শবঘর পেরিয়ে গেলে এবার একটি খোলামেলা মাঠের মতো পড়ে, তারপর দেখা দেয় কুমুরডাঙ্গার ক্ষুদ্র হাসপাতাল। হাসপাতালটির সামনের শবঘরের মতো অনেকটা জায়গা, তবে সেখানে কোনো গাছপালা-ঝোপঝাড় নেই। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নার্সরা অবাধেই তাকায় তার দিকে। আজ তারা যেন জটলা করে তাকায় তার দিকে।
হাসপাতাল পেরিয়ে তারই পাশ দিয়ে একটি গলি ধরে সকিনা খাতুন অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণ বাড়িঘর পড়ে না; হাসপাতালটি ক্ষুদ্র হলেও তার সামনে-পেছনে বিস্তর জায়গা। হাসপাতালের সীমানা শেষ হলে একটি নিঃসঙ্গ তালগাছের পর দরিদ্র-পাড়া শুরু হয়। সেখান থেকে এবার আবার অনেক চোখ কৌতূহলের সঙ্গে তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখে।
দরিদ্র-পাড়াটি একপাশে রেখে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে ভুঁই ফুড়েই যেন গরুগাড়ির চাকায় সুগভীরভাবে অঙ্কিত একটি পথ জেগে ওঠে যে-পথের আগামাথা নেই বলে মনে হয়।
শীঘ্র সকিনা খাতুনের পথ শেষ হয়। গরুগাড়ির চক্রাঙ্কিত পথটি রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে দু-পাশে দু-চারটে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়িঘর আত্মপ্রকাশ করে যার একটি কারো বসতবাটি নয়; সেটি কুমুরডাঙ্গা শহরের মেয়েদের মাইনর স্কুল।
সচরাচর সকিনা খাতুনের আগেই স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রি করিমুন্নেসা বানু স্কুলে এসে পৌঁছায়। করিমুন্নেসা বানু বহুসমস্যা-জর্জরিত বিধবা মানুষ, শিক্ষয়িত্ৰী বা ছাত্রীর ওপর তার সদা-বিষণ্ণ দৃষ্টি কদাচিৎ পড়ে থাকে। তবে সেদিন স্কুলে প্রবেশ করতেই সকিনা খাতুন করিমুন্নেসা বানুর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। এই যে তুমি এসে গিয়েছ, প্রধান শিক্ষয়িত্রী বলে। হয়তো স্বভাববিরুদ্ধ ধরনের অভ্যর্থনা জানিয়েছে বুঝে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্যে কী বলবে তা স্থির করতে পারে না। এ সময়ে সকিনা খাতুন আরো দু-একজন শিক্ষয়িত্রীকে দেখতে পায়। তারা প্রধান শিক্ষয়িত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে তারই দিকে কেমন স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে, যেন তাকে আগে কখনো দেখে নি বা সে যেন কোনো প্রকারের গুরুতর অপরাধ করেছে। কয়েক মুহূর্তব্যাপী কেমন অস্বস্তিকর নীরবতার পর প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী সকিনা খাতুনের দৃষ্টি এড়িয়ে প্রশ্ন করে,
তুমি নাকি কী-একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাও?
সকিনা খাতুন উত্তর দিতে একটু দেরি করে। অবশেষে শুষ্ককণ্ঠে আস্তে বলে, হ্যাঁ।
তারপর তাদের দিকে তাকাতে সাহস হয় না বলে সে নতদৃষ্টিতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
বৃহৎ বটগাছটির পাশে কালু মিঞার বাড়ির সামনে যেদিন মুহাম্মদ মুস্তফা দেখা দিয়েছিল তার দু-দিন পরে জুমার নামাজের সময় একজন মধ্যবয়সী জামাই আর একজন চাকরের কোলে চড়ে কালু মিঞা গ্রামের মসজিদে হাজির হয়। বৃদ্ধ কালু মিঞাকে বছর কয়েক যাবৎ বাইরে কেউ দেখে নি; অগ্রহায়ণ মাসের এক ভরা দুপুরে কী একটা নিদারুণ রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে তার বাইরে আসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে।
কালু মিঞার চেহারা দেখে মসজিদে সমবেত গ্রামবাসীরা বিস্মিত হয়। একদিন যে। দরাজগলা কর্মব্যস্ত স্বাস্থ্যবান লোক ছিল, বলবতী ধারার মতো যার মধ্য দিয়ে অফুরন্ত জীবনশক্তি প্রবাহিত হত, তাকে চেনাই দুষ্কর। ভ্রূ-দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছে, কোটরাগত চোখ অন্ধের চোখের মতো জ্যোতিহীন, অস্বচ্ছ, অস্থিচর্মাবিশেষ মুখ শত বলিরেখায় কুঞ্চিত। জামাই এবং ভৃত্যটি তার অর্থব, হাড়সম্বল হাল্কা দেহটি সামনের সারিতে বসিয়ে দিলে দুর্বল মেরুদণ্ডের ধনুকসম বক্রতা নিমেষে সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করে, মুখটাও এমনভাবে বুকের ওপর ঝুলে পড়ে যে মনে হয় তা তুলে রাখার ক্ষমতা তার নেই, এবং শীঘ্র আরো মনে হয় দেয়াল-ফুটে-গজানো গাছের মতো সেটি যেন তার ধসে-পড়া বুক ভেদ করেই উঠেছে। তার কোটরাগত চোখ এ সময়ে অদৃশ্য হয়ে পড়ে। হয়তো সে-চোখ শান্তিতে নিমীলিত হয়ে পড়ে, হয়তো তাতে তন্দ্রা নেবে আসে; বর্ষার দিনে মেঘের মতো অতি অনায়াসে বৃদ্ধ মানুষের চোখে ঘুমতন্দ্রা আসা-যাওয়া করে।
কাল মিঞার চেহারা নামাজিদের মনে একটি বিচিত্র ভাবের সৃষ্টি করে, তাদের আকস্মিক দীর্ঘশ্বাসে ছোট মসজিদ-ঘর বার-বার প্রতিধ্বনিত হয়; তার চেহারা নিঃসন্দেহে কালের নির্দয়তার কথাই তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। একদা আপন চেষ্টায় কত কিছু না করেছে লোকটি : বিস্তর জোতজমি বিষয়আশয়, পুকুরের ধারে মস্ত আটচালা বাড়ি, ফলমূলের বাগান। ধীরে-ধীরে আশেপাশে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয় যে সকলে তাকে মাতব্বর হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে; লোকেরা নানা ব্যাপারে উপদেশ-পরামর্শ চাইতে তার কাছে আসত, তার অনুমতি বিনা বিয়ে শাদি বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করত না। দুঃস্থ মানুষেরাও তার সাহায্যপ্রত্যাশী হয়ে পড়ে, সে-ও তাদের দুঃখে দুঃখিত হয়ে কখনো-কখনো মুক্তহস্তে তাদের ধান-চাল-পয়সা দিত, ধার-কর্জ হলে তা পরিশোধ করার জন্যে পীড়াপীড়ি করত না। তবে নিরবচ্ছিন্ন সুখভোগ হয়তো কখনো সম্ভব নয়, কারণ আলো যেমন পতঙ্গ আকর্ষণ করে তেমনি মানুষের সৌভাগ্য হিংসুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই একদিন খেদমতুল্লা নামক একটি লোকের ছায়া এসে পড়ে কালু মিঞার সুখ স্বচ্ছন্দপরিপূর্ণ জীবনের প্রাঙ্গণে। সহসা সবাই জানতে পায় যে এক খণ্ড পৈতৃক জমি ছাড়া অন্যান্য জোতজমির ওপর কালু মিঞার কোনো স্বত্বাধিকার নেই, দলিলপত্র জাল করে একটি সঙ্গতিপন্না কিন্তু মূর্খ নির্বোধ বিধবা এবং তার নাবালক সন্তান-সন্ততিদের ঠকিয়ে সে-সব সে নাকি আত্মসাৎ করেছে। বিধবা নারীটিকে পরামর্শ দিয়ে হক দাবিদাওয়া সম্বন্ধে তাকে সচেতন করে কালু মিঞার হাত থেকে অন্যায়ভাবে কবলিত সে-সব সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয় খেদমতুল্লা। প্রতিদানে সে কী আশা করেছিল কে জানে, তবে তার অন্তরে অর্থলোভের চেয়ে ঈর্ষাই ছিল বেশি; পরের সুখে তার অন্তরে অর্থলোভের চেয়ে সর্বনাশী আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠত। গ্রামবাসীরা বুঝে উঠতে পারে নি কার পক্ষ নেবে-কালু মিঞার, না খেদমতুল্লার। কালু মিঞার প্রতি আনুগত্য দেখালেও এবং সময়ে-অসময়ে তার সুখের অংশীদার হলেও তারাও কি তার উন্নতিতে গোপনে-গোপনে ঈর্ষাবোধ করে নি? সকলের অন্তরেই ঈর্ষা থাকে। প্রতিবেশীর ক্ষেতে ভালো ফসল হয়েছে দেখে কার না ইচ্ছা হয় গরুটা ছেড়ে বা আইলটা কেটে সে-ফসল নষ্ট করে? ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ পরের ক্ষতি করে কেউ করে না, কিন্তু পরের ক্ষতিতে সবাই খুশি হয়। তাই কী হবে তা দেখবার জন্যে তারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে শুরু করে।
তবে সে-দফা কালু মিঞা রক্ষা পায়, কারণ যার মনে প্রচণ্ড ঈর্ষা দেখা দিয়েছিল এবং যে তার বিষম ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছিল, সে-ই নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারায়। হয়তো অদৃশ্য বিচারের খড়গ সদা খাড়া, সদা প্রস্তুত, কখন এবং কেন কার মাথায় নেবে আসে তা সব সময়ে বোঝা সম্ভব নয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কালু মিঞা বলেছিল, খোদার দুনিয়ায় সুবিচারের অভাব নেই, হিংসাত্মক হয়ে যে নির্দোষ মানুষের ধ্বংস করতে চায় সে-ই ধ্বংস হয়। তবে লোকেরা অবিলম্বে একটি কথা শুনতে পায়। সেটি এই যে, খেদমতুল্লার মৃত্যুতে কালু মিঞার নাকি হাত ছিল। হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না : বিচারের খড়গ কখন কার হাতে গিয়ে ওঠে কে জানে। গ্রামবাসীরা সব সময়ে সে-সব কথা জানতে চায় না। অতএব সে যে নির্দোষ তা জানাবার জন্যে কালুমিঞা যে-কথাটি প্রচার করেছিল সে-কথা বিশ্বাস করে নি, অবিশ্বাসও করে নি, শুধু শুনে গিয়েছিল। নিঃসন্দেহে কথাটি আজগুবি, তবু তারা যা স্বচক্ষে দেখে নি তার সত্যাসত্য নিয়ে কী করে মতামত প্রকাশ করে? তাছাড়া খেদমতুল্লা আর বেঁচে নেই, ওদিকে কালু মিঞার জীবন জোতজমি প্রভাবপ্রতিপত্তি সবাই অক্ষত অক্ষুণ্ণ। মানুষের আত্মরক্ষার প্রয়োজনও তারা বোঝে না? শত উপায়ে মানুষকে আত্মরক্ষা করতে হয়, কখনো সত্য বলে কখনো মিথ্যা বলে। এবং কখনো সত্য অবিশ্বাস্য মনে হয় আবার কখনো জলজ্যান্ত মিথ্যা বিচারকের ঘরেও অখণ্ডনীয় সত্য বলে গৃহীত হয়। কথাটি না বলে কালু মিঞার উপায়ই-বা কী ছিল। যে-স্থানে খেদমতুল্লার মৃত্যু ঘটে তার নিকটে মীরণ শেখ নামক কালু মিঞার একজন বিশ্বস্ত লোককে কি দেখা যায় নি।
কালু মিঞা বলেছিল, সিন্দুরগাঁ-এ নিঃসন্দেহে কোনো নিরাপরাধ পরিবারের ধ্বংসের মতলব এঁটে খেদমতুল্লা যখন কামলাতলা বিলের পাশ দিয়ে চাঁদবরণঘাট অভিমুখে যাচ্ছিল তখন সে-পথ দিয়ে মীরণ শেখও বাড়ি ফিরছিল। সন্ধ্যা হয়-হয়। মীরন শেখ সহসা দেখতে পায় খেদমতুল্লাকে, বগলে ছাতা নিয়ে লুঙ্গিটা একহাত দিয়ে কিছু তুলে ধরে নত মাথায় হনহন করে তীব্র বেগে সে হেঁটে আসছে। খেদমতুল্লা বেশ কাছে এসে পড়েছে এমন সময়ে হঠাৎ সে সচকিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মীরন। শেখ প্রথমে ভাবে খেদমতুল্লা তাকে দেখেই এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছ, কিন্তু শীঘ্র বুঝতে পারে খেদমতুল্লার দৃষ্টি অন্য কোথাও, তাছাড়া তার মুখে বিস্ময়ভিভূত নিথর ভাব। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার মিরন শেখ ভীষণাকার দৈত্যের মতো একটি মূর্তি দেখতে পায়। ভীষণকার হলেও মূর্তিটি যেন রক্তমাংসের নয়, সেটি যেন শূন্যের মধ্যে ধুঁয়ার মতো জেগে উঠেছে। তবে আচম্বিতে খাপ থেকে তলোয়ার খোলার মতো বিদ্যুৎঝলকের মতো হঠাৎ আকস্মিকভাবে। তারপর নিমেষে অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে : আবছা মূর্তিটি ঘি-ঢালা আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠে সন্ধ্যাকাশ আলোকিত করে তোলে, সঙ্গে-সঙ্গে সুগম্ভীর কণ্ঠের গর্জন শোনা যায়, পায়ের তলে জমি কাঁপতে শুরু করে থরথর করে। মীরন শেখের পক্ষে আর তাকানো সম্ভব হয় নি। একটু পরে সে যখন আবার তাকাতে সক্ষম হয় ততক্ষণে চোখ-ধাঁধানো আলোটা নিভে গিয়েছে, পায়ের তলে জমিও স্থির হয়ে পড়েছে, কোথাও দৈত্যের মতো মূর্তিটির খেদমতুল্লার কোনো চিহ্ন নেই। মীরন শেখ প্রায় সজ্ঞাহীন অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে কোনোমতে বাড়ি ফিরে আসে।
কথাটি নিঃসন্দেহে অতিশয় বিচিত্র, হয়তো তা তাদের বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু কী সে-আগুন যা দপ করে জ্বলে উঠে সন্ধ্যাকাশ আলোকিত করে তুলেছিল, বিদ্যুৎঝলকের মতো আবির্ভূত হওয়া সে-দৈত্যের ছায়া তারাও কি কখনো-কখনো তাদের অন্তরে অনুভব করে না? হয়তো তাই তেমন অবিশ্বাস্য কথাটি আবার বিশ্বাসও হয়েছে। সে জন্যে কালু মিঞাকে মিথ্যাবাদী বলে নি, এবং হয়তো মনে-মনেও তাকে দোষান্বিত করে নি।
দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই বলে কালু মিঞা বসে-বসে নামাজ পড়ে, তারপর নামাজ শেষ হলে উঠবার চেষ্টা না করে পূর্ববৎ নত মাথায় বসে থাকে। হাতটা একটু কাঁপে, যেন তসবি পড়ে, কিন্তু হাতে তসবি নেই।
সে-দিন নামাজিরা অন্যদিনের মতো নামাজের শেষে যে-যার পথে চলে না গিয়ে অপেক্ষা করে, তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি কালু মিঞার ওপর নিবদ্ধ। ইমামও ঘুরে বসে। নামাজ-খোতবা শেষ হয়েছে বলে তাকে অসহায় দেখায়; কী করবে বুঝে উঠতে পারে না বলে সে শূন্য চোখে নিঃশব্দে দোয়াদরুদ পড়ে। কে জিজ্ঞাসা করবে কেন কালু মিঞা তার অক্ষম অথর্ব দেহটি মসজিদে টেনে নিয়ে এসেছে? কৌতূহলটা তীক্ষ্ম হয়ে উঠলে নামাজিরা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে, তবে কালু মিঞার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে তাদের সাহস হয় না। তাদের কেমন মনে হয়, সে যদি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মসজিদে এসে থাকে সে-উদ্দেশ্যেরই কোনো বিশেষ আকার নেই: বৃদ্ধ মানুষটি তার জীবনের এমন একটি স্তরে এসে উপনীত হয়েছে যেখানে তার উদ্দেশ্য ইহজগতের মানদণ্ডে মাপা আর সম্ভব নয়। উপরন্তু, তার অন্তরে যেন কারো। বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই, ভয়-আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই, নিরাশাও নেই। যদি কিছু থেকে থাকে তা দুঃখ, কারণ সব কিছুর শেষ হলেও দুঃখের শেষ হয় না, অবশেষে দুনিয়ার সব কিছুই অটুট দুঃখে পরিণত হয়; মানুষ যখন তার কবরস্থান অভিমুখে রওনা হয় তখন কেবল দুঃখেই তার প্রাণহীন দেহ জমাট হয়ে থাকে।
অবশেষে ইমাম প্রশ্ন করে। কিছু বলবেন কালু মিঞা?
নিঃশব্দ মসজিদ-ঘরে আকস্মিক প্রশ্নটি বৃদ্ধ কালু মিঞাকে চমকিত করে। হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ইমামের প্রশ্নে তার নিদ্রাভঙ্গ হয়। ঈষৎ বিহ্বলভাবে মুখটি কিছু তোলে, কয়েকমুহূর্তের জন্যে তার কোটরাগত চোখের খানিকটা দেখা যায়। তবে শীঘ্র সে-মুখ আবার বুকের ওপর ঝুলে পড়ে, যেন বুকের মধ্যেই তার মুখ আশ্রয় সন্ধান করে; যে-বুকের মধ্যে একদিন কত আশা-নিরাশা আলোছায়ার মতো খেলা করেছে, কত ভালো-মন্দ বাসনা-কামনা ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করেছে, সে-বুকে এখন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি কারণ সেখানে সমস্ত আলোছায়ার খেলা সব ঝড়ঝঞ্ঝার অবসান ঘটেছে। তারপর মনে হয় বৃদ্ধ মানুষটি কাঁদতে শুরু করেছে; তার শীর্ণ দেহটি থরথর করে কাঁপে। কেবল চোখে অশ্রু দেখা দিয়ে থাকলেও সময়কাল-কর্ষিত চিবুকে কোনো সজলতার আভাস দেখা যায় না।
বলেন কালু মিঞা, ইমামটি দরদীকণ্ঠে বৃদ্ধকে আবার বলে।
কালু মিঞা নিজেকে সংযত করে, অথবা যে-ভাবাবেগ তার দেহে সহসা কম্পন সৃষ্টি করেছিল সে-ভাবাবেগ নিঃশেষ হয়ে যায়; তার দেহ ধীরে-ধীরে স্থির হয়ে পড়ে। কেবল হাত-দুটি পূর্ববৎ কেঁপে চলে। এবার সে কী-যেন বলে, কিন্তু তার ক্ষীণকণ্ঠ মুখ হতে বেরিয়ে এসে পিপীলিকার মতো শুভ্র দাড়ি বেয়ে বস্ত্রের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে যায়, সে-কণ্ঠ কারো কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।
ইমাম নয়, অন্য কেউ জিজ্ঞাসা করে, কিছু বললেন কালু মিঞা?
কালু মিঞার কণ্ঠ দ্বিতীয় বার শোনা যায় না। একটু অপেক্ষার পর কালু মিঞার। জামাই শ্বশুরের পক্ষে বলে, তিনি বললেন-খেদমতুল্লাহকে খুন করেন নাই, করানও নাই।
তবে, এ-কথা বলবার জন্যেই বৃদ্ধ কালু মিঞা দুটি মানুষের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে মসজিদে এসেছে। মসজিদে কেউ মিথ্যা বলে না; সেখানে মিথ্যা বললে যে-গুনাহ্ হয় সে-গুনাহর মাফ নেই।
ঘরময় সহসা গভীর নীরবতা নাবে, সবাই শাসরুদ্ধ করে অপেক্ষা করে। হয়তো তাদের মনে হয় হঠাৎ অতি অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটবে, কোথাও একটি বিশাল হাওয়াই তারাবাজি সমগ্র দুনিয়া আলোকিত করে বিকট আওয়াজে ফেটে পড়বে, পায়ের তলে অতল গহ্বর সৃষ্টি করে ধরণী দ্বিধাকৃত হয়ে পড়বে। তারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে। এমন সময়ে মানুষের কিছু করতে নেই : নাইওরে যেতে নেই, বরাতে শরিক হতে নেই, কাস্তে-কোদাল হাতে নিতে নেই, খাজনা-খেসারত দিতে নেই, দাখিলি জমা করতে নেই, গঞ্জে গিয়ে দাদন দিতে নেই, প্রসূতির স্তনে ঠোকা জাগলে অধীর হতে নেই।
তবে কিছুই ঘটে না। এক সময়ে তারা দেখতে পায় জামাই আর ভৃত্যটি হাতে হাতে মিলিয়ে যে-আসন তৈরি করেছে, সে-আসনে বসে বৃদ্ধ কালু মিঞা মসজিদ ত্যাগ করছে। মসজিদ-ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটি অতিক্রম করে দরজার নিকটে পৌঁছুলে আকস্মিক আলোতে বৃদ্ধের চোখ দুটি মিটমিট করে ওঠে, অন্ধের চোখে যেন প্রাণ সঞ্চার হয়, এবং সে-আলোয় তার শুভ্র দাড়ি তার মুখমণ্ডল শীতল তারার শুদ্ধ নির্মল রূপ ধারণ করে।
কালু মিঞা নিরাপদে মসজিদ ত্যাগ করে।
তবারক ভুইঞা বাজারে সাইকেলের দোকানের মালিক ছলিম মিঞার কথা বলছিল। ছলিম মিঞা জনপ্রিয় মানুষ নয়। বরঞ্চ বদমেজাজি জন্তু-জানোয়ারকে মানুষ যেমন এড়িয়ে চলে তেমিন লোকেরা তাকে এড়িয়ে চলে, অকারণে বড় একটা তার নিকটে আসে না। তবু সকলে গোপনে-গোপনে তাকে সমীহ না করে পারে না। মানুষের তুচ্ছতম দোষ-ত্রুটিও তার সহ্য হয় না, কিছু পছন্দ না হলে পরিষ্কারভাবে বলে ফেলে, তবে নীচমনা কুৎসা-পরনিন্দায় তার প্রবৃত্তি নেই। এবং দুনিয়ায় কোথাও সে ভালো কিছু দেখতে না পেলে মনে হয় সত্যিই কোথাও ভালো কিছু নেই। মানুষের চরিত্র-আচরণ-ব্যবহারে অনেক কিছু সে দেখতে পায় যা অন্যদের চোখে ধরা পড়ে না। অনেকদিন আগে স্টিমারঘাটের বাদশা মিঞা যখন প্রথমবার খৈনিমুখে বাজারের পথে দেখা দিয়েছিল তখন সে-ই তার চোয়ালের অস্ফুট সঞ্চালন লক্ষ করেছিল। কায়েক মুহূর্ত তার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গভীর বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে বলেছিল : কাকের ময়ূর হবার সখ, কুচকাঁটার কদলীগাছ হবার সাধ। তবু লোকটি নির্দয় নয়। ঘাট বন্ধ হবার পর যখন জানা যায় বাদশা মিঞা চাকুরি হারিয়েছে তখন উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল, ঐ যে ব্যাটাটা খৈনি খায়, উড়ে-বিহারি ভাব দেখায় এবার কী হবে তার? ছলিম মিঞার খিটখিটে মেজাজের পশ্চাতে কোথায় যেন ন্যায় অন্যায়ের বিষয়ে গভীর সচেতনতা।
মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন যে একটি বিচিত্র কান্না শুনতে পায় সে-খবর শোনার পর ছলিম মিঞা প্রথমে কিছু বলে নি, কেউ প্রশ্ন করলে সবেগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নীরব হয়ে থেকেছে যেন অবান্তর কথার ওপর কোনো উক্তি করা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয় তার কাছে। তবে সেদিন রাতে স্ত্রীর মুখে কথাটি শুনলে সহসা রাগান্বিত হয়ে পড়ে।
বেশ রাত করে দোকানে ঝাঁপ দিয়ে বাড়ি প্রত্যাবর্তন করে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে এমন সময়ে তার স্ত্রী করিমন কথাটি তোলে। করিমন বলে, আমার কেমন মনে হয় কিছু একটা হবে। সেদিন থেকে মধ্যে-মধ্যে কেমন একটা। অস্বস্তির ভাব যেন বুকের ভিতর।
ছলিম মিঞা নীরবেই শোনে, কিন্তু অবান্তর কথাটির উত্থাপনে অসন্তুষ্ট হয় বলে খাওয়ার ভঙ্গিতে ক্ষিপ্রতা এসে পড়ে। বস্তুত, কথাটি কখনো তাকে প্রীত করে নি। মেয়েটি কী শোনে কে জানে। তাছাড়া কিছু শুনতে পায় তাই-বা কী করে বলা যায়। হয়তো সেটি তার কল্পনা, বা কানের ভুল। যা ছলিম মিঞাকে আরো অসন্তুষ্ট করে তা এই যে, মেয়েটি কিছু শুনে থাকলেও লোকেরা এমন শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়বে কেন? জীবনে কখনো কান্না শোনে নি তারা?
তবু ছলিম মিঞা রাগান্বিত হত না যদি তার স্ত্রী সহসা একটি অদ্ভুত কথা না বলত। স্বামীর অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করলেও করিমন নিরস্ত হয় না। করিমন সাদাসিধে মানুষ, কথাও তেমন বলে না, তবে ক্বচিৎ কখনো কিসে তাকে যেন পেয়ে বসে, অকস্মাৎ কথা বলতে শুরু করে। তখন তার শ্রোতার প্রয়োজন হয় না, অনেক সময়ে শ্রোতা থাকেও না। এ-সময়ে তার মুখে-চোখে কেমন একটা ভাব জেগে ওঠে, যেন বুকের মধ্যে থেকে যে-সব কথা উদ্বেলিত হয়ে শব্দাকারে দেখা দিয়েছে তারই আওয়াজে সে সম্মোহিত হয়ে পড়েছে। জীবনের দুঃখ-দুর্দশা নিয়েই সে কথা বলে এবং কোনো ঘটনা অনেকদিন আগে ঘটে থাকলেও এমনভাবে তার অবতারণা করে যে মনে হয় তা সম্প্রতি ঘটেছে, এবং তা তার বুকে যে আঘাতের সৃষ্টি করেছিল সে-আঘাত সবেমাত্র কাটিয়ে উঠেছে। কখনো-কখনো তার কথায় ছলিম মিঞা বিস্মিত হয়, কারণ তার স্ত্রী অকস্মাৎ এমন কথা পাড়ে যা আগে কখনো শোনে নি। কোত্থেকে আসে, কোথাই-বা দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে রাখে সে-সব কথা? তবে ছলিম মিঞার বিশ্বাস, যা তার স্ত্রী বলে তার অধিকাংশই অসত্য। সে যে সজ্ঞানে মিথ্যা বলে তা নয়; তার মস্তিষ্কটি এমনই যে সেখানে সময়কাল, সত্য-অসত্য, আশা-আকাক্ষা, ভীতি আশা–এসব কী করে গোলতাল পাকিয়ে যায়। এজন্যে সচরাচর স্ত্রীর কথায় বড় একটা কান দেয় না, কেবল তা অসহ্য রকমের ঘ্যানঘ্যানানিতে পরিণত হলে বা অসম্ভবের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে ধমকে বলে, চুপ করো। ধমক খেয়ে করিমন চুপ করে, সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তব জগতেও প্রত্যাবর্তন করে।
মনের অসন্তুষ্টি চেপে ছলিম মিঞা আপন ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়েছে এমন সময়ে সহসা সকর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ সে শুনতে পায় মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ের কথা বলতে-বলতে তার স্ত্রী অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। পনেরো-বিশ বছর আগে একবার কুমুরডাঙ্গায় যে-বসন্ত রোগের মহামারী লেগেছিল, কোনো কারণে সে-মহামারীর কথাই তুলেছে। প্রথমে ছলিম মিঞা ভাবে, অবশেষে তার স্ত্রী সকিনা খাতুনের কথা ভুলেছে। কিন্তু শীঘ্র তার ভ্রান্তি দূর হয়।
করিমন বলে, তখনো মড়ক লাগে নি, সহসা আমি কী একটা কান্না শুনতে শুরু করি সকিনা খাতুনের মতোই। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করি, কোনো কান্না শুনতে পাও? সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায় যেন, আমার মাথা খারাপ হয়েছে। আমি অবশেষে বুঝতে পারি কোথাও কেউ যদি কেঁদে থাকে সে-কান্না আমিই কেবল শুনতে পাই। তারপর মড়ক লাগে। কত লোক মারা গেল সেবার! একটু থেমে আবার বলে, মড়ক লাগবে বলেই অন্তরে কান্নাটি শুনতে পেতাম। অন্তর অনেক সময়ে অনেক কিছু জানতে পায়।
কথাটি শোনামাত্র ছলিম মিঞা বুঝতে পারে তাতে একরত্তি সত্য নেই, এবং খুব সম্ভব পূর্বে তেমন কথা তার স্ত্রীর মনে কখনো দেখা দেয় নি কী-করে মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ের কথায় তেমন একটি ধারণা মাথায় এসে সহসা সত্যের রূপ ধারণ করেছে।
এবার ভাত-মাখা হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ছলিম মিঞা ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, চুপ করো, চুপ করো বলছি।
শীঘ্র খাওয়া শেষ করে নিত্যকার মতো ভেতরের উঠানের পাশে হুঁকা নিয়ে সে বসে, তবে হুঁকায় স্বাদ পায় না। তার মনে হয় বিষম ক্রোধে তার সমস্ত অন্তর যেন কুঁকড়ে রয়েছে।
পরদিন ছলিম মিঞা যখন দোকানে যাবার আগে অন্যদিনের মতো বাড়ির পেছনে আতাফলের গাছগুলি দেখতে যায় তখনো তার রাগ পড়ে নি, মুখে থমথমে ভাব। আতাফলের গাছগুলির দিকে দৃষ্টি দিয়ে সেদিন তার আনন্দ হয় না যদিও নিত্য এ সময়ে গাছগুলির ওপর চোখ পড়তেই তার চোখ তৃপ্তিতে নরম হয়ে ওঠে। গাছগুলি শ্রমের ফল, বড় শখের জিনিস। চার বছর আগে বৈশাখ মাসে চারা লাগানোর পর থেকে স্নেহভরে তাদের বৃদ্ধি লক্ষ্য করে এসেছে, নিচে জমিতে যাতে অতিরিক্ত পানি জমে না যায় আবার শুষ্কতাও দেখা না দেয় বা গোড়াতে আগাছা না জন্মায়-এসব বিষয়ে সতর্কতারও সীমা থাকে নি। চার বছরের যত্ন-সতর্কতার ফলে গাছগুলি বড় হয়ে উঠেছে, কিছুফলও ধরেছে। তবে প্রথম ফল কখনো ভাল হয় না। তার বিশ্বাস দু-এক মাসের মধ্যে বর্ষাটা ভালো করে নাবলে বেশ উত্তম ফল ধরবে এবং এক-গাছ থেকে দুই-শ আড়াইশ ফলও পাবে। ফলমূলের গাছ করার ব্যাপারে তার বড় উৎসাহ এবং নিজের হাতে যা লাগায় তা ভালোও হয়। কেবল বেশি কিছু করার সুযোগ নেই। ঐ তো ছোট জমিটা, বাড়ির পেছনে। তবু সেখানে কত কিছুই না করে : আলু পটল মটর হতে শুরু করে লেবু লিচু, এবং এখন আতাফল। বাল্যকালে ছলিম মিঞা এতিম হবার পর লোকেরা বলত বড় হয়ে সে ভাগ্যবান হবে। ভাগ্যের নমুনা এখনো দেখে নি, তবে কখনো-কখনো তার মনে হয় অল্প বয়সে পিতা-মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত মানুষটির প্রতি গাছ-লতাপাতা যেন কিছু করুণা বোধ করে।
প্রিয় গাছগুলির দিকে প্রায় না তাকিয়েই ছলিম মিঞা দোকান অভিমুখে রওনা হয়। দোকানে পৌঁছে ঝাঁপ তুলে নির্দিষ্ট স্থানে বসে, মুখের থমথমে ভাব তখনো কাটে নি। শেষরাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। সামনের সাদা মাটির পথটি এখনো সিক্ত, এখানে-সেখানে জমা পানি। সে-পথের দিকে নিপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছলিম মিঞা যেন পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে বিস্মৃত হয়ে স্থির হয়ে থাকে, ঠোঁটের প্রান্তে বক্র রেখায় মানুষের নির্বুদ্ধিতার প্রতি গভীর বিতৃষ্ণার ভাব। একটু পরে একটা খরিদ্দার আসে। সাইকেলের খরিদ্দার নয়; সাইকেলের খরিদ্দার কালেভদ্রে আসে। ছলিম মিঞা তার দোকানে অন্যান্য জিনিসও মজুত রাখে : পেরেক বন্টু লোহা-লক্কড় সুঁচ-সুতা-এই ধরনের নানাপ্রকারের চুটিচাটি জিনিস।-খরিদ্দারটি কিছু বলে, কিন্তু তার কথা ঠিক তার কর্ণগোচর হয় না, কারণ সহসা পথে একটি ছায়া জেগে উঠলে সেদিকে তার দৃষ্টি ছুটে যায়। ছায়াটি মোক্তার মোছলেউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুনের রূপ ধারণ করে : অন্যদিনের মতো কালো ছাতা মাথায় সকিনা খাতুন বাজারের পথ দিয়ে স্কুল অভিমুখে চলেছে। নুয়ে থাকা ছাতার জন্যে মুখের নিম্নাংশ শুধু চোখে পড়ে, এবং সে-অংশটিও ছায়াচ্ছন্ন বলে তেমন পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না। অন্যদিনের মতো ঈষৎ মাজা-ভাঙ্গা ভঙ্গিতে ধীর-মন্থর গতিতে সে হাঁটে, তবে পথের এখানে-সেখানে জমে-থাকা পানির জন্যে আজ তাকে এঁকেবেঁকে চলতে হয়।
ছলিম মিঞা প্রথমে নিথর দৃষ্টিতে সকিনা খাতুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত এমনি কাটে। তারপর কী যেন ঘটে, সহসা কোথায় যেন একটি শিরা ফেটে যায়, তার চোখ দুটি নিমেষে রক্তাপ্লুত হয়ে পড়ে, কী একটা দুর্বোধ্য ক্রোধে তার নাসারন্ধ্র কাঁপতে শুরু করে। এবার ক্ষিপ্রবেগে উঠে দাঁড়িয়ে উন্মত্ত পশুর মতো দোকান থেকে পথে নেবে সকিনা খাতুনের পথরুদ্ধ করে দাঁড়ায়, আসবার সময়ে পানি জমা স্থানে পা পড়লে ছলাৎকরে কিছু পানি যে তার লুঙ্গি ভিজিয়ে দেয় তা লক্ষ্য করে না।
এবার একটি তীক্ষ্ম আর্তনাদে পথের এ-মাথা ও-মাথা যেন কেঁপে ওঠে।
কী কান্না শোনেন, কোথায় কান্না শোনেন?
মুহাম্মদ মুস্তফা অতিশয় সাবধানী মানুষ; জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর থেকে সাবধান হয়ে কখনো কিছু করে নি, অসতর্কভাবে কখনো এক পা-ও নেয় নি। আমার মনে হয়, বাল্যবয়সে তার মধ্যে যে-উচ্চাশা দেখা দিয়েছিল (উচ্চাশা ছাড়া অশিক্ষিত প্রায় দরিদ্র পরিবারের ছেলে অতদূর কি যেতে পারত?) সে-উচ্চাশার বিষয়ে কখনো আপন মনেও স্পষ্টভাবে ভাবতে সাহস করে নি এই ভয়ে যে তা নিয়ে উচ্চবাক্য করলেও কোথাও কোনো হিংসাত্মক শক্তি তাকে ধ্বংস করার জন্যে খড়গহস্ত হবে। তার অগ্রসর হওয়ার পথে কোনো বাধাবিপত্তি দেখলে তার বহর খাটো করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নি, মল্লযুদ্ধে আহ্বান করে নি, বরঞ্চ ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার সঙ্গে মিলে মিশে থাকবার চেষ্টা করেছে এবং দুর্জয় শত্রু নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে নিন্দ্রাভিভূত হলে সুযোগ বুঝে আস্তে সরে পড়েছে। ছুটিছাটাতে দেশের বাড়ির পথ ধরলে তার মনে যে-ভাবটি দেখা দিত তাও তার সাবধানী চরিত্রের পরিচায়ক। চাঁদবরণঘাটে স্টিমার থেকে নেবে খালে পথ ধরলে সহসা তার কেমন মনে হত সে যেন কখনো ইস্কুলে কলেজে পড়ে নি বড়বড় পরীক্ষা পাস দেয় নি, এমন যে-গ্রাম যে-জীবন থেকে নিস্তার পাবার জন্যেই এত শ্রম-অধ্যবসায়, সে-গ্রাম বা জীবন ছেড়েও কখন কোথাও যায় নি। দেশের বাড়ির পথে চৈত্র মাসের বৃক্ষপল্লবের মতো তার সমস্ত তালিম-শিক্ষা নিঃশব্দে ঝরে-পড়া, তারপর গ্রামের সামীপ্যে উপস্থিত হলে পদক্ষেপে জড়তা মুখে-জবানে উনবুদ্ধি ঢিলেমি দেখা দেয়া-এ সবের কারণ এই নয় যে দরিদ্র অশিক্ষিত গ্রাম এত দুর্বল এত অসহায় যে সেখানে শিক্ষাদীক্ষার ঈষৎ চিহ্নপ্রদর্শনও অন্যায়, সাবধানতাই ঐ ভাবটির আসল কারণ : দন্তহীন নিরীহ জন্তুকেও উস্কাতে নেই, কোনো আপদ-বিপদ চোখে দেখা না গেলেও নিরাপদ বোধ করা অনুচিত। এ-ধরনের সাবধানতার আসল উপাদান হল ভীতি এবং সে-কথা নিজে বুঝলেও মুহাম্মদ মুস্তফা কখনো লজ্জা বোধ করে নি, বরঞ্চ নিরাপত্তার জন্যে ভীতি একান্ত আবশ্যকীয়-এমন একটি দৃঢ়বিশ্বাসে সচেতনভাবে সে-ভীতি লালিত-পালিত করে তাকে তার চিন্তাধারা আচরণ-ব্যবহারের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে নেয়; ভীত মানুষ কখনো বেপরওয়া হয়ে হঠকারী কাজ করে বসে না, তেমন কাজের পরিণামও তাকে ভোগ করতে হয় না। এমন মানুষ কি সজ্ঞানে স্ব-ইচ্ছায় কালু মিরি বাড়ির সামনে উপস্থিত হবে? তবে সজ্ঞানে না হোক, তারই অজানিত কোনো দুর্বোধ্য তাড়নায় সেখানে উপস্থিত হয়ে থাকবে-এমন একটি সন্দেহ মুহাম্মদ মুস্তফার মনে দেখা দিয়েছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করতে তার দেরি লাগে নি। তাও-বা কী করে সম্ভব? তার বিশ্বাস মানুষ তার নিজের মনের মতিগতি বুঝতে পারবে না তা হতে পারে না। অন্যের কাছে একটি মানুষের মন দুর্বোধ্য বা রহস্যময় মনে হতে পারে যার কারণ শুধুমাত্র এই যে, সমাজে বাস করতে হলে মানুষকে পরের কাছ থেকে অনেক কিছু ঢাকতে হয়, ছলনা-কৌশলের শরণাপন্ন হতে হয়, যে-পথ ধরে সে-পথও সকল সময়ে সোজা চলে না। কিন্তু নিজের কাছে মানুষের মন দিবালোকের মতো সদাস্বচ্ছ সুস্পষ্ট, সেখানে অজানার ছায়া বা গুহাপথের রহস্যের অবকাশ নেই। এ কি সম্ভব যে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কালু মিঞার বাড়ির সামনে দেখা দেবে অথচ সে-উদ্দেশ্য তার কাছেই অজ্ঞাত থাকবে?
তবে মুহাম্মদ মুস্তফা যে পথভ্রষ্ট হয়ে কালু মিয়ার বাড়ির সামনে প্রাচীন বটগাছটির নিকট হাজির হয়েছিল এবং বাল্যকালের স্মৃতি স্মরণ করেই তার তলায় একটু দাঁড়িয়ে পড়েছিল-এসব কথা বাড়ির লোকদের বিশ্বাস হয়নি। সে-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে একটি আশা, কেমন একটা উত্তেজনাও, ধীরে-ধীরে তাদের গ্রাস করে, এবং সত্য বলতে কী, আমিও কিছু আশান্বিত কিছু উত্তেজিত হয়ে উঠি। সবারই মনে হয়, এবার মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু করবে। তার বাপের মৃত্যুর পর অলসপ্রকৃতির ছোট চাচা হঠাৎ কী কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল এই মর্মে যে এখন মুহাম্মদ মুস্তফা নাবালক, কিন্তু তাকে বড় হতে দাও, তখন দেখবে। সহসা সেই ভবিষ্যদ্বাণীটি সকলের মনে পড়ে। মুহাম্মদ মুস্তফা আর নাবালক নয়, ইতিমধ্যে অনেক পাস-পরীক্ষাও দিয়েছে, যে-দিনের জন্যে ছোট চাচা অপেক্ষা করতে বলেছিল সেদিন হয়তো এসেছে।
আমরা যে আমাদের আশা-উত্তেজনার কারণ বা স্বরূপ ঠিক বুঝতে পারি তা নয়। দিনটা এসে থাকলেও কিসের জন্যে সেদিন এসেছে, কীই-বা করবে মুহাম্মদ মুস্তফা? তবু আশাটি একবার দেখা দিলে সেটা নূতনও মনে হয় নি; একদিন মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু করবে সে-বিশ্বাস খেদমতুল্লার মৃত্যুর পরেই কি আমাদের মনে দেখা দেয় নি?
খেদমতুল্লার মৃত্যুর পর তার প্রতি আমাদের মনোভাবের বিষম পরিবর্তন ঘটে। তার জীবনের শেষ দিকে সে আর বাড়ির লোকদের স্নেহমমতার পাত্র ছিল না। বলতে গেলে, খেদমতুল্লাই সমস্ত স্নেহের বন্ধন নিজ হাতে ছিন্ন করেছিল। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের প্রতি তার উদাসীনতা স্বার্থপরতা অবিবেচনার ফলে সকলের মনে গভীর বিরূপ ভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। তার অবিরেচনা সহ্য করতে না পেরে ছোট চাচা তার নাম মুখে নেয়া বন্ধ করেছিল, বাপজান একবার বড় অর্থকষ্টে পড়লে তার কাছে সামান্য সাহায্য চেয়ে সাহায্য না পেলে স্থির করেছিল হৃদয়হীন ভাই-এর মুখ কখনো দেখবে না। দেখাদেখির অবকাশও ছিল না। চাঁদবরণঘাটে বসবাস শুরু করার পর খেদমতুল্লা দেশের বাড়িতে আসা ছেড়ে দিয়েছিল, এমনকি ঈদের দিনে কম ভাগ্যবান ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের স্মরণ করে কখনো একটা ছিটের জামাও পাঠিয়ে দিত না। তবু তার অপঘাতে মৃত্যুর পর ভাইদের মন থেকে সমস্ত বিরূপতা অদৃশ্য হয়ে যায়, তার বিধবা স্ত্রী এবং পিতৃহারা অল্পবয়স্ক ছেলেকেও তারা সাদরে বাড়িতে গ্রহণ করে। খেদমতুল্লা নিষ্ঠুরপ্ৰাণ দুর্বৃত্ত লোক ছিল, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের দিকে মুখ ফিরেও তাকাত না, তবু সে এ-বাড়িরই কারো ভাই কারো চাচা-জেঠা ছিল, তাদের সবাইকে উপেক্ষা করে অন্যত্র চলে গেলেও এ-বাড়িতেই তার জন্ম হয়েছিল। তবে কে জানে, যদি স্বাভাবিক কোনো কারণে খেদমতুল্লার মৃত্যু ঘটত তবে হয়তো এমন ভাবান্তর ঘটত না। হয়তো খেমতুল্লার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে জবাই-করা গরুর নিথর নিস্তেজ দেহের মতো যে-অসহায়তা প্রকাশ পায় সে-অসহায়তা, তারপর অন্যায়ের বিচার দেখার যে-বাসনা স্বভাবতই জেগে ওঠে তাদের মনে সে-বাসনা-এ সবের তলে মৃত লোকটির দোষঘাট নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তবে তখন তারা কিছু করতে পারে নি, সামান্য আস্ফালন করে নিরস্ত হয়। তারা জানত, সরকার বা পুলিশ কিছু করবে না, সুবিচারের আশা দুরাশা মাত্র। কালু মিঞার তখন সমগ্র অঞ্চলে প্রচণ্ড প্রভাব প্রতিপত্তি; কালু মিঞাই যে খেদমতুল্লার হত্যার জন্যে দায়ী সে-বিষয়ে কারো কাছে জলজ্যান্ত সাক্ষি-প্রমাণ থাকলেও সে-সাক্ষি-প্রমাণ নিয়ে এগিয়ে আসবে না-তাও জানত। বস্তুত, কেউ একবার বেফাসে একটি কথা বলে ফেলে মুখে যে খিল দিয়েছিল আর টুশব্দ পর্যন্ত করে নি; একটি মানুষের ঘাড়ে কটাই-বা মাথা?
তবে যারা কিছু করতে পারে নি তাদের মনে সে-সময়েই আশাটির জন্ম হয় : বড় হয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু করবে। তাই তার বাপের মৃত্যুর পর সে যখন পড়াশুনা করে যাবে বলে দৃঢ়সংকল্প হয় তখন সে-সংকল্পের মধ্যে একটি অর্থই দেখতে পায় সবাই একদিন কিছু করতে চায় বলে সে পড়াশুনা করে প্রথমে মানুষ হতে চায়। তার চরিত্রগত সাবধানতা-সতর্কতার মধ্যেও তার সেই অনুচ্চারিত উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দেখতে পায় : একবার মানুষ হয়ে শক্তি-সামর্থের অধিকারী না হওয়া পর্যন্ত হুশিয়ার হয়ে চলা সমীচীন নয় কি? তারা কেউ বিশ্বাস করে নি খেদমতুল্লা অতিশয় দুর্বৃত্ত চরিত্রের লোক ছিল বা নিদারুণ শাস্তিটা তার প্রাপ্য ছিল-এসব মুহাম্মদ মুস্তফা নির্বিবাদে গ্রহণ করে নিয়েছে। তা কী করে সম্ভব? বাপ-মায়ের বিষয়ে কোনো সন্তানের হৃদয় লৌহগঠিত নয়। তাছাড়া তা বিশ্বাস করলে জীবনে আর থাকে কী? এমন একটা ধারণাতেই কোথাও সমস্ত কিছু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় না কি?
মুহাম্মদ মুস্তফা যে দৈবক্রমে কালু মিঞার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয় নি-তা প্রথমে তার মুখের ওপর বলতে আমাদের সাহস হয় নি; ততদিনে প্রায়-গ্রামছাড়া উচ্চশিক্ষার্থী মুহাম্মদ মুস্তফা সকলের অজান্তেই দূরে, কিছু উর্ধ্বেও চলে গিয়েছে, এবং স্নেহমমতা বা শুভাকাঙ্খার কমতি না হলেও তার এবং বাড়ির মধ্যে ইতিমধ্যে একটি অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছিল বলে সম্পর্কে পূর্বের সরলতা বা স্বচ্ছন্দতা ছিল না। তবে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, স্ব-ইচ্ছায় সজ্ঞানেই মুহাম্মদ মুস্তফা কালু মিঞার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেখানে তার আবির্ভাব এবং একদিন কালু মিঞার সম্বন্ধে লোকেরা যা বলাবলি করত এ-দুটির মধ্যে সম্বন্ধ না থেকে পারে না। পথ ভুল হয় কী করে? যারা নিয়মিতভাবে গ্রামে বসবাস করে তাদের মতো সময়-অসময়ের ধুলা উড়িয়ে বা কাদা ভেঙ্গে সে আর সারা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় না, হয়তো অঞ্চলটি তেমন আর পুঙ্খানুপঙ্খভাবে জানেও না, কারণ কয়েক বছর যাবৎ। ছুটিছাটাতে বাড়ি এলে সচরাচর বই-খাতাপত্রেই ডুবে থাকে, বাইরে গেলেও সামনের মাঠ ধরে কিছু বেড়িয়ে ফিরে আসে। তবু সে বিদেশী নয়। ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি হোক, চোখে দেখা-যায়-না এমন অন্ধকারে পরিচিত নিশানা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, কোনো কারণে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ুক, তবু পথ-হারানো সত্যি অসম্ভব।
প্রথমে বাড়িতে একটা গম্ভীর ভাব নেবে আসে, গোপনে-গোপনে আমরা মুহাম্মদ মুস্তফার আচরণ লক্ষ্য করে দেখতে শুরু করি যদি তার মধ্যে তার পরবর্তী চালের বা তার পরিকল্পনার কোনো ইঙ্গিত দেখতে পাই। তার মা আমেনা খাতুন হঠাৎ তার জন্যে। ভাপা পিঠা বানাতে বসে। সে-পিঠা মুহাম্মদ মুস্তফার বড়ই প্রিয়। উত্তর-বাড়ি থেকে মা জান এবং খোদেজা ছুটে আসে আমেনা খাতুনকে সাহায্য করবার জন্যে। এক সময়ে আমেনা খাতুনের চোখ ছাপিয়ে সহসা অশ্রু দেখা দেয়। তবে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সে সংযত করে এই ভয়ে যে কেন কাঁদছে তা কেউ জিজ্ঞাসা করলে কী উত্তর দেবে? হয়তো সবাই যখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল এই ভেবে যে মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু করবে তখন মায়ের প্রাণেই কেবল একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল : কালু মিঞাই কি তার। বাপকে খুন করে নি?
সেদিন অপরাহ্নবেলায় মা-জান উত্তর-ঘরের ছায়ায় উঠানে বসে খোদেজার চুলে বেণী বাঁধছিল এমন সময় বাইরে থেকে আমার বাপজানের গলা শোনা যায় : ক-দিন ধরে বিকল-হয়ে-থাকা ঢেঁকিটি সারাবার জন্যে বাপজান ছুতার মিস্তি ডেকে নিয়ে এসেছে এবং মেয়েদের উঠান থেকে সরে যেতে বলছে। মেয়েরা অদৃশ্য হয়ে গেলে ছুতার মিস্ত্রিকে নিয়ে ভেতরে এসে উঠান অতিক্রম করছে এমন সময়ে আমরা শুনতে পাই বাপজান লোকটিকে কালু মিঞার বাড়ির সামনে মুহাম্মদ মুস্তফার আবির্ভাবের কথা বলছে। বাপজানের গলা বেশ চড়া। ছুতার মিস্ত্রির সঙ্গে ঢেঁকির ঘরে ঢোকার পরেও তার উচ্চকণ্ঠ উত্তর-ঘরে দক্ষিণ-ঘরে, হয়তো বেড়ার ওপাশে ছোট চাচার ঘরেও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তার কণ্ঠে গর্বের ভাব, যেন মুহাম্মদ মুস্তফা এমন একটি কাজ করেছে যার দরুন লজ্জিত অপমানিত পরিবারের সম্মান রক্ষা হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। বিবরণে কিছু অতিরঞ্জনও। নিঃসন্দেহে ছুতার মিস্ত্রির এই ধারণা হয় যে মুহাম্মদ মুস্তফা কালু মিঞার সঙ্গে দেখা করেছিল, তাকে শাসিয়েছিলও, না হলে গৃহস্বামীর মুখ ভয়ে এমন সাদা হয়ে উঠেছিল তা মুহাম্মদ মুস্তফা কী করে জানবে?
এ-সময়ে আমার বুকটা দুরুদুরু করে ওঠে। আমি জানতাম, দক্ষিণ-ঘরে চৌকিতে হাঁটু তুলে ঝুঁকে বসে মুহাম্মদ মুস্তফা পড়ছিল; বাপজানের উচ্চকণ্ঠ তার কর্ণগোচর হয়ে থাকবে। ছুতার মিস্ত্রি ঢেঁকিঘরে বলে এবার মা-জান এবং খোদেজা বেরিয়ে আসে, চুলবিনুনির বাকি কাজ ঘরেই শেষ হয়েছে। খোদেজা কলসি হাতে বাড়ির পেছনে পুকুরের দিকে রওনা হয়, তবে মা-জান উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে-কানটা চেঁকিঘরে কিন্তু চোখ দক্ষিণ-ঘরে অদৃশ্য মুহাম্মদ মুস্তফার দিকে। তখনো ঢেঁকিঘরে বাপজান মুহাম্মদ মুস্তফার কথা বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছিল, এবং একই কথার পুনরাবৃত্তিতে অতিরঞ্জণটাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। হয়তো আমার মতো মা-জানের মনেও এই ভয় দেখা দেয় যে মুহাম্মদ মুস্তফা সহসা দক্ষিণ-ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাপজানের কথা মিথ্যা বলে ঘোষণা করে আমাদের আশা-উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটাবে।
তবে মুহাম্মদ মুস্তফা বেরিয়ে আসে নি, তার কোনো সাড়াও পাই নি। আমাদের মনে যদি কিছু সন্দেহ বাকি ছিল সে-সন্দেহ এবার দূর হয়, এবং তখন থেকে বাড়ির সকলে নিতান্ত খোলাখুলিভাবে সেদিনের ঘটনাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করে, মুহাম্মদ মুস্তফা নিকটে থাকলেও দমিত হয় না। মুহাম্মদ মুস্তফা নীরব হয়েই থাকে, মুখে আত্মমগ্নভাব, হয়তো ঈষৎ বিহ্বলতা, যেন বাড়ির লোকদের কথায় তার মনে সন্দেহ জেগেছে সে সত্যি দৈবচক্রেই কালু মিঞার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়েছিল কিনা সে-বিষয়ে। এ-সময়ে বাড়ির লোকেরা খেদমতুল্লার স্মৃতি স্মরণ করে নানাভাবে মৃত ব্যক্তিটির গুণ গাইতে শুরু করে। এটা নূতন নয়, তবে এমন উচ্ছ্বসিতভাবে সমস্বরে তার গুণকীর্তন কখনন করে নি। সে নয়, সমাজই অসৎ নির্দয় নির্মম ন্যায়বিচারজ্ঞানশূন্য-যে-সমাজ তাকে সর্বপ্রকারে নিপীড়িত করেছিল। সে যদি অমানুষিক পরিশ্রম করে স্ত্রী-পুত্রের কথা ভেবে সৎ উপায়ে দুটি দানার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিল, দয়াহীন পাষণ্ড মানুষেরা সে-দুটি দানা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে দ্বিধা করে নি। এমন একটি সময় আসে যখন অন্যায়-অবিচার সহ্যাতীত হয়ে পড়ে। যে সাপ কারো কোনো ক্ষতি করতে চায় না তাকে অযথা অকারণ মারতে গেলে সে যেমন ফণা তুলে ফুঁসে দাঁড়ায়, তার মুখে বিষ চড়ে-তেমনি একদিন খেদমতুল্লাও রুখে দাঁড়িয়েছিল, তার মুখে প্রতিহিংসার বিষ এসে গিয়েছিল। তার হৃদয় ছিল মহৎ, উদার, পরার্থপর; সে-হৃদয় হিংসাত্মক লোকেরা পদদলিত করেছিল। সে দুর্বলের রক্ষক ছিল, প্রতারিত উৎপীড়িত অসহায় মানুষের জন্যে তার দরদী মন কাঁদত। অন্যায়ভাবে জোতজমি দখল করে কালু মিঞা যে স্বামীহারা অবলা নারীকে ঠকিয়েছিল সে-নারীকে সে সাহায্য করতে চেয়েছিল যাতে যা তার হক তা সে ফিরে পায়। এবং সেজন্যেই তাকে প্রাণ দিতে হয়।
এ-সবও মুহাম্মদ মুস্তফা নীরবে শোনে।
তারপর চতুর্থ দিনে খবরটি আমাদের গ্রামে এসে পৌঁছায়। খবরটি এই যে, অথর্ব কালু মিঞা মসজিদে গিয়ে ঘোষণা করেছে সে নির্দোষ।
খবরটি বাড়ির সবাইকে স্তম্ভিত করে। বস্তুত কিছু সময়ের জন্যে সকলে কেমন বাকশূন্য হয়ে পড়ে। তাদের মনে হয়, মসজিদ-ঘরে কথাটি বলে ধূর্ত কালু মিঞা আমাদের সঙ্গে বড়ই শয়তানি করেছে, যেন যাকে আমরা প্রায় ধরে ফেলেছিলাম সে হাত থেকে ফস্কে গিয়ে একটি দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গটি সাধারণ দুর্গও নয়, সেটি আকায়িদ-ঈমানে তৈরি দুর্গ।
বাপজান অবশেষে কালু মিঞার কারসাজির বিষয়ে তার মত প্রদান করে। উঠানে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গিট খুলে আবার শক্ত করে বাঁধতে-বাঁধতে (কোনো কারণে ক্রুদ্ধ বা বিচলিত হয়ে পড়লে বাপজান অমনি লুঙ্গির গিট খুলে আবার শক্ত করে বাঁধে) উচ্চস্বরে বলে, যে-মানুষ খোদার বান্দাকে খুন করতে ভয় পায় না সে-মানুষ খোদার ঘরে মিথ্যা বলতে ভয় পাবে কেন?
সে-রাতে বাপজান মুহাম্মদ মুস্তফাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, কী করতে চাও, বাবা?
মুহাম্মদ মুস্তফা কোন উত্তর দেয় নি। সেদিন তাকে সত্যি বড় বিহ্বল মনে হয়, যেন যে-মানুষ কোনো প্রকারের দ্বিধা-সংশয় পছন্দ করে না সে-ই নিদারুন একটি দ্বিধা-সংশয়ের কবলে পড়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে উঠেছে।
তার মানসিক অবস্থার কারণ পরদিন জানতে পাই।
মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু করবে-এমন একটা আশায় আমরা যখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম সে-সময়ে অন্য একটি কথায় সে ভাবিত হয়ে পড়ে। সেটি এই যে, কালু মিঞার বাড়ির সামনে তার আবির্ভাব গৃহস্বামীকে সন্দিগ্ধ, হয়তো-বা সন্ত্রস্তই করে থাকবে। তারপর বৃদ্ধ লোকটি মসজিদে গিয়েছে সে নির্দোষ সে-কথা বলতে-তা জানার পর মুহাম্মদ মুস্তফা দেখতে পায় তার সন্দেহটি অযথা ছিল না : সত্যি, অথর্ব অক্ষম রোগব্যাধি জর্জরিত লোকটি ভয়ানকভাবেই ভীত হয়ে পড়েছে। কালু মিঞা দোষী হোক নির্দোষ হোক, মুহাম্মদ মুস্তফা সেদিন কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে তার বাড়ির সামনে দেখা দেয় নি। সে-কথা তাকে জানানো এবার তার কর্তব্য বলে মনে হয়।
কালু মিঞাকে কথাটি জানানোর দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। আমি একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালে সে আমার দৃষ্টি এড়িয়ে বাপজানের কথা যেন শোনে নি এমনিভাবে শুধু বলে, মসজিদে কেউ মিথ্যা কথা বলে না।
অল্পক্ষণের মধ্যে খালি পায়ে ছাতাবগলে আমি মুক্তাগাছি গ্রাম অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ি এবং বাড়ির গভীরভাবে নিরাশ হওয়া ক্ষুদ্ধ প্রবঞ্চিত লোকদের বিষয়ে না ভেবে বা মুহাম্মদ মুস্তফার আচরণের অর্থ বুঝবার চেষ্টা না করে সজোরে পদসঞ্চালন করে এগিয়ে চলি। যে-কথা দুর্বোধ্য মনে হয় সে-বিষয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে না।
কী কারণে তবারক ভুইঞা থামে। বাইরে, রাতের ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে নদীর বিক্ষুব্ধ অশ্রান্ত পানি আর্তনাদ করে। সে-আওয়াজই সহসা কানে এসে লাগে। শ্রোতাদের মধ্যে একজনের চোখ নিমীলিত হয়ে পড়েছে, মুখটা ঈষৎ খুলে সোজা হয়ে বসে সে ঘুমায়। শান্ত মুখ, তাতে ঘুমের কোনো ছায়া নেই। তাই মনে হয় সে বুঝি। জেগেই চোখ বুজে রয়েছে, অথবা সে অন্ধ।
তারপর আবার তবারক ভুইঞার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
সে বলে: সেদিন সকালে ক্রোধোন্মত্ত পশুর মতো ছুটে গিয়ে সকিনা খাতুনের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ভীষণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেও সম্বিৎ ফিরে পেতে ছলিম মিঞার দেরি হয় নি। তারপর মেয়েটির ভীতবিহ্বল মুখ দেখতে পেলে সে গভীরভাবে লজ্জিত বোধ করে এবং এ-সময়ে কেউ এসে তার হাত ধরলে সে বশীভূত পশুর মতো মেয়েটির পথ ছেড়ে দোকানে ফিরে আসে, তার রাগের কারণটি সহসা নিজেই যেন বুঝতে পারে না।
তবে শহরবাসীরা তার রাগের কারণটা অবিলম্বে বুঝতে পারে। নিঃসন্দেহে ছলিম মিঞা একটু বাড়াবাড়ি করেছে, কিন্তু তার মতো তারাও কি জানতে চায় না মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন কী শোনে, কোথায় শোনে, তার অর্থই-বা কী? কান্নার কথাটি সকলের মনে কী-একটা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে যেন। সে-আশঙ্কাই ছলিম মিঞার আকস্মিক ক্রোধের কারণ। লোকটির আত্মসংযম নেই, ঝট করে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়, একবার রক্ত চড়লে সে যেন চৈতন্য হারিয়ে ফেলে। তবু আশঙ্কাটি অহেতুক নয়। শহরবাসীরা কেন, মোক্তার মোছলেহউদ্দিনও বুঝতে পারে ছলিম মিঞার আচরণটি অন্যায্য নয়। বাজারের পথে তার মেয়ে অপমানিত হয়েছে খবর পেয়ে প্রথমে তার রাগের সীমা থাকে নি, সাইকেলের দোকানের বদমেজাজি মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে বলে শাসায়। সকিনা খাতুন যদি কিছু একটা শুনে থাকে তবে তাদের কী? সে কারো ক্ষতি করে নি, সমাজ বা নীতিবিরুদ্ধ কোনো কাজও করে নি, তারা তাকে পথে-ঘাটে অপমান করতে শুরু করবে কেন? তবে এক সময়ে তার রাগ পড়ে এবং রাগের স্থলে চিন্তা দেখা দেয় নি। বিচিত্র কান্নাকাটির কথায় অন্যেরা যদি বিচলিত হয়ে পড়ে থাকে, তাদের মনে অস্কুট একটি আশঙ্কার ছায়া দেখা দিয়ে থাকে, বা তারা জানতে চায় কী সে-কান্না যা মেয়েটি শুনতে পায়, তবে তাদের সত্যি দোষ দেয়া যায় না। সে-ও ওকি মনে-মনে কেমন বিচলতি বোধ করতে শুরু করে নি, সে-ও কি। কান্নাটির রহস্যভেদ করতে চায় না? প্রথমে স্ত্রীর মুখে কথাটি জানতে পারলে তাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে নি এবং নিজেই বিচিত্র খবরটি সবিস্তারে বলে বেড়িয়েছে। হয়তো তখন অন্যদের বললেও তা তার আবার কেমন বিশ্বাস হয় নি, বিশ্বাস হলেও ভেবেছে তার পশ্চাতে ধরাছোঁয়া যায় এমন কোনো কারণ থেকে থাকবে : হয়তো কোথাও একটি মেয়েলোক কাঁদে, হয়তো-বা কোনো জীবজন্তুই কাঁদে এমনভাবে; যা অস্বাভাবিক তা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। তবে একদিন খটকা লাগে। তাই যদি হয় তবে শুধু মেয়েটিই কেন তা শুনতে পাবে? সে-কথা যেদিন বুঝতে পারে সে-দিন মনে সহসা দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। তারপর মেয়েকে বারবার জিজ্ঞাসা করে কিন্তু মেয়ে বিশেষ কিছু বলতে পারে নি। কেবল এই বিষয়ে তাকে নিশ্চিত মনে হয় যে থেকে-থেকে একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে, নারীকণ্ঠে কে যেন কোথায় কাঁদে নদীর দিক থেকে, কিন্তু জানে না কে কাঁদে, কেন কাঁদে, কেনই-বা তার আওয়াজ অন্য কারো কর্ণগোচর হয় না।