০৬.
মেডিকাল কলেজের উলটো দিকে আরপুলি লেন দিয়ে ভিতরে ঢুকে মধু গুপ্ত লেন ধরে এগোলে প্রকাণ্ড সেকেলে বাড়ি। বাড়ি প্রকাণ্ড হলেও শরিকানার ভাগাভাগি আছে। তবে সামনের দিকের বড় একটা অংশই বড়বাবুর দখলে। বাড়ির সামনে বড় একটা দরজা, দরজার দুদিকে চওড়া টানা দুটো রক। বাঁ দিকের রক বড়বাবুর, ডান দিকের রক ছোটবাবুর। বাইরের লোকজনের লিমিট এই রক পর্যন্ত, এর ভিতরে আর বড় কেউ একটা ঢুকবার অনুমতি পায় না। প্রায়ই দেখি, কেউ দেখা করতে এলে বড়বাবু তার রকে বা ছোটবাবু তার রকে এসে দাঁড়ান। দু’ভাইয়ের রং ফরসা টকটকে, বেশি লম্বা না হলেও পেট কাধ বুক-পায়ের গোছা নিয়ে বিশাল চেহারা, পরনে গামছা, খালি গা ও পা। রকে রাজারাজড়ার মতো বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়ান, প্রয়োজন হলে ঘন্টার পর ঘণ্টা তেমনি দাঁড়িয়ে কথা বলেন, কখনও অভ্যাগতকে ভিতর বাড়িতে নেওয়ার নাম করেন না। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, গামছা পরে আছেন কেন, তা হলে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় সকালে বা বিকেলে দু’ ভাই-ই একই উত্তর দেন, এই তো, এবারে গা ধুতে যাব।
আসলে গা ধুতে যাওয়ার কথাটা স্রেফ মামদোবাজি। আমি জানি দু’ ভাই-ই বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে সবসময়ে গামছা পড়ে থাকেন। অবশ্য তাদের গামছার প্রশংসা না করাটা অন্যায় হবে। তারা যে গামছা পরে থাকেন তা বাজারের সেরা জিনিস।
বড় ভাই গিরিবাবু এক সময়ে দারুণ ঘুড়ি ওড়াতে পারতেন, এখন পায়রা পোষেন, পাশা খেলেন। চেহারার মধ্যে একটা সব পেয়েছির তৃপ্ত ভাব। আমার সঙ্গে দেখা হলেই কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখাই যে জীবনের সব সার্থকতার মূলে তা বোঝাতে থাকেন।
এ বাড়িতে আমিও বহু বার রক থেকে ফিরে গেছি। আজকাল অন্দরে ঢুকতে বাধা হয় না। বিয়ে-পৈতে-পাল-পার্বণ বা ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য হলেও মাসি আমাকে নেমন্তন্ন জুটিয়ে দেয় এ বাড়িতে। সেই থেকে ভিতর বাড়িতে ঢোকার ভিসা পাওয়া গেছে। মিথ্যে বলব না, বড়বাবু, ছোটবাবু বা এ বাড়ির অন্যসব পুরুষদের কিছু বংশগত বদ দোষ আছে। কিন্তু এ বাড়িতে যখন নেমন্তন্ন করে কাউকে খাওয়ানো হয় তখন আয়োজন দেখে ভ্যাবাচ্যাকা লেগে যায়। ছ’ রকমের ভাজা, শুকতুনি, দু’রকম ডাল, তিন ধরনের মাছ, মাংস, ডিম, চাটনি, দই মিষ্টির সে এক দিশেহারা ব্যাপার। কিন্তু অসুবিধে হল, আমি যখন এই প্রলয়ংকর ভোজের ধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলেছি তখন আমার পাশে বসেই অনর্গল কথা বলতে বলতে বড়বাবু এবং নিস্তব্ধ মুখে বড়বাবুর ছানাপোনারা অতি সাধারণ ডাল তরকারি মাছের ঝোল দিয়ে সাদামাটা খাওয়া সেরে মাথা নিচু করে বসে আছে। এ বাড়ির এই নিয়ম। বাইরের লোকের জন্য এক আয়োজন, বাড়ির লোকদের জন্য আর-এক। মাসি আমাকে একবার কানে কানে সাবধান করে দিয়েছিল, খেতে বসে এ বাড়িতে কিন্তু কোনও পদ আর-এক বার চাসনে। ওদের বাড়তি জিনিস থাকে না।
যা যা থাকলে মেয়েদের সুন্দর বলা যায় তার যদি একটা বিশ দফা ফর্দ করা হয় তবে তার মধ্যে ষোলো দফাই বড়বাবুর মেয়ে কেতকীর সঙ্গে মিলে যাবে। গায়ের রং বড়বাবুর মতোই ফরসা, চেহারা লম্বাটে গড়নের, মুখখানা এত মিষ্টি যে মনে হয় পিপড়ে ধরবে। ভারী একটা সরল মুগ্ধতার হাবভাব আছে তার মধ্যে। যার দিকে চায়, যেদিকে চায় তাকেই বা সেটাকেই যেন ভালবেসে ফেলে। এই বিভ্রান্তকারী দৃষ্টি যার ওপর পড়ে সেই ভুল করে ভেবে ফেলতে পারে যে, কেতকী তার প্রেমে পড়েছে। গয়লা শিউপূজন থেকে শুরু করে পাড়ার ছেলেছোকরা এবং এমনকী আমি পর্যন্ত ভাবি। কেতকীর কটাক্ষের প্রভাব ক্যানসারের মতো সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। ট্রেনের কামবায় বা বাসের জানালায় যারা একঝুকে তার চোখে চোখ রাখতে পেরেছে তাদের কেউই বোধহয় আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। এইরকম হিসেব ধরলে সারা কলকাতায় এবং গোটা পশ্চিমবঙ্গে কেতকীর প্রেমিক অগুনতি। কেতকীর নামে ডাকে এবং হাতে রোজ যত চিঠি আসে তার হিসেব এবং ফাইল রাখতে একটা পুরো সময়ের কেরানি দরকার।
বড়বাবু কেরানি রাখেননি, তবে কেতকীর ভাইদের অবসর সময়ের একমাত্র কাজ হল চিঠিধরা। দরজার ফাঁকে, জানালার ফোকরে, ডাকবাক্সে, বইয়ের ভাঁজে, ঘরের জলনিকাশী ফুটোয়, ভেন্টিলেটারে সর্বদাই তারা চিঠি খুঁজছে এবং পাচ্ছে। এমনকী ছাদে ঢিল বাঁধা চিঠিও প্রতি দিনই বেশ কিছু এসে পড়ে। প্রেমিকদের প্রাবল্য দেখে বড়বাবু একসময়ে ঠিক করেছিলেন কেতকীর লেখাপড়া বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু কেতকী পড়াশুনোয় সাংঘাতিক ভাল হওয়ার ফলে সেটা আর হয়নি। কেতকী এখন এম এ পাশ করে মঙ্গলকাব্যে নারীর সাজ নিয়ে রিসার্চ করছে। দুটো গুমসো গুমসো ভাই সঙ্গে করে ইউনিভার্সিটি বা লাইব্রেরিতে নিয়ে যায় নিয়ে আসে।
আজ ছোটবাবুর রকে ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। নতুন রাঙা গামছায় তার চেহারার বড় খোলতাই হয়েছে। বাঁ হাতে তেলের শিশি থেকে ফোটা মেপে ডান হাতের তেলোয় তেল নিয়ে চাদিতে পালিশওলা ছোকরা যেমন বেগে বুরুশ চালায় তেমনি ঘষছেন। এ বাড়ির পুরুষরা চেঁচিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারেন না, আমাকে দেখেও ছোটবাবু বিকট চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই যা উপলচন্দোরকে দেখছি যেন! অ্যাঁ!
ছোটবাবুর পায়ের ডিম দেখে অবাক মানতে হয়। গোদ নেই, তবু পা কী করে অত মোটা হয় তা গবেষণার বিষয়। ছোটবাবুও আমার চোখ দেখে ব্যাপারটা ধরে ফেলে তেমনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, এ আর কী দেখছ ভায়া, সে বয়সে দেখলে ভিরমি খেতে। এমন মাসল ড্যানসিং করেছি যে জজ ব্যারিস্টার পর্যন্ত দেখতে এয়েছে।
অমায়িক হেসে বড়বাবুর অংশে ঢুকতে ঢুকতে শুনি, ভিতরে বড়বাবু চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছেন, অ্যাঁ, ডিম এনেচ্যা! ডিমের গুষ্টির তুষ্টি করেছি। যা ফেলে দিগে যা। কাল থেকে পোনা মাছের টক খাব বলে পই পই করে বলে রাখলুম, গুষ্টির মাথা গুচ্ছের ডিম এনে দাঁত বের করছিস কোন আক্কেলে রা!
দালানে গিয়ে দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায়, এ বাড়িতে এখনও পুরুষদের প্রাধান্য। মেয়েদের দাপট অতটা নেই। বড়বাবুর এত চেঁচামেচিতে বড়গিন্নির গলার কিছু সরু শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল মাত্র।
অফিসের সময় হয়েছে, বড়বাবু খুব দাপুটে পায়ে দালান কাপিয়ে কলঘরে যাওয়ার সময়ে আমাকে দেখে যাওয়া না-থামিয়েই বলতে বলতে গেলেন, উপল-ভাগ্নে যে! খবর সব ভাল তো! সাত-সকালে দেখো গে যাও গোবিন্দ গুচ্ছের অযাত্রার ডিম এনে ফেলেছে। পাখি-পক্ষীর ডিম খেয়ে মানুষ বাঁচে, বলো? বাঙালির শরীরে মাছ ছাড়া রক্ত হয়, শুনেছ? বলেছি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতে।
কলঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তবু ভিতর থেকে জলের শব্দের সঙ্গে চেঁচানি আসতে লাগল, পয়সা মেরেছে। হিসেব নিয়ে দেখো না। আজকাল বিড়িটিড়ি ফুঁকছে তো।
রান্নাঘরের দিক থেকে বড়গিন্নির স্বর প্রবল হল, ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় করতে হয় ছেলেকে। ডিম-ডিম করে দিনরাত পাগল কবে খেলে! যা গিয়ে এক্ষুনি ফেরত দিয়ে আয়।
কলঘর থেকে বড়কর্তা তখনও চেঁচাচ্ছেন, আরে, আমি বলেছি তো, ওর পকেট-টকেট ঝেড়ে দেখো গে। লায়েক হয়েছে, পয়সা চিনেছে। দু-চার পয়সা এদিক-ওদিক বাজার থেকে আমরাও বয়সকালে করেছি। তা বলে পোনা মাছের বদলে বাপের জন্মে ডিম আনিনি বাবা। দাও ওর মুখে কাঁচা ডিম ঘষে।
রান্নাঘর থেকে গিন্নি গলার রগ ছিড়ে এবার চেঁচান, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা ফেরত দিতে না পারবি তো। তেঁতুল গুলে, ফোড়ন সাজিয়ে বসে আছি, মাছ এলে রান্না হবে, উনি খেয়ে আপিস যাবেন, বেলা সাড়ে ন’টায় থলি দুলিয়ে বাবু এলেন। ঝ্যাঁটা, ঝ্যাঁটা—
তাড়া খেয়ে বড়বাবুর গুমসো মতো বড় ছেলে গোবিন্দ দালানে বেরিয়ে এল। আকাট মুখর মতো রাঙামুলো চেহারা। পাজামা আর নীল শার্ট পরা ছেলেটা ডিম ফেরত দিতে যাওয়ার সময়ে আমাকে দেখে একটু লজ্জিত হয়ে ভ্যাবলা মতো হেসে চলে গেল। চেহারার মধ্যে বংশের ছাপ পড়ে গেছে। বড়বাবুর চার ছেলের মধ্যে কেউই পকেটে কখনও পয়সা নিয়ে বেরোয় না, নিতান্ত বাস বা ট্রামের ভাড়াটা ছাড়া। রাস্তায় চটি ছিড়লে সারানোর পয়সা পর্যন্ত থাকে না পকেটে। কী সাংঘাতিক! বাড়তি পয়সা থাকলেই খরচ হওয়ার ভয়। পৌষপার্বণের দিন পিঠে তৈরি হয় বলে এ বাড়িতে সেদিন রান্না বন্ধ। সবাই পিঠে খেয়ে থাকে। আমার বাবার বাড়িওয়ালা বাবাকে হরতালের আগের দিন দু’বার বাজার করতে দেখে খেপে গিয়েছিলেন। এদের দেখলেই সেই বুড়ো বাড়িওলা ভারী খুশি হতেন।
এত চেঁচামেচির মধ্যে মাসির কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। পাওয়ার কথাও নয়। আমার বোকাসোকা, ভালমানুষ কানা মাসি সবসময়ে তার আশপাশের লোকজনকে বড় বেশি চালাক-চতুর বলে মনে করে। কী জানি বাবা, আমি যখনই কথা কই তখনই কেমন বোকা-বোকা কথা বেরিয়ে পড়ে প্রায়ই এই বলে দুঃখ করত মাসি। এ বাড়িতে আসা ইস্তক বোেকা কথা বলে ফেলার ভয়ে মাসির বাক্য প্রায় হরে গেছে। যাও-বা বলে তাও ফিসফিসের মতো আস্তে করে। এ বাড়ির ঝি-চাকরকেও খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে মাসি। কোনও ঝগড়া কাজিয়া চেঁচামেচির মধ্যে নাক গলায় না। কর্তা যা বোঝায় তা-ও বোঝে, আবার গিন্নি যা বোঝায় তা-ও বোঝে। যা কিছু বলার কথা থাকে তা আমাকে বলার জন্য পেটে জমিয়ে রাখে মাসি।
বকাবকি এখনও শেষ হয়নি। ভিতর-বাড়ির দিক থেকে একটা গদি-আঁটা মোড়া এক হাতে, অন্য হাতে খবরের কাগজ নিয়ে বড়গিন্নি উঠে আসছিলেন বকতে বকতে, মতিচ্ছন্ন, মতিচ্ছন্ন! বাজারে যাওয়ার সময়ে পই পই করে বললুম মাছের কথা, কান দিয়ে শুনল।
কলঘর থেকে বড়কর্তা বললেন, মাছ কান দিয়ে মাথায় ঢুকেই ডিম হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বের করে দাও আজই জুতোপটা করে।
মাসির কাছে যাতায়াত করতে করতে আমি এ বাড়ির পুরনো লোক হয়ে গেছি। তাই বড়গিন্নি আমাকে দেখে লজ্জা পেলেন না, খবরের কাগজ ধরা হাতে ঘোমটাটা একটু টেনে বললেন, ডিম নিয়ে কী কাণ্ড শুনছ তো! আমার ছেলেরা সব ওইরকম। যাও, ঠাকুরঝি রান্নাঘরে আছে।
মাসি রান্নাঘরেই চৌপর দিন পড়ে থাকে, আমি জানি। ইচ্ছে করেই থাকে। রান্নাঘরের বাইরের দুনিয়াটায় মাসির বড় অস্বস্তি।
মাসি আলু কুচিয়ে নুন মাখা শেষ করেছে, কড়াইতে তেল হয়ে এল। ছাড়ার আগে তেলের ফেনার শেষ বুদবুদটার মিলিয়ে যাওয়া একটা চোখে সাবধানে দেখছিল। মুঠোয় ধরা জল নিংড়ানো ঝিরিঝিরি করে কুচোনো আলু! আজ মাছের বদলে বড়বাবু এই আলুভাজা খেয়েই যাবে।
মাসি বলে ডাকতেই মাসি ঠান্ডা সুস্থির মুখখানা বোল! কানা চোখটার কোলে জল জমে আছে। একগুচ্ছ উঁচু নোংরা দাত ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে থাকে সবসময়ে, ওই দাঁতগুলোর জন্য কখনও দুই ঠোঁট এক হয় না। দু’গালের হনু জেগে আছে। ময়লা থানের ঘোমটায় আধো-ঢাকা মাথায় অনেকগুলো পাকাচুল ভেসে আছে। মাসি দেখতে একদম ভাল না। দাঁতগুলোর জন্যই আরও কুচ্ছিত দেখায়। বাবার দু’-একজন শুভানুধ্যায়ি বা বন্ধুবান্ধব বাবাকে বলত, বাপু হে, দ্বিতীয় বিয়েটা আর-একটু দেখেশুনে করলে পারতে! বাবা জবাব দিত, না হে, বউ সুন্দর-টুন্দর হলে আমি হয়তো বা বউ-খ্যাপা হয়ে যেতাম, তা হলে আমার উপলের কী হত! উপলকে মানুষ করার জন্যই তো দ্বিতীয় বিয়েতে বসা।
কানা মাসি সুন্দর নয় বলে আমার তো কিছু খারাপ লাগে না।
তেল থেকে ধোঁয়া উঠতে, মাসি কুচোনো আলু ছাড়তে ভুলে গিয়ে দু’গাল ভরতি করে হেসে বলল, দিনরাত ভাবছি। ও উপল, দু’বেলা ভরপেট খাস তো।
খাই। আমার খাওয়ার চিন্তা কী?
পিঁড়ি পেতে বোস।
বসলাম। বললাম, মাসি তেল পুড়ে যাচ্ছে, আলু ছাড়ো।
তেলে পড়ে আলু চিড়বিড়িয়ে উঠল। মাসি এক চোখের দৃষ্টিতে গোরু যেমন বাছুরকে চাটে তেমনি চেটে নিল আমাকে। বলল, একটা মাত্র চোখ, তা সে চোখে ছানি আসছে।
উদাস হয়ে বললাম, আসবেই। বয়স হচ্ছে।
কলঘর থেকে বড়বাবু মাটি কাঁপিয়ে বেরোলেন। শব্দ হল। মাছের শোক এখনও ভুলতে পারেননি, চেঁচাচ্ছেন সমানে, বললুম তো, বিড়ি-টিড়ি খেতে শিখেছে, খোঁজ নিয়ে দেখোগে যাও। কত করে ডিমের জোড়া এনেছে বলল?
বলতে বলতে বড়বাবু পুরনো সিঁড়িতে ভূমিকম্প তুলে ওপরতলায় উঠে গেলেন।
মাসি একটা সোনার মতো রঙের ঝকঝক করে মাজা কাঁসার থালায় ভাত বাড়তে লাগল। এমন যত্নে ভাত বাড়তে বহুকাল কাউকে দেখিনি। নিখুঁত একটা নৈবেদ্যের মতো সাজানো ভাতের ঢিবি, একটা ভাতও আলগা হয়ে পড়ল না। ঢিবিটার ওপর ছোট একটা মধুপর্কের মতো বাটিতে একরত্তি ঘি। নুনটুকু পর্যন্ত কত যত্নে পাতের পাশটিতে সাজিয়ে দিল। দেখলে খেতে ইচ্ছে করে।
মাসি বলল, আজ মাছ নেই বলে ঘিয়ের ব্যবস্থা, নইলে ঘি রোজ দেওয়ার কথা নয়। গোবিন্দটা বড্ড বকুনি খেল আজ।
মাসির রান্নার কোনও তুলনা হয় না। আমাদের মতো গরিব-গুর্বোর বাড়িতে কীই বা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল! তবু মাসি জলকে তেল বলে চালিয়ে, কি কাঠখোলায় ভাজা সম্বর দিয়ে এমন সব রান্না করত যে আমরা পাত চেটেপুটে উঠতাম। সেই রান্নার ধাঁচ আজও আছে। মাসি একটু নিরামিষ বাটিচচ্চড়ি যখন বড়বাবুর পাতে সাজিয়ে দিচ্ছিল তখন পুরনো আভিজাত্যের গন্ধ নাকে ঠেকল এসে।
বললাম, মাসি, তোমাকে এরা খেতে-টেতে দেয়?
মাসি চাপা গলায় বলল, এ সব অত জোরে বলিস না। কে শুনতে পাবে।
বলে একটু চুপ করে থেকে বলল, দেয়। আবার একটু চুপ করে আলু ভাজা ওলটাল মাসি, খানিক নেড়ে চেড়ে তেল থেকে হলুদ, মুড়মুড়ে ভাজা ছেঁকে তুলে বড়বাবুর পাতের বাহার বাড়িয়ে বলল, তোকে দেয়?
দেবে না কেন? তা ছাড়া পুরুষ ছেলের আবার খাওয়ার ভাবনা। তোমার খাটুনি কেমন?
মাসি রেখে-ঢেকে বলল, সে আর বেশি কী? দু’বেলা মোটে তো রান্না। চোখটাই আজকাল বড় অসুবিধে করে। সকালে কী খেয়েছিস?
চা আর বিস্কুট। তুমি?
বড় অফিস গেলে এইবার খাব। বোস। তোর জন্য একটা জিনিস রেখেছি। কতকাল আসিস না বল তো! মাঝরাতে উঠে বুক কেমন করে। কাঁদি কত।
ওপর থেকে বড়গিন্নি ডাক দিল, ঠাকুরঝি ভাত দিয়ে যাও।
মাসি এক হাতে থালা, অন্য হাতে ডালের বাটি নিয়ে উঠে গেল। ফাঁকা রান্নাঘরে বসে নিজেকে খুব খারাপ লাগল। আমার কত কিছু হওয়ার কথা ছিল! তার একটা কিছু হলে মাসি কি এ বাড়িতে রেঁধে খায়? একটু বাদে মাসি ফিরে এসে বলল, ওদের ফাইফরমাশ খাটিস নাকি?
খাটি।
খাটিস। না খাটলে ভালমতো খেতে দেবে না। বড়কে বলে রেখেছি ওর অফিসে তোকে একটা কাজ দিতে।
বড়বাবু আমাকে দেবে কেন? তার বড় ছেলেকে ঢোকাবে বরং।
তোকেও দেবে। বি কম পাশ চাট্টিখানি কথা নাকি! বড়র একটা ছেলেরও অত বিদ্যা আছে? তা ছাড়া তুই কত কী জানিস! গান, আঁকা, পাট করা।
মাসি পুরনো একটা কৌটো খুলে দু’-তিনটে পাউরুটির টুকরো বের করে আমাকে দিয়ে বলল,খা।
মাসির এই এক রোগ, কোনও কিছু ফেলবে না। আমাদের বাড়িতে লাউ বা আলুর খোসা পর্যন্ত ফেলত না, চচ্চড়ি বা ভাজা করে ফেলত। এমনকী পেঁপের খোসা পর্যন্ত রসুন-টসুন দিয়ে বেটে ঠিক একটা ব্যঞ্জন তৈরি করে ফেলত।
পাউরুটির টুকরোগুলো বিস্কুটের মতো। কটকটে শক্ত।
উনুনের ধারে রেখে রেখে করেছি। ভাল না?
ভালই। খেতে খেতে বলি, পয়সাকড়ি দেয় কিছু?
না। পয়সা দিয়ে হবেই বা কী? এক মাঝে মাঝে তোকে একটু জামা-টামা দিতে ইচ্ছে করে। কেমন এক ছোঁটলোকি পোশাক পরে বেড়াস। গোবিন্দর কেমন সব জামাকাপড়। কিন্তু কাজ-টাজ হয় না কেন তোর বল তো! তা হলে তোর কাছে থেকে দু’বেলা দুটো রেঁধে খাওয়াতাম।
ক্ষণার দেওয়া বাজারের পয়সা থেকে বা সারা বাড়ি আঁতিপাঁতি খুঁজে যা পয়সাকড়ি জমিয়েছি তা সবসুদ্ধ গোটা ত্রিশ টাকা হয়েছে। সেগুলো আনার সময় পাইনি আজ। সুবিনয়ের দেওয়া পাঁচটা টাকার যা অবশিষ্ট আছে তা থেকে দুটি টাকা পকেট থেকে বের করে মাসিকে দিয়ে বলি, রেখে দাও। কিছু খেতে-টেতে ইচ্ছে করলে কিনে খেয়ো।
কানা চোখে জল পড়ছিলই, এবার ভাল চোখ দিয়েও গড়াতে লাগল।
ঠাকুরঝি, ভাত আনো। বড়গিন্নি সিঁড়ির ওপর থেকে বলে।
যাই।–বলে মাসি বাটি-টাটি নিয়ে উঠে গেল।
রান্নাঘরটা ঝকঝক করছে পরিষ্কার। কোথাও একটু ঝুল কালি নেই, মেঝেয় গুচ্ছের জল পড়ে নেই, খাবার আটকা অবস্থায় রাখা নয়। মাসি এ সব কাজে পি-এইচ ডি।
মাসি খবরের কাগজে মোড়া একটা মুগার থান হাতে ফিরে এসে বলল, এটা দিয়ে দুটো জামা করিয়ে নিস।
হাতে নিয়ে দেখি, পুরনো হলেও আসল মুগার জিনিস। এখানে সেখানে কয়েকটা ছোপ ছোপ জলের দাগ বাদ দিলে এখনও ঝকমক করছে। বললাম, কোথায় পেলে?
বড়র মা মরে গেল তা বছর দুই হবে। তার সব বাক্স-প্যাটরা ঘেঁটে এই সেদিন পুরনো কাপড়-চোপড় যা বেরিয়েছিল তার থেকে বড়গিন্নি এইটে আমাকে দিয়েছে। তখনই ভেবে রেখেছি, তুই এলে জামা করতে দেব। ভাল দরজিকে দিয়ে বানাস। ভাল না জিনিসটা?
হুঁ।
কেতকীর সঙ্গে খুব ঝগড়া হচ্ছে বাড়ির সবার।
কেন?
কেন আর! মেয়েটা বড় ভাল, কিন্তু ওকে ছোঁড়ারা বড় যন্ত্রণা করে। ওর দোষ কী?
আমি চুপ করে থাকি। কেতকীর ব্যাপারে মাসির একটা দুরাশা আছে। মাসি চায়, কেতকীর সঙ্গে আমার বিয়ে হোক।
বললাম, মাসি, কেতকীকে নিয়ে অত ভেবো না। তাকে নিয়ে ভাববার অনেক লোক আছে।
মাসি দমের আলু সেদ্ধ করে খোসা ছাড়াচ্ছিল। বলল, কাকে নিয়ে না-ভেবে পারি বল। আপনা থেকেই সব ভাবনা আসে। এই যে গোবিন্দটা আজ বকুনি খেল সেই বসে বসে সারা দিনমান ভাবব। বড্ড গোবেচারা ছেলে। ডিমের নামে পাগল। কত দিন লুকিয়ে-চুরিয়ে আনে, বলে, ভেজে দাও। আমিও দিই।
মনটা একটু খচখচ করে। একদিন ছিল, যখন মাসির গোটা বুকখানা জুড়ে আমিই ছিলাম। এখন আবার সেই জায়গায় অন্য লোকজন একটু-আধটু ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়ছে। দোষ নেই, আমি মাসির বল্গাছাড়া ছেলে, এক বুক মায়া নিয়ে মাসিরই বা একা পড়ে থাকতে কেমন লাগে। মায়া এমনিই, থাকতে থাকতে দেখতে দেখতে একজন না একজনের ওপর পড়ে যায়।
বললাম, কেতকীকে নিয়ে তুমি আর ভেবো না মাসি, আমার গতিক তো দেখছ।
মাসি একটা চোখে ছানি সত্ত্বেও বেশ খর করে তাকিয়ে বলল, হালগতিক খারাপটা কী? বরাবরই তুই একটু কুঁড়ে বলে, নইলে তোরটা খেয়ে লোকে ফুরোতে পারত না। মা যেমন ছেলে চেনে তেমন আর কে চিনবে রে? ও সব বলিস না। বোস একটু, দমটা কষাই, দু’খানা রুটি দিয়ে খেয়ে যা। না কি ভাত খাবি দুটো?
না, না। ঝামেলায় যেয়ো না। পাঁচটা কথা উঠে পড়তে পারে।
মাসি একটা মাত্র ছানিপড়া চোখ সার্চলাইটের মতো আমার ওপর ফেলল। স্টিমারের বাতি যেমন তীরভূমির অন্ধকার থেকে খানাখন্দ, গাছপালা ভাসিয়ে তোলে, মাসির চোখ তেমনি আমার ভিতরকার খিদে-টিদে, জ্বালা-যন্ত্রণা সব দেখে নিল।
বেশি কথার মানুষ নয়, আলুর দম চাপিয়ে ঝকঝকে একটা কাঁসার থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, লোকে তোকে সোনা হেন মুখ করে খেতে দেবে, তেমন কপাল করেছিস নাকি? যে বাড়িতে থাকিস তাবাও না জানি কত গালমন্দ শাপ-শাপান্ত করে তবে খেতে দেয়।
আমার খিদেটা কোনও সময়েই তেমন তৃপ্তি করে মেটে না। খুব তৃপ্তি করে খেলে পেটে যে একটা চমৎকার যুদ্ধবিরতির অনুভূতি হয়, তা আজকাল টের পাই না। সব সময়েই একটা খিদের ভাব থাকে, সেটা কখনও বাড়ে, কখনও কমে। কয়েক দিন আগে এক বিকেলে ক্ষণা সবাইকে আনারস কেটে দিয়েছিল। আমাকে কিছু কম, অন্যদের কিছু বেশি। সুবিনয় আনারস চিবিয়ে ছিবড়ে ফেলছিল। দেখলাম, ক্ষণাও ছিবড়ে ফেলে, সুবিনয়ের মাও। কিন্তু আমার আর ছিবড়ে হয় না। যত বার মুখে দিয়ে চিবোই, তত বার শেষ পর্যন্ত গিলে ফেলি। পাছে ওরা লোভী ভাবে, সেই ভয়ে একবার-দু’বার অতি কষ্টে একটু-আধটু ছিবড়ে ফেলেছি বটে, কিন্তু আগাগোড়া ছিবড়ে ফেলার ব্যাপারটাকেই আমার খুব অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। আমার তো আজকাল আখ খেলেও ছিবড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না।
মাসি ভাতের থালাটা রান্নাঘরের কোণের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, খেতে থাক। দমটা হয়ে এল, ঘি গরম মশলা দিয়ে নামিয়ে ফেলব এবার। পেট ভরে খা, ভয়ের কিছু নেই।
পেট ভরে খা এই কথাটা বহুকাল কেউ বলেনি আমাকে। আমার দুনিয়া থেকে কথাটা একেবারে লোপাট হয়ে গেছে। তাই ভাবি, শুধু এক থালা ভাতের জন্য নয়, ওই কথাটুকু শুনবার জন্যই বুঝি মাসির কাছে মাঝে মাঝে এই আসা আমার।
ভাতের থালাটা নিয়ে আবডালে সরে বসে খেতে খেতে বলি, মাসি, এর জন্য তোমাকে না আবার কথা শুনতে হয়।
মাসি আলুর দমের ঢাকনা খুলে চার দিক গন্ধে লন্ডভন্ড করে দিয়ে বলল, অত কিটির কিটির করিস না তো বাপঠাকুর। সারাদিন এ বাড়ির জন্য গতরপাত করছি, তাও যদি আমার ছেলে এখান থেকে শুধু মুখে ফিরে যায় তো এর চেয়ে ফুটপাথে গিয়ে থাকা ভাল।
মাসির এই তেজ দেখে অবাক হই। আগে মাসির এত তেজ ছিল না। এ বাড়িতে বেগার খেটে খেটে কি মাসির একটা মরিয়া ভাব এসেছে নাকি!
জানালার শিকের ফাঁকে একটা বেড়াল লাফ দিয়ে উঠে এসে পরিষ্কার গলায় ডাকল, মা।
মাসি তার দিকে চেয়ে বলল, সারাটা সকাল কোন মুলুকে ছিলে? এখন হাত জোড়া, বসে থাকো ওইখানে। খাবেই বা কী, আজ মাছ-টাছের বালাই নেই।
জানালার বাইরে একটা কাক হুতুম করে এসে বসল, একটা চোখে মাসিকে দেখে খুব মেজাজে বলল, খা?
মাসি তাকেও বলল, মুখপোড়া কোথাকার! যখন-তখন তোমাদের আসবার সময় হয়! যা, এখন ঘুরে-টুরে আয়।
বলতে বলতে মাসি বেড়ালকে এক খাবলা দুধে-ভাতে মেখে দিল, জানালার বাইরে কাকটাকে দু’ টুকরো বাসি রুটি দিয়ে বিদেয় করল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম, এইসব কাক বেড়াল সেই আমাদেরগুলোই নাকি! মাসির গন্ধে গন্ধে এসে এখানেও জুটেছে।
বললাম, মাসি, সারাটা জীবন তোমার পুষ্যিরা আর তোমাকে ছাড়ল না। কাক, কুকুর, বেড়াল, আমি।
মাসি বলল, মুখ্যু।
কে?
তুই।
এই যে বলে বেড়াও, আমি বি কম পাশ করা মস্ত লায়েক!
তা হলেও মুখ্যু। যে নিজেকে কাক কুকুরের সমান ভাবে, সে মুখ্যু ছাড়া কী?
তাই তো হয়ে যাচ্ছি মাসি দিনকে দিন।
বালাই ষাট। একদিন দেখিস, তোরটা কত লোকে খাবে।
আলুর দম দিয়ে মাখা ভাত মুখে দিয়ে দুনিয়া ভুল হয়ে গেল। আমি কোথায় আছি, আমি কে, এ সব জরুরি ব্যাপার পর্যন্ত মনে পড়ছে না। পেটের ভিতর এক অপরিসীম প্রশান্তি নেমে যাচ্ছে। মনে হয়, আমার হৃদয়ের কোনও সমস্যা নেই, মস্তিষ্কের কোনও চাহিদা নেই, আমার কেবল আছে এক অসম্ভব খিদে।
সেই মুহ্যমান অবস্থা থেকে যখন বাস্তবতায় জেগে উঠি, পৃথিবীটা তখন নতুন রকম লাগে। একটা কুয়াশার মতো আবছায়ার ভিতর থেকে রান্নাঘরটা যখন আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল তখন দেখি, দরজার চৌখুপিতে সাংঘাতিক ঝলমলে রঙে একটা মেয়ের ছবি কে এঁকে রেখেছে। অবাক হয়ে মেয়েটা আমাকে দেখছে। আমিও অবাক হয়ে তাকে দেখি।
মেয়েটা বলল, উপলদা না?
কেতকীকে দেখে মনে হল, সে খুব হালে খোলস ছেড়েছে। কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে তাকে। রোগা, বিষন্ন। সেই ভালবাসার চোখও যেন আর নেই।
লজ্জা পেয়ে বলি, এই দেখোনা, মাসি জোর করে খাওয়াল।
কেতকী একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, আপনার খুব খিদে পেয়েছিল। এমনভাবে খাচ্ছিলেন।
মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো বলি, হ্যাঁ, আমার খুব খিদে পায়।
আমার পায় না।
এই বলে কেতকী তার স্নান করা ভেজা এলোচুল বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এনে আঙুলে জট ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, খাওয়া জিনিসটাই এত বাজে আর বিচ্ছিরি! আমার একদম খেতে ইচ্ছে করে না। লোকে যে কী করে খায়!
মাসি জড়সড় হয়ে বসে ছিল। বেরিয়ে থাকা দাঁতের ওপর দুটো মাছি বসে একটু মারপিট করে উড়ে গেল। মাসি টের পেল না।
কেতকী পিছনে হেলে আবার তার চুলের গোছ পিঠে ফেলে দিয়ে বলল, পিসি খুব ভাল রাঁধে, কিন্তু তবু আমার খেতে ইচ্ছে করে না।
এই বলে কেতকী চলে গেল।
মাসি অকারণে বলল, বড় ভাল মেয়েটা। খাওয়া-টাওয়া খুব কম। কোনও বায়নাক্কা নেই।
আমি বললাম, হু, বেশ ভাল।
পড়াশুনোতেও খুব মাথা।
হু।
কেবল ছোঁড়াগুলো জ্বালায়, তার ও কী করবে! ও কারও দিকে ফিরেও দেখে না। তবু সেদিন বড়গিন্নি ওকে কী মার মারলে! তারপর মেয়ে তিন দিন খায়নি।
অবাক হয়ে বলি, অত বড় মেয়েকে মারল কী গো?
তাও কী মার বাবা! একবার ছড়ি দিয়ে, একবার জুতো দিয়ে, শেষমেষ মেঝেয় মাথা ঠুকে ঠুকে উত্তম কুস্তম মার। সে মার দেখে আমার বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ আর শরীরে কাঁপুনি উঠে গেল।
হয়েছিল কী?
ওই গলির মোড়ের লাল বাড়িটায় একটা গুন্ডা ছেলে থাকে। তার বড় বাড় হয়েছে। রাস্তায়-ঘাটে যখন তখন কেতকীকে জ্বালাতন করে। তার সঙ্গে আবার ছোটকর্তার সাট আছে। কাকা হয়ে ভাইঝিকে হেনস্থা করার যে কী রুচি বাবা। সেই ছোটকর্তার লাই পেয়ে ছোঁড়াটার আরও সাহস বেড়েছে। এই তো সেদিন কেতকী কলেজ থেকে ফিরছে সন্ধেবেলা। ছোঁড়াটা মোড়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, কেতকী যেই এসেছে অমনি দু-তিনজন মিলে তাকে ধরেছে ট্যাক্সিতে তুলবে বলে। চেঁচামেচি, রই-রই কাণ্ড। শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি ভাগ্যে! সেইজন্য নির্দোষ মেয়েটাকে ধরে এই মার কি সেই মার।
পুলিশে ধরিয়ে দিল না কেন ছেলেটাকে?
কে দেবে বাবা! সে ছেলের ভয়ে নাকি সবাই থরহরি। বড়কর্তা খানিক চেঁচামেচি করল রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তারপর সব চুপচাপ। মার খেয়ে কেতকী আমাকে ধরে সে কী কান্না। কেবল বলে, বাবাকে বলো আমার বিয়ে দিয়ে দিক, আমি আর এ সব যন্ত্রণা সইতে পারছি না।
উৎসুক হয়ে বলি, কাকে বিয়ে করতে চায় কিছু বলল।
না, তোর যদি একটা কিছু হত, একটু যদি মানুষের মতো হতি! বড় ভাল ছিল মেয়েটা। একদিন ঠিক ষণ্ডাগুণ্ডায় টেনে নিয়ে যাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ি।