মনু নদীর তীরে মাঝারি আকৃতির একটা লঞ্চ বাঁধা আছে। লঞ্চের নাম এমভি সওদাগর।
অন্য লঞ্চগুলির সঙ্গে এই লঞ্চের কিছু অমিল আছে। এর ডেকে সস্তা ধরনের কিছু সোফা বিছানো। সোফাগুলি নোংরা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। লঞ্চের ছাদেও সোফা বিছানো। সোফার সঙ্গে বিশাল আকৃতির দুটি কোলবালিশসহ জাজিম বিছানো। হলুদ রঙের ত্রিপল দিয়ে সোফা জাজিম সবই ঢাকা। লঞ্চের জানালাগুলি কটকটে সবুজ রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। সারেং-এর জানালার ঠিক নিচে ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা প্রাইভেট। ইংরেজি বানানটা ভুল। সেখানে লেখা–PRIVAT।
লঞ্চ মালিকের নাম বশির মোল্লা। এটা তার লাইনের লঞ্চ। তার যখন ফুর্তি করার ইচ্ছা হয় তখন তিনি লাইনের একটা লঞ্চে প্রাইভেট সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। দ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশ। জীবনের বড় একটা অংশ ফুর্তিতে কাটিয়েছেন। চেহারায় ফুর্তির স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে।
ইবাদত নগরে তিনি এসেছিলেন মনু নদীর ব্রিজ বানানো দেখতে। লোকমুখে শুনেছিলেন দেখার মতো দৃশ্য। বিরাট হুলস্থূল। স্বচক্ষে দেখে তিনি মর্মাহত। নদীতে পাইলিং করা হচ্ছে। ধুমধাম ধুপুস ধাপুস শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মাথা ধরে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন–শুয়োরের বাচ্চারা কী শুরু করেছে? তার নির্দেশে লঞ্চ অতি দ্রুত সরিয়ে এমন জায়গায় নেয়া হলো যেখানে শব্দ আসে না। সেটা আরেক যন্ত্রণা। লোকালয়ের বাইরের এক জায়গা। গাছগাছালিতে ভরা নদীর পাড়। রাজ্যের পাখি গাছে গাছে কিচমিচ করছে। এদের ক্যাচক্যাচানি পাইলিং-এর শব্দের মতোই যন্ত্রণাদায়ক। পাখিদের ক্যাচক্যাচানি বন্ধ করার জন্যে তাঁর নির্দেশে কয়েকবার ফাঁকা ফায়ার করা হয়েছে।
বশির মোল্লার লাইসেন্স করা দুটি বন্দুক আছে। একটা বিলাতি উইন্ডসর কোম্পানির। আরেকটা জার্মানির দুনলা বন্দুক। বিনা লাইসেন্সের একটা পিস্তলও আছে। পিস্তলটা থাকে তাঁর বালিশের নিচে।
ইবাদত নগরে এসে তিনি ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়েছিলেন। সার্কাস দেখার পর বিরক্তি পুরোপুরি চলে গেছে। সার্কাসের তিনটি মেয়েকেই তার পছন্দ হয়েছে। সবচে বেশি পছন্দ হয়েছে ছোটটিকে। মেয়েটির বিষয়ে কী করা যায় সেটা ঠিক করার জন্যে তিনি সার্কাস কোম্পানির ম্যানেজারকে খবর পাঠিয়েছেন। ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। এটা ভালো লক্ষণ। বশির মোল্লা মোটামুটি নিশ্চিত যে ধানাই-পানাই করে বেশি সময় নষ্ট করতে হবে না। অল্প সময়েই কার্যোদ্ধার হবে। তিনি জীবনে নানান ধরনের মেয়ের সঙ্গে ফুর্তি-ফার্তা করেছেন। সার্কাসের কোনো মেয়ের সঙ্গে করা হয় নাই। দড়ির উপর যে মেয়ে নাচানাচি করে সে আর দশটা মেয়ের মতো হবে না এটা নিশ্চিত। ফুর্তির নতুন বিষয় মাথায় আসার পর থেকে বশির মোল্লার ভালো লাগছে। পাখির ক্যাচক্যাচানিও এখন আর তত খারাপ লাগছে না। সার্কাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা চিন্তা তাঁর মাথায় চলে এসেছে। তিনি তাঁর শরীরে উত্তেজনা অনুভব করছেন।
আপনে সার্কাসের ম্যানেজার?
জি।
ঘোড়া নিয়া রঙ তামাশা আপনে করেন?
জি।
সত্য সত্যই কি ঘোড়াকে বিবাহ করেছেন? আপনার শরীর থেকে ঘোড়ার গন্ধ আসতেছে। রাগ করেছেন না-কি? আমিও একটু রঙ তামাশা করলাম।
আপনি আমাকে কী জন্যে খবর দিয়ে এনেছেন বললে ভালো হয়।
বলব, এত ব্যস্ত কেন?
আমার মালিক অসুস্থ, উনারে দেখতে যাব।
আপনি তো ডাক্তার না। আপনার দেখা না-দেখা সমান। আপনার নাম কী?
তৈয়ব আলী।
ও আচ্ছা, আপনি মুসলমান? আপনার হিন্দু হিন্দু চেহারা। আপনি মনে হয় গো-মাংস খান না। যারা গো-মাংস খায় না তাদের চেহারার মধ্যে হিন্দু হিন্দু ভাব চলে আসে। আপনি গো-মাংস খান?
খাই।
আরো বেশি করে খাবেন। মদ্যপান করেন?
জি-না।
মদ্যপান করেন না কী জন্যে? ধর্মীয় কারণে?
অভ্যাস নাই।
অভ্যাস না থাকলে অভ্যাস করতে হয়। জন্ম থেকে কেউ অভ্যাস নিয়া আসে না। মেয়েছেলের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস আমাদের থাকে না। পরে অভ্যাস হয়। তাদের বিছানায় নিয়ে যাই। আমার কাছে বিদেশী হুইস্কি আছে। নেন, আধা গ্লাস খান। মদ যারা খায় তাদের মধ্যে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হয়। আপনের সঙ্গে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হওয়া দরকার।
কেন?
আপনার সার্কাসটা আমি কিনে নিতে চাই। নগদ টাকায় কিনব। আমার যৌবনের সামান্য অভাব আছে, টাকার অভাব নাই। ভাটি অঞ্চলে আমার সাতটা জলমহাল আছে। সিজনে দৈনিক মাছ বিক্রি বাবদ লাখ টাকা মুনাফা থাকে।
সার্কাস আমার না। আমার মালিকের। সার্কাস কিনতে চাইলে মালিকের সাথে কথা বলবেন।
ব্যবসা নিয়া আমি বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলি না। এক দুইজনের সঙ্গে কথা বলি। আপনের সঙ্গে বললাম আপনি আপনার মালিকের সঙ্গে কথা বলবেন।
কী কথা বলব?
আরে যন্ত্রণা, এতক্ষণ ভেরভের করে কী বললাম? আমি সার্কাস কিনে নিব। আপনি দালালি করবেন। দালালির টাকা পাবেন।
আমার মালিক সার্কাস বেচবে না।
অবশ্যই বেচবে। কেন বেচবে না? ভালো দাম দিলেই বেচবে। ধরেন আপনার একটা শার্ট আছে। শার্টের দাম ২০০ টাকা। আমি যদি বলি আমি দুই হাজার টাকা দিব, আপনার পুরনো শার্ট আমার কাছে বেচে দেন। আপনি বেচবেন না?
আমার শখের শার্ট হলে আমি বেচব না।
তখন আমি বলব আমি বিশ হাজার টাকা দিব। দুইশ টাকা দামের শার্ট, আমি দিব বিশ হাজার টাকা। এখন তো বেচবেন? ব্যবসা বাণিজ্যের লাইনে কথা বলেন। ভাবের লাইনে না। ব্যবসা বাণিজ্যে ভাব চলে না।
সার্কাসের দল দিয়ে আপনি কী করবেন?
কী করব সেটা আমার বিবেচনা। আমার নিজের একটা যাত্রার দল আছে। নাম সুন্দরী অপেরা। তারা নিজের মনে সারা দেশে পাট গায়। কী টাকা পায়, কী না পায় এটা নিয়ে আমি ভাবি না। যাত্রা দল আমি যেভাবে কিনেছি সার্কাসও সেইভাবে কিনব। যাত্রার দল কেন কিনেছিলাম বলব?
বলুন।
সুন্দরী অপেরার একটা পালা দেখে মন উদাস হয়েছিল। যে মেয়েটা নায়িকার বোন করেছিল সে ছিল সাক্ষাৎ বিউটি। তার নাম হেনা। মাঝে মাঝে আমার মন যদি উদাস হয় তখন খবর দিয়া যাত্রার দল নিজের কাছে নিয়া আসি। হেনারে বলি, পাট গাইয়া শোনাও। সে পাট গায়।
সার্কাস কিনতে চাচ্ছেন কেন? সার্কাসের কাউকে মনে ধরেছে?
দড়ির খেলা যে দেখায়েছে এদের প্রত্যেকটারে মনে ধরেছে। বিশেষ করে ছোটটারে। আচ্ছা ছোট মেয়েটার নাম নাকি পয়সা, এটা কি সত্য?
হ্যাঁ সত্য।
পয়সা যার নাম সে তো থাকবে আমার সাথে। টাকা পয়সা বশির মোল্লার কাছে না থাকলে কার কাছে থাকবে বলেন?
স্যার, আজ আমি উঠি।
উঠতে চাইলে উঠেন। আপনের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি এই জন্যে সামান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে।
বশির মোল্লা বালিশের নিচে থেকে একশ টাকার একটা বান্ডিল বের করল। এমনভাবে বের করল যেন পিস্তলটা দেখা যায়। তৈয়ব শুকনা গলায় বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না।
বশির মোল্লা বিরক্ত গলায় বলল, আমারে না কথাটা বলবেন না। না শুনতে আমার ভালো লাগে না। এইখানে দশ হাজার টাকা আছে। টাকাটা রাখেন। সন্ধ্যাকালে আবার আপনার সাথে দেখা হবে।
আবার দেখা হবে কেন?
পয়সা মেয়েটারে মেডেল দিব ডিক্লেয়ার দিয়েছি। মেডেল দিব না? স্বর্ণকারের দোকানে লোক চলে গেছে। দুই ভরি ওজনের মেডেল। মেডেলের সাথে টাকার পরিমাণ আগে বলেছিলাম এক হাজার, এখন এটারে বাড়ায়ে করেছি দশ হাজার। এক হাজার টাকা দিলে বশির মোল্লার মান থাকে না। আপনের নামটা ভুলে গেছি। আপনার কী যেন নাম?
তৈয়ব।
পাখির ক্যাচক্যাচানি শুনতেছেন?
কীসের ক্যাচক্যাচানি?
পাখির।
জি শুনতেছি।
ক্যাচক্যাচ শব্দটা এক্কেবারে মাথার ভিতরে ঢুকে। এরা এমন ত্যক্ত করে। ঐ, পাখির ক্যাচক্যাচানি থামাও।
বশির মোল্লার কথা শেষ হবার আগেই লঞ্চের ছাদ থেকে দোনলা বন্দুকের আওয়াজ হলো। তৈয়ব বুঝতে পারছে বন্দুকের শব্দ পাখিদের শুনানোর জন্যে না। তাকে শুনানোর জন্যে।
হারুন সরকার হাসপাতালের বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে। তার মাথা ঘুরছে, শরীর এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে যাবে। সেই পড়াই হবে শেষ পড়া। আর উঠা যাবে না। মৃত্যু হবে নিতান্তই অপরিচিত ফিনাইলের গন্ধ মাখা বিছানায়। তারপরও হারুন সরকার চেষ্টা করছে মুখ হাসি হাসি রাখার। ভাবটা এরকম যেন সে ভালো আছে। বেশ ভালো। এরকম ভাব দেখানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কারণ সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার চেষ্টায় আছে। সারাদিন ফিনাইলের গন্ধের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে। সন্ধ্যার পর জিনের বোতল নিয়ে বসা যাবে না–এটা ভেবেই তার শরীরে ছটফটানি চলে আসছে। তার মন বলছে বেশি করে তেঁতুল দিয়ে দুগ্লাস জিন খেলেই শরীরে চনমনে ভাব চলে আসবে।
ডাক্তারের সঙ্গে সকালবেলা হারুন সরকার রিলিজ নিয়ে কথা বলেছে। ডাক্তার হতভম্ব মুখ করে বলেছে–আপনি রিলিজ নিতে চান? আপনি জানেন আপনার প্রেসার কত? পালস রেট কত? চোখ গাঢ় হলুদ হয়ে আছে। আমার ধারণা আপনার খারাপ ধরনের জন্ডিস হয়েছে।
হারুন সরকার মিনমিন করে বলেছে, হাসপাতালে থাকলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।
কেন?
হারুন সরকার চুপ করে গেল। ডাক্তার এবং পুলিশ এই দুই জাতির কাছে তারা যা বলে সেটাই শুদ্ধ। এদের সঙ্গে তর্কে যাওয়া বৃথা। এখন এক মাত্র ভরসা তৈয়ব। একমাত্র সে-ই পারবে তাকে এই জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে যেতে।
বসে আছেন কেন? শুয়ে থাকুন। রেস্ট নিন।
হারুন সরকার ডাক্তারের কথা শুনল না। বসে রইল। রাগে মুখের ভেতর ফেনা জমে যাচ্ছে। ফেনার স্বাদ তিক্ত। লক্ষণ ভালো না। মৃত্যুর আগে আগে মুখের ভেতরে তিতা ভাব চলে আসে। রসগোল্লা খেলেও মনে হয় রসে ডুবানো তিতা করলা খাওয়া হচ্ছে।
তৈয়বের উপর প্রচণ্ড রাগ লাগছে। ছাগলটা কখন আসবে? হারুন সরকারের মৃত্যুর পরে আসবে জানাজা পড়াতে। এইসব অকর্মণ্য ছাগলগুলিকে লাথি মেরে বার্মা পাঠিয়ে দেয়া দরকার। মিলিটারিদের গুতা খেয়ে মরুক। হারুন সরকার মনে মনে ঠিক করে ফেলল তৈয়ব যদি দুপুরের খাওয়ার আগে না আসে তাহলে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চাকরি তার শেষ। প্রয়োজনে হারুন সরকার হাট থেকে একটা বুড়া ভেড়া কিনে আনবে। ভেড়াকে ম্যানেজারের চাকরি দেবে কিন্তু তৈয়বকে রাখবে না। তৈয়বের দিন শেষ।
দুপুরের খাওয়ার সময় শেষ হলো, তৈয়ব এলো না। হারুন সরকার সময় আরেকটু বাড়াল–আছর ওয়াক্তে এলেও চাকরি থাকবে। তৈয়ব এলো আছর পার করে। হারুন সরকার বলল, এতক্ষণ ‘…’ ছিড়ছিলা? থাপপড় দিয়ে তোমার দাঁত যদি না ফেলি।
তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, আপনার শরীর তো খারাপ। জ্বর বেড়েছে।
হারুন সরকার তুই তুকারিতে চলে গেল। চাপা গলায় ক্রুদ্ধ গর্জন করল, খবর্দার, গায়ে হাত দিবি না।
শুয়ে থাকেন। বসে আছেন কেন?
আবার কথা বলে।
এই রকম করতেছেন কেন?
সন্ধ্যার আগে আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করার ব্যবস্থা কর।
আচ্ছা করতেছি। আপনি শান্ত হন।
হারুন সরকারের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। এতক্ষণ তিনি যে রাগারাগি করছিলেন তার জন্যে খানিকটা লজ্জাও লাগল। হুট করে এতটা রাগ করা ঠিক হয় নি। তৈয়ব ছেলে ভালো।
তৈয়ব!
জি।
আমারে বের করার ব্যবস্থা কর।
জি করতেছি।
আজ রাতটা এখানে থাকলে আমি মারা যাব। অবশ্য এখানে না থাকলেও মারা যাব। তখন মরব নিজের বিছানায়।
আপনার শরীর কিন্তু বেশি খারাপ।
শরীর খারাপ হোক বা ভালো হোক, তুমি তেঁতুলের জোগাড় দেখ।
কী বললেন?
প্রশ্ন করবা না। যা বলব মাথা হেট করে শুনবা এবং সেই মতে কাজ করবা। খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে আছ কেন? আমার রিলিজের কী ব্যবস্থা করলা?
করতেছি।
হারুন সরকার ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আমি সকাল থেকে ছটফট করতেছি, তুমি আসলা সন্ধ্যা পার করে। আমি যে একটা মানুষ এই বোধটা তো তোমাদের মধ্যে নাই। কেউ তো আমারে দেখতেও আসল না। আর কেউ আসুক না আসুক জামদানীর তো আসা উচিত ছিল। এই মেয়েটাকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করি।
আমি সবাইকে আসতে নিষেধ করেছি।
কেন?
আসলেই আপনি কথা বলবেন। আপনার বিশ্রাম হবে না।
আমার দিকে তোমার দেখি বড়ই দরদ। শোন তৈয়ব, মায়ের চেয়ে যদি অন্য কারোর প্রতি বেশি দরদ হয় তারে বলে ভান। ভান কি জানো?
না।
ভান হলো শয়তান। তুমি অবশ্যই শয়তান।
জি আচ্ছা। দেখি আপনের রিলিজের ব্যবস্থা করি।
তেঁতুল লাগবে। আজ কিন্তু তেঁতুল ছাড়া হবে না। আরেকটা কথা–জামদানীরে নিষেধ করবা সে যেন আগামী সাতদিন আমার সামনে না আসে। আমি তার উপর বেজার হয়েছি। তাদের তিন বোনুরেই এই কথা বলবা। তাদের তিনজনের উপরই আমি বেজার হয়েছি। এদেরকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করতাম। এখন অত্যাধিক ঘৃণা করি। আমার সবই বেশি বেশি। আমার স্নেহ যেমন বেশি, ঘৃণাও বেশি। আমার মধ্যে মাঝামাঝি বলে কিছু নাই। অমাবস্যাপূর্ণিমায় জন্ম নিলে এই জিনিস হয়। তাদের মাঝামাঝি কিছু থাকে না। আমার জন্ম পূর্ণিমার রাতে। তারিখটা এখন মনে পড়তেছে না। পেটে মাল পড়লে মনে পড়বে। তখন তোমারে বলব।
জি আচ্ছা।
তৈয়বের সঙ্গে কথা বলে হারুন সরকার হাপিয়ে গিয়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু তার শরীরটা এখন আগের চেয়ে ভালো লাগছে। মাথা ঘুরানো বন্ধ হয়েছে। তলপেট থেকে ধাক্কার মতো কী যেন উপরের দিকে আসত। সেটাও বন্ধ। শুধু বুক ধুকপুক করছে। শব্দ করে করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার জামার নিচে বসে ডুগডুগি তবলা বাজাচ্ছে। যে বাজাচ্ছে সে প্লেয়ার ভালো। বিশ্রাম নেয়ার জন্যে এক মুহূর্তের জন্যও থামছে না। বাজিয়েই যাচ্ছে। তেরে কেটে তাক তাক। তেরে কেটে তাক তাক।
আসমানীরা তিন বোন স্পিড বোটে বসে আছে। নি পোর্টার স্পিড বোট চালাচ্ছে। তিন বোনই খুব মজা পাচ্ছে। বাঁক নেবার সময় স্পিড বোট কাত হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে পড়ল পানিতে। মজাটা তখন খুব বাড়ছে। আসমানী এবং জামদানী প্রথমে বিদেশী সাহেবের কাছে কিছুতেই আসতে রাজি হয় নি। কিন্তু পয়সা যাবেই। তার একটাই কথা–তাকে চা খাবার দাওয়াত করা হয়েছে। সে বলেছে যাবে। এখন আর কিছুতেই না বলা সম্ভব না। এটা সে করতে পারবে না।
জামদানী বলল, করতে পারবে না কেন?
পয়সা কঠিন মুখ করে বলল, কারণ আমি বলেছি যাব।
আসমানী বলল এটা তো কোনো কঠিন প্রতিজ্ঞা না, যে যাব বললে যেতেই হবে।
পয়সা বলল, আমার জন্যে এটা কঠিন প্রতিজ্ঞা।
আসমানী বলল, তোর জন্যে কঠিন প্রতিজ্ঞা হবে কেন? তুই কি ঐ লালমুখা বান্দরের প্রেমে পড়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি প্রেমে পড়েছি। আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তার চাদমুখ না দেখতে পেলে আমি মরে যাব।
তামাশা করছিস কেন?
আমি তামাশা করছি না। তোমরা তামাশা করছ। আমাকে আটকে রাখছ। আমি দশ মিনিটের জন্যে যাব। এক কাপ চা খেয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে তাহলে আমরাও যাব।
পয়সা বলল, বেড়াতে যাবার জন্যে যদি যেতে চাও তাহলে অবশ্যই যাবে। কিন্তু আমাকে পাহারা দেবার জন্যে যেতে পারবে না।
আসমানী বলল, তুই কি পাহারার উর্ধ্বে?
পয়সা বলল, হ্যাঁ।
জামদানী বলল, তুই কিন্তু তোর জন্যে বিরাট বিপদ ডেকে আনছিস। খাল কেটে বিদেশী কুমীর আনছিস।
পয়সা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ভালো করছি।
আসমানী এবং জামদানী মেজাজ খারাপ করে বোনের সঙ্গে গেল। যাবার পথে দুজনের কেউই একটা কথাও বলল না।
নি পোর্টারের তাঁবুর ভেতর ঢোকার দশ মিনিটের মাথায় তিনজনেরই মেজাজ ভালো হয়ে গেল। কারণ নি পোর্টার তাদের জন্যে ভালো চমকের ব্যবস্থা রেখেছিল। সে তার ভিডিও ক্যামেরায় দড়ির উপর তিন বোনের ছোটাছুটির পুরোটাই ভিডিও করে রেখেছিল। লং শট, ক্লোজআপ সবই আছে। দর্শকদের রিএকশান আছে। পয়সা যে মাঝে মধ্যেই পড়ে যাবার ভঙ্গি করছে। আবার দড়ি থেকে লাফিয়ে উঠে নিজেকে ঠিক করছে তাও আছে।
ভিডিও দেখে তিনবোনই অবাক। তাদের নিজেদের খেলাটা যে এত সুন্দর এত মজার তা তারা কল্পনাও করে নি। পয়সা বলল, আমি আবার দেখব। নি পোর্টার হাসি মুখে বলল, অবশ্যই। পুরোটা আবার দেখা হলো। দ্বিতীয়বার দেখার সময় তিন বোনের আরো মজা লাগল। পয়সার আরো একবার দেখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
তিন বোনের জন্য গিফট র্যাপে মোড়া তিন প্যাকেট চকলেট ছিল। আর তিনটা সেন্টের শিশি। শিশির রঙ গাঢ় নীল। আর শিশিটা এমন অদ্ভুত সুন্দর। দেখে মনে হয় নীল রঙের তিন মেয়ে কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পয়সার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল–তারা তিন বোন পুরস্কার হিসেবে সোনা-রুপার মেডেল পেয়েছে, টাকা পেয়েছে; কিন্তু এত সুন্দর উপহার তাদেরকে কেউ দেয় নি।
স্পিড বোট নিয়ে ঘোরার সময়ও মজা কম হলো না। এক সময় সাহেব বলল, তোমরা কেউ স্পিড বোট চালাবে? হাল ধরে থাকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না।
পয়সা বলল, আমি চালাব।
আসমানী বলল, না না, তুই উল্টে ফেলবি।
উল্টে ফেললে ফেলব কিন্তু আমি চালাবই।
পয়সা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই স্পিড বোট চালাল। তখন জামদানী বলল, আমিও চালাব।
আসমানীও বাদ রইল না।
পয়সার শরীর ঝনঝন করছে। কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছে না তার এত আনন্দ হচ্ছে কেন? খুব বেশি আনন্দ হলে তার শরীর টলমল করতে থাকে। তখন খুব সমস্যা হয়। দড়ির উপর ঠিকঠাক পা পড়ে না। ব্যালেন্সে খুব অসুবিধা হয়। আজ অবশ্যই অসুবিধা হবে। এবং আরেকটা ব্যাপারও হবে–রাতে এক ফোটা ঘুম হবে না। পয়সার এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই হয়। সারারাত এক ফোটা ঘুম আসে না।
হারুন সরকারের মনে হচ্ছে তার শরীর পুরোপুরি সেরে গেছে। দুর্বল ভাবটা আছে, বুকের ধুকধুকানিও আছে। তার পরেও শরীর যে পুরোপুরি সেরেছে এই বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সিগারেটে টান দিতে ভালো লাগছে। জিনের গ্লাসে চুমুক দিতেও ভালো লাগছে। বমি আসছে না। শরীর সেরেছে কী সারে নি তার আসল পরীক্ষা সিগারেটে। শরীর খারাপ থাকলে সিগারেটে টান দেয়া যায় না। সে তো ভালোই টানছে। হারুন সরকার তেঁতুল মিশানো জিনের গ্লাসে লম্বা টান দিয়ে গাঢ় স্বরে ডাকল, তৈয়ব!
তৈয়ব বলল, জি।
কাছে আছ তো?
জি, কাছে আছি।
শো শুরু করে দিয়ে আবার চলে আসবে।
জি চলে আসব। কিন্তু আপনে একটু ধীরে খান। আপনার শরীর ঠিক হয়। নাই।
শরীর ঠিক আছে। আমার শরীর আমি বুঝব না, তুমি বুঝবে? শরীর নিয়া কোনো কথা বলব না। টিকিট বিক্রির অবস্থা কী?
আজও সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
হারুন সরকার তৃপ্তি নিয়ে বলল, হাতির বাচ্চাটার জন্মের পর থেকে আমাদের ভাগ্য ফিরে গেছে।
হতে পারে।
হতে পারে টারে কিছু না। ঘটনা এটাই। হাতির বাচ্চারে একটা রূপার ঘণ্টা বানায়ে দিবে। ঘণ্টা গলায় ঝুলবে।
জি আচ্ছা।
কালকের মধ্যে ঘণ্টা বানাতে হবে। ঘণ্টা আমি নিজের হাতে পরায়ে দিব।
জি আচ্ছা।
আমি হাতির বাচ্চাটা এখনো দেখি নাই। এটা একটা আফসোস। কাল দেখবেন।
অবশ্যই কাল দেখব। নিজের হাতে গলায় ঘন্টা পরায়ে দেব।
এখন যাই। শো টাইম হয়ে গেছে।
আর দশটা মিনিট বসো। গ্লাসটা শেষ করি। নতুন এক গ্লাস বানায়ে হাতে ধরায়ে দিয়ে যাও।
তৈয়ব দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আবার বসল। হারুন সরকার বলল–চারদিন পার করে দিলাম এখনো কোনো ভেজাল হয় নাই। বিরাট আশ্চর্য ঘটনা। ঠিক না?
ঠিক। তবে ছোট্ট ভেজাল বোধহয় হবে।
কী ভেজাল?
বশির মোল্লা বলে এক লোক মনে হয় ঝামেলা করবে। সহজ ঝামেলা না। জটিল ঝামেলা। সে সার্কাস কিনে নিতে চায়।
কোনখানের ফাজিল?
ভাটি অঞ্চলের। সে আমাকে দালাল ধরেছে। দালালি বাবদ দশ হাজার টাকাও দিয়েছে।
বলো কী?
আমি খোঁজ নিয়েছি–লোক ভয়ঙ্কর।
সার্কাস কিনতে চায় কেন?
মেয়ে তিনটার জন্যে কিনতে চায়। সার্কাসের যে মালিক সে মেয়ে তিনটারও মালিক, আর কিছু না।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, আমার তো নেশা কেটে যাওয়া ধরেছে। এটা তুমি কী বললা?
তৈয়ব কিছু বলল না। হারুন বলল, সমস্যার সমাধান কী?
তৈয়ব চুপ করেই রইল। হারুন সরকার বলল, ঐ লোকের নাম কী? বশির মোল্লা।
তাকে বলো যে সার্কাস আমি বেচে দিব। কিন্তু দাম এক কোটি টাকা। তখন বাপ বাপ করে দৌড় দিয়ে পালায়ে যাবে।
তৈয়ব বলল, পালাবে না। সে এই টাকা খরচ করবে। আমি নিশ্চিত।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, এখন করা যায় কী?
ঘণ্টা পড়ে গেছে। শো শুরু হবে। তৈয়ব আলী ওঠে দাঁড়াল।
রাত দুটা বাজে। পয়সা পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে আছে। স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। এখন আর ঘুম আসছে না। স্বপ্নটা তেমন অদ্ভুত না। তার জন্যে সাধারণ স্বপ্ন। সে প্রায়ই দেখে। তবে আজকের স্বপ্নটা একটু অন্যরকম। সে দেখেছে দড়ির খেলা হচ্ছে, হঠাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে সে দড়ি থেকে পড়ে গেল। শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে, সে নিচে নামছে নিচে নামছে। চারদিক থেকে চিৎকার–বাঁচাও বাঁচাও। এই পর্যন্ত স্বাভাবিক স্বপ্ন। পয়সা নিয়মিতই এই স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নের পরের অংশটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নের মধ্যে সে শুনল ভট ভট শব্দ হচ্ছে। নিচে তাকিয়ে দেখে বিশাল সমুদ্র। সে পড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। ভট ভট শব্দটা স্পিড বোটের। তাকে বাঁচানোর জন্যে নি পোর্টার স্পিড বোট নিয়ে ছুটে আসছে।
পয়সার স্বপ্ন এই পর্যন্ত। সে বাঁচল না-কি সমুদ্রে তলিয়ে গেল সেটা আর দেখা হলো না।
পয়সা।
হুঁ।
কী হয়েছে?
পয়সা জবাব দিল না। আসমানী বলল, তুই কাঁদছিস কেন?
পয়সা গালে হাত দিয়ে দেখল গাল ভেজা। তার চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছে এটা সে নিজেও জানে না। একটা ব্যাপার শুধু জানে তার খুব একলা লাগছে। যেন সে এখন আর তিন বোনের একজন না। সে আলাদা।
আপা।
কী?
কাল সকালে আমি কিন্তু ঐ বিদেশী সাহেবের কাছে বেড়াতে যাব।
ঠিক আছে তোকে নিয়ে যাব।
তোমরা যাবে না আপা, আমি একা যাব।
আসমানী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা, তোর যদি ভালো লাগে তুই একাই যাবি।