সমাপ্তি গাঁথা
আমি সারা দিন লিখলাম, তারপরের দিন, তারপরের দিনও লিখলাম।
প্রতিদিন সকালে আমি পিদরা নদীর তীরে যেতাম। প্রতিটি দুপুরে সেই মহিলা আমার কাছে আসত, আমার হাত ধরে সেই পুরাতন আশ্রমে নিয়ে যেত।
তিনি আমার কাপড় ধুয়ে দিতেন, রাতের খাবার তৈরি করতেন, আমার সাথে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতেন, তারপর আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।
এক সকালে যখন আমি লেখার কাজ শেষ করলাম আমি একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। আমার অন্তরটা লাফিয়ে উঠল। কিন্তু আমি কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। আমার নিজেকে আবারো মুক্ত স্বাধীন মনে হলো, সেই আগের পৃথিবীতে আবারো ফিরে যেতে চাইলাম যেটার অংশ আমি একদিন ছিলাম।
ঝড়ঝঞ্জা কমে গেছে যদিও দুঃখটা তখনো রয়ে গিয়েছিল।
আমার মনই ঠিক ছিল। কাজ থেকে আমি মাথা না তুলেই তার উপস্থিতি টের পেলাম, শুনতে পেলাম তার পায়ের শব্দ।
পিলার। সে আমার সামনে বসে বলল।
আমি উত্তর না দিয়ে লেখা চালিয়ে যেতে থাকলাম।
আমার বুকটা তখনো লাফাচ্ছিল। আমার কাছে ছিটকে বের হয়ে তার কাছে ছুটে যেতে চাইছিল। কিন্তু আমি সেটা করলাম না।
আমি যখন লিখছিলাম সে নদীর দিকে তাকিয়েছিল।
সারা সকালটা এভাবে কিছু না বলেই কেটে গেল। কুয়োর পাশে যখন রাতের নিরবতা নেমে আসল আমি হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম যে আমি তাকে ভালোবাসতাম।
যখন আমার হাত আর কিছুই লিখতে পারল না তখন আমি লেখা থামালাম।
সে কথা বলা শুরু করল।
“আমি যখন আশ্রমের বাইরে আসলাম তখন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে খুঁজে পাই নি। তাই আমি জারাগোজায় চলে গেলাম। এমনকি আমি সোরিয়াতেও গিয়েছিলাম। সমস্ত জায়গায় আমি তোমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। তারপর আমি আবার পিদরা নদীর পাশে এই আশ্রমে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম যদি সেখানে তোমার কোন চিহ্ন খুঁজে পাই। তখন একটা মহিলার সাথে আমার দেখা হলো। সেই আমাকে তুমি কোথায় আছ সেটা দেখাল। সেই মহিলা আমাকে বলেছে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছ।
আমার চোখ আবারো পানিতে ভরে উঠল।
‘আমি নদীর পাশেই তোমার সাথে এখানে বসে থাকব। তুমি যদি ঘুমাতে যাও তাহলে তোমার পিছু পিছু গিয়ে তোমার বাড়ির সামনে ঘুমাব, তুমি যদি তারপরেও চলে যাও তাহলে আমি তোমার পিছু নিতে থাকবে যতক্ষণ না তুমি আমাকে চলে যেতে বলে। যখনি চলে যেতে বলবে তখনি আমি চলে যাব। কিন্তু আমার জীবনের বাকি সময়টা আমি তোমাকে ভালোবেসেই যেতে চাই।’
আমি আর কিছুতেই আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। সেও আমার সাথে কাঁদতে থাকল।
‘আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই…’। সে আবার কথা বলা শুরু করল।
কিছু বলার দরকার নেই। তুমি এই কাগজগুলো পড়ো।’ আমি তার হাতে আমার লেখা কাগজগুলো দিলাম।
সারাটা বিকেল আমি পিদরা নদীর দিকে তাকিয়ে থালাম।
আশ্রমের মহিলাটা আমাদের জন্য স্যান্ডউইচ, মদসহ আরো খাবার নিয়ে আসল। তারপর আমাদেরকে একা রেখে চলে গেল। আমার লেখা কাগজগুলো সে পড়া শুরু করে কিছুক্ষণ পর পর থেমে আকাশের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। আবার পড়া শুরু করল।
আমি তাকে পড়ার মধ্যে রেখে কিছুক্ষণের জন্য নদীর পারে যেখানে ছোট্ট ঝরনাটা পড়ছে সেদিকে হেঁটে আসলাম।
যখন সূর্য অস্ত যেতে শুরু করল আমি সেখানে ফিরে আসলাম যেখানে তাকে রেখে গিয়েছিলাম।
কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে সে বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।
পিদরা নদীর তীরে বসে আমি কাঁদলাম।
তোমার ভালোবাসা আমাকে রক্ষা করেছে আর আমার স্বপ্নের কাছে ফিরিয়ে এনেছে। সে আবার বলতে থাকল।
আমি কিছুই বললাম না।
‘তুমি কি বাইবেলের স্তুতিগান ১৩৭ এর বিষয়ে কিছু জানো?’ সে জিজ্ঞেস করল।
আমি মাথা নাড়লাম। কথা বলতে আমি ভয় পাচ্ছিলাম।
‘ব্যবিলন নদীর তীরে…’।
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি এটা। আমি বললাম যেন আবারো আমি জীবনের কাছে আস্তে আস্তে ফিরে আসছি।
‘এটা হলো নির্বাসনের কথা। এখানে এমন কিছু লোকের কথা বলা হয়েছিল যারা নিজেদের প্রাণের সংগীত বাজাতে পারে নি বলে যার যার বাদ্যযন্ত্র ঝুলিয়ে দিয়েছিল।
“কিন্তু যখন সেই স্তুতিগানের রচয়িতা তার স্বপ্নের ভূমির জন্য কাঁদতে শুরু করলেন তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,
‘আমি যদি তোমাকে ভুলে যাই হে জেরু্যালেম,
তাহলে আমার ডান হাত যেন অকেজো হয়ে পড়ে
আমার জিহ্বা যেন মুখের তালুর সাথে এটে থাকে
আমি যদি জেরুালেমকে সম্মান না করি।’
আমি আবারো হাসলাম।
‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি এটা মনে করিয়ে দিলে।
‘তুমি কি মনে করো তোমার সেই উপহারটা আবার ফিরে এসেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আমি জানি না। কিন্তু দেবীরা আমাকে সব সময় জীবনে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিয়ে থাকেন। তুমি হলে আমর সেই সুযোগ। তিনি আমাকে আবারো সাহায্য করবেন আমার পথ খুঁজে বের করার।
‘আমাদের পথ।
‘হ্যাঁ। আমাদের।
আমার হাত ধরে সে আমাকে দাঁড় করালো।
যাও তোমার সব কিছু গুছিয়ে নাও। সে বলল। স্বপ্ন মানে হলো কাজ।
[সমাপ্ত]