৬. ষষ্ঠ দিন

৬. ষষ্ঠ দিন

রাত্রে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে, কিন্তু রাজুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। বিছানায় তার পাশে সাগর মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। পাশের বিছানায় ঘুমাচ্ছে আগুনালি। সে যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ হম্বিতম্বি করতে থাকে, কিন্ত ঘুমাচ্ছে গুটিসুটি মেরে একেবারে একটা বলের মতো হয়ে। শাওন পাশের ঘরে সোফার উপরে শুয়ে ঘুমিয়েছে। মশারি খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু কয়েকটা মশার কয়েল পাওয়া গিয়েছিল। কে জানে ঠিক করে ঘুমাতে পেরেছিল কি না!

রাজু বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে উঁকি দিল। শাওন সোফায় নেই, প্রথমে বুকটা ধক করে ওঠে, কিন্তু পরের মুহূর্ত সে শান্ত হয়ে আসে। শাওন জানালার কাছে দুই গালে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজু একটু শব্দ করে ঘরে ঢুকতে শাওন ঘুরে তাকাল। রাজুকে দেখে হেসে বলল, “তুমিও উঠে গেছ?”

“হ্যাঁ, তুমি কখন উঠেছ?”

“অনেক ভোরে।”

“মশার কামড়ে খেয়ে?”

“না, মশা কামড়ায়নি। এমনিতেই ঘুম ভেঙে গেল।” ঘুম হয়েছে তোমার?”

শাওন আবার একটু হাসল, “হয়েছে, মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙেছে, তখন হঠাৎ করে মনে পড়েছে আমি পালিয়ে চলে এসেছি–তখন যে কী মজা লেগেছে!”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, ইচ্ছে হয়েছে উঠে ডিগবাজি দিই।”

একটা ফুটফুটে মেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ডিগবাজি দিচ্ছে–দৃশ্যটা চিন্তা করে রাজু খিকখিক করে হেসে ফেলল।

শাওন আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “জায়গাটা কী সুন্দর!”

রাজু এগিয়ে গিয়ে শাওনের পাশে দাঁড়াল। দূরে ছোট ছোট টিলা, টিলার কাছে গাছের সারি, পুরো এলাকাটা একধরনের নরম কুয়াশার ঢেকে আছে। এখনও সূর্য ওঠেনি, আকাশে একটা লালচে ভাব এসেছে। বাইরে পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে, কে জানে, তাদেরও মনে হচ্ছে খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেছে।

শাওন বাইরে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, যে–”

শাওন তার কথাটা শেষ করল না। রাজু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “যে?”

“যে আমাকে মরতে হবে না!”

কথাটা শুনে রাজুর এত মায়া লাগল যে বলার নয়। সে নরম গলায় বলল, “মরবে কেন, ছি!”

“আমি একেবারে রেডি হয়েছিলাম–”

”থাক। এগুলো মনে করে আর লাভ নেই।”

“মরে গেল আর এত সুন্দর জায়গাটা দেখতে পারতাম না।”

“এখন তো দেখছ। সবাই ঘুম থেকে ওঠার পর নাস্তা খেয়ে আমরা ট্রেন স্টেশনে যাব। সেখান থেকে ট্রেন করে ঢাকায় তোমার আম্মার কাছে। চিন্তা করো তোমার আম্মা কী খুশি হবেন!”

শাওন সাবধানে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, “হ্যাঁ, বেচারি আম্মা! কী কষ্টটাই-না পাচ্ছে!”

“থাক, এখন আর দুঃখকষ্টের কথা ভেবে লাভ নেই। সকালে কী নাস্তা করবে বলো!”

“নাস্তা তৈরি করবে কে?”

“এই আমরা নিজেরাই তৈরি করব।”

“কী কী আছে তৈরি করার?”

রাজু মাথা চুলকে বলল, “বেশি কিছু নেই। মুড়ি আর বিচিকলা।”

শাওন হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। চোখ মুছে বলল, “মুড়ি আর বিচিকলা! তুমি যেভাবে জিজ্ঞেস করেছে মনে হল হাতি ঘোড়া কত কী খাবার আছে!”

রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আসলে চান মিয়া তো এখনও আসেনি, সেজন্যে এই অবস্থা! আগুনালি অবিশ্যিও চাও তৈরি করতে পারে, কিন্তু সে চাও খাওয়া যায় না।”

“কেন?”

“আলকাতরার মতো কুচকুচে কালো হয় আর খেতে একেবারে ইঁদুর মারার বিষের মতো।”

শাওন আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে আর তাকে হাসতে দেখে এবারে রাজুও প্রথমে একটু একটু তারপর বেশ জোরে জোরে হাসতে শুরু করল।

.

সবাই যখন ঘুম থেকে উঠল তখন বাসাটিতে একটা কর্মব্যস্ততার ভাব ফুটে উঠল। কয়দিনে বাসার নানা জায়গায় যেসব জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল শাওন সেগুলি গোছাতে শুরু করে এবং অন্য তিনজন অবাক হয়ে লক্ষ করল কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো বাসার চেহরাটা পালটে গেছে। আগুনালি নাস্তা তৈরি করার দায়িত্ব নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল, রাজু গেল তাকে সাহায্য করতে। সাগর শাওনের পিছুপিছু ঘুরঘুর করে তার কাজকর্মে পদেপদে ঝামেলা করতে লাগল। রাজু হলে এতক্ষণে সাগরকে তুলে একটা আছাড় দিয়ে বসত, কিন্তু শাওন একটুও রাগ করল না। মনে হয় খোদা যখন মেয়েদের তৈরি করেছেন তখন তাদের শরীরে ধৈর্য প্রায় দশ কে. জি. বেশি দিয়েছেন।

সকালের নাস্তা খাওয়ার অনুষ্ঠানটি হল খুব চমৎকার। রাজু কাছে কাছে ছিল বলে এবারে আগুনালি চা-টা বেশি কড়া করতে পারল না এবং সেটা বেশ খাওয়া গেল। মুড়ি শেষ হওয়ার পর বিচিকলা মুখে দিয়ে পুট করে তার বিচি কে কতদূরে ছুঁড়ে দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় আগুনালিকে কেউ হারাতে পারল না। দেখে বড় প্রতিযোগী মনে না হলেও শাওন হল রানার্স আপ। সাগর অনেক চেষ্টা করার পরও তার বিচিগুলি মুখ থেকে বের হয়ে থুতুনির মাঝে ঝুলে থাকতে লাগল। সেটা দেখে প্রথমে শাওন এবং শাওনকে দেখে অন্য সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। যদিও সাগরকে নিয়ে সবাই হাসছে, কিন্তু সাগর তবুও এতটুকু রেগে গেল না। বরং সবাইকে এত আনন্দ দিতে পারছে বলে সে নিজেও হাসতে লাগল। নাস্তা শেষ হবার পর আগুনালি তার আগুনের খেলা দেখাল। তার আগুনি পাখুনি নিয়ে সে বিশাল একটা আগুনের হলকা শাওনের একেবারে কানের কাছে দিয়ে পাঠিয়ে দিল। শাওন প্রস্তুত ছিল না বলে ভয়ে চিৎকার করে রাজুকে জড়িয়ে ধরল, আর তাই দেখে অন্য সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। শাওনকে অবাক করে দেবার জন্যে আগুনালি মুখে পেট্রোল নিয়ে আগুনের উপর দিয়ে ফুঁ দিয়ে বের করতেই মনে হল তার মুখ থেকে ড্রাগনের মতো আগুন বের হয়ে এল। সেটা দেখে শাওন এত ভয় পেল, যে চিৎকার দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল। আগুনালি আবার সেটা দেখানোর চেষ্টা করতেই শাওন ছুটে গিয়ে আগুনালির হাত ধরে ফেলে বলল, “না না, তুমি এটা করতে পারবে না।”

আগুনালি দাঁত বের করে বলল, “ভয় পাবার কিছু নাই, এর মাঝে কোনো বিপদ নাই। মুখে পেট্রোলের গন্ধ খারাপ লাগে, কিন্তু কোনো বিপদ নাই।”

শাওন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “একশো বার আছে।”

“এইটা দেখেই ভয় পাও, আমার অন্য খেলা দেখলে তুমি কী করবে?”

“কী খেলা?”

“সারা শরীরে আগুন লাগিয়ে পানির মাঝে ঝাঁপ দেওয়া।”

শাওন ভয়ে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে বলল, “তুমি শরীরে আগুন লাগিয়ে পানিতে ঝাঁপ দাও?”

“এখনও পুরো শরীরে লাগাই নাই। দুই হাতে লাগিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। পেট্রোল দিয়ে আগুন দিতে হয়। পেট্রোল পুড়ে গেলে আগুন নিজ থেকে নিভে যায়, দেখে ভয় লাগে, আসলে ভয়ের কিছু নাই। তুমি দেখ নাই সার্কাসে দেখায়?”

শাওন মাথা নাড়ল, সে দেখেনি।

আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেইজন্যে এত ভয় পেয়েছ। ভয়ের কিছু নাই। আগুনকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তোমরা যদি আগুন নিয়ে খেল

অনেক বিপদ হতে পারে, আমি যদি খেলি কোনো বিপদ নাই।”

শাওন থমথমে মুখে বলল, “তোমার যা ইচ্ছা তুমি বলতে পার, কিন্তু এখন আমাকে ছুঁয়ে তোমার একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।”

আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “কী প্রতিজ্ঞা?”

“আগে আমাকে ছোঁও।” সাগর জিজ্ঞেস করল, “ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলে কী হয়?”

শাওন সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেল তা হলে যাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে সে মরে যায়। শাওন আবার আগুনালির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “ছোঁও। ছুঁয়ে আমার সাথে সাথে বলো–”

“কী বলব?”

“বলো, আমি জীবনে শরীরের কোনো জায়গায় আগুন লাগাব না–”

“কিন্তু–কিন্তু—”

“না। আমি কোন কথা শুনব না। আমাকে ছুঁয়ে তোমার বলতে হবে। আমি কোনো কথা শুনব না। বলো–”

আগুনালি আরও কয়েকবার চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে শাওনকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল যে সে জীবনে কখনও নিজের, শরীরে আগুন লাগাবে না। রাজুর ধারণা ছিল প্রতিজ্ঞাটা করার পর আগুনালির নিশ্চয়ই একটু মন খারাপ হবে, কিন্তু দেখা গেল তার ঠিক মন-খারাপ হল না। একজন মানুষের তার জন্যে এত মমতা থাকতে পারে–ব্যাপারটা অনুভব করে হঠাৎ তার নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে লাগল।

আগুনালির খেলা শেষ হবার পর তারা কীভাবে ঢাকা ফিরে যাবে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকে। আগুনালি বলল যে খুব ভোরে একটা ট্রেন ছিল, সেটা চলে গেছে। পরের ট্রেনটা দুপুরে। রাজু বলল, “আমাদের সেটাই ধরতে হবে।”

সাগর বলল, “যদি শাওন আপুকে চিনে ফেলে?”

“কে চিনে ফেলে?”

“শাওন আপুর আব্বা?”

হঠাৎ করে সবাই চুপ করে গেল। গত রাতে শাওনকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর কী হয়েছে কেউ জানে না। তারা চলে আসার পর দরজাটা ভেঙে নিশ্চয়ই সবাই ভিতরে ঢুকেছে। যখন দেখেছে ভিতরে শাওন নেই তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে গেছে। তখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। দারোয়ানটা আগুনালিকে খুব ভালো করে দেখেছে, সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আগুনালি বারবার নাহার মঞ্জিলে গিয়ে সে তার গোরু খোঁজাখুঁজি করেছে তার পিছনে আসলে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। আগুনালিকে একবার দারোয়ানটা রাজু আর সাগরের সাথেও দেখেছিল। তখন সেটা দেখে হয়তো কিছু মনে করেনি, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। তারা একসাথে ঘোরাঘুরি করেছ, দুই মাথাওয়ালা গোরু দেখতে গিয়েছে, বাজারে রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়েছে–তখন আবার আগুনালি সবাইকে বলে বেড়িয়েছে রাজু আর সাগর মাস্টার সাহবের ভাগনে। কাজেই কেউ যদি ভালোভাবে খোঁজাখুঁজি করে করে তাদেরকে খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই জানতে পারবে না, এক-দুইদিন লেগে যাবার কথা। কিন্তু আর দেরি করে লাভ নেই–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা চলে যেতে হবে।

সাগর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “যদি শাওন আপুর আব্বা দেখে ফেলে তখন কী হবে?”

রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তখন অনেক বড় বিপদ হবে।”

“শাওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, অনেক বড় বিপদ।”

“কাজেই এখন আমাদের কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না কিছুতেই না।”

“যদি কেউ আমাদের ধরতে চায় তা হলে সে রেলস্টেশনে আর বাসস্টেশনে অপেক্ষা করবে।”

“কেন?”

“কারণ তারা নিশ্চয়ই জানে আমরা ঢাকা যাব। আর ঢাকা যাবার উপায় কী, ট্রেন নাহয় বাস।”

“তা হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে!”

রাজু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ মুশকিল হয়ে যাবে। আমাদেরকে দেখলে হয়তো চিনবে না, কিন্তু শাওনকে তো চিনে ফেলবে।”

সবাই শাওনের দিকে তাকাল, সাগর মুখ ছুঁচালো করে বলল, “শাওন আপুর চেহারা এত সুন্দর, কেউ একবার দেখলেই ট্যারা হয়ে যাবে।”

রাজু চোখ পাকিয়ে সাগরের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। সাগর আবার বলল, “শাওন আপুকে ছদ্মবেশ করিয়ে নিলে কেমন হয়?”

“কী ছদ্মবেশ?”

“জুতা পালিশওয়ালা, না হলে কুলি, না হলে বাদামওয়ালা।”

সবাই আবার শাওনের দিকে তাকাল, সে জুতাপালিশ করছে কিংবা মাথায় করে সুটকেস টেনে নিচ্ছে কিংবা বাদাম বিক্রি করছে–ব্যাপারটা কেউ চিন্তাও করতে পারল না। রাজু আবার সাগরকে একটা ধমক দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আগুনালি বলল, “সাগর বুদ্ধিটা খারাপ দেয় নাই, যদি শাওন রাজুর শার্ট প্যান্ট পরে চুলগুলি কেটে নেয়—”

সাগর মাথা নাড়ল, “নাহ্! তবু শাওন আপাকে ছেলের মত লাগবে না। কলম দিয়ে যদি মোচ এঁকে দেওয়া যায়—”

“ধুর গাধা! রাজু এবারে একটা ধমক লাগাল। আজকাল তো অনেক ছেলে মাথায় বেসবলের টুপি পরে। সেরকম একটা টুপি পরে নিলেই হয়।”

ছেলের ছদ্মবেশ পরার পর তাকে দেখতে কেমন লাগবে সেটা পরীক্ষা করে দেখা হল, কিন্তু শাওনের চেহারার মাঝে মেয়ের ভাবটা এত বেশি যে, যতই চেষ্টা করা যাক কিছুতেই তাকে ছেলের মতো দেখানো গেল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সবাই হাল ছেড়ে দিল।

শাওনকে যখন ছেলে সাজানো গেল না তখন তাকে বড় একজন মহিলা সাজানো যায় কি না সবাই সে-চিন্তা করতে লাগল। শাড়ি পরিয়ে যদি লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে দেওয়া যায় তা হলে কেউ তার চেহারা দেখতে পারবে না। বুদ্ধিটা খুব খারাপ না, কিন্তু একটা সমস্যা, আজগর মামার বাসায় কোনো শাড়ি নেই। মামি মারা গেছেন বহু আগে, বসার ঘরে মামির একটা ছবি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাসায় কোথাও মামির কোনো একটা শাড়ি রয়ে যাবে তার কোনো আশা নেই জেনেও তার একটু খোঁজাখুঁজি করে দেখল। যখন কিছুই খুঁজে পেল তখন আগুনালি বলল, “একটা শাড়ি কিনে আনলে কেমন হয়?”

“শাড়ি? কিনে আনলে?”

“হ্যাঁ। বাজারে কাপড়ের দোকানে কত শাড়ি! সস্তা একটা কিনে আনলেই হয়।”

“সস্তা?” সাগর চিৎকার করে বলল, “সস্তা কেন?”

আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “ঠিক আছে, দামিই নাহয় কিনে আনলাম।”

শাওন মাথা নাড়ল, বলল, “না না, শুধু শুধু একটা দামি শাড়ি কেন কিনে আনবে? আমি শাড়ি ভালো করে পরতেও পারি না। সস্তা কিনে আনলেই হবে।”

“কী রঙের শাড়ি কিনব?” সাগর গলা উঁচিয়ে বলল, “লাল–লাল।”

রাজু মাথা নাড়ল, “না, লাল না। লাল শাড়ি সবার চোখে পড়বে। ম্যাটম্যাটে রঙের শাড়ি কিনতে হবে। নীল না হলে সবুজ। রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পারবে একটা শাড়ি কিনে আনতে?”

“না পারার কী আছে!”

দুপুরের ট্রেনটা ধরতে হলে এখনই একটা শাড়ি কিনে আনতে হবে, আগুনালি তাই তখন-তখনই রওনা দিল। বাজার থেকে শাড়ি কিনে রেস্টুরেন্টের ছেলেটাকে বলবে একটু বেশি করে খাবার পাঠাতে।

আগুনালি বের হবার পর রাজু আর সাগর তাদের ব্যাগ বের করে মাত্র সেখানে কাপড়-জামা রাখতে শুরু করেছে হঠাৎ দেখতে পেল কে যেন ছুটে ছুটে তাদের বাসার দিকে আসছে। রাজু আর সাগর অবাক হয়ে বাইরে গিয়ে দেখল আগুনালিই ছুটতে ছুটেতে ফিরে আসছে। বারান্দায় উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে!”

রাজুর হঠাৎ ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। ঢোক দিলে বলল, “কী সর্বনাশ?”

“একটা মাইক্রোবাস থেমেছে। বাসভরতি অনেকগুলি মানুষ–”

মুহূর্তে শাওনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আগুনালি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “মানুষগুলির হতে বন্দুক।”

“বন্দুক?”

“হ্যাঁ। মানুষগুলি নেমে বাসাটাকে ঘিরে ফেলছে।”

“ঘিরে ফেলছে?”

“হ্যাঁ, তাকালে মনে হয় দেখতে পারবে। আগুনালি ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে তাকাল এবং হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “ঐ দেখো!”

রাজু শুকনো গলায় বলল, “সবাই ভিতরে চলোতাড়াতাড়ি।”

সবাই ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। সাগর হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়, খানিকক্ষণ কান্না আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে হঠাৎ কেঁদে উঠে বলল, “এখন কী হবে?”

শাওন এতক্ষণ ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়েছিল, এবারে খুব ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসে নিজের হাঁটুর উপর হাত রেখে শূন্যদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাল। তারপর প্রায় শোনা যায় না সেরকম গলায় বলল, “একটা ব্লেড আছে?”

রাজু চমকে উঠে শাওনের দিকে তাকাল। শাওন চোখ সরিয়ে নিয়ে খুব নরম গলায় বলল, “আমার বাবা খুব ভয়ংকর মানুষ। তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। কত ভয়ংকর।”

কেউ কোনো কথা বলল না। শাওন চোখ তুলে বলল, “আমরা ধরা পড়ে গেছি। এখন আর কিছু করার নেই। আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে। আমাকে পেলে তোমাদের হয়তো কিছু বলবে না।”

তখনও কেউ কোনো কথা বলল না। শাওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা খুঁজে আমাকে একটা ব্লেড এনে দাও। প্লিজ দেরি কোরো না।”

রাজু আগুনালির দিকে তাকাকেই সে মাথা নিচু করে ফেলল। সাগর এতক্ষণ নিজের কান্না আটকে রেখেছিল, এবারে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রাজু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, যে-মানুষগুলি আস্তে আস্তে বাসাটাকে ঘিরে ফেলছে তারা আরও এগিয়ে এসেছে, তাদের চেহারা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মানুষগুলির চেহারা কী ভয়ংকর মুখে কোনোরকম অনুভূতির চিহ্ন নেই! হাতে নিশ্চয়ই কোনোরকম অস্ত্র ধরে রেখেছে, কিন্তু চাঁদরে শরীর ঢাকা, তাই অস্ত্রটা দেখা যাচ্ছে না। রাজু মানুষগুলিকে দেখে একবার শিউরে উঠল, কী ভয়ংকর ভাবলেশহীন চেহারা!

শাওন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেরি করে লাভ নেই রাজু। তোমার মামার শেভ করার ব্লেড নিশ্চয়ই আছে, খুঁজে দেখো। আমি লুকিয়ে রাখব নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”

রাজু শেষবারের মতো ব্যাপারটা চিন্তা করার চেষ্টা করে। সত্যিই কি তাদের কিছু করার নেই? কোনোভাবেই কি আর শাওনকে বাঁচাতে পারবে না? হঠাৎ করে তার মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে ওঠে। এতদূর আসার পর তাদের হেরে যেতে হবে? একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে না?

রাজু হঠাৎ শাওনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাওন”

শাওন রাজুর গলার স্বর শুনে চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে রাজু?”

“তুমি বলছ তুমি তো মরেই যাবে।”

“হ্যাঁ।”

“যে মরে যাবে তার তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই? তুমি কি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাও?”

শাওন অবাক হয়ে বলল, “কী চেষ্টা?”

“আমার মামার একটা মোটর-সাইকেল আছে। তুমি মোটর-সাইকেলে আমার পিছনে বসবে। লোকগুলি যখন খুব কাছে আসবে হঠাৎ দরজা খুলে মোটর-সাইকেলে করে আমরা বের হয়ে যাব।”

শাওন এমনভাবে রাজুর দিকে তাকাল যন সে ঠিক বুঝতে পারছে না রাজু কী বলছে। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি মোটর সাইকেল চালাতে পার?”

“একটু একটু পারি।”

“তুমি সত্যি সত্যি পারবে?”

রাজু সত্যি সত্যি পারবে কি না জানে না, কিন্তু সে মুখ শক্ত করে বলল, “একশোবার পারব।”

শাওন একবার আগুনালির দিকে তাকাল, আগুনালি মাথা নেড়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস বুদ্ধি!”

সাগর হঠাৎ চোখ মুছে উজ্জ্বল চোখে বলল, “হ্যাঁ ভাইয়া, হ্যাঁ। মামার বন্দুকটা বের করব?”

রাজু চমকে উঠল, সাগর সত্যি কথাই বলেছে, মামার একটা বন্দুক রয়েছে। আলমারিতে তালা মারা, কিন্তু কাঁচ ভেঙে ভিতর থেকে বের করে নেওয়া যেতে পারে। রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আগুনালি, দেখো তো বন্দুকটা বের করতে পার কি না–পারলে নিয়ে আসো।” তারপর শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো শাওন আমার সাথে।”

মোটর-সাইকেলের চাবিটা বের করে সে শাওনের হাত ধরে তাকে নিয়ে ছুটে চলল।

যে-ঘরটাতে মোটরসাইকেলটা রাখা সেটা এক কোণায়। সামনের দরজাটা ছিটকিনি নিয়ে লাগানো ছিল, রাজু সাবধানে সেটা খুলে নিল। এখন মোটর সাইকেল নিয়ে ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিলেই সেটা ছিটকে খুলে যাবার কথা। রাজু মোটরসাইকেলে বসে চাবি ঢোকাল। শাওন আগে কখনও মোটর-সাইকেলে চড়েছে বলে মনে হল না, সেখানে কেমন করে বসতে হয় সেটা দেখিয়ে দিতে হল। রাজু গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখো।”

শাওন মাথা নেড়ে বলল, “রাখব।”

রাজু স্টার্টারে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আগুনালি বন্দুকটা বের করতে পেরেছে কি-না কে জানে, যদি না পারে তা হলে এমনিতেই যেতে হবে। আর দেরি করা যাবে না। রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে মোটরসাইকেলে বসে থেকে যখন প্রায় স্টার্ট দিয়ে দিচ্ছিল তখন সে হঠাৎ দেখতে পেল আগুনালি আর সাগর ছুটে আসছে, আগুনালির হাতে মামার বন্দুকটা। কাছে এসে বলল, “কী করব এটা?”

রাজু বলল, “আমাদের কাছে দাও। বন্দুক দেখে যদি ভয় পায়”

“কেমন করে নেবে?”

“শাওনের পিঠে ঝুলিয়ে দাও।”

আগুনালি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে সেটা শাওনের পিঠে ঝুলিয়ে দিল। রাজু গলা নামিয়ে বলল, “আমরা যখন বের হব তখন সবাই আমাদের পিছুপিছু ছুটবে। সেই ফাঁকে তুমি সাগরকে নিয়ে বের হয়ে যেয়ো। বাসায় ভিতরে থেকো না, টিলার দিকে চলে যেয়ো।”

“যাব।”

“আর আমি চেষ্টা করব ঢাকার দিকে যেতে। রাস্তাটা কোনদিকে তুমি জান?”

“জানি। খুব সোজা রাস্তা। এই বাসার রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার গেলে বাজার। তখন ডান দিকের বড় রাস্তায় উঠে যাবে। সেটা ধরে সোজা পশ্চিম দিকে।”

“পশ্চিম কোনদিকে? আমি পূর্ব-পশ্চিম চিনি না।”

“ডানদিকে। সোজা ডানদিকে।”

“ঠিক আছে। আমরা তা হলে গেলাম।” রাজু আগুনালির চোখের দিকে। তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, “দোয়া কোরো।”

“করব।”

রাজু এবারে সাগরের দিকে তাকাল, তার দিকে চোখ মটকে বলল, “সাবধানে থাকিস।”

সাগর খুব সাবধানে চোখ মুছে মাথা নাড়ল। সে সত্যিই সাবধানে থাকবে।

রাজু তার স্টার্টারে লাথি দিতেই মোটর-সাইকেলটা গর্জন করে উঠল, সাথে সাথে সে অনুভব করল শাওন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, ঘাড়ের কাছে তার মুখটা রেখেছে, প্রায় তার গাল স্পর্শ করে আছে তার মুখ, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেবে আসছে, সব মানুষের শরীরে বুঝি একধরনের গন্ধ থাকে।

রাজু বাম হাতে ক্লাচটা শক্ত করে ধরে এক্সেলেটর ঘোরাল, মোটর সাইকেলটা হঠাৎ হিংস্র একটা জানোয়ারের মতো দাপিয়ে ওঠে, সে ক্লাচ ছেড়ে দিতেই সেটা প্রায় লাফিয়ে উঠে একটা ঝটকা দিয়ে সামনে ছুটে গেল, প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল দরজাকে। বিকট শব্দে দরজার পাল্লাগুলি ছিটকে খুলে যায় আর তার মাঝে দিয়ে রাজু গুলির মতো বের হয়ে আসে।

বাসার সামনে খানিকটা জায়গা অসমতল, সেখানের মোটর-সাইলেকটা একবার লাফিয়ে উঠে প্রায় কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পা দিয়ে সে কোনোমতে সামলে নিল। ঠিক তার সামনে দুইজন মানুষ কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল, তাদের মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন। রাজু মোটর-সাইকেলটা সোজা তাদের দিকে ছুটিয়ে নেয়, মানুষগুলি লাফিয়ে দুই পাশে সরে গেল। রাজু এক্সেলেটর ঘোরাতেই মোটর সাইকেলটা আবার গর্জন করে উঠে প্রায় লাফিয়ে উঠল এবং সবার চোখের সামনে দিয়ে সেটা তীব্র গতিতে বের হয়ে গেল।

শাওন মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল, ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। কিছু মানুষ ছোটাছুটি করছে, কিন্তু তাদেরকে আর ধরতে পারবে না। রাজু পা দিয়ে গিয়ার পালটে নেয় দ্রুত, দেখতে দেখতে মোটরসাইকেলের বেগ আরও বেড়ে যায়। খোয়া-ছড়ানো রাস্তায় সেটা ধুলো উড়িয়ে যেতে থাকে। রাজুকে শক্ত করে ধরে রেখে শাওন আবার পিছন দিকে তাকাল, দূরে আজগর মামার বাসাবাসার সামনে মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে। বাসাটাকে ঘিরে কিছু মানুষজন, কিন্তু তারা বাসটাতে উঠছে না, ছোটাছুটি করছে। কেন মানুষগুলি মাইক্রোবাসে উঠছে না বোঝা গেল হঠাৎ, বিশাল একটা আগুনের হলকা ভিতর থেকে বের হয়ে এল। আগুনালি নিশ্চয়ই তার তৈরি একটা বোমা ভিতরে ছুঁড়ে দিয়েছে।

রাজু রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই কিলোমিটার সামনে একটা বাজার, বাজারে গিয়ে ডানদিকে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে হবে। শাওন রাজুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “আগুনালি মাইক্রোবাসে বোমা মেরেছে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, আগুন জ্বলছে বাসে।”

“তাকে ধরতে পারেনি তো?”

“বোঝা যাচ্ছে না।”

রাজু একটা নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দেয়। এখন তার আর কিছু করার নেই। শাওনকে নিয়ে ঢাকার দিকে ছুটে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

বাজারের কাছে এসে সে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে আনল, রাস্তার পাশে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। একটা বাচ্চা ছেলে বিশাল একটা মোটরসাইকেল ছুটিয়ে নিচ্ছে আর তার পিছনে বসে আছে একটা ফুটফুটে মেয়ে। বাতাসে মেয়েটার চুল উড়ছে আর সে শক্ত করে ধরে রেখেছে ছেলেটাক। মেয়েটার পিঠে ঝুলছে একটা বন্দুক। অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য–তারা সত্যিই দেখছে কি না কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। ব্যাপারটা কী বোঝার আগেই মোটর-সাইকেলটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তাদের সামনে থেকে।

রাজু ডানদিকে ঘুরে রাস্তায় উঠে গিয়ে আবার মোটরসাইকেলের বেগ বাড়িয়ে দিল। রাস্তাটা অনেক ভালো, তার মনে হল সে বুঝি মোটর-সাইকেলকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সত্যি আর উড়িয়ে নেওয়ার দরকার নেই, আগুনালি যদি মাইক্রোবাসটাকে পুড়িয়ে দিতে পেরে থাকে তাদের বিপদ মনে হয় কেটে গেছে। এখন তাদের শুধু সরে যেতে হবে। যত দূর সম্ভব সরে যেতে হবে।

বড় রাস্তায় উঠে প্রথম কিছুক্ষণ রাজু আর শাওনের সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে ছিল। খুব ধীরে ধীরে তারা খানিকটা সহজ হল। মোটর-সাইকেলটা মোটামুটি ভালভাবে যাচ্ছে, রাস্তার দুপাশের গাছপালা হুশ হুশ করে বের হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে বিকট একটা ট্রাক সামনের দিকে থেকে ছুটে আসে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে রাজুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তবে বড় রাস্তায় ট্রাক বাস গাড়ির মাঝখানে সে আগেও সাইকেল চালিয়েছে, কাজেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে রাস্তার এক পাশে চলে এসে ট্রাকগুলিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তবে ওদের সমস্যা হল সম্পূর্ণ অন্যদিকে দিয়ে যেসব গাড়ি ট্রাক বাস তাদের পিছন থেকে আসছে তারা তাদের দেখে ব্যাপারটা কী হচ্ছে বোঝার জন্যে তাদের পাশে পাশে যাবার চেষ্টা করে। কৌতূহলী মুখ জানালা দিয়ে মাথা বের করে, কিছু একটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করে। তখন হয় রাজুকে এক্সেলেটর ঘুরিয়ে সামনে চলে যেতে হয়,

হয় ব্রেক করে পিছিয়ে আসতে হয়। তবু তারা মানুষের কৌতূহল থেকে উদ্ধার পাবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় খবর ছড়িয়ে পড়েছে, পুলিশের কানে যখন যাবে তখন তারাও কি চলে আসবে না? মানুষের যখন বিপদ তখন তো পুলিশের কাছেই যাবার কথা, কিন্তু এই ব্যাপারটায় পুলিশ কি তাদের পক্ষে, নাকি শাওনের বাবার পক্ষে?

রাজু যত ভালো করে মোটরসাইকেল চালাবে ভেবেছিল তার থেকে অনেক ভালো করে চালাচ্ছে। প্রথম প্রথম যেটুকু ভয় ছিল এখন তার একবিন্দুও নেই। যত সময় যাচ্ছে উলটো তার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যদি পিছন থেকে ধরতেও আসে সে এত জোরে চালিয়ে যেতে পারবে যে কেউ তাকে ধরতেও পারবে না। মনে হচ্ছে যদি সামনে একটা খানাখন্দ চলে আসে উড়ে বের হয়ে যেতে পারবে।

মোটর-সাইকেলে যেতে যেতে রাজু আর শাওন টুকরো টুকরো কথা বলতে শুরু করে, বাতাসের শব্দ, মোটরসাইকেলের গর্জন সব মিলিয়ে কথা শোনা যায় না, তাই চিৎকার করে করে কথা বলতে গচ্ছিল। জরুরি কথা চিৎকার করে বলা যায়, কিন্তু সাধারণ কথা চিৎকার করে বলা সহজ নয়। তবু তারা চেষ্টা করে যেতে থাকে–কে কোন ক্লাসে পড়ে, কোন স্কুলে যায়, রোল নম্বর কত, সবচেয়ে খারাপ লাগে কোন সাবজেক্ট পড়তে, সরল অঙ্ক এত কঠিন, কিন্তু সরল নাম কেন দেওয়া হল–তারা এই ধরনের কথাবার্তা চালিয়ে যায়। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য পালটে যেতে থাকে। প্রথমে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ছিল, ধীরে ধীরে সেগুলি পালটে গিয়ে গ্রামের দৃশ্য এসে যায়। রাস্তার দুপারে বিস্তীর্ণ সোনালি ধানক্ষেত, বিল, নদী, গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, গোরু নিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলে। এরকম পরিবেশ এলে মন ভালো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু রাজুর মন ভালো হয়ে যাচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে একটা চাপা ভয়–সবকিছু মিলিয়ে একধরনের অশান্তি। সাগরকে একা একা ছেড়ে এসেছে, আগুনালি আবার মাইক্রোবাসের ভিতর একটা বোমা ছেড়ে বসেছে, সেটা করতে গিয়ে তার আর কোনো বিপদ হল কি না, ধরা পড়ে গেল কি না? যদি ধরা পড়ে গিয়েই থাকে তা হলে কী অবস্থায় আছে, সাগরই-বা কী অবস্থায় আছে–সব মিলিয়ে ভিতরের চাপা দুশ্চিন্তায় একটুও শান্তি পাচ্ছে না। শুধু তাই না, শাওনের বাবার লোকজন তাদেরকে চলে যেতে দেখেছে, আগে হোক পরে হোক তাদের পিছুপিছু ছুটে আসবে। যখন ধরে ফেলবে তখন কী হবে? রাজু জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিল। যা হবার হবে–সে যেটা করেছে সেটা যদি না করত তা হলেও শাওনের সর্বনাশ হয়ে যেত। জেনেশুনে সে শাওনকে তো মারা যেতে দিতে পারে না– কিছুতেই না।

রাজু ঘণ্টাখানেক একটানা মোটর-সাইকেল চালিয়ে রাস্তার পাশে মোটর সাইকেলটা থামাল। গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে, একটু হাত-পা ছড়িয়ে হেঁটে শরীরটাকে ঠিক করে নেওয়া দরকার। ব্যাপারটা অবিশ্যি খুব সহজ হল না, দেখতে দেখতে তাদেরকে ঘিরে ছোট বাচ্চাদের একটা ভিড় জমে উঠল। শুধু তাই না, যেসব গাড়িকে তারা পার হয়ে এসেছিল তাদেরকে থামতে দেখে এইসব গাড়িও থেমে গেল। গাড়ি থেকে লোকজন নেমে এল কথা বলার জন্যে। রাজু ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে আবার মোটরসাইকেলে চেপে বসে, তার পিছনে শাওন। লোকজন তাদেরকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, কিন্তু রাজু না শোনার ভান করে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। ব্যাপারটা ভালো হল না খারাপ হল সে জানে না, কিন্তু তাদের আর কিছু করার নেই।

আরও ঘণ্টাখানেক যাবার পর রাজু আর শাওন মোটামুটি একই সাথে দুটি জিনিস টের পেল, তাদের খুব খিদে পেয়েছে এবং একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। ছেলেদের বাথরুমে যাওয়া খুব সোজা, একটা আড়ালে চলে গেলেই হল, কিন্তু একটা মেয়ের জন্য সত্যিকারের একটা বাথরুম খুঁজে বের করতে হবে।

খাওয়া এবং বাথরুমের জন্যে কোথাও হয়তো থামতেই হবে, সাথে বন্দুকটা থাকলে ব্যাপারটা সোজা হত, কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। কিছু-একটা বানিয়ে বলতে হবে, কারও জন্যে নিয়ে যাচ্ছে বা এই ধরনের কিছু। রাস্তার পাশে বাড়িঘর দেখে যখন রাজু থামবে-থামবে করছিল তখন হঠাৎ শাওনের ভয়-পাওয়া গলা শুনতে পেল, “রাজু!”

“কী হয়েছে?”

“পিছনে একটা মাইক্রোবাস!”

“কার মাইক্রোবাস?”

“দেখে একটু অন্যরকম লাগছে, কিন্তু মনে হচ্ছে আমার বাবার।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, আগুনে পুড়ে ময়লা হয়েছে বলে অন্যরকম লাগছে।”

“ভিতরে কয়জন?”

“বোঝা যাচ্ছে না।”

রাজু তার মোটর-সাইকেলের স্পীড বাড়িয়ে দিল, মাইক্রোবাসটা দেখতে দেখতে অনেক পিছনে পড়ে গেল, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে সেটা আবার তাদের ধরে ফেলল। সামনে রাস্তাটা খারাপ, রাজুকে তার স্পীড কমিয়ে আনতে হল, আর তখন মাইক্রোবাসটা একেবারে কাছে চলে এল। শাওন পিছনে তাকিয়ে শিউরে ওঠে–ড্রাইভারের পাশে বসে থেকে তার বাবা স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাওন কাঁপা গলায় বলল, “মাইক্রোবাসের আমার বাবা বসে আছে–”

রাজু তার ভিতরে একটা কাঁপুনি অনুভব করে, কিন্তু অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করে রাখল। আজগর মামার নির্জন বাসায় একদল মানুষ হামলা করে শাওনকে ধরে নিয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু পরিষ্কার দিনের বেলা রাস্তার উপর থেকে শাওনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে অন্য ব্যাপার। রাজু চিৎকার করে বলল, “শাওন, বন্দুকটা হাতে নাও।”

শাওন গত দুই ঘণ্টা মোটরসাইকেলের পিছনে বসে বসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, রাজুকে ধরে না রেখেই সে এখন বসে থাকতে পারে। দুই হাত ব্যবহার করে সে বন্দুকটা হাতে তুলে নিল।

রাজু আবর চিৎকার করে বলল, “মাইক্রোবাসটার দিকে বন্দুকটা ধরে রাখে, কিন্তু খবরদার গুলি কোরো না–”

“যদি আমাদের গুলি করে?”

“আমাদের করতে চাইলে এর মাঝে করতে পারত বন্দুক দিয়ে গুলি করতে ধাক্কা লাগে, উলটে পড়ে যাবে।”

“ঠিক আছে।”

রাজুর কথা শেষ হবার আগেই মাইক্রোবাসটা রাজুকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যাবার চেষ্টা করল, রাজু এক্সেলেটর ঘুরিয়ে স্পীড বাড়িয়ে ফেলল, সে সামনে যেতে দিতে চায় না।

মোটর-সাইকেলের স্পীড বেড়ে গেছে খুব বেশি, থরথর করে কাঁপছে। রাস্তা ভালো নয়–যে-কোনো সময় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। রাজু দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করে ধরে রাখে, বাতাসের ঝাঁপটায় চোখ খোলা রাখতে পারছে না। ঠিক তখন শিস দেবার মতো একটা শব্দ শুনতে পেল, সাথে সাথে শাওন চিলের মতো গলায় চিৎকার করে উঠল, “গুলি করছে আমাদের!”

রাজুর মেরুদণ্ড দিয়ে আবার একটা ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে যায়। মনে হয় সবকিছু চিন্তা করার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাচ্ছে, সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াটে আর অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। জোর করে সে মাথা ঠিক রাখল, তাকে এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হবে। কী হবে সে জানে না, কিন্তু কোনো ভুল যেন না হয়। তারা মাত্র দু’জন কিন্তু শাওনের বাবার দলে অনেক মানুষ। তাদের দিকে এখন দরকার আরও মানুষের, রাস্তার মানুষ, বাজারের মানুষ গ্রামের মানুষ

সামনে কিছু দোকানপাট দেখা যাচ্ছে, সেই পর্যন্ত কি সে পৌঁছাতে পারবে? রাজু আবার এক্সেলেটর ঘুরিয়ে দেয়, ঠিক তখন দ্বিতীয় গুলিটার শব্দ শুনতে পেল। মোটরসাইকেলের টায়ারে গুলি লেগেছে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, তার মাঝে অনেক কষ্ট করে তাল সামলাল রাজু, ব্রেক করল প্রাণপণে, পেছন থেকে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল শাওন। মোটর-সাইকেলটা বিপজ্জজনকভাবে একবার বামদিকে থেকে ডানদিকে গিয়ে রাস্তার মাঝামাঝি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ল রাজু আর শাওন। প্রচণ্ড জোরে আঘাত লেগেছে মাথায়, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে সে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে জ্ঞান হারাতে দিল না। চোখ খুলে তাকাল রাজু, শাওন উঠে দাঁড়িয়েছে তার আগে, তার চোখেমুখে একরকম অবিশ্বাসের দৃষ্টি। চারিদিকে ঘুরে তাকাল একবার, তারপর কাছে ছুটে এল, ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজু, কেমন আছ তুমি?”

রাজু ফিসফিস কলে বলল, “ঠিক আছি।”

সে কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করল, রাস্তার মাঝখানে মোটর-সাইকেলটা উলটো হয়ে পড়ে আছে, পিছনের টায়ারটা ফেটে গেছে, তার মাঝেই সেই চাকাটা ঘুরে যাচ্ছে কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে সেজন্যে! রাজু সামনে তাকাল, মাইক্রোবাসটা থেমেছে সামনে আর দরজা খুলে নেমে এসেছে শাওনের বাবা। তার পিছুপিছু আরও অনেকগুলি লোক। মানুষগুলি ছুটে আসছে তাদের দিকে, একবার ধরে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাজু উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু উঠতে পারল না, কোথায় জানি বেকায়দা ব্যথা লেগেছে, কিছু একটা ভেঙে গেছে কোথাও।

শাওন শূন্যদৃষ্টিতে একবার সামনে তাকাল, তারপর রাজুর দিকে তাকাল। রাজু ফিসফিস করে বলল, “বন্দুক।”

শাওন হঠাৎ যেন জ্ঞান ফিরে পেল, বন্দুকটা পড়ে আছে একটু দূরে হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। তাদের ভাগ্য ভালো গুলি বের হয়নি। শাওন বন্দুকটা হাতে তুলে নিয়ে রাজুর কাছে ছুটে আসে, রাজু তখন কোনোমতে উঠে বসেছে হাঁটুতে ভর দিয়ে। রাজু আবার ফিসফিস করে বলল, “বন্দুকটা ওদের দিকে ধরো আমার ঘাড়ে রেখে এইম করো।”

শাওন রাজুর পিছনে বসে পড়ে বন্দুকটা তার বাবার বুকের দিকে তাক করে রাখল।

শাওনের বাবা লম্বা পায়ে হেঁটে আসছিল, হঠাৎ করে বন্দুকটা দেখে থেমে গেল। শাওন চিৎকার করে বলল, “আর এক পা এলে গুলি করে দেব।”

শাওনের বাবা থেমে গেল, তার ফরসা মুখ আস্তে আস্তে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁতে ঘসে বলল, “বেতমিজ মেয়ে–”

শাওন চিৎকার করে বলল, “চুপ করো তুমি চুপ করো!

রাজু কোনোদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারে তাদের ঘিরে ভিড় জমে উঠছে। রাস্তায় গাড়ি থেমে যাচ্ছে, গাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার নেমে আসছে। ট্রাক থেকে ট্রাক-ড্রাইভাররা নেমে আসছে। দোকানপাট থেকে মানুষ ছুটে আসছে। ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা বাচ্চা মেয়ে তার বয়সী একটা ছেলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সম্ভ্রান্ত চেহারার একজন মানুষের দিকে তাক করে রেখেছে–দৃশ্যটি অকল্পনীয়। কেউ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

শাওনের বাবা হুঙ্কার দিয়ে বলল, “ফারজানা–”

”আমি ফারজানা না। আবার নাম শাওন।”

শাওনের বাবার মুখ অসহ্য ক্রোধে বিকৃত হয়ে গেল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রাখল। তাদেকে ঘিরে যেসব মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

শাওনের বাবা শান্ত গলায় বলল, “আমার মেয়ে। বদ ছেলের পাল্লায় পড়ে কী করেছে দেখেন। দেশে আইন নেই? এই বয়সী ছেলের হাতে বন্দুক? মোটর সাইকেল?”

মানুষজনের মাঝে একটা গুঞ্জন শোনা যায়, আজকালকার ছেলেরা যে অসম্ভব পাজি হঠাৎ করে সে-বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকে না। শাওনের বাবা গলা উঁচিয়ে বলল, “আপনারা যারা আছেন তারা মেয়েটার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেন দেখি—”

এরকম সম্ভ্রান্ত চেহারার একজন মানুষের কথা শুনে কয়েকজন সত্যি সত্যি পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসছিল, তখন হঠাৎ শাওন চিলের মতো চিৎকার করে উঠল, “খবরদার! ঐ মানুষটা আসলে জানোয়ার। সে রাজাকার। তার বাবা রাজাকার-আমাকে মায়ের কাছে থেকে ধরে এনেছে–খবরদার কেউ কাছে আসবে না।”

যারা কাছে এগিয়ে আসছিল তারা হঠাৎ থেমে গেল। শাওনের মতো ফুটফুটে চেহারার একটা মেয়ে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে না। শাওন আবার চিৎকার করে বলল, “আমাকে বেঁধে রেখেছিল–আমি পালিয়ে এসেছি। মায়ের কাছে যাচ্ছি–এরা এসেছে আমাকে ধরে নিতে।”

কমবয়সী একজন মানুষ হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে শাওনের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”

শাওনের বাবা কিছু বলার আগেই শাওন বলল, “সত্যি। আমার কথা বিশ্বাস করলে আমার মাকে জিজ্ঞেস করেন। পুলিশ ডেকে আনেন–ঐ লোকটার কথা বিশ্বাস করবেন না। সে জানোয়ার। রাজাকার”

একটি বাচ্চা মেয়ে যদি পুলিশকে ডেকে আনতে বলে নিজের মাকে ডেকে আনতে বলে, সে নিশ্চযই বদ ছেলের পাল্লায় পা বখে-যাওয়া মেয়ে হতে পারে না। উপস্থিত লোকজন হঠাৎ করে শাওনের পক্ষে চলে আসে। শাওন আবার চিৎকার করে বলল, “আমাদের ধরে নেয়ার জন্যে দেখেন সে আমাদের গুলি করেছে–”

রাজু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শাওনের বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষটির মুখে পরাজয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বুঝতে পেরেছে সবাই শাওনের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তার মুখে প্রথম ক্রোধ, তারপর ঘৃণা, এবং সবার শেষে একধরনের বিচিত্র জিঘাংসার চিহ্ন ফুটে উঠল। রাজু মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করে। হঠাৎ করে মানুষটি সত্যি সত্যি দানবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে মুখে চেহারায় একটা হিংস্র পশু বের হয়ে আসে। মানুষটি হঠাৎ শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বের করে আনে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লম্বা পা ফেলে এসে শাওনের মাথার দিকে তাক করে ধরল। রাজু মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, আর হঠাৎ করে বুঝতে পারল সে ভয় দেখানোর জন্যে শাওনের মাথায় রিভলবারটি ধরেনি, গুলি করার জন্যে ধরেছে। শাওনকে মানুষটি মেরে ফেলবে। আর একটিমাত্র মুহূর্ত, তারপর শাওন আর্তনাদ করে পিছনে পড়ে যাবে, কেউ আর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কেউ পারবে না। আর একটিমাত্র মুহূর্ত। মাত্র একটি মুহূর্ত।

সেই একটি মুহূর্ত যেন হঠাৎ বিশাল মহাকালের মতো বিস্তৃত হয়ে গেল। রাজু দেখতে পেল ট্রিগারে আঙুল চেপে বসেছে, দেখতে পেল রিভলবারের সকেট ঘুরতে শুরু করেছে, দেখতে পেল রিভলবারের হ্যাঁমার পিছন দিকে সরে যাচ্ছে, দেখতে পেল মানুষটির মুখে কুশ্রী একটা আত্মতৃপ্তির হাসি লেপটে যাচ্ছে, আর সেইসব কিছু দেখতে দেখতে হঠাৎ রাজুর সমস্ত যন্ত্রণা যেন উবে গেল ম্যাজিকের মতো। হঠাৎ করে তার শরীরে যেন চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা এসে ভর করল। তার সমস্ত শরীর হঠাৎ ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে উঠল, তারপর ক্রুদ্ধ গোখরো যেমন করে ছোবল দেয় ঠিক সেইরকম আক্রোশ নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল দানবটির দিকে। সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করল মানুষটির রিভলবার-ধরা হাতটিকে।

প্রচণ্ড একটা শব্দ শুনতে পেল রাজু, সাথে সাথে ভয়ংকর একটা আঘাতে ছিটকে পড়ল নিচে। গুলি লেগেছে তার শরীরে। কোথায় লেগেছে গুলি? ব্যথা করছে না কেন তার? রাজু চোখ খুলে তাকাল, রাস্তায় শুয়ে আছে সে, উপরে আকাশ। কী সুন্দর নীল আকাশ! আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ টের পেল তার শরীর ভিজে যাচ্ছে উষ্ণ রক্তে। উপুড় করে রাখা বোতলের মতো গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রাজু তার হাতটা রাখল বুকে, হাত ভিজে গেল রক্তে। সে চোখের সামনে এনে ধরল তার হাত, টকটকে লাল হয়ে আছে তার হাত। রক্ত এত লাল হয়? কী আশ্চর্য!

রাজু হাত নামিয়ে এনে চোখ বন্ধ করল। ভয় নয়, আতঙ্ক নয়, কষ্ট বা যন্ত্রণা নয়, ক্লান্তি লাগছে তার। কী অমানুষিক ক্লান্তি–সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে সেই ক্লান্তিতে। কেউ যেন তাকে ডাকছে বহুদূর থেকে। খুব চেষ্টা করে চোখ খুলল রাজু। তার উপর ঝুঁকে আছে শাওন। চিৎকার করে ডাকছে তার নাম ধরে। রাজু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। শাওনের দিকে, কী সুন্দর দেখতে মেয়েটি! আহা, কী সুন্দর! সে কি তাকিয়ে থাকতে পারবে শাওনের দিকে? নাকি আবার তার চোখ বন্ধ হয়ে আসবে?

রাজু শাওনের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল সে ডাকছে তার নাম ধরে, “রাজু-রাজু-রাজু-”

রাজুর ইচ্ছে করল বলতে, এই তো আমি কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। সে শাওনের দিকে তাকিয়ে রইল, দেখল সে এখনও চিৎকার করে ডাকছে, কিন্তু তার কথা আর শোনা যাচ্ছে না। শুধু তাকে দেখছে, কিন্তু কিছু আর শুনতে পারছে না। মানুষজনের চিৎকার হৈচৈ কোলাহল কিছু নেই। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে শুধু আশ্চর্য সুমসাম নীরবতা।

এটাকেই নিশ্চয়ই মৃত্যু বলে–এমন কিছু তো খারাপ নয়।

শাওন অবাক হয়ে দেখল রাজুর মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *