৬. সবাই চলে যাবার পরে

সবাই চলে যাবার পরে, উদিত নারায়ণের জন্য, চারদিকে তাকাল। এ সময়ে, উদিতের চোখে পড়ল, রাস্তার এক পাশে একটা জিপ। দু-তিনজন লোক, ওকে আর মেয়েটিকে দেখছে, নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে। হয়তো উদিতদের অবস্থা দেখেই, কিছু বলাবলি করছে। তবু, লোকগুলোর দৃষ্টি ওর ভাল লাগল না। তিন জনেই বেশ ভাল পোশাক পরে আছে। তাদের দেখলে মনে হয় না, কোনওরকম দুশ্চিন্তায় আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে গেলাস। সামনেই একটা পানের দোকানে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। লোকগুলো বোধ হয় মদ খাচ্ছে। বাঙালি না অবাঙালি, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাদের লক্ষ্য বেশি, মেয়েটির দিকেই।

মেয়েটি সে সব দেখছিল না। সে উদিতের দিকে তাকিয়ে, কিছু বলতে চাইছে। লজ্জায় বা সংকোচে পারছে না বোধ হয়। উদিত এবার নিজেই জিজ্ঞেস করল, আপনি ঠিক কোথায় যাবেন বলুন তো?

মাটিয়ালি।

উদিত চমকে উঠে বলল, মেটুলি!

হ্যাঁ।

সে তো শিলিগুড়ি থেকেও অনেক দূর। এই দুর্যোগ দেখে, এত দূরের পথে আপনি বেরোলেন কী করে?

বুঝতে পারিনি।

 সেখানে আপনার কে আছে?

মেয়েটি যেন একটু থমকে গেল। তারপর বলল, আমার আত্মীয়ের বাড়ি আছে।

 কথাটা উদিতের ঠিক বিশ্বাস হল না। তবে, ওর জানবার দরকারই বা কী।

ও আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না, এমনকী মেয়েটির নামও না।

এমন সময়ে জিপের কাছ থেকে একটি লোক এগিয়ে এসে উদিতকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাবেন?

লোকটির লক্ষ্য আসলে মেয়েটি, আড়চোখে সে তাকেই দেখছিল। উদিত তীক্ষ্ণ চোখে লোকটাকে দেখল। মদের গন্ধও পেল। বলল, কোথাও যাব কি না, এখনও বলতে পারি না।

গেলে কোথায় যাবেন?

উদিত বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে খোঁজে আপনার কী দরকার?

 লোকটি একটু নরম হবার চেষ্টা করল, না সেরকম হলে, আমাদের একজন আপনার ট্রাকে যেত!

উদিত পরিষ্কার জানিয়ে দিল, অচেনা কোনও লোককেই আমরা নেব না।

লোকটি মেয়েটির দিকে এক বার ভাল করে দেখল। বলল, অ! আচ্ছা, ঠিক আছে।

কেমন যেন একটা চ্যালেঞ্জের সুর আছে লোকটার গলায়। যেতে যেতেও, বারে বারে মেয়েটির দিকে ফিরে দেখল। ওর দলের লোকেরা সবাই এদিকেই তাকিয়ে ছিল। লোকটা ওদের কাছে যাবার পরে, সবাই একযোগে মেয়েটির দিকে তাকাল, আর নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করতে লাগল।

উদিতের কী মনে হতে, ও মেয়েটির দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলুন তো। ওরা কি আপনার চেনা লোক?

মেয়েটি অবাক চোখে চকিতে একবার জিপ গাড়ির সামনে লোকগুলোকে দেখল। উদিতের দিকে ফিরে, ঘাড় নেড়ে বলল, না তো।

উদিত আবার লোকগুলোর দিকে দেখল। ওর মনের সন্দেহ ঘুচল না। বলল, লোকগুলো আপনাকে ওভাবে তাকিয়ে দেখছে কেন?

মেয়েটির মুখ একটু রক্তাভ হল। বলল, তা কী করে জানব বলুন। ওদের একটা লোককেও তো আমার চেনা মনে হচ্ছে না।

উদিত চিন্তিত হল, ওর ভুরু বেঁকে রইল। লোকগুলোকে ওর মোটেই ভাল লাগছে না। ওরা মেয়েটির দিকেই বারে বারে তাকিয়ে দেখছে। এমনিতেই দুর্যোগ, তারপরে যদি মেয়েটিকে নিয়ে, কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়, সেটা মোটেই ভাল হবে না। লোকগুলো কারা হতে পারে, কেনই বা মেয়েটিকে এভাবে দেখছে, কে জানে। ও আবার মেয়েটির দিকে ফিরে তাকাল। মেয়েটির চোখও তখন ওর ওপরেই। চোখাচোখি হতেই, মেয়েটি চোখের পাতা নামাল। আবার তৎক্ষণাৎ উদিতের দিকে চেয়ে বলল, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে, আমি ওদের চিনি?

উদিত বলল, তা বলছি না। তবে ওদের ধরন ধারণ যেন কী রকম। আপনার কিছু মনে হচ্ছে না?

মেয়েটি চকিতে আর একবার জিপের দিকে দেখল। বলল, হ্যাঁ, খুবই ডাউটফুল। কিন্তু কেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উদিত বলল, ওদের একজন আমাদের সঙ্গে ট্রাকে যেতে চাইছে।

 মেয়েটি বলল, সে কথা তো শুনলাম।

তাতেই মনে হয়, ওদের একটা কিছু উদ্দেশ্য আছে।

বলতে বলতেই উদিত মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, থাকলেই বা আর কী করা যাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।

উদিতের কথা শুনে, মেয়েটি যেন একটু স্বস্তিবোধ করল।

.

বেশ খানিকক্ষণ বাদে, নারায়ণ ফিরল। ওর হাতে মস্ত বড় খাবারের ঠোঙা আর ভাঁড়। এসে বলল, এখানকার থানার খবর হচ্ছে, আদিনা পান্তুয়া দিয়ে গাজোল পর্যন্ত রাস্তা ঠিকই আছে। শামসী পর্যন্ত রাস্তায় খানে খানে জল উঠেছে, খুব বেশি না। চাঁচলের অবস্থা খুব ভাল না, তবে পার হওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে হয় পূর্ণিয়া ঢুকতে হবে, না হয় তো পশ্চিম দিনাজপুর দিয়ে পূর্ণিয়ায় গিয়ে পড়তে হতে পারে। পুলিশ বলছে, না যাওয়াই ভাল। এখন কী করবি?

উদিত ভাবল খানিকক্ষণ। মেয়েটিকে এক বার দেখল। বলল, চলেই যাই। দেখি না কী হয়।

নারায়ণ বলল, আমারও তাই ইচ্ছা।

বলে নারায়ণ এবার মেয়েটির দিকে তাকাল। উদিতকে জিজ্ঞেস করল, উনি তা হলে থেকে গেলেন?

 হ্যাঁ।

 নারায়ণ বলল, ঠিক আছে, আপনি একটু কিছু খেয়ে নিন আমাদের সঙ্গে।

মেয়েটি বলল, থাক, খেতে ইচ্ছে করছে না।

 নারায়ণ বলল, সে তো ইচ্ছে করবেই না। তবে মন খারাপ করে কী করবেন, যা তোক একটু খেয়ে নিন।

ইতিমধ্যে একটা ছেলে জলের কুঁজো আর কয়েকটা গেলাস নিয়ে এল। পাতায় খাবার ভাগ করে, মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিতেই, মেয়েটি বলল, আমাকে একটু ভেতরে গিয়ে বসতে দেবেন?

নারায়ণ বলল, আসুন।

সে দরজা খুলে দিল। মেয়েটি পাশে দাঁড়ানো উদিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। উদিত মেয়েটির হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে এল। বলল, আমার ব্যাগটা পিছনে রয়েছে।

উদিত সে কথায় কান দিল না। মেয়েটি ভিতরে ঢুকল। নারায়ণ তার হাতে খাবার তুলে দিল।

উদিত পিছন থেকে মেয়েটির ব্যাগ তুলে নিয়ে এসে, ভিতরে তার পাশে রেখে দিল। মেয়েটি সেই মুহূর্তেই মুখে খাবার তুলতে যাচ্ছিল। যেন লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, শুনুন, উদিতবাবু।

উদিত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বলুন।

আমার দু হাতই জোড়া হয়ে গেছে। ব্যাগের ভিতরে একটা ছোট ভোয়ালে আছে, একটু বের করে দেবেন?

উদিত মেয়েটির দিকে তাকাল।

মেয়েটিও ওর দিকেই তাকিয়ে। বলে উঠল, বিরক্ত হচ্ছেন না তো?

উদিত বলল, না, বিরক্তি আর কীসের।

এই একটু আগেই, ট্রাকের পিছন থেকে, হাত ধরে নামিয়ে দেবার সময়ে, মেয়েটির ভঙ্গি ওর মনে পড়ে গেল।

তবু উদিত যেন খানিকটা অনিচ্ছায় ব্যাগ খুলল। ভিতর থেকে একটা সুন্দর গন্ধ বেরোল। ব্যাগের মুখের কাছে ম্যাগাজিনগুলো। তারপরেই তোয়ালে। সেটা বের করে দিল। তারপরে ও আর নারায়ণ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে পাতার ঠোঙা থেকে খাবার খেতে লাগল।

নারায়ণ জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার নামধাম পরিচয় কিছু জানলি?

না। খালি বলল, ও মেটেলি যাবে।

মেটেলি! তা হলে আর যাওয়া হয়েছে। কিন্তু মেটেলি কার বাড়ি যাবে?

বললে, কে নাকি আত্মীয় আছে।

 তুই তো আচ্ছা ছেলে। নামধাম পরিচয়টা তো জেনে নিতে হয়।

উদিত খেতে খেতে বলল, কী হবে পরিচয় জেনে? শিলিগুড়ি অবধি পৌঁছে দিলেই হল। তারপরে যে যার রাস্তায়।

নারায়ণ বলল, নামটা তো অন্তত জানা দরকার।

তোর দরকার থাকে, তুই জেনে নিস।

নারায়ণ মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে অদ্ভুত স্বরে বলল, তোর কোনও রসকষ নেই। এ রকম একটা মেয়ে সঙ্গে যাচ্ছে। কোথায় খুশি হবে, তা না, যেন ব্যোমকে বসে আছিস।

ব্যোমকে বসে থাকব কেন। যা করবার, তা-ই করছি। তোর রস বেশি হয়ে থাকে, তুই যা খুশি তাই কর।

উদিত তাকাল নারায়ণের দিকে। নারায়ণ মুখে খাবার নিয়ে হাসল। বলল, করব আবার কী। করার কিছু নেই। তবে এ রকম জানি, একটা ওরকম মেয়ে সঙ্গে থাকলে, আমার বেশ ভালই লাগে।

উদিত অবিশ্যি এক বারও বলেনি, ওর খারাপ লেগেছে। নারায়ণের কথা শুনে, ওর মনে হল, খারাপ আর কী। বাজে কোনও ঘটনা না ঘটলেই হল। নারায়ণ আবার বলল, মেয়েটাকে যত বারই দেখলাম, কেবল তোর দিকে চেয়ে আছে। তোকে বোধ হয় ভাল লেগেছে।

উদিত ভুরু কুঁচকে নারায়ণের দিকে তাকাল। নারায়ণের প্রকাণ্ড মাংসলো মুখটা দেখলে বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু উদিত নারায়ণকে ভাল চেনে। ছেলেবেলার বন্ধু। এক সঙ্গে এক শহরে ওরা বড় হয়েছে, মেলামেশা করেছে। নারায়ণদের অবস্থা ওদের থেকে বরাবরই ভাল। তাতে মেলামেশা আটকায়নি। কলেজ ছেড়ে দেবার পরেও, মেশামেশিটা একরকমই আছে। উদিত বলল, দ্যাখ নারাণ, পেছনে লাগার তাল করিস না।

নারায়ণ হেসে ওঠার মতো শব্দ করে বলল, পেছনে লাগব কেন। যা সত্যি, তাই বলছি। যত বারই দেখেছি, ঠিক তোর দিকে তাকিয়ে আছে। কথাটা তোকে বলব ভেবেছিলাম।

উদিত নারায়ণের মুখ থেকে চোখ না তুলেই বলল, তোকে আমি চিনি না, না?

নারায়ণ এবার হেসে উঠল। বলল, মাইরি বলছি, আমি একটুও মিথ্যে বলিনি।

উদিত বলল, বেশ, সত্যিই বলেছিস। তাতে কী এল গেল? মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়েছিল তো কী হল।

তাকানোর মধ্যে একটু বিশেষত্ব আছে।

উদিত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমার প্রেমে পড়ে গেছে।

তুই একটু ঝোঁক দিলেই পড়ে যাবে।

উদিত বিরক্ত হতে গিয়ে হেসে ফেলল। নারায়ণও ওর সঙ্গে হেসে উঠল।

উদিত বলল, ওরে গাধা, বিপদে পড়লে ওরকম সবাই মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। হাওড়া ইস্টিশনে কেমন ডাঁট দেখিয়েছিল, তা তো দেখিসনি।

নারায়ণ নতুন করে উৎসাহী হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি? কী রকম?

উদিত হাওড়া বুকস্টলের কথা বলল। নারায়ণ শুনে বলল, ওরকম হয়ে থাকে। ওটা ডাঁট দেখাবার জন্য নয়, এমনি আপন মনে কাগজ কিনছিল, তোর গায়ে বর্ষাতির জল লেগে গেছল। তারপরে মানিকচকের বান দেখে প্রেমে পড়ে গেল।

উদিত হো হো করে হেসে উঠল। তারপরে গলা নামিয়ে বলল, বুঝেছি, মেয়েটাকে দেখে তুই মজেছিস। তা চেষ্টাচরিত্র করে দ্যাখ না।

নারায়ণ একরাশ খাবার মুখে পুরে দিয়ে, মুখটাকে ফুলিয়ে তুলল। খাবার চিবোতে চিবোতে হাউ হাউ করে বলল, এরকম চেহারার লোকের সঙ্গে মেয়েরা প্রেম করে না।

উদিত বলল, তবু যদি তোকে না জানতাম। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি হিসেবে কম করে দু ডজন। মেয়ে ছাড়া তোকে আমি আজকাল ঘুরতেই দেখি না।

নারায়ণ বলল, সঙ্গে ঘোরা আর প্রেম করা এক কথা না।

উদিত ঠোঁট মুচকে হেসে বলল, আমি তো অন্যরকম জানি।

কী রকম?

নারায়ণ সিনহা যে মেয়ের সঙ্গে ঘোরে, সে মেয়েই তার প্রেমিকা।

 নারায়ণ খাবার চিবোতে চিবোতে উদিতের মুখের দিকে তাকাল। চোখে তার ভ্রকুটি অনুসন্ধিৎসা। কেবল উচ্চারণ করল, তার মানে?

উদিত বলল, তার মানে, মনে করে দ্যাখ, এরকম কথা তুই-ই আমাকে বলেছিলি বছর খানেক আগে, নারায়ণ সিনহা রোজ একটা করে প্রেম করতে পারে।

নারায়ণ মুখের মধ্যে খাবার নিয়ে, হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত উদিতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে যেন অবাক হয়ে, লজ্জা পেয়ে বলল, বলেছিলাম নাকি! যাঃ, বাজে কথা।

উদিত বলল, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় বলিসনি, পেটে তখন তোর প্রচুর মাদকদ্রব্য ছিল।

নারায়ণ গাল ফুলিয়ে হাসবার ভঙ্গি করল। কিছু বলল না। উদিত মুখ টিপে হাসল। কথাটা ও মিথ্যা বলেনি। নারায়ণের পানের ব্যাপারে মাত্রাধিক্য ঘটলে, ওরকম অনেক কথাই সে বলে থাকে। মানুষ তার নিজের ইচ্ছা বা রুচিতেই পান করে। তথাপি পরিবেশের একটা ব্যাপার বোধ হয় আছে। নারায়ণ যে-পরিবেশে থাকে, অধিকাংশ সময় চলাফেরা করে, মদ্যপানটা সেখানে নিয়মিত এবং অপ্রতিরোধ্য ভাবে চলে। তাদের ব্যবসার জগতে, যা কিছু করণীয় এবং যাদের সঙ্গে উঠতে বসতে হয়, খাতির করে চলতে হয়, সেই জগতে এবং ব্যক্তিদের কাছে মদ গলা ভেজাবার পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নারায়ণ যতকাল দাদাদের সঙ্গে ব্যবসায়ে নামেনি, ততকাল তার ও সব ছিল না। আস্তে আস্তে শুরু হয়েছিল। তার আগে, ওর দাদারা শুরু করেছিল। এখন ওরা তিন ভাই একসঙ্গে বসেই মদ্যপান করে। এটা একটা নারায়ণদের স্বাভাবিক পারিবারিক চিত্র। তবে এই চিত্র শিলিগুড়ির বাড়িতেই। জলপাইগুড়ির বাড়িতে নারায়ণের বাবা থাকেন। সেখানে ও সব নিষিদ্ধ। আজকের এই বিরাট কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা একদা নারায়ণের বাবা-ই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন নারায়ণের দুই দাদা আর সে, সব দেখাশোনা করে। বাবা বিশ্রাম নিয়েছেন। হয়তো নারায়ণের বাবাও জানেন, তাঁর ছেলেরা পানাসক্ত। তাঁর মনোভাবটা বোধ হয় এইরকম, ব্যবসা ঠিক মতো বজায় রেখে, দূরে বসে ছেলেরা একটা মোটামুটি স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে। যদিও সেটা মাত্রাতিরিক্ত হবে না, এবং তাঁর সীমানার মধ্যেও সম্ভব নয়।

অবিশ্যি, নারায়ণের মদ্যপানটা লুকোচুরির কিছু না। সকলেই জানে। নারায়ণ সকলের ছোট, সে হিসেবে একটু রোমান্টিক। শিলিগুড়ির যে সব পরিবারের সঙ্গে ওদের ওঠাবসা, তারা সরকারি মিলিটারি কসমোপলিটান সমাজ। ভারতের সব প্রদেশের লোকই তার মধ্যে আছে। নারায়ণ মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে। ওর নিজের একটা গাড়ি আছে। টাকাও পকেটে থাকে। গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজের ভারটাও কম বহন করতে হয়। অতএব, আজ একে নিয়ে দার্জিলিং, কাল ওকে নিয়ে কালিম্পং, পরশু তাকে নিয়ে গ্যাংটক ছুটোছুটিতে ওর অসুবিধে নেই। অসুবিধে একটি মাত্র, আজ অবধি ভাল করে গাড়ি চালাতে শেখেনি। উদিতকে তার প্রয়োজন হয়, এই কারণেই বেশি। নারায়ণের অনেক অভিসার ভ্রমণেরই সঙ্গী উদিত।

অভিসার নারায়ণের ভাষায়। যে-মেয়ে ওর সঙ্গে বেড়াতে যায়, সে মেয়েই ওর প্রেমিকা। নারায়ণ নিজেও জানে, কথাটা সত্যি না। ভাবতে ভালবাসে। আসলে নারায়ণ সরল হৃদয়, ফুর্তিবাজ। কোনও কোনও সময় বোকা বলে মনে হয়। কিন্তু সে বোকা নয়। আবেগের সময় যা মনে আসে, তা-ই বলে। তখন বোকা বোকা মনে হতে পারে। কাজের বেলায় কেবল বুদ্ধিমান না, সে রঙ্গ ব্যঙ্গও জানে।