মিতিনমাসিও সত্যি
—উড ইউ কেয়ার ফর অ্যানাদার ড্রিঙ্ক?
মাথা নাড়লেন জুডিথ। ওয়াইন এমনিতে তাঁর বরাবরের পছন্দের। কিন্তু আজ আর ইচ্ছে করছে না। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। আচ্ছন্ন লাগছে। ঝিম ধরছে। অনেকটা খাওয়া হয়ে গেছে আজ। এতটা না খেলেই হত বোধহয়। কিন্তু একটু বেনিয়ম হয়ে তো যায়ই এক একটা বিশেষ দিনে। কী আর করা? শরীরের প্রতিটা কোষ একটাই দাবি করছে এখন। ঘুম, নিশ্চিন্ত ঘুম। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কোনওমতে বলতে পেরেছিলেন, ‘গুড নাইট সুজয়।’ একুশ বছরের জুডিথ অলীক কল্পনাতেও ভাবেননি তখন, রাত্রি শুভ হওয়া তো দূরস্থান, চরম অভিশপ্ত হতে যাচ্ছে।
‘ফিলিং স্লিপি বেবি?’ বলে সুজয় যখন বিছানায় উঠে এসেছিল, হাত রেখেছিল গালে, ওই আধোজাগা অবস্থাতেও জুডিথ বুঝেছিলেন সহজাত নারী-ইন্দ্রিয়ে, এ স্পর্শ নিছক বন্ধুত্বের নয়। উঠে বসতে চেয়েছিলেন। পারেননি। শিরা-ধমনিতে অ্যালকোহলের দাপাদাপিতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। এবং সুজয় যখন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল গায়ের জোরে, আপ্রাণ প্রতিরোধও কাজে আসেনি। ‘নো! প্লিজ় নো… প্লিজ়…’, নিষ্ফল চিৎকারে এটুকু বলতে পেরেছিলেন শুধু, মনে আছে।
ওটুকুই। বাকিটা ব্ল্যাকআউট। ‘ফরম্যাটিং’ করে কেউ যেন পরিপাটি মুছে দিয়েছে মেমরি কার্ড থেকে।
.
চ্যানেলে চ্যানেলে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ চলতে শুরু করল দুপুর আড়াইটে-পৌনে তিনটে থেকে। যে খবর নেহাতই মামুলি এবং সবার জানা হয়ে গেছে, তাতে হরেক মালমশলা মিশিয়ে ‘ব্রেকিং’ বলে চালিয়ে দেওয়ার যে ফর্মুলা চালু আছে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে, তার অনুসারী নয় এ ঘটনা। উদ্বেগ-আশঙ্কা-চাঞ্চল্য-ঔৎসুক্য… যাবতীয় উপাদান মজুত এই খবরে। আক্ষরিক অর্থেই ‘ব্রেকিং’।
‘দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে বিদেশিনীকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত গ্রেফতার’…, ‘ভোররাতে শারীরিক অত্যাচারের শিকার বিদেশিনী যুবতী, পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্ত’…, ‘শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে লালবাজার, রিপোর্ট তলব স্বরাষ্ট্র দফতরের’…।
অত্যাচারিতা যেহেতু বিদেশিনী, স্থানীয় সীমানা ছাড়িয়ে দ্রুত সর্বভারতীয় মিডিয়ায় নিজস্ব নিয়মে জায়গা করে নিল খবরটা। জাতীয় স্তরের চ্যানেলগুলোতেও সমান গুরুত্ব দিয়ে শুরু হল ঘটনার বিবরণ।
ঘটনার বিস্তারে ঢোকার আগে সামান্য দু’-চার কথা। গোয়েন্দা কাহিনিতে আসক্ত পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে, ‘রহস্যহীনতায় কে বাঁচিতে চায়!’ যে মামলার কথা লিখছি, গোড়াতেই স্বীকার্য, তা সেই অর্থে রহস্যহীনই। অপরাধী যে আসলে কে, একাধিক সূত্রের খোলস ছাড়িয়ে সেটা আন্দাজ করার রোমাঞ্চ নিরুদ্দেশ এই কেসে। বরং উলটোটাই। অভিযুক্ত চিহ্নিত অপরাধের ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই। এবং গ্রেফতারও অনতিবিলম্বে। তা হলে আর রহস্যের রইলটা কী?
লেখার এখানে এটুকুই, গুরুতর মামলার তদন্ত মোটেই সীমায়িত নয় স্রেফ অপরাধীর চিহ্নিতকরণে। শাস্তিবিধান নিশ্চিত করাতেই তার পূর্ণতা। বাস্তবের তদন্ত ছোটগল্প নয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’-এর অমোঘ মোচড় কেস ডায়েরিতে অধরা। তদন্ত তুলনীয় নয় উপন্যাসের সঙ্গেও, চরিত্রের চালচিত্র বা ঘটনার ঘনঘটায় যা আমূল নাড়িয়ে দেবে পাঠককে। কোনও কেসের সমাধান-পরবর্তী তদন্ত আপাত-নীরস প্রবন্ধের মতো। যার অনাড়ম্বর গতিপথে আসলে লুকিয়ে থাকে বহু চড়াই-উতরাই। আলোচ্য মামলাটি যেমন। তদন্তকারীদের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের নিরিখে শুধু কলকাতা নয়, দেশের তদন্ত-ইতিহাসেও এই কেস দিক্চিহ্নস্বরূপ।
কালীঘাট থানার মামলা। তারিখ, পয়লা জুন ২০১৩। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬(১) ধারায়। অভিযোগ ধর্ষণের। অভিযোগকারিণী বিদেশিনী। আইরিশ যুবতী। নাম জুডিথ।
জুডিথ ফ্লোরেন্স। আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি কাভানের কাছে বাল্টিমোরস ব্রিজ বলে এক মফস্সল শহরের বাসিন্দা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজছাত্রী। বয়স কুড়ি ছাড়িয়ে একুশ ছোঁয়ার মুখে। আর পাঁচটা ওই বয়সের তরুণী যেমন হন, তেমনই। উচ্ছল, প্রাণবন্ত। হাসিখুশি আমুদে স্বভাবের জন্য বন্ধুবৃত্তে তুমুল জনপ্রিয়। সপ্তাহান্তে বন্ধুদের ‘গেট টুগেদার’-এর হইহুল্লোড় জমেই না জুডিথকে ছাড়া।
কলেজের পড়াশুনো আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি সমাজসেবাতেও কিশোরীবেলা থেকেই ঝোঁক জুডিথের। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন সময়-সুযোগ হলেই। মাদার টেরিজার কথা শুনে এসেছেন ছোটবেলা থেকে। প্রবল ইচ্ছে, মাদারের ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত হওয়ার। সেটার মূল কর্মকাণ্ড অবশ্য ইন্ডিয়ায়, ক্যালকাটা বলে একটা শহরে। ওয়েস্টবেঙ্গল বলে স্টেটে। হলই বা বহুদূরের বিদেশবিভুঁই, যাওয়া যায় না একবার?
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়ই। হলও। ডাবলিনের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ কলকাতার ‘মাদার হাউস’-এর। যে সংস্থা প্রতি বছরই ইউরোপের একাধিক শহর থেকে বাছাই করা জনা বিশেক তরুণ-তরুণীকে নিয়ে যায় কলকাতায়, হাতেকলমে ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। জুডিথ গিয়ে ধরলেন এই এনজিও-র কর্তাদের। ইন্টারভিউ হল একটা, যাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে জুডিথের সামান্যতম সংশয়ও ছিল না। নির্বাচিতদের প্রশিক্ষণ পর্ব চলল আয়ারল্যান্ডেই, সপ্তাহদুয়েক ধরে। জনা কুড়ির গ্রুপ। সমবয়সি প্রায় সবাই। অধিকাংশের সঙ্গে অল্পদিনেই গলায়-গলায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল জুডিথের। চনমনে যুবক উইলিয়ামস আর ফিটনেস-ফ্যানাটিক মনিকার সঙ্গে তো প্রায় ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’-এর রসায়ন!
দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেল ভারত-যাত্রার। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যাওয়া, জুলাইয়ের মাঝামাঝি ফেরা। ওই সময়টা সচরাচর ভ্যাকেশন থাকে বেশিরভাগ কলেজে। ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সুবিধে। ডাবলিন বিমানবন্দরে যখন চেক-ইন করছেন ভারতগামী উড়ানে পা রাখার জন্য, জুডিথ দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, এটাই ইন্ডিয়ায় প্রথম এবং শেষবারের মতো যাওয়া। আয়ারল্যান্ডের ফিরতি উড়ান ধরতে হবে মাসখানেকের মধ্যেই।
কলকাতায় এসে জুডিথরা ঠিক করলেন, ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র কাছাকাছি হোটেলে থাকাই ভাল। সুবিধে হবে যাতায়াতের। জুডিথ উঠলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ‘হোটেল সার্কুলার’-এ। মনিকা, উইলিয়ামস আর বাকিরাও কাছেপিঠের হোটেল বা গেস্টহাউসে।
সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরেই দৌড়নো ‘মাদার হাউসে’। সিস্টারদের কাছে ইন্ডোর ট্রেনিং নেওয়া, হাতে-কলমে কাজ শেখা দিনভর, ওয়ার্কশপ-ফিল্ড ট্রেনিং সেরে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে। ‘মিশনারিজ় অফ চ্যারিটি’-র সঙ্গে অবৈতনিকভাবে যুক্ত একাধিক ডাক্তারের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল দিব্যি।
কলকাতা শহরটাকে অল্পদিনেই ভাল লাগতে শুরু করল জুডিথের। ট্রেনিং শিডিউল অনুযায়ী শনিবার বিকেল থেকে ছুটি। ফের কাজ শুরু সোমবার থেকে। উইকেন্ডে বন্ধুদের সঙ্গে শহরটা অনেকটাই ঘুরে দেখেছে জুডিথ। ভিক্টোরিয়া, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, টেম্পল অফ গডেস কালী, নোবেল লরিয়েট পোয়েট টেগোরের বাড়ি…। ক্যালকাটার মানুষজনকে খুব হেল্পফুল লেগেছে জুডিথের। কোথায় কোন্দিক দিয়ে যেতে হবে, সেটা পথচলতি কাউকে জিজ্ঞেস করলে কারও কোনও বিরক্তি নেই। হাসিমুখে বলে দেয়। লাইফ আছে শহরটায়। ঘুরে-টুরে অবশ্য জুডিথের সবথেকে ভাল লেগেছে সন্ধে-রাতের পার্ক স্ট্রিট। আলো ঝলমল রাস্তাটা যেন ফুটছে সবসময়। আর দিনকয়েক পরেই তার জন্মদিন। দেশের বাইরে জন্মদিন কাটানো এই প্রথম। এই পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্তোরাঁ বা পাবে একটা ছোটখাটো বার্থডে পার্টি করলে কেমন হয়?
৩১ মে, ২০১৩। বার্থডে পার্টি, জুডিথের একুশতম জন্মদিন। পার্ক হোটেলের নাইটক্লাব ‘তন্ত্র’ নাকি বেশ জমজমাট জায়গা উইকেন্ড পার্টির জন্য, শুনেছিলেন কলকাতায় সদ্যপরিচিতদের মুখে। যে হোটেলে আছেন, তার ম্যানেজারকেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনিও কাছেপিঠের মধ্যে তন্ত্র-র কথাই বলেছিলেন। বেশ, ওখানেই হোক। রাত দশটা থেকে দুটো অবধি তন্ত্র-তে জায়গা বুক করেছিলেন জুডিথ। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা তো বেশি নয়,এই অজানা শহরে চেনেনই বা ক’জনকে? আয়ারল্যান্ড থেকে আসা গ্ৰুপের মধ্যে দশজন। আর ‘মাদার হাউসে’ আলাপ হওয়া ডাক্তার বন্ধু আফরোজ আলম। সব মিলিয়ে জনা বারো।
সকালে কেক কিনে এনেছিল মনিকা। মজা-হইহল্লা বিস্তর হয়েছে হোটেলের ঘরেই। স্কাইপে কথাও হয়েছে মা-বাবা-দাদার সঙ্গে। ফুরফুরে মেজাজে সেজেগুজে রাতের পার্টির জন্য উইলিয়ামসের সঙ্গে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরিয়েছিলেন জুডিথ। লিন্ডসে স্ট্রিটের মোড়ে এসে যখন ট্যাক্সি খুঁজছেন, ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালে থেমে আছে গাড়ি, পাশের একটা গাড়ি থেকে ছিটকে আসা আওয়াজে ফিরে তাকিয়েছিলেন জুডিথ।
‘হাই উইলিয়ামস! হোয়াটস আপ?’
মিনিটখানেকের মধ্যেই জানা হয়ে গিয়েছিল, ওই গাড়ির চালকের নাম অভিষেক ওরফে অ্যাবি। উইলিয়ামসের সঙ্গে যার খুচরো আলাপ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে, নিউ মার্কেটের একটা জুতোর দোকানে। এবং আদানপ্রদান হয়েছে ফোন নম্বরের। অ্যাবি স্বাভাবিক সৌজন্যে জানতে চেয়েছিল, কোথায় যাচ্ছে উইলিয়ামসরা।
‘তন্ত্ৰা? বার্থডে ব্যাশ? হপ ইন গাইজ়! আইল গিভ ইউ আ রাইড।’
উইলিয়ামসের পরিচিত, যাওয়ার পথে ড্রপ করে দিতে চাইছে পার্ক হোটেলে। গাড়ির পিছনের সিটে নির্দ্বিধায় উঠে পড়েছিলেন দু’জনে। সামনে স্টিয়ারিংয়ে ছিল অ্যাবি। পাশে আরেকজন। সপ্রতিভ, দেখে মনে হয়, মিড-থার্টিজ়। পিছনে তাকিয়ে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, ‘হাই, দিস ইজ় সুজয়। সুজয় মিত্র।’
লিন্ডসে স্ট্রিট থেকে কতটাই বা দূরে আর পার্ক হোটেল? খুচরো আলাপের মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটে। স্বাভাবিক সৌজন্যবশত জুডিথ বলেছিলেন নামার সময়, ‘হোয়াই ডোন্ট ইউ গাইজ় জয়েন আস?’ বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল সুজয় আর অ্যাবি। কে জানত তখন, ওই সৌজন্য-প্রস্তাবের জন্য আজীবন আফশোস করতে হবে?
‘তন্ত্র’ জায়গাটা সত্যিই জমজমাট। যাকে বলে হ্যাপেনিং। ইউরোপের যে-কোনও নাইটক্লাবের মতোই। পছন্দ হয়েছিল জুডিথের। ডিজে একের পর এক চার্টবাস্টার গান বাজাচ্ছে উদ্দাম। পা নড়তে বাধ্য তালে তালে। সুজয় ছেলেটাও মজার। ভাল লেগেছিল জুডিথের। এমন সহজভাবে মিশে যাচ্ছিল সবার সঙ্গে, কে বলবে অপরিচিত, কে বলবে অন্য ইনভাইটিজ়দের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সবেমাত্র? দুর্দান্ত সেন্স অফ হিউমার, জোকসের স্টক অফুরান। আর ইংরেজিটা বলে তুখোড়, নিখুঁত ইউরোপিয়ান অ্যাকসেন্টে। ইন্ডিয়ার বাইরে ছিল কখনও?
অ্যাবি বেশিক্ষণ ছিল না পার্টিতে। আধঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সুজয় থেকে গিয়েছিল। আর সুজয়ই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মাইকেলের সঙ্গে। যে হঠাৎই এসে যোগ দিয়েছিল ওদের গ্ৰুপটার সঙ্গে। যার হাবভাব দেখেই মনে হয়, নিয়মিত যাতায়াত আছে এখানে। পেটানো চেহারা, লম্বায় অন্তত ছ’ফুট প্লাস, কায়দার পনিটেল। ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস’ বলার পরেই মাইকেল সিগারেট ধরাল একটা। ধরাল নয়, বানাল। সিগারেটের মধ্যে অন্য কিছু ঠুসে যেটা সুজয়-মাইকেলের হাতে হাতে ঘুরতে থাকল মধ্যরাতের মাতোয়ারায়, তিন গ্লাস ওয়াইন খাওয়ার পরেও দিব্যি বুঝতে পারছিলেন জুডিথ, ওগুলো সিগারেট নয়। জয়েন্ট। ড্রাগ জায়গা বদল করে নিয়েছে তামাকের সঙ্গে। সে ওরা যা করছে করুক, ভেবেছিলেন জুডিথ। মাথাটা হালকা লাগছে, বেশি ভেবে লাভ নেই। তাই সুজয় যখন এসে বলেছিল, ‘হেই.. হোয়াট অ্যাবাউট আ ডান্স?’, বিনা দ্বিধায় ডান্স ফ্লোরে পা রেখেছিলেন জুডিথ। ডিজে-র ডিস্কে তখন বাজছিল, ‘দ্য নাইট ইজ় স্টিল ইয়াং…’। খুব পছন্দের গান জুডিথের। নাচছিলেন প্রাণ খুলে। জানতেন না, রাত আজ সত্যিই বাকি। এবং অনেকটাই।
অন্যান্য নাইটক্লাবে যা নিয়ম থাকে সচরাচর, এখানেও তাই। বন্ধ হওয়ার আধঘণ্টা আগে ‘লাস্ট ড্রিঙ্ক’-এর অর্ডার নেওয়া হয়। নেশার মাত্রা বেশি হয়ে যায় কারও কারও। ক্লাব বন্ধ হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বার কাউন্টারে গিয়ে হইহুল্লা এসব জায়গায় নিত্যনৈমিত্তিক। ঝামেলা সামলানোর জন্য মুশকো চেহারার ‘বাউন্সার’-ও থাকে একাধিক। বাড়াবাড়ি হলেই অর্ধচন্দ্র দেওয়ার জন্য তৈরি।
ঝামেলায় অবশ্য জড়াল না জুডিথদের গ্রুপের কেউই। সুজয় আর মাইকেল শুধু ম্যানেজারকে অনুরোধ করল আর একটা ড্রিঙ্কের জন্য। ম্যানেজার দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, ‘নো।’ জুডিথের আরও একটু থাকতে ইচ্ছে করছিল। দারুণ কেটেছে সময়টা। কিন্তু বড্ড তাড়াতাড়ি যেন শেষ হয়ে গেল। এই তো কিছুক্ষণ আগে ঢোকা হল, এর মধ্যে দুটো বেজে গেল! নামে নাইটক্লাব, তা হলে সারারাত কেন খোলা রাখে না এরা? রাত দুটোয় রাত শেষ হয়ে যায় বুঝি?
ক্লাব থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে যখন পা রাখলেন জুডিথরা, ঘড়ির কাঁটা সদ্য দুটো ছুঁয়েছে। সকলেরই নেশা হয়েছে কমবেশি। পা টলমল অল্পবিস্তর। যে যার বাড়ি বা হোটেলে ফেরার ট্যাক্সি খুঁজছে যখন, মাইকেলই প্রস্তাবটা দিল, ‘মাই প্লেস ইজ় ক্লোজ়বাই। হোয়াই ডোন্ট ইউ গাইজ় ড্রপ ইন ফর সাম মোর ফান? হেই বার্থডে গার্ল, হোয়াট সে?’ সোৎসাহে সায় দিল সুজয়ও, ‘ইয়েস ইয়েস.. হোয়াই নট?’ জুডিথ বন্ধুদের দিকে তাকালেন। উইলিয়ামস বলল, ‘ইয়োর কল, উই আর টু টায়ার্ড ফর দিস।’ জুডিথ তখন দোটানায়। অত্যন্ত ভদ্রভাবে বাড়িতে আরও কিছুক্ষণ পার্টি করার প্রস্তাব দিচ্ছে মাইকেল। গত কয়েক ঘণ্টায় সুজয় বা মাইকেল, কেউই কোনওভাবে শালীনতার গণ্ডি পেরোয়নি কোনও অছিলায়। আর জন্মদিনের রাত তো বছরে একবারই আসে। দ্বিধাগ্রস্ত জুডিথ একটু ভেবে বলে ফেললেন, ‘ওকে ফাইন।’ বোঝেননি, ওই মুহূর্তের দ্বিধা এবং সম্মতি কী ঘোর সর্বনাশ ডেকে আনতে যাচ্ছে। বোঝেননি, নেশাকাতর অবস্থায় সব প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে নেই। সে যতই থাকুক সাময়িক ভাল-লাগা।
বাকিরা বেরিয়ে গেল যে যার মতো। মাইকেলের ফ্ল্যাট কাছেই। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের পাশের রাস্তায়। হেঁটেই সুজয়-মাইকেলের সঙ্গে ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন জুডিথ। রাত তখন কত হবে? প্রায় আড়াইটে। ছোট্ট দু’-কামরার অগোছালো ফ্ল্যাট। ঢুকেই মাইকেল বসার ঘরের একটা ক্যাবিনেট থেকে বার করল ওয়াইনের বোতল, ‘লেটস হ্যাভ আ ফিউ মোর।’ প্রথম গ্লাসটা অর্ধেক শেষ করতে না করতেই ওয়াশরুমে ছুটতে হল জুডিথকে। খাদ্য-পানীয় যা যা উদরস্থ হয়েছিল সন্ধে থেকে, সব বেরিয়ে গেল। পরের একঘণ্টা আচ্ছন্নের মতো সোফায় বসেছিলেন জুডিথ। মনে আছে, মাইকেল জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিল, ‘ইউ ওকে?’ মনে আছে, সুজয়-মাইকেল ‘জয়েন্ট’ ধরাচ্ছিল একের পর এক। ধোঁয়ার চোটে দমবন্ধ লাগতে শুরু করেছিল জুডিথের। সাড়ে তিনটে নাগাদ একরকম জোর করেই উঠে পড়েছিলেন, ‘আই নিড টু গো নাউ।’ উঠে পড়েছিল সুজয়ও, ‘শিয়োর, আইল ড্রপ ইউ হোম।’ সুজয়ের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ওঠার পর পিছনের সিটে নিজেকে এলিয়ে দেওয়া মাত্র চোখ আপনিই বুজে এসেছিল জুডিথের।
চোখ খুলেছিল ট্যাক্সির ব্রেক কষার শব্দে। বিল মেটাতে মেটাতে সুজয় বলছিল, ‘লেটস গো জুডিথ, উই আর হোম।’ মানে? ‘হোম’ মানে? হোটেলে ফেরার কথা তো! এটা কোথায়? একটা বড় রাস্তা। তার উপর তিনতলা একটা বাড়ি। যেটা দেখিয়ে সুজয় বলছে, ‘দিস ইজ় মাই প্লেস। ইউ লুক টায়ার্ড। ফ্রেশেন আপ আ বিট… আই উইল ড্রপ ইউ ব্যাক টু দ্য হোটেল।’
এটা কী হল? ওই আচ্ছন্ন অবস্থাতেও বিপদসংকেত টের পাচ্ছিলেন জুডিথ। কিন্তু সে সংকেতে সাড়া দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না শরীর। অত রাতের ওই শুনশান অজানা-অচেনা রাস্তায় কী করবেন? চিৎকার করার মতো শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই শরীরে। নেশার দাপটে যেন অসাড় হয়ে গেছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব। সুজয় হাত ধরে জুডিথকে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িটার তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ঠোক্কর খেয়েছিলেন বারকয়েক। সুজয় কোমরে হাত দিয়ে সামলে নিয়েছিল।
ছিমছাম পরিপাটি একটা ঘর। ঢুকেই বেশ জোরে মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দিয়েছিল সুজয়। আর খুব কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘উড ইউ কেয়ার ফর অ্যানাদার ড্রিঙ্ক?’ জুডিথ মাথা নেড়েছিলেন। এলিয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। সুজয় যখন উঠে এসেছিল বিছানায়, হাত রেখেছিল গালে, ওই আধোজাগা অবস্থাতেও সহজাত নারী-ইন্দ্রিয় জানান দিয়েছিল, এ স্পর্শ নিছক বন্ধুত্বের নয়। সুজয় যখন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল গায়ের জোরে, আপ্রাণ প্রতিরোধে জুডিথ শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘নো… প্লিজ় নো…’। বাকিটা ব্ল্যাকআউট।
আচ্ছন্ন ভাবটা কেটেছিল সকালে। শরীরী প্রতিক্রিয়া এবং বিস্রস্ত পোশাক জানান দিয়েছিল জুডিথকে, নেশাতুর অবস্থার সুযোগ নিয়ে রাতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলপূর্বক সহবাস করেছে সুজয়, একাধিকবার। সোজা ভাষায়, ‘রেপ’। চূড়ান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় কোনওভাবে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পথ আটকেছিল সুজয়। যার হাতে তখনও, ওই ভোর সাতটায় মদের গ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট। চোখেমুখে অনুতাপের চিহ্নমাত্র নেই। স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ‘হোয়াটস রং? আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু গেট ইউ গোয়িং।’
বাকিটা পড়ুন জুডিথের বয়ানে, যে বয়ান দিয়েছিলেন তদন্তকারী অফিসারদের।
‘আমার যতটা না রাগ হচ্ছিল, তার থেকে বেশি ভয় হচ্ছিল। তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটায় একটা বারান্দা ছিল। একবার এ-ও ভেবেছিলাম, ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দিই নীচে। মাথা কাজ করছিল না। শুধু ভাবছিলাম, কেন রাজি হলাম মাইকেলের ফ্ল্যাটে যেতে গত রাতে? হোয়াই ডিড আই এগ্রি? কেন এভাবে ড্রাঙ্ক হয়ে গেলাম? কেন রাজি হলাম ওদের কথায়?
সুজয়কে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করলাম সর্বশক্তিতে,‘জাস্ট গেট লস্ট!’ একটু থতমত খেয়ে রাস্তা ছেড়ে দিল সুজয়। আর আমি দরজা খুলে দৌড়লাম নীচে। বড় একটা রাস্তা, পাশেই মেট্রো স্টেশন। নামটা পড়লাম। কালীঘাট। কালীঘাট? এই স্টেশনেই তো এসেছিলাম পার্ক স্ট্রিট মেট্রো থেকে, গডেস কালীর টেম্পল দেখতে!
সকাল হয়ে গিয়েছিল। সাড়ে ছ’টা বাজে প্রায়। গাড়িঘোড়ার চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। লোকজনও বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। কৌতূহল নিয়ে দেখছে আমাকে। অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। একটা ট্যাক্সি থামালাম। উঠে ঠিকানা বললাম হোটেলের। গাড়ি যখন চলছে, ফোন করলাম মনিকাকে। তুলল না। উইলিয়ামসকে করলাম, আফরোজকে করলাম। নো রেসপন্স। লেট নাইটের পরে ন্যাচারালি ঘুমচ্ছে নিশ্চয়ই সবাই। তিনজনকেই এসএমএস করলাম, ‘প্লিজ় রেসপন্ড, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার।’
সেই এসএমএস প্রথম দেখলেন মনিকা। ধড়মড়িয়ে উঠে ফোন করলেন জুডিথকে। ঘটনা জানার পর মনিকা-আফরোজ-উইলিয়ামস যখন পৌঁছলেন ‘হোটেল সার্কুলার’-এ, সকাল তখন প্রায় সাড়ে দশটা। নিজের ঘরে বসে কেঁদে চলেছেন জুডিথ। যাঁকে কিছুটা ধাতস্থ করতেই লাগল ঘণ্টাদেড়েক। জুডিথকে নিয়ে বন্ধুরা পার্ক স্ট্রিট থানায় পৌঁছলেন সোয়া বারোটা নাগাদ। ওসি শুনলেন সব, ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে সময় নিলেন না একটুও। জুডিথদের নিয়ে নিজেই গেলেন কালীঘাট থানায়। জমা পড়ল সুজয় মিত্রের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ।
সুজয়ের বাড়ির যেটুকু বর্ণনা জুডিথ দিতে পারলেন, পুলিশের পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল বাড়িটা দ্রুত চিহ্নিত করতে। কালীঘাট মেট্রো স্টেশন, বড় রাস্তা, তিনতলা বাড়ি। ১৩৮, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের বাড়িটাকে শনাক্ত করলেন জুডিথ। হ্যাঁ, এটাই। তিনতলার ঘরে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শুয়ে থাকা সুজয়ের নাগাল পাওয়া গেল সহজেই। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে এই ঘরে। দরকার হবে খুঁটিয়ে তল্লাশির। ঘরটা ‘সিল’ করে দিয়ে দুপুর দুটো নাগাদ যখন সুজয়কে নামিয়ে এনে ভ্যানে তুলছে কালীঘাট থানার পুলিশ, তখন ভিড় জমে গেছে বাড়ির সামনে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। জয়েন্ট সিপি (ক্রাইম) সহ পদস্থ অফিসাররা রওনা দিয়েছেন কালীঘাট থানার উদ্দেশে।
টিভি-র পরদায় ‘ব্রেকিং নিউজ়’ চলতে শুরু করল ঘণ্টাখানেক পর থেকেই। একের পর এক ওবি ভ্যান এসে ভিড় জমাল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের সেই বাড়ির সামনে, ‘এই সেই বাড়ি, যেখানে গতরাতে ধর্ষিতা হয়েছেন এক আইরিশ যুবতী। গ্রেফতার হয়েছেন অভিযুক্ত। নাম সুজয় মিত্র।’
অল্প কথায় এবার সুজয়ের পরিবার-পরিচয়। দক্ষিণ কলকাতার বনেদি বিত্তশালী পরিবার সুজয়দের। ইলেকট্রনিক গুডসের পুরনো এবং রমরমা পারিবারিক ব্যবসা। সুজয়ের বাবাই দেখাশোনা করেন ব্যবসার। দুই ছেলে। সুজয় বড়, বয়স ছত্রিশ। ছোটভাইও তিরিশের কোঠায়। কনভেন্ট-শিক্ষিত সুজয় গ্র্যাজুয়েশনের পর এমবিএ করেছিলেন। আমেরিকাতে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানেই এক মার্কিন সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম এবং বিয়ে। সস্ত্রীক দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু বিয়েটা টেকেনি বেশিদিন। স্ত্রী ফিরে গিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। সরকারি ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি, কিন্তু দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ বা সম্পর্ক, কোনওটাই বেঁচে নেই আর। কাজ বলতে কালেভদ্রে নাম-কা-ওয়াস্তে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করা। আসল ‘কাজ’ অবশ্য পার্টি-মদ-মহিলা-ড্রাগে বুঁদ হয়ে থাকা।
তিনতলা বাড়ির একতলাটা ব্যবহৃত হয় ব্যবসার কাজে। দু’তলাটা ভাড়া দেওয়া আছে। মিত্র পরিবারের সদস্যরা থাকেন তিনতলায়। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে যথেষ্ট প্রশস্ত, অন্তত দুই হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটা। চারটে ঘরের একটায় সুজয়ের মা-বাবা থাকেন। একটা মোটামুটি খালিই পড়ে থাকে। বাড়িতে গেস্ট এলে ব্যবহার হয়। বাকি দুটো ঘরে দুই ভাই। ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে সবার কাছেই। সুজয় যখন সেই রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে নিজের ঘরে জুডিথকে নিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাড়ির অন্যরা তখন গভীর ঘুমে। সকাল সোয়া ছ’টা নাগাদ যখন জুডিথ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘুম ভেঙেছিল সুজয়ের মা-বাবা-ভাইয়ের। পুলিশ যখন দুপুরবেলা তালাবন্ধ করে দিচ্ছে বড়ছেলের ঘর, নীচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মা-বাবা। ওসি-কে শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সুজয়ের মা, ‘কী করেছে ও?’
জুডিথের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনার পরেই থানার একটা টিম বেরিয়ে গিয়েছিল মাইকেলের খোঁজে। সদর স্ট্রিটে স্থানীয় ‘পেয়িং-গেস্ট অ্যাকোমোডেশন’গুলোয় মাইকেলের চেহারার বিবরণ দিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই হদিশ মিলেছিল মাইকেলের দু’কামরার ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটের। ভাড়ার ফ্ল্যাট। তালাবন্ধ। তালা ভেঙে কয়েকটা খালি ওয়াইনের বোতল আর সামান্য পোশাক-আশাক ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি।
জানা গিয়েছিল, মাইকেল আদতে ড্রাগ-পেডলার। রাতবিরেতের হাই-প্রোফাইল পার্টিতে বা ক্লাবে চড়া দামে ড্রাগ সরবরাহ করাটাই পেশা। মাইকেলের নাগাল পাওয়া যে কঠিন হবে এবার, বুঝেছিলেন অফিসাররা। ফ্ল্যাটে ‘রেইড’ হয়েছে, খবর ঠিকই পেয়ে যাবে। এবং এমুখো আর হবেই না। মাইকেলকে ধরা অবশ্য পুলিশের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না। জুডিথ কোনও অভিযোগ করেননি মাইকেলের বিরুদ্ধে। এই মামলায় মাইকেলকে গ্রেফতার করার কোনও কারণ ছিল না। ওকে প্রয়োজন হতে পারে সাক্ষী হিসেবে। সে পরে দেখা যাবে। অনেক বেশি জরুরি কাজ এখন পড়ে আছে হাতে।
প্রথম কাজ সুজয়ের ঘরের তল্লাশি। বাজেয়াপ্ত হল বেশ কিছু গর্ভনিরোধকের প্যাকেট, মদের বোতলও একাধিক, বিছানার চাদর। কাজ নম্বর দুই, অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী, দু’জনেরই ডাক্তারি পরীক্ষা, পরিভাষায় ‘মেডিক্যো-লিগাল একজামিনেশন’। ঘটনার সময় দু’জনে যা পোশাক পরেছিলেন, তা বাজেয়াপ্ত করা হল। পাঠানো হল ফরেনসিক পরীক্ষায়।
সুজয় আগাগোড়াই অভিযোগ অস্বীকার করলেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে। বলে গেলেন, ‘ইট ওয়াজ় কনসেনসুয়াল।’ যা হয়েছে, উভয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় উড়ে গেল আত্মপক্ষ সমর্থনে সুজয়ের এই দাবি। রিপোর্ট জানাল, জুডিথের শরীরে ‘ডিফেন্সিভ উন্ডস’ (আত্মরক্ষাজনিত আঘাত) রয়েছে। রয়েছে বলপূর্বক সহবাসের অকাট্য প্রমাণ। ‘কনসেনসুয়াল’ নয়, ‘রেপ’-ই। পোশাক-আশাকের ফরেনসিক পরীক্ষায়ও খারিজ হয়ে গেল সুজয়ের ‘সম্মতিমূলক শরীরী মিলন’-এর তত্ত্ব।
এই কেসের তদন্তের দায়িত্ব যে গোয়েন্দাবিভাগের উপর পড়বে, জানাই ছিল। ৬ জুন মামলার তদন্তভার নিল ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। গোয়েন্দাপ্রধান গঠন করলেন বিশেষ টিম। সাব-ইনস্পেকটর তৃষ্ণা বসু (বর্তমানে ইনস্পেকটর) নিযুক্ত হলেন তদন্তকারী অফিসার হিসেবে। তাঁকে সাহায্য করার জন্য রইলেন ইনস্পেকটর গৌরী মুখোপাধ্যায় (পদোন্নতি হয়ে বর্তমানে গোয়েন্দাবিভাগেই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার) এবং ইনস্পেকটর পৃথ্বীরাজ ভট্টাচার্য।
জুডিথ নিজেই ফের বয়ান দিতে চাইলেন তদন্তকারীদের কাছে। জানালেন, এফআইআর-এ যা লিখেছিলেন, সেটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল। তখনকার মানসিক অবস্থায় খুব বিস্তারিত লিখতে পারেননি। ক্লাইভ স্ট্রিটে আইরিশ দূতাবাসের অফিসে নেওয়া হল জুডিথের বিস্তারিত বয়ান, যাতে সেদিন সন্ধে থেকে কী কী, কীভাবে, কখন ঘটেছিল, তা আরও বিস্তারে জানালেন জুডিথ। এই বিবৃতি রেকর্ড করা হল জুডিথের মা এবং দাদার উপস্থিতিতে। যাঁরা ঘটনার কথা জানার পরের দিনই ডাবলিন থেকে ফ্লাইট ধরেছিলেন ভারতের। দিল্লির আইরিশ দূতাবাসের মূল অফিস থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন ফার্স্ট সেক্রেটারি ক্যাটি মরিসরো। তিনিও থাকলেন বয়ান নথিভুক্ত করার সময়। আদালতেও গোপন জবানবন্দি দিলেন জুডিথ, ফৌজদারি বিধির ১৬৪ ধারায়। এবং মা-দাদার সঙ্গে দেশের ফ্লাইট ধরলেন ১৩ জুন। বিচারের সময় আরেকবার আসতে হবে, যাওয়ার আগে জুডিথকে বললেন তৃষ্ণা। জুডিথ বললেন, ‘শিয়োর।’
আয়ারল্যান্ড দূতাবাস থেকে মামলার অগ্রগতি জানতে চেয়ে সপ্তাহে একটা করে চিঠি আসতে শুরু করল। স্বাভাবিক। নিজের দেশের কোনও নাগরিক ‘টুরিস্ট ভিসা’ বা ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ নিয়ে বিদেশ গিয়ে যৌননিগ্রহের শিকার হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটা অস্বস্তি তো মাথাচাড়া দেবেই। তদন্তকারীদের উপর চাপ বাড়তে শুরু করল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চার্জশিট দেওয়ার।
সেই চাপ সামলানো দুরূহ হল না তেমন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণ প্রমাণিত। দু’জনের সে-রাতের পোশাক-আশাকের ফরেনসিক পরীক্ষাতেও সমর্থন মিলেছে ডাক্তারের রিপোর্টের। পার্ক হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজেও ‘তন্ত্র’-য় সেদিনের পার্টিতে সুজয়ের উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে। পার্টির পর সুজয়-মাইকেলের সঙ্গে জুডিথের হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার একাধিক সাক্ষী রয়েছে। রয়েছে সুজয়-জুডিথের ফোনের টাওয়ার লোকেশন, যা খাপে খাপে মিলিয়ে দিচ্ছে সদর স্ট্রিটে মাইকেলের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়া থেকে ভোর সোয়া ছ’টা পর্যন্ত দু’জনের একত্রে অবস্থান। আছে আদালতে দেওয়া জুডিথের জবানবন্দি। পয়লা জুনের সকালে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পোশাকে ট্যাক্সি খুঁজছেন এক বিদেশিনী যুবতী, এই দৃশ্যেরও স্থানীয় সাক্ষী রয়েছে একাধিক।
কী বাকি থাকে আর? সাক্ষ্যপ্রমাণ একত্রিত করে তৃষ্ণা চার্জশিট পেশ করলেন ১১ জুলাই। ঘটনার ঠিক একচল্লিশ দিনের মাথায়। এবার নতুন টার্গেট, বিচারপর্ব দ্রুত শেষ করতে আদাজল খেয়ে লেগে থাকা। এই মামলায় শাস্তি হওয়াটাই যথেষ্ট নয় শুধু। হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
কিন্তু টার্গেট স্থির করা এক, আর সেটা পূরণ করা আরেক। গোয়েন্দাবিভাগ প্রথম হোঁচটটা খেল খোদ জুডিথেরই কাছ থেকে। ভারত ছাড়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিচারপর্বে কিছুদিনের জন্য ফিরে আসার। কেস এবার ‘ট্রায়াল স্টেজ’-এ, জুডিথকে মেল করে জানানো হল। প্রত্যুত্তরে জুডিথ জানালেন, বিচারপর্বে আসতে পারবেন না ভারতে। আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অক্ষম। তৃষ্ণা ফের অনুরোধ করলেন জবাবি মেলে, অন্তত দিন পনেরোর জন্য এলেই যথেষ্ট। বিদেশে বেশিদিন থাকা যে অসুবিধের, সেটা বিচারক নিশ্চয়ই বিবেচনা করবেন, তাড়াতাড়িই মিটে যাবে সাক্ষ্যদান-পর্ব। কিন্তু জুডিথ অনড়। আর ইন্ডিয়ায় আসবেন না কিছুতেই। আয়ারল্যান্ডে ফোন করেও বিস্তর বোঝানোর চেষ্টা করলেন গৌরী-তৃষ্ণা। কিন্তু জুডিথের এক কথা, সশরীরে ওই সুজয় মিত্রের মুখোমুখি হওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া ওই রাতের ঘটনা নিয়ে আদালতে প্রকাশ্য কাটাছেঁড়া সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তাঁর।
এবার? ধর্ষণের মামলায় অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যদান এবং অভিযুক্তকে চিহ্নিতকরণ একেবারে ন্যূনতম পূর্বশর্ত। পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে এ মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। দীর্ঘ বেঠকে বসলেন জয়েন্ট কমিশনার( ক্রাইম)। যে বৈঠকে জুডিথের অসহযোগিতা নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না তদন্তকারী টিমের অফিসাররা।
রীতিমতো হতাশই শোনাচ্ছিল তৃষ্ণাকে, ‘এভাবে হয় স্যার, বলুন? বারবার বললাম, জাস্ট দু’সপ্তাহের জন্য আসুন। কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। ভিক্টিমের এগজামিনেশন না হলে তো মামলা বিশ বাঁও জলে চলে যাবে।’
গৌরীও যোগ দিলেন আলোচনায়, ‘একজ়্যাক্টলি। একদিকে ওদের এমব্যাসি থেকে চিঠি এসেই চলেছে কেসের প্রোগ্রেস জানতে চেয়ে, অথচ ভিক্টিম কোর্টে সাক্ষী দিতে আসবে না! এটা কিন্তু আনফেয়ার স্যার। জাস্টিস দেওয়ার জন্য আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছি আমরা, এভিডেন্স যা আছে, কনভিকশন হবেই। কিন্তু জাস্টিস পেতে গেলে ভিক্টিমকেও তো মিনিমাম কো-অপারেশন করতে হবে!’
পৃথ্বীরাজও ক্ষোভ গোপন করলেন না, ‘সেটাই। মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপে জানা নেই-শোনা নেই, এমন দু’জন লোককে বিশ্বাস করে কেউ ওভাবে অত রাতে বেরিয়ে যায়? কই, আর কেউ তো যায়নি। বন্ধুদের সঙ্গে হোটেলে ফিরে গেলে ঘটনাটাই ঘটত না। আর ঘটে যখন গেছেই, কালপ্রিটের শাস্তি নিশ্চিত করতে আর একবার আসা যায় না ট্রায়ালের সময়? আমরা কার জন্য এত কিছু করছি? জুডিথের জন্যই তো! কিছু মনে করবেন না স্যার, সেই রাতে জুডিথ নির্বোধের মতো কাজ করেছিলেন। আর এখন অন্যায় জেদ করছেন।’
গোয়েন্দাপ্রধান চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণ। বুঝছিলেন,অফিসারদের যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ক্ষোভও নয় পুরোপুরি অসংগত। সব শোনার পর মুখ খুললেন।
‘একটা ব্যাপার বোঝো। জোর করে তো আমরা জুডিথকে ভারতে আসতে বাধ্য করতে পারব না। ‘‘আসবে না’’ ধরে নিয়েই অন্য রাস্তা ভাবতে হবে। আর শোনো, সেদিন রাতে জুডিথের আচরণ নিয়ে জাজমেন্টাল না হওয়াই ভাল। বোকামি তো নিশ্চয়ই করেছিল মেয়েটি। আর তার চরম মূল্যও চোকাতে হয়েছে। আসলে কী জানো, এই কুড়ি-একুশ বয়সটা অদ্ভুত। বিপদকে অ্যান্টিসিপেট করতে পারলেও সাধারণত বিশ্বাস করতেই বেশি উৎসুক থাকে ওই বয়সিরা। কাকে কখন বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা উচিত, সেই বোধটা খুব পরিষ্কারভাবে ঠিক তৈরি হয় না। বিশ্বাস করার মাশুল এভাবে দিতে হবে জানলে কি আর যেত?’
‘মানলাম স্যার’, তৃষ্ণা বলে ওঠেন, ‘কিন্তু বিদেশবিভুঁইয়ে আরও অনেক বেশি কেয়ারফুল থাকা উচিত ছিল। সমাজসেবা করতে এসে…’
গোয়েন্দাপ্রধান থামিয়ে দেন তৃষ্ণাকে, ‘সে তো একশোবার। কেয়ারফুল ছিল না বলেই তো এত কিছু। কিন্তু ওই যে বললাম, বয়সটাই ঝুঁকি নেওয়ার। আর ভুলে যেয়ো না, শি ওয়াজ় ড্রাঙ্ক। আর একটা কথা, সমাজসেবা করতে এসেছিল একটা প্যাশন থেকে। তার সঙ্গে তো বন্ধুদের নিয়ে হইহুল্লোড় করার কোনও বিরোধ নেই। মাদার টেরিজার সংস্থায় কাজ করতে এসেছিল বলে ওকেই মাদার টেরিজা বলে ভেবে নেওয়াটাও বোধহয় আনফেয়ার।’
পৃথ্বীরাজ না বলে পারেন না, ‘তবু স্যার…।’
‘শোনো পৃথ্বীরাজ, আরও একটা বেসিক জিনিস ভুলে যাচ্ছ তোমরা। দুটো সোসাইটির তফাত। ইউরোপ বা আমেরিকায় নারী-পুরুষে ফ্রি-মিক্সিংয়ে কোনও ছুঁতমার্গ নেই। যেটা আমাদের এখানে আছে। আমাদের দেশে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনও মেয়ে অপরিচিত দু’জন পুরুষের সঙ্গে হুট করে মধ্যরাতের পার্টিতে চলে যাওয়ার আগে হাজারবার ভাববে। ইউরোপ-আমেরিকায় মোটেই ভাববে না অতটা। কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু দুটো সমাজ আলাদা। তাদের ভ্যালুসিস্টেম আলাদা। মাইন্ডসেট আলাদা। এটা তো ভুললে চলবে না। তা ছাড়া জুডিথ তো তোমাদের বলেওছে, কনসেনসুয়াল সেক্স হলে কোনও অসুবিধা ছিল না ওর। ওকে সুজয় ফোর্স করেছিল বলেই কমপ্লেনটা করেছে।’
‘সে তো বুঝলাম স্যার, কিন্তু এখন কেসটার কী গতি হবে?’ তৃষ্ণার চোখেমুখে উদ্বেগ ধরা পড়ছিল।
‘ভেবে দেখলাম, একটাই রাস্তা পড়ে আছে।’ গোয়েন্দাপ্রধান বললেন শান্তভাবে।
‘কী স্যার?’
‘ভিসি। ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং।’
‘ভিডিয়ো–কনফারেন্সিং?’ পৃথ্বীরাজের গলায় ঠিকরে বেরয় সংশয়, ‘রেপ কেসে ভিডিয়ো–কনফারেন্সিং স্যার? ছোটখাটো কেসে ভিসি-র মাধ্যমে ট্রায়াল এর আগে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু রেপ কেসে বোধহয় এদেশে ভিসি-ট্রায়াল হয়নি স্যার। আমাদের রাজ্যে তো হয়ইনি। ডিফেন্স প্রচুর ঝামেলা করবে।’
‘জানি। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় আছে কি কোনও? চেষ্টা তো একটা করতেই হবে। সব কিছুরই একটা প্রথমবার থাকে। এই কেসে কনভিকশন না করাতে পারলে শুধু কলকাতা পুলিশ নয়, গোটা রাজ্যের মুখ পুড়বে। দেশেরও। তোমরা কালই জুডিশিয়াল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলো। শেষ না দেখে ছাড়ার প্রশ্নই নেই।’
.
ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং-এর মধ্যস্থতায় অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়া, তা-ও ধর্ষণের মামলায়, দেশে এই প্রথম। না অভিজ্ঞতা ছিল স্থানীয় আদালতের, না পুলিশের।
প্রথম কাজ আইরিশ দূতাবাসে মেল করে প্রস্তাবটা দেওয়ার। জেনে নেওয়া, এই পদ্ধতিতে জুডিথ আদৌ রাজি আছেন কিনা। মেলের উত্তর দিতে বেশ কিছুটা সময় নিলেন জুডিথ। অবশেষে আইরিশ দূতাবাস মারফত জানালেন, রাজি। তাঁর সমস্যা ভারতে আবার আসা নিয়ে। আসতে না হলে যে কোনও প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সহযোগিতা করবেন। কোনও আপত্তি নেই।
জুডিথের সম্মতি পাওয়ামাত্র জানানো হল আলিপুর কোর্টে। অনুমতি চাওয়া হল ভিসি-র মাধ্যমে জুডিথের সাক্ষ্যদানের । আদালত সম্মত হল, সরকার পক্ষের আইনজীবীকে নির্দেশ দিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে। সঙ্গে সঙ্গে লালবাজার থেকে চিঠি গেল রাজ্য সরকারের আইনমন্ত্রকে। অনুরোধ, সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতর যেন সাহায্য করে আদালতে ভিসি-র প্রক্রিয়ার সুবন্দোবস্তে। তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী তৃষ্ণা-গৌরী ছুটলেন ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার (এনআইসি)-এ। ঠিক কী কী দরকার হবে আদালতে , পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা দিল এনআইসি।
লালবাজারের কম্পিউটার সেল, টেলিফোন বিভাগ, ওয়ারলেস দফতরের যৌথ সমন্বয়ে দ্রুতই তৈরি হয়ে গেল পরিকাঠামো। কম্পিউটার, প্রোজেক্টর-স্ক্রিন, স্পিকার-মাউথপিস, ফোর জি ডঙ্গেল… যা যা দরকার। খুব বেশি তো কিছু লাগে না একটা ভিসি-র আয়োজনে ।
জুডিথকে একটা ‘স্কাইপ’ অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হল। লালবাজারের ‘উইমেন্স গ্রিভান্স সেল’-ও অ্যাকাউন্ট খুলল স্কাইপে। আদালতের নির্দেশে সাক্ষ্যগ্রহণের দিনগুলিতে জুডিথকে আয়ারল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসে উপস্থিত থাকতে বলা হল। সময়টা নির্ধারিত হল দু’দেশের ‘টাইম ডিফারেন্স’ মাথায় রেখে। আমাদের যখন সকাল দশটা, আয়ারল্যান্ডে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। ভারত সাড়ে চার ঘণ্টা এগিয়ে। জুডিথকে অনুরোধ করা হল আইরিশ সময় সকাল দশটায় দূতাবাসে আসতে। যাতে দুপুর আড়াইটে থেকে টানা সাক্ষ্য নেওয়া যায় কোর্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ।
গোয়েন্দাবিভাগ এবং এনআইসি-র টেকনিক্যাল টিম সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর বিচারক নিজে খুঁটিয়ে দেখলেন সবটা। এবং নির্দিষ্ট দিনে ভিডিয়ো-কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হল আলিপুর টু আয়ারল্যান্ড। শুরু হল জুডিথ ফ্লোরেন্সের সাক্ষ্যগ্রহণ। জুডিথের সঙ্গে উপস্থিত থাকলেন আয়ারল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি বেঞ্জামিন বেসরা। বিচারকের কাছে সরকারি আইনজীবী বিচারপর্বের শুরুতেই আবেদন করেছিলেন, মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী যেন জুডিথের সাক্ষ্যদান পর্ব তাড়াতাড়ি শেষ করা হয়। সম্মত হয়েছিলেন বিচারক।
তিন দফায়, দিন পনেরোর মধ্যেই প্রায় শেষ হয়ে এল জুডিথের ‘একজামিনেশন-ইন-চিফ’, (সাক্ষীকে বাদীপক্ষের উকিলের জেরা, যার উদ্দেশ্য হল প্রশ্নমালা সাজিয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারবত্তা প্রমাণ করা)। এরপর পালা ‘ক্রস-একজামিনেশন’-এর, যখন বিবাদী পক্ষের উকিলের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে জুডিথকে। যতই চেষ্টা করুন অভিযুক্তের আইনজীবীরা, তথ্যপ্রমাণের জাল কাটিয়ে সুজয়ের বেরনো অসম্ভব, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তৃষ্ণা-গৌরীরা। সেই বিশ্বাস সামান্য টোল খেল, যখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুজয়ের আইনজীবী ‘ক্রস-একজামিনেশন’-এর আগেই পিটিশন করলেন কোর্টে। পিটিশনের সারবস্তু? ধর্ষণের এই মামলায় এভাবে ভিসি-র মাধ্যমে অভিযোগকারিণীর সাক্ষ্যগ্রহণের আইনি বৈধতা নেই। প্রক্রিয়াটাই তাই বাতিল করা হোক।
বাতিল করার সপক্ষে যুক্তি সাজালেন সুজয়ের আইনজীবী। এক, বিচারপর্বে হাজির থাকার জন্য সমন পাঠানো হয়নি জুডিথকে। দুই, যিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তিনিই যে অভিযোগকারিণী, সে ব্যাপারে ওকালতনামা জমা নেওয়া উচিত ছিল কোর্টের। নেওয়া হয়নি। তিন, সাক্ষ্যগ্রহণের সময় জুডিথ এবং ভারতীয় দূতাবাসের অফিসার ছাড়া অন্য কেউ যে উপস্থিত থাকছেন না, সেটা নিশ্চিত করা হয়নি। হতেই পারে, ওই ঘরে অন্য কেউ থাকছেন, যিনি ক্যামেরার আড়ালে থেকে জুডিথকে ইশারায় নির্দেশ দিচ্ছেন। চার, কথা বলার সময় ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছেনই না জুডিথ। সাক্ষীর শরীরী ভাষা স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়াটাও সাক্ষ্যমূল্য নির্ধারণের একটা শর্ত। সেই শর্ত পালিত হচ্ছে না।
আলিপুর কোর্ট মানল না এই যুক্তি। প্রশ্ন তুলল পালটা, এইসব ওজর-আপত্তি আগে তোলেননি কেন বিবাদী পক্ষের উকিল? প্রক্রিয়াগত ত্রুটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন প্রক্রিয়া অনেকটা সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর? মানা যায় না এই হঠাৎ বোধোদয়। সুতরাং যেমন চলছে, তেমনই চলবে।
যেমন চলছিল, তেমন আর চলল কই? বিবাদী পক্ষ পত্রপাঠ দ্বারস্থ হল হাইকোর্টের। সওয়াল-জবাব পর্ব শেষ হওয়ার পর উচ্চ আদালতও খারিজ করে দিল সুজয়ের আইনজীবীদের দাবি।
খারিজ করার কারণ?
প্রথমত, সমন জারি করে আদালতে বিদেশিনী সাক্ষীর সশরীরে হাজিরা শুধু সময়সাপেক্ষই নয়, অনিশ্চিতও। ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়ায় দেশে সাক্ষ্যদান হয়েছে একাধিক। অধিকাংশই যদিও দেওয়ানি মামলায়, ফৌজদারি মামলাতেও নজির আছে। ধর্ষণের মতো গুরুতর মামলায় এ যাবৎ হয়নি ঠিকই , কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে যে-কোনও কেসেই ভিসি-প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যদানে কোনও আইনি বাধা নেই।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষ্যদানের সময় ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি উপস্থিত ছিলেন, যিনি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের দায়িত্বশীল অফিসার। তিনি অবশ্যই এটুকু নিশ্চিত করেছেন যে জুডিথের হয়ে অন্য কেউ সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। জুডিথের ছবি আছে কেস ডায়েরিতে। সেই ছবির সঙ্গে বাস্তবের সাক্ষীর ন্যূনতম অমিলও খুঁজে পাননি নিম্ন আদালতের বিচারক। এই জুডিথই সেই জুডিথ কিনা, সেই প্রশ্ন তোলা তাই হাস্যকর। এবং ফার্স্ট সেক্রেটারির উপর এটুকু ভরসাও রাখতেই হবে যে তিনি জুডিথ ছাড়া অন্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তিকে উপস্থিত থাকতে দেননি সাক্ষ্যদানের সময়।
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সাক্ষী দেওয়ার সময় একজন ধর্ষিতা ক্যামেরার দিকে কতটা তাকালেন বা না তাকালেন, সেটা মোটেই গ্রাহ্য নয় সাক্ষ্যের গুরুত্ব নির্ধারণে। একজন ‘রেপ-ভিক্টিম’-এর পক্ষে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় ‘ট্রমাটাইজ়ড’ থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দৈনিক ভিত্তিতে শেষ করতে হবে জুডিথের সাক্ষ্যদান।
হাইকোর্টের রায় বেরনোর যা অপেক্ষা! সুজয়ের আইনজীবীরা রায়ের বিপক্ষে দ্রুত আবেদন করলেন সুপ্রিম কোর্টে। সুজয়দের পরিবার যথেষ্ট অর্থবান। নামজাদা উকিলদের পিছনে জলের মতো টাকা খরচ করাটা কোনও সমস্যাই নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ফের শুরু হল যুক্তি-পালটা যুক্তির আইনি লড়াই।
একটা ব্যাপার পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চিত লক্ষ করবেন। এই যে লিখছি, নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন হল হাইকোর্টে, রায় বহাল রাখল হাইকোর্ট, ফের আবেদন হল সুপ্রিম কোর্টে…ঘটনা-পরম্পরা ধরা থাকছে মাত্র কয়েকটা অনুচ্ছেদে। পড়লে হয়তো মনে হবে,ও আচ্ছা, এটার পর ওটা ঘটল। আর ওটার পর সেটা। বাস্তবের বিচারপর্ব সিনেমার ‘কোর্টরুম ড্রামা’ নয়। বরং, বিলম্বিত লয়। এটা-ওটা-সেটার যাত্রাপথে সময় কীভাবে চলে যায়, তদন্তকারীরাই জানেন। হাজার হাজার বিচারাধীন মামলা। হরেক তাদের চেহারা, হরেক তাদের চরিত্র। একটা নির্দিষ্ট মামলাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও স্রেফ সংখ্যার চাপে উপায় হয় না আদালতের। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়, ক্যালেন্ডারে পালটে যায় বছর।
এবং ঠিক এখানেই তদন্তকারী অফিসারদের সিলেবাসে কঠিনতম চ্যাপ্টারের প্রবেশ। ধৈর্যের অনন্ত পরীক্ষা, অধ্যবসায়ের শেষ সীমান্ত ছুঁয়ে আসার চ্যালেঞ্জ। মগজাস্ত্রের প্রয়োগে কেসের সমাধান তো সিঁড়ির একটা ধাপ স্রেফ। জটিল মামলার বিচারপর্বে দাঁত কামড়ে লেগে থাকা তার থেকেও ঢের বেশি কঠিন।
গৌরী এবং তৃষ্ণা প্রাণপণ লড়ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ধেয়ে আসা বাউন্সারকে ‘ডাক’ করে পড়ে ছিলেন পিচ আঁকড়ে। উভয় পক্ষের তার্কিক স্নায়ুযুদ্ধ যখন চলছে সুপ্রিম কোর্টে, শুনানির পর শুনানিতে সুজয়ের আইনজীবীরা সাজাচ্ছেন ভিসি-প্রক্রিয়া বাতিল করার যুক্তিজাল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ দিল্লিতে কাটিয়েছিলেন গোয়েন্দাবিভাগের এই দুই মেধাবিনী তদন্তকারী। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করে সাজিয়েছিলেন পালটা যুক্তি। যখন সুপ্রিম কোর্টে জারি এই মামলার চাপান-উতোর, তার মাসখানেক আগেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন তৃষ্ণা। সামনে ছিল ছেলের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। গৌরীর বাবাও সেই সময়েই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবশ্য কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর দায়বদ্ধতা কবেই বা গ্রাহ্য করেছে সময়-অসময়-দুঃসময়কে?
রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। যে রায়ে খুশি হওয়ার কারণ ছিল। হতাশ হওয়ারও।
খুশি, কারণ সুপ্রিম কোর্ট শর্তাধীন বৈধতা দিল ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জুডিথের সাক্ষ্যদানকে। কী শর্ত?
(ক) রাজ্য সরকারকে এনআইসি-র সহায়তা নিয়ে ‘VC Location’ নামক সফ্টওয়ারের মাধ্যমে ভিডিয়ো-কনফারেন্সিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এনআইসি এ বিষয়ে আয়ারল্যান্ডে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলবে এবং সুনিশ্চিত করবে উভয় পক্ষের প্রযুক্তিগত সাযুজ্য। আলিপুর কোর্টের বিচারক একটি বিশেষ ঘর চিহ্নিত করবেন, যেখানে চলবে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। এজলাসে নয়, অন্য কোনও নির্দিষ্ট ঘরে।
(খ) আয়ারল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাস একজন দায়িত্বশীল আধিকারিককে চিহ্নিত করবে। সাক্ষ্যগ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনিই একমাত্র জুডিথের সঙ্গে দূতাবাসে ভিসি-র জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে থাকবেন এবং নিশ্চিত করবেন কোনও তৃতীয় ব্যক্তির অনুপস্থিতি। এবং এই শর্তগুলো যে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হচ্ছে সে ব্যাপারে সাক্ষ্যগ্রহণের আগে কোর্টকে লিখিত হলফনামা দেবেন সংশ্লিষ্ট অফিসার।
(গ) সাক্ষ্যদানে যে যে প্রশ্নের উত্তরে যা যা বললেন জুডিথ, পুরোটা স্ক্যান করে মেইল করতে হবে আইরিশ এমব্যাসিতে। জুডিথ সেটা পড়ে দেখে নেবেন, বয়ান নথিভুক্ত করায় কোনও ভুলভ্রান্তি হয়েছে কিনা। তারপর বয়ানে সই করবেন এবং সেই স্বাক্ষরিত বয়ানের এক কপি স্ক্যান করে মেইল করতে হবে আলিপুর কোর্টে। আর একটা কপি থাকবে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসারের কাছে। বন্ধ খামে।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু খুশির পাশাপাশি হতাশারও উদ্রেক করল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের শেষাংশ। যাতে বলা হল স্পষ্ট, এ যাবৎ জুডিথের যা সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হল। নতুন করে শুরু হবে সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়া, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের শর্তাবলি মেনে, ‘The instant parameters have to be adopted to record the testimony of the prosecutrix-PW 5, in addition to the procedure and safeguards provided for in the impugned order. Accordingly, it will be imperative to record her testimony afresh.’
মানে? ফের শূন্য থাকে শুরু? নিম্ন আদালতে এত যে কাঠখড় পোড়ানো, কলকাতা-দিল্লিতে এত যে দৌড়ঝাঁপ, এত যে মেইল-চালাচালি, সব কিছুর নিট ফল শেষমেশ এই? এ তো অনেকটা সেইরকম হল, বল উইকেটে লাগল, কিন্তু বেল পড়ল না। নট আউট! আবার ফিরে যাও বোলিং রান-আপে। শুরু করো নতুন করে। কী আর করা, ভাবলেন তৃষ্ণারা। শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক। এত কাছে এসে ফিরে যেতে নেই।
সুপ্রিম কোর্টের যাবতীয় শর্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে ফের শুরু হল নতুন করে জুডিথের সাক্ষ্যদানের প্রক্রিয়া। প্রতিদিনই সুজয়ের সঙ্গে আদালতে হাজির থাকতেন তাঁর মা। একদিনও বাদ যেত না, ছেলের পাশে থাকতেন আগাগোড়া। সাক্ষ্যদান প্রক্রিয়ায় মাঝেমাঝেই ‘মেন্টাল ব্রেকডাউন’ হত জুডিথের। ক্যামেরার দিকে মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে ফের নামিয়ে নিতেন। কেঁদেও ফেলতেন কখনও কখনও।
গৌরী-তৃষ্ণা লক্ষ করছিলেন, ‘আইডেন্টিফিকেশন অফ দ্য অ্যাকিউজ়ড’ বা অভিযুক্তের চিহ্নিতকরণের দিন যত এগিয়ে আসছিল, নিজের চেহারায় সচেতনভাবে বদল আনছিলেন সুজয়। ‘ক্লিন-শেভড’ ছিলেন ঘটনার সময়। হঠাৎই দাড়িগোঁফ রাখতে শুরু করলেন । চুল কাটা বন্ধ করে দিলেন। ‘হিপি’-দের মতো চেহারা করে ফেললেন। ঘটনার সময়ের চেহারার সঙ্গে যাকে মেলানো দায়। অঙ্ক পরিষ্কার, চেহারাকে এতটাই ভাঙচুর করা, যাতে চিহ্নিতকরণের দিন ‘আইডেন্টিফাই’ করতে অসুবিধা হয় জুডিথের। যিনি সুজয়কে দেখেছিলেন মাত্র সাত-আট ঘণ্টার জন্য। তারপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে বছর চারেক।
চিহ্নিতকরণের দিন যা ঘটল, ধরা থাক তৃষ্ণার জবানিতে, ‘ভীষণ টেনশনে ছিলাম আমরা। এতদিনে আমাদেরও এনার্জি ফুরিয়ে এসেছিল প্রায়। শুধু ভাবছিলাম শেষরক্ষা হবে তো? কয়েক মাস চুল-দাড়ি না কেটে একটা কিম্ভূত চেহারা করে ফেলেছিল সুজয়। বিচারক সেদিন মাত্র চোদ্দো-পনেরো জনকে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন ভিসি-রুমে। দু’পক্ষের আইনজীবী মিলিয়ে চারজন। আমি আর গৌরী। কোর্টের কর্মী পাঁচজন। এনআইসি-র দু’জন আধিকারিক। আর সুজয়। নির্দেশ ছিল, আইনজীবীরাও থাকবেন সাদা পোশাকে। প্রথাগত কালো গাউন পরে নয়। ঠিক পৌনে তিনটেয় ভিসি চালু হল। জুডিথকে দেখে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। আমরা শুধু ভাবছিলাম, পারবে তো?
‘ক্যামেরা চলতে শুরু করল। বিচারক কোনও বাড়তি কথায় গেলেন না। সোজাসুজি বললেন, এই ঘরে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেককে ভাল করে দেখুন। এবং দেখে বলুন, এঁদের মধ্যে কি সেই ব্যক্তি আছেন, যাঁর বিরুদ্ধে আপনি ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন? ভাল করে দেখুন। কোনও তাড়া নেই।
‘সুজয় সেদিন সাদা শার্ট পরে এসেছিল। ক্যামেরা ধীরে ধীরে জ়ুম করছিল ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকের মুখের উপর। সুজয়ের মুখের উপর থেকে যেই ক্যামেরা সরে ফোকাস করল বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর উপর, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল জুডিথ, ‘‘হোল্ড ইট! ব্যাক প্লিজ়!’’ ক্যামেরা ফিরল সুজয়ের মুখের উপর। সুজয় মুখ তুলছিল না। বিচারক ধমক দিলেন, ‘‘মুখ তুলুন!’’ ঘরে একটা দমবন্ধ অবস্থা তখন। সেকেন্ড দশেক বড়জোর, জুডিথ ফের চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘ইটস হিম ! দ্য ওয়ান ইন দ্য হোয়াইট শার্ট!’’ বলেই ফের মুখ নিচু করে কেঁদে ফেললেন, ‘‘ক্যান উই এন্ড দিস নাউ?’’ একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। নিশ্চিত হয়ে গেলাম, কনভিকশন এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।’
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের বিস্তারিত দিনপঞ্জি দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি না এ-লেখার কলেবর। তবে এটুকু অবশ্যই উল্লেখ্য, যে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি খুব বেশি হলে এক বা দেড় বছরের মধ্যে হয়ে যাবে বলে ভেবেছিলেন লালবাজারের কর্তারা, বিস্তর টানাপোড়েনের বাধা পেরিয়ে তার রায় বেরিয়েছিল প্রায় সাড়ে চার বছর পরে। ২০১৮-র জানুয়ারিতে। আলিপুর আদালত সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল সুজয় মিত্রকে। জরিমানা বাবদ জুডিথকে দুই লক্ষ টাকা দেওয়ারও নির্দেশ ছিল সুজয়ের উপর।
‘জাস্টিস ডিলেইড’ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ‘ডিনায়েড’ হয়নি। গৌরী-তৃষ্ণা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে দেননি ভারতে এসে যৌন-নির্যাতনের শিকার হওয়া এক বিদেশিনীকে। বিচারপ্রক্রিয়ায় তদন্তকারীদের মরিয়া লড়াই আর নিরলস অধ্যবসায়ের জন্যই গোয়েন্দাপীঠ লালবাজারের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে এই মামলা।
কল্পনার গোয়েন্দা কাহিনিতে সংখ্যার নিরিখে হোক বা জনপ্রিয়তায়, মহিলা ডিটেকটিভের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। বিদেশি গোয়েন্দা সাহিত্যে এক এবং অদ্বিতীয়া আগাথা ক্রিস্টি সৃষ্ট মিস মার্পল। বাংলায় মুখ ফেরাই যদি, আছেন অনেকে। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘কৃষ্ণা’ থেকে মনোজ সেনের ‘দময়ন্তী’। প্রদীপ্ত রায়ের ‘জগাপিসি’ থেকে নলিনী রায়ের ‘গন্ডালু,’ বা অদ্রীশ বর্ধনের ‘নারায়ণী’। তবে লোকপ্রিয়তার মাপকাঠিতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘মিতিনমাসি’ বা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গার্গী’ অনেকটাই এগিয়ে অন্যদের তুলনায়। অনেকেরই স্বাভাবিক কৌতূহল, বাস্তবে নেই মহিলা গোয়েন্দা? পুরুষদেরই আধিপত্য একচেটিয়া?
সত্যের খাতিরে স্বীকার্য, আধিপত্য হয়তো আছে। হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই আছে। কিন্তু তা মহিলা গোয়েন্দাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো নিরঙ্কুশ নয় মোটেই। মেধা, পরিশ্রম এবং আন্তরিকতার ত্র্যহস্পর্শে বহু জটিল মামলার সুচারু সমাধান করেছেন মহিলা অফিসাররা। আলোচ্য কেস তো একটা নমুনা মাত্র।
এ কাহিনির শেষ অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মনে পড়ে যায়। ছবির একদম শুরুতে রুকু ওরফে ক্যাপ্টেন স্পার্কের সেই ডায়লগটা ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে আসে অনিবার্য। ‘সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি…।’
বাস্তবেও তাই। ফেলুদা সত্যি, ব্যোমকেশ সত্যি। মিতিনমাসিও সত্যি।