৬. সাচ্চা রিপোর্ট দাখিল করায় থানেদারের সাজা

সাচ্চা রিপোর্ট দাখিল করায় থানেদারের সাজা

একদিন জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় সটান এসে হাজির হল আধা ফৌজি লিবাস পরা এক খুবসুরত ছোকরা। সাহেব জানতে চাইলেন কী চায় সে? ছোকরা জবাব দিল, “আমার নাম লুচ্চা সিং। তিন বছর আগে চেষ্টা হয়েছিল আমাকে খতম করে দেওয়ার। কিন্তু খুনের দায়ে আমার চাচাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। শুনছি তার উমর কয়েদ হবে।” ছোকরার কথা শুনে হুজুর যেন একটু চমকালেন। তবে কোনও কিছুই ফয়েসলা করতে তাঁর বেশি ওয়াক্ত লাগত না। তিনি তলব করলেন মামলার মিছিল (misl)। নথির বয়ান মোতাবেক:

“বেয়াকুফপুরের থানেদার গাধাপ্রসাদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এত্তেলা করেছে ফাসাদগঞ্জের খুদকস্ত লুচ্চা সিং-এর কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলতে পারছে না কোথায় গেছে সে। আপন ভাইয়ের জরুর সঙ্গে তার নাজায়েজ রিস্তা ছিল। ভাই গ্রামে থাকত না। লুচ্চা সিং-এর চাচা এই নাজায়েজ রিস্তার কথা জানতে পারে। তারপর থেকেই সে গায়েব। ম্যাজিস্ট্রেট এই এত্তেলা পড়ার পর গাধাপ্রসাদ থানেদারকে বরখাস্ত করেন। তাঁর কৈফিয়ত ছিল, লুচ্চা সিংকে খুন করা হয়েছে। খুন করেছে তারই কোনও রিস্তেদার। নাজায়েজ সম্পর্কের কারণেই এই খুন। বেয়াকুফপুরের থানেদার আসলে রিশবত খোর। ঝুঠা মামলা খাড়া করতে চাইছে। কোতোয়ালকে তাই হুকুম দেওয়া হল সে যেন ফাসাদগঞ্জে গিয়ে খুনিদের দুই হপ্তার মধ্যে গ্রেফতার করে। কামইয়াব না হলে তাকেই নোকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।

দুই হপ্তা হওয়ার আগেই কোতোয়াল এসে ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর করল, কাম ফতে। হদিশ পাওয়া গেছে লুচ্চা সিং-এর খুনিদের। লুচ্চাকে খুন করেছে তারই চাচা জালিম সিং। জালিম যে শুধু নিজের গুনাহ কবুল করেছে তাই নয় এমন সব সাবুদ মিলেছে যার থেকে সাফ জাহির হয় সেই আসল খুনি। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সে আবারও নিজের গুনাহ কবুল করে। তার বয়ান মোতাবেক ফুলঝরিয়া আর লুচ্চার নাজায়েজ সম্পর্ক ছিল। সবাই সে কথা জানতে পারলে অচ্ছুত করা হত। শুরুতে সে লুচ্চাকে সাবধানও করেছিল। কিন্তু জালিমকে সে বেপাত্তা করে দেয়। নাচার জালিম তাই এক রাতে তাকে খুন করে। লাশটা ভাসিয়ে দিয়েছে গঙ্গায়। আসামিকে আর কোনও সওয়াল করা হয়নি। হুজুরের সামনে ঘরের কোনায় বসিয়ে লেখা হয়েছে তার জবানবন্দি। তিনজন বাইরের ইশাদিও সেখানে হাজির ছিল। কোনও রকম জোর জবরদস্তি ছাড়াই আসামি কবুল করেছে সে খুনি।

বাইরের ইশাদিরা নিজের কানে শুনেছে ফুলঝরিয়ার সঙ্গে লুচ্চা সিং-এর নাজায়েজ সম্পর্কের কথা। আসামি জালিম সিং যে তাকে খুন করার হুমকি দিয়েছিল সে কথাও সে সাফ জাহির করেছে। তবে খুনটা কেউ তাকে করতে দেখেনি। লাশ তো গায়েব, মেলেনি কোনও ঔজার। তবু ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিয়েছেন মামলটা দায়রা আদালতে জজ সাহাবের কাছে পাঠানো হোক।

জজ সাহেবের সামনে আবার করে আসামি তার গুনাহ কবুল করল। ইশাদিরা জানাল জবানবন্দিতে কোনও বদল হয়নি। এই কথাই তারা আগেও শুনেছে। আইনি কর্তা কিস্‌সা শুনেই ফতোয়া জারি করলেন আর জজ সাহেবের হুকুম হল মিছিল (misl) সদর নিজামি আদালতে পেশ করা হোক। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের রায়—জালিম সিং-এর হওয়া উচিত ফাঁসি।

সময় মাফিক দিস্তা দিস্তা কাগজ আমাদের নিজামি আদালতে জজ সাহেবের সামনে দাখিল করা হল। দায়রা আদালতের রায় ছিল জালিম সিং-এর ফাঁসি। এখানেও জজ সেই রায়ের সঙ্গে সহমত হলেন। কিন্তু সাহেবান আলিসান জজ সাহেব নম্বর দুই, জনাব—এর মেহেরবানি তিনি ওই রায়ে সহমত হলেন না। তাঁর মনে হল, জালিম সিং তো নিজেই গিয়েছিল বেয়াকুফপুর থানায় আর সেই জানায় যে লুচ্চা সিং গায়েব। ম্যাজিস্ট্রেটের বয়ানে আছে কেবল তারই জবানবন্দি, তাকে তো কোনও সওয়াল তিনি করেননি। কোতোয়াল, ম্যাজিস্ট্রেট আর দায়রার দেওয়া জবানবন্দি হুবহু। বেশক তাদের পরিবারে ঝঞ্জাট হয়, আর আসামি জালিম সিং যে খুনের হুমকি দিয়েছিল তাতেও কোনও ভুল নেই। কিন্তু খুনটা যে সেই করেছে তার সাবুদ কোথায়? তেমন কোনও প্রমাণ হাতে না এলে জালিম সিংকে ফাঁসি না দিয়ে উমর কয়েদের সাজা শোনানো যেতে পারে। আর ইন্তেজার করা হোক যদি লুচ্চা সিং-এর কোনও হদিশ মেলে।

এবার জনাব—এর সঙ্গে বাকি জজ সাহেবেরাও সহমত হলেন। জালিম সিং-এর কপালে বদমাশ মোহর দাগিয়ে চালান করা হল গোরখপুরে। গাধাপ্রসাদকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি জানিয়ে দেওয়া হল সে সরকারি কাজে না কাবিল। কিশমত খুলে গেল কোতোয়ালের। শুধু যে তাকে ৫০০ টাকা ইনামই দেওয়া হল তাই নয় মিলল করগুজারির সনদ। এবার লুচ্চা সিং ফিরে এলে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিখে নিলেন তার বয়ান। ফুলঝরিয়ার সঙ্গে তার যে নাজায়েজ সম্পর্ক ছিল সে কথা সে কবুল করল। তার চাচা জালিম সিংকে সে খুবই ডরাত। শুনেছিল চাচা নাকি তাকে খুন করতে আসছে। গ্রামের বাইরে তখন ছাউনি ফেলেছিল সেপাইদের এক পল্টন। তারা যাবে বাঙাল মুলুক। লুচ্চা সিং গিয়ে ভিড়ে গেল সেই পল্টনে। আচানক তার কাছে খবর আসে চাচা জালিম সিংকে গুনাহগার বলে চালান করা হয়েছে। পল্টন থেকে ছুটি নিয়ে তাই সে সোজা চলে এসেছে হুজুরের কাছে, ইরাদা সাচ কবুল করা।

সাহেব আর ওয়াক্ত বরবাদ না করে গোরখপুর থেকে তলব করে পাঠালেন জালিম সিংকে। তাকে যখন জেরা করা হচ্ছে আমিও তখন মোওকা বুঝে সেখানে হাজির। ভাতিজা জিন্দা আছে জানার পর তাকে আজাদ করা হয়েছে। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে সে গিয়ে হুজুরের পায়ে পড়ল। বারে বারে নিজের দাগানো কপাল দেখিয়ে জানতে চাইল এই আজাদির কী মানে? তার কাছে জানতে চাওয়া হল কেন তিন-তিনবার সে গুনাহ কবুল করেছিল। সে জবাব ছিল, তার মতো হাল হলে সাহেবও একই কাজ করতেন। রাতভর তাকে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে রাখা হত জঞ্জালের গাদায়। ছাড় মিলত না এতেও, পুরো দিন খাড়া থাকতে হত ঠা ঠা রোদে। ভয়ানক এই জুলুমের হাত থেকে রেহাই পেতে কোতোয়াল তাকে যেমন তালিম দিয়েছিল সে তেমনটাই কবুল করেছে। তাকে তো ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ সাহেব কোনও সওয়ালই করেননি। উলটে কিছু বলতে চাইলে খেতে হয়েছে ধমক। এখন তাকে আজাদ করা হল কী হল না তাতে কী যায় আসে। এই দাগানো কপাল নিয়ে সে কোন মুখে লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে।

সাহেব জয়েন্ট তো খুব কড়া লব্জে তাঁর বক্তব্য নিজামত আদালতে (Nizamat Adalut) পেশ করলেন। তাঁর মনে হয়েছিল সবার আগে বরখাস্ত করতে হবে কোতোয়ালকে। ছিনিয়ে নিতে হবে তার সনদ আর ইনাম। সে যেহেতু ঝুঠমুট খুনের মামলা সাজিয়েছে তাই তার খিলাফ রুজু করা হোক একটা ফৌজদারি মামলা। গাধাপ্রসাদকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক তার নোকরি। দেওয়া হোক ইনামও। হুকুমতের জিম্মেদারি হল বেচারা জালিম সিং-এর খোরপোশের বন্দোবস্ত করা। কিন্তু তাঁর এসব খোয়াহিশ কি আখেরে লাগু হল?

জালিম সিং আজাদি পেল ঠিকই কিন্তু খোরপোশ জুটল না। তার কপালে মোহর দাগানোর জন্য কোনও খেসারত দিতে ইনকার করল সরকার। গাধাপ্রসাদকে নিয়ে কারও কোনও শিরদর্দ ছিল না। কোতোয়ালের ৫০০ টাকা ইনাম তারই রইল কেউ তার কাছে কোনও জবাবদিহি চাইল না। এখনও সে বহাল তবিয়তে কোতায়ালই আছে।

সাহেবের আর্জি বেপাত্তা হওয়ায় তিনি বড়ই মায়ুস (Mayus) হয়ে পড়লেন। এই বেইজ্জতি চুপচাপ হজম করা ছাড়া আর কী বা করতে পারতেন। গুনাহগারদের এই রকম দাগানো বা গোদনা (Godena)-র সাজা আমাকে খুবই বেচৈন (becian) করেছিল। হুকুমতের তো সাজা দেওয়ার আরও হাজারও কানুন মজুদ তবে কেন সেই আদমির দেহের উপর এই হামলা! এতে তো তার পুরো জিন্দেগিই বরবাদ। আজাদি মিললেও এই মোহর তাকে গুনাহগারই বানিয়ে রাখবে। সমাজ তাকে ভাল চোখে দেখবে না। চাইলেও সে মিশে যেতে পারবে না সবার সঙ্গে। যারা একদিন এই গোদনার হুকুম দিয়েছিল তাদের খিলাফ ওঠানো যাবে না কোনও আওয়াজ। গোস্তাখি (Gustakhi) মাফ, ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি হচ্ছি মামুলি এক আর্দালি। সাহেবদের খিলাফ কিছু বলি সেই ঔকাত আমার কোথায়!

১. রিস্তা: সম্পর্ক, আত্মীয়তা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *