৬. যশোড়া – কাঞ্চনপল্লী

৬. যশোড়া – কাঞ্চনপল্লী

যশোড়া গণ্ডগ্রামকে না চেন, শিমুরালি-ইস্টিশানকে নিশ্চয় চিনবে।

এখানে ছিল জগদীশ পণ্ডিত-এর শ্রীপাট। তাঁর প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথদেবের মন্দিরটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। মূর্তিটি হুবহু পুরীর জগন্নাথের অনুসরণে। সাদৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে!

এ সম্বন্ধে যে লোকগাথা আছে তা এবার বলি। বিশ্বাস করা-না-করা তোমাদের অভিরুচি :

জগদীশ পণ্ডিত যখন অশীতিপর বৃদ্ধ, তখন স্নানযাত্রার প্রাক্কালে পুরীধামে যান তীর্থ করতে। নিশ্চয় শুনেছ যে, শ্রীধামের ঐ ত্রিমূর্তির নবকলেবর হয় দ্বাদশ বৎসরের ব্যবধানে দারুময় ব্রহ্ম! পুরাতন মূর্তি কীভাবে বিলীন হয়ে যায় তা নিয়ে নানা মত। কেউ কেউ বলেন তা সৎ-ব্রাহ্মণেরা লোকচক্ষুর অন্তরালে সমুদ্রতীরে দাহ করেন—ঘৃত, মধু, দুগ্ধ, দধি ইত্যাদি সহযোগে, চন্দন কাষ্ঠের বেদী গড়ে। তা সে যাই হোক, মোটকথা দেবতার নবকলেবর হলে সাধারণ মানুষ পূর্বযুগের জগন্নাথ-মূর্তিকে আর চর্মচক্ষুতে দেখতে পায় না।

বৃদ্ধ জগদীশ পণ্ডিত স্নানযাত্রার পূর্বে পুরীধামের প্রধান পাণ্ডার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ করেন—তিনি অনুমতি করলে পূর্ব-প্রজন্মের পরিত্যাজ্য দারুময় ত্রিমূর্তিকে তিনি স্বগ্রামে নিয়ে যাবেন। সেখানে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করবেন।

এটি শাস্ত্রবিরোধী যাচ্‌ঞা। বড়পাণ্ডা কিন্তু সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন না। অদ্ভুত এক শর্ত আরোপ করলেন, আপনি পুরাতনী ত্রিমূর্তিকে স্বগ্রামে নিয়ে যেতে পারেন একটি শর্তে। ত্রিমূর্তির ভিতর জগন্নাথদেবের মূর্তিটি আপনি যদি স্বয়ং পদব্রজে বহন করে নিয়ে যেতে স্বীকৃত হন।

হয়তো প্রধান পাণ্ডার এ এক কৌশল। সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে একটি অবাস্তব শর্ত আরোপ করলেন তিনি। অশীতিপর বৃদ্ধের পক্ষে পদব্রজে সমস্তটা পথ প্রত্যাবর্তনই এক অবাস্তব প্রস্তাব। তদুপরি ঐ জগদ্দল দারুমূর্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া তো নিতান্ত অসম্ভব। সকলেই অবাক হয়ে গেল বৃদ্ধের প্রত্যুত্তরে। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! দারুময় ব্রহ্মকে স্বয়ং বহন করে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনাকে আরও একটি অনুমতি দিতে হবে প্রভু! আমি বৃদ্ধ; পথে যদি আমার জীবনাবসান হয় তাহলে যেখানে আমার মৃত্যু হবে সেখানেই ঐ মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করা হবে। তার ব্যয়ভার আমি বহন করব!

এ শর্তে স্বীকৃত না হওয়ার হেতু নেই!

বৃদ্ধ জগদীশ পণ্ডিত অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন। স্বয়ং ঐ দারুময় ব্রহ্মকে বহন করে উপনীত হলেন স্বগ্রামে। প্রতিষ্ঠা করলেন দেবতাকে। আশ্চর্যের কথা, তারপরও দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন তিনি। আজও—না, আজও বলা উচিত হবে না, আমাদের বাল্যকালেও—প্রতিবৎসর পৌষমাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে যশোড়ায় জগদীশ পণ্ডিতের তিরোভাব উৎসব হত। এ ছাড়া মাঘী পূর্ণিমাতেও গঙ্গাস্নানের যোগ উপলক্ষ্যে বহু তীর্থযাত্রীর হত সমাগম।

শিমুরালীতে যদি যাও জগন্নাথদেবের দোলমঞ্চটিকে দেখে এস।

তার চিহ্ন বোধহয় আজও আছে!

আজকের হিসাবে চব্বিশ পরগণা জেলার সমাপ্তি আর নদীয়া জেলার শুরুতে এই কাঁচড়াপাড়া—প্রাচীন কাঞ্চনপল্লী। যা ছিল কাঞ্চন তা আজ কাঁচকড়াও নয়, একেবারে কাঁচড়া! ঐ যেখানে আজ দৈত্যের মতো রেলওয়ে ইঞ্জিনগুলোকে মেরামত করা হয়, দিবারাত্র গজগজ ফোসফোস করে, ওর নাম সেকালে ছিল বীজপুর! তখনো ওখানে ছিল দৈত্যাকার যন্ত্রচালিত কিছু ইঞ্জিনের মতো কালো মুকো মানুষ—ডাকাত তারা। ছিল এক ডাকাতে-কালী। নরবলির আয়োজন করে তারা ডাকাতি করতে বার হত।

বৈষ্ণবসাহিত্যে এর পরিচয় · সেন শিবানন্দের পাট।

শিবানন্দ ছিলেন চৈতন্যপ্রভুর এক অনুগত ভক্ত। তাঁর ভদ্রাসনে পদধূলি দান করেছিলেন প্রেমের ঠাকুর। সন্ন্যাসগ্রহণের পর শ্রীচৈতন্যদেব যখন নীলাচলের বাসিন্দা তখন রথযাত্রার প্রাক্কালে গৌড়মণ্ডলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে সমবেত হতেন বৈষ্ণব ভক্তবৃন্দ—ঐ শিবানন্দের ভদ্রাসনে। তাঁদের বাসস্থান ও আহারের ব্যবস্থা তো বটেই এমনকি অনেক দুঃস্থ ভক্তকে পাথেয় পর্যন্ত যোগান দিতেন শিবানন্দ। তাঁর তিন পুত্র—চৈতন্যদাস, রামদাস ও পুরীদাস। সর্বকনিষ্ঠ পুরীদাস ওরফে পরমানন্দ সেন ছিলেন পণ্ডিত। সংস্কৃত ভাষায় তিনখানি পুঁথি রচনা করেন : চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক, চৈতন্যচরিতামৃত কাব্য এবং গৌরগণোদ্দেশদীপিকা স্বয়ং শ্রীচৈতন্য তাঁকে উপাধি দান করেছিলেন: কবিকর্ণপুর পরমানন্দ!

সেন শিবানন্দ প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণরায়ের বাঙলা আটচালা মন্দিরটি নয়নাভিরাম। স্থাপত্যশৈলী শান্তিপুরের শ্যামচাঁদ মন্দিরের অনুসরণে—সম্মুখভাগে তিন-খিলান, অশ্বখুরাকৃতি। এই মন্দিরটি যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাতপুত্র রাঘব রায় পুননির্মাণ করে দেন এবং দেবসেবার জন্য একটি নিষ্কর ভূখণ্ড দান করেন। দু-একশ বছরের ভিতর গঙ্গার প্রবাহ পরিবর্তিত হওয়ায় সে মন্দিরটিও গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে যে আট-চালা বাঙলা মন্দিরটি দেখা যায় তার নির্মাণকাল 1785 খ্ৰীষ্টাব্দ। নির্মাণ ব্যয় যৌথভাবে বহন করেন শহর কলকাতার নিমাইচরণ ও গৌরচরণ মল্লিক।

কবি ঈশ্বরগুপ্তের (1812-59) জন্মস্থানও এই কাঞ্চনপল্লী।

আরও একজনের কথা বলি : যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ (1845–1904 )।

‘আর্যদর্শন’ পত্রিকার এই সম্পাদক, গ্যারিবল্ডি-ম্যাটসিনি, জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবন চরিত রচনা করে স্বাদেশিকতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো তিনিও ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাঙলার জাতীয় ভাব উদ্দীপনে বিদ্যাভূষণের প্রভূত দান। তাঁর সম্বন্ধে আর একটি তথ্য—যা প্রায়ই উল্লিখিত হয় না—এখানে লিপিবদ্ধ করে যাই। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথা। যুবক বয়সেই তাঁর প্রথমা পত্নীর মৃত্যু হয়। বাড়ুজ্জে বংশের কুলীন পাত্র–এম. এ. পাশ, ক্যাথিড্রেল মিশন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক, এবং তখন তিনি সরকারী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কন্যাদায়গ্রস্তের দল হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। বিদ্যাভূষণ বেয়াড়া বায়না ধরলেন—বিপত্নীকের সঙ্গে বিবাহ হওয়া উচিত বিগতভর্তার। কোনও মানে হয়? উপার্জনক্ষম পুত্র—পিতা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রখ্যাত ডাব্‌লু. সি. ব্যানার্জি নন) পুত্রকে ত্যাগ করতে পারলেন না, তবে ব্যাজার হলেন। আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করলেন তাঁকে। মহাপণ্ডিত একঘরে হয়ে প্রকাশ্যে বিবাহ করলেন পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিধবা কন্যাকে। গোপনেও কিছু করলেন তিনি—রচনা করেছিলেন কয়েকটি স্বদেশাত্মমূলক গ্রন্থ : প্রাণোচ্ছ্বাস, আত্মোৎসর্গ, কীর্তিমন্দির।

বাঙলার গুপ্ত বিপ্লবীদলের সদস্যদের সেগুলি অবশ্য-পাঠ্য ছিল।

কাঞ্চনপল্লী থেকে আড়াইক্রোশ দূরে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কেন্দ্র : ঘোষপাড়া। আউলেচাঁদের শিষ্য সদ্‌গোপ-বংশীয় রামশরণ পাল এই ঘোষপাড়াকেই তাঁর মূল কেন্দ্র করেন। রামশরণের স্ত্রী হচ্ছেন ‘সতী মা’। পীঠস্থানের অদূরে হিমসাগর দিঘি। সেখানে ডুব দিলে অন্ধও নাকি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।

অদূরেই কুলিয়ার পাট বা অপরাধভঞ্জন। প্রতি বৎসর অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা একাদশী তথিতে এখানে তিন দিন ব্যাপী মেলা হত। উপলক্ষ : ঐ তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেব কুলিয়া রামবাসী বৈষ্ণব-নিন্দক পণ্ডিত দেবানন্দের অপরাধ মার্জনা করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *