৬. সুষমা মেঘবতী

৬. সুষমা মেঘবতী

টুনিদের স্কুলে সাধারণত বছরের মাঝখানে কেউ ভর্তি হয় না। কিন্তু দেখা গেল টুনিদের ক্লাশেই হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার আগে নতুন একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে। নতুন কেউ ভর্তি হলে তাকে বাজিয়ে নিতে হয়। যারা মোটামুটি ভালো ছাত্র কিংবা ছাত্রী তারা বাজিয়ে নেয় দেখার জন্য এই নতুন মানুষটি লেখাপড়ায় কীরকম–তার কারণে তাদের রোল নম্বর এক দুই ঘর পিছিয়ে যাবে কিনা। যারা দুষ্টু তারা বাজিয়ে নিতে চায় দেখার জন্য নতুন মানুষটি কী রকম দুষ্টু, তাদের দল কী ভারী করা যাবে কিনা সেইটা জানতে চায়। যারা পাজি টাইপের তারা বাজিয়ে দেখতে চায় নতুন মানুষটা সহজ সরল টাইপের কিনা সেটা দেখার জন্য, তাকে জ্বালাতন করে আনন্দ পাওয়া যায় কিনা সেটা বোঝার জন্য!

তবে মজার ব্যাপার হলো কোনো দলই বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। দেখা গেল মেয়েটা কথা বলতেই রাজি না। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে। বিড়বিড় করে কী বলে সেটা নিয়েও কেউ পুরোপুরি নিশ্চিত না–কয়েকজন বলছে সে বলে, “আমি এখন কথা বলতে চাই না”, বলছে সে বলে, “প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না”, আবার কয়েকজন বলছে সে বলে, “দূর হও–জাহান্নামে যাও বেকুব কোথাকার!” পরিচয় হওয়ার আগেই একজন সবাইকে বেকুব ডাকবে, জাহান্নামে যেতে বলবে সেটা বিশ্বাস হয় না কিন্তু কেউ আর কোনো কিছুতেই নিশ্চিত না।

কয়েক দিনের ভিতরেই সবাই হাল ছেড়ে দিল। বুঝে গেল মেয়েটা অন্যরকম, হয় বাড়াবাড়ি অহংকারী না হয় তার কোনো একটা ঝামেলা আছে। মেয়েটার নাম সুষমা মেঘবতী এবং তার রোল নম্বর বাহান্ন। এ ছাড়া আর কেউ কিছু জানতে পারল না এবং মনে হলো এইটুকু দিয়েই সবাইকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে ৷

সবাই হাল ছেড়ে দিলেও টুনি হাল ছাড়ল না। সে একটিবারও মেয়েটির কাছে যায়নি কিংবা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। কিন্তু মেয়েটা সম্পর্কে জানার জন্য তার এক ধরনের কৌতূহল হলো। সে এটাও বুঝতে পারল মেয়েটা সম্পর্কে আসলেই যদি কিছু জানা সম্ভব হয় তাহলে সেটা তার পক্ষেই সম্ভব, আর কেউ সেটা পারবে না।

টুনি তাই মেয়েটা যেখানে বসে তার থেকে কয়েকটা বেঞ্চ পিছনে এক পাশে একটু সরে গিয়ে বসতে লাগল যেন মেয়েটাকে সারাক্ষণ দেখতে পারে। কয়েকদিন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে মেয়েটা সম্পর্কে কয়েকটা বিষয় আবিষ্কার করল। একটি বিষয় হচ্ছে কোনো একটা কারণে মেয়েটার খুবই মন খারাপ। কাউকে সে কিছু বুঝতে দেয় না কিন্তু উদাস মুখে কোনো একদিকে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর খুব সাবধানে চোখের কোণা থেকে এক ফোঁটা পানি মুছে ফেলে। মেয়েটার মনে কোনো একটা কষ্ট যার কথা কেউ জানে না। টুনির খুব মায়া হয় তার জন্য।

টুনি আরো একটা জিনিস লক্ষ করল। মেয়েটা মাঝে মাঝেই তার ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা ধরে নিশ্চিত হতে চায় সেটা এখনো সেখানে আছে। অনেক সময় ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বসে থাকে, আনমনা হয়ে কোনো একদিকে তাকিয়ে থাকে।

যখন টিফিনের ছুটি হয় তখন সবাই হৈচৈ করে চিৎকার করে ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে যায় শুধু এই মেয়েটা চুপ করে বসে থাকে। অনেক সময় দুই হাত টেবিলে রেখে সেই হাতে মাথা গুঁজে বসে থাকে। মেয়েটাকে আরো ভালো করে লক্ষ করার জন্য একদিন টুনি টিফিন ছুটিতে বের না হয়ে নিজের সিটে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ডাইরি লিখতে লাগল–তাকে দেখলে মনে হতে পারে এই ডাইরি লেখার ওপরেই তার জীবন মরণ নির্ভর করছে। মেয়েটা একা থাকতে চায়। তাই নিশ্চয়ই মনে মনে মেয়েটা টুনির উপরে বিরক্ত হয়েছে কিন্তু তার কিছু করার নেই। মেয়েটা যেন কিছুই সন্দেহ না করে সে জন্য টুনি একবারও মাথা তুলে তাকাল না। চোখের কোণা দিয়ে বুঝতে পারল মাঝে মাঝে মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে টুনিকে দেখছে। যখন বুঝতে পারল টুনি তাকে লক্ষ করছে না তখন খুব সাবধানে একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল। টুনি অবশ্যি কিছুক্ষণেই বুঝে গেল মেয়েটি আসলে বইটি পড়ছে না। কারণ একবারও বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টালো না বইয়ের একজায়গাতেই তাকিয়ে আছে। মনে হয় বইয়ের ভিতরে কিছু একটা রাখা আছে, মেয়েটি সেটির দিকে তাকিয়ে আছে।

টুনি তখন মেয়েটার সাথে সহজ হওয়ার জন্য তার পরের কাজগুলো শুরু করল। মেয়েটা যেহেতু কথা বলতে চায় না তাই সে মেয়েটার সাথে এমনভাবে কথা বলবে যেন মেয়েটার কথার উত্তর দিতে না হয়। কয়েকদিন এভাবে কথা বললে মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে মেনে নিবে।

তাই টুনি বেশ শব্দ করে তার ডাইরি লেখা শেষ করল এবং টুনি বুঝতে পারল মেয়েটা সাথে সাথে তার বইটা বন্ধ করে ফেলেছে। টুনি তখন আরো শব্দ করে তার সিট থেকে উঠল এবং মেয়েটা তখন বইটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। টুনি ক্লাশরুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে মেয়েটার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার নামটা কী সুইট! সুষমা মেঘবতী। ইশ! আমার যদি তোমার মতো এতো সুন্দর একটা নাম থাকতো! সুষমা মেঘবতী! আমার আব্বু আম্মু আমার কী নাম রেখেছে জান?

টুনি মেয়েটার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, কথা বলতে থাকল, “আমার নাম রেখেছে টুনি! টুনি একটা নাম হলো? সবাই ইয়ারকি করে ডাকে টুনটুনি। চিন্তা করতে পার? এখন ছোট আছি ঠিক আছে। যখন বড় হব চাকরি-বাকরি করব তখন কী হবে? ধর স্কুলের টিচার হলাম–ছাত্রছাত্রীরা আমাকে ডাকবে টুনটুনি ম্যাডাম! ছিঃ ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা!”

টুনটুনি হতাশ হওয়ার ভঙ্গী করতে করতে মেয়েটার কোনো উত্তর দেবার জন্য অপেক্ষা না করেই বের হয়ে গেল। প্রথম দিন মেয়েটাকে নিজের নামটা বলে দেওয়া হলো–আজকে এটুকুই থাক। আস্তে আস্তে এগুতে হবে।

পরের দিন টিফিন ছুটির পর টুনি অপেক্ষা করল ক্লাশরুমটা খালি হয়ে যাবার জন্য। যখন পুরোপুরি খালি হয়ে গেল তখন সে তার সিট থেকে উঠে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে এগুতে থাকে। মেয়েটার কাছাকাছি এসে সে দাঁড়িয়ে গিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নামের দুটো অংশই এতো সুন্দর! সুষমা আর মেঘবতী! আমি ঠিক করেছি তোমাকে মেঘবতী বলে ডাকব।” টুনি তারপর টেনে টেনে উচ্চারণ করল, “মে-ঘ-ব-তী! মনে হয় একটা কবিতা বলছি।” তারপর আবার তার নামটা উচ্চারণ করতে করতে বের হয়ে গেল। মেয়েটাকে আজকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে সে তাকে ডাকাডাকি করবে। মনে মনে একটু রেডি হয়ে থাকুক।

পরের দিন টুনি আরেকটু এগিয়ে গেল, পিছন থেকেই তাকে ডাকলো, “মেঘবতী!”

মেয়েটা একটু চমকে উঠে তার দিকে তাকালো। টুনি তখন তাকে বলল, “মেঘবতী, তুমি তো নতুন এসেছ সবার সাথে পরিচয় হয় নাই। তোমাকে কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তোমার কাজে লাগবে। প্রথমেই তোমার রাজুকে চিনতে হবে। রাজু হচ্ছে আমাদের ফার্স্টবয়। লেখাপড়ায় জন্মেও কেউ তাকে হারাতে পারবে না। বাম হাতে লিখেও পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে যাবে। যারা ফার্স্টবয় হয় তারা সাধারণত হয় অহংকারী আর হিংসুক। কিন্তু আমাদের রাজু মোটেও অহংকারী না হিংসুকও না। যদি নৌকার অঙ্ক না হলে বানরের বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্কে আটকে যাও, তুমি রাজুকে জিজ্ঞেস করলে সাথে সাথে তোমাকে বুঝিয়ে দেবে। শুধু অঙ্ক না সে বাংলা ইংরেজি সব জানে। বিবমিষা বানান জিজ্ঞেস করে দেখো সে বলে দেবে। তুষ-ই-কার দীর্ঘ-ঈ-কার দন্ত্য-স তালব্য-শ মূর্ধন্য-ষ কোনো গোলমাল হবে না। খাটাসের ইংরেজি জিজ্ঞেস করে দেখো কিংবা আল-জিহ্বার ইংরেজি জিজ্ঞেস করে দেখো, সেইটাও বলে দেবে। রাজু হচ্ছে একেবারে পারফেক্ট ছেলে। তাকে নিয়ে অনেক কাহিনী আছে পরে তোমাকে একদিন বলব।”

টুনি টানা কথা বলে একটু দম নেওয়ার জন্য থামল। মেঘবতী কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে টুনির সব কথা বুঝে উঠতে পারছে না। টুনি অবশ্য সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না, আবার শুরু করল, “বুঝলে মেঘবতী। রাজুর ঠিক উল্টা হচ্ছে সবুজ। রোল নাম্বার ফর্টি থ্রী। আগে দুষ্টু ছিল এখন যতই দিন যাচ্ছে সে পাজি হয়ে যাচ্ছে। যদি দেখে একজন ছেলে বা মেয়ে একটু নরম টাইপের ব্যস তাহলেই হলো, তাকে জ্বালাতন শুরু করবে। তোমাকে দেখে অবশ্য নরম টাইপ মনে হচ্ছে না কাজেই তোমার মনে হয় কোনো ঝামেলা হবে না–তবু জানিয়ে রাখলাম। মনে থাকবে তো? রোল নাম্বার ফর্টি থ্রী। তাকে নিয়েও অনেক কাহিনী আছে, যদি শুনতে চাও তোমাকে বলব।” টুনি মুখটা হাসিহাসি করে তার বক্তৃতা শেষ করে হেঁটে হেঁটে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। মেঘবতী নিশ্চয়ই ভাবছে তার একটু মাথা খারাপ। ভাবুক। মেয়েটার মনে কিছু একটা নিয়ে কষ্ট, তার একজন বন্ধু দরকার।

টুনি পরের দিন কী বলবে সেটা মোটামুটি ঠিক করে রেখেছিল কিন্তু তার আগেই একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গেল।

.

সেদিন স্কুল ছুটির পর টুনি বের হয়েছে। স্কুলের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি। যারা বড়লোকের ছেলেমেয়ে তাদেরকে নেওয়ার জন্য গাড়ি এসেছে। যাদের বাসা একটু দূরে তারা রিকশায় উঠেছে। অন্যেরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। টুনির হেঁটে যেতে ভালোই লাগে।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ টুনি লক্ষ করল মেঘবতী তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। টুনি একটু চিন্তা করল, তাড়াতাড়ি হেঁটে তাকে ধরে ফেলে দুজন একসাথে হেঁটে যাবে কী না। কিন্তু মেঘবতী বেশ খানিকটা দূরে, তাড়াতাড়ি হেঁটেও তাকে ধরে ফেলা সহজ হবে না। টুনি তাই তার পিছু পিছুই যাওয়া ঠিক করল। যদি এর মাঝে সে তার বাসায় ঢুকে যায় তাহলে বাসাটা চিনে রাখবে।

টুনি দেখল মেঘবর্তী হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দূর থেকে এটা কিসের দোকান বোঝা যাচ্ছে না। মেঘবতী খানিকক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করল তারপর আবার হেঁটে যেতে শুরু করল।

খানিকদূর গিয়ে আবার ঘুরে দোকানটার সামনে ফিরে এলো, দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে দোকানটাতে ঢুকবে কী ঢুকবে না পুরোপুরি ঠিক করতে পারছে না। তারপর হঠাৎ কী মনে করে দোকানে ঢুকে গেল।

টুনি দোকানটা ভালো করে দেখার জন্য রাস্তার অন্যপাশে গিয়ে হেঁটে একটু সামনে গিয়ে বুঝতে পারল এটা একটা ফার্মেসি, ওষুধের দোকান। টুনি রাস্তার অন্যপাশে অপেক্ষা করে এবং বেশ খানিকক্ষণ পর মেঘবতী বের হয়ে এলো, হাতে একটা ছোট প্যাকেট। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে ছোট ব্যাগটার ভিতর থেকে কোনো একটা ওষুধ বের করে, তারপর তার স্কুলের ব্যাগ থেকে হলুদ রঙের একটা পলিথিনের ব্যাগের ভিতর ওষুধটা রাখল। তারপর পলিথিনের ব্যাগটার ভিতরে তাকাল, সেখানে কী আছে একটু দেখে সেটা তার স্কুলের ব্যাগের ভিতর রেখে হাঁটতে শুরু করল। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, মেঘবর্তী একটা ওষুধ কিনে একটা ব্যাগে রাখছে, টুনি সেটা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাতো না কিন্তু হঠাৎ করে তার ভিতরে একটা খটকা লাগল। কারণ দেখল মেঘবতী হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর সেটাতে ঢুকে গেল। তার যদি ওষুধ কিনতেই হবে সব ওষুধ একটা ফার্মেসি থেকে কেন কিনছে না?

টুনি রাস্তার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে মানুষজনের ভিতর আড়ালে থেকে লক্ষ করে। মেঘবতী কিছুক্ষণ পর আবার একটা ছোট প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে এলো। আবার ছোট প্যাকেট থেকে একটা ওষুধ বের করে তার হলুদ ব্যাগে রাখল। তারপর খালি প্যাকেটটা রাস্তার পাশে একটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে হাঁটতে লাগল। মেঘবতী ফার্মেসি থেকে কোনো একটা ওষুধ কিনে কিনে এক জায়গায় রাখছে। কী এমন ওষুধ যেটা একটা ফার্মেসি থেকে কেনা যায় না? টুনির বুকটা হঠাৎ ছ্যাৎ করে উঠে। ঘুমের ওষুধ না তো?

মেঘবতী আবার হাঁটছে, আবার একটা ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। এবারে কী হবে টুনি সেটা জানে। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। সত্যি সত্যি মেঘবতী মেয়েটা একটা ওষুধ কিনে তার হলুদ প্যাকেট রাখছে। প্রেসক্রিশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি করা যায় না, অনেক অনুরোধ করলে হয়তো একটা বিক্রি করতে পারে, মেঘবতী নিশ্চয়ই তাই করছে। এক দোকান থেকে পারবে না তাই অনেকগুলো দোকান থেকে কিনছে। কিন্তু সত্যিই কী ঘুমের ওষুধ? অন্য কিছু যদি হয়? ব্যাপারটা পুরোপুরি না জানা পর্যন্ত টুনি শান্তি পাচ্ছে না। কিন্তু কীভাবে সেটা পুরোপুরি ঠিকভাবে জানতে পারবে? ফার্মেসিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, কিন্তু তাকে কি বলবে? একটু কায়দা করে জিজ্ঞেস করতে হবে যেন কোনো কিছু সন্দেহ না করে। টুনি দেখল মেঘবতী হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাস্তার পাশে দোকানের সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই ফার্মেসি খুঁজে বেড়াচ্ছে। টুনি তাকে চলে যেতে দিল। তারপর রাস্তা পার হয়ে ফার্মেসিটাতে ঢুকে গেল। একটু আগে এখানে মেঘবতী ঢুকে একটু ওষুধ কিনেছে।

ফার্মেসির ভিতরে একজন মানুষ ওষুধ কিনছে, টুনি তার পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। দোকানের আরেকজন কর্মচারী এগিয়ে এসে কাউন্টারের ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করল, “কী লাগবে তোমার?”

টুনি বলল, “আমি ঠিক জানি না –“

মানুষটার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। বলল, “কী লাগবে তুমি জান না? সমস্যাটা কী শুনি।”

টুনি বলল, “আসলে আমার, চাচি আমাকে আর আমার কাজিনকে একটা ওষুধ কিনে নিতে বলেছে। কাগজটা ভুলে বাসায় রেখে এসেছি।”

“ওষুধের নাম জান?”

“নাহ্। আমার কাজিন একটু আগে এদিক দিয়ে গেছে। সে ওষুধটা কিনলে আমাকে আর কিনতে হবে না।”

“তোমার কাজিন কে, আমরা কীভাবে বলব?”

“ঠিক আমার মতো বয়স, স্কুল ড্রেস পরা।”

মানুষটা মাথা নাড়ল বলল, “হ্যাঁ একটু আগে এসেছিল। এক ডজন টেবলেট কিনতে এসেছিল। প্রেসক্রিশান ছাড়া এসেছে তাই আমরা বিক্রি করতে চাই নাই। অনেক জোরাজুরি করল তখন একটা দিয়েছি।”

টুনি ভান করল সে জানতে পেরে অনেক স্বস্তি পেয়েছে। বলল, “গুড। এখন মনে হয় একটাতেই হবে। চাচি চাইলে পরে আরো বেশি কিনতে পারবে।“

মানুষটা বলল, “প্রেসক্রিপশান ছাড়া কেউ দিবে না। আর তোমরা ছোট মানুষেরা কেন এই ওষুধ কিনতে এসেছ? বলবে বড় মানুষদের পাঠাতে।”

টুনি বলল, “বলব। বলব। কী ওষুধ ছিল ওইটা? দরকারী ওষুধ?”

“যার ঘুম হয় না তার জন্য অনেক দরকারী।”

“ও আচ্ছা, আচ্ছা।” টুনি বলল, “থ্যাংকু থ্যাংকু।” সে চলে যেতে যেতে কী মনে করে আবার ফিরে এল, বলল, “আচ্ছা আপনাদের কাছে কি ভিটামিন সি ওষুধটা আছে?”

“হ্যাঁ আছে।”

“সেইটা কিনতে কি প্রেসক্রিশান লাগে?”

“না! এটা লজেন্সের মতো। চুষে চুষে খায়। প্রেসক্রিপশান লাগে না।”

টুনি তার ব্যাগ খুলে দেখল তার কাছে কত টাকা আছে, তারপর বলল, “আমাকে দুই পাতা দিবেন?”

মানুষটা দুই পাতা ভিটামিন সি লজেন্স দিল। দেখে মনে হয় ওষুধ কিন্তু চুষে খেতে বেশ মজা। টুনি অবশ্যি মজা করে খাওয়ার জন্য কিনল না। তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা কাজ করছে, সেখানে কাজে লাগবে।

বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় টুনির কেমন জানি অশান্তি হতে থাকে। মেঘবতী মেয়েটা এভাবে ঘুমের ওষুধ কিনছে কেন? মানুষ সুইসাইড করার জন্য ঘুমের ওষুধ খায়। তাহলে কী এই মেয়েটা সুইসাইড করার কথা চিন্তা করছে? এতো ছোট বাচ্চা মেয়েরা কী কখনো সুইসাইডের কথা চিন্তা করে? কী সর্বনাশ! বড়দের সাথে এইটা নিয়ে কথা বলতে হবে।

.

টুনির যখন বড় মানুষদের সাথে কথা বলতে হয় তখন সে সবসময় ঝুমু খালাকে দিয়ে শুরু করে। ঝুমু খালাকে যত আজব একটা জিনিসই বলা হোক না কেন সে অবাক হয় না। পৃথিবীর যে কোনো বিষয়ে ঝুমু খালার নিজের একটা মত থাকে। তাই আজকেও টুনি ঝুমু খালাকে দিয়ে শুরু করল। রান্নাঘরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঝুমু খালা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

ঝুমু খালা চুলার আগুন কমাতে কমাতে বলল, “কী কথা? কোনো সমস্যা?“

“না, কোনো সমস্যা না।”

“বল, কী বলবা।”

“ছোট মেয়েরা কী কখনো সুইসাইড করে?”

ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “কী বল তুমি? ছোট মেয়েরাই তো সুইসাইড খায়।”

“সুইসাইড কেউ খায় না ঝুমু খালা।” টুনি শুদ্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “সুইসাইড করে।”

ঝুমু খালা বলল, “তুমি আমারে শিখাইবা কোনটা খায় আর কোনটা করে? তুমি কোনটা করছ বল?”

টুনি বলল, “আমি কোনোটা করি নাই।”

ঝুমু খালা বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি কমপক্ষে চারবার চেষ্টা করছি।”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি চারবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছ? কী সর্বনাশ!”

“সর্বনাশের কী আছে? গেরাম ঘরে ছোটবেলায় সবাই চেষ্টা করে।”

“কেন?”

“মায়ে গালি দেয়। তখন মনে হয় এই জেবন রাখুম না। পানিতে ফাল দেয়।”

“ফাল না ঝুমু খালা। লাফ।”

“একই কথা।”

“ঠিক আছে। কিন্তু পানিতে লাফ দিলে কী হয়?

“গেরামঘরের পোলাপান তো সাঁতার জানে। তাই পানিতে ফাল দিয়া লাভ হয় না। একটু পরে যখন শীত লাগে তখন পানি থেকে উইঠা আসে। বাড়ি আসলে মা আবার আচ্ছামতোন বানায়। গেরামঘরে সুইসাইড খাওয়ার মাঝে কোনো শান্তি নাই।“

টুনি বুঝতে পারে ঝুমু খালার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলে লাভ নাই, ঝুমু খালা মনে হয় ব্যাপারটা ধরতেই পারছে না। তাই সে তখন গেল ছোটাচ্চুর কাছে। ছোটাচ্চু তার ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। টুনি গিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?”

ছোটাচ্চু গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “না।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “না?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি খুব একটা জরুরি কাজ করছি। তোর কথা তো আমার কাজ থেকে জরুরি হতে পারবে না।

“যদি হয়?”

ছোটাচ্চু এখন মুখ তুলে টুনির দিকে তাকালো, বলল, “কী কথা, শুনি। যদি জরুরি না হয় তাহলে তোর খবর আছে।”

টুনি বলল, “আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে ছোট বাচ্চারা কি কখনো সুইসাইড করে?”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “কোন ছোট বাচ্চা সুইসাইড করতে চাচ্ছে?”

“কেউ চাচ্ছে না। আমি জানতে চাইছি কখনো ছোটরা সুইসাইড করে কি না!”

“কত ছোট বাচ্চা?’

টুনি ইতস্তত করে বলল, “এই ধর আমার বয়সী।

“তোর বয়সী?”

“হ্যাঁ।”

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ গলার স্বর খুবই নরম করে বলল, “টুনি, তোর কী হয়েছে? এরকম কথা কেন বলছিস? আয়, আমার কাছে, বস। বল আমাকে কী হয়েছে। এরকম কথা তোর মাথায় কেন এসেছে? কে কী করেছে?’

টুনি হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ওহ্ ছোটাচ্চু! আমি সুইসাইড করার কথা ভাবছি না। আমি তোমার কাছে জানতে চাইছি আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা সুইসাইড করে কি না!”

“তুই ভাবছিস না?”

“না।”

“তাহলে যে বললি খুবই জরুরি কথা?”

“ওহ্ ছোটাচ্চু! শুধু আমি করতে চাইলে জরুরি? অন্য কেউ করতে চাইলে জরুরি না?”

“কে করতে চাইছে? আমাদের বাসার কেউ?”

টুনি আবার হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, “না ছোটাচ্চু। আমাদের বাসার কেউ না। “

“তাহলে কে?”

“সেটা এখন তোমাকে বলে লাভ নেই। তুমি শুধু বল আমাদের বয়সী বাচ্চারা সুইসাইড করে কি না।”

ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর বয়স জানি কত? দশ?”

“না। তেরো।“

ছোটাচ্চু মুখটা সূঁচালো করে কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এসএসসি পরীক্ষার পর জিপিএ ফাইভ না পেয়ে অনেক ছেলেমেয়ে সুইসাইড করে, কিন্তু তাদের বয়স তোর বয়স থেকে বেশি। ঈদের দিন নতুন জামা কিনে দেয় নাই বলে একবার একটা মেয়ে সুইসাইড করেছিল কিন্তু তার বয়স কত ছিল সেটা মনে নাই–”

টুনি বলল, “গুগল ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখো–”

“কী ভাইয়া?”

“গুগল ভাইয়া। গুগল চাচ্চুও ডাকতে পার, তুমি যদি চাও।”

ছোটাচ্চু এবারে বুঝতে পারল, চোখ গরম করে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “সবকিছু নিয়ে ইয়ারকি!”

“ইয়ারকি কখন করলাম? একটু সম্মান করে কথা বললাম।”

ছোটাচ্চু তখন ল্যাপটপে খোঁজা শুরু করল। একটু পরে মুখ সূঁচালো করে বলল, “হ্যাঁ, তেরো বছরের কম বয়সীরাও সুইসাইড করে। আমেরিকায় বছরে প্রায় সত্তর জন কমবয়সী বাচ্চা সুইসাইড করে!”

“সর্বনাশ!”

“হ্যাঁ, যখন বয়সন্ধির সময় হয় তখন ছেলেমেয়েরা খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ে, অল্প কিছুতেই তারা খুব আপসেট হয়ে যায়। তখন সুইসাইড বেশি হয়।”

“কীভাবে সুইসাইড বন্ধ করা যায় কিছু লিখেছে?”

ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ তার ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি করল, তারপর বলল, “ঐ তো, কমনসেন্স যেটা বলে সেটাই। যদি দেখা যায় কারো ভিতরে সুইসাইডের ভাব আছে তাহলে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই সাবধান থাকা, চোখে চোখে রাখা। যেসব ব্যবহার করে সুইসাইড করা যায় সেগুলো সরিয়ে রাখা।”

টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু।”

ছোটাচ্চু আরো বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোদের এই বাচ্চা বয়সে যদি সুইসাইড নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় তাহলে তো মুশকিল!”

টুনি কিছু বলল না।

.

রাতে টুনির আম্মু টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি রে টুনি তোর কী হয়েছে? এতো চুপচাপ কেন?”

আম্মুদের কাছে কিছু গোপন রাখা যায় না, টুনি তাই তার চেষ্টাও করল না। বলল, “আমাদের ক্লাশে একটা নতুন মেয়ে এসেছে তাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।”

“কী নিয়ে চিন্তা হচ্ছে?”

“মেয়েটা কারো সাথে কথা বলে না। সারাক্ষণ একা একা বসে থাকে। মেয়েটার সবসময় মন খারাপ থাকে। মাঝে মাঝে কাউকে না দেখিয়ে চোখের

পানি মুছে। কিন্তু সেই জন্য চিন্তা হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে কারণ মেয়েটা ফার্মেসি ঘুরে ঘুরে ঘুমের ওষুধ কিনছে?”

“ঘুমের ওষুধ?” আম্মু ভুরু কুঁচকালেন, “তুই ঠিক জানিস?”

“হ্যাঁ আম্মু। প্রেসক্রিপশান নাই তাই ফার্মেসি তার কাছে ঘুমের ওষুধ বিক্রি করতে চায় না-বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা একটা করে কিনে জমা করছে।”

“কী সর্বনাশ!”

“হ্যাঁ আম্মু, কী করব বুঝতে পারছি না।”

আম্মু মাথা নাড়লেন, বললেন, “এটা আর ছোটদের ব্যাপার নাই। এটা এখন বড়দের ব্যাপার। তার আব্বু আম্মুকে জানাতে হবে, টিচারদের জানাতে হবে। এখানে কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না।”

“বুঝেছি আম্মু।

“কালকে গিয়েই তোদের টিচারদের বলবি। স্কুলের অফিসে নিশ্চয়ই তার গার্জিয়ানদের ফোন নম্বর আছে। তাদেরকে ফোন করতে হবে।”

টুনি মাথা নাড়ল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “যারা সুইসাইড করতে চায় তাদেরকে বোঝানোর কোনো উপায় নাই?”

“নিশ্চয়ই এসব কাজের জন্য প্রফেশনাল কাউন্সেলর আছে, কিন্তু তোরা

তো আর এক্সপার্ট না। তোরা কী বুঝাবি? তবে

“তবে কী আম্মু?”

“সব দেশে সুইসাইড হট লাইন থাকে। যে সুইসাইড করতে যাচ্ছে শেষ মুহূর্তে অনেক সময় তারা সেই হট লাইনে ফোন করে। তখন তাকে টেলিফোনে হেল্প করে।”

“কীভাবে আম্মু?”

“আমি যতদূর জানি তারা শুধু মানুষটাকে কথা বলতে দেয়–তারা খুব দরদ দিয়ে তাদের কথা শুনে। কোনো মানুষ যদি অনেক কষ্টে থাকে তখন যদি মানুষটা তার প্রাণের বন্ধুর সাথে কথা বলে তাহলেই তার কষ্টটা অনেক কমে আসে।”

টুনি হতাশভাবে মাথা নাড়ল। বলল, “মেয়েটার কোনো বন্ধু নাই আম্মু, মেয়েটা কারো সাথে কথা বলে না।”

“তাহলে প্রফেশনাল হেল্প ছাড়া গতি নাই। কালকেই তোদের টিচারকে জানা। এখন টিচাররা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিলে হয়।”

টুনি কিছু বলল না, কোনো একটা কিছু চিন্তা করতে লাগল। আম্মু একটু অবাক হয়ে তার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার এইটুকুন মেয়ের ঘাড়ে কেমন করে এতো বড় বড় দায়িত্ব এসে পড়ে?

.

পরদিন টুনি একটু সকাল সকাল স্কুলে গিয়ে রাজুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাজু এসে তার সিটে স্কুলে ব্যাগটা রাখার আগেই টুনি তাকে ধরে ফেলল, গলা নামিয়ে বলল, “রাজু, বাইরে চল ৷”

“বাইরে? কেন?”

“খুবই জরুরি কাজ।”

“কী কাজ?”

“আয় আমার সাথে বলছি।“

রাজু একটু অবাক হয়ে স্কুল ব্যাগটা ডেস্কে রেখে টুনির সাথে বাইরে এল। টুনি বারান্দার এক কোণায় একটা নিরিবিলি কোণায় গিয়ে রাজুকে বলল, “তোকে একটা কাজ করে দিতে হবে।”

“কী কাজ?”

“খুবই জরুরি কাজ। তোকে করে দিতেই হবে। যেভাবে পারিস।“

রাজু একটু অধৈর্য্য হয়ে বলল, “কী কাজ সেটা আগে বলবি তো।”

টুনি বলল, “আমাদের ক্লাশে একটা নতুন মেয়ে এসেছে দেখেছিস তো?”

“হ্যাঁ, কারো সাথে কথা বলে না। টিফিন ছুটির সময় নিজের সিটে চুপচাপ বসে থাকে। “

“হ্যাঁ। আজকে টিফিন ছুটির পর সবাই যখন বের হয়ে যাবে তখন তুই ঐ মেয়েটাকে দুই মিনিটের জন্য বাইরে নিয়ে যাবি।”

রাজু চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ।”

“আমি কেমন করে ঐ মেয়েকে ক্লাশরুমের বাইরে নিব? ঐ মেয়ে কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না।”

“আমি এতো কিছু বুঝি না। তুই যেভাবে পারিস ঐ মেয়েটাকে কিছু একটা বলে দুই মিনিটের জন্য বাইরে নিবি। কী বলবি তুই ঠিক কর।”

“কী আশ্চর্য–”

টুনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “এর মাঝে আশ্চর্যের কিছু নাই। শুধু শুনে রাখ এটা একটা জীবন মরণের ব্যাপার –“

“জীবন মরণ?”

“হ্যাঁ তোকে আমি সব বলব, এখন আমার কাজটা করে দে।”

রাজু কেমন জানি অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “আমি চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু এই মেয়ে আমার কথা শুনবে কেন?”

“চেষ্টা করে দেখ। যেভাবে পারিস।”

টিফিনের ছুটির ঘণ্টার পর টুনি আজকে অন্য সবার সাথে ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে গেল। টুনির হাতে দুটো ছোট প্যাকেট। সে ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে বেশি দূরে গেল না। দরজার কাছে নিজেকে একটু আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল। রাজু যদি মেঘবতাঁকে ক্লাশরুম থেকে বের করে আনতে পারে তাহলে সে ভিতরে ঢুকে যাবে।

সবাই বের হয়ে যাবার কয়েক মিনিট পর রাজু একটু ব্যস্ত ভঙ্গীতে ক্লাশরুমে ঢুকল, গলা উঁচিয়ে মেয়েটিকে ডাকল, “মেঘবতী।”

মেঘবতী একটু অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকাল।

রাজু গলায় একটুখানি ব্যস্ততা ফুটিয়ে বলল, “তুমি এক সেকেন্ডের জন্য একটু বাইরে আসবে?”

মেঘবতী চোখ বড় বড় করে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি সেদিন টিফিন ছুটিতে তাকে রাজুর কথা বলেছে, রোল নম্বর এক এবং খুবই ভালো ছেলে তাই তাকে সে চিনে। কিন্তু সে একবারও ভাবেনি যে রাজু তাকে এভাবে ডাকবে।

রাজু দুই পা এগিয়ে এসে কাতর গলায় বলল, “প্লিজ তুমি এক সেকেন্ডের জন্য আস। শুধু একটা জিনিস দেখে আমাকে একটা কথা বলবে। তুমি ছাড়া আর কাউকে দিয়ে এটা হবে না। প্লিজ!”

মেঘবতী একটু নড়ে বসে এই প্রথম একটা কথা বলল, “কী দেখব?”

“ক্লাশের সবাই মিলে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। আমাকে বলছে আমি নাকি কালার ব্লাইন্ড, রং ঠিক দেখি না–উল্টাপাল্টা দেখি। তুমি প্লিজ বাইরে এসে দুইটা ফুল দেখে বলবে কোনটা কী রং-প্লিজ!”

শেষ পর্যন্ত মেঘবতী উঠে দাঁড়াল এবং রাজুর সাথে হেঁটে বাইরে গেল। রাজু তাকে বারান্দার আরেক মাথায় নিয়ে ফুলের বাগানের দুইটা ফুল দেখিয়ে বলল, “বাম পাশের ফুলটার কী রং বলবে প্লিজ?”

টুনি তখন হুট করে ক্লাশের ভিতর ঢুকে গেল। মেঘবতীর স্কুলের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে তার ওষুধের হলুদ রঙের ব্যাগটা বের করে তার হাতের খালি প্যাকেটে সবগুলো ওষুধ ঢেলে নিল। তারপর অন্য প্যাকেটের ওষুধগুলো হলুদ প্যাকেটে ঢেলে প্যাকেটটা তার স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। গতকাল সে যে ভিটামিন সি-এর লজেন্সের মতো ট্যাবলেটগুলো কিনেছে সেগুলো সে কেটে আলাদা করে এনেছে। ব্যাগের উপরে হাত দিয়ে মেঘবতী কখনো বুঝতে পারবে না এগুলো তার ঘুমের ওষুধ না। সত্য কথা বলতে কী ভিতরে উঁকি দিয়েও বুঝতে পারবে না, শুধু বের করে উপরের নাম পড়লে বুঝতে পারবে।

টুনির কাজ শেষ। সে যখন চলে আসবে তখন হঠাৎ লক্ষ করল মেঘবতী যে বইটা খুলে ভিতরে তাকিয়ে থাকে সেই বইটা স্কুল ব্যাগের নিচে চাপা দিয়ে রাখা আছে। টুনি শুনল রাজু এখনো কথা বলছে, মেঘবতী এক্ষুণি চলে আসবে না–তাই সে বইটা বের করে এনে খুলল সাথে সাথে একটা ফটো বের হয়ে এল। একজন সুন্দরী মহিলা মেঘবতাঁকে ধরে রেখেছে। দুজনেই হাসছে, কী সুন্দর হাসি। মহিলার চেহারা ঠিক মেঘবতীর মতো। তার মানে নিশ্চয়ই তার মা। বইয়ের ভিতর ছবি রেখে ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে সেটার দিকে তাকিয়ে কাঁদে। তার মানে নিশ্চয়ই মেঘবতীর মা মারা গেছেন! টুনির বুকটা দুঃখে ভেঙে গেল। সে বইটা মেঘবতীর স্কুল ব্যাগের নিচে আগের মতো রেখে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে গেল। ব্যাগের ভিতর প্যাকেট দুটো রেখে সে তার ডাইরিটা বের করে সেখানে খুব মনোযোগ দিয়ে লিখতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে মেঘবতী এবং তার পিছু পিছু রাজু ক্লাশে এসে ঢুকল। রাজু টুনিকে দেখে একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “তুই এখানে?”

“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”

“তোদের সব দুই নম্বুরি কাজ আমি বের করে ফেলেছি।”

টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “কোন দুই নম্বুরি কাজ তুই বের করে ফেলেছিস?”

“ঐ যে সবাই মিলে আমাকে বোঝালি ডালিয়া ফুলটার রং নীল! আমি কালার ব্লাইন্ড তাই সেটাকে হলুদ দেখি।”

“আসলেই তো তাই।”

“মেঘবতাঁকে বাইরে নিয়ে দেখিয়েছি। মেঘবতী বলেছে এটা আসলেই হলুদ। তোরা সবাই মিলে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছিস!”

টুনি বলল, “তুই কী একটা জিনিস চিন্তা করে দেখেছিস?”

“কী জিনিস?”

“হয়তো মেঘবতীও তোর মতো কালার ব্লাইড! সেও নীল ফুলটাকে হলুদ দেখছে!”

রাজু হতাশার মতো ভঙ্গী করে মাথা নেড়ে বলল, “তুই বললেই আমি বিশ্বাস করব? তুই জানিস না মেয়েরা বলতে গেলে কালার ব্লাইন্ড হয়ই না–এটা ছেলেদের সমস্যা!

টুনি বলল, “না জানলেও আন্দাজ করতে পারি। সব সময় সব সমস্যা হয় ছেলেদের! আমরা মেয়েরা যে কীভাবে তোদের সহ্য করি সেটাই আমি মাঝে মাঝে ভাবি।

রাজু হতাশার ভঙ্গী করে মাথা নাড়তে নাড়তে ক্লাশরুম থেকে বের হতে লাগল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেঘবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাংকু মেঘবতী।”

মেঘবতী কোনো কথা বলল না। টুনি দেখল সে তার স্কুল ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়েছে। নিশ্চয়ই দেখছে তার ওষুধের প্যাকেটটা আছে কিনা ৷ মেঘবতী হাতটা বের করে আনে। কোনো কিছু সন্দেহ করেনি।

টুনি ডাইরি লেখার ভান করে পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে। সে যেহেতু ঘুমের ওষুধগুলো সরিয়ে নিয়েছে তাই হাতে একটু সময় পেয়েছে। আজকেই তাদের হেড মিস্ট্রেসকে না বললেও ক্ষতি নেই। যদি তাদের টিচার গার্জিয়ানদের সাথে এটা নিয়ে কথা বলা হয় তাহলে সব মিলিয়ে বিশাল হৈচৈ শুরু হবে। বড় মানুষেরা কোনো কিছু শান্তভাবে করতে পারে না। বড়দের না জানিয়ে সে কী কোনোভাবে অন্যদের নিয়ে কাজটা শেষ করতে পারে না? তাদের ক্লাশের সালমারও মা মারা গেছেন সে তো বেশ সামলে নিয়েছে। ক্লাশ টেনের শাপলা আপুরও তো মা মারা গেছে, তাকে দেখে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে? তাহলে সবাই মিলে যদি মেঘবতাঁকে সাহায্য করে তাহলে বড়দের কিছু না জানিয়ে কী কাজটা করা যায় না? বেশি কিছু তো না, শুধু মেঘবতাঁকে দিয়ে তাদের সাথে কথা বলাতে হবে।

টুনি আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে থাকে।

.

বাসায় আসামাত্র টুনিকে তার আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের টিচারকে জানিয়েছিস?”

“না আম্মু। এখনো বলিনি।”

“সর্বনাশ! দেরি করছিস কেন? যদি ঘুমের ওষুধগুলো খেয়ে ফেলে?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না আম্মু, খাবে না।

“তুই কেমন করে জানিস খাবে না?”

টুনি তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা প্যাকেট বের করে আম্মুকে দেখিয়ে বলল, “এই যে! ওষুধগুলো এখন আমার কাছে! আমি তার প্যাকেটে ভিটামিন সি ট্যাবলেট দিয়ে এসেছি। খেয়ে ফেললেও ক্ষতি নেই।”

আম্মু চোখ কপালে তুলে ফেললেন, কীভাবে কাজটি করেছে জিজ্ঞেস করলেন। তার মেয়ের কাজ কর্ম আম্মু নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারেন না। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করে মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু দেরি করিস না। ঘুমের ওষুধ ছাড়াও সুইসাইড করা যায়।”

পরের দিন টিফিনের ঘণ্টা পড়ার পর যখন সবাই ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে গেল তখন টুনি নিজের সিট থেকে উঠে মেঘবতীর কাছে গেল ৷ মেঘবতীর পাশে দাঁড়িয়ে খুবই শান্ত গলায় বলল, “মেঘবতী, তোমার সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই।”

মেঘবতী একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকালো, তারপর প্রায় শোনা যায় না সেভাবে বলল, “কী কথা?”

টুনি বলল, “আমি এখানে বলতে পারব না। যে কোনো সময় কেউ চলে আসতে পারে। আমার সাথে চল, বাইরে একটু নিরিবিলি জায়গায় কথা বলি।”

মেঘবতী মাথা নাড়ল, সে কোনো কথা বলতে চায় না। তারপর, মুখ ঘুরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। এরকম একটা কিছু হবে টুনি জানতো। সে বেশি অবাক হলো না। আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলল, “দেখো মেঘবতী আমি জানি তোমার খুব মন খারাপ। তুমি কোনোভাবে তোমার আম্মুর কথা ভুলতে পারছ না —

মেঘবতী ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কেমন করে জান?”

টুনি বলল, “আমি আরো অনেক কিছু জানি। আমি জানি তুমি সুইসাইড করার কথা চিন্তা করছ।”

মেঘবতী এবারে ঝট করে ঘুরে টুনির দিকে তাকালো। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বলতে পারল না। টুনি বলল, “আমি এটাও জানি যে তুমি ফার্মেসি ঘুরে ঘুরে ঘুমের ওষুধ কিনছ।“

মেঘবতাঁকে এখন কেমন জানি হিংস্র দেখায়, তার চোখ দুটি জ্বলে ওঠে, হিসহিস করে বলল, “তুমি কেমন করে এতো কিছু জান? কেমন করে?”

“সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তুমি যে সুইসাইড করার কথা ভাবছ সেই কথাটা আমাদের টিচারদের বলতে হবে। আমাদের যে হেড মিস্ট্রেস আছেন সেই ম্যাডাম আমাকে অনেক আদর করেন। আমি গিয়ে যদি বলি তাহলে ম্যাডাম সাথে সাথে ব্যবস্থা নিবেন। অফিসে নিশ্চয়ই তোমাদের বাসার টেলিফোন নম্বর আছে, সেখানে ফোন করবেন। দরকার হলে নিজেই চলে যাবেন। বুঝতে পারছ?”

মেঘবতাঁকে কেমন যেন আতংকিত দেখা গেল, সে বলল, “না! না!”

টুনি বলল, “আমিও বলতে চাই না মেঘবতী। বড় মানুষদের কাজকর্ম ঠিক নেই। তারা ছোটদের ব্যাপার স্যাপার বুঝে না। তারা মনে করে যে আমরা কিছু বুঝি না তারাই সব কিছু বুঝে। তারা তোমার বিষয়টা জানলে এমন হাউকাউ শুরু করে দেবে, এমন ঘোঁট পাকাবে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। এখন তুমি বল, তুমি কি সেটা চাও?”

মেঘবতী মাথা নেড়ে জানাল, সে এটা চায় না।

“আমিও চাই না। কিন্তু এটা তো অনেক সিরিয়াস। কাজেই তুমি আমার কথা শোনো। প্লিজ! তুমি আমার সাথে আস।” টুনি মেঘবতীর হাত ধরে বলল, “প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”

টুনি ভেবেছিল মেঘবর্তী ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিবে কিন্তু হাত সরালো না। একটু পর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চল ৷”

কিছুক্ষণের মধ্যেই টুনি মেঘবতাঁকে নিয়ে স্কুল বিল্ডিংয়ের শেষ মাথায় চলে এলো। জায়গাটা নির্জন, কয়েকটা বড় বড় গাছ দিয়ে ঢাকা পড়ে আছে। সেখানে টুনিদের ক্লাশ টেনের শাপলা আপু আর তাদের ক্লাশের সালমা বসে আছে। টুনি এই দুইজনকে আগে থেকে খবর দিয়ে রেখেছিল। দুজনেরই মা মারা গেছেন।

টুনি মেঘবতাঁকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে বলল, “শাপলা আপু এই হচ্ছে মেঘবতী। সুষমা মেঘবতী।”

শাপলা আপু কোনো ভূমিকার ধারে কাছে গেল না, একেবারে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল, “তোর মা মারা গেছে সেজন্য তুই সুইসাইড করার কথা চিন্তা করছিস? আমি কিন্তু পোলাপানদের তুমি তুমি করে বলতে পারব না, আগেই বলে রাখছি।

মেঘবতী একেবারে সরাসরি এরকম প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল। কেমন যেন অবাক হয়ে শাপলা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল। সালমা বিষয়টাকে সহজ করার জন্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শাপলা সুযোগ দিল না, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গেল, আঙুল দিয়ে মেঘবতীর বুকে টোকা দিয়ে বলল, “শোন, তোকে আমি বলি। আমার মা যখন মারা গেছে তখন আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি। আমার কাছে মনে হলো পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে গেল, বুঝলি? কুচকুচে কালো–কী কষ্ট, কী কষ্ট–বাচ্চা কালে যাদের মা মারা যায় নাই তারা ছাড়া আর কেউ সেটা চিন্তাও করতে পারবে না। যখন আমার মনে হলো আমি আর সহ্য করতে পারব না তখন আমি ঠিক তোর মতো ঠিক করলাম সুইসাইড করব। সন্ধেবেলা যখন কেউ লক্ষ করছে না আমি বাসার ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের উপরে দাঁড়ালাম, ছয় তালার ছাদ, নিচে তাকাতে ভয় লাগে তাই উল্টা হয়ে দাঁড়ালাম এইভাবে—”

শাপলা তখন দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দেখালো সে কীভাবে দাঁড়িয়েছিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, “আমি তখন দুই চোখ বন্ধ করে উপর দিকে তাকিয়েছি তখন কী হলো জানিস?”

মেঘবতী চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

“আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার মা’কে। আমার মা প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বলল, খবরদার! খবরদার তুই যদি ছাদ থেকে লাফ দিস। আমি কী তোকে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরার জন্য জন্ম দিয়েছিলাম? নেমে আয় রেলিং থেকে–নেমে আয় বলছি—”

টুনি অবাক হয়ে শাপলার দিকে তাকিয়ে রইল, শাপলা আপু খুবই শক্ত মেয়ে কিন্তু হঠাৎ তার গলাটা কেমন জানি ধরে এল। গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, “আমার মা বলল, তোদের আমি আদর করে বড় করতে পারি নাই ৷ আগেই চলে যেতে হয়েছে। আমি যেটা পারি নাই তোদেরকে সেটা করতে হবে। তোকে বড় হতে হবে, তারপর তোকে বিয়ে করতে হবে, তোর ঘর ভরা ছেলেপুলে হবে তুই তাদের আদর দিয়ে বড় করবি।“

শাপলা আপু থামল, তারপর বলল, “এরপর মা আমাকে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট কথাটা বলল।”

মেঘবতী জিজ্ঞেস করল, “সেইটা কী?”

“মা বলল, বোকা মেয়ে! তুই ভেবেছিস আমি নাই? আমি আছি। আমি সবসময় তোর সাথে আছি। সবসময় তোর সাথে আছি।”

শাপলা ঘুরে মেঘবতীর দিকে তাকাল, বলল, “তুই টের পাস না যে তোর মা তোর সাথে আছে? সবসময় তোর সাথে আছে?”

মেঘবতী একটু ইতস্তত করে বলল, “না মানে –”

“আছে, আছে। তোর মা সব সময় তোর সাথে থাকে। এই এখন যে আমরা কথা বলছি, আমাদের মায়েরা উপর থেকে আমাদের কথা শুনছে।’ শাপলা আপু উপর দিকে তাকাল, বলল, “উপরে তাকিয়ে দেখ, চোখ খুলে দেখলে হবে না, চোখ বন্ধ করে দেখতে হবে তাহলে তোর মা’কে দেখতে পাবি! মায়েরা সব সময় তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে থাকে।” শাপলা আপু সালমার দিকে তাকালো, “তাই নারে সালমা? তোর মা তোর সাথে থাকে না?”

সালমা মাথা নাড়ল, “সব সময় থাকে। আমার আম্মু আমার সাথে না থাকলে আমি কী টিকে থাকতে পারতাম?”

শাপলা আপু বলল, “এই সালমারে দেখ। আমাদের মাঝে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সালমার। তার মা মরে গেল, সেই দুঃখে বাবার মাথাটাও আউলা ঝাউলা হয়ে গেল। সালমাকে তার বাবারে দেখতে হয়, ছোট ভাইবোনদের দেখতে হয়। মাঝে মাঝে সারারাত জেগে থাকতে হয়। ক্লাশে এসে মুখ হা করে ঘুমায়—”

সালমা আপত্তি করল, “আমি মোটেও মুখ হা করে ঘুমাই না।”

শাপলা আপু ধমক দিয়ে বলল, “তুই কেমন করে বলবি তুই মুখ হা করে ঘুমাস নাকি মুখ বন্ধ করে ঘুমাস? বসে বসে ঘুমালে সব সময় মানুষের মুখ হা হয়ে যায়!”

সালমা আবার আপত্তি করল, “না শাপলা আপু –”

শাপলা আপু বলল, “ঠিক আছে। এইটা ইম্পরট্যান্ট না। ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে জানা যে তোর আম্মু সব সময় তোর সাথে আছে।” শাপলা আপু এবারে মেঘবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে মেঘবতী এখন তুই বল সুইসাইড করার দরকার আছে?”

মেঘবতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের কোণাটা মুছে ফেলে মাথা নাড়ল। ফিসফিস করল, “নাই ৷

সালমা বলল, “বুঝলে মেঘবতী আমি আর শাপলা আপু দুই জনেই এর ভিতর দিয়েছি, কী কষ্ট কী কষ্ট! মনে হয় এই কষ্টেই মরে যাব। কিন্তু দেখবে তুমি মরবে না। কষ্টটা কীভাবে কমাতে হয় জান?”

“কীভাবে?”

“কারো সাথে এই কষ্টটার কথা বলতে হয়। আমরা সেই জন্য এসেছি। তুমি আমাদের বলবে। সবকিছু বলবে। কষ্টটা খুবই আজব। আরেকজনের কাছে বলা খুবই কঠিন, কিন্তু যদি বলতে পার, তাহলে দেখবে কষ্টটা কমে যাবে। মনে হয় ভাগাভাগি হয়ে যায়।”

শাপলা মাথা নাড়ল, বলল, “সালমা ঠিকই বলেছে, কষ্ট ভাগাভাগি হলে কমে। আনন্দ ভাগাভাগি হলে বাড়ে। বুঝেছিস?”

মেঘবতী মাথা নাড়ল। শাপলা আপু বলল, “তাহলে তুই কী আমাদেরকে বলবি?”

মেঘবতী নিচু গলায় বলল, “কী বলব?”

“তোর মায়ের কথা। তোর দুঃখের কথা। কষ্টের কথা।”

“কিন্তু আমি তো কখনো আমার কষ্টের কথা কাউকে বলি না।“

সালমা বলল, “আমরা জানি, কষ্টের কথা অন্যকে বলা খুব কষ্টের! কিন্তু আমরা তো ঠিক তোমার মতো কষ্টের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। আমরা এখানে এসেছি খালি তোমার সাথে কথা বলার জন্য। বলবে?”

মেঘবতী শেষ পর্যন্ত মাথা নেড়ে বলল, “চেষ্টা করব।”

শাপলা আপুর মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “গুড গার্ল! নে বস। বলতে বলতে যদি চোখে পানি চলে আসে কেঁদে ফেলিস। লজ্জা করিস না। এই দেখ আমি টিস্যুর প্যাকেট নিয়ে এসেছি চোখ মোছার জন্য।”

সালমা বলল, “দেও আপু, আমাকে কয়টা টিস্যু দাও। আমার খুব অল্পতে চোখের পানি চলে আসে।”

মেঘবতী বসল। তার দুই পাশে দুইজন–শাপলা আপু আর সালমা। টুনি বসল তাদের পায়ের কাছে। শাপলা আপু শুরু করিয়ে দিল, বলল, “প্রথমে বল তোর আম্মু দেখতে কেমন ছিল- “

মেঘবতী বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মা ছিল অপূর্ব সুন্দরী, একেবারে পরির মতন…।”

.

যখন টিফিন ছুটি শেষের ঘণ্টা পড়ল তখন মেঘবতী থামল। একটা টিস্যু দিয়ে নিজের নাক মুছল। শাপলা আপু আর সালমা তারাও তাদের চোখ মুছল। শাপলা আপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে আজকে এই পর্যন্তই। বাকিটা কালকে।

মেঘবতী বলল, “কালকেও?”

“হ্যাঁ। যতদিন তুই স্বাভাবিক না হচ্ছিস ততদিন।”

সালমা বলল, “তুমি কী এখনও সুইসাইডের কথা চিন্তা করছ?” মেঘবতী মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“তাহলে তোর ঘুমের ট্যাবলেটগুলো এখনই টয়লেটে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করে দে।“

টুনি অনেকক্ষণ পর এই প্রথম কথা বলল, “তার দরকার হবে না শাপলা আপু। মেঘবতী ইচ্ছা করলে খেতে পারে।”

শাপলা চোখ কপালে তুলে বলল, “খেতে পারে?”

“হ্যাঁ। আমি ঘুমের ট্যাবলেটগুলো আগেই সরিয়ে ফেলেছি। তার জায়গায় আছে ভিটামিন সি-এর ট্যাবলেট। খেতে খুব মজা– লজেন্সের মতো।”

শাপলা আপু টুনির ঘাড় ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই এতে বড় মিচকি শয়তান? এতো বড় ধুরন্ধর? এতে বড় মতলববাজ?”

টুনি নিজেকে শাপলা আপুর থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “মিচকি শয়তানের কী আছে? যেখানে জীবন-মরণ নিয়ে কথা সেইখানে রিস্ক নেওয়া ঠিক না।”

মেঘবতী অবাক হয়ে টুনির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর প্রথমবার ফিক করে হেসে বলল।

টুনি অবাক হয়ে দেখল মেয়েটা যখন হাসে তখন তাকে কী সুন্দরই না দেখায়।

.

এক সপ্তাহ পর মেঘবতাঁকে সবার সাথে সাতচাড়া খেলতে দেখা গেল। কী তার নিশানা! প্রত্যেকবার প্রথমবারই টেনিস বল ছুঁড়ে চাড়া ভেঙে ফেলে।

কার ভিতরে কী প্রতিভা আছে বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *