৬. সূৰ্য কী?

ষষ্ঠ অধ্যায় – সূৰ্য কী? 

সূর্য এতই চোখধাঁধানো উজ্জ্বল, আর শীতল জলবায়ুতে এত বেশি সান্ত্বনাদায়ক, আর উষ্ণ জলবায়ুতে এত বেশি নির্দয় গাত্রদাহকর, আসলেই অবাক হবার কোনো কারণ নেই পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠীই কেন সূর্যকে একজন দেবতা হিসেবে উপাসনা করেছে। সূর্য-উপাসনা প্রায়শই চন্দ্র-উপাসনার সাথে একসাথেই ঘটেছে আর সূর্য আর চন্দ্রকে প্রায়শই পরস্পরের বিপরীত লিঙ্গ হিসেবে ভাবা হয়। নাইজেরিয়ার টিভ গোত্র ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু অংশের জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বিশ্বাস করে যে, সূর্য হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা আয়োনডো’র ছেলে, আর চাঁদ হচ্ছে আয়োনডো’র মেয়ে। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার বারোটসে গোত্রের সদস্যরা মনে করে সূর্য চাঁদের ভাই নয়, বরং তার স্বামী। পুরাণ-কাহিনিগুলো প্রায়শই সূর্যকে পুরুষ আর চাঁদকে নারী হিসেবে ভেবেছে, কিন্তু এর বিপরীতটাও হতে পারে। জাপানের শিন্টো ধর্মে সূর্য হচ্ছে দেবী আমাতেরাসু আর চাঁদ হচ্ছে তার ভাই ওগেটসুনো। 

ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিয়ার্ডরা [স্পেনবাসী] সেখানে আসার আগে যে বিখ্যাত সভ্যতাগুলো দক্ষিণ আর মধ্য-আমেরিকায় সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল, সেগুলো সূর্যের উপাসনা করত। আন্দিজের ইনকারা বিশ্বাস করত সূর্য আর চাঁদ হচ্ছে তাদের পূর্বসূরি। মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা সেই এলাকার প্রাচীন সভ্যতার বহু দেবতাকে নিজেদের দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে উপাসনা করেছিলেন, যেমন—মায়া সভ্যতা। এই দেবতাদের অনেকেরই সূর্যের সাথে একটি সম্পর্ক ছিল। অ্যাজটেকদের ‘পাঁচটি সূর্যের পুরাণ’ অনুযায়ী বর্তমান এই পৃথিবীর আগে আরো চারটি পৃথিবী ছিল, প্রত্যেকটির ছিল নিজস্ব একটি সূর্য। এর আগের চারটি পৃথিবী, একটার পর একটা ধ্বংস হয়েছিল মহাবিপর্যয়ের কারণে, প্রায়শই যে কাজটির কারণ ছিল দেবতারাই। প্রথম সূর্য ছিল দেবতা কৃষ্ণ তেজকাটলিপোকা, সে তার ভাই, কেটজালকোটাল সাথে যুদ্ধ করেছিল, যে তাকে তার হাতে লাঠি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আকাশ থেকে ফেলে দিয়েছিল। একটি অন্ধকার পর্বের পর, যখন কোনো সূর্য ছিল না আকাশে, কেটজালকোটাল দ্বিতীয় সূর্য হয়েছিল। তীব্র ক্রোধে তেজকাটলিপোকা সব মানুষকে বানরে রূপান্তরিত করেছিলেন। এরপর কেটজালকোটাল সব বানরকে ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেন ও দ্বিতীয় সূর্য হিসেবে পদত্যাগ করেন। 

দেবতা টালোক এরপর তৃতীয় সূর্য হয়েছিলেন এবং যখন তেজকাটলিপোকা, তাঁর স্ত্রী শকিকেটসালকে চুরি করেছিলেন, টালোক খুবই রাগ করেছিলেন এবং বৃষ্টি পড়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, সুতরাং ভয়াবহ খরা হয়েছিল। পৃথিবীবাসীরা বৃষ্টির জন্য দিন পর দিন প্রার্থনা করেছিল, আর টালোক এই প্রার্থনায় এতই বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি পানির বদলে আগুনের বৃষ্টি পাঠিয়ে ছিলেন, পুরো পৃথিবী পুড়ে গিয়েছিল এবং দেবতাদের আবার সব নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল। 

চতুর্থ সূর্য ছিল টালোকের নতুন স্ত্রী চাচিউতলিকুয়ে; তাঁর শুরুটা বেশ ভালো হয়েছিল, কিন্তু তেজকাটলিপোকা এরপর তাঁকে এতটাই দুঃখ দিয়েছিলেন যে তিনি বাহান্ন বছর ধরে রক্তের অশ্রু ঝরিয়ে অবিরাম শুধু কেঁদেছিলেন। পুরো পৃথিবী প্লাবিত করেছিল তাঁর এই অশ্রু এবং আবারো দেবতাদের নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল। বিষয়টি খুব অদ্ভুত তাই নয়, প্রসঙ্গক্রমে একটি প্রশ্ন, কিভাবে পুরাণ-কাহিনি তুচ্ছ সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে? যেমন ধরুন, কিভাবে অ্যাজটেকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তিনি ৫২ বছর ধরে কেঁদেছিলেন, ৫১ বা ৫৩ বছর নয়? 

বর্তমানে আকাশে আমরা যে সূর্যকে দেখতে পাই অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত যে এই বর্তমান সূর্যই হচ্ছে সেই পঞ্চম সূর্য, আর ইনি ছিলেন টোনাটিউহ, হুইটসিলোপচলি নামেও যিনি পরিচিত। দুর্ঘটনাবশত একগুচ্ছ পালক দ্বারা গর্ভবতী হয়ে তাঁর মা কোয়াটলিকুয়ে তাঁকে জন্ম দিয়েছিলেন। শুনলে বেশ অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু এই বিষয়গুলো মনে হয় খুব স্বাভাবিক ছিল সেই সময়ের মানুষগুলোর কাছে, যারা ঐতিহ্যবাহী পুরাণ-কাহিনির মধ্যে প্রতিপালিত হয়েছিল [আরেকজন অ্যাজটেক দেবীও গর্ভবতী হয়েছিলেন কুমড়ার ফাঁপা শুকনো খোলসের পাত্রের দ্বারা]। কোয়াটলিকুয়ের অন্য ৪০০ পুত্র তাদের মা আবারো গর্ভবতী হয়েছে এমন খবর শুনে এত ক্ষেপে গিয়েছিল যে, তারা চেষ্টা করেছিল তাদের মায়ের মাথা কেটে ফেলতে। তবে, ঠিক সেই সময়ে তিনি হুইটসিলোপচলির জন্ম দিয়েছিলেন, আর তিনি জন্মই নিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবে সশস্ত্র হয়ে এবং তাঁর ৪০০ সৎভাইকে হত্যা করার জন্য তিনি খুব বেশি সময় নেননি, শুধুমাত্র কয়েকজন ছাড়া যারা পালিয়েছিল দক্ষিণে। হুইটসিলোেপচলি এরপর পঞ্চম সূর্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। 

অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত সূর্যদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে তাদের নরবলি দিতে হবে, অন্যথায় প্রতি সকালে সে পূর্বদিকে উঠবে না। স্পষ্টতই তাদের কারোরই একবারো মনে হয়নি বিষয়টি একটু পরীক্ষা করে দেখার জন্য, যেমন—একদিন নরবলি না দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা, তা সত্ত্বেও পরের দিন সকালে পূর্বদিকে সূর্য উদিত হচ্ছে কি না। এই নরবলিগুলো খুবই বিখ্যাতভাবে বীভৎস। অ্যাজটেকদের স্বর্ণযুগের শেষ পর্বে যখন স্পেনবাসীরা সেখানে হাজির হয়েছিল [তাদের নিজস্ব বীভৎসতা নিয়েও তারা এসেছিল], এই সূর্যপূজা তার চরম বীভৎস রূপে পৌঁছেছিল। ধারণা করা হয় ১৪৮৭ সালে টেনোচটিটলানের মহামন্দিরটি পুনঃউৎসর্গ করার অনুষ্ঠানটিতে প্রায় ২০,০০০ থেকে ৮০,০০০ মানুষকে বলি দেয়া হয়েছিল। সূর্যদেবতার সন্তুষ্টির জন্য বহু ধরনের উপহার নিবেদন করা যেত, কিন্তু তিনি যা আসলেই পছন্দ করতেন সেটি হচ্ছে মানুষের রক্ত, মানুষের স্পন্দনরত হৃৎপিণ্ড। সেই সময়ে তাদের যুদ্ধ করার একটি প্রধান কারণ ছিল বহুসংখ্যক বন্দিসংগ্রহ করা যেন তাদেরকে এভাবে বিসর্জন দেয়া যায়, সাধারণত হৃৎপিণ্ড তাদের শরীর থেকে কেটে বের করে আনার মাধ্যমে। অনুষ্ঠানটি সাধারণত হত উঁচু কোনো জায়গায় [সূর্যের কাছাকাছি হবার জন্য], যেমন—সেইসব অসাধারণ পিরামিডগুলোর উপরে, যেগুলো বানানো জন্যে অ্যাজটেক, মায়া আর ইনকারা বিখ্যাত ছিল। যাকে বলি দেয়া হবে তাকে একটি পূজার বেদির উপর চারজন পূজারি জোর করে শুইয়ে শক্ত করে ধরে রাখত, আর পঞ্চম পূজারি ছুরি চালাত। যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত হৃৎপিণ্ড কেটে বাইরে বের করে আনত, সূর্যের প্রতি নিবেদন হিসেবে উপরে তুলে ধরা সময় যেন সেটি তখনো স্পন্দনরত থাকে। অন্যদিকে সেই হৃৎপিণ্ডহীন আর রক্তাক্ত মৃতদেহ পাহাড়ের ঢাল বা পিরামিডের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ত নিচে, যেখানে সেগুলো সংগ্ৰহ করতে বৃদ্ধ মানুষেরা এবং তারপর সাধারণ ধর্মীয় আচারের জন্য প্রস্তুত কোনো খাদ্যে মাংস হিসেবে ব্যবহারের জন্যে সেগুলোকে কাটা হত। 

পিরামিডের সাথে আমরা আরেকটি প্রাচীন সভ্যতাকে সংশ্লিষ্ট করে থাকি, সেটি প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা। প্রাচীন মিসরীয়রাও সূর্যপূজারি ছিল। তাদের দেবতাদের মধ্যে অন্যতম একজন দেবতা ছিলেন সূর্যদেবতা ‘রা’। একটি মিসরীয় পুরাণ আকাশের বক্রতাটি বিবেচনা করে দেবী ‘নুট’-এর শরীর হিসেবে, তিনি পৃথিবীর উপর একটি আর্চ বা খিলানের মতো অবস্থান করছেন। প্রতিরাতে দেবী সূর্যকে গিলে ফেলেন এবং প্রতি সকালে আবার সূর্যের জন্ম দেন। 

প্রাচীন গ্রিক আর উত্তরের নর্সম্যানসহ, বহু জনগোষ্ঠীর কিংবদন্তিতে আছে, সূর্য হচ্ছে আকাশ অতিক্রমকারী একটি রথ। গ্রিকদের সূর্যদেবতার নাম ছিল হেলিওস এবং সেখান থেকে সূর্য সংক্রান্ত নানা বৈজ্ঞানিক নামগুলোর উৎপত্তি হয়েছে, যা আমরা অধ্যায় ৫-এ দেখেছি। 

অন্য পুরাণে, সূর্য কোনো দেবতা নয়, কিন্তু কোনো একজন দেবতার সৃষ্টিগুলোর মধ্যে প্রথম একটি সৃষ্টি। মধ্য-প্রাচ্যের মরুভূমির হিব্রু গোত্রের পুরাণ হচ্ছে, তাদের গোত্রীয় দেবতা ইয়াওয়ে [YHWH] তাঁর সবকিছু সৃষ্টি করার ছয় দিনের প্রথম দিনে আলো সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তারপর, বিস্ময়করভাবে তিনি সূর্য সৃষ্টি করেননি চতুর্থ দিন অবধি। ‘আর ঈশ্বর দুটি মহান আলো সৃষ্টি করেন : দিনের বেলা রাজত্ব করার জন্যে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী আলো আর রাতের বেলায় শাসন করার জন্য কম শক্তিশালী আলো : তিনি রাতের নক্ষত্রগুলোও সৃষ্টি করেন।’ কিন্তু প্রথম দিন আলো কোথা থেকে এসেছিল, সূর্য আর নক্ষত্র সৃষ্টি হবার আগে? সেটি কিন্তু আমাদের বলা হয়নি। 

এবার সময় হল বাস্তবতার দিকে নজর দেয়া, সূর্যের সত্যিকার প্রকৃতির দিকে নজর দেয়া, যা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। 

আসলেই সূর্য কী? 

সূর্য হচ্ছে একটি নক্ষত্র, অন্য বহু নক্ষত্রের চেয়ে এটি খুব আলাদা কোনো কিছু নয়, শুধুমাত্র, আমরা এর কাছাকাছি অবস্থান করি, আর সে-কারণে অন্য কোনো নক্ষত্রের তুলনায় এটি দেখতে আকারে বড় আর অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং একই কারণে, সূর্য, অন্য যে-কোনো নক্ষত্রের ব্যতিক্রম, অনেক তপ্ত অনুভূত হয়, এটি আমাদের চোখ নষ্ট করে দিতে পারে, যদি আমরা এর দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকি এবং এটি আমাদের চামড়া পুড়িয়ে ফেলতে পারে যদি আমরা সূর্যের প্রখর আলোয় বাইরে বেশিক্ষণ থাকি। এটি শুধুমাত্র অন্য যে-কোনো নক্ষত্রের চেয়ে আমাদের ‘খানিকটা’ নিকটবর্তীই শুধু নয় : আসলে আমাদের অনেক বেশি কাছে এটির অবস্থান। নক্ষত্রগুলো আসলে কত দূরে আর মহাশূন্য আসলেই কতটা সুবিশাল সেটি অনুধাবন করা খুবই কঠিন। অনুধাবন করা আসলেই কঠিনের চেয়েও অনেক কঠিন, প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। জন ক্যাসিডি’র ‘আর্থসার্চ’ নামে চমৎকার একটি বই আছে, সেটি একটি স্কেল মডেল ব্যবহার করে বিষয়টি কিছুটা বুঝতে বইটি চেষ্টা করেছিল। 

[১] একটি ফুটবল নিয়ে বড় একটি মাঠে নিয়ে যান এবং তারপর এটিকে মাটিতে নামিয়ে রাখুন, যা সূর্যকে প্রতিনিধিত্ব করবে। 

[২] এরপর প্রায় ২৫ মিটার দূরে হেঁটে চলে যান এবং সেখানে শুকনো গোলমরিচের একটি বীজ রাখুন, সূর্যের সাথে পৃথিবীর তুলনামূলক আকার ও সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের প্রতিনিধিত্ব করতে।

[৩] এই মাত্রায় চাঁদ হবে কোনো আলপিনের মাথার সমান এবং এটি গোলমরিচের সেই বীজের থেকে মাত্র ৫ সেন্টিমিটার দূরে থাকবে।

[৪] কিন্তু সূর্য ছাড়া আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী অন্য নক্ষত্রটি হচ্ছে প্রক্সিমা সেন্টোরাই, সেই একই মাত্রায় হবে আরেকটি ফুটবলের মতো [খানিকটা ছোট] এবং এর অবস্থান প্রায়… দাঁড়ান… অপেক্ষা করুন, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে! 

প্রক্সিমা সেন্টোরাই প্রদক্ষিণ করছে এমন কোনো গ্রহ থাকতে বা না-ও থাকতে পারে, কিন্তু অবশ্যই বহু নক্ষত্র আছে যাদের চারপাশে গ্রহ আছে, হয়তো বেশিরভাগ নক্ষত্রের ক্ষেত্রে সেটি ঠিক। আর নক্ষত্রগুলোর পারস্পরিক দূরত্বের চেয়ে প্রতিটি নক্ষত্র ও তাদের গ্রহগুলোর মধ্যে দূরত্ব সাধারণত কম। 

নক্ষত্ররা কিভাবে কাজ করে 

কোনো একটি নক্ষত্র বা তারা [যেমন, আমাদের সূর্য] এবং একটি গ্রহের [মঙ্গল কিংবা বৃহস্পতি] মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, তারারা উজ্জ্বল আর উত্তপ্ত এবং আমরা তাদের নিজেদের আলোয় দেখতে পাই, কিন্তু গ্রহগুলো অপেক্ষাকৃত শীতল এবং নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে আসা আলো প্রতিফলনের কারণে আমরা তাদের দেখতে পাই, যার চারদিকে তারা প্রদক্ষিণ করছে। আর সেই পার্থক্য, আবার ঘটে, তাদের আকারের তারতম্যের কারণে। বিষয়টি ঘটে এভাবে। 

আকারে কোনো বস্তু যতই বড় হবে, তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানও তত শক্তিশালী হবে এর কেন্দ্র বরাবর। সবকিছুই সবকিছুকে মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে টানে। আপনি ও আমি পরস্পরের উপর মাধ্যাকর্ষণের শক্তির টান প্রয়োগ করি, কিন্তু লক্ষ করার জন্যে সেই টান খুবই দুর্বল, যদি-না এই দুটো শরীরের কোনো একটি খুবই বিশাল আকারের হয়। পৃথিবী বিশাল, সে-কারণে এর দিকে আমরা একটি শক্তিশালী টান অনুভব করি। যখন আমরা কোনোকিছু ফেলে দেই এটি নিচের দিকে পড়ে—অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। 

কোনো নক্ষত্র পৃথিবীর মতো গ্রহের চেয়ে আকারে অনেক বেশি বড়, সুতরাং এর মহাকর্ষীয় টান অনেক বেশি শক্তিশালী। বড় কোনো নক্ষত্রের মধ্যভাগে তীব্র চাপ থাকে, কারণ প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি মহাকর্ষীয় বল নক্ষত্রের মধ্যে সবকিছুকে এর কেন্দ্রের দিকে টানে। আর কোনো নক্ষত্রের ভিতরে চাপ যত বেশি হবে ততেই এটি উত্তপ্ত হবে। যখন তাপমাত্রা আসলেই খুব বেশি বেড়ে যায়—আপনার কিংবা আমার সম্ভাব্য সব কল্পনার চেয়েও বেশি, খুব ধীরে কাজ করা কোনো হাইড্রোজেন বোমার মতো নক্ষত্রটি আচরণ করতে শুরু করে, এটি প্রচুর পরিমাণে তাপ ও আলো সৃষ্টি করে এবং রাতের আকাশে আমরা তাদের উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে দেখি। তীব্র তাপ নক্ষত্রকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে দেয়, আর একই সাথে মাধ্যাকর্ষণ সবকিছুকে এর কেন্দ্রের দিকে টেনে ধরে। বাইরে ছড়িয়ে পড়ার ধাক্কা আর মাধ্যাকর্ষণের ভিতরমুখী টান, এই দুটি বিপরীতমুখী বলের মধ্যে একটি ভারসাম্য কাজ করে। নক্ষত্র নিজেই নিজের থার্মোস্ট্যাট [তাপমাত্রা পরিবর্তন শনাক্ত ও প্রয়োজনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্ৰণ হিসেবে কাজ করে। যতই উত্তপ্ত হয় এটি, ততই এটি স্ফীত হয় এবং ততই এটি আকারে বড় হয়। ততই কেন্দ্রের ভর কম ঘনীভূত হয়, সুতরাং এটি খানিকটা শীতলও হয়। এর মানে এটি আবারো সঙ্কুচিত হবে এবং এটি আবার তাকে উত্তপ্ত করে তুলবে এবং এভাবে চলতে থাকে। শুনলে মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডের হৃদস্পন্দনের মতো নক্ষত্ররাও একবার ফুলছে আর একবার সঙ্কুচিত হচ্ছে, কিন্তু এটি তেমন নয়। বরং এটি একটি মধ্যম আকারে এসে স্থির হয়, যা নক্ষত্রকে সেই সঠিক তাপমাত্রায় রাখে, সেভাবে থাকার জন্য যা দরকার। 

আমি শুরু করেছিলাম এমনকিছু বলে যে, সূর্য অনেক নক্ষত্রের মতোই একটি নক্ষত্র, কিন্তু আসলে বহু ধরনের নক্ষত্র আছে মহাবিশ্বে, আর তাদের আকারে বৈচিত্র্যও অনেক বেশি। আমাদের সূর্য আকারে খুব বেশি বড় নয়, যদি অন্য নক্ষত্রদের সাথে এর তুলনা করা হয়। প্রক্সিমা সেন্টোরাই থেকে এটি সামান্য বড়, তবে অন্য বহু নক্ষত্রের চেয়ে এটি আকারে অনেক ক্ষুদ্ৰ। 

আমাদের জানা মতে সবচেয়ে বড় নক্ষত্র কোনটি? সেটি নির্ভর করবে কিভাবে আপনি তাদের পরিমাপ করবেন। যে নক্ষত্রটি আড়াআড়িভাবে সবচেয়ে বড় সেটির নাম ভিওয়াই ক্যানিস মেজোরিস [VY CanIs MajorIs], এক পাশ থেকে অন্য পাশে [এর ব্যাস] এটি সূর্যের চেয়ে ২০০০ গুণ বড়। আর সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। 

তবে, ভিওয়াই ক্যানিস মেজোরিস এত বেশি হালকা যে, আকারে এত বড় হওয়া সত্ত্বেও এর ভর সূর্যের চেয়ে মাত্র ৩০ গুণ বেশি, এর সব উপাদানের ঘনত্ব যদি সূর্যের মতো হত তাহলে এর হাজার কোটি গুণ ভারী হবার কথা ছিল। অন্যগুলো, যেমন—পিস্তল স্টার অথবা আরো সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কার হওয়া এটা কারিনি আর আর ১৩৬এ১ [R136a1, খুব আকর্ষণীয় কোনো নাম নয়] সূর্যের চেয়ে ১০০ গুণ অথবা তার চেয়েও বেশি তাদের আকারে। পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের ভর ৩০০,০০০ গুণ বেশি, তার মানে এটা কারিনি’র ভর পৃথিবীর চেয়ে ৩০ মিলিয়ন গুণ বেশি। 

যদি দানবীয় একটি নক্ষত্র, যেমন—R136a1-এর কোনো গ্ৰহ থাকে, সেগুলো অবশ্যই এর থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থান করবে, নয়তো তাৎক্ষণিকভাবেই সেগুলোর বাষ্প হয়ে যাবার কথা। এর মহাকর্ষীয় বল এত বেশি [কারণ এর সুবিশাল ভর], যদিও গ্রহগুলো আসলেই বহু দূরে অবস্থান করে, কিন্তু তারপরও গ্রহগুলো এর চারপাশে একটি কক্ষপথে বাধা থাকবে। 

যদি এরকরম কোনো একটি গ্রহ থেকে থাকে এবং কেউ যদি সেখানে বাস করে, R136a1 সম্ভবত তাদের কাছে দেখতে তেমনই বড় মনে হবে যেমন সূর্যকে আমাদের কাছে মনে হয়। কারণ যদিও আকারে সূর্যের চেয়ে এটি অনেক বেশি বড়, কিন্তু এটি এত দূরে থাকবে যে, ঠিক সঠিক পরিমাণ দূরত্বে, বাস্তবিকভাবে, ঠিক সঠিক আকারের জীবন ধারণ করার জন্য, অন্যথায় সেখানে কোনো জীবনই থাকবে না! 

একটি নক্ষত্রের জীবনকাহিনি 

যদিও R136a1 নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণরত গ্রহ থাকার সম্ভাবনা আসলেই বেশ কম, জীবন তো আরো দূরের ব্যাপার। এর কারণ হচ্ছে খুব বিশাল আকারের কোনো নক্ষত্রের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত। R136a1 সম্ভবত এক মিলিয়ন বছর প্রাচীন, যা সূর্যের বয়সের হাজার ভাগের একভাগেরও কম অবধি : জীবনের বিবর্তন হবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সময় সেখানে অতিক্রম হয়নি। 

সূর্য হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ছোট, আরো বেশি ‘মূলধারার’ নক্ষত্র : সেই ধরনের নক্ষত্র, যেগুলোর জীবনের গল্পের ব্যাপ্তি হাজার কোটি বছরের মাত্রায় [শুধুমাত্র মিলিয়ন নয়], যে সময়ে এটি অতিক্রম করে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পর্ব। অনেকটা কোনো শিশুর মতো, যে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়, মধ্যবয়স অতিক্রম করে অবশেষে বার্ধক্যপর্ব অতিক্রম করে মারা যায়। মূলধারার তারাগুলো মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি, সব মৌলের মধ্যে যে মৌলটি সবচেয়ে সরলতর। অভ্যন্তরের ‘খুব-ধীরে-কাজ-করা-হাইড্রোজেন-বোমা” এই হাইড্রোজেনকে দ্বিতীয় সরলতম মৌল, হিলিয়ামে রূপান্তর করছে [হাইড্রোজেনের চেয়ে ভিন্ন, এর নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক সূর্যদেবতা হেলিওস থেকে] এবং সেই প্রক্রিয়ায়, তাপ, আলো আর অন্য ধরনের বিকিরণ রূপে এটি বিশাল পরিমাণ শক্তি তৈরি করে। আপনাদের মনে আছে যে, আমি বলেছিলাম যে-কোনো নক্ষত্রের আকার হচ্ছে, তাপের বাইরে দিকে বেরিয়ে আসার ধাক্কা আর মহাকর্ষীয় বলের কেন্দ্রমুখী টানের মধ্যে একটি ভারসাম্য। বেশ, মোটামুটিভাবে ভারসাম্যটা একই থাকে, যা কয়েক বিলিয়ন বছর নক্ষত্রকে কর্মক্ষম অবস্থায় রাখে। যতদিন-না নক্ষত্রের সব জ্বালানি শেষ না হয়ে যায়। এরপরে সাধারণত যা ঘটে, তা হল মহাকর্ষীয় বলের বাধাহীন প্রভাবের কারণে এটি তার নিজের উপরেই ধসে পড়ে—যে মূহূর্তে নারকীয় যজ্ঞের সূচনা হয় [যদি সম্ভব হয় নক্ষত্রের অভ্যন্তরের নারকীয় অবস্থা এমনিতেই যেমন বিদ্যমান, তার চেয়ে আরো নারকীয় কিছু চিন্তা করে দেখুন]। 

নক্ষত্রের জীবনকাহিনি কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানীর একক জীবদ্দশায় দেখার জন্যে অনেক বিশাল, তাঁরা শুধু এর খুব সামান্য খানিকটা অংশই দেখতে পান। সৌভাগ্যক্রমে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যখন তাঁরা আকাশ নিরীক্ষা করেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের নক্ষত্রদের দেখতে পান, প্রত্যেকেই তাদের পূর্ণ বিকাশ প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে আছে। কিছু শিশু-তারা আছে, যাদের দেখা গেছে ধুলা আর গ্যাসের মেঘ থেকে সৃষ্টি হতে, যেমন করে আমাদের সূর্য তৈরি হয়ে ছিল সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে। বহু মধ্যবয়সী তারা আছে আমাদের সূর্যের মতো, কিছু বৃদ্ধ ও মৃত হবার পথে তারাও দেখা যায়, আরো কয়েক বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের কী হতে পারে, সেগুলো আমাদের আগাম একটি ধারণা দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রদের একটি সমৃদ্ধ ‘চিড়িয়াখানা’ গড়ে তুলেছেন, নক্ষত্রদের জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপ আর আকারে যেখানে তাদের অবস্থান। আর এই ‘চিড়িয়াখানার’ সব সদস্যই প্রদর্শন করে, অন্যগুলো কেমন দেখতে ছিল আর তাদের ভবিষ্যৎ কেমন? 

কোনো একটি সাধারণ নক্ষত্রের মতোই আমাদের সূর্যেরও একদিন সব হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে, আর যেমন আমি বর্ণনা করলাম, এটি এরপর হিলিয়ামকে ‘পোড়াতে’ শুরু করবে [আমি পোড়ানো বলেছি, তবে এটি আসলে পোড়ানো নয়, আরো বেশি উত্তপ্ত একটি প্রক্রিয়া], এই পর্যায়ে এটিকে বলা হয় ‘রেড জায়ান্ট’ বা লোহিত দানব। প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বছর পর সূর্য একটি রেড জায়ান্টে পরিণত হবে, এর মানে এটি মোটামুটি এখন তার জীবনচক্রের ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থান করছে, কিন্তু তার বহু আগেই আমাদের এই অসহায় পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বসবাস করার জন্য। দুই বিলিয়ন বছর পর সূর্য এখনকার চেয়ে আরো ১৫ শতাংশ বেশি উজ্জ্বলতর হবে, এর মানে আজ যেমন শুক্ৰ গ্ৰহ, পৃথিবী তেমন হবে। শুক্র গ্রহে কেউই বাঁচতে পারবে না, সেখানে তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও বেশি, কিন্তু দুই বিলিয়ন বছর আসলেই লম্বা একটি সময় এবং মানুষ অবশ্যই তার বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সুতরাং দাহ্য হবার জন্য কেউ সেখানে অবশিষ্ট থাকবে না। অথবা আমাদের প্রযুক্তি, এমন একটি পর্যায়ে অগ্রসর হবে যে আমরা আসলেই পৃথিবীকে তখন সুবিধাজনক একটি কক্ষপথে সরিয়ে দিতে পারব, কিন্তু পরে, যখন হিলিয়ামও শেষ হয়ে যাবে, সূর্য মূলত পুরোপুরি হারিয়ে যাবে ধুলা আর অবশিষ্টাংশের মেঘে, বাকি থাকবে একটি ছোট কেন্দ্রস্থল বা ‘কোর’, যাকে ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’ বা শ্বেত বামন বলা হয়, সেটি ক্রমশ শীতল হয়ে ম্লান হয়ে যাবে। 

সুপারনোভা এবং নক্ষত্রকণা 

যে নক্ষত্রগুলোর আমাদের সূর্যের চেয়েও আকারে অনেক বেশি বড় আর উত্তপ্ত, যেমন সেই দানবীয় নক্ষত্রগুলো যাদের নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ আগেই কথা বলেছিলাম, গল্পটি তাদের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে শেষ হয়। এই দানবগুলো তাদের হাইড্রোজেন ‘পুড়িয়ে’ ফেলে দ্রুত এবং তাদের ‘হাইড্রোজেন বোমা” পারমাণবিক চুল্লি শুধুমাত্র হাইড্রোজেন পরমাণুদের জোড়া লাগিয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াই তৈরি করা ছাড়াও আরো বেশি কিছু করে। অপেক্ষাকৃত বড় নক্ষত্রদের এইসব আরো উত্তপ্ত চুল্লিগুলো হিলিয়াম নিউক্লিয়াইদের জোড়া লাগিয়ে আরো ভারী মৌল তৈরি করে এবং এভাবেই তারা বহু ধরনের ভারী মৌলের পরমাণু তৈরি করে। এই ভারী মৌলগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও লোহা [কিন্তু লোহার চেয়ে ভারী কিছু নয় আপাতত] : যে মৌলগুলো পৃথিবীতে এবং আমাদের সবার মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত সময়ে, এ ধরনের খুব বিশাল আকারের কোনো নক্ষত্র অবশেষে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে একটি দানবীয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় সুপারনোভা এবং এই বিস্ফোরণগুলোয় লোহার চেয়ে ভারী মৌলগুলো তৈরি হয়। 

কী হবে যদি ‘এটা কারিনি’ কালই বিস্ফোরিত হয় একটি সুপারনোভা হয়ে? সেটি হবে সব বিস্ফোরণের জননী, কিন্তু চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, কারণ আরো ৮০০০ বছর অতিক্রান্ত না হলে সেই মহাবিস্ফোরণের কথা আমরা জানতে পারব না, কারণ এটা কারিনি আর আমাদের মধ্যে সুবিশাল দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর সেই পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন হবে [আর কোনোকিছু আলোর চেয়ে দ্রুত বেগে চলতে পারে না], কিন্তু ধরুন যদি ‘এটা কারিনি’ ৮০০০ বছর আগেই বিস্ফোরিত হয়ে থাকে? বেশ, সে ক্ষেত্রে আলো আর অন্য বিকিরণ যা সেই বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল আসলেই আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে এখন যে-কোনো সময়ে। যে মুহূর্তে আমরা এটি দেখতে পাব, আমরা জানব যে এটা কারিনি এর ৮০০০ বছর আগেই বিস্ফোরিত হয়েছে। লিপিবদ্ধ ইতিহাস বলছে আজ অবধি মাত্র ২০টি সুপারনোভা দেখা গিয়েছে। ১৬০৪ সালের ৯ অক্টোবর, বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহানেস কেপলার একটি দেখেছিলেন, যে বিস্ফোরণের অবিষ্টাংশ এখন আরো অনেক ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর প্রথমদেখার সেই দিনটি থেকে। এই বিস্ফোরণটি আসলে ঘটেছিল সেই সময়েরও ২০,০০০ বছর আগে, মোটামুটি সেই সময়ে যখন নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়েছিল। 

সুপারনোভাগুলো, সাধারণ নক্ষত্রগুলোর ব্যতিক্রম, লোহার চেয়েও ভারী মৌল তৈরি করতে পারে : যেমন—সিসা আর ইউরেনিয়াম। একটি সুপারনোভার দানবীয় বিস্ফোরণ সব মৌলগুলো চারিদিকে বহু দূরে মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয় যা সেই নক্ষত্রটি আর পরে সুপারনোভাটি তৈরি করেছিল, যার মধ্যে জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় মৌলগুলো অন্তর্ভুক্ত। অবশেষে এই ধুলোর মেঘ, ভারী মৌলে যা সমৃদ্ধ, চক্রটি আবার শুরু করে, নতুন নক্ষত্র আর গ্রহদের তৈরি করে তারা ঘনীভূত হয়। এখান থেকে আমাদের পৃথিবীর সব পদার্থ এসেছিল এবং সে-কারণে আমাদের গ্রহে সেইসব মৌল আছে, আমাদের তৈরি করার জন্য যা-কিছু দরকার : কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি; সেই ধুলো থেকেই এগুলো সব এসেছে, বহুদিন আগে ঘটা একটি সুপারনোভার পরে যা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল, যা এই মহাবিশ্বকে আলোকিত করেছিল। এটাই সেই কাব্যিক বাক্যটির উৎস : We are stardust, আমরা সবাই নক্ষত্ৰকণা দিয়ে তৈরি, এটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। কখনো কখনো [কিন্তু খুবই দুর্লভ] ঘটা সুপারনোভা বিস্ফোরণগুলো ছাড়া, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলগুলোর কোনো অস্তিত্বই থাকত না। 

চারিদিকে বিরতিহীন ঘোরা 

একটি বাস্তব সত্য যা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না তা হল, পৃথিবী ও সূর্যের অন্য গ্রহগুলো তাদের নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে একই ‘সমতলে’। এর মানে কী? তাত্ত্বিকভাবে, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে-কোনো একটি গ্রহের কক্ষপথ হয়তো অন্য কোনোটির চেয়ে খানিকটা হেলানো থাকতে পারে যে-কোনো কোণে, কিন্তু আসলে এভাবে কোনোকিছু নেই। যেন মনে হতে হতে পারে একটি অদৃশ্য চ্যাপ্টা চাকতি আছে আকাশে, যার কেন্দ্রে আছে সূর্য, আর সব গ্রহই তার চারপাশে ঘুরছে সেই চাকতি উপর, শুধু কেন্দ্র থেকে তারা ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত। আরো একটি বাস্তব সত্য হচ্ছে গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরছে একই দিক বরাবর। 

কেন? সম্ভবত এর কারণ এভাবেই তারা শুরু করেছিল। প্রথমে এই ঘোরার দিকটি লক্ষ করা যাক। পুরো সৌরজগৎ, তার মানে সূর্য আর গ্রহগুলো, শুরু হয়েছিল ধীরে ঘূর্ণায়মান গ্যাস আর ধুলোর মেঘ হিসেবে সম্ভবত সেটি ছিল কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের অবশিষ্টাংশ। মহাবিশ্বে অন্য যে-কোনো স্বাধীনভাবে ভাসমান বস্তুর মতো, এই মেঘটি তার নিজের অক্ষের উপর ঘুরছিল এবং, হ্যাঁ, আপনি ঠিক অনুমান করেছেন : এই ঘোরার দিকটি ছিল একই, যে দিকে গ্রহগুলো এখন সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। 

কিন্তু তাহলে কেন গ্রহগুলো সেই চ্যাপটা ‘চাকতি’র একই সমতলে অবস্থান করে? কিছু জটিল মাধ্যাকর্ষণজনিত কারণে, যা আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব না এখানে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা খুব ভালো করেই সেটি বোঝেন; মহাশূন্যে বিশাল ঘূর্ণায়মান গ্যাস আর ধুলোর কোনো মেঘ ঘূর্ণায়মান চাকতির রূপ নেয়, যার কেন্দ্রে থাকে বিশাল জমাট বাঁধা অংশ এবং ধারণা করা হয়ে সেটাই ঘটেছিল আমাদের সৌরজগতের সাথে। ধুলা, গ্যাস আর পদার্থের ক্ষুদ্র টুকরোগুলো আর ধুলো আর গ্যাস হিসেবে রয়ে যায়নি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তারা তাদের প্রতিবেশীর কাছাকাছি জড়ো হয়েছিল, যেভাবে এই অধ্যায়ে আগেই আমি বর্ণনা করেছিলাম। তারা তাদের সেই প্রতিবেশীদের সাথে যুক্ত হয়ে পদার্থের আরো বড় টুকরো তৈরি করে। সেই টুকরো যতই বড় হয়ে ওঠে, ততই তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানও তীব্রতর হতে থাকে। সুতরাং, যা ঘটেছিল আমাদের সেই ঘূর্ণায়মান চাকতির সাথে তা হল বড় টুকরোগুলো আরো বেশি বড় হয়েছিল, সুতরাং তারা তাদের আশেপাশে সব ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের শুষে নিয়েছিল। 

সবচেয়ে বড় টুকরো হয়েছিল কেন্দ্রের সূর্য, অন্য টুকরোগুলো, যথেষ্ট বড়, ছোট ছোট টুকরাগুলোকে শুষে নিয়েছিল যেগুলো তাদের কাছাকাছি ছিল, তবে তারা সূর্য থেকে দূরে ছিল যথেষ্ট পরিমাণে যে সূর্য তাদের শুষে নিতে পারেনি। তারা পরিণত হয়েছিল গ্রহে। সূর্যের কাছে থেকে দূরে গ্রহদের ধারাবাহিকভাবে আমরা নাম দিয়েছি মার্কারি [বুধ], ভিনাস [শুক্র, আর্থ [পৃথিবী], মার্স [মঙ্গল], জুপিটার [বৃহস্পতি], স্যাটার্ন [শনি], ইউরেনাস ও নেপচুন। প্রাচীন তালিকাটি প্লুটোকে রেখেছে নেপচুনের পরে, কিন্তু এখন মনে করা হয় গ্রহ হিসেবে চিহ্নিত হবার জন্য এটি আকারে অনেক বেশি ছোট। 

গ্রহাণুপুঞ্জ ও উল্কাপিণ্ড 

ভিন্ন পরিস্থিতিতে আরেকটি গ্রহও তৈরি হতে পারত মঙ্গল আর বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যে, কিন্তু ছোট ছোট টুকরাগুলো যারা একসাথে যুক্ত হয়ে এই বাড়তি গ্রহটি তৈরি করতে পারত, সম্ভবত বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণের তীব্র উপস্থিতি তাদের সেটি করতে বাধা দিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো প্রদক্ষিণরত অবশিষ্টাংশের বলয় হিসেবে রয়ে গেছে, যাকে আমরা বলি ‘অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট’। মঙ্গল আর বৃহস্পতির কক্ষপথের মধ্যে এই গ্রহাণুপুঞ্জ একসাথে একটি বলয় তৈরি করে। এখানে সেই বাড়তি গ্রহটি থাকত যদি তারা একসাথে হতে পারত। শনির চারপাশে বিখ্যাত বলয়ও সেখানে আছে একই কারণে। তারাও একসাথে জড়ো হয়ে আরেকটা উপগ্রহ তৈরি করতে পারত [শনির ইতোমধ্যে ৬২টি উপগ্রহ আছে, তাহলে এটি হত ৬৩ তম], কিন্তু তারা আসলে পৃথক হিসেবে রয়ে গেছে পাথর আর ধুলোর রিং বা বলয় হিসেবে। গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়ে—শনির বলয়ের সমতুল্য সূর্যের বলয়, সেখানে কিছু অবশিষ্টাংশ যথেষ্ট বড়, তাদের বলা যেতে পারে প্লানেটেসিমাল [ঠিক পুরোপুরি ‘গ্রহ’ নয়], এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি, যার নাম ‘সেরেস’, প্রায় ১০০০ কিমি তার প্রশস্ততায়, যথেষ্ট বড় ও গোলাকৃতি মোটামুটি কোনো একটি গ্রহের মতো, কিন্তু অধিকাংশই বিচিত্র ধরনের পাথরখণ্ড আর ধুলোর টুকরো। তারা মাঝে মাঝে একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়, বিলিয়ার্ড বলের মতো, আর মাঝে মাঝে তাদের কোনো কোনোটি গ্রহাণুদের বলয় থেকে ধাক্কা খেয়ে বের হয়ে আসে এবং যা অন্য কোনো গ্রহের খুব কাছাকাছি চলে আসে, যেমন—পৃথিবী। আমরা প্রায়ই তাদের দেখি, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরেই তারা জ্বলে যায়, শুটিং স্টার বা মিটিওর বা উল্কাপিণ্ড হিসেবে তাদের আমরা চিনি। 

যদিও কম সাধারণ ঘটনা, বায়মণ্ডল অতিক্রম করার জন্যে উল্কাপিণ্ড আকারে যথেষ্ট বড় হতে পারে এবং আসলেই সেগুলো পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়ে। ১৯৯২ সালে ৯ অক্টোবর, একটি উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলে টুকরো হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল, বড় ইটের টুকরোর মতো একটি খণ্ড একটি গাড়িকে আঘাত করেছিল নিউইয়র্কের পিকস্কিলে। আরো অনেক বড় একটি উল্কাপিণ্ড, একটি বাড়ির সমান যার আকার, সাইবেরিয়ায় বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৯০৮ সালের ৩০ জুন, যা একটি বনভূমির বিশাল এলাকায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। 

বিজ্ঞানীদের কাছে এখন প্রমাণ আছে যে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে আরো বড় উল্কাপিণ্ড আঘাত করেছিল ইউকাটানে, বর্তমান মধ্য-আমেরিকায় এবং এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল, যা সম্ভবত ডায়নোসরদের মেরে ফেলেছিল। গণনা করে দেখা গেছে যে এই ভয়াবহ সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় যে পরিমাণ শক্তির অবমুক্তি ঘটিয়েছিল, সেটি পৃথিবীর সব পারমাণবিক বোমা ইউকাটানে একসাথে বিস্ফোরিত করা হলে যে পরিমাণ শক্তির অবমুক্তি ঘটত, তার চেয়েও শতগুণ বেশি শক্তিশালী। দুনিয়াকাঁপানো ভূমিকম্প, সুবিশাল সুনামি, বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চলে আগুন এবং ধুলা আর ধোঁয়ার মেঘের ঘন আবরণ সৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়ই, যা বহু বছরের জন্য পৃথিবীপৃষ্ঠকে অন্ধকার করে রেখেছিল। 

এই পরিস্থিতিতে বহু উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করতে পারেনি, কারণ তাদের দরকার সূর্যের আলো এবং সেইসব প্রাণীরা যাদের গাছ দরকার খাদ্যের জন্যে তারাও খাদ্যাভাবের শিকার হয়েছিল। ডায়নোসররা মারা গিয়েছিল সেটি বিস্ময়কর নয়, বরং আমাদের স্তন্যপায়ী পূর্বসূরিরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। হয়তো মাটির নিচে হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রায় থাকা ছোট একটি জনগোষ্ঠী বেঁচে গিয়েছিল। 

আমাদের জীবনের আলো 

আমাদের জীবনে সূর্যের গুরুত্ব নিয়ে কিছু কথা বলে আমি এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই। মহাবিশ্বে অন্য কোথাও জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা আমরা জানি না [যে প্রশ্নটি আমি পরের কোনো অধ্যায়ে আলোচনা করব] কিন্তু আমরা জানি, যদি অন্য কোথাও জীবন থেকে থাকে, প্ৰায় নিশ্চিতভাবে কোনো নক্ষত্রের নিকটবর্তী সেটি থাকবে। আমরা আরো বলতে পারি, যদি সেটি অন্ততপক্ষে আমাদের জীবনের মতো কোনোকিছু হয়ে থাকে, এটি হবে সম্ভবত এমন কোনো গ্রহে যা এর নক্ষত্র থেকে আপাতদৃষ্টিতে একই দূরত্বে থাকবে, সূর্য থেকে যে দূরত্বে আমরা আছি। আপাতদৃষ্টিতে ‘একই দূরত্ব’ বলতে আমি বোঝাচ্ছি কোনো জীবন তার থেকে এই দূরত্বটি যেভাবে অনুভব করবে। সত্যিকারের দূরত্ব হতে পারে অনেক বিশাল একটি মাত্রার, যেমনটি আমরা দেখেছি সুপার জায়ান্ট R136a1 নক্ষত্রের ক্ষেত্রে, কিন্তু যদি আপাত দূরত্ব একই হয়, তাহলে সেখানকার ‘সূর্য’ তাদের কাছে দেখতে একই আকারের হবে আমাদের সূর্যটি যেমন আমাদের কাছে মনে হয়। তার মানে হচ্ছে তাপ আর আলো যা আমরা এর থেকে পাই সেটি প্রায় সমান হবে। 

আর কেন কোনো একটি নক্ষত্রের কাছাকাছি জীবনকে থাকতে হবে? কারণ সব জীবনের জন্যে শক্তির প্রয়োজন, আর শক্তির একটি সুস্পষ্ট উৎস হচ্ছে নক্ষত্রের আলো। পৃথিবীতে উদ্ভিদরা সূর্যের আলো জড়ো করে এবং এর শক্তিটিকে পৃথিবীর সব জীবের কাছে লভ্য করে তোলে। বলা যেতে পারে উদ্ভিদ সূর্যের আলো খেয়ে বাঁচে, কিন্তু তাদের অন্য জিনিস ও দরকার, বাতাস থেকে, যেমন—কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পানি আর মাটি থেকে কিছু খনিজ, কিন্তু তারা তাদের শক্তি পায় সূর্যের আলো থেকে, তারা এই শক্তিটিকে ব্যবহার করে শর্করা উৎপাদনে, যা এক ধরনের জ্বালানি, যা পরিচালিত করে সবকিছুই যা তাদের করার প্রয়োজন। 

শক্তি ছাড়া আপনি শর্করা বানাতে পারবেন না। আর একবার যখন আপনি শর্করা বানাতে পারবেন ও পাবেন, আপনি সেটিকে ‘পোড়াতে’ পারবেন আবার শক্তি ফিরে পাবার জন্য—যদিও আপনি সব শক্তি ফেরত পাবেন না, সবসময় কিছু-না কিছু শক্তি এই প্রক্রিয়ায় আপনি হারাবেন। যখন আমি বলছি ‘পোড়ানো’, তার মানে এই না যে এটি ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আক্ষরিকার্থে পোড়ানো হচ্ছে কোনো জ্বালানি থেকে শক্তি মুক্ত করার একটিমাত্র উপায়। আরো নিয়ন্ত্রিত উপায় আছে শক্তিকে বের করে আনার, ধীর ও উপযোগী উপায়। 

কোনো সবুজ পাতাকে আপনি ভাবতে পারেন একটি নিচু, ছড়িয়ে থাকা কোনো কারখানা, যার পুরো সমতল ছাদ হচ্ছে একটি বড় সোলার প্যানেল, যা সূর্যের আলোকে ফাঁদ পেতে ধরছে এবং সেটিকে ব্যবহার করছে ছাদের নিচে সাজানো অ্যাসেম্বলি লাইনের চাকাগুলোকে চালানোর জন্য। এই কারণে পাতারা পাতলা আর চ্যাপ্টা, যা তাদের বড় বিস্তৃত একটি পৃষ্ঠদেশ দেয় যেখানে সূর্যের আলো পড়তে পারে। এই ফ্যাক্টরি উৎপাদিত পণ্য হচ্ছে নানা ধরনের শর্করা। এরপর এইসব উৎপাদিত শর্করা পাতার শিরার মধ্যে দিয়ে উদ্ভিদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে সেগুলো ব্যবহৃত হয়ে অন্য কিছু বানাতে, যেমন—স্টার্চ, শক্তি সঞ্চয় করে রাখার জন্যে সাধারণ শর্করার চেয়ে যা আরো আরো বেশি সুবিধাজনক একটি উপায়। অবশেষে, স্টার্চ বা শর্করা থেকে শক্তি বিমুক্ত হবে কোনো উদ্ভিদের অন্য সব অংশ তৈরির জন্য। 

তৃণভোজী প্রাণীরা [যারা শুধু উদ্ভিদ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে], যেমন— অ্যান্টিলোপ বা খরগোশ, যখন উদ্ভিদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, এই শক্তি হস্তান্তরিত হয় তৃণভোজী প্রাণীদের শরীরে—আর আবারো, এই প্রক্রিয়ায় তার কিছুটা হারিয়েও যায়। তৃণভোজীরা সেই শক্তি ব্যবহার করে তাদের শরীর নির্মাণ করতে, তাদের মাংসপেশিদের জ্বালানি সরবরাহ করতে যেন তারা তাদের কাজ করতে পারে। তাদের সেই কাজের মধ্যে আছে, আরো বেশি করে উদ্ভিদ থেকে খাদ্যসংগ্রহ করা। শক্তি যা মাংসপেশিকে শক্তি দেয় যেন তারা হেঁটে বেড়াতে পারে আর পাতা চিবাতে পারে, যুদ্ধ করতে পারে এবং প্রজনন করতে পারে। উদ্ভিদের মাধ্যমে এই শক্তি আসছে সূর্য থেকে। 

তারপর অন্য প্রাণীরা, মাংসাশীরা এই দৃশ্যে উপস্থিত হয় তৃণভোজীদের খাবার জন্য। শক্তি হস্তান্তরিত হয় আরো একবার [আবারো এই প্রক্রিয়ায় কিছু শক্তি হারিয়ে যায়] এবং এটি মাংসাশীদের মাংসপেশিকে শক্তি দেয়, যখন তারা তাদের কাজ করে। এই ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে খাওয়ার জন্য, আরো তৃণভোজী প্রাণীদের শিকার করা, সেইসাথে আরো অন্য নানা কাজ তারা যা করে থাকে, যেমন প্রজনন, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব করা, গাছে ওঠা এবং স্তন্যপায়ীদের জন্য তাদের শিশুদের জন্য দুধ তৈরি করা। তারপরও, সূর্যই হচ্ছে শক্তির মূল যোগানদাতা, যখন সেই শক্তি তাদের কাছে পৌঁছায় পরোক্ষ কোনো উপায়ে এবং সেই পরোক্ষ উপায়ের প্রতিটি ধাপে, বেশ ভালো পরিমাণ শক্তির অংশ হারিয়ে যায় হারিয়ে যায় তাপ হিসেবে, যা বাকি মহাবিশ্বকে উষ্ণ করার অপ্রয়োজনীয় কাজটি করতে অবদান রাখে। 

অন্য প্রাণীরা, যেমন—পরজীবীরা, তৃণভোজী ও মাংসাশী প্রাণীদের জীবন্ত শরীর থেকে তাদের খাদ্য গ্রহণ করে। আরো একবার শক্তি যা পরজীবীদের শক্তি যোগায় সেটাও আসছে সূর্য থেকে, আবারো এর সবটুকুই ব্যবহার হচ্ছে না, এর কিছুটা অপচয় হয়ে তাপ হিসেবে। 

পরিশেষে, যখন কিছু মারা যায়, উদ্ভিদ কিংবা তৃণভোজী বা মাংসাশী বা পরজীবী, সেগুলো খেয়ে নেয় পচা মাংস-ভোজী স্ক্যাভেন্জার যেমন— বারিইং বিটল, অথবা এটি ক্ষয় হয়ে যায়, যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাকটেরিয়া অথবা ছত্রাক। তারা শুধু ভিন্ন এক ধরনের স্ক্যাভেন্জার। আবারো সূর্য থেকে আসা শক্তি হস্তান্তরিত হয় এবং আবারো এর কিছু তাপ হিসেবে হারিয়ে যায়। আর সে-কারণেই কম্পোস্টের স্তূপ বেশ গরম। এই স্তূপে সব তাপ মূলত আসছে সূর্য থেকে, যা সংগ্রহ করেছিল এর আগের বছরের পাতার সোলার প্যানেলগুলো। খুব চমৎকার একটি অস্ট্রেলীয়-এশীয় পাখি, যাদের নাম মেগাপোডস, তারা কম্পোস্টের তাপ ব্যবহার করে তাদের ডিমে তা দেয়ার জন্য। অন্য পাখিদের ব্যতিক্রম, যারা তাদের ডিমের উপর বসে এবং তাদের শরীরের তাপ দিয়ে ডিম উষ্ণ করে, মেগাপোডসরা কম্পোস্টের একটি স্তূপ তৈরি করে এবং সেখানে তারা ডিম পাড়ে। তারা স্তূপের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এর সাথে আরো কম্পোস্ট যোগ করে এটি আরো উষ্ণতর করে তুলেতে অথবা কম্পোস্ট সরিয়ে আরো শীতলতর করে, কিন্তু সব পাখি অবশেষে সেই সূর্যের শক্তিই ব্যবহার করে তাদের ডিমে তা দেয়ার জন্য, সেটি তাদের শরীরের তাপ দিয়ে হোক অথবা কম্পোস্টের স্তূপ হোক। 

কখনো উদ্ভিদেরা কারো খাদ্য হয় না বরং তারা কোনো জলাশয়ের নিচে ডুবে যায়। বহু শতাব্দী ধরে কাদার স্তরের নিচে, ক্রমশ আরো নতুন স্তর তৈরি হবার মাধ্যমে তীব্র চাপে এরা পিট কয়লায় রূপান্তরিত হয়। পশ্চিম আয়ারল্যান্ডে অথবা স্কটল্যান্ডের দ্বীপগুলোর অধিবাসীরা শীতে তাদের বাড়িগুলো উষ্ণ রাখতে এই পিট কয়লা খুঁড়ে বের করে সেগুলো ইটের মতো করে টুকরো করে কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। আরো একবার, এরাও আটকে পড়া সূর্যের আলো—এই ক্ষেত্রে সেই আলো আটকে পড়েছে বহু শতাব্দী আগে, যার শক্তি অবমুক্ত হয় আগুন হিসেবে গলওয়ে থেকে হেবরিডেসে। 

সঠিক পরিস্থিতিতে এবং বহু মিলিয়ন বছর ধরে, পিট আরো তীব্র চাপে রূপান্তরিত হতে থাকে, যেন এটি একসময় কয়লায় পরিণত হয়। ওজন মাপে কয়লা পিটের চেয়ে জ্বালানি হিসেবে অনেক বেশি দক্ষ এবং অনেক উচ্চ তাপমাত্রায় এটি দাহ্য। আর কয়লার আগুন আর চুল্লি অষ্টাদশ আর ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প-বিপ্লবের চালিকাশক্তি ছিল। কোনো একটি ইস্পাতের কারখানা বা একটি ব্লাস্ট ফারনেসের তীব্র তাপ, জ্বলন্ত ফায়ারবক্স যা ভিক্টোরীয় স্টিমইঞ্জিনকে লোহার রেলে গর্জন করে ছুটে যেতে সাহায্য করেছিল অথবা তাদের জাহাজকে দ্রুত এগিয়ে যেতে দিয়েছে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে। সেইসব তাপ মূলত এসেছে সূর্য থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগের বেঁচে থাকা গাছের পাতার মাধ্যমে। 

পরে সুতার কলগুলো চলত কয়লাচালিত স্টিমইঞ্জিনে, আবারো মূলত সূর্য থেকে আসা শক্তির মাধ্যমে, কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে বাষ্পে রূপান্তরিত হবার আগে কারখানাগুলো একটি অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় অতিক্রম করেছিল। তারা তাদের পানির চাকা বাদ দেয়নি লুম আর শাটল চালানোর জন্য, কিন্তু স্টিম ব্যবহার করেছিল একটি ট্যাঙ্কে পানি পাম্প করার জন্য, যেখান থেকে এটি ওয়াটার হুইলের কাছে প্রবাহিত হত, তারপর এটি আবার পানি পাম্প করে দিতে তার আগের জায়গায়। সুতরাং পানি মেঘে উত্তোলন করেছে সূর্য নাকি এটিকে উত্তোলন করেছে কয়লাচালিত বাষ্পীয় ইঞ্জিন, কোনো পানি ট্যাঙ্কে প্রবেশ করানোর জন্য সেই শক্তি প্রথমত আসছে সূর্য থেকে। পার্থক্য হচ্ছে যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত হচ্ছে সূর্যের সংগৃহীত আলো যা সংগ্রহ করেছিল উদ্ভিদ বহু মিলিয়ন বছর আগে, যা কয়লা হিসেবে সংরক্ষিত আছে মাটির নিচে, অন্যদিকে পানির হুইল নদীর উপর চালিত হচ্ছে সূর্যের আলো, যা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই পাহাড়ের উপর জমা হয়েছে পানি রূপে। এই ধরনের ‘সঞ্চিত’ সূর্যের আলোকে বলে পোটেনশিয়াল এনার্জি। কারণ পানির সেই পোটেনশিয়াল আছে, এর ভিতরে ধারণ করার শক্তি, কাজ করার শক্তি, যখন এটি নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। 

এটি আমাদের চমৎকারভাবে বুঝতে সাহায্য করে সূর্য কিভাবে জীবন পরিচালনা করার শক্তির যোগান দেয়। যখন উদ্ভিদরা সূর্যের আলো ব্যবহার করে শর্করা তৈরি করার জন্য, এই প্রক্রিয়াটি পাহাড়ের উপর পানি পাম্প করে তোলার মতো একটি কাজ, অথরা কোনো ফ্যাক্টরির ছাদে পানির ট্যাঙ্কে পানি তুলে করে জমা করে রাখার মতো। যখন উদ্ভিদ [অথবা তৃণভোজী যারা উদ্ভিদ খায় অথবা মাংসাশী যারা তৃণভোজীদের খায়] সেই শর্করাটি ব্যবহার করে [অথবা সেই শর্করা থেকে তৈরি স্টার্চ, অথবা সেই স্টার্চের কারণে সৃষ্ট হওয়া মাংস]; আমরা শর্করাকে ভাবতে পারি পুড়ছে বলে, ধীরে পুড়ছে মাংস চালনা করার জন্য, ঠিক যেভাবে কয়লা দ্রুত পোড়ে বাষ্প তৈরি করতে যা কোনো কারাখানার মূল শ্যাফট চালায়। 

যদি আমরা আক্ষরিকার্থে আগুনে চিনি [শর্করা] বা অন্য কোনো খাদ্য জ্বালানি পোড়াই সেটি আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। পোড়ানোর প্রক্রিয়ায় অপচয় হয় বেশি, সূর্যের সঞ্চিত শক্তি পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়ায় এটি বিধ্বংসী প্রক্রিয়া। আমাদের কোষে যা-কিছু ঘটুক-না কেন, এত ধীর ও সতর্কতার সাথে সেগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় যে, এটি যেন পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া পানির দ্বারা পরিচালিত ধারাবাহিকভাবে সাজানো ওয়াটার- হুইল। শর্করা তৈরি করতে সূর্য-চালিত রাসায়নিক বিক্রিয়া যা সবুজ পাতায় ঘটে, সেটি উপরের দিকে শক্তি ব্যবহার করে পানি পাম্প করে তোলার মতো। প্রাণী আর উদ্ভিদ কোষে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো যারা শক্তি ব্যবহার করে—মাংসপেশি পরিচালিত করতে, যেমন—সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রিত ধাপে ধাপে। উচ্চশক্তির জ্বালানি, শর্করা অথবা যাই হোক-না কেন, তাদের শক্তি অবমুক্ত করতে প্ররোচিত করা যেতে পারে ধাপে ধাপে, বেশকিছু ধারাবাহিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে, যার প্রতিটি তার পরের বিক্রিয়াকে পরিচালিত করে, ধারাবাহিক ছোট জলপ্রপাতের মতো বয়ে যাওয়া কোনো নদীর মতো, যা একের পর এক ছোট ‘ওয়াটার- হুইলগুলোকে’ ঘুরিয়ে। 

বিস্তারিত বিষয় যাই হোক-না কেন, জীবনের সব ওয়াটার-হুইল আর কগ কিংবা ড্রাইভ শ্যাফট মূলত পরিচালিত হয় সূর্যের দ্বারা। হয়তো সেই আদিম মানুষেরা আরো বেশি ভক্তির সাথে সূর্যদেবতার উপাসনা করতেন যদি তাঁরা অনুধাবন করতে পারতেন জীবনের কতটুকু সূর্যের ওপর নির্ভরশীল। আমি এখন যা ভাবছি তা হল, আর কত নক্ষত্র আছে মহাবিশ্বে, যারা তাদের প্রদক্ষিণরত কোনো জীবনের যন্ত্র এভাবে পরিচালনা করছে, কিন্তু সেই আলোচনার জন্যে পরের একটি অধ্যায়ের জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *