৬. লঙ্কা-শনিবার, হাসির কাণ্ড

৬. লঙ্কা-শনিবার, হাসির কাণ্ড

স্বপ্ন দেখছিলুম । পুকুড়পাড়ে উলুধ্বনিতে ঘুম ভাঙল । স্বপ্নে এই উলু্ধ্বনিটাই রেড ইনডিয়ান ঘোড়সোয়ারদের আক্রমণাত্মক ব্যাটল ক্রাই হল্লা মনে হচ্ছিল । স্বপ্নের আওয়াজের সঙ্গে সত্যিকারের আওয়াজের মিল ঘটে, প্রায়ই এরকম ঘুম ভেঙেছে । স্বপ্নের নাচের সঙ্গে কাঁচের গেলাস ভাঙার আওয়াজ । স্বপ্ন দেখলুম কোলোম্বাসের সঙ্গে রেড ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধ, তাও নাভাহো রেড ইন্ডিয়ান, কোলোম্বাসের ক্রীতদাস বানানো বেঁটে অর্ধেক-ন্যাড়া রেড ইন্ডিয়ান নয় । অনেক দিন পর স্বপ্ন দেখলুম । স্বপ্ন দেখে উবহু মনে করতে পারি না সবকিছু ।

এখনও আকাশ পরিষ্কার হয়নি, কিন্তু স্ত্রী-আচারের উলু দিতে গোটা কুড়ি বউ পুকুরপাড়ে । বোধহয় ফাল্গুন মাসের শেষ বিয়ে । বা অন্য পুজো । শনিপুজোর ক্যাসেট আরম্ভ হবে এগারটা নাগাদ, সামনের রাস্তায়, তাতে উলু ওঠে বিকেলে । পা#চ বছর হয়ে গেল কিন্তু উলুর সঙ্গে অনুষ্ঠান-উৎসব মেলাতে পারিনি । এই বয়সে এত ভোরে উলু বেশ বিরক্তিকর, সংস্কৃতির ব্যাপার হলেও । আজান যদি এত সকালে হয়, বিরক্ত হবো । সমষ্টিকে ধার্মিক রেয়াত দেয়া ব্যক্তি-আমির পক্ষে সম্ভব নয় । পাটনায় ইমলিতলা পাড়ার মিনারে লাউডস্পিকার দেখিনি ছোটোবেলায় । তখন সৌদি আরবের হুকুম আর রেস্ত সেঁদোয়নি এদেশে ।

আর ঘুম এলো না । শুয়ে রইলুম চুপচাপ । নিজের ভাবনাগুলো খোলোশা করে নেয়া যায় শুয়ে-শুয়ে । বাক্য তৈরি করা যায় । এটা আমি রাত্তিরে শোবার সময়ে করি । ঘুম আসতে এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে । সকালে যেটুকু মনে থাকে তা নোটখাতায় লিখে নিই । পড়ার টেবিলে বসে চিন্তা-বিশ্লেষণ সম্ভব নয় । দুপুরে ন্যাপ নেবার আগে, সময় থাকলে, করি । এই সময়ে কবিতার পংক্তিমিশ্রণ, শব্দখেলাগুলো আসে । প্রাতঃভ্রমণ আর সান্ধ্যভ্রমণের সময়, যেদিন হাঁটতে যাই, করি, কিন্তু চেনা-অচেনা কেউ-না-কেউ কথা বললে রেশ কেটে যায় । সব বাড়ি থেকেই অবসরপ্রাপ্তরা বেরিয়ে আসেন তখন, আর এঁদের অনুসন্ধিৎসা ফুরোয় না । মুম্বাইতে ছিলুম বলে, আর সলিলার কথাবার্তায় । অনেকে কেবল টিভিতে প্রতিদিন হিন্দি সিনেমা দেখে মুম্বাই সম্পর্কে ধারণা গড়ে নিয়েছে । ছেলে-মেয়েদের কলেজে ওরকমভাবে সবাই মিলে নাচে ?

হ্যাঁ, অনুষ্ঠান হলে নাচে ।

মুম্বাইতে অনেকের পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ধারণা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনকে দেখে-দেখে । কোনো পরিচালকের উচিত উচ্ছল-জীবন্ত তরুণ-তরুণীকে নিয়ে একটা বাংলা চলচিত্র করা, যে-সব কচি-কচি ছেলে-মেয়েরা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ঝাঁক বেঁধে লিটেরারি ক্রিটিসিজমের বিভাগে ঘোরে । শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে গৌতম ঘোষের সঙ্গে কথা হল, কিন্তু এ-প্রসঙ্গ মনে এল না । অতিতরুণ পরিচালক চাই । ডুপলিকেট সত্যজিৎ-ঋত্বিক নয়, বা সরকারি দলের চামচা নয় । অবসরপ্রাপ্ত নকশালের ছদ্মনাম স্বর্ণ মিত্র । কোনো বাঙালিকে অন্ত্যজ বা উপজাতি ছদ্মনাম নিতে আজ পর্যন্ত দেখলুম না । যাবতীয় বঙ্গবিপ্লব এই একটি ক্যারদানিতেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে । সব্যসাচী দেবের ছদ্মনাম ইরাবান বসুরায় । আমি কি কেবল রোজনামচাতেই এসব লিখে রাখব ?

দাঁত মাজতে গিয়ে ওপরপাটির কষদাঁত নড়ে উঠল । একেই অশেষ যন্ত্রণা বলে নিশ্চই । সবকটা দাঁত এক-এক করে পড়বে বা ডাক্তারে ওপড়াবে, তখন যন্ত্রণার শেষ । রাসবিহারীর সুতৃপ্তিতে বসে, এক বর্ষাবিকেলে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘দাঁতে ব্যথা থাকলে জ্ঞানের কথা আর দর্শনতত্ব মাথায় ওঠে ‘। সন্দীপন সম্পর্কে একটা তথ্য লিখে রাখি, কেউ তো এই ডায়রির পাতাটা পড়বে কখনও । ‘আজকাল’ কাগজের সম্পাদককে ( অশোক দাশগুপ্ত ) একটা চিঠিতে লিখেছিলুম, ‘সন্দীপনের তো বঙ্কিম পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেছে, আর কতকাল মাগি-মরদের গল্প লিখবেন ? এবার ওনাকে ওই ঘুঘুর বাসার গল্প লিখতে বলুন, যাতে জীবন-যৌবন কাটালেন ।’ সন্দীপন কলকাতা কর্পোরেশন সম্পর্কে লিখলেন বটে, কিন্তু যে-সময়ের কথা লিখলেন, তখন ওটা ঘুঘুর বাসা ছিল না । নৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক কর্মসাংস্কৃতিক পচনের উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপকতা এড়িয়ে গেলেন । অদ্রীশ বিশ্বাস আমার কাছ থেকে সন্দীপন সম্পর্কে লেখা চাননি কেন জানি না । একটা-দুটোর চেয়ে বেশি কথা লিখতে পারতুম । কেউ তো মুখ ফুটে লেখেননি কিছু ।

একটা রেমুলাইড আর সঙ্গে টপসিড খেলুম । দাঁত ওপড়ালে আমার রক্ত থামে না । আগের বার থামেনি ; ডেনটিস্ট বলেছে যতদিন সম্ভব ব্যথা সামাল দিন । আপনা থেকে পড়তে দিন । বারো বছর কয়লার ছাই দিয়ে দাঁত মাজার ফল ।

দইতে ফ্লেক দিয়ে খেলুম । প্রশান্ত কিনে দিয়ে গিয়েছিল ফ্লেকটা বছরখানেক আগে । দুধ খেলে আমার পেট খারাপ হয় । ভূমেনদা যদিও দই খেতে নিষেধ করেছেন ।

সুবিমলের টেলিফোন, আসতে পারবে না, চিরঞ্জীবের কাছে আছে । উত্তম দাশের টেলিফোন, বিকেলে কেদার ভাদুড়ির আস্তানায় পৌঁছোবে । ধনেখালি থেকে ‘বিকর্ণ’ পত্রিকার সম্পাদক জয় মুখোপাধ্যায়ের টেলিফোন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে আসবে । নিশিনাথ সেনের টেলিফোন, ‘রাজধানী’ পেয়েচি কিনা জানতে চাইলেন । জয়ের প্রেমিকাটি সুন্দরী । মুর্শিদের টেলিফোন । বলল, “জহর সেনমজুমদার আপনার কবিতা সম্পর্কে লেখা দেবেন না মনে হচ্ছে, এই নিয়ে কুড়িবার দৌড় করালেন ; অবশ্য আগে জানিয়েছিলেন, এভাবে ঠিক হয় না, আলাদা একটা বড় করে লিখব । আর সুমিতা চক্রবর্তী আপনার প্রবন্ধ নিয়ে যে-লেখাটা দেবেন বলেছিলেন, সেটা নাকি ট্রেনে হারিয়ে ফেলেছেন ।”

ঢাকার বিদ্যাসাগর সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক এস এম রহমান আর মোহম্মদ আবদুল হাই এলেন । মিজানুর রহমান পাঠিয়েছেন । বিদ্যাসাগরের নাম শুনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ভীতির হল কেন ? ‘দ্বিতীয় ভাগ’-এর বানান শিক্ষার বাল্যস্মৃতির জন্য । বাড়িতে শর্টস পরি । পশ্চিমবাংলার কবিদের সম্পর্কে ধারণায় একটা চিড় নিয়ে ফিরবেন রহমান সাহেব আর হাই সাহেব ।

অঞ্জলিদির উচ্চকন্ঠ, ‘অ্যাই ট্যামপুন ওভারফ্লো করতাসে’ । আমাদের ছাদের জলের ট্যাঙ্ক ওভারফ্লো করছে । একতলার বউটি পাম্প চালিয়ে ভুলে গেছে । নামকরণের মাধ্যমেই বউটির সঙ্গে বদলার খেলা বজায় রেখেছেন অঞ্জলিদি । যৌনতার দ্বন্দ্ব সম্ভবত । সবসময় চুড়িদার-পরা বউটির যৌনতাও ওভারফ্লো করে । পরিবার নিয়োজনের ওষুধের টিউব, ব্যবহৃত নিরোধ, ইচ্ছাকৃতভাবে পেছনের ঘাসে ফেলা হয় ।

সলিলা বলল, ‘আজকেও কাকটা কাস্টমসবাবুর ছাদে বসে রয়েছে ।’ সলিলার বক্তব্য এই কাকটা সাধন চৌধুরী । নাতি দিগন্তের ছোঁড়া ভাত খায়, কেননা মরার সময়ে ছেলে জাপানে ছিল । কাকটাকে আমিও দেখেছি আলসের কোনে ডিমে তা দেবার ভঙ্গীতে বসে ধাকে এক ঠায়, প্রতিদিন । কাকেরা তো কোথাও বেশিক্ষণ বসে না । প্রকৃতির অতি-অলৌকিকতা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা দ্রুত গড়িবে চলেছি অজানা অনির্ণেয় অনিশ্চয়তার দিকে । বললুম, ‘ওটা সাধন চৌধুরী নয়, দোতলার বাঁড়ুজ্জেমশায়, গরম জলে ভিক্স শুঁকে-শুঁকে ফুসফুস কালো হয়ে গিছল তো ।’

সরস্বতী নিজের স্টক ধেকে মাঝে-মাঝে অলৌকিকতা ছাড়া । চোখমুখ দেখে মনে হয় বিশ্বাস করে । অবিশ্বাসের সর্বগ্রাসে আগাপাশতলা ঢাকা না-ও পড়ে ধাকতে পারে ! ওদের ডাক্তার পাঁচ তাকায় দাঁত তুলে দ্যায়, সুতো বেঁধে । একটুও কষ্ট হয় না ।

Note : ১ ) ইউমান হিসট্রি ক্যান বি ডেসিফার্ড ফ্রম দি রিঙ্কলস অব এ ফেস । ২ ) থিংস হ্যাভ মেমরিজ অব দেয়ার ওন অ্যান্ড দি রাইটার হ্যাজ টু ডেসিফার, আন্ডারস্ট্যান্ড অ্যান্ড এক্সপ্লেন । ৩ ) নাথিং ইজ টু মিন ফর ইম্যাজিনেশান অ্যাজ নাথিং অন আর্থ ইজ ইনসিগনিফিক্যান্ট । ৪ ) টেররস মাল্টিপ্লাই উইথ এক্সপিরিয়েন্স । ৫ ) অল টুথব্রাশেস হ্যাব এ হাম । ৬ ) কমিউনাল আউটব্রেক ইন দি মাইন্ড । ৭ ) দি ডেফিনিশান অব শুইসাইডস আর ইনভ্যারিয়েবলি নরম্যাটিভ । ৮ ) এ ম্যান হু ইজ স্কেয়ার্ড অব হিজ ওন সিক্রেটস, হিজ ফিয়ার্স, হিজ ইনক্যাপাসিটিজ । ৯ ) হুইচ ইজ দি ফার্স্ট সং ইউ হার্ড ইন চাইল্ডহুড অ্যান্ড স্টিল রিমেম্বার ? ১০ ) ইউ স্ট্রাইভ টু রিভাইজ অ্যান্ড সো কনট্রোল ইওর ক্রিয়েটিভ ইন্সপিরেশান্স আনটিল অল দ্যাট রিমেইন্ড অব অ্যাকসিডেন্ট ইজ আর্ট । ১১ ) চ্যালেঞ্জ রিয়্যালিটি বাই এক্সপ্লোরিং দি ভ্যাকুয়াস রুটিন অব ডেইলি লিভিং । ১২ ) সামথিং ক্যান সাইমালটেনাসলি বি ইটসেল্ফ অ্যান্ড ইটস অপোজিট । ১৩ ) ম্যানস স্যাভেজারি, হোয়েন ইভোকড বাই এনি ড্যাম আইডিয়ালিজম, ক্যান বি লিমিটলেস । ইট ইজ এ প্রসেস অব ডিপার্সোনালাইজেশান হোয়েন ক্রুয়েলটি বিকামস কোটিডিয়ান ।

আজকাল দিনে অনেকবার পেচ্ছাপ হচ্ছে । পিয়ার্সের মেদিকাল এনসাইক্লোপেডিয়ায় হদিশ পেলুম না । ভূমেনদা বললেন, সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে বারণ করা সত্ত্বেও প্রস্টেট অপারেট করালেন । শুনে ভয় ধরে গেছে ।

অ্যালিস জার্ডাইনের ‘দি ডেমাইজ অব এক্সপেরিয়েন্স’ প্রবন্ধটা পড়লুম । এ বিষয়টা মনে রেখে ভাবতে হবে ।

এগারোটা নাগাদ শুভ্রা সাহা এসেছিলেন । সুশ্রী । কবি । বললেন, ‘আধুনিক কবিতা’র সম্পাদক প্রফুল্লকুমার দত্ত’র সঙ্গে একবার এসেছিলেন । আমি দরোজা খুলে স্তম্ভিত । নাম, গড়ন, গায়ের রং, চুলের ঢেউ, এত বেশি মিল থাকতে পারে ! আমার পক্ষে বিশেষ কথা বলা সম্ভব হল না । ওনার পক্ষে আমার প্রতিক্রিয়া বোঝা সম্ভব নয় । উনি তো জন্মেছেন ছয়ের দশকের পরে । সেদিন, যেদিন প্রফুল্লদার সঙ্গে এসেছিলেন জানালেন, স্ট্রাইক করেনি কেন ? মন খারাপ হয়ে গেল ।

সলিলা কাক নিয়ে মগ্ন । রান্নাঘরের চার্জ নিলুম । আজকে খিচুড়ি হোক । বিহারে কড়ায়ের ডালের খিচুড়ি হয়, শেষে হাতায় পাঁচফোড়ন গরম করে খিচুড়িতে ঢুকিয়ে দাও । বিহারি প্রস্তাব পছন্দ হল না সলিলার । মুসুর ডাল আর পাহাড়ি আতপচাল ধুয়ে রাখলুম । মুম্বাই, লখনউ-এর মতন সুগন্ধী আতপচালের সস্তা ভ্যারায়টি নেই কলকাতায় । দেহরাদুনে ট্যুরে গেলে চাষির খামার থেকে বাসমতি চাল কিনতুম । ডুমো-ডুমো কপি ভাজলুম ; ছোটো-ছোটো আলু বেছে, স্টিম দিয়ে, ছাড়ালুম । চারটে কাঁচালঙ্কা চিরে বিচিগুলো ফেলে দিলুম । মিক্সিতে টম্যাটো পিষলুম । দাদা টম্যাটো বারণ করেছে, ইউরিয়া বাড়া । ডাল আর চাল একসঙ্গে ভাজার পর সলিলাকে চার্জ দিয়ে দিতে হল । লুকিয়ে ঘি ঢেলে দিতে পারি সন্দেহে ।

ন্যাপ নেয়া গেল না । শনিপুজোর তামঝাম শুরু হয়েছে । ক্যাসেটে হিন্দি গান, পাঞ্জাবি গান । বাঙালি গায়করা বিভিন্ন পুজোর সুরেলা বাংলাগানের ক্যাসেট কেন বের করে না ? প্রগতিতত্ত্ব থেকে লাৎ খাবার ভয়ে । শনি, বিশ্বকর্মা, শেতলা, মনসা, কার্তিক, জগদ্ধাত্রী, লক্ষ্মী, কালী, দুর্গা, সব পুজোয় অবাঙালি গান বাজে । অফিস থেকে সারা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে গ্রামেগঞ্জেও তা নজরে এসেছে । রিকশা চালানোর কাজ বিহারিরা দখল করে নিচ্ছে । শনিপুজোও চলে যাচ্ছে তাদের দখলে । যেমন গেছে বিশ্বকর্মাপুজো । কালীঘাট মন্দির যে বিহারি মাফিয়াদের দখলে, তা আগে জানতুমই না । দি ডেমাইজ অব এক্সপেরিয়েন্স । পার্টির মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে বিহারিরা ।

শংকর সরকার এসেছিলেন । নাকতলা পোস্ট অফিস মোড়ে রিকশা ছিল না । হেঁটে এসেছেন । এই প্রথম ভালোভাবে আলাপ হল । দেড় দশকের বেশি লিটল ম্যাগাজিন চালাবার আপস অ্যান্ড ডাউনের কথা বললেন । আমার বইপত্র দিলুম । জানি না ওনার পড়ার সময় হয় কিনা । তবুও ।বেলগরিয়ার ভিমরুল চাকে পড়ুক । অনেকের কাছে আমার বইপত্র পৌঁছোয়নি, পৌঁছোয় না । পৌঁছোনো দরকার, যাতে আমি আমার কাজকে না ছাপিয়ে যাই, আর যার সম্ভাবনা অনেক বেশি । অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় আর সমীরণ মজুমদার বলেছিলেন, আমার মৃত্যুসংবাদটা ছড়িয়েছিলেন দেবী রায় ।

সন্ধ্যাবেলা কেদার ভাদুড়ীর আস্তানায় গেলুম । পুরো গভমেন্ট কলোনিটা একদিন কেদারের মাথায় ধসে পড়বে । এলাকাটা এককালে গাঙ্গুলিদের বিশাল বাগান ছিল । এই বাগানের চারিদিকে গোড়ে গ্রামের চাষিরা, সবাই মুসলমান, থাকত, আর বৌবাজারে গোড়ের মালা সরবরাহ করত । এখন তার নাম হয়েছে গড়িয়া । কেদারের আস্তানায় উত্তম পৌঁছে গিয়েছিল, মহাদিগন্তের উত্তম দাশ, মালবিকার উত্তম দাশ । হুইস্কি খাওয়া হল । উত্তম যথারীতি একের পর এক খেয়ে ফেলল চোঁ চোঁ করে । আমি নেশার মৌতাতরেখা ওব্দি গেলুম । ওরা যাচ্ছে বেড়াতে, গড়চুমুক । আমার একা বেড়াতে ভাল্লাগে । ছয়ের দশকে ছিল বিপরীত । কবি-লেককদের দলবেঁধে বেড়ানোটা ভাবনা-চিন্তার পক্ষে ক্ষতিকর ।

ফিরে, নেশা থাকতে-থাকতে, একটা কবিতার খসড়া তৈরি করলুম । একগাদা লাইন এসে ভিড় করছিল মগজে ।

Note : ১ ) ইউ লুক আপ মেটেরিয়া মেডিকা হোয়েন ইউ সাফার ফ্রম এ সিকরেট ডিজিজ । দি নেক্সট স্টেপ ইজ টু কনফাইড ইন সামওয়ান । ইউ কনফাইড ইন এ পোয়েম হুম ইউ গিভ এ নেম । ২ ) দি এসট্যাবলিশমেন্ট প্ল্যানস নট বাই ডিসটরশান অব হিসট্রি বাট বাই ডিনায়াল অব ইসট্রি ।

সিসিএন-এ বাংলা ছবি দেখলুম, শেষ দিকটা । আগেকার তুলনায় এখনকার সংলাপ এত দ্রুত কেন বলা হয় ? কথাগুলো ফোঁপরা বলে অনেক কথা বলতে হয় ? এই সংলাপদ্রুতির বিকাশের সামাজিক কারণটা কী ? কিছু অতিপুরনো ফিল্ম দেখতে হবে । ফিল্ম ক্রিটিকরা এসব ভাবছে না । সবাই সবরকম সাংস্কৃতিক কাজকে সমাজের বাইরে নিয়ে গিয়ে ভাবছেন । কেন বাঙালিরা এরকম করছে সেটাও চিন্তার বিষয়বস্তু । আইডেনটিফাই করতে হবে ।

উৎপল সরকার-এর টেলিফোন । ওনার ‘অন্যভূমি’ পত্রিকার জন্য গল্প দেবার কথা মনে করিয়ে দিলেন । সুবিমল বলছিল উৎপল সরকার একজন প্র্যাক্টিসিং তান্ত্রিক, আগে সিপিয়েম করতেন । সমীরণ মজুমদার যে-গল্পটা ভয়ে ছাপেননি, সেটাই আবার লিখে উৎপল সরকারকে পাঠিয়ে দেব । অজিত রায়কে যে লেখাটা দিয়েছি, তার সঙ্গে অর্গানিক লিংক থাকবে । সমীরণকে লেখাটা রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়েছিলুম । উনি জানালেন পাননি । নাকতলা পোস্টাপিস বলল, আলবত পেয়েছেন । ঘটনাটা সেদিন সুরজিৎ সেনকে বলেছিলুম । ও বললে, ‘ওসব কাগজে লেখা দেন কেন বলুন তো ? কী সব স্লোগান থাকে দেখেছেন ?’

আমার মনে হয় মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে ওখানকার পত্রিকার ঘাড়েও নব-বর্গিরা চেপে বসেছে ।

গৌতম সেনগুপ্ত আর সুরজিৎ সেন আমার ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটা নিয়ে একটা লেখা দিয়েছিল জ্যোতি দত্তর ‘চারনগর’ পত্রিকায়, ওদের বক্তব্য অনুযায়ী, সম্পাদক মণ্ডলীর অনুরোধে । লেখাটা লাথড়া খেয়ে ফিরে এসেছে, সে-কথা ওরা দুজন জানায়নি আমাকে । আমার রচনা যে জাতে কিং কোবরা তা টের পেতে ওদের দেরি হল ।

ভূমেনদা বললেন, ‘আরে জ্যোতি ! ওর বোন তো বোরখা পরে আমার ডাক্তারখানায় আসত।’ সেসব শুনতে-শুনতে সলিলা বলল, ভূমেনদা, অনেক বেশি মদ খেয়ে ফেলেছেন ।’

গল্পটা এরকম :

অট্টহাস্য অবিনির্মাণ

—ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ…

—হাঃ হাঃ হাঃ….

—আর হাঃ হাঃ সি এমের মুখটা হাঃ হাঃ দেখেছিলেন ?

—ওফ ফোঃ ফোঃ পপ্পঃ তাক্কাঃ হাঃ হাঃ হাঃ যেই না হাঃ হাঃ…

—হিঃ হিঃ হিঃ…

–কিগ্গ হম হোঃ হোঃ ভির…

—হোঃ হোঃ রিঅ্যাঃল অ্যাহডমিহনিসট্রেটঃর হোঃ হোঃ হোঃ…

—অ্যাডমিনিস্টার্ড হিঃ হিঃ হিঃ গাহ হিঃ হিঃ হিম হিঃ হিঃ ভিরজো…

—ওফ ফোঃ ফোঃ ফোঃ…

—হাঃ হাঃ পপ্প…কপি…হিঃ হিঃ করল…

—হ্যাঁ হ্যাঃ হ্যাঃ পুপ্পুলি থেথ্থেকে… হ্যাঃ হ্যাঃ…

—আঃমিঃ তোঃ দেঃখ হাঃ হাঃ ছিলুম তোমাদের মুখ হাঃ হাঃ হাঃ…

—হাসবে না কাঁদবে হিঃ হিঃ বুঝে উঠতে পারছিল না কেউ…

—ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ…

—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—হিক হিক হিঃ…

—পপ্প হাঃ হাঃ…

—তাকাটা হিঃ হিঃ হিঃ এঃকেঃবাঃরেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…

—ধপ !

—তোমারই তো হোঃ হোঃ হোঃ ডিড্ডিপার হাঃ হাঃ হারমেন্ট !

—নাঃ হাঃ হাঃ হাঃ পুঃরতোঃ হাঃ হাঃ হাঃ দপতরেঃ হাঃ হাঃ হাঃ…

—ওফ হোঃ হোঃ হোঃ পপ্প….তাকা…হোঃ হোঃ টায়…

—টান হিঃ হিঃ হিঃ দিতেই…

—পপ্পু…লিল্লি…থেথ্থে হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…

—ফুলের ভারে হাঃ হাঃ হাঃ…

—ধপ !

—সি এম তো স্টান্ড !

—আমি তোঃ হোঃ হোঃ এসডিএম পোস্টিঙেও দেখিনি এমন ঘঘঘঘটনা…

—ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ…

—তোঃমাঃদেরই ডিঃপারট হাঃ হাঃ হাঃ মেন্ট !

—নাঃ পুপ্পুর হিঃ হিঃ হিঃ তো দঃপতঃর ।

—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…

—ওহ চোয়াল ব্যথা হয়ে গেল হাসতে-হাসতে…

—ধপ !

–এইঃ আঃ হাঃ হাঃ হাঃ পনিঃ ওই ধপটা হাঃ হাঃ এঃবার বন্ধ করুন ।

—হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ খিঁচ-ব্যথা ধরে যাচ্ছে পেটে ।

—ওফ ফোঃ ফোঃ পপ্প..তাকাটা যেই…

—না, হাসা উচিত নয় কিন্তু ।

—হাসছি তোমাদের তখনকার মুখগুলো মনে পড়ছে বলে ।

এইসব উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা ভোরবেলায় লেকের ধারে হাঁটতে এসে এত হাসাহাসি করছেন কেন তা ঠাহর করার চেষ্টা করছিল অর্ণব । আই এ এসদের তো সরকারি খরচে গোমড়া আর গম্ভীর থাকার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় । একযোগে এমন দিলখোলা হাসি শোনাটা তো বেশ বিরল ব্যাপার । কিন্তু হাসাহাসির বিষয়টা কী ? ঘটনাটা কী?

সাদা হাফ প্যান্টে থলথলে মোদো গালের প্রায়-বৃদ্ধ আর খোঁড়া লোকটাকে আবছা ভাবে চেনে অর্ণব, অর্ণব দস্তিদার, কেননা বহুকাল আগে ওরই দপতরে মাস ছয়েকের জন্যে জুট কমিশনার হয়ে এসেছিলেন । পাটের দালাল আর পার্টির দুলালদের জন্যে টিকতে পারেননি । প্রোমোটি আই এ এস । তারাপদ রায় । রাজস্ব বিভাগে কেরানি হয়ে ঢুকেছিলেন । জুট কমিশনে ফিল্ড অফিসার থাকার সময়ে পাটচাষিদের প্যাঁদানির চোটে ঠ্যাং ভেঙে নয়ানজুলিতে যৌবনে একরাত পড়েছিলেন বলে গুজব ।

উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা আছেন বেশ । আজ এ-বিভাগ , কাল ও-বিভাগ । যদ্দিন চেয়ারে, তদ্দিন পেয়ারে ।ইংরেজরা এনেছিল এই কচুরিপানা । এখন ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের অন্দরে-কন্দরে ।

কিন্তু হাসিটা কী নিয়ে ? পপ্প আর পপ্পু এটা কী ব্যাপার ? এনারা সবাই সেই ঘটনার অংশভাক, এটা অন্তত টের পাওয়া যাচ্ছে । এই লোকগুলো সেই ঠাকুমা-দিদিমার আমল থেকে গল্প দিয়ে গড়া । কথাবার্তার অতল কাদায় কোন মুখে যে কোন গল্প ঢুকে কী চেহারায় বেরোবে তার নিশ্চয়তা নেই । লাউডগার মতন কখন যে এনারা কোন গল্পের গিঁট পাকিয়ে এগিয়ে যান কে জানে ।

আচমকা ঝিরঝিরে বৃষ্টির দরুণ বটগাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন হাফ-প্যান্ট টি-শার্ট প্রৌঢ়রা । অর্ণবও । অর্ণবের জগিঙের শেষ পাকটা কেবল বাকি ছিল । বটগাছটা বোধহয় ভি আর এস নিয়েছে । নিজেরই ঝরাপাতাদের উড়ন্ত ফিসফিসের মাঝে চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে । গরম-শেষের বুড়ো ঘাসেরা যৌনতাবর্ধক বৃষ্টিফোঁটার অপেক্ষায় । শালিকশিশুকে কেঁচো কিংবা পিঁপড়ে খুঁটতে শেখাচ্ছেন ওর মাম্মি-ড্যাডি । বাংলা ফিল্মের থায়রয়েডকন্ঠী গায়িকার ঢঙে একটা কাক ওর প্রেমিকদের ডাকছে তারস্বরে, পাঁচিলের ওপর ভিজতে-ভিজতে । ওপারে ফুটপাতে গোটাকতক রুডিয়ার্ড কিপলিং টাইপের নেড়িকুকুর । চায়ের দোকানের বেঞ্চে নবযুগ আনতে বিফল সাত-আটজন হাড়প্যাংলা বুঢঢার খেঁকুরে জমায়েত । একজনের তোতলা জিভ সম্ভবত অনুপ্রাসে পালিশ-করা, হদিশ মিলছে এত দূর থেকেও । প্লাস্টিকের একটা ভাঙা খেলনা গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায় । শৈশব ফুরিয়ে গেছে খেলনাটার ।

বটপাতায় বৃষ্টির চপেটাঘাত আরম্ভ হল । আগে কেটে পড়লেই হত, ভেবে মন খারাপ লাগল অর্ণবের । আমলাদের হাসাহাসির হাটও ভেঙে এল প্রায় । যে-যার গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন ধুপধাপ । ওই টাকমাথা আই এ এস বারবার ‘ধপ’ কথাটা বলছিলেন আর হেসে উঠছিল সবাই । কারোর ধপ করে বসে-পড়া নিয়ে হয়তো হাসাহাসি । আমলাটির চেহারা অনেকটা কাঁদানে গ্যাস কারখানার কর্মীর মতন আমুদে । যারা নিজেরা চোখের মধ্যে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায় ।

কারোর-কারোর হাসি দেখলে কিন্তু ভয় করে । যেমন ওই চশমা-পরা ভুঁড়িদাস, যিনি ফোঃ ফোঃ করে হাসছিলেন । দাঁতের পাটি নিশ্চই নকল । নাড়িভুঁড়ি বেরোনো খাটের ছোবড়ার রঙে কলপ-দেয়া চুল । চোখদুটো সামনে না হয়ে যেন ঘোড়ার মতন কানের দিকে । মরচে-পড়া একান্নবর্তী চেহারা । ওনার বাড়ির আত্মায় বোধহয় রান্নাঘরখানা আছে ।

বৃষ্টিটা আবার ঝিরঝিরে আদল নেয়ায় নিজের স্কুটারের দিকে এগোল অর্ণব । স্কুটারে ডিকিতে প্লাসটিকের রেইনকোট আছে ।

স্লোগানে-স্লোগানে স্মৃতিবিলোপ ঘটেছে সামনের বাড়ির ফিকে হলুদ রাস্তাটার । আধাবাস্তব-আধাজোচ্চুরি মেশানো ছড়ার স্লোগান । শব্দদের রক্ষিতার মতন পোষে এইসব স্লোগান ।

ওর, অর্ণবের, অফিসের দেয়ালেও স্লোগানের সর জমেছে । জুট কমিশনারের অফিস নাকি উঠে যাচ্ছে । সরকার আর পাট কিনবে না । যাকেনার দালালরা সরাসরি কিনবে চাষিদের থেকে । সরকারের চটকলে লোকসানের বোঝা বওয়া দায় । বাদবাকি চটকলগুলোও আর টিকবে না । কত রমরমা ছিল এককালে পাট আর চটকলের । পাট তো ছিল বাঙালির সিল্ক । রাজা পরতেন পট্টবস্ত্র । রানি ছিলেন পট্টমহিষী । সিংহাসন ছিল রাজপট্ট । আর এখন ? গৌড়ের রাজপ্রাসাদের মতন পাট শব্দটাও ভেঙে চুরমার । মিথ্যের নাম গুলপট্টি, কেননা ঘায়ের ব্যান্ডেজের নাম পট্টি । গৌড়ের সেনাপতির চোটজখম বাঁধা হতো পাটের সিল্ক দিয়ে । এখন পট্টিমার মানে ধাপ্পাবাজ, পট্টিবাজ মানে মিথ্যুক ।

ইংরেজরা চটকল পত্তনের আগে খত্রিরা পাটের ব্যবসা করত ; টাকাকড়ি ধার দিত চাষিদের । টাকা ধার দেবার সুযোগে পাট ব্যবসায় সেঁদিয়ে গেল মারোয়াড়িরা । পাটের আগে ওরা আফিম চাষিদের টাকা ধার দিত । তখন কাগজের টাকা আসেনি । চটকল পত্তনের পর ওরা হয়ে গেল মজুরদের আড়কাঠি । বিহার, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র আর তামিলনাডু থেকে মজুর ফুসলিয়ে এনে বসিয়ে দিলে নতুন-নতুন চটকলে । ইসলামি রাজত্বে ব্যবসাদাররা এসেছিল রাজস্হান, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ থেকে ।

বাঙালির জিম্মায় হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু টিকে নেই ।

কিন্তু এক্ষুনি যে হাসাহাসি চলছিল তার উৎসটাই বা কী !

রাস্তা পার হবার সময়ে বিরাট হোর্ডিঙের দিকে নজর গেল অর্ণবের । রোজই আসে, কিন্তু খেবাল করেনি এতদিন। এটা নিয়ে নিশ্চই হয়নি হাসাহাসিটা । পপ্প, পপ্পু, কাক্কা, তাত্তা, ধপ, এগুলোকে তো মেলানো যাচ্ছে না । যারা হুকিং করে বিদ্যুৎ চুরি করছে, তাদের ধরিয়ে দেবার জন্যে বড় বড় হরফে তেলিফোন নম্বর দিয়েছে বিদ্যুৎ পর্ষদ।

হলুদ হোর্ডিঙের পাশের বিজলি বাতির থামে তার ফেলে দুটো লাইন নামানো হয়েছে । একটাতে শনিমন্দির, প্রকাশ্য । আরেকটা ঢুকেছে ফুটপাতিয়া ঝুপড়িতে, বোধহয় কোনো রাজনৈতিক দলের জমঘট । ইচ্ছে করলে হাসা যায় ব্যাপারটা নিয়ে । কিন্তু যা আখচার তা নিয়ে তো আর হাসাহাসি হয় না ।

স্কুটারের গা ঘেঁষে এক ঋষিপ্রতিম ষাঁড় দাঁড়িয়ে । বৃষ্টিটাও বেইমান, আবার ঝেঁপে এল । বর্ষাতি চাপাবার জন্যে দ্রুত স্কুটারের ডিকি খুলল অর্ণব । খবরের কাগজে মোড়া বর্ষাতিটা হাতে নিয়েই, হাসতে শুরু করল, অট্টহাস্য, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঃ হাঃ হাঃ ফোঃ ফোঃ ফোঃ হিঃ হিঃ হিঃ হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ, ওফ, পরশুর বকেয়া হাসি হাসছিলেন আমলাদের দলটা । পরশু যে হাসির দমকটা সবাই মিলে গম্ভীর মুখে চেপে গিয়েছিলেন, হাসার সময়ে হাসতে পারেননি, আজকে ভোরবেলায় সবাই জড়ো হয়ে সেই হাসিটাই হাসছিলেন । অফুরন্ত । পরশু মহাকরণের অনুষ্ঠানে এনারা আমলাসুলভ গোমড়া মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ভ্যাবাচাকা খেয়েছিলেন, আর পেট গুলিয়ে যে-হাসি উঠে এসেছিল, তাকে চাপা দিয়েছিলেন, এতকালের প্রশাসনিক জগদ্দল দিয়ে । খবরটা প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম । লিখেছে, “মুখ্যমন্ত্রী দড়ি টানতেই পুলিসুদ্ধ খসে পড়ল জাতীয় পতাকা।”

বর্ষাতিটা সিটের ওপর রেখে, ভিজতে ভিজতে, বিস্তারিত সংবাদটা পড়তে শুরু করল অর্ণব ।

“স্টাফ রিপোর্টার : স্বাধীনতা দিবসে মহাকরণের সামনে রাজ্যসরকারের উদ্যোগে জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজনে কোনো ত্রুটি ছিল না । কিন্তু গোড়াতেই গলদ । মুখ্যমন্ত্রী দড়ি ধরে টানামাত্র পতাকাটি না-খুলে দণ্ডের উপর থেকে ধপ করে মাটিতে এসে পড়ে । সমবেত অতিথি-অভ্যাগতদের বিস্ফারিত চোখের সামনে এই অভাবিত কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী যারপরনাই বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হন । তখনকার মতো অবিচলিতভাবে পতাকাহীন দণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বাকি অনুষ্ঠানটুকু শেষ করলেও এর পরেই তিনি মহাকরণে নিজের ঘরে চলে যান । মুখ্যসচিবকে ডেকে তিনি কেন এই অঘটন ঘটল, তার তদন্ত করতে বলেন । ওদিকে অনুষ্ঠানে উপস্হিত বর্ষীয়ান স্বাধীনতা-সংগ্রামী নরেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ঘটনাটিকে জাতীয় পতাকার অবমাননা মনে করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন । এই ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্তের পর কলকাতার সশস্ত্র পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আর কে জুহুরি পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারকে জানিয়েছেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু নয় । তুষারবাবু শুক্রবার মহাকরণে গিয়ে সে কথা মৌখিকভাবে পুলিশমন্তীকে জানিয়ে এসেছেন ।

বৃহস্পতিবার ওই পতাকা উত্তোলনের কথা ছিল সকাল সাড়ে দশটায় । ঠিক সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় মহাকরণের সামনে রাস্তার কোনায় দেখা দেওয়া মাত্র আটজন ঘোড়সওয়ার মুখ্যমন্ত্রীকে এসকর্ট করে নিয়ে আসে। বিনয়-বাদল-দীনেশের মূর্তির সামনে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল । সেখানে গাড়ি থেকে নেমে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠেন । পতাকাদণ্ডের সঙ্গে দড়ি দিয়ে পুঁটলির মতন করা বাঁধা পতাকাটি ওড়ানোর জন্য তিনি দড়ি টানতে থাকেন । সরসর করে পুঁটলিটি দণ্ডের শীর্ষে উঠে যায় । আর একটা তান দিলেই সেটি খুলে পুষ্পবৃষ্টি হওয়ার কথা জাতীয় সঙ্গীতের সুর । অভ্যস্ত হাতে মুখ্যমন্ত্রী দড়িতে টান দিতেই ফুলসহ পতাকাটি বাঁধা অবস্হাতেই দড়িদড়া নিয়ে নিচে পড়ে যায় । মুখ্যমন্ত্রীর চোখ ছিল পতাকার দিকেই । তিনি সময়মতো সরে না গেলে সেটি তাঁর গায়ে পড়ত। ওদিকে দড়ি টানলেই পতাকা খুলে যাবে ধরে নিয়ে পুলিশ-ব্যাণ্ডে জাতীয় সঙ্গীত বাজতে শুরু করে দিয়েছে । মুখ্যমন্ত্রী মনের ভাব গোপন রেখে পতাকাহীন দণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন । মুখ্যসচিব অনীশ মজুমদার তাঁর একপাশে স্হানুবৎ এবং অন্যপাশে আধিকারিকরা দাঁড়িয়ে থাকেন থমথমে মুখমণ্ডল নিয়ে । জাতীয় সঙ্গীত শেষ হয় । বাকি অনুষ্ঠানও নমো নমো করে সারা হয় । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী জানিয়েছেন পতাকাটি পাটের দড়ি দিয়ে কাঠের কপিকলে বাঁধা ছিল এবং তাতেই বিপত্তি ।”

—লোকটা পাগল না কী গো ? এই অঝোর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজ পড়ছে । মন্তব্য শুনে হুঁশ হল অর্ণবের। ছাতা মাথায় দম্পতি । মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরছেন ।

–হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ……..

৭. উত্তর-রবিবার, কাণ্ড বটে একখানা

আমার কোনো কাজের-দিন ছুটির-দিন পার্থক্য আর নেই । বাঁশদ্রোণী বাজারের কাজের দিন হল রবিবার । বাজার এইদিন বহুসাংস্কৃতিক উৎসব । আশেপাশের গলিতে, গলিগুলোয়, বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয় বাজার । এই উৎসবে অংশ নেয়াটা আমার সাপ্তাহিক রিচুয়াল । বহুক্ষণ, কোনো-কিছু না কিনে, এমুড়ো-ওমুড়ো ঘুরে, শহুরে বঙ্গসমাজটিকে বোঝবার চেষ্টা করি । লেখালিখির, চিন্তার, অনেক কাঁচামাল, কলকাতায় আসার পর, সকালের মাছ-মাংস-সবজির বাজার থেকে পেয়েছি আমি, এখানের কুশীলবদের থেকে তো বটেই, ঋতুর সঙ্গে তাল রেখে বাজারে পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সঙ্গেও । রবিবার দিন অনেক সকালে উঠি । আজও উঠেছি ।

এত ঘোরাঘুরি করেছি ভারতবর্ষে, মুম্বাইয়ের স্যাসুন ডকে, কিন্তু এখানের মাছের বাজারটা সুপার্ব ।

রাত্তিরে সলিলার ঘুম গোলমাল হয়েছে । হুইস্কির পর হোমিওপ্যাথি খেয়ে । মাঝরাতে পুদিন হারা ক্যাপসুল দিয়েছিলুম ।

মশারি খুললুম । ফিজিওথেরাপি করলুম । দাঁত মেজে চা বানালুম । থলে নিয়ে বাজার । থলেগুলো পালটাতে হবে । নাইলন আর প্লাসটিকের দরুন কনট্যাক্ট ডারমাটাইটিস হয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে । তাজ হোটেলে থাকার সময়ে প্রশান্ত অনেকগুলো ভালো চটের থলে দিয়ে গেছে ! ‘তাজ হোটেল’ লেখা থলে নিয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারে যাওয়া যায় না । কোথাও যাওয়া যায় না ।

আজও বাজারে কিছু লিঙ্গুইস্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলুম । মাসি সম্বোধন না করে, ‘বউমা সজনে ডাঁটা কত করে’ সম্বোধন শক সৃষ্টি করল । ‘এই আবদুল পেঁয়াজ কত করে’ জিগ্যেস করে ক্ষুব্ধ করলুম হিন্দু ছেলেটিকে । আকটি বউকে ‘কি গো বড়বউ মেথিপাতা কত করে’ জিগ্যেস করায় আজকে সে দাদু না-বলে ভাশুরঠাকুর প্রত্যুত্তর দিল । জ্যান্ত ছোটোপনা দর করতে বসে রুই না মৃগেল বলে-বলে খেললুম মাছগুলোকে নিয়ে কিছুক্ষণ । মায়ের অতিপ্রিয় জ্যান্ত রুপোলি পোনা ।

স্কুটারে চেপে একজন পাঁচ টাকার কুপোন বিলিয়ে গেল সবাইকে । পার্টির লোক । আরেকজন বিনা টোকেনেই টাকা তুলল । আনওয়ার শা-র শাজাদা মস্তনের লোক । থানার অংশ ধরা আ্ছে । ‘প্রতিদিন দিতে হয় ?’ ‘না, হপ্তায় হপ্তায় । আজকে রোববার তো । বোড়াল বারুইপুর থেকেও বেচতে আসে ।’

ডেঙো ডাঁটা বিক্রি হচ্ছে : ‘ক্লিন্টনের চুরুটের চেয়েও মিষ্টি, নিয়ে যান কাকু ।’

জামরুল, উত্তরপাড়া আর ঠাকুমার স্মৃতি । বকফুল, বড়দি-ছোড়দির স্মৃতি । অঢেল গাঁটকপি, কল্মিশাক, কচুডাঁটা, শাপলা-লতি, পাটনা আর জ্যাঠামশায়ের স্মৃতি । ঝালের, ঝোলের, ভাজার বড়ি, জেঠিমার স্মৃতি । লখনউ যাব বলে বিশেষ বাজার করলুম না । ট্রেনে প্রথম দিন রুটি আর আলু ছেঁচকি । পরের দিন মেথির রুটি । মুম্বাই যাবার সময়ে ট্রেনে ছাতুর রুটি খেয়ে পৌঁছেই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল । দ্বিতীয়বার ।

জলখাবার খাবার পর কলিম খান এলেন । ওঁকে নিয়ে ধুর্জটি চন্দর বাড়ি গেলুম, বিজ্ঞাপন জগতটা সম্পর্কে জানতে চান কলিম । পথে একজন লোক আরেকজনকে শুয়োরের বাচ্চা গাল দেয়ায় মনে পড়ল জীবনানন্দের কোটি কোটি শূয়োরের আর্তনাদ । বাঙালির এই শুয়োর ঘৃণার কারণ ব্যাখ্যা করলেন কলিম । উৎস, পুরাণ । ভারতবর্ষে অনেক জায়গায় থেকেছি, ঘুরেছি, কিন্তু সেসব জায়গায় শুয়োরের প্রতীকত্ব হারামি, হারামজাদায় সীমিত, যা প্রকৃতপক্ষে শুয়োরের সঙ্গে সম্পর্কহীন । আসলে ইসলামি সংস্কৃতিতেই গালাগালটার উৎস । কেননা হিন্দুর যখন বরাহ অবতার ছিল, তখন বরাহসন্তানকে শুয়োরের বাচ্চা বলায় অপমানিত হওয়া তো উচিত নয় । তাছাড়া গালাগালটা পুর্ববঙ্গে বেশি প্রচলিত ।

ধুর্জটির বাড়ি অনেকক্ষণ আড্ডা হল । আগামী দীর্ঘ লেখাটার জন্য তাড়া দিলেন । ‘পরাবাস্তববাদ’ যত কপি বাঁধানো হয়েছিল সব বিক্রি হয়ে গেছে । ‘এবং’ পত্রিকার সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যায় গজেন্দ্রকুমার ঘোষ লিখিত ‘সুইডেনে ভারত উৎসব’ পুনর্মুদ্রণ করার জন্য মল্ল;ইকা সেনগুপ্ত আর সুবোধ সরকার ক্ষিপ্ত । সম্ভবত নারীবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে তার অনেক পরে । পশ্চিমবঙ্গের নারীবাদীরা সম্পূর্ণরূপে পিতৃতন্ত্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, এরকম একটা নির্ণয়ে পোঁছোলুম তিনজনে । নির্ণয়টাও সম্ভবত পিতৃতান্ত্রিক । আমাদের ব্যক্তিপ্রতিস্ব তো পিতৃতন্ত্রের বানানো ।

ফিরতে দেরি হল। কাকটা নিজের জায়গায় ঠায় বসে ।

আজকে অশথ গাছটায় কচি পাতা গজানো শুরু হল । স্বচ্ছ, মেরুন । নিমের সাদা ফুল, তোড়ার মতন । চাঁপাগাছে পাতা ঝরা সম্পূর্ণ হয়নি এখনও । কলকে ফুল অজস্র ফুটছে প্রতিদিন । পাটনায় কলকে ফুল শুকিয়ে বাখরগঞ্জের ইমলিতলা পাড়ায় ছোটোবেলায় খেলতুম । ওখানে বলে কানাইল । এখানে খেলতে দেখি না । কাঁইবিচি দিয়ে মেয়েদের বাঘবন্দি খেলাও তো দেখি না আর । ফল শুকিয়ে মাথানত শিউলি গাছ । ন্যাড়া গাছে কয়েকটা নাছোড় বেল ।

সলিলাকে সাহায্য করলুম রান্নাঘরে । আজকে আইটেম বেশি ।

Note: ১) পিপল ইন হুজ লিভিং ব্লাড অ্যান্ড সিড উই আওয়ারসেলভস লে ডরম্যান্ট অ্যান্ড ওয়েটিং । ২ ) ওনলি দি নেম অব রোডস চেঞ্জ হুইচ ইজ নট চেঞ্জ ইন হিসট্রি । ৩ ) উই মাস্ট গো বিয়ন্ড আনসারটেইনটিজ । ৪ ) ইট ইজ অ্যান এলিমেন্ট অব এভরি অথরস ইমপালস টু স্পিচ অ্যান্ড এক্সপোজার : দি ডিজায়ার টু প্রেজেন্ট দি ওয়র্স্ট ইন ওয়ানসেল্ফ ইন দি গাইজ অব এ গিফট । ৫) এভরি হোয়্যার ওয়ান ইজ ভালনারেবল টু সাডন র‌্যানডাম ভায়োলেন্স । ইট ইজ নট এগেইনস্ট দি ইনডিভিজুয়াল বাট এগেইনস্ট হিজ আইডেনটিটি ।

দুপুরের ন্যাপটা ভালো হল । বাংলা সংবাদপত্রের গুণ । পড়তে-পড়তে ঘুম আসে ।

একজন হকার-বধু কিছু বেচতে এসেছিল । সম্ভবত অন্তর্বাস আর স্যানিটারি ন্যাপকিন । সলিলার কথা শুনতে পেলুম, ‘এসব আর আমার দরকার হয় না ।’ হকারদের তুলে দেবার পর তাদের বউ আর মেয়েরা প্রতিদিনই বেচতে আসেন কিছু । ফলে দরকার না থাকলেও টুকিটাকি কিনে ফেলছে সলিলা । ফ্রিজের জল আর বিস্কুট খাওয়াচ্ছে । এক-দুজন গৃহবধু কেঁদেও ফেলেছেন ।

বিকেলে পার্থ মুকোপাধভায় এসেছিল । ‘প্রমা’র জন্য লেখাটা দিয়ে দিলুম । একটা স্কেচ দিলুম সৌজার আঁকা, লেখাতার সঙ্গে দেবার জন্য । ‘জলাঞ্জলি’ রিভিউ বেরিয়েচে বলল । অর্ণব চট্টোপাধ্যায় করেছে । তরুণ গদ্যকারদের সম্পর্কে আলোচনা হল ওর সঙ্গে । ‘অ-য় অজগর’ পত্রিকায় সা্জাদ ফিরদৌসের পাঠযোগ্য সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে জানাল । জেমস জয়েসের অনেক রচনাংশ অপ্রয়োজনীয়, বলেছে ছেলেটি । কাগজটা দেখতে হবে । জানি না ছেলেটি নামাজ পড়ে কিনা । মুসলমান লেখকদের পক্ষে খ্রিস্টধর্মী লেখকদের মূল্যায়ন, সেমিটিক উৎসসূত্রের দরুন, তুলনামূলকভাবে বিশ্বাসযোগ্য । আমার মতন একজন হিন্দু অথচ দেবতাহীন সাহিত্যিকের কাছে জেমস জয়েস এবং অন্যান্য খ্রিস্টসেমিটিক লেখকদের কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ । আগে এঁর নাম শুনিনি । মুর্শিদকে বলতে হবে এনে দিতে । সুবিমল মিশ্রের লেখাও বেশ কয়েক বছর পড়িনি । কিছুকাল আগে একদিন টেলিফোন করেছিলেন, আমার বিরুদ্ধে বলা কথাগুলো প্রকৃতপক্ষে সাক্ষাৎকারে বলেননি জানাতে । কোথায় কী বলেছেন আমি জানি না । এত লোকে চল্লিশ বছরে এত কিছু বলেছে আর লিখেছে যে এখন সব ফালতু মনে হয় । হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি-পরা অবস্হায় সাতজন চোর-ডাকাত-খুনির সঙ্গে রাজপথ দিয়ে হাঁটার পর কে কী বলল বা লিখল তাতে কিচ্ছু এসে যায় না ।

বাংলা খবরের কাগজগুলোর গদ্যের চেয়ে আমেরিকান আর ব্রিটিশ খবরের কাগজের গদ্য কমপোজিশান উন্নত কেন । দূরদর্শনের লিখিত সংবাদের গদ্য কমপোজিশানের তুলনায় সে এন এন, বি বি সি, ডি ডাব্লু, অসট্রেলিয়া টিভির গদ্য উন্নত কেন ? তাও আবার তাদের সাংবাদিক তো ঘটনাস্হলে দাঁড়িয়ে বলে চলেছেন ।

দি নিউ ইমপ্রেসান হাউস-এর অমর, কমল যাদের ডিটিপি সেন্টারে এই ‘নখদন্ত’ উপন্যাসের অক্ষরবিন্যাস চলছে, বলল দ্বিতীয় প্রুফ তোলার পর ফর্মা পুরো করার জন্য দু-পৃষ্ঠার মতন ম্যাটার চাই । ‘নখদন্ত’র পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে পড়েছিল বছর খানেক । দাদার বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল যে দু-পৃষ্ঠায় কী দেয়া যায় । ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ লেখাটা বই করে বের করার জন্য মায়ের অ্যালবাম থেকে ইমলিতলায় আমাদের ছোটোলোক পর্বের ফোটো বাছাই করছিলুম । ফোটো দেয়া জরুরি । আমি নাবার্ডে ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার আর দাদা রাজ্য সরকারে ডায়রেক্টার অব ফিশারিজ হয়ে রিটায়ার করায় অনেকেই ছোটোলোক পর্বের সঙ্গে আমাদের মেলাতে পারছেন না !

অরবিন্দ প্রধান, ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকার সাবঅলটার্ন সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন, বললেন, পশ্চিমবঙ্গে ওভাবে কেউ ‘উঠে আসার’ কথা ভাবতে পারছে না বলেই মেলাতে পারছে না । এখানে সব ‘তুলে ধরার’ ব্যাপার । দেখলেন তো সাবঅলটার্ন নিয়ে বক্তৃতা দিলেন পৈতেধারী বর্গের নবারুণ ভট্টাচার্য আর জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় । পশুপতি মাহাতো, অচিন্ত্য বিশ্বাস কিংবা সুবিমল বসাককে বলতে দেয়া হয় না কেন বলুন তো ?

জীবনময় দত্ত বলল, ব্যাপারটা ‘উঠে আসা’ আর ‘তুলে ধরা’র ডায়ালেকটিক ।

আরও কয়েকজন উপস্হিত ছিলেন দাদার বাড়িতে । অনেককে দাদা ‘হাওয়া৪৯’-এর ‘অপর’ সংখ্যায় লেখা দিতে ডেকেছে । আমি ফোটো বাছছিলুম আর দাদার ‘অপর’ বিষয়ক বক্তৃতা চলছিল । একটি তরুণ, নাম বোধহয় শতদল, হঠাৎ বলে উঠল, দূরদর্শনে ‘রাজসভায় মাধবী’ দেখেছেন ? একজন সুন্দরী বৃদ্ধা আর একপাল কুৎসিত কবির পিরিয়ডনাট্য ? কেন বাবা ! পঙ্কজ সাহা, নাসের হোসেনের মতন সৌম্যকান্তি কবিদের নিলেই হতো ।

সলিলা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখেচি ; ওরা বুঝি কবি ?

আমি বললুম, হ্যাঁ, র‌্যাম্বো ওয়ান, র‌্যাম্বো টু, র‌্যাম্বো থ্রি ।

ওই তোমার র‌্যাঁবো বোদলেয়ার ?

সবাই একসঙ্গে এমন হেসে উঠল যে চা চলকে টেবিলময় । বড়জ্যাঠার ফোটোতে ছিটে লাগল । চা খাবার ঘোর বিরোধী ছিলেন । চায়ে ভিজে গেল ‘বুদবুদ’ নামের চটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংখ্যা । সম্পাদিকা স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় আর সোমা মজুমদার পাল । দাদা বলল, বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে । লেখাগুলোয় মগজ বোলালুম । লেখকরা আসল ব্যাপারটাই এড়িয়ে গেছেন । ওনারা ঠাহর করতে পারেননি যে যাঁরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী তাঁরা ‘উঠে আসেন’ । কিন্তু যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক তাঁদের ‘তুলে ধরা’ হয় । দুটো ডিসকোর্স একেবারে আলাদা । প্রতিষ্ঠানবিরোধীর সাবটেক্সট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

‘অপর’ সংখ্যার জন্য আমি সাজেস্ট করলুম যে শম্ভু রক্ষিতের বিরিঞ্চিবেড়িয়ার বাড়ি যাওয়া আর পরিবারে দুদিন কাটাবার যর গল্প ভূমেনদা শুনিয়েছিলেন, সেটা ওনাকে লিখতে বলা হোক । আর বিনোদ বেরার একটা সাক্ষাৎকার নেয়া হোক । অ্যাকাডেমি-টেমিরা তো পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্রদেরই ‘অপর’ হিসাবে পার্মানেন্টলি নির্মাণ করে ফেলেছে ।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের একটি মেয়ে বসেছিল চুপচাপ । বয়কাট চুল । চুড়িদার । ডিজাইনার চশমা । কোনো অধ্যাপকের জন্য হাওয়া উনপঞ্চাশ প্রকাশনীর বইপত্র কিনতে এসে মজে গিয়েছে আড্ডায় । হঠাৎ বলে উঠল, ”কথাসাহিত্য উৎসবে তো অনেকে সমীরদা আর মলয়দার পোস্টমডার্নিজম বিষয়ক বক্তব্য নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে । আর ‘দেশ’ পত্রিকার গল্প সংখ্যার সম্পাদকীয়তেও আপনাদের কথাগুলো রপিট করেছে । ইউনিভার্সিটিতে পোস্টমডার্নিজম নিয়ে যে সেমিনারগুলো গত বছর হয়েছিল, সেখানেও ওয়েস্টার্ন ডিসকোর্সের বিকল্প ছিল আপনাদের কথাগুলো । আপনাদের কিন্তু ডাকা হয় না ।”

আড্ডা একেবারে যাকে বলে থম । বোমা বিস্ফোরণ ।

দাদা সামাল দিল তাড়াতাড়ি, না-না, আমায় তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর উজ্জীবন পাঠমালায় বক্তৃতা দিতে ডাকে ।

মেয়েটির কথা শুনে বেশ ভাল্লাগল । সমাজ ও সাহিত্য বিশ্লেষণ তাহলে কারেক্টলিই করছি । ইউরোপীয় মেটান্যারেটিভের জগদ্দল যাদের মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে আছে, তারাই আমাদের কথাগুলো বলছে । এই বয়কাট মেয়েটি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারছে । এই যে মেয়েটির আবেগে চোবানো প্রতিক্রিয়া, এইটেই তৃপ্তিদায়ক প্রাপ্তি।

ব্রহ্মপুর থেকে লেটারবক্স ফিরলুম ফুরফুরে মেজাজে । দাদার বাসায় যা খেয়েছি তাতে রাতে আর কিছু খাবার দরকার নেই ।

ঘুমের ট্যাবলেট খেলুম । ঘুমের ট্যাবলেট খেলে চোখে পিচুটি পড়ে বলে ফোঁটাকয়েক আইড্রপ নিলুম ।

একটা কথা স্ট্রাইক করল । ওয়ালটার বেনিয়ামিন তাঁর ‘শার্ল বদল্যার : এ লিরিক পোয়েট ইন দি এরা অব হাই ক্যাপিটালিজম’ বইতে বদল্যারের যে বিশ্লেষণ করেছেন, তার সামান্যতম আঁচও বুদ্ধদেব বসুর আলোচনায় নেই। কেন নেই, এটা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে । বুদ্ধদেব বসু তো অনেক দিন পশ্চিমে ছিলেন । তবে ?

প্রতিদিন একটা বাড়িতে গিয়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য কুসংস্কার ছেড়ে দাও যাতে সবাই আজীবন তাতে ভোগে ।

নিরোধ কী করে খায় ? কে খাবে ? স্বামী না স্ত্রী ?

ঘুষ নেয় আর বলে, ‘সমাজের মূল্যবোধ যত পড়ে আমার মূল্য তত বাড়ে’ ।

সমাজবিরোধীরা যে ছেলেটিকে খুন করেছিল, তার শহিদবেদির ওপর বসে সেই সমাজবিরোধীগুলোই ঘ্যাঁজায় । হুঁ হুঁ বাবা, পশ্চিমবঙ্গ বলে কথা ।

আজও কমোডটা পরিষ্কার করা হল না । কাল নিশ্চয়ই করতে হবে ।

।।ইতি শ্রীশ্রীপশ্চিমবঙ্গের সাতকাহন শেষ হইল ।।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *