প্রথম ভাগ
দ্বিতীয় ভাগ

৬. মুসলিম সমাজের দুর্দশা

৬ষ্ঠ অধ্যায়

মুসলিম সমাজের দুর্দশা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা বিনষ্ট হওয়ার পর মুসলিম সমাজের যে সীমাহীন দুর্দশা হয়েছিল, তা নিম্নের আলোচনায় সুস্পষ্ট হবে।

পলাশী যুদ্ধের পূর্বে সামরিক ও বেসামরিক চাকুরীক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের প্রাধান্য ছিল। কোম্পানী ক্ষমতা হস্তগত করার পর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের প্রথম ধাপেই মুসলিম সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। তার ফলে কিছু উচ্চশ্রেণীর কর্মচারীই বেকার হয়ে পড়ে। ফলে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকারত্ব ও দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেয়া হয়।

দ্বিতীয়তঃ দেশের গোটা রাজস্ব বিভাগকে ইংলন্ডের পদ্ধতিতে পুনর্গঠিত করার ফলে বহুসংখ্যক মুসলমান কর্মচ্যুত হয়। সরকারের ভূমি রাজস্ব নীতি অনুযায়ী বহু মুসলমান জমিদার তাদের জমিদারী থেকে উচ্ছেদ হয়। ১৭৯৩ সালে গ্রাম্য পুলিম প্রথা রহিতকরণের ফলেও হাজার হাজার মুসলমান বেকার হয়ে পড়ে। এভাবে এ দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে উচ্চশ্রেণীর মুসলমান শুধু সরকারী চাকুরী থেকেই বঞ্চিত হয়নি, জীবিকার্জনের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়।

নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের পেশা ছিল সাধারণতঃ কৃষি ও তাঁতশিল্প। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ থেকে মানচেষ্টারের মিলজাত বস্ত্রাদি প্রচুর পরিমাণে আমদানীর ফলে, বাংলার তাঁতশিল্প ধ্বংস হয় এবং লক্ষ লক্ষ তাঁতীও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তারপর শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করা তাদের জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

কোম্পানী এ দেশে আগমনের পর থেকেই কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ তাদের অধীনে চাকুরী-বাকুরী করে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদেরকে বলা হতো ‘গোমস্তা’। পলাশী যুদ্ধের পর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এদের হয়েছিল পোয়াবারো। কোম্পানীর একচেটিয়া লবণ ব্যবসায় এবং আভ্যন্তরীণ অন্যাণ্য ব্যবসা-বাণিজ্যে এসব গোমস্তাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ক’রে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। কিনউত এতদ্দেশীয় ব্যবসা ধ্বংস করে জনগণকে চরম, দুর্দশাগ্রস্ত ক’রে ফেলে। কোম্পানীর দেশী-বিদেশী কর্মচারীগণ ইংলন্ড থেকে আমদানীকৃত দ্রব্যাদি অত্যধিক উচ্চমূল্যে খরিদ করতে এবং দেশের উৎপন্ন দ্রব্যাদি অতি অল্পমূল্যে বিক্রয় করতে জনসাধারণকে বাধ্য করে। তাদের উৎপীড়ন-নির্যাতনের বিবরণ দিতে হলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন। কোম্পানীর অত্যাচার-উৎপীড়নে পূর্ণ সহায়তা করে বাংলার হিন্দু কর্মচারীগণ। ১৭৮৬ সালে কালীচরণ নামে জনৈক গোমস্তার জুলুম-নিষ্পেষণে ত্রিপুরা অঞ্চলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার অপরাধে তাকে সেখান থেকে অপসারিত ক’রে চট্টগ্রামে রাজস্ব বিভাগের দেওয়ান বা ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়। এক বৎসরে সে চট্টগ্রামের জমিদারের নিকট থেকে অন্যায়ভাবে ত্রিশ হাজার টাকা আদায় করে। লর্ড কর্ণওয়ালিসের নিকটে বিষয়টি উপস্থাপিত করলে, চট্টগ্রামের রাজস্ব কন্ট্রোলার মিঃ বার্ড বলেন, কালীচরণকে চাকুরী থেকে অপসারিত ক’রে তার স্থলে তার গোমস্তা নিত্যানন্দনকে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু কোলকাতার অতি প্রভাবশালী গোমস্তা জয় নারায়ণ গোসাই-এই হস্তক্ষেপের ফলে বিষয়টির এখানেই যবনিকাপাত হয় এবং কালীচরণ তার পদে সসম্মানে বহাল থাকে।

এ একটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, কোম্পানীর হিন্দু কর্মচারীগণ গ্রামবাংলার ধ্বংস সাধনে কোন সর্বনাশা ভূমিকা পালন করেছিল। জনৈক ইংরেজ মন্তব্য করেনঃ ইংরেজ ও তাদের আইন-কানুন যে একটি মাত্র শ্রেণীকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করেছিল তা হলো, তাদের অধীনে নিযুক্ত এতদ্দেশীয় গোমস্তা-দালাল প্রতিনিধিগণ। এসব লোক পংগপালের মতো যেভাবে দ্রুতগতিতে গ্রামবাংলাকে গ্রাস করতে থাকে তাতে করে তারা ভারতের অস্তিত্বের মূলেই আঘাত করছিল। -(Muinuddin Ahmad Khan, Muslim Struggle for Freedom in Bengal, pp. 8)।

ইংরেজদের পলিসি ছিল, যাদের সাহায্যে তারা এ দেশের স্বাধীনতা হরণ ক’রে এখানে রাজনৈতিক প্রভুত্ব লাভ করেছে, তাদেরকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত ক’রে মুসলমানদেরকে একেবারে উৎখাত করা, যাতে ক’রে ভবিষ্যতে তারা আর কখনো স্বাধীনতা ফিরে পাবার কোন শক্তি অর্জন করতে না পারে। হ্যাস্টিংসের ভূমি ইজারাদান নীতি ও কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা মুসলমান জমিদারদের স্থান দখল করে। নগদ সর্বোচ্চ মূল্যদাতার নিকটে ভূমি ইজারাদানের নীতি কার্যকর হওয়ার কারণে প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদারগণ হঠাৎ সর্বোচ্চ মূল্য নগদ পরিশোধ করতে অপারগ হয়। পক্ষান্তরে হিন্দু বেনিয়অ শ্রেণী, সুদী মহাজন, ব্যাংকার ও হিন্দু ধনিক-বণিক শ্রেণী এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন জমিদারীর অধিকাংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এসব ধনিক-বণিকদের কাছে অচিরেই হস্তান্তরিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান জমিদারদের অধীনে নিযুক্ত হিন্দু নায়েব-ম্যানেজার প্রভৃতির স্বীকৃতি দান। ১৮৪৪ সালের Calcutta Review-তে যে তথ্য প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয় এক ডজন জমিদারীর মধ্যে, যাদের জমিদারীর পরিধি ছিল একটি ক’রে জেলার সমান, মাত্র দু’টি পূর্বতন জমিদারদের দখলে রয়ে যায় এবং অবশিষ্ট হস্তগত হয় প্রাচীন জমিদারদের নিম্নকর্মচারীর বংশধরদের। এভাবে বাংলার সর্বত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীর পত্তন হয়, যারা হয়ে পড়েছিল নতুন বিদেশী প্রভুদের একান্ত অনুগত ও বিশ্বাসভাজন।

হান্টার তাঁর The Indian Mussalmans গ্রন্থে বলেনঃ যেসব হিন্দু কর আদায়কারীগণ ঐ সময় পর্যণ্ত নিম্নপদের চাকুরীতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানা অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। অথচ মুসলমানেরা নিজেদের শাসনামলে এ সুযোগ সুবিধাগুলো একচেটিয়াভাবে ভোগ করেছে। -(Hunter, The Indian Mussalmans: অনুবাদ আনিসুজ্জামান, পৃঃ ১৪১)।

মুসলিম শাসনামলে আইন ছিল যে, জমিদারগণ সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতিকারী ও দস্যু-তস্করের প্রতি কড়া নজর রাখবে। ধরা পড়লে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদিসহ তাদেরকে সরকারের নিকটে সমর্পণ করবে। ১৭৭২ সালে কোম্পানী এ আইন রহিত করে। ফলে, নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করকে ধীরয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতিপালন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির অংশীদার হতে থাকে। এটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, এসব দস্যু-তষ্কর কারা ছিল, এবং কারা ছিল গ্রামবাংলার লুণ্ঠিত হতভাগ্যের দল। ১৯৪৪ সালে Calcutta Review-প্রকাশিত তথ্যে বলা হয় যে, এসব নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করদেরকে প্রতিপালন করতো ধন অর্জনের উদ্দেশ্যে। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত ঢাকা-জালালপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্টেও এসব দুষ্কৃতি সত্য বলে স্বীকার করা হয়।

-(Muinuddin Ahmad Khan –Muslim Struggle for freedom in India –oo.10)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মুসলমান জমিদারদের উৎখাত ক’রে শুধুমাত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীরই পত্তন করেনি, নতুনভাবে জমির খাজনা নির্ধারণেরও পূর্ণ অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে তারা চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেয়। এসব জমিদার সরকারী রাজস্বের আকারে অতি উচ্চহারে ঠিকাদার তথা পত্তনীদারদের নিকটে তাদের জমিদারীর ভারার্পণ করতো। তারা আবার চড়া খাজনার বিনিময়ে নিম্নপত্তনীদারদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করতো। অতএব সরকারের ঘরে যে রাজস্ব যেতো, তার চতুর্গুণ –দশগুণ প্রজাদের নিকটে জোর-জবরদস্তি করে আদায় করতো। বলতে গেলে, এ নতুন জমিদার শ্রেণী রায়তদের জীবন-মরণের মালিক-মোখতার হয়ে পড়েছিল।

ফরিদপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আপিস থেকে এমন কিছু সরকারী নথিপত্র পাওয়া যায়, যার থেকে এ তথ্য প্রকাশিত হয় যে, অন্ততঃপক্ষে তেইশ প্রকার ‘অন্যায় ও অবৈধ’ আবওয়াব রায়তদের নিকট থেকে আদায় করা হতো। বুকানন বলেন, “রায়তদেরকে বাড়ী থেকে ধরে এনে কয়েকদিন পর্যন্ত আবদ্ধ রেথে মারপিট করে খাজনা আদায় করা তো এক সাধারণ ব্যাপার ছিল। উপরন্তু নিরক্ষর প্রজাদের নিকট থেকে জাল রসিদ দিয়ে জমিদারের খাজনা আদায় করে আত্মসাৎ করতো”। (M. Martin –The History, Antiquities, Topography & Statistics of Eastern India, London-1838, Vol. 2).

হিন্দু জমিদারদের অমানুষিক অত্যচার কাহিনী, তিতুমীরের জমিদার বিরোধী আন্দোলন যথাস্থানে আলোচিত হবে।

সামগ্রিকভাবে বাংলার মুসলিম সমাজের অবস্থা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কেমন ছিল, তার একটা নিখুঁত চিত্র অংকন করতে হলে জানতে হবে এ সমাজের তিনটি প্রধান উপাদান বা অংগ অংশে কোন অবস্থা বিরাজ করছিল। সমাজের সে তিনটি অংগ অংশ হলো –নবাব, উচ্চশ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়।

১. নবাব

পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার হয়ে পড়েছিলেন কোম্পানীর হাতের পুতুল। চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদেরকে একচেটিয়া অধিকার দেয়া হয়। উপরন্তু কোম্পানী ও তাদের সাদা-কালো কর্মচারীদেরকে মোটা উপঢৌকনাদি দিতে হতো। মীর জাফর যেসব উপঢৌকনাদি দিয়েছিল, কোম্পানীর ১৭৭২ সালের সিলেক্ট কমিটির হিসাব অনুযায়ী তার মূল্য ছিল বার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। ১৮৬৫ সালের পর নবাবকে বার্ষিক ভাতা দেয়া হয় ৫৩,৮৬,০০০ টাকা। ১৭৭০ সালে তা হ্রাস করে করা হয় বত্রিশ লক্ষ এবং ১৭৭২ সালে মাত্র ষোল লক্ষ টাকা। পূর্বে নবাবগণ তাঁদের অধীনে বহু মুসলমানকে চাকুরীতে নিয়োজিত করতেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য, জায়গীর প্রভৃতি দান করতেন। তা সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁরা চরম দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। কিছু সংখ্যক বাংলাদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান তাঁদের ভাগ্যান্বেষণের জন্যে এবং অবশিষ্ট দারিদ্রে নিষ্পেষিত হতে থাকেন।

২। সম্ভ্রান্ত বা উচ্চশ্রেণীর মুসলমান

সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে অথবা দুঃসাহসী ভাগ্যন্বেষী হিসাবে বিভিন্ন সময়ে এ দেশে আগমন করেন। অতঃপর এ দেশেকে তাঁরা মনেপ্রাণে ভালোবেসে এটাকেই তাঁদের চিরদিনের আবাসভূমিরূপে গ্রহণ করেন। বিজয়ী হিসাবে স্বভাবতঃই তাঁরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার রাখতেন। হান্টার বলেন, একটি সম্ভান্ত মুসলমান পরিবার তিনটি প্রধান সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ করতো –সামরিক বিভাগের নেতৃত্ব, রাজস্ব আদায় এবং বিচার বিভাগ ও প্রশাসন ক্ষেত্রে চাকুরী।

প্রথম সূত্রটি, বলতে গেলে, ছিল তাদের একেবারে একচেটিয়া। মীর জাফর স্বয়ং আশি হাজার সৈন্য চাকুরী থেকে অপসারিত করে। নজমুদ্দৌলা তার আপন মর্যাদা রক্ষার্থে যে পরিমানসংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন হতো তাই রাখতে পারতো। ফলে, বাংলা বিহারের কয়েক লক্ষ মুসলমান বেকারত্ব ও দারিদ্যে নিষ্পেষিত হতে থাকে।

হান্টার বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে, সেনাবাহিনী। সেকানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হ’য়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়অ হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না।

তাদের অর্ত উপার্জনের দ্বিতীয় সূত্র ছিল –রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু উপরে বর্ণিত হ’য়েছে কিভাবে নিম্নপদস্থ হিন্দু রাজস্ব আদায়কারীগণ কোম্পানীর অনুগ্রহে এক লাফে মুসলমানদের জমিদারীর মালিক হ’য়ে বসে।

লর্ড মেটকাফ ১৮২০ সালে মন্তব্য করেনঃ দেশের জমি-জমা প্রকৃত মালিকের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে একশ্রেণীর বাবুদের নিকটে হস্তান্তরিত করা হয় –যারা উৎকোচ ও চরম দুর্নীতির মাধ্যমে ধনশালী হয়ে পড়েছিল। এ এমন এক ভয়াবহ নির্যাতনমূলক নীতির ভিত্তিতে করা হয় যার দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।

-(E. Thompson The life of Charls Lord Metcalfe; A.R. Mallick : British Policy and the Muslims of Bengal).

ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত মুসলমান কর্মচারী ও ভুমির প্রকৃত মালিকের স্থান অধিকার করে বসে ইংরেজ ও হিন্দুগণ।

আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। বুকাননের

মতে একমাত্র বিহার ও পাটনা জেলার একুশ প্রকারের লাখেরাজ ভূমি দান করা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। ইংরেজ আমলে নানান অজুহাত এসব লাখেরাজদারকে তাদের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বর্ধমারে স্পেশাল ডিপুটি কলেক্টর মিঃ টেইলার একদিনে ৪২৯ জন লাখেরাজদারের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতে রায় দান করেন।

ইংরেজ সরকারের Tribunals of Resumption-এর অধীনে লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের পুনর্দখলে নেয়া হয়। চট্টগ্রাম বোর্ড অব রেভেনিউ-এর জনৈক অফিসার নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ সরকারের নিয়তের প্রতি লাখেরাজদারগণ সন্দিগ্ধ হ’য়ে পড়লে তাতে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৪৬৩টি মামলার মধ্যে সব কয়টিতেই লাখেরাজদারদের অনুপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার পর Tribunals of Resumption-এর প্রতি তাদের আস্থাহীন হবারই কথা (Comment by Smith in Harvey’s Report of 19th June 1840; A.R. Mallick British Policy and the Muslims of Bengal).

মুসলমান লাখেরাজদারদের ন্যায্যা ভূমির মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নানাবিধ হীনপস্থা অবলম্বন করা হতো এবং ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে এক বিদ্বেষদুষ্ট মানসিকতা বিরাজ করতো। লাখেরাজদারদের সনদ রেজেষ্টী নাক রার কারণে বহু লাখরাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়। জেলার কালেকটরগণ ইচ্ছা করেই সময় মতো সনদ রেজেষ্ট্রী করতে গড়িমসি করতো। তার জণ্যে চেষ্টা করেও লাখেরাজদারগণ সনদ রেজেষ্ট্রী করাতে পারতেন না।

চট্টগ্রামে লাখেরাজদারদের কোর্টে হাজির হবার জন্যে কোন নোটিশই দেয়া হতো না। অনেকক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, মামলার ডিক্রী জারী হবার বুহ পূর্বেই সম্পত্তি অন্যত্র পত্তন করা হয়েছে। ১৮২৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সমগ্র বাংলা বিহারে লাখেরাজদারদের মিথ্যা তথ্য সংগ্রহের জন্যে চর, ভূমা সাক্ষী ও রিজাম্পশন অফিসার পংগপালের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলমানদেরকে মামলায় জড়িত করে। এসব মামলায় সরকার ছাড়াও তৃতীয় একটি পক্ষ বিরাট লাভবান হয়। যারা মিথ্যা সাক্ষদান করে এবং যারা সরকারী কর্মচারীদের কাছে কাল্পনিক তথ্য সরবরাহ করে –তারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। পক্ষান্তরে, মুসলিম উচ্চম্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হ’য়ে যায়।

পন্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেনঃ

ইংরেজরা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বহু ‘মুয়াফী’ অর্থাৎ লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তির অস্তিত্ব ছিল। তাদের অনেক ছিল ব্যক্তিগত, কিন্তু অধিকাংশই ছিল শিক্ষায়তনগুলির ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে ওয়াকফকৃত। প্রায় সকল প্রাইমারী স্কুল, মকতব এবং বহু উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এসব ‘মুয়াফীর’ আয় নির্ভর ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিলাতে তাদের অংশীদাগণকে মুনাফা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি টাকা তোলার প্রয়োজনবোধ করে। কারণ কোম্পানী ডিরেক্টরগণ এজন্যে খুব চাপ দিচ্ছিল। তখন এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ‘মুয়াফী’র ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নীতি গৃহীত হয়। এসব ভূ-সম্পত্তির সপক্ষে কঠিন সাক্ষ্যপ্রমাণ পেম করার হুকুম জারী করা হয়।

কিন্তু পুরানো সনদগুলি ও সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র ইতিমধ্যে হয় কোথাও হারিয়ে গেছে, নয় পোকায় খেয়ে ফেলেছে। অতএব প্রায় সকল ‘মুয়াফী’ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। বহু বনেদী ভূম্যাধিকারী স্বত্বচ্যুত হলেন। বহু স্কুলে কলেজের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে বহু জমি সরকারের খাস দখলে আসে আর বহু বনেদী বংশ উৎখান হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপরোক্ত ‘মুয়াফী’র আয় নির্ভর ছিল, সেগুলি বন্ধ হয়ে গেল। বহু সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগীয় কর্মচারী বেকার হ’য়ে পড়লেন। -(Pandit Jawhellal Nehru: The Discovery of India, pp. 376-77)

উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মুসলমানদের জীবিকার্জনের তৃতীয় অবলম্বন ছিল সরকারের অধীনে চাকুরী –বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে। কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পরও প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত তাঁরা চাকুরীতে বহাল ছিলেন। কারণ তখন পর্যন্ত সরকারী ভাষা ছিল ফারসী। কিন্তু হঠাৎ আকস্মিকভাবে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে সরকারী ভাষা করা হয়। মুসলমানগণ তার জন্যে পূর্ব থেকে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ১৮৩২ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে ক্যাপ্টেন টি ম্যাকাম প্রস্তাব পেশ করেন যে, ক্রমশঃ ইংরেজী ভাষার প্রচলন করা হোক এবং মুস্যলমান কর্মচারীদেরকে অন্ততঃ পাঁচ/ছ’বছরের অবকাশ দিয়ে নোটিশ দেয়া হোক। হন্ট ম্যাকেঞ্জীও অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, জেলাগুলিতে ক্রমশঃ এবং পর পর ইংরেজীর প্রচলন করা হোক। কিন্তু সহসা সর্বত্র ও পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী চাকুরী থেকে অপসারিত হন যাদের জীবিকা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতো একমাত্র চাকুরীর উপর। ১৮২৯ সালে সবরকম শিক্সার বাহন হিসাবে স্কুল-কলেজে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। ১৮৩৭ সালের ১লা এপ্রিল থেকে (তৎকালীন আর্থিক বৎসরের প্রথম দিন) সহসা সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজীর প্রবর্তন হয়।

হান্টার সাহেবও এসব সত্য স্বীকার করে বিদ্রুপ করে বলেছেনঃ

“এখন কেবলমাত্র জেলখানায় দু’একটা অধঃস্তন চাকুরী ছাড়া আর কোথাও ভারতের এই সাবেক প্রভুরা ঠাঁই পাচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে কেরানীর চাকুরীতে, আদালতের দায়িত্বশীল পদে, এমনটি পুলিশ সার্ভিসের উর্ধ্বতন পদগুলিতে সরকারী স্কুলের উৎসাহী হিন্দু যুবকদেরকে নিযুক্ত করা হচ্ছে”।
 

এ পরিবর্তনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় পূর্ণ সুফল ভোগ করে। বিভিন্ন কলেজ থেকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে তারা সর্বথ্র সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক অগনে পট পরিবর্তনের ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারসমূহ জীবিকার্জনের সকল সুযোগ-সুবিধা তেকে বঞ্চিত হ’য়ে দারিদ্র্য, অনাহার ও ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়।

৩। নিম্নশেণীর মুসলমানঃ কৃষক ও তাঁতী

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষককুলের যে চরম দুর্দশা হ’য়েছিল তার কিঞ্চিত আভাস উপরে দেয়া হয়েছে।

একথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমিদার এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে আরও দুটি স্তর বিরাজ করতো। যথা পত্তনীদার ও উপপত্তনীদার। জমিদারের প্রাপ্য খাজনার কয়েকগুণ বেশী এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে রায়তদের কাছ থেকে আদায় করা হতো এবং তাতে করে রায়ত বা কৃষকদের শোষণ-নিষ্পেষণের কোন সীমা থাকতো না। জমিদার-পত্তনীদারদের উৎপীড়নে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়তো। বাধ্য হয়ে তাদেরকে হিন্দু মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হতো। শতকরা ৩৭ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হারে সুদে তাদেরকে টাকা কর্জ করতে হতো। উপরন্তু তাদের গরু/মহিষ মহাজনের কাছে বন্ধক রাখতে হতো। অভাবের দরুন মহাজরেন কাছে অগ্রিম কোন শস্য গ্রহণ করতে হলে তার দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হতো। আবার উৎপন্ন ফসল যেতেতু মহাজনের বাড়ীতেই তুলতে হতো, এখানেও তাদেরকে প্রতারিত করা হতো। মোটকথা হতভাগ্য কৃষকদের জীবন নিয়ে এসব জমিদার মহজনরা ছিনিমিনি খেলে আনন্দ উপভোগ করতো।

কৃষকদের এহেন দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায়ও ছিল না। কারণ তা ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উপরন্তু জমিদার ও তাদের দালালগণ উৎকোচ ও নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে খরচ কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিত। পরিণাম ফল এই হতো যে, জমিদার মহাজন তাদেরকে ভিটেমাটি ও জমিজমা থেকে উচ্ছেদ করে পতের বিভারীতে পরিণত করতো।

কৃষক সম্প্রদায় ধান ও অন্যান্য শস্যাদি উৎপন্নের সাথে সাথে নীলচাষও করতো। এই নীলচাষের প্রচলন এদেশে বহু আগে থেকেই ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারত থেকে নীল রং সর্বপ্রথম ইউরোপে রপ্তানী হয়। ব্রিটিশ তাদের আমেরিকান ও পশ্চিম ভারতীয় উপনিবেশগুলিতে নীলচাষের ব্যবস্থা করে। এগুলি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবার পর বাংলা প্রধান নীল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়। ১৮০৫ সালে বাংলায় নীলচাষের পরিমাণ ছিল ৬৪,৮০৩ মণ এবং ১৮৪৩ সালে তার পরিমাণ হ’য়ে পড়ে দ্বিগুণ। বাংলা, বিহার এবং বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নদিয়া, মুশিদাবাদ প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত জেলগুলিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশের তত্বাবধানে ব্যাপক আকারে নীলচাষ করা হয়। কিন্তু বিদেশী শাসকগণ নীলের এমন নিম্নমূল্য বেঁধে দেয় যে, চাষীদের বিঘাপ্রতি সাত টাকা ক’রে লোকসান হয় যা ছিল বিঘাপ্রতি খাজনার সাতগুণ। তথাপি চাষীদেরকে নীলচাষে বাধ্য করা হতো। বাংলার নীলচাষীদের উপরে শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার উৎপীড়নের মর্মন্তুদ ও লোমহর্ষক কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ক্ষমতা মদমত্ত শাসক ও তাদের দালালদের মানবতাবোদ সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল। নতুবা তাদের নিষ্পেষণের দরুন কৃষক সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মর্মন্তুদ হাহাকারে বাংলার আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতো না।

দরিদ্র ও দুঃস্থ কৃষকগণ বেঁচে থাকার জন্যে নীলচাষের মাধ্যমে কিছু অর্থ উপার্জনের আশা করতো। তাদের দারিদ্র্য ও অসহায়তার সুযোগে ইংরেজ নীলকরগণ কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হ’তে তাদেরকে বাধ্য করতো। অনেক সময় অনিচ্ছুক কৃষকদের ধরে আগুন লাগিয়ে দিত। এতেও সম্মত করতে না পারলে জাল চুক্তিনামার বলে তাদের জমাজমি জবরদখল ক’রে নীলকরগণ তাদের কর্মচারীদের দ্বারা সেসব জমিতে নীলচাষ করাতো। কখনো কখনো অত্যাচারী জমিদার তার প্রজাকে শাস্তি দেবার জন্যে তার কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে নীলকরদেরকে দিয়ে দিত। একবার অ্যাশলী ইডেন নীল কমিশনের সামনে ১৮৬০ সালে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, বিভিন্ন ফৌজদারী রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ঊনপঞ্চাশটি ঘটনা এমন ঘটেছে, যেখানে নীলকরগণ দাংগা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি, লুটতরাজ এবং বলপূর্বক অপহরণ প্রভৃতি গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকে। তার বহু বৎসর পূর্বে জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট একজন খৃষ্টান মিশনারীর সামনে মন্তব্য করেন যে, মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়া ব্যতীত একবাক্স নীলও ইংলন্ডে প্রেরিত হয় না। (১৮৬১ সালের নীল কমিশন রিপোর্ট এবং ক্যালকাটা খৃষ্টান অবজার্ভার, নভেম্বর, ১৮৫৫ সাল)।

নীল চাষীদের দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায় ছিল না। চৌকিদার-দফাদারের সামনে চাষীদের উপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হলেও চৌকিদারদের ঘৃণাক্ষরেও সেকথা প্রকাশ করার সাধ্য ছিল না। একবার নিষ্ঠুর নীলকরগণ একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করলে তা নির্বাপিত করার জন্যে এক ব্যক্তি চীৎকার ক’রে লোকজন জড়ো করে। তার জন্যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে আহত অবস্থায় একটি অন্ধকার কামরায় চার মাস আটক রাখা হয়। ও দিকে আবার নীলকরগণ পুলিশকে মোটা ঘুষ দিয়ে বশ করে রাখতো। (নীল কমিশন রিপোর্ট ১৮৬১)।

হতভাগ্য অসহায় কৃষকগণ ম্যজিস্ট্রেটের নিকট থেকে কোন প্রকারের প্রতিকার ও ন্যায় বিচারের আশা করতে পারতো না। উক্ত নীল কমিশন রিপোর্টে বলা হয়ে ছে যে, সাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেটগণ আপন দেশবাসীদের পক্ষই অবলম্বন করতো। ফৌজদারী আইন-কানুন এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যে, ইংরেজ প্রজাকে শাস্তি দেয়া ছিল অসম্বব ব্যাপার। একজন দরিদ্র প্রজা সূদুর প্রত্যন্ত এলকার তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে ফেলে কোলকাতায় গিয়ে মামলা দায়ের করার সাহস রাখনো না। কারণ তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের জানমাল ইয্যৎ-আবরু নীলকরদের দ্বারা বিনষ্ট হতো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে অধিক পরিমানে নীলচাষ করা হতো। ফলে নিম্নশ্রেণীর মুসলমান নীলকরদের চরম নির্যাতন-নিপীড়নের সার্বক্ষণিক শিকারে পরিণত ছিল।

তাঁতী

কৃষক শ্রেণীর মতো এদেশ তাঁতী শ্রেণীও চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়। বাংলা-বিহারের লক্ষ লক্ষল মুসলমান তাঁতশিল্প দ্বারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হবার পূর্ভেই লাভজনক ব্যবসা হিসাবে তাঁত শিল্পের মৃত্যু ঘটেছিল। তথাটি উপায়ান্তর না থাকায় যেসব মুসলমান তখন পর্যন্ত তাঁতশিল্প আঁকড়ে ধরে ছিল, ১৮৯১ সালের আদশুমারী অনুযায়ী তাদের সংখ্যা বিহার প্রদেশ ও বাংলার কয়েকটি জেলায় ছিল ৭,৭১২৩৭। নদিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, নোয়াখালী, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের তাঁতীগণ ছির এ সংখ্যার বাইরে। অতএব কোম্পানী আমলের প্রথমদিকে সমগ্র বাংলা ও বিহারে মুসলমান তাঁতীর সংখ্যা অন্ততঃপক্ষে উপরোক্ত সংখ্যার যে দশগুণ ছিল তা বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে। এসব তাঁতী ব্যবসায়ীদের কিভাবে সর্বনাশ করা হয়েছিল, তার কিঞ্চিৎ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে আগমনের পূর্বে এদেশের তাঁতশিল্প চরম উৎকর্ষ সাধন করেছিল। প্রতিট জেলায় বিশিষ্ট ধরনের অতি উৎকৃষ্ট তাঁতবস্ত্র নির্মিত হতো। চাহিতা মেটাবার জন্যে প্রচুর পরিমাণে কার্পাস আমদানী করা হতো। এসব তাঁতশিল্প থেকে মোটা ও মিহি উভয় প্রকারের বস্ত্র তৈরী হতো। ভারত ছিল মোটা বস্ত্রের বাজার এবং সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী করা হতো। মুসলমান শাসকদের সাহায্য সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার রেশমজাত অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী করা হতো। মুসলমান শাসকদের সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার রেশমজাত অতিসূক্ষ্ম ‘মসলিন’ বস্ত্র দু’শতাব্দী ব্যাপী ইউরোপীয় বাজারে বিরাট আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল। মোটা বস্ত্র হোক, অথবা অতিসূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র উভয় বস্ত্রই ছিল মুসলমান তাঁতশিল্পীদের বিরাট অবদান। উইলিয়াম বোল্ট নামক জনৈক ইংরেজ বণিক, কোম্পানী কর্তৃক তাঁতীদের উপর অকথ্য নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কোম্পানীদের একচেটিয়া অধিকার। ইংরেজ এবং তাদের অধীনস্ত হিন্দু বেনিয়অ ও গোমস্তাগণ আপন খুশী খেয়াল মতো কাপড়ের দর বেঁধে দিয়ে সে দরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বস্ত্র সরবরাহ করতে তাঁতীদের বাধ্য করতো। নীলকরদের মতো তাঁতীদের স্বার্ত-বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতেও তাদেরকে বাধ্য করা হতো। নির্দিষ্ট কোয়ালিটির বস্ত্র নির্দিস্ট পরিমাণে তাদেরই বেঁধে দেয়া দরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে তাঁতীদেরকে বাধ্য করা হতো –ওসব চুক্তি বলে। তাদের বেধেঁ দেয়া দর আবার বাজার দর থেকে শতকরা পনেরো থেকে চল্লিশ ভাগ কম হতো। কোম্পানী ও তার অত্যাচারী দালালদের মনস্তুষ্টি সাধন করতে না পারলে তাঁতীদেরকে বেত্রাঘাত করা হতো। এ যেন জ্যান্ত চামড়া খুলে মানুষের মাংস ভক্ষণ করা। আদিম যুদে অরণ্য নিবাসী অসভ্য বর্বর মানুষ প্রয়োজনবোধে নর-নারীর মাংসে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতো বলে শুনা যায়। কিন্তু তাদের চেয়ে এসব তথাকথিত সভ্য ইংরেজ ও তাদের দালালগণ কোন দিক দিয়ে উৎকৃষ্টতর ছিল?

পরবর্তীকালে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ বাংলার বস্ত্রশিল্পে চরম আঘাত হানে। তারা বাংলা থেকে তৈরী বস্ত্র ইংলন্ডে আমদানী না করে কাঁচামাল হিসেবে কার্পাস ও রেশম আমদানী করতে থাকে। অতঃপর তারা সুপারিশ করে যে, রেশমী বস্ত্রের কারিগরগণকে নিজেদের তাতেঁ কাজ করার পরিবর্তে কোম্পানীর নিজস্ব কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হোক। পরিণামে এ শিল্পপ্রধান দেশটি ইংলন্ডের বস্ত্র নির্মাতাদের কাঁচামালের বাজারে পরিণত হয়। ১৭৮৯ সালের পর থেকে ঢাকার সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্রের রপ্তানী হ্রাস পেতে থাকে। ১৭৯৯ সালে শুধুমাত্র ঢাকা থেকে বস্ত্র রপ্তানী হয়েছিল ১২ লক্ষ টাকার। সেকালের বার লক্ষকে এখনকার টাকার মূল্যমানে অনায়াসে বার কোটি বলা যেতে পারে। ১৮১৩ সালে রপ্তানী হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় তিন লক্ষ টাকায়। ১৮১৭ সালে ঢকার উৎপন্ন বস্ত্রের রপ্তানী একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

মোটকথা বাংলা বিহারের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস করে উপার্জনহীন তাঁতী সম্প্রদায়ের রক্তমাংসে গড়ে উঠে মানচেষ্টারের বস্ত্রশিল্প। ক্রমে রপ্তানীকারী দেশ আমদানীকৃত মালের বাজারে পরিণত হয়। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত এদেশে বার্ষিক বস্ত্র আমদানী হতো বার লক্ষ পাউন্ড মূল্যের। ১৮০৯ সালেতার পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি চৌরাশি লক্ষ পাউন্ড মূল্যের। ব্রিটিশের নীতিই ছিল ধীরে ধীরে এদেশের তাঁতী সম্প্রদায়কে নির্মূল করা যারা ছিল প্রায়ই মুসলমান। (আবদুল মওদুদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ)।

তাঁতীদের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্র এঁকেছেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর The Discovery of India গ্রন্থে। তিনি বলেন, এসব তাঁতীদের পুরানো পেশা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। নতুন  কোন পেশার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। উন্মুক্ত ছিল শুধু মৃত্যুর
দ্বার। মৃত্যুবরণ করলো লক্ষ লক্ষ। লর্ড বেন্টিংক ১৮৩৪ সালের রিপোর্টে বলেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশার তুলনা নেই বাণিজ্যের ইতিহাসে। ভারতের পথঘাট পূর্ণ হয়েছে তাঁতীদের অস্থিতে। -(Pandit Nehru: The Discovery of India, p. 352)।

মোটকথা, পলাশীর যুদ্ধে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেয়ার পর থেকে একশত বছরের সঠিক ইতিহাস ও বিভিন্ন তথ্যাবলী থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, এ সময়কালের ইতিহাস বাংলার মুসলমানদের শোষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন-নিষ্পেষণ, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ও হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস। আর এ কাজে ইন্ধন যুগিয়েছে, সর্বপ্রকারে সাহায্য সহযোগিতা করেছে কোম্পানী সরকারের অনুগ্রহপুষ।ট দেশীয় ‘বাদুদের’ দল। দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মূল্যও তারা লাভ করে পূর্ণমাত্রায়। আর তা হলো এই যে, দেশের সমুদয় জমিদারী, জোতদারী প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসব ‘বাবুদের’ দেয়া হয়েছে চিরকালের জন্যে পুত্র-পৌত্রাধিক্রমে ভোগের জন্যে। আর এরা অগাধ ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হ’য়ে পড় উৎকোচ ও দুর্নীতির মাধ্যমে। -(E. Thompson: The life of Charles Lord Metcalfe; A. R. Mallic: British Policy & the Muslims of Bengal).

শোষণ-নিষ্পেষণের মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হলো এই যে, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ বাংলার লোক মরেছে তিনভাগের একভাগ, চরম অবনতি ঘটেছে চাষবাসের। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস হিসাব কষে ও কড়া চাপে নির্ধারিত রাজস্বেরও বেশী টাকা আদায় করেছেন মুমূর্ষু কৃষকদের দুঃখ মোচনের জন্যে খরচ করেননি। বরঞ্চ বাখরগঞ্জ জেলার ৩৩,৯১৩ মণ চাউল বিক্রয় ক’রে ৬৭,৫৯৩ টাকা মুনাফা লুটেছেন। ঢাকার ৪০,০০০ মণ চাউল বাঁকীপুরের সেনানিবাসে গুদামজাত করেছেন, বলেছেন আবদুল মওদুদ তাঁর ‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’ গ্রন্থে (পৃ: ৬৩)।

আবদুল মওদূদ আরও বলেন, যে তাজমহলকে স্থপতিরা পৃথিবীর বুকে স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ করেন, যার নির্মাণকর্মে ২৩ কোটি ডলার ব্যয়িত হয়েছিল এবং যার পরিকল্পনা মানস সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিজয়ীর মানসকেও ম্লান করে লজ্জা দেয়, সেই তাজমহলটিকে ভেঙে তার মাল-মসলা আত্মসাৎ করার জন্যে ভারতে অন্যতম পরম দয়ালু ও কল্যাণসাধক বড়লাট হিসাবে নন্দিত লর্ড বেন্টিংক একবার একজন হিন্দু কন্ট্রাক্টরকে মাত্র দেড় লক্ষ ডলারে বিক্রয় করারও চুক্তি করেছিলেন। (The Round the World Traveller, Loreng: p. 379)। ওয়ারেন হেস্টিংস দেওয়ান-ই-খাসের হাম্মামখানাটি উপড়ে নিয়ে বিলাতে চতুর্থ জর্জকে উপহার পাঠিয়েছিলেন এবং লর্ড বেন্টিংক প্রাসাদটির অন্যান্য অংশ বিক্রয় করে ভারতের রাজস্ব বৃদ্ধি করেছিলেন (India: Chirol-p.54; The Story of Civilization, Our Oriental Heritage by Will Durant, pp. 609-10)।

এমনি, মহামূল্য লুণ্ঠিত ‘কোহিনুর’ এখনো ইংলন্ডের শাহীমহলের মোভা বর্ধন করছে। এহেন লুণ্ঠনকার্যের দ্বারা শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতা-ভব্যতার গর্বিত ইংরেজদের চরম হীন প্রবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

এডমন্ড বার্ক সত্যিই নিমর্শ উক্তি করেছেনঃ আমাদের আজ যদি ভারত ছাড়তে হয়, তাহলে ওরাংওটাং বা বাঘের চেয়ে কোন ভালো জানোয়রের অধিকারে যে এদেশ চিল তার প্রমাণ করবার কিছুই থাকবে না। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃঃ ৬৪)

কোম্পানীর শাসন আমল সমাপ্তির পূর্বক্ষণে জন ব্রাইট বলেছিলেন, “ভারতের নিরীহ জনগণের উপর এক শ’ বছরের ইতিহাস হলো অকথ্য অপরাধসমূহের ইতিহাস (Oxford History of India: p. 680).

হিন্দু মুসলিম সম্পর্কঃ ধর্ম ও সংস্কৃতি

মুসলমানরা, মধ্যযুদের প্রারম্ভকাল থেকে আরব, তুরস্ক, ইরান-তুরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। অতঃপর এ দেশকে তারা ভালোবেসেছে মনে-প্রাণে, তাদের চিরন্তত আবাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করেছে এ দেশকে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের হিন্দুর সাথে পাশাপশি বসবাস করে এসেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক নির্মম সথ্য এই যে, হাজার বছরেরও বেশী কাল হিন্দু-মুসলমান একত্রে পাশাপাশি বাস করে, একই আকাশের নীচে একই আবহাওয়ায় পালিত বর্ধিত হয়েও এ দু’টি জাতি যে শুধু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি, তাই নয়, বরঞ্চ তাদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য এ সুদীর্ঘকালের মধ্যে তারা উভয়ে কখনো কখনো মিলেমিশে কাজ-কর্ম করেনি, একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়নি, তা নয়। তবে তা বিশেষ স্থান, কাল ও ক্ষেত্র বিশেষে –জাতি হিসাবে নয়, প্রতিবেশী হিসাবে। সেও আবার সামরিকভাবে। তাদের মধ্যে সৌহার্দ ও একাত্মতার স্থায়ী শিকড় বদ্ধমূল হতে পারেনি কখনো। এই যে পাশাপাশি বসবাস করেও উভয়ের মধ্যে দূরত্ব অক্ষুণ্ণ রইলো এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেনঃ

এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস ও সমাজবিধান সম্পূর্ণ বিপরীত… হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যের প্রেরণা পায় সংস্কৃত থেকে আর মুসলমানরা পায় আরবী-ফারসী থেকে। মুসলমানদের ধর্মের গোঁড়ামিও মুসলমানদেরকে তাদের প্রতি সেরূপ বিরূপ করেছিল। … হিন্দুরা যাতে মুসলমান সমাজের দিকে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখানে না পারে, তার জন্যে হিন্দু সমাজের নেতাগণ কঠোর বিধানের ব্যবস্থা করেছিলেন। (রমেশ চন্দ্র মজুমদারঃ বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, পৃঃ ২৪২-৪৩ ও ৩৩৪-৫০)।

উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ব্যবধান, তা দূরীভূত হয়ে আত্মীক সম্পর্ক গড়ে না উঠার কারণ বর্ণতা করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেনঃ

“সকলের চেয়ে গভীর আত্মীয়তার ধারা নাড়ীতে বয়, মুখের কথায় বয় না। যাঁরা নিজেদের এক মহাজাত বলে কল্পনা করেন, তাঁদের মধ্যে নাড়ীর মিলনের পথ ধর্মের শাসনে চিরদিনের জন্য যদি অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাঁদের মিলন কখনই প্রাণের মিলন হবে না। -[রবীন্দ্র রচনাবলী (শতবার্ষিকী সংস্করণ), ১৩’শ খন্ড-পৃঃ ৩০৮]

অতএব দেখা যাচ্ছে এই যে পার্থক্য এবং দূরত্ব এ শুধু বাহ্যিক ও কৃত্রিম নয়। এর গভীর মূলে রয়েছে উভয়ের পৃথক পৃথক ও বিপরীতমুখী ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি। ভারতের এককালীন বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা H.V. Hodson ভারতের হিন্দু-মুসলমান দু’টি জাতি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেনঃ

“…..এখানে বিরাট দু’টি সম্প্রদায় আছে যারা বসবাস করে একই দেশে বলতে গেলে এই গ্রামে, এই সুখ-দুঃখের অংশিদার হয়ে এবং একই সরকারের অধীনে। মূল জাতির দিক দিয়ে আলাদাও নয়। কারণ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান তাদের প্রতিবেশী হিন্দুর উর্ধ্বতন পূর্ব পুরুষদেরই বংশস্ভূত। তথাপি পৃথক ও  স্বতন্ত্র। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিত-পদ্ধতির দিক দিয়েই স্বতস্ত্র নয়
, বরঞ্চ জীবনের সামগ্রিক বিধান ও মানসিক দৃষ্টিভংগীর দিক দিয়েও স্বতন্ত্র। প্রত্যেক দল বা সম্প্রদায় স্থায়ী বংশভিত্তিক। না তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাহের প্রচলন আছে, আর না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা”। -(H.V. Hodson the Great Divide, p. 10)।

বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান আবহমানকাল থেকে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে। ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেনঃ

“মুসলমানেরা মধ্যযুগের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যণ্ত স্থানবিশেষে ১৩০০ হইতে ৭০০ বৎসর হিন্দুরা সংগে পাশাপাশি বাস করিয়াও ঠিক পূর্বের মতো আছে। … অষ্টম শতাব্দীর আরম্ভে মুসলমানেরা যখন সিন্দুদেশ জয় করিয়া ভারতে প্রথম বসতি স্থাপন করে, তখনও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদগুলি ছিল, সহস্র বর্ষের পরেও এক ভাষার পার্থক্য ছাড়া ঠিক সেইরূপই ছিল। ….বর্তমান শতান্দীর প্রথম হইতে আমাদের দেশে একটি মতবাদ প্রচলিত হইয়াছে যে, মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতিরক মিশ্রণের ফলে উভয়েই স্বাতন্ত্র্য হারাইয়াছে। এবং এমন একটি নতুন সংস্কৃতি গঠিত হইয়াছে যাহা হিন্দু সংস্কৃতি নহে, ইসলামীর সংস্কৃতি নহে –ভারতীয় সংস্কৃতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারিকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি এবং শেষভাগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় প্রভৃতি বাংলার তদানীন্তন শ্রেষ্ট নায়কগণ ইহার ঠিক বিপরীত মতই পোষণ করিতেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য এই বিপরীত মরেই সমর্থন করে। ১২০০ খৃষ্টাব্দে হিন্দুসমাজ ও হিন্দুধর্ম যাহা ছিল, আর ১৮০০ খৃষ্টাব্দে হিন্দুধর্ম ও সমাজ যাহা হইয়াছিল, এই দুয়ের তুলনা করিলেই সত্যতা প্রামণিত হইবে। -(রমেশ চন্দ্র মজুমদারঃ বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, পৃঃ ২৪২-৪৩ ও ৩৩৪-৫০)।

মুসলমান ভারতে আসার পর হতে সহস্রাধিক বৎসর হিন্দুদের সাথে বসবাস করারপর উভয়ে মিলে এক জাতি গঠনের পরিবর্তে উভয়ের স্বাতন্ত্র্য অধিকতর সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় হয়েছে। কে. এম. পান্নিকর তাঁর Survey of India History গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ “ভারতে একটি ধর্ম হিসাবে ইসলাম প্রবর্তনের প্রধান সামাজিক পরিণামফল দাঁড়ালো এই যে, সমাজ দেহকে খাড়াভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করা হলো। তের শতকের পূর্বে হিন্দু সমাজে যেসব বিভাগ দেখা দিয়াছিল, সেগুলির প্রকৃতি ছিল কিছুটা আনুভূতিক। তখন বৌদ্ধধর্মের পক্ষে এসব উপধর্মগুলিকে হজম করা সম্ভব ছিল এবং কালেবদ্রে এর হিন্দুধর্মের পরিসীমার মধ্যে আপন আপন আঞ্চলিক আবাস গড়ে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে ইসলাম ভারতীয় সমাজকে আগাগোড়া স্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত করে। এবং আজকের দিনরে ভাষায় আমাদের নিকট যা দুই তাত্বি বলে পরিচিত হয়েছে, তা সেই প্রথম দিনেই জন্মগ্রহণ করে। এরপর থেকে একই ভিত্তির উপর দু’টি সমান্তরাল সমাজ খাড়াভাবে বিভক্ত অবস্থায় বিরাজ করতে থাকে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দু’টি সমাজ পৃথক ও স্বতন্ত্র হয়ে গেল এবং পৃথকভাবেই আত্মপ্রকাশ করলো। উভয়ের মধ্যে কোনরূপ সামাজিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ বা জীবনের ক্ষেত্রে আদান-প্রদান রইলো না। অবশ্য হিন্দুত্ব থেকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ অবিরাম চলতে থাকলো। কিন্তু সংগে সংগে নতুন মতবাদ ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব এবং নতুন প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তার মনোভাব সৃষ্টি হলো। ফলে হিন্দু সমাজদেহ ক্রমশঃ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর শিক্ষাপ্রাপ্ত পন্ডিতপ্রবর ডক্টর সৈয়দ মুজতাব আলী যে নির্মম সত্যউক্তি করেছেন, তা পাঠকবর্গকে পরিবেশন করা যেতে পারে। তিনি বলেনঃ

“বড় দর্শন নির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্র-পৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর শত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিনউত পাশ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় শত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিয়-প্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু-আলী সিনা, আলগাজ্জালী, আবু রুশদ ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চা হলো, তার কোন সন্ধানই পেলেন না। এবং মুসলমান মওলানাও কম গাফলতি করলেন না –তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুস্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। …শ্রীচৈতন্য নাকি ইসলামের সংগে পরিচিত ছিলেন …কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নব-যৌবনের পথে নিয়ে যাওয়ার। ….মুসলমান যে জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন এনেছিলেন এবং পরবর্তী যুদে বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরংজেব পর্র্যন্ত মগোল জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র করি-পন্ডিত-ধর্মজ্ঞ-দার্শনিক এ দেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব-পান্ডিত্য উজাড় করে দিলেন, তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত দার্শনিকেরা কনামাত্র লাভবান হননি… হিন্দু পন্ডিতের সংগে তাঁদের কোনও যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি”। -(বড়বাবু, সৈয়দ মুজতাব আলী)।

ইসলামী তৌহিদের চিত্তচাঞ্চল্যকর বিপ্লবী বাণী, স্রষ্টা সমীপে সর্বস্ব নিবেদন ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও প্রেম, তার সাম্যের বাণী ও সুবিচার, তার গণতান্ত্রিক আদর্শ মানুষের মনে যে আবেদন-পুলক সৃষ্টি করে তা ছিল অপ্রতিরোধ্য। ফলে দলে দলে হিন্দুগণ ইসলামের সুশীতল ছায়ায়, আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। তারপর হিন্দুধর্মের কাজ হলো আত্মরক্ষার। ইসলামের বাণীর মুখে আত্মরক্ষা তেমন সহজও ছিলনা। তাই ভারতের এখানে সেখানে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণী প্রচারিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে যুগে যুগে –রামানন্দ, একলব্য, দাদু, নানক কবীর প্রভৃতি সাধক-প্রচারকদের আবির্ভাবে। ইসলামের অদ্বৈতবাদকে ভিত্তি করে তারা হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন ইসলাম থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। অথবা ইসলাম ধর্মে হিন্দুত্বের প্রভাব ও অনুপ্রবেম ঘটিয়ে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মতো ইসলামকে সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বের মুখে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা করেছেন মাত্র।

এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ বলেনঃ

“এ আন্দোলনগুলি অবশ্য বিশ শতকের রাজনীতিক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধায় আসে এবং 
‘জাতীয়তাবাদী’ নামাংকিত করে হিন্দু রাজনীতিকেরাই এক ভারতীয় সংস্কৃতির ধূঁয়া তোলে, তাছাড়া অনতিকাল মধ্যে এগুলো ইসলাম ও দন্ডধর মুসলিম শক্তিকে বাধা দেবার ও সম্ভব হলে বিতাড়িত করবার সত্রিয় প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে উঠে। তখন তাদের রাজনীতিক ভূমিকা ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন এসব সমন্বয় সাধনার বুলি স্পষ্ট হয়ে উঠে। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ২৫)।

আবদুল মওদূদ, আহমদ শরীফ প্রণীত ‘মুসলিম পদ সাহিত্য’ (সাহিত্য পত্রিকা, বর্ষা সংখ্যা, ১৩৬৭) –এর বরাত দিয়ে বলেনঃ

“শিক বা বৈষ্ণব আন্দোলনে যে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল –তার বহু প্রমাণ আছে। রাষ্ট্রীক প্রয়োজনে বাদশাহ আকবর থেকে গান্ধীর কাল পর্যন্ত সমন্বয় সাধনের পথ অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর ‘রামধুন’ সংগীত ও নজরুলের কয়েকটি কবিতাকে শেষ প্রয়াস ধরে নেয়া যেতে পারে”।

অতঃপর তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে এগুলো ছিল সর্বগ্রাসলোভী ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের অভিনব প্রয়াস –এ পথেই অঝগরের মতো ইসলামকে লীন করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রীক প্রয়োজনে এ ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতির ঐক্যের মহামন্ত্র অতীতে উদগীত হয়েছিল এবং এখনও হয়ে থাকে। (আবদুল মওদূত-ঐ-পৃঃ২৫)।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, নিছক রাজনৈতিক কারণে সম্রাট আকবর থেকে আরম্ভ করে বিংশতি শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ে জগাখিচুড়ি তৈরী করে এক ভারতীয় জাতি ও সংস্কৃতি অথবা এক বাঙ্গালী জাতি ও সংস্কৃতি বলে চালাবার যে হাস্যকর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তা জাল ও অচল মুদ্রার মতো সত্যনিষ্ঠদের দ্বারা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। কারণ তা ছিল অস্বাভাবিক, অবান্তর ও অসম্ভব।

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ

বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ জাতি হিন্দু ও মুসলমান দু’টি স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির ধারক বাহক –এ দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, দু’টি স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাসী একই দেশে মিলেমিশে, শান্তিতে ও নির্বিবাদে বসবাস করতে পারলোনা কেন। পৃথক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সদ্ভাব, সৌহার্দ ও মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি কেন? এর জন্য দায়ী কে? তারা কি উভয়ে না কোন একটি দল? এর সঠিক জবাব ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হবেনা নিশ্চয়।

হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সংঘর্ষের মূল কারণ যে প্রধানতঃ রাজনৈতিক তাতে সন্দেহ নেই। এ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে জন্যে ধর্মের নামে স্বজাতিকে ডাক দেয়া হয়েছে, প্রতিপক্ষকে ধর্ম বিনষ্টকারী পরস্বাপহরণকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিদেশী-হানাদার, নরসন্তা, নারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিদেশী-হানাদার, নরহন্তা, নারী ধর্ষণকারী, প্রতিমা ও মন্দির ধ্বংসকারী বলে চিত্রিত করে স্বজাতির মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ উপমহাদেশে হিন্দুশাসনের পরিবতর্থে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা হিন্দুজাতি মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। অষ্টম শতকের পর থেকে পরবর্তী কয়েক শতক পর্যন্ত মুসলিম সামরিক শক্তির, বলতে গেলে যৌবন-জোয়ার জলতরংগ দেশদেশান্তর ব্যাপী প্লাবন এনে দিচ্ছিল। এ অপ্রতিহত শক্তির মুখে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকতে পারেনি বলে মুসলিম শাসন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাই বলে এ দেশের বিজিত হিন্দুগণ হৃত রাজ্যের জন্য দুঃখ-অপমানে-লজ্জায় মুসলিম শাসন অন্তর দিয়ে মেনেও নিতে পারেনি। তাদের অন্তরাত্মা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। বহু শতকের পুঞ্জিভূত বিক্ষোভ ও প্রতিহিংসার বহ্নির বিস্ফোরণ ঘটেছিল মধ্যভারতে রাজপূত, মারাঠা, শিখদের বিদ্রোহের মাধ্যমে এবং তা সার্থক হয়েছিল ১৭৫৭ সালে সিরাজদৌলার পতনে। তারপর থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত দেড় শতাব্দী যাবত মুসলমানদের জীবনে নেমে এসেছিল চরম দুর্দিন। হিন্দু ও ইংরেজদের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে তাদেরকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে উৎখাত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা ও কৌশল অবলম্বন করা হয়। এ সময়কালে হিন্দুজাতি ইংরেজদের ভূয়সী প্রশংসা ও বিগত মুসলিম শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে অকথ্য কুৎসা রটনা করেছে। বাংলা সাহিত্য ও কবিতা ইসলাম ও মুসলমানদের কাল্পনিক কুৎসা রটনায় ভরপুর হয়ে আছে। কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রংগলাল বন্দোপধ্যয়, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যয়, নবীনচন্দ্র এবং সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় থেকে শুরু করে ছোটো-বড়ো সকল হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন ইসলাম ও মুসলমানদের চরিত্রে কলংক আরোপ করাকে। অনেকের ধারণা মুসলমানদের চরিত্র বিকৃতকরণের ব্যাপারে শরৎপন্দ্র চট্টোপাধ্যয় সকলের পিছনে, কিন্তু তথাপি তাঁর কলমও কম বিষোদগার করেনি।

ভারত উপমনাদেশে হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য কম চেষ্টা-সাধনা হয়নি। এ ধরনের মিলনের প্রচেষ্টা যখন চলছিল, সে সময়ে শরৎবাবুর লিখনী মুসলমানদের খোঁচা দিতে ভুল করলো না, তিনি তাঁর ‘দিক কয়েকের কাহিনী’ শীর্ষক প্রবন্ধের এক স্থানে বলেন-

“…শুনিতে পাইলাম হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি একদিন জাতীয় সহাসভার মধ্যে সুসম্পন্ন হইয়া গেল। সবাই বাহিরে আসিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বলিতে লাগিল –যাক বাঁচা গেল, চিন্তা আর নাই। নেতারা হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান করিয়া দিলেন, এবার শুধু কাজ, শুদু দেশোদ্ধার। প্রতিনিধিরা ছুটি পাইয়া মুখে দলে দলে টাঙ্গা, এক্কা এব মোটর ভাড়া করিয়া প্রাচীন কীর্তিস্তম্ভ সকল দেখিতে ছুটিলেন। সে ত আর এক আধটা নয়, অনেক। সংগে গাইড, হাতে কাগজ-পেন্সিল –কোন কোন মসজিদ কয়টা হিন্দু মন্দির ভাঙ্গিয়া তৈয়ার হইয়াছে, কোন ভগ্নস্তূপের কতখানি হিন্দু ও কতখানি মোসলেম, কোন বিগ্রহের কে কবে নাক এবং কান কাটিয়াছে ইত্যাদির বহু তথ্য ঘুরিয়া ঘুরিয়া সংগ্রহ করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। অবশেষে শ্রান্ত দেহে দিনের শেষে গাছতলায় বসিয়া পড়িয়া অনেকেরই দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সহিত মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিতে লাগিল –উঃ হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি”। -(বিজলী ২৫ আশ্বিন, ১৩৩০)।

চট্টোপাধ্যয় মহাশয় আরও বলেন,

-ইংরেজেরদ আর যাহাই দোষ থাক, -যে মন্দিরের প্রতি তাহার বিশ্বাস নাই তাহারও চূড়া ভাঙে না, যে বিগ্রহের সে পূজা করে না, তাহারও নাক কান কাটিয়া দেয় না। অতএব যে কোন দেবায়তনের মাথার দিকে চাহিলেই বুঝা যায় ইহার বয়স কত। স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন –‘ওটি অমুক জিউর মন্দির –সম্রাট আওরাংজেব ধ্বংস করিয়াছেন, ওটি অমুক জিউর মন্দির –অমুক বাদশাহ ভূমিসাৎ করিয়াছেন, ওটি অমুক দেবায়তন ভাঙিয়া মসজিদ তৈয়ার হইয়াছে (ইংরেজ কর্তৃক), ইত্যাদির পুণ্যময় কাহিনীতে চিত্ত একবারে মধুময় করিয়া আমরা অকেন রাত্রে আশ্রমে ফিরিয়া আসিলাম।

-(বিজলী, ২৩ কার্তিক, ১৩৩০ সাল)

একই কলমের দ্বারা ইংরেজদের প্রশংসাসহ পুষ্পবর্ষণ করা হচ্ছে এবং অতীতের মুসলমান শাসকদের মুন্ডপাত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হিন্দুমন্দিরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হচ্ছে। তাহলে বলতে হবে হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা প্রহসন মাত্র, তার মধ্যে ঐকান্তিকতার লেশমাত্র নেই।

কবি হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যয় ইংরেজ প্রভুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় গেয়ে উঠলেন-

“না থাকিলে এ ইংরাজ

ভাত অরণ্য আজ –কে শেখাতো, কে দেখাতো

কে বা পথে লয়ে যেতো

যে পথ অনেক দিন করেছ বর্জন”।

-(শতাব্দী পরিক্রমা, ডঃ হাসান জামান সম্পাদিত, পৃঃ ২৮৪)

ঊনবিংশ শতকের প্রথম পাদে হিন্দু জমিদার ও কোম্পানী শাসনের দ্বারা বাংলার মুসলমান নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও জর্জরিত হচ্ছিল এবং তার প্রতিবাদে বাংলায় ফারায়েজী আন্দোলন ও সাইয়েদ তিতুমীরের আন্দোলন প্রচন্ড আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে সাইয়েদ আহমদ শহীদের জিহাদী আন্দোলন সারা ভারতে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অতঃপর ভারতের প্রথম আযাদী আন্দোলন শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। এ সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার ফলে ভারতীয় মুসলমান ইংরেজদের কোপানলে পড়ে কোন অসহনীয় জীবন যাপন করছিল, তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। জেল, ফাঁসী, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং ইংরেজ কর্তৃক অন্যান্য নানাবিধ অমানুষিক-পৈশাচিক অত্যচারে মুসলিম সমাজদেহ যখন জর্জরিত, সে সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় লিখনীর নির্মম আঘাত শুরু করেন মুসলিম জাতির জর্জরিত দেহের উপর। তিনি তাঁর আনন্দমঠ, রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, দেবী চৌধুরী প্রভৃতি উপন্যাসগুলিতে মুসলমানদের বিরুদ্দে যে বিষোদগার করেছেন তাতে পাঠকের শরীর রোমাঞ্চিত হবারই কথা। তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং তাঁর বর্ণনামতে মুসলমান কর্তৃক ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস’, ‘হিন্দু নারী ধর্ষণ’ প্রভৃতি উক্তির দ্বারা হিন্দুজাতির প্রতিহিংসা বহ্নি প্রজ্জলিত করার সার্থক চেষ্টা করা হয়েছে। ১৮৯৮ সালে মুসলিম এডুকেশান সোসাইটি অধিবেশনে নবাব নবাব আলী চৌধুরীর উদ্যোগ বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারণার তীব্র প্রতিবাদ করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত করে হিন্দু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে দেয়া হয়। কোন পত্রিকায় তা ছাপা হয়নি, শুধুমাত্র ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করা হয়। -(Bengali Muslim Public Opinion as reflected in the Bengal Press-1901-30: Mustafa Nural Islam PP.141-42).

সাহিত্যের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারণার দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু উদ্ধৃতি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

“রাজপুত্রী বলিলেন –আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের লাতি মার। কার লাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি”। -[রাজসিংহ (১ম খন্ড( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে চিত্রদলনা।]

“ঔরঙ্গজেবের দুই ভগিনী- জাহানারা ও রওশনারা। জাহানারা শাহজাহাঁর বাদশাহীর প্রধান সহায়। …তিনি পিতার বিশেষ হিতৈষিনী ছিলেন। কিন্তু তিনি যে পরিমাণে এ সকল গুনবিশিষ্টা ছিলেন, ততোধিক পরিমাণে ইন্দ্রিয় পরায়ণা ছিলেন। ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য অসংখ্য লোক তাঁহার অনুগতির পাত্র ছিল। সেই সকল লোকের মধ্যে ইউরোপীয় পর্যটকেরা এমন এক ব্যক্তির নাম করেন যে, তাহা লিখিয়া লেখনী কলুসিত করিতে পারিলাম না!”–(রাজসিংহ, ২য় খন্ড, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ জেবউন্নিসা।)

“ঔরঙ্গজেবের তিন কন্যা। …জ্যেষ্ঠ জেব-উন্নিসা বিবাহ করিলেন না। পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মত পুষ্পে মধু পান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন”। -(রাজসিংহ, ২য় খন্ড দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ জেব-উন্নিসা।)

সতীসাধ্বী মুসলিম রমীণদের চরিত্রে কতকানি কলংক আরোপ করা হয়েছে তা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই স্বীকার করবেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘লেখনী কলুষিত করিতে পারিলেন না’। -বলে খেদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একজন লোকের নিছক মুসলিম বিদ্বেষের কারণে, বিবেক ও রুচি কতখানি বিকৃত ও ব্যাধিগ্রস্থ হলে কোন অন্তঃপরবাসিনী পর্দানশীল সতীসাধ্বী দ্বীনদার খোদাভীরু মুসলিম রমণীর চরিত্র তিনি এমনভাবে কলংকিত করতে পারেন, তা পাঠকের বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়।

পূণ্যবতী জেব-উন্নিসার চরিত্র অধিকতর জঘন্যভাবে চিত্রিত করতে বঙ্কিম কণামাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। না করবারই কথা। মুসলমানের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষে আগাগোড়া বাদশাহ আওরংজেব-আলমগীর ও তাঁর বিদূষী কন্যা জেন-উন্নিসার চরিত্র জঘন্যরূপে বিকৃত করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মনের সাধ মিটিয়েছেন।

‘দুর্গেশনন্দিনী’ গ্রন্থে জগৎসিংহের সাথে আয়েশা নাম্নী এক কল্পিতা মুসলিম মহিলার অবৈধ প্রণয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। স্যার যদুনাথ সরকার ‘দুর্গেশনন্দিনী’ সম্পর্কে বলেনঃ “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে সত্য ইতিহাস কতটুকু আছে? মানসিংহ, জগৎসিংহ, কুৎলু খাঁ, খাজা ইসা, উসমান –ইহারা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ ….ইহা ভিন্ন ‘দুর্গেশনন্দিনী’র আর সব কথা কাল্পনিক।….

আয়েশা, তিলোত্তমা, বিমলা সকলেই কাল্পনিক। এগুলি আসিয়োছে ঐতিহাসিক নামজাদা একজন ঘোর কাল্পনিক হাসেবের লেখা হইতে, তিনি কাপ্তান আলেকজান্ডার ডাও (Alexnder Dow)। এই সাহেবটি ফিরিশতা রচিত হিন্দুস্থানের ইতিহাস ইংরাজীতে প্রায়শঃ অনুবাদ করিয়া দিতেছেন বলিয়া এবং নিজ গ্রন্থের নামপত্রে ফিরিশতার নাম সংযোগ করিয়া দিয়া অপর্যাপ্ত মেকী কথা চালাইয়াছেন, যাহা ফিরিশতাতো লেখেন নাই, এমনটি, কোনও পারসিক লেখকের পক্ষে সেরূপ সম্ভব ছিল না”। -[কঙ্কিম রচনাবলী, ষষ্ঠ প্রকাশ ১৩৮২ (উপন্যাস প্রসংগ) পৃঃ ২৯-৩০।]

একথা সত্য যে, মুসলমানদের ইতিহাস ও চরিত্র বিকৃতকরণে ইংরেজ এবং হিন্দু উভয়েই বাকপটুতা প্রদর্শন করেছেন। তবে এ ব্যাপারে কে কতখানি অগ্রগামী তা বলা কঠিন।

‘আনন্দমঠে’ বঙ্কিমচন্দ্র মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলছেনঃ “দেখ যত দেশ আছে মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর, কোন দেশের এমন দুর্দশা, কোন দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে ঘাস খায়? কাঁটা খায়? উইমাটি খায়? বনের লতা খায়? কোন দেশে মানুষ শিয়াল-কুকুর খায়, মড়া খায়? কোন দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউদের পেটে ছেলে রাখিয়া সোয়াস্তি নাই? পেট চিরে ছেলে বার করে। ….আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেশাখোর নেড়েরদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’–(‘আনন্দমঠ’, প্রথম খন্ড, দশম পরিচ্ছেদ।)

বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর মন্ত্রশিষ্যগণ তাঁদের সাহিত্যে, কবিতায়, প্রবন্ধে মুসলমানদের নামের পূর্বে ‘নেড়ে’, ‘পাতি নেড়ে’, ‘স্লেচ্ছ’ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার না করে লেখনী ধারণ করা পাপ মনে করতেন। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে জগৎসিংহ ও কল্পিত আয়েশাকে পরস্পর প্রণয়াবদ্ধরূপে দেখানো হয়েছে। তবুও আয়েশাকে যবনী বরে আত্মতৃপ্তি লাভ করা হয়েছে। দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদে সমাপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আয়েশা যবনী হইয়াও তিলোত্তমা আর জগৎসিংহের অধিক স্নেহাবশত সহচরীবর্গের সহিত দুর্গান্তঃপুরবাসিনী হইলেন”।

আল্লাহ, কোরআন শরীফ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে উপহাস করে ‘আনন্দমঠে’র চতুর্থ খন্ড, পঞ্চম পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে-

মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, ‘আল্লা-আকবর! এতনা রোজের পর কোরআন শরীফ বেবাক কি বুটা হলো? মোরা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ করি, তা এই তেলককাটা হিঁদুর দল ফতে করতে নারলাম?”

বিপিন চন্দ্র পাল ‘আনন্দমঠ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ

“আনন্দমছে তিনি দেশমাতৃকাকে মহাবিষ্ণুর বা নারায়ণের অংশে স্তাপন করিয়া আমাদের দেশপ্রীতি ও স্বদেশ সেবাব্রতকে সাধারণ মানবপ্রীতি এবং বিশ্বমানবের সেবার সঙ্গে মিলাইয়া দিয়াছেন। মহাবিষ্ণুকে বা নারায়ণকে বা বিশ্বমানবকে ছাড়িয়া দেশমাতৃকার পূজা হয় না। এ কথাটা আনন্দমঠের একটা অতি প্রধান কথা”। -(নবযুগের বাংলা সাহিত্য, পৃঃ ১০৯)

রমেশচন্দ্র দত্ত ‘ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা’র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় শীর্ষক প্রবন্ধে (১১’শ সংস্করণ, ষষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ১১০) বলেনঃ

“আনন্দমঠের’ সারকথা হলো ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করে উৎপীড়নমূলক মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানো। …শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, ভারতে একটি হিন্দুরাজ্য স্থাপনের আদর্শে ‘আনন্দমঠ’ উদ্দীপ্ত”।

মোটকথা, বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ লিখে একদিকে মুসলমান জাতির বিরুদ্ধে তাঁর স্বজাতিকে ক্ষিপ্ত করে তুলোছেন এবং ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের মাধ্যমে ধর্মের নামে –দেবী দেশমাতৃকার নামে হিন্দুজাতির মধ্যে পুনর্জাগরণের প্রেরণা সৃষ্টি করেছেন। এ পুনর্জাগরণ সম্ভব মুসলিম দলনে এবং ব্রিটিশ শাসনকে এদশে স্বাগতঃ জানিয়ে এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করে –এ ভাবধারা আনন্দমঠের ছত্রে ছত্রে প্রবাহিত। ‘আনন্দমঠের’ বন্দেমাতরম মন্ত্রের সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বংগভংগ রদ আন্দোলনে।

বংগভংগ ও বংগভংগ বিরোধী আন্দোলন যথাস্থানে আলোচিত হবে। তবে এখানে ‘বন্দোমাতরমের’ ভাবাদর্শে যে সন্ত্রাসবাদ জন্মলাভ করেছিল তার কিঞ্চিৎ আভাস দিয়ে রাখি।

আবদুল মওদূদ বলেনঃ

সন্ত্রাসবাদ বাংলার মাটিতে আসন খুঁজে পায়নি উনিশ শতকে এবং ভদ্রলোকদের সহানুভূতিও লাভ করেনি। ১৯০৩ সালের পূর্বে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ লন্ডন থেকে কোলকাতায় প্রত্যাগমন করে উত্তেজনা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, কিন্তু কোন সহানুভূতি পাননি।

….বিফল হ’য়ে তিনি বরোদায় বড়দানা অববিন্দ ঘোষের নিকট গমন করেন। অরবিন্দ ইংলন্ডে উচ্চশিক্ষিত। তিনি তখন গায়কোয়াড় কলেজের ভাইসপ্রেসিডেন্ট ছিলেন। বারীন্দ্র বরোদায় বসে অনুধাবন করেন, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একাঙ্গীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ হবে না। এ জণ্যে তিনি গীতাপাঠের সঙ্গে রাজীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে ‘অনুশীলন সমিতি’র পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষ করতে থাকেন।

“সুযোগ মিললো ১৯০৪ সালে, অরবিন্দ এসে যোগ দিলেন ১৯০৫ সালে। বাংলা বিভাগ কার্যকর হলো, বাঙালী হিন্দু শিক্ষিত সস্প্রদায় বিক্ষেভে ফেটে পড়লো। ‘বংগমাতার’ অংগচ্ছেদ বলে বিভাগটার ধর্মীয় রূপ দেয়া হলো এবং সমগ্র হিন্দু বাংলা আন্দোলনে মেতে উঠলো”। -(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতি রূপান্তর, পৃঃ ২০২।)

‘আনন্দমঠের’ বন্দেমাতরম মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ কেই বাংলার মাটিতে সন্ত্রাসবাদ জন্মলাভ করে। অরবিন্দ ঘোষের স্বীকৃতিই তার প্রমাণ। ১৯০৭ সালের ১৬ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্রের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ লিখেন। তার থেকে কিঞ্চিত উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হলোঃ

“The earlier Bankim was only a poet and stylist –the latr Bankim was a saint and a nation-builder”.

অর্থাৎ, ‘প্রথম দিককার বঙ্কিম একজন কবি ও শিল্পী –শেষ দিককার বঙ্কিম- ঋষি ও জাতি গঠনকারী’। তিনি আরও বলেন-

“It was thirty two years ago that Banking wrote his great song The Maitra had been given and in a Single Day a whole people had been converted to the religion of patriotism. The mother had revealed herself A great nation which has had that vision can never again be placed under the foot of the conqueror”.

অর্থাৎ “বত্রিশ বছর বঙ্কিম তাঁর বিখ্যাত ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত রচনা করেছিলেন। মন্ত্র ফুঁকে দেয়া হলো, আর একদিনেই গোটা জাতি দেশমাতৃকার ধর্মে দীক্ষিত হ’য়ে গেল। দেশমাতা আত্মপ্রকাশ করলেন ….সেই স্বপ্নসাধ পোষণ করতো যে এক বিরাট জাতি, সে আর বিজেতার পদতলে লুণ্ঠিত হবে না”। -[শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগাল-(বঙ্কিম রচনাবলী গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্কিম পরিচিতি লেখক), পৃঃ ২৫-২৬।]

বঙ্কিম সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের প্রতি বিষোদগীরণের বিরুদ্ধে বিংশতি শতকের প্রথম পাদে মুসলিম পত্র-পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। বরঞ্চ হিন্দুদের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবাদ ও হিংস্রতা ক্রমশঃ বেড়েই চলছিল। কোলকাতা থেকে প্রকাশিক মাসিক পত্রিকা ইসলাম প্রচার-এর বাংলা ১৩১৪ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় (১৯০৭ খৃঃ) নিম্নের চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়ঃ

“ইংরেজ এবং মুসলমানদের উৎখাত করার সংকল্প নিয়ে সর্বশ্রেণীর হিন্দুদেরকে –উচ্চশিক্ষিত থেকে স্কুলের ছাত্র পর্যন্ত –লাঠিখেলা ও কুস্তি শিক্ষার জন্যে দলে দলে ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের ভয়াবহ গতিবিধি সারা বাংলার বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে। এসব ঠগেরা কুমিল্লায় একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে, জামালপুরে দু’জনকে জবাই করেছে এবং হিন্দু ও মুসলমান ফকীর সন্যাসীদের ছদ্মবেশে সারা বাংলায় আতংক ছড়াচ্ছে। মৌলভীর ছদ্মবেশে তারা হিন্দুদের লুন্ঠন করার, হিন্দু বিধবাদের বিবাহ করার, এবং হিন্দু নারী ধর্ষণের জন্যে মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করছে এই বলে যে, এ ব্যাপারে সরকার এবং ঢাকার নবাবের কাছ থেকে নিশ্চিত সাহায্য পাওয়া যাবে।

‘ইসলাম প্রচারকের’ এই সংখ্যায় আরও সংবাদ পরিবেশিত হয় যে, পাঞ্জাবে হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা এবং বিশেষ করে আর্যসমাজী কংগ্রেসী টাউটদের তৎপরতার বিরুদ্ধে মুসলিম সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন যে, এসব হিন্দু সন্ত্রাসবাদ ও অরাজকতার সাথে মুসলমানদের কোনই সংস্রব সম্বন্ধ নেই।

এ অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ’। এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মূল উৎস কঙ্কিম সাহিত্য। বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলমানদেরকে ‘যবন’, ‘স্লেচ্ছ’, ‘নেড়ে’, ‘পাতি নেড়ে’ প্রভৃতি ইতর ভাষায় আখ্যায়িত করে এ যবন ও স্লেচ্ছ নিধন হিন্দুজাতির ব্রত ও পূণ্যকর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে। ‘বন্দোতরম’ মন্ত্র এ যবন নিধনে তাদেরকে প্রেরণা যোগায়। কিন্তু বিংশতি শতাব্দীর প্রথম পাদে একদিকে যখন হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান হচ্ছিল সারা দেশে, তখন হিন্দু-মুসলিমের যুক্ত বৈঠক ও সভাসমিতিতে অনিবার্যরূপে গাওয়া হতো ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত। মুসলমানের বহু আপত্তি ও প্রতিবাদ সত্বেও তাঁরা নিবৃত্ত হননি।

মাসিক পত্রিকা ‘শরিয়তে ইসলাম’ বাংলা ১৩৩৫ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় (১৯২৮ খৃঃ) হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সভায় ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত বন্ধ কররা দাবী জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন। The Mussalman-এর সম্পাদক মৌলভী মজিবর রহমান কংগ্রেসের জাতীয় কমিটির নিকটে সভাসমিতিতে ‘বন্দোমাতরম’ নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু এতেও কোনই ফল হয়নি।

হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের আর একটি কারণ হলো মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার এবং হিন্দু জমিদারীর অধীনে ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলমানদের গো-কোরবানীতে বাধা দান। এ নিয়ে বহু বাদ-প্রতিবাদের কোন লাভ হয়নি।

মুসলিম ভারতের উপরে চরম আঘাত হানে আর্য সমাজীদের ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ আন্দোলন। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা লালা হরদয়াল কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতিতে বলা হয়, যা ১৯২৫ সালের ২৫শে জুলাই Times of India-তে প্রকাশিত হয়ঃ

“হয় মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হবে, নতুমা জীবন ও মানসম্মানসহ ভারত পরিত্যাগ করতে হবে”। আর্য সমাজের স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রধান শিষ্য সত্যদেব একই সময়ে ঘোষণা করেনঃ

“আমরা শক্তি অর্জন করার পর মুসলমানদের নিকটে এ শর্তগুলি পেশ করব, ‘কোরআনকে আর ঐশী গ্রন্থ হিসাবে চলবে না, মুহাম্মদকে খোদার নবী বলে স্বীকার করা চলবে না, মুসলমানী অনুষ্ঠান পর্বাদি পরিত্যাগ কের হিন্দু পর্ব পালন করতে হবে। মুসলমানী নাম পরিত্যাগ করে রামদ্বীন, কৃষ্ণখান, ইত্যাদি নাম রাখতে হবে। আরবী ভাষায় উপাসনার পরিবর্তে হিন্দী ভাষায় উপাসনা করতে হবে”। A History of the Freedom Movement পৃঃ ২৬২ থেকে গৃহীত। -(Mustafa Nurul Islam: Bengali Muslim Public Opinion as refcted in the Bengal Press 1901-1930, 0=p. 125)।

রাজনৈতিক হাংগামার প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল বোম্বাইয়ে যখন হিন্দুনেতা বালগঙ্গাধর তিলক দুটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসবকে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু জনমত ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত করতে থাকেন। এ দুটি উৎসবের একটি হলো ‘গণেশের’ পূজা আর দ্বিতীয়টি ‘শিবাজী’ উৎসব। স্কুল কলেজের যুবকদের সামরিক শিক্ষা দিয়ে, এ দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে, হিন্দু ক্ষাত্র শক্তিকে জাগ্রত করা হয়। তিলক শিবাজী উৎসবে পৌরহিত্যকালে ভগবদগীতার উদ্ধৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন যে, আত্মকারণে না হলে জাতি বা দেশমাতার কারণে গুরু ও আত্মীয় হত্যায় কোন পাপ হয় না। তাঁর শিক্সায় স্কুল কলেজের ছাত্র শিক্ষক উদ্দীপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে গুপ্ত সমিতি গঠন করতে থাকে হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য।

বংগবংগের পর ১৯০৬ সালে এ আন্দোলন হঠাৎ জোরদার হয়ে উঠে এবং সারা ভারতব্যাপী ‘শিবাজী উৎসব’ পালন করে হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হতে থাকে। এ উৎসবে সকল প্রখ্যাত হিন্দু সমাজনেতা, রাজনীতিবিদ, কবি সাহিত্যিক সানন্দে যোগদান করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ‘শিবাজী উৎসব’ লিখে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগদান করেন। তিনি ‘শুভশঙ্খনাদে জয়তু শিবাজী’ উচ্চারণ করে এ ‘ধ্যানমন্ত্রে’ দীক্ষা গ্রহণ করেনঃ

ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-

দরিদ্রের বল।

‘এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন

করিল সম্বল।

(Indian Sedition Committee Report, 1918, p. 2; B.B. Misra: the Indian Middle class: Their growth, আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ দ্রষ্টব্য)।

বাংলা তথা সারা ভারতে রাজনীতি ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলন একাকার হয়ে গেল। ধর্মীয় উন্মুত্ততা রাজনীতির আবহাওয়াকে করলো বিষাক্ত ও কলুষিত এবং ফলে চারদিকে শুরু হলো হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও সংঘর্ষ। একে অপরের রক্তে হাত রঞ্জিত করতে লাগলো।

খেলাফত আন্দোলন চলাকালে সাময়িকভাবে হলেও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতি সাধিত হয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে হিন্দুজাতি একরকম বলতে গেলে ‘মুসলিম আতংকের’ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ ব্যাধি ছড়াচ্ছিলেন প্রধানতঃ বিপিনচন্দ্র পাল, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, লালা লাজপৎ রায় এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। এ চার ব্যক্তি ছিলেন, ‘শুদ্ধি সংগঠন’ আন্দোলনের উদ্যোক্ত, এবং সংগ্রেসের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় এঁদের অবদান ছিল সর্বাধিক। উপরন্তু এঁরা সারা ভাবতে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দীভাষা প্রবর্তনেরও জোরাদার ওকালতি করেন।

রিয়াজুদ্দীন আহমদ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত কোলকাতার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সুলতানে’ ১৯২৩ সালের জৈষ্ঠ্য মাসে ‘রবীবাবুর আতংক’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে আক্ষেপ করে বলা হয়ঃ

“রবীন্দ্র ঠাকুর পর্যন্ত এ ব্যাধিতে আক্রান্ত বলে আমরা দুঃখিত। তাঁকে এরূপ বলতে শুনা গেছে, ‘ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম শাসন কায়েম হবে। সেজন্য হিন্দুদের মারাত্মক ভুল হবে –খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়া। মহাত্মা গান্ধীকে মুসলমানেরা পুতুলে পরিণত করেছে। তুরস্ক ও খেলাফতের সাথে হিন্দুস্বার্থের কোনই সংস্রব নেই”।

উপসংহারে ‘সুলতান’ বলেন, “অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে আমরা একজন কবি খ্যাতনামা কবি, বিশ্ববিখ্যাত কবি হিসাবে মানি …কিন্তু নিতি রাজনীতিক নন ভারতে মুসলিম শাসনের কল্পিত আতংকে তিনি আতংকিত”।

-(Mustafa Nurul Islam Bengali Muslim Public Opinion as reflected in the Bengali press 1901-1930, pp. 147-48)।

বলতে গেলে, খেলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদানে ঐকান্তিকতা ছিলনা মোটেই, মুসলমানেরা মনে করেছিল এবার হয়তো হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের অবসান ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি।

এস কে মজুমদার তাঁর ‘জিন্নাহ ও গান্ধী’ গ্রন্থে বলেনঃ

“খেলাফত আন্দোলনকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কোন জোরদার বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুসলমানদের কাছে এটা ছিল একটা ধর্মীয় আন্দোলন, ভারত স্বাধীন করার কোন চিন্তা এতে ছিলনা। পক্ষান্তরে গান্ধী এটাকে গ্রহণ করেছিলেন নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে। গান্ধীজী বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কেলাফত আমাদের দু’জনের নিকটে কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল- মওলানা মুহাম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম। আর আমার নিকট হ্ছে, খেলাফতের জন্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে গো-নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নির্ভয় করছি। অর্থাৎ আমার ধর্মকে মুসলমানের ছুরিকা থেকে রক্ষা করছি’।

‘ধর্ম’ বলতে এখানে গান্ধীজী যে ‘গোধর্মই’ বুঝিয়েছেন, তা না বললেও চলে। মুসলমানের ছুরিকা থেকে ‘গোধর্ম’ বা গোজাতিকে রক্ষা করার অর্থ হলো ভারতভূমিতে মুসলমানের গো-কোরবানী চিরতরে বন্ধ করা।

১৮৭০ সাল থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানে যত দাংগা হয়েছে তার খতিয়ান বিবেচনা করলে জানা যাবে যে এসবের প্রত্যক্ষ কারণ (Immediate cause) হচ্ছে এই যে, প্রথম চার বছর হিন্দুর দূর্গাপূজা আর মুসলমানের কোরবানী একই সময়ে, বলতে গেলে, একই দিনে হতো। কথা যদি এই হতো যে, ঠিক আছে, উভয়ে উভয়ের উভয়ের উৎসব পালন করুক –হিন্দুরা দূর্গাপূজা করুক, মুসলমান কোরবানী করুক। কিন্তু তা নয়। মুসলমানরা গো কোরবানী করতেই পারবে না। আর হিন্দু দুর্গাপূজা ত করবেই। বরঞ্চ বিসর্জনের দিনে মসজিদের সামনে দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে মিছিল করে যাবে। ফলে দাংগা হাংগামা ত অনিবার্য। গায়ে পড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, দাংগা-হাংগামা বাধিয়ে মুসলমানকে খুনী আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রায় দেয়া হবে- “বাবা, এখন জানমাল ও মান-সম্মান নিয়ে যে দেশ থেকে এসেছিলে, সেখানে চলে যাও”। এসব পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হচ্ছিল, এ কথা মনে করার সংগত কারণও আছে। পরবর্তীকালে আর্য সমাজীরা এবং হিন্দু মহাসভার নেতাগণ এ কথাই বারবার বলেছেন। কঙ্কিম ‘আনন্দমঠে’ বন্দোমাতরম মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন ‘যবন-স্লেচ্ছ’ নিধনযজ্ঞের আর এদের কথা হলো, ‘হত্যাযজ্ঞের পরে যারা তোমরা বেঁচে আছ, ভারত ত্যাগ করা’।

পরিকল্পিত দাংগা-হাংগামায় হিন্দুপক্ষ সমর্থনের বড়ো সাধ ইংরেজদেরও ছিল। কারণ উনবিংশতি শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলমান চিল তাদের চোখের বালি। ১৮৮৩ সালে জন ব্রাইট লন্ডনে ইন্ডিয়ান কমিটি নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এবং পঞ্চাশ জন ইংরেজ এম পিকে এর সভ্য করেন। ১৮৮৫ সালে অ্যালেন হিউম ভারতীয় সংগ্রেস গঠন করেন। হিউম বাংলা প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। তিনজন ইংরেজ এই কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং তাঁরাই ইংলন্ডে কংগ্রেসের প্রচারকার্য চালিয়ে কংগ্রেসকে একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইংলন্ডবাসীর কাছে পরিচিত করেন। ১৮৮৮ সালে চার্লস ব্রাডল সংগ্রেসের সার্বক্ষণিক বেতনভুক্ত কর্মচারী নিযুক্ত হন। লন্ডনে সংগ্রেসের প্রচারকার্যে নিয়োজিন হন উইলিয়ম ডিগবী। কংগ্রেসের প্রচারকার্যে ১৮৮৯ সালে ব্যয়িত হয় ২৫০০ পাউন্ড। ডিগবী প্রচার করতেন, সংগ্রেস ভারতের সব জাতি, সম্প্রদায় ও শ্রেণীর একমাত্র মুখপাত্র। এমনটি মুসলমানেরও।

হিন্দু-মুসলিম দাংগায় ভারতভূমি যখন রক্তরঞ্জিত হচ্ছিল, সে সময়ে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার না কোন ব্যক্তি, আর না কোন প্রতিষ্ঠান ছিল। ক্নিুত ব্রিটেনের ইন্ডিয়া কমিটি কংগ্রেসকেই সমর্থন করে বলতো, -“ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রীতি অক্ষুণ্ণ আছে”।

ব্রিটেনের ১৯০৫ সালের নির্বাচনে ভারতফেরত বেশ কিছুসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস অফিসার হাউস অব কমন্সের সদস্য হন। তাঁরা ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারী কমিটি গঠন করেন। স্যার হেনরী কটন ছিলেন তার একজন সদস্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয়দের আশা আকাংখা তুলে ধরার দায়িত্ব পালনে গৌরব বোধ করেন তিনি। তিনি প্রচার করতেন, “জাতি ধর্ম নির্বিমেষে সকল ভারতীয় এক জাতীয়তায় গৌরব বোধ করে”। লাহোর, কার্ণাল প্রভৃতি স্থানে যখন প্রচন্ড সাম্প্রদায়িক দাংগা চলছিল এবং বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা লুঠতরাজ দ্বারা বিভীষিকা সৃষ্টি করছিল, তখন হেনরী কটন বলতেন, “মুসলমানদের স্বার্থ হিন্দু সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমর্থিত হয় না”। বংগভংগ রদের ব্যাপারে সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমর্থিত হয় না”। বংগভংগ রদের ব্যাপারে হিন্দুদের দোসর ইংরেজ সাহেবদের আচরণ কি ছিল তা পূর্ববর্তী অধ্যায় আলোচিত হয়েছে।

উপরে বলা হয়েছে যে, খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বংগভংগের পর বাংলা তথা সারা ভারতে হিন্দুজাতির মানসিকতা যেভাবে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে, তারপর –খেলাফত আন্দোলনে তার উপরে যে একটা কৃত্রিম প্রলেপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল তাও ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে। এ সময়ের সবচেয়ে মর্মন্তুদ ও লোমহর্ষক ঘটনা হলো মুসলিম মোপলা সম্প্রদায়ের উপর অমানুষিক ও পৈশাচিক নির্যাতন নিষ্পেষণের।

এ সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী সংবাদ ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু পত্র-পত্রিকা ও নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে হিন্দু মহাসভা ও আর্য সমাজের নেতাগণ প্রকৃত ঘটনাকে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত করে হিন্দুভারতকে দাংগা-হাংগামার সূত্রপাত হয়। ১৯২২ সালে অমৃতসর থেকে ‘দাস্তানে জুলম’ নামে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সাহারনুর থেকে ‘মালাবার কি খুনি দাস্তান’ নামে আর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এ পুস্তিকা দু’টির অধিকাংশ সংবাদ অতিরঞ্জিত, কল্পিত ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে গৃহীত।

প্রথম পুস্তিকায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় তার সারাংশ হচ্ছেঃ

মালাবারের সশস্ত্র মোপলা সম্প্রদায় হত্যা লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক হিন্দদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ প্রভৃতি কাজে লিপ্ত রয়েছে। বলা হয়েছে যে, একজন পুরুষ হিন্দুকে প্রথমতঃ তারা গোসল করিয়ে দেয়। তারপর মুসলমানী কায়দায় তার চুল কেটে দেয় হয়, অতঃপর মুসলমানী কালেমা পড়তে বাধ্য করা হয়। মেয়েদেরকে মোপলাদের পোষাক পরিয়ে দেয়ার পর কান ছিদ্র করে ইয়ারিং পরিয়ে দেয়া হয়।

দ্বিতীয় পুস্তিকায় বলা হয় যে, মালাবারের মুসলমানরা হিন্দুদেরকে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করতে এবং মুসলমান হতে বাধ্য করছে। সম্মত না হলে তাকে ঘরে আবদ্বধ করে তার মুখে গরুর গোশত গুঁজে দেয় হয়। তার আপনজন ও আত্মীয় স্বজনকে তার চোখের সামনে মারধর করা হয়। এতেও মুসলমান হতে রাজী না হলে, তাকে হত্যা করে খন্ড বিখন্ড করে কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং তার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মন্দির ধ্বংস করা হচ্ছে, প্রতিমা চূর্ণ বিচূর্ণ করা হচ্ছে। হিন্দু সন্যাসীদেরকে গরুর কাঁচা চামড়া পরিধান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। -(A. Hamid Muslim Scparalismin India, pp. 158-159): (দাস্তানে জুলম –সেক্রেটারী, মালাবার হিন্দু সহায়ক সভা, অমৃতশহর, ১৯২২)।

হিন্দুজাতির কাছে এই বলে উদাত্ত আহবান জানানো হতোঃ

“হিন্দুজাতি জাগ্রত হও। তেমাদের নিদ্রা তোমাদের মৃত্যু ডেকে আনবে। আত্মরক্ষার জন্যে বদ্ধপরিকর হও। তোমাদের দুর্বলতা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে। লাঞ্ছিত জীবন যাপন অপেক্ষা মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়। তোমাদের ভাইয়ের দুঃখ দুর্দশা তোমাদের নিজেদেরই”। -(A. Hamid Muslim Separation in India, p. 159, দাস্তানে জুলম, ঐ)।

প্রকৃত ঘটনা জানার জন্যে কেন্দ্রীয় খেলাফত সংগঠনের পক্ষ থেকে গঠিত একটি কমিটির উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে যে রিপোর্ট পেশ করে তার সারাংশ নিম্নরূপঃ সরকারী ঘোষণার যে মালাবারের ঘটনাবলীকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়,তা সঠিক নয়। অবস্থা স্বাভাবিক এবং বিদ্রোহের চিহ্নমাত্র নেই। ভারতের অন্যান্য স্থানের মুসলমানের ন্যায় মোপলাগণও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে। কিন্তু স্থানীয় খেলাফত কমিটির সেক্রেটারীকে ধরে এনে একটি গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয়। তার স্ত্রীকে সেখানে এনে তার চোখের সামনে তার চামড়া খুলে ফেলা হয়। তারপর ট্রাফিক আইন ভংগ করার তুচ্ছ অপরাধে মোপলাদের জনৈক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে একজন পুলিশ কনস্টেবল মুখে থাপ্পড় দেয়। অন্য একজন খেলাফত কর্মীকে অন্যায়ভাবে অস্ত্র নির্মাণ অপরাধে জড়িত করা হয়। অবশেষে পুলিশ মোপলাদের গৃহে বলপূর্বক ঢুকে পড়ে তাদের যথাসর্বস্ব লুন্ঠন করে এবং গৃহের মালিকদের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার করে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে পুলিশ তাদের উপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণ করে। মোপলা সম্প্রদায় অসীম সাহসী ও যোদ্ধা ছিল। ফলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তারা জয়ী হয়। ক্ষিপ্ত মোপলারা অতঃপর টেলিগ্রাফ তার ও রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ পর্যন্ত হিন্দুদের সাথে তাদের পূর্ণ সদ্ভাব বজায় ছিল। কারণ খেলাফত কর্মী হলেও তারা ছিল কংগ্রেসী। তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচার করে বেড়ায় এবং হিন্দু মহল্লা ও তাদের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। -(A. Hamid Muslim Separation in India, p. 159-160: কাশফে হাকীকতে মালাবার-বাদাউন, ১৯২৩)।

দু’সপ্তাহ পর বহুসংখ্যক পুলিশ ও সৈন্য বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। ‘বিদ্রোহী’ মোপলাদের সংবাদ সরবরাহ করার জন্যে অধিকাংশ হিন্দু গুপ্তচরের কাজ শুরু করে। এর ফলে মোপলাগণ হিন্দুদের প্রতি রুষ্ট হ’য়ে পড়ে। পুলিশ হিন্দুদেরকে মোপলাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। আর্য-সমাজী কর্মীগণও তাদেরকে সাহায্য করে। পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী মিলিতভাবে মোপলাদের প্রতিশোধ গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদেরকে কাটাতে হয়। শত শত মোপলা বাস্তুহারা ও নিঃস্ব হয় পড়ে। শত শত লোক কারাবরণ করেন এবং দুইশত জনেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় –(A. Hamid: do, p. 160 কাশফে হাকীকতে মালাবার)।

Indian Annual Register-এ বর্ণিত হয়েছে যে, পুলিশ ও সরকারী প্রশাসন বিভাগকে পরাজিন তরে মোপলাগণ খেলাফত কায়েম করে এবং শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। হিন্দুদের পাইকারীভাবে ধর্মন্তরকরণের সংবাদ ভিত্তিহীন। মোপলাগণ বনে জঙ্গলে আত্মগোপন ক’রে গেরিলা তৎপরতা চালায়।

উক্ত রেজিষ্টারে একটি তুলনাহীন বর্বরতার উল্লেখ করা হয়। তা হচ্ছে এবই যে, একশত বন্দী মোপলাদেরকে একটি রেলের মালগাড়ীতে ভর্তি করে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে অন্যত্র পাঠানো হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবার পর দরজা খোলা হলে দেখা যায় ৬৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং অবশিষ্ট মুমূর্ষু অবস্থায়। উক্ত রেজিস্টার মন্তব্য করেঃ এ সময়ের মালাবার ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ের কত যে অমানুষিক লোমহর্ষক ঘটনা অজ্ঞাত আছে, তা একমাত্র ভবিষ্যতেই প্রকাশ করতে পারে –(A, Hamid : Muslim Senaratism in India, p. 160: Indian Annual Register 1922, p. 266)।

এ ঘটনাগুলি সারা ভারতের হিন্দু-মুসলমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুসলিম ভারতে মর্মাহত হয়ে পড়ে এবং  মোপলাদের সাহায্যের জন্যে আবেদন জানায়। চতুর্দিক থেকে অপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হিন্দু সংবাদপত্র ও নেতৃবৃন্দ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে হিন্দুদেরকে উত্তেজিত করতে থাকেন।

সারাদেশে নতুন করে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রথম মহররম উৎসবকে কেন্দ্র করে। ১৯২৩ সালে তার পুনরাবৃত্তি, ঘটে এবং প্রচন্ড সংঘর্ষ ঘটে সাহারানপুরে। এখান নিহতের সংখ্যা তিনশতের অধিক বলা হয়েছে। পরবর্তী বৎসরে আঠারোটি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ৮৬ জন নিহত এবং ৭৭৬ জন আহত হয়। চরম সংঘর্ষ ঘটে কোহাটে। জনৈক হিন্দুকর্তৃক ইসলাম বিরোধী কবিতা প্রকাশনাই এর মূল কারণ। দু’দিন ধরে যে দাঙ্গা চলে তাতে ৩৬ জন নিহত এবং ১৪৫ জন আহত হয়, দোকান-পাট লুণ্ঠিত হয়, এবং প্রায় সত্তর হাজার টাকার ধনসম্পদ বিনষ্ট করা হয়। পর বৎসর ১৯২৫ সালে অবস্থা কিছুটা শান্ত হলেও ১৯২৬ সালে আবার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। এ বৎসর সারাদেশে মোট ৩৬টি দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে দু’হাজার লোক নিহত হ। এ বৎসর দাঙ্গার সূত্রপাত হয় কোলকাতা শহর থেকে মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যবাজনাকে কেন্দ্র করে। পরিস্থিতি আয়ত্তাধীন হবার পূর্বে দু’শ দোকান লুন্ঠিত হয়, বারটি পবিত্র গৃহ ধ্বংস  ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়
, ১৫০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয় এবং হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে চৌদ্দশ’

১৯২৭ সালে সারাদেশে একত্রিশটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়ে পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এবার হতাহতের সংখ্যা এক হাজার ছয়’শ। নিতহের সংখ্যা একশ চল্লিশ।

১৯২৮ সালে অবস্থা কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারী থেমে মে মাসের মধ্যে বোম্বাই শহরে দাঙ্গা সংঘটিত হয় যার ফলে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় এগার শ’। বিগত কোলকাতা দাঙ্গার ন্যায় এখানেও দোকান-পাট লুণ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালে কানপুরে প্রচন্ড দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয় এবং তিনি দিন পর্যণ্ত হত্যা, লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে। জনৈক হিন্দু হত্যাকারীর সম্মানে বলপূর্বক দোকানপাট বন্ধ করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয় বহুসংখ্যক মসজিদ মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং বহু ঘর-বাড়ী অগ্নিদগ্ধ হয়। -(A. Hamid Muslim Srparation in India. P. 162; Cumming Political India, p. 114-17)।

হিন্দু ও মুসলমানের পক্ষ থেকে এসব সংঘর্ষের বিবরণ গান্ধীজীর নিকটে বিবৃত করা হলে তিনি মুসলমানদের ঘাড়েই দোষ চাপান। গান্ধীজী মন্তব্য করেনঃ আমার মনে কোনই সন্দেহ নেই যে, অধিকাংশ কলহে হিন্দুদের স্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়ে। আমার এ মন্তব্য আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ যে, মুসলমানরা স্বভাবতঃই বন্ডা প্রকৃতির এবং হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই ভীরু। আর, যেখানেই ভীরু লোক বিরাজ করে সেখানে সর্বদাই থাকবে, ষন্ডাদল।

(The Indian Quarterly Register, p. 647; A. Hamid: Separation in India, p. 105).

মিঃ গান্ধী হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য ও কলহ দমনে সহায়ক হলেন না। বরঞ্চ তাঁর উপরোক্ত মন্তব্য মুসলমানদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং এটা হিন্দু দাঙ্গাকারী একটা শক্তিশালী সনদ হয়ে পড়ে।

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে হিন্দু মুসলিম অনৈক্য অথবা কলহ-কোন্দল যে অন্তরায় একথা বুঝতে পেরে মিঃ গান্ধী যে বিব্রত হয়ে পড়েননি, তা নয়। তবে হিন্দু মুসলিম মিলনের সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানকল্পে তাঁর কোন চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি।

তিনি একবার বলেন যে, একমাত্র চুক্তি বা প্যাক্টের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিমের স্থায়ী মীমাংসা হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি বলেন, “প্যাক্টের দ্বারা ঐক্য হতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা এক হওয়া যায় না।প্যাক্ট যদি এক হওয়ার ভিত্তি হয়, তাহলে তা হবে একেবারে অর্থহীন, বরঞ্চ তার চেয়েও খারাপ। প্যাক্টের স্বভাবই হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ। প্যাক্ট একে অপরকে নিকটে টানবার বাসনা জাগ্রত করে না, এর দ্বার ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি হয় না, আর তা দালগুলিকে মূল লক্ষ অর্জনে একত্রে বাঁধতেও পারে না। একে অপরকে নিকটে টানার পরিবর্তে চুক্তির অধীন দলগুলি একে অপরের কাছ থেকে যতটা সম্ভব আদায় করবার চেষ্টা করে। সকলের অভিন্ন স্বার্থোদ্ধারের জন্যে ত্যাগ স্বীকারের পরিবর্তে চুক্তির অধীন দলগুলি সর্বধা রক্ষ্য করে যে, একদলের ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা অন্য দলের মঙ্গল সাধিত যেন না হয়। …হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অন্তরের মিল ব্যতীত ‘স্বরা’ শুধুমাত্র স্বপ্নই রয়ে যাবে”।

কিন্তু পরক্ষণেই আবার তিনি বলেন “‘স্বরাজ’ সমস্য অপেক্ষাগো-সমস্যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গোরক্ষা করতে সক্ষমহবো আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারব না”। গান্ধীর এসব উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, ভারতীয় স্বাধীনতা হিন্দুত্বের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলেরই অপর নাম। লাহোরে একটি ঐক্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি পাঞ্জাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার আতংক প্রকাশ করেন। অদূর ভবিষ্যতে পাঞ্জাব একটি রণদক্ষ জাতির আবাসভূমি হয়ে পড়লে উপমহাদেশের শাস্তি বিনষ্ট হবে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। -(মুহাম্মদ আমীন যুবেরী, সিরাসতে মিল্লিয়া, পৃঃ ১৭৫-৮৪)।

দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হিন্দু ও মুসলিম সমাজদেহ যখন রক্তাক্ত তখন তিনি তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবকে উভয়ের কল্যাণমূলক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তৎপরিবর্তে তিনি রানীতি থেকে দূরে সরে পড়ে আহমদাবাদের নিকটবর্তী সবরমতী আশ্রমে নির্জনবাস শুরু করেন এবং ভারতীয় রাজনীতির নিরপেক্ষ দর্শক হিসাবে দিন কাটাতে থাকেন। তবে একেবারে চুপচাপ বসে না থেকে খাদি ও স্বহস্তে নির্মিত বস্ত্রের মহত্ব, ছাগ-দুগ্ধের উপকারিতা, টিকা-ইনজেকশনের অপকারিতা, সোয়াবিনের খাদ্যপ্রাণ প্রভৃতি সম্পর্কে প্রবন্ধাদি লিখেন, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি মুখ বন্ধ করে থাকেন। (মুহাম্মদ আমীন যুবেরীঃ সিরাসতে মিল্লিয়া, পৃঃ ১৭০)।

ভারতীয় জাতীয় সংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতের হিন্দুজাতির প্রকৃত মুখোশ খুলে গেল ১৯৩৭ সালের পর, যখন ১৯৩৫ সালের পর, যখন ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া এ্যাক্টের অধীন ভারতের প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে মন্ত্রীত্ব গঠিত হলো, মুসলমান প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে মন্ত্রীত্ব গঠিত হলো, মুসলমান চারটি প্রদেশে এবং হিন্দু সাতটি প্রদেশে মন্ত্রীত্ব গঠনের দায়িত্ব লাভ করে। ভারতীয় সংগ্রেস –ভারতের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনক্ষমতা একমাত্র কংগ্রেসের উপরেই অর্পণ করতে হবে। পক্ষান্তরে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ এ আশংকা প্রকাশ করে আসছে যে, কংগ্রেসের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে ভারতীয় মুসলমানদের সকল স্বার্থ দলিত-মথিত হবে এবং মুসলিম জাতিকে তাদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও তাহজীব তামাদ্দুন বিসর্জন দিয়ে হিন্দুর গোলামে পরিণত হতে হবে।

১৯৩৭ সালের পর কংগ্রেসের দাবী  মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং মুসলমানদের আশংকা সত্যে পরিণত হয়। কংগ্রেস মাদ্রাজ
, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, বোম্বাই ও উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশে তাদের সংখ্যগরিষ্ঠ মন্ত্রীসভা গঠন করে।

নির্বাচনের পূর্বে এরূপ আশা করা গিয়েছিল যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদশেগুলিতে, বিশেষ করে ইউ পি এবং বোম্বাই-এ মুসলিম লীগ সদস্যদেরকে নিয়ে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। গভর্ণরদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, মন্ত্রীসভায় শামিল করা উচিত। ইউ পিতে মুসলমান ছিল মোট লোকসংখ্যার ছয় ভাগের একভাগ। সেখাতে তাদের তুলনায় তাদের প্রভাব ও ঐক্য ছিল অনেক বেশী এবং এ কারণে সংগ্রেস ও মুসলিম লগের মধ্যে এরূপ একটি অলিখিত বুঝাপড়া হয়েছিল যে, অন্ততঃ দু’জন মন্ত্রী মুসলিম লীগ থেকে নেয়া হবে। কিন্তু ইউ পি এবং বোম্বাই-এ মুসলিম লীগের কোন সদস্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়া হয়নি। কংগ্রেস এখানেই মারাত্মক ভুল করে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় যে, একমাত্র কংগ্রেসই সারা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। মুসলমানদের নিকটে এটা ছিল হিন্দু শাসনের কাছে নতিস্বীকার করা। ফলে ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধ্বনি উথিত হয় এবং ‘কংগ্রেসরাজ’ ব্রিটিশরাজ থেকে অনেক খারাপ বলে বিবেচিত হয়। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ও মিঃ জিন্নাহর মধ্যে ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে নেহরু ও মিঃ জিন্নাহর মধ্য ১৯৩৮ সালের  প্রথম দিকে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে নেহরুর দাবী হলো ধর্মনিরপেক্ষ যুক্ত ভারতের এবং মিঃ জিন্নাহর দাবী হলো লীগকে কংগ্রেসেরই সমমর্যাদাশীল বলে মেনে নেয়ার। কোন ফরমূলা বা সমঝোতার ভিত্তিতে এর মীমাংসা সম্ভব হলো না
–(H.V. Hodson: The Great Divide, p. 63, pp. 66-67)।

ভারতে কংগ্রেস শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সকল শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার করা হবে, সংখ্যলঘুদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, ইত্যাদি ধরনের কংগ্রেসের বড়ো বড়ো বুলি ১৯৩৭ সালের পর মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেসের আড়াই বৎসরের শাসন ‘হিন্দু রামরাজ’ বলে কুখ্যাতি লাভ করে এবং মুসলমানরেদ প্রতি অন্যায় অবিচার, তাদের ধর্ম-তাহজিব-তামাদ্দুন বিলুপ্তির প্রচেষ্টা প্রভৃতির দ্বারা কংগ্রেস সারা ভারতের মুসলমানদের আস্থা একেবারে হারিয়ে ফেলে। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে পাটনায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতির সকল আশা ভরসা ‘কংগ্রেস ফ্যাসিবাদের’ দ্বারা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ভারতের সর্বত্র মুসলমানদের পক্ষ থেকে অত্যাচারী কংগ্রেস শাসনের অবসান দাবী করে বিক্ষোভ প্রদশিত হতে থাকে।

কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের প্রতি কৃত অন্যায় অবিচারের তদন্তের জন্যে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেত তা, ‘পীরপুর রিপোর্ট’ নামে খ্যাত। ‘বিহারের মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ’–শীর্ষক একটি রিপোর্ট পেশ করেন বিহার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্তৃক গঠিত কমিটি। একে ‘শরীফ রিপোর্ট’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘পীরপুর রিপোর্টের’ পর ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ‘শরীফ রিপোর্ট’ পেশ করা হয়। অতঃপর ডিসেম্বর মাসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী মিঃ এ কে ফজলুল হক ‘কংগ্রেস শাসনে মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশা’ নামে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। হিন্দু পত্র-পত্রিকা রিপোর্টগুলিতে বর্ণিত অভিযোগগুলি অস্বীকার করে এবং বিহার সরকার ‘পীরপুর রিপোর্ট’ প্রত্যাখ্যান করেন।

H.V. Hodson : তার The Great Divide গ্রন্থে বলেনঃ

“ভারতের ইতিহাসের এ এক সুবিদতি ঘটনা যে, যখন থেকে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করা শুরু করেছে, তখন থেকেই কিছুটা ধর্মীয় উত্তেজান বিরাজ করে আসছে। যেমন ধরুন গো-পূজা, নামাজের আজানে বাধা প্রদান, মসজিদ অপবিত্রকরণ, নারী ধর্ষণ, নারী হরণ প্রভৃতি ব্যক্তিগত আক্রমণ। অপরদিকে, রাজনৈতিক ও শাসন সংক্রান্ত নতুন নতুন অভিযোগ বিরাজ করছে, বিশেষ করে যেসব বর্ণিত হয়েছে যুক্তিপূর্ণ ‘পীরপুর রিপোর্টে’। হিন্দীর সপক্ষে উর্দুকে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে; পুলিশ ও ম্যাজিষ্ট্রেট পক্ষপাতিত্ব করছেন; সরকারী চাকুরীতে মুসলমানদেরকে তাদের ন্যায্যা অংশ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা থেকে তারা কোন প্রকার ন্যায়পরতা আশা করে না; কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক অনুরূপ পালটা সরকার চলতে দেয়া হচ্ছে; কংগ্রেস শাসন অর্থাৎ হিন্দু শাসন; যেমন সর্বত্র কংগ্রেস পতাকা উড়ানো হচ্ছে, ইসলাম বিরোধী ‘বন্দোতরম’ সংগীত জাতীয় সংগীত হিসাবে গীত হচ্ছে এবং ‘ওয়ার্ধা স্কীম’ অনুযায়ী গ্রাম্য শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করা হচ্ছে। এ হচ্ছে মিঃ গান্ধীর কল্পনাপ্রসূত আদর্শ যার ভিত্তি হচ্ছে অহিংসা, সূতা প্রস্তুতকরণ ও বয়ন শিল্প এবং ধর্ম থেকে নিবৃত্তি। এর বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিদ্রোহ করতে হয়। কারণ তাদের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল সকল সময়ে কোরআন ভিত্তিক”। -(H.V. Hodson The Great Divine, pp. 73-74)।

মিঃ হডসন আরও বলেনঃ

“কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলির ব্রিটিশ গভর্নরগণ সাধারণতঃ এ ধরনের মত পোষন করতেন যে, তাঁদের মন্ত্রীগণ যদিও বা অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার দিক দিয়ে দল নিরপেক্ষ থাকবার চেষ্টা করেন, কিনউত জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেসীদেরকে ক্ষমতা প্রবণতা তাদেরকে ঔদ্ধত্য ও উত্তেজনাকর আচরণে লিপ্ত করে। মোট কথা, ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্র দ্বারা তা পরিচালিত হবে। আর এর পশ্চাতে এমন একটি সংগঠন থাকবে যে কখনো বিরোধিতা বরদাশত করবে না এবং কাউকে তাদের ক্ষমতার অংশীদার করতেও স্বীকৃত হবে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ১৯৩৭ থেকে ও ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দ্বিজাতিত্ব-মতবাদ প্রচার ও পাকিস্তান আন্দোলনের কারণ”। -(H.V. Hodson: The Great Divide, pp. 74)

ভারতের হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ও বিরোধ সমাধানকল্পে কবি ইকবাল ১৯৩৭ সালের ২১শে জুন আঙিনা ভাগ করার পরামর্শ দেন। ৭ই জুলাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলম ছাত্র সমাজক লক্ষ্য করে বলেনঃ

ওই সর্বনাশটাকে ধর্মের দামেতে করো দামী
ঈশ্বরের করো অপমান
আঙিনা করিয়া ভাগ দুই পাশে তুমি আর আমি
পূজা করি কোন শয়তানে?

তারপর দশ বছর হয়েছে অধিকতর বিরোধ ও সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে। আড়াই বছরের কুখ্যাত কংগ্রেস শাসনের ইংগিত উপরে করা হয়েছে। ১৯৩৯ সালের ১৭ই অক্টোবর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকারীন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতি যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য সহযোগিতার আহবান জানিয়ে ভারতের বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো এক বিবৃতি প্রদান করেন। মুসলমানদের বিক্ষোভের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে নয়, বড়োলাটের বিবৃতির সাথে একমত হতে না পেরে সংগ্রেস হাই কমান্ড মন্ত্রীসভাগুলিকে এস্তেফাদানের নির্দেশ দেয়। তাঁরা নীরবে এ নির্দেশ পালন করেন এবং সাতটি প্রদেশ থেকে কংগ্রেস কুশাসনের অবসান ঘটে। এর জন্যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানগণ সারাদেশে ‘নাজাত দিবস’ পালন করেন।

মুসলিম লীগের উদ্যোগে সারাদেশে ‘নাজাত দিবস’ পালন ন্যায়সঙ্গত তোক বা না হোক, কিনউত একটি জিনিস দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ দেমে শাসনক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও মিলন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। অতএব আল্লামা ইকবালের পরামর্শ অনুযায়ী আঙিনা ভাগ করা ব্যতীত স্থায়ী সমাধানের আর অন্য কোন পথ রইলো না। কিন্তু আঙিনা ভাগ করতে মোটেই রাজী নয়। তাই এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে অধিকতর সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে আঙিনা ভাগ হলো দশটি রক্তাক্ত বছরের পর। অর্থাৎ ভারতের আঙিনা ভাগ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট মুসলমানের জন্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কিন্তু ভারতের আঙিনায় যেসব মুসলমান রয়ে গেল, আঙিনা ভাগ করতে চাওয়ার অপরাধে তাদেরকে চড়া মাশুল দিতে হয়েছে বহু বছর ধরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *