৬. যোগাযোগ

যোগাযোগ

১৬৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে ভারত-ইউরোপ বাণিজ্যের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপে ভারতীয় পণ্যের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে কোম্পানির দৌলতে ভারতে একটা ইউরোপীয় সমাজ গড়ে ওঠে। কোম্পানির অবস্থা অবশ্য নিরুপদ্রব ছিল না। রাজনৈতিক সংকট ও বাণিজ্যে মন্দার কারণে কোম্পানি বন্ধ হওয়ারও উপক্রম হয়। ঐতিহাসিক কে. এন. চৌধুরী দেখিয়েছেন যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পেছনে তিনটে ব্যাপারে সাফল্য কাজ করেছে— দূরদর্শী ম্যানেজমেন্ট, স্প্যানিশ রুপোর বাজার আওতায় রাখা এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা

এই একশো বছরে কোম্পানির মাধ্যমে সমাজ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে সুদূরপ্রসারী বদল হয়, এই পরিচ্ছেদে তার আলোচনা হবে।

ইউরোপের বাজার

ইউরোপে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ আমেরিকা ও এশিয়া-আফ্রিকা থেকে আমদানি জিনিসের বাজারে ব্যাপক বৃদ্ধির পেছনে কোম্পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বৃদ্ধি হয়েছে খুবই ধীর গতিতে। যুদ্ধবিগ্রহ, প্লেগ ও লন্ডনের অগ্নিকাণ্ড মাঝেমাঝে বাজারে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। তা হলেও আমদানি পণ্যের উপর সাধারণ মানুষের টান বেড়েই চলেছে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির থেকে দ্রুত হারে (অর্থনীতির ভাষায় ভোক্তাদের ‘ওয়েলফেয়ার’ বেড়েছে)। এর পেছনে একটা কারণ আমদানি ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রমাগত কমেছে, অন্তত তুলনামূলকভাবে বাড়েনি। অন্যভাবে বললে আমদানি পণ্যের জোগান অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আস্তে আস্তে বিরাট বাণিজ্যের পরিকাঠামো গড়ে উঠছিল। বিদেশি ব্যাবসা থেকে পাওয়া লাভ বিনিয়োগ করে তৈরি হল বন্দর, ডক, গুদাম ও জাহাজ শিল্প। সামুদ্রিক পরিবহনের খরচ কমে এল। ব্যবসায়িক আইন বিধিবদ্ধ হল। অল্পবয়েসি ছেলেরা দলে দলে জাহাজের কাজে যোগ দিল। নতুনরা শুধু জাহাজি কাজ নয়, ব্যাবসার কাজ, অল্পস্বল্প যুদ্ধবিদ্যা ও একাধিক ভাষাও শিখল।

বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ে ব্যাঙ্কিং ও ইন্সিয়োরেন্স। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লেনদেনের বাজারে লন্ডন আমস্টার্ডামকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে বিল ভাঙানোর ব্যাবসায়, যার উপরে বৈদেশিক বাণিজ্য বেশি করে নির্ভর করত। এর ফলে ব্যাবসায় পাওনা বা দেনা ‘লিকুইড’ মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, শুধু লন্ডনেই নয় বিভিন্ন দেশের আর্থিক বাজারে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড (১৬৯৪) যদিও শুরু হয় সরকারের সঙ্গে লেনদেন চালাবার জন্যে, কিন্তু তার বোর্ডে ঢুকল প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কাররা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড— সিটি অফ লন্ডনের দুই খুঁটি— এক দিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ আর অন্যদিকে হ্যানোভারিয়ান রাজাদের সামরিক-আর্থিক সম্প্রসারণের সহায়তা করে চলল।

এই বিশাল বহুমুখী বদল শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি প্রস্তুত করে। ১৭০০ সাল নাগাদ কারখানার মালিকরা কদাচিৎ ধারে ব্যাবসা করত। ১৮০০ সাল নাগাদ বড় শিল্পোদ্যোগ মাত্রেই ধারে ব্যাবসা। এদের ধার করার ক্ষমতা নির্ভর করত বিল ভাঙানোর সুবিধার উপরে। এই সুযোগ ব্যবহার করে ম্যানচেস্টারের কাপড়ের কল সারা বিশ্বের বাজারে কাপড় বিক্রি করতে পেরেছিল।

এক এক সময়ে ব্রিটেনের বাজারে এক একটা বিদেশি জিনিস প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। যেমন সপ্তদশ শতাব্দীতে এশিয়ার গোলমরিচ। মধ্যযুগের ইউরোপিয়ানরা সারা জীবনের সঞ্চয়, এমনকী জীবন বিপন্ন করেও গোলমরিচ খুঁজে বেড়াত (তার সঙ্গে দারচিনি, আদা, জাফরান, জায়ফল, লবঙ্গ, জয়িত্রি ও গালাঙ্গল)। গোলমরিচের ব্যাপারে এরা কেন এত পাগল ছিল সে প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। একসময়ে মনে করা হত যে বাসী মাংসের দুর্গন্ধ ঢাকবার জন্য মাংস রান্নার সময় অনেক গোলমরিচ ঢালার দরকার হত। অথবা অনেকটা গোলমরিচ দিয়ে মাখানো থাকলে মাংস বেশি দিন ভাল থাকত। সম্প্রতি ঐতিহাসিক পল ফ্রিডম্যান অনেকগুলি ইউরোপিয়ান ভাষায় লেখা প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য রান্নার বই ঘেঁটেঘুঁটে বলেছেন যে মশলা ছিল সে যুগের স্ট্যাটাস সিম্বল, প্রয়োজনের উপকরণ ততটা নয়। বড়লোকরা রান্নায় বেশি মশলা ব্যবহার করত। উঠতি বড়লোকদের কাছে সুদূর ইন্দোনেশিয়া বা মালাবারের হাওয়ায় তৈরি গোলমরিচের একটা রোমান্টিক ইমেজ তৈরি হয়।

সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে দুটো আমেরিকান উৎপন্ন— তামাক আর চিনি— আমদানির বাজারে বড় ভূমিকা নিল। ১৭০০ সালে তামাকের দাম ১৬২০-র তুলনায় কুড়ি গুণ কম, আর সেই সঙ্গে আমদানি বেড়েছে ২০০০০ পাউন্ড থেকে ২ কোটি ২০ লক্ষ পাউন্ডে। ক্যারিবিয়ানের চিনি আমদানি বাড়তে থাকে সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে, আঠারো শতকে বৃদ্ধির হার ছিল তামাকের মতোই চমকপ্রদ।

১৭০০ সালের কাছাকাছি ভারত থেকে আনা দুটো জিনিস কোম্পানির ব্যবসায়ে প্রধান ছিল, সুতোর কাপড় ও সোরা। সোরার বাজার নিয়ে বেশি বলার দরকার নেই, পুরোটাই যেত বারুদ ও গোলাগুলির পেছনে। দু’রকম কাপড় বেশি করে কেনা হত, চিন্টজ বা ছিট অর্থাৎ ছাপা কাপড়, আর ক্যালিকো বা ধোলাই করা সাদা কাপড়। রঙিন কাপড়ের আকর্ষণ কাপড়ের থেকে বেশি রঙের জন্যে। ভারতীয় রংরেজরা অনেক রকমের জৈব রঙের নিখুঁত ব্যবহার জানত। কী করে মর্ড্যান্ট পদার্থ দিয়ে রং পাকা করতে হয়, কী করে কাঠের ব্লক দিয়ে সূচিকর্ম করে আর কলমকারী করে কাপড়ে রঙিন ডিজাইন করতে হয়, এ ব্যাপারে ভারতীয়দের দক্ষতা ও জ্ঞান ছিল সারা বিশ্বের ঈর্ষার বিষয়। বলাবাহুল্য ভারতীয় ছিট কিছু দিনের মধ্যেই ইউরোপে ফ্যাশনের ধ্যানধারণা বদলে দিতে লাগল।

১৭০০ সালে ভারত থেকে সব ইউরোপীয় কোম্পানিদের আমদানি কাপড়ের মোট পরিমাণ ছিল ২৫০-৩৫০ লক্ষ গজ, ব্রিটেনে পৌঁছত এর দুই-তৃতীয়াংশ, আন্দাজ ১৭০-২৩০ লক্ষ গজ। পার্লামেন্ট এই আমদানি কম রাখার চেষ্টা করে বিশেষ সফল হয়নি। পরবর্তী একশো বছরে আমদানির পরিমাণ খুব বদলায়নি। ১৭৯০-১৮০০ সালে বছরে ২২০ লক্ষ গজ কাপড় ভারত থেকে ব্রিটেনে আসে। এই বিশাল পরিমাণ আমদানি কাপড়ের কিছুটা অবশ্যই ঘরোয়া তাঁতিদের বাজার নষ্ট করেছে, যে ভয় থেকে পার্লামেন্ট ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তবে এর বেশিটাই কাপড়ের বাজার বাড়ানোয় সাহায্য করে। ব্রিটেনের জনসংখ্যা ১৭০০ সালে যদি ৫০ লক্ষের কাছাকাছি হয়, তা হলে ভারত থেকে আমদানি কাপড় মাথাপিছু ৫ গজ পরিমাণ বেশি কাপড়ের ব্যবহার বাড়িয়েছে, যা মোট ব্যবহারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

বাজার বিপ্লবের শেষ ভাগে মুখ্য ভূমিকা নেয় চিনের চা। ১৭০০-র গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে চা খাওয়ার চল ছড়িয়ে পড়ে। ১৭২৮ সালে চা আমদানির পরিমাণ দশ লক্ষ পাউন্ডের কম ছিল। ১৭৫৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লক্ষ পাউন্ডে। ‘এই ভয়ংকর নেশা দেশের সর্বনাশ করে ছাড়বে, ১৭৫৭ সালে একজন প্যামফ্লেট লেখক উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। ১৭৭০ নাগাদ আন্দাজ চল্লিশ থেকে সত্তর লক্ষ পাউন্ড চা প্রত্যেক বছর আমদানি হচ্ছিল, তার অনেকটাই চোরাচালান। চোরাচালান বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় কারণ চায়ের উপরে ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জনরোষে পড়ে এই ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে রাজস্বও চাই। তখন ক্ষতিপূরণের জন্যে ট্যাক্স চাপানো হল যে চা ইংল্যান্ড ঘুরে আমেরিকা যেত তার উপরে। ১৭৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বোস্টন টি পার্টি-র এখানেই সূত্রপাত।

বাজার বিপ্লব যে বাণিজ্য বিপ্লবের উপর নির্ভরশীল ছিল তা কিন্তু নয়। বরং বাণিজ্য বিপ্লবের পেছনে কাজ করেছে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। ঐতিহাসিক জে. আর. ওয়ার্ড দেখিয়েছেন যে এই দুটো শক্তি পরস্পরনির্ভর হয়ে ওঠে। বাণিজ্য নতুন জিনিস ক্রেতাদের সামনে নিয়ে আসে। আর ক্রেতাদের আগ্রহে নতুন জায়গায় গিয়ে জিনিস সংগ্রহ করার ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে ব্যবসায়ীরা আরও প্রস্তুত হয়। চায়ের ক্ষেত্রে এই সম্বন্ধ ছিল নিবিড়। চিনে কোম্পানির ব্যাবসা বাড়ানোর পেছনে বড় কারণ ছিল ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ও বাণিজ্য বিপ্লবের কারণে শহুরে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষদের সংখ্যা বৃদ্ধি। এদের মধ্যেই চা খাওয়ার অভ্যাস সবথেকে বেশি বাড়ে। গরিব লোকেদের ভালমন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করলে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ানোর সপক্ষে রায় দেওয়া আবশ্যক। ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে চোরাচালান বন্ধ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বাণিজ্যের চাকার তেল ছিল আমেরিকা থেকে আমদানি রুপো।

আমেরিকার রুপো

আমেরিকায় স্প্যানিশ সাম্রাজ্য ইউরোপে সস্তায় প্রচুর রুপো এনে দেয়। কোম্পানি প্রথম দিকে ইউরোপের জিনিস বিক্রি করে ভারতের জিনিস কেনার চেষ্টা করে। উলের বোনা কাপড় বিক্রিতে সামান্য সাফল্য আসে। আঠারো শতকের শেষভাগে লোহার কামান-বন্দুক প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হতে থাকে। এর মধ্যে ভারতীয়দের চাহিদা ও ইউরোপের উৎপাদনক্ষমতার মধ্যে যোগসাধন করা সম্ভব হয়নি।

কোম্পানির ক্রয়ক্ষমতা নির্ভর করত স্প্যানিশ রুপোর উপরে। ভারতের আর্থিক বাজারে ধার নিয়েও ব্যাবসা চালানো যেত না, কারণ সুদের হার ভারতে অত্যন্ত চড়া। টাকার দামের সঙ্গে সংগতি রেখে সোনারুপো ও ভারতের বাজারে ইউরোপের তুলনায় বেশি দামি। কাজেই স্প্যানিশ রুপো আমদানি ছাড়া গতি নেই। অনেকটা পরিমাণে স্প্যানিশ রুপো এশিয়ায় পাঠিয়ে সিটি অফ লন্ডনে কোম্পানির অবস্থান একটু বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। সেকালের সব টাকাই ধাতব। টাকা বিনিময়ের বাজারও যথেষ্ট উন্নত নয়। কাজেই বৈদেশিক ব্যাবসা চালাতে সোনা-রুপো অত্যাবশ্যক। এ রকম পরিস্থিতিতে একটা সংস্থা অজস্র রুপো বিদেশে পাঠিয়ে দিলে অন্য যারা বিদেশে ব্যাবসা করছে তাদের দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। কোম্পানির শত্রুও বিস্তর, প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা তো আছেই। তার পরে, জন চাইল্ডের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের গন্ডগোল বাধবার সময়ে, যখন খবর এল যে এই রুপো দিয়ে কোম্পানি ভারতে যুদ্ধের রসদ কিনছে তখন শত্রুতা প্রায় হিংস্রতার পর্যায়ে চলে যায়।

সমুদ্রযাত্রা

১৬৫০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে সমুদ্রযাত্রায় বিরাট বদল ঘটে গেছে, যার ফলে ইউরোপে এশিয়ার দেশগুলি সম্বন্ধে জ্ঞান ও এশিয়ায় কলোনি বানিয়ে বাস করার প্রবণতাও বাড়ে।

যেসব জাহাজ লোকলশকর ও মালপত্র নিয়ে ইউরোপের কোম্পানিদের হয়ে এশিয়ায় যেত সেগুলিকে বলা হত ইস্টইন্ডিয়াম্যান। ১৬০০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে ইস্টইন্ডিয়াম্যানের চেহারা বদলে যায়, এবং নাবিকরাও আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এশিয়ার রুটে জাহাজ চালাতে শেখে। একেবারে প্রথম দিকের অনেক রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে কিছুটা ভাগ্য অন্বেষণের মতো মনোভাব নিয়ে নাবিকরা বেরত। পথে অনেক জায়গায় থেমে কিছু বিক্রিবাটার চেষ্টা করত। ব্রিটেন থেকে এশিয়া পৌঁছতে সময় লাগত দু’বছর বা আরও বেশি। পদে পদে বাধাবিপদ অনেক, জাহাজডুবি থেকে জাহাজে মড়ক বা অচেনা বন্দরে শত্রুর আক্রমণ পর্যন্ত। প্রথম যুগের একটা অভিযানের বর্ণনা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যায়।

১৬০৮ সালের মার্চ মাসে শুরু কোম্পানির চতুর্থ যাত্রার কথা ধরা যাক। এই যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন জন জুর্দেইন, যাঁর ডায়েরি এই সময়ের কোম্পানির ইতিহাসের সাক্ষ্য। মে মাসে জাহাজগুলি ক্যানারি ও কেপ ভার্ড দ্বীপপুঞ্জে দাঁড়িয়ে জল, দানাশস্য ও ছাগল তুলে নিল, তার পরে একটানা পাঁচ সপ্তাহ চলে জাহাজগুলি পৌঁছল উত্তমাশা অন্তরীপে। মাঝে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায় একটি পর্তুগিজ ক্যারাক ও একটি ডাচ জাহাজ। মারপিট বাধাবার জন্যে দুই দলেরই হাত নিশপিশ করছিল, কোনওরকমে গোলমাল আটকানো যায়। এদিকে স্কার্ভিতে নাবিকদের হাল খারাপ।

অন্তরীপে তারা দু’মাস বিশ্রাম নিয়ে জাহাজগুলিকে সারিয়ে আরও মজবুত করে নিল, এর পরেই সামনে আছে কেপের বিখ্যাত বিধ্বংসী ঝোড়ো হাওয়া। সেপ্টেম্বরে তারা ফের রওনা দিতে না দিতেই ঝড়ে পড়ে দুটো জাহাজ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। এডেনের কাছে এদের একটা বাকি দলটাকে খুঁজে পায়। অন্যটা সুমাত্রায় ব্যাবসা করতে গিয়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে আসে। ১৬০৮-এর নভেম্বর মাসে প্রধান জাহাজ জাঞ্জিবার যেতে গিয়ে পেম্বায় এসে হাজির হয়। স্থানীয় বণিকরা এদের দেখে খুশি হয়নি। কিছু দিন না যেতেই উপকূলের বণিকদের সঙ্গে জাহাজিদের প্রচণ্ড ঝগড়া বাধল। ফের নোঙর উঠল। কিন্তু তখন উত্তর- পূর্ব মৌসুমি বায়ু তাদের দিকে বইছে, এই হাওয়া ঠেলে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। আরও ভয়ানক দুঃসংবাদ, খাবারদাবার ছিল যে জাহাজটায় সেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই জাহাজের কোনও পাত্তাই আর পাওয়া যায়নি।

১৬০৯-এর জানুয়ারি মাসে পথ হারিয়ে ক্ষুধার্ত নাবিকরা এসে পৌঁছল এক অচেনা দ্বীপপুঞ্জে, সম্ভবত সিশেল্স। এই দ্বীপগুলিতে মাছ, বনমুরগি এবং ‘কোকর-নাট’ নামে একটি জল ও শাঁসযুক্ত ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেল। আরও আনন্দের কথা, দেখা গেল অজস্র ছোটখাটো কুমির রোদ পোয়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে বুভুক্ষু ইউরোপিয়ান নাবিকদের আগে আলাপ হয়নি। অনায়াসে ধরে খেলেও তারা কোনও আপত্তি জানায়নি। এক মাস এই ভূস্বর্গে বিশ্রাম নিয়ে দলটা রওনা দিল এডেনের দিকে। এডেন হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত না। রাস্তা চেনার জন্যে পথের ছোট একটা বন্দরে এক গুজরাটি নাবিককে কিডন্যাপ করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। এডেনে কিছু ব্রিটিশ কাপড় ও লোহার খরিদ্দার মিলল। কিন্তু তার আগে বিক্রিবাটার অনুমতি পেতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেক চাতুরি করতে হয়েছে, আর তার জেরে মারপিট এমনকী খুনজখম হবার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।

১৬০৯-এর জুলাই মাসে জাহাজগুলি চলল ক্যাম্বে উপসাগরের দিকে। এবার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু তাদের রাস্তা থেকে ঠেলে সরিয়ে কাঠিয়াওয়াড়ের উপকূলে নিয়ে গেল। একটা জাহাজ তলিয়ে গেল। শেষমেশ সেপ্টেম্বর নাগাদ দলটা পৌঁছল তাদের গন্তব্য সুরাট বন্দরের কাছে। পৌঁছতেই খবর এল পর্তুগিজরা শহরের শাসকদের বুঝিয়ে ও ভয় দেখিয়ে রাজি করিয়েছে যেন এই নবাগতরা ঢুকতে না পারে। সপ্তদশ শতকের প্রথম দশ-বিশ বছর যাত্রা হত এই রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে।

পরবর্তী এক শতাব্দীকালে জাহাজে অনেক উন্নতি হয়, ফলে ইস্ট- ইন্ডিয়াম্যানগুলির যাত্রার সময় অনেকটা কমে আসে। জাহাজগুলি আগের যুগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বড়। আগের যুগে জাহাজ ছোট হওয়ায় একটা অতিরিক্ত জাহাজ দরকার হত শুধু খাবারদাবার ও জল বইবার জন্যে, আর পুরো দলটাকেই অনেক জায়গায় থামতে হত রসদ তুলবার জন্যে। এই জাহাজ ডুবলে বা ঝড়ে দলছাড়া হয়ে গেলে সবাইকে না খেতে পেয়ে মরতে হবে। এখন খাদ্য ও পানীয় নাবিকদের সঙ্গেই যায়। বন্দর খুঁজে বার করতে দেশি গাইডের প্রয়োজন হয় না। সমুদ্রে কম সময় কাটাবার ফলে স্কার্ভির প্রকোপ কমেছে। মৌসুমি বায়ু ব্যবহার করে কী করে আরব সাগরে যাতায়াত করতে হয় সেই জ্ঞান আগের থেকে ইউরোপিয়ান নাবিকদের এখন অনেক বেশি। রসদ নেওয়ার জন্য আগে ক্যানারি বা কেপ ভার্ডে দাঁড়াতে হত, এখন লন্ডন ছাড়বার পরে সোজা কেপে চলে যাওয়া যায়। বড়জোর মদ তোলার জন্যে মাদিরায় কয়েক দিন দাঁড়ানো যেতে পারে। রাস্তায় বড় স্টেশন কেপ, এখনও এখানে থেমে জাহাজ মেরামত করানো প্রয়োজন, কারণ সামনে ঝোড়ো হাওয়া। কেপ থেকে কলকাতার পথে আগের যুগের দুটো স্টপ— জাঞ্জিবার ও এডেন— আর ব্যবহার হয় না। বরং দরকার হলে আরও সুবিধাজনক কোমোরো দ্বীপপুঞ্জ বা মাদাগাস্কারে দাঁড়ানো যেতে পারে। ছয় মাসের কম সময়ে যাত্রীরা উড়িষ্যার উপকূলে কোনারক মন্দিরের চুড়ো দেখতে পাবে। পরদিন হুগলি নদীর মুখে জাহাজ পৌঁছবে।

কারখানা

কোম্পানির কাজকর্মের কেন্দ্র হল কারখানা বা আড়ত, যাকে বাংলায় আড়ং বলা হত। কারখানায় কোনও কিছু তৈরি হত না। প্রধানত এটা ছিল গুদাম, যেখানে কাপড় ও অন্যান্য রপ্তানির জিনিস জমা পড়ত ও পরীক্ষা মাপজোক ইত্যাদি হয়ে গেলে জাহাজের অপেক্ষায় গুছিয়ে রেখে দেওয়া হত। কারখানার দায়িত্বে ছিল কাউন্সিল। কাউন্সিলে সবার উপরে চিফ, তার নীচে অ্যাকাউন্টেন্ট, পার্সার মেরিন অর্থাৎ জাহাজের ক্যাবিন রসদ ইত্যাদির তত্ত্বাবধায়ক কর্মচারী ও সেক্রেটারি। সব মিটিং-এর বিবৃতি ও রোজকার ঘটনাবলির বর্ণনা লিখত এই সেক্রেটারি। সেই লেখাগুলির নাম কনসালটেশনস। সেক্রেটারি আরও একটি কাজ করত। পুরো কারখানার কাজকর্মের উপরে একটি রিভিউ বা পর্যালোচনা লিখত। এই কনসালটেশনস ও রিভিউয়ের কপি হেড অফিসে পাঠানো হত। এই নথিগুলি এখন ঐতিহাসিকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যের উৎস। এ ছাড়া পাদরি ও ডাক্তার (বা চ্যাপলেইন ও সার্জন) কারখানার সামাজিক জগতে প্রামাণ্য ব্যক্তি। এদের নীচে স্টুয়ার্ড বা কার্যাধ্যক্ষ। তার নীচে একদল ব্যবসায়ী, কারখানাদার বা ফ্যাক্টর, কেরানি বা রাইটার ও শিক্ষানবিশ।

সাধারণত অফিসের কাজে সময় বেশি লাগত না, সকালে তিন ঘণ্টা ও বিকেলে তিন ঘণ্টা দিলেই যথেষ্ট। মাঝে লম্বা একটা মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। কিন্তু যখন বন্দরে জাহাজ এসে ভেড়ে, তখন কয়েকটা দিন অফিসে হইহই করে কাজ হত, নিশ্বাস ফেলার সময় থাকত না।

কোম্পানির নিজের উচ্চপদস্থ অফিসাররা মোটামুটি নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাত্রা পালন করত, কিছুটা ইংল্যান্ডের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জীবনের মতো। কারখানায় তাদের থাকা-খাওয়া ফ্রি, আর বেশ কয়েক জন ভৃত্য ও খিদমতগারও ফ্রি। এদিক ওদিক গেলে পালকি মজুদ, পাশে পাশে কয়েক জন ইউরোপিয়ান পল্টন চলবে। ঘোষক চিৎকার করে জানান দেবে কে পালকি চেপে চলেছে। পল্টন সঙ্গে থাকলেও এরা কারখানা থেকে দু’-এক মাইলের বেশি দূরে যেত না। খুব বেশি হলে শহরের সীমানায় বাগানে হাঁটতে যেত। এই শহর যদি সুরাট বা মসুলিপতনম হয় তা হলে দিনের শেষে ডাচ অফিসাররা ইংরেজদের সঙ্গে হেঁটে গল্প করে সন্ধেটা কাটাবে।

মধ্যাহ্নভোজন বেশ বড় ও সামাজিক ব্যাপার। সবাই একসঙ্গে এক টেবিলে অপর্যাপ্ত খাবার নিয়ে বসবে এই নিয়ম। ইউরোপিয়ান খানসামার চাহিদা খুব। মাঝেমাঝেই ডাচ, ডেনিশ ও ইংরেজরা পরস্পরের কারখানার হেড খানসামাকে ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। মদেরও চাহিদা খুব, জোগান কম। সবথেকে ভাল মদ ইউরোপের আমদানি, এগুলি অফিসাররাই খেতে পেত। বেশির ভাগ সময়ে স্থানীয় চোলাই মদ খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হত। কী করে ভারতে উপলব্ধ মালমশলা দিয়ে মোটামুটি চলনসই মদ চোলাই করা যেতে পারে ইউরোপিয়ান সমাজের অনেকেই এই বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে চলত। বলাবাহুল্য চলনসই মদ সবসময়ে স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ ছিল না।

এক টেবিলে বসলেও উচ্চ-নীচ ভেদ রক্ষায় কড়াকড়ি ছিল। কে কোথায় বসবে সে ব্যাপারে কঠোর নিয়ম ছিল। আবার উচ্চপদস্থরা খাওয়া শেষ করে বিদেয় হতেই জুনিয়ররা পোশাক বদলে কুর্তা পাজামা পরে গালচের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে ভারতীয় স্টাইলে খাওয়া শেষ করত। ইটালিয়ান নিকোলাও মানুচ্চি জানাচ্ছেন, খাওয়া শেষ হলে মাটিতে বসে ছোকরা অফিসাররা হুঁকো হাতে ধরে পান চিবোতে চিবোতে আড্ডা মারত।

বাইরে নানারকম নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম রক্ষা হলেও কারখানার জীবনের গভীরে একটা অস্থিরতার প্রবাহ ছিল। ফ্যাক্টর ও অফিসাররা অনেক সময়ে পরস্পরের প্রতিযোগী। ব্যক্তিগত ব্যাবসার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী, এবং তার জেরে ভৃত্যদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা দরকার হতে পারে। এই সব জটিলতা থেকে ঝগড়াঝাঁটি প্রায় নিশ্চিত। কোম্পানির নিয়মকানুনে তুড়ি মেরে নিজস্ব ব্যাবসা প্রায় সকলেই চালায় এবং সকলেই এ ব্যাপারে অল্পবিস্তর নির্লজ্জ। কিন্তু কারওর পেছনে লাগতে গেলে আবার এটাই অস্ত্র। কারখানার পরিবেশে বড়-ছোট, অভিজাত-অনভিজাত বিভেদ বেশি করে চালাবার চেষ্টা করলেই কলহ বাধবে। হাজার হোক ইংল্যান্ডে যে জাতবিচার মানুষ মেনে নেয়, ইংল্যান্ড থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সেটা মানবে কেন? কলহ অনেক সময়ে ডুয়েল পর্যন্ত গড়াত। সবথেকে বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা ছিল মহিলাঘটিত। আলিপুর ব্রিজের কাছে কিছু দিন আগে পর্যন্ত দুটো গাছ ছিল যাদের সেকেলে নাম ‘সর্বনাশী বৃক্ষ’ (ট্রিস অফ ডেস্ট্রাকশন)। এদের নীচে এককালে অজস্র ডুয়েল সংঘটিত হয়েছিল, প্রায় সবই ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে। এ রকম অবস্থায় পাদরিদের কাঁধে বড় দায়িত্ব ছিল সবাইকে নীতি, ধর্ম, ইন্দ্রিয়দমন আদি মূল্যবোধ ভাল করে বোঝানোর। পাদরির নিজের ব্যক্তিত্বের উপরে অনেকটা নির্ভর করত কারখানার পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল বা অস্থির।

লন্ডনে অবস্থিত অফিসাররা কারখানার জগতের বেআইনি ব্যাপারস্যাপার নিয়ে অল্পবিস্তর ওয়াকিবহাল ও সর্বদাই তটস্থ। দূর থেকে তারা আর কতটুকু সামলাবে। কিন্তু কারখানার খরচের হিসেব নিয়ে মাঝেমাঝেই চুলচেরা প্রশ্ন তুলত। নিয়ম হল যে, কারখানার খরচ উঠবে স্থানীয় জমিজমা ও ভাড়ার আয় থেকে। কিন্তু আয় ভাল হলেও বাজে খরচ এড়াবার উপায় নেই। তা ছাড়া ভারতে বসে যে হিসেবপত্র তৈরি হত তাতে অনেক ভারতীয় নিয়ম ও শব্দ ব্যবহার হওয়ায় লন্ডনের লোকেরা হিসেব ভাল বুঝতও না।

চিফ অফিসারদের জীবনযাত্রার আদর্শ লন্ডনের অফিসার নয়, স্থানীয় রাজাদের চালচলন। তাদের ঘিরে থাকত ভৃত্যবাহিনী। ঘোড়ার গাড়ি ও সুসজ্জিত পালকি ছাড়া এক-পা যেতে তারা রাজি নয়। সঙ্গে যাবে এক ডজন পিয়ন, আরদালি ও সৈন্য। সামনে একজন ইংল্যান্ডের পতাকা হাতে নিয়ে হাঁটবে, দু’ধারে বিশাল হাতপাখা নিয়ে দু’জন মাছি তাড়াবে, আর পেছনে সারি দিয়ে হাঁটবে একদল গায়ক-বাদক, যাদের ‘সম্মিলিত আওয়াজে ভূত পালায়’ (চার্লস লকিয়ার, ১৭১১)। এত আড়ম্বরের উদ্দেশ্য দেশি দরবারে যেন তাদের রাজার সম্মান মেলে।

খাবারদাবার ও পার্টিতে অপব্যয়ের সুযোগ অপর্যাপ্ত। ১৭০০-র প্রথম দিকে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত একটা বিশেষ ভোজে পরিবেশিত হল একধরনের পাঁঠার মাংসের ঝোল যাতে তিমিমাছের পেটের মোম (অ্যাম্বার্গিস) প্রচুর পরিমাণে ঢালা হয়েছে। এক এক প্লেট রান্নার খরচ ২০০ টাকা, আজকের টাকায় এক লক্ষের বেশি। এ ছাড়া, কোম্পানির জাহাজে মাল পাঠালে কোম্পানির পদস্থ অফিসাররা নিয়মের থেকে একটু বেশি ছাড় পেত। স্থানীয় রাজাদের জন্যে উপহার কিনলেও টাকা মারবার সুযোগ।

এই যে বিচিত্র কারখানার জগৎ, তার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকটাই আসে কনসালটেশনস বই থেকে, এবারে এই বই নিয়ে একটু কথা বলা যাক।

কনসালটেশনস বই

কারখানার যাবতীয় ঘটনা এই বইয়ে ডায়েরির মতো লিখে রাখা হত। কী ধরনের ঘটনা? জুলাই ১৬৮২ থেকে ডিসেম্বর ১৬৮৩-র মধ্যে লেখা মসুলিপতনমের বই থেকে কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। কনসালটেশনস বইয়ের এক একটি পাতা এক এক দিনের বিবরণী। মাঝেমাঝে কিছু দিন হয়তো বাদ পড়েছে কারণ লেখার মতো কোনও ঘটনা সেই দিনগুলিতে ঘটেনি। যদি মালের বিবরণ, দাম, পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য বাদ দিই, তা হলে তিনটে বিষয় প্রাধান্য পায়।

এক, নিত্যকর্ম অর্থাৎ জাহাজ আসা-যাওয়ার খবর, জাহাজ আসার আগাম খবর, অন্য কারখানা থেকে আগত এজেন্টদের কথা, ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে লেনদেনের হার নিয়ে দরদস্তুর, মালবাহক আর ধোলাইকারদের (ওয়াশারম্যান) সঙ্গে আলোচনা আর ভারতীয় ব্যবসায়ী ও এজেন্টদের সঙ্গে আলাপ। এই সব দৈনন্দিন বিষয়গুলি হয়তো দু’-চারটে কথায় সারা হয়। দু’নম্বর বিষয়টি আর একটু জটিল, কারখানার পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে শহরের গভর্নর বা নবাবের প্রতিনিধি প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারদের আলোচনা। আলোচনার প্রধান বিষয় ইন্টারলোপার বা অনধিকার প্রবেশকারী প্রাইভেট বণিকদের কী করে আটকানো যায়। আর-একটা গৌণ বিষয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত বিবাদ মেটানো। তিন নম্বরে আছে নানারকম আকস্মিক ঘটনা, যেমন মৃত্যু, অসুখ বা অপ্রত্যাশিত আগমন। পাওনা, চালান, রসিদ বিষয়ে নীরস বিবরণের মাঝখানে হঠাৎ সুর বদলে শুরু হল জীবনের অনিত্যতা নিয়ে দার্শনিক আলোচনা। দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে হঠাৎ উত্তেজনার সঞ্চার হল ১৬৮৩-র বর্ষার এক সকালে, যখন বাংলা থেকে আসা একটা মালজাহাজ কারখানার চত্বরে হবু হিরের ব্যবসায়ী জন এলস্ট ও তার পরিবারকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

নবাবের দরবারে আইনকানুন নিয়ে আলোচনা সবথেকে জটিল বিষয় বলাই বাহুল্য। নবাব মাহমুদ আলি বেগ মাঝেমাঝে কারখানায় বিনীত ভাষায় চিঠি পাঠাতেন বিদেশি মদের বোতল ও চিনি কেনবার আগ্রহ প্রকাশ করে। কারখানা সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর মদ ও চিনি নবাবের বাড়ি পাঠিয়ে দিত, সবিনয়ে দামের ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হত। সেক্রেটারি কনসালটেশন বইয়ে লিখলেন, ‘কাউন্সিলের মতে সুসম্পর্ক রাখার জন্যে এইটাই অপেক্ষাকৃত শস্তা উপায়।’ যেদিন দিগন্তে ইন্টারলোপার জাহাজের মাস্তুলের চূড়া দেখা দিল, সেদিন বোঝা গেল সম্পর্ক ভাল রাখা দরকার কেন।

১৭ আগস্ট ১৬৮৩ ‘কনস্ট্যানটিনোপল’ নামে এক জাহাজ ঝোড়ো হাওয়ায় পথ হারিয়ে তীরে এসে উঠল। জাহাজের ক্যাপ্টেন জন স্মিথ। কারখানার গুপ্তচর সংবাদ দিল জাহাজের দু’জন ইহুদি ব্যবসায়ী, নাম রোড্রিকস ও ডিপোর্টা, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে নবাবের দরবারে যাচ্ছে। কারখানার অফিসাররা সঙ্গে সঙ্গে নবাবের দরবারে গোপনে একদল প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল যারা কলকাঠি নাড়বে যাতে নবাবের সঙ্গে এদের দেখাসাক্ষাতের সুযোগ না হয়। বলাই বাহুল্য যেখানে আইনকানুন নবাবের হাতে সেখানে নবাবের সাহায্য ছাড়া ইন্টারলোপারদের আটকানোর অন্য উপায় ছিল না।

ইউরোপীয়দের দুর্বোধ্য রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া বা ইংরেজদের হয়ে ডাচদের বিরুদ্ধে ব্যাট করা নবাবের পছন্দ ছিল না। একবার কারখানার লোকেদের কাছে ইন্টারলোপার সংক্রান্ত নালিশ শুনে নবাব খেপে গেলেন, ‘নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ কর না বাপু, আমাকে টানছ কেন?’ ইংরেজরা লজ্জিত হয়ে কারখানায় ফিরে এসে দালালদের খবর দিল যেন প্রাসাদের আমলাদের আরও বেশি করে ঘুষ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।

ইন্টারলোপারদের উপস্থিতিতে কারখানার সঙ্গে ভারতীয় বণিকদের সম্পর্কও বেশ জটিল হয়ে উঠত। ১৬৮৩ সালের ২০ নভেম্বর কাপড়ের জোগানদারদের সঙ্গে কারখানার অফিসারদের মহা ঝগড়া বেধে গেল। এক বিরাট বান্ডিল কাপড়ে খুঁত বেরিয়েছে বলে কারখানা অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে। জোগানদাররা কাপড় ফেরত নিতে রাজি নয়, উলটে ভয় দেখাল তারা আর যত ডেলিভারির মাল আছে সব নিয়ে ‘অন্যত্র ক্রেতা খুঁজতে যাবে।’ কাউন্সিলের সদস্যরা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে টেবিলে ফিরে এল এবং নম্রভাবে জোগানদারদের সব দাবি মেনে নিল। কারণ চরেরা খবর এনেছে ইন্টারলোপার জাহাজ বন্দরে আসছে।

সাধারণত জোগানদারদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু চুক্তি রক্ষা করা। জাহাজ যখন বন্দরে এসে অপেক্ষা করছে তখন প্রত্যেকটা মুহূর্ত দামি। জোগানদারদের উপর তখন প্রচণ্ড চাপ; অনেকটা মাল খুব অল্প সময়ে ডেলিভারি দিতে হবে। জোগানদাররা জবাব দিয়ে দিল, হবে না। তখন কারখানার অফিসারদের কাজ কিছুটা বাবা-বাছা করে এবং কিছুটা ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা।

জোগানদাররা কখনও আপত্তি জানাচ্ছে এত বড় অর্ডার এ তল্লাটে আগে কেউ হাতে নেয়নি। তাদের কোনওমতে রাজি করানো হল। কিন্তু ডেলিভারির সময় সেক্রেটারি লিখলেন, কাউন্সিল দেরি দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে আছে। সমস্যার সৃষ্টি হত আর এক কারণে, কাপড়ের মানে বা ডিজাইনে খুঁত। ছিটের কাপড় বা কলমকারীর অর্ডার দেওয়া হত স্যাম্পল দেখে। প্রায় সবসময়েই ডেলিভারির মালের সঙ্গে স্যাম্পলের তফাত থাকত, কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত। তখন আবার একদফা দীর্ঘ ক্লান্তিকর কথাবার্তা।

সমাজ

১৭২০ সালে এক আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে বম্বের কারখানায় মোটমাট ৮০ জন লোক কাজ করছে, সকলেই পুরুষ। এ ছাড়া আছে ২৬ জন মহিলা, প্রায় সবাই বিবাহিতা, আটটা শিশু, আর ৫০ জন সৈন্য। সংখ্যায় পুরো ব্যাপারটা খুবই ছোট, যদিও এই গণনায় ধরা হয়নি এমন সব সৈন্য যাদের চাকরি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে বা ইউরোপীয় ব্যবসায়ী যারা কারখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যাবসা শুরু করেছে বা কর্মচারী যাদের কাজের কড়ার শেষ কিন্তু তারাও কারখানার বাইরে এসে বাস করছে। গণনা থেকে এটাও স্পষ্ট যে পুরুষ-নারী অনুপাত ভীষণ অসমান। এই অসাম্য অবশ্য সেকালে অনেক পরিযায়ী বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই দেখা যেত।

কারখানার সাধারণ কর্মচারী একটি যুবক, কুড়ির কাছাকাছি বয়েস এবং খুবই অধস্তন অফিসার। ভাগ্য ভাল হলে আর পরিশ্রমী হলে সে হয়তো কোম্পানির সঙ্গে লিখিত ইন্ডেনচার বা কড়ার শেষ করে, অসুখবিসুখ কাটিয়ে উঠে অর্থাৎ বেঁচে থেকে নিজস্ব ব্যাবসায় যথেষ্ট টাকা করে দেশে ফিরতে পারবে। বা ব্যবসায়ী হয়েই এ দেশে থেকে যাবে। সেই শুভ মুহূর্ত আসা পর্যন্ত কারখানার কাজের একঘেয়েমি, কারখানার সমাজের তীব্র শ্রেণিভেদ তাকে নির্মম ভাবে পীড়ন করে চলবে।

এই জাঁতাকল থেকে পালিয়ে বাইরে গিয়ে বৃহত্তর সমাজে যোগ দেওয়ার প্রবৃত্তি অনেক সময়ে দুর্দম হয়ে উঠত। কেমন ছিল কারখানার পাঁচিলের বাইরের সেই জগৎটা?

ইউরোপীয় নাবিক আর ইউরোপীয় ভাড়াটে সৈন্যরা কারখানার বাইরে নিজস্ব একটা জগতে বাস করত, যার সঙ্গে কোম্পানির পদস্থ অফিসারদের সমাজের আকাশপাতাল দূরত্ব। দুই দলে বিশেষ মেলামেশা হত না। নাবিক- সৈন্যদের জীবনে কোনও শৃঙ্খলা নেই। যুদ্ধ ও অন্যান্য হাঙ্গামা লেগেই আছে। মেরামতির জন্যে জাহাজ বেশিদিন বন্দরে আটকে গেলে নাবিকরা তীরের কাছেই বাস করত। রাতারাতি সেখানে গজিয়ে উঠত বস্তি, দোকানপাট, মদের ঠেক ও বেশ্যাবাড়ি। এই ছিল কারখানার বাইরের সমাজ।

দুই জগতের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বিশেষ করে মদ ও মেয়েমানুষের ক্ষেত্রে তীব্র হয়ে উঠত। ভারতে বসে ভাল মদ সংগ্রহ ইউরোপিয়ানদের কাছে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। কারখানার পদস্থ অফিসারদের জন্যে বিদেশ থেকে মদ আসত, কাঠের বাক্স ভরতি মাদিরার বোতল। অন্যরা কাছাকাছি শহর-গ্রাম থেকেই মদ জোগাড় করার চেষ্টা করত। এই প্রজেক্ট মাঝেমাঝে এমন দুঃসাধ্য হয়ে উঠত যে বেপরোয়া হয়ে এরা যে মদ হাতের কাছে পেত তাই খেয়ে বসত। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম সিমসন ১৭১৫ সালে লিখলেন, ‘অপরিমিত বাজে মদ খেয়ে এখানে বেশ কয়েক জন ইউরোপিয়ান মারা গেছে।’ সিমসন সুরাটের তাড়ির প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়। জাহাজঘাটে, নাবিক- সৈন্যদের বস্তিতে একাধিক ‘পাব’ গজিয়ে ওঠে, বিশেষ করে কলকাতার কাছে হুগলির তীরে। মদ সহজলভ্য হলেও যে মদ এখানে পাওয়া যেত তা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং অল্পবিস্তর বিষাক্ত। সবাই এখানে ‘বোল পাঞ্চ খেতে আসত— দেশি ধেনো, গুড়, লেবুর রস আর কয়েক ফোঁটা মাস্কাডিন আঙ্গুরের রস মেশানো এই ককটেল খেয়েই অনেকের স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে যেত এ রকম সেকালের ডাক্তারদের বিশ্বাস ছিল।

দ্রুত পাব কালচার শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ১৭৭০ সালের বর্ণনায় জানতে পারি কলকাতার লালবাজার এলাকায়, পরে যেখানে পুলিশের হেড অফিস বসল, অনেকগুলি ‘নিচুমানের সরাইখানা’, ‘পাঞ্চ হাউস’, ‘অ্যারাক হাউস’ ইত্যাদি গজিয়ে উঠেছে, যার মালিকরা ইটালিয়ান, স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ। এইখানে ‘পারিয়া অ্যারাক’ পাওয়া যায় ‘সৈন্যদের চরিত্র খারাপ করতে যার জুড়ি নেই’। সরকারি নিয়ন্ত্রণ তৈরি হওয়ার আগে অনেকগুলি এ রকম পাবের নাম জানা যায়, হারমনিক, ইউনিয়ন, রাইট’স নিউ ট্যাভার্ন, এক্সচেঞ্জ, ক্রাউন, অ্যাঙ্কর ইত্যাদি। কলকাতা যে এই সময়ে একটি আন্তর্জাতিক মেল্টিং পট হয়ে উঠেছিল তা এই পাবগুলির ইতিহাস থেকে সবথেকে ভাল বোঝা যায়। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত বাংলায় লেখা ‘কলকাতা পরিচয়’-এর বই থেকে জানি যে পুরনো কলুটোলা স্ট্রিটে তখনও একটি পাবের ভাঙাচোরা সদর দরজা ও চত্বর দেখা যেত, তার সামনে প্রতিষ্ঠার তারিখ লেখা ছিল ১৭৬৭।

মদ তৈরি বা পরিবেশন কলকাতায় বরাবরই আইনসংগত ছিল, তবে মাঝে মাঝে ট্যাক্সের কারণে ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। ১৭২০ সালে জনৈক বিবি ডোমিঙ্গো অ্যাশ, সম্ভবত পর্তুগিজ-ভারতীয়, অ্যারাক বিক্রির লাইসেন্সের জন্যে কোম্পানির কাছে দরখাস্ত দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাবসায় নিয়ন্ত্রণ এলেও মদের গুণমান রক্ষা করার দায়িত্ব বহুদিন সরকার হাতে নেয়নি। আর শহুরে পাবগুলিতে আসতও গরিব লোকেরা, খেটে- খাওয়া ইউরোপিয়ানরা, তাদের হাতে দামি মদ কেনার পয়সা নেই। ফলে পাব-খরিদ্দার-মদ একের কুখ্যাতি অন্যের কুখ্যাতি বাড়িয়ে তুলত।

এই পাবে নিয়মিত মারপিট খুনজখমের ঘটনা ঘটত। তার একটা কারণ নদীতে যেসব ডাকাত ও জলদস্যু চরে বেড়াত তারা লুটের মাল নিয়ে আসত পাবে, আর লাভের বখরা ও দরকষাকষি থেকে রক্তারক্তি লেগে যেত। বলাই বাহুল্য মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্যে জঘন্য পানীয়ও সহায়ক ছিল।

কারখানার কর্মচারীদের মধ্যে খুব কম জনই ইউরোপিয়ান মেয়ে বিয়ে করার সুযোগ পেত। এমনকী পদস্থ অফিসারদের মধ্যেও বিবাহযোগ্য ইউরোপিয়ান মেয়ে খুঁজে পাওয়া গেলে বিয়ের আগে বেশ কয়েকবার ডুয়েল লড়ার দরকার হত। অবশ্য বিয়ে বা সখ্য করতে হলে ইউরোপিয়ান মেয়েই দরকার এমন কোনও বাছবিচার অফিসারদের ছিল না, জুনিয়রদের তো নয়ই। বরং বলা যায় ভারতীয় মেয়েদের প্রতি একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিদের মধ্যে ভারতীয় মেয়ে নিয়ে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল।

১৬৮০ সালে ফ্রান্সোয়া বার্নিয়ের লিখলেন, ‘বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, আর তার উপরে বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্য আর সহৃদয় মেজাজ এতই আকর্ষণীয় যে পর্তুগিজ, ইংরেজ আর ডাচদের মধ্যে প্রবাদ আছে একশোটা দরজা দিয়ে এদেশে ঢোকা যায়, কিন্তু একটাও বেরবার দরজা নেই।’ বার্নিয়েরের একশো বছর পরেও বাঙালি মেয়েদের বিষয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল আগের মতোই জোরদার। ডাচ অফিসার জন স্টাভোরিনাসের মতো বাঙালি চরিত্রের কড়া সমালোচক মেয়েদের প্রসঙ্গে নরম হয়ে লিখলেন (১৭৭০) — ‘বাঙালি মেয়েগুলি যদিও একটু দুষ্টু হয়, এদের শরীরের গঠন বেশ সুন্দর।’ সমসাময়িক আর একজন আগন্তুক লিখলেন, ভারতীয় মেয়েরা ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। সবথেকে ঈপ্সিত হল ‘জেন্টু জাতির মেয়েরা’, অর্থাৎ হিন্দু উঁচু জাতের মেয়েরা। ‘এদের গঠন এত সুন্দর, হাত-পা যেন ঈশ্বরের হাতে গড়া ভাস্কর্য, চোখে কি অভিব্যক্তি’ ইত্যাদি (ফিলিপ স্ট্যানহোপ, ১৭৮৪)। বার্থলোমিউ বার্জেস, ১৭৮০-তে কলকাতার বাসিন্দা আর এক ব্যবসায়ী হিন্দুস্থানি মেয়েদের ওড়নার রোমান্টিক-ব্যাবহারিক নানারকম উপযোগিতা নিয়ে সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখে বন্ধুদের পাঠিয়ে দিলেন।

জেন্টু মেয়েদের সম্বন্ধে কবিত্ব করলেও কোনও ব্রাহ্মণ বা বানিয়া জাতির মেয়ে ইউরোপিয়ানদের নাগালের মধ্যে ছিল না। ‘ধনী ব্যবসায়ীরা আট বছরে পড়তে না পড়তেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়’ (টমাস বাওরি, ১৬৭০)। অন্যদিকে সম্পদশালী পরিবারের বয়স্থ মেয়েদের ‘ভয়ানক সাবধানে অন্দরে লুকিয়ে রাখা হয়’ (টমাস টেন্যান্ট, ১৮০৪)। ভারতীয় সমাজের শিক্ষিত ও অভিজাত অংশ সযত্নে ইউরোপিয়ানদের মুখের উপর অন্দরমহলের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

কাছ থেকে ভারতীয় মেয়ে দেখতে হলে এদের আসতে হত সেই জাহাজঘাটার বস্তিতে। ১৭৭০ সালে কলকাতার উত্তরে বরানগর বিখ্যাত ছিল অনেক সখীদের বসতি হিসেবে, এদের ডাচ কোম্পানি ব্যাবসা করার লাইসেন্স দিয়েছিল। কেউ বা পেশাদার নাচিয়ে-বাইজিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করত, এবং শাস্তি হিসেবে ‘ওদের অতিশয় প্যানপেনে গান’ শুনে তারিফ করতে হত। কারখানার অফিসার শ্রেণির লোকেরা পাড়ার বাইরে এসে বস্তির মধ্যে বন্ধু ও সঙ্গিনী খুঁজত। এখানে ভারতীয় ও ইউরোপিয়ান খেটে-খাওয়া মানুষরা পরস্পরের প্রতিবেশী। এই পাড়া থেকেই কিছু মেয়ে বড়লোক পাড়াতেও যাতায়াত করত। ১৭৭০ সালে লেখা কলকাতার ইংরেজ ব্যবসায়ীদের রোজনামচার বর্ণনায় বলা হয়েছে: সকাল আটটা নাগাদ খাস চাকর শোবার ঘরে ঢুকে মালিককে জাগাতেই মালিকের পাশ থেকে এক মহিলা উঠে পড়বে, সে হয় প্রাইভেট সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে যাবে, নয় তো তাকে খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

নবাগত পাদরিদের প্রথম কাজ অনেক বড় ছেলেমেয়েদের (এবং তাদের মায়েদের) ব্যাপটাইজ করা আর পুরনো বিয়ে ধর্মসংগত করা। ইউরোপিয়ান জামাই ও তাদের ভারতীয় শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক নিয়ে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। অফিসাররা বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা বোঝাই যায় শ্বশুরবাড়ির লোকদের বেশি কাছাকাছি আসতে দিত না। তবে অনেক নাবিক-কারিগর শ্রেণির লোকেরা বস্তিতেই বাস করত তাদের ভারতীয় প্রতিবেশী ও স্বজনদের কাছেই।

মেয়েদের মেলামেশা নিয়ে হিন্দুসমাজের গোঁড়ামির প্রতিফলন ইউরোপিয়ানদের জীবনযাত্রায় নানাভাবে দেখা যেত। একটা মর্মস্পর্শী উদাহরণ উইলিয়াম হিকির ডায়েরিতে পাওয়া যায়। হিকি ১৭৮০-র কাছাকাছি সময়ে কলকাতায় উকিল ও কেতাদুরস্ত পয়সাওয়ালা ইউরোপীয় সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। ডায়েরিতে তাঁর সঙ্গিনীকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘আমার জমাদারনি’ ডাকনামে।

ইন্দো-ইউরোপিয়ান সমাজের পরিধি যত বাড়তে লাগল, কারখানা সমাজের স্বতন্ত্রতা তত কমে আসতে থাকল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বিরাট সংখ্যায় ইন্দো-ইউরোপিয়ান কারিগর, ব্যবসায়ী, সৈন্য কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বের ভারতীয় পাড়ায় বাস করছে। অনেকে ভারতীয় রাজাদের দরবারে বা বাহিনীতে কাজ করছে। তারা দরবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশা করে। দুই দল একই সমাজের অঙ্গ। এদের সন্তানরা অনেক সময়েই সৈন্যবাহিনীতে বা কারিগর হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছে, কেউ কেউ লেখাপড়ার জগতেও, যেমন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা কিড

আশ্চর্যের বিষয়, একই সঙ্গে জাতিভেদ একটা নতুন মাত্রা নেয়। যদিও আগের থেকে অনেক বেশি ইউরোপিয়ান মেয়েরা সাগর পেরিয়ে ভারতে আসছে ‘ন্যাবোব’ বিয়ে করবার আশায়, তখনও প্রধানত ইউরোপিয়ান শাসক সমাজের মাথারাই ইউরোপিয়ান মেয়ে বিয়ে করত। অন্যদিকে সাধারণ অবস্থার ইংরেজ পুরুষদের সঙ্গিনী ছিল ভারতীয় মেয়ে, কিন্তু ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরা। শাসক সম্প্রদায় যত বেশি সঙ্গিনী নির্বাচনের ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গপন্থী হল ততই ইন্দো-ইউরোপিয়ানরা ভারতীয় সমাজের কাছাকাছি আসতে বাধ্য হল— অবশ্যই সে সমাজ এলিট সমাজ নয়, সেখানেও তাদের দরজা বন্ধ। এই দুই দিকের জাতবিচারের মাঝখানে পড়ে ইন্দো-ইউরোপিয়ান সম্প্রদায় দু’দিকেই পতিত হতে বসল। ব্রাহ্মণ আর বানিয়াদের অনুসরণ করে ইউরোপিয়ান শাসক সম্প্রদায় স্থির করল যে স্বজাতির বাইরে বিয়ে করা মহাপাপ। দুটো জিনিস মিশে ইংরেজ পুরুষদের সঙ্গে ভারতীয় মেয়েদের সম্পর্ক হেয় করে দেখার মনোবৃত্তি তৈরি হল। ফলে নানা দিকে কৃতী হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেকটা সময় জুড়ে মিশ্র রক্তের লোকেদের সরকারি চাকরিতে ঢোকার অধিকার দেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি পিটার রব ১৭০০-র শেষ দিকে কলকাতার আর্কিটেক্ট রিচার্ড ব্লেকিন্ডেনের ডায়েরির উপর ভিত্তি করে ইন্দো-ইউরোপিয়ান সমাজ নিয়ে দুটো ভাল বই লিখেছেন। তার একটা ব্লেকিন্ডেন ও সমসাময়িক কয়েক জনের বিবিদের নিয়ে। আমরা জানতে পারি যে দু’-একজন বিরল উত্তর ভারতের মুসলমান ছাড়া বিবিরা সকলেই শহুরে খেটে-খাওয়া জনশ্রেণি থেকে এসেছিলেন। এই কপর্দকহীন প্রায় পেশাদার মেয়েদের সঙ্গে বাস করতে গিয়ে ইউরোপিয়ানদের জীবনযাত্রায় প্রচুর পরিবর্তন আসে। তার কিছু আভাস আমরা ডায়েরি থেকে পাই। কিন্তু ভারতীয় সমাজ সম্বন্ধে প্রায় কোনও দরকারি তথ্যই ডায়েরিতে পাওয়া যায় না, হিন্দু এলিট সমাজ তো দূরের কথা। অথচ ব্যাবসায় হিন্দু এলিটরাই এদের পার্টনার। এই স্ববিরোধের উৎস কোথায়?

ইন্দো-ইউরোপিয়ান সমাজের ইতিহাস লিখেছেন আরও যেসব ঐতিহাসিক— পার্সিভাল স্পিয়ার, পিটার মার্শাল বা সম্প্রতি দূর্বা ঘোষ — সকলেই মনে করেছেন যে ইউরোপ থেকে আমদানি স্বাজাতিকতা ভারতে জাতিভেদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু হিন্দুসমাজের জাতিভেদ ইউরোপীয় স্বাজাতিকতা বা বর্ণবিদ্বেষের থেকে আরও পুরনো আরও বনেদি এবং আরও প্রগাঢ় মনোবৃত্তি। ইউরোপিয়ান সমাজের গঠনের উপর হিন্দু সমাজব্যবস্থার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রভাবের চেহারা শান্ত নিঃশব্দ দৃঢ়তার সঙ্গে ইউরোপিয়ানদের হিন্দু এলিট সমাজের গণ্ডির বাইরে রাখা। এই প্রভাবের সূত্রপাত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শুরু হওয়ার কয়েকশো বছর আগে, যখন প্রথম ইউরোপিয়ানরা এখানে ব্যাবসা করতে আসে। এই উলটো প্রভাব এবং ব্যবসায়িক যুগের সমাজ নিয়ে এখনও কোনও কাজ হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *