শেষ পর্ব
সুদীর্ঘ ষাট দিন, অর্থাৎ দু মাস পর।
হাঁসুলী বাঁকের চারিপাশে কোপাই নদীর বাঁকে বকে বিচিত্র শব্দ উঠছে। খটখটখটখট। সে শব্দ ছুটে চলে যাচ্ছে নদীর গর্ভের মধ্য দিয়ে; ছুটে গিয়ে ওদিকের বাঁকের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আবার এদিকে ফিরে আসছে। অকস্মাৎ শান্ত হাঁসুলী বাক শব্দমুখর হয়ে উঠেছে।
রোগশয্যার উপর বনওয়ারী আজ উঠে বসল। ষাট দিন শয্যাশায়ী ছিল; তার মধ্যে পঞ্চাশটা দিন কেটেছে চৈতন্যহীন অবস্থায়। চামড়া-ঢাকা মোটা হাড়ের কাঠামোখানা শুধু নিয়ে কোনোমতে সে উঠে বসল আজ।
ষাট দিন আগে কোপাইয়ের কূল থেকে জ্বরে অচেতন অবস্থায় কাহারেরা তুলে ঘরে এনেছিল। কারণ কেউ জানে না। বনওয়ারীর কিছু বলবার অবস্থা ছিল না। তবে প্রলাপের মধ্যে শুধু চিৎকার করেছে—বাবাঠাকুর, অক্ষা কর। আর চিৎকার করেছে—ওই কালোশশী, ওই গোপাল! আঃআঃ-ওরে আমি যে উড়তে পারি না!
চিকিৎসা! সে না-চিকিৎসা। জাঙলের সদূগোপ কবিরাজের ওষুধ। কবিরাজ ষাট দিনের মধ্যে পাঁচ দিন ঘাড় নেড়ে বলেছেন-রাত পার হবে না বাপু।
তবু বনওয়ারী বেঁচে উঠে বসল। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনের মধ্যে সবল জীবনীশক্তিআহরণকরা কাহার-মাতব্বরের জীবন, এত সহজে যাবার নয় বলেই বাঁচল। কিন্তু না বেঁচে এর চেয়ে মরলেই বোধহয় ভাল হত। বনওয়ারী আজ নিজেই বললে এ কথা।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শেষ হয়ে গিয়েছে। আর তার বেঁচে লাভ কি? কেন বাচালি। আমাকে?—বলে বার বার সে গভীর হতাশায় ঘাড় নাড়লে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল হাঁসুলী বাঁকের মাটির বুকে।
কথাটা বনওয়ারী সত্যই বলেছে।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বোধহয় শেষ হয়ে গেল। চিরকালের মত শেষ হয়েছে কি না, সেকথা বলা অবশ্য যায় না; কিন্তু এ কথা ঠিক যে, শেষ হয়েছে বা হবে-হবে করছে।
পাপের ফলে দেবতা চলে গেলেন। বাবাঠাকুর চলে গিয়েছেন, কালারুদ্রের মন্দিরে যুদ্ধের আপিস বসেছে। কালারুদ্রও চলে গিয়েছেন। যুদ্ধকাল যুদ্ধ!
বনওয়ারীই বললে। মৃদুস্বরে গভীর দুঃখের সঙ্গে কথাটা উচ্চারণ করলে, বলতে বলতে চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়ল। বললে—যুদ্ধ লেগেই হালীর বাককে সেরে দিয়ে গেল। হতাশভাবে ঘাড় নাড়লে। মর্মান্তিক আক্ষেপ যেন ঘাড় নেড়ে সমস্ত হাঁসুলী বাঁকে ছড়িয়ে দিতে চাইলে সে।
পঞ্চাশ দিনে জ্বর ছেড়েছে, কদিন থেকেই অল্পস্বল্প চেতনা হচ্ছিল তার। কিন্তু সকল ইন্দ্রিয় ক্ষীণ দুর্বল। চোখ মেলে চেয়ে দেখেও যেন কিছু বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার চোখের পাতা কিছুর ভারে যেন নেমে পড়ে সে ঘুমিয়ে পড়ছিল। ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে চেতনা স্পষ্ট হয়ে এল।
তার বিছানা—বিছানা একখানা ঘেঁড়া কথা—সেই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নসুবালা। হ্যাঁ তো, নসুবালাই। চেতনা হওয়ার প্রথম দিন থেকেই সে শুধু তাকেই দেখছে। সে গোঁফকামানো মুখ, মেয়েদের মত ভঙ্গিতে ঘেঁড়া ময়লা শাড়ি পরা, মাথায় খোপা বাঁধা, হাতে চুড়ি নোয়া শাখা পরা নসুবালা তার বিছানার পাশে অহরহ রয়েছে। সুবাসীকে দেখতে পাচ্ছে না। প্রথম কয়েকদিন মনে কোনো প্রশ্ন জাগে নাই, শুধু অতিপরিচিত কাউকে যেন পাচ্ছে না বলে মনে হয়েছিল। আর একজনকে মধ্যে মধ্যে আবছা চিনতে পারছিল পাগলকে। পাগল? মিতে?
প্রথম দিন সে চোখ মেলে চাইতেই সুবালা তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিল—সোর হয়েছেন? চিনতে পারছ আমাকে?
না। ঘাড় নেড়েছিল বনওয়ারী। তারপর পাগল এসে পাশে বসেছিল। ব্যানো! বলে পরম স্নেহে তার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়েছিল। বনওয়ারী তবুও তাকে চিনতে পারে। নাই।
দ্বিতীয় দিন সে পাগলকে চিনেছিল। নসুবালাকে দেখে প্রশ্ন করেছিল—সুবাসী? নসু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিল।
তৃতীয় দিনে নসুকে চিনেছিল, বলেছিল—নসুবালা?
নসু একমুখ হেসে বলেছিল—চিনতে পেরেছ আমাকে? আঃ, বাঁচলাম! পরানট আমার উদ্যাগে খলবল করছিল। আঃ, সেই শূরবীর মানুষ গো!
তারপর এদিক-ওদিক চেয়ে খুঁজে না পেয়ে বনওয়ারী জিজ্ঞাসা করেছিল—সে কই?
কথাটা শুনেই পাগল উঠে চলে গিয়েছিল। নসু প্রশ্ন করেছিল—কে?
—সুবাসী।
—সে আছে। আসছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নসুবালা বলেছিল—গিয়েছে কোথা। আসবে।
কিন্তু সুবাসী এল না। সমস্ত দিন চলে গেল—তবু এল না। বনওয়ারী বুঝতে পারলে এবার। আর জিজ্ঞাসা করলে না সে। কাহারপাড়ার উপকথার ধারা তো সে জানে। শুধু কাদলে খানিকটা। নসু বললে কেঁদো না। চোখ মুছিয়ে দিয়ে একটু জল দিলে তার মুখে, বললে— জল খাও এক ঢোক। তারপর ছড়া কাটলে—‘বেঁচে থাকুক চুড়োবাঁশি, রাই হেন কত মিলবে দাসী’। ঝাটা মারি তার মুখে।
বনওয়ারী আর কোনো প্রশ্ন করে নাই। তার মনেও পড়েছে সব, দশ দিনে তার বুদ্ধি এবং অনুমানশক্তির মধ্যে সজীবতা এসেছে। সুবাসী কোথায় সে কথা সে কল্পনা করতে পারছে। চুপ করে শুয়ে শুধু ভাবলে আপনার যত পুরনো কথা। এই যে অবস্থা তার হয়েছে এমন যে হবে, এ কোনোদিন সে মনে ভাবে নাই। আজকের এই দিনে ন ছাড়া আর তার কেউ নেই। তার এই দিনগুলির জন্যেই কি বাবাঠাকুর দয়া করে নসুকে নারীর স্বভাব দিয়ে গড়েছিলেন? গড়ে বলেছিলেন—আমি যখন চলে যাব হাঁসুলী বাঁক ছেড়ে, বনওয়ারী যখন কুটোর মত তুচ্ছু লোক হবে, তখন তার ভার নেবার জন্যেই তোকে গড়লাম?
খট-খট-খট-খট! খটাং, খটাং খটাং! শব্দ ছুটে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। আজ মনে হল— খটখটখটখট করে কিসের একটা শব্দ উঠছে। শব্দটা বোধহয় চেতনা হওয়ার পর থেকেই। শুনছে, কিন্তু ওদিকে শব্দটা খুব স্পষ্ট ছিল না, কানে সে শুনতে পেত না; মনটাও ওদিকে যেত না। মন শুধু এ কদিন খুঁজে ফিরছে পুরনো কথা। আজ সে পুরনো কথা খুঁজে পেয়েছে। সব মনে পড়েছে। কানেও আজ শুনতে পাচ্ছে। শব্দটা আজ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল। আজ যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। অনবরতই শব্দ উঠছে। নিঝুম তেপান্তরের মাঠে কে যেন কাঠের উপর কিছু ঠুকেই চলেছে—খটখটখটখট!
কোপাইয়ের বাঁক থেকে শব্দটা ঘুরে আসছে—খট-খট-খট-খট-খটাং, খটাং, খটাং! সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত–খটাং, খটাং, খটাং!
সে একলা শুয়ে ছিল ঘরে। শব্দটা শুনে শুনে তার মনে প্রশ্ন জাগল।
সে ডাকল–নসু! পাগল!
কেউ উত্তর দিলে না। ধীরে ধীরে সে চোখ বন্ধ করলে।
কি রকম যেন! কোথাও মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নাই, কেউ চিৎকার করে কাউকে। ডাকছে না, কেউ কাঁদছে না, কেউ হাসছে না, কেউ ঝগড়া করছে না, গাই বাছুরকে ডাকছে। না, বাছুর মাকে ডাকছে না। ছেলে-ছোকরারাও কি গান ভুলে গেল?
কেবলই শব্দ উঠছে—খট-খট-খট-খট-খটাং-খটাং-খটাং–
শুধু খট-খট খটাং-খটাং নয়। গোঁ-গোঁ গোঁ-গোঁ! উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে বোধহয়। শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ল বনওয়ারী। এর পরের দিন বহিঃপ্রকৃতি সম্বন্ধে সে সচেতন হয়ে উঠল। বললে—দরজাটা ভাল করে খুলে দে দেখি। দিনমণিকে একবার দেখি, ওঠ দেখি। তারপর সে প্রশ্ন করলে পুলের ওপর গাড়ি যেছে, লয়! এরই কিছুক্ষণ পর আবার সেই শব্দ উঠতে লাগল—খটখট খটখট খটাং-খটাং ভুরু কুঁচকে সে নসুর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলে—কি ন? শব্দ?
–বাঁশ কাটছে?
বাঁশ কাটছে? সকাল থেকে সন্জে পর্যন্ত প্রতিদিনই বাঁশ কাটছে? হবে। জাঙলের ঘোষ মহাশয়েরা মালিক, ঘরদোর ছাওয়ানোর সময়। হবে।
কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
খাবার সময় নসু তাকে ডাকলে—সবটুকুন খাও।
শব্দ উঠছে—খটাং-খটাং!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে সে। ভাবতে লাগল সুবাসীর কথা, তার দশার কথা, করালীর কাছে তার সেদিনের নিষ্ঠুর পরাজয়ের কথা। চোখ দিয়ে ফেঁটা ফেঁটা জল পড়তে লাগল। লুকাবার জন্য সে বিছানায় নিস্পন্দের মত পড়ে রইল।
বিকালে পাগল ডাকলেওঠ ভাই, দুটো কথা বল।
বনওয়ারীকে সে-ই ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিলে। এইবার তার কানে এল খটাং-খটাং খটাং-খটাং! শব্দ ছুটছে হাঁসুলী বাঁকের এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক।
পরের দিন আবার শব্দ উঠতে লাগল। খটখটখটাং
সে আজ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলে—আজও বাঁশ কাটছে নসুবালা? এত বাঁশ কে কাটছে? নির্মূল করলে বাঁশগুলান!
পাগল বললে—যুদ্ধের ঠিকেদারেরা তামাম বাঁশ কিনেছে ভাই, জাঙলের সদ্গোপেরা বেচেছেন। টাকায় দুটি বাঁশ। তারাই কাটছে বাঁশ।
টাকায় দুটি বাঁশ? টাকায় আটটা বাঁশ দুটি দরে বিক্রি হচ্ছে? যুদ্ধর ঠিকেদারে সব বাঁশ কাটছে? হে ভগবান! এ কি হল? আগুন লেগে গেল দেশে? কিন্তু কেন?
আকাশের দিকে মুখ তুলে পাগল বললে—পিথিমীতে ভীষণ যুদ্ধ লেগেছে, এমন যুদ্ধ ভূভারতে কখনও হয় নাই। জাপানিরা খুব যুদ্ধ চালিয়েছে। কলকাতায় বোমা মেরে ভেঙে চুরমার করছে। সেখানকার লোকে কুকুর বিড়ালের মত পালিয়ে এসেছে। চন্ননপুরের কুঁড়ের ভাড়া পাঁচ গণ্ডা টাকা! চন্ননপুরে ঘর না পেয়ে জাঙলে সদ্গোপদের বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দশ-বার ঘর কলকাতার লোক। চালের মন চল্লিশ টাকা, ধানের মন চব্বিশ টাকা। আরও নাকি নানান দেশ থেকে লোকেরা পালিয়ে আসবে। যাবে শুনেছি চন্ননপুরের রেললাইনের পাশের পাকা সড়ক দিয়ে। কাটোয়া দুমকা হয়ে চলে যাবে পশ্চিম দেশে। তারা পথে চন্ননপুরে থাকবে; জিরোবে দুদিন, তার জন্য বাঁশের ঘর তৈরি হচ্ছে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পাগল আবার বললে—সে-ই ভাই, সে সন্ধান দিলে বাঁশবাঁদির বাঁশের, হাঁসুলী বাঁকের কাঠের। সেই করালী! সব্বনেশে করালী!
হ্যাঁ।
-হ্যাঁ, সেই তো দেবে। তার ধরমই তো এই। কেউ গড়ে, কেউ ভাঙে। আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে–চন্ননপুরে তা হলে খুব জমজমাট।
—খুব।
হাত-পা নেড়ে ভঙ্গি করে নসুবালা বললে—সে একখানা বড় গেরাম, বুল্লে কিনা! তার মধ্যে দশ-দশটা কাহারপাড়া ঢুকে যায়। বাবা রে, বাবা রে, বাবা রে, সে কত কাণ্ড গো! তার জন্যে ইদারা হয়েছে, ডাক্তার বসেছে, পাঁচ শো মন চিড়ে তৈরি করে এখেছে, জালায় জালায় মন মন গুড় এখেছে। সেইসব ঘরের জন্যে বাঁশ কাটছে। তা’পরেতে উত্তরে যে এললাইন বসেছে, সেখানে উড়োজাহাজের আস্তাবল হয়েছে, সেখানে সব কি হচ্ছে, তাতে বাঁশ লাগবে। সরকার থেকে হুকুম হয়েছে–বাঁশ দিতে হবে, দাম যা চাও লাও। বড় বড় গাছ কেটে কাঠ করে আখছে আন্নাবান্নার জন্য।
অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগল বনওয়ারী। বুঝতে পারলে না। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় এ কখনও ঘটে নাই। বান এসেছে, ঝড় এসেছে, গায়ে আগুন লেগেছে, মড়কও হয়েছে, পৃথিবীও কেঁপেছে—তাও আছে হাঁসুলী বাঁকের উপকথায়। দাঙ্গা আছে, ডাকাতি আছে, কালোবউ, বড়বউয়ের প্রেতাত্মা আছে, কিন্তু যুদ্ধ নাই। সে যুদ্ধে হাঁসুলী বাঁকের তন্দ্ৰা নষ্ট হয়, উপকথায় ছেদ পড়ে, এখনকার মানুষের জীবনস্রোত পৃথিবীর জীবনস্রোতের আকর্ষণে ইতিহাসের ধারায় মিশে যায়, সে যুদ্ধ উপকথার কল্পনায় নাই। বাবাঠাকুর কখনও বলেন নাই, স্বপ্ন দেন নাই। কালারুদূও কখনও জানান নাই। কি করে জানবে তারা? স্থূলমস্তিষ্ক হাঁসুলী বাঁকের মানুষ বিরাটদেহ বনওয়ারী, যে কাধ বেঁকিয়ে চলে, ধপধপ শব্দ ওঠে যার অতিকায় পায়ের সবল পদক্ষেপে, তার মস্তিষ্কে এ কিছুতেই ঢুকল না।
পরদিন আবার শব্দ উঠতে লাগল। বনওয়ারী বললে—আমাকে একবার বাইরে নিয়ে যাবি নসু?
–বাইরে যাবা?
–হ্যাঁ। একবার মা-জনুনীকে দেখি।
–মা-জনুনী?
–হ্যাঁ রেআমার হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাঁদি মা-জনুনীকে একবার দেখি, কি দশা করলে তার? আঃ-আঃ! বুক ফেটে আক্ষেপ বেরিয়ে এল তার।
—যেতে পারবা?
–ধর, খুব পারব আমি। সে নিজেই উঠে বসল। উঠে দাঁড়াল। মটমট শব্দ করে উঠল দীর্ঘদিন শুয়ে-থেকে জাম-ধরা মোটা হাড়গুলি।
খাঁখাঁ করছে চারিদিক, খাঁখাঁ করছে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাঁদির বাঁশবন নির্মূল হয়ে গিয়েছে। শুধু বাঁশবন নয়, বড় বড় বটগাছ অশ্বথ গাছ পর্যন্ত নাই। ঘর থেকে বার হতেই তীব্র আলো চোখে এসে লাগল। আকাশের কোলে এতটুকু সবুজ নাই। এখানে-ওখানে রয়েছে শুধু দুটো-চারটে শীর্ণকায় পল্লবহীন শিরীষ-শ্যাওড়া বেলগাছ। কোথাও কোনো ছায়া নাই, চোখে এসে লাগে ছটা, চারিদিকে খটখট করছে মাঘের রৌদ্র। চারিদিকে দেখা যাচ্ছে নদীর কিনারা পর্যন্ত হাঁসুলী বাঁকের বেড়। নদী পার হয়ে ওপারে দেখা যাচ্ছে গ্রাম-গ্রামান্তর। পথ চলে গিয়েছে কোন্ দেশ দিয়ে। সে হাঁসুলী বাঁকের কোনো চিহ্নই আর নেই যেন। গায়ে ঢুকে ছায়ার নেশায় একটা কেমন ঢুলুনির ঘোর লাগত। ছায়ায় ছায়ায় চলতে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবনা ভাবতে ভাল লাগত। বাঁশবনের আর বট-অশ্বথের ঘন ছায়া মুছে যাওয়ার সঙ্গে সেসব ঘুচে গেল। আর গাছতলায় বসে চোখে তন্দ্ৰা নামবার অবকাশ হবে না, ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার স্বপ্ন রচনার ঠাঁই রইল না।
ফিরে তাকালে সে বাবাঠাকুরের থানের দিকে। বাবাঠাকুরের থান, আর তার মধ্যে ছিল আটপৌরে-পাড়ার সেই বটগাছটি, যার তলায় আলো নিবিয়ে দিয়েছিল কালোশশী, যার তলায় সুবাসীকে দেখে তার কালোশশী বলে ভ্রম হয়েছিল। কই সে গাছ? বাবাঠাকুরের থানই-বা। কোন দিকে? ওটা কোন জায়গা? এত মোটর গাড়ি কিসের? কাদের? চন্ননপুরের কারখানাটা এগিয়ে এল? গো-গো শব্দ করছে কখানা গাড়ি। কি বিশ্রী ধোঁয়ার গন্ধ! এখন পর্যন্ত এসে বনওয়ারীর নাকে ঢুকছে।
সে অসহায় আর্তের মত পাগলের দিকে চেয়ে বললে—পাগল, এ যে আমি কিছু ঠাওর পেছি না ভাই। বাবাঠাকুরের থান কোথা গেল? ওটা কোন্ জায়গা? এত গাড়ি? পাগল?
–ওই তো ভাই! বাবাঠাকুরের থান তো আর নাই। যুদ্ধর মটরগাড়ির আড্ডা হয়েছে।
চিহ্ন নাই বাবাঠাকুরের স্থানের বেলগাছ নাই, বদরলাঠির গাছটি নাই, কুলগাছের ঝোপগুলি নাই, আলোকলতা নাই, তালগাছের বেড় নাই। লাল কাকর বিছানো চত্বর চারিপাশের সাদা রঙ-মাখানো ইটের ঘেরার মধ্যে ঝকমক করছে। মোটর গাড়ি যাচ্ছে আসছে গোঙাচ্ছে।
পাগল বললে-বাবার থানকে কেটেকুটে সমান করে মটরগাড়ির আস্তানা করছে বনওয়ারী ভাই। কলির শেষ, আমাদেরও শেষ। ওইখান থেকে বাঁশ-কাঠ বোঝাই করে নিয়ে যায়। চন্ননপুর। চন্ননপুর থেকে হাঁসুলী বাঁক পর্যন্ত পাকা আস্তা করেছে। কিছু আর আখলে না।
ওই সেই রাস্তা। পাকা শাহী চওড়া রাস্তা। লাল কাকরে মোড়া সোজা চলে গিয়েছে হাঁসুলী বাক থেকে জাঙল হয়ে চন্ননপুর; তীরের মত সোজা রাস্তা। রাস্তার গাঁটছড়াটা চন্ননপুরের সঙ্গে হাঁসুলী বাঁককে বেঁধে দিয়েছে। ধানের জমি মেরেছে, খাল পুরিয়েছে, নালা বেঁধে সাঁকো তুলেছে। ভোঁ-ভোঁ শব্দ করে ওই পথে গাড়ি যাচ্ছে আর আসছে।
পাগল বললে—কোপাইয়ের ঘাট পর্যন্ত গিয়েছে পথ। এইবার কোপাই পেরিয়ে ওপারে উঠবে। ওপারের গাছও সব কাটবে কিনা।
বনওয়ারী আর্তনাদ করে উঠল এবার—কেনে বাঁচালি আমাকে পাগল? ওরে নসুবালা, এ তোরা কি দেখাতে বাঁচালি? আঃ, হায় রে, কেনে বাঁচলাম আমি?
চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি তুলেই সে আবার কাহারপাড়ার দিকে তাকালে।
এতক্ষণে আর একটা জিনিস তার চোখে লাগল, মনে ধরা পড়ল।
খাঁখাঁ চারিপাশের দিকদিগন্তরই করছে না। হাঁসুলী বাঁকের বেড়ের মধ্যে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার পুরী বাঁশবাঁদি গ্ৰাম—সেও যেন খাঁখাঁ করছে। ঘরগুলি রয়েছে, কিন্তু কলরব নাই, গরু নাই, বাছুর নাই, ছাগল নাই, ভেড়া নাই, মেয়েরা কলহ করছে না, বাঁধের জলে হাঁস চরছে না, ছেলেরা খেলা করছে না, এ কি হল? এমনকি কাহারপাড়ার কুকুরগুলোও দেখা যায় না। হাঁসুলী বাঁকের বুকের মধ্যে উপকথার কৌটার ভিতর ভোমরা-ভোমরীর মত কালো কাহারদের মেয়েপুরুষেরা কোথায় গেল?
পাগল হাসলে, বললে—তারা আছে, সুখেই আছে। করালী তাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছে। চন্ননপুরে কারখানায় মজুরি খাটছে—খাচ্ছে। কেউ কেউ সন্ধেতে আসবে। কতক-বা আসবে না। বেশির ভাগই আসে না। সুখেই আছে যে তারা!
বনওয়ারী আর কোনো আক্ষেপ প্রকাশ করলে না। থাকু, তারা সুখেই থাক্।—নসু বললে, কতক মরেছে, কেউবা পাছে।
নসুবালা হিসেব দিলে। বলে গেল একে একে এক-একজনের কথা। তার মুখের কাছে। হাত নেড়ে বললে—সেই অমন বুড়ো গো! সবচেয়ে আগে পালাছে সেই অমনকাকা তোমার। তোমাকে যেদিন অসুখ হয়ে ঘরে নিয়ে এল, ঠিক তার দুদিন বাদেই।
বুড়ো রমণ তার দুদিন পরেই গরু চরাতে গিয়ে সেখানেই বনওয়ারীর একটা ভাল গাই পাইকারদের বিক্রি করে দিয়ে মাঠের পথ ধরে পালিয়েছে। শোনা যায়, সে আছে কাটোয়ায়, লাঠি হাতে কুঁজো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ভিক্ষে করে। বলে—শেষ দশা, তাই এলাম মা-গঙ্গার ধারে। হাড় কখানা গঙ্গায় পড়লে আসছে জন্মে উঁচুকুলে জনম-টনম হবে।
নয়ানের মা মরেছে। সে মরণ তার ভীষণ। অন্তত নসু তাই বললেনবানের দিন, অগ্রহায়ণের শেষ মাসে গিয়েছে নবান্ন। নয়ানের মা জাঙলে সদ্গোপ মহাশয়দের চার বাড়িতে আকণ্ঠ এঁটোকাটার প্রসাদ খেয়ে দম বন্ধ হয়ে হাসফাস করে মারা গিয়েছে। নড়তে পারে নাই, কথা বলতে পারে নাই, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মরেছে।
নসুবালা হঠাৎ কেঁদে ফেললে। তার মনে পড়ে গেল সে কথা। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল নয়নের মায়ের সেই মরণকালের ছবি। শিউরে উঠল সে। চোখ জলে ভরে উঠল। কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে সে বললে—এই দেখ, ওইখানে ওই গাছতলাটিতে মরেছেল নয়ানের মা। একা পড়ে অইল, কেউ দেখলে না। তুমি অসুখে পড়ে, মাতব্বর নাই, মুরুব্বি নাই, অনাথাকে দেখবার গরজ কার, বল? তবে তোমাকে নিয়েও খুব হইচই তখন, নোকে ভাবছে— কি হয়, কি হয়? নয়ানের মাকে কে দেখবে বল? আমি দেখে কাছে বসলাম। ভাবলাম—আহা, ভাতার যেয়েছে, যুগ্যি পুত যেয়েছে—অনাথা। মনে হল কি জান? আমারও হয়ত শেষে এই দশাই হবে। আমারও তো কেউ নাই। আমাকেও এমনি করে মরতে হবে। মুখে জল দেলাম। তো খেলে, আবার হাঁ করলে। আবার খেলে। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বললাম—কি হয়েছে নয়ানের মা? তা মুখে কিছু বলতে পারলে, শুধু অনেক কষ্টে হাতটি তুলে কপালে আখল। বুল্লে কিনা, বললে-কপালনেক। তা’পরেতে কোতাতে লাগল। সে কি কোতানি, মনে হল। জীউটা বেরিয়ে গেলে খালাস পায়। তা কি সে সহজে যায়? অ্যানেক এতে আঁধারের মধ্যে কখন যে জীউটা বেরিয়ে গেল, তা বুঝতে পারলাম।
—আটপৌরেদের একজন মরেছে—এই যে গো—বেশ নামটি। কিন্তু কিছুতেই মনে থাকে না।
পাগল বললে–বিশ্বামিত্ত।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিশ্বামিত্ত।
‘বিশ্বামিত্ৰ’ নামটি নসুর মনে থাকে না।
বিশ্বামিত্রের বাবা যাত্রায় পালাগান দেখে ওই নাম রেখেছিল ছেলের। বিশ্বামিত্ৰ মরেছে জ্বরে। তারপর এর ওর ছেলে মরেছে, কচিকাঁচা মরেছে—সে ধর্তব্যের মধ্যে নয়। নসু বললে— পায়ের হাতের আঙুলে গোনা যায় না ব্যানোকাকা, হিসেব দোব কি? একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠল—আর তোমার নিমতেলে পানার হয়েছে জেল। আহা! পানকেষ্ট কদমতলায় বিহার করতে যেয়ে গেল জেলখানাতে।
—জেল?
–হ্যাঁ, জেল। নসু খুব রঙ দিয়েই বললে–যেমন জেলাপির পাক বুদ্ধি, তেমনি ফল। মনিবের সঙ্গে হিসেব নিয়ে ঝগড়া হল। পানু আমার পানকেষ্ট; মনিবের শোধ নিতে–মনিবের উপো-বাঁধানো হুঁকো চুরি করেছিল। পানার মনিবকে তো জান! পেকো মোড়ল নাম! কাজেও পেকো মোড়ল!
পাগল বললে–ধরা পড়ত না ছোঁড়া। ধরা পড়ল পরিবারের টানে। ধরিয়ে দিলে করালী। পুলিশে খবর দিয়েছিল পেকো মণ্ডল। পানু তখন লুকিয়ে পড়েছে। কোথা যে লুকিয়ে থাকত কেউ জানত না। রাত্তে এসে ঘরে চারটি করে খেয়ে যেত। তুমি তখন শয্যাশায়ী অজ্ঞান, করালী বুক ফুলিয়ে আসে যায়; ছোঁড়া এখন পানার পরিবারকে নানা রকম লোভ দেখাতে লাগল। বলে— চন্ননপুরে চল, খাটবি খাবি। ভাল কাজ করে দেব আমি। সেই লোভে মেয়েটা স্বীকার করলে রাত্রে পানা এসে খেয়ে যায় বাড়িতে। করালী শুনে রাত্রে তত্ত্বে তত্ত্বে ছিল—ধরলে একদিন চেপে। দিয়ে দিলে পুলিশে। পানা বলে গেল কি জান? বললে—যাক, কিছুদিন এখন নিশ্চিন্দি।
নসু বললেপানার বউ এখন চন্ননপুরে আঙামুখো সাহেবের উড়োজাহাজের আস্তানায় খাটে। খাটুনি না মাথা! ওজকার খুব; ফেশান কি?
বনওয়ারী উদাস হয়ে চেয়ে রইল। চোখ গিয়ে পড়ল তার চন্ননপুরের রাঙা পাকা পথের উপর। রাস্তাটা ঝকঝাক তকতক করছে। ওই পথে সব ছুটে যায় চন্ননপুরে খাটুনি খাটতে। পাঁচ সিকে দেড় টাকা মজুরি। যারা আবার রেলের তেরপল-ঢাকা-মালগাড়িতে লাইনের কাজে সেইখানেই দিনরাত্রি থাকে, তারা পায় বেশি। কয়লা পায়, রেলের লোকেরা কম দামে চালডাল দেয়।
হঠাৎ বনওয়ারী পাগলের মুখের দিকে চেয়ে বললে—পাগল, কুলকম সবাই ছাড়লে? অতন, গুপী, পেল্লাদ–সবাই?
কথার উপরেই কথা দিয়ে জবাব দিলে নসুবালা—সবাই সবাই সবাই। কেউ বাকি। নাই। মেয়ে-পুরুষ সব চন্ননপুরে ছুটছে ভোর না হতে। সময় নাই। রবকাশ নাই। কি করবে বল? পেটের দায়।
পাগল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেওদর, পেট-বনওয়ারী, উনিই সব।
নসুবালা বললে—মরে যাই। শুধু ওদর? লোভ পাপ, বুয়েচ ব্যানোকাকা, পাপ! পিথিমীতে পাপের ভারা ভরতে আর বাকি নাই। একটি নোক দেখলাম না যে ধম্মের মুখ তাকায়। ঘোষেরা–তোমার এতকালের মনিব, ভাগের জমি ছাড়িয়ে নিলে। সায়েবডাঙায় জমি, তুমি উইকে এক পিঠ উঁইকে এক পিঠ দিয়ে ভাঙলে। চন্ননপুরের বাবু তা সব কেড়ে নিলে। পাগলমামা যেয়েছিল একবার বাবুদের ঠেনে, তা—
বনওয়ারী পাগলের মুখের দিকে চেয়ে বললে—পাগল!
পাগল মাটি খুঁটতে খুঁটতে বললে—“যেয়েছে, সেসব যেয়েছে, ভাই। বাবুরা এক ছটাক ভাগ। দিলে না।
বনওয়ারীর কাছে পিতিপুরুষের আমল থেকে যে জমি ভাগ দিয়েছিল, ঘোষেরাও তা ছাড়িয়ে নিয়েছে।
বনওয়ারী হাসলে। যাক, সর্বস্বান্ত হয়েছে তা হলে। নিশ্চিন্ত।
অনেকক্ষণ পর বনওয়ারী বললে, নিজের কথা বাদ দিয়ে কাহারদের কথাই বললে—তা লোকে কারখানায় গিয়ে ভালই করেছে। দোষ দেবার কিছু নাই।
নসুবালা বলে গেল-দুর্দশার দিনে করালী ওদের ডাকলে। নিয়ে গেল চন্ননপুরের রেলের কারবারে কারখানায়। কাজ দিলে। সব সুড়সুড় করে চলে গেল। তোমার এত বড় ব্যামো গেল, কেউ খোজও করলে না।
বনওয়ারী হাসলে–তা না করুক।
নসু বললে না এলে দুঃখ হয় বৈকি! দুঃখ হয় না?
পাগল হেসে বললে দুঃখ করেই-বা কি করবে বুন?
বনওয়ারীর হাত-পায়ের ডগাগুলি ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
নসু বললে আমি শুধু যাই নাই। ব্যানোকাকা, ওই মুখপোড়া করালীর উপর ঘেন্নায় লজ্জায় যাই নাই। যত ভালবাসতাম তাকে, তত বিষ হয়েছে তার উপর। ছিছিছি! লজ্জায় মরে যাই! সে আবার সেপাইদের মতন পোশাক পরে আজকাল বলে—মেলেটারি! জুতো পরে, টুপি মাথায় দেয়।
নসুবালা বলে যায় করালীর লজ্জাকর ঘৃণাৰ্হ কীর্তিকলাপের কথা। বনওয়ার কয়েকদিন তখন শয্যাশায়ী, এখন-তখন অবস্থা, সেই সময় একদিন সকালে দেখা গেল, সুবাসী নাই। সুবাসী তার আগের দিন বনওয়ারীর চিকিৎসার খরচের অজুহাতে গরু-বাছুরগুলি বিক্রি করেছিল। সেও টাকাকড়ি সব নিয়ে বনওয়ারীকে ফেলে গভীর রাত্রে অদৃশ্য হল। দুপুর নাগাদ খবর এল, সুবাসী চন্ননপুরে করালীর বাসায়। বনওয়ারীকে ‘মামা’ বলত করালী। সম্পর্ক। বাছলে নাছি-ছিছি! রোগা মানুষ বনওয়ারী, মেয়েটা চলে গেলে তার কি হবে, সে কথাও একবার ভাবলে না। নিষ্ঠুর হৃদয়হীন ঘৃণাৰ্হ করালী। শুধু গায়ের জোরে, রক্তের তেজে, আর রোজগারের গরমে ধর্মকে পায়ে মাড়িয়ে গেল, রীতি-ব্যবহারকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলে। থুতু দিলে, ছি! ছি!
বনওয়ারী মাটির দিকে চেয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। না বললেও সে এ কথা মনে মনে বুঝেছিল। তার অন্তর বলে দিয়েছিল—সুবাসী যখন পাশে নাই, ঘরে নাই, তখন করালী তাকে নিয়ে গিয়েছে। হাসতে হাসতে কালোবউয়ের মত রঙ্গ করে করালীর সঙ্গে গিয়েছে, সে তা জানে। যাবেই—এই নিয়ম। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় এই কথাটি পুরনো কথা। পাগল হাসলে, ঘাড় নাড়লে, সেও জানে হাঁসুলী বাঁকে এই নিয়ম। ন চোখ মুছছিল, চোখ মুছে সে আবার বললে—বলব কি ব্যানোকাকা, পাখীর মত মেয়ে, তার মুখের দিকেও চাইলে না সে। পাখী আঃ কি বলব ব্যানোকাকা—‘চোখ গেল পাখি যেমন ‘চোখ গেল’ বলে ডেকে সারা হয়, তেমনি করে কাঁদলে, বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদলে।
আবার কাঁদতে লাগল নসুবালা। চোখ মুছতে লাগল। বললে—আঃ আঃ, পাখীর কথা মনে। হলে আমার হিয়েটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আবার চোখ মুছে বললে আমি আর লারলাম কাকা। আমি করালীকে শাপ-শাপান্ত করে গাল দিয়ে চলে এলাম-গাঁয়ে চলে এলাম। বলে এলাম-জনমের মত হল তোর সঙ্গে। গাঁয়ে এলাম। এসেই মনে পড়ল তোমার কথা। আঃ, তোমাকে কে দেখছে? ঘরে তো আর দ্বিতীয় জন নাই। সুবাসী পালিয়েছে, অমন পালিয়েছে, কে দেখবে? রোগা মানুষ, প্রলয় জ্বর, অচেতন অবস্থা—কি হবে মানুষটির সম্বলহীন অবস্থা যথাসৰ্বস্ব নিয়ে পালিয়েছে সুবাসী। সংসার নিয়ে যারা ব্যতিব্যস্ত, মাথার ঘায়ে পাগল কুকুরের। মত ছুটে বেড়াচ্ছে যারা, তাদেরই বা অবসর কোথায়! মেয়েরা দু-এক জন আসছিল, যাচ্ছিল, দেখছিল; কিন্তু ঘরে তো আর স্ত্রীলোক ছিল না। শূরবীরের মত বিকারগ্রস্ত পুরুষ বনওয়ারী, পরের ঘরের স্ত্রীলোকেরা তাকে সামলায় কি করে? তবে কি মানুষটা এতবড় শূরবীর, এতবড় মান্যের নোকটি’বিনা সেবায় মরবে? রাত্রে জলের জন্য হাঁ করে জল পাবে না, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে ছাতি ফেটে মরে যাবে? আমার মন বললে—তবে তু কি করতে আছিস? ভগবান যে তোকে পুরুষ গড়েও মেয়ের মন দিয়েছে, মেয়ের মতন কাজকর্ম করবার ক্ষমতা দিয়েছে, কেনে। দিয়েছে? আর এক দণ্ডের জন্য ভাবলাম না। চলে এলাম, শিয়রে এসে বসলাম।
ভগবানকে প্রণাম করে নসু বললে— তার চরণে পেনাম, তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি।
বনওয়ারী আবার বললে—কেনে বাচালি নসু?
—তোমার পেরমাই আর আমার হাত ধন্যি।
পাগল হেসে বললে—মরলেই তো ফুরুল বনওয়ারী। বহুভাগ্যের মনিষ্যি-জন্ম নয়ন ভরে সাধ মিটিয়ে দেখে লে। মরণ আছেই। হঠাৎ সে গান ধরে দেয়–
হাঁসুলী বাঁকের কথা—বলব কারে হায়?
কোপাই নদীর জলে—কথা ভেসে যায়।
ওদিকে বাঁশ কাটা, গাছ কাটা চলছেই। খট-খট-খট-খট! খটাং-খটাং! মড়মড় শব্দে আছাড় খেয়ে পড়ছে গাছ, বাঁশ শুয়ে পড়ছে অল্প শব্দ করে-মার-খাওয়া গরিব মানুষের মত। গাছ পড়ছে হাঁসুলী বাক পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
খট-খট-খট-খট-খটাং-খটাং শব্দ ছুটে চলেছে চারিদিকে। হাঁসুলী বাঁকের বেড়ের কূলে কূলে ছড়িয়ে যাচ্ছে; দূরে-দূরান্তরে, কোপাইয়ের পুলে ঘা খেয়ে আবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। হয়ত হাঁসুলী বাঁকের ভাবীকালে দেশ-দেশান্তরের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘোষণা করেও তার তৃপ্তি হচ্ছে না—প্রতিধ্বনির মধ্য দিয়ে ফিরে এসে অতীতকালের কল্পে কল্পে যেন আঘাত হেনে চলেছে।
নসুর কথা ফুরাবার নয়। সে অবার আরম্ভ করলে—দুঃখ আমার পাখীর জন্যে। আঃ, সোনার বরণ হলুদমণি’ ‘বেনেবউ পাখি গো—সেই পাখি মনে পড়ে আমার পাখীর কথা মনে হল। হা, মেয়ে বটে। বুঝলে, যেমনি সুবাসীকে নিয়ে গোল করালী, পাখী বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। পাখীর কান্না দেখে আমি তো গালিগালাজ করে পালিয়ে এলাম। সেইদিন সনজেবেলায়। এই খানিক আত হয়েছে, এমুনি সময় পাখীও পালিয়ে এল গায়ে মায়ের কাছে। কাপড় অক্ততে আঙা হয়ে যেয়েছে। পাখীর চোখ জ্বলছে।
জ্বলবে বৈকি! কাহার-মেয়ে ক্ষেপে উঠেছিল যে! সে যে তখন দু-কূলভাঙা কোপাইয়ের মত ভয়ঙ্করী।
সন্ধ্যাবেলা কান্না শেষ করে পাখী ঝগড়া আরম্ভ করেছিল করালীর সঙ্গে। তারপর একখানা কাটারি নিয়ে নিজের মাথায় মারতে গিয়ে হঠাৎ সে বলে উঠল—একা মরব কেন? করালী চেষ্টা করেছিল তার হাত ধরতে, তবু পাখী কাটারি বসিয়ে দিল করালীর মাথায়। শুধু করালীর মত পুরুষ আর তার হাত ধরে ফেলেছিল বলেই বেঁচেছে করালী, নইলে তাকে বাঁচতে হত না। তবু খানিকটা চোট লেগেছিল করালীর মাথায়। সেই রক্ত মেখে পাখী এখানে পালিয়ে এল পাগলিনীর মত। পরদিন সকালে করালী এল কাহারপাড়ায় মাথায় ডাক্তারখানার ফেটা বেঁধে। তখন পাখী সাধের খাচায় মরে পড়ে আছে। তার সাধের কোঠাঘরের সাঙায় দড়ি বেঁধে গলায় ফাস লাগিয়ে ঝুলছে; তবে হ্যাঁ, করালীর কপালে পাখী চিরস্থায়ী দাগ এঁকে দিয়ে গিয়েছে। পাখীকে ভুলবার পথ রাখে নাই পাখী।
বসন–পাখীর মা চিরকালের ভাল মানুষ। আর চৌধুরীবাবুর ছেলের সঙ্গে প্রেমের কথা তো সবাই জানে। কাহারপাড়ার বিচিত্র মেয়ে বসন্ত। ওই চৌধুরীর ছেলেকে সে যে ভালবেসেছিল, তারপর সে আর কারও দিকে ফিরে তাকায় নাই। কাহারপাড়ার নীল বাঁকে শালুকের বনের মধ্যে পদ্মকলি যেমন উদয়াস্ত সূর্যের দিকেই চেয়ে থাকে, তেমনি ওই একজনের দিকেই ছিল তার মপ্রাণ চোখ সব। চৌধুরীদের ছেলের মৃত্যুর পর সে থাকত সজাতের গৃহস্থঘরের বিধবার মত। শান্ত মৃদুভাষী বসন্ত—মেয়ের মৃত্যুর পর গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ওই ভাঙা চৌধুরী বাড়িতে। সেইখানেই এঁটোকাটার প্রসাদ খায়, আর মৃত্যুর প্রতীক্ষায় পড়ে থাকে।
বসন্তের মা সুচাঁদ চন্ননপুরে আছে। রেলের হাসপাতালের আশ্চর্য চিকিৎসা পা কাটতে হয় নাই। বুড়ি বেঁচেছে। লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেড়ায় ভিক্ষে করে। চন্ননপুরের ভদ্রলোেকদের বাড়ি গিয়ে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বলে, ইস্টিশানের গাছতলায় বসে বলে। কেউ থাকলেও বলে, না থাকলেও বলে, বলেই যায়, বলেই যায়—বাশবনে-ঘেরা তা-মাখা স্বপ্নসুলভ ছায়াচ্ছন্ন। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা ফুলে ভরা, বিষে ভরা, রঙে স্নিগ্ধ, বেরঙে উগ্র, হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় বসন্ত তার সাদা রঙের তুলির দাগ, পাখী তার রক্তলেখা। এই কথা সে নিজের ভাষায় বলে। সম্ভবত হাঁসুলী বাঁকের উপকথার ঝুলি কাধে নিয়ে সে নিজে হল আদ্যিকালের বুড়ি; করালী হল দৈত্য কিংবা শয়তান কিংবা সে-ই হল রাজপুত্র, নতুন কালের মাতব্বর। যুদ্ধকে ওই ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশি করে ঢোকালে হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়ায়। সে-ই ঠিকাদারদের খবর দিলে। হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবনে আদ্যিকালের বুড়ো বট রয়েছে। কেটে ফেললে সেই বটগাছটা। প্রথমে এসেই তারা কাটলে সেই বটগাছ। হাঁসুলী বাঁকের উপকথার হাড়-পাজরামেরুদণ্ড কাটিয়ে এনে তৈরি করছে যুদ্ধের হুকুমমত ইতিহাসের ছাদে ঘরবাড়ি।
মড়মড়-দুম! প্রচণ্ড উচ্চশব্দে চকিত হয়ে উঠল হাঁসুলী বাক। এক ঝাক পাখি কলরব করে উঠল। অল্প এক কঁক। ঝাঁকে ঝুঁকে বন্য পাখির দলের বাসা ঘুচে গিয়েছে হাঁসুলী বক থেকে। দাতালের দুটো-একটাও এ শব্দে ছুটে বার হল না। ঊৰ্ধপুচ্ছ হয়ে ভয়ার্ত গরু ছুটে এল না, ছাগলও না। ছেলেরা ছুটে বেরিয়ে গেল না দেখতে, এত কিসের শব্দ! ছেলেদের নিয়েই যে খাটতে যায় কাহারেরা চন্ননপুরে। তা ছাড়া থাকলেও হয়ত তারা এ শব্দে বিস্মিত হত না; চন্ননপুরে ধ্বনির উচ্চতা এবং বৈচিত্র্য এর চেয়ে যে অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
ছাগল গরু নাই-ই আর কাহারপাড়ায়। যুদ্ধ লেগেছে। চালান যাচ্ছে। দু টাকার ছাগল দশ। টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দশ টাকার গাইয়ের দাম তিরিশ টাকা। পঁচিশ টাকার বলদ একশো টাকা। দুধের দাম নয়, হেলের শক্তির দাম নয়, মাংসের দাম। যুদ্ধ কাহারদের গোসেবা দুধ বিক্রি ভুলিয়ে দিলে, ও ব্যবসাটাই ঘুচিয়ে দিলে।
নসু উঠে দেখলে, ব্যাপার কি? গালে হাত দিয়ে শিউরে উঠল সোমা গো, দহের ধারে সেই শিমুলবৃক্ষটিকে কাটলে গো! মড়মড় শব্দে প্রচণ্ডবেগে পড়ছে, আদিকালের বনস্পতি। তার পড়ার বেগের ঝটকা তখনও বাতাসে বয়ে চলেছে। বোধহয় শুধু বেগের মধ্যে দিয়ে বলে যাচ্ছে—আমি যাচ্ছি।
খট-খট-খট-খট-খট-খট। বাঁশ কাটছেই। আজ একটা পাশ একেবারে সাফ হয়ে হাঁসুলী বাঁক মিলে গেল—দূর দেশান্তরের সঙ্গে! হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় শেষকালে শুধু গাছকাটার শব্দ। মানুষেরা চন্ননপুরে চলে গিয়ে শহরে বাজারে রাজপথে চলমান দ্রুত ধাবমান জনস্রোতের মধ্যে মিশে গিয়েছে। স্থাণু স্থাবর বনস্পতি, যারা সর্বপ্রথম গড়েছিল হাঁসুলী বাঁকের উপকথার ছায়াচ্ছন্ন শান্ত-তন্দ্ৰালু গ্রামখানি, তারাই যাচ্ছে এবার, তারা হচ্ছে বিগত। তারই মধ্যে বসে আছে সে যুগের শেষ মানুষ বনওয়ারী, স্থাবরের মত।
খুঁটি ধরে সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে। কিছুই নাই—কিছুই নাই—হাঁসুলী বাঁকের সে কাহারপাড়ার আর কিছুই নাই। বাঁশবনের বেড় নাই, আদ্যিকালের বৃক্ষ নাই, মানুষ নাই, জন নাই; পশু নাই, পক্ষীরা পর্যন্তও নাই। পক্ষীর মধ্যে আছে কাকেরা, তারা উচ্ছিন্ন বাঁশবন, আগাছার জঙ্গল থেকে গৃহহীন পতঙ্গগুলিকে ধরে খাচ্ছে। চারিদিকে শুধু শক্ত বাঁধানো লাল কাকরের পথ। আছে শুধু কোপাইয়ের বেড়, হাঁসুলী বাঁকের মাটি, আর পুরনো আমলের পড়োপ’ড়ো জনহীন ঘরগুলি। ওগুলির দিকে তাকিয়ে সে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালে—শূন্য বাঁশঝাড়ের দিকে। একটু বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ও ঘরগুলিও থাকবে না।
সন্ধ্যার সময় সে পাগলকে বললে—দেহ এইবার আখি, কি বলিস?
—দেহ রাখবি? পাগল চমকে উঠল।
—আর বাঁচব না। বেঁচেও লাভ নাই। দেখার লোভ তোর আছে, তু দেখ, নয়ন ভরে দেখ। পাগল তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললে—মন খারাপ করিস না ভাই।
—মন খারাপ নয় পাগল, মন আমার পাষাণ হয়ে যেয়েছে। কথা তা নয়। আমার ডাক এসেছে। বুয়েচিল—বেশ বুঝতে পারছি। একলা থাকলেই অন্তর আমাকে বলছে—চল্।
—ও তোর মনের ভুল।
–উঁহুঁ! ঘাড় নাড়লে বনওয়ারী। আজ আবার খানিক জ্বর হয়েছে। বনওয়ারীর কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল পাগল।
বনওয়ারী বললে—আমার একটি সাধ ছিল পাগল, অ্যানেক দিনের সাধ। কত জনকে জ্ঞানগঙ্গা নিয়ে গিয়েছি। মনে আছে তোর, কাঁদরা যেয়েছিলাম বিয়েতে, আটমঙ্গলায় বর-কনে পৌছিয়ে দিয়ে খালি পালকি কাধে ফিরে আসছিগাছতলায় এক বুড়ো বাবাজীর সাথে দেখা হয়েছিল?
—মনে আছে বৈকি। মহাপুরুষ। মনে থাকবে না। দুপুরে ওদে গাছতলায় ঠেস দিয়ে বসে ছিলেন, গলা দিয়ে রজ বেরোয় না। তু জল দিলি। জোড় হাত করে বললিনীচ জাত, জল দিয়েছি মুখে, আমার অপরাধ লেবেন না বাবা। বাবা বললেন—আমার নিজেরই জাত নাই বাবা, আমি জাহারা বোষ্টম, বৈরাগী। মনে আছে বৈকি।
আমি শুধালাম—এই দেহ নিয়ে পথে কেন বেরিয়েছেন বাবা? বাবা বললেন বাবা, দেহখানা আর বইছে না বলেই ওকে রাখতে চলেছি। মনে আছে? বললেন—অনেক দিন ও আমাকে বয়েছে বাবা, আমিও ওকে অনেক ভালবেসেছি। কত সাজিয়েছি, কত মাৰ্জ্জনা করেছি, ওর গরবে কত গরব করেছি, তাই যেখানে সেখানে ওকে ফেলে যেতে আমার মন সরছে না। চলেছি মা-গঙ্গার কূলে, জলে শোব, মাথাটি রাখব কূলে প্রভুকে ডাকতে ডাকতে চলে যাব, ওকে মা-গঙ্গার জলে দিয়ে যাব। মনে আছে? আমরা তখন ধরলাম—বাবা চলুন, এই পালকিতে আপনাকে বহন করে নিয়ে যাব। বাবা হাসলেন।চল, নিয়ে চল।
একটু চুপ করে থেকে বনওয়ারী আবার বললে—জানিস, গঙ্গাতীরে বাবাকে আমি শুধিয়েছিলাম, তোরা ছিলি না কাছে, একা পেয়ে শুধালাম-বাবা, আপনার তো ওগ কিছু নাই, তা কি করে বুঝছেন? বাবা বললেন-বাবা, মন বলছে আমার। এই রাতদুপুরো। তারপর হেসে বললেন-বাবা, মন বাইরের মায়ায় ভুলে থাকে বলে ভিতরের খবর পায় না। মোটা কথা ধর না বাবা, চাষে যখন মেতে থাক, তখন ক্ষিদে বুঝতে পার না। খেতে মনে থাকে না। মন যদি বাইরের থেকে চোখ ফিরিয়ে আপনার ভিতরের মনের সঙ্গে কথা বলে, সে ঠিক বলবে ভাই, এইবার আমি যাব। তা আমার বাইরের নেশা ছুটেছে ভাই। আমি ভিতরের জনের কথা শুনতে পেছি যে। বলছে—আমি যাব।
পাগলের চোখ দিয়ে দরদর ধারায় জল পড়ছিল। বনওয়ারী বললে-কাঁদিস না মিতে। জ্ঞানগঙ্গা কাহারের ভাগ্যে হবার নয়। তবে আমার মা-কোপাই তো অয়েছেন, অমি যখন বলব রে, তখন যেন কোপাইয়ের কূলে আমাকে তোরা দুজনে ধরে নিয়ে যাস। বুয়েচিস?
সে পাগলের হাত দুটি চেপে ধরলে।
পাগল বললে–যাব।
—আর কাহারদিগে একবার খবর দিবি। যদি আসে তো একবার দেখে যাব নয়ন ভরে।
সে হাসলে।
পাগল অনেকক্ষণ পর বললে–নটে গাছটি মুড়িয়ে গেল, হাঁসুলী বাঁকের কথা শেষ হয়ে গেল। হাঁসুলী বাঁকেরও শেষ হয়ে গেল।
বনওয়ারী ঘাড় নাড়লে–না।
না। বাকি আছে। কত্তা বলেছেন, কালরুদ্রের খেলা, হরির বিধান, বান না এলে শেষ হবে না হাঁসুলী বাঁকের উপকথা। প্রলয়ঙ্কর বান। কোপাই হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় ক্ষ্যাপা কাহারমেয়ের মত; কোপাই ক্ষেপে উঠে হাঁসুলী বাঁককে শেষ করে দিয়ে যাবে।
এল বান। তেমনি ক্ষ্যাপা বান। হুড়হুড়—দুড়দুড়–কলকল—খলখল শব্দে ভেসে উঠল। কোপাইয়ের দু কূল। সেই বাবাঠাকুর যেবার খড়ম পায়ে দিয়ে বন্যার জলের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, তার চেয়েও বড় বান। প্রলয় বান। এবার কিন্তু কাহারেরা ড়ুবে মরল না। গাছেও চড়ল না। এবার তারা ছিল চন্ননপুরে। হাঁসুলী বাঁক বন্যায় ড়ুবে গেল। বাঁশবনের বেড় নির্মূল হওয়ায় কোপাইয়ের বান এবার শতগুণ বেগ নিয়ে বয়ে গেল কাহারপাড়ার উপর দিয়ে। ভূমিসাৎ করে দিয়ে গেল গোটা কাহারপাড়া। একখানি ঘরও রইল না দাঁড়িয়ে। নীল বাঁধ পুরে গেল বালিতে। সায়েবডাঙার জমিগুলি পলিতে সোনা হয়ে উঠল। সায়েবদের কুঠি শেষ হয়ে গেল, চিহ্ন পর্যন্ত রইল না।
বন্যার কথা উপকথা নয়, ইতিহাসের কথা। ১৩৫০—ইংরেজি ১৯৪৩ সালের বন্যা। তের শো পঞ্চাশের যে বন্যায় রেললাইন ভেসে গেল, সেই বন্যা। ইতিহাসে আছে তার কথা। দামোদরের অজয়ের ময়ূরাক্ষীর কোপাইয়ের বন্যায় শুধু রেললাইন ভাসে নি, হাঁসুলী বাঁকের মত অগণিত স্থানের উপকথার পটভূমি ভেসে গিয়েছে, পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস অবশ্য কর্তার বাণী, কালরুদ্রের খেলা, হরির বিধান মানে না। সে বলে—আকস্মিক, কাকতালীয়। বলুক-সত্য যাই হোক, কাহারেরা একে সত্য বলেই মানে।
পাগল বলে—বনওয়ারী জানত। সে হেসেছিল কাটা বাঁশবেড়ের দিকে চেয়ে। তার সে হাসি আমি চোখে দেখতে পেছি।
বনওয়ারী প্রবল বন্যার আগেই দেহ রেখেছে। ঠিক যেমনটি তার সাধ ছিল, তেমনটি করেই রেখেছে। মৃত্যুর তিন দিন আগে—কোপাইয়ের গর্ভে গিয়ে কুঁড়ে বেঁধে শয্যা পেতেছিল। গোটা কাহারপাড়াকে ডেকে, তাদের নয়ন ভরে দেখে, হাসতে হাসতে দেহ রেখেছে সে। শুধু দেখা হয় নাই করালীর সঙ্গে। করালী-ডাকাবুকো করালী, সে-ই শুধু আসে নাই। এল তার মৃত্যুর পর। বনওয়ারী আরও বলেছিল-ওই দহের ধারে আমাকে দাহ করিস। যেখানে কালোবউ দহের জলে পড়েছিল, যেখানে তার বড়বউকে দাহ করা হয়েছিল—সেইখানে। তাই হয়েছিল। সেই দাহের সময় সে এসে দাঁড়াল। নিয়ে এসেছিল পাকা শাল কাঠ আর ঘি। তাতেই চিতা সাজিয়ে বনওয়ারীকে চাপিয়ে তার পায়ের পরশ নিলে মাথায়। বললে—যাও, চলে যাও স্বগ্গে।
উপকথার ছোট নদীটি ইতিহাসের বড় নদীতে মিশে গেল।
কাহারেরা এখন নতুন মানুষ। পোশাকে-কথায়-বিশ্বাসে তারা অনেকটা পালটে গিয়েছে। মাটি ধুলো কাদার বদলে মাখে তেলকালি, লাঙল কাস্তের বদলে কারবার করে হাম্বর-শাবল-গাঁইতি নিয়ে। তবে চন্ননপুরের কারখানায় খেটেও তারা না খেয়ে মরে, রোগে মরে, সাপের কামড়ের বদলে কলে কেটে মরে, গাড়ি চাপা পড়ে মরে। কিন্তু তার জন্যে বাবাঠাকুরকে ডাকে। না। ইতিহাসের নদীতে নৌকা ভাসিয়ে তাদের তাকাতে হচ্ছে কম্পাসের দিকে বাতাস দেখার যন্ত্রটার দিকে।
তবু চন্ননপুরের পাকা ঘুপচি কোয়ার্টার্স থেকেও তাকায় বালিভরা ওই হাঁসুলী বাঁকের দিকে। কিন্তু কি করে ফিরে যাবে তারা, আগে পথ ধরবে কে?
হাঁসুলী বাঁক বসতহীন হয়ে চেয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। বন্ধ্যা মেয়ের মতন নতুন সন্তানসন্ততির জন্য তপস্যা করছে। বন্যায় চাপানো বালির রাশি হাঁসুলী বাঁকের সোনার মাটির উপর চেপে ধু-ধু করছে, সেখানে শুধু নসুবালাই যায়। নিত্যই যায়। তার না গেলে চলে না। সে যায় ওই বাঁকে গোবর কুড়াতে, কাকড়া মাছ ধরতে, কাঠ ভাঙতে। চারিদিক তাকিয়ে দেখে আর পা ছড়িয়ে বসে কাদেমা জনুনী গো!
পাগল গান গায় গায়ে গায়ে, দোরে দোরে–ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে–
হাঁসুলী বাঁকের কথা বলব কারে হায়!
পাগল গান গায়, ঢোলক বাজায়, তার সঙ্গে নসুবালা কাঁচাপাকা চুলের বেণিতে লাল ফিতে জড়িয়ে খোপা বেঁধে নূপুর পায়ে নাচে। ঘুঙুর পছন্দ করে না নসু।
পাগল আর ক্ষ্যাপায় না নসুকে। সুও ক্ষ্যাপে না। হাসে। দুজনে মিলেছে সেই বনওয়ারীর ঘর থেকে।
পাগল গায়—
যে বাঁশেতে লাঠি হয় ভাই সেই বাঁশের হয় বাঁশি
বাঁশবাঁদির বাঁশগুলিরে তাই তো ভালবাসি।
নসু নাচতে নাচতেই গান ধরে–
বেলতলায় বাবাঠাকুর কাহার-কুলের পিতা
বাঁশবনেতে থাকত বাহন অজগরো চিতা
পরান-ভ্ৰমরে সে থাকত আগুলি,
(ও হায়) তারে দাহন করে মারল করালী!
বাঁশের বেড়া বাঁশের ঝাঁপি তাহারই ভিতর
কাহার-কুলের পরান-ভ্রমর বেঁধেছিল ঘর।
বাঁশের বেড়ের ঝাঁপি শেষে ভাঙলে মিলিটারি–
কাহারেরা, হায় রে বিধি, হল ভ্রমণকারী।
ঘর-ভোমরার মত তারা ঘুরিয়ে বেড়ায়
দুখের কথা বলব কারে হায়!
পাগল গান ধরে–
জল ফেলিতে নাই চোখে জল ফেলিতে নাই,
বিধাতা বুড়ার খেলা দেখে যা রে ভাই।
পাগল গানের মধ্যেই কাহারপাড়ার আদিকাল থেকে একাল পর্যন্ত সুচাঁদের হাঁসুলী বাঁকের উপকথাকে গান গেয়ে বলে যায়। সর্বাগ্রে বলে—সৃষ্টিতত্ত্ব; শেষে বলে সেই শেষ কথা—দুঃখই। বা কিসের, চোখের জলই বা ফেলছ কেনে? ভাঙা গড়া-হল বিধাতা বুডোর খেলা। একটা ভাঙে একটা গড়ে—এই চলছে আদিকাল থেকে। ছেলেরা যেমন বালি দিয়ে ঘর গড়ে আবার ভাঙে, মুখে বলে–হাতের মুখে পড়লাম, পায়ের সুখে ভাঙলাম, ঠিক তেমনি, ঠিক তেমনি, ঠিক তেমনি!
সুচাঁদ গাছতলায় বসে বলে যায় হাঁসুলী বাঁকের উপকথা। শ্রোতারা কেউ শোনে গোড়াটা, কেউ মাঝখানটা, কেউবা শেষটা। অর্থাৎ খানিকটা শোনে, তারপর উঠে চলে যায়। বুড়ি আপন মনেই বলে যায়। গল্প শেষ করে বলে—বাবা, ছেলেবেলায় শুনেছি, হিয়ের জিনিস যাতা মাথায় রাখলে উকুনে খায়, মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে ধরে, হাতে রাখলে নখের দাগ বসে, ঘামের ছোপ লাগে; তাই হিয়েতে রেখেছি। হিয়ের জিনিস নিয়ে হিয়েতে যদি কেউ রাখত—তবে থাকত। তা তো কেউ নিলে না, রাখলে না। আমার সাথে সাথেই এ উপকথার শেষ। তবে পার তো নিকে রেখো। আঃ-হাঁসুলী বাঁকও শেষ আমিও শেষ, কথাও শেষ। আঃ আঃ!
কিন্তু–।বলতে বলতে থেমে যায় সুচাঁদ। আকাশের দিকে চেয়ে ভাবে। ভাবে, শেষ কি হয়? কিছুর শেষ কি কখনও হয়েছে? চন্দ সুয্যি যত কাল, তার পরেও তো শেষ নাই; তার পরে আছেন মহাকাল। বাবা কালারুদ্দের চড়ক পাটার ঘোরা। সে ঘোরার শেষ নাই, আলো নাই, অন্ধকার নাই, তবু পাটা ঘোরার শেষ নাই। সেই ঘোরাতেই তো কখনও প্রলয়, কখনও সৃষ্টি আঁধারে সৃষ্টি ডোবে, আবার আলোতে ওঠে। তবে শেষ কি করে হবে? সে ভাবে।
হঠাৎ একদিন ছুটে এল নসুবালা। প্রায় বছর দুয়েক পর। বললে-ওলো দিদি, দিদি লো! আমার নূপুর জোড়াটা দে লো। আমি নাচব।
দিদি তখন কথা শেষ করে বলছে—সব শেষ লো—সব শেষ।
নসু হেসে ঢলে পড়ে বলে উঠল উচ্চকণ্ঠে–না লো দিদি, শোন। আমি কি দেখে এলাম। শো। দেখে এলাম, বাঁশবাঁদির বাঁধের বেড়ে বালি ঠেলে বাঁশের কেঁড়া বেরিয়েছে। আর কি কচি কচি ঘাস! আর দেখে এলাম সেই ডাকাবুকোকে।
বাঁশের কোঁড়া বেরিয়েছে।
হ্যাঁ।
—আর সেই ডাকাবুকোকে দেখে এলি? করালীকে?
–হ্যাঁ লো পিসি। লুকিয়ে একা গিয়েছে-গাঁইতি হাতে। বালি খুঁড়ছে। বালি খুঁড়ছে। বালি। খুঁড়ছে আর কি খুঁজছে। খানিক খুঁজছে। আবার উঠছে, আবার খুঁড়ছে। শুধালাম কি খুঁজিস? বললে—মাটি। ঘর কর আবার নতুন কাহারপাড়া হবে। নতুন বাঁধ দেবে।
সুচাঁদ দু হাত তুলে সানন্দে বলে—আবার নতুন বাঁশের বেড়া উঠবে–
নসু বললে–না, বাঁশের বেড় দেবে না। এবার বালি মাটি স্তূপ্যুইমান করে বাঁধ দেবে। দিয়ে, তার গায়ে শরবন লাগাবে। বাঁশের বেড়ে আঁধার হয়। সে আমাকে অনেক কথা বললে পিসি–অনেক কথা। এক ঘর কথা।
পাগল ঘাড় নাড়তে লাগল। তার মনে গান এসেছে। নতুন গান–
যে গড়ে ভাই সেই ভাঙে রে, যে ভাঙে ভাই সেই গড়ে;–
ভাঙা গড়ার কারখানাতে, তোরা, দেখে আয় রে উকি মেরে।
নসু সঙ্গে সঙ্গে পায়ে নূপুর বেঁধে নাচতে লেগে গেল—
তাই ঘুনাঘুন বাজে লো নাগরী
ননদিনীর শাসনে, চরণের নূপুর থামিতে চায় না।
তাই ঘুনাঘুন—তাই ঘুনাঘুন!
হাঁসুলী বাঁকে করালী ফিরছে। সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, বালি কাটছে, বালি কাটছে, আর মাটি খুঁজছে। উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে। নতুন হাঁসুলী বাঁক।
এ তো অসাধারণ উপন্যাস।