এবারও কপালী বাবাই বিয়ে দেবেন। জংলি কালীকে প্রণাম করার জন্য এগিয়ে যেতেই রাধার ভিতর থেকে কেউ বলে উঠল, ভুল হল, খুব ভুল হল। মজাখানা টের পাবি।
রাধার দুপা মাটির সঙ্গে আটকে গেল। মুখে আর দু’চোখে রক্ত উঠতে লাগল। কালীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে রাধার। বিড়বিড় করে বলল, রাক্ষুসী! আগে বললি না কেন? ভুল পথে নিজে টেনে নিয়ে গিয়ে কত আর মজা দেখাবি? শেষে তো আমাকে বাঁচানোর দায়ে নিজে এক বুড়ীকে খেয়েছিস! সাধ্য থাকে তো এবার আমাকে খেয়ে মজা দেখার সাধ মেটা।
হঠাৎ ওর চোখ মুখের এই পরিবর্তন দেখে কপালী বাবা অবাক। মনোহরও। কপালী বা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, হঠাৎ হল কি রে তোর, বিড়বিড় করে কি বলছিস?
আরক্ত চোখে রাধা ঘুরে তার দিকে তাকালো। তারপর মনোহরের দিকে। শেষে আস্তে আস্তে আবার কালীর দিকেই ফিল। হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে মাথা রেখে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করল। মনে মনে কেবল এক কথাই বার বার বলে গেল। তোর দায় তোর দায় তোর দায়। তুই সব করাচ্ছিস, সব করাচ্ছিস। তোর পরীক্ষায় আমি ভয় পাই না, ভয় দেখাস না, ভয় দেখায় না। রাখলে তুই রাখবি, খেলে তুই খাবি, লেখা কত মজা দেখাবি, তোর পা যেন না ছাড়ি না ছাড়ি, ছাড়লে তোর হার তোর হার তোর হার!
বিয়েটা নিঃশব্দে হয়ে গেল। কিন্তু দুদিন বাদে বউ ভাতের ঘটা দেখালো মনোহর পাইক। তার ঘরের সামনে মশু সামিয়ানা খাঁটিয়ে উৎসব। এ উৎসবে রাধাকে যারা স্নেহ করে, ভালবাসে তাদের কেউ নেই। সকলেই মনোহরের ইয়ারবকশী আর তার ব্যবসার খাতিরের লোক। এদের মধ্যে নিতাই স্যাকরাও আছে। রাধার প্রথম বিয়ের পর থেকেই মনোহরের তার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব।
-এই উৎসবে আরো একজন অতিথির পদার্পণ ঘটতে উপস্থিত সকলে মহাব্যস্ত। মনোহর আর তার সাঙ্গপাঙ্গারা তাকে কোথা বসাবে, কত ভাবে আপ্যায়ন করবে ভেবে পায় না। রাধা সহজে ভোলে না, দেখামাত্র চিনল। এদিকের সমস্ত অঞ্চলের নামজাদ। জোতদার শ্রীনাথ পোন্দার–লক্ষ্মীকান্তপুরে যার নিবাস। আজ আর হাঁটুর নিচে কাপড় তোলা নয়, খুব সাজগোজ করে এসেছে। হাসি হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালো, বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল, তার পর মন্তব্য করল, বহর পাঁচ ছয় আগেও একবার দেখেছিলাম, এখন তার থেকেও পাঁচছ’গুণ খাসা দেখতে হয়েছে, তোর বিবেচনা আছে দেখছি রে মনা।
মনা অর্থাৎ মনোহর তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘটা করে প্রণাম কৈল একটা। আহাদে গদগদ, আপনি হলেন গে আমার গার্জেন, আপনার প্রশংসার লাখো টাকা দাম মানি।
শ্ৰীনাথ পোদ্দার হাতের গয়নার বাক্স খুলে সরু একটা সোনার চেন হার বার করল। মনোহরকে বলল, নে তুই পরিয়ে দে।
জোরালো আপত্তি তুলে মনোহর বলল, বাঃ, আমি কেন, আপনার আশীৰ্বাদ আপনি নিজে হাতে পরিয়ে দিন ছিনাথদা, এমন ভাগ্যি আর কি আমাদের হবে!
মোসায়েব হৈ-হৈ করে উঠল, এমন ভাগ্যি থেকে বঞ্চিত করবেন না–আপনি নিজে পরিয়ে দিন–নিজে পরিয়ে দিন।
দ্যাখো ছোঁড়াদের কাণ্ড! শ্রীনাথ হাসিমুখে হার নিয়ে এগিয়ে এলো। রাধা মাথা নোয়াতে নিজের হাতেই হার পরালো। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। মনোহর চেঁচিয়ে বউকে বলল, লুটিয়ে পেন্নাম কর, তোর সামনে কে দাঁড়িয়ে জানিস না!
ওই হার, সেই সঙ্গে হাতের স্পর্শ মুহূর্তের মধ্যে জল-বিছুটির মতো চিড়বিড় করে উঠল। রাধা সোজা তাকালো। তারপর দু’হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে প্রণাম সারল। মনোহর জোরেই ধমকে উঠল, এটা কি রকম গড় করা হল–তোকে কি বললাম।
রাধার ঠাণ্ডা দু’চোখ মনোহরের দিকে ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীনাথ পোদ্দারও ওকেই খেঁকিয়ে উঠল, দ্যাখ মনা, তুই একটা গাধা, আজকের দিনে বউয়ের মর্যাদাখানা কি এ ধারণাটুকুও নেই! ধমক খেয়ে রাধা আস্তে আস্তে তার পায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, শ্রীনাথ বুকে সেই হাতটা ধরে ফেলে বলল, থাক, ওইটুকুতেই যথেষ্ট হয়েছে। হাতটা হাতে ধরাই থাকল, চাউনি বুকের দিকে সামান্য নেমে আবার মুখের ওপর স্থির হয়ে উঠল। রাধা চেয়ে আছে, চোখে চোখ। ছদ্ম আক্ষেপের সুরে এনাথ বলল, তিন ডাকাতের হাত থেকে বেরিয়ে এবারে আরো একটা বড় ডাকাতের হাতে পড়লি রে–।
হাসির হুল্লোড়। এমন রসিকতার কথা আর যেন হয় না। এই লোকের হাতের মধ্যে রাধার হাতটা জ্বলছে, হারের স্পর্শে গলায় ছ্যাকা লাগছে। কথাগুলো গলানো সিসের মতো কানে ঢুকেছে। –ভিতর থেকে ডাক শুনেছিল, ভুল হল, মজা টের পাবি। এই মূহুর্তে মনে হল, এই একজনও ওর জীবনে বিপদের মানুষ। এ সংকেত যেন তার চোখে মুখে লেখা।
রাত্রি। এটা রাধার দ্বিতীয় বাসর। প্রথম বাসরে হারাণ মণ্ডল তার যৌবনের আঙিনায় ভিখিরির মতো এসে গড়িয়েছিল। দ্বিতীয় বাসরের এই একজন ভোগের সদর্প উল্লাসে অধিকার বিস্তার করেছে। এই ভোগ প্রায় হিংস্র, প্রায় নিষ্ঠুর। না, রাধা দোসর হতে পারেনি।
পরদিনই রাধা নিজের ঘরে চলে এসেছে। এরকমই কথা ছিল। নিজের বাড়িতে মনোহর দিনে তার ব্যবসা আর লোকজন নিয়ে থাকবে, রাতের বাস এখানে। তার ব্যবসা বা তার লোকজন সম্পর্কে রাধার কোন ধারণা নেই। মাসখানেকের মধ্যে ধারণা করা সুযোগও হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যায় বা রাতে এলে মদের গন্ধ নাকে এসেছে তৃতীয় দিনে সেটা প্রথম পেয়েছে। জিগ্যেস করেছে, তুমি কিছু খেয়েটেয়ে এসেছ নাকি?
মনোহর প্রথমে অবাক একটু। পরে বুঝেও ঢাকতে চেষ্টা করেনি। বলেছে, তোর খাতিরে মদ তো খেয়েছি সেই দুকুরে, তা-ও গন্ধ পাচ্ছিস? তারপরেই হ্যাঁ-হ্যাঁ হাসি, রাতে মদ খেলে তোকে সেভাবে পেতে পারি না, অপেত্যঙ্গ ছাড়াছাড়া লাগে, এ জন্যেই দিনে খাচ্ছি, তা কি হয়েছে, তোর কপালী বাবা মওকা পেলে তো দিনেও চালায়, রাত্তিরেও চালায়।
বাবা এখন রাধার কপালী বাবা হয়েছে। আর দিনে মদ গেলার কারণ, রাতে খেলে ভোগে ঘাটতি পড়ে। একটা মাস ধরে এই ভোগের হিংস্র নিষ্ঠুর উল্লাস দেখে যাচ্ছে রাধা। একদিন কেবল বলেছিল, তুমি আমাকে বে-করা বউ ভাবব না আর কেউ ভাবব–এ কেমনধারা লম্পটের মতো আনন্দ করা তোমার?
জবাবে দাঁত বার করে হেসেছে, যন্ত্রণা স্বীকারই করেছে, মরদ কেমন টের পাচ্ছে। পরে বলেছে, অবাক করলি যে, লম্পট পছন্দ নয় তোর। আরো অর্থপূর্ণ আরো কুৎসিত হাসি। তারপর চাউনি একটু একটু করে ক্রুর হয়ে উঠেছে। বলেছে, শয়ে শয়ে লাল পিঁপড়ে দিয়ে আমার গায়ের মাংস কুরে খাইয়েছিস, সে-যা আমি ভুলে গেছি ভেবেছিস?
তপতপে মুখ করে রাধা বলেছে, সে-যন্তয়াও কিছু নয় বলে তো ঘরে বিষ মজুত রেখেছিলে!
আবার হি হি হাসি।–বিষ। তোর মতো মেয়ের জন্যি?–তা তোকে দেখাবার জন্যি ঘরে একটা শিশিতে গ্লুকোজের গুড় কিছু রেখেছিলাম বটে, কিন্তু দেখানোরও দরকার হলনি, শুনেই ঢলে পড়লি!
ঘৃণায় রাগে রাধা স্তব্ধ।–ভুলের বহর তো বুঝতেই পারছে, এরপর কি মজা টের পেতে বাকি?
ওর দিকে চেয়ে উৎকট আনন্দে মনোহর বুক ফুলিয়ে বলল, নিজের বোনাইয়ের সঙ্গে বে তে বসলি যখন, নিতাইয়ের দোকানে বসে বুক ঠুকে পিতিজ্ঞে করেছিলাম তোকে আমি কজায় আনব, না যদি পারি আমাকে যেন বেজন্মার ছেলে বলে-হারাণ মণ্ডল ভালোয় ভালোয় নিজে না মরলে ডাকাত কাকে বলে দেখতে পেতিস– কোথায় তোক নিয়ে উধাও হতাম কাক-পক্ষী টের পেত না। এই এক বছর ধরে আমি কোন্ জোরের মানুষ তোর ধারণা নেই–আমার মুরুব্বিকে দেখেছিস কিন্তু জানিস না।
রাধা সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে এক বছর ধরে কে তার মুরুব্বি। লক্ষ্মীকান্তপুরের শ্রীনাথ পোদ্দার।
কপালী বাবা হিমালয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মনে মনে অনেক বছর ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এবারে চট করেই সুযোগ হয়ে গেল। মনোহর পাইক রাধার মারফৎ দরাজ হাতেই তাকে টাকা দিয়েছে। রাধার মুখ দেখে বাবার কিছু খটকা লেগে থাকবে, মনোহরের অগোচরে অনেকবারই ওকে জিগ্যেস করেছেন, কেমন বুঝছিস ছোঁড়াটাকে–বল না?
কঠিন গলায় রাধা একই জবাব দিয়েছে, তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামিও না বাবা, তুমিও এ বিয়ে চেয়েছিলে বলে তোমাকে একটুও দুষব না-বোঝাপড়া যদি কিছু হয় তো মায়ের সঙ্গেই হবে।
কপালী বাবা কত মাস বাদে ফিরবেন সেটা তিনিও জানেন না। জংলি কালীর পুজোর ভার মনোহরের সামনেই তিনি রাধাকে দিয়ে গেছেন। রাতের এই সময়টুকুই কেবল রাধার শান্তি। সন্ধ্যার মধ্যে আসে, কিন্তু ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে ফিরতেই হয়। এরই মধ্যে শাসানো হয়ে গেছে, আমার দরকারে সময় না পেলে তোর পুজোটুজো বন্ধ করে দেব। রাধা মনে মনে জবাব দিয়েছে, তোমার মতো তিন পাষণ্ড এলেও ক্ষমতায কুলোবে না, কিন্তু ঝগড়া এড়াবার জন্য জবাব দেয়নি। বিয়ের পর থেকে বিলাসীর আবার ঠাঁই বদল হয়েছে, এখানকার ডেরার দাওয়ায় পড়ে থাকে। ফল-ফুল সরঞ্জাম সে-ই গুছিয়ে রাখে রাধার একপ্রস্থ য় জামা-কাপড় এখন মায়ের ঘরেই দড়িতে ঝোলানো থাকে। পরা-কাপড় বদলে রাখা পুজোয় বসে। পুজোয় বসা মানে আকুল হয়ে মা-কে ডাকা।
মাস দুই ভাইয়ের মধ্যেই মনোহরের রাধা-নেশা কমে এসেছে। মদের নেশায় মত্ত হয়ে ঘরে ফেরে। তখন বাদশাই মেজাজ। অকথ্য গালাগাল করে, কথায় কথায় মারতে আসে, বিয়ে না করেও ওর থেকে কত সুন্দরী মেয়ে ভোগে এসেছে বড়াই করে বলে। মদ গিলতে গিলতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে, সব কথাই জড়িয়ে যায়, রাতে ঘরে ঢোকার সামর্থ্য থাকে না। দাওয়ায় যে চটাই বিছিয়ে বসে মদ গেলে, তার ওপরেই ঢলে পড়ে। সকালের রোদে গা পুড়তে থাকলে তবে ঘুম ভাঙে। তারপরেও গুম হয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর চান-টান করে খেয়ে বা না খেয়ে সেই যে বেরোয়, ফেরে রাত দশট। এগারোটায়। ঘরে ফিরে আবার দেদার মদ গেলে। কবে-কবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ নেশা চলে সেটা রাখা মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে। বাড়িতে মদ গেলার ব্যাপারে আপত্তি করতে সে শাসিয়েছে, ফের একথা বললে ইয়ারবকশীদের নিয়ে এখানে মদের আসর বসাবে। তাদের কেউ কেউ দিনের বেলাতেও মাঝে সাঝে দাদার অর্থাৎ মনোহরের খোঁজ নিতে আসে। দরকার পড়লে তো আসেই। তাদের কুৎসিত সুব্ধ চোখ রাখার গায়ের মাংস ধুর। নিতে চায়। রাখার রাগ আর ঘেয়া মনোহর অনায়াসে বুঝতে পারে। চলে গেলে হি-হি করে হাসে। বলে বেশি দেমাক দেখাসনি, ওদের লেলিয়ে দিলে তোকে ছিঁড়ে খাবে। রাধা ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। কারণ, মজা টের পাওয়ার ব্যাপারে মা ওকে অনেক দূর টেনে নিয়ে যাবে এটা সে বুঝতে পারছে। মন বলছে, তো সবে শুরু।
কিন্তু এরপর যে অশান্তির শুরু রাধা সেটা সহজে বরদাস্ত করতে পারল না। একদিন দেখা করতে গেল পিছনের চালাঘরটা মনোহর লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করাচ্ছে। কি হবে জিগ্যেস করতে গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছে, দরকার আছে।
দরকারটা দুদিনের মধ্যেই বোঝা গেছে। এরপর দু’চাকা লাগানো একটা ঠেলাও এসেছে ওই ঘরে। সন্ধ্যায় এক-একদিন লোক এসে ঠেলাটা নিয়ে যায়, আর রাতের অন্ধকারে ওতে বোঝাই করে কি সব আসে। চালের বস্তা হলে রাধা তক্ষুনি বুঝতে পারে। কিন্তু ঠেলা নিয়ে বোঝাই ছোট বড় টিনের কৌটো আসে রাবারের থলে বোবাই হয়ে কিসব আসে, আবার এক-আধ দিনের মধ্যে রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে যায়।
সেই দুপুরে মনোহর খেতে বসেছে। তার আধ-হাতের মধ্যে রাধা গালে হাত দিয়ে উপুড় হয়ে বসে। দিনের বেলাতেই মদ গিলেছে। ভক ভক গন্ধ আসছে। রাধা জিগ্যেস করল, তোমার নিজের দুটো ঘর আর অত জায়গ, খালি থাকতে পিছনের চালা ঘরে কি এনে রাখছ?
মনোহর থমকে তাকালো। কঠিন গলায় জবাব দিল, তোর জানার দরকার নেই।
ঠাণ্ডা গলায় রাধা বলল, আমার ঘরে রাখতি হলে আমার জানার দরকার আছে।
খাওয়া থামিয়ে দিয়ে চেয়ে রইলো একটু। পরের মুহূর্তে রাখা বসা থেকে তিন হাত দূরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চোখে অন্ধকার দেখছে। গাল কান বেড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়েই চড়টা মেরেছে। আস্তে আস্তে উঠে বসতে যাতে দাঁতে দাঁত ঘষে মনোহর বলল, তোর দরকারের জবাব পেলি?
রাধা স্থির চেয়ে রইলো খানিক। গালের একদিক তপতপে লাল, ফর্সা হলে রক্ত ফেটে পড়ছে মনে হত। বলল, তোমার এত সাহস? থানার বড়বাবু আর তার বউ এখানে আসত তুমি খবর রাখো? বড়বাবুকে খবর দেব তুমি কি জিনিস রাখে, এসে দেখে যেতে।
পরের মুহূর্তে পৈশাচিক কাণ্ড। খাওয়া ফেলে উঠেছে। তারপর রাধাকে আবার মাটি নিতে হয়েছে। পাগলের মতো কিল চড় ঘুষি। সঙ্গে সঙ্গে হুংকার।ভয় দেখাচ্ছিস তুই আমাকে, বড়বাবু দেখাচ্ছিস! জোকের মুখে নুন দেবার মতো তোর বড়বাবুর বাবা আছে আমার হাতে সে খপর রাখিস? তার একটা কলমের আঁচড়ে তার চাকরি চলে যাবে–তাকে ডেকে আনবি বলে তড়পাচ্ছিস?
রাধা মুখ বুজে অমানুষিক মার সহ্য করেছে। লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে নিতেই থামল ‘ মদের নেশা ছুটে গেছে। খানিক বাদে জামা-প্যান্ট পরে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হল। রাধা মেঝেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। বার কয়েক আড়চোখে তাকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খুব কষ্ট হলেও রাধা জংলি কালীর পুজোয় এসেছে। এক-দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। মুখে কিছু বলছে না, মনে বলছে। মজা টের পাওয়াচ্ছিস, না? আমি তোরই মেয়ে ঠিক আছে।
পুজো শেষ হবার আগেই, মানে মা-কে মন ভরে ডাকা শেষ হবার আগে বিলাসীর সঙ্গে আর একজনের গলা পেল। না, রাধার মন আর স্থির হবে না। উঠে পড়ল। ঘরের আড়ালে গিয়ে পুজোর বেশবাস বদলে বেরিয়ে এলো।
মনোহর টর্চ হাতে পাশে পাশে চলেছে। মাঝে মাঝে গলা খাঁকারি দিচ্ছে। বলল, আন্ধারে কিছুতে একটা টর্চ হাতে না নিয়ে বেরুবি না, তোর বড় গো।
রাধা নির্বাক।
একটু বাদে আবার আপোসের গলা।-সকালেই মদের ওপর তুই দিলি তাতিয়ে–বিচ্ছিরি ব্যাপারটা হয়ে গেল, জানিস তো মদ খেলে আমার মাথার ঠিক থাকে না।
রাধা পথ ভাঙছে। মুখ তুলে তাকাচ্ছেও না।
হাসির চেষ্টা একটু ইয়ে, লক্ষ্মীকান্তপুরে ছিনাথদার ওখানে গেছলাম, তোর গায়ে হাত তুলেছি এনে রাগের চোটে আমার হাত ভেঙে দিতে আসে আর কি। আরে বাপ! তার এমন রাগ শিগগীর দেখিনি।–তোকে একদিন দেখতি আসবে বলেছে।
রাধার মুখে রা নেই।
ঘরে পৌঁছুলল। মনোহর এর আপোসের শেষ তাসটা ছাড়ল। আচ্ছা, তোর অপছন্দের জিনিস আর ওই চালাঘরে থাকবে না। কেবল চাল ডাল থাকলে তো আপত্তি নেই।
রাধা এর পরেও স্থির নির্বাক। তবে সোজা চোখে চোখ রেখেছে।
রাতে মদ খায়নি। কাছে এসে আদর করতে চেষ্টা করেছে। বলেছে, তুই সত্যি কি সুন্দর, আমি একটা পাষণ্ড।
রাখা মুখ খুলেছে।-আমার শরীলে যন্ত’ হচ্ছে, সরে যাও!
পরের দুদিন বা দুরাতেও মদ খায়নি। তার সোহাগের নিষ্ঠুরতা রাধা মুখ বুজে সহ্য করেছে।
দিনের পর দিন এরপর ওই চালাঘরে মাঝেসাজে কেবল চালের বস্তা আসতে দেখেছে। অন্য কিছু না। বেশির ভাগ দিন ফাঁক। চালাঘরে দু-চাকার ঠেলাটা পড়ে থাকে। রাধা বোঝে এ শুধু ভয়ে, আর কোনো কারণে নয়। তার গুরু শ্ৰনাথ পোদ্দার এই লোকের থেকে ঢের চালাক।
তারপর আবার যে-কে সেই। দেদার মদ গেলে। সত্যি না মারলেও কথায় কথায় তেড়ে মারতে আসে। অশ্রাব্য গালাগাল দেয়। রাধা যতটা পারে চুপ করে থাকে। মদ গিললে কথা বলা ছেড়ে ধারে কাছেও ঘেষে না। মদে বেহুশ হয়ে বেশির ভাগ রাতই ওই লোক দাওয়ায় পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। দাওয়ার ওপর ঢালু টালির ছাদ থাকায় নোদ-জলেও ঘুমের ব্যাঘাত হয় না।
কপালী বাবা ফিরেছেন আট মাস বাদে। রাধা নিজে কিছু না বললেও অশান্তি আঁচ করেছেন। বলেছেন, তোক তো একটুও ভালো দেখছি না, ছোঁড়াটা বেয়াড়া হয়ে উঠেছে?
রাধা বলেছে, ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, তোমার মায়ের পুজো যেমন করছি তেমনি করে যেতে অনুমতি দাও।
–ঠিক আছে ঠিক আছে, আমার মা কি রকম, তোর নয় নাকি?
রাধা জবাব দেয়নি। এতদিন বাদে ফিরে কপালী বাবা মনোহরের সম্পর্কে যেটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন তাতেই বিচলিত। শুধু মুখে নয়, পুজোর কাপড় জামা বদলাবার সময় রাধার গায়ে পিঠেও বিচ্ছিরি মারের দাগ দেখেছে বিলাসী তা-ও বলেছে। তিনি ফেরার পর মনোহর দেখা করতে আসেনি, পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। স্তম্ভিত হয়ে পরে তিনি রাধাকে বলেছেন, ছোঁড়াটার তো পাখা গজিয়েছে দেখছি–ও তো মরবে। আমি তোর কথা বলে ধমক লাগাতেই মুখের ওপর জবাব দিল, তোমার উপকার ছাড়া কখনো অপকার করিনি, আমার ব্যাপারে আর নাক গলাতে এসো না!
-সত্যি এসো না বাবা, কঠিন গলায় রাধা বলেছে, মায়ের হাতে ছেড়ে দাও, দেখি কোন্ পর্যন্ত টানে।
এত অশান্তি আর যন্ত্রণার মধ্যেও রাধা গান ছাড়েনি। আগের থেকে কম যদিও, তবু ডাক এলেই গাইতে যায়। গান যখন করে সব ভুলে যায়। দোতারবাবু রুমা সেনবিন্দুবাসিনী দেবী এবং আরো কেউ কেউ নিয়মিত টাকা-কাপড় দ্যান। ঘরের বউ তার টাকার মুখাপেক্ষী নয়, মনোহর এও বরদাস্ত করতে চায় না। প্রায়ই হুমকি দেয়, ভিক্ষে নিতে লজ্জা করে না, এরপর আমি তোর গানই বন্ধ করে দেব।
রাখা জংলি কালীর পুজো সেরে বা কোথাও থেকে গান গেয়ে রাতে যখন ফেরে, সময়ের বা টাকার হিসেব নেবার জন্য ইদানীং মনোহর কোনদিনই সজাগ থাকে না। তার নেশার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে চলেছে। টালির ছাদের নিচে দাওয়ার ওপর বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে। মুখ দিয়ে কেনা বেরুতে থাকে। দাওয়া থেকে কেউ তাকে ঠেলে উঠোনে ফেলে দিলে টের পাবে না বোধহয়।
*
মানুষটাকে সামনে দেখা মাত্র রাধার বুকটা ধক করে উঠল। মন বলে উঠল, এবার বিপদের দিন এলো।
মনোহরের গুরু নামজাদা জোতদার লক্ষ্মীকান্তপুরের শ্রীনাথ পোদ্দার উঠোনে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। এমন ভাগ্যের জোয়ারে বিহ্বল মনোহর পাইক সটান উপুড় হয়ে শুযে তার জুতোয় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে গা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো। ডেরার বাইরে থেকে শ্রীনাথের জনা ছয় জোয়ান ব্যসেব সঙ্গী উঁকি দিচ্ছে।
রাধা উঠোনেব তারে শাড়ি মেলছিল, তাকে দেখে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেছে।
আনন্দে আত্মহারা মনোহর বলে উঠল, হাঁ করে আছিস কি, ছিনাথাকে এরই মধ্যে ভুলে গেলি? পেন্নাম কর, পেন্নাম কর আজ আমাদের ভাগ্যি সুয্যি কোন্ দিকে উঠেছেল–অ্যাঁ?
শ্রীনাথ পোদারের ফর্সা মুখে টিপটিপ হাসি। হাসি-ছোঁয়া চাউনি রাধার মুখের ওপর। দেড়বছর আগে সেই বিয়ের সময় দেখেছিল। বধূবেশে তখনো বেশ ভালোই লেগেছিল। কিন্তু আটপৌরে বেশের এই রূপ যেন আবিষ্কারের জিনিস।
রাধা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। চোখ দুটো একবার শুধু পরম সম্মানের অতিথির চোখের সঙ্গে মিলেছে। কাছে এসে প্রণাম করার জন্য কুকতে অতিপরিচিত আত্মজনের মতো শ্রীনাথ দু-হাতে তার দুই বাহু ধরে টেনে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। বাহু ধরাই আছে, চপল নিবিষ্টতায় মুখখানা দেখল একটু। বলল, অত পেয়ামের ঘটা আমার ভালো লাগে না। মনোহরের দিকে ফিরল, তোর মিষ্টি বউয়ের গানের প্রশংসা আমি লক্ষ্মীকান্তপুরে বসেও শুনেছি–কিন্তু তোর মতো রাসকেলের হাতে পড়েও এরই মধ্যে আরো এত মিষ্টি হয়ে গেল কি করে!
রাধার বয়েস এখন সাতাশ শুরু হয়েছে। এত অশান্তি আর যন্ত। সত্ত্বেও মা যেন আকেল দেবার জন্যেই ওর যৌবনে স্থির জোয়ার নামিয়ে রেখেছে–চলতে ফিরতে উছলে ওঠে।
দুই বাহুর চামড়া শাডি জামা সত্ত্বেও চিড়বিড় করছে। হাত দুটো এখনো নামেনি।
মুরুব্বির রসিকতার কথায় মনোহরের মুখে হাসি আর ধরে না। চলো চলে, ভিতরে বসবে চলো, আজ এসে গেছ যখন সহজে ছাড়ছি না-খেয়ে যেতে হবে।
শ্রীনাথের হাসিতে স্নেহ ঝরল, আজ হঠাৎ এসে গেছি, ও-সব হাঙ্গামায় দরকার নেই, আর একদিন হবে’খন, সঙ্গে ছ’জন লোক আছে–
ও-সব কোনো ওজর আমি শুনব না, যারা আছে তাদের ব্যবস্থা আমি যেভাবে পাৰি কবছি, আমার বউ রান্নায়ও দৌপদী এটা জেনে রাখো।
বাহুর অস্বস্তি ভুলে এবার রাধার চোখে মুখে অন্য সংকট। এই বেলা সাড়ে দশটায় মাছ দূরের কথা আনাজ পর্যন্ত যোগাড় করা যাবে কিনা সন্দেহ। এই লোক বলে কি?
অতিথির ঘনিষ্ঠ দু’চোখ আবার তার মুখের ওপর।গাধাটার কথা শুনলে, এই অবেলায় এসে এখন আমি তোমাকে বাড়তি সাত জনের হাঁড়ি ঠেলতে পাঠাব! বাহু থেকে হাত নামালো। বাইরের দিকে চেয়ে হাঁক দিল, এই বিশে, এদিকে আয়।
জোয়ান চেহারার একজন ছুটে এলো। সিল্কের পাঞ্চাৰি পকেট থেকে মানি ব্যাগ বার করে একটা একশ টাকার নোট তার হাতে দিল।–আমাকে এখন এর ছাড়বে না, তোরা তিনজন তিনজন করে জয়নগর থেকে খেয়ে আয়, এক ব্যাচ এলে অন্য ব্যাচ যাবে
মাথা ঝাঁকিয়ে বিশে চলে গেল। এই ফাঁকে রাধা আস্তে আস্তে দুপা সরে এসেছে। এনাথ এগিয়ে গিয়ে অন্তরঙ্গজনের মতো এক হাতে আবার ওর কাঁধে বেষ্টন করে বলল, মনা ছাড়বে না। আগেই জানতাম, চলো, কিন্তু শুধু খাওয়ালে চলবে না, গান শোনাতে হবে
নিশ্চয় শোনাবে, এসো এসো। ব্যস্ততা মনোহরের।
রাধার সর্ব অঙ্গ অবশ অবশ লাগছে। আবার জ্বালাও, গায়ে পিঠে যেন বিছে দংশাচ্ছে।
জুতো জোড়া দাওয়ায় রেখেই ভিতরে ঢুকল। দেব-দেবীর সারি সারি ফোটো দেখে বলে উঠল, বা-ব্বা, কেউ যে বাকি নেই দেখছি।
হা হা করে হেসে মনোহর যোগ দিল, আর বলো কেন দাদা, ভক্তির ঠেলায় অস্থির হয়ে গেলাম
সঙ্গে সঙ্গে অতিথি ধমকে উঠল, তুই থাম! চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যে এমন বউ পেয়েছিস!
–ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে-এবার ঠাণ্ডা হয়ে বোসো।
রাধার বরাবর মেঝেতে শুয়ে অভ্যেস, কিন্তু বিয়ের পরেই এ-ঘরে পালঙ্ক এসেছে। তার ওপর শৌখিন বেডকভার পাতা। এব্যবস্থা যার, মাসের মধ্যে ইদানিং প্রায় তিরিশ দিনই নেশার ঘোরে তার বাইরের দাওয়ার ওপর শয়ন।
টান করে পাতা বেডকভারটা দু-তিনবার হাতের চাপড়ে ঝেড়ে মনোহর বলল, বোসো দাদা, বোসো–এমন ঘরে তোমাকে বসাতেও লজ্জা।
অতিথির ভ্রুকুটি।–ফের!
–আর বলব না, আর বলব না, রাধা দাদাকে আগে বেশ ভালো করে এক গেলাস নেবুর সরবত এনে দে
এতক্ষণে রাধার মুক্তি। কপালে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দাওয়ার ডান দিকে বিচ্ছিন্ন হেঁসেল। সেখানে এসে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল।
তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে সামনে মনোহর। বুকে মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, মাছ কি আছে?
–চার পাঁচ টুকরো হবে।
–ওতেই হবে, আনাজ?
–আছে।
–বেশ, তুই সরবত নিযে যা আমি চট করে মাংসটা আর কিছু মষ্টি নিয়ে আসছি।
-এত বেলায় মাংস কোথায় পাবে?
-কি বলিস ঠিক নেই, মোছলমানদের ঘরে ঘরে মুরগী, আর মাংস পাবনি?
এবারে রাধা আস্তে আস্তে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো। এই হেঁসেলে কখনো মুরগী ঢোকেনি।
–যতো সব! যেমন অসহিষ্ণু তেমনি বিতৃষ্ণা।–যে মানুষ এসেছে তার জন্যি দরকার হলে গোরুর মাংস ঢুকবে! বুঝলি? ঠিক আছে, রাধব তো আমি আর খাওয়া হবে দাওয়ায় বসে হেঁসেলের পিছনে কাঠ জ্বেলে যদি রাধি তাতে তো আর কিছু অশুদ্ধ হবে না। এখন সরবত নিয়ে তাড়াতাড়ি যা–একলা বসে আছেন, পরে তোর ছুচিবাই আমি ছাড়াচ্ছি–
ছুটে বেরিয়ে গেল।
একটু বাদে শাড়ির আঁচল বেশ করে বুকে পিঠে জড়িয়ে রাধা সরবত নিয়ে ঢুকল। শ্রীনাথ খুশি মুখে হাত বাড়িয়ে সরবত নিল। হাতে আঙুলের স্পর্শ ইচ্ছাকৃত মনে হল। খাটের পাশটা দেখিয়ে বলল, বোস।
রাধা মৃদু স্বরে বলল, রান্নাঘরে যাব
-তোরা এত ব্যস্ত হলে আমি না খেয়েই চলে যাব–বোস।
অগত্যা রাধা যতটা সম্ভব পালঙ্কের এদিক ঘেঁষে বসল। হাসি হাসি মুখে সরবত খাচ্ছে। চোখ দুটো রাধার মুখে বুকে সর্বাঙ্গে বিঁধছে।
-মনা কোথা গেল।
-কি আনতে টানতে
–দ্যাখ, তত অসময়ে এসে কি হুজ্জোতে ফেললাম তোদের। …গানে তো তোব বেশ নাম শুনি, দুই-একবার আমাদের লক্ষ্মীকান্ত পুরেও গেছলি শুনলাম?
–অনেক আগে–
–কেবল ভক্তির গানই করিস বুঝি?
চুপ করে থাকাটুকুই জবাব। সোজা না তাকিয়েও দু’চোখের ওঠা-নামা টের পাচ্ছে।
–বিয়েতে তোকে হার দিয়েছিলাম, পরিস না?
–তোলা আছে।
-হাতেও তো কেবল লোহ ছাড়া কিছু দেখছি না, মন টাকা তো আমার থেকে কম পায় না, গড়িয়ে দেয় না কেন? ওকে আমি আচ্ছা করে বকব
এবারে রাধা স্পষ্ট করেই বলল, আমি গয়না পরি না।
চেয়ে রইলো। তারপর হেসে রসিকতা করল, গয়না না পরলেও তুই কম সুন্দর না, তবু মনার তো তোকে সাধ করে পরানো উচিত।
মনোহর ফিরতে রাধা উঠে গেল। রাধার রান্না মোটামুটি হয়েই গেছল। আর যেটুকু করল তাতে আধ-ঘণ্টাও লাগল না। মনোহর হেঁসেলের পিছনেই মুরগীর মাংস চড়িয়ে তাকে ভাগিদ দিল, তুই ছিনাথদার কাছে গিয়ে বোস্–দুই একটা গান-টান শোনা, এদিক আমি দেখছি।
তবু ওর গড়িমসি ভাব দেখে মনোহরই এক-রকম ঠেলে নিয়ে এলো। –নে দাদাকে দুই একখানা গান শোনা।
রাধা সোজা তার দিকে তাকালো। এখন গান আসবে না।
অবাধ্যতার জন্য তার মুখে সেই থেকে হাসি নেই লক্ষ্য করে মনোহর হাড়ে হাড়ে চটছিল। রাগ আর চাপতে না পেরে খেঁকিয়ে উঠল, কার সামনে বলছিস জানিস না–এত দেমাক তোর। গানের বাবা আসবে
-মনোহর। চাপা গজনই করে উঠল শ্রীনাথ, ফের ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলবি তো আমার হাতে থাপ্পড খাৰি। রাধার দিকে চেয়ে খুব কোমল গলায় বলল, এত দূর থেকে এলাম, একটা গানও হবে না? খুব কষ্ট হলে অবশ্য থাক–
রাখার চোখে জড়তা নেই, লোকটার দিকে সোজা তাকালো। তারপর ঘরের কোণের কাপড়ে ঢাকা হারমোনিয়ামটার দিকে। বুঝে নিয়ে মনোহর ব্যস্ত হয়ে হারমোনিয়ামটা তুলে খাটের ওপর রাখতে গেল।
-ওখানে নয়।
দু’হাতে হারমোনিয়াম নিয়ে মনোহর দাঁড়িয়ে গেল। কোণ থেকে গোটানো মাদুরটা এনে রাধা মেঝেতে পাতলো। মনোহর হার মোনিয়াম রাখতে পিছনে পা মুডে রাধা নিজের ঢঙে বসল। যা’মনে এলো সেটা ফকির সাহেবের শেখানো গান।
‘রাম-রহিম না জুদা করো, দিলকো সাচ্চা রাখো জী,
হাজী হাজী করতে রহহ, দুনিয়াদারি দেখো জী।
যব য্যায়সা তব ত্যায়সা হোয়ে সদা মগমে রহেনা জী,
মাটিমে ইয়া বদ বনি হায় ইদ সদা রাখনা কী।
তব, যব সেকো ফর রহহ ভাই,
যিস যিস কামমে মানা জী,
ক্যা জানে কব দম ছুটেগা, উসকো নেহি ঠিকানাজী।
সমঝদার শ্রোতার আড়ালে দুটো হাঙরের চোখ তার মুখে বুকে ওঠা-নামা করছে। রাধা এক-একবার সোজা তাকিয়ে দেখছে, চোখে চোখ রেখেই শেষ করল। তারপর উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে মনোহলের আরক্ত চক্ষু। আরো গাইবার জন্য ধমকে উঠতে যাচ্ছিল, হাত তুলে শ্রীনাথ তাকেই খামালো। আবার কেন, এই একটাই হজম হয়েছে। গানের ভিতর দিয়ে ও কি উপদেশখানা ঝাড়ল মগজে ঢুকেছে? হাসিমাখা চাউনি রাধার দিকে, বলল, দুকান ভরে গেল, এমন নিটোল মিষ্টি গলা কমই শুনেছি।
খেয়ে দেয়ে আধ-ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে মানী অতিথি চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মারমুখো মূর্তি মনোহরের, এমন একটা লোক সেধে ঘরে এলো, আমার সব ভবিষ্যত ওর হাতে–আর তুই কিনা সর্বক্ষণ বোবা হয়ে থাকলি! ছ’ছটা বডি-গার্ড নিয়ে ঘরে, সক্কলের কাছে লুকনো অস্ত্র থাকে, বাড়ি পর্যন্ত প্লেন ড্রেসের পুলিশের লোক পাহারা দেয়, আর তুই কিনা তার সঙ্গে হেঁজি-পেঁজি লোকের মতো ব্যাভার করলি?
রাধা তার দিকে অপলক চেয়ে রইলো খানিক। তারপর বলল, ওজন্য চিন্তা রেখোনি, যতটা আশা করেছিলে তোমার মানী অতিথি তার থেকে ঢের বেশি মুগ্ধ হয়ে এখেন থেকে বেরিয়েছে।
মনোহর থমকালো একটু। কথাগুলো মগজে ঢুকতে একটু হেসে উঠেই আবার খেঁকিয়ে উঠল, রসের কথা তত কম জানিস না, ছিনাথদার সামনে মুখ সেলাই করে থাকলি কেন?
.
বর্ষা কাল। মাঝে মাঝে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টি মাথায় করে দোতারাবাবু অংশুমানের কোয়ার্টারস এসে উপস্থিত। দুর্যোগে সন্ধ্যা না হতে রাত্তির। রিকশয় এসেছেন, গায়ে বর্ষাতি আর সঙ্গে ছাতাও আছে। ভেজেননি। তবু এ-সময়ে তাকে দেখে অংশুমান জিগ্যেস করলেন, কি ব্যাপার, এই জলের মধ্যে?
এসে গেলাম রে ভাই, ক’দিন ধরে মনটা উতলা হয়ে আছে, ভাবলাম তোমার কানে কথাটা তুলে দিই। সুচারু দেবীকে বললেন, আগে এক কাপ চা দাও।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা আসতে দোতারাবাবু মন কেন উতলা সেটা একটু বিস্তৃত করেই বললেন।
-দেড় মাস যাবত রাখার ওপর ভয়ানক অত্যাচার শুরু হয়েছে। অত্যাচার করছে তার স্বামী মনোহর পাইক। ভীষণ মারধর করছে। লক্ষ্মীকান্তপুরের নামকরা জোতদার নাথ পাোরের রাখার ওপর চোখ পড়েছে। একদিন এসে দু-তিন ঘণ্টা থেকে রাধার গান শুনে খেয়ে দেয়ে গেছে। সাত দিন না যেতে শ্রীনাথ রাধাকে নিয়ে যাবার জন্য বার বার নেমন্তন্ন করেছে। তার কাছে মনোহরের টিকি বাঁধা, সে ওকে দিয়ে অনেক রকমের কাজ করায়, টাকাও দেয়। দোতারা বাবুও যতটুকু জানেন, মনোহর লোকটা পাজির পা-ঝাড়া, বছর তেত্রিশ মাত্র বয়েস, নেশায় চুর হয়েথাকে। নিতাই সেকরা তার প্রাণের বন্ধু, রাধাকে বিয়ে করাব জন্য একসময় সে-ও ক্ষেপে উঠেছিল। মদ খেয়ে তার কাছে গলগল করে সব কথা বলে। দোতারাবাবুর বাজার সবকারের সঙ্গে আবার নিতাই সেকরার খাতির। রাধার বিপদ আঁচ করে সে-ই বাজার সরকারকে চুপিচুপি বলেছে দোতারাবাবুকে জানাতে, সে জানে বাবু রাধাকে খুব স্নেহ করে।রাধা নিজের বিপদ বুঝেই বার বার গোঁ ধরে শ্রীনাথের নেমন্তন্ন বাতিল করছে, আর মনোহর ক্ষেপে গিযে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। নিতাই সেরা নাকি বলেছে, বউকে এনে দেবার টোপ ফেলেও নাকি মনোহর পাইক তার কাছ থেকে থোকে থোকে টাকা লুটেছে, কিন্তু বউকে আনতে পারছে না বলে এখন তারও মেজাজ গরম। গত রাতেও নাকি নেশা করে মনোহর নিতাইয়ের কাছে বুক ঠুকে বলেছে, ও না যায় তো ওর আধমরা লাশ যাবে শ্রীনাথ পোদ্দারের কাছে, আরো বলেছে, তিন তিনটে ডাকাতের হাত দিয়ে ঘুরে এসে এখন সতীপনা দেখাচ্ছে, শ্রীনাথের কাছ থেকে ছিবড়ে হয়ে ফিরে এলে আর যাদের লোভ আছে ওর ওপর তাদের কাউকেই বঞ্চিত করবে না–তবে ওকে পিঁপড়ে দিয়ে খাওয়ানোর পুরনো হিসেব মিটবে। কবে নাকি রাখা ওকে পিঁপড়ের ভাইয়ের ওপর শুইয়ে দিয়ে শেষ করে এনেছিল।
সুচারু দেবী আঁতকে উঠেছেন।–এ কি সব্বেনেশে লোক গো এমন আবার হতে পারে নাকি? রাধার মুখে তো কখনো এতটুকু বিকার দেখিনি, তবে মেয়েটা অনেক দিন আসে না অবশ্য–কিন্তু সত্যি হলে কি হবে?
একটু ভেবে অংশুমান বললেন, নকশালদের হুমকি খেয়ে নাথ পোদ্দার নিজেই তো এখন চুপসে আছে। নকশালদের ওপর অংশুমান তখন দারুণ কুদ্ধ। ওদের হাঙ্গামার জন্যেই তাঁর বদলী প্রমোশন সব আটকে আছে। বললেন, তবে শ্রীনাথ পোন্দারের এই দোষের কথা অনেক শোনা আছে, কিন্তু ওই নিতাই সেকরা আবার নিজের লোভে মনোহরকে ঘায়েল করতে চায় না তো?
দোতারাবাবু মাথা নাড়লেন, মনে হয় না, লোকটাও পাজি তবে ভীতু, কিছু সত্যি না হলে বাজার সরকারকে আমার কানে তোলার জন্য বলত না।
বৃষ্টি একটু ধরতে অংশুমান উঠলেন, চলুন, আগে রাধার সঙ্গে একবার দেখা করে আপনাকে বাড়িতে ছেড়ে আসছি।
জিপ থেকে নেমে মিনিট দুই জংলা পথ ভাঙলে কপালীবাবার ডেরা। উনি বাইরের দাওয়ায় বসেছিলেন। দোতারাবাবু চেনা লোক, সাদা পোশাক সত্ত্বেও থানার ওসিকেও চিনলেন। প্রায় আট বছর আগে সেই একবার জিপে করে রাধাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছলেন। ডাকলেন, রাধা তোর কাছে কারা এলেন দ্যাখ, লণ্ঠনটা নিয়ে আয়
লণ্ঠন হাতে রাধা বেরিয়ে এলো। জঙ্গলের ডেরায় এ আর কতটুকু আলো, তবু চিনতে অসুবিধে হল না। ভালো করে দেখার জন্য দুজনেই একটু এগিয়ে এলেন, কিন্তু আবছা আলোয় এই ঠাণ্ডা গম্ভীর মুখ দেখে কতটকু আর বুঝবেন। একট ইতস্তত করে অংশুমান বললেন, তোর সঙ্গে দুই-একটা কথা ছিল।
রাধা চেয়ে আছে। কি কথা বোঝার চেষ্টা। বলল, বাবার সামনে সব কথাই হতে পারে, কিছু এনে পেতে দেব-বসবে?
-না ঠিক আছে। ইয়ে–তোর সম্পর্কে কি সব শুনছি, তোর স্বামী নাকি খুব অত্যাচার করছে?
তোমাদের কে বললে?
অংশুমান দোতারাবাবুর দিকে তাকাতে তিনি বললেন, নিতাই সেকরা আমার বাজার সরকার শঙ্কুকে বলেছে, তোকে ডেকে পাঠালা, এলি না, এখন বড়বাবুকে খোলাখুলি বল না কি হয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কপালী বাবা ধীর গম্ভীর মুখে সকলকে দেখছেন, রাখাকেও। অংশুমান বললেন, যা অনলায় তার কি সত্যি হলেও বল, থানায় নিয়ে গিয়ে দু’চারটে ঝাঁকুনি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে
রাধা তবু জবাব দিতে সময় নিল একটু। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, শোনো বড়বাবু, তোমাদের কিছুই জেনে দরকার নাই, শুধু জানি রাখে যা হতেছে সেটা কেবল মায়ের সঙ্গে আমার মামলা, তোমাকে কাউকে ধৰি নে যেতে হবে না, শাসাতে হবে না, মা শেষ পর্যন্ত কি করে আমি তাই দেখার অপেক্ষায় আছি, আমার জন্য তোমরা মনে কিছু ভাবনা রেখে না।
এবারে কপালী বাবা অধীর গলায় বলে উঠলেন, ভয়ংকর রকমের কিছু হয়ে যাচ্ছে আমিও বুঝতে পারছি, বিলাসীও বলছে–কিন্তু ওর কেবল এই এক কথা–এটা মায়ের সঙ্গে ওর মামলা কাউকে কিছু ভাবতে হবে না–আরে ভেবে ভেবে যে আমি অস্থির হয়ে গেলাম!
তার দিকে চেয়ে রাখা ওই এক কথাই বলল, ভেবে লাভ নেই, ভেব না।
*