মায়া
আবার উত্তর কলকাতা।
ললিতা সকৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কই, মেম বউদিকে আনলে না?’
সোম বসে পড়ে বলল, ‘আসল মেমের চেয়ে নকল মেমে নাকাল বেশি। না খেলেন একটা চুমো, না বললেন একবার ডার্লিং, সূর্যমুখী ফুলের মতো তাঁর একই লক্ষ্য—মা-র মুখ।’
কুণাল বলল, ‘ললিতার যে মা ছিলেন না সে আমার ভাগ্য।’
ললিতা বলল, ‘আমার মা থাকলেও তোমার স্ত্রীভাগ্য একই হত।’
সোম বলল, ‘প্রতিমার মা না-থাকলে আমার স্ত্রীভাগ্য একই হত কি না সে বিষয়ে কিন্তু আমার সন্দেহ থাকল।’
সোমের মে-ফেয়ার কাহিনি শেষ হলে ললিতা বলল,—‘ভালো কথা, কে একজন কেষ্টবাবু তোমার খোঁজ নিতে এসে ফিরে গেছেন, বলে গেছেন, তোমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।’
‘কেষ্টবাবু?’
‘বললেন শুধু কেষ্ট মামা বললেই তুমি চিনবে।’
‘তাই বলতে হয়—কেষ্ট মামা। হ্যাঁ, কেষ্ট মামা। চা-বাগানের কেষ্ট মামা। হোঁদলকুতকুতের মতো চেহারা—না?’
ললিতা বলল,—‘আহা, কী মাতুল-ভাগ্য!’
কুণাল আড়চোখে সোমের দিকে চেয়ে বলল, ‘নরাণাং মাতুলক্রমঃ।’
সোম বলল,—‘তার মানে আমিও একটি হোঁদলকুতকুত! বেশ, বন্ধু, বেশ। তবু যদি আপন মামা হতেন!’
ললিতা বলল, ‘হোঁদলকুতকুত না-হলে কোথাও বউ জোটে না-কেন? বিয়ের ফুল ফোটে না-কেন?’
সোম বলল,—‘তোরা কেউ পারবিনে গো ফোটাতে ফুল ফোটাতে।’ এই বলে দার্শনিকের মতো অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
সোম মামার সঙ্গে তাঁর মেসে গিয়ে দেখা করলে তিনি বললেন, ‘এই যে ভজা।’ একমুখ পান চিবোতে চিবোতে তখন তাঁর অসামাল অবস্থা। আর কিছু বলতে পারেন না। ‘এই যে ভজা।’
ও নাম অনেক দিন বাতিল হয়েছে। সোম একটু বিরক্ত হল!
‘তারপর। কবে ফিরলি?’
‘মাস দেড়েক আগে।’
‘হুঁ; কোথায় চাকরি হল? না, হয়নি?’
সোম বিমর্ষভাবে বলল—, ‘কোথায় আর হল? বিলেত থেকে যা পুঁজি এনেছিলুম তাও ফুরিয়ে এল।’
‘হবে, হবে। যেমন দিনকাল। একটু সবুর করতে হয়। প্রফেসারি করবি ঠিক করলি?’
‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ যাতে দু-পয়সা আসে তাই করতে রাজি আছি।’ তারপর মনে মনে জুড়ে দিল, তবে হব না মুচি, হব না, হব না, যদি না পাইমুচিনি।
‘হা-হা-হা-হা। তেমনি ছেলেমানুষ আছিস। ‘ভজগোবিন্দ পরমানন্দ’ বলে তোকে খ্যাপাতুম মনে পড়ে? তোর মতো অত বড়ো স্কলার। বংশের গৌরব। দ্যাখ, ও সব কাজ আমার মতো লক্ষ্মীছাড়ার। কোন কাজে হাত না দিয়েছি—বল। অবশ্য তুই সবটা ইতিহাস জানিসনে। মাইনিং, প্লান্টিং, মোটর ইমপোর্টিং। শেষে এই দারুণ ট্রেড ডিপ্রেশান। এবার খুলেছি বিয়ের ব্যাবসা।’
‘কী! শেষকালে—’
‘কেন রে! এতে শক পাওয়ার কী আছে! দেশের লোক খেতে পায় না বলে কি মেয়ের বিয়ে, ছেলের লেখাপড়া বন্ধ রাখবে? একটাও আঁতুড়ঘর, কি স্কুল খালি হয়েছে বলতে পারিস? তুই একটি বিয়ে কর না। লক্ষ্মী যদি অন্তঃপুরে আসেন তো জীবনের সবদিক দিয়ে আসেন। পয়মন্ত দেখে বিয়ে করলে জীবনের half the battle জেতা গেল।’
‘বিয়ে করতে কি আমার অনিচ্ছা? কিন্তু—’
‘না, না, ওসব কিন্তু টিন্তু শুনব না। চল, চল আমার আপিসে চল।’
মামার আপিস কর্পোরেশন স্ট্রিটে। কামরার বাইরে লেখা—
MR. CARR
Hindu Marriage Broker
মামা কোট ও ভেস্ট খুলে গোল চেয়ারে বসে এক চক্কর ঘুরে নিলেন। তারপর ভাগনের দিকে একটি চুরুট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘Sorry, couldn’t offer you a cigarette. দেশের লোকের সেন্টিমেন্টটাকে খাতির করতে হয়। আর বিলিতি সিগ্রেট কি প্রকাশ্যে কেনবার জো আছে?’
সোম পকেট থেকে তার ইটালিয়ান সিগ্রেটের কেস বের করে মামার সামনে ধরল। তিনি চোরের মতো ইতস্তত করতে করতে খপ করে মুখে পুরলেন। বললেন, ‘Thank you. কতকাল পরে!’
সোম বলল, ‘দেশের মস্ত পরিবর্তন হয়েছে, তা অস্বীকার করতে পারিনে। কিন্তু বিয়ের বাজারটা—’
‘আমাদের সমাজ,’ তিনি সিগ্রেটটা ধরিয়ে এক টান দিয়ে বললেন, ‘কোন brand বল তো?’
‘সিগ্রেটের আবার brand কী?’ সোম বলল, ‘যেমন স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি তেমনি—’
‘বোয়েছি (বুঝেছি)। বেড়ে লাগছে। আশা করি স্বদেশি নয়?’
‘না, ইটালিয়ান। নেপলসে কেনা।’
‘তাই বল।’ পিঠ পিঠ কয়েক টান দিয়ে সেটাকে নিবিয়ে নিজের কেসে তুলে রাখলেন। একসঙ্গে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে শুঁকতে শুঁকতে বললেন, ‘ধোঁয়ারও কেমন মিষ্টি গন্ধ দেখেছিস?’
তারপর তাঁর মনে পড়ল কী বলতে যাচ্ছিলেন। ‘হ্যাঁ—আমাদের সমাজ যদিও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই তবু পশ্চিমমুখো হতে হতে কোনো দিন মক্কা পেরিয়ে বিলেত পর্যন্ত—আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকা অবধি—যাবে কি না আল্লাই জানেন। আমরা আজকাল কেউ থাকি আকিয়াবে, কেউ করাচিতে, কেউ নেলোরে, কেউ ফতেপুর সিক্রীতে। আমাদের ছেলেমেয়েদের কোর্টশিপ হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে না-হয় ধরেই নিলুম, কিন্তু হওয়া কি geographically সম্ভব? দৈবাৎ কারো সঙ্গে কার চোখের দেখা ও চোখের দেখায় প্রেম হয়ে যেতে পারে বটে—অন্তত বাংলা নভেলে তো তাই লেখে ও তাই পড়ে মেয়েগুলো পর্যন্ত বকছে—কিন্তু গ্রেট মেজরিটির কথা ভেবে দ্যাখ ভজগোবিন্দ।’
আবার সেই মান্ধাতার আমলের নাম। সোম ব্যঙ্গ করে বলল, ‘গ্রেট মেজরিটির জন্যে গ্রেট-থিঙ্কার প্রয়োজন। যেমন আপনি।’
‘নেহাত ভুল বলিসনি, ভজা,’ তিনি আর একবার চক্কর দিলেন। ‘যে কাজটি আমি করছি সেটি এক হিসেবে social service. যোগ্যং যোগ্যেন যোজয়েৎ। যার যেমনটি পাত্র বা পাত্রী চাই তাকে ঠিক তেমনটি জোগাড় করে দিই। তোর বাবা তোর জন্যে নিজের চেষ্টায় জোর একশোটি সম্বন্ধ পাবেন কিন্তু আমার সাহায্য নিলে এক হাজারটি। Scope কত বেড়ে গেল হিসাব করে দ্যাখ। কে জানে হয়তো সাতশো সাতাত্তর নম্বর সম্বন্ধটি সবদিক থেকে নিখুঁৎ হত। দুই পক্ষের কারুর মনে কোনো ক্ষোভ থাকত না, প্রজাপতির স্বহস্তের নির্বন্ধ।’
সোম বলল, ‘প্রজাপতির স্বহস্তের মহিমা অপার। আমার কিন্তু প্রাণান্ত হত হাজারটি পাত্রীকে স্বচক্ষে দেখতে ও স্বকীয় উপায়ে পরীক্ষা করতে।’
কেষ্ট মামা কান দিলেন না। হাঁটু জোড়াকে সবেগে ঠোকাঠুকি করতে করতে বললেন, ‘মুস্কিল এই যে লোকে এখনও এসব বিষয়ে এক্সপার্টের সাহায্য নিতে শেখেনি। হয় নিজেরা যা-তা একটা করে বসে, নয় আনাড়িকে লাগিয়ে দেয়। তাতে পয়সা কি বাঁচে ভাবছিস? যাক, ধীরে ধীরে আমার পসার জমছে। কয়েক ঘর বাঁধা ক্লায়েন্ট হয়েছেন, ষষ্ঠী যাঁদের ঘরে বাঁধা। হ্যাঁরে তোর নামটা রেজিস্ট্রি করে রাখব?’
‘না,। না।’ সোম সাতঙ্কে বলল। ‘আপনার খাতা দেখে ষষ্ঠী কোন দিন না আপনি এসে ধন্না দেন।’
‘নামটা থাক না? বিয়ে তো কেউ জোর করে দিচ্ছে না। ইচ্ছে না-হয় না-করিস। কিন্তু মাঝে মাঝে তোকে ডাক দেব, মেয়ের বাপের ঠিকানা দেব। তুই যতদিন হাতে থাকবি ততদিন আমার লাভ। বিয়ে করলে তো হাত থেকেই গেলি। আমি কি তা বুঝিনে?’
টেলিফোনে কে ডাকল।
‘Hallo! Yes, I am Mr Carr বলুন কী করতে হবে। মেয়ের বিয়ে দিতে চান? সে তো আনন্দের কথা। শুভস্য শীঘ্রম—শাস্ত্রেই বলেছে। মেয়েটির রং কেমন? হুঁ। পড়াশুনো? হুঁ। পণ যৌতুক মিলিয়ে কত দান করতে চান? মোটে। হুঁ। হুঁ। হুঁ। আপনারা? হুঁ। কোন শ্রেণি? হুঁ Alright, I’ll fix you up. আজ সন্ধ্যার আগে খবর দেব। আপনার ফোন নম্বরটি কত! হুঁ। O K Thank you.’
নম্বরটা টুকে নিয়ে গুনগুন করে গান করতে করতে বেল টিপলেন। ‘পিয়ন, সত্য বাবুকো সেলাম দো।’ ওই একটিমাত্র পিয়ন, ওই একটিমাত্র কেরানি।
সত্যবাবু কেরানি এলেন। চশমা কপালে তোলা। ধুতির উপর শার্ট, তার কলার নেই, তবু ঘাড়ের উপর একটি stud আছে। প্রৌঢ়, রোগা, ছা-পোষা মানুষ।
‘সত্যবাবু, বামুনদের রেজিস্ট্রারখানা নিয়ে আসুন।’
সত্যবাবুর তথাকরণ। কেষ্টবাবু রেজিস্ট্রারের দুই তিন জায়গায় লাল পেনসিলের দাগ দিলেন। তারপর ফোন তুলে নিলেন।
‘৫৩২১ (অপ্রকাশ্য)। Hallo, শরৎবাবু বাড়ি আছেন? আমি মিস্টার কার, ম্যারেজ ব্রোকার, যাকে বাংলায় বলে ঘটক।…এই যে শরৎবাবু। একটি ভালো পাত্রী পেয়েছি। রং ধরতে গেলে ফরসাই। ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পাবার আশা আছে। দেওয়া-নেওয়া এই—আজকালের বাজারে—আপনারও তো জানা আছে! একবার দেখতে চান? কখন যাবেন বলুন? আমাকে যেতে হবে? বেশ তো। আমি আরও হাজার খানেকের জন্যে বলে দেখতে রাজি আছি। যদি আমার কমিশনটা ভুলে না যান। শতকরা এক টাকা মাত্র।’
সোম শুনছিল আর মনের রাগে হাসছিল।
‘এই হচ্ছে, বাবাজি, আমার কাজ।’ কেষ্ট মামা আর এক চক্কর দিয়ে দু-চার বার হাত তুলে স্যাণ্ডো করলেন—বিনা ডাম্বেলে। ‘তা তুই তৈরি থাকিস। কলকাতা ছাড়িসনে। সত্যবাবু, কায়স্থদের রেজিস্টারখানা নিয়ে আসুন দেখি।’
দিন চারেক পরে সোম পেল কেষ্ট মামার চিঠি। লিখেছেন, মায়া মেয়েটির নাম। পিকেটিং করে ছ-মাস জেল খেটে ফিরেছে। পাছে আবার ওদিকে ওর মতি যায় সেই ভয়ে বাপ-মা ওকে এই মাসেই পাত্রস্থ করতে ব্যগ্র। বড়োলোক। তোর সঙ্গে যদি হয় তবে আমরাও হব কুটুম্ব। তুই সোজা আমার আপিসে চলে আসিস, আমি তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
ভবানীপুরে কুমারী মায়া মল্লিকের বাড়ি।
মামা-ভাগ্নে সেই বাড়িতে পৌঁছে বৈঠকখানার পথ খুঁজে পেলেন না—এমনি বিরাট ব্যাপার। একজন বলে, ‘কাকে চান? ওঃ! যান, ওইদিকে যান।’ আর একজন বলে, ‘কিসকো মাংতে হেঁ। বগলমে তল্লাস কিজিয়ে।’ তৃতীয় একজন বলে, ‘আরে, কুআড়ে যাউছ ম।’ (কোথায় যাচ্ছ?)
মহা বিভ্রাট। কেষ্ট মামা বললেন, ‘এ বাড়ির একটা নিজস্ব ডাইরেক্টরি থাকা দরকার।’
সোম বলল, ‘এবং এক সেট ভাষা শিক্ষার বই।’
এই সময় কে একজন সাহেবি পোশাক-পরা ভদ্রলোক হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কেষ্ট মামা তাঁর পথ রোধ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মশাই, বাংলা বোঝেন?’
‘দেখছেন না, মশাই, আমি ডাক্তার? ছাড়ুন, ছাড়ুন, পথ ছাড়ুন।’ ভদ্রলোক যে patient নন তাঁর গতির দ্বারা তা প্রমাণ হল।
একজন নরসুন্দর সেই পথ দিয়ে হেলে দুলে চলেছিলেন। কেষ্ট মামা বললেন, ‘ও ভাই সাহেব, বলি তুমি তো সবাইকার দাড়িগোঁফের খবর রাখ। এ বাড়িতে ফটিকবাবু বলে কাউকে চেনো?’
‘কৌন ফটিকবাবু? যিসকো লড়কী গান্ধীমাঈ বন গই?’
‘ঠিক, ঠিক, সোহি।’
‘ও ক্যা?’ নরসুন্দর আঙুল দিয়ে কাকে বা কোন জিনিসকে নির্দেশ করলেন তিনিই জানলেন। কেষ্ট মামা ও সোম সেই দিকে গিয়ে দেখেন গারাজ।
‘নরসুন্দরের চাতুরীর প্রবাদ আছে। তারই একটা দৃষ্টান্ত আজ প্রত্যক্ষ করা গেল।’—সোম বলল।
‘ব্যাটাকে আবার দেখলে চড় দিয়ে দাঁত উড়িয়ে দেব। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি।’ বলে কেষ্ট মামা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুলতে থাকলেন।
সেই গারাজের লোক তাঁদের একটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাবার পরামর্শ দিল, বলল, বাবুরা নীচে নামেন না। কার যে কোন মহল তা উপরে খোঁজ করলে পাত্তা পাওয়া যাবে।
ফটিকবাবু বললেন, ‘আপনারা সোজা তেতালায় চলে এলেন না কেন? আমরা তো ভেবে আকুল। ইনিই পরম কল্যাণীয় কল্যাণ? দেখে সুখী হলুম। ওদেশ থেকে কবে আসা হল?’
সোম এর উত্তর দিল। অমনি আরও কত মামুলি প্রশ্নেরও। কেষ্ট মামা তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুরুব্বিয়ানা ফলাতে থাকলেন। দেখতে দেখতে বাবুর মোসাহেবদের মুখ ছুটল। তাদের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন দেখি, সার, ওদেশের ঝি-চাকর কি এই দেশ থেকে গিয়ে বসবাস করছে, না-আফ্রিকা থেকে? …কী বললেন? ওরাও সায়েব? অ্যাঁ! ঝি-চাকর সাহেব-মেম!’
আর একজন সবজান্তার মতো মন্তব্য করলেন, ‘কেমন? আমি বলিনি ওকথা? সিনেমায় যা দেখায় তা নেহাত যা-তা নয় হে। ওদের সমাজের জ্বলজ্বলে ছবি।’
সোম বলল, ‘আপনি ওঁর চেয়ে আরও ভুল করলেন।’
তাই নিয়ে সোমকে অনেকক্ষণ বকবক করতে হল। এক পেয়ালা চায়ের অভাবে তার গলা যখন শুকিয়ে এসেছে তখন তিনটে চাকরের ছয় হাতে খাদ্যদ্রব্য বোঝাই করে তাদের পিছু পিছু এল মায়া। সে জেলে ছয় মাস কাটিয়েছে বলে কায়া তার শীর্ণ শুষ্ক রুগ্ন নয়। বরঞ্চ তার নিটোল অঙ্গ অনাবশ্যক মেদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেনি। তার চক্ষু অসাধারণ দীপ্ত। কিন্তু চপল নয় তার চরণ। আপনি সে সংহত। কিন্তু ঢেউ ওঠে তার চতুর্দিকে।
চাটুকারেরা বলাবলি করল, ‘আগুনের ফুলকি। জেলে মন পড়ে আছে।’
‘জানো না বুঝি, সার্জেন্টের ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
‘শুধু দাঁড়ায়নি, লাগাম ধরেছিল।’
‘নাম মায়া, কিন্তু প্রাণের মায়া নেই।’
‘কিসের মায়াই বা আছে? ঐশ্বর্যের? গৃহের?’
‘যা বলেছ, এমনটি দেখা যায় না।’ ‘নকল অনেক হয়েছে, কিন্তু আসলের ধার দিয়েও যায় না।’
মহিলাকে সম্মান প্রদর্শন করবার জন্যে সোম আসন ছেড়ে দাঁড়াল। মায়া তার কাছে এসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৈলাতিক সম্ভাষণ করল ও তার পাশের চেয়ারে বসল।
সোম বলল, ‘আপনি ও আমি প্রায় এক সময়েই বাড়ি ফিরেছি, যদিও এক জায়গা থেকে নয়।’
মায়া বলল, ‘কদিনের জন্যে ফেরা আমার! আবার তো যাচ্ছি।’
ফটিকবাবু আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘তোর না-হয় প্রাণের মায়া নেই, আমাদের তো সন্তানমায়া আছে।’
চাটুকারগণ ব্যস্ত হয়ে গুঞ্জন করল। সেইসঙ্গে ভুঞ্জনটাও চলছিল পরিপাটি রূপে।
‘আমিও’, সোম হেসে বলল, ‘ঘুরে আসব ভাবছি। কাজকর্মের বাজার যেমন মন্দা, গভর্নমেন্টের ভাত থাকতে ঘরের ভাত খাই কেন? তবে ছুটন্ত ঘোড়ার সুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে সত্যি বলছি আমার সাহসে কুলাবে না।’
‘আমি বুঝি দু-বেলা তাই করে বেড়াই?’ মায়া বলল স্তোক দিয়ে।
‘দু-বেলা দূরে থাক, জীবনে একবারও আমি পারব না।’
‘আমিও কি দ্বিতীয়বার পারব ভেবেছেন? আর লোকে যতটা বাড়িয়ে বলে ততটা নয়।’
চাটুকারেরা বললেন, ‘কী বিনয়! সাধে কী লোকে বলে গান্ধীমায়ী!’
কেষ্ট মামা এতক্ষণ খাদ্যবস্তুর শ্রাদ্ধ করছিলেন। সব কথা শোনেননি। একটা কিছু বলতে হয়, তাই বললেন, ‘ঘোড়ায় চড়তে পারো তো মা?’
মায়া বিষম অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নীচু করল। ফটিকবাবু বললেন, ‘ওর দোষ নেই, আমিই ও-শিক্ষা দিইনি।’
মোসাহেবরা বললেন, ‘তাতে কী?’
‘দোষটা কীসের?’
এবার স্তোক দেবার পালা সোমের। সে বলল, ‘ঘোড়ায় চড়তে যে সে পারে, আমিও। কিন্তু ছুটন্ত ঘোড়ার সম্মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন বিলেতের সাফ্রেজটরা আর পারেন বাংলার আপনি!’
মায়া কৃতজ্ঞ হয়ে লজ্জা চেপে বলল, ‘এটা কিন্তু অত্যুক্তি।’
সেদিন কথাবার্তা হল প্রচুর, কিন্তু কেউ কারুর নতুন বা গভীর কোনো পরিচয় পেল না। ওঠবার সময় সোম বলল, ‘আমার বন্ধুদের বাড়ি একদিন চা খেতে আসুন।’
মায়া বলল, ‘দেখলেন না, চা আমি খাইনে? অভ্যাস গেছে, আবার করলে আবার যাবেও।’
‘তাহলে এমনি বেড়াতে আসুন। এত বড়ো বীরাঙ্গনার দর্শন পাবার জন্যে ওরা সবাই আগ্রহ বোধ করবে। না করলে ওদের ওপর আমি এমন রাগ করব।’
কেষ্ট মামা ভরা-পেটে বললেন, ‘বাস্তবিক, আমার এত বড়ো কারবার, কত পাত্রী নাড়াচাড়া করতে হয়, কিন্তু ওরা সবাই অঙ্গনা, কেউ বীরা নয়। এতদিনে কুমারী মায়া মল্লিক আমার ব্যবসায়ী জীবন সার্থক করলেন। ওরে ভজা, তুই আর দ্বিধা করিসনে, আমি জাহ্নবীদাকে লিখি যে ছেলের পছন্দ হয়েছে, ছেলের মামারও—মা তো নেই, ধরে নিতে হয় যে মামাই এক্ষেত্রে মা, দুগ্ধাভাবে ঘোলং দদ্যাৎ—এখন ছেলের বাপ ‘হাঁ’ বললেই বাকি থাকে মিষ্টান্নং ইতরে জনাঃ।’
মোসাহেবরা বললেন, ‘সে আমরা জানি আর জানেন ফটিকদা।’
ফটিকবাবু বললেন, ‘ফটিক শুধু চান সঠিক খবর যে তাঁর বড়ো মেয়ে মায়া ঘোড়ার পায়ে না পড়ে মানুষের হাতে পড়েছে।’
মায়াকে সোম একান্তে বলল, ‘তা হলে?’
মায়া চোখ নামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘আসুন কেষ্ট মামা’, সোম পা বাড়িয়ে বলল, ‘ওসব পরে হবে। মায়া দেবীকে যে জেলে যেতে দেওয়া হবে না অন্তত কিছুদিন এই আপাতত যথেষ্ট।’
পথে কেষ্টমামা সোমকে ভর্ৎসনা করলেন। ‘তুই কেন দেরি করছিস, বল তো? আমি কারবারী মানুষ, আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে অমন মাল আমি কোনোদিন নাড়াচাড়া করিনি, বিশ্বাস হল না? দেখলি তো কত বড়ো বাড়ি, তিন তিনখানা মোটর, ঝি-চাকর অগুণতি, মোসাহেবই বা কত! অর্ধেক রাজকন্যা—না, না অর্ধেক রাজত্ব—ফটিকবাবুর অংশের আট আনা তুইই তো একদিন পাবি, ওঁর যদি ইতিমধ্যে পুত্রসন্তান না-হয়।’
‘জমিদার বুঝি?’
‘নয়? দেশ ওদের রংপুর জেলায়। এক তামাক থেকে ওঁদের আয় কত! আমার ক্লায়েন্ট তা না-হলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তোর মতো বহু যোগ্য পাত্রের দরখাস্ত পেত। তোকে কি এতটা সমীহ করত রে ভজা?’
সোম বলল, ‘আমি দরখাস্তই করতুম না।’
মামা বললেন, ‘সেই ভজাই আছিস। সংসারের তুই বুঝিস কী? সংসার কেবল একটি অক্ষে ঘুরছে—নাম তার টাকা। সেই টাকার জন্যে মানুষ না করছে কী! আর তুই করবিনে বিয়ের দরখাস্ত! যাক, তোকে দরখাস্ত করতে বলা হচ্ছে না। আমি একরকম সব গুছিয়ে এনেছি। এখন তোর মত হলেই আমি কমিশন যা পাব তুই নাই-বা জানলি। ওসব কনফিডেনশিয়াল!’
‘কিন্তু’, সোম বলল, ‘কংগ্রেসি মেয়ে আমি বিয়ে করতে চাইলেই বাবা অমনি রাজি হয়ে যাবেন ওটা তোমার ভুল ধারণা, কেষ্ট মামা। ওঁকে এখনও সরকারি চাকরি করে খেতে হয়, সরকারি পেনসন ওঁর শেষ বয়সের ভরসা, আর আমাকেও সরকারি চাকুরে করবেন বলে ওঁর তদ্বিরের ত্রুটি নেই।’
কেষ্ট মামার উৎসাহের তেজ মুহূর্তে নিভে গেল। ট্যাক্সিও মেসের নিকটবর্তী হয়েছিল। তিনি নেমে পড়ে বললেন, ‘গুড বাই, ভজা।’
মায়া বলেছে আসবে। কিন্তু সত্যি আসবে কি না, এলেও সোমের সঙ্গে তার সম্বন্ধ নিবিড়তর হবে কি না, যে পুরুষ সরকারি চাকরি পেলেও পেতে পারে তাকে বিয়ে করবে কি না, বিয়ে করলে কংগ্রেসের কাজ সম্পূর্ণ ত্যাগ করবে কি না—এইরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সোম পৌঁছে গেল।
ললিতাকে বলল, ‘কাকে দেখে এলুম ও ডেকে এলুম জানো? মায়া মল্লিক!’
ললিতা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘সর্বনাশ। ও মেয়েকে সামলাতে পারবে?’
‘তুমি চেনো ওকে?’
‘সাক্ষাৎভাবে না-হোক পরোক্ষে।’
‘আমার তো বিশেষ শ্রদ্ধা হল ওর উপর। দেখা যাক তোমার কী হয়!’
ললিতা বলল, ‘তুমি যাকে বউ করবে সেই হবে আমার বউদিদি, তাকেই করব ভক্তি। কিন্তু মায়া মল্লিক কি বউমানুষের মতো ঘরে চুপ করে থাকবে?’
সোম বলল, ‘কে বলছে তাকে গৃহলক্ষ্মী হতে! সে যা হতে চায় তাই হোক, মেকি না হলেই হল। ভন্ডামি ছাড়া আমি বোধ হয় আর সব সইতে পারি, ললিতা।’
‘কী জানি বাপু, আমি অত বুঝিনে। মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষের মতো না-দেখলে আমার মাথা বিগড়ে যায়।’
কুণাল বলল, ‘কল্যাণ যা বলছে তা তোমার প্রতিপক্ষের কথা নয় গো, তোমারই কথা। মেয়েমানুষ যদি খাঁটি হয় তবে মেয়েমানুষই থাকে, দেখতে যারই মতো হোক। ঘোমটার আকার মেপে যদি নারীত্ব নির্ণয় করতে হত তবে তুমিই তোমার ঠাকুরমার চেয়ে নারীত্বে খাটো হতে।’
‘যাও’, বলে ললিতা তর্কে ভঙ্গ দিল। ‘শোনো, ললিতা শোনো’, সোম তাকে ডাক দিয়ে ফিরিয়ে বলল, ‘আমার একটু উপকার করতে হবে। মায়ার সঙ্গে যাতে আমার নিভৃত আলাপ হয় তার কৌশল তোমরা চিন্তা করো। তার সঙ্গে যদি আসেন কোনো মহিলা তবে তাঁকে নিয়ে যেতে হবে ভুলিয়ে পাশের বাড়িতে। আর যদি কোনো পুরুষ আসেন তবে কুণাল যেন তাঁকে জমিয়ে রাখতে পারে।’
কুণাল বলল, ‘ওবাড়ির গল্প-দাদাকে নিমন্ত্রণ করলে ভাবনা থাকে না। ভদ্রলোক যা তিব্বতের গল্প করেন, না-শুনলে বিশ্বাস করবে না, শুনলেও বিশ্বাস করবে না।’
ললিতা বলল, ‘মায়াকে ও তোমাকে এক ঘরে রেখে যাওয়া সম্ভব হলেও সংগত কি না তাই প্রশ্ন। হয়তো তুমি আদর করে কিছু বলবে আর সে অমনি তোমার জিব উপড়ে নেবে।’
সোম বলল, ‘না, না, যতটা শুনেছ ততটা অরসিক সে নয়। রসের নিবেদন স্থান-কাল ও নিবেদকের ব্যক্তিত্ব অনুসারে সাড়া পায়। আমি পটীয়ান ব্যক্তি, আমার জিব আস্ত থাকবে, ভয় নেই।’
মায়ার সঙ্গে এল তার বোন ছায়া আর তাদের অভিভাবকরূপে এলেন তাদের বাড়ির সরকার মশাই। সরকারের যা বিদ্যার দৌড় তিব্বত তার মানসিক ভূগোলে দেশ কি পর্বত তার ঠিক নেই। গল্পদাদা তাকে বৃথাই শোনালেন যে, ‘মশাই, আমার তিব্বতি বন্ধু বিদেশে যাবার সময় তার বউমাকে আমার কোলে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ভাই এ তোমারও।’ সরকার খাপ্পা হয়ে বলল, ‘আপনি বুড়ো মানুষ, আপনার মুখে এসব কী কথা। রামঃ রামঃ।’ দাদা বললেন, ‘ওহে ওটা যে পঞ্চপান্ডব ও এক দ্রৌপদীরদেশ।’
যাহোক সরকারকে নীচে আটকে রাখা গেল। এদিকে ছায়া কি সহজে দিদির কাছ থেকে নড়তে চায়? বছর তেরো চোদ্দো বয়স তার, দিদির স্বেচ্ছাদাসী। এমন দিদি কার আছে? ললিতা তাকে পরিশেষে খোকা-কল্যাণের দ্বারা আকর্ষণ করল। খোকার কী জানি কেন তাকেই পছন্দ হল বেশি। ‘এসো, এসো, এত রোগা হয়ে গেছ কেন? তুমি বুঝি খুব পড়ো? তোমার চোখে এই বয়সেই চশমা’ ইত্যাদি পাকা পাকা কথা বলে খোকা তো নিয়ে গেল তার শাড়ি ধরে টেনে।
সোম বলল, ‘মায়া দেবী, জেলে কি আপনি সত্যি আবার যেতে চান?’
মায়া বলল, ‘কী করব বলুন। জেলের বাইরে আমি বন্দিনী, জেলেই আমি মুক্ত। বাড়িতে আমি নিজের হাতে এক গ্লাস জল খাব তার জো নেই—দশটা চাকর হাঁ হাঁ করে ছুটে আসবে। লেখাপড়া করতে চাই, দু-বেলা আধডজন প্রাইভেট টিউটার হাজিরা দেন। কোথাও যাব—সঙ্গে লোকলস্কর, হই চই উপদেশ, পরামর্শ, তোষামোদ। জেলে আমি গোটাকয়েক নিয়ম মেনে নিশ্চিন্ত, নির্ঝঞ্ঝাট।’
‘কিন্তু মায়া দেবী’, সোম ব্যথার ব্যথীর মতো বলল, ‘জেল তো কারও চিরদিনের নয়। এমন দিন আসবেই যে দিন মেয়েরা দলে দলে তীর্থযাত্রীর মতো কারার পথ ধরবেন না। তখন আপনার কী গতি হবে?’
‘সেটা ভাবিনি।’
‘সেইটে ভাবুন।’
‘দেখুন, বাইরে যতক্ষণ থাকি দেশের কত দাবি। চাই অন্ন, চাই স্বাস্থ্য, চাই মুক্ত বায়ু,—কিন্তু এ চাওয়া মেটাবে কে? আমারই কানে এসে বাজে, প্রাণে পীড়া লাগে, কিন্তু কী আমার ক্ষমতা! মোটে তো দুখানি হাত।’
সোম হেসে বলল, ‘হাত রাখেও যেমন মারেও তেমনি। দু-খানা হাত নিয়েই ইউরোপের লোক যা লড়াই করছে তা বনের চতুষ্পদের অসাধ্য। আপনি কী করবেন কে জানে।’
‘সত্যি!’ মায়া বলল, ‘ক্ষমতা যার অল্প মমতা তার বেশি হওয়া উচিত নয়—ভগবানের ভুল।’
‘ভগবান তো এও চেয়েছেন’, সোম বলল, ‘যে, মমতা যাদের বেশি তারা রইবে ঘরে আর ক্ষমতা যাদের বেশি তারা বইবে বাইরের ঝুঁকি। মেয়ে-পুরুষে ওই যে অধিকারীভেদ ওটা মানলে তো ভগবানের ভুল ধরতে হয় না।’
‘কিন্তু কই’, মায়া এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, ‘ছায়া কোথায় গেল?’
‘তিনি’, সোম বলল, ‘এখন নিরাপদ দূরবর্তিনী।’ তারপর বিনা ভূমিকায় বলল, ‘আপনার সঙ্গে আমার একটু নিভৃত আলাপের আবশ্যক আছে।’
মায়া সচকিতভাবে বলল, ‘ছায়া থাকলে ভালো হত না?’
‘কিছুমাত্র না। Two is company, three is a crowd.’
মায়া চুপ করে বসে দেয়ালে কুণাল-ললিতার ফোটো নিরীক্ষণ-করণে মন দিল।
সোম বলল, ‘মায়া দেবী, জেলে আবার নাই গেলেন?’
মায়ার চুড়িগুলো কনকনিয়ে উঠল। কিন্তু মুখ ফুটল না।
‘জেল আপনার যে কারণে ভালো লাগে ঘরও ভালো লাগবে সেই কারণে, অধিকন্তু বাইরের সঙ্গে তার যোগ থাকবে অবারিত।’
‘সে তো এখনও আছে,’ মায়া কড়াসুরে বলল।
‘এখন যা আছে,’ সোম সহিষ্ণুভাবে বলল, ‘তাতে আপনার প্রকৃত কর্তৃত্ব নেই, আছে প্রভূত মান। যা হতে পারে তা ঠিক এই জিনিস নয়।’
মায়া সশব্দে হেসে বলল, ‘সোজা কথায় বলুন। অত আকার ইঙ্গিত কেন? আমি কি কালা, না আপনি বোবা?’
‘এই তো চাই।’ সোম হৃষ্ট হয়ে বলল, ‘আমার গৃহিণী হবেন?’
‘আপনার কাছে কী পাব?’ মায়া ফস করে জিজ্ঞাসা করল।
‘আর যাই পান টাকা দিয়ে যেসব সুবিধা কেনা যায় সেসব পাবেন না।’
‘বাঁচা গেল। তারপর?’
‘পাবেন একটি পরিশীলিত বিদগ্ধ মন—বহুদেশ দর্শনে যার যাবতীয় কোণীয়তা—angularities—ঘর্ষিত হয়েছে।’
‘অমন মনের প্রতি আমার লোভ আছে। তারপর?’
‘তারপর! কী, আপনি কেবল মন নিয়ে সন্তুষ্ট নন এত বড়ো আধ্যাত্মিক দেশের নারী হয়েও!’
মায়া অপ্রতিভ হয়ে নীরব রইল।
‘জানতে যখন চাইলেন তখন শুনুন। অবশ্য না-জানতে চাইলেও শোনাতুম।’
মায়া উৎকর্ণ হয়ে আরক্তবর্ণ হল।
সোম বলল, ‘আর পাবেন একটি অনুশীলিত অভিজ্ঞ দেহ।—’
মায়া শিউরে উঠল।
‘শিউরে উঠলেন যে বীরাঙ্গনা। দেহ কথাটা এতই অশ্লীল? যদি বলতুম পাঁচ বছর ধরে অম্বলের ব্যারামে ভুগছি, এদিকে মাথাধরাও অনিত্য জীবনে নিত্য সত্য, পায়ে বাত, পিঠে বিষফোঁড়া তাহলেও তো সেই দেহের কথাই হত। কিন্তু আপনি শিউরে উঠতেন কি? ব্যাধিজীর্ণ বিষাক্ত দেহ বলিনি, বলেছি অনুশীলিত অভিজ্ঞ দেহ।’
মায়া জিজ্ঞাসা করল, ‘তার মানে?’
সোম থেমে থেমে বলল, ‘দেখুন, প্রথমে আমার কাছে সত্য করুন যে আমার মতো সামান্য প্রাণীকে—আমি ঘোড়াও নই, সার্জেন্টও নই—বাধা দেবেন না, আমার কথার মাঝখানে উঠে যাবেন না, ছায়াকে ডেকে নির্জনতাকে জনতায় পরিণত করবেন না।’
‘কী সাংঘাতিক শপথ!’ মায়া মৃদু হেসে শপথ পাঠ করল।
‘এরূপ ক্ষেত্রে করমর্দনের ও কিঞ্চিৎ পানের বিধি আছে। আপনি কি অন্তত করমর্দনও করবেন না?’
মায়া ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। সোম তাতে এমন বিপুল ঝাঁকুনি দিল যে বালাতে চুড়িতে জলতরঙ্গ বাজল।
সোম তর্জনী আস্ফালন করে বলল, ‘সত্য রক্ষা করবেন, ভুলবেন না!’
মায়া টিপে টিপে হাসতে থাকল।
‘মায়া দেবী’, সোম সাড়ম্বরে আরম্ভ করল, ‘মেয়ে-পুরুষে তফাতটা বাস্তবিক কীসে? আত্মায় নয় নিশ্চয়। আপনার আত্মা স্ত্রী-আত্মা আর আমার আত্মা পুরুষ আত্মা এ আমি অস্বীকার করি, আপনিও—’
‘আমিও অস্বীকার করি।’
‘তাহলে হয়তো মনে। কিন্তু মন তো দেহের শামিল। আমার মনটা পুরুষের মন। এর অর্থ এমন নয় যে আমার মনটা পুরুষের বলে আমি পুরুষ। এর অর্থ আমি পুরুষ বলে আমার মনটা পুরুষের। আমি পুরুষ, সে কেবল আমার দেহ পুরুষের বলে। তেমনি আপনি নারী আপনার দেহ নারীর বলে।’
মায়া আবার শিউরে উঠল। এবার অগোচরে।
‘তাহলে’, সোম বলল, ‘দেহই আমাদের ভিন্ন করেছে।’
মায়া বলল, ‘সমস্তটাকে অমন বিশ্লেষণ করা আমার মতে অনুচিত। আমি সব জড়িয়ে নারী, আপনি সব জড়িয়ে পুরুষ।’ এইটুকু বলে সে শরমে অরুণ হল।
‘আপনাকে’, সোম বলল, ‘একটু আগে আমি বলেছি আমার গৃহিণী হতে। যদি আপনি তাই হন ও আমাদের একটি সন্তান হয় তবে তার জন্মমুহূর্তে সকলে যখন জানতে চাইব খোকা হল না-খুকী হল তা নির্ণয় করবার কী উপায়?’
মায়া লজ্জায় নিরুত্তর। তার উজ্জ্বল চোখ দুটি দিয়ে চুরি করে চেয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। কিন্তু কেউ আড়ি পেতে শুনল কি না কে জানে।
সোম হাসিমুখে বলল, ‘আর একটা উদাহরণ দিই। মা-বাপ যখন স্থির করেন যে এই বেলা বিয়ে না-দিলে নয়, মেয়ে সেয়ানা হয়েছে, নইলে লোকে নিন্দে করবে তখন কি পিতামাতা বা সমাজ কন্যার আত্মার পরিণতি পরখ করেন? আত্মা তো অজরামর। না মনের পরিণতির খবর নেন? বর্ণপরিচয় পড়া বোকা মেয়ের বাপ ও ম্যাট্রিক পাস করা বুদ্ধিমতীর বাপ কেউ কি কারুর চেয়ে কম ভাবনায় পড়েন মেয়েকে পাত্রস্থ করা নিয়ে? বিয়েটা তো আগে হয়ে যাক, তারপর যতখুশি পাস করুক, একথা কি যত্রতত্র শোনেননি, মায়া দেবী?’
মায়া মুচকে হেসে বলল, ‘শুনেছি।’
‘তবে?’ সোম জয়ের গর্বে বলল ‘তবে? আমার দেওয়া দুটো দৃষ্টান্ত মিলিয়ে ধরুন। স্ত্রী পুরুষকে জন্মকালে ভিন্ন করে দিল প্রকৃতি—কীসের দ্বারা? না দেহের দ্বারা। যৌবনকালে যুক্ত করে দিল সমাজ—কীসের দ্বারা না দেহেরই দ্বারা। জন্মত আমরা স্ত্রী এবং পুরুষ না-হলে বিবাহের কি কোনো আবশ্যকতা থাকত, না সম্ভাব্যতা থাকত? আর স্ত্রী ও পুরুষ হয়ে যে জন্মিয়েছি তার নিদর্শন আমাদের আত্মায় আছে, না মনে আছে?’
মায়া ভাবতে লাগল আনত আননে।
‘ভাবছেন কি মায়া দেবী’, সোম বলল। ‘নিন একটা সিগ্রেট নিন। নেবেন না? বিলিতি নয়, ইটালিয়ান। দোষ হবে না।’
মায়া দৃঢ়ভাবে বলল, ‘না।’
‘না? চাও খাবেন না, সিগ্রেটও না। অতিথি হিসেবে আপনি অতি নির্দয়। আপনাকে দিতে পারি এমন খাদ্য আর কী আছে—এক আছে ‘চ’ দিয়ে আরম্ভ দুই অক্ষরের শব্দ, অথচ ‘চড়’ নয়।’
মায়া কোপদৃষ্টি হানল। সোম ভুরু উঁচিয়ে জিব কাটল।
‘কিন্তু,’ সোম বলল, ‘আমার কথাটি ফুরোয়নি, নটে গাছটি মুড়োয়নি। বলছিলুম দেহ শব্দের মানে। আশা করি বুঝেছেন যে দেহের মানে বিয়ের একমাত্র উপকরণ।’
‘বুঝেছি,’ মায়া বলল। ‘কিন্তু মানিনে।’
‘জানিনে আপনি কী মানেন। হয়তো অলংকার, হয়তো বস্ত্র, হয়তো সানাই, হয়তো মন্ত্র।’
‘এগুলোর কোনোটা নয়।’
‘তবে?’
‘মনের মিল।’
‘ওইটে,’ সোম বলল, ‘আধুনিকদের কুসংস্কার। মনের মিলই যদি বিয়ের কারণ হয় তবে চোখের আড়াল হলে এত বেদনা কেন? বিরহ তবে নিরর্থক। মনের মিল বিয়েরই বা কারণ হবে কেন? দুই পুরুষ বন্ধুতে দুই মেয়ে বন্ধুতে মনের মিল লক্ষ করা যায়।’ তারা কি বিয়ে করে?
মায়া পরাজিত হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।
তার আর ভালো লাগছিল না এই বক্তৃতা, কিন্তু কথা দিয়েছে সবটা শুনবে।
বিজেতা বলল, ‘দেহ, দেহ, দেহ। সংস্কৃত কবিরা তা মানতেন। আপনি কবি না হতে পারেন কিন্তু সংস্কৃত হবেন না কেন? সংস্কৃত হয়েও আধুনিক থাকা যায়।’
বিজিতা বলল ‘আমি উঠি?’
‘না, না, বসুন। এখনও একটা শব্দের মানে বলা হয়নি।’
‘অভিজ্ঞ দেহ’। দেহের মানে বলেছি। বাকি আছে অভিজ্ঞ।’
মায়া মনোযোগ করল।
‘দেহই যখন উপকরণ তখন সব জিনিসের মতো তার ইতরবিশেষ আছে। অভিজ্ঞ দেহ দেহান্তরকে কোমল লীলার সহিত ধারণ করে, যেমন গুণীর হাত ধরে বীণাকে। অভিজ্ঞের স্পর্শ নিশ্চিত, অকম্পিত, স্বচ্ছন্দ। অভিজ্ঞ হচ্ছে রসোত্তীর্ণ, তার লোভ নেই, উদ্বেগ নেই, শঙ্কা নেই। সে ভুল করে না। সে জানে, বোঝে, ক্ষমা করে।’
মায়া ব্যঙ্গ করে বলল, ‘আমি জানলুম না, বুঝলুম না, ক্ষমাও করলুম না। কী আবোল-তাবোল বকছেন, মিস্টার সোম? আমি উঠি।’
সোম রহস্য করে বলল, ‘তার থেকে ধরা পড়ল আপনি অনভিজ্ঞ।’
‘বেশ, আমি অনভিজ্ঞ। আমরা বিলেতও যাইনি, অভিজ্ঞ হইনি। তা নিয়ে উপহাস করতে চান, করুন বসে। আমি কিন্তু উঠি।’
‘আরে, আরে, ভালো করে না-শুনে, না-বুঝে অমনি রাগ করা হল। অহিংস অসহযোগীদের কি রাগ করা সাজে? বসুন, মায়া দেবী, বসুন।’
ছায়া অনেকক্ষণ গেছে, ফিরছে না কেন? সরকার মশাইয়ের দরকার মায়াকে ওঠাবার তাগাদা দেওয়া, কিন্তু তিনি তিব্বতের গল্প শুনে চীনের সেচুয়ান প্রদেশের বিপ্লব কাহিনিতে মনোনিবেশ করেছেন। একজন মুসলমান বণিক তাঁর একমাত্র কন্যা ও বহু সহস্র স্বর্ণমুদ্রা সমেত গল্পদাদার Consulate-এ উপস্থিত হয়ে বললেন, জনাব, জান বাঁচান। অবশ্য চীনা ভাষায়। যেহেতু মুসলমানটি হিন্দুস্থানের নন, চীনের। দাদা তাঁদের দুজনকে ও তাঁদের সোনার ঘড়াগুলিকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখলেন যে চীনে ব্যাটারা তাঁর দাড়িটি দেখতে পেল না। বিপ্লবের অন্তে বণিক বলললেন, সাহেব,—দাদার তখন সাহেবি পোশাক, Consulate এর বড়োবাবু—যে উপকার করলেন তার বিনিময়ে আপনাকে কী দেব? দাদা বললেন, কিছুই দিতে হবে না। বণিক বললেন, তা কি হয়? আপনি আমার এই কন্যারত্নটিকে গ্রহণ করে তার সঙ্গে আমাকে ও আমার সোনার ঘড়াগুলিকে হিন্দুস্থানে নিয়ে চলুন; চাকরি আপনাকে করতে হবে না। দাদা হচ্ছেন গোঁড়া কায়স্থ, এখন যেমন, তখনও তেমনি। বণিককে বললেন, আমার যে দেশে একটি আছেন। বণিক দাড়ি নেড়ে বললেন, অধিকন্তু ন দোষায়—অবশ্য দেবভাষায় নয়। বণিক এবং বণিককন্যা দুজনেই দাদাকে কত কাকুতিমিনতি করলেন, কিন্তু দাদার নামগৌরীশংকর।
সরকার মশাই বললেন, ‘মশাই, অতগুলো টাকা!’
‘কেন আপনার আফশোস হচ্ছে নাকি?’
‘হবে না? বিয়ে না-করলেন, রাখতেও তো পারতেন।’
‘ওরে বাপরে! কোন দিন জল তেষ্টায় অন্ধ হয়ে তার হাতে জল খাই আর ফুড়ুত করে জাতটি উড়ে যাক! আমার বাপ-মা-কে গয়ায় পিন্ডি দেবে কে? আপনি?’
কোন কথা থেকে কোন কথা উঠল। কুণাল হল যারপরনাই লজ্জিত।
হঠাৎ একটা গুরুভার পতনের শব্দ শুনে সরকারের হল কম্প, দাদা দিলেন লম্ফ। কুণাল ক্ষণবিলম্ব না-করে উপরে ছুটল। ‘কী হল,’ ‘কী হল’ বলে ওদিক থেকে ললিতা ছায়া ও পাশের বাড়ির জন কয়েক বেরিয়ে এলেন।
কুনাল দেখল সোমের চেয়ারটা চারটে পায়া তুলে দিয়ে ছটফট করছে, সোম ডিগবাজি খেতে খেতে দূরে গিয়ে পড়ছে। মেঝেতে কয়েক ফোঁটা রক্ত। মায়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে খোলা চোখে ধ্যান করছে।
কুণাল সোমকে উঠিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কী হয়েছে, কল্যাণ? কী হয়েছে?’
সোম কথা বলতে পারছিল না। মায়ার দিকে তাকিয়ে কষ্টের হাসি হাসল।
‘কী হয়েছে, কল্যাণদা, কী হয়েছে?’ একই প্রশ্ন ললিতার মুখে।
সোম মাথা নেড়ে জানাতে চাইল কিছুই হয়নি।
পাশের বাড়ির মহিলারা বললেন, ‘ওঁকে ও-ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিন, ডাক্তারের জন্যে আমরা ফোন করছি।’
ছায়া দিদির কাছে গিয়ে দিদির গা ঘেঁসে দাঁড়াল। দিদি বলল, ‘চল, যাই।’
ললিতা কতকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। গম্ভীরস্বরে মায়াকে বলল, ‘ও কী! কিছু মুখে দিয়ে যাবেন না?’
মায়ার রাগ হচ্ছিল ললিতার উপর, সে কেন মায়াকে সোমের সঙ্গে একা রেখে গেল। উত্তর দেওয়া প্রয়োজন বোধ করল না। তরতর করে নেমে গিয়ে মোটরে চেপে বসল। ছায়া ললিতাকে নমস্কার করল। বলল, ‘আসবেন একদিন আমাদের ওদিকে।’ খোকা-কল্যাণকে চুমু খেয়ে বলল, ‘তুমিও এসো, জ্যাঠামশাই।’
গাড়ি যখন চলল ছায়া জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদি, কী হয়েছিল বলো তো?’
‘কিছু না।’
‘কিছু হল না তো মিস্টার সোম গড়াগড়ি যাচ্ছিলেন কেন?’
‘আমি জানিনে। তুই ছেলেমানুষ, তোর জানবার দরকার?’
‘ছেলেমানুষ বই কী। তুমি ওঘরে ছিলে, তুমি জানো না কী রকম।’
‘বেশ জানি তো জানি। তুই আমাকে জেরা করবার কে?’
‘বলো না ভাই, লক্ষ্মীটি।’
মায়া দৃঢ়তার সহিত বলল, ‘না।’
ছায়া যদি চুপ করল সরকার মশাই মুখ খুললেন। ‘কীসের শব্দ রে, মা? আমি তো ভাবলুম বোমা ফাটল না-কী হল।’
মায়া বলল, ‘মিস্টার সোম চেয়ারশুদ্ধ পড়ে গেলেন, তারই শব্দ, সরকার কাকা।’
‘আহা। পড়ে গেলেন। লাগেনি তো?’
‘যার লাগে সেই জানে। আমি কেমন করে বলব?’
‘আহা! বড়ো ভালো ছেলেটি।’
‘ভালো না আর কিছু।’
সরকার মশাই চুপ করলেন।
ওদিকে গল্পদাদা কুণালকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘চোট লাগেনি তো?’
‘লেগেছে একটু।’
‘পরিতাপের বিষয়। আমারও একবার অমন হয়েছিল। আমি তখন সিকিমে। চেয়ারে বসে চিন্তা করছি। পা দুটি দিয়েছি তুলে টেবিলের উপর। একটু দোল খাচ্ছি পা দিয়ে টেবিলটাকে ঠেলে, চেয়ারের পিছনদিকের পায়া দুটোর উপর ভর দিয়ে। দোল খাচ্ছি আর ভাবছি। ভাবছি আর দোল খাচ্ছি। আরাম লাগছে। হঠাৎ শুনি দুড়ুম করে একটা আওয়াজ। বন্দুকের নয়। চেয়ারের। আমার পিঠটা ফুটবলের মতো ঢপ করে পড়ল, আবার উঠল, আবার পড়ল। পা দুটো বাদুড়ের মতো উপরের দিকে তোলা। নামল যখন, তখন আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলুম আমি উঠে দাঁড়িয়েছি ডিগবাজি খাওয়া জাপানি পুতুলের মতো।’
দিন দুই পরে সোম মাথায় ফেটি বেঁধে অর্ধশয়ান অবস্থায় কুণাল ও ললিতাকে বৃত্তান্তটা আনুপূর্বিক শোনাচ্ছিল।
ললিতা শুনে বলল, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল। আমি কি তোমাকে সাবধান করে দিইনি?’
সোম বলল ‘আমি তো ওকে আদরের কথা বলিনি, আদরও করিনি। আমি বলছিলুম নারীদেহ আমার নিকট অজ্ঞাত রাজ্য নয়, আমি দেশাবিষ্কারক, explorer. অমনি আমার কপাল টিপ করে নারীহস্তের অশিক্ষিতপটু এক ঘুষি। দেশ আবিষ্কারক আমি ভূপৃষ্ঠ আবিষ্কার করলুম।’
‘বেশ হয়েছে।’—বলল ললিতা।
‘তুমি সবাইকে নাকাল করলে, কিন্তু মায়া তোমাকে হাটিয়ে দিল।’—বলল কুণাল।
‘ইংরেজের ইতিহাস’, সোম বলল, ‘তুমি পড়েছ ও পড়িয়েছ। তার কোনোখানে দেখেছ যে ইংরেজ কোনো যুদ্ধে হেরেছে? আমিও তেমনি অপরাজিত। মায়ার হাতের মার তো আমার জয়ের মালা। হার যদি তাকে বলো, তবে সে আমার সোনার হার।’
‘তুমিও ওরকম হার পরবে কি গো?’ ললিতা শুধাল তার স্বামীকে।
‘প্রিয়ে তোমার কাছে যে হার মানি সেই তো আমার জয়।’ কুণাল দিলীপকুমার রায়ের শরণ নিল।
‘কিন্তু মায়া তো দাদার প্রিয়া নয়’, বলল ললিতা।
‘কেন নয়?’ বলল সোম।
‘সবে দুবার দেখা—তাতেই এত?’
‘প্রেম কি দুবার দেখার অপেক্ষা রাখে? Whoever has loved that has not loved at first sight? আমার তৃতীয়ার কাহিনি তো জানো। দেখা না হতেই প্রেমের পরাকাষ্ঠা।’—অথ সোম।
‘বরং বলো দেখা না হয়েই প্রেমের পরাকাষ্ঠা, দেখা হলে প্রেমের প্রতিপরাকাষ্ঠা, anticlimax’—অথ কুণাল।
‘তাহলে মায়া তোমার প্রিয়া। কয় নম্বর?’ শুধাল ললিতা।
‘পাগল?’ বলল সোম। ‘আমি কি এতবার ঠেকে এইটুকু শিখিনি যে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে বিয়ে করা যায় না, যাকে বিয়ে করা যায় তাকে ভালোবাসা যায় না।’
কুণাল ও ললিতা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মনে আঘাত লাগল। সোম বুঝল।
বলল, ‘তোমরা যদি বিয়ের খাঁচায় ভালোবাসাকে পুষতে পারো, বন্ধু, তবে তোমরা অসাধ্য সাধন করলে, তোমরা মানবকুলের নমস্য। আমি প্রেমের সঙ্গে বিবাহের সংগতি কোনোমতেই ঘটাতে পারলুম না বলে ওদুটোর একটাকে বেছে নিয়েছি—বিবাহকে! তাই সুলক্ষণাই বলো মায়াই বলো যাদের প্রতি খুব সম্প্রতি আমার হৃদয়ে আবেগ অনুভব করেছি তারা আমার নায়িকা নয়, তারা আমার সম্ভবপর জায়া। সে হিসেবে তারা অমিয়া, কি প্রতিমা, কি শিবানীর থেকে শ্রেষ্ঠ নয়।’
‘দাদা দেখছি নির্বিকার ব্রহ্ম হয়েছেন’, টিপ্পনী কাটল ললিতা।
‘তুমি ওকে সত্যি নির্বিকার ভেবো না’, কুণাল ললিতাকে সতর্ক করে দিল। ‘ওর ওই পণটি, ওটির ভিতরে নির্বাচনের ইঙ্গিত রয়েছে। কোন মেয়ে ওর পণ শুনে ওকে সহজ মনে বিয়ে করবে বল? প্রায় মেয়েই বিকার বোধ করবে, কেউ ওকে ঘটা করে ক্ষমা করতে চাইবে, কেউ শাসিয়ে বলবে আর অমন কাজ কোরো না, কেউ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলবে, পুরুষমানুষ তো? আর কত হবে! হাজারের মধ্যে হয়তো একজন ওকে ভালোবাসবে, ভালোবাসবে ওর দেহকে, বিকারের পরিবর্তে পুলক বোধ করবে, দেহের ইতিহাস মনে রাখবে না। পরের দেহকে যে মেয়ে ভালোবাসতে জানে সে-মেয়ের আপন দেহ স্বাস্থ্যবান, শুচি ও সুশ্রী না হয়ে পারে না, কল্যাণও তার দেহকে অবলম্বন করে তাকে ভালোবাসবে। বিবাহ সেই ভালোবাসাকে কেন যে ঘুম পাড়াবে তার সংগত হেতু নেই, বিবাহ তাকে জাগিয়েই রাখবে, কেননা বিবাহ মানে তো সঙ্গ? অঙ্গের পক্ষে সঙ্গই সর্ব।’
কুণালের আজ মন খুলে গেছল। মনের বাহন মুখ। কুণাল বলতে লাগল, ‘বাল্মীকির প্রথম শ্লোক স্ফূর্ত হয়েছিল কীসের সমবেদনায়? সঙ্গচ্যুতির। বিরহ যেক্ষেত্রে কেবল উদ্বেগ আনে—প্রিয়জন যথাসময়ে আহার করছেন কি না, প্রিয়জনের হঠাৎ অসুখ করল বুঝি, প্রিয়জন না-জানি কত অসুবিধা ভোগ করছেন—সেক্ষেত্রে তার মতো হাস্যকর আর কী আছে?’
‘বাহবা, বন্ধু বেশ।’ সোম হেসে বলল, ‘তোমাকে তো নেহাৎ ভালো মানুষের মতো দেখায়, তুমি এত কথা শিখলে কোথায়? ও যে আমার কথা।’
‘হয়তো তোমারই কাছে শুনেছি ছাত্রকালে।’ কুণাল বলল নম্রভাবে।
ললিতা লজ্জায় গম্ভীর হয়ে গেছল। তার ভালোবাসাকে সে কোনোদিন বিশ্লেষণ করেনি। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরোবে এইরকম একটা আশঙ্কা তার অবচেতনায় অবস্থিতি করছিল। দেহ মানুষের চিরদিন সতেজ থাকে না, আধি আছে ব্যাধি আছে দারিদ্র্য আছে অনশন আছে। তাকে প্রেমের ভিত্তি করলে প্রেম একদিন টলবে। প্রেম অর্থে অসীম মমতা, অনন্ত সহিষ্ণুতা, অখন্ড ধৈর্য, অবিরত স্বার্থত্যাগ। এই তো ছিল তার ধারণা। স্বামীর মুখে অন্যরূপ ব্যাখ্যা শুনে সে লজ্জায় বাক্যহারা হয়েছিল।
সোম বলল, ‘এই দু-দিন ভেবে কী ঠিক করেছি জানো?’
কুণাল বলল, ‘থট রিডিং তো শিখিনি, অপরের ভাবনা কী উপায়ে জানব?’
সোম ঘোষণা করল, ‘তবে শোনো। আমি পাঁচ বছরের জন্যে লোকান্তরিত হব।’
কুণাল ও ললিতা সচমকে বলল, ‘কী! কী!’
‘ভয় নেই’, সোম আশ্বাস দিল, ‘আত্মহত্যা যে নয় তা পাঁচ বছর পরে জানতে পাবে। আত্মগোপন।’
‘না?’ কুণাল বলল অবিশ্বাসের স্বরে।
‘অসম্ভব’, ললিতা বলল প্রত্যয়ের ভরে।
‘কঠিন কিছু নয়। পাঁচ বছর তোমরা আমার ঠিকানা পাবে না, চিঠি পাবে না—এই তো ব্যাপার। আমার কথা যদি জিজ্ঞাসা করো আমি সভ্যতার আসল ও নকল দুইই দেখেছি, দেখে মরিয়া হয়ে উঠেছি। ‘Good-bye to Civilisation’ বলতে পারবার সামর্থ্য নেই, তাই পাঁচ বছরের জন্যে বলছি ‘পুনর্দর্শনায় চ।’
‘তুমি কি সত্যি বনে যাবে?’ শুধাল কুণাল।
‘সে কিছুতেই হতে পারে না,’ জবাব দিল ললিতা।
‘বাবাকে লিখো আমি গঙ্গায় ডুবে মারা গেছি, আমার শব উদ্ধার করতে পারা যায়নি।’ সোম বলল।
‘কিন্তু তুমি যাবে কোথায় শুনি? সুন্দরবনে?’
কুণালের এই জিজ্ঞাসার উত্তরে সোম জানাল যে, ‘যাবে সাঁওতাল—কোল-ভীল-কুকি-নাগা-জৈন্তিয়া-খাসি-চাকমা-গারো খোন্দ গোন্দ জুয়াঙ্গদের ট্রাইবে স্ত্রীরত্নের অন্বেষণে। পাঁচ বছর পরে যখন সে ফিরবে তখন তাকে জীবিত দেখে তার বাবা এত উল্লসিত হবেন, যে তার অর্ধাঙ্গিনীর জন্মপরিচয় সন্ধান করবেন না।’
‘অতিরিক্ত আনন্দবাজার,’ ‘টেলিগ্রাফ, বাবু, নয়া টেলিগ্রাফ,’ ‘তাজা খবর। গান্ধীমায়ী গ্রেপ্তার।’
কুণাল একখানা কিনল। বেচারা দেশের জন্যে ত্যাগ করবার মধ্যে করছে সকাল বেলা দুটি ও বৈকালে কোনো কোনো দিন একটি পয়সা।
কুমারী মায়া মল্লিক। আবার ছয় মাস। ‘এ’ ক্লাস কয়েদি। মায়া মল্লিকের অস্পষ্ট প্রতিকৃতি। মায়া মল্লিকের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। সেই ছুটন্ত ঘোড়ার সম্মুখে ঝাঁপ দিয়ে লাগাম ধরার বিবরণ। এবার কিন্তু ওসব কিছু নয়। ডিক্টেটার হয়ে ঘরে বসে গ্রেপ্তার ১৯৩৩।