ভ্রমণবৃত্তান্ত/ফ্যানি পার্কস ১৮২২-২৮
১
১৮২২—২৩ সন
শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস কলকাতা শহরে এসেছিলেন অনেকদিন আগে, ১৮২২ সালে নভেম্বর মাসে। ইংলন্ড থেকে তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলেন এবং নানা দেশ ঘুরে শেষে ভারতবর্ষেও এসেছিলেন। তখন এ দেশে ইংরেজদের প্রধান ও প্রথম দর্শনীয় স্থান ছিল কলকাতা শহর। ভারতভ্রমণে এসে ফ্যানি কিছুটা ‘ভারতীয়’ হয়ে গিয়েছিলেন মনে হয় অজ্ঞাতসারেই। দেবনাগরী অক্ষরে ‘শ্রীগণেশঃ’ নামে একটি বহুবর্ণ চিত্র তাঁর গ্রন্থের শোভাবর্ধন করেছে। ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন, ‘although a pukka Hindu, Ganesh has crossed the Kala Pani, or Black Waters, as they call the ocean, and has accompanied me to England. There he sits before me in all his Hindu state and peculiar style of beauty—my inspiration.’
‘শ্রীগণেশ পাক্কা হিন্দু হলেও কালাপানি পার হয়ে আমার সঙ্গে ইংলন্ডে এসেছেন। তিনি তাঁর হিন্দুত্বের সমস্ত মর্যাদা ও ঐশ্বর্য নিয়ে আমার সামনে উপবেশন করে আছেন। আমার প্রেরণা ও ক্ষমতার উৎস তিনি।’
অতঃপর শ্রীগণেশকে ‘সেলাম, সেলাম’ বলে বন্দনা করে শ্রীমতী ফ্যানি ভ্রমণকাহিনি লেখা আরম্ভ করেছেন।
.
নভেম্বর ১৮২২
অপূর্ব ও বিচিত্র শহর কলকাতায় এসে পৌঁছলাম। কলকাতাকে সকলে ‘প্রাসাদপুরী’ (City of Palaces) বলেন। এ নাম সত্যিই তার প্রাপ্য। নদীতীরে ময়দানের সামনে বিশাল ‘গবর্নমেন্ট হাউস’, তার পেছনে অ্যান্ড্রুজ চার্চ ও শহর। বাঁদিকের জায়গার নাম ‘চৌরঙ্গি’। সুন্দর সব বাগান—ঘেরা ছাড়া—ছাড়া বাড়ি চৌরঙ্গি অঞ্চলে। বড় বড় স্তম্ভের উপর টানা—টানা বারান্দা, নিচে থেকে উপর পর্যন্ত বাড়িগুলির চেহারায় এমন একটা মনোরম গাম্ভীর্য এনেছে যা না দেখলে বর্ণনা করা যায় না। এই নির্মাণকৌশলের জন্য রৌদ্রের তাপেও বাড়ি ঠান্ডা থাকে এবং বর্ষার বৃষ্টিধারাও উপভোগ করা যায়। গড়নের জন্যও বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন বাড়িগুলি পাথরের তৈরি। চৌরঙ্গিতে বাড়িভাড়াও অত্যন্ত বেশি, আসবাবপত্র ছাড়া মাসিক ৩০০—৩৫০ টাকা, বড় বাড়ি ৪০০—৪৫০ টাকা। আমরা ৩২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে চৌরঙ্গিতেই একটি বাড়ি নিলাম।
ভারতীয় গৃহের সাজসজ্জার সঙ্গে ইংলন্ডের বেশ পার্থক্য। ঘরের মেঝে মাদুর বা শতরঞ্জি দিয়ে ঢাকা থাকে। শীতকালের কয়েক মাস পার্সি বা মির্জাপুরি কার্পেট পাতা হয়। ঘরের দরজা—জানলা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং ঘরগুলিও অনেক বড় ও উঁচু। প্রত্যেক শোয়ার ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুম আছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য মধ্যে ছোট ছোট ঠেলাদরজা আছে। শৌখিন আসবাবপত্রের অভাব নেই শহরে। চমৎকার ফরাসি ফার্নিচারের জন্য মঁসিয়ে দ্য বাস্তের দোকান কলকাতা শহরে বিখ্যাত। বড় বড় মার্বেল পাথরের টেবিল, সুন্দর সুন্দর আয়না ও আরামকেদারা তাঁর দোকানে প্রচুর মজুত থাকে। এ ছাড়া ইয়োরোপীয়দের আরও অনেক ফার্নিচারের দোকান আছে। কলকাতায় ক্যাবিনেট—মেকারদের মধ্যে বোধহয় বিদেশিদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু বিদেশিদের দোকানে আসবাবপত্র তৈরি করে এ দেশি ছুতোর—মিস্ত্রিরা, সাহেবরা তাদের নির্দেশ দেন। স্থানীয় অন্যান্য বাজারে যেসব কাঠের জিনিসপত্র বিক্রি হয় তা ভাল নয়।
শীতকালে কলকাতায় আবহাওয়া এত মনোরম ও লোভনীয় যে সবসময় আমার ইংলন্ডের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কথা মনে পড়ছিল। এই সময় কলকাতায় বাস করলে তাঁরাও নিশ্চয় খুশি হতেন। কলকাতা দেখে সারা ভারতবর্ষটাকেই আমার সুন্দর দেশ বলে মনে হল। কিন্তু ভারতবর্ষে বাস করতে গেলে যে এত ভৃত্যের প্রয়োজন হয় তা আগে কল্পনাও করতে পারিনি। কেবল আমি নই, ইয়োরোপ থেকে যে—কেউ প্রথম এ দেশে এলে ভৃত্যের বহর দেখে অবাক হয়ে যাবেন। মনে হবে, শুধু চাকরের চাপে পতন অনিবার্য। ভৃত্যদের বেতন বেশি নয়, অনেক সময় খেতে দিলেও তারা কাজ করে। কিন্তু এত বেশি সংখ্যায় তাদের রাখতে হয় যে তাতে খরচ কুলিয়ে ওঠা বেশ রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে।
স র কা র বা বু
সংসারে ভৃত্যকুলের শিরোমণি হলেন সরকারমশায়। এই ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া এক পা—ও চলবার উপায় নেই। প্রত্যহ সকালবেলা সবার আগে তাঁরই মুখদর্শন করতে হয়। খাতা হাতে, মাথা নত করে তিনি এসে সামনে দাঁড়ান, সেদিনের কেনাকাটার ফিরিস্তি তৈরি করার জন্য। মেমসাহেবের কাছ থেকে অর্ডার নেওয়া শেষ হলে তিনি বাজার যান। ফার্নিচার বই পোশাক—পরিচ্ছদ তিনি সাহেবদের দোকান ঘুরে ঘুরে নিয়ে আসেন, এবং গৃহকর্ত্রীর পছন্দ হলে কিনে দেন। বিদেশি বা দেশি, ছোট বা বড় সকল শ্রেণির ব্যবসায়ী বা দোকানদারের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। জিনিস কেনার জন্য তাঁর পাওনা হল দস্তুরি, এবং সকলকেই তা দিতে হয়। নেহাত ভিক্ষের কড়ি নয় এই দস্তুরি, শতকরা বেশ ভাল একটা অংশ। মাস গেলে সেটার অঙ্ক কম মোটা হয় না। একদিন সকালে আমার সরকারকে ডেকে বললাম, কাল যে জিনিসপত্র কিনেছেন তার দাম অত্যন্ত বেশি। তার উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনি আমার মা—বাপ, আমি আপনার ছেলে। মাপ করবেন আমাকে, আমি বেশি কিছু নিইনি, টাকায় মাত্র দু’আনা দস্তুরি নিয়েছি।’
এই ধরনের কথা বলতে এ দেশের লোকের মুখে আটকায় না। আর—একদিন সরকারমশায় বললেন, ‘আপনি আমার মা—বাপ, আপনি সাক্ষাৎ দেবী।’ আমি খুব বিরক্ত হয়ে সেদিন তাঁকে ধমক দিয়েছিলাম। তার উত্তরে সরকার ব্যাখ্যা করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, যেহেতু আমি তাঁকে অন্নদান করছি, এবং আশ্রয় দিচ্ছি সেইজন্য আমি তাঁর কাছে দেবীতুল্য। যা—ই হোক, ধমকে কাজ হয়েছিল, তারপর থেকে আর কখনও তিনি ওইভাবে কথা বলতেন না। কলকাতার একজন বিশিষ্ট সরকারমশায়ের ছবি আমি বইতে ছেপে দিলাম। পরিষ্কার সাদা ধবধবে কাপড় কাছা—কোঁচা দিয়ে পরে, গায়ে সাদা চাদর জড়িয়ে রাখাই এঁদের পোশাকের বৈশিষ্ট্য। মাথাতেও একটি সাদা পাগড়ি থাকে, তার কাপড়ের দৈর্ঘ্য একুশ গজ এবং প্রস্থ চৌদ্দ ইঞ্চি। এই সমস্ত কাপড়টা চমৎকার কায়দায় ভাঁজ করে পাগড়ি বাঁধা হয়। কানে খাগের কলম গোঁজা থাকে এবং হাতে থাকে সাদা কাগজ, মেমসাহেবের ফরমাশ লেখার জন্য। পায়ে থাকে নাগরা জুতো, তার চামড়া ভাল নয়, কিন্তু সোনালি—রুপোলি কারুকাজ করা থাকে খুব। ভারতবর্ষের সব লোকের দেখতে পাই ছোটবড় গোঁফ থাকে। তারা সাহেবদের চাঁছাপোঁছা মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, এবং মনে হয় যে দাড়ি—গোঁফহীন পুরুষের মুখ তাদের কাছে দেখার বস্তু। সরকার যে জাতিতে হিন্দু, কপালে তিলকের চিহ্ন দেখে তা বোঝা যায়।
দস্তুরির কথা বলি। দস্তুরিটা হল কতকটা ট্যাক্সের মতন। দারোয়ান গেটের মধ্যে কোনো ফেরিওয়ালাকে ঢুকতে দেয় না দস্তুরি না পেলে। ভেতরে ঢোকার পর যদি কোনো জিনিস সাহেব তাঁর কাছ থেকে কেনেন তাহলে সর্দার—বেহারাকে দস্তুরি দিতে হয়। আর যদি মেমসাহেব কোনো জিনিস কেনেন তাহলে দস্তুরি দিতে হয় আয়াকে। তাতে অবশ্য ফেরিওয়ালার লোকসানও হয় না, কারণ দস্তুরির হিসেব করেই সে সাহেবের কাছ থেকে জিনিসের দাম আদায় করে নেয়। সাধারণত টাকায় দু’পয়সা থেকে চার পয়সা হল দস্তুরির হার, চার পয়সাই বেশি। তবে সরকারমশাই যদি কিছু কেনেন এবং দস্তুরির প্রার্থী হন তাহলে অন্যান্য ভৃত্যরা কেউ আর ভাগ চায় না। সরকার নিজেই প্রায় টাকায় দু’আনা হারে দস্তুরি নিয়ে নেন। ভৃত্যরা সকলে সরকারকে খুব সমীহ করে চলে, কারণ তিনি তাদের ভাগ্যবিধাতা এবং যাবতীয় ন্যায়—অন্যায় আচরণের জন্য সাহেব—মেমের কাছে দায়ী। মধ্যে মধ্যে ভৃত্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বেশ মজা লাগে। একমাত্র দরজি ছাড়া আর কেউ একটি ইংরেজি কথাও বলতে পারে না। বাধ্য হয়ে তাই আমাকে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য হিন্দুস্থানি শিখতে হয়েছিল।
ইয়োরোপ থেকে যখন কেউ ভারতবর্ষে আসে তখন প্রথম এক বছরের জন্য সেই নবাগতকে ‘গ্রিফিন’ (Griffin) বলা হয়। এ দেশের সবকিছুই এত বিরাট বিচিত্র ও বিস্ময়কর যে গ্রিফিনের দৃষ্টিতে তাজ্জব ব্যাপার বলে মনে হয়। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে অনেক সময় লাগে।
.
ডিসেম্বর ১৮২২
ডিসেম্বর মাসে এমন উপভোগ্য আবহাওয়া হয় কলকাতায় যে মনে হয় যেন এমন শহর পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সারা বছর যদি এইরকম আবহাওয়া থাকত তাহলে আমি পশ্চিমের লোকজনকে বলতাম ও দেশ ছেড়ে এ দেশে চলে আসতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আবহাওয়া একরকম থাকে না এবং গ্রীষ্মকালের কথা মনে হলে শীতের সমস্ত আরাম এক মুহূর্তে উবে যায়।
আমার স্বামী আমাকে একটি সুন্দর আরবি ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন, তার নাম রাখা হয়েছিল, ‘আজর’। কী কারণে জানি না, সাহেবরা এই নামটি বিকৃত করে সবসময় তাকে ‘অরোরা’ বলে ডাকত। অবশেষে আজর ও অরোরা দু’টি নামই বাদ দিয়ে তার নাম রাখা হল ‘রাজা’। রাজার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে আমার খুব ভাল লাগত এবং রোজ ভোরে অথবা সন্ধ্যাবেলা ঘোড়দৌড়ের মাঠে ও লাটসাহেবের বাড়ির সামনে ময়দানের ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে আমি রাজার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তখন ময়দানে হাড়গিলা পাখি জমায়েত হত খুব। প্রায় দেখতাম লাটের বাড়ির গেটের মাথায় সিংহের মূর্তির উপর হাড়গিলারা সার বেঁধে বসে রয়েছে। দেখে মনে হত সিংহের মতন পাখিগুলোও বাড়ির স্থাপত্যের অঙ্গবিশেষ।
১৬ ডিসেম্বর তারিখে লর্ড হেস্টিংস লাটবাড়িতে বিরাট একটি ভোজ ও নাচের আয়োজন করে সিভিল ও মিলিটারি অফিসারদের ও কলকাতায় স্থানীয় অভিজাত বাসিন্দাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। নবাব ও রাজা—মহারাজারা, মারাঠি গ্রিক তুর্কি আরমেনিয়ান হিন্দু ও মুসলমানরা নানা রকমের বিচিত্র সব পোশাক পরে ভোজসভায় এসেছিলেন। রং—বেরঙের পোশাকের বিচিত্র এক প্রদর্শনী হয়েছিল লাটবাড়িতে। কিন্তু এমন ঘন কুয়াশায় পথঘাট ঢেকে গিয়েছিল যে লাটবাড়িতে যাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তা একেবারে দেখা যাচ্ছিল না, গাড়ি করে যাওয়াও বিপজ্জনক মনে হচ্ছিল। দু’জন মশালচি ঘোড়ার গাড়ির আগে মশাল নিয়ে দৌড়চ্ছিল এবং গাড়িতেও আলো জ্বালা ছিল পথ দেখার জন্য। মশালের আলোয় এবং সহিস—ভৃত্য—গাড়োয়ানের হল্লায় কুয়াশা কেটে গিয়ে পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। নিরাপদে আমরা লাটবাড়িতে পৌঁছলাম।
ঘোড়াগাড়ি ছাড়া চলাফেরার জন্য পাল্কি ছিল কলকাতায়। বেয়ারারা বেশ দ্রুত পাল্কি বইতে পারত। পাল্কিকে দ্বিপদ ঘোড়ার যান বললেও ভুল হয় না। গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করতে করতে তারা পথ চলত এবং চলার ছন্দের সঙ্গে সুরের তাল কাটত না কখনও। ওস্তাদ ও অভিজ্ঞ বেয়ারারা এমন কায়দায় দৌড়তে পারত যে পাল্কি একটুও দুলত না।
ইংলন্ডের বিত্তবান ভদ্রলোকদের মধ্যে খুব কম লোকই স্ত্রী—কন্যাদের চড়ে বেড়াবার জন্য ঘোড়া পুষতে পারেন। তাই কলকাতায় এসে ইংরেজ মহিলাদের ঘোড়ায় চড়ার বহর দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কলকাতায় প্রত্যেক ইংরেজ মহিলারই বোধহয় একটি করে ঘোড়া ছিল এবং তিনি তার পিঠে চড়ে সগর্বে বেড়িয়ে বেড়াতেন। বেশ পাকা ঘোড়সওয়ার হয়েছিলেন কলকাতার মহিলারা। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম যখন দেখলাম একদিন এক ইংরেজ মহিলা, সন্তান প্রসবের মাত্র সপ্তাহ তিনেক পরে দুর্ধর্ষ এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে ময়দানে মহানন্দে গ্যালপ করে বেড়াচ্ছেন। কলকাতার এই অশ্ববিলাসী মহিলারা আমাকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কী সাঙ্ঘাতিক কড়া নার্ভ এই মহিলাদের। ভাবতেও ভয় হয়।
সিভিল মিলিটারি অফিসাররা এবং কলকাতার স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী বাসিন্দারা লর্ড ও লেডি হেস্টিংসের বিদায় উপলক্ষে একটি বিরাট ভোজ দিলেন। তারপর তাঁরা দু’জনে ফিরে গেলেন ইংলন্ডে।
ক্রিসমাসের দিনে দেখেছি বাড়ির ভৃত্যরা গাছ—লতাপাতা দিয়ে গেট সাজায় এবং চারদিকে ফুলের মালা ঝুলিয়ে দেয়। বেয়ারা, ধোপা ও অন্যান্য সকলে রেকাবে ও ট্রে—তে করে নানা রকমের ফল—মূল—কেক—মিষ্টি ইত্যাদি সাজিয়ে ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসে এবং বকশিস চায়। আমার মনে হয় ‘ক্রিসমাস—বক্সের’ উৎপত্তি হয়েছে এইভাবে। আমরা ফল—মিষ্টি উপহার নিই, এবং তার বদলে টাকা বকশিস দিই।
সকলে বলে, চীনের পর ভারতবর্ষেই নাকি চুরি হয় সবচেয়ে বেশি। চুরির ভয়ে আমরা বাড়িতে একটি দারোয়ান রেখেছিলাম এবং দু’জন চৌকিদার নিযুক্ত করেছিলাম রাত্রে পাহারা দেবার জন্য। তা ছাড়া খুব উঁচু প্রাচীর দিয়ে বাড়ির চারদিকে ঘেরা ছিল। একদিন সকালে শুনলাম বেয়ারারা খুব উত্তেজিত হয়ে কী একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। জানা গেল আমাদের বাড়িতে গত রাত্রে চুরি হয়ে গেছে। এক বন্ধু অতিথি থাকতেন আমাদের বাড়িতে, তাঁর অনেকগুলি সোনার মোহর ও মূল্যবান জিনিসপত্র দেরাজ ভেঙে চোরেরা নিয়ে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, যেরাতে চুরি হয়েছিল সেইরাতে চৌকিদারের হাঁকডাক শোনা গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। চোর অবশ্য হাতেনাতে ধরা গেল না, তবে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে দারোয়ান ও চৌকিদারের যোগসাজশে খানসামাই চুরি করেছে। অতএব খানসামাকেই তাড়িয়ে দেওয়া হল।
.
মার্চ ১৮২৩
প্রায় চার মাস হল কলকাতায় এসেছি, এর মধ্যে এ দেশের আবহাওয়া সম্বন্ধে আমার ধারণা একেবারে বদলে গেছে। মার্চ মাস থেকে গরম হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। এ হাওয়া সহ্য করা কঠিন। হঠাৎ চুল্লির মুখ খুললে যেমন তাপ লাগে মুখে তেমনি এই সময় দুপুরে বাইরে বেরুলে গরম হাওয়ায় মুখ পুড়ে যায়। পারতপক্ষে দিনদুপুরে এই সময় কাজকর্ম করতে বেরুনো খুবই কষ্টকর। সন্ধ্যার পরে আবহাওয়া ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে এবং ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়। বেশ রাত করে আমরা বেড়াতে যাই, এবং শুক্লপক্ষের রাত এত সুন্দর দেখায় যে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কৃষ্ণপক্ষের রাতে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি জ্বলতে থাকে, মনে হয় যেন ছোট ছোট আগুনের ফুলকি হাওয়ায় উড়ছে। একটা—দুটো নয়, অসংখ্য জোনাকি। এগুলো একজাতীয় পতঙ্গ, এমনি দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত, লেজের দিকে আলো ঝলমল করে, উড়ে যায় যখন তখন আলো জ্বলতে ও নিভতে থাকে। বাড়ির গাছপালাগুলো ঘিরে জোনাকিরা যখন জ্বলতে—নিভতে থাকে তখন যে কী সুন্দর দেখায় তা আর কী বলব!
যে—কোনো নবাগত গ্রিফিনের কাছে আরও একটি আশ্চর্য বস্তু হল ‘টানা—পাখা’। এই বিচিত্র বস্তুটি এ দেশে না এলে হয়তো চোখে দেখার সৌভাগ্য হত না। একে একটা বিরাট দৈত্যাকার পাখা বলা যায়, দশ—কুড়ি—ত্রিশ ফুট কিংবা তারও বেশি লম্বা সিলিং থেকে মোটা দড়ি দিয়ে ঝুলানো; ঘরের বাইরে থেকে একটি লোক সেটা টানে। এ পাখা এ দেশের লোকের আবিষ্কার যে তাতে সন্দেহ নেই। যে—সে লোকের বাড়িতে দেখতে পাওয়া যায় না। বেশ বড়লোক না হলে ঘরে টানা—পাখা ঝুলিয়ে হাওয়া খাওয়া যায় না। ইচ্ছা করলে পাখা বেশ বাহারে করা যায়। ঝালর দেওয়া যায় রঙিন দামি কাপড় দিয়ে, শৌখিন লোক যাঁরা তাঁরা সিল্কের কাপড়ও দেন। কাঠের গায়ে রঙিন চিত্রের নকশাও করা যায়। টানা—পাখা তখন সত্যিই চরম বিলাসিতার বস্তু হয়ে ওঠে, মনে হয় ঘরের সিলিঙের নিচে কোনো অপ্সরী যেন ডানা মেলে উড়ছে।
চৈত্র—বৈশাখ মাসের আবহাওয়া খামখেয়ালি। এই হয়তো প্রচণ্ড গরমে প্রাণ আইঢাই করছে, তারপরেই হয়তো ঘনকালো মেঘ জমল আকাশে, প্রবল বেগে ঝড় উঠল কালবৈশাখী, বিদ্যুৎ ঝিলিক দিতে লাগল, বৃষ্টি হল মুষলধারে। গাছপালাও কলকাতায় প্রচুর। এরকম সবুজের প্রাচুর্য আমাদের কাছে বিস্ময়কর! জানি না, এই ধরনের আবহাওয়ার মধ্যে কোনো আলসেমির আমেজ আছে কি না। থাকতেও পারে হয়তো। তা না হলে এ দেশের লোক এত আলসে হয় কী করে? একেবারে হাড়েমজ্জায় আলসে। যেমন আমার আয়াটার কথা বলি। তার কাজ হল আমার সাজপোশাক গুছিয়ে দেওয়া। কোনোরকমে সেই কাজটুকু সেরে সে তার ঘরে চলে যায় খাওয়াদাওয়া করে এবং ফিরে এসে আমার ঘরে এককোণে শুয়ে সারাদিন ঘুমোয়। বেয়ারাগুলোও এমন কিছু মেহনতের কাজ করে না, কেবল খায় আর ঘুমোয়। খাওয়া আর ঘুমোনো—এই হল এ দেশের লোকের জীবনের প্রধান কাজ।
এ দেশের লোক সকলে না হলেও, কেউ কেউ দেখতে সত্যি খুব সুন্দর। তবে দেখলেই মনে হয় প্রাণশক্তিহীন ও কর্মবিমুখ। তার জন্য ভৃত্যেরও প্রয়োজন হয় এত বেশি। কাজ করার ক্ষমতা তাদের কম, এবং সব রকমের কাজ সকলে করতে চায় না। যে রাঁধবে সে থালাবাসন ধোবে না, যে বেয়ারার কাজ করবে সে মোট বইবে না, যে ঘরের কাজ করবে সে বাইরে কিছু করবে না, এইরকম অনেক ওজর—আপত্তি আছে তাদের। এর সঙ্গে জাতধর্মের ব্যাপারও জড়িত আছে। বিভিন্ন কাজের মর্যাদার তারতম্য আছে এবং জাতিভেদ অনুযায়ী কর্মভেদও আছে। মহাহাঙ্গামার ব্যাপার, এ দেশের মতন ইংলন্ডের ভৃত্যদের নিয়ে এতে ঝামেলা পোহাতে হয় না। দৈনন্দিন জীবন এই ভৃত্যদের উপদ্রবে অসহ্য হয়ে ওঠে।
তার উপর ‘মশা’ বলে একটি জীব আছে এ দেশে। অগুনতি তাদের সংখ্যা, গুনগুন শব্দ করে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায়। তাদের অতিসূক্ষ্ম ক্ষুদ্র দেহে একটি করে হুল থাকে, মানুষের দেহে সেটি সুচের মতন বিঁধিয়ে দিয়ে রক্তপান করে। অন্তত একবার যে না এই মশার কামড় খেয়েছে তাকে বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, তার জ্বালা কী! কামড় দিলেই সেখানে চুলকোতে হবে, চুলকোলেই সেখানে ফুলে উঠবে, ফুললেই সেটা বিষোবে এবং সেই বিষ ঝাড়তে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তার চেয়ে গরম ঢের ভাল কিন্তু মশা একেবারে অসহ্য।
চ ড় ক পূ জা
একদিন ঠিক করলাম (চৈত্রসংক্রান্তির দিন), কালীঘাটে মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। চৌরঙ্গি থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দক্ষিণে কালীঘাটের কালী মন্দির। ঘোড়াগাড়ি করে কালীঘাট যাত্রা করলাম সন্ধ্যাবেলা। পথে এক দৃশ্য দেখলাম, উৎসবের দৃশ্য, অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কীসের ভিড়?’ শুনলাম, চড়কপূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটি কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়কপূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কত রকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এ দেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায়—নগ্ন বলা চলে। একজন বৈরাগী তার শীর্ণ হাতদুটি মাথার উপর তুলে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে, অসাড় হয়ে গেছে হাত ও দেহ, পাখির মতন আঙুলের ধারালো লম্বা লম্বা নখগুলি হাতের পেছন থেকে বিঁধে ফুঁড়ে বেরিয়েছে ভিতরের তেলো দিয়ে। ভগবান বিষ্ণুর কাছে মানতের জন্য সে এই ভয়ংকর ক্লেশ স্বীকার করছে। নখগুলি প্রথমে বিদ্ধ হবার জন্য যন্ত্রণা হয় নিশ্চয়, কিন্তু পরে হাত অসাড় হয়ে গেলে আর কোনো যন্ত্রণা থাকে না। এই শ্রেণির আত্মপীড়নদক্ষ সাধুকে সকলে খুব পুণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের পরম প্রিয়পাত্র না হলে এরকম কষ্ট স্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি—গদগদচিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।
আরও কয়েকজন সাধু মাথার উপরে এক হাত তুলে চক্ষু উলটে বসে ছিল। একদল নীচজাতের হিন্দু বাহুর মাংসপেশি এ ফোঁড়—ও ফোঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের লাঠি ও লৌহশলাকা পুরে ঢোলের বাজনার তালে তালে বীভৎস ভঙ্গিতে তাণ্ডবনৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুঁড়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছিল জনতার কাছে। কয়েক গজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা একএকটা খুঁটি, তার মাথায় আড়ে একটি বা দু’টি করে বাঁশ বাঁধা। যে খুঁটির মাথায় একটি বাঁশ বাঁধা তার একদিকে একটি লোক ঝুলে রয়েছে, আর—একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লোকজন খুঁটির চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লোকটিও তার ফলে ঘুরছে বনবন করে। যে খুঁটির মাথায় দু’টি বাঁশ ক্রস করে বাঁধা আছে তাতে আরও বেশি লোক ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, উপরের লোকগুলি হুকবিদ্ধ হয়ে ঝুলছে ও ঘুরছে এবং তাদের বুকে ও পিঠে সেই হুকগুলি বিঁধে রয়েছে। উপরের লোকটি খুঁটির মাথায়, বাঁশের ডগায় ঘুরছে তো ঘুরছেই, আর নিচের লোকজন উন্মত্তের মতন তাদের পাক দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ঘোরার শেষ নেই, পাকেরও শেষ নেই। উপরে ঘুরছে যারা তারা বোধহয় বেশি পুণ্যবান, কারণ একটি থলি ভর্তি করে ফুল—বাতাসা নিয়ে উপরে থেকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিচের লোকজন মহা উল্লাসে সেগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে দেবতার প্রসাদের মতন। কেউ কেউ বুকে—পিঠে কাপড় না জড়িয়েই হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রচুর পরিমাণে নেশা করে, গাঁজা—আফিম খেয়ে তাদের চোখ—মুখের চেহারা পিশাচের মতন ভয়ংকর দেখাচ্ছিল।
নীচজাতের হিন্দুরা শুনেছি চড়কপূজার অত্যন্ত ভক্ত। পূজা—উৎসবে যোগদানকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এরকম পৈশাচিক ভয়াবহ উৎসব আর কোথাও দেখিনি। এই ধরনের উৎসবে দুর্ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। চড়কপূজায় শতকরা তিন—চারজন লোক মারাও যায়। ধনী লোকেরা টাকাপয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়ককাঠে চরকিপাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য। এইভাবে প্রক্সি দিয়েও নাকি পুণ্যলাভ করা যায়।
উৎসবে ছ্যাকরাগাড়ি ভর্তি হয়ে বাইজিরাও এসেছিল অনেক। যেমন তাদের পোশাক, তেমনি নাচ—গানের ভঙ্গি। যাঁর রুচি আছে তাঁর পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। কিন্তু এই বাইজিনাচ দেখার জন্য হিন্দু ভদ্রলোকের ভিড় হয়েছিল উৎসবে।
.
রা ম মো হ নে র বা ড়ি র ভো জ স ভা
একদিন এক ধনিক সম্ভ্রান্ত বাঙালিবাবুর বাড়ি ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবুর নাম রামমোহন রায়। বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তাঁর বাড়ি, ভোজের দিন নানা বর্ণের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চমৎকার আতশবাজির খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলোয় আলোকিত হয়েছিল তাঁর বাড়ি।
বাড়িতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাইজি ও নর্তকীদের নাচ—গান হচ্ছিল। বাইজিদের পরনে ছিল ঘাগরা, সাদা ও রঙিন মসলিনের ফ্রিক দেওয়া, তার উপর সোনারুপোর জরির কাজ করা। সাটিনের ঢিলে পায়জামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পোশাকে ও আলোয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলংকারও ছিল নানা রকমের। তারা নাচছিল দল বেঁধে বৃত্তাকারে, পায়ের নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের তালে তালে। নাচের সময় মুখের, গ্রীবার ও চোখের ভাবপ্রকাশের তির্যক ভঙ্গিমা এত মাদকতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল যে তা বর্ণনা করতে পারব না। নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল, সারেঙ্গি মৃদঙ্গ, তবলা ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা।
গানের সুর ও ভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্যরকম, আমরা শুনিনি কখনও। মধ্যে মধ্যে মনে হয়, সুর কণ্ঠ থেকে নির্গত না হয়ে নাসিকার গহ্বর থেকে তরঙ্গায়িত হয়ে আসছে। কোনো কোনো সুর এত সূক্ষ্ম ও মিহি যে কণ্ঠের কেরামতির কথা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয়। বাইজিদের মধ্যে একজনের নাম নিকি, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাইজিদের মহারানি সে, এবং তার নাচ—গান শুনতে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের কথা।
বাইজিদের নাচ—গান শোনার পর রাতের খাওয়াদাওয়াও শেষ হল। তারপর এ দেশের ভেলকিবাজ জাগলারদের অদ্ভুত সব ক্রীড়াকৌশল আরম্ভ হল। কেউ তলোয়ার লুফতে লুফতে হাঁ করে সেই ধারালো অস্ত্রটা গিলে ফেলল, কেউ—বা অনর্গল ধারায় আগুন ও ধোঁয়া বার করতে লাগল নাক—মুখ দিয়ে। একজন শুধু ডান পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পিছনদিক দিয়ে বাঁ পা তুলে ধরল কাঁধের উপর। এই ধরনের কৌশল দেখে নকল করার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক। বাড়ির ভিতর সুন্দর ও মূল্যবান আসবাবপত্র সাজানো, এবং সর্বই ইয়োরোপীয় স্টাইলে, কেবল বাড়ির মালিক হলেন বাঙালিবাবু (রামমোহন)।
ভারতবর্ষে ইয়োরোপীয় ছেলেমেয়েদের মুখ—চোখ কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখায়, স্বদেশের রক্তিম আভা কোথায় যে মিলিয়ে যায় তার ঠিক নেই। এ দেশের আবহাওয়ার গুণে এরকম রং পর্যন্ত বদলে যায়।
ভারতবর্ষের ফলমূল দেখতে খুব সুন্দর এবং বড় বড়। কেবল গন্ধের দিক থেকে মনে হয় ইংলন্ডের মতন সুগন্ধি নয়। এ দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ফল হল আম, সকলেই খুব প্রশংসা করে, আমার ভাল লাগে না। কলকাতায় এত রকমের আম খেয়েছি, তার মধ্যে কেমন যেন একটা তারপিনের গন্ধ আছে বলে মনে হয়েছে। সুরা সব রকমের পাওয়া যায় কিন্তু সবসময় নয়। পোর্ট ও শেরি গ্রীষ্মকালে বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না। মদিরার যে খুব প্রচলন আছে তা নয়। বর্গান্ডি, ক্ল্যারেট ও অন্যান্য হালকা ফরাসি সুরা রুচিবানেরা বেশি পছন্দ করেন।
কলকাতার নতুন কেল্লাটি খুব প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন, কিন্তু আবহাওয়ার জন্য সৈন্যদের স্বাস্থ্য ভাল থাকে না। কেবল ধপাধপ অসুখে পড়ে আর মরে।
একদিন কেল্লায় গিয়ে দেখি প্রায় তিনশো সৈন্য অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছে। সৈন্যদের মধ্যে মৃত্যুর হারও খুব বেশি। এর কারণ আমার মনে হয় সস্তায় অত্যধিক মদ্যপান এবং কড়া রোদ লাগানো। এখানকার স্যাঁতসেঁতে হাওয়ার সঙ্গে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপ মিশলে ঘরেও বাস করা যায় না, বাইরেও বেরুনো যায় না, দম বন্ধ হয়ে আসে। এইজন্য দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এখানে রীতিমতো ব্যয়সাপেক্ষ। স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করতে হলে এইখানে যা প্রয়োজন হয় তা প্রায় বিলাসিতার শামিল, ইংলন্ডে তার দরকার হয় না। কলকাতার একজন সাধারণ ইয়োরোপীয় দোকানদারের একটি বগি—গাড়ি আছে। এই গাড়ি করে সন্ধ্যার পরে বেড়াতে না বেরুলে তার দেহ—মন শীতল হয় না।
আজ জুন মাসের পয়লা তারিখ। সকালবেলা খুব গরম ছিল, এখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে বৃষ্টি নামছে। মনে হচ্ছে যেন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মেঘের গুরু গুরু গর্জন শোনা যাচ্ছে, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, চোখ ঝলসে যাচ্ছে আলোয়। আমি ইয়োরোপে কখনও বজ্রের এরকম কর্ণভেদী নিনাদ শুনিনি। এ দেশের বাসিন্দাদের এ সম্বন্ধে কোনো হুঁশ আছে বলে মনে হয় না। বিদ্যুতের জন্য ভাল ভাল বাড়িতে কন্ডাক্টর আছে। ঝড়বৃষ্টি বজ্রপাতের পর বাতাস খুব ঠান্ডা হয়ে যায়, আরাম লাগে।
আমার এক বন্ধু সপরিবারে লখনউ বেড়াতে যাচ্ছেন। তাঁর জন্য যে বিরাট নৌবহর তিনি তলব করেছেন সংক্ষেপে তার বিবরণ দিচ্ছি :
একটি চমৎকার ষোলো—দাঁড়ের পানসি, তার মধ্যে দু’টি সুন্দর কেবিন, ভেনিসিয়ান কাচের জানালা দিয়ে ঘেরা, ভিতরে টানা—পাখা এবং ঝর্নাস্নানের জন্য উপরে ঝাঁঝরি লাগানো বাথরুম দু’টি। এই পানসিতে আমার বন্ধু, তাঁর স্ত্রী ও শিশুসন্তান যাবেন।
সঙ্গে বাবুর্চিদের ডিঙি, তাতে নানা রকমের খাদ্যদ্রব্য ভর্তি।
একটি বিরাট নৌকায় বিছানা, বাসনকোশন ও আসবাবপত্তর ঠাসা।
ধোপার জন্য আলাদা একটি নৌকা, তাতে ধোপার বউ এবং সাহেবের কুকুরও যাত্রী।
একটি বৃহৎ নৌকা ভাল ভাল ঘোড়ার জন্য সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। সাহেব মধ্যে মধ্যে তীরে নেমে ঘোড়ায় চড়বেন।
এ ছাড়া আরও একটি বড় নৌকা সঙ্গে যাবে, যদি কোনো দরকারে লাগে তাই।
এ তো গেল নৌকার হিসেব, এবারে তার খরচের হিসেব দিচ্ছি। পানসির ভাড়া দৈনিক কুড়ি টাকা, অন্যান্য নৌকার ভাড়ার হারও আনুপাতিক। নদীপথে লখনউ যেতে তিন—চার মাস লাগে। কেবল নৌকাভাড়া হিসেব করলেই বোঝা যায় খরচের বহর কত।
এ দেশের গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত তিনটি প্রধান ঋতুর সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়ে গেছে। এখন বর্ষাকাল, বেশ গরম আছে, পাখা চলে। তবু মধ্যে মধ্যে প্রবল বৃষ্টিপাতের পর আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে যায়।
২৯ আগস্ট ১৮২৩
গবর্নর—জেনারেল ও লেডি আমহার্স্ট দু’জনেই কলকাতার লোকের কাছে খুব প্রিয়। লাটভবনে খানাপিনার সময় লেডি আমহার্স্টের আদর—আপ্যায়নে অতিথিরা প্রীত ও মুগ্ধ হন। নতুন লাটসাহেব নিজের ভোগবিলাসের ব্যাপারেও মিতব্যয়ী। তাঁর আমলে ভৃত্যের সংখ্যা অনেক কমে গেছে এবং বাড়ির বাহারে বাতিও নিভে গেছে অনেক। তিনি ঠিক করেছেন ব্যারাকপুরের বাগানে সবজি চাষ করবেন এবং ভাল করে আলু ফলাবেন। ভারতীয়রা এই ধরনের হিসেবিপনায় অভ্যস্ত নয়, তাই ইয়োরোপীয় কাউকে এরকম হতে দেখলে তারা বেশ আশ্চর্যই হয়ে যায়।
অন্যান্য জায়গার মতন এ দেশেও নগদ পয়সা দিয়ে একান্ত প্রয়োজনীয় ও বিলাসিতার সামগ্রী কিনতে হয়। অতএব পয়সার অভাব হলেই মহাজনদের কাছ থেকে ধার করতে হয় (এই মহাজনদের ফ্যানি ‘richest dogs’ বলেছেন)। এখন শতকরা আট টাকা করে সুদ, আগে ছিল দশ টাকা করে। ঋণের পরিমাণ কিছু দূর বাড়লে তারা বাধ্য করে ইনশিওর করতে এবং তার হারও অত্যন্ত বেশি। কত লোকের জীবন যে এ দেশে এই ঋণের বোঝা বহন করতে না পেরে নষ্ট হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। আমি ইংরেজদের কথা বলছি। ঋণের দায়ে এমনভাবে অনেকে জড়িয়ে পড়েন যে শেষে ভারতবর্ষ ছেড়ে আর স্বদেশে ফিরতে পারেন না। সুদের হার এত বেশি যে তার চাপে ঋণের বোঝা শীঘ্রই দ্বিগুণ হয়ে যায়, এবং তা পরিশোধ করতে না পারলে তিনগুণ বা চারগুণ হতেও দেরি হয় না। মনে কোরো না আমি রংচং দিয়ে ছবি আঁকছি। এর মধ্যে রং চড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করিনি। যা বললাম তার প্রত্যেকটি কথা সত্য। এখানে না থাকলে তা বুঝতে পারা সম্ভব নয়। এ দেশে যাঁরা নতুন আসেন তাঁদের বুঝতে সময় লাগে যে টাকা ধার করলে সুদ আর আসলের হিসেবে এক আর এক মিলে দুই—ই হয় না, এগারো হয়।
টি পু সু ল তা নে র পু ত্র
আমাদের বাড়িতে টিপু সুলতানের পুত্র শাহাজাদা জামান জামউদ্দিন মহম্মদ বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের বাসার কাছে একটি বাড়িতে তিনি থাকেন, আগে কথা দিয়েছিলেন যে একদিন বেড়াতে আসবেন। পরদিন সকালেই তিনি আসেন এবং প্রায় ঘণ্টা দুই বসে গল্পগুজব করেন। গত বছরখানেক ধরে তিনি ইংরেজি শিখছেন। খাঁচায় একটি ছোট্ট পাখি দেখে তিনি বললেন, ‘সুন্দর হলদে পাখিটা, নাম কী পাখির?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘ক্যানারি পাখি।’ ‘ক্যানারি পাখি? বেশ চমৎকার পাখি তো? এ দেশে হয় না বুঝি?’ এইভাবে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল, ভাঙা—ভাঙা ইংরেজিতে তিনি বলতে লাগলেন, আমিও তার জবাব দিলাম। অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। ভাবলাম তিনি বোধহয় আর উঠবেন না। জানতাম না যে এ দেশীয় প্রথা অনুযায়ী কারও বাড়িতে আসাটা অতিথির ইচ্ছার মতন, কিন্তু যাওয়াটা গৃহস্বামীর খুশি ও অনুমতির উপর নির্ভর করে। তিনি আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, বিদায় নিতে পারছিলেন না। পরে বিদায় নিয়ে বললেন, ‘এখন যাই তাহলে, আবার একদিন আসব।’ পরদিন তিনটি পাত্র ভরে তিনি আমাকে নানারকম মিষ্টি পাঠিয়ে দিলেন। কেন পাঠালেন বুঝতে পারিনি। পরে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম, এ দেশের প্রথা হল কারও বাড়িতে বেড়াতে এলে পরে তাকে মিষ্টি উপহার দিতে হয়, এবং তা প্রত্যাখ্যান করলে অতিথিকে নাকি অপমান করা হয়।
.
দুর্গোৎসব ১৮২৩
সেদিন দুর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম একজন ধনিক বাঙালিবাবুর বাড়ি। ‘দুর্গা’ নামে হিন্দুদের যে দেবী আছেন তাঁরই ‘অনারে’ এই উৎসব হয়। বাবুর চারমহলা বাড়ি, মধ্যিখানে বিরাট উঠোন। সেই উঠোনের একপাশে উঁচু মঞ্চের উপর দেবী দুর্গার সিংহাসন পাতা। সিংহাসনের উপর দুর্গার মাটির প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। মঞ্চের দু’ধারে সিঁড়িতে ব্রাহ্মণরা উপবিষ্ট, পূজার অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। প্রতিমার হাত দশটি, যার জন্য দুর্গা দশভুজা বলে পরিচিত। একটি ডান হাত দিয়ে তিনি এক ভীষণাকৃতি অসুরকে বর্শাবিদ্ধ করেছেন, বাম হাতে একটি বিষাক্ত সাপের লেজসহ অসুরের ঝুঁটি ধরেছেন, সাপটি অসুরের বক্ষ স্থল দংশন করছে। বাকি আটটি হাত ডাইনে—বামে প্রসারিত, প্রত্যেক হাতে একটি করে মারণাস্ত্র। তাঁর দক্ষিণ হাঁটুর কাছে একটি সিংহ এবং বাম হাঁটুর কাছে অসুর। সিংহ দেবীকে বহন করছে মনে হয়।
পূজামণ্ডপের পাশের একটি বড় ঘরে নানা রকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই বাবুর ইয়োরোপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশি পরিবেশক ‘মেসার্স গান্টার অ্যাণ্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও ফরাসি মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হলঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজিদের নাচ—গান হচ্ছিল, এবং ইয়োরোপ ও এ দেশি ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে, চেয়ারে বসে সুরা—সহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। বাইরেও বহু সাধারণ লোকের ভিড় হয়েছিল বাইজিদের গান শোনার জন্য। গানের হিন্দুস্থানি সুর মণ্ডপে সমাগত লোকজনদের মাতিয়ে তুলেছিল আনন্দে।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলতে থাকে। পাঁচ দিন পরে ষষ্ঠীর দিন দেবী জেগে ওঠেন, এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিনে মহাসমারোহে তাঁর পূজা হয়। নবমীর দিন বলিদান দেওয়া হয় এবং এক কোপে মুণ্ডচ্ছেদ করতে না পারলে বলি নাকি সার্থক হয় না। পরদিন দশমীতে দেবীর প্রতিমা নদীতে বিসর্জন দিয়ে উৎসব শেষ হয়ে যায়। আরও পাঁচ দিন পরে পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজা হয়। সেদিন রাতে নাকি হিন্দুরা ঘুমোয় না। কারণ পূর্ণিমার রাতে লক্ষ্মী সকলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। বাড়ি অন্ধকার ও লোকজন নিদ্রিত দেখলে তিনি ফিরে যান। লক্ষ্মী হলেন ধনৈশ্বর্যের দেবী, গৃহে পদার্পণ করলেই গৃহীর ধনলাভ হয়। সুতরাং লক্ষ্মী যাতে ফিরে না যান তার জন্য হিন্দুরা আলোকিত ঘরে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেন।
দুর্গাপূজার কয়েকদিন আগে, বাড়ির সরকারমশায়রা ছুটি নিয়ে দেশঘরে চলে যান। আর ধনিক বাঙালিবাবুরা পূজার সময় যে পরিমাণ অর্থব্যয় করেন তার হিসেব নেই।
চু রি ও চা ল প ড়া র ক থা
কলকাতায় আসার পর আমাদের বাড়িতে যে কতবার চুরি হয়েছে তার ঠিক নেই। ভৃত্য ও বেয়ারাদের বদল করেও চুরি বন্ধ করা যায় না। একদিন এক আশ্চর্য চুরি হল বাড়িতে। কয়েকজন বন্ধুকে সেদিন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলাম খাবার জন্য। আমার স্বামী বৈঠকখানার টেবিলে তাঁর হাতঘড়িটা রেখে খেতে গিয়েছিলেন। এসে দেখেন ঘড়ি উধাও, অর্থাৎ চুরি গেছে। চোরকে চিনতে আমাদের দেরি হল না, তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেওয়া হল। মুনশি এলেন, খোঁজখবর করে সাত দিন সময় দিলেন, এবং বললেন যে, এর মধ্যে চোরাই ঘড়ি যদি ফেরত না—পাওয়া যায় তাহলে বাড়ির সকলকে তিনি চালপড়া খাইয়ে চোর ধরবেন। সাধারণত দেখা যায় যে চালপড়ার ভয় দেখালেই কাজ হয়, চোরাই মাল যথাস্থানে ফিরে আসে। নির্দিষ্ট দিনে পুলিশ মুনশি বাড়ি এলেন এবং ভৃত্যদের তাঁর সামনে ডেকে পাঠালেন। ভৃত্যরা আগে থেকেই তাঁর আদেশমতন উপোস করে ছিল। মুনশির সামনে তারা সার বেঁধে বসল। তারপর চালপড়ার প্রস্তুতি আরম্ভ করলেন পুলিশ—মুনশি।
কলকাতা শহরে তখন হরেক রকমের টাকা চলতি ছিল। তার মধ্যে ‘আকবরবাদী’ টাকার উপর এদেশের লোকের আস্থা ছিল গভীর। চালপড়ার জন্য মুনশি প্রায় দশ সের চাল ঠান্ডা জলে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর একটি ছোট নিক্তিতে একদিকে আকবরবাদী টাকা দিয়ে তিনি চাল ওজন করে ভাগে—ভাগে রাখতে লাগলেন। ওজন করা শেষ হয়ে গেলে এক—একজন করে ভৃত্যদের ডেকে হাতের মুঠোয় এক ভাগ করে চাল দিয়ে শপথ করতে বললেন এই বলে—’আমি চুরি করিনি, কে চুরি করেছে জানি না, চোরাই জিনিস সম্বন্ধেও খোঁজ রাখি না।’ প্রায় পঁয়ত্রিশজন ভৃত্য ছিল। সকলকে চাল খাওয়ানো ও শপথ করানো হয়ে গেলে মুনশি তাদের ডেকে বললেন : ‘তোমাদের মধ্যে কেউ মিথ্যা শপথ করেছ। যে মিথ্যা বলছ, ভগবান তাদের শাস্তি দেবেন। এই চাল মুখের ভিতর দিয়ে চিবিয়ে তোমরা সামনের কলাপাতায় ফেলবে। যে মিথ্যা বলেছ বা চুরি করেছ, বা চুরি সম্বন্ধে কিছু জানো, তার মুখের চাল ভিজবে না, শুকনো থাকবে।’
প্রত্যেকে চাল চিবিয়ে কলাপাতায় ফেলল। তার মধ্যে বত্রিশজনের মুখের চাল দেখা গেল বেশ ভিজে ও লালাসিক্ত, আর বাকি তিনজনের একেবারে শুকনো খটখটে। চেবানোর ফলে চাল গুঁড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু একটুও ভেজেনি। মুনশি তাদের দেখিয়ে বললেন, এরাই অপরাধী, ঘড়ি এরাই চুরি করেছে। বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতকড়া দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। বাস্তবিকই যে তিনজনের মুখের চাল শুকনো ছিল, তারা আগেকার দাগি চোর। ঘড়ি পাই বা না পাই, কিছুদিনের জন্য চোরের হাত থেকে রেহাই পাব জেনে নিশ্চিন্ত হলাম। চালপড়া অপরাধী ধরার একটা অভিনব পদ্ধতি বটে, কিন্তু এর মধ্যে অনুমান ছাড়াও বিজ্ঞান কিছুটা আছে। আসলে অপরাধী যে, সে ভয় পাবেই এবং ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে যাবেই। সে যা—ই হোক, আমি এ দেশের চালপড়ার পক্ষপাতী, কারণ হাতেনাতে তার ভালই ফল পেয়েছি।
১৮২৪—২৮ সাল
কলকাতা শহরে বাস করার কতকগুলো সুবিধা আছে। কাছাকাছি গবর্নমেন্টের নজরে থাকা যায় এবং তাতে চাকরিবাকরি পাওয়ার সুবিধা হয়। ইংলন্ডের সংবাদও সবার আগে পাওয়া যায় কলকাতায়। অসুখবিসুখ হলে চিকৎসার সুবিধাও আছে এখানে। কিন্তু শহুরে জীবনের অসুবিধা যেগুলি তারও অভাব নেই। প্রচণ্ড বাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয়ের খরচও অত্যধিক, আর টাকা দু’হাতে ছড়ানোর প্রলোভন যে কত তার ঠিক নেই।
.
জানুয়ারি ১৮২৪
আমাদের এক বন্ধু, বেশ উচ্চপদস্থ সিবিলিয়ান, বছর আঠারো আগে (১৮০৫—০৬ সাল) কলকাতার এসে হাজার পনেরো টাকা ধার করেছিলেন। তখন সুদের হার ছিল শতকরা বারো টাকা। জামিনের জন্য পরে তাঁকে লাইফ—ইনশিওরও করতে হয়। তার জন্য দালালি শতকরা এক টাকা করে ধরে মোট সুদের হার হয় শতকরা ষোলো টাকা। আসল টাকার প্রায় পাঁচগুণ পরিশোধ করার পর তিনি আশা করেছিলেন যে মহাজন এবারে হয়তো তাঁর সুদবৃদ্ধির হার কিছু কমাবেন। কিন্তু মহাজনটি তাঁকে বলেন, ‘আসল টাকা ঘুমিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সুদের চোখে ঘুম নেই, দিনরাত সে জেগে বসে আছে।’ কাজেই বন্ধুটি এখন দেনা মিটিয়ে ফেলার জন্য সর্বস্ব পণ করে সঞ্চয় করতে আরম্ভ করেছেন।
আমরা এ দেশে এসে বিলাসিতা করি বলে অনেকে অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা যদি জানতেন, একটু সুখে—স্বচ্ছন্দে—আরামে থাকতে হলে একটা ভাল বাড়ি, ভাল আসবাবপত্তর, ভাল গাড়িঘোড়া, বন্ধুদের জন্য ভাল সুরা, ভাল ও সংখ্যায় বেশ কয়েকজন ভৃত্য, ভাল ক্রেডিট এবং একটা ভাল চাকরি যে কত দরকার তাহলে অনর্থক ব্যয়বাহুল্য সম্বন্ধে অভিযোগ করতেন না।
লাটসাহেবের একটি বাগানবাড়ি আছে ব্যারাকপুরে, সেখানে ঘোড়দৌড়ের সময় কলকাতার লোকদের ভিড় হয়। এক সপ্তাহের জন্য আমরা ব্যারাকপুরে গিয়েছিলাম, খুব ভাল লেগেছিল। লেডি আমহার্স্ট অনেক খরচ করে লাটভবনে বাজি পোড়ানোর উৎসব করেছিলেন। ব্যারাকপুর থেকে পাঁচ মাইল দূরে বর্ধমানরাজের জমিদারির অধীন একটি জায়গায় পুরনো দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তা খুব খারাপ বলে আমি বগি গাড়িতে না চড়ে হাতির পিঠে চড়ে গিয়েছিলাম। এর আগে কখনও হাতির পিঠে চড়িনি। হাতিটা হাঁটু গেড়ে বসল, তার গায়ে মই লাগিয়ে পিঠের উপর উঠে বসলাম। তারপর সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মন্থরগতিতে চলতে লাগল। মনে হল যেন একটা গোটা বাড়ি চার পায়ে ভর দিয়ে চলেছে।
মাঠ, খানা—ডোবা ও ধানের খেতের উপর দিয়ে হাতি তার বিরাট পদস্তম্ভ দিয়ে সব দলে—পিষে চলছিল। খেতের মধ্যে সরু আল দিয়ে সব জমি ঘেরা। এই সরু আলের উপর দিয়ে মাহুত হাতিটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, যাতে খেতের ফসলের না ক্ষতি হয়। হাতিরও চলা দেখে মনে হচ্ছিল এ সম্বন্ধে সে—ও কম হুঁশিয়ার নয়। যেতে যেতে রাস্তার ধারে একজন ফকিরকে দেখলাম। বেশভূষা দেখলেই ফকিরকে চেনা যায়, কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না। পথের ধারে একটা মাটির গর্তের মধ্যে তার বাসা, ছেঁড়া মাদুর ও কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা। ফকিরের অস্থিচর্মসার চেহারা দেখলে বোঝা যায় প্রায় অনাহারেই তাকে দিন কাটাতে হয়। এই গর্তটির মধ্যে পাঁচ বছর ধরে সে রয়েছে, হাজার অনুরোধ করলেও গ্রামের মধ্যে থাকতে চায় না। মাথার কাছে সারারাত কাঠের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারলে সে আর কিছু চায় না। ফকিরটি উভয় প্রদেশের লোক, সেখানে তার বিষয়সম্পত্তি থেকে তার কোনো আশা নেই দেখে শেষে ফকিরের বেশ ধরে এইভাবে জীবন কাটাতে আরম্ভ করে।
ব্যারাকপুরের লাটভবনে একটি ছোট পশুশালা আছে, তাতে ভাল ভাল কয়েকটি বাঘ, চিতা ও হায়নাও রাখা হয়েছে। আমার আয়া একদিন বায়না ধরে বসল যে আমার সঙ্গে পশুশালায় সে বেড়াতে যাবে, কারণ তার হায়না দেখার খুব ইচ্ছে। সঙ্গে করে তাকে হায়না দেখাতে নিয়ে গেলাম। হায়নার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বিশেষ করে হায়না সম্বন্ধে তোমার এত কৌতূহল কেন?’ প্রথমটা হেসে, তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে সে বলল, ‘আমি ও আমার স্বামী আমাদের কোলের সন্তানটিকে নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম, এমন সময় একটি হায়না এসে চুপিসারে ছেলেটিকে তুলে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। গ্রামের লোক তার পিছনে ছুটে শিশুটিকে উদ্ধার করে বটে, কিন্তু মৃত টুকরো—টুকরো অবস্থায়। তাই আমার হায়না দেখার এত আগ্রহ।’
ভারতবর্ষের সঙ্গে স্টিমবোটে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা এবারে কিছুটা সফল হবে বলে মনে হয়। কিছুদিন ধরে এ বিষয়ে কথাবার্তা চলছে, এবারে একটা কিছু না হয়ে আর যায় না। প্রথম যিনি স্টিমবোট চালানোর জন্য একটি কোম্পানি করবেন তিনি মোটা মুনাফা করতে পারবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এবারে কেউ—না—কেউ সাহস করে এ পথে পা বাড়াবেন আশা করা যায়।
অন্যান্য শহরের মতন কলকাতাতেও ভাল বাড়ি পাওয়া শক্ত। আমাদের প্রথম বাড়িটায় গ্রীষ্মকালে গরম হাওয়া ঢুকত বেশি, দ্বিতীয় বাড়িটা ছিল নিচু ও স্যাঁতসেঁতে, অসুখবিসুখ বেশি হত। আমার স্বামী কলেজ ছাড়ার পর কলকাতায় চাকরি পেয়েছেন, আমরা চৌরঙ্গি রোডের একটি নূতন বাসায় চলে এসেছি।
ভাল নাচ দেখতে চেয়েছিলাম বলে মহীশূরের রাজকুমার আমাকে একটি নাচের আসরে নিমন্ত্রণ করেন। কিন্তু নাচ আমার তেমন ভাল লাগেনি, তার চেয়ে গানগুলি বরং বেশ মধুর লেগেছিল। কলকাতার দিনগুলিও এখন আনন্দের ও স্ফূর্তির দিন। লাটভবনে বড় বড় ‘পার্টি’ তো লেগেই আছে, শহরের ধনী ব্যক্তিরাও ডিনার ও ফ্যান্সি—বলনাচে বিভোর হয়ে আছেন।
কলকাতায় যে গোরুর দুধ পাওয়া যায় তা খেতে মোটেই ভাল নয়, সাধারণত ছাগলের দুধ আমরা খেয়ে থাকি। বাংলা দেশের ছাগলগুলো দেখতে বেঁটে ও ছোটখাটো হলেও হৃষ্টপুষ্ট, দুধও ভাল দেয়। চাকরে সকালবেলা দুধ দুয়ে ফেনাসমেত পাত্রে করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এনে দেয়।
আমার স্বামী কলকাতার লটারিতে কয়েকটি টিকিট কিনে জিতেছেন, তেরোটি পুরো টিকিট, একটি অর্ধেক, প্রত্যেক টিকিটে একশো টাকা। সব টাকাটাই তিনি তাঁর এজেন্টদের পাঠিয়ে দিয়েছেন, কেবল একটি টিকিটের টাকা উপহার দিয়েছেন আমাকে। আমার টিকিটের প্রাইজ পাঁচ হাজার টাকা। পরদিন আমরা ভাল আরবি ঘোড়া এবং একজোড়া পার্সি ঘোড়া কিনেছি।
.
১৭ জুন ১৮২৪
আমাদের এক তরুণ বন্ধু রাইটার্স বিল্ডিঙে থাকেন, অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। দু’দিন পরে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ি। তেরো দিন পরে সুস্থ হই। আমাকে সেবা করে আমার স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়েন, এগারোজন ভৃত্যও তাঁর সঙ্গে শয্যাশায়ী হয়। কলকাতার এই অসুখটা মহামারীর মতন দেখা দেয়, সাহেব ও বাঙালি মিলিয়ে শ’দুই লোক রেহাই পেয়েছিলেন কি না সন্দেহ। আশ্চর্য হল, বয়স্কদের মধ্যে কেউ এই অসুখে মারা যায়নি। অসুখটা আমারও হয়েছিল, কিন্তু ছত্রিশ ঘণ্টা পরে ছেড়ে যায়, আমি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ি। আমার স্বামীর ঠিক সেই অবস্থা হয়। গুটিতে সর্বাঙ্গ ছেয়ে যায়। চিতাবাঘের গায়ের ছোপের মতন অনেকের মুখে দাগ হয়ে যায়।
অসুখটা এমন ভয়াবহরূপে দেখা দেয় যে কোর্টকাছারি, কাস্টম হাউস, লটারি অফিস প্রভৃতি কলকাতার সব বড় বড় সরকারি বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। তিন দিনে আমাকে তিনজন ডাক্তার দেখেন, পরে তিনজনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সপ্তাহ তিনেক পরে অসুখ অনেক কমে যায় এবং লোকজন স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম শুরু করে।
ইংলন্ড থেকে নতুন কেউ এ দেশে এলে তাঁর টেবিলের জন্য যে সংখ্যক ভৃত্য দরকার হয় তা অবিশ্বাস্য। গতকাল আমরা আটজন মিলে একটি ডিনার খেয়েছিলাম, তার জন্য তেইশজন ভৃত্য প্রয়োজন হয়েছিল। প্রত্যেক ভদ্রলোক একজন থেকে দু’জন পর্যন্ত ভৃত্য সঙ্গে নেন, এবং প্রত্যেক মহিলা যত জন খুশি দাসী পরিবৃতা হয়ে আসেন। কলকাতা শহরে এই সময় সাহেবসমাজে হুঁকোয় তামাক খাওয়ার ফ্যাশন খুব চালু হয়েছিল। ভোজন শেষ হবার আগেই হুঁকোবরদাররা তামাক সেজে নল হাতে করে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। তামাকের গন্ধটি খুব মনোরম, পাশে বসে না খেয়েও উপভোগ করা যায়। মধ্যে মধ্যে মফসসলের সাহেবদের হুঁকোবরদাররা কী এক রকমের তামাক সেজে দেয় জানি না, অত্যন্ত উৎকট গন্ধ, পাশে থাকলে সহ্য করা যায় না।
কলকাতায় যে অসুখের কথা বলেছিলাম এখন আর তা নেই। সেদিন বেড়াতে বেরিয়ে দেখি সকলেরই কপালে—মুখে কালো পোড়া দাগের চিহ্ন, নিজের পর্যন্ত। কী কারণে এই অসুখের উৎপত্তি হল তা নিয়ে চিকিৎসকদের ও সাধারণ লোকের জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই। অসুখের নাম কী তা—ও ঠিক হয়নি। নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন অনাবৃষ্টির জন্য, কেউ বলেন বজ্রবিদ্যুতের অভাবের জন্য এই ব্যাধি দেখা দিয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়েও এই ব্যাধির উপদ্রব ছিল বলে শোনা যায়, তবে কোন বয়স্ক রোগীর মৃত্যু হত না সহজে।
ক বি বা ই র নে র মৃ ত্যু
১৮২৪ সালের অক্টোবর মাসে আমরা লর্ড বাইরনের মৃত্যুসংবাদ শুনে মর্মাহত হলাম। সেদিন সন্ধ্যায় বেড়াতে বেরিয়ে দেখলাম, হুগলি নদীর তীরে একটি গ্রিক চ্যাপেলে বাইরনের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হচ্ছে। যাঁরা বাইরনের দুশ্চরিত্রতা নিয়ে গলাবাজি করেন তাঁদের সঙ্গে সুর মেলাতে আমরা রাজি নই।
কলকাতায় শীত পড়ে গেছে, বিবাহেরও হুজুগ পড়েছে। তরুণরা (ইংরেজ) এখানে যেরকম ব্যস্ত হয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করে ফেলে তা অত্যন্ত হাস্যকর। পূর্বরাগ থেকে মিলন পর্যন্ত খুব বেশি হলে এক মাস সময় লাগে। অনেকে আইনত সাবালক হবার আগেই, অর্থাৎ নিজেরাই শিশু থাকতে থাকতে নতুন এক শিশুর পিতা হয়ে যায়। এ দেশের আবহাওয়ায় বিবাহ করাটা জলপানের চেয়েও সহজ ব্যাপার। কেবল অবাক হয়ে ভাবি, এত সহজে যেখানে বিবাহ হয় সেখানে দীর্ঘ বিবাহিত জীবন কাটে কী করে!
ডিসেম্বর (১৮২৪) মাস পড়েছে। ঘোড়দৌড়, থিয়েটার, ফ্যান্সি ড্রেসবল, ডিনার পার্টি, বোটানিক্যাল গার্ডেনে নৌকাযাত্রা ইত্যাদি বিচিত্র সব আমোদ—প্রমোদ পুরোদমে আরম্ভ হয়েছে। শীতের আমেজে আমার আরবি ঘোড়াটারও তেজ বেড়েছে, তার পিঠে চড়ে বেশ আরামে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, মনে হয় যেন হংসবলাকার মতন উড়ছি শহরে। শহর এখন সরগরম, প্রাসাদ অট্টালিকার দ্বার উন্মুক্ত, ভোজসভা, নাচসভা ও আতিথেয়তার বিলাসিতায় সকলে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, ক্রিসমাসের স্ফূর্তির হাওয়া বইছে।
.
ধ নি ক হি ন্দু র বা ড়ি না চ স ভা
এপ্রিল মাস, ১৮২৬ সাল। এ দেশের জেনানামহল বা অন্তঃপুর সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। প্রায় চার বছর হল ভারতবর্ষে এসেছি, কিন্তু নীচজাতের দাসীও নাচিয়ে বাইজি ছাড়া সাধারণ ভদ্র পরিবারের কোনো স্ত্রীলোকের মুখদর্শন করা সম্ভব হয়নি। বাইজির কথা বলতে একটি নাচসভার কথা মনে হচ্ছে। তার বিবরণ দিচ্ছি।
কিছুদিন আগে কলকাতা শহরে এক ধনিক হিন্দুর বাড়ি নাচসভায় নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রথম জাগলারদের খেলা দেখে বেশ আনন্দ পেলাম। তলোয়ারের খেলা তারা যা দেখাল খুব চমৎকার। খেলা শেষ হবার পর পরিবারের কর্তামশায় বললেন, অন্দরমহলে গিয়ে আমি তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক কি না। অবশ্যই ইচ্ছুক, এই সুযোগটাই এতদিন খুঁজছিলাম। সম্মতি জানাতে ভদ্রলোক আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। সামনে বিরাট এক পর্দা ঝুলছে। পর্দা পার হয়ে আরও ভিতরে গেলাম, বেশ ঘন অন্ধকার, কোনদিকে কী বা কে আছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের ভিতর থেকে দু’জন মহিলা (পরিচারিকা মনে হয়) এসে আমার হাত ধরলেন, এবং বিশাল সিঁড়ি পার হয়ে একটি সুসজ্জিত আলোকোজ্জ্বল ঘরে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলেন। সেই ঘরে গৃহস্বামীর স্ত্রী ও অন্যান্য মহিলা আত্মীয়রা এসে আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। দু’জন মহিলা, রীতিমতো সুন্দরী দেখতে। তাঁদের পোশাক—পরিচ্ছদ দেখে বুঝলাম কেন অন্দরমহলে এই মহিলাদের স্বামীরা ছাড়া অন্য সকলের প্রবেশ নিষেধ। তাঁদের পরনে অতিসূক্ষ্ম বেনারসি শাড়ি, সোনার জরির পাড় বসানো, দুই পেঁচ দিয়ে গায়ে জড়ানো, প্রান্তটি বা আঁচল পিঠে ফেলা। এই বস্ত্রের তলায় অন্য কোনো অন্তর্বাস নেই। কাজেই গায়ে দুই পেঁচ জড়ানো থাকলেও তা এত সূক্ষ্ম যে অঙ্গের শোভা পর্যন্ত বিচ্ছুরিত হয় তার ভিতর দিয়ে। মনে হয় যেন একটা রেশমি ওড়না গায়ের ওপর ফেলা রয়েছে। গলায় ও হাতে সোনা—হীরের অলংকার। গায়ের রং অনেকের হালকা মেহগনির মতন, কারও কারও বেশ কালো। আলোকিত ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা বাইরের একটি চিক—টাঙানো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এই চিকগুলি বাঁশের সরু কাঠি থেকে তৈরি এক রকমের পর্দা, চমৎকার দেখতে। বাইরে থেকে ভিতরে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু ভিতর থেকে বাইরে বেশ দেখা যায়। নিচের হলঘরের অতিথিদের উপর থেকে মহিলারা দেখতে পাচ্ছিলেন, নাচ দেখতেও তাঁদের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। সর্ববিষয়ে তাঁদের কৌতূহল বেশ সজাগ, সভার প্রায় প্রত্যেকটি লোককে তাঁরা চেনেন দেখলাম। আমার স্বামীটিকে উপর থেকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা অনুরোধ করলেন এবং আমার সন্তানাদিরও খুঁটিয়ে খোঁজ নিলেন। সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের জেনানামহল দেখার শখ অনেকদিন পরে মিটল বটে, কিন্তু দেখে তেমন খুশি হতে পারলাম না।
আমার স্বামী এলাহাবাদে নতুন একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে বদলি হবেন ঠিক হল। নদীপথে এলাহাবাদ ৮০০ মাইল এবং স্থলপথে ৫০০ মাইল বলে আমরা স্থির করলাম, নৌকায় করে ভারী মালপত্তর পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা গাড়িঘোড়া করে রওনা হব। ২২ নভেম্বর ১৮২৭, কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলাম। বাঁকুড়া, হাজারিবাগ, শেরঘাটি, সসরাম, নহবতপুর, মোগলসরাই হয়ে বারাণসী পৌঁছলাম ২৫ ডিসেম্বর। অধিকাংশ পথই আমরা আরবি ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলেছি, মধ্যে মধ্যে বগিতেও চলতে হয়েছে। ঘোড়া নিয়ে নদী পার হতে হয়েছে অনেক, আমরা নৌকায় পার হয়েছি, ঘোড়া সাঁতার দিয়েছে এমনও হয়েছে।
বারাণসীতে আমাদের এক সিবিলিয়ান বন্ধুর বাড়ি অতিথি হলাম। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে এলাহাবাদ পৌঁছতে হবে বলে আমার স্বামী বারাণসীতে আমাকে থাকতে বললেন এবং কলকাতার গাড়ি ও ঘোড়া বিদায় করে দিয়ে নতুন গাড়িঘোড়া নিয়ে বিশ্রামান্তে যাত্রা করতে নির্দেশ দিলেন। বারাণসী হল ভারতের হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থনগর, এর পথঘাট, ইটকাঠ, দেবদেউল, ঘাটমাঠ, এমনকি নাচিয়ে—বাজিয়ে পর্যন্ত সবকিছু অতি পবিত্র। এহেন প্রাচীন পবিত্র শহর দেখার লোভ আমি সম্বরণ করতে পারলাম না। আগে কলকাতা শহরে থেকেছি, তাতে বারাণসীর মতন শহর সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা হয় না। কলকাতায় নানা জাতির লোকের বাস, প্রত্যেক জাতি ইচ্ছা করলে তাদের নিজস্ব সামাজিকতার মধ্যে কালযাপন করতে পারে। বারাণসীতে তা সম্ভব নয়। ধর্ম, পুণ্য, ভক্তি, পরকাল—চিন্তা, পূজাপার্বণ ইত্যাদি নিয়েই বারাণসীর সামাজিক পরিবেশ রচিত হয়। সেদিন হিন্দুদের একটি মন্দিরে পূজা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসের যন্ত্রটি দেহের মধ্যে বোধহয় ঈশ্বর একটু বিশেষ কারিগরি করে তৈরি করেছেন।
ভোরে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম আরম্ভ করার আগে প্রত্যেকটি লোক দেবদেবীর পূজার্চনা করতে যায়। তাদের হাতে একটি ছোট পিতলের পাত্রে তেল থাকে, একটিতে থাকে ভাত আর একটিতে গঙ্গাজল ও ফুল। মন্দিরে এসে দেবতার মাথায় তারা সেগুলি ঢেলে দেয়, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে, এবং যাবার সময় সামনে ঝোলানো একটি ছোট ঘণ্টা তিনবার বাজিয়ে চলে যায়। পুরুষ ও মেয়ে সকলেই তা—ই করেন। এইটাই নাকি এখানকার প্রথা।
মন্দিরের ভিতরে বিচিত্র সব মূর্তি আছে, তার মধ্যে কালো ও সাদা পাথরের তৈরি দু’টি ষাঁড় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্দিরের বাইরে দু’টি জ্যান্ত ষাঁড় প্রায় সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, শোনা যায় তারাও নাকি পবিত্রতার প্রতিমূর্তি এবং দেবতার মতনই আরাধ্য। ফল—ফুল, ভোগ—নৈবেদ্য ভক্তরা তাদেরও দিয়ে থাকেন। পুণ্যবান হিন্দু যাঁরা প্রগাঢ় ভক্তিপ্রদর্শনে ইচ্ছুক তাঁরা একটি কচি নিখুঁত ও নধর ষাঁড় নিয়ে এসে দেবতাকে উৎসর্গ করার জন্য ব্রাহ্মণকে দান করেন। ব্রাহ্মণ সেই ষাঁড়ের গায়ে একটি ছাপ দিয়ে ছেড়ে দেন, যত্রতত্র স্বাধীনভাবে সে চরে বেড়ায়। তখন তাকে বলা হয় ‘ধর্মের ষাঁড়’ (Brahmani bull)। এই ধর্মের ষাঁড়ের স্বাধীনতার অধিকার অবাধ, অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়েও বেশি। কোন মানুষ অন্যায় করলে বা পথেঘাটে উপদ্রব করলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়, কিন্তু ধর্মের ষাঁড়কে তা কদাচ দেওয়া যায় না। তাকে আঘাত করলে, হিন্দুরা মনে করেন, পাপ হয়। ধর্মের ষাঁড়েরা তাই মনে আনন্দে বারাণসীর সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, দোকানে—বাজারে যা পায় তা—ই খায়, লোকেও ভক্তি করে খেতে দেয় এবং রাস্তায় রাস্তায়—গলিতে ফঁস ফঁস করে নিরীহ পথিকদের সন্ত্রস্ত করে। তাঞ্জামে করে বারাণসী শহরে ঘুরে বেড়ালাম। পথঘাট খুব সংকীর্ণ, তঞ্জামের উপর থেকে দু’পাশের বাড়ির ছাদ হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এ ছাড়া গলির তো অন্ত নেই, যেমন সরু তেমনি আঁকাবাঁকা, একবার ঢুকলে কোথায় বেরুব বা আদৌ বেরুতে পারব কিনা বলা যায় না। এরকমের গলির মধ্যে মুখোমুখি যদি ধর্মের ষাঁড়ের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে অবস্থাটা কি হতে পারে যে—কেউ কল্পনা করতে পারেন। আমার তঞ্জামের সামনে চরজন সশস্ত্র বরকন্দাজ রাস্তার লোকজন, পশু ইত্যাদি তাড়াতে তাড়াতে যাচ্ছিল। আমি কতকগুলি পূজার পিতলের ঘটি সংগ্রহ করলাম। ইচ্ছা হল বাড়িতে ফিরে শিশুটিকে বিগ্রহ সাজিয়ে তার কোঁকড়ানো চুলভরা মাথায় ঘটি করে তেল ও ফুল ও গঙ্গাজল ঢেলে হিন্দুদের মতন দেবপূজার মহড়া দেব।
এলাহাবাদ গিয়ে নতুন করে ঘরসংসার পেতে বসলাম। এখানে এসে এ দেশের বিচিত্র স্টিম—বাথ বা বাষ্পস্নানের অভিজ্ঞতা হল। পর পর তিনটি ঘর, প্রথম ঘরের উষ্ণতা মাঝামাঝি, দ্বিতীয় ঘরের তার চেয়ে বেশি, তৃতীয় ঘরে যেখানে স্টিম তৈরি হয় সেখানে প্রায় ১০০ ডিগ্রি। তৃতীয় ঘরটিতে কিছুক্ষণ বসার পর গা দিয়ে যখন বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরতে থাকে তখন পরিচারিকারা এসে বেসন (চানা বা ছোলার গুঁড়ো) দিয়ে গা ডলতে থাকে এবং আস্তে আস্তে তার উপর গরম জল ঢেলে পরিষ্কার করে স্নান করার পর শরীর এত তাজা হয় এবং গায়ের চামড়া এত পরিচ্ছন্ন হয়ে যায় যে মনে হয় যেন সাপের খোলস ছাড়ার মতন অবস্থা হয়েছে। স্টিম—বাথের এরকম অভিনব পদ্ধতি কল্পনা করা যায় না।
বাষ্পচালিত স্টিমার কলকাতা থেকে সর্বপ্রথম এলাহাবাদ এসে পৌঁছল ছাব্বিশ দিনে, এই বছরের (১৮২৮ সাল) পয়লা অক্টোবর তারিখে। যমুনা নদীর তীরে হাজার হাজার লোকের ভিড় হল স্টিমার দেখার জন্য। তাদের কাছে এটা একটা ভয়ানক তাজ্জব ব্যাপার।
.
স তী দা হে র বি ব র ণ ৭ ন ভে ম্ব র ১ ৮ ২ ৮
আমাদের বাড়ির খুব কাছে একজন ধনিক বাস করত। তার ব্যবসা ছিল ধান—চাল—গমের। জাতিতে হিন্দু। একদিন শুনলাম যে মারা গেছে। সেদিন নভেম্বর মাসের ৭ তারিখ। সকালে উঠে দেখি বাজারে খুব ভিড় হয়েছে, লোকজনের হল্লা হচ্ছে। ঢাকঢোল, ড্রাম, টমটম, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি মহানন্দে বাজানো হচ্ছে। হঠাৎ এত ধুমধাম করে বাজনা বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশের কারণ কী জানবার কৌতূহল হল। খোঁজ করে খবর পেলাম, মৃত বেনের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাবার সংকল্প করেছে। সতী হবে, সতী হবে একটা শোরগোল পড়ে গেছে। তারই জন্য এত আনন্দ।
স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট মহিলাকে ডেকে পাঠিয়ে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে সহমরণে কোনো লাভ নেই। যে মৃত তার জন্য প্রাণ দিয়ে কোনো পুণ্য সঞ্চয় করা যায় না। কিন্তু হাকিমের কোনো যুক্তিতেই কাজ হল না, রমণীর সংকল্প অটল রইল। অবশেষে হাকিম তাকে টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তাতেও কিছু হল না। এসব কথার উত্তরে হিন্দু রমণীটি বললেন, ‘হুজুর, আপনি যদি আমাকে আমার মৃত স্বামীর সঙ্গে সতী হতে বাধা দেন তাহলে আমি এই আদালতেই আপনার সামনে গলায় দড়ি দিয়ে মরব।’ এই কথা বলে সে দু’হাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে লাগল। শাস্ত্রকাররা নাকি বলেন যে সতীর প্রার্থনা ও কামনা কখনও ব্যর্থ হয় না, দেবতারা পর্যন্ত তা শুনে বিচলিত হন। অতএব সেই রমণীর মুখ দিয়ে যখন সতী হবার বাসনা প্রকাশ পেয়েছে তখন তার কোনোরকম নড়চড় করার সাধ্য নেই কারও, হাকিম তো দূরের কথা, দেবতারও নেই।
শাস্ত্রে আছে, পতির মৃত্যুর পর থেকে চিতায় সতী হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিধবা স্ত্রী জলস্পর্শ করতে পারবে না, করলে সে সতী হতে পারবে না। বেশিক্ষণ উপবাস করে থাকলে যদি রমণীটি ক্ষুধার তাড়নায় কিছু খেয়ে ফেলে এবং তার জন্য সতী হতে না পারে—এই আশায় হাকিম সেই বেনের মৃতদেহ ৪৮ ঘণ্টা, অর্থাৎ পুরো দুদিন আটকে রাখলেন। বিধবার কাছে প্রহরী বসিয়ে রাখা হল কিছু খায় কি না দেখার জন্য, কিন্তু সে কিছুই খেল না। কাজেই সহমরণ নিবারণের সমস্ত উপায় একে একে ব্যর্থ হবার পর হাকিম সাহেবও হতাশ হলেন। পরদিন সতীদাহ দেখার জন্য গঙ্গার ঘাটে লোকের ভিড় হল খুব, প্রায় পাঁচ হাজার লোক জমা হয়েছিল মনে হয়। আমার স্বামীও হাকিমের সঙ্গে সতীদাহ দেখার জন্য গঙ্গাতীরে গেলেন। তীরের উপর চিতা সাজানো হল এবং তার উপর সেই বাসি মৃতদেহও চাপিয়ে দেওয়া হল। হাকিম চারদিকে পাহারা দাঁড় করিয়ে দিলেন, যাতে কোনো লোক জ্বলন্ত চিতার দিকে না আসতে পারে।
গঙ্গাস্নান করে বেনের বিধবা পত্নী একটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিল, স্বামীর চিতার চারপাশে ঘুরে বেড়াল তা—ই নিয়ে, এবং শেষে চিতায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার উপর হাসিমুখে উঠে বসল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল চিতায়, সে তার স্বামীর মাথাটি কোলের উপর তুলে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল আগুনের মধ্যে। মুখে কয়েকবার উচ্চারণ করল, ‘রামনাম সত্য, রামনাম সত্য।’
বাতাস লেগে আগুন যখন শিখা বিস্তার করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করল তখন সতী রমণী হাত—পা ছুড়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে আরম্ভ করল, চেষ্টা করল চিতার উপর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পাশে যে একজন হিন্দু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল তার উপর অত্যাচার না—করা হয় দেখার জন্য, শেষ পর্যন্ত সে—ই তাকে লাঠি তুলে মারতে উদ্যত হল। ভয়ে শিউরে উঠে সতী আবার এগিয়ে গেল চিতার দিকে। তা—ই দেখে হাকিম হিন্দু পুলিশটিকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। সতী চিতার দিকে একটু এগিয়েই লাফ দিয়ে দৌড়ে পালাল, এবং ছুটতে ছুটতে গিয়ে কাছে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমবেত জনতা এবং মৃত বেনিয়ার আত্মীয়স্বজন ও ভাইরা একডাকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ধরে আন হতভাগিকে, মেরে ফেল, বাঁশের বাড়ি দে মাথায়, হাত—পা বেঁধে চিতায় ফেলে দে।’ এই কথা বলে হই হই করে দৌড়ে যখন তারা পলাতক সতীকে ধরতে গেল তখন উপস্থিত দু’চারজন ভদ্রলোক, হাকিম ও পুলিশ তাদের তাড়া করে বিদায় করে দিলেন।
সতী রমণী এবারে শান্ত হয়ে খানিকটা জল পান করল এবং তার লাল কাপড়ের আগুনও নিবিয়ে ফেলা হল। পরক্ষণেই সে বলল, চিতায় তাকে উঠতেই হবে, সতী হতেই হবে, তা না ছাড়া গতি নেই।
হাকিম ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত দিয়ে (তাতে অবশ্য সেই রমণী লোকের কাছে অপবিত্র হয়ে গেল) বললেন, ‘শাস্ত্রমতে আর তোমার সতী হওয়া চলবে না। মা! আমি জানি একবার চিতায় উঠে ছেড়ে চলে এলে আর তাতে ওঠা যায় না। কাজেই আর তোমাকে সতী হতে আইনত আমি দিতে পারি না। জানি আজ থেকে তোমাকে হিন্দুসমাজে একঘরে হয়ে বিনা দোষে কলঙ্কিত জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে একটুও চিন্তা করতে হবে না। কোম্পানির গবর্নমেন্ট তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবেন, তোমার খোরাক—পোশাকের অভাব হবে না।’
এই কথা বলে হাকিম স্ত্রীলোকটিকে পাল্কি করে, সঙ্গে একজন পাহারাদার দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। জনতা পাল্কির পথ ছেড়ে দূরে সরে গেল অবজ্ঞায় মুখ ঘুরিয়ে। অপবিত্র, অ—সত্য রমণীর মুখ দর্শন করাও পাপ। হিন্দুরা যে যার বাড়ি গিয়ে পরম বিজ্ঞের মতন এই কথা আলোচনা করতে লাগল। মুসলমানরা বলল, ভালই হয়েছে, জেনানার জান বেঁচেছে, তবে সাহেবসুবো হাকিম—হুজুরের জন্য এমন সুন্দর একটা তামাশা শেষ পর্যন্ত দেখা গেল না এই যা আপশোস!
বাস্তবিকই হাকিম ও কয়েকজন ইংরেজ ভদ্রলোক যদি সেখানে উপস্থিত না থাকতেন তাহলে হিন্দুরা স্ত্রীলোকটিকে মেরে—কেটে যেভাবে হোক তার মৃত স্বামীর সঙ্গে ওই চিতায় দাহ করত। তারপর বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াত যে, স্বেচ্ছায় সে সতী হয়েছে, তার মতন পুণ্যবতী রমণী আর কেউ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ত্রীলোকটি চিতায় উঠে বসার সময় শাস্ত্রসম্মত বিধান অনুযায়ী কয়েকবার বলেছিল, ‘এর আগে আমি ছ’বার জন্মগ্রহণ করেছি এবং ছ’বার আমার মৃত পতির সঙ্গে সহমরণে সতী হয়েছি। যদি সপ্তমবারও সতী না হই তাহলে আমার মতন হতভাগি আর কে আছে!’ পাশের একজন লোক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী লাভ হবে তোমার সহমরণে সতী হয়ে?’ স্ত্রীলোকটি উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার স্বামীর পরিবারে বিবাহিতা স্ত্রীলোকেরা সকলেই সতী হয়েছে, আমি যদি না হতে পারি তাহলে পরিবারের কলঙ্ক হবে।’ স্ত্রীলোকটির বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর। শোনা গেল তার কিছু সম্পত্তি আছে, এবং তার আত্মীয়স্বজন সেইজন্যই সহমরণের জন্য অত উদগ্রীব। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীটিকেও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারলে সম্পত্তি নিষ্কণ্টক হয়ে যায়।
যদি অন্যান্য সহমরণ এইরকম যত্ন করে তদারক করা হত তাহলে আমার বিশ্বাস ভারতবর্ষে এত সতীদাহ কখনও ঘটত না। কিন্তু অধিকাংশ জায়গায় তা হয় না। ক্ষিপ্ত জনতা ও কুচক্রী আত্মীয়দের তাড়নায় অসহায় অনাথ রমণীরা শেষ পর্যন্ত সহমরণ বরণ করে সতী হতে বাধ্য হয়। যে স্ত্রীলোকটির কথা আমরা বলছি, চিতার আগুনে তার হাত—পা সামান্য দগ্ধ হয়েছিল মাত্র। যদি সে সতী হত তাহলে হিন্দুরা নদীর তীরে তার একটি ছোট সমাধি—মন্দির তৈরি করে দিত। তার নাম সতী—মন্দির। গঙ্গাস্নানের সময় যাতায়াতের পথে হিন্দু নারীরা সেই মন্দিরে ভক্তিভরে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করত, ‘জন্মজন্মান্তরে যেন তোমার মতো পুণ্যবতী সতী হতে পারি।’ আমরা যখন কলকাতা শহরে ছিলাম তখনও অনেক সতীদাহ হয়েছে, তবে অধিকাংশই গঙ্গার অপর তীরে বলে আমরা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাইনি। এখানে সেই সুযোগ পাওয়া গেল। কারণ এটা কলকাতা শহর নয়। এখানে লোকজন নিশান উড়িয়ে, বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে সতীদাহের জন্য যাচ্ছিল, আমারই বাড়ির পাশ দিয়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা দেখলাম। মধ্যিখানে বেনের স্ত্রী লাল রঙের একটি কাপড় পরে হেঁটে চলেছে। আমার ভৃত্যরা সকলে দৌড়ে এল আমার অনুমতি নেবার জন্য, শোভাযাত্রার সঙ্গে তারাও সতীদাহের তামাশা দেখতে যাবে। ব্যাপারটা সাধারণ লোকের কাছে সত্যিই একটা তামাশা বা খেলার মতন। অনুমতি দিতে তারা সকলে চলে গেল, কেবল যে টানা—পাখা টানছিল তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হল না। সে বোধহয় তার জন্য আমাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল। আমার সাহেব বলেছিলেন, স্ত্রীলোকটি নাকি বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, দেখে মনে হয়নি যে আগুনে পুরে মরতে সে ভয় পাবে। যা—ই হোক, শেষ পর্যন্ত যে সে প্রাণে বেঁচেছে তাতে আমরা সকলে খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা হল, বেচারিকে এখন সমাজ—পরিত্যক্ত হয়ে একঘরে অবস্থায় বাস করতে হবে। তার হাতের ছোঁয়া তো কেউ খাবেই না, মুখ পর্যন্ত দর্শন করবে না। তবু এরকম সতীদাহ থেকে মুক্তির দৃষ্টান্ত কিছু লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরতে পারলে সমাজের যথেষ্ট কল্যাণ হবে বলে মনে হয়। তবু রক্ষা যে স্ত্রীলোকটির কোনো সন্তানাদি ছিল না। সম্পত্তির মধ্যে ছিল একটি ভাল বাড়ি এবং নগদ আট—ন’শো টাকা। সহমরণের উদ্দেশ্য সফল হলে তার দেবররা এই সম্পত্তিটুকু নিশ্চিন্তে ভোগদখল করতে পারত।