর হতেই শোর-গোল শুরু হয়ে গেল। চিৎকার ভেসে আসতে লাগল বাঁচাও, চাচাও। ঘোড়া এমনভাবে বিকট আওয়াজ করতে লাগল যেন বড় মসীবতের সম্মুখীন হয়েছে। একজন হাঙ্গর, হাঙ্গর করে চিৎকার করে উঠল।
দেখতে ঘাস দেখা গিয়ে ছিল আসলে তা ছিল গভীর জলাভূমি। পানির ওপর ঘাস বেড়ে উঠে ছিল।
বাহিনী দ্রুত পিছনে ফিরে এলো কিন্তু ফিরে আসতে আসতেই কয়েকটা গাধা ও কয়েকজন ফৌজ পানির তলে হারিয়ে গেল।
সেখান থেকে ফিরে তারেক পাহাড়ী রাস্তা ধরলেন। রাস্তা অত্যন্ত বিপদ সংকুল। একে তো হিংস্র প্রাণীর ভয় তাছাড়া রাস্তা এতো সরু যে একটু খানি বেখেয়াল হলেই নিচে পড়ে জীবন হারানোর রয়েছে শংকা। প্রতিটি ফৌজ ক্লান্ত শ্রান্ত। কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদের উৎসা-উদ্দীপনায় তারা ভেঙ্গে পড়েনি। হয়নি। হিম্মত হারা। অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে পরিশেষে দীর্ঘ দেড়মাস পর ফৌজ পৌঁছল স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর মায়েদার সন্নিকটে।
দু’দিন বিশ্রামের পর তারেক শহর অবরোধ করলেন।
শহরের প্রাচীরের ওপর বেশুমার ফৌজ তীর ও বর্শা হাতে দন্ডায়মান। তারা মুসলমানদেরকে আহ্বান করছে যেন শহর রক্ষায় তারা জীবন বিলিয়ে দেবে।
তারেক ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে শহরের চতুর্দিক প্রদিক্ষণ করলেন। দেখতে পেলেন শহরের প্রাচীর সবদিকে ভীষণ মজবুত। আর বুঝতে পারলেন এখানের মানুষের অন্তর প্রাচীরের পাথরের মত শক্ত ও দৃঢ়।
তারেক এলান করালেন তোমরা যদি স্বেচ্ছায় দরজা খুলে দাও তাহলে তোমাদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করা হবে আর যদি আমরা খুলি তাহলে তোমাদের সাথে সেরূপ ব্যবহার করা হবে যেমন দুশমন দুশমনের সাথে করে।
এলানের জবাবে ওপর থেকে তীর বর্ষিত হতে লাগল তার সাথে আওয়াজ এলো পারলে তোমাদের হিম্মতে তোমরা দরজা খোল।
তারেক দরজার ওপর হামলার নির্দেশ দিলেন, সারা দিন হামলা চলল, কিন্তু কোন ফলাফল পাওয়া গেল না।
পরের দিন সকালেও ঐ রকম হামলা-আক্রমণ চলতো কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে শহরের প্রধান ফটক খুলে গেল এবং চারজন ঘোড় সোয়ার সফেদ ঝান্ডা নিয়ে এগিয়ে এলো। তারা সম্মুখে এগিয়ে এসে বলল, তোমাদের সিপাহ্ সালার কোথায় আমরা সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তাকে তারেক ইবনে যিয়াদ নাগাদ পৌঁছে দেয়া হলো। সন্ধির জন্যে এসেছিল স্বয়ং কেল্লাদার নিজে।
কেল্লাদার : হে সিপাহসালার! বিপদ সংকুল ভয়াবহ জলাভূমি দিয়ে নাকি এসেছেন?
তারেক মৃদু হেসে বললেন, কেন? আপনি কি আশ্চর্য হচ্ছেন যে আমি ঐ জলাভূমি অতিক্রম করে এসেছি?
কেল্লাদার : হ্যাঁ, শুধু আমিই নই যেই শুনবে সেই আশ্চর্যবোধ করবে। ঐ জলাভূমি দিয়ে কেবল জিন-ভূত অতিক্রম করতে পারবে। কোন মানুষ জীবিত ঐ রাস্তা পাড়ি দিতে পারে না।
তারেক ইবনে যিয়াদ : দেখুন আমার দোস্ত! আমি আমার লস্করসহ আপনার সামনে জীবিত। এখন চিন্তা করুন যে ব্যক্তি এত বড় ভয়াবহ উপত্যাকা পাড়ি দিয়ে আসতে পারে তার জন্যে এ শহরের দরজা খোলা কোন ব্যাপার নয়। আপনি যদি ইনসানের খুন প্রবাহিত করতে ভালবাসেন তাহলে আপনার এ আশা পূর্ণ করব তবে জেনে রাখেন আপনি জিন্দা থাকবেন না আর এ শহরের অধিবাসী ও ফৌজকে বহু জরিমানা দিতে হবে।
কেল্লাদার : আমি খুন-খারাবী চাই না। মেনে নিয়েছি, যে ব্যক্তি এত বড় ভয়াবহ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে পারে তার জন্যে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা সন্ধির শর্ত ঠিক করবার এসেছি।
তারেক : ঠিক আছে আপনার শর্ত পেশ করুন।
আমরা শহরবাসীর জান-মাল-ইজ্জত আব্রুর জামানত চাই। লোকদের ঘরে লুটতরাজ হবে…।
তারেক : এ শর্ত তোমাদের নয় বরং এ শর্ত তো ঐ মহান ধর্মের যা আমরা সাথে নিয়ে এসেছি। আমরা এখানে লুটতরাজ ও মানুষের ইজ্জত হরনের জন্যে আসিনি। আমরা মানুষকে ঐ অধিকার ফিরিয়ে দিতে এসেছি যা আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে দিয়েছেন। যান, ফটক খুলে দিন।
এভাবে কোন প্রকার খুন-খারাবী ছাড়াই মায়েদা শহর তারেক ইবনে যিয়াদের হস্তগত হলো।
এ শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে লোক নিয়োগ করে তারেক ইবনে যিয়াদ সম্মুখ শহরের দিকে অগ্রসর হলেন। সে শহর কোন প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া তার হাতে এলো।
তারেক ইবনে যিয়াদ ফৌজকে কিছুদিন বিশ্রাম দানের সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ঐ সকল তুহফা আমার সম্মুখে নিয়ে এসো যা এ পর্যন্ত একত্রিত করা হয়েছে।
তার সম্মুখে তাৎক্ষণিকভাবে তা উপস্থিত করা হলো। তার মাঝে সবই মূল্যবান জিনিস ছিল সবচেয়ে মূল্যবান ছিল ঐ টেবিল যা হযরত সুলায়মান (আ)-এর বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।
তারেক খুশীর আতিশয্যে বললেন, এটা আমিআমীরুল মু’মিনীন এর কাছে তুহফা হিসেবে পেশ করব।
“আমীরুল মু’মিনীনের জন্যে সবচেয়ে কিমতি ও খুব সুরত তুহফাতো হলো উলুস।” এক সালার বলল,
তারেক : স্পেন তো আমি আল্লাহর দরবারে পেশ করে দিয়েছি। এ মুলক আল্লাহর রাসূলের জন্যে। কে জানে কোন সময় দুশমনের একটা তীর আমাকে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে দেবে।
তারপর তারেক তুহফা ভাগ করতে লাগলেন, “এগুলো আমীরে মুসা ইবনে নুসাইরের জন্যে আর এগুলো আমীরুল মু’মিনীন এর সম্মানে পেশ করব।
***
যখন তারেক তার সৈন্য বাহিনীকে বিশ্রাম দিচ্ছেন তখন মেরীদাতে আব্দুল আজীজ তার পিতা মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে রিপোর্ট পেশ করছে, সে কিভাবে বিদ্রোহ দমন করল এবং কতজন বিদ্রোহীর গর্দান উড়িয়েছে।
আব্দুল আজীজ : আর এ কাজের পিছনে রয়েছে ইঞ্জেলার পূর্ণ অবদান। সে নাহলে বিদ্রোহের খবর আমরা তখন পেতাম যখন বিদ্রোহীরা তামাম বড় বড় শহর : দখল করে নিত। তারপর সে ইঞ্জেলা ও বিদ্রোহীদের বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করল।
ইঞ্জেলা; এখন বুঝতে পারলে তো কেন আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করিনি। নিজ ধর্মে থাকার দরুনই তারা আমার জালে ধরা দিয়েছে। তানাহলে তারা আমার কাছে আসত না। সুতরাং আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করতে আর কখনো বলবে না। আর সবচেয়ে জরুরী কথা হলো ইহুদীদেরকে বিশ্বাস করা ছেড়ে দাও। তারা বাহ্যিকভাবে তারেক ইবনে যেয়াদকে যে সাহায্য করেছে তা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে করেছে। তারা চেয়েছিল রডারিকের বাদশাহী খতম করতে তাতে তারা কামিয়াব হয়েছে এখন তারা চেষ্টা করছে, যাতে তোমার বাদশাহী কায়েমই না হয়।
আব্দুল আজীজ মুসাকে বলল, তারেক ইবনে যিয়াদকে সতর্ক করে দেয়া দরকার সে এখনও ইহুদীদেরকে দোস্ত, জ্ঞান করছে। সে একা রয়েছে, কোথায় কোন বিপদে পড়ে বলা যায় না।
মুসা গর্জে উঠে বললেন, “তারেককে আমি কি সতর্ক করব। সে অবাধ্য, নাফরমান। থোকায় পড়বে, বিপদের সম্মুখীন হবে তখন বুঝবে। তাকে আমি বলেছিলাম যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করো কিন্তু সে তা অমান্য করে সামনে অগ্রসর হয়েছে। এখন সংবাদ পেলাম সে টলেডো ছেড়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে।
আব্দুল আজীজ : টলেডো থেকে কি কেউ এসেছে?
মুসা : তাকে টলেডোতে অবস্থান করতে বলে কাসেদ পাঠিয়ে ছিলাম কিন্তু কাসেদ যাবার তিন দিন পূর্বেই সে রওনা হয়ে গেছে। গত রাত্রে কাসেদ ফিরে এসেছে। সে যে রাস্তা দিয়ে গেছে তা খুবই বিপদাপন্ন। আমি তার কাছে পয়গাম পাঠাচ্ছি যেন সে টলেডোতে এসে সাক্ষাৎ করে।
আব্দুল আজীজ : পয়গাম কোথায় পাঠাচ্ছেন? কাসেদ তাকে কোথায় পাবে।
মুসা : সে যে জলাভূমি দিয়ে গেছে তার সম্মুখে মায়েদা নামে এক শহর রয়েছে। কাসেদ নিরাপদ রাস্তা দিয়ে যাবে। আমার সম্মুখে তারেকের উপস্থিতি খুবই জরুরী। আমি তাকে লাগাম লাগাতে চাই।
আব্দুল আজীজ মুসাকে রাগান্বিত দেখে বলল, সম্মানিত বাবা! তারেককে শাস্তি দিতে গেয়ে আপনাকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে ইতিমধ্যেই সে স্পেন বিজয়ীর মর্যাদা অর্জন করেছে এবং স্পেনের ভবিষ্যৎ আমির সেই হবে।
মুসা : তাকেই আমি স্পেন বিজয়ী মনে করি। তবে তার মত অবাধ্যকে আমীর নিযুক্ত করব না।
আব্দুল আজীজ; আমার মনে হয় তারেক আপনার গোলাম ছিল এজন্যে তার প্রতি আপনার খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
মুসা : না, বেটা! নিজের আজাদকৃত গোলামকে তুচ্ছ জ্ঞান করা ইসলামের পরিপন্থি। আমি ইসলামের কোন বিধানের পরিপন্থি চলার দুঃসাহস করতে পারি না। হযরত আবু বকরের ইন্তেকালের কিছু দিন পূর্বে আমার জন্ম। হযরত উমরের পূর্ণ খিলাফত কাল প্রত্যক্ষ করেছি যা এখনও আমার পূর্ণমাত্র স্মরণ রয়েছে। আমি ঐসব খলীফাদের নকশে কদমে চলতে চাই। তুমি হয়তো শুনেছ যে হযরত উমর (রা) খালীদ ইবনে ওয়ালীদকে সিপাহ্ সালার পদ হতে বিচ্যুত করে ছিলেন। তুমি কি জান ইবনে ওয়ালীদ কত বড় সিপাহ্ সালার ছিলেন?
আব্দুল আজীজ : হ্যাঁ ওয়ালেদে মুহতারাম! তা জানি। তাকে রাসূল (স) সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহর তরবারী বলেছিলেন। রাসূল (স) এর ইন্তেকালের পর ধর্মান্তরিত হবার ফেস্তা ব্যাপকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ছিল, খালেদ তা দমন করে ছিলেন। আপনি তারেককে সাজা দিতে পারেন তাই বলে স্পেনের সর্ব প্রথম আমীর হবার অধিকার হতে তাকে বঞ্চিত করতে পারেন না।
ইঞ্জেলা : তুমি কি চুপ করতে পারছ না। তোমার বাবা সালারে আলা। স্পেনে কাকে আমীর নিযুক্ত করতে হবে তিনি তা ভাল জানেন। তারেক হয়তো ভাল সিপাহসালার এবং বাস্তবেও তাই। কারণ রডারিকের মত বাদশাহকে পরাজিত করা চারটি খানি কথা নয়। কিন্তু তার মাঝে আমীরের গুণাবলী নেই। আমীরের গুণাগুণ তোমার মাঝে রয়েছে।
“আমার মাঝে!” আব্দুল আজীজ আশ্চর্য হয়ে বলল,
ইঞ্জেলা : হ্যাঁ! স্পেনের আমীর হবার গুণাবলী, তোমার মাঝে পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে। তুমি এক মহৎ ব্যক্তির সন্তান। তিনি তোমাকে তোমার যোগ্যতানুসারে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরী করেছেন।
ঐ রাত্রে আব্দুল আজীজ-ইঞ্জেলা যখন শয়ন করতে গেল তখন আব্দুল আজীজ, মুসার সাথে যে কথা হচ্ছিল তা উঠাল।
আব্দুল আজীজ : ইঞ্জেলা! আমি তারেক ইবনে যিয়াদের বিরুদ্ধে কোন কথা সহ্য করতে পারি না। তুমি এখনো তাকে গোলাম মনে করছ আর আমাকে তার চেয়ে উত্তম জ্ঞান করছ।
ইঞ্জেলা কেবল সুন্দরীই ছিল না বরং বিজ্ঞ এক যাদুকর ছিল। সে খুব ভাল করে জানত কার কাছে কোন সময় কোন কথা বলতে হবে।
ইঞ্জেলা আব্দুল আজীজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি অন্তর থেকে তারেকের বিরোধী নই। তুমি তাকে যে পরিমাণ সম্মান কর আমিও সে পরিমাণ করি। তবে তোমার সম্মুখে তার তারীফ করতে ভয় হয় যে তুমি সন্দেহে পড়ে যাও যে, তোমার চেয়ে আমি তারেককে বেশী পছন্দ করি।
ইঞ্জেলার নরম শরীর, মধুময় হাসির যাদুতে কিছুক্ষণের মাঝেই আব্দুল আজীজ যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়ল।
বেশ কিছুক্ষণ নানা কথা-বার্তা বলার পর ইঞ্জেলা বলল,
লক্ষ্য রেখো! তোমার পিতা,যদি স্পেনের আমির তোমাকে বানানোর ফায়সালা করে তাহলে তারেক হকদার” একথা বলে এড়িয়ে যেও না। আমি তোমাকে স্পেনের শাহী তখতে আসনাসীন দেখতে চাই।
“তুমি যা বলতে চাও তাই হবে ইঞ্জেলা।” আব্দুল আজীজ আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলল।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে টলেডোতে আসার জন্যে পয়গামসহ কাসেদ পাঠিয়ে ছিলেন।
একদা বিকেলে ইলো আব্দুল আজীজের সাথে গল্প করছে এমন সময় এক খাদেমা এসে ইঞ্জেলাকে সংবাদ দিল তার এক পুরাতন খাদেমা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে।
ইঞ্জেলা : তার নাম কি?
খাদেমা : নাম বলেনি। বলছে যদি নাম বলি তাহলে তিনি আমার সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। আর তিনি আমার সাথে সাক্ষাৎ না করলে তার ভীষণ ক্ষতি হবে।
ইঞ্জেলী : ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
কিছুক্ষণ পরেই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক সুন্দরী মহিলা ভেতরে এসে ইঞ্জেলার প্রতি ঝুঁকে সালাম জানাল।
ইঞ্জেলা : ও তুমি! নাদিয়া তুমি কি মনে কর যে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি? তুমি কি আমার খাদেমাকে বলেছ যে আমি যদি তোমার সাথে মুলাকাত না করি তাহলে আমার ক্ষতি হবে? আমার কি ক্ষতি হবে?
নাদিয়া : আমি ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে আসিনি মালেকা! এসেছি আমার বিশ্বস্ততা : প্রমাণ করার জন্যে। যদি ইজত, দেন তো কিছু বলি।
আব্দুল আজীজ : সে কি অন্যায় করেছে ইঞ্জেলা?
রডারিকের মৃত্যুর পর আমি রাজিলীর সাথে মেরীদাতে চলে এসেছিলাম। রাজিলী আমাকে পাওয়ার জন্যে পাগল পারা হয়ে উঠেছিল। একদিন রাত্রে আমি তার কামরায় যাওয়ার জন্যে বের হচ্ছি এমন সময় আমার এক খাদেমা বলল, নাদিয়া বেশ অনেক ক্ষণ ধরে রাজিলীর কামরাতে গেছে। তারপর নাদিয়াকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাজিলীর সাথে অসংলগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। তারপর তাকে আমি বলেছিলাম মহল হতে বের হয়ে যেতে এবং বলেছিলাম এ শহরে যেন আর কোনদিন আমার সাথে সাক্ষাৎ না হয়।
আব্দুল আজীজ : যা হবার তো হয়েছে, এখন তাকে জিজ্ঞেস কর সে কেন এসেছে এবং তার কি বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে এসেছে।
ইঞ্জেলা : ঠিক আছে, বসে বললো, কি পেশ করবার জন্যে এসেছ?
নাদিয়া : ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে এখানে আসিনি। এ আবেদনও করব না যে পুনরায় আমাকে খেদমতে রাখুন। আমি যে একেবারে নিরাপরাধ ছিলাম তাও বলছি না। বরং আপনি আমাকে যে মর্যাদা দান করেছিলেন তার জন্যে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।
আব্দুল আজীজ : এখন কেন এসেছ? তা বল।
নাদিয়া : মালেকা ইঞ্জেলাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে আর তার জন্যে আমাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিভাবে হচ্ছে তা আপনি শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন।
আব্দুল আজীজ : ধীরে সুস্থে তুমি বর্ণনা কর, আমরা তা শ্রবণ করব।
নাদিয়াঃ আমি মেরীদা হতে একটু দূরে একটা গ্রামে থাকি। সেখানে এক বড় জমিদারের ঘরে তার বাচ্চাকে দেখা-শুনা করি। ঐ জমিদারকে বলেছিলাম আমি.. রানী ইঞ্জেলার খাছ খাদেমা ছিলাম। একদিন জমিদার বললেন, তুমি আমার সাথে চল, তোমাকে এক যাদু করের কাছে নিয়ে যাব সে তোমার ভাগ্য পরিবর্তন করে দিবে ফলে তুমি পুনরায় রাজদরবারের কর্ম ফিরে পাবে। আমি তার সাথে গেলাম। যাদুকর ঐ গ্রামেই থাকত। সেখানে নতুন এসেছে। ইতিপূর্বে তাকে আমি দেখিনি। যাদুকর আমাকে তার সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কি চাই। আমি তাকে বললাম, আমি স্পেন রানীর খাছ খাদেমা ছিলাম। আমার ভুলের কারণে বের করে দিয়েছে,আমি চাই তিনি যেন আমাকে পুনরায় তার নকরীতে বহাল করেন।
আমার এ বাসনা আমি নিজের অন্তরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কাউকে বলিনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না আমার ঐ জমিদার মুনিব নিজ থেকে কেন আমার প্রতি এত সহানুভূতিশীল হলেন এবং নিজেই আমাকে যাদুকরের কাছে নিয়ে গেলেন।
যাদুকর আমাকে তার সামনে বসিয়ে তার আমল শুরু করে বলল, এটা এমন আমূল যা উল্টা করা যায়। সে তার আংটি আমার মাথার ওপর ঘুরাতে লাগল। আমাকে বলল, মালেকা ইঞ্জেলার তাসবীর সামনে এনে তার চোখে চোখ রাখার জন্যে। তারপর সে আমাকে বলল, এ বাক্যগুলো যেন বারবার বলতে থাকি তা হলো, “এ আওরাত আমার দুশমন, তাকে আমি ঘৃণা করি। সে যদি আমার সামনে আসে তাহলে তাকেগলা টিপে ধরব।” আমিএমনটি করতে লাগলাম। তারপর আমার তন্দ্রা ভাব এসে গেলে আমি মালেকার তাসবীর চোখের সামনে দেখতে পেলাম এবং পরিস্থিতি এমন হলো যেন সত্যিই মালেকা আমার দুশমন, তাকে পেলে আমি হত্যা করব। আমল শেষ হলে সে আমাকে বলল, এর দ্বারা মালেকার সাথে তোমার মহব্বত পয়দা হবে এবং তিনি নিজে এখানে এসে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। এ আমল পাঁচ-ছয়দিন করতে হবে। তুমি প্রতিদিন রাত্রে আমার কাছে আসবে। সেদিনের মত আমার মুনিবের সাথে ফিরে এলাম। পরের দিন রাত্রে আমরা তার কাছে গেলে সে একই আমল করে বিদায় দিল।
তৃতীয় দিন রাত্রে নির্ধারিত সময় যাদু করের কাছে গেলাম। সেখানে গিয়ে বেশ কিছু পরিচিত লোক দেখতে পেলাম। আমি পাশের কামরাতে চলে গেলে তারা আলাপ শুরু করল। তাদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা ইবরানী ভাষায় কথা বলছিল। তাদের হয়তো ধারনা ছিল আমি ইবরানী ভাষা বুঝি না তাই তারা বেশ উঁচু স্বরে কথা বলছিল। মালেকা তো জানেন আমি ইবরানী ভাষা ভাল করে বুঝি ও বলতে পারি।
তারা তো অনেক আলাপ-আলোচনা করল কিন্তু মূলকথা যেটা বলার জন্যে এখানে এসেছি। আমার মুনিব জিজ্ঞেস করল, কতদিনের মাঝে মূল কাজ হবে? যাদুকর জবাব দিল সাত-আট দিনের মাঝে কাজ হয়ে যাবে। আরেকজন জিজ্ঞেস করল এ লাড়কী দ্বারা কাজ হবে তো? যাদুকর বলল,এর দ্বারাই কাজ হবে। মাত্র দুটি দিন আমল করেছি তাই তার কিছু ফল পাওয়া শুরু হয়ে গেছে। অপর জন। জিজ্ঞেস করল,
মূল কাজ কিভাবে হবে? যাদুকর বলল, আপনাদেরকে প্রথমে যে ভাবে– বলেছিলাম সেভাবেই হবে। অর্থাৎ এ মহিলা ইঞ্জেলার কাছে গিয়ে তাকে গলাটিপে হত্যা করবে। একজন জিজ্ঞেস করল, যদি পাকড়াও হয় তাহলে তো সর সে বলে দেবে। যাদুকর বলল, তার বোধ শক্তি থাকবে না সে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবে ফলে তার কাছে যেই আসবে তাকেই সে কতল করতে যাবে তাই তাকে পাকড়াও করে হত্যা করা হবে।
তাদের একজন বলল, আমরা এটাই ভাল করে জানতে এসেছি। আমার মুনিব বলল, ইঞ্জেলার মত রমণীর জীবিত থাকা আদৌ উচিত নয়। সেই আমাদের নেতৃস্থানীয় ও প্রধান প্রধান ব্যক্তিদেরকে কতল করিয়েছে।
যাদুকর : আমি তোমাদের কাছে খামাখা আসিনি বরং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে এসেছি। ইহুদীরা এ মুলকে নিজেদের সম্মান ফিরে পেয়েছিল। মুসলমানরা তাদেরকে জায়গীরদান করেছিল। এখন সব কিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব করেছে শয়তান ইঞ্জেল। ঐ বদবখত জানেনা যে ইহুদীরা জমিনের নিচ থেকে মূল কর্তন করে।
আমরা কামিয়াব হবে এবং এখানে পুনরায় খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন এক আওরত পেয়েছি যে কোন প্রকার বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই ইঞ্জেলার কাছে পৌঁছতে পারবে।
গোস্বায় আব্দুল আজীজের চেহারায় রক্ত চড়ে গেল। ইঞ্জেলা কাঁপতে লাগল।
আব্দুল আজীজ : তারপর কি হলো? তাড়াতাড়ি বল, আমরা তোমাকে ইনয়ামে ভূষিত করব।
নাদিয়া : আমার শরীর কাঁপতে ছিল। মনে মনে ভাবতে ছিলাম পালিয়ে যাই কিন্তু চিন্তে করলাম আমি পালিয়ে গেলে তারাও সরে পড়বে। তাই বসে রইলাম! যাদুকর এসে প্রতিদিনের ন্যায় আমল শুরু করল। মালেকার তাসবীর আনতে বলল কিন্তু তা আমি আনলামনা। মুখে কেবল ঐ শব্দগুলো উচ্চারণ করলাম এবং নিজেকে পূর্ণ মাত্রায় স্থির রাখলাম। তারপর আমল শেষ হলো…
এটা গত রাতের ঘটনা। সকালে আমার মনিবের কাছে শহরে আসার অনুমতি প্রার্থনা করলাম। তিনি কোচওয়ানসহ ঘোড়া দিয়ে দিলেন। আমি কোচওয়ানকে শহরের প্রধান ফটক হতেই বিদায় করে দিয়েছি। তাকে বলেছি আমি একাই সন্ধ্যায় ফিরে যাব। কোচওয়ানকে আরো বলেছি প্রতিদিন যেখানে যাই সে সময়ের পূর্বেই আমি পৌঁছব এবং সেখানে যাব।
আপনাদের দু’জনকে এ সংবাদ দেয়ার জন্যেই আমি এসেছি। আমি মালেক কে এ অনুরোধ করব না যে তিনি আমাকে পূর্বের ন্যায় তার খিদমতে নিয়োজিত করুন। মালেকার প্রতি মহব্বত ও ভালবাসার টানে এখানে এসেছি।
মালেকা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমি যে অন্যায় করে ছিলাম ইচ্ছে করলে তিনি আমাকে হত্যা করতে পারতেন তাকে কেউ জিজ্ঞেস করত না। কিন্তু তিনি তা করেননি বরং নিরাপদে কেবল চলে যেতে বলেছেন। তার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রয়েছে তা কোনদিনও শেষ হবে না এবং তা বিন্দুমাত্র কমবেও না। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।
আব্দুল আজীজ : তুমি সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে যাও। সে গ্রামের রাস্তা ভাল করে বলে যাও। তুমি তোমার মুনিবের সাথে যাদু করের কাছে পৌঁছে যাবে বাকী কাজ আমাদের।
ইঞ্জেলা : নাদিয়া! তুমি তোমার ভালবাসা মহব্বতের দায়িত্বপালন করেছ। আমি আমার মহব্বতের দায়িত্ব পালন করব।
রাত্রে বেলা। নাদিয়া যাদুকরের সম্মুখে। যাদুকর তার যাদুর আমল করে চলেছে। পাশের কামরাতে নাদিয়ার মালিকসহ তিন-চারজন বসে আছে। দরজায় করাঘাত হলে এক ব্যক্তি দরজা খুলে দিল। সে দরজা খুলার সাথে সাথে বাঘ দেখার মত চমকে উঠে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু বাহির হতে দরজাতে এত জোরে ধাক্কা দেয়া হলো সে দরজা বন্ধ করতে ব্যর্থ হলো। বিশ পঁচিশ জন জানবাজ মুজাহিদ ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। পুরো গ্রাম অবরোধ করা হলো। এর নেতৃত্বে ছিল স্বয়ং আব্দুল আজীজ।
যাদুকরসহ ঘরে যেসব লোক ছিল সকলকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোককৈও তাদের সাথে পাকড়াও করা হলো। নাদিয়াকেও তাদের সাথে নিয়ে গেল যাতে তাকে সন্দেহ না হয়। তাদের সকলকে মেরীদাতে নিয়ে গিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। আব্দুল আজীজ আবুল হাসান নামে এক পুলিশ অফিসারের কাছে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করে যাদুকর ও নাদিয়ার মালিক থেকে তথ্য বের করার নির্দেশ দিল।
আবুল হাসান তাদেরকে বিশেষ কামরাতে নিয়ে নানা ধরনের শাস্তি ও জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য বের করার চেষ্টা করলেন। ইহুদী যাদুকর বাধ্য হয়ে তথ্য দিতে স্বীকার হলো এবং সে বলল, আমি সব কিছু সরাসরি আব্দুল আজীজের কাছে বলব, তাছাড়া তার সাথে আরো কিছু কথা রয়েছে।
পরের দিন সকালে যাদুকর আব্দুল আজীজের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বলল,
“আমি একজন ইহুদী ফলে আমি তাই করেছি যা একজন ইহুদীর করা দরকার ছিল। ইঞ্জেলাকে ইহুদী কওম কখনো ক্ষমা করতে পারে না। সে আমাদেরকে বিদ্রোহে উসকে দিয়ে আমাদের সকলকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছে। এজন্যে তাকে কতল করা আমাদের একান্ত দায়িত্ব ছিল। কিন্তু হত্যার জন্যে কেউ তৈরী হচ্ছিল না। কারণ তাকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝ থেকে কতল করা বড় দুস্কর ছিল। তাকে কতলের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল। আমার কাছে যাদুর হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। এ যাদু কার্যকর করার জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল যে কোন প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়া ইঞ্জেলার কাছে পৌঁছতে পারত।”
তারপর যাদুকর নাদিয়াকে কিভাবে পেল এবং তার মাধ্যমে কিরূপ যাদু করছিল তার বর্ণনা দিল।
যাদুকর : এখন আমার শাস্তি কি?
আব্দুল আজীজ : মৃত্যু দণ্ড।
যাদুকর : আমি যদি আপনাকে এমন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করি যদ্দরুন আপনি ভবিষ্যতের বিপদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন। তাহলে কি আমাকে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহায় দেবেন?
আব্দুল আজীজ : তুমি যদি এমন কিছু বলতে পার যা আমার এবং স্পেন সালতানাতের উপকার হবে তাহলে হয়তো বাঁচতে পার।
যাদুকর : আমাকে যদি মৃত্যুর হাত থেকে নিস্কৃতি দেয়া হয়, তাহলে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আপনার এবং আপনার সালতানাতের ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন কোন পদক্ষেপ নিব না যাতে সামান্যতম ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
আব্দুল আজীজ : ঠিক আছে বল!
যাদুকর : মুহতারাম সালার! প্রথম কথা হলো ইহুদীদের ওপর ভরসা করবেন না। কোন মুসলমানের জন্যেই কোন ইহুদীকে বিশ্বাস করা ঠিক না। এখানে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে যে সাহায্য করেছে তা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে করেছে। দ্বিতীয় কথা হলো, যে জমিনে আপনি আপনার হুকুমত প্রতিষ্ঠিত করবার এসেছেন, এটা একটা ষড়যন্ত্রপূর্ণ রাজ্য আর এর ইতিহাস রক্ত ঝরা ইতিহাস। ভবিষ্যতেও রক্ত ঝরবে।
আব্দুল আজীজ : এটা কোন নতুন কথা নয় বরং যে দেশে হামলা হয় সে দেশে কিছু খুন-খারাবী তো হবেই। একদল অপর দলকে কতল করে, হামলা করে।
যাদুকর : আমিএ হত্যা কান্ডের কথা বলছিনা, এদেশের অভ্যন্তরে যে খুন খারাবী, হয় তার কথা বলছি। রডারিক মারা গেছে তার পূর্বেও অনেক বাদশাহ্ হত্যা হয়েছে। সে সব হত্যা কাণ্ডের রহস্য এখনো উম্মোচিত হয়নি। আমি আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি নিজের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর কখনো কোন রমণীর মতকে প্রাধান্য দেবেন না। আপনি যাকে বিবাহ করেছেন সে খুবই সুন্দরী। সে যার প্রতি দৃষ্টি দেয় সেই তার গোলাম হয়ে যায়। কিন্তু তার সুন্দর নয়যুগল রক্ত চায়। সে রডারিকের বিবি হবার পর রডারিক মারা গেছে। বিদ্রোহীদের অনেকেই তার প্রতি ফেরেফত হয়েছিল তারা সকলেই মারা গেছে, এখন সে আপনার…
আব্দুল আজীজ : তুমি কি ইঞ্জেলার কথা বলছ?
যাদুকর : হ্যাঁ, আমি তার কথাই বলছি।
আব্দুল আজীজ : তুমি ইহুদী। মৃত্যুকে সম্মুখে দেখেও ষড়যন্ত্র ও থোকাবাজী– থেকে ফিরে আসনি;… তুমি কি জীবিত থাকতে চাও না?
যাদুকর : এ প্রশ্নই আমিও আপনাকে করি, আপনি কি জীবিত থাকতে চান না? আমি জানি আপনি কি জবাব দেবেন। আপনাকে বলছি, আপনার শির বেশীদিন আপনার শরীরে থাকবে না, ইঞ্জেলা জীবিত থাকবে। এটাও আপনাকে বলছি স্পেন মুসলমানদের হাতে আসবে ঠিক কিন্তু মুসলমানদের বাদশাহ্ একে অপরের হাতে জীবন দেবে। এ সত্য কথায় যদি আপনি দুঃখ পেয়ে থাকেন তাহলে আমাকে কতল করতে পারেন।
আব্দুল আজীজ :-আমাদের ধর্ম ইহুদীদের ভবিষ্যৎবাণী ও যাদুকে বিশ্বাস করে না। আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি।
যাদুকরঃ এটা ধর্মের কথা নয় সালার! আমি আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করাতে পারবনা, তবে আপনাকে সতর্ক করে দিলাম।
আব্দুল আজীজ মনে করল, এ ইহুদী ইঞ্জেলাকে তার হাতে কতল করাতে চাচ্ছে বা তালাক দিয়ে বিদায় করে দিতে বলছে তাই তাকেসহ খ্রীষ্টান জমিদার ও তার সাথীদেরকে কতল করার নির্দেশ দিল।
***
টলেডোতে ফিরে আসার জন্যে মুসার নির্দেশ সম্বলিত পয়গাম তারেক ইবনে যিয়াদের হাতে পৌঁছল তালবিয়া শহরে। তারেক যেন এ নির্দেশেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার অধিনত কয়েকজন সালারকে সাথে নিয়ে টলেডোর দিকে রওনা হলেন। তিনি গণিমতের যে সব মূল্যবান জিনিস খলীফা ও আমীরে মুসাকে দেয়ার জন্যে রেখেছিলেন তা নিয়ে আসছিলেন।
এখন তারেক সোজা-সরল রাস্তা দিয়ে অতিদ্রুত আসছেন, কয়েকদিনের মাঝেই তিনি টলেডো পৌঁছে গেলেন। তারেক শহরের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছিলেন এ সময় মুসাকে তার আগমনের সংবাদ দেয়া হলো। মুসা সঙ্গে সঙ্গে চাবুক হাতে বেরিয়ে এলেন।
তারেক মুসাকে দেখা মাত্র ঘোড়া থেকে নেমে মুসার দিকে দৌড় দিলেন। তিনি দুই হাত প্রসারিত করে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তার ধারণা ছিল স্পেন বিজয়ের কারণে মুসা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে ধন্যবাদ জানাবেন। কিন্তু দর্শকরা এক আশ্চর্যজনক অবস্থা প্রত্যক্ষ করল আর এ দৃশ্য ইতিহাস তার বুকে ধরে রাখল।
মুসা চামড়ার চাবুক বের করে প্রস্তুত করলেন, তারেক কাছে আসা মাত্র তার শরীরে সপাং সপাং করে আঘাত হানলেন।
তারেক নিষ্প্রাণ মূর্তির ন্যায় ‘থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন।
যেন গোটা পৃথিবী মুহূর্তের মাঝে স্থবির হয়ে গেল।
আশেপাশের বহুলোক এতক্ষণ আনন্দ করছিল হঠাৎ করে নিশ্চুপ হয়ে গেল। এমন নিরবতা ছেয়ে গেল যেন গাছের পাখি পর্যন্ত নড়া-চড়া বন্ধ করে দিল।
“নাফরমান!” মুসা ইবনে নুসাইর গর্জে উঠে বললেন, “আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যেখানে আছ সেখানে অবস্থান করতে, আর তুমি সারা মুলক বিজয়ের জন্যে সামনে অগ্রসর হয়ে চলেছ, আমার হুকুমের কোন পরওয়া করনি।” মুসা আরেকটি চাবুক মারলেন।
মুসা চাবুক মারছেন আর তারেক নিপ দাঁড়িয়ে তা সহ্য করে যাচ্ছেন। যেন নিষ্প্রাণ কাষ্ঠখণ্ডে আঘাত হানা হচ্ছে।
“আমি তোমাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করছি।” মুসা ফায়সালা শুনালেন, তারপর কাছে দাঁড়ান সালারদেরকে হুকুম দিলেন,একে কয়েদখানাতে রেখে আস। আমি তাকে আযাদ দেখতে চাই না।”
তৎক্ষণাৎ দু’জন সালার তাকে ধরে নিয়ে চলল
রাস্তাতে এক সালার বলল, “আমাদেরকে ক্ষমা কর ইবনে যিয়াদ। আমরা তো হুকুমের দাস।”
দ্বিতীয় সালার : এমনটি করা আমীরে মুসার ঠিক হয়নি।
পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করে তারেক বললেন, আমার বন্ধুরা! আমি আল্লাহর হুকুমের পাবন্দ। আমীরের অনুগত থাকার ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে, তানাহলে আমি যদি বর্বরদেরকে ইশারা করি তাহলে আরবীদের নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার আশংকা হচ্ছে, বর্বররা আমার এত বড় অপমান মেনে নেবে না। আমি যদি কয়েদখানাতে বন্দী থাকি তাহলে আমীরে মুসা এবং তোমাদের কেউ বর্বরদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
***
তারেক ইবনে যিয়াদ কেবল আশংকা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাস্তবে তা হতে যাচ্ছিল।
স্পেনে সকল ফৌজের মাঝে এ খবর মুহূর্তের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল, স্পেন। বিজেতা তারেক ইবনে যিয়াদকে আমীরে মুসা প্রকাশ্য জনসম্মুখে বেত্রাঘাত করেছেন।
কেন? সিপাহ্ সালার কি অন্যায় করেছে?
এ সওয়ালের জওয়াব কারো কাছে ছিল না। নানা ধরনের গুঞ্জন ফৌজের মাঝে হচ্ছিল। টলেডোর ফৌজের মাঝে প্রায় নব্বই ভাগ বর্বর ছিল। গোস্বায় ফেটে পড়ছিল। একে অপরকে বলতে লাগল যারা তালবিয়া চলে গেছে তাদের কাছে এ খবর পাঠান হোক।
অন্যান্য জেনারেলরা তারেককে কয়েদী অবস্থায় দেখতে পেলেন, তারা মূক হয়ে গেলেন। ভেবে পেলেন না কি করবেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ পরে কিভাবে মুক্তি পেলেন এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, স্পেনের সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে মুসা খলীফার কাছে দূত পাঠিয়ে ছিলেন। খলীফা সে দূতের মাধ্যমে তারেককে মুক্ত করে পুনরায় সিপাহসালার নিযুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। আর কেউ বলেছেন গোপনে তারেক নিজেই লোক পাঠিয়ে ছিলেন খলীফার কাছে। তবে এটা যুক্তিযুক্ত– মনে হয় না।
তবে বাস্তব ঘটনা হলো মুসাকে প্রকৃত বিষয়টা বুঝানো হয়ে ছিল যে, তারেককে কয়েদ করাতে বর্বররা ক্ষেপে উঠেছে, যে কোন মুহূর্তে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। তারা আপনার সমালোচনা শুরু করেছে। কোন আরবী সালার যদি তাদেরকে কিছু বলে তাহলে পরস্পরে লড়াই বেধে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। বর্বর মুজাহিদরা তারেককে নিজেদের মুর্শিদ মনে করে।
জুলিয়ন : আমিরে আফ্রিকা ও মিশর! আপনার ফায়সালাতে আমরা নাক গলাতে চাই না। তবে আমি এবং আওপাস যেভাবে আপনার ফৌজকে পথ প্রদর্শন করেছি এবং আওপাস যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইহুদী ও গোথাদেরকে রডারিকের বিরুদ্ধবাদী করে তুলেছে, তাতে আমরা আপনার ফায়সালার ওপর কথা বলতে পারি।
আওপাস : কাবেলে ইহতেরাম আমীর! যদি প্রকৃত যুদ্ধের ময়দানে কয়েক হাজার গোথা ওদিক থেকে তারেকের পক্ষে না এসে যেত, তাহলে রডারিকের সাথে যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতো। কিন্তু তার উদ্দেশ্য এ নয় যে লড়াই এ গোথারা বিজেতা। বিজয় অবশ্যই তারেকের বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসীকতার ফল। তারেকের জায়গায় যদি অন্যকোন কমজোর জেনারেল হতো আর তারচেয়েও যদি কয়েকগুণ বেশী গোথা এসে মিলিত হতো তবুও রডারিককে পরাজিত করতে পারত না। রডারিকের মত বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ জেনারেলকে কেবল তারেকই পরাজিত করতে পেরেছে।
জুলিয়ন : এমন মূল্যবান ব্যক্তিকে আপনি ধ্বংস করবেন না।
সালার মুগীছে রুমী : আমীরে মুহতারাম! বর্বরদের পক্ষ হতে পূর্ণ বিপদের আশংকা রয়েছে। আপনি হয়তো সংবাদ পেয়েছেন কিন্তু তা পূর্ণ সংবাদ নয়। আমি জানি বর্বরা কত কঠিন। তাদেরকে আমি পরিচালনা করেছি। তারা মুখেই শুধু কথা বলে না বরং কাজ করে দেখায়। তারা যদি বাস্তবেই বিদ্রোহ করে বসে তাহলে তখন বুঝা যাবে তারা কত কঠিন। তারা বিদ্রোহ করলে স্পেনীরা তাদের সাথে। মিলবে ফলে পরস্পরে লড়াই শুরু হবে যার পরিণাম হবে, আমরাও থাকতে পারব না বর্বররাও না। তখন হাতের মুটোতে আসা স্পেন হবে হাত ছাড়া। আমি চুপে চুপে তাদের কথা-বার্তা শুনেছি। তারেককে যদি মুক্ত না করা হয় তাহলে তারা ময়দানে নেমে আসবে।
সালার আবু জুরয়া তুরাইফ বললেন, আমি আপনাকে বলতে চাই, তারেক কেন আপনার হুকুম মানেননি।
মুসা : সেটা তোমাদের কাছে নয় তা স্বয়ং তারেকের মুখে শুনব। তোমরা যে আশংকার কথা বলছ, তোমরা কি মনে করছ তা আমি জানি না। তোমরা কি জান না যে ইসলাম আমীরের নির্দেশ অমান্যকারীকে ক্ষমা করে না। তোমরা কি আমাকে আহমক মনে করছ যে, আমি তারেকের বিজয় ধুলিম্বা করে দেব আর তার কৃতিত্ব আমার নামে লিপিবদ্ধ করাব? আল্লাহ্ ভাল জানেন কে কি করেছে।
আমার কর্ম মানুষকে দেখাতে চাই না। আমার কর্মফল আল্লাহর দরবারে পেশ করতে চাই। তারেককে আজকের দিবা-রজনী কয়েদ খানায় থাকতে দাও। কাল সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। আমাদেরকে আরো সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। সম্মুখে ফ্রান্স। জানতে পেরেছি, সেখানের সৈন্য স্পেনের চেয়েও বেশী লড়াকু।
মুগীছে রূমী : এ দিবা-রজনী বর্বরদেরকে কিভাবে শান্ত রাখা যায়?
মুসা : তাদেরকে বল, বরং পূর্ণ মাত্রায় ঘোষণা করে দাও, তারেকের মুক্তি বা শাস্তির ফায়সালা আগামীকাল হবে।
ফৌজের মাঝে যখন এ ঘোষণা করা হলো তখন তারা শ্লোগান দিতে লাগল
“আমরা তারেকের মুক্তি চাই।”
“আমরা তারেকের সাথে এসেছিলাম, তারেকের সাথেই ফিরে যাব।”
“তারেক যেখানে আমরা সেখানে যেতে চাই।”
“আমরা কিন্তী জ্বালিয়ে এসেছি, স্পেনে আগুন জ্বালিয়ে ফিরে যাব।”
“তারেক নেই তো আমরাও নেই।”
বর্বরদের এ শ্লোগান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করা হলো।’
পরের দিন সকালে পায়ে বেড়ি, হাতে শিকল পরা অবস্থায় তারেককে মুসার সামনে উপস্থিত করা হলো। মুসা আগে তার হাত-পায়ের বেড়ি খুলে দেয়ার হুকুম দিলেন।
বেড়ি খোলর পর মুসা তারেককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার হুকুম অমান কেন করেছিলো।
সেখানে চারজন জেনারেল, জুলিয়ন ও আওপাস উপস্থিত ছিল।
তারেক : আমার সাথীরা এখানে উপস্থিত রয়েছে তাই অন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে না। যে সময় আপনার হুকুম আমার হাতে পৌঁছে, তখন স্পেন ফৌজ আমাদের হাতে পরাজিত হয়ে পলায়ন করছিল। স্পেনের ফৌজের অর্ধেকের বেশী কতল হয়ে ময়দানে পড়েছিল। এখানের বাদশাহ্ রডারিক হয়েছিল নিহত। বাকী ফৌজরা আশ-পাশের শহর পল্লীতে আশ্রয় নিচ্ছিল। এ অবস্থায় আমি আমার সালারদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এ পরিস্থিতিতে আমীরের হুকুম আমাদের জন্যে মানা উচিৎ কিনা? তারা সকলেই ফায়সালা দিল, এখন তাদের যদি পশ্চাৎ ধাবন না করা হয়, তাহলে তারা বিভিন্ন কেল্লাতে গিয়ে আবার প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। আমি তাদেরকে স্বস্তিতে একত্রিত হবার সুযোগ দিতে চাইনি। আমার সাথীরা সকলে এমন পরামর্শই দিয়েছে। জুলিয়ন এর প্রতিই বেশী তাগিদ দিয়েছেন, আমিও সামনে অগ্রসর হওয়াকেই ভাল মনে করেছি। তার দ্বারা যে ফায়দা হাসিল করেছি তাহলো, স্পেনের রাজধানী আমি আপনার সমীপে পেশ করছি। আপনি আমাকে মওকা দিলে এটাই প্রথমে করতাম কিন্তু আপনি আমাকে আগে চাবুক মারা জরুরী মনে, করেছেন।
মুসা : তুমি যে ফায়দা হাসিল করেছ তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমি তোমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তোমার ভুল, তুমি আমাকে অবগত করনি যে, এ জন্যে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আমাকে অবহিত করলে তোমার জন্যে সাহায্য পাঠাতাম। কিন্তু পরিণামে নিজে আমাকে আসতে হয়েছে। আমি আশংকা করেছিলাম স্পৃহা উদ্দীপনা নিয়ে অগ্রসর হতে হতেএমন বিপদের সম্মুখীন হবে যে, তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া তোমার জন্যে অসম্ভব হবে।
জুলিয়ন : ইবনে নুসাইর! ইবনে যিয়াদ যে বক্তব্য পেশ করল তা পূর্ণ মাত্রায় সত্য। আমি তাকে বলেছিলাম যদি আমীরে আফ্রিকা নারাজ হয় তাহলে আমি তাকে বুঝিয়ে ঠিক করব। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে ছিল, যে আপনাকে অবগত করার কথা আমাদের কারো মনে আসেনি। আমরা সকলে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
মুসা : মার্জনাকারী আল্লাহ্! তাকে যে বেত্রাঘাত আমি করেছি তার অর্থই হচ্ছে, তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি জানো জুলিয়ন। ইসলামের বিধান বড় কঠিন। তুমি হয়তো অবগত আছে যে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাদশাহী ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুর্মার করে দিয়েছিলেন। ইসলামী সালতানাতকে তিনি যে বিস্তৃতা দান করেছেন পৃথিবীর দ্বিতীয় আর কেউ এমনটি করেনি তার পরও সামান্যতম কারণে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর তাকে পদচ্যুত করেছিলেন। এমন বড় সিপাহ্ সালারদের বড় ভুল-ভ্রান্তিও রাজা-বাদশাহরা ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু ইসলামের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এ ধরনের আরো কিছু কথা-বার্তা হলো, তারেক তার স্বপক্ষে আর কোন কথা বললেন না। মুসা তারেককে আরো কিছু বলে ক্ষমা করে দিলেন। তারেক তো মুসাকে কেবল আমীরই নয় বরং নিজের পিতা জ্ঞান করতেন এ কারণে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মুসার হস্তদ্বয় ধারণ করে, চুমু খেলেন। নয়ন যুগল দিয়ে অজর ধারে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু ধারা।
মুসা : তারেক ইবনে যিয়াদ! একদিন আসবে যেদিন তোমার কবরে হাড় হাড়ি মাটিতে মিশে যাবে, তোমার কবরও হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কিন্তু ধরাতলে যতদিন স্পেন থাকবে ততদিন তোমার নাম জিন্দা থাকবে।
এরপর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মুসার ভেতর এমন পরিবর্তন এলো যেন তারেক তার ঔরসজাত সন্তান।
তারেককে ক্ষমার পর স্পেনের যেসব এলাকা তখনও বিজয় হয়নি সেদিকে অগ্রসর হবার প্লান তৈরী করতে লাগলেন।
তারেক : সম্মানিত আমীর! আমাকে সুযোগ দিলে এখানের গুরুত্বপূর্ণ হাদিয়া আপনার খেদমতে পেশ করতে পারি।– মুসার অনুমতিতে তারেক হাদিয়ার জিনিসপত্র উপস্থিত করতে বললেন। মূল্যবান জিনিসপত্র দেখে মুসার চক্ষু বিস্ফোরিত হয়ে গেল। অধিকাংশ জিনিস ছিল স্বর্ণের তার মাঝে ছিল মুক্তা খচিত। এমন মূল্যবান দুর্লভ জিনিস কেবল বাদশাহর দরবারেই থাকে।
তারেক জিনিস পত্র দেখিয়ে দেখিয়ে বলছিলেন এটা আপনার আর এটা আমীরুল মুমিনীনের জন্যে। পরিশেষে তারেক ঐ টেবিল পেশ করলেন যা নিয়ে পাদ্রীরা পলায়ন করছিল।
তারেক বললেন, এ টেবিলের ব্যাপারে কিছু আশ্চর্যজনক কথা শুনেছি, তার মাঝে এক নম্বর কথা হলো, কোন জামানায় এক বাদশাহ্ জেরুজালেমে হামলা করে ছিল সে এ টেবিল সেখানে প্রধান উপাসনালয়ে পেয়েছে। দ্বিতীয় কথা হলো, এটা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর রাজত্বের তৃতীয় আশ্চর্য কথা হলো, পাদ্রীরা বলেছে, যে বাদশাহ্ এ টেবিলের মালিকত্বের দাবী করবে তার পতন হবে খুব ভয়াবহ। তার মৃত্যু হবে অত্যন্ত করুন ও লাঞ্ছনাদায়কভাবে।
টেবিলটা ভালভাবে পরখ করে মুসা বললেন,এর মাঝে আমিএকটা জিনিস আশ্চর্য দেখতে পারছি তাহলো এর পায়া তিনটি একটা পায়া নেই।
তারেক : তার পায়াগুলো খুলে লাগান যায় হয়তো কোন বাদশাহ্ তা খুলে বিনষ্ট করে ফেলেছেন।
সকলে দেখলেন যে টেবিলের একটা পায়া নেই। কিন্তু ইতিপূর্বে যারা দেখে ছিলেন তারা সকলেই তার চারটি পায়া দেখেছিলেন কিন্তু এ প্রশ্ন এখন কেউ করলেন না যে ইতিপূর্বে এর চারটি পায়াই ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে না কেন?
মুসা : এর সাথে আমি চতুর্থ পায়াটি সংযোজন করব। তার সাথে যে পাথর ও হিরামতি সংযোজিত রয়েছে তা তো আর পাওয়া যাবে না তাই স্বর্ণ দ্বারা তৈরী করা হবে চতুর্থ পায়। এটা আমি আমীরুল মুমিনীনের দরবারে পেশ করব। একজন স্বর্ণকারকে ডাক সে যেন অন্য পায়াগুলোর ন্যায় একটা পায়া বানিয়ে দেয়।
মালে গণীমতের মাঝে সোনা-রূপার কোন অভাব ছিল না। একজন স্বর্ণকারকে ডেকে তা দেখান হলে, কয়েকদিনের মাঝে চতুর্থ পায়া তৈরি করে লাগান হলো।
***
কয়েকদিন পর মুজাহিদ বাহিনী স্পেনের একটি শহর আরাগুনের দিকে রওনা হলো। এ বাহিনীর দু’জন কমান্ডার, মুসা ইবনে নুসাইর ও তারেক ইবনে যিয়াদ। মুসা জীবনের শেষ প্রান্তে আর তারেক যৌবনের আখিরী প্রান্তে। কিন্তু স্পৃহা উদ্দীপনায়, দুজনই ছিলেন টগবগে যুবা। তারা যে রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তা ছিল অতি-সংকটময়। প্রকৃত অর্থে তা ছিল প্রশস্ত একটা উপত্যকা।
তারা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তা ছিল তারেক যে ভয়াবহ জলাভূমি দিয়ে মেরীদা গিয়েছিলেন তার মত কঠিন ও খুবই ভয়াবহ। তাতে ছিল উঁচু নিচু টিলা। সম্মুখে ছিল অসংখ্য নদী-নালা।
তারেক যেমন জলাভূমিতে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হয়ে ছিলেন এ মুজাহিদ বাহিনীও কঠিন বিপদের সম্মুখীন হলেন। নদী পার হতে গিয়ে কয়েকজন মুজাহিদ পানির নিচে তলিয়ে গেল। কয়েকজন মুজাহিদ কাদাতে কোমর পর্যন্ত পুঁতে গেল। রশির সাহায্যে তাদেরকে উদ্ধার করা হল। এসব প্রতিকুলতা তো ছিলই তার পর শুরু হয়েছিল পূর্ণ দিবা-রজনী প্রবল বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া। গাছের ডাল-পালা ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছিল। বৃক্ষরাজি উপড়ে পড়ছিল। এর সাথে ছিল বিকট বজ্র নিনাদ, যাতে ছিল মৃত্যুর প্রবল আশংকা। মুজাহিদরা পাহাড়ের পাদদেশে লুকিয়ে জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করছিলেন। খচ্চর-ঘোড়া চিৎকার করে আওয়াজ করতে ছিল। কি পরিমাণ বিপদের সম্মুখীন তারা হয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়।
নদী-নালা ভরে টইটম্বুর হয়ে গেল। পাহাড়ের টিলা দিয়ে বর্শা বয়ে চলল, এ পরিস্থিতিতেও মুসা ও তারেক চুপ-চাপ বসেছিলেন না তারা ঘোড়াতে মোয়র হয়ে মুজাহিদদের খোঁজ-খবর নিতে ছিলেন। তাদের মাঝে উদ্দীপনা ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন।
মুসা জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে বলতে ছিলেন, সমুদ্র তোমাদেরকে রুখতে পারেনি, স্পেনের নদী-নালাও তোমাদের গতিরোধ করতে পারবে না।
স্পেনের ফৌজী প্রাচীর তোমাদেরকে থামাতে পারেনি, শিলাখণ্ডের ন্যায় কেল্লাকে তোমরা ভেদ করেছ, ফলে এ তুফানও তোমাদের গতিরোধ করতে পারবে না।
প্রতিটি সালার মুজাহিদদেরকে হিম্মত বাড়াবার চেষ্টা করছিলেন। মুসা প্রত্যেক জায়গায় গিয়ে বলছিলেন, আমার প্রতি লক্ষ্য কর, আমার বয়স দেখ। এ বয়সে বার্ধক্যের দরুন কাঁপতে থাকি, কিন্তু এ কঠিন তুফানের মাঝেও আমার শরীরকে স্থির রেখেছি।
সকলে শারীরিকভাবে নানা কষ্ট স্বীকারের দরুন ভেঙ্গে পড়েছিল কিন্তু তাদের মনোবল ছিল পূর্ণ মাত্রায় অটল-অবিচল। বরং এ তুফানে তাদের রুহানী শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বর্ষণ থেমে গেল। পানিও নেমে গেল। কাল বৈশাখী যেমন সবকিছু চুরমার করে লন্ড-ভন্ড করে রেখে যায় ঠিক মুজাহিদ বাহিনীর হাল তেমন ছিল। সামনে অগ্রসর হবার ক্ষমতা মুজাহিদদের ছিলনা। অনেকে পড়েছিলেন অসুস্থ হয়ে। মেয়র
একদিন বিশ্রাম করতে দিয়ে মুজাহিদ বাহিনীকে রওনা করা হলো। ফজরের পর ফৌজ রওনা হয়। নামাজান্তে মুসা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করলেন যা আজও ইতিহাস ধারন করে রেখেছে।, “আল্লাহ তুফান থেকে তাদেরকে নিস্কৃতি দেন যাদের প্রতি তিনি রাজী-খুশী হন। তুফানে নুহ হতে কেবল তাদেরকেই নিস্কৃতি দিয়েছেন যারা তাঁর অনুসারী ছিল এবং যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেছিল। আল্লাহ্ তাঁর আনুগত্যশীলদেরকে প্রতিদান দেন দুনিয়া ও আখিরাতে। তোমরা এ কুফুরে পূর্ণ ভূমিতে নিয়ে এসেছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পয়গাম। নিশ্চয় এ জমিনকে তোমাদের কদম, তোমাদের সেজদা ও শহীদের রক্ত করেছে পূত-পবিত্র। তোমাদের আযান ধ্বনি এখানের পরিবেশকে করে সুশোভিত। এটা আল্লাহর ওয়াদা যে তোমরা যদি ঈমানদার হও তাহলে দশজন মু’মিন একশ ও একশজন এক হাজার-কাফেরের মুকাবালা করতে পারবে। স্মরণ রেখ! তোমাদের পরিচয় বর্বর নয়, আরবীও নয়। বরং তোমাদের পরিচয় তোমরা মুসলমান। তোমরা সকলে সমান। সে উত্তম আল্লাহর রাস্তায় নিজের জান-মাল উৎসর্গ করার বাসনা যার রয়েছে। আমার বন্ধুগণ! আল্লাহ্ তোমাদের সাথে রয়েছেন।”
***
মুজাহিদ বাহিনী নব উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে আরাগুণ পৌঁছে গেল। শহরের আশ-পাশ ছিল সৌন্দর্য মন্ডিত। শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্ত। মুসা শহর অবরোধ করার পূর্বে এক সালারকে পাঠালেন যে, গিয়ে কেল্লাবাসীকে বল, তারা রক্তপাত ছাড়াই যেন ফটক খুলে দেয়। মুকাবালা যদি করে আর আমরা যদি কেল্লা আয়ত্ব করতে পারি তাহলে কাউকে ক্ষমা করা হবে না। নিজে খুলে দিলে সকলের সাথে সদ্ব্যবহার করা হবে।
সালার এলান করে দিলেন।
কেল্লার প্রাচীরের ওপর হতে জবাব এলো, “তোমরা যদি এখান থেকে ফিরে যাও তাহলে তোমাদের পশ্চাৎ ধাবন করা হবে না। এ কেল্লা কজা করার স্বপ্ন ত্যাগ করে ফিরে যাও।”
সালার! আমরা রক্তপাত করতে চাই না।
ওপর থেকে জবাব এলো, আমরা রক্তপাত করতে চাই। যে রডারিককে তোমরা পরাজিত করেছ সে মারা গেছে, এখানে কোন রডারিক নেই। একথা শেষ। হতেই প্রাচীরের ওপর হাসির রোল পড়ে গেল।
“ফিরে এসো!” মুসা গর্জে উঠে তার সালারকে চলে আসার হুকুম দিলেন।
শহর অবরোধ করা হলো। শহরের ফৌজ বাহিরে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। তারা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়তে লাগল কিন্তু মুসলমানদেরকে পিছু হঠাতে পারল না। অন্যান্য জায়গার মত তারাও এ পন্থা অবলম্বন করল যে একবার অতর্কিত হামলা করে কেল্লাতে প্রবেশ করে আবার সুযোগমত হামলা করত। এতে মুসলমানদের বেশ ক্ষতি হতে লাগল।
পরিশেষে এভাবে লড়াই করেও তারা টিকতে পারলনা তবে কিছু সংখ্যক মুজাহিদকে জীবন দিতে হলো। তাদের সংখ্যা পঞ্চাশ বা একশত ছিল।
অষ্টম বা নবম দিন। কেল্লার ভেতর হতে এক দরজা দিয়ে সবে মাত্র চারশত সোয়ারী অপর দরজা দিয়ে তিনশর মত পায়দল সৈন্য বাহিরে এসেছে এমন সময় মুসলমান তীরন্দাজরা তাদের ওপর বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ শুরু করে দিল। তীরন্দাজরা স্পেনী ফৌজের অনেককে আহত করল আর বাকীদেরকে কেল্লার ভেতর প্রবেশে বাধ্য করল। তারা ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে লাগল এরি মাঝে মুসলিম তীরন্দাজরা কেল্লার ভেতর প্রবেশ করল। তারা জীবনবাজী রেখে লড়াই করে দরজা বন্ধ হতে দিল না। তবে তারা সকলে শহীদ হয়ে গেল, বাকী মুসলমানরা অতর্কিত ভাবে একযোগে হামলা করে ভেতরে চলে গেল। শহুরী ফৌজ অত্যন্ত বীরদর্পে লড়ে গেল কিন্তু মুসলমানরা যে আক্রোশ নিয়ে গিয়েছিল তার সামনে তারা দাঁড়াতে পারল না। বেশ অনেক হতাহত হলো। পরিশেষে শহর মুসলমানদের হস্তগত হলো।
মুসা ইবনে নুসাইর শহরের কমান্ডারসহ বাকী ফৌজকে কয়েদ করে সর্ব প্রকার সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিলেন। আর শহরবাসীর ওপর কর নির্ধারন করলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর অতি তাড়াতাড়ি শহরের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিককাজে মুসলমানদের মাঝ হতে হাকেম বা গভর্নর ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ করলেন। কোন ইহুদী ও খ্রীস্টানকে কোন পদে আসীন করা হলো না। গভর্নর যাকে নিয়োগ করা হয়েছিল তার নাম ছিল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি সেখানে এক বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ফলে তার নাম আজও ইতিহাসে রয়েছে লিপিবদ্ধ।
***
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের বীরত্ব, সাহসীকতা ও যুদ্ধ পরিচালনা কৌশল দেখে তাকে সিপাহ্ সালার নিযুক্ত করলেন, তারপর সম্মুখে অগ্রসর হলেন। সামনে গিয়ে দু’টো শহর বিজয় করলেন। গালিশিয়া ও আলিতরয়াস দুটো বিভাগ রয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিল, সেখানকার খ্রীস্টান গভর্নররা স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে নিয়োজিত রয়েছে। আর সেখানে কার্যত পাদ্রীরা হাকেম, তারা মানুষকে ধর্মের নামে গোঁড়ামীতে ডুবিয়ে রেখেছে। পথ বড় সংকটময়। নদী-নালা, খাল-বিল, বন বাদাড়ে পুরো এলাকা ঢাকা। ঝড়-তুফান, কাদা-মাটি ইত্যাদি প্রতিকুল অবস্থা মুজাহিদদের গতিরোধ করার চেষ্টা করল কিন্তু আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনীতে, সকল বাধার প্রাচীর হয়ে গেল চৌচির। এ আল্লাহর সৈনিকরা যেথায় গিয়েছে সেথায় শহীদ ও গাজীর রক্তে জমিন হয়েছে রঞ্জিত আর ইসলামের পতাকা উড়েছে পতপত করে।
মুজাহিদরা অতি সহজে গালিশিয়া ও আলিতরয়াস শহরদ্বয়ও জয় করলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে সম্বোধন করে বললেন, প্রিয় বৎস! স্পেনের কি এমন কোন শহর, এলাকা বা কেল্লা রয়েছে যা আমরা বিজয় করিনি।
– না, আমীরে মুহতারাম! স্পেনের এমন কোন শহর, এমন কোন কেল্লা নেই, যেখানে ইসলামী সালতানাতের ঝান্ডা উড়ছে না।
– খোদার কসম ইবনে যিয়াদ! তুমি আমাকে সাহায্য করবে, আমরা ফ্রান্স সীমান্তে পৌঁছতে চাই।
– ইসলামী সালতানাতের তো কোন সীমানা নেই, আমীরে মুহতারাম! আমাদেরকে ফ্রান্সের শেষ সীমান্তপর্যন্ত পৌঁছতে হবে।
– মুসা ইবনে নুসাইর ফ্রান্স সীমান্তের কাছে কয়েকদিন অবস্থান করলেন, যাতে ফৌজ বিশ্রাম করে লড়াই এর পূর্ণ শক্তি ফিরে পায়। সে সময় মুসা ও তারেক পুরো ইউরোপ বিজয়ের প্লান তৈরী করলেন এবং একদিন সকালে ফ্রান্স সীমান্তে পৌঁছে গেলেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই ফ্রান্সের দু’টো বড় শহর তারা দখল করে নিলেন।
ঐতিহাসিক গিবন লেখেছেন, মুসা ইবনে নুসাইর একদা ফ্রান্সের এক পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে পুরো ফ্রান্স পর্যবেক্ষণ করে বললেন, তিনি আরব সৈন্য তার বাহিনীতে শামিল করে ইউরোপকে বিজয় করে কনস্টান্টিনেপল পৌঁছবেন এবং সেথা হতে নিজ দেশ সিরিয়াতে প্রবেশ করবেন।
গিবন আরো লেখেছেন, “যদি ঐ মুসলমান জেনারেল সম্মুখে অগ্রসর হবার সুযোগ পেতেন, তাহলে ইউরোপের স্কুলে ইঞ্জিলের পরিবর্তে কুরআন পড়ান হতো এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদের রেসালাতের সবক দেয়া হতো। আর আজকে রোমে পোপের পরিবর্তে শায়খুল ইসলামের হুকুম কার্যকর হতো।”
মুসা ইবনে নুসাইর ফ্রান্সের মাত্র দু’তিনটি শহর বিজয় করে ফিরে এলেন সম্মুখে অগ্রসর হলেন না কেন?
এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাসে এরূপ পাওয়া যায় যে, মুসা এবং তারেক একটি শহর বিজয় করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন পথিমাঝে একটি ধ্বংস স্তূপ দেখতে পেলেন তার মাঝে একটা পিলার দাঁড়িয়ে ছিল তাতে লেখা হয়েছে, “হে আওলাদে ইসমাঈল! এ পর্যন্ত তোমরা পৌঁছেছ, এখান থেকে ফিরে যাও, তোমরা যদি আরো। সম্মুখে অগ্রসর হও তাহলে তোমাদের পরস্পরে গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে যা তোমাদের একতা ও শক্তিকে বিনষ্ট করে দেবে।”
মুসা গভীরভাবে লেখাগুলো পড়ে চিন্তামগ্ন হলেন তারপর সালারদের সাথে পরামর্শ করলেন, সকলে পরামর্শ দিলেন ফিরে যাওয়াই উত্তম। আমরা যে এলাকা বিজয় করেছি তা সুষ্ঠু সুন্দরভাবে পরিচালনা করা দরকার। যাতে স্পেনের মাঝে কোন বিশৃংখলা দেখা না দেয়। সুতরাং মুসা প্রত্যবর্তনের নির্দেশ দিলেন।
এছাড়া একটা সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় তাহলো, মুসা ফ্রান্সে অবস্থানকালে একদা দামেস্ক থেকে খলীফাতুল মুসলিমীন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের বিশেষ দূত আবু নসর মুসার কাছে এ পয়গাম নিয়ে গেল,
“মুসা এবং তারেক আর সম্মুখে অগ্রসর না হয়ে তাৎক্ষণিক যেন দামেস্কে পৌঁছে এবং বিস্তারিত নির্দেশের জন্যে যেন খলীফার দরবারে হাজির হয়।”
“আমীরুল মু’মিনীন কি অবগত নন যে, আমি এবং তারেক যদি এখান থেকে চলে যায় তাহলে বিজিত স্পেন আমাদের হাত ছাড়া হতে পারে?”
মুসা আবু নসরকে লক্ষ্য করে বললেন।
আবু নসর : আমীরুল মুমিনীন কি অবগত আছেন আর কি অবগত নল তা আমি জানি না। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, মুসা এবং তারেক যেন দ্রুত দামেস্কে পৌঁছে।
ইতিপূর্বেও খলীফা মুসাকে দামেস্কে পৌঁছতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি এতো ব্যস্ত ছিলেন যে সে হুকুম তামিল করার সুযোগ পাননি। খলীফার সাথে মুসার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ফলে তার গোস্বা হবার আশংকা ছিল না। কিন্তু খলীফা তার বিশেষ দূত মাধ্যমে কড়া নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন।
আবু নসর : ইবনে নুসাইর! যদি নিজের কল্যাণ চাও, তাহলে দ্রুত আমার সাথে দামেস্কের দিকে রওনা হও।
তারেক মুসার থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন, মুসা তাৎক্ষণিক এক দ্রুতগামী কাসেদ তারেকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
তারেক সংবাদ পাওয়া মাত্র এসে উপস্থিত হলেন।
মুসা তাকে খলীফার পয়গামের খবর শুনিয়ে বললেন, আগামীকাল ফজরের পর রওনা হতে হবে।
তারেক : আমীরে মুহতারাম! এটা কি হতে পারেনা যে, আমীরুল মু’মিনীনের কাছে…
মুসা : ইবনে যিয়াদ! আমীরুল মুমিনীন কোন ওজন্ম-আপত্তি শুনবেন না। তার মেজাজ-মর্জি সম্পর্কে আমি অবগত।
আমার তারেক বেটা! যেতেই হবে। প্রত্যাবর্তনের মাঝেই আমাদের কল্যাণ। ..
তারেক : আমি কখনো নিজের কল্যাণের কথা চিন্তা করিনা বরং সব সময় সালতানাতে ইসলামীয়ার কল্যাণ-মঙ্গলের চিন্তা করি।
মুসা : তুমি আমার হুকুম অমান্য করেছিলে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমীরুল মু’মিনীন তার নির্দেশ অগ্রাহ্য করলে আদৌ ক্ষমা করবেন না। যাও… বেটা! যাবার প্রস্তুতি নাও। আমরা ফিরে আসব। ফ্রান্সের এ উঁচু পাহাড়ের চূড়া আমাদের প্রহর গুনবে।
মুসা এবং তারেক দামেস্কে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলেন। তারা আদৌ কল্পনা করেন না যে তারা চির দিনের জন্যে যাচ্ছেন আর কোন দিন ফিরে আসবেন না। আর দামেস্কের কারাগার তাদের জন্যে প্রতিক্ষায় রয়েছে।