৬. সোনার বাংলা

সোনার বাংলা

[ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বাংলাদেশে দু’বার এসেছিলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের ইতিহাসে সপ্তদশ শতাব্দী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বণিকরা তখন বাংলাদেশে ঘাঁটি তৈরি করেছেন এবং মোগল শাসনের বনিয়াদ ক্রমেই শিথিল হয়ে ভেঙে পড়ছে। এই সময়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে, পরবর্তী পরিবর্তনের ধারা সঠিকভাবে বোঝা কঠিন। বার্নিয়ের আসার প্রায় তিনশ’ বছর আগে ইবনবতুতা বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বাংলাদেশের সুন্দর বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বার্নিয়েরের বিবরণ সংক্ষিপ্ত হলেও, সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক মূল্যবান জ্ঞাতব্য তথ্য তিনি পরিবেশন করে গেছেন।—অনুবাদক।]

বাংলাদেশের সম্পদ প্রসঙ্গে

যুগে—যুগে বিভিন্ন লেখকরা মিশর দেশকে চিরকাল সোনার দেশ বলে গেছেন। ফল—ফুল—ফসলে—ভরা এরকম দেশ নাকি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। এখনও অনেকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাঁরা মনে করেন, মিশরের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে তুলনা করা যায়, এরকম দেশ কোথাও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে দু’বার বেড়াতে এসে যে অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি, তাতে আমার মনে হয় যে মিশর সম্বন্ধে এতদিন যা বলা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য। বাংলাদেশে ধান চাল এত প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় যে আশপাশের এবং দূরের অনেক দেশে ধান চালান দেওয়া হয় এখান থেকে। গঙ্গানদীর উপর দিয়ে নৌকাভরা ধান চালান যায় পাটনায় এবং সমুদ্রপথে যায় দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বন্দরে, মুসলিপত্তমে ও করোম্যান্ডাল উপকূলের অন্যান্য বন্দরে। বিদেশেও ধান চাল আর বাংলাদেশ থেকে, প্রধানত সিংহলে ও মালদ্বীপে। ধান ছাড়াও বাংলাদেশে চিনি পাওয়া যায় প্রচুর এবং গোলকুণ্ডা কর্ণাট প্রদেশে এই চিনি চালান যায়। বাইরে আরব, মেসোপোতামিয়া ও পারাস্য দেশে পর্যন্ত বাংলার চিনি রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশে নানা রকমের মিষ্টান্নও তৈরি হয়। মিষ্টান্নের বৈচিত্র্যের জন্য বাংলাদেশ বিখ্যাত। বাংলাদেশের যে—সব অঞ্চলে পর্তুগিজরা বসতি গড়ে তুলেছে, নানারকমের মিষ্টান্নের প্রচলন সেই সব অঞ্চলেই খুব বেশি দেখা যায়। তার একটা কারণ হল, পর্তুগিজরা খুব ভাল মিষ্টান্ন তৈরি করতে পারে, খুব সুদক্ষ ময়রা তারা। শুধু তাই নয়, মিষ্টান্নের ব্যবসা তাদের অন্যতম ব্যবসা। এছাড়া লেবু, আম আনারস প্রভৃতি ফলেরও ব্যবসা করে তারা।

বাংলাদেশের আহার্যের প্রাচুর্য

বাংলাদেশে অবশ্য মিশরের মতো গম উৎপন্ন হয় না। কিন্তু এটা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৈন্যের পরিচয় নয়। খুব বেশি কম বাংলাদেশে উৎপন্ন না হবার কারণ হল, বাঙালিরা গম তেমন পছন্দ করে না, গম তাদের প্রধান খাদ্যশস্যও নয়। বাঙালিরা ভাত খায়, তাই ধানের চাষই বেশি হয় বাংলায়। তাহলেও গম যে একেবারেই হয় না, তা নয়। যা হয় তাই যথেষ্ট। গম দিয়ে দেশি কারিগররা যে সব বিস্কুট তৈরি করে, ইংরেজ, ডাচ ও পর্তুগিজ নাবিক ও ব্যবসায়ীরা জাহাজে তাই তৃপ্তি করে খায়। তিন—চার রকমের তরি—তরকারি, ভাত মাখন ইত্যাদিই হল বাঙালিদের প্রধান খাদ্য এবং খুব সামান্য মূল্যেই এইসব খাদ্য পাওয়া যায়। এক টাকায় কুড়িটার বেশি মুরগি কিনতে পাওয়া যায়। হাঁসও খুব সস্তা। ছাগল ভেড়ার তো অভাব নেই। শুয়োরের দাম এত সস্তা যে পর্তুগিজরা বাংলাদেশে প্রধানত শুয়োরের মাংস খেয়েই বেঁচে থাকে। এই শুয়োরের মাংসই নুনে জারিয়ে ইংরেজ ও ডাচরা জাহাজের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। নানা রকমের মাছ এত প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বাংলাদেশে যে তা বলে শেষ করা যায় না। এককথায় বলা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্যের কোনো অভাব নেই বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের এই প্রাচুর্যের জন্যই পর্তুগিজ ও অন্যান্য খ্রিস্টানরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন বসতিকেন্দ্র থেকে ডাচদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে এসে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশে আস্তানা গেড়ে বসেছে। অনেক খ্রিস্টান গির্জা আছে বাংলাদেশে এবং খ্রিস্টানদের স্বাধীন ধর্মানুষ্ঠানে কোথাও কোনো বাধা নেই। জেসুইট ও অগাস্টিন ধর্মযাজকদের মুখে শুনেছি যে কেবল হুগলিতেই নাকি আট—নয় হাজার খ্রিস্টানের বাস এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মোট খ্রিস্টানের সংখ্যা হল হাজার পঁচিশ । বাংলাদেশের প্রতি খ্রিস্টানদের এই বিশেষ প্রীতির অন্যতম কারণ হল, বাংলার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাঙালি মেয়েদের কোমল প্রকৃতি। এইজন্য পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ প্রভৃতি খ্রিস্টানদের মধ্যে একটা প্রবাদ চালু আছে যে বাংলাদেশে আসার দরজা আছে একশটা, কিন্তু যাবার দরজা একটিও নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে আসার আকর্ষণ আছে অনেক এবং একবার এলে আর ছেড়ে যাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের আকর্ষণের কারণ

বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট হবার প্রধান কারণ হল, বাংলায় পণ্যদ্রব্যের বৈচিত্র্য বেশি। বাণিজ্যের উপযোগী এত রকমের সুন্দর সুন্দর পণ্য আর কোথাও উৎপন্ন হয় বলে মনে হয় না। চিনির কথা তো আগেই বলেছি এবং চিনির ব্যবসায়ের কথাও উল্লেখ করেছি। এছাড়া, তুলো ও রেশমের এত রকমের জিনিস তৈরি হয় বাংলায় এবং এত প্রচুর পরিমাণে হয় যে এই বাংলাদেশকে হিন্দুস্থানের কাপড়চোপড়ের প্রধান আড়ৎ বললে ভুল হয় না। শুধু হিন্দুস্থানের বা মোগল সাম্রাজ্যের নয়, প্রতিবেশী সমস্ত দেশের এবং ইয়োরোপেরও কাপড়চোপড়ের আড়ৎ হল বাংলাদেশ। সরু মোটা, সাদা রঙিন নানারকমের তাঁতের কাপড় তৈরি হয় বাংলায়। তাঁতের কাপড়ের এরকম প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য আমি কোথাও কখনও দেখিনি। দেখলে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। ডাচরা এই সব কাপড় যথেষ্ট পরিমাণে জাপানে ও ইউরোপে চালান দেয়। ইংরেজ ও পর্তুগিজ বণিকরা এবং দেশীয় বণিকরাও প্রধানত এই কাপড়ের ব্যবসায়ই করে। তাঁদের কাপড়ের মতো সিল্কের কাপড়ও প্রচুর তৈরি হয় এবং তার বৈচিত্র্যও যথেষ্ট। সিল্কের কাপড়ও বাংলাদেশ থেকে সব জায়গায় চালান যায়, লাহোরে, কাবুলে এবং ভারতবর্ষের বাইরে অন্যান্য দেশে। পারস্য, সিরিয়া, সৈয়দ বা বৈরাটের সিল্কের মতো বাংলাদেশের সিল্ক খুব সূক্ষ্ম না হলেও, এত সুলভ মূল্যে সিল্ক কোথাও পাওয়া যায় না।

দেশের অভিজ্ঞ লোকদের মুখে শুনেছি, বাংলার তন্তুবায়দের প্রতি যদি আর একটু যত্ন নেওয়া হত এবং তাদের দিকে নজর দেওয়া হত, তাহলে অনেক সস্তায় আরও অনেক ভাল ভাল তাঁতের ও রেশমের কাপড় তারা তৈরি করতে পারত। ডাচদের কাশিমবাজারের রেশমকুঠিতে সাত—আটশ তাঁতি কাজ করে শুনেছি। ইংরেজ ও অন্যান্য বণিকদেরও এরকম অনেক কুঠি আছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে সোরাও (Saltpetre) উৎপন্ন হয় প্রচুর। পাটনা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সোরা আমদানিও করা হয়। গঙ্গার উপর দিয়ে নৌকা করে সোরা চালান দেওয়ার সুবিধা খুব এবং বিদেশি বণিকরা এইভাবে সোরা হিন্দুস্থানের নানা অঞ্চলে চালান দিয়ে থাকে।

এছাড়া বাংলাদেশে গালা, মরিচ, আফিম, মোম প্রভৃতি নানারকমের ব্যবসায়ের জিনিস পাওয়া যায়। মাখনও প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশে পাওয়া যায়। কিন্তু এত বড়ো বড়ো মাটির পাত্রে ঘি মাখন থাকে যে বাইরে চালান দেওয়া কষ্টকর। তবু সমুদ্রপথে বাইরে যথেষ্ট মাখন চালান দেওয়া হয়।

বাংলার জলবায়ু

বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আবহাওয়া বা জলবায়ু খুব স্বাস্থ্যকর ছিল না। বিশেষ করে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চল খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। ডাচ ও ইংরেজরা যখন প্রথম বাংলাদেশে আসে তখন তাদের মৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। আমি একবার বালাসোরের বন্দরে দুটি ব্রিটিশ জাহাজকে অবস্থান করতে দেখেছিলাম। প্রায় এক বছর কাল জাহাজ দুটি বন্দরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ হল্যান্ডের সঙ্গে তখন যুদ্ধ চলছিল বলে ইংলন্ডে প্রত্যাবর্তনের কোনো উপায় ছিল না। এক বছর পরে যখন জাহাজ দুটির দেশে ফিরে যাবার সময় হল তখন দেখা গেল যে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবার মতো লোকজন বা নাবিক—লস্কর নেই। জাহাজের অধিকাংশ নাবিক—লস্করই অসুখে ভুগে মারা গেছে। কিছুকাল পরে অবশ্য ডাচ ও ইংরেজরা আরও সাবধানে থাকতে আরম্ভ করে, এবং অসুখ—বিসুখের প্রাবল্যও কমে যায়। জাহাজের কাপ্তেনরা লক্ষ্য রাখেন যাতে জাহাজের লস্কর নাবিকরা বেশি সুরাপান না করে, এবং এদেশীয় নারীর সংস্পর্শে আসতে না পারে। তাতে কিছুটা রোগব্যাধির উপদ্রব কমে যায়। সুরা সম্বন্ধে বলা যায় যে ক্যানারি বা গ্রেভ বা শিরাজ জাতীয় সুরা খারাপ জলবায়ুতে স্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে মন্দ নয়, পরিমিত পানে ক্ষতি হয় না। সুতরাং একটু হিসেব করে সংযত হয়ে চললেই স্বাস্থ্যহানির কোনো কারণ ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না। মৃত্যুর হারও অনেক পরিমাণে কমে যেতে পারে। বুলেপঞ্জ নামে এক জাতীয় দেশি মদ আছে যা গুড় থেকে তৈরি হয় এবং এদেশি লোক লেবু জল ইত্যাদি মিশিয়ে পান করে। আস্বাদ খুব ভাল, পানীয় হিসাবেও মনোরম, কিন্তু অত্যন্ত অনিষ্টকর স্বাস্থ্যের পক্ষে।

বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার আগে মনে রাখা দরকার যে রাজমহল থেকে সমুদ্রের মুখ পর্যন্ত প্রায় তিনশ মাইল লম্বার গঙ্গার উভয় তীর সে—দেশের শোভাবর্ধন করছে। এর মধ্যে অসংখ্য খাল আছে, যা পণ্যদ্রব্যের চলাচলের সুবিধার জন্য এবং জলপ্রবাহের জন্য সুদূর অতীতকালে কাটা হয়েছে। মানুষের দৈহিক মেহনতের এ এক অপূর্ব ভারতীয় নিদর্শন। এইসব খালের দুই দিকে সারিবদ্ধ নগর ও গ্রাম গড়ে উঠেছে। লোকজনের বসতিও যথেষ্ট আছে। তারই মধ্যে মধ্যে সুবিস্তৃত ধানক্ষেত, আখক্ষেত, ফসলক্ষেত, নানারকমের সবজিবাগান, সরষে ও তিলের ক্ষেত, আর দু—তিন ফুট উঁচু তুঁতগাছের সারি রেশমি গুটিপোকার খাদ্যের জন্য বিরাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে লোভনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হল, গঙ্গার দুই তীরের মধ্যবর্তী ছোটো ছোটো দ্বীপগুলি। দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যেতে ছ—সাতদিনও লেগে যায় অনেক সময়। ছোটো বড়ো নানা আকারের দ্বীপ সব, কিন্তু একটি বিশেষত্ব সকলেরই আছে—এমন শস্য—শ্যামলা উর্বরা দ্বীপ সচরাচর দেখা যায় না। প্রত্যেকটি দ্বীপ নিবিড় অরণ্যে ঘেরা, তার মধ্যে নানারকমের ফলের গাছ, আনারসের বাগান। হাজার হাজার আঁকাবাঁকা খাল নালা তার ভিতর দিয়ে চলে গেছে, কতদূরে যে তা বলা যায় না, একেবারে দৃষ্টির অন্তরালে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন দ্বীপের মধ্যে গাছের বাঁকানো তোরণশ্রেণি দিয়ে সাজানো আঁকাবাঁকা পথ সব।

মগ দস্যুদের অত্যাচারের কাহিনি

সমুদ্রের কাছাকাছি অনেক দ্বীপ এখন প্রায় জনবসতিশূন্য হয়ে গেছে। প্রধানত আরাকানের জলদস্যু বা বোম্বেটেদের অত্যাচারে এইসব দ্বীপ ছেড়ে লোকজন পালিয়ে গেছে। এখন এই দ্বীপগুলি দেখলে মনে হয় না যে এককালে এখানে লোকালয় ছিল। ধূ—ধূ করছে জনমানবশূন্য গ্রামের পর গ্রাম। মানুষ নেই, বন্য জন্তুর উপদ্রব বেড়েছে তার বদলে। একসময় সেখানে মানুষের বসবাস ছিল, এখন সেখানে হরিণ শুয়োর আর বন্যকুক্কুট চরে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছন্দে। তারই আকর্ষণে বাঘেরও আনাগোনা আছে সেখানে। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে অনেক সময় বাঘগুলো সাঁতার দিয়ে চলে যায়। গঙ্গার উপর সাধারণত ছোটো ছোটো নৌকায় করে চলে বেড়াতে হয়। এছাড়া নদীপথে চলাচলের আর অন্য কোনো যান নেই। নৌকা থেকে এই সব দ্বীপের যে—কোনো স্থানে অবতরণ করার বিপদ আছে অনেক। তার কারণ, স্থানগুলি নিরাপদ নয়। রাত্রিবেলা নৌকা কোনো গাছের ডালের সঙ্গে বেশ শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে, তীরে থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে রাতের ঝোঁকে নৌকায় যে—কোনো আরোহীকে বাঘে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে পারে। এরকম দুর্ঘটনা প্রায় ঘটে থাকে। রাত্রে তীরে নৌকা নোঙর করে আরোহীরা যখন নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়, তখন বাঘ এসে সন্তর্পণে ঢোকে নৌকার ভিতর এবং শিকার ধরে নিয়ে চলে যায়। এ অঞ্চলের মাঝিমাল্লাদের মুখে এরকম কাহিনি অনেক শোনা যায়।

পিপলি বন্দর থেকে হুগলির পথে বার্নিয়ের

পিপলি বন্দর থেকে হুগলি পর্যন্ত আমার নৌকাযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা এইবার বর্ণনা করব। এইসব দ্বীপ ও ছোটো ছোটো অসংখ্য খালনালার ভিতর দিয়ে পিপলি থেকে নদীপথে নৌকায় করে আমার হুগলি পৌঁছতে প্রায় নয় দিন লেগেছিল। সেই নৌকাযাত্রার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে আছে আজও। এমন কোনো দিন যায়নি, যেদিন নতুন কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিনি। হয় কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা, অথবা দুঃসাহসিক কোনো ঘটনা, একটা—না—একটা কিছু ঘটেছে। যে নৌকায় আমি যাত্রা করেছিলাম সেটি একখানি সাতদাঁড়যুক্ত নৌকা। পিপলি থেকে বেরিয়ে যখন আমরা প্রায় দশ—বারো মাইল জলপথ পার হয়ে সমুদ্রের বুকে পাড়ি দিয়েছি, উপকূল ধরে তখন এইসব দ্বীপ ও খালের দিকে যেতে যেতে দেখলাম, বড়ো বড়ো রুইমাছের মতো মাছের ঝাঁক তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে জলের মধ্যে একজাতীয় তিমি মাছ। মাছগুলোর কাছাকাছি নৌকা নিয়ে যেতে বললাম মাঝিদের। কাছে গিয়ে মনে হল, মাছগুলো যেন মড়ার মতো অসাড় নিষ্পন্দ হয়ে রয়েছে। দু—চারটে মাছ মন্থরগতিতে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাকিগুলো যেন দিশাহারা ও বিহ্বল হয়ে প্রাণপণ লড়াই করছে আত্মরক্ষার জন্য। আমরা হাত দিয়েই প্রায় গোটা চব্বিশ মাছ ধরলাম এবং দেখলাম মাছগুলোর মুখ দিয়ে ব্লাডারের মতো রক্তাভ একরকম কি যেন বেরিয়ে আসছে। আমার মনে হল এই ব্লাডারের সাহায্যেই বোধহয় মাছগুলো ভেসে বেড়ায়, ডুবে যায় না। কিন্তু তাহলেও এগুলো এইভাবে মুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে কেন বুঝতে পারলাম না। ডলফিন বা তিমিমাছের তাড়া খেয়ে ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করতে গিয়ে হয়তো এই ব্লাডারটা মুখের বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবং রক্তাভ হয়েছে। কথাটা অন্তত শতাধিক নাবিক ও মাঝির কাছে বলেছি এবং তাদের জিজ্ঞাসা করেছি। অনেকেই আমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি। একজন ডাচ নাবিক মাত্র আমাকে বলেছিল যে বড়ো নৌকা করে চিনের উপকূল দিয়ে যেতে যেতে সে এইরকম মাছ দেখেছে এবং ঠিক আমাদেরই মতো হাত দিয়ে অনেক মাছ ধরেছে।

পরদিন বেলা পড়ে গেল, আমাদের নৌকা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ধীরে ধীরে ভিড়ল। এমন একটি স্থান আমরা নোঙর করার জন্য বেছে নিলাম যেখানে বাঘের উপদ্রব বিশেষ নেই। সেইখনে নেমে আমরা সেদিনের মতো (রাতে) বিশ্রাম নেবার জন্য প্রস্তুত হলাম। তীরে নেমে প্রথমে আগুন জ্বালানো হল। তারপর একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আমি বললাম, আমার খাবার জন্য গোটা দুই মুরগি আর কয়েকটা মাছ তৈরি করতে। তাই দিয়ে বেশ ভালোভাবেই সান্ধ্যভোজন শেষ করা গেল। মাছগুলোর স্বাদ খুব চমৎকার। তারপর আবার নৌকায় উঠে মাঝিদের বললাম, রাত পর্যন্ত নৌকা বাইতে। রাতের অন্ধকারে খালের আঁকাবাঁকা পথ চিনে নৌকা চালানো খুব কঠিন। যে—কোনো সময় পথ হারিয়ে বিপন্ন হবার সম্ভাবনা। সুতরাং বড়ো খাল থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারের আগে বেরিয়ে এসে আমরা একটা ছোটো খালের মধ্যে ঢুকে রাত কাটাবার সঙ্কল্প করলাম। একটি বড়ো গাছের মোটা ডালে নৌকাটি বাঁধা হল শক্ত করে। তীর থেকে অনেকটা দূরে নৌকা সরিয়ে রাখা হল, বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। রাতে বসে আছি নৌকায়, চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, এমন সময় প্রকৃতির এক বিচিত্র রূপ আমার নজরে পড়ল। দিল্লিতে থাকাকালীন এরকম দৃশ্য বারদুই দেখেছিলাম মনে আছে। দেখলাম, চাঁদের রামধনু। নৌকায় সঙ্গীদের সব ঘুম থেকে ডেকে তুললাম দেখাবার জন্য। সকলেই দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। আমার নৌকায় দুজন পর্তুগিজ নাবিক ছিল। এক বন্ধুর বিশেষ অনুরোধে আমি তাদের আমার নৌকায় স্থান দিয়েছিলাম। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়ে গেল সেই পর্তুগিজ নাবিক দুজন। তারা বলল যে এরকম রামধনু তারা এর আগে আর কখনো কোথাও দেখেনি এবং কারো কাছে শোনেও নি রাতের এই রামধনুর কথা।

তৃতীয় দিন আমরা খালের মধ্যে একরকম পথ হারিয়ে প্রায় নিখোঁজ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলাম বলা চলে। কাছাকাছি দ্বীপে কয়েকজন পর্তুগিজ লবণ তৈরির কাজ করত। তারাই আমাদের সে—যাত্রা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল। তারা না থাকলে আমাদের পক্ষে পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। সেই রাতে আবার আমরা একটা ছোটো খালের মধ্যে নৌকা ভিড়ালাম। আমার পর্তুগিজ সঙ্গীরা তার আগের দিন ওই রকম বিচিত্র দৃশ্য দেখে সেই রাতে আর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারেনি। আকাশের দিকে চেয়ে জেগেছিল তারা। ঘুম থেকে সে—রাতে তারা আমাকে ডেকে তুলল, আবার ওই রামধনুর দৃশ্য দেখবার জন্য। ঠিক সে দিনের রামধনুর মতনই সুন্দর ও মনোহর। কোনো আলোকমণ্ডল বা তারকামণ্ডলকে যে আমি ভুল করে রামধনু বলছি তা নয়। বর্ষাকালে দিল্লিতে সে—রকম তারকামণ্ডল আমি আকাশ আলোকিত করতে বহুবার দেখেছি। কিন্তু আমি যে আলোকমণ্ডলের কথা বলছি তা চন্দ্রকে ঘিরে বৃত্তাকারে উদ্ভাসিত নয়। চাঁদের বিপরীত দিকে, ঠিক দিনের আলোর রামধনুর মতন উদ্ভাসিত। যখনই রাতের এই রামধনু দেখেছি তখনই দেখেছি চাঁদ রয়েছে পশ্চিমে, আর ওই আলোকমণ্ডল পূবে। চাঁদ মনে হয় পূর্ণিমার চাঁদ। তা না হলে ওইরকম আলোকরেখা বিচ্ছুরিত হয়ে রামধনুর আকার ধারণ করত না। আলো যে খুব উজ্জ্বল সাদা তা নয়। নানা রঙের ছটা তার মধ্যে পরিষ্কার দেখা যায়। সুতরাং আমি প্রাচীনদের চাইতে অনেক বেশি ভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ দার্শনিক আরিস্ততেলের মতে, তাঁর আগের যুগের কেউ চাঁদের রামধনু চোখে দেখেনি কোনোদিন।

চতুর্থ দিন সন্ধ্যাবেলা আমরা আবার বড়ো খাল থেকে বেরিয়ে এসে ছোটো খালের মধ্যে ঢুকলাম নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। সেই রাতটি একটি স্মরণীয় রাত। হঠাৎ যেন চারিদিক স্তব্ধ হয়ে গেল মনে হল। পরিপার্শ্ব থমথমে হয়ে উঠল। হাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না, অনুভবও করা যায় না। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল যেন আমাদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসেরও কষ্ট হচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমে বাতাস বেশ গরম হয়ে উঠল। চারিদিকের ঝোপে—ঝাড়ে জোনাকি পোকাগুলো এমনভাবে জ্বলছিল যে মনে হচ্ছিল যেন বনে আগুন ধরে গেছে। তারই মধ্যে আবার সত্যই আগুনের মতো কি যেন দপ দপ করে জ্বলে উঠছিল। দূরে গভীর বনের মধ্যে যেন আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে নিভে যাচ্ছে। মাঝিরা বেশ ভীত হয়ে উঠল দেখলাম। তাদের বিশ্বাস, এসব বনের ভূতপ্রেতের অপকৌশল ছাড়া কিছু নয়। আগুনের এই বিচিত্র লীলার মধ্যে দুটি দৃশ্যের কথা আমার বেশ মনে আছে। একটি গোলাকার—বলের মতন আগুন, আর একটি প্রজ্বলিত বৃক্ষের মতো দেখতে। মিনিট পনেরো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।

পঞ্চম রাত্রিটি সবচেয়ে বিপজ্জনক ও মারাত্মক হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম আমরা। এমন ভয়ংকর ঝড় উঠেছিল যে হঠাৎ যে আমরা গাছপালার মধ্যে নিরাপদে থেকেও এবং আমাদের নৌকা বেশ শক্ত করে বাঁধা থাকলেও প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল যেন আমরা ছিটকে গিয়ে বড়ো খালের মধ্যে পড়ে কোথায় তলিয়ে যাব। তাই যেতামও কারণ নৌকাদড়ি ঝড়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ আমাদের মাথায়, কতকটা প্রাণের দায়ে, বুদ্ধি খেলে গেল। আমরা তৎক্ষণাৎ (আমি ও আমার দুজন পর্তুগিজ সঙ্গী) গাছের ডাল প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ঝুলতে লাগলাম। প্রায় দু ঘণ্টা এইভাবে ঝুলে রইলাম ডাল ধরে। প্রবল বেগে ঝড় বইতে লাগল। আমার ভারতীয় মাঝিরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল। কেউ আমরা কারও দিকে চেয়ে দেখবার সুযোগ পাইনি। গাছের ডাল ধরে ঝড়ের মধ্যে যখন আমরা ঝুলে ছিলাম, তখন আমাদের রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল। কলকল করে অঝোরে বর্ষণ হচ্ছিল এবং এমন সশব্দে চারিদিক আলোকিত করে বজ্রপাত হচ্ছিল যে আমাদের প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, এখনই বুঝি মাথায় পড়বে। এইভাবে সে—রাত আমাদের কাটল। কোনোরকমে আমরা প্রাণে বেঁচে গেলাম।

বাকি পথটা আমাদের ভালোই কেটেছিল, বেশ আরামে। নয় দিনের দিন আমরা হুগলি (Ogouly) পৌঁছলাম। চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, গঙ্গার উভয় তীরের মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চেয়ে রইলাম একদৃষ্টে সেই দিকে। নৌকা গঙ্গার বুকে ভেসে চলল। হুগলি পৌঁছলাম। আমার বাক্সপেটরা, জামা—কাপড় সব ভিজে গেছে তখন। মুরগিগুলো মরে গেছে, মাছের অবস্থাও তথৈবচ এবং বিস্কুটগুলো সব জলে ভিজে ফুলে ভেপসে উঠেছে।

…………..

১। পর্তুগিজরা যে ভাল মিষ্টান্ন তৈরি করতে পারত এবং মিষ্টান্নের ব্যবসা করত, একথা বোধ হয় অনেকেই জানেন না। এছাড়া, আমাদের দেশের অধিকাংশ ফলফুলের কথাও আমরা পর্তুগিজরা আসার আগে জানতাম না। এ সম্বন্ধে ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘History of Bengal’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে (৩৬৮ পৃষ্ঠা) যা লিখেছেন তা এখানে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি :

 “It is seldom realised that many of our common flowers and fruits were totally unknown before the Portuguese came. ‘The noxious weed that brings solace’ to many and now forms a stapele product of Rangpur was brought by the Portuguese, as was the common article of food, Potato– Which is relished by princes and peasants alike. Tobaco and Potato came from North America. Form Brazil They brought Cashewnut, which goes by the name of Hijli Badam, because it thrives so well in the sandy soil of the Hijli litteral …. We are indebted to the Portuguese for Kamranga which finds so much favour with our children. To this list may be added Peyara, which found an appreciative poet in Monmohan Basu. The little Krishnakali that cheers our countryside in its yellow, red and white is another gift of the once dreaded Feringi.”

২। একসময় আমাদের বাংলাদেশে যে যথেষ্ট দেশি বেকারি ছিল এবং বাঙালি কারিগররা (প্রধানত মুসলমান) যে নানা রকমের পাঁউরুটি বিস্কুট তৈরি করত, বার্নিয়ের তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে গেছেন। বিস্কুটগুলোকে বার্নিয়ের “sea-biscuits” বলেছেন, তার কারণ তিনি জাহাজের ফিরিঙ্গ নাবিকদের একরকম দেশি বিস্কুট খুব বেশি খেতে দেখেছিলেন। তাই তাঁর ধারণা হয়েছিল যে বিস্কুটগুলো বোধ হয় সমুদ্রযাত্রীদের জন্যই তৈরি হয়।

৩। বাংলাদেশের রেশমের কাপড়ের সুলভতা এবং বাঙালি তন্তুবায়দের প্রতি দেশের কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা সম্বন্ধে বার্নিয়েরের অভিমত প্রণিধানযোগ্য হলেও বাংলার রেশমের সূক্ষ্মতা সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা ঠিক নয় বলে মনে হয়। এ সম্বন্ধে “History of the Cotton Manufacture of Dacca District” এবং যতীন্দ্রমোহন রায়ের ”ঢাকার ইতিহাস” গ্রন্থে যে বিবরণ আছে তা পঠিতব্য।

৪। ইংরেজ, ডাচ ও পর্তুগিজদের একাধিক সোরার কারখানা ছিল ছাপরা জেলায়।

৫। ঘি মাখনের ব্যাবসা ভারতের অন্যতম ব্যবসা। তার মধ্যে বাংলাদেশের ভূমিকাও প্রধান। ভারতের এই ঘিয়ের ব্যবসার প্রাধান্যের কথা বোঝা যায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকের এই হিসেব থেকে।

 ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘিয়ের ব্যাবসা বাংলাদেশে যে কি রকম চলত, তা পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতির ঘিয়ের ব্যাবসার কাহিনি থেকেই বোঝা যায়। তাঁর জীবনচরিত থেকে এই ব্যাবসায়ের কথা উদ্ধৃত করে দিচ্ছি :

 ”১৮৫২ খ্রিঃ অব্দে তর্কবাচস্পতি মহাশয় বীরভূমে প্রত্যেক বিঘায় দুই আনা কর ধার্য করিয়া দশ হাজার বিঘা জঙ্গলভূমি চাষ করিতে প্রবৃত্ত হন। কৃষিকার্যোপযোগী পাঁচ শত গরু ক্রয় করেন। যে সকল গাভী ক্রয় করিতেন, তাহাদের দুগ্ধ হইতে যে ঘৃত উৎপন্ন হইত, তাহা কলিকাতায় আনাইয়া বিক্রিত হইত। তৎকালে রেলের পথ হয় নাই, সুতরাং মুটের দ্বারা ওই ঘৃত কলিকাতায় আনাইতেন। উক্ত কার্যের অধ্যক্ষ হারাধন পাল নামক এক ব্যক্তি নিযুক্ত ছিলেন।” (শ্রী শম্ভুচরণ বিদ্যারত্ন : তারানাথ তর্কবাচস্পতির জীবনচরিত : ১৩০০ সাল : পৃষ্ঠা ২৪)

৬। ‘বুলেপঞ্জ’ কথাটি মনে হয়, দুটি কথার বিচিত্র সংমিশ্রণ এবং বার্নিয়ের তাকে দেশি মদের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘Bowl’ ও ‘Punch’ এই কথা দুটির পরিণতি হয়েছে বুলেপঞ্জ। H. Meredith Parker নামে জনৈক সিভিলিয়ান (নিম্নবঙ্গে সুপরিচিত) ‘Bole-Ponjis containing the tale of the Bucaneer : A Bottle of Red Ink : The Decline and Fall of Ghosts, and other Ingredients, 2 Vols.– নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন ১৮৫২ সালে। দেশি মদের গুণগান অবশ্য আরও অনেক বিদেশি পর্যটক করে গেছেন। ওভিংটন (Ovington) তাঁর ‘A Voyage to Surattiee in the year 1686 (London, 1696)’ গ্রন্থে লিখেছেন বাংলাদেশের দেশি মদ সম্বন্ধে : ‘Bengal is a munch stronger spirit than that of Goa, though both are made use of by the Europeans in making punch.’

 বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়েরের (Tavernier) বাংলাদেশের বিবরণের মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যায়। খাদ্যশস্য বা পণ্যদ্রব্যের প্রাচুর্য সম্বন্ধে বার্নিয়ের যা বলেছেন, প্রায় একই ভাষায় দেখা যায় তাভির্নিয়েরও তাই বলেছেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য তাভার্নিয়েরের বর্ণনা কিছু—কিছু উদ্ধৃত করা হল।

 বাংলাদেশের চিনি—প্রসঙ্গে তাভার্নিয়ের বলেছেন : ‘Further, it (Bengal) also abounds in Sugar, so that it furnishes with it the Kingdoms of Golkonda and Karnates.’… (Tavernier, Vol II, P 140.)

 বাংলাদেশের তুলা ও রেশমপ্রসঙ্গে তাভার্নিয়ের বলেছেন : As to the commodities of great value, and which draw the Commerce of Strangers thither (to Bengale) I know not whether there be a Country in the world that affords more and greater variety : for besides Sugar… there is store of cottons and silks, that it may be said that Bengale is as it were the general magazine thereof, not only for Indostan…. but also for all the circumjacent Kingdoms and for Europe itself. (Tavernier, Vol.II, P 140f.)

 বাংলাদেশের মাখন প্রসঙ্গে তাভার্নিয়ের বলেছেন : ‘Butter is to be had there in so great plenty.’ … (Tavernier, Vol.II, P 141)

 বিদেশিদের আকর্ষণ প্রসঙ্গে তাভার্নিয়ের বলেছেন : ‘In a word, Bengale is a country abounding in all things; and it is for this very reason that so many Portuguese, Mesticks and other Christians are fled thither…’ (Vol. II, P 140)

৭। বার্নিয়ের যে সব কাটা খালের কথা এখানে বলেছেন, তার অধিকাংশই অবশ্য কাটা খাল নয়। নদ—নদীর প্রাচুর্য দেখে এবং তার পাশের বাঁধগুলো দেখে বার্নিয়েরের মনে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে নদীগুলি মানুষের মেহনতে কাটা খাল ছাড়া কিছু নয়। আসলে বার্নিয়ের যাকে খাল বলেছেন তার অধিকাংশই হল নদী।

৮। বার্নিয়ের এর পূর্বেও মগদস্যুদের লুণ্ঠনের কাহিনি বর্ণনা করেছেন (এই গ্রন্থের ৬৮—৬৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার যে কতদূর পর্যন্ত চরমে উঠেছিল এবং বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যে কি—ভাবে বিপর্যস্ত করেছিল, শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বিভিন্ন বংশের (প্রধানত ব্রাহ্মণ) কুলজী থেকে তার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত সব সংগ্রহ করেছেন (প্রবাসী : চৈত্র ১৩৫৩)। বাংলার বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারও দেখা যায়, মগের দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পায়নি। মগের এই দৌরাত্ম্যের জন্য সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলার রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ—সমাজে এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে ‘মগদোষ’ বলা হয়। কুলপঞ্জীতে এই মগদোষের বিবরণের মধ্যে ঘটকরা অজ্ঞাতসারে বহু করুণ ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এই জাতীয় ঐতিহাসিক উপকরণ অন্য কোনো গ্রন্থে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন কুলপঞ্জী (হাতেলেখা) থেকে শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এগুলি যদি উদ্ধার না করতেন, তাহলে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়ের কথা আমরা সম্পূর্ণ জানতে পারতাম না।

 কুলগ্রন্থ থেকে মগদৌরাত্ম্যের কয়েকটি বিবরণ উল্লেখ করছি : (ক) ‘বন্দ্যঘটী’ অর্থাৎ ব্যানার্জি বংশের একটি বিখ্যাত শাখা ‘সাগরদিয়া’ নামে পরিচিত। এই শাখায় জহু« প্রসিদ্ধ কুলীন ছিলেন। তাঁর এক পৌত্র (বলভদ্রের পুত্র) শ্রীপতির নাম ধ্রুবানন্দ তাঁর ‘মহাবংশাবলী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। শ্রীপতি ১৫০০ সনে জীবিত ছিলেন। তাঁর এক প্রপৌত্র রামচন্দ্রের কুলবিবরণ মধ্যে পাওয়া যায়। : ‘ততো বিষ্ণুপ্রিয়া নাম্নী কন্যা মগেন নীতা সর্বনাশাদ্ধানিঃ।’ এই ঘটনা আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৬০০—১৬৫০ সাল) ঘটে। রামচন্দ্রের বাড়ি কোথায় ছিল জানা যায় না। কুলাবস্থান থেকে মনে হয়, নদীয়া যশোহর অঞ্চলেই তাঁর বাস ছিল।

(খ) উক্ত রামচন্দ্রের এক ভাইয়ের নাম রাঘব। তিনিও ওই একই অঞ্চলের বাসিন্দা বলে মনে হয়। তাঁর আট পুত্রের মধ্যে চতুর্থ চাঁদ সদ্বংশে বিবাহ করেন। কিন্তু—’চাঁদস্য পিতৃভদ্রকালে মুং যাদবেন্দ্র রায়স্য কন্যাবিবাহ অত্র সাধুঃ, পশ্চাৎ মগেন নীতা।’ তাঁর বাকি চার ভাইকেও মগ দস্যুরা ধরে নিয়ে যায়—’চাঁদ বিনোদ রাজারাম যদু মধু মগেন নীতা।’ কেবল তাই নয়, তাঁর তিন ভগ্নীকেও মগেরা নিয়ে যায়—’ততঃ স্বরূপা—মণিরূপা—কর্পূরমঞ্জরী এতাঃ কন্যাঃ মগেন নীতা সর্বনাশাদ্ধানিঃ।’

(গ) খড়দহ মেলের প্রসিদ্ধ কুলীন ছিলেন ভগীরথপুত্র শ্রীমন্ত। শ্রীমন্তের প্রপৌত্র কৃষ্ণচরণ সম্বন্ধে লিখিত আছে : ‘কৃষ্ণচরণস্য ফিরাঙ্গি অপবাদের বিক্রমপুর কাঁটালতলি গ্রামে।’ কৃষ্ণচরণের ভাই রামদেব সম্বন্ধে লেখা আছে : ‘রামদেবস্য ফারাঙ্গিতে নীতা মগসংপর্কঃ ।’ রামদেব নিঃসন্তান ছিলেন। একটি গ্রন্থে কৃষ্ণচরণ নামে একটি কারিকা উদ্ধৃত হয়েছে—

 ‘কৃষ্ণচরণ বন্দ্যবর পাইয়া ফিরিঙ্গি ডর

 কাঁঠালতলা করি পরিত্যাগ।’

৯। পিপলি বা পিপলিপত্তন বলে পরিচিত। একদা উড়িষ্যার উপকূলে, সুবর্ণরেখা নদী থেকে প্রায় ১৬ মাইল দূরে, বিখ্যাত বন্দর ছিল। ১৬৩৪ সালে ইংরেজরা এখানে পর্তুগিজদের কুঠির বদলে একটি নতুন কুঠি স্থাপন করেছিলেন বাণিজ্যের জন্য। নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য অনেক বন্দরের মতো পিপলিপত্তনেরও পতন হয়। এখানেই বার্নিয়ের পূর্বোল্লিখিত ইংরেজদের বাণিজ্যপোত দেখেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *