মাহমুদা রহমানের বাসায় গিয়ে আমি কলিংবেল বাজাই; আমি নিজেই অবাক হই। এখানে আমার আসার কথা ছিলো না, আমি আসতে চাই নি, ইচ্ছে ছিলো ব্রিজ দেখতে যাবো, কাজ কেমন হচ্ছে দেখবো বা নদী দেখবো; তার বদলে আমি মাহমুদা রহমানের ফ্ল্যাটের কলিংবেলে আঙুল রেখে দু-বার চাপ দিই। আমি মাতাল হই নি, কখনো হই না, অতোটা আমি কখনোই খাই না; শুধু একটু গন্ধ ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না একটু আগে আমি পান করেছি। মাহমুদা রহমান আমাকে দেখে অবাক হন, বিব্রতও হন; আমি বুঝতে পারি তিনি বিব্রত, তাতে আমি অবাক হই; এ-সময়ে আমাকে দেখে তার শুধুই অবাক হওয়ার কথা ছিলো, বিব্রত হওয়ার কথা ছিলো না। অন্য দিন হলে তিনি আমাকে সরাসরি শয্যাকক্ষে নিয়ে যেতেন, সেটাই আরামদায়ক ও অন্তরঙ্গ, আজ ড্রয়িংরুমে ঢুকতে হলো তাঁর সাথে, ঢুকে আমি একটু আহত হলাম সেখানে যুগ্ম জিল্লুর রহমানকে দেখতে পেয়ে। আমি জানি না তিনি জিল্লুর রহমান কি না, তিনি যুগ্মসচিব, কি না, মাহমুদা রহমান তাঁর এ-পরিচয়ই দিলেন; পরিচয়টি ঠিকই হবে, আমার কাছে তাঁকে লুকোতে চান নি মাহমুদা রহমান, আমার যে-পরিচয় দিলেন তাঁর কাছে, সেটা ঠিকই। যুগ্ম শব্দটি সব সময়ই আমার অদ্ভুত কিম্ভুত লাগে, প্রথম যখন পেয়েছিলাম তখন থেকেই, শব্দটি শুনলেই লেগে থাকার গেথে থাকার সেঁটে থাকার ভাব মনে। আসে, আর আমি দু-একটি যুগু দেখেছি, সেগুলো অদ্ভুতভাবে লেগে থাকতে গেঁথে থাকতে পারে; আমি বুঝতে পারি এ-যুগটি লেগে আছেন গেঁথে আছেন মাহমুদা রহমানের পশ্চাতে। তার কোনো উপসচিবের বাসায় থাকার কথা ছিলো, তিনি এখন। মাহমুদা রহমানের বাসায়। আজই কি তিনি প্রথম মাহমুদা রহমানের যুগ্ম হয়েছেন? না কি কয়েক দিন ধরেই হয়েছেন, আসছেন? তিনি খুব টানটান হয়ে আছেন, তার সারা দেহখানি দাঁড়িয়ে আছে; কোনো শিথিলতা ক্লান্তি নেই তাঁর শরীরে চোখেমুখে, মনে। হচ্ছে এখনি ফেটে পড়বেন; তাহলে তিনি লেগে থাকার পুরস্কার পান নি এখনো। আমি কি চলে যাবো, তাঁদের কথা আর কাজে অসুবিধা হচ্ছে সম্ভবত, আমি কি চলে যাবো? মাহমুদা রহমান আমাদের দুজনকে নিয়ে কী করবেন? একটি যুগ আরেকটি ক্যান্টিলিভার তার একসাথে দরকার পড়বে না। মাহমুদা রহমানই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ভার নিলেন, তিনি আমাকে এখনো পরিত্যাগ করেন নি।
তিনি বললেন, আপনাকে কয়েক দিন ধরেই ফোন করছি (সত্য নয়), পাচ্ছি না (সত্য নয়), আপনাকে আমার খুব দরকার (হয়তো সত্য নয়)।
আমি কী বলব, বলবো কি আমি ঢাকায় ছিলাম না, তাই পান নি; আমি তা বলতে পারি না, কী বলতে হবে বুঝতে পারি না, শুধু বলি, আজ আমি যাই, আরেক দিন আসবো।
মাহমুদা রহমান আরো বিব্রত হয়ে পড়েন, আমার চলে যাওয়া সুন্দর দেখাবে না বলে আমার মনে হয়, এবং তারও মনে হয় বলে আমার মনে হয়।
তিনি বলেন, আপনাকে আমার খুব দরকার (সত্য নয়), দয়া করে একটু বসুন।
তিনি এভাবে কথা বলছেন কেনো? আমি চলে গেলে তার কী আসে যায়?
আমি মাহমুদা রহমানের দিকে তাকাই, আমার মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগে তাঁকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছিলো, ছুঁতেও খুব ইচ্ছে করছিলো; এখন আমার কিছুই ইচ্ছে করছে না, দেখতেও ইচ্ছে করছে না, ছুঁতেও না; পান করার সময় তাকে আমার কবুতর মেঘ টুনটুনি জলপাই মনে হচ্ছিলো, এখন তাকে মিসেস রহমান মনে হচ্ছে, যাকে দেখার কিছু নেই হেয়ার কিছু নেই। যুগ্মটি সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন আজ আর কোনো কাজ হবে না, একটা বাজে গ্রহ দেখা দিয়েছে; তিনি উঠে দাঁড়ান, ভাবীকে আশ্বাস দিতে থাকেন শিগগিরই আবার আসবেন, তাঁর আজ অনেক কাজ, নইলে আরো কিছুক্ষণ থাকতেন; মাহমুদা রহমান তাঁকে দরোজা পর্যন্ত দিয়ে আসেন। আমি মাহমুদা রহমানকে আবার দেখি, তাকে আমার কবুতর মনে হয় না মেঘ মনে হয় না টুনটুনি। মনে হয় না জলপাই মনে হয় না, তাঁকে দেখার কিছু নেই হেয়ার কিছু নেই। তিনি হয়তো আমার চোখ দেখে তা বুঝতে পারেন, তাকে এতো অসহায় দেখাতে থাকে যে এবং এমন অসহায়ভাবে আমার পাশে এসে বসেন যে আমার মায়া হয়। তাঁর মুখটি। অত্যন্ত ছোটো দেখায়, তাতে রক্ত নেই বলে মনে হয়।
তিনি বলেন, যুগ্মসচিব আমাকে বিয়ে করতে চান, পরিচয়ের পর থেকেই প্রস্তাব দিচ্ছেন, আংটিও কিনেছেন, বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছেন।
আমি তার মুখের দিকে তাকাই, কিছু বলি না।
তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমার রূপের খুব প্রশংসা করছেন, বাহু গাল ঠোঁটও বাদ দিচ্ছেন না, দ্রতা করে হয়তো বুকটাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, খুব শুতে চেয়েছিলেন, আমি রাজি হই নি; এখন বিয়ে করেই শুতে চান।
আমি বলি, প্রেম ও ধর্ম দুটিই কাজে লাগাতে চান, যেটিতে কাজ হয়। আমাদের আমলারা বেশ নীতিপরায়ণ পরহেজগার মানুষ, এখনো বিয়েশাদিতে তারা বিশ্বাস হারান নি।
তিনি বলেন, দ্রলোকের বউ অতিরিক্ত সচিবের সাথে পালিয়েছে কয়েক মাস আগে। শোকেদুঃখেঅপমানে কাতর হয়ে আছেন, আমাকে বিছানায় তুলে শোকদুঃখঅপমান ভুলতে চান।
আমি বলি, তার কোনো উপসচিব নেই?
তিনি বলেন, তা আমি জানতে চাই নি। আমি তাঁকে একটি অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলাম, চারপাশে মেয়েগুলো বিয়ে করতে না পেরে শুকিয়ে মরছে, এমএ পাশ মেয়েগুলো রিয়াদের ঝাড়ুদার বিয়ে করছে, কিন্তু তিনি অবিবাহিত মেয়ে। বিয়ে করতে চান না, বিধবা বিয়েও করতে চান না, কারো বউ ভাগিয়ে বিয়ে করতে চান মনে হয়।
আমি বলি, কারো বউ ভাগিয়ে বিয়ে করায় গৌরব আছে, আর তাতে দ্রুত পদোন্নতি হয়।
তিনি বলেন, আমার একটি স্বামী আছে, একটি উপপতি আছে, আমি কেনো তাঁকে বিয়ে করতে যাবো। আমি আমার ধরনে সৎ থাকতে চাই।
মাহমুদা রহমান তার বাচ্চাদের ইস্কুল থেকে আনতে যাবেন, তার শুধু প্রেম করলে চলে না, শুধু নিজের শরীরের কথা ভাবলে চলে না, শরীরের ভেতর থেকে যাদের বের করেছেন তাদের কথাও ভাবতে হয়। আমার এসব ভাবতে হয় না, ফিরোজা ভাবছে। এসব। ফিরোজা যদি এখন নৃতাত্ত্বিকটির সাথে থাকে, সেও এখন উঠছে, তার পক্ষেও আর নৃতত্ত্ব চর্চা সম্ভব হচ্ছে না, শরীরের ভেতর থেকে যাকে বের করেছে তার কথা ভাবতে হচ্ছে। ফিরোজও নিজের ধরনে সৎ থাকছে; কিন্তু আমি কি সৎ থাকছি আমার নিজের ধরনে? সততা কাকে বলে আমি বুঝতে পারছি না, কারো প্রতি একনিষ্ঠ থাকাই কি সততা? দুজনের প্রতি একনিষ্ঠ থাকা সততা নয়? তিনজনের প্রতি একনিষ্ঠ থাকা। সততা নয়? আমি বুঝি না। আমি ব্রিজের দিকে বেরিয়ে যাই, ব্রিজ দেখি, নদী দেখি; বিকেলে অফিস শেষ হওয়ার একটু আগে অফিসে ফিরি, দেখি আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী খুব উদ্বেগের মধ্যে আছে, আমাকে দেখে সে আলোকিত হয়ে ওঠে। বেশি দিন হয় নি সে আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী হয়েছে, ভালো করে দেখিও নি, আজ দেখে মনে হয় সে একটা ছোটোখাটো আগুন লাগাতে পারে, আমাকে ঘিরেও তা লাগতে পারে। তার এ-জ্বলে ওঠার মধ্যেই আমি একটা বিপথে ছুটে যাওয়া আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাই।
সে বলে, স্যার, যা উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম; কোথায় গেলেন কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।
মেয়েটি উদ্বেগ উচ্চারণ করতে পারে, অর্থ বোঝে! তার কথা শুনে আমার বেশ। ভালোই লাগে, তার কণ্ঠস্বরে একটা কবুতরের ওড়ার আর পাখা ঝাঁপটানোর শব্দ আছে, আমার ভালো লাগে, তবে আমার জন্যে উদ্বেগবোধের অধিকার তাকে এতো তাড়াতাড়ি কী করে দিই।
আমি বলি, উদ্বেগবোধ কি আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? আমাকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকার জন্যে সম্ভবত আপনাকে নিয়োগ করা হয় নি।
মেয়েটি নিষ্প্রভ হয়ে যায়, মাথা নিচু করে থাকে; বলে, আমার ভুল হয়ে গেছে, স্যার।
আমার আবার ভালো লাগে, অনেক দিন ধরে আমার সাথে কেউ বিনয়ের সাথে কথা বলে নি, তোষামোদের ভঙ্গিতে অনেকেই বলে, আমি মেয়েটির কণ্ঠস্বরে একটা ভীত দোয়েলের গলা শুনতে পাই, ডালিমগাছের ডাল থেকে এইমাত্র একটা দোয়েল। উড়ে গেলো। কিন্তু মেয়েটিকে এতোটা অপ্রস্তুত করে দেয়া ঠিক হয় নি, রাতে হয়তো ঘুমোতে পারবে না; বিবাহিত হলে বা বয়ফ্রেন্ড থাকলে আজ কিছু করতে পারবে না। আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা হয়ে যাবে, কোনো দিন যদি আমাকে চুমোও খায় তাহলেও এটা তার ওপর ছায়া ফেলবে। ঠিক আছে ছায়া ফেলুক, আমি না হয় কারো। কারো ঠোঁটের ওপর রাহুর ছায়াই হয়ে থাকবো।
আমি তাকে বলি, ঠিক আছে, আর তো উদ্বেগের কারণ নেই আপনার, আমি এসে গেছি, অফিসও ছুটি হয়ে গেছে, আপনি বাড়ি যান।
মেয়েটি বেরিয়ে যায়, তার বেরিয়ে যাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে।
অর্চির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, ফোন করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভয় লাগছে; অর্চি কি খুশি হবে আমার ফোন পেয়ে?
অর্চি হয়তো আমার গলা চেনে না, ফোনে ওর সাথে কথাই হয় না, আমার গলা ও নাও চিনতে পারে।
অর্চি, আমি বলি, অর্চি, আমি আব্বু।
অর্চি বলে, আব্ব? তুমি? এ-সময়? গম্ভীর হতাশা আর বিরক্তির স্বর ভেসে আসতে থাকে মহাজগতের দশ দিক থেকে।
তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো, আমি বলি, অনেক দিন কথা বলি নি।
অর্চি বলে, আহ, আব্ব, তোমার সাথে কথা বলার মতো সময় আমার আছে, বলো! আমি ভাবলাম কোনো বন্ধু ফোন করেছে।
আমি বলি, তুমি কী নিয়ে এতো ব্যস্ত, অর্চি?
অর্চি বলে, তুমি বুঝবে না আব্ব, আর আমার অকাজে কথাই বলতে ইচ্ছে করে না, আমার ঘেন্না লাগে।
আমি বলি, বন্ধুদের সাথে তুমি কি শুধু কাজের কথাই বলো?
অর্চি বলে, কাজের কথাই বলি, আমি প্রেমট্রেমের কথা বলি না আব্ব, আমরা। কয়েক বন্ধু স্টেটসে চলে যাবো, নানা জায়গায় চিঠি লিখছি সে-কথাই বলি।
আমি বলি, আমাকে তো কখনো বলে নি।
অর্চি বলে, বলার কিছুই নেই, যখন যাবো তখন বলবো ভেবেছিলাম, তবে আজ তোমাকে বলে ফেললাম।
আমি বলি, ফেইভরেবল চিঠিপত্র কি পাচ্ছো?
অর্চি বলে, বেশ তো পাচ্ছি, শুধু মাধ্যমিকটার জন্যেই কিছু করতে পারছি না; পরীক্ষাটা হয়ে গেলে বাঁচি।
আমি বলি, তুমি তাহলে চলে যাবে?
অর্চি বলে, আলু, তুমি এখনি কাঁদতে শুরু কোরো না। আমি আজই যাচ্ছি না।
আমি কথা বলতে চাই, অর্চি বলে, রাখি, আলু, রাখি। অর্চি টেলিফোন রেখে দেয়।
আমি একটা শূন্যতা বোধ করি। এমন নয় অর্চিকে আমি প্রতিদিন বুকে জড়িয়ে ধরি, আদর করে কপালে চুমো খাই, ঘুম পাড়াই; এমন নয় ও আমার কন্যা বলে। আমি একটা গুরুগম্ভীর পিতৃত্বের বোধের মধ্যে থাকি, আমি যে ওর পিতা আমার মনেই থাকে না, কিন্তু ও হয়তো আমার ভেতরে কোথাও রয়েছে, আর থাকবে না। আমি ওর ভেতরে নেই, ফিরোজাও ওর ভেতরে নেই, কেউ ওর ভেতরে নেই। অর্চি কেন্দ্রে আছে। আরো কেন্দ্রে চলে যেতে চায়, চলে যাবে; আমি বাধা দিতে পারবো না। কিন্তু আমার শূন্যতা আমাকে বইতে হবে, কেউ জানবে না আমি পাথরের থেকেও ভারী একটি শূন্যতা বয়ে চলছি।
ফিরোজা বেশ চাঞ্চল্যের মধ্যে আছে, এত চাঞ্চল্যে আছে যে আমার সাথেও সারাক্ষণ কথা বলতে চায়, এমন সব কথা যা আগে কখনো বলে নি, কিন্তু এখন বলার জন্যে ব্যর্থ। কোথা থেকে উৎসারিত হচ্ছে ফিরোজার ঝরনাধারা? আমি তার উৎস নই, আমি তাকে ঝিরঝির কলকল করে বহাচ্ছি না, আমি তাকে বাতাসে পালকের মতো। ওড়াচ্ছি না, কিন্তু ফিরোজা বইছে উড়ছে।
আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আছি, প্রাণভরে একগাদা ন্যাংটো মেয়ে দেখছি, কতোটা ন্যাংটো হতে পারে দেখছি, শিল্পকলা কতোটা ন্যাংটো হতে পারে দেখছি, ন্যাংটো কতোটা শিল্পকলা হতে পারে দেখছি; ন্যাংটো, শিল্পকলা, মেয়ে দেখছি; শিল্পকলা, মেয়ে, ন্যাংটো দেখছি; মেয়ে, ন্যাংটো, শিল্পকলা দেখছি, আমি দেখছি ন্যাংটো ন্যাংটো ন্যাংটো, আমি দেখছি শিল্পকলা শিল্পকলা শিল্পকলা, আমি দেখছি মেয়ে মেয়ে মেয়ে; ফিরোজা তখন এসে পাশে বসে।
এসব দেখতেই তোমার ভালো লাগে, ফিরোজা বলে। আমাকে একটা বড়ো অপবাদ দেয়ার জন্যে কথাটি বলে নি, আমি বুঝি, একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় বেছে নিয়েই সে কথা শুরু করতে চেয়েছে।
আমার সময় চায় আমি এসব দেখি, আমি বলি, আমার সময় চায় আমি এসবের মর্ম উপলব্ধি করি, আমি আমার সময়ের দাবি পূরণ করছি।
ফিরোজা বিব্রত হয়, এসব নিয়ে আর তর্ক করতে চায় না; এক্সএক্সএক্স সেও উপভোগ করে মাঝেমাঝে, এখন সে অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতে চায়।
সেদিন তুমি অদ্ভুত আচরণ করেছে, ফিরোজা অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে বলে, আমার মনে হচ্ছিলো তুমি…। ফিরোজা আর এগোয় না।
আমি বলি, তোমার কী মনে হচ্ছিলো?
ফিরোজা বলে, তুমি আমাকে রেইপ করছে।
আমি বলি, তাহলে তোমার উচিত ছিলো চিৎকার করে ওঠা, যাতে পাশের বাড়ির সবাই জেগে উঠে তোমাকে রক্ষা করতে আসতে পারতো, তোমার কর্তব্য ছিলো আমার মুখে নখ বসিয়ে দেয়া; প্রমাণ থাকতো।
ফিরোজা বলে, কিন্তু তুমি আমাকে পীড়ন করতে চেয়েছিলো তাতে সন্দেহ নেই।
আমি বলি, কিন্তু তুমি পীড়ন উপভোগ করলে কেনো?
ফিরোজা বলে, মনে হলো প্রতিরোধ করতে যেহেতু পারবো না তখন উপভোগ করাই ভালো।
আমি বলি, সত্যিই কি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে পীড়ন করতে চেয়েছিলাম?
ফিরোজা বলে, হ্যাঁ, আমি আজো ঠিক মতো হাঁটতে পারি না।
আমি বলি, আমি দুঃখিত, সচেতনভাবে আমি অমন কিছু করতে চাই নি।
ফিরোজা বলে, তাহলে অসচেতনভাবে করতে চেয়েছিলে।
আমি বলি, হয়তো তা হবে, তার জন্যেও আমি দুঃখিত।
ফিরোজা বলে, আমার ভয় হয় অসচেতনভাবে তুমি কোনো দিন আমাকে কিছু একটা করে ফেলতে পারো।
আমি বলি, তুমি কি খুন বোঝাচ্ছো?
ফিরোজা বলে, হ্যাঁ, ও রকমই কিছু একটা।
আমি বলি, আমি কি এতটা ভয়ঙ্কর মানুষ?
ফিরোজা বলে, আমার মনে হয় এরপর সাবধান হতে হবে, খুন না করলেও আমাকে তুমি বিকলাঙ্গ করে দিতে পারো।
আমি বলি, তুমি কি এখন বিকলাঙ্গ বোধ করছো?
ফিরোজা কোনো কথা বলে না, হয়তো সে সত্যিই বিকলাঙ্গ বোধ করছে; আমি তার কোনো খবর নিই নি, দরকার পড়ে নি, ফিরোজার হয়তো দরকার পড়েছে। ফিরোজা কি তার অঙ্গ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে এর মাঝে, এবং ব্যর্থ হয়েছে। বিকলাঙ্গতার জন্যে কি তার দুটি তিনটি লাল লাল বিকেল অপচয় হয়ে গেছে, যার চম কার ব্যবহার তারা চেয়েছিলো? নৃতাত্ত্বিকটিকে মনে পড়ে আমার। আমি কিছুটা তাপ বোধ করি।
আমি বলি, তুমি কি পরখ করে দেখেছো কোথাও?
ফিরোজা উত্তেজিত হয়ে বলে, সবাইকে নিজের মতো মনে কোরো না।
ফিরোজা এখন নিজেকে দেবী আর আমাকে পিশাচ ভাবছে; শুধু ভাবছে না নিজেকে দেবীর সিংহাসনে বসাচ্ছে, আমাকে নামিয়ে দিচ্ছে পিশাচপাতালে; সে আমার মতো নয়, সে পবিত্র, তার শরীর পবিত্র, আমিই শুধু অপবিত্র, পিশাচের শরীর আমার। আমি কি বলবো যে ধানমণ্ডির আটনম্বর সড়কে সেদিন সন্ধ্যায় তাকে আমি দেখেছি, একটা। পাঁচতলা বাড়ির দরোজা দিয়ে তার গাড়ি বেরিয়ে এলো, আমি দেখলাম? বলবো কি আমি গাড়ির পেছনে ছুটতে পারতাম, কিন্তু আমি ছুটি নি? বলতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু ফিরোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আমি নিশ্ৰুপ হয়ে গেছি, আমি। পরাজিত হয়ে গেছি তার দেবীত্বের কাছে, সে তা উপভোগ করছে। কিন্তু দেবীটেবী দেখতে আমার ভালো লাগছে না।
তুমি মাঝেমাঝে ধানমণ্ডির আটনম্বর সড়কের একটি পাঁচতলা বাড়িতে যাও? আমি বলি।
ফিরোজা চমকে ওঠে, কোনো কথা বলে না।
আমি বলি, কোনো কথা বলছে না যে?
ফিরোজা বলে, যাই, কিন্তু আমি তোমার মতো নই; কাউকে দেহ দিতে আমি সেখানে যাই না।
আমি বলি, আমার মতো তুমি নও, তা জানি; আর তুমি সেখানে কাউকে দেহ দিতে যেতে না পারো, তবে কেউ তো তোমাকে দেহ দিতে পারে।
ফিরোজা কোনো কথা বলে না। ফিরোজা আমার থেকে শুদ্ধ, সব সময়ই; সে দেহ দেয় না, দেহকে সে অপূর্ব রীতিতে শুদ্ধ রাখে, পুরুষের সভ্যতা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে; দেহ দিলেও সে অশুদ্ধ হবে না, দেহ সামান্য বস্তু, অসামান্য হচ্ছে মন হৃদয় আত্মা, সেগুলো সে দেবে না, পবিত্র রাখবে, আমার সে-শক্তি নেই, আমি পারি শুধু। অশুদ্ধ হতে। এ-মুহূর্তে আমাদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়ে যেতে পারতো, ওসব আমার ভালো লাগে না; আমি ফিরোজার দেহ নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, দেহে আমি পবিত্রতা অপবিত্রতা কিছুই দেখি না, দেহ হচ্ছে দেহ, যা বিষাক্ত হতে পারে, মধুর হতে পারে, কঠিন হতে। পারে, গলতে পারে। দেহ আমার চোখে সুন্দর, আকর্ষণীর বস্তু, যদিও এখন ঘেন্নার বোধ জাগাচ্ছে আমার, তবু দেহের থেকে সুন্দর কিছু আমি দেখি নি। এ-দেহ শুধু মানুষের নয়, সব কিছুরই; বেড়ালের দেহের দিকে আমি সারা সকালবেলা তাকিয়ে থাকতে পারি, যেমন পারি ইঁদুরছানার দেহের দিকে তাকিয়ে থাকতে; ছেলেবেলায় আমি আমাদের শাদা গাভীটির দেহের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, ঘুরতে ঘুরতে যে-ষাড়টি আমাদের গোয়ালের পাশে এসে হাঁক দিত, তার দেহের সৌন্দর্য তো অবর্ণনীয়। আমার যদি অমন একটি দেহ থাকতো, অমন অণ্ড অমন অজগর। মানুষের শরীর আমার চোখে সুন্দর, সবেচেয়ে সুন্দর নারীশরীর। আমি ওই সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হয়েছি, চিরকাল মুগ্ধ হবো; ওই শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি সৌন্দর্য বুঝেছি; ওই। শরীর ছোঁয়ার সাথে সাথেই আমি ভালোবাসতে পেরেছি, চিরকাল পিরবো; ওই অপূর্ব বস্তুকে ভালোবাসার জন্যে কোনো পূর্বভালোবাসার দরকার আমার কখনো পড়ে নি। আমি যাকে ঘেন্না করি, তার দেহকেও তীব্রভাবে ভালোবাসতে পারি; যেমন ফিরোজাকে আমার ঘেন্না লাগছে, কিন্তু তার দেহকে ঘেন্না লাগছে না; যদি ওই দেহের সাথে আজ রাতে আমি জড়িয়ে পড়ি, পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে আমি তার প্রতিটি খণ্ডকে ভালোবাসতে পারবো। শরীরই আমার কাছে স্বর্গ আর নরক, আমি অবশ্য স্বর্গেটর্গে বিশ্বাস করি না; তবে শরীর আমাকে স্বর্গের অভিজ্ঞতা দিয়েছে, নরকের অভিজ্ঞতা দিয়েছে; শরীর আমাকে বেঁচে থাকার অমৃত দিয়েছে মৃত্যুর বিষও পান করিয়েছে। আর আমি শরীরের সীমাবদ্ধতায় সব সময়ই পীড়িত বোধ করেছি; আমি যতোটা উপলব্ধি। করতে চাই, আমি দেখেছি আমার শরীরের, আমার ইন্দ্রিয়গুলোর সে-শক্তি নেই; আমার শরীর আমার ইন্দ্রিয়গুলো খুবই সীমাবদ্ধ। আমার ওষ্ঠ একটি নির্দিষ্ট সীমার পর আর কাজ করে না, আর অনুভব করে না; আমি যখন ওষ্ঠ দিয়ে চরমতমকে উপলব্ধি করতে চাই, তখন ওষ্ঠ নির্বোধ ত্বকমাংসের সমষ্টি থেকে যায়; আমি যখন গভীর থেকে গভীর থেকে গভীরতমে পৌঁছে ভেঙে যেতে চাই ফেটে পড়তে চাই পরমতমকে ছুঁতে চাই, তখন আমি সীমাবদ্ধ একটি মাংসের ফলক রয়ে যাই। শরীর শরীর চায়, এবং একটি শরীর শুধু আরেকটি শরীর নিয়েই চিরকাল সজীব থাকতে পারে না, তার সীমাবদ্ধতা আরো বাড়তে থাকে; ওই অবস্থায় মরে যেতে থাকে, আর বেঁচে থাকার জন্যে ভিন্ন শরীরের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফিরোজা ভিন্ন শরীর চায়, যদিও সে স্বীকার করছে না; আমার শরীরের থেকে নৃতাত্ত্বিকটির শরীর তার শরীরকে বেশি: আলোড়িত করছে এখন; যেমন ফিরোজার শরীরের থেকে দেবীর আর মাহমুদা রহমানের শরীর আমার শরীরকে বেশি আলোড়িত করে। শরীর পুরোনো হয়ে যায়, তা নতুন হয়ে উঠতে পারে নতুন শরীরের স্পর্শে; তা আমার ফিরোজার মাহমুদার দেবীর ও অন্য সবার জন্যেই সত্য, কারো জন্যেই মিথ্যে নয়। সমাজ চায় শরীর পুরোনো হয়ে যাক, তার সজীবতা লুপ্ত হয়ে যাক, কিন্তু শরীর তা চায় না।
কয়েক দিন ধরে ভোরে ঘুম ভাঙছে আমার, ভোর হওয়ার অনেক আগেই চোখের ওপর একটা স্বপ্নের মতো কী যেনো টের পাচ্ছি, খুব হাল্কা লাগছে, অনেকক্ষণ ধরে। একটা সুখের মধ্যে পড়ে থাকছি। পাশের বিছানায় ফিরোজার কেমন লাগছে, আমি জানি না; সেও তার বিভোরতার মধ্যে থাকতে পারে, সেটা তার ব্যক্তিগত; আমার ব্যক্তিগত বোধ এক হাল্কা আচ্ছন্নতার। রওশনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সময় এমন হয়েছিলো, এখন তেমনি হচ্ছে, মাঝেমাঝে মনে রাখতে পারছি না আমি কোথায় শুয়ে আছি, ঢাকা শহরে না গ্রামে, আমার বয়স কতত, পনেরো না পঁয়তাল্লিশ, আমি মনে রাখতে পারছি না; বেশ কিছুটা সময় ভাবার পর আমি আমার বাস্তবতা স্থির করতে পারছি। হয়তো শরীরের বয়স বাড়ে, মনের বয়স বাড়ে না, অন্তত ভোরগুলোতে আমার তা-ই মনে হচ্ছে। বেশ একটা ভার আমি বোধ করছিলাম কয়েক মাস ধরে, ওই ভারটা কেটে গেছে; ফিরোজার সাথে আমার ভারী সম্পর্কটির কথাও মনে থাকছে না। আমি আরো সজীব হয়ে উঠছি, নতুন মাটিতে একটি নতুন কলাগাছের চারা মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি এতো দিন বুঝতে পারি নি যে আমি বয়স্কদের দলে পড়ে গেছি, আমি যাদের সাথে জীবন যাপন করছি, ঘুমোচ্ছ, তাঁদের চমৎকার শরীর আর মুখাবয়ব থাকলেও তাঁরা বয়স্ক; তাঁদের জগত ভিন্ন তরুণ জগত থেকে। আমার গাড়ির সামনেই ঘটনাটি ঘটে, তরুণীটির রিকশা উল্টে পড়ে বেবিট্যাক্সির ধাক্কায়; তরুণীটি নিচে পড়ে যায়, তার ভাগ্য ভালো পেছনের গাড়িগুলো থামে, কিন্তু কেউ তাকে টেনে তোলার সাহস করে না; মৃত্যুর থেকে নৈতিকতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে সম্ভবত মনে হয় তাদের। আমি লাফিয়ে নামি গাড়ি থেকে, রিকশা সরিয়ে তরুণীটিকে দু-হাতে জড়িয়ে দাঁড় করাই; একটু ভয় ছিলো আমার স্পর্শে তার সতীত্ব ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে সে ক্ষেপে উঠতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেপে না, ভয় পেয়ে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে; আমি তার শক্ত জড়ানোর কোমলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই, সে হাসপাতালে যেতে চায় না; তার বেশি কিছু হয় নি, সে বাড়ি যেতে চায়। গাড়িতে উঠে সে আমার থেকে একটু দূরে সরে বসে, কিন্তু আমার মনে হতে থাকে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তাকে আমার ভালো লাগে;–সে সুন্দর, সজীব, তরুণ, সপ্রতিভ; এবং ভেতরে তার একটি সুন্দর শরীর রয়েছে।
আমার নাম অনন্যা, অনন্যা আহমেদ, সে বলে, আপনাকে কি আমি ধন্যবাদ জানাবো?–আমি বুঝতে পারছি না।
আমি বলি, না, না, এখন ধন্যবাদের দরকার নেই; পরে কখনো জানাবেন।
সে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একজোড়া চোখ মেলে বলে, অদ্ভুত লাগছে আপনার কথা, অদ্ভুত লাগছে আমার।
আমি বলি, অদ্ভুত লাগছে কেনো?
সে বলে, আপনি এখন ধন্যবাদ চাচ্ছেন না, কিন্তু পরে কখনো চাচ্ছেন।
আমি বলি, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরই ধন্যবাদ জানানো ভালো।
সে বলে, কিন্তু আপনার সাথে আর নাও তো দেখা হতে পারে।
আমি বলি, হবে।
সে বলে, আপনি এতো নিশ্চিত কেনো?
আমি বলি, আমি কখনো কখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারি।
আমার এভাবে কথা বলা উচিত হয় নি; আমি বয়স্ক মানুষ, পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি এসে গেছি, তার আব্বা আমার পরিচয় পেলে হয়তো সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়াতে, আঠারো বছর বয়সে যদি আমি সংসার শুরু করতাম তরুণী আমার কন্যাও হতে পারতো, আমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি। তাকে নামিয়ে দিয়ে এসে আমার বারবার মনে হতে থাকে আমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয় নি; নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ দেখানো উচিত ছিলো আমার, এমনভাবে কথা বলা উচিত ছিলো যাতে গাড়ি থেকে নামার সময় সে আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতো। আমি কেনো গম্ভীর হতে পারি নি, কেনো আমি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারি নি? আমার কি ইচ্ছে হচ্ছিলো ওই তরুণীর সহপাঠী হওয়ার? আমি তাকে আমার কার্ড দেয়ার পর সে প্রায় কোলাহলের মতো ঝলমল করে উঠেছিলো, বলছিলো সে বুঝতে পারছে না আমি কতো বড়ো, সব দিকেই, যদিও আমাকে দেখে তার অমন বড়ো কিছু মনে হয় নি। অনেক দিন পর আমি কোনো তরুণের পাশে অর্থাৎ তরুণীর পাশে বসেছি বলেই কি আমার অমন হয়েছে? কার। পাশে বসছি, তার একটা চাপ পড়ে আমাদের ওপর; কয়েক বছর আগে আমি একটি বুড়োর সাথে বসে ব্রিজের পর ব্রিজ পরিকল্পনা করেছি, এক দিন আমি টের পাই। বুড়োটি ব্রিজের থেকে বেশি পছন্দ করে আমার সঙ্গ, আমার সঙ্গ তাকে শীত থেকে তুলে আনে, সে আমার তাপ শোষণ করে, তখন আমি তার সঙ্গ ছেড়ে দিই। বুড়োটি তারপর আর বেশি দিন বাঁচে নি। না, আমি তরুণীর শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি নি, ওই মুহূর্তেই আমার মনে তার শরীর ভোগের কোনো পরিকল্পনা জেগে ওঠে নি; বরং উল্টোটিই ঘটে, ওই প্রথম আমি কোনো নারীর পাশে বসি, কিন্তু আমার ভেতর কেনো ক্ষুধা দেখা দেয় না। অনন্যাকে কি আমি নারী মনে করি নি, অবচেতনায় তাকে কি। আমি অর্চিই মনে করেছি, মনে করেছি সে আমার কন্যাই? তাও মনে হয় না, কোনো সম্পর্ককেই আমি জৈবিক আত্মীয়তার সম্পর্কে দেখতে পছন্দ করি না, এবং দেখি না; আমার কোনো কোনো বন্ধু একেকটি ব্রিজ বানিয়ে বলেন এটা তাঁর সন্তান, খুব সুখ পান ব্রিজকে সন্তান মনে করে, তার ঔরস কোনো বিশাল নারীর গর্ভে জন্ম দিয়েছে সন্তান, যদিও ব্রিজ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা শিশ্ন ও যোনিকে, যাদের কখনো মিলন ঘটবে না; জৈবিকভাবে তারা জড়িয়ে পড়েন তাঁদের সৃষ্ট বস্তুর সাথে, আমি তা করি না। জৈবিক সম্পর্ক থেকে আমি অনেক দূরে সরে গেছি, বংশানুক্রম আমার কাছে মূল্যবান নয়। আমি ওই তরুণীকে নারীই মনে করেছি, কন্যা মনে করি নি, তবে তার দেহ আমার মাংসে কোনো ভোগপিপাসা জাগায় নি, যদিও তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
তারপর মনে হতে থাকে আমি যে গুরুত্বপূর্ণ হতে চাই নি অনন্যার কাছে, নিজেকে গুরুগম্ভীর আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেখাতে চাই নি দেশের একটি বড়ো নির্মাণ। লিমিটেডের, ভালোই করেছি; আমি চল্লিশোত্তরতার ভার অনেকটা কমাতে পেরেছি, অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছি। এজন্যেই আমার খুব ভোরে ঘুম ভাঙছে, ঘুম ভাঙার সময় বুঝতে পারছি না আমি কোথায়, কোনো গ্রামে না শহরে না কোথায়, বুঝতে পারছি না। আমি কে, কোনো কিশোর না যুবক না বৃদ্ধ, এটা আমাকে সুখ দিচ্ছে। পর দিনই অনন্যা টেলিফোন করেছে; এটা অন্য এক জগতের টেলিফোন, তার কণ্ঠস্বর ভিন্ন, অভিধান আর বাক্য ভিন্ন, যার সাথে খাপ খাওয়াতে আমার বেশ কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমি বিস্মিত হয়েছি যে শুধু আমারই বয়স বাড়ে নি, আমার ভাষারও বয়স বেড়েছে, আমার মতো আমার ভাষারও বয়স কমাতে হবে, যদি আমি অন্য জগতের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তাকে টেলিফোন করি নি, আমার সাহস হয় নি; বয়স হলে নানা রকম ভয় দেখা দেয়, আমারও তাই হয়েছে; কিন্তু কম বয়সের দারুণ দুঃসাহস রয়েছে, অনন্যা পরপর চারদিন ধরে টেলিফোন করছে, আমি অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছি। আমি আজকাল আটটার মধ্যেই অফিসে পৌঁছে যাচ্ছি, আটটা দশের মধ্যেই তার টেলিফোন বেজে উঠছে, পনেরো মিনিটের মতো কথা বলছি আমরা; এর মধ্যে সে আমার সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে গেছে, আমি শুধু একটি বৃত্তান্তই জেনেছি সে এক কলেজে এক বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছে। টেলিফোনে আমরা কী কথা বলতে পারি? অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা, ছেলেমেয়ের অসুখ, খুনজখম, আধুনিক সাহিত্য, সমান্তরাল সিনেমা, ধর্ষণ, ব্ল্যাক হোল, মেয়েমানুষের মন্ত্রীত্ব, পুরুষের পুঙ্গবতা? না কি কাতর কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা মেঘলা পানি পানি পচে-যাওয়া শবরি কলা ধরনের কথা? আমাদের দুজনেরই মনে হয় বিষণ্ণ। হওয়ার, টেলিফোনে, সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে লঘু পরিহাসে ভেসে যাওয়া। আমি তার সমাজসংসার বংশ পিতামাতা সম্পর্কে কিছুই জানতে চাই নি, ওগুলোতে আমার কোনো আগ্রহ নেই; এবং আমি জানতে চাই নি সে বিবাহিত কিনা। এতে সে বিস্মিত হয়েছে; তার সাথে দেখা হওয়ার পরই নাকি লোকেরা তার যে-সংবাদটি জানতে চায়, যে-সংবাদটি না জানলে তাদের কিছুই জানা হয় না বলে মনে হয়, তা হচ্ছে সে বিবাহিত কিনা। আমি যে ইচ্ছে করে ওই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছি, এমন নয়, আমার মনেই পড়ে নি; মানুষের যে একটি বিবাহগত গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি থাকে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তা আমার মনে পড়ে নি।
একদিন অনন্যা হেসে বলে-বিষণ্ণ হওয়ার এটা তার প্রিয় পদ্ধতি, আপনি কিন্তু আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি জানতে চান নি, দেখা হলেই যা সবাই জানতে চায়।
আমি বলি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ? আমি বুঝতে পারছি না, সেটা কী?
অনন্যা বলে, আমার বিয়ে হয়েছে কি না? না হলে কেননা হচ্ছে না?
আমি বলি, এটাই সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ সংবাদ?
অনন্যা বলে, হ্যাঁ, মেয়েদের সম্পর্কে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
আমি বলি, যে-পদার্থবিজ্ঞান পড়ায় তার সম্পর্কেও এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ?–অনন্যা বলে, মেয়েদের বেলা পদার্থবিজ্ঞানে আর গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে কিছু আসে। যায় না, আসে যায় বিবাহে ও অবিবাহে।
আমি বলি, তুমি কী উত্তর দাও?
অনন্যা বলে, আপনি কি আজই আমার উত্তরটি শুনতে চান?
আমি বলি, যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।
অনন্যা হাসে, এবং বলে, আগে বলতাম বিয়ে করবো না-বলা উচিত ছিলো বসবো না; তাতে ঝামেলা বেড়ে যেতো, কেনো বিয়ে করবো না অর্থাৎ বসবো না তা সবাইকে। বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে হতো।
আমি বলি, এখন কী বলে?
অনন্যা বলে, এখন বলি পাত্র পাচ্ছি না। আর অমনি নতুন ঝামেলা বেঁধে যায়, কেউ সেনাবাহিনী থেকে মেজর, কেউ হাইকোর্ট থেকে বিপত্নীক বিচারপতি ব্যারিস্টার নিয়ে আসে; কলেজের আয়ারাও পাত্র নিয়ে আসতে থাকে, মধ্যপ্রাচ্যে ইলেক্ট্রিশিয়ান।
আমি বলি, চমৎকার পাত্র, এবং একটু থেমে বলি, উচ্চরক্তচাপসম্পন্ন হৃদরোগসমৃদ্ধ দু-একটি কি আমিও নিয়ে আসবো?
অনন্যা বলে, ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ; সে হাসে, আমি কান পেতে শুনি, এবং বলে, ইউনিভার্সিটিতে আমার তিনচারটি বন্ধু ছিলো, ওদের সাথে আমি কার্জন হলের ঝোঁপের পাশে বসতাম, ওরা গাঁজা খেতো, আমি পড়তাম।
আমি বলি, পড়তে কেনো, গাঁজা খেতে পারতে।
অনন্যা বলে, আমি খেতে চাইতাম, ওরা দিতো না। বলতো মেয়েমানুষের গাঁজা খাওয়া ঠিক না। কল্কেটা পুরুষের। ওরা প্রত্যেকেই মনে করতো একদিন আমি তাকে নিয়ে সংসার করবো, স্ত্রী গাঁজা খাবে এটা ওদের ভালো লাগতো না বোধ হয়।
আমি বলি, শত হলেও তারা সমাজপতি পুরুষমানুষ।
অনন্যা বলে, পাশ করার পর ওরা আমাকে বলতো তুই আমাদের কাউকে বিয়ে কর। আমি বলতাম তোদের চারজনকেই আমার বিয়ে করা উচিত, তোদের। চারজনকেই আমি বিয়ে করতে চাই। ওরা রেগে উঠতো। তখন আমি বলতাম আমি বিয়ে করবো না। ওরা চেপে ধরতো, ক্যান তুই বিয়া করবি না। আমার কোনো কথাই ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। শেষে রেগে বলতো, তোর তো একটা দ্যাহ আছে, তুই দ্যাহের ক্ষুধা মিটাবি কেমনে? আমি বলতাম, কেনো, তোদর মতো ব্রোথেলে গিয়ে। ওরা চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিতো।
আমি হেসে বলি, তাহলে ব্রোথেলেই যাচ্ছো?
অনন্যা হেসে বলে, একবার যেতে চেয়েছিলাম। যে-রিকশাঅলা আমাকে নিয়ে যেতে আসতো, সে একদিন কই যাইবেন আফা বলতেই আমি বলি, বাদামতলির। পাড়ায় যাব, সেখানে চলো। রিকশাঅলা আমার দিকে পাগলের মতো তাকায়, শেষে আমার পায়ে পড়ে বলে, এমন কথা কইবেন না আফা, আপনারে আমি পাড়ায় লইয়া যাইতে পারুম না। তাই আমার আর ব্রোথেলে যাওয়া হয় নি।
আমি বলি, বড়ো দুঃখের কথা।
অনন্যা হাসতে থাকে, আমি তার মুখ দেখতে পাই না, কিন্তু তার হাসি দেখতে পাই; অনেকক্ষণ ধরে আমি তার তরুণ হাসি শুনতে থাকি, দেখতে থাকি, তার হাসির সুগন্ধ গ্রহণ করতে থাকি। যখন আমি অনন্যার সাথে টেলিফোনে কথা বলি তখন সিগারেট খাই না।
একদিন আটটা দশে টেলিফোন বাজে না, আমি একটু উৎকণ্ঠিত হই; ওই মুহূর্তে আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী তাকে নিয়ে আমার কক্ষে ঢোকে। আমি বিব্রত হতে পারতাম, হওয়ারই কথা ছিলো, কিন্তু আমি বিব্রত হই না, আমি হঠাৎ আলোর। ঝলকানি বোধ করি, দাঁড়িয়ে অনন্যাকে অভ্যর্থনা করি। আমি কী করে পারলাম? আমার সহকারিণী অবাক হয় মর্মান্তিকভাবে, একটি তরুণীকে আমি এমন অভ্যর্থনা। করতে পারি, সে কখনো ভাবতে পারে নি; তাই সে সম্ভবত অনন্যাকে কোনো দেশের রাজকন্যা বলে মনে করতে থাকে, তার মাথায় একটা মুকুট খুঁজতে থাকে। সে কোনো মুকুট দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়, কিন্তু আমি মুকুট দেখতে পাই। আমার কক্ষে সাধারণত ঢোকে দর্প অর্থ শক্তি দাস, সৌন্দর্য আর কোমলতা ঢোকে না; এই প্রথম সৌন্দর্য কোমলতার স্যান্ডলের স্পর্শে আমার কক্ষ শিউরে ওঠে, তাঁতের শাড়ির শোভায় বদলে যেতে থাকে। আমার চেয়ারটিতে আমার বসতে ইচ্ছে করে না, ওটাকে কোনো হাবশি বাদশার সিংহাসন বলে মনে হয়, ওটিতে আমি অস্বস্তি বোধ করতে থাকি; মনে হতে থাকে চেয়ারকার্পেটের জগত থেকে অনেক দূরে কোনো ঘাস খড় কাশবন।
ফড়িঙের জগতে যেতে পারলে আমি স্বস্তিতে বসতে পারতাম। সে সুন্দর, সেটা সুন্দরীর থকথকে সৌন্দর্য নয়, তার সৌন্দর্য চারপাশের কদর্যতার উল্লাসকে শান্ত করে আনে, তাকে দেখার পর সব ধরনের বাড়াবাড়িকে মনে হয় হাস্যকর। আমার কেনো যেনো নির্মলতা নিষ্পপতা ব্যাপারগুলো মনে পড়ে, যদিও আমি ঠিক নির্মলতা নিষ্পপতায় বিশ্বাস করি না, ওগুলোকে ভাবালুতাই মনে করি, তবু আমার ওগুলোর কথাই মনে পড়ে। এখন আর কারো ছোঁয়ায় মৃত প্রাণ ফিরে পায় না, কুষ্ঠরোগী সেরে ওঠে না; কিন্তু আমার মনে হতে থাকে সে যদি এখন কোনো মৃতকে ছোঁয়, তবে মৃত প্রাণ ফিরে পাবে; যদি কোনো কুষ্ঠরোগীর দিকে তাকায়, তবে ওই অভিশপ্ত দেবদূতের মতো। কান্তিমান হয়ে উঠবে। আমিও তার করুণা লাভ করি, আমার বয়স কমে যেতে থাকে ওই প্রায়-অপার্থিব উপস্থিতিতে; অপার্থিব বলছি এজন্যে যে তার উপস্থিতি আমার ভেতরে কোনো কামবোধ সৃষ্টি করে না, যদিও অমন কোনো বোধের উন্মেষ ঘটা বেশ স্বাভাবিক ছিলো; যেমন আমার ব্যক্তিগত সহকারিণী তরুণীটি বেশ চমৎকার তরুণী, কোনো বাড়াবাড়ি করে না, কিন্তু সে যততবারই আমার কক্ষে ঢোকে, আমি তার দিকে তাকালেও লঘু একটা কাম বোধ করি।
অনন্যা বলে, আপনি এতো উঁচুতে থাকেন, মাটি ঘাস নদী থেকে এতো ওপরে।
আমি হেসে বলি, পারলে আমি মেঘে থাকতাম।
অনন্যা বলে, কিন্তু সাততলায় উঠতেই আমার মাথা ঘোরাচ্ছে, লিফট আমি ভীষণ ভয় পাই, মেঘে থাকলে আপনার সাথে আর দেখা হতো না।
আমি বলি, তখন তোমার দুটি ডানা থাকতো, কোনো কষ্ট হতো না। ডানার কথায় সে বেশ প্রফুল্ল বোধ করে, এবং আমি আরো বলি, সাত কি সতেরো তলায় থাকার একটি সম্ভাব্য উপকারিতা আছে।
সে জানতে চায়, উপকারিতাটি কী?
আমি বলি, প্রয়োজনের মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে দ্রুত সমাধানে পৌঁছা যায়।
সে ভয় পায়, আঁতকে উঠে বলে, আপনার লাফিয়ে পড়ার প্রবণতা আছে না কি?
আমি বলি, কততবার আমি লাফিয়ে পড়েছি।
সে ভয় পায়, আর আমি তার চোখেমুখে বিস্ময় ছড়ানো দেখতে পাই; এতো বিস্মিত হয়েছে যে ভয় পেয়ে যাচ্ছে, যেনো এই সব আসবাবপত্র টেলিফোনদঙ্গল শীততাপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র পিসি জিসি টিসি তাকে গ্রাস করার জন্যে এগিয়ে আসছে।
অনন্যা বলে, আমার ভয় লাগছে।
আমি জানতে চাই, কেনো?
অনন্যা বলে, আমি কখনো এতো কিছু দেখি নি, এতো ঝকমকে কিছু দেখি নি। আমি একা হলে ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম। আপনি ভয় পান না?
আমি বলি, এগুলো না থাকলেই আমি ভয় পেতাম, এগুলোই আমাকে সাহস দেয়, বারবার বলে ভয় পেয়ো না তোমার পেছনে আমরা সবাই আছি।
অনন্যা বলে, কিন্তু আপনার এখানে যে আমার আর আসার সাহস হবে না, এসবের কথা মনে হলেই আমার মাথা ঘোরাবে। আপনাকে আমি আর দেখতে পাবো না।
আমি বলি, তুমি তো পদার্থবিজ্ঞান পড়াও।
অনন্যা বলে, কিন্তু এসব পদার্থকে আমি ভয় পাই। আমার বোধ হয় উচিত ছিলো গ্রামে খালের পারে একটি কুঁড়েঘরে থাকা, মরিচ আর লাউ বোনা, একটি ছাগল। পোষা। অনন্যা নিঃশব্দে হাসতে থাকে।
কোনো নারীর মুখোমুখি হলে আমি প্রথমেই একটি জরিপ করে নিই, ব্রিজ তৈরি করতে হলে যেমন জরিপ করি, কয়েক মুহূর্তেই তার অবয়ব সম্পর্কে আমার একটি
স্পষ্ট ধারণা হয়ে যায়। তার পাড় কেমন, মাটির অবস্থা কী, ভিত্তিকূপ তৈরিতে কতোটা বিপর্যয় দেখা দেবে, এমন একটা জরিপ কয়েক মুহূর্তেই আমার করা হয়ে যায়, যেমন, অন্য পুরুষরাও করে; কিন্তু অনন্যার বেলা তা হয় না, আমার মন কোনো জরিপ করতে রাজি হয় না। তার কোনো দেহ আছে, দেহের সংস্থান অন্য নারীদের মতোই, সে-সংস্থান থেকে একই রকমে মধু উৎসারিত হতে পারে, এটা ভাবতে ঘেন্না লাগে–আমার। অনন্যা ওঠার জন্যে প্রস্তুত হয়। আমি তাকে চাও দিতে পারি নি; কী খাবে: তাও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। তবে আমার ব্যক্তিগত সহকারিণীর দক্ষতা অসীম, সে। কোনো কিছুই বাদ রাখে নি, পাঁচতারা থেকে বাছাই করে সে সব নিয়ে এসেছে-তাকে, একটি প্রোমোশন দেয়া উচিত ছিলো; কিন্তু অনন্যা কিছুই ছুঁতে চায় না। শুধু এক। টুকরো চকোলেট কেক আর লাল চা। আমি তাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে আসি, লিট সে ভয় পায়, তার মাথা ঘোরে; তবে লিফটে সে মাথা ঘুরে আমার ওপর পড়ে যায় নি, আমাকে বিব্রত করে নি। আমি তাকে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব করতে পারি নি; সেটা বাড়াবাড়ি মনে হয় আমার; এমনকি পথ পর্যন্তও দিয়ে আসতে পারি নি, সেটাও মনে; হয় বাড়াবাড়ি।
ফিরোজা বোধ হয় বেশ এগিয়ে গেছে, অত্ত্বিকটির সাথে এক চাইনিজে তাকে: দেখেছে আমার এক বন্ধু, মোসলেম আলি, ফিরোজার এক অপ্রকাশিত অনুরাগী; আমাকে টেলিফোন না করে উত্তেজিত হয়ে আমার অফিসে এসেছে এক সন্ধ্যা একরাত কষ্টে নিজের উত্তেজনা চেপে রেখে। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিলো তার বউ ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে গেছে, সে লাফিয়ে পড়তে পারে সাততলা থেকে। ফিরোজা তাকে চিনতে পারে নি, না চেনার ভান করেছে, এতে সে আরো বিপর্যস্ত হয়ে গেছে, এবং আমার জীবনে যে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এতে সে কাতর হয়ে পড়েছে। মোসলেম আলিকে আমি পছন্দ করি; সে আমার একনিষ্ঠ অনুরাগী নজরুল ছাত্রাবাসে। ঢোকার পর থেকেই;–আমি যদি মহাপুরুষ হতাম তাকে পেতাম প্রথম বিশ্বাসীরূপেই; সে আমার কাছে নিয়মিত স্বীকারোক্তি করে চলতো তার সমস্ত পাপের, যেনো আমি। কোনো পুরোহিত, তাকে পাপমুক্ত করার জন্যে প্রার্থনার অধিকার আমার রয়েছে। সে একদিন এসে কাঁদতে থাকে আমার কাছে, খুব গোপনে; বারবার মাফ চাইতে থাকে। আমি তার কাছে জানতে চাই সে এমন কী অপরাধ করেছে, যে এতোটা ভেঙে পড়েছে, মাফ চাচ্ছে; সে পাপীর মতো জানায় সে আর সহ্য করতে পারে নি, মাসের পর মাস সহ্য করেছে, আত্মদমনের অনেক চেষ্টা করেছে, শয়তানটিকে পাজামার রশি দিয়ে বেঁধেও রেখেছে, আর পারে নি, শেষে আর্কিটেকচারের ওয়াজেদাকে ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে একটি কাজ করে ফেলেছে। তার পাপের শেষ নেই। তার দু-একদিন পরই মোসলেম আলি তবলিগে যোগ দিয়ে এক মাসের জন্যে টঙ্গি চলে যায়, এবং তিন মাসের মধ্যে মামাতো বোনকে শাদি করে, এবং দশ মাসের মধ্যে প্রথম পুত্রটি পয়দা করে। ফিরোজার যে সে অপ্রকাশিত অনুরাগী, এটা সে কখনো আমাকে বলে নি, ফিরোজাই বলেছে আমাকে; আমি বুঝি ফিরোজাকে মনে রেখেও মাঝেমাঝে সে তার স্ত্রীর সাথে কাজটি করে। মোসলেম আলি আমার জন্যে ভয়াবহ সংবাদ নিয়ে এসেছে; সে নিশ্চিত আমার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
ভাবী আমারে চিনতে পারল না, মোসলেম আলি বলে, তাইতেই আমি বুঝছি এইতে একটা কিন্তু আছে।
তোমার কী মনে হয়? আমি বলি।
যা মনে হয়, মোসলেম আলি বলে, তা আমি তোমার স্ত্রী আর আমার ভাবীর। সম্পর্কে বলতে পারব না। মোসলেম আলি বিমর্ষ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর বলে, তোমাগো সংসার কি ভাল যাইতেছে না?
আমি বলি, ভালোই তো যাচ্ছে, কোনো মারামারি নেই।
মোসলেম আলি বলে, আমার কথা শুইন্যা আইজ মারামারি করবা না?
আমি বলি, না।
মোসলেম আলি বলে, এইর লিগাই মাইয়ালোকগুলি এমন হইয়া যাইতেছে। আমি হইলে আইজ বানাইতাম, পরপুরুষের লগে চাইনিজে যাওয়া দেখাইতাম।
আমি বলি, এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে?
মোসলেম আলি বলে, তুমিও আবার পরের মাইয়ালোকের লগে যাও কি না কে জানে।
মোসলেম আলি চলে যায়, আমি একটু বিমর্ষ বোধ করি; আমার ইচ্ছে হয় অনন্যার কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি যদি একটি রিকশা নিয়ে ওর কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াই, অনেকক্ষণ দাঁড়াই, দাঁড়িয়ে এবং দাঁড়িয়ে এবং দাঁড়িয়ে থাকি, কলেজ থেকে বেরোতে গিয়ে অনন্যা যদি দেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি সে কতোখানি চমকে উঠবে? কততখানি বিহ্বল হবে? কতোটা ভয় পাবে? আমাকে কি চিনতে পারবে? আমি কি কলেজের গেইটে গিয়ে দাঁড়াতে পারি? গাড়ি নিয়ে গেলে তোকজন ভাববে আমি আমার কন্যাকে নিতে এসেছি; কন্যাকে নেয়ার জন্যে কেউ কি এতো আগে গিয়ে গেইটে বসে থাকে? আমি কি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না? কিন্তু আমি বেরোবো কেমনে? অনেকগুলো শেকল খুলে আমাকে বেরোতে হবে; ব্যক্তিগত সহকারিণীর শেকল খুলতে হবে, তিনজন অধস্তনের শেকল খুলতে হবে, তা আমি খুলতে পারবো; কিন্তু ড্রাইভারের শেকল খুলবো কীভাবে? যদি আমি আমার গাড়িতে না উঠি, পথের দিকে হাঁটতে থাকি, প্রথম আমার ড্রাইভার পাগল হয়ে যাবে, সাথে তার আরো দশটি সঙ্গী পাগল হবে, ওরা সবাই মিলে আমাকে পাগল মনে করবে। মনে। করবে আমি হঠাৎ পাগল হয়ে গেছি; একটি মেয়ে যে আমার কাছে এসেছিলো এটা সম্ভবত এখন তাদের আলোচনার বিষয়, এবং তারই ফল ফলছে মনে করে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে। নানা দিকে সংবাদ পৌঁছে যাবে, আমার বাসায়ও পৌঁছোবে। আমি এমন। সংবাদের বিষয় হয়ে উঠতে পারি না। অনন্যার কলেজের গেইটে আমার যাওয়া হবে না, আমি এতোটা সাহসী হতে পারবো না। তখন মাহমুদা রহমানের ফোন বাজে;–অনেক দিন পর মাহমুদা রহমান, তিনি জিল্লুর রহমান হয়ে গেছেন কি না জানি না, কিন্তু তার ফোন উদ্ধারের মতো মনে হয়। আমি কি খুব শূন্যতার মধ্যে আছি, কোনো কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে গেছি? নইলে ওই ফোনকে উদ্ধার মনে হচ্ছে কেনো? কিন্তু না, উদ্ধার নয়, বরং মাহমুদা রহমানই আমাকে অনুরোধ করছেন তাকে উদ্ধার করতে। আমি ভাঁকে। উদ্ধার করবো? তিনি কি আরো গভীর গর্তে পড়েছেন? এখনই তাঁর বাসায় যেতে হবে আমাকে; তার কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত হাহাকার, সমস্ত ক্রোধ, সমস্ত ঘৃণা।
মাহমুদা রহমানের বাসায় গিয়ে দেখি হাফিজুর রহমান ফিরেছেন আল মদিনা থেকে; তিনি আমাকে দেখে বসা থেকে উঠলেন না, আমি যে হাত তুলোম তার কোনো উত্তর দিলেন না, একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন। তিনি কি জেনে গেছেন তার স্ত্রীর সাথে আমার একটা শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাই ছুটে। এসেছেন সৌদি থেকে? কিন্তু তার মুখে কোনো ক্রোধ দেখছি না, আমাকে দেখে ফেটে পড়ার ভাব দেখছি না, এখনই যে উঠে স্ত্রীকে চুল ধরে টেনে আমার সাথে ঘরের বাইরে বের করে দেবেন, তাও মনে হচ্ছে না; বরং তাকেই মনে হচ্ছে অপরাধী, তিনি মাথা নিচু করে বসে থাকার চেষ্টা করছেন। আমি তাকে কুশল জিজ্ঞেস করি, তিনি। মাথা নিচু রেখেই উত্তর দেন; আমার সম্পর্কে কোনো উৎসাহ দেখান না। তাহলে উদ্ধার করতে হবে কাকে, মাহমুদা রহমান না হাফিজুর রহমান না আমাকে?
মাহমুদা রহমান চিৎকার করে বললেন, দেখুন, এই লোচ্চা সৌদি থেকে কী করে এসেছে।
হাফিজুর রহমান সব সময়ই গম্ভীর প্রকৌশলী, তার ভেতরটা মুখে প্রকাশ পায় না; মাহমুদা রহমানের অভিধায় তার ভেতরে কী ঘটলো বুঝতে পারলাম না। মাহমুদা রহমান বারান্দা থেকে টেনে কলাপাতার মতো একটি বালিকাকে আমার সামনে ছুঁড়ে দিলেন। বালিকা মেঝেতে পড়ে গেলো, তারপর উঠে একপাশে বসলো, ঘোমটা দিতে চেষ্টা করলো, তার গাল থেকে একটি মারাত্মক ঝিলিক এসে আমার চোখে ঢুকলো।
আমি বললাম, মেয়েটি কে?
মাহমুদা রহমান বললেন, কে আর, এই লোচ্চার দুই নম্বর বউ, আমার সতিন। লোচ্চাটাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।
আমি বলি, কখন বিয়ে করলেন?
মাহমুদা রহমান বললেন, বিয়ে এখনো করেন নি, করার পরের কাজটি করে। এসেছেন, পেট বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। এখন আমার কাজ দুজনকে সোহাগে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে আনা।
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারি না। সৌদিতে হাফিজুর রহমান কোথায় পেলেন এ-কলাপাতাটিকে? মাহমুদা রহমান চিৎকার করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সম্পূর্ণ কাহিনী বর্ণনা করলেন, যা তিনি সারা সকাল ধরে উদ্ধার করেছেন হাফিজুর রহমানকে ছিঁড়েফেড়ে। হাফিজুর রহমানের মাস আটেক আগে একবার দেশে আসার কথা ছিলো, কিন্তু আসেন নি; তাঁর কাজ বেড়ে গিয়েছিলো, তাই তিনি তখনকার ছুটি নেন নি (মাহমুদা রহমানের তাতে কোনো আপত্তি হয় নি, বরং হাফিজুর রহমান আসেন নি বলে তিনি কতোটা আনন্দিত ছিলেন, তা আমি জানি)। তখন আরব মরুভূমিতে এ-কলাপাতাটি দেখা দেয়। কলাপাতাটির একটি ভাই হাফিজুর রহমানের অধীনে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করে, সে খুবই ভক্ত তার মনিবের। প্রভুর থাকতে খেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো, একটি কাজের মেয়ের খুব দরকার হচ্ছিলো; তাই ইলেক্ট্রিশিয়ানটি হাফিজুর রহমানকে একটি পরিচারিকা এনে দেয় দেশ থেকে। সে নিজের ছোটো বোনকেই নিয়ে যায়, হাফিজুর রহমানই সমস্ত ব্যয় বহন করে; এবং হাফিজুর রহমান কলাপাতাটিকে পেয়ে কাজ বাড়িয়ে দেন, দেশে আসার সময় পান না, চিঠি লেখা কমিয়ে দেন, টেলিফোন করা তো বন্ধই করে দেন। কলাপাতাটির বয়স কতো হবে? মোলো? হাফিজুর রহমান আট মাস ধরে বেহেস্তে ছিলেন, মরুভূমিতে তার জন্যে একটি কলাপাতা সবুজ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো, আমি বুঝতে পারি যখন আমি আরেকবার কলাপাতাটির দিকে তাকাই। কলাপাতাটি কালবিলম্ব না করে গর্ভবতী হয়ে পড়ে-মরুভূমিতে হয়তো রাবার নেই, বা হাফিজুর রহমান জুতো পরে পুকুরে নামতে পছন্দ করেন না। এতো দিন চেপে ছিলেন, এখন তাকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছেন, হয়তো সেখানে কলমাও পরেছেন, এখানে স্বীকার করছেন না। তিনি কলাপাতাটিকে বিয়ে করবেন, মাহমুদা রহমানকে তিনি একথা জানিয়েছেন, এবং মাহমুদা রহমান তাকে জানিয়েছেন তিনি হাফিজুর রহমানের দ্বিতীয় বিবাহে সম্মতি দেবেন না, তাকে জেলে পাঠাবেন। আমি কীভাবে উদ্ধার করবো মাহমুদা রহমানকে।
হাফিজুর রহমান জানতে চাইলেন, ঢাকায় না কি এমআর করার জন্যে এখন রাস্তায় রাস্তায় ক্লিনিক হয়েছে?
আমি বলি, আমি ঠিক জানি না।
মাহমুদা রহমান বলেন, রাস্তায় বের হও, তাহলে নিজেই খুঁজে পাবে।
এমআর কথাটি এই আমি প্রথম শুনি, এর পুরোটা কী তাও জানি না, তবে হাফিজুর রহমানের প্রশ্ন থেকে কাজটি বুঝতে পারি, উত্তরও দিই; হাফিজুর রহমান। তাতে সুড়ঙ্গের পরপারে কোনো আলো দেখতে পান না। আমি কীভাবে উদ্ধার করবো এদের? আমাকে কি বালিকাটিকে নিয়ে ক্লিনিকে ছুটতে হবে, একটা চমৎকার সহৃদয়। তলপেটের ডাক্তার খুঁজে বের করতে হবে? গিয়ে যদি বলি আমার এক বন্ধু কাজটি করে ফেলেছেন, তাকে উদ্ধার করুন; ডাক্তার কি আমার দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্ট অর্থপূর্ণ হাসি হাসবে না? কিছু উপদেশ দেবে না, শেলফ থেকে দু-চারখানি ধর্মগ্রন্থ (আজকাল না কি এগুলোই থাকে তাদের শেলফে) বের করে পড়ে শোনাবে না? তারপর রারার ব্যবহারের উপকারিতা ব্যাখ্যা করবে না? আমার আর ভালো লাগছে না, আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমার বেরিয়ে পড়তে। ইচ্ছে করছে। কলাপাতাটির দিকে চোখ পড়তেই আবার একটি ঝিলিক অনুভব করি, হাফিজুর রহমান একে হারাতে চাইবেন না; কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখন তিনি এটিকে হারাতে প্রস্তুত। আমি মেয়েটির মুখের দিকে আবার তাকাই, তার মুখে এবার আমি মৃত্যুর উজ্জ্বল উদ্ধারের ছায়া দেখতে পাই। আমি কাউকে উদ্ধার করতে পারবো না, নিজেকেও না, আমি বেরিয়ে পড়ি। ড্রাইভারকে বিদায় করে দিয়ে আমি পথে হাঁটতে থাকি। অনন্যার কলেজ কতো দূর? এখন তার ছুটি হয়ে গেছে। আমি কি হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে উঠতে পারি? কতোক্ষণ লাগবে যদি আমি হাঁটতে থাকি। তাকে কি আমি সেখানে খুঁজে পাবো? গেইটে দাঁড়িয়ে থাকবো? শিক্ষকদের বসার ঘরে গিয়ে তার খোঁজ করবো? সে কি আমাকে চিনতে পারবে? এখন আমি হাঁটছি, আমাকে কেউ চিনতে পারবে না।
নিজেকে আমার অচেনা মনে হচ্ছে, শহরটাকে অচেনা মনে হচ্ছে। অনেক বছর ধরে আমি শহরটাকে উঁচু থেকে বসা থেকে কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে দেখে আসছি, দাঁড়িয়ে হেঁটে দেখি নি, সরাসরি দেখি নি; আমার ভালো লাগছে। কেউ আমাকে চিনতে পারছে না, আমিও চিনতে পারছি না, একটা পানের দোকান থেকে একটি মোটা লোক, চমকার ঘন পিক ছুঁড়েছে, আমার গায়ে এসে পড়তে পড়তে নিচে পড়ে গেলো, লোকটি আর আমি হাসলাম। গায়ে পড়লে কেমন লাগতো আমার ভাবতে ইচ্ছে হলো। বজ্রপাতের মতো একটা বাস এসে দাঁড়ালো আমার পাশেই, ওপরেও দাঁড়াতে পারতো, ছোট্ট ছাই দিয়ে তৈরি হেল্পারটি আমাকে ধরে টানাটানি শুরু করলো তার গেইট লক। সিটিং সার্ভিসে ওঠার জন্যে, আমি উঠে পড়লাম। পেছনের দিকে একটি সিটে বসলাম। আমি। আমি মাছের গন্ধ পাচ্ছি, আমার পাশের লোকটির গেঞ্জি থেকে সুন্দর একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি, একবার তার গেঞ্জিতে নাক লাগিয়ে শুকতে ইচ্ছে হলো আমার। বাস চলছে আর থামছে, থামছেই বেশি, আমার ভালো লাগছে। অনন্যা কি এ-বাসে উঠতে পারে? এ-বাসে উঠে তার যাওয়ার কখনো দরকার পড়ে না? আজই দরকার পড়তে পারে না? আমার মতো উঠে বসতে পারে না? সামনের দিকে যে-মেয়েটি বসে। আছে, সে কি অনন্যা? একটি লোক তার পলিথিনের ব্যাগটি আমার উরুর ওপর রেখেছে, ভেতর হয়তো আখের গুড় রয়েছে, আমি আখের গুড়ের গন্ধ পাচ্ছি, আমার ভালো লাগছে। অনেক দিন ধরে আমি আখের গুড় খাই না, আখের গুড়ের গন্ধ পাই না। বাস এখন চলছে না, একটি গে সেলুন দেখতে পাচ্ছি, গে লর্ড সেলুন? ঢাকায় গেদের জন্যে নিজস্ব সেলুনও রয়েছে? নাপিতগুলোকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার, ওদের ঠোঁটে লিপস্টিক আছে কি না, ওরা বক্ষবন্ধনি পরে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে। বাস বোধ হয় আর চলবে না, এখানেই থেমে থাকবে। আমি কি নেমে যাবো? এবার বাস চলতে শুরু করেছে। ব্রিজ, এ-ব্রিজটা একদিন ভেঙে পড়বে, ভেতরে ভেতরে এর ভাঙার কাজ চলছে, আজই ভেঙে পড়বে না, ভেঙে পড়বে, শব্দ শুনছি। বাস কি এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে ডানের পানিতে বাঁয়ের পানিতে? যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে আমার লাশ পাওয়া যাবে। কেউ বুঝতে পারবে না আমি কোথায় যাচ্ছিলাম। আমি একটি রহস্য হয়ে উঠবো। ড্রাইভার বলবে স্যার তাকে মাহমুদা রহমানের বাসা থেকে বিদায় দেয়, তারপর আর কিছু সে জানে না। আমার লিমিটেড একটা প্রকল্প নেবে আমি কোথায়। যাচ্ছিলাম বের করার জন্যে। ফিরোজা ভাববে গ্রামে আমার একটি উপপত্নী আছে, তার বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। অনন্যা কী ভাববে? মাহমুদা রহমান? দেবী? সাংবাদিকগুলো? তারা কোনোদিন জানবে না আমি কোথায় যাচ্ছিলাম, আমি নিজেও জানি না। আমার ওপাশের সিটে দুটি মেয়ে, ওরা বোধ হয় দেহ বিক্রি করে, সিগারেট টানছে, ওদের কর্কশ ধুয়োর গন্ধ পাচ্ছি, বেশ লাগছে; ওরা গালি না দিয়ে কথা বলছে না, বেশ লাগছে আমার। বাস এবার থামলো, ছাদের ওপর থেকে জেলেভাইদের চাঙারি পড়ে গেছে, তুলতে হবে। এবার একটা ব্রিজ, বেশি দিন টিকবে না, নিচে নদী, খালের মতো। কী নাম? মেঘবতী? মেঘেশ্বরী? সামনের চাকা খুলে বাস এবার হুমড়ি খেয়ে পড়লো একটা গাছের গায়ে। খালে পড়ে যেতে পারতো, পড়ে নি, আমি নিচে নেমে আসি।