সারা রাত ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম আমরা, এবং পরদিন ঠিক ভোরবেলা এসে পৌঁছলাম লুক্সর শহরে। প্রধান ফটকের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা প্রায় সাথে সাথেই চিনতে পারল আমাদের, এবং যথাযোগ্য সম্মানের সাথে শহরের ভেতরে নিয়ে গেল। রামেসিসকে ঘিরে একটি বেষ্টনী তৈরি করল তারা, তারপর লুক্সরের সোনালি প্রাসাদে নিয়ে গেল আমাদের সবাইকে। সেখানে ইতোমধ্যে নব্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে সভায় বসেছে ওয়েনেগ। আনন্দের বাগানে যাদের মৃত্যুদণ্ডের জন্য পাঠানো হয়েছে প্রায় তাদের সবাইকেই রাখা হয়েছে মন্ত্রিসভায়। অনেকেই কাপড়েই এখনো রক্তমাখা, সম্মানের চিহ্ন হিসেবে সেগুলো পরে আছে তারা। মনে হচ্ছে যেন লড়াই করে সবার মাঝে যৌবন ফিরে এসেছে আবার।
আমাদের স্বাগত জানাতে পেরে দারুণ খুশি হয়ে উঠল সবাই। তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক কর্তব্য হলো উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের সিংহাসনে ফারাও প্রথম রামেসিসকে অধিষ্ঠিত করা। গম্ভীর চেহারায় এই সম্মান বরণ করে নিল রামেসিস, তারপর সিংহাসনে বসে রাজ্য পরিচালনার শপথ নিল। তারপর অন্ত বর্তীকালীন মন্ত্রিসভাকেই নিজের পূর্ণাঙ্গ এবং স্থায়ী মন্ত্রিসভা হিসেবে স্বীকৃতি দিল ও। সেইসাথে আরো ঘোষণা করল, এই নতুন সভার প্রথম এবং প্রধান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে আর কেউ নয়, বরং প্রভু টাইটা।
রামেসিস যখন এসব দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত তখন তার স্ত্রী আমাদের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রথমেই নীলনদ ধরে এগিয়ে চলার জন্য আমাদের একটা দ্রুতগামী জাহাজ দরকার, যাতে করে ও পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারে। সেরেনার প্রতি সব সম্মান রেখেই বলছি, ওর এবং রামেসিসের বিয়ের কথা আমরা তিনজন বাদে আর কেউ জানে না। এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ওদের বিয়ে তখনই হতে পারে যখন আরো কিছু ব্যাপারকে নিশ্চিত করা হবে, যেমন বিয়ের অনুষ্ঠানে ওর বাবার মিত্র রাজাদের সবাই সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকা। তাই সব দিক বিবেচনা করে এটাই ঠিক হয়েছে যে, বিয়ের আগ পর্যন্ত জনসমক্ষে বা আনুষ্ঠানিকভাবে সবার সামনে আসবে না সেরেনা, অন্তত যত দিন না ওদের সব দিক মেনে বিয়ে না হচ্ছে।
সেদিন বিকেলেই এক প্যাপিরাসের পুঁথিতে আমার হায়ারোগ্লিফিক সিলমোহর আঁকলাম আমি। প্যাপিরাসে বলা হলো, আমার অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার ভার ওয়েনেগের ওপর ন্যস্ত করা হচ্ছে। তারপর রামেসিসকে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে সরে এলাম আমি। একটু পর আমাদের উদয় হতে দেখা গেল নদীর বন্দর এলাকায়। সবার চোখে ধুলো দিয়ে একটা দুই মাস্তুলওয়ালা জাহাজে চড়ে বসলাম আমরা। জাহাজের নাম হচ্ছে চার বাতাস। আমরা উঠে আসার সাথে সাথেই নোঙর তুলল জাহাজ, ঢেউয়ে ভেসে এগিয়ে চলল উত্তর দিক লক্ষ্য করে। আমাদের সামনে এখন আবু নাসকোস এবং আরো সামনে রয়েছে ভূমধ্যসাগর।
লুক্সর শহরের আলো-অন্ধকারে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাজের নিচে নিজের কামরায় অপেক্ষা করল সেরেনা। তারপর ঠিক যেন সন্ধ্যাতারা মতোই রহস্যময় এ+ সৌন্দর্য নিয়ে উদয় হলো জাহাজের ওপর। আমাদের দেখতে পেয়ে খুশিতে হেসে উঠল ও, তারপর আমার দুই গালে চুমু খেয়ে নিচে চলে গেল আবার। রামেসিসও গেল ওর সাথে। সকালের আগে আর ওদের দেখা পাওয়া গেল না। পরবর্তী তিন দিন আবু নাসকোসের উদ্দেশ্যে ভেসে চলল চার বাতাস। এই তিন দিন হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এবং সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ একটা সময়।
তৃতীয় দিন রাতে মধ্যরাতের একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম আমি। জানি যে আগামীকাল ভোরেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব আমরা। তাই এখন আর ঘুমানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তার বদলে জাহাজের ডেকে গিয়ে বসলাম আমি। জাহাজের সারেং, যার নাম গানোর্ড এসে যোগ দিল আমার সাথে। বরাবরের মতোই তার সঙ্গ পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম আমি। বয়স্ক একজন মানুষ, চেহারাটা দেখলে নীলনদের কুমিরের সাথে কোথায় যেন মিল পাওয়া যায়। কোটরে বসা এক জোড়া বাদামি চোখ, নীলনদের কিনারে এসে জমা হওয়া, নুড়িগুলোর মতো। কিছুই আটকায় না সেই চোখে। মুখে ঘন সাদা দাঁড়ি, প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। সারাটা জীবন এই নীলনদ আর উত্তর সাগরের কিনারা চষে বেড়িয়ে কাটিয়েছে সে।
এদিকের জলভাগ, এমনকি আমার চাইতেও ভালোভাবে চেনে গানোর্ড। নদীতে বসবাসকারী অশরীরী আর পানিভূতদের নামও জানা আছে তার, যদিও অনেক নামই প্রাচীন উপজাতিদের সাথে সাথে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। নীলনদ যেখানে আকাশ থেকে নেমে এসেছে সেই উৎসমুখ ঘুরে এসেছে সে, দেখেছে হাথোরের দরজা দিয়ে কীভাবে ঝরে পড়ছে নীলনদের বিশাল স্রোতধারা, তারপর অনন্তকাল ধরে হারিয়ে যাচ্ছে এক অন্তহীন গহ্বরের ভেতর।
আজ রাতে গানোর্ডের কাছ থেকে নদীর সেই অংশের গল্প শুনলাম আমি, যা আবু নাসকোসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য ওখানেই। তার মতে, প্রায় হাজার বছর আগে এক প্রাচীন কিন্তু উন্নত জাতি ওই শহরে প্রথমবারের মতো বসতি স্থাপন করে। গানোর্ডের মতে ওই জাতির সদস্য ছিল অর্ধ-দেবতারা। ভবন নির্মাণ, পড়ালেখা এবং বাগান করায় অত্যন্ত দক্ষ ছিল তারা। নীলের দুই তীরেই সেচের ব্যবস্থা করেছিল তারা, চারপাশের বর্বর জনগোষ্ঠীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তৈরি করেছিল সুউচ্চ দুর্গ। ধারণা করা হয় যে, নদীর এপার থেকে ও পারে দ্রুত যাতায়াত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল তারা, খুব সম্ভব কোনো ধরনের সেতুর মাধ্যমে। তবে গানোর্ডের ধারণা জাদু জানত তারা। এখনো নাকি আবু নাসকোসের বর্তমান শহর অঞ্চলের নিচে লুকিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপে সেই হারানো সভ্যতার নানা ধরনের চিহ্ন পাওয়া যায়।
প্রায় পাঁচ শ বছর আগে হুট করেই ধ্বংস হয়ে যায় এই সভ্যতা, খুব সম্ভব ঘন ঘন ভূমিকম্পের ফলে। আন্দাজ করা হয় যে, সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা নীলনদের কাছ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যায়, ইউফ্রেটিস নদী এবং ব্যাবিলনের দিকে সরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী পাঁচ শ বছর ধরে খালিই পড়ে থাকে আবু নাসকোস।
এই কথাগুলো যে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছি সেটা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে ডেকের নিচে চলে গেল গার্ডে। একটু পর ফিরে এলো সেই অর্ধ দেবতাদের একটা চিহ্ন নিয়ে। জিনিসটা আমাকে উপহার দিল সে। মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের ছোট একটা টুকরো বা টালি আমার হাতের তালুর চাইতে বেশি বড় হবে না। তাতে লম্বা পাখনা আর সোনালি মাথাসহ একটা অদ্ভুত মাছের ছবি আঁকা। গানোর্ড দাবি করল, এটা নাকি আবু নাসকোসের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মাঝে খুঁজে পেয়েছে সে। বলল, প্রাচীন সেই সভ্যতা যারা গড়ে তুলেছিল তাদের এই একটা চিহ্নই আছে তার কাছে।
সূর্য ওঠার একটু আগে আমার সবচেয়ে প্রিয় দুই মানুষ পা রাখল ডেকের ওপর। আলোচনায় ছেদ পড়ায় একটু অবশ্য মন খারাপ হলো আমার। মনে হলো আরেকটু বেশি সময় নিজেদের কেবিনে থাকলে নিশ্চয়ই এমন কোনো ক্ষতি হতো না ওদের।
তবে ওরা উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই আমার কাছে মাফ চেয়ে উঠে দাঁড়াল গানোর্ড। দুজনকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল সে, তারপর জাহাজের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চলে গেল। পাল গুটিয়ে আনা হলো জাহাজের। নদীতে জাহাজের চলার গতি কমিয়ে আনলাম আমরা। আর একটা বাঁক ঘুরলেই আবু নাসকোস শহর উন্মোচিত হবে আমাদের সামনে।
*
নদীর বাঁকটা ঘোরার সাথে সাথে প্রায় একই সময়ে সূর্যোদয় হলো, ফলে নীলনদের পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা শহরটার সম্পূর্ণ চেহারা খুব ভালোভাবে দেখতে পেলাম আমরা। এই জায়গায় নদীটা প্রায় এক লিগ চওড়া, যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের এক ঘণ্টার হাঁটা পথের দূরত্বের সমান। ফলে নদীর অন্য পাড় থেকে তীর ছুঁড়ে শহরের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
শহরের প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে সোনালি-হলুদ রঙের বেলেপাথরের বিশাল সব চাঙড় দিয়ে। অনেক উঁচু সেই দেয়াল, হিকসস রীতিতে প্রাচীরের ওপর কিছু দূর পরপর গড়ে তোলা হয়েছে ছাউনি। মিশরীয়দের কাছ থেকে এই শহর দখল করে নিয়েছিল হিকসসরা, পরে নিজেদের মতো করে পুনরায় নির্মাণ করেছে। হানাদার হিকসসদের এই দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করতে প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগে গেছে আমাদের। কিন্তু বিদেশিদের হাত থেকে স্বদেশকে পুনরুদ্ধার করতে পারলেও এক উন্মাদ স্বৈরাচারী ফারাওয়ের কারণে তাকে হারিয়ে ফেলেছি আবার। এখন এই শহরের দুর্ভেদ্য সীমানার মাঝেই লুকিয়ে আছে সে।
সমস্ত জীবনে প্রায় শ খানেক যুদ্ধক্ষেত্র দেখার সুযোগ হয়েছে আমার; কিন্তু এখন যা দেখলাম তার কথা আমি কখনো ভুলব না। মনে হলো যেন ভয়াবহ এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দুই পক্ষের শক্তি এবং বোকামি দুটোই উন্মোচিত হয়েছে আমার সামনে।
শহর প্রাচীর থেকে নীলনদের পানির বিস্তৃতি যেখানে শুরু হয়েছে তার মাঝখানে রয়েছে এক চিলতে বালির সৈকত। সেখানেই নিজের নৌবাহিনীকে নোঙর করিয়ে রেখেছে উটেরিক। কাছাকাছি আসার সাথে সাথে জাহাজগুলোকে গুনতে লাগলাম আমি। সব মিলিয়ে প্রায় এক শ জাহাজ এখনও সে রয়েছে সেখানে, যার প্রতিটি ত্রিশ থেকে চল্লিশজন মানুষকে বহন করতে পারে। শহরের পাথুরে দেয়াল যেন ঝুলে রয়েছে জাহাজগুলোর ওপর। এক নজরেই বুঝতে পারলাম যে প্রাচীরের ওপর বড় বড় পাথর তূপ করে রাখা হয়েছে, যাতে শত্রুপক্ষের কোনো সদস্য জাহাজগুলোর কোনো ক্ষতি করতে গেলে বা ওগুলোকে ছিনতাই করতে চাইলে তাদের ওপর পাথর ছুড়ে মারা যায়।
প্রাচীরের যেদিকটা নদীর কাছে সেখানে কোনো দরজা নেই। সত্যি কথা বলতে একটা ফাটলও নেই কোথাও, যেখান দিয়ে কোনো একরোখা আক্রমণকারী ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে পারে। দেয়ালের অর্ধেক উচ্চতা থেকে শুরু হয়েছে তীর ছোঁড়া এবং অন্যান্য কাজের জন্য তৈরি ছিদ্রের সারি, এবং মাটি থেকে সেগুলোর উচ্চতা প্রায় এক শ কিউবিট।
প্রাচীরের ওপর দিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কুচকাওয়াজ করে বেড়াচ্ছে উটেরিকের সৈন্যরা। সূর্যের আলোতে ঝলকাচ্ছে তাদের শিরস্ত্রাণ আর বর্ম। নিশ্চয়ই আশা করছে যে তাদের দেখে ভয় পেয়ে সরে যাবে আমাদের আক্রমণকারী বাহিনী। সৈন্যদের সামনে রয়েছে এক গাদা পতাকাবাহী দণ্ড, তাতে উড়ছে উটেরিকের বাহিনীর নানা রং এবং আকারের বিভিন্ন পতাকা। নদীর ওপারে নোঙর করে থাকা হুরোতাসের বাহিনীর দিকে যেন যুদ্ধে নামার জন্য সরাসরি আহ্বান জানাচ্ছে সেগুলো।
নদীর পুব তীরে নোঙর করেছে ল্যাসিডিমনের নৌবহর। ভারী লোহার শিকল দিয়ে জাহাজগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে তীরের সাথে। এটা করা হয়েছে যেন শত্রুরা রাতের আঁধারে এসে চুপি চুপি জাহাজগুলোকে দড়ি কেটে ভাসিয়ে দিতে না পারে। জাহাজের ওপর অস্ত্র নিয়ে সদা সতর্ক অবস্থায় পাহারা দিচ্ছে নাবিকরা। জাহাজের মাস্তুল আর খোলের গায়ে লাগানো হয়েছে নানা রঙের ছোট-বড় পতাকা, যেন নদীর অপর তীরে আবু নাসকোস শহরের প্রাচীরের ওপর উড়ন্ত পতাকার বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব।
হুরোতাস আর তার মিত্ররা যেখানে ঘাঁটি গেড়েছে সেখানে অবশ্য কোনো দুর্গ প্রাচীর বা স্থায়ী কোনো অবকাঠামো নেই। তাই পুরনো বন্ধু এবং মিত্রদের শিবির দেখতে পেয়ে আনন্দে ভরে উঠল আমার মন। পুব তীরের দুই দিকে যত দূর চোখ যায় নিচু পাহাড় আর টিলার ওপর ছড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গল। কিন্তু এখন সেগুলোর সামনে এসে হাজির হয়েছে শত শত তাঁবু আর ছাউনি। নির্দিষ্টভাবে আলাদা আলাদা ভাগে তৈরি করা হয়েছে সেগুলো, ফলে ষোলোটি বাহিনীর প্রত্যেকটার ছাউনি এবং সেনাপতির তাবুকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। এগুলোর পেছনে রয়েছে ঘোড়া রাখার আস্তাবল এবং হাজারখানেক রথ রাখার জায়গা। তার সাথে আরো রয়েছে প্রায় একই সংখ্যক ভারী মাল টানার গাড়ি।
সৈনিক এবং যোদ্ধাদের এই বিশাল সমারোহের বাইরের প্রান্তে গড়ে উঠেছে। সেই সব মানুষের তাঁবু আর কুঁড়েঘর, যাদেরকে প্রায় মানুষের কাতারেই ফেলা যায় না। এরা হচ্ছে ভবঘুরে এবং বেশ্যা, সেইসাথে অকর্মা আর জোচ্চোরের দল, যারা যেকোনো সেনাবাহিনীর পিছু নিয়ে থাকে। এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা লাশগুলোকে লুট করা, যা কিছু পাওয়া যায় সব আত্মসাৎ করা।
ওই যে আমার বাবার যুদ্ধনিশান! হঠাৎ করেই আমার পাশ থেকে চিলের মতো চিৎকার করে উঠল সেরেনা, একই সাথে মুঠি পাকানো হাতে ঘুষি মারতে শুরু করল আমার কাঁধে; খুব সম্ভব আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। মানতেই হবে জোর আছে মেয়েটার হাতে।
কোথায়? কোনটা? আঙুল দিয়ে দেখাও আমাকে, তাড়াতাড়ি বললাম আমি। আসলে আমার কাঁধের ওপর সেরেনার চলমান ঘুষির স্রোত থামাতে চাইছি।
ওই যে! লাল রঙের শূকর আঁকা পতাকাটা দেখতে পাচ্ছ? আমার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে। ঘুষি মারা বাদ দিয়ে এখন আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সেরেনা।
নদীর কিনারার সবচেয়ে কাছে এবং সবচেয়ে লম্বা দণ্ডটার ওপর পতপত করে উড়ছে হুরোতাসের প্রতীক আঁকা নিশান। পুরো যুদ্ধশিবিরের মাঝে সবচেয়ে বড় তাবুটাও তারই। সেই একই মুহূর্তে তাঁবুর দরজা দিয়ে দীর্ঘদেহী হালকা পাতলা গড়নের এক নারী বেরিয়ে এলো। তার পরিচয় জানার জন্য দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে তারপর তাকালাম আমি। এবং চিনতে পারলাম প্রায় সাথে সাথেই। এবার আমার গলাতেও সেরেনার মতো একই রকম চিৎকার শোনা গেল: আর ওই যে তোমার মা! তাবু থেকে বেরিয়ে আসছে!
এই কথা শুনেই দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে শুরু করল সেরেনা, একই সাথে ডেকের ওপর লাফালাফি করছে আর দুই হাত মাথার ওপর তুলে পাগলের মতো নাচছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল তেহুতি। তার পরই মেয়েকে চিনতে পারল সে, এবং হাতের ঝুড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিল এক দিকে।
আমার সোনামণি! এমন এক সুরে চিৎকার করে উঠল সে, মনে হলো তাতে আনন্দের চাইতে তীব্র কষ্টের ভাগই বেশি। দৌড়াতে শুরু করল এবার, এবং সামনে যে-ই পড়ল তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিল এক দিকে।
জাহাজের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। এবার গানোর্ডের হাত থেকে হালের চাকাটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম আমি, তারপর গায়ের জোরে ঘুরিয়ে দিলাম। তীরের দিকে নাক ঘোরাল জাহাজটা। হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে এমন ভঙ্গিতে দৌড়ে এলো সেরেনা, যেন নেকড়ের দলের তাড়া খেয়ে ছুটছে কোনো ভয়ার্ত হরিণ। জাহাজের নাকের কাছে এসেও থামল না ও, বরং ছোটার গতিকে ব্যবহার করে এক লাফে তীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল নীলনদের পানিতে। একরাশ পানি ছিটিয়ে নদীর বুক চিরে ঢুকে গেল ওর একহারা শরীরটা।
কয়েক মুহূর্ত যেন থেমে রইল আমার হৃৎপিণ্ডটা। কিন্তু তার পরেই আবার পানির ওপর ভেসে উঠল সেরেনার মাথা। দ্রুত গতিতে তীরের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করল ও। দুই হাত মাথার সামনে উঠছে আর নামছে, সেইসাথে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। চুলগুলো মুখের ওপর জড়িয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেন ভোঁদড় একটা সাঁতার কাটছে। পেছনে রেখে যাচ্ছে ফেনার রেখা। মেয়ের দু-এক মুহূর্ত পরেই তেহুতি পৌঁছে গেল পানির কিনারে, তারপর সে নিজেও লাফ দিল। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে মা-মেয়ে কতটা দক্ষ সঁতারু। সত্যিই এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে আমার। সত্যি কথা বলতে, উঁচু বংশের দুজন নারীকে এমন কাজ করতে প্রায় কেউই দেখেনি এর আগে। রাজবংশের যেসব নারী সদস্যরা সাঁতার জানে তারা সাধারণত গোপনে একা একা সাঁতার কাটে। সে সময় দেবী আইসিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে নগ্নই থাকে তারা। ধারণা করা হয় যে, দেবীর যোনির গঠন অনেকটা সামুদ্রিক শঙ্খের মতো।
গভীর পানিতে পরস্পরের সাথে মিলিত হলো মা আর মেয়ে, এবং প্রায় সাথে সাথেই একে অপরকে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরল যে, দুজনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য পানির ওপরে আর দেখা গেল না। তার পরেই আবার ভেসে উঠল দুজনের মাথা, একই সঙ্গে হাসছে, কাঁদছে আর হাঁপাচ্ছে। এভাবে তৃতীয়বারের মতো তাদের মাথা দুটো ডুবে যেতে দেখে তীরে জড়ো হওয়া জনতা সবাই রুদ্ধশ্বাসে সামনে এগিয়ে এলো, সবাই ভাবছে যে বিপদ বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ঘটেই যাবে।
এমনকি আমি নিজেও ভয় পেয়ে গেলাম। রামেসিসকে বললাম, আমরা কেউই চাই না যে ওরা কুমিরগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করুক। বোকা মেয়ে দুটোকে পানি থেকে টেনে তুলতে হবে আমাদের। তারপর কাপড় খুলে ফেললাম আমরা, রইল কেবল অন্তর্বাস। এবার পানিতে ঝাঁপ দিলাম আমরা। কিন্তু মা-আর মেয়ের কাছে পৌঁছে আবিষ্কার করলাম কিছুতেই তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। অগত্যা ওই অবস্থাতেই তাদেরকে জাহাজে টেনে নিয়ে আসা হলো। গানোর্ড এবং অন্য নাবিকরা আমাদের জাহাজে উঠতে সাহায্য করল। ওদিকে তীরে দাঁড়িয়ে উল্লসিত চিৎকারে ফেটে পড়ল জনতা।
শয়তান সেথ আর অন্য সব বদমাশ দেবতার কসম, এখানে হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? তীর থেকে আর সবার কণ্ঠ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল একটা পরিচিত গলা। জনতা দুই ভাগ হয়ে পথ করে দিল, সেই পথ দিয়ে নদীর কিনারে এগিয়ে এলো রাজা হুরোতাস। প্রচণ্ড ক্রোধে চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে তার। কিন্তু যখনই বুঝতে পারল যে নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট জাহাজটার নাবিকরা যে দুই নারীকে পানি থেকে টেনে তুলেছে তারা আসলে তার সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষ, সাথে সাথে বদলে গেল তার হাবভাব। গলার স্বর বদলে গেল, আদুরে আর ভালোবাসায় গদগদ হয়ে উঠল। আরে, আমার খুকুমণি সেরেনা! বলে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিল সে। চওড়া পেশিতে ভরে আছে তার হাত দুটো, শত শত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফসল। তার ওপর নানা রকম ভয়ংকর উল্কি আঁকা হয়েছে তাতে, যাতে ভয় পায় শত্রুরা। বাবার কাছে এসো, লক্ষ্মীসোনা! বলে উঠল সে।
এতক্ষণে সেরেনার গলা ভেঙে চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে গেছে ঠিক; কিন্তু দৌড়ানো এবং সাঁতার কাটার জন্য এখনো যথেষ্ট শক্তি আছে তার শরীরে। আমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ও, তারপর আবার পুরো ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। চার বাতাসের ডেকের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আবার নীলনদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও, পেছন পেছন গেল তার মা। মুহূর্তের ব্যবধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজন, তারপর আবার সাঁতার কেটে রওনা দিল তীরের দিকে।
কী মনে হয় তোমার, ওদেরকে উদ্ধার করতে যাওয়া কি উচিত হবে? গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল রামেসিস। নাকি ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দেব ওদের? তেহুতির আগে জাহাজের ডেক থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে সেরেনা, ফলে নদীর পুব তীরে দাঁড়ানো হুরোতাসের কাছ সেই আগে পৌঁছাল। কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে ছুঁড়ে দিল হুরোতাস, ঠিক যেন ছোট কোনো বাচ্চা। নেমে আসতেই আবার মেয়েকে ধরে ফেলল সে, তারপর চুমুয় চুমুয় আর দাঁড়ির ঘষায় ভরিয়ে দিল। এর ভেতরেই তেহুতি চলে এলো দুজনের কাছে। মুক্ত হাত দিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল হুয়োতাস, তারপর দুই হাতে দুজনকে বুকের সাথে চেপে ধরে নিজের তাঁবুর দিকে রওনা দিল।
ওদিকে আমি আর রামেসিস দ্রুত নিজেদের শরীর মুছে একটু আগে ফেলে যাওয়া পোশাক পরে নিলাম আবার। এই ফাঁকে নদীর তীরের দিকে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে গেল গানোর্ড। জাহাজের সামনের অংশ তীরে ঠেকতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম আমরা, তারপর উত্তেজিত লোকজনের ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পথ করে দিয়ে হুরোতাসের তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলাম, যেখানে একটু আগে স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। কাজটা খুব একটা সহজ হলো না, কারণ মনে হলো যেন উপস্থিত সবাই আমাদের উটেরিকের হাত থেকে সেরেনাকে উদ্ধার করার জন্য ধন্যবাদ এবং প্রশংসা জানাতে চায়। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সবাই জড়িয়ে ধরতে লাগল আমাদের, চুমু দিয়ে ভিজিয়ে দিল। তবে শেষ পর্যন্ত ঠিকই হুরোতাসের তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়লাম আমরা।
*
হুরোতাসের মালিকানায় থাকা বেশির ভাগ জিনিসের মতো তার তাঁবুটাও প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল, দেখলেই সম্ভ্রম জাগে মনে। সত্যি কথা বলতে, তবুটা অনায়াসে স্পার্টার দুর্গ-প্রাসাদের মন্ত্রণাকক্ষের সাথে পাল্লা দিতে পারে। অবশ্য তাতে এক হিসেবে ভালোই হয়েছে, কারণ ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো হুরোতাসের সাথে যারা এসেছে তাদের অর্ধেকই বোধ হয় তাঁবুর ভেতর আস্তানা গেড়ে বসেছে। ল্যাসিডিমন থেকে হুরোতাসের সাথে আসা ষোলোজন মিত্র রাজার অসংখ্য বউ এবং রক্ষিতা, সভাসদের দল, প্রধান প্রধান সেনা কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীসহ আরো অনেকেই রয়েছে তাদের মধ্যে।
রামেসিস এবং আমি ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই তাঁবুর অন্য প্রান্ত থেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ল রাজা হুরোতাস। আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে বুঝে বলে উঠল, তেহুতি আর সেরেনা গেছে ভেজা কাপড় বদলাতে। সুতরাং বুঝতেই পারছ বেশ সময় লাগবে ওদের। কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে।
তার কথা শুনে দাঁত বের করে হাসলাম আমি, তারপর এক হাত রামেসিসের কাঁধে রেখে তার কানের এক ইঞ্চি দূরে মুখ রেখে হুরোতাসের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলাম। আমাদের চারপাশে অন্তত কয়েক শ লোকের ভিড় রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন হাতে মদের বোতল নেই, এমন কেউ এখানে উপস্থিত নেই এবং প্রত্যেকেই তার পাশের জনকে উদ্দশ্য করে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। তার ওপর আবার চার-পাঁচটা বাদক দলও নিজেদের মতো করে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নরক গুলজার অবস্থা।
যুগপৎ হতাশা এবং গাম্ভীর্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। শয়তানি আর ঠগবাজির দেবতা ডলোসের নামে কসম করে বলো তো, এটা তুমি কীভাবে করো, টাইটা? ওর সাথে প্রথম যখন আমার দেখা হয় তখন মাঝে মাঝেই আমার অন্তদৃষ্টিকে পরীক্ষা করে দেখত ও। কিন্তু অনেক আগেই সেই চেষ্টা বাদ দিয়েছে। আমার ধারণা, একদিন এই কাজটা ও নিজেও করতে শিখবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওকে নিয়ে হালকা মজা করতে তো আর কোনো দোষ নেই।
জনাকীর্ণ তাঁবুর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে বেশ একটু সময় লেগে গেল। তবে হুরোতাসের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে এবং বেশ অনেকটা সময় ধরেই রাখল। তারপর আমাদের সাথে নিয়ে এক পাশের একটা দরজা দিয়ে অন্যদিকের একটা ছোট কিন্তু আলাদা কামরায় এসে ঢুকল। এবং ঢুকেই রামেসিসের দিকে ফিরল সে। সেরেনা এবং তোমার বিয়ের ব্যাপারে ওর সাথে খুব বেশি কথা বলার সময় পাইনি আমি। তবে অন্তত একবারের জন্য হলেও আমার সাথে একমত হয়েছে ও। উটেরিক যে কত বড় শয়তান এবং ভণ্ড সেটা সবার সামনে তুলে ধরার এখনই সময়। সবাইকে জানাতে হবে যে সে একজন নির্দোষ কুমারীকে তার পরিবারের কাছ থেকে অপহরণ করেছে এবং অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে তার ওপর।
মহামান্য রাজা, সাথে সাথে তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল রামেসিস। আপনাকে একটা কথা পরিষ্কারভাবে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি। উটেরিক আপনার মেয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে এ কথা ঠিক। ওকে মারধর করা হয়েছে, বন্দি করে রাখা হয়েছে কারাগারে। তবে ওর কুমারীত্ব নষ্ট করেনি সে, এবং নিজের কোনো অনুচরকেও এই কাজ করার অনুমতি দেয়নি।
এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে কৃতজ্ঞচিত্তে সকল দেব-দেবীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমি, বলল হুরোতাস। কিন্তু পৃথিবীর সকল দেশেই এমন কিছু লোক থাকবে যারা আমার মেয়ের নামে বদনাম ছড়ানোর কোনো সুযোগ নষ্ট করবে না, এবং তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য একটাই উপায় আছে আমাদের হাতে।
সেরেনাকে যত দ্রুত সম্ভব স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে আমার চাইতে খুশি আর কেউ হবে না। আর কিছু বলতে হবে না আপনাকে, রাজা হুরোতাস। আমার দিকে একবারও তাকাল না রামেসিস। তবে আমি ঠিকই বুঝে নিলাম যে রামেসিস আর সেরেনাকে আমি যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছিলাম তার কথা চিরকাল আমাদের তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
তাহলে তো আর কোনো কথাই রইল না। তোমাকে একমাত্র পুত্র হিসেবে পেলে আনন্দের কোনো সীমা থাকবে না আমার। এই বলে উঠে দাঁড়াল হুরোতাস, আমার দিকে তাকাল। প্রিয় টাইটা, এবার বোধ হয় একটু আমার স্ত্রী আর কন্যার খবর নেওয়া দরকার। কে জানে হয়তো কাপড় বদলাতে ওদের এত বেশি সময় নাও লাগতে পারে।
চোখ পিটপিট করল একবার রামেসিস, তারপর ভবিষ্যৎ শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি টাইটাকে এই কথাটা আগেও বলেছিলেন রাজা হুরোতাস? হ্যাঁ। এই একটু আগে তোমরা যখন আমার তাঁবুতে ঢুকলে তখন।
কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছু বলতে শুনলাম না। বিভ্রান্ত দেখাল রামেসিসকে। দারুণ হইচই হচ্ছিল আপনার তাঁবুর ভেতরে।
সে ক্ষেত্রে আমি বলব চোখ দিয়ে কীভাবে শুনতে হয় সেটা টাইটার কাছ থেকে শিখে নেওয়া উচিত তোমার। আমার জানা মতে একমাত্র তার পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব।
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। পুরো ব্যাপারটা বুকে নেওয়ার পর তার চেহারায় প্রথমে বিভ্রান্তি, তারপর অভিযোগ ফুটে উঠতে দেখলাম আমি। এখন আমি নিশ্চিত যে খুব তাড়াতাড়িই চোখ দিয়ে শুনতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা হবে দুজন। তার আগ পর্যন্ত আমাকে রেহাই দেবে না রামেসিস। অবশ্য ওর এই বিদ্যেটা শিখে নেওয়া দরকারিও বটে, কারণ চিরকাল এটা গোপন রাখতে পারব না আমি। এ ছাড়া সামনের বছরগুলোতে এই বিদ্যে নিশ্চয়ই আমাদের অনেক কাজে আসবে। এখন আমি জানি, পরস্পরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের ভবিষ্যৎ।
*
যদিও সমগ্র বিশ্বের সামনে রামেসিস আর সেরেনাকে স্বামী স্ত্রী এবং মিশরের ভবিষ্যৎ ফারাও আর ফারাওইন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছি আমরা; কিন্তু সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যথাযথ সম্মানের সাথে ছাড়া এ ধরনের কাজ কখনোই করা যায় না।
কাজটা আরো কঠিন হয়ে উঠল যে কারণে তা হলো, খুব শীঘ্রই রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা। মিশর অথবা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভয়াবহ এক যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে এই যুদ্ধ।
বিয়ে এবং এ ধরনের ব্যাপারগুলোতে সাধারণত মেয়েদেরই প্রাধান্য বেশি থাকে, এবং নিজের সহজাত বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমি বুঝলাম যে এখানে আমার জড়িত না হওয়াই সমীচীন। তাই অপেক্ষাকৃত পুরুষালি ব্যাপারগুলো অর্থাৎ যুদ্ধ এবং দেশ দখলের ব্যাপারে মনোযোগ দিলাম আমি। এখানে আমার সঙ্গী হলো পুরনো এবং বিশ্বাসী দুই বন্ধু জারাস এবং হুই; এবং তাদের সাথে সাথে রামেসিস এবং অন্য রাজারা, যাদের সাথে আমার পরিচয়ের বয়স খুব বেশি না হলেও ইতোমধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি আমরা।
বরাবরের মতোই এবারও অভিজ্ঞ যোদ্ধার প্রথম লক্ষ্যকে নিজের লক্ষ্য ধরে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। আর তা হলো শত্রুকে জানো।
আমার শত্রু হলো উটেরিক বুবাস্টিস; কিন্তু তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমি। সে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যে কিনা প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে নিজের পরিচয় এবং আকার বদলায়। আমি এমনকি এটাও নিশ্চিতভাবে জানি না যে, সে আদৌ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কি না। হুরোতাসের শিবিরে পৌঁছানোর পর পরবর্তী দুই দিন শুধু নীলনদের অপর তীরে অবস্থিত শহর এবং দুর্গের দিকে নজর রেখে কাটালাম আমি আর রামেসিস। এমন অনেককেই চোখে পড়ল, যে উটেরিক হতে পারে এবং কখনো কখনো এমন দু-তিনজনকেও একসাথে দেখলাম। কাউকে দেখে হুমকির মুখে কান্নায় ভেঙে পড়া উটেরিককে মনে পড়ল আমার কেউ কেউ মনে করিয়ে দিল প্রচণ্ড ক্রোধে খ্যাপা উন্মত্ত উটেরিকের কথা।
তবে আশার কথা এটাই যে, যুদ্ধ শুরু করার জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়ো নেই আমাদের। এখন সময় প্রস্তুতি এবং সেনাবাহিনীর সমন্বয় সাধনের। আমরা লুক্সর থেকে এখানে এসে পৌঁছানোর মাত্র পাঁচ দিন আগে নদীর এই তীরে শিবির ফেলার কাজ শেষ করেছে হুয়োতাস। এখন পর্যন্ত তার মিত্র রাজাদের সবাই উত্তর দিক থেকে এখানে এসে পৌঁছায়নি। প্রতিদিনই নীলনদ ধরে এগিয়ে আসছে নতুন নতুন নৌবহর, যোগ দিচ্ছে আমাদের সাথে। এখনো আমাদের সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়, এই মুহূর্তে আক্রমণ পরিচালনা করা মোটেই উচিত হবে না। সৈন্যদের সামলানো এমনিতেই দারুণ জটিল একটা কাজ। তার ওপরে আরো একটা গণ্ডগোল বাঁধল যখন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্তের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল বেকাথা।
সৌভাগ্যক্রমে ঘটনাটা ঘটল রাজা হুরোতাসের আয়োজন করা একটি ব্যক্তিগত পারিবারিক নৈশভোজের আসরে। উটেরিকের হাতে বন্দিদশা থেকে মেয়ে সেরেনার নিরাপদে ফিরে আসার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে এই ভোজের আয়োজন করেছে সে। ভোজের আরো একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেরেনার অপহরণ এবং অত্যারকে কেন্দ্র করে পুরো পরিবারের ওপর যে দুঃখ এবং শোকের চাদর নেমে এসেছিল তার বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে আরো শক্তিশালী করে তোলা।
হুরোতাস এবং হুইয়ের মুখ থেকে অনলবর্ষী বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হলো সন্ধ্যাটা। তারপর বক্তৃতা দিল বেকাথার বাকি তিন ছেলে। এই সময়ের মধ্যে তেহুতি এবং বেকাথা দুজনই প্রচুর পরিমাণে ল্যাসিডিমনের উৎকৃষ্ট লাল মদ গলায় ঢেলেছে। ছেলেদের রক্তপিপাসু কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বেকাথা; কিন্তু হঠাৎ করেই কী যে হলো, কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। সাথে সাথে বদলে গেল সবার মেজাজ।
উপস্থিত নারীরা সবাই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বেকাথার চারপাশে জড়ো হয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। বিমূঢ় হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল পুরুষরা। শেষ পর্যন্ত সবাই তাকালাম হুইয়ের দিকে। মুখে কিছু বললাম না তবে আমাদের মনের কথা ঠিকই বুজতে পারল সে: এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। সে তোমার স্ত্রী। তাকে সামলাও!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল হুই। তবে কপাল ভালো তার, কারণ সে বেকাথার কাছে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ বুকভাঙা চিৎকার করে উঠল বেকাথা, আমার সবগুলো সন্তানকে মরতে পাঠাতে হবে কেন?
সেই মুহূর্তেই নানা অংশে টুকরো টুকরো হয়ে গেল দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ পরিবারটি।
সাথে সাথে ছোট বোনের পাশে এসে দাঁড়াল তেহুতি। বেকাথা ঠিকই বলেছে। সেরেনাকে ফিরে পেয়েছি আমরা। এই ছোটখাটো অর্থহীন যুদ্ধে লড়াই করার কোনো মানেই হয় না এখন।
অর্থহীন মানে? গর্জে উঠল হুরোতাস। তুমি কি সত্যিই এই শব্দটা উচ্চারণ করলে, প্রিয়তমা আমার? ছোটখাটো শব্দটাও কি তোমার মুখ থেকে শুনলাম আমি? তুমি বুঝতে পারছ পুরো একটা সেনাবাহিনীকে এই মিশর পর্যন্ত নিয়ে আসতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে? এখন কিছুতেই ফিরে যেতে রাজি নই আমি, যে যাই বলুক না কেন। এই কষ্টের পাই পয়সা উসুল না করে আমি ছাড়ব না।
আমাদের সাথে এমন কাজ কোরো না মা, বেকাথার মেজ ছেলে সস্ট্রেটাস এবার বলে উঠল। সবেমাত্র সৈনিক জীবনে পা রেখেছি আমরা। এই সময়ে আমাদের অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বোলো না। তাহলে পুরো পৃথিবী বলবে আমরা সবাই কাপুরুষ, জোচ্চোর উটেরিকের সাথে লড়াই করার মতো সাহস রাখতে পারিনি।
আমি তাকিয়ে ছিলাম সেরেনার দিকে। আমার জানা আছে এই পুরো ব্যাপারটার ফলাফল কী হবে তা নির্ভর করছে একান্তই ওর ওপর। হুরোতাস তার মেয়ের কথামতোই কাজ করবে এবং একই কথা তেহুতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মুখে হয়তো প্রতিবাদ করবে ওরা দুজন; কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেবল সেরেনাই নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দেখলাম এক মুহূর্তের জন্য হুরোতাসের দিকে তাকাল ও; এক চিলতে সন্দেহের ছায়া এসে ভর করল চেহারায়। তারপর মায়ের দিকে তাকাল ও এবং সব শেষে খালা বেকাথার দিকে। বুঝলাম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে ওর। এটাও বুঝতে পারলাম, যে করেই হোক ওর সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। তা না হলে হয়তো আগামীকালই ল্যাসিডিমনের দিকে ফিরতি পথে রওনা দেবে এই বাহিনী।
আমার মনে হয় এই দেশকে নিশ্চিতভাবেই ঘৃণা করে সেরেনা, এবং তাকে সারাটা জীবন এখানে কাটাতে বাধ্য করাটা হবে একেবারেই নিষ্ঠুরতার পরিচয়, বলে উঠলাম আমি। আমার মতে ঠিকই বলেছে বেকাথা এবং তেহুতি। আমাদের উচিত এই মুহূর্তে ল্যাসিডিমন ফিরে যাওয়া। এই অভিশপ্ত দেশ নিয়ে যা খুশি করুক গিয়ে উটেরিক। আমি নিশ্চিত যে আমাদের মিত্র রাজারা আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারবে, এবং এটাও আশা করি যে, তাদের সেনাবাহিনীকে এত দূর নিয়ে আসা এবং তাদেরকে আবার শূন্য হাতে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ চাইবে না তারা। সেরেনা তার জন্মভূমিতে সুখে দিন কাটাবে। হুরোতাস নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট কোনো কুটিরের সামনে খেলা করে বেড়াবে তার আর রামেসিসের একগাদা বাচ্চাকাচ্চা। পারিবারিক সম্পদ যে ভালো কাজেই ব্যয় হয়েছে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে সে। নিজের জন্য সে যে ফালতু নামটা ঠিক করেছিল, রানি ক্লিওপেট্রা… ইতোমধ্যে যেন পাখা গজিয়েছে আমার মুখ থেকে উচ্চারিত কথাগুলোর। হাঁ করে সেগুলো শুনছে সবাই, বিশেষ করে সেরেনা।
তার পরেই আমি দেখলাম একটু আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও সেটা আবার এক লহমায় বদলে ফেলল।
প্রিয় টাটা, তোমার কথাগুলো সবই সত্যি। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নেরই দুটো চেহারা থাকে। আমাকে সব সময় শেখানো হয়েছে যে, একজন স্ত্রীর উচিত যেকোনো পরিস্থিতিতে দেবতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া, এবং তার স্বামীর সামনে দেবতারা যে দায়িত্বই দিন না কেন তা পালন করতে তাকে সব রকম উপায়ে সাহায্য করা। আমি জানি যে সময় হলে রানি ক্লিওপেট্রা নামটাও গ্রহণ করব আমি, তা যতই ফালতু হোক না কেন। রামেসিস এবং আমি যদি এই মিশরের ফারাও এবং ফারাওইন হিসেবে থেকে যাই তাহলে আমার যেকোনো সময় আমার প্রিয় মা আমাকে দেখতে আসতে পারবে, অন্তত তার যাতায়াতের ব্যয় বহন করতে কোনো অসুবিধা হবে না আমাদের। এই মিশরের সৌন্দর্য এবং সম্পদকে উপভোগ করতে শিখে নেব আমরা দুজন। আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা, আমার কারণে দারিদ্র্যে পতিত হতে হবে না আমার বাবাকে।
এই বক্তৃতার সাথে সাথে নীরবতা নেমে এলো চারদিকে। কিন্তু বেকাথার ছেলেরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ঠিকই। নতুন করে কান্নায় ভেঙে পড়ল বেকাথা। কিন্তু আমি এক পেয়ালা মদ নিয়ে এগিয়ে যেতে সেটায় চুমুক দেওয়ার জন্য কান্না থামাতে হলো তাকে।
গম্ভীর হয়ে এসেছে হুরোতাসের চেহারা। প্রিয়তমা কন্যা আমার, বলল সে, অত্যন্ত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি। কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ নেই। যে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমার দিকে এক নজর তাকাল সে, তারপর গম্ভীর চেহারাতেই এক চোখের পাতা বন্ধ করল আলতো করে। অভিনন্দন জানানো হচ্ছে আমাকে। আরো একবার অল্প একটুর জন্য জিতে গেছি আমরা।
*
পরদিন রাতে আমি আর রামেসিস বের হলাম নীলনদের পশ্চিম তীরটা পরীক্ষা করে দেখতে। এই তীরেই আবু নাসকোস শহর অবস্থিত, যেখানে ঘাঁটি গেড়েছে উটেরিক। নদীর দিকটায় কোনো প্রবেশপথ নেই, যেখান দিয়ে শহরে ঢোকা যায়। অন্য দরজাগুলোর বর্ণনা জানা আছে আমার; কিন্তু নিজের চোখে কখনো দেখিনি। বুঝতে পারছি যে ওগুলো দেখতেই হবে আমাকে। সাথে করে পনেরোজন লোক নিয়েছি আমরা। মাঝরাতের পরে চাঁদ উঠল আকাশে। তার আগের অন্ধকার সময়টাতে নীলনদ পার হয়ে গেলাম আমরা, তারপর নদীর তীরে নলখাগড়ার বনে লুকিয়ে রাখলাম আমাদের নৌকাগুলো। তারপর সামনেটা দেখতে পাওয়ার মতো আলো ফুটতেই দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম শহর প্রাচীরের দিকে। কয়েক শ কিউবিট এগোনোর পরেই দেখলাম উটেরিকের এক পাল ঘোড়া চাঁদের আলোয় ঘাস খাচ্ছে নদীর তীরে। সেগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করলাম আমরা, তারপর দুজনকে পাঠালাম ওগুলোকে আমাদের নৌকার কাছে রেখে আসতে। এভাবে তিনবারে প্রায় দেড় শ রথের ঘোড়া জোগাড় করে ফেললাম আমরা।
দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের ওপর ঝলকাচ্ছে চাঁদের আলো, ফলে নিরাপদ দূরত্ব থেকেই শহরের দুটো দরজা দেখতে পাচ্ছি আমি। সেগুলোর আকার আকৃতি এবং নির্মাণশৈলীও আন্দাজ করে নিলাম এর ভেতরেই। আক্রমণ ঠেকানোর উপযোগী দেয়াল আর চোখা কাঠ দিয়ে ভর্তি পরিখাগুলোর কথাও মাথায় রাখতে ভুললাম না।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর পিছিয়ে এলাম আমরা। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর পর দেখা গেল আমাদের রেখে যাওয়া নৌকাগুলোর মাঝে দুটো নৌকার সাহায্যে ঘোড়াগুলোকে নদীর ওপারে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেমনটা আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। বাকি নৌকাগুলো নিয়ে ওদের অনুসরণ করলাম এবার। বেচারা ঘোড়াগুলোর জন্য অবশ্য একটু বেশিই কষ্ট হয়ে গেল, নীলনদ এখানে প্রায় দেড় লিগ চওড়া। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা যখন পুব তীরে হুরোতাসের শিবিরের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন আমি আর রামেসিস সবগুলো ঘোড়া গুনে দেখলাম। একটা ঘোড়াও খোয়া যায়নি দেখে খুশি হয়ে উঠলাম সবাই।
এভাবে সফলতা পেয়ে আমাদের সাহস বেড়ে গেল। চার রাত পর রামেসিসের কথায় প্রভাবিত হয়ে আরো একবার একইভাবে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করলাম আমরা, যদিও এবার আমার মনের ভেতর সায় দিচ্ছিল না। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এবার আর আগের মতো সফলতা ধরা দিল না আমাদের হাতে। উটেরিকের লোকেরা বাকি ঘোড়াগুলোকে সরিয়ে ফেলেছিল এবং আমাদের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করছিল তারা। যেখানে নৌকা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে আসার জন্য প্রাণপণে লড়াই করতে হলো আমাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন নৌকার কাছে আসতে পারলাম তখন দেখলাম যে ওগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য যাদের রেখে গিয়েছিলাম তাদের কচুকাটা করে ফেলা হয়েছে। সেইসাথে খসিয়ে দেওয়া হয়েছে সবগুলো নৌকার তলি। আমাদের মাঝে অর্ধেকের বেশি লোক সাঁতার জানত না। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত নৌকাগুলোকেই ভেঙে তক্তা আলাদা করে ফেললাম আমরা, একই সাথে লড়াই করতে হলো শত্রুদের সাথে। নৌকাগুলো থেকে তক্তা বের করে আনার কাজ শেষ হতেই নদীতে নেমে পড়লাম আমরা, যারা সাঁতার জানত না তাদের প্রত্যেককে একটা করে তক্তা ধরিয়ে দিলাম। তারপর তাদের ঠেলে ঠেলে বা টেনে নিয়ে পালিয়ে এলাম নদীতে। তীরে দাঁড়িয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ বর্ষণ করতে লাগল শত্রুরা, তীর ছুঁড়তে লাগল আমাদের লক্ষ্য করে। অগত্যা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম আমরা। পানিতে ডুবে অথবা কুমিরের মুখে পড়ে আরো পাঁচজন লোক প্রাণ দিল। যার অর্থ হচ্ছে, যারা গিয়েছিলাম তাদের মাঝে মাত্র ছয়জন প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারলাম নীলনদের পুব তীরে। আমার বিখ্যাত পুঁথি যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাস-এ আমি লিখেছি, যুগে যুগে যত বিখ্যাত এবং মেধাবী সেনানায়ককে দেখা গেছে তারা প্রত্যেকেই জীবনে অন্তত একবার হলেও পরাজয়ের শিকার হয়েছে। সেই পরাজয় থেকে সে বেঁচে ফিরতে পারল কি না সেটাই মুখ্য, পরাজয়টা কীভাবে ঘটেছিল তা মুখ্য নয়।
সৌভাগ্যক্রমে হুরোতাসের মিত্র রাজাদের মাঝে সবচেয়ে শেষজন প্রায় আমাদের সাথে সাথেই নীলনদের পুব তীরের নোঙর ফেলল। এ হচ্ছে সেই বীরবাহু বের আর্গোলিদ, থিবিসে অবস্থিত বোয়েশিয়ার রাজা। সাতটি জাহাজের নৌবহর নিয়ে এসেছে সে। সব মিলিয়ে ৬৩০ জন সৈনিক রয়েছে তার দলে, সেইসাথে তার অসংখ্য স্ত্রীদের মাঝে দশজন। রানি হ্যাগনেও আছে তাদের মাঝে, কিছুদিন আগেও যে ছিল সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পূজারিনি।
নীলনদের অববাহিকার দিক থেকে এক সারিতে এলো তারা। এবং অবাক হয়ে দেখল, ফারাও রামেসিস এবং তার প্রধান মন্ত্রী টাইটা অর্ধনগ্ন অবস্থায় সারা গায়ে কাদা মেখে কয়েকটা ভাঙা তক্তা ধরে ভাসছে নীলনদের পানিতে। দ্রুত বের আর্গোলিদের প্রধান জাহাজে টেনে তোলা হলো আমাদের। এবং আমাদের দেখে তাদের চেহারায় প্রথমে যে বিস্ময় ভর করেছিল তা দুষ্টুমিতে পাল্টে যেতে বেশি সময় লাগল না।
আমার কাপড়চোপড়ের বেহাল দশা দেখে আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল রানি হ্যাগনে। নিজের শরীর থেকে রাজকীয় গাউন খুলে ফেলল সে, তারপর আমাকে দিয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমার চাইতে আপনারই এটা বেশি দরকার মহামান্য টাইটা।
খুশি মনেই তার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম আমি, যদিও তার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে রানির উন্মুক্ত বুকের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাওয়া। এবং স্বীকার করছি, বীরবাহু বের আর্গোলিদের রুচির প্রশংসা করতে হয়। তা ছাড়া গাউনটাও বেশ আরামদায়ক হলো আমার পরনে, রংটা আমার চোখের সাথে সুন্দর মানিয়ে গেল। যদিও হাতা এবং ঝুলের দিক দিয়ে একটু খাটো হলো, তবে তাতে কিছু আসে-যায় না। এবার আমাদের দুর্দশার কাহিনি শোনার জন্য আমাদের চারপাশে জড়ো হলো বীরবাহু এবং তার সকল কর্মকর্তা, সেইসাথে তাদের স্ত্রীরা। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এমন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তাই রামেসিসসহ বাকি সবাইকে ইতোমধ্যে সাবধান করে দিয়েছি, যেন মুখ বন্ধ রাখে তারা।
আসলে বলার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি, বীরবাহুর প্রশ্নের জবাবে বিনয়ের অবতার সেজে জবাব দিলাম আমি।
নিশ্চয়ই আরো একবার বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন আপনি, প্রভু টাইটা, বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল রানি হ্যাগনে। সুতরাং এবার একটু বাড়িয়ে বলা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না আমার সামনে।
ফারাও রামেসিস আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে উটেরিকের ঘোড়ার সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। তাতে উটেরিকের কাছে পর্যাপ্ত রথ থাকবে না, অথচ আমাদের রথের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। দেখলাম অবাক হয়ে গেল রামেসিস, আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলল। তারপর হঠাৎ মুখ বন্ধ করে ফেলে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল আমার কথায়।
ঘোড়া কি আনতে পেরেছেন? জানতে চাইল বীরবাহু। আমার কাছে তো মনে হচ্ছে না সফল হয়েছেন আপনারা, বলে হো হো করে হেসে উঠল সে।
তা কিছু ঘোড়া পেয়েছি আমরা, মধুমাখা গলায় জবাব দিলাম আমি।
কিছু বলতে কত? জানতে চাইল সে। পাঁচ? দশ?
তার চাইতে সামান্য বেশি, স্বীকার করলাম আমি। এই ধরুন দেড় শর মতো। তবে শুধু দেবতারাই বলতে পারবেন যে ওগুলোর মাঝে কতগুলো আমাদের শিবিরে পৌঁছবে। বুঝতেই পারছেন, ঘোড়াগুলো আমাদের আগেই। এই তীরে এসে উঠেছে, এবং উঠেই দৌড়ে পালিয়েছে এদিক-ওদিক। কিছু ঘোড়া যে হারাতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে আশা করি বেশির ভাগই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব আমরা। এই বলে জিজ্ঞাসু চোখে রামেসিসের দিকে তাকালাম আমি। তোমার কি আর কিছু বলার আছে রামেসিস? মাথা নাড়ল ও আমার বানানো গল্প শুনে হাঁ হয়ে গেছে। তবে সেই মুহূর্তেই আলোচনায় যোগ দিল রানি হ্যাগনে।
তাহলে এই কাজ করতে গিয়েই এমন কাকভেজা দশা হয়েছে আপনাদের। ঘোড়াগুলোর সাথে নদীর ওই তীর থেকে এ পর্যন্ত সাঁতরে এসেছেন আপনারা, তাই না? কি মিষ্টি জ্ঞানী একজন মহিলা। যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি আমি। সন্দেহ নেই, সাহসী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে এক নজরেই চিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে।
একেবারে সঠিক ধরেছেন, মহামান্য রানি, তার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। বুঝতেই পারছেন আমাদের নৌকাগুলোকেও নষ্ট করে রেখে আসতে হয়েছে আমাদের। যদিও ওগুলোর খুব সামান্যই মূল্য আছে; কিন্তু আমরা চাইনি যে শত্রুরা ওগুলোর ফায়দা লুটুক।
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল বোয়েশিয়ার রাজা। একটু আগে যে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠেছিল তার মুখে সেটা এখন মুছে গেছে। জাহাজের ডেকের ওপরেই আমাদের সবাইকে মদ পরিবেশন করার জন্য পরিচারককে নির্দেশ দিল সে।
এই মদটা সত্যিই দারুণ, রামেসিস এবং আমার বিজয় আর নায়কোচিত বীরত্বের গল্পের সবটুকু শোনার পর মন্তব্য করল বীরবাহু। সত্যিই দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বিজয়ের কথা মানুষ বেশি দিন মনে রাখে না। মানুষের নিজস্ব ভুল এবং অন্য ত্রুটিগুলোর কথা তাই কাউকে না জানানোই ভালো।
*
বীরবাহু বের আর্গোলিদের আগমনের সাথে সাথে হুরোতাসের শিবিরে ষোলোজন মিত্র রাজার সবার উপস্থিতি নিশ্চিত হলো। এবার অবশেষে রামেসিস এবং সেরেনার বহুপ্রতিক্ষীত দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজনে হাত দেওয়া যেতে পারে। প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠানে আমিই ছিলাম একমাত্র অতিথি এবং অন্য সব দায়িত্বও আমাকেই পালন করতে হয়েছিল। তাই দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকব বলেই ঠিক করলাম। সেরেনাকে সাহস দেওয়ার জন্য তার পুরো পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন সবাই রয়েছে এখানে, ওদিকে রামেসিসের জন্য আছে বেকাথা এবং তার তিন ছেলে, যারা তাকে নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখন আর আমাকে না হলেও চলবে ওদের।
এবার অন্য একটা ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পেলাম আমি, যেটা সেই লুক্সর থেকে গানোর্ডের সাথে নদীপথে যাত্রা করার সময় থেকেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, গানোর্ডের কাছ থেকে শোনা সেই অপেক্ষাকৃত উন্নত জাতির বিবরণ; যারা নীলনদের তীরে আবু নাসকোস শহরের এই জায়গায় গড়ে তুলেছিল এক প্রাচীন কিন্তু সমৃদ্ধ জনপদ।
পোশাকের ভেতরটা হাতড়ে গানোর্ডের কাছ থেকে উপহার পাওয়া সেই মাটির ভাস্কর্যটা বের করলাম আমি, যাতে আঁকা আছে সোনালি মাথাসহ একটা মাছ। আরো একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম সেটাকে। জিনিসটা সুন্দর ঠিক; কিন্তু রহস্যময়ও বটে। নদীর কিনারে চলে এলাম আমি; সেখানে নোঙর করে থাকা ছোট ছোট নৌকা আর জাহাজগুলোর মাঝে চার বাতাসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। তবে মাঝিদের কাছ থেকে জানা গেল জাহাজটা নাকি লুক্সরে ফিরে গেছে। সে সময় নদীর পশ্চিম তীরে ঘোড়া সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম আমি। গানোর্ড যে কোথায় গেছে তা কেউ বলতে পারে না। মাঝিদের সোনালি মাথার মাছটা দেখালাম আমি। সবাই একমত হলো যে জিনিসটা সুন্দর; কিন্তু এমন কিছু কেউ আগে কখনো দেখেনি।
ভোঁদড়ের চামড়া দিয়ে একটা থলে তৈরি করলাম আমি, যার মাঝে মাটির টুকরোটা নিখুঁতভাবে এঁটে যায়। তারপর টালিটাকে থলের ভেতর ভরে একটা সুতোয় বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। আমার জামার ভেতর ঝুলে রইল জিনিসটা। চিন্তাভাবনা করার সময় টালিটাকে আনমনে আঙুলের মাঝে নাড়াচাড়া করতে বেশ ভালো লাগে।
পরবর্তী কয়েক দিন নদীর তীরে একা একা ঘুরে বেড়ালাম আমি। তবে কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ করলাম না। নীলনদের সন্তান আমি, যদিও আমার জন্মতারিখ আমি নিজেও জানি না। তবে এটা জানি যে জন্মের দিন থেকেই নীলনদকে আমার বন্ধু বলে জেনে এসেছি আমি। এই বিশাল স্রোতস্বিনীকে ভালোবাসি আমি, এবং অনুভব করতে পারি যে সেও ভালোবাসে আমাকে।
নদীর তীরে একটা গাছের ছায়ায় আরামদায়ক একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম আমি। এখান থেকে পশ্চিম তীরে অবস্থিত আবু নাসকোস শহরের দুর্গটাকে দেখা যায়। এবং এখানেই নীলনদের মাঝখানে কয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপ দেখা যায় এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো দ্বীপের ওপরেই গজিয়েছে বড় বড় গাছ আর বুনো লিয়ানা লতা। এখানে নদী প্রায় দেড় লিগ চওড়া এবং দ্বীপগুলোর মাঝে প্রায় পোয়া লিগ দূরত্ব বিদ্যমান। আমার মনে হলো খুব বেশি হলে আধাঘণ্টার মধ্যেই সাঁতার কেটে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারব আমি। তার পরেই আনমনে হেসে উঠে মাথা ঝাঁকালাম। এমন কাজ করার তো কোনো দরকার পড়েনি আমার।
চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। বরাবরের মতোই সোনালি মাছটা ছিল আমার ডান হাতে। কিন্তু হঠাৎ করে যেন বুড়ো আঙুলে হুল ফোঁটাল ওটা। ব্যথা এবং বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। মনে হলো যেন বোলতার হুল, তবে ও রকম ব্যথা লাগল না। টালিটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা পরীক্ষা করে দেখলাম আমি। এমন কোনো দাগ নেই, যা দেখে বোঝা যেতে পারে যে এখানে হুল বা এমন কিছু ফুটেছে। ব্যথাটাও দ্রুত মিলিয়ে গেল। অগত্যা ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিবিরে ফিরে এলাম আবার।
সেদিন সন্ধ্যায় তেহুতি আমাকে দাওয়াত করল তার এবং হুরোতাসের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। রামেসিস আর সেরেনাও থাকল তাদের সাথে। গত কয়েক দিনে ওদের সাথে আমার দেখাই হয়নি। সবাই মিলে বেশ সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালাম, আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কিত আলোচনায় পার হয়ে গেল সময়টা।
পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। দ্রুত কাপড় পরে নিলাম আমি, তারপর এগিয়ে চললাম নীলনদের তীর বরাবর তৈরি হওয়া পায়ে চলা পথ ধরে। দ্বীপগুলোর কাছাকাছি এসে গতকাল বিকেলে যেখানে বসেছিলাম সেই একই মসৃণ পাথরটার ওপর বসলাম। অত্যন্ত শান্ত একটা পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। অনেকটা আনমনেই টালিটা আমার গলায় ঝোলানো চামড়ার থলে থেকে বের করে আনলাম, তারপর আঙুলে ঘষতে শুরু করলাম সেটাকে। আমার মাথার ওপর গাছের ডালে বাসা বাঁধছে এক দল পাখি। জানি না ঠিক কতক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। তবে একসময় ক্ষুধার্ত বোধ করতে শুরু করলাম। মনে পড়ল সকাল থেকে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি।
উঠে দাঁড়ালাম আমি। সাথে সাথে টালিটা দারুণ জোরে হুল ফোঁটাল আমার হাতে। দারুণ চমকে উঠে ওটাকে হাত থেকে ছেড়ে দিলাম আমি, ব্যথা পাওয়া আঙুলটা মুখে পুরে চুষতে লাগলাম। আমার গলায় বাঁধা সুতোর সাথে ঝুলতে লাগল ওটা। এবং এবারই প্রথম বুঝতে পারলাম এর মাঝে আসলে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে। এক আঙুলে আরেকবার স্পর্শ করলাম ওটাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীর মাঝে নিয়ে ঘষতে লাগলাম, প্রতি মুহূর্তে আশা করছি যে আরো একবার হুলের খোঁচা খেতে হবে। কিন্তু এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। ওদিকে এতক্ষণে আমার ক্ষুধা উধাও হয়ে গেছে। এখন আর খাবারের চিন্তা নেই আমার মাথায়, অন্য চিন্তা এসে ভর করেছে তার বদলে।
এবার একটু সরে এসে অন্য একটা জায়গায় বসলাম আমি, যাতে সূর্যের আলোটা সরাসরি টালির ওপর এসে পড়ে। এমনভাবে ওটাকে পরীক্ষা করতে লাগলাম, যেন জীবনে প্রথমবার দেখছি জিনিসটা, আগে কখনো দেখিনি। মাছের শরীরের আঁশগুলো গুনে দেখলাম। মাছের পাখনা এবং লম্বা লেজটাও একইভাবে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম; কিন্তু কোনো রহস্যময় নিগূঢ় তথ্য ধরা দিল না আমার সামনে। এবার টালির উল্টো দিকটাও ভালো করে পরীক্ষা করলাম। এই দিকটায় কোনো লেখা হায়ারোগ্লিফ বা কিউনিফর্ম তো দূরের কথা, সামান্য একটা আঁচড়ের দাগ পর্যন্ত নেই। তবে জিনিসটা আবার সোজা করে ধরার সময় একটা ব্যাপার চোখে পড়ল আমার, যেটা এর আগে আমার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। সূর্যের আলোর দিকে বিশেষ একটা কোণ করে না ধরলে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। টালির পেছন দিকে অর্থাৎ মাছের ছবি যেদিক আঁকা রয়েছে তার উল্টো দিকে কয়েকটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র গর্ত রয়েছে। খুব সম্ভব টালিটা বানানোর পর আগুনে পোড়ানোর আগে কোনো সরু সুইয়ের মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে গর্তগুলো তৈরি করা হয়েছিল। আলোর দিক বদল করতেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল ফুটোগুলো। আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে আবার দেখা গেল সেগুলোকে।
ছিদ্রগুলো গুনে দেখলাম আমি। সব মিলিয়ে চারটি: মাছের লেজের পেছন বরাবর দুটো আর দুটো রয়েছে নাকের সামনে। এগুলো কী কারণে তৈরি করা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করলাম; কিন্তু কোনো তল পেলাম না। ফলে মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল। বুঝতে পারছি যে কিছু একটা আমার হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ধরতে পারছি না। আবার ক্ষুধা লেগে গেল এবার। এক দৌড়ে শিবিরে ফিরে এলাম আমি, রান্নাবান্না যেখানে হয় সেদিকটায় চলে এলাম। গতকালের কিছু ঠাণ্ডা সসেজ রয়েছে বাবুর্চিদের কাছে। তেলতেলে, লবণও বেশি। কিন্তু তার পরও সবকটা সাবাড় করলাম আমি। মনে হচ্ছে দেবতারা আমাকে নিয়ে মজা করছে, এবং এটাই প্রথমবার নয়। তাদের কাছে হার মানার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
খাওয়া শেষ হতে আবার নদীর পাশে সেই পাথরটার ওপর ফিরে এলাম আমি। বিস্বাদ সসেজ খাওয়ায় একটু পর পর কটু ঢেকুর উঠছে। আরো একবার জামার নিচ থেকে বের করে আনলাম মাছের ছবি আঁকা টালিটাকে। সূর্যের দিকে উঁচু করে ধরে ঘোরাতেই সেই চারটে ছিদ্র আবার দেখা গেল। টালিটা নামিয়ে রেখে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
নদীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট প্রায় একই রকম দ্বীপগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে আমার চোখ। সবুজ পানির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সামনে যে রহস্য রয়েছে তার সাথে তো ওদের কোনো সম্পর্ক নেই… নাকি আছে?
হঠাৎ করে মৃদু উত্তেজনার শিহরণ বয়ে গেল আমার, শরীরে রোম খাড়া হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম নদীর বুকে দ্বীপের সংখ্যা হচ্ছে চার, যেটা একই সঙ্গে আমার হাতে ধরে রাখা টালির মাঝে দেখা ছিদ্রগুলোর সংখ্যাও বটে। হয়তো একেবারেই তাৎপর্যহীন একটা ব্যাপার; কিন্তু চার হচ্ছে দেবী ইনানার সংখ্যা, যে আমার রক্ষাকারী দেবী। বুঝতে পারলাম, ওই চারটি দ্বীপের অন্তত একটাতে যেতেই হবে আমাকে।
ইচ্ছে করলে একটা নৌকা নিয়ে এক ঘণ্টার ভেতরেই প্রথম দ্বীপটায় পৌঁছে যেতে পারি আমি। কিন্তু আমার জানা আছে নদীর অন্য পাড়ে অবস্থিত দুর্গ প্রাচীরের ওপর থেকে এই দিকে শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে শত্রুরা। নৌকার চাইতে বরং আমার সাঁতারের গতি বেশি দ্রুত, এবং অন্য পাড় থেকে দেখলে আমার মাথাটাকে ভোঁদড়ের মাথা বলে ভুল করবে যে কেউ। চিন্তাগুলো মাথার ভেতর পূর্ণাঙ্গ রূপ নেওয়ার আগেই কাপড় ছাড়তে শুরু করলাম আমি।
কাপড় ছাড়া শেষ হতে নদীর তীর ধরে এগোতে শুরু করলাম। পানির কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছি, যাতে আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীর থেকে আমাকে দেখা না যায়। সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা যখন আমার এবং দুর্গ প্রাচীরের ঠিক মাঝখানে চলে এলো তখন নদীর কিনারের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি, তারপর পানিতে নেমে পড়লাম। গলা পানিতে নেমে এসে একবার দেখে নিলাম যে গলায় ঝোলানো থলেটা ঠিকঠাক আছে কি না। ছুরিভরা খাপটা অন্তর্বাসের সাথে বেঁধে নিয়েছি। এবার সেটাকে খাপ থেকে বের করে বুড়ো আঙুলে ঠেকিয়ে ধার পরীক্ষা করে নিলাম। যথেষ্ট ধার রয়েছে ওটাতে। ছুরিটা আবার খাপে ঢুকিয়ে টালিসহ থলের সুতোটা গলার সাথে এমনভাবে বেঁধে নিলাম যেন ওটা ঠিক আমার পিঠের সাথে আটকে থাকে। সামনের দিকে থাকলে সাঁতার কাটার সময় হাতে জড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
এবার তীর থেকে সরে এসে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম আমি, লক্ষ্য সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা। লক্ষ্য রাখছি যেন আমার হাত বা পায়ের বাড়িতে কখনো পানির ওপর আলোড়ন না ওঠে। স্রোতের বিরুদ্ধে কোনাকুনিভাবে উল্টো ঠেলে এগোতে হচ্ছে আমাকে, যাতে দ্বীপটা সব সময় আমার এবং দুর্গের মাঝখানে থাকে।
দ্বীপের কাছে পৌঁছানোর পর পানির ওপর ঝুলে থাকা একটা লিয়ানা লতা ধরে ফেললাম আমি, তারপর পা দিয়ে তলা খুঁজতে লাগলাম। এবং এখানেই প্রথমবারের মতো অবাক হতে হলো আমাকে। তলা নেই! দ্বীপের কিনারটা যেন খাড়া নেমে গেছে নদীর তলদেশ বরাবর। অগত্যা লতাটা ধরে ঝুলে থেকে কয়েকবার লম্বা দম নিলাম আমি। তারপর লতা ছেড়ে দিয়ে বুনো হাঁসের মতো মাথা নিচু করে ডুব দিলাম পানির ভেতর। ঘোলা পানির মাঝ দিয়ে নেমে চললাম নিচে, আশা করছি যেকোনো মুহূর্তে নদীর তলদেশের দেখা পাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফুসফুঁসে ব্যথা শুরু হতে হাল ছেড়ে দিয়ে ওপরে উঠে আসতে বাধ্য হলাম আবার।
পানির ওপর মাথা তুলে আবার লতাটা চেপে ধরলাম, তারপর বুক ভরে টেনে নিলাম মিষ্টি বাতাস। একটু দম ফিরে পেতে এগিয়ে গেলাম দ্বীপটার পাথুরে পাড়ের দিকে। গাছের শিকড় আর ডাল ধরে ধরে নিজেকে টেনে তুললাম ওপরে, উঠে পড়লাম সমতল পিঠের ওপর। এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। তারপর ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বৃত্তাকারে চক্কর দিতে শুরু করলাম দ্বীপের কিনার ঘিরে, যতক্ষণ না আবার আগের জায়গায় এসে পৌঁছলাম।
এবার আমি বুঝতে পারলাম দ্বীপটা আসলে আকৃতিতে গাছের গুঁড়ির মতো অন্যান্য সাধারণ দ্বীপের মতো ঢিবি আকৃতির নয়। পানির নিচে এবং ওপরে দুই জায়গাতেই এটা সম্পূর্ণ খাড়াভাবে ওপরে উঠে গেছে। ওপরের অংশটা চ্যাপ্টা গোলাকার। এমন কোনো দ্বীপের কথা আগে কখনো শুনিনি আমি, দেখা তো দূরের কথা। ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলল আমাকে; কিন্তু ঘন জঙ্গলে কারণে দ্বীপের সঠিক আকার-আকৃতি আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার এ পাশ থেকে ও পাশে পায়ে হেঁটে দেখলাম। মাঝে মাঝে ওল্টানো গাছের গুঁড়ি পার হতে হলো, কখনো খালি হাতে মাটি খুঁড়ে দেখলাম নিচে কোনো পাথুরে স্তরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কি না। কিন্তু গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের শিকড়ের জাল বিছিয়ে রয়েছে মাটির নিচে, সেগুলোকে খালি হাতে ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। সঙ্গে থাকা ছুরিটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। বহু বছরের পুরনো এগুলো, অত্যন্ত শক্ত।
আমি বুঝতে পারছি অদ্ভুত কিছু একটা আছে এখানে। ইনানা এবং আমার সম্পর্কটা বেশ খাপছাড়া, তবে আমি জানি যে দরকার পড়লে তার ওপর নির্ভর করা যায়। আমাকে কখনো ঠকায়নি সে, যদি ঠকিয়েও থাকে তাহলে তার কথা আমার জানা নেই। আরো ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর একটু বিশ্রাম নিতে বাধ্য হলাম আমি। একটা বুনো ডুমুর গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম মাটিতে।
এখানে কী পাবে বলে আশা করেছিলে? নিজেই প্রশ্ন করলাম নিজেকে। একা থাকলে প্রায়ই নিজের সাথে জোরে জোরে কথা বলি আমি। প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম মাথার ভেতর। তারপর চিন্তাভাবনা করে জবাব দিলাম, কিছুই আশা করিনি। কিন্তু ভেবেছিলাম প্রাচীন সেই জাতির কাছ থেকে কোনো একটা চিহ্ন বা বার্তা পাওয়া যাবে। প্রাচীন জাতি বলতে হাজার বছর আগে এখানে যারা বাস করত তাদেরকে বোঝাচ্ছি আমি।
হাতের আঙুলে হুল ফোঁটার মতো কোনো চিহ্ন? প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে বের হলো ঠিকই; কিন্তু আমি বলিনি কথাটা। দারুণ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম এবং দেখতে পেলাম তাকে। আমার দৃষ্টিসীমার ঠিক এক কোণে গাছপালার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। ছায়ার মাঝে যেন আরেকটা ছায়া। কিন্তু এক পলকেই আমি চিনতে পারলাম তাকে, কোনো ভুল হলো না।
*
ইনানা! বলে উঠলাম আমি। সাথে সাথে হেসে উঠল সে জলতরঙ্গের মতো সুমধুর বুলবুল পাখির মতো মিষ্টি গলা। তারপর আবার কথা বলে উঠল, তবে এবার আর আমার কণ্ঠে নয়; বরং তার নিখুঁত কণ্ঠই শুনতে পেলাম আমি।
যা খুঁজছ তা যদি দষ্টির সামনে না থাকে তাহলে এমন জায়গায় খোজো যেখানে দৃষ্টি দিয়ে সামনে এগোনো যায় না। আবার হেসে উঠল সে, তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি; কিন্তু তাকে ধরার কোনো উপায় নেই।
আমি জানি, তার পিছু ধাওয়া করে বা নাম ধরে ডেকে কোনো লাভ নেই। এর আগে বহুবার এই কাজ করেছি আমি, কখনো কাজ হয়নি। অগত্যা আবার বসে পড়লাম আগের জায়গায়। নিজেকে কেমন যেন প্রতারিত মনে হচ্ছে।
তার পরেই অনুভব করলাম তীক্ষ্ণ কী যেন বিধল আমার শরীরে। যে জায়গায় ব্যথা লেগেছে অর্থাৎ আমার দুই নিতম্বের ঠিক মাঝখানটায় সেখানে হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাঙরের দাঁতের মতো ধারালো শক্ত কিছু একটা বিঁধে আছে সেখানে। দুই আঙুলে ধরে সেটাকে টেনে বের করে আনলাম আমি, ব্যথা লাগতেই কুঁচকে উঠল মুখ।
জিনিসটা এবার সাবধানে ধরে রেখে চোখের সামনে তুলে আনলাম আমি। সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠল আমার হৃৎপিণ্ড, রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠল। কাঁধের ওপর হাত বাড়িয়ে পিঠ থেকে চামড়ার থলেটা খুলে আনলাম আমি, যেটার মধ্যে গানোর্ডের দেওয়া সেই মাটির তৈরি মাছটা রয়েছে।
নিখুঁত টালিটা হাতের তালুতে রাখলাম আমি, তারপর নিতম্বে বিধে থাকা ধারালো টুকরোটা নিয়ে সেটার পাশে রাখলাম। টালির একটা কোনার চেহারার সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে ধারালো জিনিসটা।
যেই জায়গাতে টুকরোটা ভেঙে এসেছে সেখানটা ক্ষুরের মতো ধারালো এবং সুইয়ের মতো তীক্ষ্ণ। এখনো আমার পেছন থেকে বের হওয়া এক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে তাতে। অন্য প্রান্তটা চওড়া এবং আমার হাতে ধরে রাখা আস্ত টালির গায়ে আঁকা মাছের মাথার মতো হুবহু একই রকম একটা মাথা আঁকা রয়েছে তাতে।
ভাঙা টুকরোটা প্রথম টালির ওপর রাখতেই দুটো নিখুঁতভাবে মিলে গেল। খুব সম্ভব হাজার বছর আগে একই ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হয়েছিল এ দুটোকে। একটা অক্ষত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে আমার হাতে, আরেকটার একটা ভাঙা অংশ এখন খুঁজে পেয়েছি আমি।
প্রাচীন সেই মানুষেরা যে আমার আগেই এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিল এটা তারই চিহ্ন বলে ধরে নিলাম আমি। নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে তারা। এটাও বুঝতে পারছি যে তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে আমার কাছে। আস্ত টালিটা এক হাতে নিলাম আমি, ভাঙা টালিটা নিলাম অন্য হাতে। তারপর সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলাম তাদের ওপর। বেশ কিছুটা সময় কিছুই ঘটল না, তারপর আস্ত টালিটার পেছনে আঁকা চারটে ছিদ্র যেন ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল, জ্বলজ্বল করে উঠল ছোট ছোট তারার মতো।
চার! সংখ্যাটা ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম আমি, বুঝতে পারছি যেকোনো একটা সমাধান আমার হাতের খুব কাছেই অপেক্ষা করছে। এক কিংবা দুই নয়, চার… হঠাৎ করেই থেমে গেলাম, কারণ অর্থটা এবার ধরা দিয়েছে আমার সামনে। ছিদ্রগুলো আমাকে বলতে চাইছে যে একটা নয় বরং চার চারটে দ্বীপ আছে এখানে। প্রথম দ্বীপে যদি সমাধান পাওয়া না যায় তাহলে বাকি তিনটে দ্বীপেও খুঁজে দেখতে হবে আমাকে!
টালি দুটোকে গলার সাথে সুতো দিয়ে বাঁধা চামড়ার থলেতে ভরে রাখলাম আমি তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট দ্বীপটার পশ্চিম পাশে চলে এলাম। এখান থেকে বাকি তিনটে দ্বীপ এবং আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। তবে গাছের আড়াল থেকে মুখ বের করেই আবার সরিয়ে নিতে হলো আমাকে, কারণ আমার ঠিক সামনেই যে দ্বীপটার রয়েছে সেটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে শত্রুদের দুটো পাহারাদার নৌকা। বেশ বড় নৌকা, প্রতি পাশে এক জোড়া করে দাঁড়। প্রতিটা দাঁড় বাইছে দুজন লোক। মাস্তুলগুলোতে এখন পাল খাটানো নেই ঠিক; কিন্তু তার বদলে প্রত্যেক নৌকাতে রয়েছে দুজন করে তীরন্দাজ। সবার হাতে ধনুক তাতে তীর জোড়া। দ্বিতীয় দ্বীপের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গলগুলো পরীক্ষা করে দেখছে তারা। আমার চোখের সামনেই সবচেয়ে কাছের নৌকাটা মুখ ঘুরিয়ে এদিকে আসতে শুরু করল। বুকে হেঁটে পিছিয়ে এলাম আমি, তারপর একটু আড়ালে এসেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম দ্বীপের অন্য পাশে। এখান থেকে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লাম নদীতে, তারপর পানিতে মাথা তুলেই সমস্ত শক্তি দিয়ে হুরোতাসের শিবির লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। মনে হলো যেন শত্রুরা জানত যে আমি ওখানে রয়েছি, আমাকে খুঁজতেই এসেছিল তারা। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, হয়তো নৌকাগুলোর ওখানে হাজির হওয়ার ঘটনাটা নেহাতই কাকতালীয়।
সাঁতার কাটতে অবশ্য তেমন কোনো অসুবিধা হলো না আমার। সাঁতরাতে সাঁতরাতে প্রথম দ্বীপে যা যা দেখেছি তা নিয়ে চিন্তা করার একটা অবকাশ পাওয়া গেল। দুটো জিনিসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবং বারবার ফিরে আসছে আমার চিন্তার ভেতরে। প্রথমটা হলো দ্বীপটার অদ্ভুত গঠন। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে সবুজ রঙের মাটির ওই টালির টুকরোটা, যেটা আমার নিতম্বে খোঁচা মেরেছিল। গানোৰ্ড অদৃশ্য হওয়ার আগে যে টালিটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল তার সাথে হুবহু মিলে যায় ওই টুকরোটা।
সাঁতার কাটতে কাটতে এই দুটো ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। মোটামুটি অর্ধেক পথ পার হয়ে আসার পর প্রথম সম্ভাবনাটা উঁকি দিল আমার মাথায় অথবা বলা যায় যে প্রথম অসম্ভব ধারণাটা মাথায় এলো। ধারণাটা এতই অদ্ভুত যে উচ্চ স্বরে বলে উঠলাম আমি, এমন কি হতে পারে যে দ্বীপটা আসলে প্রাকৃতিক নয়, বরং সেই প্রাচীন জাতির রেখে যাওয়া কোনো স্থাপত্যের চিহ্ন?
উত্তেজনার চোটে এক ঢোক পানি খেয়ে ফেললাম আমি, সেটাকে বের করে দেওয়ার জন্য খক খক করে কেশে উঠতে হলো। তবে ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ধারণাটা চলে এসেছে আমার মাথায়। আর তাই যদি হয়ে থাকে, বলে উঠলাম আমি, তাহলে বাকি তিনটে দ্বীপও কি তারা একই নিয়ম মেনে তৈরি করেছিল? কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত কাজ কেন করবে তারা?
তৃতীয় সম্ভাবনাটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সাঁতরে চললাম আমি। আরো একবার জবাবটা খেলে গেল আমার মাথায় এবং এবারও গানোর্ডের কাছ থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতেই বেরিয়ে এলো সেটা। হয়তো তারা দ্রুত এবং গোপনে নদী পার হওয়ার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল, যাকে বলা যেতে পারে জাদুবিদ্যা? সাঁতার থামিয়ে পানিতে ভেসে ভেসে ব্যাপারটার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। আমার ধারণা মতে প্রাচীন সেই জাতির লোকেরা নীলনদের ওপর দিয়ে নৌকা বা সেতুর মাধ্যমে পার না হয়ে বরং নদীর নিচ দিয়ে অতিক্রম করার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। এমন অদ্ভুত চিন্তা অবশ্য মাঝে মাঝেই খেলা করে আমার মাথায়। মাঝে মাঝে এটাও ভাবি যে, মানুষের পক্ষে আকাশে ওড়া সম্ভব কি না। যদিও মানুষের শরীরে কখনো পাখা গজানো সম্ভব নয় এটা বোঝার পর চিন্তাটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছে আমাকে। তবে এটা ঠিক যে আমার পক্ষে এক ডুবে নদীর তলদেশ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, গত এক ঘণ্টায় সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। কিন্তু এক ডুবে নদীর এ পার থেকে ও পার পর্যন্ত যাওয়ার কথা চিন্তা করতে গিয়ে এমনকি আমার মনও হোঁচট খেল। দূরত্বটা কম নয়, প্রায় দেড় লিগ। যদিও পানির ওপর দূরত্বের সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এমনকি পানিতে চলমান কোনো জাহাজ অথবা কোনো সঁতারুর গতিও মাপা অসম্ভব। এই সব চিন্তা মাথায় নিয়েই হুরোতাসের শিবিরের সামনে নদীর পাড়ে এসে উঠলাম আমি। কোমর পানিতে এসে হেঁটে হেঁটে ডাঙায় উঠছি, এই সময় সেরেনার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ডাকছে আমার নাম ধরে। টাটা, তুমি জানো না যে নদীর এই তীরে কুমির এবং তার চাইতেও অনেক ভয়ংকর সব মানুষের আড্ডাখানা? বরাবরের মতোই আমার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় ঠিকই কীভাবে যেন হাজির হয়ে গেছে ও। আমাকে পানি থেকে উঠতে সাহায্য করার জন্য দ্রুত এগিয়ে এলো ও। রামেসিসও ওর সাথেই ছিল, সেও আমাকে সাহায্য করল।
যদিও গতকালই ওদের সাথে দেখা হয়েছে আমার, তবু দারুণভাবে ওদের অভাব বোধ করছিলাম। বোঝা যাচ্ছে যে আরো একবার আমার জীবন বাঁচাতে পেরেছে ভেবে দুজনই বেশ খুশি খুশি বোধ করছে। এখন কোনোমতে শুকনো মাটিতে পা রাখতে পারলেই হয়, আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে পারি আমরা।
বিয়ের জন্য একটা দিন ঠিক করেছি আমরা রুদ্ধশ্বাসে বলতে শুরু করল রামেসিস।
এবং সেটা হচ্ছে পরশু দিন দুপুরে! ওর মুখ থেকে বাকি কথাটুকু কেড়ে নিল সেরেনা। আশা করি এই বিয়েটাও আমার পড়ানো বিয়েটার মতোই সুন্দর হবে, বললাম আমি।
কোনো কিছুই ওই বিয়ের ধারে কাছে যেতে পারবে না টাইটা। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আমাকে চুমু খেল সেরেনা।
*
বিয়ের সব ঝামেলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হলো যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি। অবশ্য উটেরিক বুবাস্টিস যদি আমাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে চায় তাহলে আমরাও তার জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কোমর থেকে কখনো তলোয়ারের খাপ খুলছি না আমি, এমনকি সুন্দরী মেয়েদের সাথে নাচার সময়ও না। রামেসিসের সভাইকে যে কখনো বিশ্বাস করা যায় না। এটা আমার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। নীলনদের অপর পারে দুর্গ-প্রাচীরের ওপর ভিড় জমিয়েছে শত শত কৌতূহলী মাথা। উটেরিক এবং তার অনুচররা নজর রেখেছে আমাদের ওপর, বোঝার চেষ্টা করছে যে এত গানবাজনা আর নাচের আয়োজন আসলে কীসের উদ্দেশ্যে।
এই তীরের সকল মহিলা তাদের মাথায় পরেছে ফুলের মুকুট। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক এবং সুন্দরী মেয়েদের সবার দেহের উর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্যবস্থাটা দারুণ পছন্দ হলো আমার। মদের বোতলগুলো যত হাত বদল হতে লাগল ততই উদ্দাম হয়ে উঠল নাচের ছন্দ, উচ্চকিত হয়ে উঠল বাজনা। আরো খোলামেলা হয়ে উঠল গায়কদের গানের কথা। মেয়েদের মধ্যে যারা একটু অভিজ্ঞ তারা তাদের প্রেমিক অথবা প্রেমিকদের নিয়ে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল, যখন ফিরে এলো তখন অদ্ভুত এক আনন্দে ঝলমল করছে তাদের চেহারা।
ষোলোজন রাজার সবাই বর এবং কনের চিরন্তন সুখশান্তি কামনা করে লম্বা চওড়া বক্তৃতা রাখল, তারপর নানা রকম দামি উপহার এনে রাখল তাদের সামনে। উপহারের মধ্যে থাকল মাহুতসহ হাতির দল, জাহাজ এবং সেগুলোর দাঁড় বাইবার জন্য যথেষ্ট ক্রীতদাস, কবিতা এবং সেগুলো আবৃত্তি করার জন্য কবি; ট্রাম্পেট এবং ঢাক আর সেগুলো বাজানোর জন্য বাদক; হীরা-মুক্তা এবং অন্যান্য রত্ন আর সেগুলো সাজানোর জন্য মুকুট; দামি মদ এবং রুপার পেয়ালা, সেইসাথে সেগুলোর স্বাদ আরো বাড়িয়ে তুলতে অজস্র স্বর্ণের ভাণ্ডার।
তবে এত কিছুর মাঝেও আমাদের সবচেয়ে দক্ষ দুই শ যোদ্ধাকে আলাদা করে নিয়েছি আমি এবং দিনের বেলায় একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মদ খেতে নিষেধ করে দিয়েছি সবাইকে। অন্যদিকে হুরোতাস হুই এবং আমি মিলে নীলনদের তীরে বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছি, যেখান দিয়ে উটেরিকের গুণ্ডাপাণ্ডারা নদী পার হয়ে অনুপ্রবেশ করতে পারে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর রাত নেমে এলো; কিন্তু একই তালে চলতে লাগল গানবাজনা আর আনন্দ উৎসবের প্রবাহ; বরং আরো যেন বাড়ল তাদের উৎসাহ।
হুরোতাস, হুই এবং আমি- এই তিনজন মিলে আমাদের বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে চলে এলাম নীলনদের তীরে সেই জায়গাগুলোতে, যেগুলো দিনের বেলায় বেছে রেখেছি আমরা। রামেসিসকে ইচ্ছে করেই এ ব্যাপারে কিছু জানাইনি আমি। ওকে এখন প্রায় নিজের মতোই চিনি আমি। আজকের কথা জানতে পারলে নিঃসন্দেহে আমাদের সাথে যোগ দিতে চাইত ও। কিন্তু আগামীকাল সেরেনার বিয়ে। আমি চাই না যে ওর বিয়ের উপহারের তালিকায় রামেসিসের লাশটাও যোগ হোক।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না আমাদের। ঘণ্টাখানেক পরেই আমাদের পেছনে শিবির থেকে ভেসে আসা উদ্দাম উৎসবের কোলাহল কমে আসতে শুরু করল। পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যেই থেমে গেল সব। সন্দেহ নেই উটেরিকের সৈন্যরা বেশ ভালো সময়ই বাছাই করেছে। অবশ্য উটেরিক নিজে তাদের সাথে এই নৈশ-আক্রমণে যোগ দেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম বলেই মনে হয় আমার।
দূরে নদীর অপর তীরে অন্ধকারের মাঝে উঁকি দিয়েছে এক টুকরো হলদে চাঁদ, তার প্রতিফলন নাচছে নদীর বুকে। সেই আলোতে আবু নাসকোসের দিক থেকে এক দল ছোট নৌকা এগিয়ে আসতে দেখলাম আমরা। আমাদের দিকেই আসছে তারা।
সরাসরি বাঘের মুখে এসে পড়বে ব্যাটারা, আমার পাশ থেকে মৃদু স্বরে হেসে উঠল হুরোতাস। আমি নিজেও এত ভালোভাবে সাজাতে পারতাম না সব কিছু।
আমার তা মনে হয় না, ফিসফিস করে জবাব দিলাম আমি। আমাদের কাছ থেকে কমপক্ষে তিন কিউবিট উজানে রয়েছে ওরা।
দূরত্বটা খুব বেশি নয়, সুন্দরী একটা মেয়ের দুই পায়ের মাঝখানের দূরত্বের সমান বলতে পারো, বলল হুরোতাস। এটুকু দূরত্ব মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই আমার।
ওদেরকে আরো একটু কাছে আসার সুযোগ দিলাম আমি। নৌকাগুলো আমাদের কাছাকাছি এগিয়ে এলো। তীরের কাছাকাছি আসতেই লাফ দিয়ে কোমর পানিতে নেমে পড়ল সামনের নৌকার লোকগুলো, তারপর নৌকাগুলোকে টেনে টেনে তীরের দিকে নিয়ে আসতে লাগল।
এইবার? হুরোতাসকে প্রশ্ন করলাম আমি।
এইবার! সম্মতি জানাল হুরোতাস। মুখের মধ্যে দুই আঙুল পুরে তীক্ষ্ণ একটা শিস বাজালাম আমি। এতক্ষণ ধনুকে তীর জুড়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের তীরন্দাজরা। আমার সংকেত শুনতে পেয়েই একসাথে তীর ছুড়ল তারা। রাতের বাতাস কেটে দিয়ে ছুটল তীরবৃষ্টি। তার পরেই শোনা গেল মানুষের দেহে তীর বিদ্ধ হওয়ার ভেতা আওয়াজ এবং আহতদের আর্তনাদ। এক এক করে পানিতে ডুবে যেতে লাগল তারা।
প্রলয় বয়ে গেল যেন উটেরিকের পাঠানো বাহিনীর ওপর দিয়ে। কয়েকটা নৌকা ঘুরে পালানোর চেষ্টা করল এবং ফলশ্রুতিতে ধাক্কা খেল পেছনের নৌকাগুলোর সাথে। এভাবে ডুবে গেল বেশ কয়েকটা নৌকা। বর্মের ভারে অসহায়ভাবে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগে চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ার জন্য খুব সামান্যই সময় পেল লোকগুলো। বাকিদের চিৎকার আরো প্রলম্বিত হলো, এবং আমাদের তীরন্দাজরা এক এক করে ঘায়েল করল তাদের।
এবার আমাদের দলের আরো কয়েকজন জুলন্ত মশাল হাতে সামনে এগিয়ে গেল, আগুন ধরিয়ে দিল নদীর তীরে স্তূপ করে রাখা শুকনো কাঠে। আজ বিকেলেই এগুলো কিছু দূর পরপর স্কুপ করে রেখেছিলাম আমরা। এক নিমেষে জ্বলে উঠল কাঠ, আগুনের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ। উটেরিকের বাহিনীর নৌকা এবং নৌকার আরোহীদের স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল সেই আলোতে। এতক্ষণ অন্ধকারের মাঝে তীর ছুড়ছিল আমাদের তীরন্দাজর ফলে প্রচুর তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এবার তাদের নিশানা হয়ে উঠল আরো নির্ভুল। পশ্চিম তীর থেকে যতগুলো নৌকা এসেছিল তার মাঝে অর্ধেকও ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেল না। যেগুলো ফিরে যেতে পারল সেগুলোর আরোহীদের অনেকেই নিহত হলো, বাকিরা হলো আহত।
এবার ধনুক সরিয়ে রেখে অগভীর পানিতে নেমে পড়ল আমাদের সৈন্যরা, কোমর থেকে খুলে নিল ছুরি। যারা আহত হয়েছিল তাদের ব্যবস্থা করা হলো এবার। মৃতদেহগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হলো স্রোতে আর না হয় বর্মের ওজনে নিজে থেকেই ডুবে গেল পানিতে।
আগামীকাল এই জায়গাতেই এক আনন্দঘন বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ করলাম আমরা। আহতদের গোঙানি আর আর্তনাদ এবং মৃতদেহের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠুক, এমনটা কারো ইচ্ছে নয়।
*
পরদিন দুপুর নাগাদ খণ্ডযুদ্ধের সব চিহ্ন ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলা হলো। নদীর তীরে পড়ে থাকা শুকনো রক্ত ঢেকে দেওয়া হলো বালি দিয়ে। নীলনদের স্রোতে ভেসে মৃতদেহগুলো সাগরের দিকে চলে গেছে। যারা বর্ম পরে ছিল তাদেরকে ওই বর্মের ওজনই টেনে নিয়ে গেছে নদীর গভীর অন্ধকার তলদেশে। সেখানে কুমির এবং নীলনদের অন্য বাসিন্দারা তাদের শেষকৃত্য সম্পাদন করবে।
আবু নাসকোসের দুর্গ-প্রাচীরের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত আমাদের শিবিরের চারপাশে অস্ত্রের দুর্ভেদ্য বলয় তৈরি করেছি আমরা। ঘোড়াগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের রথের সাথে এবং দশ হাজার সৈন্যের সবাই পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। পায়ের জুতো থেকে শুরু করে মাথার ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পর্যন্ত সম্ভাব্য সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রয়েছে সবাই।
বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান মঞ্চ পর্যন্ত কনেকে কারা এগিয়ে নিয়ে যাবে তা অবশেষে ঠিক করতে পেরেছে সেরেনা। ভালোবাসা এবং বিবাহের মিশরীয় দেবী আইসিস এবং ল্যাসিডিমনের দেবী আফ্রোদিতিকে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে এই মঞ্চ। প্রথমে প্রত্যেক মিত্র রাজার স্ত্রীদের মাঝ থেকে একজন করে মোট ষোলোজনকে বেছে নিতে চেয়েছিল ও। কিন্তু তাতে যেসব স্ত্রীরা বঞ্চিত হয়েছে তাদের মাঝে দারুণ কোন্দল লেগে গিয়েছিল। ফলে কনের সঙ্গীর সংখ্যা প্রথমে বত্রিশে এবং পরে আটচল্লিশে তুলে আনতে বাধ্য হয় সেরেনা ও রানি তেহুতি। এখন একমাত্র সান্ত্বনা এটাই যে, এই সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উপহারের পরিমাণও একই হারে বাড়বে। এই সমাধানে সেরেনাসহ সবাই খুশি হয়েছে। দেবীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত মঞ্চের সামনে স্থূপাকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে উপহারগুলো। তার পেছনে দাঁড়িয়েছে বাদকদের দল। পালাক্রমে একের পর এক রণসংগীতের বাজনা বাজাচ্ছে তারা, নীলনদের অপর তীরে অবস্থিত শত্রু শিবিরের উদ্দেশ্যে বিদ্রূপ করতে চাইছে যেন। একই সাথে আমাদের মিত্রদের সবার সাহসও উজ্জীবিত হয়ে উঠছে সেই বাজনায়।
দুপুরবেলা যত এগিয়ে এলো ততই চড়ায় উঠতে লাগল বাজনার সুর, দ্রুত হতে লাগল তাল। সেইসাথে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে তালে তালে ঢালের ওপর আঘাত করতে লাগল সৈন্যরা আর বজ্রের মতো আওয়াজ তুলল দশ হাজার কণ্ঠের সম্মিলিত সংগীত। তারপর নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে অটুট নীরবতা নেমে এলো চারদিকে। মনে হলো যেন সেই নীরবতার ভার সহ্য করতে না পেরে ফেটে যাবে সবার কানের পর্দা।
এবার দশ হাজার সৈন্যের দলটি নিঃশব্দে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেল। আর সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমাদের মিশরের নতুন শাসক ফারাও রামেসিসের দীর্ঘদেহী সুদর্শন অবয়ব। আইসিস এবং আফ্রোদিতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঞ্চে নিজের নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এলো সে। এগিয়ে যেতে যেতে একবার কনের তাঁবুর দিকে তাকাল সে, যেখানে সেরেনাকে আড়াল করে রেখেছে তার সঙ্গিনীরা, একই সাথে এক হাত উঁচু করে ইঙ্গিত দিল। সাথে সাথে শুরু হলো গান।
প্রথমে মনে হলো যেন শান্ত সাগরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এক ঝলক মৃদু গ্রীষ্মের গন্ধমাখা হাওয়া; এমন মৃদু স্বরে গাইতে শুরু করল সবাই। তারপর ধীরে ধীরে আনন্দের ছোঁয়া লাগল তাতে, ভালোবাসার প্রশস্তি শুরু হলো। এবার খুলে গেল মেয়েদের তাবুর দরজা। তার ভেতর থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে এলো রংধনুর পোশাক পরা মেয়েদের দুটো সারি। প্রতিটি সারিতে রয়েছে পঁচিশজন। সবার পা খালি, চুল বেঁধেছে রংবেরঙের ফিতে আর ফুল দিয়ে। হাসছে আর গান গাইছে তারা, একই সাথে লিয়ার, সিথারা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে হাততালি দিচ্ছে। ডান পাশের সারির নেতৃত্ব দিচ্ছে রানি তেহুতি, আর বাম পাশের সারির নেতৃত্বে রয়েছে তার বোন বেকাথা।
দুটো সারির মাঝখানে হাঁটছে এক পুরুষ ও দুই নারী। পুরুষটি আর কেউ নয় বরং রাজা হুরোতাস, পরনে স্বর্ণ এবং বহুমূল্য পাথরখচিত পোশাক। মুকুটে চুনির অলংকরণ, জুতোয় হীরা। বেগুনি সিল্কে তৈরি হয়েছে তার পোশাক, তার। ভেতরে বাদামি অলংকরণ। মুখে চওড়া হাসি এবং তা এতই প্রাণবন্ত যে, সেই হাসি দেখে উপস্থিত সবার মুখেও হাসি ফুটে উঠল।
তার ডান পাশে রয়েছে দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের এক নারী। লম্বায় হুরোতাসের কাঁধ সমান লম্বা হবে সে; কিন্তু মাথার ওপর থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে সোনার সুতোয় বোনা কাপড়ে। দুপুরের সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সেই আবরণ। কিন্তু চেহারা ঢাকা থাকলেও তার মাঝ থেকে এমন অপার্থিব কমনীয়তা আর ক্ষমতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে যে, উপস্থিত কেউই তার পরিচয় সম্পর্কে একটুও সন্দেহের অবকাশ পেল না।
দুই হাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল মিশরের ফারাও রামেসিস। রাজা হুরোতাস তার মেয়ের হাত ধরে ঘূর্ণিবায়ুর মতো ঘুরিয়ে দিল তাকে, ফলে সোনালি আবরণে ঢেউ তুলে রামেসিসের দিকে এগিয়ে গেল তার হবু স্ত্রী। রামেসিসের সামনে এসে শরীরের ঊর্ধ্বভাগ নত করে দণ্ডায়মান হলো সে। তার হাত ধরুল রামেসিস তারপর সোজা করে দাঁড় করাল। কনের মুখের সামনের আবরণটা আলতো করে ধরল সে, তারপর এক টানে সরিয়ে আনল। সবার সামনে। উন্মোচিত হলো রাজকুমারী সেরেনার শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য। মাথার সোনালি চুলগুলো মুক্তা আর স্ফটিক দিয়ে সাজানো হয়েছে তার বহু বর্ণের রেশমি পোশাক, যেন শরীরের প্রতিটি বাঁক আর অঙ্গের গঠনকে আরো প্রস্ফুটিত করে তুলেছে।
সেরেনা মানবী নাকি দেবী সে তর্কে যাব না; কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে, সেদিন উপস্থিত সবাই ওকে এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল তাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলে।
এবার নাচতে শুরু করল রামেসিস আর সেরেনা, তাদের সাথে নাচল বাকি সবাই। শুধু যখন সূর্য ডুবে আঁধার নেমে এলো তখনই কেবল নিজেদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করল বর আর কনে। তবে অনুষ্ঠানের আনন্দে কোনো কমতি হলো না, সারা রাত ধরে চলল তার উদযাপন।
*
তেহুতি আর বেকাথা- দুজনের সাথেই একবার করে নাচলাম আমি, তারপর সবার অলক্ষ্যে সরে এলাম আমার নিজের তাঁবুতে। হুরোতাসের বাগান থেকে তৈরি দারুণ মদে একটা চুমুকও দিইনি এবং স্বীকার করছি যে কাজটা করতে নিজের ইচ্ছাশক্তির সবটুকু ব্যবহার করতে হলো আমাকে।
সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে জাগলাম আমি, তারপর রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়টার সুযোগ নিয়ে চলে গেলাম নদীর কাছে। উৎসবের আনন্দে পাড় মাতাল হয়ে যেখানে-সেখানে পড়ে আছে সবাই, দেখে মনে হচ্ছে যেন ভয়াবহ কোনো যুদ্ধ শেষে পড়ে আছে নিহতদের মৃতদেহ। তাদের মাঝ দিয়েই পথ করে নিয়ে এগিয়ে যেতে হলো আমাকে। শুধু তারার আলোয় পথ চিনে নিয়ে এগিয়ে চললাম আমি। পরনে কেবল অন্ত বাস, ছোরাটা বেঁধে নিয়েছি খাপে। মাছের ছবি আঁকা টালিগুলো যে থলেতে ভরা ছিল সেটা ঝুলছে আমার গলায়। পানিতে নেমে পায়ে হেঁটে গলা পানি পর্যন্ত এগিয়ে এলাম আমি, তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। প্রথম দ্বীপের কাছে একবারও না থেমে পার হয়ে গেলাম, এগিয়ে চললাম দ্বিতীয় দ্বীপটার কাছে। যখন ভয় পেতে শুরু করেছি যে অন্ধকারে আবার পার হয়ে গেলাম কি এই সময় হঠাৎ করেই ভোরের প্রথম আলোয় আমার সামনে ফুটে উঠল দ্বীপটার অবয়ব। দ্বীপের ভাটির দিক দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি, যাতে স্রোতের অত্যাচার কিছুটা হলেও কম সহ্য করতে হয়।
এবার দ্বীপের গোড়া লক্ষ্য করে পানির নিচে ডুব দিলাম আমি, উদ্দেশ্য নদীর তলদেশ। ইতোমধ্যে বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে আকাশ, ফলে প্রথম দ্বীপের সাথে দ্বিতীয় দ্বীপটার তুলনা করার সুযোগ পাওয়া গেল। অবাক হয়ে দেখলাম, দুটো দ্বীপ প্রায় সব দিক দিয়েই একই রকম। একই আকৃতি, সামান্য তফাত যদি থাকে তাহলে তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে ধরার উপায় নেই। এখন আমি নিশ্চিত ধারণা করতে পারি যে এগুলো মানুষের হাতেই তৈরি, এবং এগুলোর নির্মাণকৌশলের পেছনে সম্ভবত একজন মানুষের মাথাই কাজ করেছে।
কাজটা নিশ্চয়ই প্রচুর সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ ছিল, এবং এ থেকে কোনো সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল বলেও মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যে দুটো দ্বীপ দেখেছি সেগুলোর কোনোটাই পানির ওপরে এত উঁচু নয় যে যোগাযোগের সংকেত পাঠানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে। সত্যি কথা বলতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মানুষের চোখ এড়ানোর জন্য যেন ইচ্ছে করেই নিচু করে তৈরি করা হয়েছে ওগুলোকে। এ ছাড়া নদীর এই জায়গাটা অনেক গভীর এবং স্রোতও প্রচণ্ড। এমন জায়গায় এই দ্বীপ তৈরি করাটা নিঃসন্দেহে সেই প্রাচীন জাতির জন্য দারুণ কঠিন একটা কাজ ছিল। এগুলো কোনো বাঁধের অংশ হতে পারে কি না সেটাও একবার ভেবে দেখলাম আমি। কিন্তু তেমন কোনো কাজের পক্ষে দ্বীপগুলোর মাঝের দূরত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া দুই তীরেও এমন কোনো চিহ্ন নেই, যা দেখে বোঝা যাতে পারে যে সেচ বা অন্য কোনো কাজের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ইতোমধ্যে যথেষ্ট আলো ফুটে উঠেছে আকাশে। সেই আলোতে দেখলাম দ্বীপের গায়ে হাত এবং পা রাখার জায়গা রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করে ওপরে ওঠা যায়। ওপরে উঠতে উঠতে আমি বুঝলাম এটা আসলে প্রথম দ্বীপের মতোই একটি গোলাকার স্তম্ভ, মাথাটা চ্যাপ্টা। কিন্তু প্রথম দ্বীপের মতো নষ্ট হয়ে যায়নি এর আকার-আকৃতি, অনেক অংশেই অবিকৃত আছে। ওপরে ওঠার পর দেখতে পেলাম মাটিতে এখনো পাথর খোদাই করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করার চিহ্ন রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় যে এগুলো দক্ষ হাতের কাজ, তবে কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে এসেছে অনেক জায়গায়। মাটি সরিয়ে পাথরের বাঁধাই খোলার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু প্রতিটা পাথর একেবারে নিখুঁতভাবে কাটা হয়েছে, দুই পাথরের মাঝখানে যে ফাঁক তা দিয়ে একটা চুলও গলবে কি না সন্দেহ। কাজটা করতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলো আমাকে। কয়েক ঘণ্টা ধরে পাথর সরানোর পর সবে কোমর পর্যন্ত গর্ত খুঁড়তে পারলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক হয়েছে। এবার ক্ষান্ত দেওয়া উচিত, অন্তত শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত কাজটা। জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে আমার আঙুলের নখ। নিজের হাত নিয়ে গর্ব করি আমি, নারীমহলেও নিজের হাতের যত্ন নেওয়ার জন্য সুনাম আছে আমার। মনে মনে ঠিক করলাম এটাই শেষ, এরপর আর একটা পাথরও সরাব না আমি। কিন্তু এই শেষ পাথরটার নিচে যে জিনিসটা দেখা গেল তা দেখে একেবারেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। এখনো জিনিসটার শুধু ওপরের দিক দেখা যাচ্ছে; কিন্তু তাতেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা একেবারেই আলাদা কিছু একটা। কাঁধের ওপর ঝুলে থাকা চামড়ার থলেটা খপ করে ধরে সামনে আনলাম আমি, তারপর ঈষৎ কাঁপা কাঁপা আঙুলে ভেতর থেকে বের করে আনলাম গানোর্ডের দেওয়া সেই পোড়ামাটির টালিটা। এইমাত্র বেরিয়ে আসা টালির ওপর রাখলাম ওটাকে। একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল দুটো টালি।
এবং সেই মুহূর্তেই কাজটা অন্য কারো হাতে, বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম আমি।
কোমরের খাপ থেকে ছুরিটা বের করলাম এবার, তারপর শত শত বছর ধরে পাথরের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকা টালিটাকে খুব সাবধানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত বের হয়ে এলো জিনিসটা।
এবার গর্ত থেকে বের হয়ে এসে নতুন টালিটাকে কোলের ওপর নিয়ে উবু হয়ে বসলাম। স্বীকার করছি যে বসার আগে একবার ভালো করে মাটির ওপরটা দেখে নিলাম আমি। বলা তো যায় না, এখানেও ইনানা দুষ্টুমি করে আরেকটা ধারালো টুকরো রেখে দিতে পারে। এবার মনোযোগ ফেরালাম নতুন টালিটার দিকে, অথবা বলা যেতে পারে যে নতুন পাওয়া প্রাচীন টালিটার দিকে।
আকার এবং আকৃতিতে এটা মাছের ছবি আঁকা টালির মতো হলেও অন্য সব দিক দিয়েই এটা একেবারেই আলাদা। মাছের টালিটা ছিল সবুজ রঙের সেখানে এটার রং গাঢ় নীল। এটার ওপর আঁকা রয়েছে কোনো একটা সামুদ্রিক পাখির ছবি, খুব সম্ভব পাফিন। তবে বলা যায় না, এমনকি উটপাখির ছবিও হতে পারে এটা। কীসের ছবি এঁকেছে সেটা পরিষ্কার করে বোঝাতে চায়নি শিল্পী। এ ছাড়া মাছের টালিটার গায়ে ছিল চারটি ছিদ্র সেখানে এই টালিটার গায়ে দেখা যাচ্ছে তিনটি।
ইতোমধ্যে দ্বীপ দুটোকে মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপ নামে ডাকব বলে ঠিক করেছি আমি। নদীর ওপারে আবু নাসকোস দুর্গের দিকে তাকালাম একবার। মনে মনে ভাবলাম বাকি দুটো দ্বীপকেও হয়তো এভাবে নামকরণ করেছিল প্রাচীন নির্মাতারা; হতে পারে সেটা কুমিরদ্বীপ এবং জলহস্তীদ্বীপ। ব্যাপারটা ভাবতে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে।
আবার পাথর খননের কাজে ফিরে গেলাম আমি। এবার আবিষ্কার করলাম প্রথম টালিটা যেখানে পাওয়া গেছে তার পর থেকে একই রকমের আরো টালির সারি নেমে গেছে নিচে। ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই ভাবিয়ে তুলল আমাকে, আরো কিছু পাওয়া যায় কি না দেখার জন্য নতুন উদ্যমে খুঁড়ে চললাম আমি। তবে সামান্য দূরত্ব যাওয়ার পরেই হঠাৎ বাধা পেতে হলো আমাকে। খুব সম্ভবত মাটির অভ্যন্তরীণ গঠনে কোনো একটা পরিবর্তন ঘটেছিল কখনো, সেটাই বদলে দিয়েছে টালির সারির গতিপথ। এর বেশি সামনে এগোনোর আর কোনো উপায় নেই।
এখন পর্যন্ত শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছি যে হাজার বছর আগে সেই রহস্যময় জাতির সদস্যরা মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপে দুটো সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল। কিন্তু এগুলো কতটা গভীর অথবা এই বিপুল পরিশ্রমের কাজ তারা কেন করেছিল সেটা জানার কোনো উপায় নেই আমার সামনে। আমার পায়ের নিচে যে সুড়ঙ্গটা রয়েছে তার মুখ কিছুটা নিচে গিয়েই ধস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে।
আচ্ছা, যদি কোনোভাবে মৎস্যদ্বীপ আর পক্ষীদ্বীপের মাঝে একটা সংযোগ থেকে থাকে? কথাটা আমি বলিনি, এমনকি চিন্তাও করিনি। সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম আমার কণ্ঠ ব্যবহার করে কথা বলে উঠেছে ইনানা। আমার সাথে দুষ্টুমি করতে সম্ভবত দারুণ মজা পায় সে।
ইনানার কথাটাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করলাম আমি। দুই দ্বীপের মধ্যে সংযোগ কেন থাকবে? মানুষ যে পানির নিচে খুব বেশি সময় থাকতে পারে না তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। নীলনদ ছাড়াও অনেক জলাশয়ের গভীরে ডুব দিয়েছি আমি; কিন্তু কোনো জায়গাতেই খুব বেশি সময় দম রাখতে পারিনি।
মৎস্যদ্বীপের দিকে তাকিয়ে দুই দ্বীপের মাঝে দূরত্বটা খালি চোখে মাপার চেষ্টা করলাম এবার। মাত্র একবার দম নিয়ে এই দূরত্বের দশ ভাগের এক ভাগ পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা করতেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো আমার হাত-পা। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম আমি, উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলাম একবার; কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সম্পূর্ণ নিরেট আমার পায়ের নিচের মাটি, ভেতরে কিছু থাকলেও তা ওপর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
এমন কি হতে পারে যে দুই দ্বীপের মাঝে খরগোশের গর্তের মতো কোনো সুড়ঙ্গপথ আছে? আনমনে বলে উঠলাম একবার এবং মাথা নাড়লাম প্রায়। সাথে সাথেই। পানি সর্বদা তার জায়গা খুঁজে নেয়। খুব ছোটবেলাতেই এই কথাটাকে ধ্রুব সত্য হিসেবে জেনে গিয়েছিলাম আমি। মাটির যেকোনো সাধারণ গর্তের মতোই খরগোশের গর্তও পানিতে ভর্তি হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।
কিন্তু কোথাও একটা জিনিস ভুল হচ্ছে আমার বুঝতে পারছি সেটা। ব্যাপারটা নিয়ে আবার নতুন করে চিন্তা করতে বসলাম। আমি যখন নীলনদের তলায় ডুব দিই তখন আমার ফুসফুঁসে পানি ঢোকে না কেন?
কারণ আমি দম বন্ধ করে রাখি, ফলে আমার ফুসফুঁসের প্রবেশপথও বন্ধ হয়ে যায়।
তার মানে সুড়ঙ্গের দেয়াল যদি পানিরোধী হয় এবং প্রবেশপথগুলো হয় পানির ওপরে তাহলে ওই সেই সুড়ঙ্গও পানিরোধী হয়ে যাবে। কোনোভাবেই ভেতরে পানি ঢুকতে পারবে না।
হ্যাঁ, কিন্তু সমস্যাটা তো ওখানেই! সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলো তো পানিরোধী নয়। মাটি দিয়ে তৈরি সেটা এবং মাটির ভেতর সহজেই পানি প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু প্রাচীনরা যদি এমন একটা পানিরোধী বস্তু আবিষ্কার করে থাকে যেটা দিয়ে সুড়ঙ্গের দেয়ালে আস্তরণ তৈরি করা যায় তাহলে তাদের পক্ষে পানির নিচ দিয়ে চলাচল করা কোনো ব্যাপারই ছিল না। এই কথাগুলো উচ্চারিত হলো ইনানার মিষ্টি মায়াবী কণ্ঠস্বরে। মুখ তুলে তাকাতেই আমার সামনে একটা গাছের সাথে আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাকে। বরাবরের মতোই আকাশকুসুম যুক্তি তৈরি করেছে সে; কিন্তু এটাও ঠিক যে একটু ঘুরপথে হলেও সত্যের কাছাকাছি আসতে পেরেছি আমি।
তার পরেই মৃদু হাসল ইনানা। বলল, গানোর্ড তোমাকে বলেছিল যে ওরা জাদুবিদ্যার সাহায্যে পার হতো নদী। কিন্তু ভুল করেছে সে। স্বাভাবিক বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো কিছুরই সাহায্য নেয়নি প্রাচীনরা। এবং আমি জানি সেই একই জিনিসটা তুমিও কাজে লাগাবে। এই কথা বলেই গাছের গায়ে হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, তারপর দ্বীপের কিনারার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর এক পা বাড়িয়ে পড়ে গেল কিনার থেকে। শুকনো পাতার মতো হালকাভাবে ভাসতে ভাসতে নিচে নামল তার শরীরটা। দেখলাম ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সে আর নদীর বুক থেকে রুপালি কুয়াশার মতো বাষ্প উঠে এসে ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে তাকে।
*
আজ এখানে সমবেত হওয়ার পর তোমাদের সবাইকে প্রথমেই আমি আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। তার কারণ, একের অপমান মানে সবার অপমান-এই মর্মে তোমরা যে শপথ নিয়েছিলে তা পালন করতে কেউ পিছিয়ে যাওনি। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এক অত্যাচারী স্বৈরাচারকে উৎখাত করা, যে ফারাওদের ন্যায্য সিংহাসনকে দখল করে রেখেছে… নীলনদের পুব তীরে আবু নাসকোসের উল্টো দিকে সবুজ ঘাসে ঢাকা এক টুকরো মাঠে দাঁড়িয়ে বিদেশি রাজাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছে হুরোতাস।
রাজাদের প্রত্যেকেই পরে আছে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজ। তাদের পেছনে। সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সৈন্যরা, সব মিলিয়ে যাদের সংখ্যা দশ হাজার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা, মনে হচ্ছে যেন শেষ নেই তাদের। প্রত্যেকের ঢাল পরস্পরের সাথে স্পর্শ করে থাকা অবস্থায় ধরে রেখেছে সামনে, শিরস্ত্রাণের নিচে কঠোর চেহারা সবার। ঢালের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে রোদ। ধনুকে এখনো ছিলা পরানো হয়নি; কিন্তু দুই কাঁধে ঝুলছে তীরভর্তি তূণ।
নীলনদের তীরে সৈন্যদের ঠিক পেছনেই নোঙর করে রাখা আছে তাদের নৌবহর। নোঙর ফেলেছে ঠিকই কিন্তু নাবিকরা সবাই পুরোদস্তুর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, আসন্ন যুদ্ধে যার যার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা উপহার দিতে কেউ পিছপা হবে না।
ভাষণ শেষ করে উপস্থিত বাদকদের দিকে তাকাল হুরোতাস, তারপর তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তলোয়ার উঁচু করল। তার ইশারা পেয়ে একযোগে ঢাকের কাঠি ঠোঁটের সামনে তুলল বাদকরা। এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করল হুরোতাস, তারপর তলোয়ার দিয়ে একবার ডানে একবার বামে বাতাস কাটল। ঝড়ের মতো আওয়াজ তুলল বাদকদের ঢাক। অস্ত্রধারী সৈন্যরা এবার সারি ধরে এগোতে শুরু করল অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোর দিকে। এই জাহাজগুলোই তাদের নিয়ে যাবে নদীর অপর তীরে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে হয় মৃত্যু অথবা বীরের সম্মান।
পুরো ব্যাপারটা সামলানো অত্যন্ত জটিল এবং বিপদসংকুল একটা কাজ। আমরা ঠিক করেছি যে নৌবহরের সাহায্যে রথ, ঘোড়া এবং সৈন্যদের নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হবে নীলের অপর তীরে। উটেরিকের সৈন্যরা ওই এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছে। আবু নাসকোসের দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য দুর্গ এই আফ্রিকা মহাদেশেই দ্বিতীয়টা আছে কি না সন্দেহ, মিশরে তো অবশ্যই নেই। আমাদের এটাও জানা আছে যে, হুরোতাস আর তার মিত্ররা যখন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে রওনা দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে সেই অবসরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছে উটেরিক। এবং এটাও জানা গেছে। যে, মিশরের পুব সীমান্তের ওপাশে এবং তারও অনেক দূরের অনেক শক্তিশালী সব দেশের সাহায্য পেয়েছে সে।
উটেরিকের এই মিত্রদের মাঝে রয়েছে পারসিয়া, মেদিয়া ইত্যাদি দেশ এবং আরো প্রায় পঞ্চাশটার মতো উপজাতি ও গোত্র। এরা সবাই দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং যোদ্ধা বলে যথেষ্ট সুনাম রাখে। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, বাস্তব এবং সুনামের মাঝে তফাতটা অনেক ক্ষেত্রেই বড় বেশি হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া আবু নাসকোস থেকে ল্যাসিডিমন যত দূরে তার চাইতে অনেক বেশি দূরত্বে অবস্থিত পারসিয়া এবং মেদিয়া।
তার পরও সাবধানের মার নেই ভেবে পুরোদমে আক্রমণ চালানোর আগে নীলের পশ্চিম তীরে কয়েকটা ছোট ছোট হামলা চালানোর জন্য হুরোতাস এবং হুইকে রাজি করালাম আমি। এতে ওদের ক্ষমতার প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে। এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, আমাদের রথগুলো উটেরিকের রথের চাইতে শক্তিশালী এবং আবু নাসকোস দুর্গ থেকে উজানে কোনো একটা জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করার জন্য ওগুলোকে ব্যবহার করতে পারব আমরা। আর একবার এমন একটা ঘাঁটি তৈরি করতে পারলে সেখান থেকেই ঘিরে ফেলা যাবে পুরো শহরটাকে। তখন তাদের ওপর অবরোধ আরোপ করতে পারব আমরা।
পরবর্তী পাঁচ দিন ধরে নদীর উজান-ভাটি ধরে যাওয়া-আসা করল আমাদের জাহাজগুলো, ভাব দেখাল যেন যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করবে। কয়েকটা জাহাজে অস্ত্রধারী সৈন্যদের মোতায়েন করা হলেও বেশির ভাগ জাহাজেই কাঠের মূর্তি এবং কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করা হলো বিভিন্ন জায়গায়। আমাদের জাহাজগুলোকে তীর থেকে অনুসরণ করতে লাগল উটেরিকের রথ বাহিনী, আর পদাতিক সৈন্যের দল জাহাজ থেকে তাদের চলার পথে ধুলো উড়তে দেখলাম আমরা। এভাবেই খুব সতর্কতার সাথে মেপে নিলাম তাদের আনুমানিক সৈন্য এবং রথের সংখ্যা। যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি ওরা সংখ্যায়।
*
ষষ্ঠ দিন ভোরবেলা নদীর ভাটি ধরে বড় একটা সেনাদলকে পাঠানো হলো শত্রুর চোখে ধূলো দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আর আমি এবং হুরোতাস আমাদের শ্রেষ্ঠ রথ এবং চালকদের নিয়ে ছোট একটা বাহিনী সাজিয়ে চলে এলাম উল্টো দিকে প্রায় পাঁচ লিগ দূরত্বে। গত কয়েক দিন নদীর বুকে চলাফেরা করার সময় খুব সতর্কতার সাথে সব দিক বিবেচনা করেছি আমরা, তারপর আবু নাসকোস থেকে দশ মাইল দূরত্বে নীলনদের পশ্চিম তীরে একটা জায়গা বেছে নিয়েছি অবতরণের জন্য। এখানে জঙ্গল থেকে একটা ছোট স্রোতস্বিনী বের হয়ে এসে মিশে গেছে নীলনদের সাথে। নদীটার তলদেশ পাথরে ভরা, ফলে রথের চাকা দেবে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। রথগুলোকে ছোট নদীটায় নামিয়ে দিতে পারব আমরা, তারপর জাহাজ থেকে নেমে সেগুলোকে ডাঙায় তুলে নেওয়া যাবে আবার।
আমাদের পেছনে দিগন্তে সূর্য উঠল একসময়। আমরা তখন বহরের মাঝ থেকে দুটো জাহাজকে পশ্চিম তীরের বালির ওপর তুলে রাখতে ব্যস্ত। আমাদের প্রতিটি জাহাজে রয়েছে চারটি করে রথ, ঘোড়াগুলোকে বেঁধে রাখা হয়েছে সেগুলোর সাথে। রথচালকরা লাগাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রথের ওপর। জাহাজের মাথা থেকে পাটাতন নামিয়ে দিতেই তার ওপর দিয়ে নেমে গেল রথগুলো। অগভীর নদীর মাঝ দিয়ে রথগুলোকে টেনে নিয়ে গেল ঘোড়ার দল। প্রথম রথে রয়েছে হুরোতাস। সারিতে মোট আটটা রথ, সবার শেষ রথটায় রয়েছি আমি। আমাদের দলের সবার কাছেই রয়েছে দুই দিক বাঁকানো ধনুক, যেকোনো মুহূর্তে বিপদের মোকাবিলা করার জন্য সবগুলোতেই ছিলা পরিয়ে রাখা হয়েছে। সেইসাথে প্রস্তুত রয়েছে কুঠার আর তলোয়ারও। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল শত্রুপক্ষের হালহকিকত পরিদর্শন করা। দরকার হলে উটেরিকের সৈন্যদের মুখোমুখি হব আমরা, তারপর তাদের শক্তি এবং সংখ্যার আন্দাজ নেওয়ার চেষ্টা করব। এর মধ্যে আমাদের দলের বাকি জাহাজগুলো নদীতে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করবে আমাদের ফেরার। তীরে থাকা অবস্থায় যদি কোনো কারণে দ্রুত পালানোর দরকার হয় সে জন্য যেকোনো মুহূর্তে জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে তারা।
এখন পর্যন্ত উটেরিকের সৈন্যদের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কাছাকাছি দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে আমাদের রথগুলো। হুরোতাসের নেতৃত্বে ঘাসের মাঝ দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাওয়া পথটা ধরে চলতে শুরু করলাম আমরা।
জঙ্গলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায়, এই সময় হঠাৎ ভয়ংকর এক শব্দ ভেসে এলো আমাদের কানে। শব্দটা সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার কাছে, এমন শব্দ আগে কখনো শুনিনি আমি। তবে ধারণা করলাম যে শব্দটা সম্ভবত অনেকগুলো ট্রাম্পেট একসাথে বাজিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সাথে সাথে একটা মুঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ধরল হুরোতাস, অগ্রগতি বন্ধ করার সংকেত। ওদিকে আমাদের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে লাফালাফি শুরু করেছে, ঘাড় মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে লাগাম। রথের চালকরা সবাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে অবাক চোখে, কেউ জানে না যে এই অদ্ভুত শব্দ কোথা থেকে ভেসে এলো।
শব্দটা আর শোনা গেল না ঠিকই; কিন্তু তার জায়গা দখল করল ঘোড়ার খুর আর চাকার গর্জন। এত জোরালো শব্দ, মনে হলো যেন এক শ রথ পুরোদমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। কাউকে কিছু বলতে হলো না, আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এক সারিতে দাঁড়িয়ে গেল সবাই।
কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মাত্র রথ, যদিও এমন রথ আমরা কেউই আগে কখনো দেখিনি। সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে রথটা, এবং তার উদ্দেশ্য যে মোটেও শুভ নয় সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি মাথা খাটাতে হয় না। আমাদের রথের চাইতে এই রথটা প্রায় দ্বিগুণ হবে চওড়ায়, দেড় গুণ উঁচু। আমাদের রথগুলোর চাকা যেখানে মোটে এক জোড়া সেখানে এই রথটার প্রতি পাশে চারটি করে চাকা অর্থাৎ মোট আটটা চাকা রয়েছে।
আমাদের রথের চাকাগুলো তৈরি হয়েছে শক্ত কাঠের সাহায্যে, প্রতিটায় ছয়টা করে ভারী শিক লাগানো। আর শত্রু রথের চাকাগুলোতে কোনো শিক নেই, স্রেফ রুপালি রঙের এক অচেনা ধাতুর তৈরি এক একটা চাকতি। চাকার ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে প্রায় এক হাত লম্বা একটা ধারালো ফলা। এটা ছাড়াও প্রতিটা চাকার পরিধি জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসানো রয়েছে আরো চারটি ফলা, সবগুলোই ঘুরছে বন বন করে। যদিও এই জিনিস আগে দেখিনি আমি কিন্তু এটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হলো না যে, ওই ফলার সংস্পর্শে যা কিছু আসবে সব কিছুই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমাদের রথের চাকাগুলোর কী অবস্থা হবে ভেবে শিউরে উঠলাম আমি।
আমাদের রথগুলো টানতে দরকার হয় তিনটি করে ঘোড়া। পক্ষান্তরে শত্রু রথের সামনে জোড়া রয়েছে আটটা বিশাল ঘোড়া, সবগুলো চকচকে কালো রঙের। প্রত্যেকটা ঘোড়া আমাদের ঘোড়াগুলোর চাইতে কমপক্ষে এক হাত উঁচু। এবং প্রতিটার কপালের ঠিক মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে একটা করে লম্বা, কালো, প্যাচানো শিং। তালে তালে পা ফেলে দৌড়ে আসছে ঘোড়াগুলো, একই সাথে নাকের বিস্ফারিত ফুটো থেকে বেরিয়ে আসছে গরম বাষ্প।
আমাদের রথগুলোতে সব মিলিয়ে তিনজন লোক দাঁড়াতে পারে, একজন চালক এবং দুজন তীরন্দাজ। ওদিকে শত্রু রথের যাত্রী বলতে কেবল চালক। পেছন দিকে হেলে পড়ে ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে রেখেছে সে, সরাসরি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
এমন বিশালদেহী লোক এর আগে খুব কমই দেখেছি আমি। শরীরে খুবই সাধারণ চেহারার একটা বর্ম পরে আছে সে; গলার নিচ থেকে পালিশ করা রুপোর আবরণ। নিঃসন্দেহে শত্রুর তীরকে প্রতিহত করার জন্য পরেছে সেটা। হাতে কোনো অস্ত্র নেই, তবে পাশে রাখা রয়েছে একটা ছিলাবিহীন ধনুক আর একটা চওড়া তলোয়ার। রথের লাগাম ছাড়া আর কিছুই নেই তার হাতে। তবে তার শিরস্ত্রাণটা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। কেবল তার মাথা এবং মুখের ডান পাশ ঢেকে রেখেছে সেটা। চকচকে ধাতুর মাঝে একটা সরু ফুটোর ভেতর দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তার ডান চোখ।
তবে তার মুখের বাম পাশটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, এবং বীভৎস দেখতে। অজস্র ক্ষত আর কাটা দাগে ভর্তি তার মুখের এই দিকটা। ঠোঁটগুলো ফুলে আছে, বেঁকে গেছে নিচের দিকে। চোখের পাতা ঝুলে পড়েছে; কিন্তু তার ওপাশে বিচ্ছুরিত হওয়া খুনে দৃষ্টি বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।
শত্রুর রথ এবং আমাদের মাঝে দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে, এই অবস্থাতেই ডান হাতের নিচে আটকানো তূণ থেকে একটা তীর বের করে ধনুকে জুড়ে ফেললাম আমি। তারপর এক টানে তীরের লেজটা টেনে ধরে নিয়ে এলাম আমার ঠোঁটের কাছে। মুহূর্তের এক শ ভাগের এক ভাগ সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করেই ছেড়ে দিলাম তীরটা। দেখলাম ঝাপসা একটা আকৃতি নিয়ে সামান্য দূরত্বটুকু পেরিয়ে গেল তীর, সরাসরি ছুটছে ক্ষতবিক্ষত চেহারাটার বাম চোখ লক্ষ্য করে।
বাঁচার কোনো উপায় নেই লোকটার, নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম আমি। কল্পনার চোখে দেখলাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার ভেতর একেবারে পালক পর্যন্ত সেঁধিয়ে গেছে তীরটা। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেলল লোকটা। তীরের মাথাটা তার শিরস্ত্রাণে ঘষা খেয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মাঝে, একটু আগে যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে রথটা।
এমন আক্রমণের পরেও এমনকি একবার চোখের পলকও ফেলল না রথের চালক। বরং আমাদের সারির ঠিক সামনে দাঁড়ানো হুরোতাসের ওপর পুরো মনোযোগ পুঞ্জীভূত করল সে, নিশ্চয়ই হুরোতাসের চোখ ধাঁধানো শিরস্ত্রাণ আর বর্ম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কালো ইউনিকনগুলোকে সরাসরি হুরোতাসের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেল সে। শেষ মুহূর্তে সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করল হুরোতাস, নিজের ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে জোরে টান দিল। ফলে সরাসরি সংঘর্ষের বদলে কোনাকুনি তার রথকে আঘাত করল আগন্তুক আক্রমণকারীর রথ। বন বন করে ঘুরতে থাকা ছুরিগুলো হুরোতাসের রথের একটা পাশ সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিল, একই সাথে রক্ত আর হাড়ের মেঘে পরিণত করল ঘোড়াগুলোর এক পাশের পাগুলোকে। আর্তচিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল প্রাণীগুলো। রথের চাকাগুলোও ছুরির সামনে পড়ায় একই দশা হলো তাদের, গুড়ো হয়ে গেল স্রেফ। উল্টে গেল রথটা, উড়ে গিয়ে অন্য পাশে পড়ল হুরোতাস আর তার দুই সঙ্গী। মাটিতে পড়ার সময় হাত থেকে অস্ত্র ছুটে গেল তাদের।
এবার কালো ইউনিকর্নগুলো আমাদের সারির বাম পাশটা লক্ষ্য করে ধেয়ে এলো এবং একের পর এক রথের চাকাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করল। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল রথ এবং সেগুলোর আরোহী। কপাল ভালো আমার, ডান পাশে দাঁড়ানো চারটি রথের একটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, ফলে আমার রথের চাকা ভেঙে দেওয়ার কোনো সুযোগ পেল না আগন্তুক। তবে আরো একটা তীর ধনুকে জুড়লাম আমি, তারপর ছুঁড়ে দিলাম আক্রমণকারীর শিরস্ত্রাণের খোলা অংশ লক্ষ্য করে। সে সময় আমার কাছ থেকে মাত্র দশ কিউবিট দূরে ছিল সে, দুটো রথের প্রস্থের সমান। এত দ্রুত ছুটে গেল আমার তীর যে চোখ দিয়ে অনুসরণ করা গেল না। কিন্তু তীরটা শরীরে বেঁধার ঠিক আগ মুহূর্তে লোহার জাল দিয়ে ঢাকা একটা হাত ওপরে তুলল লোকটা, তারপর এমনভাবে সেটাকে সরিয়ে দিল যেন মাছি তাড়াচ্ছে। মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য আধবোজা চোখের দৃষ্টিটা স্থির হলো আমার ওপর। জীবনে ওই ভয়ানক দৃষ্টির কথা ভুলব না আমি। তার পরেই আমার সামনে থেকে সরে গেল তার রথ।
গুঁড়ো হয়ে যাওয়া রথের ওপর থেকে ছিটকে পড়েছিল হুরোতাস, এখন আমার সামনেই পড়ে আছে সে। এবার আমার রথের চালকের কাছ থেকে লাগাম ছিনিয়ে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে হুরোতাস; কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে পতনের ফলে যে চোট পেয়েছে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শিরস্ত্রাণ এবং অস্ত্র- সবই হারিয়েছে সে, টলছে মাতালের মতো। মুখের একটা পাশ ফুলে উঠেছে, ময়লা আর ধুলো লেগে আছে সেখানে।
জারাস! তার আগের নাম ধরে ডাক দিলাম আমি। যেমনটা ভেবেছিলাম, সত্যিই কাজ হলো। রথ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল হুরোতাস।
হাতটা দাও! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। যখন আমাদের বয়স আরো কম ছিল তখন এই বিশেষ কাজটা প্রায়ই অনুশীলন করতাম আমরা। সোজা হয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল হুরোতাস, ডান হাত কোমরে রেখে একটা আংটার মতো তৈরি করল। কিন্তু এখনো অল্প অল্প টলছে তার শরীর।
বাম হাতে লাগামে ঝাঁকি দিয়ে রথের তিনটি ঘোড়াকে সামনে এগোতে নির্দেশ দিলাম আমি, ওদিকে নিজে ঝুঁকে পড়েছি রথের ডান পাশে। দ্রুত হুরোতাসের দিকে এগিয়ে গেল আমার রথ। একেবারে শেষ মুহূর্তে রথের মোড় ঘুরিয়ে নিলাম আমি, ফলে ডান পাশে থাকা ঘোড়াটা ঘষা খেল ওর গায়ে। আমার এবং হুরোতাসের অবস্থান পাশাপাশি আসতেই ডান হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাতে তৈরি হওয়া আংটার মাঝে আটকে ফেললাম। ফলে প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি খেতে হলো আমাকে, আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলাম রথ থেকে। তবে কোনোমতে সামলে নিতে পারলাম শেষ পর্যন্ত এবং এক টানে হুরোতাসকে এনে ফেললাম রথের ওপর।
এখন এক হাতে হুরোতাসকে সামলাতে হচ্ছে আমার, কারণ এখনো মাতালের মতো টলছে সে। আর অন্য হাত ব্যবহার করছি রথ চালানোর জন্য। এক ঝলক চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম, যে নৌকাগুলো আমাদের তীরে নামিয়ে দিয়েছিল তার আরোহীরা আমাদের বিপদ বুঝতে পেরেছে। আমাদের তুলে নেওয়ার জন্য আবার তীরের দিকে ফিরে আসছে তারা। তবে এখন স্রোতের বিপরীতে এগোতে হচ্ছে তাদের, ফলে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে এগোনো সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। তার ওপরে বিশালদেহী মানুষ হুরোতাস, স্বাভাবিকভাবেই আমার রথের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে সে। তা ছাড়া নদীর কিনারার যত কাছাকাছি যাচ্ছি ততই নরম হয়ে আসছে রথের চাকার নিচের মাটি, ফলে ক্রমেই তাতে দেবে যাচ্ছে চাকা।
কাঁধের ওপর দিয়ে একবার পেছনে তাকালাম আমি, দেখতে চাইছি যে আমাদের বিশালদেহী শত্রু আর তার শিংঅলা দানবগুলো কী করছে। খুব বেশি দূরে তাকাতে হলো না আমাকে। ঘুরন্ত ছুরির ঘায়ে আমাদের অর্ধেক রথের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সে, এবার মনোযোগ স্থির করেছে আমার রথের ওপর। বুঝতে পারলাম হুরোতাস যে এই রথের যাত্রী হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে সে, এবং খুব সম্ভব আমার পরিচয়ও খুব ভালো করেই জানে। বাকি সবাই যখন আমার সম্মান এবং অবস্থান সম্পর্কে খবর রাখে তাহলে এই লোকটাই বা কেন রাখবে না… কিন্তু তার পরিচয়টা কী?
কাছাকাছি চলে এসেছে লোকটার রথ, এবং দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনছে আরো। প্রতি পদক্ষেপে যেন আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে রথের সাথে জোড়া ঘোড়াগুলো। ওদের মাথায় যে ভয়ানক শিংগুলো রয়েছে সেগুলোর সাহায্যে কতটা ক্ষতি করতে পারে তা নিজের চোখেই দেখেছি আমি। তবে নীলনদের তীর এখন আর দুই শ কদমও দূরে নেই আমাদের কাছ থেকে, এবং গভীর পানিতে প্রবহমান স্রোতের বাধা থেকে অবশেষে মুক্ত হতে পেরেছে উদ্ধারকারী নৌকাগুলো। দ্রুত তীরের দিকে এগিয়ে আসছে তারা।
দাগীমুখো লোকটার দিকে তীর ছুঁড়ে যে কোনো লাভ নেই সেটা খুব ভালো করেই বুঝে গেছি আমি। কিন্তু ওর রথ টানছে যে অদ্ভুত প্রাণীগুলো, ওরাও কি একই রকম অভেদ্য? মনে হয় না। রথের লাগামটা হুরোতাসের হাতে ধরিয়ে দিলাম আমি, যদিও এখনো নিজেকে সম্পূর্ণ সামলে উঠতে পারেনি সে। তারপর রথের পাশ থেকে ধনুক তুলে নিয়ে একটা তীর জুড়লাম তাতে। ইউনিকনগুলো একেবারে কাছে চলে এসেছে আমাদের, সেগুলোর মধ্যে ঠিক মাঝখানের প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে ছেড়ে দিলাম তীর।
যদিও তীব্র গতির কারণে দারুণভাবে ঝাঁকি খাচ্ছিল আমার রথ, তবু লক্ষ্য ব্যর্থ হলো না আমার। সরাসরি প্রাণীটার বিশাল বুকের ঠিক মাঝখানে গিয়ে লাগল তীর, একেবারে পালক পর্যন্ত ঢুকে গেল ভেতরে। বুঝতে পারলাম হৃৎপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ওটার। কিন্তু তার পরও সামান্যতম হোঁচট খাওয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা গেল না দানবটার মাঝে, গতি কমে আসা তো দূরের কথা। এবং এবার প্রচণ্ড আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, দাগীমুখো ওই রথচালক আর তার পোষা দানবের দলের আগমন ঘটেছে আসলে অন্য কোনো পৃথিবী থেকে। অন্ধকার দেবতাদের পাঠানো প্রতিনিধি ওরা।
এই চিন্তাটা মাথায় আসার পর মুহূর্তেই দাগীমুখো তার ইউনিকর্নের দলটাকে সরাসরি আমার রথ লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। অসংখ্য টুকরোতে ভেঙে গেল বাম দিকের চাকাটা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া পা থেকে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আমার রথের ঘোড়াগুলো কাতর স্বরে আর্তনাদ করে উঠল। তবে ঠিক একই মুহূর্তে নদীর তীরে পৌঁছে গেছি আমরা। আঘাতের ফলে গুলতি থেকে ছোঁড়া পাথরের মতো উড়ে গিয়ে পড়লাম আমরা দুজন। নীলনদের ঘোলাটে পানি যেন গিলে নিল আমাদের, সাথে সাথে এক দফা নাকানি-চুবানি খেয়ে ভেসে উঠলাম আবার।
নৌকাগুলো এগিয়ে আসছে আমাদের সাহায্য করার জন্য। কিনার থেকে মাত্র বিশ কদমের মতো দূরে রয়েছে তারা; কিন্তু পাগলের মতো দাঁড় বাইছে, একই সাথে চিৎকার করে আমাদের বলছে সাঁতার কেটে সরে আসতে। হুরোতাসকে। পানির ওপর ভেসে থাকতে সাহায্য করলাম আমি, একই সাথে টেনে নিয়ে তীর থেক দূরে সরে যেতে শুরু করলাম। আমাদের দুজনের পরনেই বর্ম থাকায় অনেক কঠিন হয়ে গেল কাজটা। তা ছাড়া হুরোতাস এখনো সম্বিৎ ফিরে পায়নি। তবে প্রথম নৌকাটার কাছে পৌঁছে যেতে পারলাম সহজেই। সাথে সাথে বেশ কয়েক জোড়া হাত নেমে এলো আমাদের নৌকায় তুলে নিতে। দ্রুত একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ইউনিকর্নের দল নিয়ে নদীর কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের শত্রু। হঠাৎ করে থেমে যেতে হওয়ায় ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসছে ঘোড়াগুলো, খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। পাশ থেকে ধনুকটা তুলে নিয়েছে দাগীমুখো এখন অভ্যস্ত সাবলীলতার সাথে বিশাল অস্ত্রটাকে বাঁকিয়ে ছিলা পরাচ্ছে।
কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে পিঠ থেকে ব্রোঞ্জের ঢালটা খুলে আনলাম আমি, তারপর আমার এবং হুরোতাসের সামনে ধরলাম সেটাকে। উদ্দেশ্য আসন্ন ঝড় থেকে নিজেদের কিছুটা হলেও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। নৌকার ওপর বসে থাকা আমাদের দিকে একবার তাকাল দাগীমুখো, তারপর ধনুকটা উঁচু করে ধরল। একটা তীর জুড়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে, এবার টেনে সেটাকে পিছিয়ে আনল সে।
মুখে হাসি ফুটেছে তার এবং এই প্রথমবারের মতো কোনো আবেগের চিহ্ন দেখলাম তার চেহারায়। ভয়ংকর বাঁকা হাসিটা ধরে রেখেই তীর ছুড়ল সে। তীরের লক্ষ্যটা আমার দিকেই ছিল; কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার জন্য আগেই প্রস্তুত হয়ে গেছি আমি। ঢালটা সামনে তুলে ধরে হুরোতাস এবং আমাকে আড়াল করার ব্যবস্থা করলাম সাথে সাথে। সম্পূর্ণ সোজা না করে ধরে একটু কাত করে ধরেছি ঢালটা। যদিও শক্ত সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি আমার এই ঢাল, কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নই আমি। এভাবে কাত করে ধরার ফলে তীরটা ঢাল ভেদ করে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাবে না, বরং পিছলে বেরিয়ে যাবে। তীক্ষ্ণ ধাতব আওয়াজের সাথে ঢালের ওপর আঘাত হানল তীর, ধাক্কা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে। পেছনের নৌকার খোলে গিয়ে লাগল তীরটা। হুরোতাসকে টেনে নৌকার খোলের ভেতর নামিয়ে আনলাম আমি, খেয়াল রাখলাম যেন মাথা ওপরে তোলার সুযোগ না পায় সে। এখানে অন্তত নদীর কিনারে দাঁড়ানো তীরন্দাজের হাত থেকে আমরা নিরাপদ। তবে বাকিদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন হলো না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল দাগীমুখোর তীরের আঘাতে আহত এবং নিহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকারে।
শক্ত হও, জারাস। হুরোতাসকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওর মুখে থাপ্পড় মারলাম আমি। নৌকাটাকে ওই পারে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করো আমাকে। কিন্তু মহান জিউসের দোহাই, খোলের ওপর মাথা তোলার চেষ্টা কোরো না। অবশ্য যদি চোখ বরাবর একটা তীর খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে আলাদা কথা।
প্রাণপণে বৈঠা মেরে নৌকাটাকে মাঝ নদীতে নিয়ে এলাম আমরা, তারপর অবশেষে কমে এলো নৌকার ওপর চলমান তাণ্ডব। এবার মনে হলো যে একটু উঁকি মেরে দেখা যায় পরিস্থিতি কেমন দাঁড়িয়েছে। আশা করা যায় এই দূরত্বে এমনকি দাগীমুখোর শক্তিশালী ধনুকও তীর ছুঁড়তে পারবে না। খালের ওপর সাবধানে মুখ বের করে দেখলাম, যে তীর থেকে পালিয়ে এলাম আমরা সেখানে এখন সত্যিই কেউ নেই। শুধু আমাদের মৃত সৈন্যদের লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দাগীমুখো আর তার ইউনিকনগুলো জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আবার। জারাস আর আমি মিলে যে নৌকাটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তার ভেতরেও আরো পাঁচটা মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। সবগুলো শরীরে বিধে আছে বেশ কয়েকটা করে তীর।