বক্তৃতা : ছয়
ব্যক্তিভিত্তিক ও সামাজিক নীতিবোধ
এই শেষ বক্তৃতায় আমি দুটি জিনিস করতে চাই। প্রথমত, পূর্ববর্তী বক্তৃতাসমূহে উপনীত সিদ্ধান্তগুলোর পুনরালোচনা; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত নীতিবোধের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদের সম্পর্ক স্থাপন, যার দ্বারা কোন ব্যক্তি তার জীবনকে পরিচালিত করতে পারে এবং অশুভ দিকগুলোকে চিহ্নিতকরণ এবং আমাদের স্বীকৃত আশঙ্কার পরেও সমীক্ষাসূত্রে প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট আশাবাদকে তুলে ধরা, যে আশাবাদ মানবজাতির খুব দূরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য নয়, যা আমার তরফ থেকে, সংযত সমীক্ষামূলক সম্ভাবনার ভিত্তিতে ন্যায়সংগত বলে আমি বিশ্বাস করি।
সংক্ষিপ্তভাবেই শুরু করা যাক। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে আমরা সামাজিক কাজকর্মের দুটি প্রধান উদ্দেশ্যকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করেছি? একদিকে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীভূত সরকারি নিয়ন্ত্রণ, যা বিশ্বভিত্তিক সরকারি গঠন পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে, অবশ্য যদি তাকে কার্যকরী করে তুলতে হয়। অন্যদিকে, প্রগতির জন্য আবশ্যক-সামাজিক বিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ব্যক্তিউদোগ দূরণের সর্বোত্তম সুযোগ ।
যতদূর সম্ভব এই লক্ষ্যগুলো পূরণের পদ্ধতি হল-ক্ষমতা-বিকেন্দ্রীকরণ। যুদ্ধ প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়-এমন সব কিছুতেই নিখিল-বিশ্ব সরকার জাতীয় সরকারগুলোকে অবাধ স্বাধীনতা দেবে; জাতীয় সরকারগুলো, পর্যায়ক্রমে, যতদূর সম্ভব সুযোগ ছেড়ে দেবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। শিল্পে, এরকম ধরে নেওয়ার কোন কারণ নেই যে, জাতীয়করণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একটি সুবৃহৎ শিল্পসংস্থার, যেমন রেলওয়ের যথেষ্ট পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন থাকা দরকার; কোন রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পে রাষ্ট্রের সঙ্গে কর্মচারীদের সম্পর্ক তাদের পূর্বতন বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কেরই যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। সংবাদপত্র, বইপত্র এবং রাজনৈতিক প্রচারপত্রের মতো মতপ্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুকেই প্রকৃত প্রতিযোগিতার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য যে কোন একচেটিয়ার বিরুদ্ধে সযত্ব রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু, এই প্রতিযোগিতা হবে সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক, এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক নয় এবং এসব সত্ত্বেও তা হওয়া উচিত ফৌজদারি আইন মোতাবেক অপেক্ষাকৃত কম সামরিক ঘরানার ।
সাংস্কৃতিক বিষয়ে বৈচিত্র্যময়তা হল অগ্রগতির শর্ত। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষিত সমাজের মতো যেসব সংস্থার রাষ্ট্র-নিরপেক্ষ অবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে, এক্ষেত্রে তাদের রয়েছে মূল্যবান ভূমিকা। বর্তমান রাশিয়ায় যা দেখা যায়, তা খুবই পরিতাপের বিষয় যে, অর্থনৈতিক ও পুলিশী ক্ষমতার সহায়তায় বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞ রাজনীতিবিদরা হাস্যকর সিদ্ধান্তের সূত্রে বিজ্ঞানের মানুষকে কুসংস্কারপূর্ণ আজেবাজে জায়গায় লিখতে বাধ্য করে। এরকম করুণ ঘটনা বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে যদি রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা সীমিত রাখা যায় সেই সব কর্মবলয়ে, যেখানে তারা দক্ষরূপে বিবেচিত হতে পারে। তাদের এই বিচারে নামা উচিত নয়-উত্তম জাতের সংগীত কী অথবা উৎকৃষ্ট মানের জীববিজ্ঞান বা ভাল দর্শনশাস্ত্রই বা কী? আমি চাই না প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত রুচিবোধ-তা অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, যে সময়েই হোক না কেন, এমনকী যদি বরাত জোরেও তার রুচিবোধ হয় নিষ্পাপ।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত প্রশ্নের বিপরীতে ব্যক্তিগত নীতিবাদের প্রশ্নে এখন আসা যাক। কোন মানুষই পুরোপুরি স্বাধীন নয়, আবার সে পুরোপুরি ক্রীতদাসও নয়। একজন মানুষের যতদূর স্বাধীনতা থাকে, আচারব্যবহার পরিচালিত করার জন্য তার প্রয়োজন হয় এক ধরনের ব্যক্তিগত নৈতিকতা। কেউ কেউ আছে, যারা বলবে-একজন মানুষ শুধু তার সমাজের স্বীকৃত নীতিবিধি মেনে চলবে। কিন্তু আমি মনে করি না-নৃতত্ত্বের কোন ছাত্র এই উত্তরে সন্তুষ্ট হবে। প্রথাগত নৈতিক মতবাদের বিরুদ্ধ নৈতিক প্রতিবাদের ফলে স্বগোত্রভোজন, নরবলি ও নরমুন্ড শিকারের মতো অভ্যাসের অবলুপ্তি ঘটেছে। যদি কোন মানুষ প্রকৃতই তার সামনে উন্মুক্ত শ্রেষ্ঠ আঙ্গিকের জীবনযাপন করতে চায়, তাহলে তাকে তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সাধারণভাবে স্বীকৃত উপজাতীয় সংস্কার ও বিশ্বাসের সমালোচক হতে হবে।
কিন্তু ভিন্নতর প্রসঙ্গে-যে সমাজে কোন মানুষ বাস করে, সেই সমাজ সঠিক বলে। মনে করে-এরকম পরিস্থিতিতে, বিবেকের তাড়নাতেই, আমাদের প্রথাগত কর্তৃত্ব ও আইনী কর্তৃত্বের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতেই হবে। শুধুমাত্র প্রথাগত নীতিবোধকে লঙ্ঘন করে, এমন কোন পদক্ষেপের চেয়ে অনেক জোরালো অজুহাতের প্রয়োজন হয় কোন বে-আইনি কাজকে বৈধ প্রতিপন্ন করতে। এর কারণ হল-যে কোন সহনশীল সমাজ-বিন্যাসের অস্তিত্বের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত হল-আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন । যখন কোন মানুষ কোন একটি নির্দিষ্ট আইনকে খারাপ বলে মনে করে, তখন তার একটা অীধকার আছে এবং তার কর্তব্যও হতে পারে, সেই আইনের পরিবর্তন ঘটানো, কিন্তু খুব বিরল ক্ষেত্রেই তা ভঙ্গ করার জন্য সঠিক কাজ করে। আমি অস্বীকার করি না যে, এমনও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যখন আইন ভাঙাও একটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়ঃ এটা তখনই কর্তব্য হিসাবে দেখা দেয়, যখন একজন মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করে, যে মান্য করাটাই হল একটা পাপ কাজ। এটা হল একজন বিবেকতাড়িত প্রতিবাদীর দৃষ্টান্ত। এমনকী, আপনি যদি নিশ্চিন্তও হন যে, সে ভুল করছে, আপনি বলতেও পারবেন না যে, তার বিবেক আদেশ দিলেও সেই কাজ তার করা উচিত নয়। যখন আইনপ্রণেতারা বিজ্ঞ হন, যতদূর সম্ভব তারা এমন সব আইন প্রণয়ন পরিহার করেন, যা বিবেকতাড়িত মানুষকে পাপ ও আইন-নির্ধারিত অপরাধের মধ্যে পছন্দ করে নিতে বাধ্য করে।
আমি মনে করি, এটাও স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে, এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে বিপ্লব ন্যায়সংগত। এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে বৈধ সরকার এতটাই খারাপ যে, নৈরাজ্যের ঝুঁকিপূর্ণ সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে সরকারকে বলপ্রয়োগে ক্ষমতাচ্যুত করাই যুক্তিযুক্ত। ঝুঁকিটা সত্যই খুব বাস্তব। এটা লক্ষ্য করার বিষয়-দুটি সফলতম বিপ্লব-১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডে ও ১৭৭৬ সালে আমেরিকায়-এমন মানুষদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই পটভূমি যেখানে অনুপস্থিত থাকে সেখানে বিপ্লবের সূত্রে হয় নৈরাজ্যবাদ, অথবা একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। সে কারণে আইনের প্রতি মান্যতা, যদিও তা একটা চরম আদর্শ নয়, তবুও তা এমন একট জিনিস যার ওপর গভীর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন এবং কিছু বিরল ক্ষেত্রে পরিপক্ক বিবেচনার পরেই ব্যতিক্রমকে অনুমোদন করা যেতে পারে।
নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, এরকম সমস্যা থেকে উদ্ভূত হতে পারে এক গভীর দ্বিত্ব, যা যতই হতবুদ্ধিকর হোক না কেন-স্বীকৃতির দাবি রাখে।
নথিবদ্ধ ইতিহাস জুড়ে নৈতিক বিশ্বাসসমূহের দেখা যায় দুটি খুব পৃথক উৎস। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি সংশ্লিষ্ট থাকে ব্যক্তিগত ধর্মীয় ও নৈতিক প্রত্যয়ের সঙ্গে। ওল্ড-টেস্টামেন্টে দেখা যায় এ দুটির সম্পূর্ণ পৃথক উপস্থিতি, একটি-’আইন’ রূপে, অন্যটি-ধর্মগুরু’ রূপে। মধ্যযুগে যাজকতন্ত্র কর্তৃক পাখিপড়ানো নীতিবোধের সঙ্গে বিখ্যাত অতীন্দ্রিয়বাদীদের অভ্যস্তও শেখানো ব্যক্তিগত পবিত্রতার একই ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো। ব্যক্তিগত ও নাগরিক নীতিবাদের দ্বৈত স্বাতন্ত্র্য আজও অব্যাহত এবং তাকে যে কোন উপযুক্ত নৈতিক তত্ত্বের মধ্যে গণ্য করা উচিত। নাগরিক নৈতিকতার অভাবে সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়; ব্যক্তিগত নীতিবোধ ছাড়া তাদের অস্তিত্ব মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সে কারণে, নাগরিক ও ব্যক্তিগত নীতিবোধ-এ দুটি উত্তম বিশ্বের জন্য সমানভাবে জরুরি।
নীতিশাস্ত্র শুধুই সর্বাত্মকভাবে আমার প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যতই সঠিকভাবে এই কর্তব্যের উপলব্ধি থাক না কেন। জনমুখী কর্তব্যের কৃতিত্ব একটা উত্তম জীবন গঠনের মধ্যেই সামগ্রিকভাবে সীমাবদ্ধ নয়; ব্যক্তিগত দক্ষতাও সেখানে অন্যতম অভীষ্ট বিষয়। মানুষের ক্ষেত্রে, যদিও আংশিকভাবে সামাজিক, পুরোটাই তা নয়। তার চিন্তা, অনুভূতি ও আবেগ আছে, যা জ্ঞানসমৃদ্ধ বা বোধহীন, মহৎ অথবা নিকৃষ্ট, ভালোবাসায় পূর্ণ অথবা ঘৃণায় অনুপ্রাণিত, হতে পারে। এসব চিন্তা ও অনুভূতি, আবেগের মহত্তর উদ্দেশ্য, যদি তার জীবনকে সহনীয় করে তুলতে হয়, তাহলে সেখানে সুযোগের অস্তিত্ব থাকতেই হবে। যদিও অল্প কিছু মানুষ নিঃসঙ্গতায় সুখী হতে পারে, তা সত্ত্বেও আরও অল্পসংখ্যক মানুষ সেই সমাজে সুখী হয়, যেখানে ব্যক্তিগত কার্যকলাপের কোন স্বাধীনতা নেই।
ব্যক্তিগত উৎকর্ষ, যদিও অন্যের প্রতি সঠিক আচার-ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে গঠিত হয়েছে তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ, তবুও তার রয়েছে অন্য একটি দিক। যদি আপনি তুচ্ছ বিনোদনের কারণে আপনার কর্তব্যে অবহেলা করেন, তাহলে আপনার বিবেকদংশন হতে পারে; কিন্তু আপনি যদি কোন বিখ্যাত সংগীত অথবা চমৎকার সূর্যাস্তের আকর্ষণে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য সরিয়ে নেন, তাহলে আপনার কোন সলজ্জ প্রত্যাবর্তন ঘটাবে না এবং এমন কোন অনুভূতিও জাগবে না যে, আপনি বাজে সময় নষ্ট করেছেন। ব্যক্তিগত পরমোৎকর্ষ বলতে আমরা যা বুঝি তার ওপর সর্বাত্মকভাবে রাজনীতি ও সামাজিক কর্তব্যবোধকে প্রভুত্ব করতে দেওয়ার ছাড়পত্র খুবই বিপজ্জনক। আমি যা বলতে চাই যদিও তা কোন অলৌকিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল নয়-আসলে খ্রিস্টীয় নৈতিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সক্রেটিস ও অ্যাপস্টলস বলেছিলেন, মানুষকে মান্য করার চেয়ে আমাদের ভগবানকে মান্য করা উচিত, এবং খ্রিস্টীয় উপদেশাবলিতে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসার বিষয়টিকে প্রতিবেশীকে ভালবাসার মতোই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমস্ত মহান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, এবং সমস্ত বিখ্যাত শিল্পী ও বৌদ্ধিক আবিষ্কারকবৃন্দ তাঁদের সৃজনমূলক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এক ধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও মহিমান্নয়ন প্রদর্শন করেছেন। খ্রিস্টীয় উপদেশের মতে যাকে ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য বলা হয়ে থাকে, তারই ভিত্তি হল এই আবেগ এবং (আমি পুনরুক্তি করছি) অলৌকিক বিশ্বাস থেকে তা পৃথক। আমার প্রতিবেশীর যে কোন ধরনের উপলব্ধি অনুসারে, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য আমার কর্তব্যবোধের সবটুকু হতে পারে না। যদি আমার এই গভীর বিবেকচালিত বিশ্বাস থাকে, সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিন্দিত পন্থায় আমার কাজ করা উচিত, তাহলে সেই বিশ্বাসকেই আমার অনুসরণ করা। উচিত এবং বিপরীতভাবে বলা যায়-আমাকে নিয়ন্ত্রিত করার জোরালো কারণ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাসকে অনুসরণ করার স্বাধীনতা সমাজের তরফ থেকে আমাকে দেওয়া আবশ্যক।
কিন্তু শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত কাজকর্মেরই অত্যধিক সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা প্রয়োজন-এমন নয়। একজন শিল্পী অথবা একজন বিজ্ঞান আবিষ্কারক সর্বাধিক সামাজিক উপযোগিতাসম্পন্ন কাজ করতে পারেন, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ দ্বারা চালিত হয়েই তাঁর কাজ ঠিকঠাক করতে পারেন না। যদি না তাঁর শিল্পকলা অর্থহীন এবং তার আবিষ্কারকে গুরুত্বহীন অভিধায় চিহ্নিত হতে হয়, তাহলে চিত্রকর্ম আবিষ্কারের জন্য তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থাকতেই হবে।
ব্যক্তিগত কর্মবৃত্তকে নৈতিকভাবে সামাজিক কর্তব্যবোধের চেয়ে নিকৃষ্টতর হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়, বরং মানবিক কর্মকাণ্ডের শ্রেষ্ঠ কিয়দংশ, অন্তত অনুভূতিতেও, সামাজিকের চেয়ে বরং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যবাহী। আমি যেমন বক্তৃতা-তিনে উল্লেখ করেছি-ধর্মগুরু, অতীন্দ্রিয়বাদী, কবি, বিজ্ঞান-আবিষ্কারক- এঁরা হলেন এমনই মানুষ, যাদের জীবন দার্শনিক অনুভূতি প্রভাবিত হয়ে থাকে; তাঁরা আবশ্যিকভাবেই নিঃসঙ্গ মানুষ। তাঁদের প্রভাবশালী প্রবৃত্তি যখন জেরালো থাকে, তখন তাঁরা মনে করেন-তাঁরা কর্তৃপক্ষকে মেনে নিতে পারেন না যদি তারা সেটা ভাল বলে গভীরভাবে বিশ্বাস করেন-কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধাচারী হয়। যদিও, এক্ষেত্রে নিজেদের সময়ে তারা প্রায়শই নির্যাতিত হয়ে থাকেন, তবুও সমস্ত মানুষের মধ্যে তাঁদের প্রতিই পরবর্তী বংশধরেরা সর্বোচ্চ সম্মান নিবেদন করে। এরাই হলেন সেই মানুষ, যাঁরা পৃথিবীকে দিয়েছেন সেইসব জিনিস, যেগুলোকে আমরা সবচেয়ে মূল্যবান বলে মনে করি-তা শুধুমাত্র ধর্মে, শিল্পে এবং বিজ্ঞানেই নয়, বরং প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের অনুভূতিজাত সম্পর্কের ক্ষেত্রে, অন্য সব কিছুর মতোই সামাজিক দায়বদ্ধতার মনোভাবের উন্নয়নেও-এবং এসবেরই পিছনে রয়েছে মূলত সেইসব নিঃসঙ্গ মানুষদের অবদান, যাদের চিন্তাভাবনা ও আবেগ যূথবদ্ধতার প্রভাবাধীন ছিল না।
যদি মানুষের জীবনকে আমরা ধূলিময় ও নীরস করতে না চাই, তাহলে এটা উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এমন জিনিস রয়েছে, যাদের মূল্যও আছে, কিন্তু তা উপযোগিতা-নিরপেক্ষ । যা প্রয়োজনীয়, তা প্রয়োজনীয়, কারণ সেটা অন্য কিছুর উপায় বা মাধ্যম, এবং এই অন্য কিছুর, পরবর্তী পর্যায়ে যদি নিছক মাধ্যমে গোত্রান্তর না ঘটে, তাহলে তার মূল্যমান নির্ধারিত করতে হবে নিজস্ব স্বার্থ ও সত্তার গুণে, কারণ তা না হলে প্রয়োজনীয়তা’ হয়ে দাঁড়াবে অলীক।
লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য স্থাপন একই সঙ্গে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি উপায় বা মাধ্যমের ওপর জোর দিতে চান, তাহলে আপনি একথা বলতে পারেন যে, একজন সুসভ্য মানুষ ও একজন আদিম বন্য মানুষের মধ্যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও একজন শিশুর মধ্যে, একজন মানুষ ও একজন পশুর মধ্যে পারস্পরিক যে পার্থক্য, তা গড়ে উঠেছে লক্ষ্য সম্পর্কিত ওজন ও মাধ্যম সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের উপকরণ দিয়ে। একজন সভ্য মানুষ তার জীবনকে বীমার মাধ্যমে সুরক্ষিত করে, কিন্তু আদিম মানুষ তা করত না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক দাঁতের ক্ষয়প্রতিরোধ করার জন্য ব্রাশ করে, কিন্তু একজন শিশুকে বাধ্য করা না হলে-ব্রাশ করে না; মানুষ শীতে খাদ্যসংগ্রহের ব্যবস্থা করার জন্য মাঠে পরিশ্রম করে, পশুরা তা করে না । দূরদর্শিতা-যা হল ভবিষ্যতের আনন্দদায়ক জিনিসের জন্য বর্তমানের অপ্রীতিকর কর্মব্যস্ততা, তা মানসিক সমৃদ্ধির অন্যতম অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য। যেহেতু ভবিষ্যৎ চিন্তা খুবই কঠিন বিষয় এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় আবেগের নিয়ন্ত্রণ, নীতিবাদীরা তার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, এবং পরবর্তী প্রাপ্তির চমৎকারিত্বের চেয়ে বর্তমান আত্মত্যাগের পুণ্যের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। আপনি সঠিক কাজ করবেন, যেহেতু সেটাই সঠিক, কারণটা এরকম নয় যে তা স্বর্গে পৌঁছানোর একটা রাস্তা। আপনি সঞ্চয় করবেন, কারণ যে কোন সুস্থমানসিকতাসম্পন্ন মানুষ তা করেন এবং তার কারণটা এরকম নয় যে, সঞ্চয়ের সুবাদে আপনার এত বিপুল অর্থ উপার্জিত হবে, যে আপনি তা দিয়ে জীবনকে উপভোগ করবেন। এরকম রয়েছে আরও অনেক দৃষ্টান্ত।
কিন্তু যে মানুষ উপায়ের তুলনায় লক্ষ্যের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতে ইচ্ছুক, তিনি সমান সত্যসমর্থিত পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন। এরকম একটা দৃশ্য খুবই করুণ, যখন দেখা যায় কোন বলিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী, যিনি তাঁর যৌবনকালে কাজের বোঝা ও উদ্বেগের চাপে ক্রমশ অজীর্ণ রোগগ্রস্তে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি এখন শুধুই শুকনো টোস্ট খেতে পারেন ও শুধু জল পান করতে পারেন, পাশাপাশি দেখা যায়, তার বেপরোয়া অতিথিরা ভুরিভোজনে ব্যস্ত; তাঁর সুদীর্ঘ পরিশ্রমী বছরগুলো জুড়ে তার প্রত্যাশিত বিত্তানন্দ তাঁর কাছ থেকে সুকৌশলে পলায়নপর এবং তখন তার একমাত্র আনন্দ হয়ে দাঁড়ায়-পুত্রকে, তার পর্যায়ক্রমে, বশীভূত করে আর্থিক ক্ষমতার ব্যবহার এবং এভাবে পুত্রও তার ভাগ্য সঁপে দেয় একই ধরনের উঞ্ছবৃত্তিতে। মাধ্যমের মধ্যে কৃপণদের স্বনিযুক্তির বৈশিষ্ট্য হল-বিকারতত্ত্বীয় এবং তা সাধারণত অবিজ্ঞোচিত বলেই স্বীকৃত হয়ে থাকে, কিন্তু ওই একই ব্যাধির গৌণ উপসর্গগুলোর অহেতুক সুপারিশমূলক গুরুত্ব পাওয়ার প্রবণতা থাকে। লক্ষ্যসম্পর্কিত কিছুটা সচেতনতা না থাকলে জীবন নিরানন্দ ও বিবর্ণ হয়ে ওঠে; চূড়ান্তভাবে, উত্তেজনা-প্রশমনের জন্য যুদ্ধ অথবা নিষ্ঠুরতা বা ষড়যন্ত্র অথবা অন্য কোন ধ্বংসাত্মক কাজের মধ্য দিয়ে প্রায়শই পথ খুঁজে নেয়-যা হয়তো অন্যভাবেও চরিতার্থ হতে পারতো।
যেসব মানুষ নিজেদের ‘বাস্তববাদী’ রূপে গর্ব করে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামগ্রিকভাবে লক্ষ্য সম্পর্কে স্বেচ্ছাবিষ্ট থাকে। কিন্তু তাদের এই বিষয়টি বিজ্ঞতার অর্ধাংশমাত্র। আমরা যখন অন্য অর্ধাংশের হিসাব নিই-যে অংশটা সম্পর্কিত থাকে লক্ষ্যের সঙ্গে-তখন আমরা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া ও মানবজীবনের সামগ্রিকতার একটা সম্পূর্ণ নতুন দিক দেখতে পাব। আমরা আর জিজ্ঞাসা করবো নাঃ উৎপাদকরা কী উৎপাদন করেছে এবং এই ভোগ, পরবর্তী পর্যায়ে, তার উপভোক্তাকে কতদূর সমর্থ করেছ? তার পরিবর্তে আমরা জিজ্ঞাসা করি : ভোগী ও উৎপাদকদের জীবনে কী এমন আছে, যা তাদের বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ সঞ্চার করে বা তাদের সৃজন হিসেবে গণ্য হতে পারে, সেরকম কীইবা তারা অনুভব করছে বা জেনেছে বা করেছে? তারা কি নতুন জ্ঞানের গৌরব সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে? তারা কি ভালাবাসা ও বন্ধুত্বের স্বরূপ জেনেছে? তারা কি সূর্যালোকে ও ঝর্ণাধারায় ও পুষ্পসৌরভে আনন্দত হয়েছে? সরল, সাদামাটা সমাজের নৃত্যগীতের আনন্দ কি তারা অনুভব করেছে? তারা কি নতুন জ্ঞানের গৌরব সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে? একবার, আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লস এঞ্জেলসের মেক্সিকো-কলোনি দেখার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল, তারা অলস ভবঘুরে, কিন্তু আমার উদ্বিগ্ন পরিশ্রমী নিমন্ত্রণকর্তাদের কবলে পড়ার চেয়ে, ওই ভবঘুরেদের খুবই ফুর্তিবাজ বলে মনে হয়েছিল, অভিশাপের পরিবর্তে জীবন যেন তাদের আশীর্বাদধন্য, আমি যখন এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম, তখন কিন্তু আমার জুটেছিল শূন্যগর্ভ ও উপলব্ধিহীন অভিজ্ঞতা।
জনসাধারণ সর্বদা মনে রাখে না-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক সাংগঠনিকতা সাধারণত মাধ্যমের বিন্যাসে অবস্থান করে, এবং সেগুলো লক্ষ্যমাত্র নয় । আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার অভিমুখ এমন দিকে নির্দিষ্ট থাকে, যাকে বলা যায় প্রশাসকের হেত্বাভাস’ যার দ্বারা আমি বোঝাতে চাইছি-সুসংগঠিত সামগ্রিকতারূপে কোন সমাজকে ভাল মনে করে দেখার অভ্যাস, যদি তা শৃঙ্খলার একটা নমুনারূপে বিবেচনা করা প্রীতিদায়ী হয়-পরস্পরের সঙ্গে সুচারুভাবে জোড়া লাগানো একটি পরিকল্পিত অঙ্গবিন্যাস।
কিন্তু কোন সমাজ বাইরের কোন সমীক্ষাকে তুষ্ট করার জন্য অস্তিত্ব রক্ষা করে না, বা অন্তত তার সেটা করা বাঞ্ছনীয়ও নয়, বরং সেই সমাজ চেষ্টা করে সেসব ব্যক্তিদের সদর্থক জীবন উপহার দিতে, যারা গড়ে তুলেছে সেই আধার। সমষ্টির মধ্যে নয় ব্যক্তির মধ্যেই খুঁজে নিতে হবে চরম মূল্যবোধ। একটি উত্তম সমাজ হল সেসব মানুষদের জন্য একটি উত্তম জীবনকে ছোঁয়ার মাধ্যম, যাঁরা তা তৈরি করেছে সেটা এমন নয় যে, নিজস্ব খাতে তার স্বতন্ত্র ধরনের কোন উৎকর্ষ থাকতে হবে।
যখন বলা হয়ে থাকে-একটি জাতি হল একটি অবয়ব, তখন এমন একটা উপমা ব্যবহার করা হচ্ছে, যা বিপজ্জনক হতে পারে, যদি না তার সীমাবদ্ধতাগুলোকে চিহ্নিত করা যায়। মানুষ এবং উচ্চতর প্রাণীরা, আক্ষরিক অর্থেই, অবয়ববিশেষই: ভাল অথবা মন্দ, যখন একজন মানুষের ওপর ঘটে, তখন তা ঘটে থাকে একজন একক ব্যক্তি মানুষের ওপরেই-এমন নয় যে, তার এই বা ওই অংশ ধরে ঘটে । যদি আমার দাঁতে অথবা পায়ের আঙুলে কোন ব্যথা হয়, তাহলে সেটা ‘আমি’ নামক ব্যক্তিটিকে ব্যথিত করে, এবং সেই ব্যথারও অস্তিত্ব থাকত না, যদি ওই উপাঙ্গের স্নায়ুর সঙ্গে মস্তিষ্কের কোন যোগ না থাকত । কিন্তু, হিয়ারফোর্ডশায়ারে কৃষক যদি হিমঝঞ্ঝায় আক্রান্ত হয়, তাহলে লন্ডনস্থিত সরকার কোনরূপ ঠাণ্ডাই অনুভব করবে না। সে কারণে, ব্যক্তি মানুষই ভাল ও মন্দের বাহক, একদিকে মানুষের কোন পৃথক অঙ্গও তা নয়, আবার অন্যদিকে মানুষের কোন সমষ্টিও তা নয়। যদি সমষ্টিগত মানুষের ভাল বা মন্দের সমতুল্য অর্থ, মোটের ওপর, বিভিন্ন ব্যক্তি মানুষের ভাল বা মন্দ-এটা বিশ্বাস করা একটা ভ্রান্তি; তাছাড়া এটা এরকম একটা ভ্রান্তি, যার থেকে জন্ম নিতে পারে চরমতন্ত্র, এবং সেকারণেই তা বিপজ্জনক।
এমন কিছু দার্শনিক ও প্রবক্তা রয়েছেন, যারা মনে করেন, নাগরিকদের কল্যাণের স্বার্থে নিছক মাধ্যম হিসাবে নয়, রাষ্ট্র তার নিজস্ব সত্তার জোরেই এক ধরনের পরমোঙ্কর্ষের অধিকারী হতে পারে। এই অভিমতের সঙ্গে একমত হওয়ার কোন কারণ আমি দেখতে পাই না। রাষ্ট্র’ হল এক বিমূর্ত সত্তা; সে আনন্দ বা যন্ত্রণা কিছুই অনুভব করে না, সে কোন আশাবাদ লালন করে না বা তার কোন ভয়ও নেই এবং আমরা তার উদ্দেশ্য বলে যেসব বিষয়কে মনে করি, তা আসলে রাষ্ট্র-পরিচালক ব্যক্তিবর্গেরই উদ্দেশ্য। আমরা যখন বিমূর্তভাবে নয়, চিন্তা করি, আমরা দেখি রাষ্ট্রে’-র জায়গায়, মুষ্টিমেয় নির্দিষ্ট ব্যক্তি অধিকাংশ মানুষের প্রাপ্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করে এবং এভাবে, “রাষ্ট্রে’-র মহিমায়ন বস্তুত একটি বিশেষ শাসক সংখ্যালঘুর অনুকূলে যশোদায়ক পরিণতিতে পর্যবসিত হয়। কোন গণতন্ত্রই এ ধরনের মৌলিকভাবে অসঙ্গত তত্ত্বকে মেনে নিতে পারে না।
এছাড়াও, আর একটি নীতিবাদী তত্ত্ব রয়েছে, যা আমার মতে অনুপযুক্ত; এটা হল সেরকমই যাকে অভিহিত করা যায়-জৈব তত্ত্ব’, যদিও আমি সুনিশ্চিত নই যে, জীবতাত্ত্বিকেরা এই তত্ত্ব সমর্থন করেন কিনা। বিবর্তন সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তার সূত্রেই এই অভিমতটি উঠে এসেছে। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সূত্র ধরে, ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর জৈব আঙ্গিকতায় রূপ নিয়ে মানুষের মধ্যে (এতদূর পর্যন্ত) ক্রিয়াশীল হয়েছে। এই মত অনুসারে-ঊর্ধ্বতন-বরং বলা উচিত, নিজ প্রজাতির অস্তিত্বরক্ষাই হল চরম লক্ষ্য। এই তত্ত্বকে যদি সঠিক বলে মেনে নিতে হয়, এই পৃথিবীর জনসংখ্যা যে কারণের সুবাদে বৃদ্ধি পায়, তাকে ‘ভাল বলে গণ্য করতে হবে, আর জনসংখ্যা হ্রাসকারক যে কোন কারণই হল মন্দ’।
এরকম এক যান্ত্রিক ও গাণিতিক দৃষ্টিভঙ্গির কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই না। সমগ্র পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চেয়ে মাত্র এক একর পরিসরে অবস্থানরত পিপীলিকার সংখ্যা বেশি-এরকম ক্ষেত্রে খুঁজে বার করা সহজ কিন্তু এরকম একটা দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে আমরা পিপীলিকার অধিকতর উৎকর্ষের স্বীকৃতি দিই না এবং মানবিক সত্তা কোনটা বেশি পছন্দ করবে-দারিদ্র্য ও জীর্ণতায় বসবাসরত এক সুবিশাল জনসংখ্যা, মাত্রাধিক স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুখে বসবাসকারী এক ক্ষুদ্রতর জনসংখ্যা?
অবশ্য এটা সত্য যে, যে কোন ক্ষেত্রে অস্তিত্বরক্ষা হল একটি প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু মূল্যবাহী বিষয়ের ক্ষেত্রেই এটি একটি শর্তমাত্র। কিন্তু তার নিজস্বখাতে কোন মূল্য না থাকতেও পারে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বারা সৃষ্ট পৃথিবীতে অস্তিত্বরক্ষা দাবি করে পর্যাপ্ত প্রশাসন। এই দুই বিপরীত প্রয়োজনীয়তার সমন্বয়সাধন আমাদের এই আলোচনাগুচ্ছে সমস্যা স্বরূপ।
এবং এখন, আমাদের সামগ্রিক আলোচনার সব সূত্রগুলো সংকলিত করে এবং আমাদের সময়ের সব বিপদকে মনে রেখে আমি কিছু নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ইচ্ছুক, এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আমি এই আশার বীজ লালন করতে চাই যে, আমাদের সন্তোষের জন্য রয়েছে যুক্তিবাদী ভিত্তি।
যারা সামাজিক আসঞ্জনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, এবং যারা ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রাথমিকভাবে মূল্য দেয়-এই দুই পক্ষের মধ্যে অব্যাহত রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন লড়াই-সেই প্রাচীন গ্রিসের আমল থেকে। এ ধরনের যে কোন চলমান বিতর্কে দুই পক্ষের অনুকূলে সত্যের অবস্থান সুনিশ্চিত; এসব ক্ষেত্রে কোন সুস্পষ্ট সমাধান থাকার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু বড়জোর যে কোন ব্যক্তিকেই বিভিন্ন ধরনের আপোষ ও সমঝোতার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়।
আমার দ্বিতীয় বক্তৃতায় দেখিয়েছি-সমগ্র ইতিহাস জুড়েই অব্যাহত ছিল বিভিন্ন পর্বের নৈরাজ্য ও বিভিন্ন পর্বভিত্তিক মাত্রাধিক সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পারস্পরিক টানাপড়েন। আমাদের সময়ে, বিশ্বভিত্তিক ক্ষেত্র ছাড়া (অদ্যাবধি), দেখা গেছে কর্তৃত্ববাদ-অভিমুখী অত্যধিক প্রবণতা, এবং উদ্যোগ সংরক্ষণের জন্য তুচ্ছ পরিমাণ যত্ন-প্রয়োগ। সুবিশাল সংস্থার নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই হয়ে থাকে অবাস্ত ব, তারা ভুলে যান, মানুষ নামক প্রজাতির অবয়ব ঠিক কি রকম এবং যন্ত্রকে মানুষের সঙ্গে অন্বিত করার পরিবর্তে মানুষকে যন্ত্রের সঙ্গে বিন্যস্ত করতে চান।
আমাদের সুসংগঠিত সমাজসমূহ স্ফুর্তিহীনতার যে উপসর্গে আক্রান্ত, তা সম্পর্কযুক্ত রয়েছে-দূরবর্তী কর্তৃত্বের দ্বারা সুবিশাল এলাকার ওপর অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি।
বিকেন্দ্রীকরণসূত্রে লভ্য সুবিধাবলির একটি হল-তা আশাবাদ ও আশার প্রতীকী ব্যক্তি-উদ্যোগের অনুকূলে নতুন সুযোগের সংস্থান করে। যদি আমাদের সামগ্রিক চিন্ত মিণ্ডল বিশাল সমস্যা ও বিশ্বজনীন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তাহলে হতাশার মেঘ নেমে আসা খুবই সহজ। যুদ্ধভীতি, বিপ্লবের আশঙ্কা, প্রতিক্রিয়ার ভয়-এসব আপনার মানসিকতা ও দলীয় আনুগত্যের সৌজন্যে প্রভাবিত হতে পারে। যদি আপনি শক্তিশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি অতিক্ষুদ্র গোষ্ঠীর একজন না হন, তাহলে আপনার তরফে এরকম অনুভূতিরও সম্ভাবনা রয়েছে যে, এসব বড়সড়ো বিষয়গুলো নিয়ে আপনি বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু, ছোটখাটো সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে-ধরা যাক, আপনার শহরের বা আপনার ট্রেড ইউনিয়নের অথবা আপনার রাজনৈতিক দলের সমস্যার ক্ষেত্রে আপনার কার্যকরী প্রভাব বিস্তার করার আশা করা যায়। এর ফলে, একটা আশাবাদী উদ্দীপনার উদ্ভব হতে পারে এবং এই উদ্দীপনা হল এমন একটা জিনিস, যার প্রয়োজন ঘটে কোন বৃহত্তর সমস্যার সফল মোকাবিলার তাগিদে একটা পথ খুঁজে বার করার জন্য। যুদ্ধ এবং আকাল ও আর্থিক দুরবস্থা প্রায় বিশ্বজনীন হতাশার জন্ম দিয়েছে এবং আশাবাদ নামক বিষয়টিকে অগভীর ও অবিশ্বস্ত করে তুলেছে। সাফল্য যদি তা গোড়ার দিকে ক্ষুদ্র পর্যায়েরও হয়-তাহলেও তা হতাশাজনিত উদ্বিগ্ন। মানসিকতার শ্রেষ্ঠ নিদান হতে পারে এবং অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই, সাফল্যের অর্থ হল আমাদের সমস্যাবলির বিভাজন, এবং তার মধ্যে যেগুলো দারুণভাবে বড়সড়ো নয়, সেই জাতীয় সমস্যার ওপর মনোযোগ অবাধে কেন্দ্রীভূত করা ।
পৃথিবী হয়ে দাঁড়িয়েছে গোঁড়া রাজনৈতিক ধর্মবিশ্বাসীদের শিকার, যার মধ্যে, আমাদের আমলে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ। আমি বিশ্বাস করি না–কোন গোঁড়া অথবা চরম আঙ্গিকের মধ্যে আছে প্রতিরোধযোগ্য রোগের দাওয়াই । ধনতন্ত্র মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষকে দিতে পারে উদ্যোগের সুযোগ; সাম্যবাদ দিতে পারে (প্রকৃতপক্ষে যদিও তা করে না) সকলের জন্য এক ধরনের ক্রীতদাসসুলভ নিরাপত্তা। কিন্তু জনসাধারণ যদি নিরর্থক সরল তত্ত্বকথা ও স্বসৃষ্ট বিবাদ-বিতর্কের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে, তাহলে বিজ্ঞানসম্মত কলাকৌশলের বিচক্ষণ প্রয়োগের মাধ্যমে সকলের জন্য সুযোগ ও নিরাপত্তা এ দুইয়েরই ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল-আমাদের রাজনৈতিক তত্ত্বগুলো আমাদের বিজ্ঞানের চেয়ে তুলনামূলক কম বোধশক্তিধর, এবং আমরা অদ্যাবধি শিখতে পারিনি-জীবনকে সুখী করা, এমনকী গৌরবময় করে তুলতে পারে, সেরকম পদ্ধতিতে কিভাবে আমাদের জ্ঞান ও আমাদের দক্ষতাকে ব্যবহার করা যায়। মানবজাতির প্রতি উৎপীড়ন-প্রবণ শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধভীতি থেকেই যে এরকমটা হচ্ছে, তা নয়-যদিও সম্ভবত এটাই হল আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অশুভ দিক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, সেরকম সুবিশাল নৈর্ব্যক্তিক শক্তিসমূহেরও নিপীড়নের শিকার আমরা, যা আমাদের এখনও পরিস্থিতির ক্রীতদাসে পরিণত করে, যদিও-ক্রীতদাসপ্রথার বৈধতা এখন আর নেই। এরকম প্রবণতার প্রয়োজন নেই। মেকি দেবতাদের পূজা-ভজনার ফলেই এরকম ঘটেছে। উদ্যোগী মানুষেরা সহজ সুখ ও বন্ধুতার তুলনায় অধিকতর পূজা করেছে শক্তিকে; হীনোদম মানুষেরা হয় মৌন সম্মতিদান করেছে অথবা দুঃখের উৎস সম্পর্কে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকে ।
যেদিন থেকে মানবজাতি ক্রীতদাসপ্রথা আবিষ্কার করেছে, সেই সময় থেকেই ক্ষমতাবানেরা এরকম বিশ্বাস করতো যে, অন্যের ওপর দুঃখকষ্ট আরোপের মাধ্যমেই অজির্ত হতে পারে তাদের সুখ। কালক্রমে, গণতন্ত্রের অগ্রগতি এবং রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে খ্রিস্ট-নীতিবাদের সম্পূর্ণ আধুনিক প্রয়োগবিধির সঙ্গে সঙ্গে, ক্রীতদাস প্রথার চেয়ে একটা অধিকতর ভাল আদর্শের সূত্রপাত ঘটেছে, এবং পূর্বে কখনই যা হয়নি-এখন থেকে ন্যায়বিচারের দাবিরও স্বীকৃতি মিলছে। কিন্তু, বিস্তৃত ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়ের অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা এই বিস্মৃতিকর আশঙ্কার মুখোমুখি হয়েছি যে, শুধুই ন্যায়বিচার যথেষ্ট নয়। দৈনন্দিন আনন্দ-বিনোদন, সাবধানতা থেকে মুক্তির অবকাশ, রোমাঞ্চ এবং সৃজনশীল কাজের সুযোগ-অন্তত এসব বিষয়ও ন্যায়বিচারের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং এসবের ফলে জীবনের এমন রূপান্তর ঘটে, যাতে মানুষ বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায়। আনন্দ ও যন্ত্রণার বিকল্পতার চেয়ে একঘেঁয়েমি আরও মারাত্মক হতে পারে । যেসব মানুষ প্রশাসনিক সংস্কার ও সামাজিক উন্নয়ন-প্রকল্পের বিষয়াদি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন, তাঁরা মূলত সেসব উদ্যেগী মানুষ যারা আর যুবক নয়। প্রায়শই তারা ভুলে যান-অধিকাংশ মানুষের কাছে সেই শুধুই স্বতঃস্ফূর্ততা নয়, সুখের জন্য কোন না কোন ধরনের ব্যক্তিগত গৌরবেরও প্রয়োজন । একজন বিখ্যাত বিজেতার অহংকার এমন হতে পারে না, যা কোন সুনিয়ন্ত্রিত পৃথিবী অনুমোদন করবে। কিন্তু একজন শিল্পীর, কোন আবিষ্কারকের, বন্যতার রূপান্তর ঘটিয়েছেন বাগানে এমন কোন মানুষের অথবা তার জন্য সংরক্ষিত দুঃখের বলয় থেকে সুখের আগমন-এরকম গৌরববোধ অবশ্যই ভাল এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যকের জন্য নয়, বরং অনেকের জন্যই আমাদের সমাজের এরকম ব্যবস্থা করা উচিত।
বহুকাল পূর্বে, যে প্রবৃত্তি আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের শিকার ও লড়াইয়ের মনোভাবকে উৎসাহিত করতো-তার একটা নির্গম পথের প্রয়োজন রয়েছে; তারা যদি এরকম কিছু খুঁজে না পায়, তাহলে তারা ঘৃণা ও চরম বিদ্বেষের দিকেই ঝুঁকবে। কিন্তু এসব প্রবৃত্তির জন্য এমন কিছু নির্গম পথ রয়েছে, যেগুলো মন্দ নয়। যুদ্ধের জন্য সমকক্ষতা ও সক্রিয় খেলাধুলা বিকল্প হতে পারে; শিকারের বিকল্পে রোমাঞ্চ ও আবিষ্কার ও সৃজন। অবশ্যই আমরা এসব প্রবৃত্তিকে উপেক্ষা করব না, এবং এগুলোর জন্য অনুতাপ করারও প্রয়োজন নেই; এগুলো হল উৎস-যা খারাপ, শুধু তারই নয়, বরং মানবিক কৃতিত্ব বলয়ে যা শ্রেষ্ঠ, তারও। যখন একবার নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে, তখন মানবকল্যাণ-আকাক্ষী ব্যক্তিদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে-নিছক নিয়ন্ত্রক ধ্বংসবিরোধী বা নির্গম পথ হিসেবেই নয়, বরং মানবিক জীবনের আনন্দ ও গৌরব উত্তর্ষের চমক জাগানো সর্বাধিক সংখ্যক নির্গম পথের অনুসন্ধান করা।
মানবসভ্যতার অগ্রগতির সুদীর্ঘ কাল ধরে মানুষ দুই ধরনের দুর্দশার শিকার হয়ে এসেছে : প্রথমত বাইরের প্রকৃতির আরোপিত যন্ত্রণা এবং দ্বিতীয়ত বিভ্রান্ত মানুষদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আরোপিত দুর্দশা। শুরুতে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোর উৎস ছিল পরিবেশ। মানুষ ছিল এক বিরল প্রজাতি, যার ঊর্ধ্বতনের বিয়ষটি ছিল দৈবাধীন। বানরের তৎপরতা ও লোমশ পশুচর্ম ছাড়া তার পক্ষে বন্য পশুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন ছিল, এবং পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলেই শীতের ঠাণ্ডাও সে সহ্য করতে পারত না। তার মাত্র দুটি জৈব সুবিধা ছিলঃ তার ঋজু ভঙ্গি হাত দুটিকে মুক্ত করেছিল এবং মেধা তাকে অভিজ্ঞতা সঞ্চালনে সমর্থ করেছিল। কালক্রমে এই দুটি সুবিধার সুবাদে সে অর্জন করেছিল শ্রেষ্ঠত্ব। মানবপ্রজাতির সংখ্যা অতিক্রম করেছিল অন্য যে কোন স্তন্যপায়ী জম্ভর সংখ্যাকে । কিন্তু বন্যা এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারির মাধ্যমে, বিপুলসংখ্যক মানবজাতির অবিরাম শ্রমের বিনিময়ে প্রাত্যহিক রুজি আদায়ের মাধ্যমে প্রকৃতি তখনও তার ক্ষমতা জাহির করতে সক্ষম ছিল।
আমাদের আমলে বিজ্ঞান-মেধার অগ্রগতির ফলে বাইরের প্রকৃতির কাছে আমাদের দাসত্ব অতিদ্রুত হ্রাসমান। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির ঘটনা এখনও ঘটে, কিন্তু আমরা বছরের পর বছর ধরে জানি, এসবের প্রতিরোধে কি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কঠোর শ্রম এখনও জরুরি, কিন্তু তা আমাদের অজ্ঞতার কারণে; শান্তি ও সহযোগিতা সাপেক্ষে আমরা খুব মামুলি ধরনের শ্রমের ওপর নির্ভর করতে পারি। বর্তমান প্রয়োগকৌশলকে নিয়েই, আমরা যদি প্রজ্ঞার অনুশীলনকে বেছে নিই, তাহলে আমরা বাইরের প্রকৃতির প্রভাবিত দাসত্ববন্ধনের অনেক প্রাচীন ধরন-ধারণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি ।
কিন্তু মানুষের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক লিপ্ত বদ অনুষঙ্গগুলোর সমপরিমাণে হ্রাস ঘটেনি। এখনও যুদ্ধ, নিপীড়ন এবং বীভৎস নিষ্ঠুরতার অস্তিত্ব রয়েছে এবং এখনও লোভী মানুষরা তাদের তুলনায় কম দক্ষ কম নিষ্ঠুর মানুষদের সম্পদ লুণ্ঠন করে। এখনও ক্ষমতালিপ্সা থেকে জন্ম নেয় বিকট স্বৈরতন্ত্র, অথবা নিছক অবরোধ, যখন তার বড় ধরনের প্রকরণের কোন সম্ভাবনা থাকে না এবং ভীতি-গভীর, কদাচিৎ যা সচেতন ভয়-তা এখনও অনেক মানুষের জীবনেই প্রভাববিস্তারী প্রবণতা।
এসব নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়; মানুষের প্রকৃতিতে এমন কিছু নেই যা এই সবমন্দ উপসর্গগুলোকে অনিবার্য করে তোলে। আমি সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের গুরুত্ব দিয়ে আবার বলতে চাই যে, আমি তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি, যারা আমাদের লড়াকু প্রবৃত্তি দেখে এই মন্তব্য করে থাকেন-মানুষের প্রকৃতি যুদ্ধ ও সংঘর্ষের অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম দাবি করে। আমি দৃঢ়ভাবে এর বিপরীত অভিমতে বিশ্বাস রাখি। আমি মনে করি, সংগ্রামী প্রবৃত্তিসমূহেরও এক অতিপ্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে এবং এগুলোর ক্ষতিকর প্রবণতাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা যেতে পারে।
যখন চরম দুরবস্থার ভয় থাকে না, তখন অধিকারলিপ্সা তুলনামূলক কম তীব্র হয়ে থাকে। অপরের কোন ক্ষতি না করে ও ক্ষমতার প্রতি ভালবাসার বিষয়টি চরিতার্থ করা যায়ঃ আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সূত্রে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে, প্রশংসাযোগ্য পুস্তক বা শিল্পকলা উৎপাদনের মাধ্যমে এবং সফল প্রত্যয় উৎপাদনের মাধ্যমে। কার্যকরী হওয়ার অনুকূলে উৎসাহ ও ইচ্ছা খুবই উপকারী যদি সেগুলো সঠিক নির্গম-পথ খুঁজে বার করতে সক্ষম হয়, এবং তখনই ক্ষতিকর-যেমন বাষ্প, যা রেলগাড়িকে চালনাও করতে পারে অথবা বয়লারে বিস্ফোরণও ঘটাতে পারে।
বহিপ্রকৃতি থেকে আমাদের মুক্তি এতকালের প্রাপ্ত মানবিক মাঙ্গলিকতার তুলনায় অধিকতর মঙ্গল সম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে যদি উপলব্ধি করতে হয়, তাহলে সর্বপথে উদ্যোগের স্বাধীনতা থাকতেই হবে, যা সুনিশ্চিতভাবে ইতিবাচক নয় এবং মানবজীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সেই ধরনের উদ্যোগের প্রতি উৎসাহদান বাঞ্ছনীয়। মানুষকে নিস্তেজ ও ভীরু করে রাখার চেষ্টা দিয়ে আমরা কোন সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে পারব না, নিজের পরিজনদের ওপর আঘাত না চাপিয়ে, মানুষকে সাহসী ও রোমাঞ্চপ্রিয় ও ভয়হীন করে তোলার মাধ্যমে তা গড়ে তুলতে হবে। যে পৃথিবীতে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই, সেখানে মঙ্গল-সম্ভাবনা প্রায় অসীম এবং অমঙ্গলের সম্ভাবনা ঠিক ততটা নয়। আমাদের বর্তমান পীড়াদায়ক অবস্থার পিছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল-আমরা আমাদের সীমানার বাইরের প্রকৃতির শক্তিকে বুঝতে ও একটা দারুণ পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি, কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা শিখিনি। আত্মনিয়ন্ত্রণ সর্বদাই নীতিবাদীদের একটি সতর্কবাণী, কিন্তু অতীতে এটা ছিল এক ধরনের উপলব্ধিহীন নিয়ন্ত্রণ । এই বক্তৃতাগুচ্ছে, অধিকাংশ রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিকতার চেয়ে মানবিক প্রয়োজনের বিস্তৃততর উপলব্ধি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি, কারণ শুধুমাত্র এরকম উপলব্ধির মাধ্যমেই আমরা সেসব আশাবাদের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারি, যদি আজও সেগুলো আমাদের দোষেই ব্যাপকভাবে হতাশার শিকার এবং আমাদের দক্ষতা যে আশাবাদকে আমাদের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে।