৫১. মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে
নতুন তাহেরের জন্ম মুক্তিযুদ্ধেরই গর্ভে। তাই ঘুরে ফিরে তাহেরের কথায় ভাবনায় আসে মুক্তিযুদ্ধ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে তাহের তার মনের হতাশা, ক্ষোভ, আক্রোশের কথা লিখে ফেলেন গ্রেনেড নামে মুক্তিযোদ্ধাদেরই একটি পত্রিকায়। লেখার শিরোনাম দেন মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে। আবার কথাটি ব্যবহার করে দ্বিতীয় একটি যুদ্ধের ডাক যেন তিনি দেন, যে দিন বদলের কল্পনার যুদ্ধটি তার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। নতুন সরকার কাঠামোর ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। তার সহযোদ্ধা, সহকর্মীরা এক এক করে রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে চলে গেলেও ধৈর্য ধরেছেন তিনি। সে ধৈর্যের বাঁধ তার ভেঙ্গে গেছে, আস্থা তার উবে গেছে। তাই লেখায় সে ক্ষোভ প্রকাশে এখন তিনি অকপট।
তাহের লেখেন—’১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি ছিল না। এটা ছিল দেউলিয়া রাজনীতির অধৈর্যতার ফল। ক্ষমতা তাদের হাত থেকে চলে গেছে, জয়ী হয়েও তারা হেরে গেছে। ষরযন্ত্র পঙ্গু করে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারের প্রভেদ ঘুচে গেছে এখন। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপদ করেছে পাকিস্তানিদের হাতে তিনি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দিয়ে এখন দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি তিনিই এখন তরুণদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানিদের হয়ে প্রচারনায় মত্ত ছিলেন তারাই এখন ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে করা হয় কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প, সেখানে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধীদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেওয়া হয় যাতে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। যাদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে আত্মশুদ্ধি করার কথা তারাই এখন নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে’।
তাহের ভেবেছিলেন ক্যান্টনমেন্টের বিচ্ছিন্ন এক ভূখণ্ডে খণ্ডিত এক বিপ্লবের সাফল্য দিয়ে অনুপ্রাণিত করবেন বিরাজমান রাষ্ট্রকাঠামোকে। ব্যর্থ হয়েছে সে প্রত্যাশা। এবার প্রস্তুত হয়েছেন ব্যক্তিগত মনন, মেধা, অভিজ্ঞতাকে নিয়োজিত করবেন কোনো বিপ্লবী দলীয় কাঠামোতে। সে চেষ্টা তিনি আগেও একবার করেছেন সিরাজ শিকদারের সঙ্গে। সাফল্য, ব্যর্থতার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এবার তিনি আগের চেয়ে স্থিতধী। তাহের বেরিয়ে পড়েন একটি যথার্থ বিপ্লবী পার্টির খোঁজে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বামপন্থী বিপ্লবীরা নানা দলে উপদলে বিভক্ত, তাদের মধ্যে মতাদর্শগত কোন্দল। সেই মধুচন্দ্রিমার সময় ট্রেনের কামরায় দেখা মস্কোপন্থী বামনেত্রী মোজাফফর আহমদ আর মতিয়া চৌধুরী তখনও গাঁটছাড়া বেঁধে আছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে হয়তো ভালো হতো, তারা সেই অচেনা মেজরের নতুন রূপ দেখে অবাকই হতেন নিশ্চয়। কিন্তু তারা ভাবছেন শেখ মুজিবকে সঙ্গী করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন। তাহের সে আশা ছেড়েছেন আগেই ফলে তিনি মনে করেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো ফায়দা নেই। আব্দুল হক প্রমুখের নেতৃত্বাধীন চীনাপন্থী যে বাম দল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই মেনে নেয়নি তাদের সঙ্গে যোগাযোগও অর্থহীন। তাহের তাই যোগাযোগ করেন মোহাম্মদ তোয়াহা, আবুল বাশার, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ চীনাপন্থী নেতাদের সঙ্গে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিয়েছেন কিন্তু আবার আওয়ামী লীগের শাসনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাননি। বাংলাদেশে দ্রুত একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাব্যতা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন তাহের। কিন্তু তারা বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশে পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটেনি, আধা সামন্ত এমন একটি দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে শিল্পায়ন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদ আরও খানিকটা বিকশিত হবার পর সমাজতন্ত্রে ডাক দেবেন তারা।
ক্রাচে ভর দিয়ে তাহের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান বদরুদ্দীন উমরের শান্তিনগরের বাড়িতে। বদরুদ্দীন উমর পড়াশোনা জানা মানুষ। একসময় চীনা পন্থীদের সঙ্গে থেকে তিনি গণশক্তি পত্রিকা বের করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চীনাপন্থীদের বিভ্রান্তিকর মূল্যায়নের কারণে তিনি সরে আসেন তাদের কাছ থেকে। নিজেই দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন একটি আন্দোলন। বদরুদ্দীন উমর মার্ক্সবাদের টীকা টিপ্পনীসহ তাহেরকে বোঝান বাংলাদেশের বিপ্লবের স্তর, সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ এবং বলেন দেশ এখন বিপ্লবের স্তরে নেই।
ক্রাচে ভর দিয়ে শহরময় ঘুরে ঘুরে তাহের খুঁজছেন একজন সঙ্গী, একটি দল যার সঙ্গে ভাবনার মিল হবে তার। এবার আর ভুল করতে চান না তিনি। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না। আনোয়ারকে একদিন বলেন : ভাবলাম সিনিয়র বাম নেতাদের সঙ্গে কথা বলে একটা পথ পাওয়া যাবে। ভেবেছিলাম সব বামপন্থীদের মিলে যৌথভাবে কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু সবাই তো যার যার পুকুরে সাঁতার কাটছে। আর সিনিয়র নেতারা সব থিওরিটিক্যালি কোন স্টেপ ভুল, কোনটা শুদ্ধ এই অংক করতে করতেই জীবন পার করে দিচ্ছেন। আমার মনে হয় পরিস্থিতিটাকে তারা খুব মেকানিক্যালি দেখছেন। তারা কেউ মনে করছেন না যে এ মুহূর্তে সোসালিস্ট রেত্যুলেশন করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে তারা একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। সময় আমাদের হাতে খুব বেশি নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা চান্স আমরা হারিয়েছি। যত দেরি করব আবারও আমরা চান্স হারাবে। আমাদের একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ নেওয়া সরকার দ্রুত। তাত্ত্বিকভাবে সেটা হঠকারী হবে কিনা কিনা জানি না। কিন্তু এছাড়া আর কোনো বিকল্প আমি দেখি না। সিরাজ শিকদার সোসালিস্ট রেভুলেশানের কথা বলছে কিন্তু ঐ আন্ডারগ্রাউন্ড টেরোরিজম দিয়ে সেটা হবে না। জাসদ তো নতুন হয়েছে, ওদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
আনোয়ার বলেনঃ জাসদের মূল তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। যুদ্ধের আগে যখন সূর্যসেন স্কোয়াড করি তখনই তার সঙ্গে যোগাযোগ।
তাহের বলেন : দেখো না একদিন তাকে নিয়ে আসতে পারে কিনা এখানে।
আনোয়ার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন, ইউসুফ চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, বেলাল আর বাহার স্বাধীনতার পর বালাদেশ মিলিটারি একাডেমীর প্রথম ব্যাচে নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু নানা প্রশাসনিক জটিলতায় প্রশিক্ষণে যোগ দিতে পারছেন না। আর সাঈদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে করতে চাইছেন ব্যতিক্রমী কিছু। ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক ওদিক। তাহের একদিন ডাকেন সাঈদকে : কি কর এখন?
সাঈদ : যুদ্ধ তো শেষ কি করব বুঝতেছি না।
তাহের : বিপ্লবীর যুদ্ধ কখনো শেষ হয় না সাঈদ। বিপ্লবী কোনো রেস্ট নাই। যাও গ্রামে গিয়ে একটা কালেকটিভ ফার্ম করো।
তাহের রিজাইন করবার পর পেনশন, গ্রাচুইটির যা টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে একটা ট্রাক্টর কিনে দেন সাঈদকে।
সাঈদ কাজলায় গিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ।
এর মধ্যে একদিন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওসমানী তাহেরকে ডেকে একটি চাকরির প্রস্তাব দেন। ওসমানী তখন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। ওসমানী তাহেরকে নারায়ণগঞ্জ ড্রেজিং সংস্থার ডিরেক্টর পদে যোগ দিতে বলেন। বাংলাদেশের নদী এবং বন্যা তাহেরের আগ্রহের বিষয়, এ নিয়ে রয়েছে তার নিজস্ব ভাবনা, যে কথা তিনি লিখেছেন তার সোনার বাংলা গড়তে হলে লেখাতে। চাকরিটি গ্রহণ করতে রাজি হন তাহের। একটা বেসামরিক চাকরিতে থেকে রাজনীতির পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেওয়া বরং সহজ হবে বলেই মনে করেন তিনি। লুৎফা, জয়াকে নিয়ে গিয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের সংস্থার ডিরেক্টরের বাসভবন জান মঞ্জিলে। নারায়ণগলেই জন্ম নেয় ত্যা তাহেরের দ্বিতীয় সন্তান যীশুর।
৫২. নতুন পাঠ
আনোয়ার একদিন সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায়। ষাট দশকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে নিউক্লিয়াস গড়ে চমক তৈরি করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন প্রথম বিরোধী দল। লম্বা চুল, মুখ ভরা দাড়ি গোঁফ অনেকটা কার্ল মার্ক্সের মতো চেহারা তখন সিরা আলম খানের। জাসদের এই নেপথ্য নেতাকে সবাই দাদা বলে ডাকেন। প্রকাশ জনসভায় তিনি বিশেষ আসেন না, নিজেকে রহস্যে ঢেকে রাখেন। বিচিত্র চেহারার এই মানুষটিকে দেখে কৌতূহল হয় লুৎফার। তাহের অবশ্য তখন তার পরিচয় গোপন রাখেন লুৎফার কাছে। বলেন : উনি একজন বিজনেসম্যান। দেখি একটা ব্যবসা করব ভাবছি উনার সঙ্গে।
তাহের সিরাজুল আলম খানকে বলেন : জাসদের পলিসিটা বোঝান।
সিরাজুল আলম খান বলেন : তার জন্য সময় লাগবে। তবে একটা বেসিক কথা হচ্ছে আমাদের এখানে ভারত, রুশ, চীন নানা ধারার কমিউনিজম তো চলছে অনেক দিন। আমরা একেবারে দেশজ একটা সমাজতন্ত্রের কথা বলছি।
তাহের : সেটা তো খুব ভালো কথা।
খান : আমরা শেখ মুজিবকে সামনে দেশে সমাজতন্ত্রের কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তিনি তো সে রাস্তায় চলছেন না। আমাদের তিনি দূরে ঠেলে দিলেন।
তাহের : আপনারা কিভাবে ভাবছেন?
সিরাজুল আলম খান তখন তার সঙ্গে আসা তরুণ নেতা ইনুকে পরিচয় করিয়ে দেন তাহেরের সঙ্গে। বলেন, এর নাম ইনু, হাসানুল হক ইনু, ইঞ্জিনিয়ার। সে এসে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করবে।
বুয়েট থেকে সদ্য পাস করেছেন ইনু। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির জাতীয় পর্যায়ের তুখোড় স্পোর্টসম্যান, ফুটবলার। এখন ঝুঁকেছেন রাজনীতিতে। ঝুঁকেছেন জাসদে।
পরদিন অনেক সকালে ইনু তার হোন্ডা চালিয়ে হাজির হন তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে। আলাপ হয় লুৎফার সঙ্গেও।
ইনু তাহেরকে বলেন : আমাদের বেশ কয়েকটা সিটিং লাগবে। কখন আপনার জন্য সুবিধা।
লুৎফা বলেন : বিজনেসের আলাপ নাকি?
হেসে দেন তাহেরবলেন : তোমাকে বলব সব পরে।
ইনুকে তাহের বলেন : আমার নয়টায় অফিস। ভালো হয় তুমি যদি আরও সকালে আসাতে পারো। তোমার সঙ্গে আলাপ সেরে তারপর অফিস যাব।
তাই ঠিক হয়। পরদিন ভোর সাতটায় যথারীতি হোন্ডা নিয়ে হাজির হন ইনু। গিয়ে দেখেন তাহের পাশের একটি ডোবার কাছে দাঁড়িয়ে লোকজনকে কি যেন নির্দেশ দিচ্ছেন। পাশে আনন্দে লাফাচ্ছে মেয়ে জয়া।
ইনু কাছে গিয়ে জানতে চান কি হচ্ছে। তাহের বলেন : ব্যাঙ ধরা হচ্ছে।
ইনু : কেন?
তাহের : ভেজে খাওয়া হবে, সোনা ব্যাঙ, খুবই ভালো জাতের।
ইনু : আপনি এই ব্যাঙগুলো ভেজে খাবেন, বলেন কি?
তাহের : কি বলো বিপ্লব করতে চাও আর ব্যাও খেতে পারবে না? আমি শিখেছি আমেরিকায় গেরিলা ট্রেনিং নিতে যেয়ে।
জয়ার সঙ্গে ব্যাঙ নিয়ে কিছুক্ষণ মজা করে ঘরে ফিরে আসেন তাহের। চা নিয়ে বসেন ইনুর সঙ্গে বলেন : বলো, শুনি তোমার কথা।
ইনু বলেন : আগে বলেন আপনি তো গভর্নমেন্টের অফিসার রাজনীতি করা সমস্যা হবে না তো?
তাহের : একাত্তরেও তো গভর্নমেন্টের অফিসার ছিলাম, যুদ্ধ করতে অসুবিধা হয়েছে?
ইনু : শুরুতেই আপনাকে বাংলাদেশে বামপন্থীদের মধ্যে বিপ্লবের স্তর নিয়ে যে বিতর্ক আছে সে ব্যাপারে দু একটা কথা বলতে চাই। আপনি জানেন যে অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দল মনে করে বাংলাদেশ একটা আধা সামন্ততান্ত্রিক এবং নয়া উপনিবেশবাদী দেশ।
তাহের : হ্যাঁ, আমি বেশ অনেকের সঙ্গেই এ নিয়ে কথা বলেছি। বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর নিয়ে নানা রকম তত্ত্ব তাদের আছে। তারা তো সবাই মনে করেন এখনও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে এসে পৌঁছায়নি।
ইনু : তাদের আর্গুমেন্টটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করতে হলে সমাজে পুঁজিবাদী উপাদান থাকা জরুরি। তারা মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী কোনো উপাদান নেই, ফলে এখানে আগে অসম্পূর্ণ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। তারপরে হবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। কিন্তু হলিডে-তে ড, আখলাক ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ নামে নিবন্ধ লিখেছেন সেটা কি আপনার চোখে পড়েছে?
তাহের : হাঁ, দু একটা ইন্সটলমেন্ট পড়েছি।
ইমু : উনি ইন্টারন্যাশনালি ফেমাস ইকোনমিস্ট। তিনি বলছেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতি আসলে পুঁজিবাদী স্তরেই আছে। তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে সামান্য যে শিল্প কারখানা রয়েছে তার উৎপাদন ধারা পুঁজিবাদী তো বটেই, এ দেশের কৃষি অর্থনীতিতেও দেখা দিয়েছে পুঁজিবাদী প্রবণতা। কৃষিতে বেশির ভাগ জমি এখন মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, অধিকাংশ কৃষক ক্রমশ সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে, জমি এখন রূপান্তরিত হয়েছে পুঁজি বিনিয়ণের উপায় হিসেবে, সেই সঙ্গে কৃষিতে উৎপাদন হচ্ছে মালিক মজুর সম্পর্কের ভিত্তিতে, তাছাড়া কৃষিতে যা উৎপাদন হচ্ছে তা পরিণত হচ্ছে জাতীয় পুঁজিবাদী বাজারের পণ্যে। এগুলো সামন্তবাদী কৃষির বৈশিষ্ট্য নয়, এ সব কিছুই প্রমাণ করে দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী ধারায় প্রবেশ করেছে।
এসময় লুৎফা ব্যঙের পা ভেজে আনেন। তাহের ইনুকে বলেন : ট্রাই ইট।
ইনু একটু ইতস্তত করে হাতে তুলে নেন একটা মুখে পুরে বলেন : মন্দ না তো?
তাহেরও মুরগির রানের মতো হাতে তুলে নেন ব্যঙের রান। ফিরে আসেন আলাপে।
ইনু বলেনঃ ড. আখলাক মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকার এই পুঁজিবাদী ধারাটিকে বিকাশ করতেই সহায়তা করছে। আমরা তার এই এনালাইসিসটাকে গ্রহণ করি। তিনি বেসিক্যালি জাসদের সঙ্গেই আছেন। আমরা মনে করি আওয়ামী লীগের এই পুঁজিবাদী ধারাকে উচ্ছেদ করে এ মুহূর্তে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া জরুরি। হয়তো বাংলাদেশের সমাজে এখনও কিছু সামন্ততান্ত্রিক উপাদান আছে, হয়তো জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অপূর্ণতা আছে কিন্তু আমরা মনে করি সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই একইসাথে এসব অপূর্ণতাকে পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
তাহের বলেন : সেই নাইনটিন গফর্টিএইটে ইন্ডিয়া স্বাধীন হবার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদন বি টি রনদিভে এমন একটা প্রস্তাবই কিন্তু করেছিলেন। তিনি সেটাকে বলেছিলেন ইন্টার টোয়াইনিং থিয়োরি অব টু রেভ্যুলেশনস। তিনি গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একই সঙ্গে সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ইনু : ঠিকই বলেছেন। ভারতের বাম দলগুলো এ প্রস্তাব তখন গ্রহণ করেনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেক বামপন্থী তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় সমাজতন্ত্রী শিবদাস ঘোষ ছিলেন এ দলে। তিনি সোসালিস্ট ইউনিট সেন্টার গঠন করে এ মতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন যে ভারত সামন্ত বা আধা সামন্ত নয় বরং পুঁজিবাদী। সুতরাং বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক। একই সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। আমাদের দাদা শিবদাস ঘোষের অনুসারী বলতে পারেন।
ইনু আর তাহেরের মধ্যে জাসদের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে আলাপ চলে। আরও কয়দিন। মাঝে মাঝে রাতেও এসে থাকেন ইনু।
তাহের জিজ্ঞাসা করেন : আমি ফুললি এগ্রি করি যে বাংলাদেশে এখন সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের ডাক দেওয়ার সময় এসেছে। কিন্তু তোমাদের স্ট্রাটেজিটা বালো।
ইনু বলেন : এটা তো স্পষ্ট যে এই সরকার দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। মস্কোপন্থীরা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে বলছেন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা। চীনাপন্থী সমাজতন্ত্রীরা কেউ কেউ বাংলাদেশকে স্বীকারই করেননি, বাকিরা বলছেন সুশ বিপ্লবের কথা। কিন্তু জাসদে আমরা অন্য রাস্তা ধরতে চাই। আমরা সরকারবিরোধী একটা গণঅভ্যুত্থানের দিকে যেতে চাই। এ মুহূর্তে আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যেতে চাই না? উগ্রভাবে যেটা সিরাজ শিকদার করছেন। গণবিচ্ছিন্ন গোপন রাজনীতিও করতে চাই না। উন্মুক্ত রাজনীতির সব রকম সুযোগ নিতে চাই। সে সংগ্রামে সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঘটিয়ে তার মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত করতে চাই আমরা। ধারাবহিকভাবে সরকারের সীমাবদ্ধতাগুলো সাধারণ মানুষের ভেতর তুলে ধরে ধীরে ধীরে একটা গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিতে চাই। এই অভ্যুত্থানই এক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্তরে উপনীত হবে।
তাহের : তোমরা কি শুধু গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের কথা ভাবছ?
ইনু : আমরা কিন্তু বিশেষভাবে শহরাঞ্চলের আন্দোলন জোরদার করতে চাচ্ছি।
তাহের : গুড আমার ভাবনার সঙ্গে কিন্তু খুবই মিলছে।
মাঝে মাঝে সিরাজুল আলম খানও আসেন। তাহেরও তাকে ডাকেন দাদা বলে। বলেন, এ মুহূর্তে আপনাদের এই মাস মুভমেন্টের কনসেপ্টটাকে আমি পছন্দ করছি। আমার মনে হয় এখন ভাবেই এগুনো উচিত।
সিরাজুল আলম খান : তবে একটা ব্যাপার বলতে চাই মাস মুভমেন্টের পাশাপাশি এক পর্যায়ে করেসপন্ডিং সশস্ত্র একটা গণবাহিনীও তৈরি করতে চাই আমরা, যাতে বাধা আসলে সরিয়ে ফেলা যায়। আপনাকে ঐ গণবাহিনীর নেতৃত্বে দেখতে চাই।
জীবন যাপনের নানা বিচিত্র ধারা সিরাজুল আলম খানের। তিনি ভাত বিশেষ খান না, অনেক সময় মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দেন সারাদিন। মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমান। তাহের, আনোয়ার বেশ মুগ্ধ খানের ব্যাপারে। মুগ্ধ না শুধু সাঈদ। সাঈদ বলে, দাদা তো আমার নাম, সে এইটা হাইজ্যাক করল ক্যামনে। আর ঘরে বিছানা খাকতে মাদুর পাইতা শোয়ার তো আমি কোনো কারণ দেখি না। সাঈদ বলেন : এই সব আমার কাছে স্টান্টবাজি মনে হয়। খেয়াল রাইখেন একটু।
ধমক দেন তাহের : সাঈদ তুমি বেশি কথা বলে। উনি সিম্পল লাইফ লিড করতে চান এর মধ্যে স্টান্টবাজির তুমি কি দেখলা?
একদিন মেজর জলিলও আসেন তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে। বলেন : স্যার, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যখন শুনলাম আপনি আর্মি থেকে রিজাইন করেছেন। চলে আসেন স্যার আমাদের সঙ্গে। আই থিঙ্ক দিস ইজ দি রাইট পার্টি
আনোয়ারের সঙ্গে আলাপ করেন তাহের। বলেন : জাসদকে আমার সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে। আমার চিন্তার সঙ্গে প্রচুর মিল পাচ্ছি। ড, আখলাকের মতো অর্থনীতিবিদ, সিরাজুল আলম খানের মতো তাত্ত্বিক আছে এদের সঙ্গে। ইনু, রব, শাজাহান সিরাজের মতো পপুলার ইয়াং লিডাররা আছে, আর আছে স্পিরিটেড মেজর জলিল। আমার মনে হচ্ছে এরা কিছু করতে পারবে। এদের সাথেই যোগ দেব ভাবছি।
তাহের আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন জাসদে। নতুন অধ্যায় শুরু হয় তাহেরের জীবনে। সিদ্ধান্ত হয় জাসদের একটা অফিসিয়াল আর্মড ফোর্স থাকবে। তাহের হবেন তাঁর প্রধান। দ্বিতীয় নেতৃত্বে ইনু। তাহেরকে করা হয় জাসদের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। নতুন পরিচয় তার। কিন্তু সরকারি চাকরি করছেন বলে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয়না। জাসদ নেতা মোহাম্মদ শাজাহান এক জনসভায় বলেন, সময়মতো আমরা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করব, সে নাম শুনে আপনারা খুশিই হবেন।
৫৩. জনৈক সাংবাদিক
ড্রেজিং কোম্পানির চাকরিকে মূলত জীবিকা হিসেবে দেখলেও স্বভাবসুলভভাবেই ঐ সংস্থার উন্নয়ন নিয়েও তৎপর হয়ে উঠেন তাহের। দেশের নদী এবং নদীপথ নিয়ে তাহেরের আগের আগ্রহকে আরও গভীরতায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন তিনি। কোম্পানির স্পিড বোট নিয়ে ছুটে যান নানা নদীর শাখা প্রশাখায়, পড়াশোনা করেন নদীর ইতিহাস নিয়ে। কোনো কোনো দিন সংস্থার কর্মচারীরা অবাক হয়ে দেখেন তাদের ডিরেক্টর, এক পা’তেই কেমন পানির উপর দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছেন ওয়াটার স্কেটিং করতে করতে। বহু পুরনো লঞ্চ, স্টিমারকে ঠিক করে তাহের নামিয়ে দেন পানিতে। কিছুদিনের মধ্যেই ড্রেজিং সংস্থাকে একটি লাভজনক সংস্থায় পরিণত করেন তাহের। অবশ্য এগুলো তার প্রকাশ্য কর্মচাঞ্চল্য হলেও তার আসল কাজটি চলতে থাকে গোপনে। জাসদের রাজনৈতিক সভাগুলোতে নিয়মিত যোগ দিতে শুরু করেন তিনি।
এসময় ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের সংবাদদাতা হিসেবে বাংলাদেশের বন্যার ওপর ফিচার করবার জন্য আসেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস। এ নিয়ে নানাজনের সঙ্গে কথা বলেন লিফসুলৎস। এক সাংবাদিক তাকে পত্রিকায় প্রকাশিত তাহেরের সোনার বাংলা গড়তে হলে লেখাটি দেখিয়ে বলেন, আপনি এই লোকটির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। প্রাক্তন আর্মি অফিসার কিন্তু নদী নিয়ে তার নিজস্ব কিছু ধারণা আছে।
লিফশুলৎস একদিন চলে যান তাহেরের নারায়ণগঞ্জের ড্রেজিং অফিসে। দুজনের পরিচয় হয়। কথা হয় বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। তাহের বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে যে কথা লিফশুলৎসকে শোনান অন্য কারো কাছে তিনি তা শোনেননি। টেবিলের উপর মোগল আমলের চার শ বছরের পুরনো বাংলাদেশের এক ম্যাপ রেখে তাহের বলেন, আমি মনে করি আমাদের দেশে বন্যার প্রধান কারণ ব্রিটিশদের তৈরি রাস্তা আর রেল লাইন।
লিফশুলৎস জানতে চান : কি রকম?
তাহের বলেন : মোগল আমলে বন্যার পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিল না। নদী তো স্বভাবতই ভার্টিক্যাল আর ব্রিটিশরা তাদের প্রয়োজনে এ দেশের মাটির উপর তৈরি করেছে হাজার হাজার মাইল রাস্তা আর রেল লাইন, যেগুলো অধিকাংশই হরাইজন্টাল। কিন্তু আপনি ম্যাপে মোগল আমলের রাস্তাঘাট দেখেন, সব কিন্তু নদীর প্যারালাল। তারা এ ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল। ব্রিটিশদের এই হরাইজন্টাল রাস্তা বিশেষ করে রেললাইন হওয়াতে প্রাচীন কাল থেকে যে পথে নদীর স্রোত চলছিল, পানি নিষ্কাশন হয়ে আসছিল তা বাধা পায়। এটিই আমাদের জন্য হয় ড্যামেজিং।
লিফশুলৎস : ইন্টারেস্টিং আইডিয়া।
তাহের : আরও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। বিশেষ করে এখন সবুজ বিপ্লবের নামে বিদেশি দাতা সংস্থারা যে উচ্চফলনশীল ধান এদেশে এনেছে এগুলো প্রচলিত জাতের চাইতে উচ্চতায় খাটো। আমাদের দেশিয় জাতের ধান উচ্চতায় এমন যে পানি একটু কমে আসলেই এগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ন্যাচারাল পদ্ধতিতেই হয়তো এই সয়েলের কারেক্টার অনুযায়ী এখানকার ধানের হাইট হয়েছে। কিন্তু এই গ্রীন রেভ্যুলেশনের হাইব্রিড ধান এদেশের মাটির চরিত্র অনুযায়ী তো হয়নি। এগুলো লম্বায় খাটো হওয়াতে বন্যার পর অনেক বেশি দিন পানির নিচে ডুবে থাকে। পানি একেবারে না সরে যাওয়া পর্যন্ত এগুলোর মাথা আর দেখা যায় না। ফলে সব ধানই নষ্ট হয়। সুতরাং বন্যা নিয়ে কিছু করতে হলে এসবের দিকে নজর দিতে হবে।
লিফশুলৎস : আপনি তো বেশ নতুন নতুন কথা শোনোলন আমাকে। এ লাইনে তো কাউকে ভাবতে দেখিনি। আপনি আর্মির মানুষ, এ ব্যাপারে এত ইন্টারেস্ট গ্রো করল কিভাবে?
হাসেন তাহের। বলেন : আসলে নদী বলে না, সাধারণভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আমার কিছু চিন্তা ভাবনা আছে। আরেকদিন সময় করে আসলে আলাপ করা যাবে।
লিফলৎসের জানার কথা নয় যে নদীপ্রেমিক প্রাক্তন এই সেনা কর্মকর্তা আসলে গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন একটি বিপ্লবের। কিন্তু তাদের এই কাকতালীয় সাক্ষাত অচিরেই পরিণত হবে একটি ঐতিহাসিক যোগাযোগে। সেজন্য দুজনকেই অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু দিন।
৫৪. একে একে নিভিছে দেউটি
যারা শেখ মুজিবকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছিলেন, যারা দেশের জন্য একটা সক্রিয়, ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চাইছিলেন তাদের অনেকেই একে একে দূরে সরে যেতে থাকেন তার কাছ থেকে। শেখ মুজিবের প্রতি দূর থেকে আস্থা রাখছিলেন তাহের, ভেবেছিলেন তিনি ঘুরিয়ে দেবেন রাষ্ট্রের মুখ। কিন্তু সে আস্থায় চির ধরে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকে আর কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন না তিনি। পদত্যাগ করেন অবশেষে।
শেখ মুজিবের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অগাধ আস্থায় বার বার ছুটে গেছেন শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু তাজউদ্দীনও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমেরিকার ব্যাপারে তার অনমনীয় মনোভাব, তার বিরুদ্ধে শেখ মণি প্রমুখদের নানা কান কথায় শেখ মুজিবের সঙ্গে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাজউদ্দীনের। ক্রমশ দলের এবং সরকারের ভেতর কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তিনি। তারপর একপর্যায়ে তিনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনায় দায়িত্বই ছিল যাদের হাতে সেই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরাও এক এক করে পদত্যাগ করতে শুরু করেন। কমিশনের কাজ ছিল উন্নয়নের সুপারিশ দেওয়া আর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন মন্ত্রিপরিষদ। কিন্তু কমিশনের সুপারিশ অধিকাংশই উপেক্ষা করতেন মন্ত্রীরা। তারা কাজ করতেন তাদের নির্বাচনী উদ্দেশ্য মাথায় রেখে নানা জনপ্রিয় ধারায়। কমিশনের সদস্যদের তারা মনে করতেন উটকো ঝামেলা। তাদের সুপারিশকে তারা বলতেন অতিরিক্ত তত্ত্বনির্ভর। আমলারাও অসহযোগিতা করতে শুরু করেন তাদের সঙ্গে। কমিশনের সদস্যদের কারণে ব্যাহত হতো আমাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। তাছাড়া অনেক আমলাই ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানপন্থী যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বহালতবিয়তে চাকরি করেছেন পাক সরকারের অধীনেই। ফলে নানা কিছু মিলিয়ে কমিশনের সদস্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে দিন দিন।
কমিশনের সবাই ক্রমশ অনুভব করেন যে সরকার পরিচালনায় তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই। শেখ মুজিবের প্রতি সবার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা অটুট থাকলেও একে একে তারা বিদায় নিতে থাকেন। আনিসুর রহমান পদত্যাগ পত্রে লেখেন
বঙ্গবন্ধু,
পরিকল্পনা কমিশনের অবৈতনিক সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্বভার শেষ করার প্রাক্কালে আপনার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু ভাবপ্রবণতায় পারিনি। … আপনার স্নেহ মনে রাখব। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি হতভাগ্য দুঃখী মানুষেরা আপনার দিকে চেয়ে আছে। ভাতকাপড়ের চাইতেও বেশি তারা চায় আশ্বস্ত হতে যে আপনি তাদের সাথেই আছেন। যে কোনো ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলে ডাকবেন। সরকারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। অনেক বেয়াদৰী করেছি, ক্ষমা নিশ্চয় করবেন।-আনিসুর রহমান।
পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামও একদিন শেখ মুজিবের অফিসে গিয়ে তাঁর কাজ থেকে অব্যাহতি চান। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। যেদিন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেছেন, সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। শেখ মুজিব একাকী বসে আছেন প্রায় অন্ধকার অফিসে। বিষণ্ণ হয়ে পড়েন তিনি। শেখ মুজিব বলেন : নুরুল ইসলাম সাহেব, আমি মুসুক্ষু মানুষ আপনাদের ওপর ভরসা করলাম আর আপনারা সব আমকে ফেলে একে একে চলে যাচ্ছেন?
জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ ঝড় দেখেন শেখ মুজিব। বলেনঃ মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানেন, আমি গভীর একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাতের বেলা অন্ধকারে একা একা হাঁটতেছি।
অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে ঐ আলো-আধারিতে অসহায় দেখায়। দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে টেনে যতবড় করা যায় শেখ মুজিব ততখানিই ভালোবাসেন এই দেশটিকে। কিন্তু তার অগাধ দেশপ্রেম আর অসাধারণ মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দিয়েও তিনি যেন আর আগলে রাখতে পারছেন না নতুন এই দেশের জটিল রসায়নকে। পরখ করতে পারছেন না মানুষের পাহাড় প্রমাণ আকাক্ষাকে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নানা সীমাবদ্ধতা যেন একে একে গ্রাস করছে তাকে।
৫৫. নতুন ঘূর্ণি
প্রায়ই জাসদের মিটিংগুলোতে মেঝেতে আসন পেতে গিয়ে বসেন তাহের। পাশে শুইয়ে রাখেন কাঁচ, হাতে স্টার সিগারেটের প্যাকেট! জাসদের তরুণ নেতা ইনু, রব, জলিল, জিকু, শাহাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মাহাবুবুল হক, কাজী আরেফ, মার্শাল মণি সবাই ঘিরে থাকেন দাদা সিরাজুল আলম খানকে। সিরাজুল আলম খান পর্যালোচনা করেন তাদের অবস্থান। বলেন : আমাদের দুটি ধারায় সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একদিকে একটা নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারনাকে স্পষ্ট করে তুলতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। বঙ্গবন্ধুও সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন কিন্তু মানুষকে বুঝতে হবে যে ঐ সমাজতন্ত্র গরিবের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাবে না কোনোদিন। উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন না করে দেশের সবকিছু রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করলে তার ফল ভোগ করবে ক্ষমতাসীনরাই। পাশাপাশি আমাদের একটা হার্ড কোর গণবাহিনীও প্রস্তুত রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিপ্লবের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সশস্ত্র শক্তি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। কর্নেল তাহের আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি এই দিকটাতে আমাদের সাহায্য করবেন। আমরা কর্নেল তাহেরের কাছে কিছু শুনতে পারি।
তাহের মেঝেতে রাখা তার ক্রাচটি স্পর্শ করেন। বলেন : আমি আবারও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটা হাইলাইট করতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ একটা সশস্ত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে সে আস্থা নষ্ট হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকেই আমি সমাজতন্ত্রের একটা সশস্ত্র সন্ত্রাম হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। যে বিপ্লবী গণবাহিনীর কথা আমরা ভাবছি তার মাধ্যমে আমরা সেই অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকেই সমাপ্ত করব বলে আমি মনে করি।
জাসদ সারাদেশে প্রচুর জনসভা করে আওয়ামী সরকারের অরাজকতার কথা তুলে ধরে এবং তাদের প্রতি জনসমর্থনের প্রক্রিয়া শুরু করে। দেশজুড়ে তারা মিছিল, কর্মিসভা, দেয়াল লিখন, প্রচারপত্র বিলি করতে থাকে। ডাক দেয় প্রতিরোধ দিবস, হরতালের। মানুষ সাড়া দেয় সে ডাকের। গণকণ্ঠ আর লাল ইশতেহার পত্রিকার মাধ্যমে চালিয়ে যায় তাদের প্রচারণা।
পাশাপাশি সশস্ত্র গণবাহিনী গঠনের কাজও অব্যহত রাখে। প্রকাশ্যে তার নাম উচ্চারিত না হলেও গোপনে তাহের ব্যাপকভাবে জড়িয়ে যান জাসদের কর্মকাণ্ডে। বিশেষ করে সশস্ত্র গণবাহিনী গঠনের কাজে। লুৎফাকে তাহের বলেনঃ সিরাজ শিকদারের সাথে যে কাজটা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, সেটা এবার সম্পূর্ণ করতে পারব বলে মনে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে জাসদের জন সমর্থন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে, জাসদের ব্যাপারে জনগণের প্রত্যাশাও বাড়তে থাকে উত্তরোত্তর। এক পর্যায়ে জাসদ তার আন্দোলকে ক্রমশ জঙ্গি রূপ দিতে থাকে। ১৯৭৪-এ জাসদ সিদ্ধান্ত নেয় দেশের প্রধান প্রধান দপ্তর, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসভবন ঘেরাও করবে। তারা ঘেরাও করবে রেডক্রসের চেয়ারম্যান, ত্রাণ কমিটির চেয়ারম্যানের অফিস, সচিবালয়, পরিকল্পনা কমিশন, মন্ত্রী সাংসদের বাড়ি ইত্যাদি। সিদ্ধান্ত হয় এ ঘেরাও কর্মসূচির সূচনা ঘটবে ১৭ মার্চ ঢাকার মিন্টু রোডে অবস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও এবং স্মারকলিপি পেশের মধ্য দিয়ে। সেদিন পল্টন ময়দানে জাসদের জনসভা শেষে হাজার হাজার মানুষ রওনা দেয় মিন্টু রোডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির দিকে। সেখানে জঙ্গি জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশের। একপর্যায়ে রক্ষীবাহিনী গুলিবর্ষণ করে ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বারো জন জাসদ কর্মী। ঘটনাস্থল থেকে রব, জলিলসহ জাসদের প্রধান অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সারাদেশেও ব্যাপকভাবে শুরু হয় জাসদের কর্মী গ্রেফতার। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠের অফিস, গ্রেফতার করা হয় সম্পাদক আল মাহমুদকে।
দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শুরু হয় আরও এক ঘূর্ণিপাক।
৫৬. ফ্যান দাও
এদিকে দেশে সংকট এসে ঠেকেছে ভাতের থালাতেও। খাবার নেই দেশে। নয় মাসের যুদ্ধে তেমন ফসল হয়নি কিছুই, বিদেশ থেকে যে খাদ্য কিনবে সে পয়সাও নেই বাংলাদেশের হাতে। স্বাধীনতার পরই হয় বিপুল এক খরা এবং তার ঠিক পর পরই লাগাতার দু দুটি ভয়াবহ বন্যা। যে সামান্য কিছু উৎপন্ন হয়েছে দেশে ভাঙ্গা ব্রিজ, রাস্তাঘাটের কারণে তা বাজারে পৌঁছানোও হয়ে ওঠেছে দুক্ষর। পাশাপাশি চোরাচালান আর অসাধু ব্যবসায়ীর খাদ্য মজুদ করা তো আছেই। সব মিলিয়ে শূন্য হয়ে গেছে দরিদ্র মানুষের ভাতের থালা, মবিত্ত ভাত ছেড়ে খাওয়া শুরু করেছে রুটি।
কিসিঞ্জার কথা দিয়েছিলেন আমেরিকা খাদ্য পাঠাবে। সে ভরসায় বসে আছেন শেখ মুজিব। হঠাৎ একদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত খবর পাঠান আমেরিকা কোনো খাদ্য পাঠাবে না। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সরকারের কাঁধে। কি ব্যাপার? তারা জানায় বাংলাদেশ কিছুদিন আগে কিউবার কিছু কিছু চটের ব্যাগ বিক্রি করেছে আর আমেরিকার পিএল ৪৮০ নিয়ম অনুযায়ী যে দেশ সমাজতান্ত্রিক কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করবে সে দেশ কোন খদ্য সাহায্য পেতে পারবে না।
শেখ মুজিবের কমিউনিস্ট বন্ধু ক্যাস্ট্রোর কাছে দুটো চটের ব্যাগ বিক্রি করার দায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অভুক্ত রাখার নির্মম সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা। আমেরিকার শত্রু ক্যাস্ট্রো, সেই ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে ভাব করবার কি পরিণতি হতে পারে তা শেখ মুজিবকে হাড়ে হাড়ে শিক্ষা দেয় আমেরিকা।
ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় দেশে। গ্রাম থেকে মানুষ কাতারে কাতারে চলে আসতে থাকে শহরে। ঢাকা শহর পরিণত হয় কঙ্কালসার মানুষের প্রেতপুরীতে। পথে পথে হাজার হাজার অভুক্ত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত ঢাকার পথে পথে ভিক্ষুকরা কাঁদে -ফ্যান দেও। ভাত আর চায় না কেউ, চায় সামান্য ফ্যান।
দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য লঙ্গরখানায় লাইন দেয় লক্ষ লক্ষ অভুক্ত মানুষ।
৫৭. আমি কার কাছে যাব?
বাংলাদেশ জুড়ে কেবলই টলটলে পানি। ছোটবড় কত অসংখ্য নদী। সেইসব নদীর কূলে বুকের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বিহ্বল, অনিশ্চিত মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ যেন তাদের কাছে অনেকদিন আগে দেখা একটা স্বপ্ন পথ হারানো মানুষ যেন সব।
বরিশাল থেকে লঞ্চে চড়ে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ঢাকায় আসেন এক লাজুক কবি আবুল হাসান। শহরের অস্থির হাওয়ার ভেতর হাঁটেন। কবিতার বই বের করেন, নাম ‘রাজা যায় রাজা আসে’। লেখেন :
আমি
কার কাছে যাবো, কোনোদিকে যাব?
অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার
সেয়ানা গুণ্ডার মত
মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিক
ওদিক
শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে
শুধু শানিত দুর্দিন, বন্যা
অবরোধ
আহত বাতাস।
আমি
কার কাছে যাবো? কোনদিকে
যাবো?
৫৮. সৎ মানুষের লিস্ট
জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম, চোরাকারবারী, কালোবাজারী, বেআইনি অস্ত্র, ব্যাংক লুট, ভেজাল, দুর্নীতির এক বিশাল পাহাড় তখন শেখ মুজিবের সামনে। বিহ্বল শেখ মুজিব ভেবে পান না কি করে এই পাহাড় ডিঙ্গোবেন তিনি। এক বক্তৃতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেন : সবাই পায় সোনার খনি, তেলের খনি, আর আমি পাইছি চোরের খনি।
এসময় একদিন দর্শনের অধ্যাপক সাইদুর রহমান তার সম্পাদিত দর্শন পত্রিকার একটি সৌজন্য কপি নিয়ে যান শেখ মুজিবের কাছে। ১৯৪৫-এ শেখ মুজিব যখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র তখন তার শিক্ষক ছিলেন সাইদুর রহমান। শিক্ষক এসেছেন ছাত্রের সাথে দেখা করতে, যিনি এখন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে শেখ মুজিব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন : স্যার, আমাকে লজিকে কত নম্বর দিয়েছিলেন মনে আছে?
সাইঁদুর রহমান নীরব থাকেন।
শেখ মুজিবের অফিসে আরও কিছু মানুষ। উপস্থিত সবার সামনেই মুজিব বলেনঃ আমাকে স্যার আপনি লজিকে ২৭ নম্বর দিয়েছিলেন।
সাইদুর রহমান কিছুটা বিব্রত হয়ে বলেন : মুজিব, তুমি এখন নম্বরের অনেক উপরে।
শেখ মুজিব : দেশের অবস্থা তো দেখছেন স্যার। যে লজিকে ২৭ পায় দেশ এর চেয়ে ভালো চালানোর ক্ষমতা তার থাকে না। তবে স্যার আপনি তো অনেক মানুষকে চেনেন। দয়া করে আমাকে একটা ১০০ ভালো মানুষের তালিকা করে দেবেন? আমি আবার তাদের নিয়ে চেষ্টা করে দেখি।
৫৯. সিধা রাস্তা
একটা বিধ্বস্ত, নিঃশ্ব দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনবার চেষ্টা করছেন শেখ মুজিব। ছুটে গেছেন ধনবান আমেরিকার কাছে। গুড় যা মিলেছে তা খেয়েছে পিপড়ায়। এরপর মিলল অপমান। খাদ্যের জাহাজ পাঠিয়েও আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল তারা। দেশকে বাঁচাবেন বলে হাত বাড়িয়েছেন সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর দিকেও। সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো একটা সূক্ষ্ম দড়ির ওপর দুলতে দুলতে এগিয়ে গেছেন তিনি। একবার ডানে একবার বাঁয়ে। সম্বল তার আত্মবিশ্বাস, ক্যারিশমা। কিন্তু আর তাল রাখতে পারছেন না। একদিকে তাকে নেমে পড়তেই হবে এবার।
একটা কোনো কঠোর ব্যবস্থার কথা, দেশে একটা মৌলিক পরিবর্তনের কথা শেখ মুজিব তার মন্ত্রী পরিষদের কাছে বলতে থাকেন প্রতিনিয়ত। কঠোরতর কোনো পদক্ষেপের ব্যাপারে তিনি ধারাবাহিক বৈঠক করতে থাকেন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে। শেখ মুজিব দলীয় নেতৃবৃন্দকে তীব্র সমালোচনা করেন। বলেন, আমি এবার এর শেষ দেখে ছাড়ব।
শেষ মুজিব সিদ্ধান্ত নেন আর ডান বাম তিনি দেশে এবার সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন। কিছুদিন আগে জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে আমেরিকার মদদে সংঘটিত অভ্যুত্থানে নিহত হন চিলির সমাজতন্ত্রী ঘেষা জাতীয়তাবাদী নেতা প্রেসিডেন্ট আলেন্দে। শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে বলেন, .. আমার পরিণতি যদি আলেন্দের মতোও হয় তবু আমি আপস করবো না।
১৯৭৪ সালের শেষে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন শেখ মুজিব।
প্রবীণ নেতাদের ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকেন মুজিব। নিজ দলের তরুণ নেতাদের ভেতরকার নানা দ্বন্দ্বেও তিনি বিরক্ত। একদিন তরুণ বামপন্থী ছাত্রনেতা হায়দার আকবর খান রনো আর রাশেদ খান মেননকে তার বত্রিশ নম্বর বাড়িতে ডেকে পাঠান শেখ মুজিব। সেটি পচাত্তর সালের শুরুর দিকে। শেখ মুজিব বলেন : সিরাতুল মুসতাকিনের মানে বুঝিস? মানে হলো সিধা রাস্তা। আমি ঠিক করেছি সমাজতন্ত্র করে ফেলব। বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারার গল্প জানিস? আমি অলরেডি লেট। আর দেরি নয়। এবার সমাজতন্ত্র করে ফেলব। তোরা আয় আমার সঙ্গে। আমি পাঞ্জাবি ক্যাপিটালিস্ট তাড়িয়েছি তাই বলে মারোয়াড়ী ক্যাপিটালিস্ট এলাও করব না। আমি ক্যাপিটালিজম হতে দেব না, সোসালি করব। তোর আয় আমার সঙ্গে।
তরুণ রনো, মেনন তর্ক জুড়ে দেন শেখ মুজিবের সঙ্গে; কিন্তু এভাবে কি সমাজতন্ত্র হয়? আপনি চাইলেন আর সমাজতন্ত্র হয়ে গেল? এর একটা প্রক্রিয়া আছে না?
কিন্তু নিজের ওপর অগাধ আস্থা মুজিবের। তিনি বিশ্বাস করেন তিনি যেটা চাইবেন, দেশের মানুষের মধ্য দিয়ে তাকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেনই। শেখ মুজিব কখনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলন করেননি। তিনি করেছেন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, করেছেন ভোটের রাজনীতি। সমাজতান্ত্রিক নয় চেয়েছিলেন মিশ্র অর্থনীতি। কিন্তু পোড় খেয়ে এবার ধরতে চাইলেন উল্টোপথ। তার শখের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জন্য উঠে পড়ে লাগলেন তিনি।
সে সময়ে ঘটা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিচিত্র নাটকের স্মৃতিচারণ করেছেন তরুণ ক্ষেপাটে লেখক আহমদ ছফা। তিনি তখন ইউনিসেফের ফান্ড নিয়ে কুমিল্লা বোর্ডে গবেষণা করছেন। ৭৫-এ জুলাইয়ের শেষের দিকে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল ইকোনমিক সেক্রেটারি ড. সাত্তার একদিন বার্ভে এসে বললেন শেখ মুজিব তাকে বলেছেন একটা দুটো গ্রামে সমাজতন্ত্রের মডেল প্র্যাকটিস করতে। তিনি তার নিজের গ্রাম চাঁদপুরে মেহেরপুর পঞ্চগ্রাম সমিতি গঠনের প্ল্যান করেছেন। সমাজতন্ত্রের ধরনটা কেমন হবে সেটা পর্যালোচনা করার জন্য ঐ গ্রামে একটা ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করেন তিনি। সেখানে একাডেমীর পদস্ত কর্মকর্তা, কুমিল্লার ডিসি, এডিসি, এসডিও, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনের লোকজন উপস্থিত, যাবার সময় সাত্তার সাহেব শেখ মুজিবের জন্য কাঁঠাল এবং ছোট মাছ ভাজা নিয়ে যান।
৬০. দ্বিতীয় বিপ্লব
শেখ মুজিব বলেন, তিনি এবার সবকিছুর শেষ দেখে ছাড়বেন। কঠোর থেকে কঠোরতর হবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। জরুরি অবস্থা ঘোষণার এক মাসের মাথায় ১৯৭৫ এর জানুয়ারিতে দেশের সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। সেই অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বদলে শেখ মুজিব হন প্রেসিডেন্ট। দেশের সর্বময় ক্ষমতা হাতে নেন তিনি। দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত হয়। দেশে শুধু একটি মাত্র দল থাকবে। সংবিধান সংশোধনীতে বলা হয় রাষ্ট্রপতির ঘোষণা জারির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সমস্ত দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ৭৫-এর ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল নামে একটা নতুন দলের প্রতিষ্ঠা করেন।
বাকশালকেই শেখ মুজিব তার নিজস্ব ধারার সমাজতন্ত্রের একটি মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চান। শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন, বাকশালের অধীনে প্রতি গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে বহুমুখী সমবায় সমিতি গড়া হবে, জেলাগুলোকে বিলুপ্ত করে প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় পরিণত করা হবে, ছোট ছোট জেলাগুলো হবে এক একটি কমিউন। তার দায়িত্ব দেওয়া হবে একজন গভর্নরকে। সেনাবাহিনী এবং পেশাজীবীদের মধ্যে সমম্বয় সাধন করা হবে। সমস্ত দৈনিক পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার নিয়ন্ত্রিত গুটিকয় পত্রিকা প্রচার করা হবে। শেখ মুজিব বললেন, এটি তার দ্বিতীয় বিপ্লব।
আওয়ামী লীগের প্রায় সব সংসদ সদস্য, সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ সব কর্মকর্তা বাকশালের ব্যাপারে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। নানা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানও একে একে যোগ দিতে শুরু করেন বাকশালে! ৭ জুন ১৯৭৫ আনুষ্ঠানিকভাবে সব সংগঠন প্রতিষ্ঠানের বাকশালে যোগদানের দিন। সেদিন বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, দমকা হাওয়া। এসবকে উপেক্ষা করে শত শত প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক, উঁকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, ছাত্র, নারী, ঢলের পানির মতো আসতে থাকেন বাকশালে যোগ দিতে। শেখ মুজিবের ছবি, ব্যানার, পোস্টার, পতাকা, নানা রং-বেরঙের শ্লোগানবাহী মিছিল। অফিসের বারান্দায় বসে এ দৃশ্য দেখেন শেখ মুজিব।
এ মিছিল কি স্বতঃস্ফূর্ত নাকি সাজানো? এই অতি উৎসাহ কি ভয় থেকে? প্রশ্ন জাগে জনমনে। এমনকি শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তার ঘনিষ্ঠ মানুষ প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম বলেন : আপনার এত বড় বড় ছবি নিয়ে এধরনের মিছিল একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
শেখ মুজিব নীরব থাকেন কিছুক্ষণ, বলেন: দেখেননি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ওরা এমন করে।
সমাজতন্ত্রের ঘোর যেন লেগেছে শেখ মুজিবের মনে।
কিছুদিন পরই মস্কো-আফ্রো এশিয়া লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে গেছেন শেখ মুজিব। সেখানকার প্রতিনিধিদের তিনি বলেন : কি হাস্যকর দেখেন আমি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলাম আর আমাকেই কিনা একদলীয় বাকশাল বানাতে হলো। আমি চাইনি কিন্তু বাধ্য হয়েছি। তবে আমি মনে করি এটা একটা সাময়িক বাবস্থা।
বাকশাল একটি ডুবন্ত দেশকে মরিয়া হয়ে টেনে তুলবার শেষ চেষ্টা শেখ মুজিবের। পৃথিবী তখন ধনতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র দুটো শিবিরে বিভক্ত। দুটোই সমানভাবে শক্তিশালী। দুদিকে ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়ে শেখ মুজিব ঝুঁকলেন এক দিকে।
৬১. অশনিসঙ্কেত
কিন্তু সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের সঙ্গে এ পদক্ষেপ মেলে না। রাশিয়া, চীন, কিউবায় সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে একটি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের দীর্ঘদিনের সগ্রামের মধ্যদিয়ে সমাজতন্ত্র মানে এক শ্রেণী দ্বারা আরেক শ্রেণীর উচ্ছেদের মাধ্যমে একটি শ্রেণীহীন সমাজের দিকে যাত্রা। সেই সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে রয়ে গেছে কত অপ্রীতিকর কৃত কৌশল। দেশের মানুষের শ্রেণী সম্পর্কের মধ্যে কোনো পরিবর্তন না করে এধরনের শান্তিপূর্ণ, অবৈপ্লবিক কৃত্রিম পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা শেখ মুজিবের জন্য হয়ে উঠে এক আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
স্বাধীনতার পর পরই এমন একটি ব্যবস্থা নিলে হয়তো এই পদক্ষেপের অন্য একটি অর্থ দাঁড়াতো। কিন্তু এত ঘটনা দুর্ঘটনার পর হঠাৎ সব দল নিষিদ্ধ করে এমন একটি একদলীয় ব্যবস্থা দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রতীয়মান হয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা হিসেবে। তারা টের পান যদি বাকশাল এবং শেখ মুজিব থাকেন তাহলে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে হবে। একটা পথ বেছে নিতে হবে তাদের। তারা থাকবেন নাকি শেখ মুজিব?
বাকশালের মাধ্যমে শিল্প কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব জাতীয়করণের ঘোষণা হালে হাত গুটিয়ে নেন বিদেশি পুঁজিপতিরা। বন্ধ হয়ে যায় স্থানীয় পুঁজিপতিদেরও বিকাশের পথ। বিদেশি বিনিয়োগকারী বা স্থানীয় পুঁজিপতি দুদলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শেখ মুজিব থাকলে বাংলাদেশে তাদের পথ বন্ধ। তাদেরও বেছে নিতে হবে একটা পথ। তারা থাকবেন নাকি শেখ মুজিব?
বাকশালের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রভু পরাক্রমশালী আমেরিকার জন্য হয় একটা প্রচণ্ড চপেটাঘাত। এমনিতেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির পরাজয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিসিঞ্জার। পাকভারত উপমহাদেশে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একীভুত পাকিস্তান ছিল জরুরি। বাংলাদেশ তা হতে দেয়নি। বিশ্বের পরাক্রমশালী জাতির জন্য এ বড় অপমান। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কিসিঞ্জার এসেছেন এদেশকে সাহায্য করবার জন্য। আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন খাদ্য বোঝাই জাহাজ। যেন হুলো বেড়াল খেলছেন এক নেংটি ইঁদুরের সঙ্গে। এই রকম অবস্থায় বাকশালের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বস্তুত আমেরিকা থেকে পুরোপুরি মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া। বাংলাদেশের মতো এমন একটি নেংটি দূরের এত বড় দুঃসাহসে দ্বিতীয়বারের মতো অপমানিত হয় আমেরিকা। ফলে আমেরিকাকেও বেছে নিতে হবে একটা পথ। শেখ মুজিবকে তার পথে চলতে দেওয়া হবে, নাকি এই অপমানের উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতে হবে এখনই?
দেশের ভেতর যেসব দল পাকিস্তানপন্থী, ইসলামপন্থী, আমেরিকাপন্থী তাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাকশালের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র শেখ মুজিব গড়তে যাচ্ছেন তাতে তাদের আর কোনো ভবিষ্যত নাই। মুসলিম বাংলা বলে একটি আন্দোলনকে বেশ গুছিয়ে আনছিলেন তারা। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদেরও। কার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করবেন, নিজেদের নাকি শেখ মুজিবের?
আর দেশে যারা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়েছেন তারা বিরক্ত। শেখ মুজিব কি বামপন্থীদের এতদিনের সগ্রামকে হাইজ্যাক করতে চান? বাকশালের মাধ্যমে এ কেমন সমাজতন্ত্রের বনভোজন শুরু করেছেন শেখ মুজিব?
শেখ মুজিব নিজের ডানে, বায়ে জন্ম দেন মারাত্মক সব শক্রর। বাকশালের মাধ্যমে শেখ মুজিব চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন চারদিকে। হয় তুমি আমার পক্ষে, নয় তুমি বিলুপ্ত।
শেখ মুজিব অনেকের জন্যই হয়ে দাঁড়ালেন মূর্তিমান প্রকাণ্ড এক বাধা। বাকশাল যদি ব্যর্থ হয়, শেখ মুজিব যদি দৃশ্যপট থেকে সরে যান তবে তা কারো জন্য অস্তিত্বের বিজয়, কারো জন্য স্বস্তি, কারো জন্য তা প্রত্যাশিত পরিবর্তন। চারদিক থেকে শুরু হয়ে যায় বাকশাল মোকাবেলার আয়োজন। বহুমুখী বিরুদ্ধ শক্তির রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। সম্ভাবনা দেখা দেয় একটি পট পরিবর্তনের। কিন্তু গুটিটা কে চালাবেন? ডানপন্থীরা না বাম?
৬২. সক্রিয় গণবাহিনী
মিটিংয়ে বসেন জাসদ নেতৃবৃন্দ। বাকশাল বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান কি হবে তাই নিয়ে আলাপ করেন তারা।
তাহের ইতোমধ্যে সক্রিয়ভাবে জড়িত জাসদের কর্মকাণ্ডে। তিনিও আছেন মিটিং এ।
তাহের বলেন : বাকশালের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল চরিত্রের পরিবর্তন হবার কোনো কারণ তো আমি দেখি না।
সিরাজুল আলম খান : শেখ মুজিব শুধুমাত্র তার আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধ লড়তে চাইছেন।
ড. আখলাক : কিন্তু সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে এভাবে একটা বেপথে চলে যেতে দেওয়া যায় না।
ইনু : বাকশাল হবার পর থেকে ইতোমধ্যে সারা দেশে সাড়াশি আক্রমণ চালিয়ে অজস্র জাসদকর্মীকে কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছে।
সিরাজুল আলম খান : আমরা ওপেন পলিটিক্সের একটা সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব পার্টি ব্যান্ড হয়ে গেলে সুযোগটা তো আর থাকছে না। এখন আমাদের এগ্রেসিভ হওয়া ছাড়া উপায় নাই। গণআন্দোলনের সুযোগ যখন আর নাই, আমাদের হার্ড কোর গ্রুপটাকে সক্রিয় হতে হবে এখন, সশস্ত্র গণবাহিনী তৈরির গতি বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের গণবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল তাহের এ ব্যাপারে আমাদের লিড করবেন।
তাহের : আমি ইতোমধ্যেই গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করেছি। ইতোমধ্যে সারাদেশে আমাদের ভালো গণভিত্তি তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের সম্ভবত একটা সশস্ত্র অভূত্থানের দিকেই যেতে হবে। আমাদের দ্রুত গণবাহিনীর সদস্যদের গেরিলা ট্রেনিং শুরু করতে হবে। কয়েক বছর আগে সিরাজ শিকদারের দলের জন্য যে ট্রেনিং ম্যানুয়াল করেছিলাম সেটা রিভাইস করছি। ওটা করেছিলাম গ্রামের গেরিলা যুদ্ধের জন্য। মায়ের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের স্ট্যাটেজি ছিল আমাদের। কিন্তু আমাদের রেভুলেশনটা তো চীনা স্টাইলে হবে না, হয়তো খানিকটা বলশেভিক স্টাইলে হবে। প্রথমত শহরের শক্তিকেন্দ্রগুলোকে দখল করতে হবে আমাদের তারপর তার সমর্থনে আমাদের গণসংগঠনের কর্মীদের মোবিলাইজ করতে হবে। আমাদের কনফনট্রেশনটা হবে প্রথমত শহরে। আমি তাই শহরভিত্তিক গেরিলা স্ট্যাটেজিগুলো ডেভেলপ করছি। আমাদের গণবাহিনীর প্রচুর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, ফলে তাদের অলরেডি আর্মস ট্রেনিং কিছু আছে।
ব্যস্ততা বেড়ে যায় তাহেরের। দিনে ড্রেজার সংস্থার অফিসের কাজ আর রাত জেগে শহরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি এবং রণকৌশলের ওপর ম্যানুয়াল আর ধারাবাহিক বক্তৃতা তৈরি করা। জয়া আধো আধো বোলে ছড়া বলে তখন আর ছোট ছোট পা ফেলে হাটে যীশু তাহের কোলে তুলে নেন জয়া আর যীশুকে, চুমু খান ওদের গালে। বলেন : লুৎফা, পার্টিতে এখনই এতটা একটিভ রোলে আসতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু পলিটিক্স এমন একটা টার্ন নিল যে হঠাৎ করে আমার রেসপনসিবিলি অনেক বেড়ে গেছে। সামনে যে কি আছে বুঝতে পারছি না।
লুৎফা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দূর থেকে দেখেন তার ব্যস্ত, গোপন বিপ্লবী স্বামীকে। জয়া, যীশুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেন তিনি।
নতুন করে পড়াশোনার মাত্রা বেড়ে যায় তাহেরের। রাতে বিছানায়, খাবার টেবিলে এমনকি টয়লেটেও বই নিয়ে ঢোকেন তিনি। ঠোঁটে সিগারেট। বক্তৃতা মালা তৈরি করতে গিয়ে ব্রাজিল, উরুগুয়ে প্রভৃতি দেশের শহুরে গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতাগুলোর ওপর ব্যাপক পড়াশোনা করতে শুরু করেন তাহের। সেগুলো উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের উপযোগী করে। অভ্যুত্থানমূলক রণনীতিতে শহরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের গুরুত্ব, শহরে গেরিলা যোদ্ধার টিকে থাকার কৌশল, কি করে শিল্পাঞ্চলে, সেনা অবস্থানের চারপাশে গেরিলা সংগঠন করতে হয়, কি করে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে সে সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান করতে হয়, ঝটিকা আক্রমণ শেষে পালিয়ে আসতে হয় এই সব এক একটি প্রসঙ্গের ওপর বক্তৃতা তৈরি করেন তাহের। ঐ বক্তৃতা ঢাকার গণবাহিনীর এরিয়া কমান্ডারদের প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হয়। একটা পুস্তিকা আকারে সে নির্দেশনা সাইক্লোস্টাইল করে দেশের অন্যান্য এলাকাতেও পাঠায় জাসদ।
গণবাহিনীর নামে দেয়াল লিখন, ঝটিকা সভা, লিফলেট ছড়ানো ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি ৭৪-এর ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হরতালও ডাকে জাসদ। আগের রাতে বোমা বানাতে গিয়ে মারা যান বুয়েটের মেধাবী শিক্ষক জাসদকর্মী নিখিল রঞ্জন সাহা। তার নামে জাসদ তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমার নাম রাখে নিখিল নোমা। বোমার সশব্দ প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকার জন্যই গণবাহিনী বোমাকে তাদের উপস্থিতি জানানোর অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে।
রক্ষীবাহিনী গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক তল্লাসি চালিয়ে গণহারে গ্রেফতার করতে থাকে জাসদকর্মীদের। জাসদ তার পার্টি পত্রিকায় লেখে, দেশে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, এখন সগ্রাম অর্থ যুদ্ধ। বাকশালের চ্যালেঞ্জ জাসদকে বাধ্য করে একটা মৃদু অবস্থান থেকে জঙ্গি অবস্থানে চলে আসতে। গণআন্দোলনের স্তর পেরিয়ে পাটি যেহেতু সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে ঝোঁকে, ফলে পার্টিতে তাহেরের অবস্থানেরও একটা গুনগত পরিবর্তন ঘটে। এযাবত তাহের ছিলেন পার্টির সহযোগী সংগঠন গণবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ, এই পর্যায়ে যেহেতু গণবাহিনী আন্দোলনের কেন্দ্রে চলে আসে, তাহেরও চলে আসেন পার্টি নেতৃত্বের পুরোভাগে।
৬৩. লাল ঘোড়া
শহরে, গ্রামে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে আগে থেকেই প্রবল চাপের মুখে রেখেছেন সিরাজ শিকদার। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবার পর তার তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দেন সিরাজ শিকদার। চুয়াত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে হরতাল ডাকে সর্বহারা পার্টি। বোমা ফাটিয়ে, লিফলেট বিলি করে আতঙ্ক তৈরি করে তারা। দেশের নানা এলাকায় তাদের ডাকে হরতাল সফলও হয়। রক্ষীবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন খুঁজছে সিরাজ শিকদারকে। সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেড মানুষ তিনি। কিন্তু তার নাগাল পাওয়া দুষ্কর। কঠোর গোপনীয়তায়, নানা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ান তিনি। নিরাপত্তার জন্য এমনকি নিজের দলের ভেতর কারো আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন তিনি।
১৬ ডিসেম্বর হরতাল সফল হবার পর আরও ব্যাপক কর্মসূচি নেবার পরিকল্পনা নিয়ে সিরাজ শিকদার তখন তার পার্টি নেতৃবৃন্দের সাথে লাগাতার মিটিং করছেন চট্টগ্রামে। একেক দিন থাকছেন একেক গোপন আস্তানায়। ১৯৭৫ এর প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে হালিশহরের কাছে এক গোপন শেল্টার থেকে একজন পার্টি কর্মীসহ সিরাজ শিকদার যাচ্ছিলেন আরেকটি শেন্টারে। বেবিট্যাক্সি নিয়েছেন একটি। সিরাজ শিকদার পড়েছেন একটি দামী যিয়া প্যান্ট এবং টেট্রনের সাদা ফুল শার্ট, চোখে সান গ্লাস, হাতে ব্রিফকেস। যেন তুখোড় ব্যবসায়ী একজন। বেবিট্যাক্সিতে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে একজন অপরিচিত লোক এসে তার কাছে লিফট চায়, বলে তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ, ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন, সে সামনেই নেমে যাবে। শিকদার বেশ কয়বার আপত্তি করলেও লোকটির অনুনয় বিনয়ের জন্য তাকে বেবিট্যাক্সিতে তুলে নেন। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের কাছে আসতেই অপরিচিত লোকটি হঠাৎ লাফ দিয়ে বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভারকে পিস্তল ধরে থামতে বলে। কাছেই সাদা পোশাকে বেশ কয়জন অপেক্ষমাণ পুলিশ স্টেনগান উঁচিয়ে ঘিরে ফেলে বেবিট্যাক্সিকে। স্বাধীন বাংলাদেশের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী, যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও তার দলের সদস্যেরই বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে যান পুলিশের হাতে।
সিরাজ শিকদারকে হাত কড়া পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ডাবল মুরিং থানায়। সেদিন সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফকার বিমানে তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা। তাকে রাখা হয় মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সরকারের ত্রাস, বহুল আলোচিত, রহস্যময় এই মানুষটিকে এক নজর দেখবার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্য, আমলাদের মধ্যে ভিড় জমে যায়।
৩ জানুয়ারি সারা দেশের মানুষ পত্রিকায় পড়ে, বন্দি অবস্থায় পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক শিকদার ওরফে সিরাজ শিকদার। ছাপানো হয় সিরাজ শিকদারের মৃতদেহের ছবি।
সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর খবরে মর্মাহত হন তাহের। যদিও তাহের এবং সিরাজের পথ হয়ে গিয়েছিল ভিন্ন। তবু উভয়ের জীবনের পথ অন্তত কিছুটা সময় মিলেছিল এক বিন্দুতে। ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন তারা একত্রে। সিরাজ তার মতোই যুথভ্রষ্টের দলে। মেধাবী প্রকৌশলী চেনা জীবনের ছক ছেড়ে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রাইফেল। পৃথিবী বদলে ফেলবেন বলে গোপন আস্তানা গেড়েছেন টেকনাফের পাহাড়ে। আশ্রয় নিয়েছেন মুরং পাড়ায়, কবিতা লিখেছেন, হায় কবে নিটোল স্বাস্থ্যবতী মুরং তরুণীর কাঁধে উঠবে রাইফেল? দুর্ধর্ষ যুদ্ধ করে পেয়ারা বাগান মুক্ত করে রেখেছিলেন পাকবাহিনীর হাত থেকে। সর্বহারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে শুরু করেছিলেন কঠোর, অপ্রিয়, সহিংস সংগ্রাম। তিনি একাই হয়ে উঠেছিলেন বিশাল ক্ষমতাশীল সরকারের সবচাইতে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ।
স্তব্ধ করে দেওয়া হলো তাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে শুরু হলো তাৎপর্যপূর্ণ মৃত্যুর আড়ম্বর। এই স্বাপ্নিক বিপ্লবীর পুরো গল্পটি কেউ একদিন হয়তো আমাদের শোনাবেন। কিন্তু আপাতত সিরাজ শিকদারের মৃত্যু বিষয়ক সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি অধিকাংশ মানুষই অবিশ্বাস করে। মানুষের ধারণা হয় পুলিশ প্রহরায় সচেতনভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিহিংসা বা হত্যার রাজনীতি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য নয়। ফলে তার নির্দেশে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়েছে সেটি হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তার একজন প্রবল প্রতিপক্ষ ঘায়েল হওয়াতে তার ভেতর একটা স্বস্তি লক্ষ করা যায়। তিনি এমনকি জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় বলেন : আমি লাল ঘোড়া দাবড়ায়ে দিছি… কোথায় সেই সিরাজ শিকদার?
৬৪. উর্দি পরা কৃষক
সিরাজ শিকদারের মৃত্যুতে সর্বহারা পার্টি হয়ে পড়ে নাজুক। সরকারের জন্য তারা আর তখন বড় কোনো হুমকি নয়। এতে করে শেখ মুজিব এবং তার সরকারের অন্যতম প্রতিপক্ষ তখন হয়ে দাঁড়ায় জাসদ। সিরাজ শিকদার বিষয়ে শেখ মুজিবের উক্তি ক্ষুব্ধ করে জাসদের কর্মীদের। আতঙ্কিতও করে। জাসদের নেতা হকর্মীদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে আগেই। তারা ভাবে হয়তো এই দমননীতি আরও কঠোর হয়ে উঠবে। হয়তো জাসদের বড় বড় নেতাকেও হত্যা করা হবে।
জাসদ ক্রমাগত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তাদের আন্দোলন। তাদের অধিকাংশ প্রধান নেতা তখন জেলে বন্দি। ফলে গণআন্দোলনের কার্যক্রম নানাভাবে ব্যাহত। তাদের মনোযোগ তখন দলের অঙ্গসংগঠন গণবাহিনীর দিকে। গণবাহিনীই তখন জাসদের মূল চালিকা শক্তি। ফলে জাসদ রাজনীতির অন্যতম ভূমিকায় তখন গণবাহিনী প্রধান তাহের। একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সুচারু পরিকল্পনায় তাহের গুছিয়ে তুলছেন গণবাহিনীকে। ঢাকা শহরকে অনেকগুলো ইউনিটে ভাগ করেছেন তিনি। প্রতি ইউনিটে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন মিলিটারি কমান্ডার, একজন পলিটিক্যাল কমিশার। মিলিটারি কমান্ডার তার ইউনিটের গণবাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেবেন আর পলিটিক্যাল কমিশার দেবেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রশিক্ষন। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় দেয়াল লিখন তখন, বিপ্লবী গণবাহিনীতে যোগ দিন। তাহের মূল পরিকল্পনাগুলো করে চলেছেন, তাকে সহযোগিতা করছেন ইনু আর নেপথ্য থেকে পরামর্শ দিচ্ছেন সিরাজুল আলম খান। জাসদের অন্য নেতাদের সঙ্গে সময় সময় মিটিং হচ্ছে তার।
সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহেরও নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন তারা। বৈধ অস্ত্র আছে সেনাবাহিনীর ভেতর, ফলে সেনাবাহিনীতে গণবাহিনীর একটি ভিত্তি গড়ে তুলবার প্রয়োজন বোধ করেন তাহের। কৃদিও সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন তাহের তবু ক্যান্টনমেন্টে বিশেষ করে সিপাইদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অনেক সিপাই ১১ নম্বর সেক্টরে তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিংবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তার সঙ্গে কাজ করেছেন লাঙ্গল ব্রিগেডে।
এসময় সেনাবাহিনীর সিপাইদের মধ্যেও নানাবিধ হতাশা। সব সৈন্যদের প্রশিক্ষণ, বাসস্থান, বস্ত্র দিতে পারেনি সরকার। অনেকেই ব্যারাকের মেঝেতে, বারান্দায় থাকেন মাসের পর মাস। যে সিপাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেশগড়ার কাজে যোগ দিতে চান। ক্যান্টনমেন্টের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা। অফিসারদের সঙ্গে সৈনিকদের প্রতিষ্ঠিত অধস্তনীয় সম্পর্কেও ধরেছে চির। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বদলে দিয়েছে তাদের মানস। যুদ্ধের সময় যে অফিসারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গনে অস্ত্র চালিয়েছেন তারা, থেকেছেন একই তাবুতে, স্বাধীনতার পর তারা হয়ে উঠেছেন সুদূরের মানুষ। এক লাফে মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন তারা। অথচ সিপাইদের জীবনে বদল ঘটেনি কিছুই। তারা ব্যারাকের বারান্দায় শুয়ে এখন মশা মারছেন। এসব মিলিয়ে সেনাবাহিনীর নিচু স্তরের সদস্যদের মধ্যে তখন তৈরি হয়েছে ভিন্ন এক অসন্তোষ।
এ সময় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক নিজেদের মধ্যেই একত্রিত হয়ে একটি ছোট সংগঠন তৈরি করেন দেশের অরাজকতা, সেনাবাহিনীর ভেতর বৈষম্য এগুলোর বিরুদ্ধে কিছু একটা করবার ভাবনা নিয়ে। নায়েব সুবেদার মাহবুবর রহমান, নায়েব সুবেদার জালালউদ্দীন আহমেদ, এয়ার ফোর্সের কর্পোরাল ফখরুল আলম প্রমুখেরা ছিলেন এর নেতৃত্বে। তারা ক্যান্টনমেন্টের বাইরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন। ব্যারাকে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকার কারণে সে সময় অনেক সৈন্যদের বেসামরিক এলাকায় থাকতে দেওয়ার অনুমতি দেয় হয়। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন দেশের নতুন সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাও ততটা কঠোর নয়। ফলে অনেক সৈনিকই শহরের নানা স্থানে আয়োজিত রাজনৈতিক জনসভাগুলোতে যোগ দেন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকরা, যারা আওয়ামী শাসনের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ, তারা আকর্ষিত হন জাসদের রাজনীতিতে। জাসদের মেজর জলিলের সাথে যোগাযোগ করেন তারা। তাহের যেহেতু কোনো প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে থাকতেন না এবং জনসমক্ষে তার নামও উচ্চারিত হতো না, ফলে অনেকেই জাসদের সঙ্গে তাহেরের সংশ্লিষ্টতার কথা জানতেন না। সৈনিকদের সঙ্গে পরবর্তীতে সিরাজুল আলম খানেরও দেখা হয়। জলিল এবং সিরাজুল আলম সৈনিক নেতাদের পরিচয় করিয়ে দেন কর্নেল তাহেরের সঙ্গে এবং তার সঙ্গেই যাবতীয় যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেন।
সেনাবাহিনীর ভেতর কাজ করবার সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছিলেন তাহের। এই সৈনিক নেতাদের সুবাদে একটা শুভযোগ ঘটে যায়। সৈনিকদের সঙ্গে তাহের এবং ইনুর মিটিং হয় এলিফ্যান্ট রোডে বড় ভাই আবু ইউসুফের বাসায়। কেউ কেউ তাহেরকে আগেই জানতেন। তাহের সৈনিকদের জাসদের রাজনীতি এবং তার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা বলেন। তাদের বলেন : সৈনিকরা বছরের পর বছর ক্যান্টনমেন্টে লেফট রাইট করবে কবে যুদ্ধ বাধবে সেজন্য আর দেশের মানুষের দেওয়া ট্যাক্সের স্বার্ট সত্তরভাগ বসে বসে খাবে, আমাদের মতো গরিব দেশে এটা তো হতে পারে না, এটা অন্যায়। এ অবস্থা পাল্টাতে হবে।
সৈনিকরা প্রবলভাবে সমর্থন করেন তাহেরের বক্তব্য।
অভ্যুত্থানের লক্ষ্যে তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ভেতর কাজ করতে সম্মত হন সৈনিকরা। সেনাবাহিনীর অধস্তন কিছু নন কমিশন অফিসার এবং সৈনিক যোগ দেন জাসদে। এক ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ হয় জাসদে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে ক্যান্টনমেন্টে অতি সন্তর্পণে কাজ শুরু করেন তারা। নন কমিশনড অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বাড়তে থাকে সংগঠনের আকার। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় তাহের এবং ইনুর। শহরের নানা জায়গায় গোপনে মিটিং চলে তাদের সেনাবাহিনীর শিথিল শৃঙ্খলার সুযোগে প্রায়ই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা চলে আসেন বুয়েটে ইনুর হোস্টেলে। সেখানে দীর্ঘক্ষণ চলে রাজনীতির ক্লাস। সিপাইদের সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
ইনু একফাঁকে তাহেরকে বলেন, ক্যান্টনমেন্টে অফিসারদের মধ্যেও কি আমাদের কাজ করা উচিত না?
তাহের বিশেষ আগ্রহ দেখান না। বলেন : অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করে লাভ নাই। ওরা সব ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে। আমি কুমিল্লায় তো তাদের নিয়ে পলিটিক্যাল ক্লাস করেছি। ওদের মাইন্ড সেট বদলানো খুব ডিফিকাল্ট। ওদের কনসার্ন হচ্ছে চেইন অব কমান্ড, ডিসিপ্লিন এসব। রেভ্যুলেশনারি কিছু কাজ ওদের দিয়ে করানো সমস্যা। তাছাড়া সৈনিকরা তো সব এদেশের কৃষকেরই সন্তান। তুমি তো জানো লেনিন এদের বলেছিলেন ইউনিফর্ম পড়া কৃষক। অফিসাররা খুব বেশি কাজে আসবে না, এই সৈনিকরাই মূলত আমদের রেভুলেশনারী শক্তি।
ইনু : তা ঠিক। তবু ধরেন আফিসারদের মধ্যে ছোটখাটো একটা বেইজ করতে পারলেও আমাদের লাভ হতো। কারো সাথে কি কথা হয়েছে কখনো?
তাহেরঃ কিছু ইয়াং এজিটেডেড অফিসার আছে। এরা বিভিন্ন সময় এসেছে আমার কাছে। বলে, সিচুয়েশন খারাপের দিকে যাচ্ছে, একটা কিছু করে ফেলা দরকার। আমি ওদের বলেছি পলিটিক্সটা বোঝ। কিছু করবার আগে সোসাল এনালাইসসটা বোঝ। মার্ক্সবাদের বেসিক কিছু বইপত্র ওদের দিয়েছি। এরপর থেকে দেখি ওরা আর আসে না। তবে অফিসারদের মধ্যে একমাত্র মেজর জিয়াউদ্দীন আছে আমাদের সাথে। ঐ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকেই সে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে। সুন্দরবনে ট্রিমেন্ডা ওয়ার করেছে সে। জিয়াউদ্দীন আসবে আমাদের সঙ্গে। আর সিনিয়রদের মধ্যে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তো আমার যোগাযোগ আছেই। আমরা কি করছি তিনি তা জানেন। তিনি তো সবসময় একটা নো মানস ল্যান্ডে থাকেন। তবে কিছু একটা ঘটলে আমার বিশ্বাস হি উইল নট গো এগেইনস্ট আস।
৬৫. মৌমাছি
যেমন রানী মৌমাছিকে ঘিরে থাকে যৌচাকের সমস্ত মৌমাছি। তাহেরকেও তেমনি ঘিরে আছে তার পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তাহেরর চারপাশে যেমন যোদ্ধার বেশেই ছিল তার সব ভাই বোন, তাহের যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জাসদের গণবাহিনীর নেতৃত্বে তখনও তার পরিবার সক্রিয়ভাবে আছেন তার পাশে।
আনোয়ার গণবাহিনীর ঢাকা অঞ্চলের প্রধান। সর্বক্ষণ আছেন তাহেরের সঙ্গে। ক্লাসদ এবং সৈনিক সংস্থার প্রায় সবগুলো মিটিংয়েরই অনিবার্য স্থান বড় ভাই আবু ইউসুফের এলিফেন্ট রোডের বাসা। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তে ইউসুফের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তাহেরের ছোট ভাই বেলাল আর বাহার বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীতে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও নানা প্রশাসনিক জটিলতায় শেষ পর্যন্ত সেটি হয়ে ওঠেনি। তারা দুজনই তখন গণবাহিনীর সক্রিয় সদস্য। তারা দুঞ্জন ঢাকার দুটি ইউনিটের মিলিটারি কমার। এছাড়াও বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য গণবাহিনীর একটি সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করা হয়েছে, যার অন্যতম সদস্য বেলাল এবং বাহার।
তাহের যখন জাসদে যোগ দিয়েছেন তখনআরেক ভাই সাঈদ কাজলায় তাহেরের দেওয়া ট্রাক্টরে কৃষিকাজ করছেন, গ্রামে চালাচ্ছেন বয়স্ক শিক্ষার স্কুল। তাহেরের আহ্বানে সাঈদ গণবাহিনীতে যোগ দিলেও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জাসদের রাজনীতি নিয়ে নানা প্রশ্নবাণে তিনি ব্যস্ত রাখেন তাহেরকে। একদিন ইউসুফের বাসায় ড. আখলাক এক পীরের আলাপ করছিলেন, তিনি যার ভক্ত। ঠোঁটকাটা সাঈদ বলেন : মার্কিস্ট মানুষ পীরের আস্তানায় যায় এ আবার কেমন কথা। তাহের ভাই আগেই বলছি সাবধানে থাইকেন কিন্তু।
এবারও বকা দিয়ে সাঈদকে থামিয়ে দেন তাহের।
এসময় নেত্রকোণায় এক আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন। আওয়ামী লীগের দুই শত্রু সর্বহারা এবং জাসদ দুটোর সঙ্গেই যোগ রয়েছে সাঈদের। কাজলায় কৃষিকাজে ব্যস্ত সাঈদকেই সন্দেহ করা হয়। মিথ্যা মামলায় জেল হয়ে যায় তার। তাহের এবং তার ভাইরা যখন গণবাহিনী তৈরিতে ব্যস্ত তখন এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সাঈদ জোলে।
শুধু বড় ভাই আরিফ রাজনীতি থেকে দূরে, সরকারি চাকরি করেন। তবে বড় ভাইয়ের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা ব্যাপারটিও পরিবারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গণবাহিনী নিয়ে তাহের যখন তৎপর হয়ে উঠেছেন তখন তিনি আরিফের মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়ে বার বার বলে এসেছেন : আরিফ ভাই আপনি কিন্তু মিজেকে এসব থেকে দূরে রাখবেন। আপনার সেইফ থাকা দরকার। আমরা মুভমেন্টের যে স্টেজে আছি তাতে যেকোন সময় সবগুলো ভাই গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি। একটা বড় বিপদ নেমে আসবে আমাদের বৌ বাচ্চাদের ওপর, ডালিয়া জুলিয়া এখনও ছোট। একজনকে সেইফ থাকা দরকার এদেরকে প্রোটেষ্ট করার জন্য।
আরিফ বলেন : সব ভেবেচিন্তে করছ তো? পার্টি পলিটিক্সে তুমি তো নতুন। জাসদ নিয়ে কিন্তু নানা রকম কথাও শোনা যায়।
তাহের ভাই : আমার পলিটিক্যাল মিশন তো আজকের না বড় ভাইজান আপনি সেটা জানেন। একটা পার্টির মধ্যদিয়ে তো আমাকে মিশনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অনেক তো দেখলাম, বহুজনের সাথেই কথা বলালাম। এ মুহূর্ত এদেরকেই আমার সঠিক রেভুলেশনারি পার্টি মনে হচ্ছে। সন্দেহের কথা বলছেন? সেটা তো আছেই। আমি বিশ্বাস রাখতে চাই।
বাড়ি থেকে বের হবার সময় ঠাট্টা করে তাহের বলেন : বাই দি ওয়ে আমরা যদি পাওয়ারে চলে যাই তখন কিন্তু কারো কোনো পারসোনাল প্রপার্টি থাকবে না। আপনার মোহাম্মদপুরের এই বাড়ি তখন আমরা নিয়ে নেব।
হাসেন আরিফ।
ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে তখন নিয়মিত জাসদের মিটিং। তাহের প্রায় দিনই নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে আসেন এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িটিতে। মাঝে মাঝে লুৎফাও আসেন তার সঙ্গে। বাড়িতে অগণিত মানুষের আনোগোনা, তাদের দেখাশোনা, চা নাস্তা, খাওয়া দাওয়ার শ্রমসাধ্য কাজটি করে চলেছেন ইউসুফের স্ত্রী ফাতেমা।
ফাতেমা বলেনঃ বুঝলে লুৎফা আমার এটা তো কোনো বাসা না, সংসার করব কি, এটা তো একটা পার্টি অফিস। তাহের বলেন : ভাবী, সত্যি ভীষণ খারাপ লাগে, যেভাবে বিপ্লবীরা দখল করেছে আপনার বাড়ি! ক্ষমা করে দেন। বিপ্লব যদি সফল হয় আপনার কন্ট্রিবিউশন কিন্তু আমরা ভুলব না।
ফাতেমা, লুৎফা কারোরই বাঙালি নারীর স্বপ্নের গৃহকোণ রচনার সুযোগ আর হয় না। বিচিত্র বিপ্লবী ব্রাদার্স পার্টিকে সামলাতেই হিমসিম খান তারা।
রাতে সব ভাইর খেতে বসেন এক সাথে। অবিরাম কথা হয় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে।
তাহের বলেন : গণবাহিনী যেভাবে এক্সপান্ড করছে আমি খুব আশাবাদী। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার এই ডেভেলভমেন্টটাও আমাদের জন্য একটা বড় প্লাস পয়েন্ট।
আনোয়ার : কবে নাগাদ আমরা একটা চূড়ান্ত অ্যাকশানে যেতে পারব বলে মনে করেন।
তাহের : জাসদের লিভারদের জেল থেকে বের করে আনা জরুরি। তবে যে গতিতে সব এগোচ্ছে তাতে আমি তো মনে করি বছর খানেকের মধ্যেই আমরা একটা ফাইনাল অ্যাকশনে যেতে পারব। আমি টার্গেট করছি ছিয়াত্তরের মাঝামাঝি বা শেষ নাগাদ।
ইউসুফ : অবশ্য শেখ মুজিব কি ধরনের অ্যাকশনে যাবেন তার ওপরও নির্ভর করছে।
তাহের : তা অবশ্য ঠিক।
ইউসুফ : আসলে শেখ মুজিব রিয়েলিটিটা বুঝতে পারছেন না। ইতিহাসে সব নেতারই একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে, সে ভূমিকাটা তিনি পালন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এজেন্ডাটা তিনি পূরণ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির যে এজেন্ডা সেটা তার একার পক্ষে ফুলফিল করা তো সম্ভব না। এখানে এসে তার উচিত ছিল স্পেসটা ছেড়ে দেওয়া। উল্টো তিনি আরও বেশি বেশি সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। ফলে এরকম একটা সশ্ব আপ রাইজিং ছাড়া ক্ষমতা বদলের আর কোনো অপশন তিনি রাখছেন না।
লুৎফা : আচ্ছা, তোমরা যদি পাওয়ারে যাও তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কি করবে?
তাহেরঃ সেটা পরিস্থিতিই বলে দেবে। আমি মনে করি বাংলাদেশের হিস্ট্রিতে তার যে কন্ট্রিবিউশন আছে সেটাকে আমরা অবশ্যই সম্মান জানাবো। ইন্দোনেশিয়ার কমুনিস্ট পার্টি সুকর্নকে একটা সেরিমোনিয়াল রোলে রাখতে চেয়েছিল, আমরাও সে রকম একটা কিছু করতে পারি।
ইউসুফের বাড়িতে রাতের খাওয়া খেয়ে, অনেক রাতে নারায়ণগঞ্জে বাড়ি ফেরে তাহের লুৎফা। ক্রাচ সামলে ড্রেজার কোম্পানির জীপে ওঠেন তাহের। ড্রাইভার গাড়ি চালায়। লুৎফার কোলে মাথা রেখে গাড়ির সিটের উপর ঘুমিয়ে জয়া, তাহেরের কোলে যিশু। অন্ধকারে হেডলাইটের আলো ফেলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের হাইওয়েতে চলে জীপ।
সামনের রাস্তায় সোজা তাকিয়ে থাকা তাহেরের দিকে আড় চোখে দেখে লুৎফা। সেই কবে বিয়ের পর ঈশ্বরগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ট্রেনের কামরায় এমনি কতবার আড় চোখে দেখেছে তাহেরকে। পাশে বসা সেই মানুষটি এখন কেমন যেন এক দূর গ্রহের মানুষ। তিনটি জীবন তার। একটি ড্রেজিং কোম্পানির সরকারি চাকুরের, একটি প্রাক্তন সামরিক অফিসারের, আরেকটি গোপন বিপ্লবীর। যে মানুষটি এই তিনটি জীবন যাপন করছে সে মানুষটি আবার পঙ্গু। এক পায়ের জীবন তারা যেন ক্রাচে ভর দেওয়া এক বিচিত্র অ্যাক্রোব্যাট, সমান্তরালে টেনে নিচ্ছেন তিনটি জীবন। তিন জীবনেরই সাক্ষী, সহযোগী লুৎফা। তাহের যখন বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন লুকা তখন তৃতীয় বারের মতো গর্ভবতী। মিশু তার গর্ভে।
৬৬. বেবিট্যাক্সির লাইসেন্স
একটি বেবিট্যাক্সির লাইসেন্সের দরখাস্ত নিয়ে জনৈক মেজর আবদুর রশীদ হাজির হন পুরান ঢাকার আগামসি লেনে খন্দকার মোশতাকের তিনতলা বাড়িতে। খন্দকার মোশতাক তখন আওয়ামী লীগের বাণিজ্য মন্ত্রী। রশীদের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। তার পাশের গ্রামের পীর হযরত খন্দকার কবিরুদ্দিন আহমদের ছেলে খন্দকার মোশতাক আহমদ। পাশের গ্রামের একজন আর্মি অফিসার এসেছেন একটা বেবিট্যাক্সির লাইসেন্সের জন্য, ব্যাপারটি নেহাত মামুলি। আলাপ চালান মোশতাক। কিন্তু বেবিট্যাক্সি মেজর রশীদের ওছিল মাত্র। কথা উঠে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। দেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ, বলেন রশীদ।
মোশতাক বলেন : অবশ্যই।
দেশে একটা পরিবর্তন দরকার : বলেন রশীদ।
মোশতাক বলেন : অবশ্যই।
নেতৃত্বের একটা পরিবর্তন দরকার : বলেন রশীদ।
মোশতাক বলেন : তা ঠিক।
মেজর রশীদ বলেন : শেখ মুজিবকে সরিয়ে দিলে কেমন হয়?
নড়েচড়ে বসেন মোশতাক : দেশের স্বার্থে সেটা ভালো কাজ হবে। তবে কাজটা কঠিন।
মেজর রশীদ বলেন : সেই কঠিন কাজটি করার ব্যবস্থা আমরা করছি। আপনি কি আমাদের সঙ্গে থাকবেন?
খন্দকার মোশতাক বলেন তিনি তাদের সঙ্গে থাকবেন। সেই খন্দকার মোশতাক যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি বলে তাজউদ্দীনের সঙ্গে বিবাদ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই চলে যেতে চেয়েছিলেন মক্কায়, যিনি মাঝপথে মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে আমেরিকার সহায়তায় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন এবং একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা যিনি সবসময় টুপি এবং আচকান পরে থাকেন।
একটি পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তখন বাংলাদেশে। প্রশ্ন ছিল, পরিবর্তনের গুটিটা কে চালবেন, বামপন্থী না ডানপন্থীরা? পরিবর্তনের দাবিতে বামপন্থীদের মধ্যে সবচাইতে সোচ্চার তখন সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদার, আর অন্যদিকে জাসদ। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুতে সর্বহারার দাবি স্তিমিত। দাবি জাগরুক রেখেছে জাসদ। তারা ব্যাপক গণজাগরণের মধ্য দিয়ে, সচেতন জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বিপ্লবী গণবাহিনীর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু আমেরিকা আর পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষাকারী যে ডানপন্থীরা তখন পট পরিবর্তন চাইছেন তাদের পক্ষে কোনো জন সমর্থন অর্জন, গণজাগরণ সৃষ্টি অসম্ভব। ফলে তাদের জন্য যে একটি মাত্র পথ খোলা আছে সেটি হচ্ছে ষড়যন্ত্র। গোপনে, নিভৃতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ তাই নেমে পড়েছেন অতলান্ত গভীর এক ষড়যন্ত্রে।
৬৭. বুদবুদ
এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব হয়ে দাঁড়ান সেনাবাহিনীর দুই মেজর। শেখ মুজিব এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে চারপাশে যে অসংখ্য ক্ষোভের বুদবুদ, তেমনি দুটি বুদবুদের নাম মেজর আব্দুর রশীদ এবং তার ভায়রা মেজর দেওয়ান ইশরাতুল্লাহ সৈয়দ ফারুক রহমান ফারুক রাজশাহীর পীর বংশের সন্তান। দেশে যখন যুদ্ধ হচ্ছে মেজর ফারুক তখন আবুধাবীতে আর্মড রেজিমেন্টে স্কোয়াড্রন কমান্ডার হিসেবে কাজ করছেন। সেখান থেকে ১৯৭১ এ ১২ ডিসেম্বর স্বাধীনতার মাত্র তিনদিন আগে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন ফারুক তিনদিনের মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের সাথে মেজর আবদুর রশীদের পরিচয় পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুর মিলিটারি একাডেমীতে। যুদ্ধের সময় রশীদ পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীন হবার মাস খানেক আগে পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। ফারুক আবেগ প্রবণ, প্রগলভ, রশীদ ধীর, স্থির, স্বল্পবাক। চট্টগ্রামের এক নামজাদা শিল্পপতির দুই মেয়েকে বিয়ে করেছেন তারা। এই দুই আধেক মুক্তিযোদ্ধার পুঁজি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাদের উগ্র ক্ষোভ। ফারুককে নিয়োজিত করা হয়েছিল দেশের নানা এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে, তখন অনেক অস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। সেসব অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে ফারুকের সাথে দ্বন্দ্ব, বিতণ্ডা বাধে আও্যামী অনেক নেতাকর্মীর, পরে এ কাজ থেকে প্রত্যাহার করা হয় তাকে। ক্ষোভ বাড়ে ফারুকের। যেহেতু তাদের এই ক্ষোভ বিশেষ গভীর কোনো রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা তাড়িত নয়, ইতিহাস তাই এই দুই মেজরের ক্ষোভের বুদবুদকে ব্যবহার করে আমেরিকাপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, ইসলামপন্থীদের ষড়যন্ত্রের অনুকূলে। এই দুই বুদবুদকে দিয়ে ইতিহাস ঘটিয়ে নেয় এদেশের নাটকীয়তম ঘটনাটি।
তারা জানেন দেশের যা পরিস্থিতি তাতে শেখ মুজিব দৃশপট থেকে সরে যাক সেটি বহুজনের প্রত্যাশা। যদি তাই হয় তাহলে গণজাগরণের মতো দীর্ঘমেয়াদী ইত্যাকার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন কি? শেখ মুজিবকে স্রেফ হত্যা করে আক্ষরিক অর্থে দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলে দিলেই তো চলে। সে সাহস যদি কারো না থাকে আমাদের থাকবে-ভাবেন মেজরদ্বয়। আমাদের হাতে বৈধ অস্ত্র আছে, দরকার মোক্ষম একটা সুযোগের, প্রয়োজন এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবার মেজাজসম্পন্ন কয়েকজন মানুষ, দরকার শেখ মুজিবকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিস্থাপন করবার মতো একজন ব্যক্তি এবং সর্বোপরি এই নতুন অবস্থাকে টিকিয়ে রাখবার জনা দরকার একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থন। এই ভাবনা নিয়ে গোপনে, সন্তর্পণে পরিকল্পনা করতে থাকেন তারা।
প্রাথমিক সম্মতি পাবার পর আগামসি লেনের তিনতলা বাড়িতে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে একাধিক মিটিং চলে মেজর রশীদের। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ, টুপি আচকান পড়া শুকনো এই মানুষটি ভেতরে ভেতরে বস্তুত মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদেরই দলে। তিনি পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত হতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন ইসলামী ধারার দেশ, চেয়েছিলেন ধনতান্ত্রিক আমেরিকার বন্ধুত্ব, চেয়েছিলেন ক্ষমতা। কোনোটিই পাননি, বাকশাল গঠনের পর সে সম্ভবনা হয়েছে আরও ধূলিসাৎ। ফলে মেজর যখন বলেছে শেখ মুজিবকে সরিয়ে ফেলবার কথা, লুফে নিয়েছেন তিনি। বলেছেন সেটি হবে দেশের জন্য মঙ্গলজনক। পুরনো পাকিস্তান যখন পাওয়া গেল না এবার না হয় তৈরি করা যাক বাঙালিদের ছোট একটি পাকিস্তান।
মেজর রশীদ মোশতাককে জানান শেখ মুজিবকে সরিয়ে ফেলবার কঠিন কাজটির ব্যবস্থা করছেন তিনি এবং তার ভায়রা মেজর ফারুক। পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তিনি প্রস্তুত হতে বলেন খন্দকার মোশতাককে।
ফারুক সেনাবাহিনীর একমাত্র ট্যাঙ্ক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারের সহঅধিনায়ক, রশীদ টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার। ফারুকের দখলে ট্যাঙ্ক, রশীদের দখলে কামান। ঘটনাটি তাদের ঘটাতে হবে সেনাবাহিনীর অস্ত্রের জোরেই। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ের সমর্থন তাদের দরকার। মেজর বুদবুদদ্বয় ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়ার কাছে। পাকিস্তানের রিসালপুর মিলিটারি একাডেমীতে যখন ফারুক, রশীদ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তখন জিয়া তাদের প্রশিক্ষক। জুনিয়র অফিসার হলেও জিয়ার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ তাদের। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে জেনারেল জিয়ার ক্ষোভের কথা মেজর ফারুক, রশীদ ভালো করেই জানেন। জানেন যে সেনাপ্রধান না করার কারণে জেনারেল জিয়া ক্ষুব্ধ। এও জানেন জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবার যে গুজব উঠেছে তাতেও তিনি অত্যন্ত বিরক্ত। শেখ মুজিবকে অপসারণের পরিকল্পনা জেনারেল জিয়াকে জানান তারা।
বরাবরের মতো এবারও স্বভাবসুলভভাবে সাবধানী মন্তব্য করেন জিয়া; আমি এধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও তাহলে তোমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।
একজনের সঙ্গে আছি আবার নেই, অভূতপূর্ব এই এক দক্ষতা অর্জন করেছেন জেনারেল জিয়া। বহুবছর পর জিয়া যখন এদেশের রাজনীতির প্রধান এক কুশীলব তখন তার জীবনীকার ডেনিস রাইট মন্তব্য করেন : যখন ফলাফল অস্পষ্ট তখন খানিকটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব রকম পথ খোলা রাখা জিয়ার স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য।
তবে মেজরদ্বয়ের জন্য ঐ মন্তব্যটুকুই ছিল যথেষ্ট। তারা জুনিয়র অফিসার সুতরাং জানেন যে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেললেও ক্ষমতা তারা দখল করতে পারবেন না। সিনিয়র অফিসাররা তা মেনে নেবেন না, বরং কোনো প্রতিআক্রমণ বা প্রতিরোধ হলে তারা নিহত হবেন। তাদের প্রয়োজন কোনো সিনিয়র অফিসারের সবুজবাতি। জিয়ার ঐ মন্তব্যে তারা এইটুকু আশ্বস্ত হন যে তারা যদি একটা কিছু ঘটয়ে ফেলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান তা জানবেন, প্রত্যক্ষ সমর্থন না করলেও তিনি বাধা দেবেন না।
এরপর তাদের দরকার ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবার মতো কিছু বেপরোয়া মানুষ। এখানে পুঁজি হিসেবে পাওয়া যায় আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া সেই অপ্রীতিকর ঘটনাটি। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন একসাথে বরখাস্ত হয়েছিলেন মেজর ডালিম, নুর, রাশেদসহ বেশ কিছু অফিসার। শেখ মুজিবের কাছে বিচার চেয়েও কোনো ফল পাননি তারা। সেই থেকে বুকে শেখ মুজিবের ব্যাপারে প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেইসব ক্ষুব্ধ অফিসাররা, শেখ মুজিবকে উৎখাতের এমন একটি অপারেশনে যোগ দিতে সোৎসাহে রাজী হয়ে যান তারা।
১৯৭৫ এর ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকশালের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবার কথা। দেশের ৬১টি জেলায় বাকশালের ৬১ জন গর্ভনর নিয়োগ পাবেন সেদিন থেকে। তাতে আরও শক্ত হয়ে যাবে শেখ মুজিবের ভিত্তি। কিছু ঘটাতে হলে ঘটাতে হবে এর আগেই। বেঙ্গল ল্যান্সারের অধিনায়ক তখন ছুটিতে ফলে সবগুলো ট্যাঙ্ক ফারুকের অধীনে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর কথা ভাবেন তারা। ১৫ তারিখ শুক্রবার, যে কাজটি তারা করতে যাচ্ছেন তাদের মতে সেটি একটি পবিত্র কাজ। ফলে এর জন্য একটি পবিত্র দিনই যথার্থ ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। তারা মনে করেন শেখ মুজিব ভারতের পুতুল সরকার মাত্র। ফলে ঐ দিন তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে ভারতকে একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে। ১২ আগস্ট ফারুক তার তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের আর্মি ব্যান্ডের সঙ্গীতের মূর্ঘনা, পোলাও আর রেজালার সুবাসের মধ্যে একফাঁকে ফারুক তার ভায়রা রশীদকে জানান। ঘটনাটি আমি ১৫ আগস্টই ঘটাবো।
ফারুক, রশীদ যখন ঘটনা ঘটাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন খন্দকার মোশতাক তখন তার পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলার ব্যবস্থা করতে থাকেন। তিনি চাঙ্গা করে নিতে শুরু করেন তার পুরনো যোগাযোগগুলো। দাউদকান্দিতে দেশের বাড়ি বেড়াতে যাবার ছলে মোশতাক কুমিল্লা বার্ডে বেঠক সেরে নেন তার পুরনো সহযোগী মাহবুবুল আলম চাষী এবং শেখ মুজিবের তথ্যমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে। বিচিত্র জুটি তারা, একজন চাষী, অন্যজন মুসলমান ঠাকুর। চাষীর মাধ্যমে মোশতাক আমেরিকার সঙ্গে তাদের পুরনো সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টারকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এমন একটি ষড়যন্ত্র বিষয়ে অবহিত করে রাখেন তারা। আওয়ামী লীগের ভেতরের কিছু মানুষের সঙ্গেও সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন মোশতাক। যোগাযোগ করেন পাকিস্তানের সঙ্গেও। খন্দকার মোশতাক এবং তার সহযোগীরা যখন মুজিববিহীন পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, মেজর ফারুক এবং রশীদ তখন প্রস্তুত হচ্ছেন মূল ঘটনাটি ঘটাবার জন্য। তেঁতুলিয়ার ভোরের শিশির, টেকনাফের নাফ নদীর টলমলে পানি কেউ তা জানে না।
৬৮. খোলা দুয়ার
স্বাধীনতার পর পরই কলকাতা থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। গেট দিয়ে সোজা চলে গেলেন বসবার ঘরে। শেখ মুজিব এলে সুভাষ বলেন : একেমন ব্যবস্থা? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কোনো সিকিউরিটি নাই, আমার ব্যাগও চেক করল না কেউ, ওতে পিস্তলও তো থাকতে পারত।
শেখ মুজিব হো হো করে হাসেনঃ কি যে বলেন, আমার দেশের মানুষ আমাকে মারবে না।
৬৯. কুরবানি
১৯৭৪-এর মাঝামাঝি। ভারত সফরে গেছেন শেখ মুজিব। খাওয়ার টেবিলে ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ মুজিব হঠাৎ বলেন, বুঝলেন ইন্দিরা, মোশতাক হচ্ছে আমার শালা, বাংলাদেশে শালার মতো এমন মধুর সম্পর্ক আর নাই।
টেবিলে বসে আছেন প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আর ড, কামাল হোসেন। তাঁরা জানেন মুজিবের সঙ্গে মোশতাকের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তারা ভাবেন, এই ঠাট্টার তাৎপর্য কি? মোশতাক কোনো মন্তব্য না করে গম্ভীর বসে থাকেন।
ভারত থেকে ঢাকায় ফিরছেন তাঁরা। ফেরার পথে প্লেনে শেখ মুজিব তার কেবিনে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পর্দার আরেক দিকে পাশের কেবিনে প্ল্যানিং কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম এবং স্বন্দকার মোশতাক কথা বলছেন। তারা কথা বলছেন দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছিলেন তাঁরা।
নুরুল ইসলাম বলছিলেন ইতিহাসে দেখা যায় কোনো দেশে মুদ্রাস্ফীতি ডবল ডিজিট ছাড়িয়ে গেলে সে সরকার আর ক্ষমতায় থাকতে পারে না। হঠাৎ শেখ মুজিব পর্দার ওপাশ থেকে এসে মোশতাকের পাশে বসেন।
শেখ মুজিব বলেন : নুরুল ইসলাম সাহেব কি বলে শুনছ তো?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে শেখ মুজিব আবার বলেন : কালকে রাতে আমি একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম আল্লাহ আমাকে হযরত ইব্রাহিমের মতো আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে কুরবানি দিতে বলছেন। অনেক চিন্তা করলাম কে আমার সবচেয়ে প্রিয়। চিন্তাভাবনা করে পরে ঠিক করলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছ মোশতাক তুমি। তোমাকেই কুরবানি করতে হবে।
হাসেন মুজিব। মোশতাক এবারও গম্ভীর।
ঝড় বা ভূমিকম্পের আগে যেমন টের পায় পাখি শেখ মুজিবও যেন আভাষ পাচ্ছেন দুর্ঘটনার।
৭০. চায়ের বদলে ট্যাঙ্ক
মেজর ফারুক এবং রশীদ ক্যান্টনমেন্টে জানান ১৪ আগস্ট ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি একটা যুক্ত মহড়া করবে। অন্ধকারে সৈন্যদের নিজ নিজ অস্ত্র বেছে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার ট্রেনিং এক্সারসাইজ এটি। স্থান নির্মীয়মান কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট।
কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টের প্রকাণ্ড ছাতার মতো পিলারগুলো তখন তৈরি হয়েছে কেবল। তার চারপাশে অসমাপ্ত দেয়াল, ইট, বালি, সুড়কি। ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাতে সেখানে ঘন অন্ধকার। কথামতো অব্যবহৃত, অন্ধকার রানওয়েতে মেজর ফারুক ট্রাক বোঝাই সৈন্য আর ২৮টি ট্যাঙ্ক নিয়ে উপস্থিত হন। আরব ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরবদের প্রতি সংহতি প্রকাশের নিদর্শন হিসেবে শেখ মুজিব মিসরকে কয়েক টন চা পাঠিয়েছিলেন। তার বিনিময়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত মুজিবকে পাঠিয়েছিলেন ৩০টি টি-৫৪ ট্যাঙ্ক। চায়ের বদলে পাঠানো সেই ট্যাঙ্কগুলো এক একটি অতিকায় পোকার মতো তখন বসে আছে রানওয়ের অন্ধকারে।
আরও ১২ ট্রাক সৈন্য আর ১৮টি কামান নিয়ে কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হন মেজর রশীদ। রাত এগারোটায় আসেন মেজর ডালিম, পাশ এবং হুদা। আসেন মেজর শাহরিয়ার। এক এক করে আসেন মেজর নুর এবং মহিউদ্দীন। সবাই কালো পোশাক। কাঁধে স্টেনগান। ফারুকের হাতে ঢাকার ম্যাপ। পরিকল্পনামতো মূল অপারেশনের দায়িত্ব ফারুকের এবং রশীদের দায়িত্ব অপারেশন পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়ার।
কালো পোশাক, কাঁধে স্টেনগান নিয়ে রানওয়েতে ছোটাছুটি করেন মেজর ফারুক। তার সঙ্গে কয়েকশত সৈন্য, আটাশটি ট্যাঙ্ক, আঠারোটি কামান, অসংখ্য হালকা, ভারী অস্ত্র। অন্ধকার রানওয়ের বিশাল চত্বরে সবাই অপারেশনের জন্য প্রত। মূল পরিকল্পনায় জড়িত কয়জন অফিসার এবং গুটিকয় এনসিও ছাড়া কেউ জানে না কি ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর শপথ… That I shall go whereever my superior orders me even at the peril of my life.
অপারেশনের মূল টার্গেট করা হয় ঢাকা শহরের তিনটি বাড়িকে।
শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি।
তার বোনের ছেলে এবং বাকশাল সেক্রেটারী শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডের বাড়ি।
ভগ্নিপতি এবং মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবতের মিন্টু রোডের বাড়ি।
সিদ্ধান্ত হয় তিনটি পৃথক দল একই সময় তিনটি বাড়িতে আক্রমণ করবে।
শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর ডালিমকে। কিন্তু এই ৩২ নম্বরে স্ত্রী নিম্মিকে নিয়ে বহুবার গেছেন ডালিম, শেখ মুজিবের স্ত্রীকে ডেকেছেন মা, একসঙ্গে বসে মুড়ি খেয়েছেন। ডালিম মনে করেন ৩২ নম্বর বাড়িতে এই অপারেশন করতে গিয়ে আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন তিনি। ফলে তিনি শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তিনি দায়িত্ব নেন আবদুর র সেখনিয়াবতের বাড়ি আক্রমণের।
শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের নেন মেজর মহিউদ্দীন, সঙ্গে নুর এবং বজলুল হুদা। মেজর ফারুকের আস্থাভাজন এনসিও রিসালদার মুসলেউদ্দীন নেন শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের দায়িত্ব।
এয়ারপোর্টের আলো আধারীতে অতিকায় পোকার মতো বসে থাকা উপহার হিসেবে পাওয়া মিসরীয় ট্যাঙ্কগুলো আড়মোড়া ভাঙ্গে ১৫ আগস্ট ভোর বেলা। তখন ফজরের আজান হচ্ছে।