শাহ সাদেক আলী বই পড়ছিলেন। বই রেখে বললেন, এসো, এসো।
আলীজাহ্ তার সম্মুখে বসলো। তখন সাদেক রোকসানাকে বললেন, ওকে কিছু খেতে টেতে দাও। এখানেই দাও। তারপর আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে, জরিনা সেই বিকেলে বেরিয়েছে। বলেছিলাম ওকে। যায়নি বুঝি এয়ারপোর্ট? তা তোমাকে এত ক্লান্ত দেখছি কেন, আলী?
শরীরটা বিশেষ ভালো নেই।
উদ্বিগ্ন হলেন সাদেক।
ডাক্তার করিয়েছো?
এমন কিছু নয়।
সাদেক বইয়ের পৃষ্ঠায় আবার কিছুক্ষণের জন্য মন দিলেন। কিন্তু চোখ থাকলেও মনটা সেখানে রইলো না। মন রইলো আলীজাহ্ দিকে –তারই সহোদরের দিকে, বাবার মৃত্যুর পর যাকে তিনি সন্তানের মতো মানু করেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন, বাহু দিয়েছেন। শাহ সাদেক আলী কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না –জরিনার মা সেটা বুঝতো–তাই হাজারো কষ্ট দিয়ে হাজারো জ্বালাতন করেও নিশ্চিন্ত নির্ভর থাকা যেত, যে, মানুষটা তাকে ভুল বুঝছে না। আর রোকসানা? রোকসানা কোনদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও সাদেক ইন্দ্রিয়বুদ্ধি দিয়ে প্রথম দিনেই জেনে গেছেন, এ হচ্ছে আলাদা জাতের মানুষ। এদের জন্য মমতা প্রকাশ না হলে ক্ষুণ্ণ হয়, অসহায় বোধ করে। তাই সাদেক যথাসম্ভব মাঝে মাঝে রোকসানাকে এ ক্ষুণতা থেকে, এ অসহায়ত্ব থেকে, নিজের মেজাজ অনুযায়ী মুক্তি দিতে চেয়েছেন। নতুন বাড়িটাও ঠিক এমনি একটা প্রকাশ। জরিনার মা হলে দরকারই পড়ত না হয়ত, কিংবা হয়ত সে নিজেই বাধা দিত। বলত–এত খরচ করে এটা না বানিয়ে, ছোটমোট একটা বাড়ি কর, তাতেই চলে যাবে। কিন্তু রোকসানা সেটা বুঝতো না। রোকসানাকে কিছুটা প্রীত করবার জ, তার জন্য তো সাদেক কিছুই করেননি হাতের সবকটা টাকা ঢেলে বাড়িটা বানিয়েছেন তিনি। কতটা কষ্ট হয়েছে তাঁর, সে কথা অনুক্তই রেখেছেন রোকসানার কাছে। আর এই যে তার সম্মুখে বসে থাকা আলীজাহ্ সে? সেও ঠিক জরিনার মায়ের দলের মানুষ যেন। তার জন্য নিজের গভীর মমতা বোঝাবার মতো চোখে দেখা যায় এমন কিছুই করতে হয় না। ইচ্ছে করলে তো তিনি মন্ত্রী থাকাকালে আলীজাহ্ জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন– শুধু ব্যবসায়ী, লাখপতি, কোটিপতি কাউকে বলে দিলেই হতো। কিন্তু সেটা হতো তার ব্যক্তিগত জীবন আদর্শের মুখে কলঙ্ক মাখিয়ে–আলীজাহ্ এটা বুঝতে পারতো। তাই বছরের পর বছর কষ্ট করেছে, আর্থিক অনটনে নিরন্তর বিব্রত হয়েছে, কিন্তু ক্ষুণ্ণ হয়নি নাদেকের ওপর। নিজের বিবেক এবং কর্মকে কলুষিত না করতে পারার মহত্বটুকু আলীজাহ্ মনে প্রাণে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আলীজাহ্ তো এ রকম হবেই –শাহ সাদেক আলী মনে মনে এখন ভাবলেন—কারণ ও আমার ভাই। নিজের রক্তের ভেতরে আলীজার জন্য নতুন করে তীব্র একটা টান,একটা জোয়ার অনুভব করলেন শাহ সাদেক আলী।
রোকসানা তসতরিতে কিছু ফল কেটে আর নেবুর শরবৎ নিয়ে ফিরে এলো। এসে আলীজাহ্ সম্মুখে টিপয় টেনে সাজিয়ে রাখলেন। বলল, খান।
ভাই?
সাদেক বইয়ের ওপর চোখ রেখেই বললেন, তুমি খাও।
আলীজাহ্ খেতে শুরু করলে তিনি বই নাবিয়ে একজোড়া পূর্ণ চোখ স্থাপন করে তার খাওয়া দেখলেন। ঈষৎ উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন, তোমার সব খবর ভালো তো, আলী?
উত্তরে আলীজাহ্ মাথায় ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কী বোঝাইতে চাইলো তা অস্পষ্টই রয়ে গেল। তাতে কিছুটা বিরক্তি বোধ করলেন শাহ সাদেক আলী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এত তাকে অপরের একেকটা এমনি অস্পষ্ট ভঙ্গি থেকে অর্থ উদ্ধার করতে হয়েছে যে পারিবারিক ক্ষেত্রে সেটা তিনি করতে রাজি নন। সেই বিরক্তিটা দমন করতে একটু সময় লাগলো। অবশেষে বললেন, মনে হচ্ছে শারীরিক কুশল। ঢাকায় কি কিছু কাজ ছিল?
না।
তাহলে আর কী কারণ থাকতে পারে?–শাহ সাদেক আলী চোখ তীক্ষ্ণ করে তার মুখ দেখে কারণটা অনুমান করতে লাগলেন। পরিবারের জন্য মায়া আছে তার, কিন্তু আলীজাহ্ কখনো সে জাতের মানুষ নয় যে কাজ ফেলে সেই মায়ার টানে ছুটে আসবে। অনেকটা ঠিক তার নিজের মতো। এছাড়া, জরিনার এয়ারপোর্টে না যাওয়াটাই নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে তার। তিনি তো বিকেল বেলায় নিজে বলেছিলেন জরিনাকে, তাকে বেরিয়ে যেতেও দেখেছেন তিনি, তবু সে গেল না কেন? তাহলে কি জরিনার সঙ্গে আলীজাহ্ এই হঠাৎ করে চলে আসার একটা অনুক্ত সম্পর্ক রয়েছে? কেমন যেন ওলোটপালোট মনে হয় তাঁর। মনে মনে এই সবের আলোড়ন চলতে থাকে।
কিন্তু বাইরে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্য কথা বলতে লাগলেন, বাড়িটা হয়ে গেছে শুনেছ বোধ হয়? ভালোই হলো তুমি এসেছ। তোমার ভাবী বলছিলেন, নতুন বাড়িতে যাবার আগে তোমাকে একবার আনাতে।
রোকসানা বসে ছিল পাশেই। মাথার ওপরে ঘোমটার ঘের টেনে দিতে দিতে সে তখন যোগ করল, একটা ছোট খাটো কিছু করব ঐদিন।
বলেই সে উৎসুক চোখে সস্মিত মুখে তাকাল আলীজাহ্ দিকে। কিন্তু আলীজাহ্ তার জন্য কিছু বলতে পারার আগেই সাদেক প্রশ্ন করলেন, তোমার ছবি কি শেষ হয়ে গেল?
তখন ঋজু হয়ে বসলো আলীজাহ্। নিঃশেষে চুমুক দিয়ে শরবতের গ্লাশটা নাবিয়ে রাখল টিপয়ে। বলল, না। আমি করছি না। আমি আর ছবি করবে না।
বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কাউকে কোন কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে, পেছনে পাথরের মতো দুটো স্তব্ধ মুখ রেখে, বারান্দায়।
আলীজাহ্ এ অসৌজন্যতা একেবারেই আকস্মিক।
.
তখন থমথম করতে লাগল সারাটা বাড়ি। শাহ সাদেক আলীর মন ভীষণ রকমে বিক্ষিপ্ত, বিস্মিত হয়ে রইলো। রোকসানা না বসতে পারলো তার কাছে, না যেতে পারল আলীজাহ্ কাছে। তার মনে হলো, এক মুহূর্তে দুভাই তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। দুভাইয়ের ভেতর এমন একটা ভাবের বিনিময় হয়ে গেছে, যেখানে সে নিতান্তই বাইরের। তার ভয় করতে লাগল। শোবার ঘরে এসে তখন চুপচাপ বসে রইলো রোকসানা।
শাহ সাদেক আলী স্থাণু হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। অনেক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি, কিন্তু কোনদিন এতটা দোলা লাগেনি তাঁর আত্মায়। সারাটা জীবনে যে রকমটি দেখা যায়নি তাকে, আজ তাই প্রত্যক্ষ করা গেল। বিব্রত হয়ে, বিচলিত হয়ে, স্পষ্ট রকমে নিজের ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করে তিনি আলীজাহ্ কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বারান্দার অস্পষ্ট আলোতে দাঁড়িয়ে আছে আলীজাহ্। তার ঈষৎ আনত মুখ, টান টান মেরুদণ্ড আর রেলিংয়ে প্রসারিত দুই বাহু– সব মিলিয়ে একটা অচেনার আভাস সৃষ্টি হয়েছে। মনের চঞ্চলতাকে দমন করে শাহ সাদেক আলী কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, আলী আমার সঙ্গে এসো।
ঘরের ভেতরে আবার দুজনে মুখোমুখি বসলো। আলীজাহ্ চোখের ভেতরে বহুক্ষণ দৃষ্টি রেখে সাদেক যেন সম্মোহিত করলেন তাকে। বললেন, ওভাবে উঠে যাওয়াটা আমি পছন্দ করিনি।
তখন ছবি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সবটুকু ইতিহাস সবিস্তারে শুনলেন সাদেক। শুধদলেন, তা এখন কী করবে ঠিক করেছ? কিছুই না।
এটা হলো অভিমান। সমস্যার সমাধান তো হলো না।
চাইনে আমি।
তাহলে এত লড়াই করলে, সব কি মিথ্যে ছিল?
উত্তরে সাদেকের দিকে বড় সরাসরি তাকাল আলীজাহ্। এমন করে কোনদিন তাকে তাকাতে দেখেননি তিনি। আলীজাহ্ বলল, অল কোশ্চেন আর ডেড টু মি নাও।
বাংলায় বলো, তিরস্কার করলেন শাহ সাদেক আলী। রূঢ় শোনাল হয়ত কিন্তু ওকে সাহস দিতে হবে আমার, বন্ধুর পথে চলার দীক্ষা দিতে হবে–মনে মনে বললেন তিনি। তারপর কণ্ঠে যতটুকু সম্ভব মমতা মাখিয়ে বললেন, লক্ষ্য থেকে যারা সরে যায় তাদের আমি ঘৃণা করি। লড়াই করতে যারা ভয় পায়, হাত পা গুটিয়ে আনে, তাদের মরে যেতে বলি। একটা দেশের কথা ধরো, একটা জাতির কথা ধরো, একটা মানুষের কথা ধরো–সবার জন্যে যে জীবন দিয়েছেন আল্লাহ, তার মূল্য কি তোমার ভয়, তোমার অভিশাপ দিয়ে মাপা হবে। জীবন একটা মহৎ শক্তির নাম। জীবনের সার্থকতা সংগ্রামে। যে মুহূর্তে তুমি সগ্রাম থেকে হটে গেলে সে মুহূর্তে জীবন থেকেও বঞ্চিত হলে তুমি।
উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন সাদেক। চেয়ারের হাতলে বাঘের থাবার মতো পাঁচটা আঙুল দৃঢ় হয়ে উঠেছে। কপালে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলীজাহ্ প্রায় চিৎকার করে উঠলো, জানি। আমি জানি।
কী! কী জানো তুমি?
ফাঁপা ফাঁপা এইসব কথার কী মূল্য?
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সাদেক। এই কি সেই আলীজাহ্ যাকে তিনি অমিত স্নেহে মানুষ করে তুলেছেন। এই চিৎকার করা, ক্ষুদ্ৰাত্মা, অজ্ঞান মানুষটা?
আলীজাহ্কে তখন যেন ভূতে পেয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলতে লাগল, কানাকড়ি দাম দেব না আমি আপনার কথার। আপনি নিজে কী করেছেন? কোথায় গেল আপনার সংগ্রাম? আপনার লক্ষ্যের জন্য নিষ্ঠা? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন। বলুন আপনি নিজেকে এই কথাগুলো। কেন হাত গুটিয়ে বসে আছেন? মন্ত্রিত্ব যাবার পর, ইলেকশানে আপনাদের সেই জাতীয় পার্টি হেরে যাবার পর, দিস্তে দিস্তে অসার বিবৃতির বকুনি ছাড়া আর কী করেছেন আপনি? কোথায় আপনার আদর্শ? দেশের মানুষ আজ নীলামে যেতে বসেছে, আপনার সাধের পাকিস্তান তার রাজস্ব দিয়ে কতগুলো লোলুপ মানুষের বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স জোগাচ্ছে, মন্ত্রিত্ব মানে আজ টাকা বানাবার গদি হয়েছে–আর আপনি ড্রইংরুমে বসে দুঃখ করছেন। অতিথিদের সঙ্গে আজ দুঃখ করা পর্যন্তই আপনার সংগ্রামের দৌড়। কেন আমাকে বলছেন এই কথাগুলো যা আপনার কাছেই মিথ্যে?
আলীজাহের কণ্ঠ কখন উঁচু পর্দায় গিয়ে পৌঁছেছে তা সে জানে না। রোকসানা ছুটে এলো এ ঘরে।
কী হয়েছে? কী হলো?
কিছু না। আলীজাহ্ চুপ করলো। চুপ করে বিসদৃশ রকমে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতটা তখনো তার শূন্যে ঝুলছে, যা সে একটু আগেই তুলেছিল শাহ সাদেক আলীর দিকে।
রোকসানা তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরাল সাদেকের দিকে। সাদেক তখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আলীজাহ্ দিকে। রোকসানার উপস্থিতি যেন তিনি অনুভবই করতে পারছেন না।
অনুতাপ হলো আলীজাহ্। সংম্বিৎ ফিরে পেলো সে। অনির্দিষ্ট চোখে একবার সাদেকের দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু পারল না। বদলে, আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। এত আস্তে যেন তার সমস্ত শক্তি অন্তর্হিত হয়ে গেছে।
.
খাবার টেবিলে এলো না আলীজাহ্। তার ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল রোকসানা, সেটাও পড়ে রইলো।
জরিনা এলো রাত এগারোটা তখন। জরিনাকে ফটক পেরিয়ে আলো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আসতে দেখে আলীজাহ্ প্রসন্ন হয়ে উঠলো মনে মনে। এতক্ষণে যেন সে অনুভব করতে পারল, সত্যি সত্যি সে ঢাকা এসেছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে আলীজাহ্ জরিনার কাঁধে হাত রাখল, বলল, টমবয় হয়েছিস, না? এত রাত করে আড্ডা মারতে শিখেছিস।
জরিনা কিছু বলল না। চোখ মাটির দিকে রেখে মাথা নাড়লো, যেন স্প্রিং দেয়া পুতুল। আলীজাহ্ শুধালো, ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
চল তোর ঘরে। এয়ারপোর্টে যাসনি যে আজ?
জরিনার ঘরের দিকে যেতে যেতে পরিহাস কণ্ঠে আলীজাহ্ উচ্চারণ করল। ঘণ্টা কয়েক আগে যে সে বিশ্রী একটা দৃশ্য করেছে, তার লেশমাত্র এখন তার ভেতরে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঘরে এসে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল জরিনা। তারপর হেসে ফেলল। সুন্দর, বিলম্বিত হাসি।
এলে তুমি আলীচাচা। আমি মনে করলাম, তুমি বুঝি আসবেই না।
ঠাট্টা করেছি তাহলে টেলিগ্রাম করে?
হুঁ–উ। নইলে আমার মনে হলো কেন আসবে না?
আলীজাহ্ও হেসে ফেলল তার কথা বলবার ধরন দেখে। আদুরে একটা ছোট্ট মেয়ের মতো পা দোলাতে দোলাতে গলায় টান তুলে কথা বলা হরিনাকে তার ভীষণ ভালো লাগল।
ছিলি কোথায়?
কোথায় ছিলাম? এক, বিকেলে নতুন বাড়িতে। খুব বিষ্টি হয়েছিল। তারপর। গিয়ে দেখি সোলেমান সাহেব মেঝেয় পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কাজে ফাঁকি–বুঝলে?
কে?
নতুন বাড়ি সাজানোর জন্যে যে ভদ্রলোক। মজার কাজ।
ও–হো। তারপর?
খুব বকুনি দিলাম! ফ্যালফ্যাল করে তখন, জানো, আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন আমাকে চিনতেই পারছে না।
ফাজলামো রাখ।
বেশ।
গম্ভীর হয়ে গেল জরিনা! তার পর আবার সেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়া।
তারপর সেখান থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে বই পড়লাম। খুব শক্ত বই। কী যেন নাম?
বাজে কথা!
সত্যি।
তারপর বেরিয়ে–কী করলাম। বেরিয়ে কী করলাম যেন?
জরিনা মাথা কাত করে তেরচা চোখে ভাবতে চেষ্টা করল। এ ভঙ্গিটা আলীজাহ্ খুব চেনা। ভঙ্গিটি যেন আরো আপনার একটা ঝির সৃষ্টি করলো তার ভেতরে।
হ্যাঁ, সিনেমা দেখতে গেলাম। দেখতে দেখতে মনে হলো আজ না তুমি আসছো, এতক্ষণ এসে গেছ?
আলীজাহ্ হঠাৎ তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তুই ড্রিংক করেছিস?
না, না।
রিনু।
আলীজাহ্ অবাক চোখে তাকাল জরিনার দিকে। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কপালে রেখে শুধালো, কতটা খেয়েছিস?
অল্প একটু।
ছি, ছি। কেন খেয়েছিস? রোজ খাস।
না।
কে শেখালো?
কেউ না।
তবে?
শুধু আজ। এই একটু। এক্সপেরিমেন্ট করলাম। লোকে বলে না ড্রিংক করলে দুঃখ থাকে না? তোমাদের শরত্যাবু একটা মিথ্যুক। নইলে আমার আরো কান্না পেল কেন?
আলীজাহ্ তাকে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু শোবে না জরিনা।
ইস এত বিশ্রী লাগছে আমার। আমাকে এক্ষুণি সারিয়ে দিতে পারো না। আমি এখন চিৎকার করব কিন্তু।
চুপ, চুপ।
তখন আলীজাহ্ ওকে বাথরুমে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিল অনেকক্ষণ ধরে। বলল, গা ছুঁয়ে বল, আর কখনো খাবিনে। তুই যে একটা কী হয়েছিস?
বকছ কেন?
মাথায় পানি ঢালবার পর কিছুটা ভালো লাগে জরিনার। নিজেই তখন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে থাকে। আর আলীজাহ্ তাকে নতুন করে নতুন চোখে দেখে। নিজের সঙ্গে একটা অলক্ষিতের মিল খুঁজে পায় যেন। মনে হয়, তারই একটা অংশ কোন জন্মান্তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, আজ আবার ফিরে এসেছে।
কী আশ্চর্য, জরিনারও তখন এই কথাটা মনে হচ্ছিল। আলীজাহ্ এই মাণিকের মতো চোখের তারা দুটো মাঝে মাঝে কোন এক অজানা দীপ্তির স্পর্শে এমনি বিচ্ছুরিত হয়। মনে পড়ে তার। শিথিল নদীর একটা ঠাণ্ডা স্রোতের মতো শিথিলতা ছড়িয়ে পড়ল তখন জরিনার শরীরে। মনে মনে উচ্চারণ করল– আলীচাচা।
ব্যক্তিগত, শুভ্র, দীপ্ত একটা শিখার মতো আলীজাকে মনে হয় তার। তীব্র একটা টান জেগে ওঠে বুকের ভেতরে। কোন এক অজ্ঞাত অপরাধের কারণে একই আত্মাকে আল্লাহ দুটো শরীরে বন্দি করে রাখলেন?–ভাবতে ভাবতে একটা অদ্ভুত একাগ্রতার ভেতরে ডুবে গেল জরিনা।
আলীজাহ্ জরিনাকে বলল, কাছে আয়। বোস।
জরিনা বসলো। বলল, সামান্য একটু খেয়েছি তাই এত মাশুল দিতে হচ্ছে।
খাসনে– কখনো খাসনে। আজ আমাকে খুব চমকে দিয়েছিস তুই। আমি না এলে কী হতো বলত?
কী হতো আর? বাবা বিশ্বাস করতেন না। আর বাবার স্ত্রী উঠে পড়ে লাগতেন তাকে বিশ্বাস করাবার জন্যে।
দূর পাগলি।
জরিনা ঝুঁকে পড়ল আলীজার দিকে। বলল, বেঁচে থাকতে হলে, ঘৃণার সঙ্গে আপোস করতে হয়, আলীচাচা?
কেন করবি? তুই করতে পারবি না।
করতে পারলাম না। কিন্তু দুঃখ হয় যে?
হোক। তাই বুঝি মদ গিলতে গিছলি?
জরিনা হেসে ফেলে। বলে, ভুলতে পারছ না। খুব শাসন করতে ইচ্ছে করছে আমাকে? করো আলীচাচা। আমি খুব খারাপ হয়ে গেছি।
তোর আজ মতিভ্রম হয়েছে। আজ তুই আবার কথা বললে মার দেব।
কিছুক্ষণ চুপ করে বইলো দুজনেই। পরে আলীজাহ্ প্রায় ফিসফিস করে শুধালো, মাসুদ লেখে না?
ইতরটার কথা মনে করিয়ে দিও না তো।
কেন?
গভীর দুচোখে জরিনার মুখের দিকে তাকাল আলীজাহ্। আস্তে আস্তে শুধোল, তুই ঠিক বুঝতে পেরেছিস?
হ্যাঁ।
জানতাম। তুই একা থাকবার ভাগ্য নিয়ে এসেছিস।
জরিনা চোখ বুজে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল আলীজাহ্কে। কত সহজে আলীজাহ্ বুঝতে পাবলো। প্রয়োজন হলো না কোনো ব্যাখ্যার, কোনো বর্ণনার।
ঘুম পাচ্ছে তোর?
হ্যাঁ। চোখ মেলল জরিনা। ভাবছিলাম।
না, ঘুমো তুই।
উঠে দাঁড়াল আলীজাহ্। জরিনা বলল, শুনবে না আলীচাচা কী ভাবছিলাম?
বল।
ভাবছিলাম, কাউকে আমার দরকার নেই। যদি কাউকে দিতে হয় নিজেকে তো এমন একজনকে দেব, যে ভালোবাসার কিসসু বোঝে না, জানে না।
হাসলো আলীজাহ্। বলল, মানে, যে ভদ্রলোক তরকারিতে পরিমাণ মতো নুন পেলেই খুশি হবে?
হ্যাঁ। রসিকতাটুকু জরিনার ভেতেরই সংক্রামিত হয়ে গেল যেন। হাসতে হাসতে সে যোগ করল, আর তা না পেলে যে আমার চুলের মুঠো ধরে নাজেহাল করবে। তাতে অনেক সুবিধে। তাতে মনটা থাকবে আমার আমার মতো যারা তাদের জন্যে।
আলীজা চুপ করে ভাবলো খানিক। একটু আগে যে হালকা হাসির রেখা মুখে ছিল তা বিলীন হয়ে গেল। জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি সব। মানুষ আসলে স্বর্গের মতো হতে চায়, কিন্তু পারে না। তাই কিছুদূর যাবার পর বড় বিশ্রী পতন ঘটে। তা নিয়ে দুঃখ করবি কেন?
আর করি না। এখন ভালো হয়ে গেছি। কাউকে লাগবে না আমার। বলতে বলতে আলীজাহ্কে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ কেঁদে ওঠে জরিনা। সে–কী কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
আলীজাহ্ তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মুখটাকে দুহাতের ভেতরে নিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ চন্দনের মতো প্রলেপ করে দেয়। বলে, লক্ষ্মী সোনা কী হলো তোর? পারবি, তুই পারবি, কেন পারবি না? শোন–শোন–দ্যাখ।
আলীজাহ্ তাকে অনেকক্ষণ ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে। নিজের জন্যও যেন সান্ত্বনা মিলছে তার এমনি করে। দুজনের ভেতরে কখন কী ভাবে একটা সুন্দর সেতু গড়ে ওঠে। জরিনার তখন পরম নিশ্চিন্ত নিরাকুল ঘুম পায়। আলীজাহ্ তখন স্থাকে বিছানায় শুইয়ে বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে চলে যায়।
.
ঘুম আসে না শাহ সাদেক আলীর।
পাশে রোকসানা শুয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তার মুখোনার দিকে তাকিয়ে আজ আবার জরিনার মায়ের কথা মনে পড়ে তার। কেমন ছিল দেখতে? চোখ বুজে সাদেক ভাবতে চেষ্টা করেন। নাহ্, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও ঝাঁপসা হয়ে আসছে। কিছুতেই স্পষ্ট করে মনে পড়ে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবলি এপাশ ওপাশ করতে থাকেন তিনি। নাহ, তবু কিছু না। শুধু বেদনার মতো একটা অনুভব। তিনি আজ বড় অভাববোধ করলেন জরিনার মার।
রোকসানা চোখ মেলে সাদেকের কপালে হাত রাখে। ঘুম জড়ানো গলায় শুধোয়, ঘুমোননি?
তুমি ঘুমোও।
রোকসানা তখন আধো উঠে বসে।
আহ উঠলে কেন?
রোকসানা তবু শুয়ে পড়ে না। তখন সাদেক চাপা কণ্ঠে তিরস্কার করেন, কী হলো তোমার?
কিন্তু পরক্ষণেই মমতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। রোকসানার বাহু আকর্ষণ করে শুইয়ে দেন। বলেন, এমনিতে ঘুম ভেঙে গেছে হঠাৎ। তুমি ঘুমোও।
তাঁর কণ্ঠের কোমলতা রোকসানাকে আবার ঘুমের ভেতর নিয়ে যায়। আবার সেই ভাবনাগুলো ফিরে ফিরে আসতে থাকে নিশাচর প্রাণীর মতো পায়ে পায়ে, নিঃশব্দে, তার চারদিকে।
আলীজাহ্ ঠিকই বলেছে, কোথায় গেল আমার সংগ্রাম? অতিথিদের সঙ্গে দুঃখ করা আর বিবৃতি লেখা পর্যন্তই আজ আমার সংগ্রামের দৌড়।
ধিক্কারে ভরে ওঠে মন। ক্ষমা নেই।
আমার ক্ষমা নেই। যে সাহস আমার নিজেরই নেই সে সাহস আমি আরেকজনকে দেব কী করে? লক্ষ্য থেকে আমি নিজেই দূরে, আমি লক্ষ্যের দিকে আলীকে ফেরাবো কী করে? রসুলুল্লাহর সেই কথাটা মনে পড়ল শাহ সাদেক আলীর। নিজে যা অনুসরণ করো না, করতে পারো না–অন্যকে তা অনুসরণ করতে বোলা না।
মনে মনে দরুদ পড়লেন তিনি।
আজ সারা দুপুর ধরে খাদ্য সমস্যার ওপর দীর্ঘ একটা বিবৃতি লিখেছেন। লিখেছেন, কেটেছেন, বাক্যকে আরো শাণিত করে তুলেছেন একেকটা সংশোধনের ভেতর দিয়ে। কই, তখন তো তার মনে হয়নি অসার, অন্তঃসারশূন্য, শাক্তহীন কতগুলো চমক লাগানো কথা তিনি সাজিয়ে যাচ্ছেন?
আলীজাহ্ ঔদ্ধত্যকে আর ঔদ্ধত্য বলে ভাবতে পারছেন না তিনি। ভয় করছেন তার বদলে।
শেষ প্রশ্নের কী জবাব দেব আমি?
নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সাদেক। বসলেন চেয়ারে। টেবিলের ওপর পানি রাখা ছিল। পানি দেখে তৃষ্ণা পেল তার। হাত বাড়িয়ে শিশুর মতো অনেকখানি পানি খেলেন।
যখন আমি প্রথম রাজনীতিতে নামলাম, তখন আমার পাওনার হিসেব ছিল না। মন্ত্রিত্বের স্বপ্ন ছিল না। প্রয়োজন ছিল না কোনো ক্ষমতার–আজ যার একটাও নেই বলে আমি মনে করছি কাজ করব কী করে?
কেন, যে করে আমার যৌবন থেকে কাজ করে এসেছি। তখন কোনো কিছুর আশা না করেই কাজ করেছি। আজ দেশে সামরিক শাসন চলছে, মানুষের বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে, আজো আমার জন্য কাজ করবার আছে। আমার পার্টি ক্ষমতায় নেই বলে কি আমার সব শক্তিও চলে গেছে?
শাহ সাদেক আলী আত্মার ভেতরে ডাক শুনতে পেলেন–এসো, বেরিয়ে এসো। শাহ সাদেক আলী টেবিলের ওপরে ফাইলের ভেতর থেকে বিবৃতিটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।
আবার আমি শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে, মানুষকে দীক্ষা দেব–ঐশ্বর্যে ভরে ওঠার দীক্ষা, সাহসের শিক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সঙ্কল্প।
রক্তের ভেতরে তারুণ্যের জোয়ার ওঠে তাঁর।
আলীজাহ্কে তখন আরো আপন মনে হয়। হঠাৎ বুকের ভেতরে মোচড় ওঠে তার।
সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না। একবার ঘুমন্ত রোকসানাব দিকে তাকিয়ে দেখেন। কাল—হ্যাঁ, কালই তিনি নতুন বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। টাকা নিয়ে কালই আলীজাহ্কে লাহোর যেতে হবে।
ফজরের নামাজ আদায় করে শাহ সাদেক আলী আলীজাহ্ কামরার কাছে এলেন। দেখা পেলেন না। এত ভোরে ও উঠেছে দেখে আশ্চর্য হলেন তিনি।
তারপর এদিকের বারান্দা ঘুরে আসতেই চোখে পড়ল–এই ভোর সকালেই আলীজাহ্ আর জরিনা ব্যাডমিন্টন খেলছে মাঠে। অস্পষ্ট আলোর ভেতরে একটা শাদা পাখির মতো কর্কটা উড়ছে, তাড়া খেয়ে ফিরে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। আর ভোরের দিকে সূর্য উঠে আসছে তার রক্তিম রাজকীয়তা নিয়ে। চারদিকের সবকিছু সেই আভায় বহ্নি হয়ে উঠেছে যেন–যে বহ্নির মতো এখনি সব আরো উর্ধ্বে উঠে যাবে–এই গাছগুলো, ফটক, বাড়ি, ল্যাম্পোস্ট সবকিছু। আর ওরা দুজন হাসছে নিৰ্বরের মতো। লাফিয়ে উঠছে মাটি ছেড়ে সেই রহস্যময় পাখিটাকে তাড়া করবার জন্য। যেন ওরাও আরো একটু পরে পাখনা মেলে। উড়তে থাকবে।
স্বপ্নের মতো চেনা অথচ অচেনা এই ছবিটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন শাহ সাদেক আলী।
.
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
রচনাকাল : ১৯৬১
**